৩.৪ কোদারি গ্রামের কাছাকাছি

অধ্যায় ৩১

দুপুরের পরপর কোদারি গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে গেল ওরা। পথে এক সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ করেনি রাশেদ। এতো চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এর আগে শুধু পোস্টার আর ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলেই চোখে পড়েছে। রাজুর জন্য একটু মায়া হলো, সেই কাঠমুন্ডু পার হওয়ার পর থেকেই ঘুমাচ্ছে, শুধু ঘুমাচ্ছে বলা ঠিক হবে না, রীতিমতো নাক ডাকছে।

কোদারি গ্রাম বেশ ব্যস্ত এলাকা, তিব্বতের সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখানে ব্যবসায়ীসহ নানা-দেশের লোকের আগমন ঘটে বেশি। ড্রাইভার এই এলাকা ভালো। চেনে, প্রায়ই এখানে আসে যাত্রী নিয়ে। কোদারি গ্রামের সব কিছু তার নখদর্পনে। এখানে অন্তত একরাত থেকে সকালে সীমান্ত পার হওয়ার প্ল্যান রাশেদের। রাজু ঘুম থেকে উঠেছে একটু আগে। এখানে কোন হোটেল নেই, থাকার ব্যবস্থা কী জিজ্ঞেস করতেই মাথা নাড়িয়ে ইশারা করলো ড্রাইভার, যার মানে দাঁড়ায়, কুছ পরোয়া নেহি।

লাগেজ নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামল রাশেদ, রাজু এখনো চোখ কচলাচ্ছে, তার ঘুম পুরোপুরি কাটেনি। ট্যাক্সিটা খালি একটা জায়গায় রেখে সামনে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ড্রাইভার। এতোটা সময় একটা কথাও বলেনি ছেলেটা। বয়স তাদের সমানই হবে, ভাবল রাশেদ। কিন্তু এতো চুপচাপ মানুষ হয় কি করে?

বিনা দ্বিধায় ছেলেটার পেছন পেছন হেঁটে চমৎকার একটা বাড়ির সামনে হাজির হলো ওরা। এই ধরনের গ্রামে এমন বাড়ি বেমানান। ইট-পাথরে তৈরি দোতলা বাড়িটা সাধারনত বড় শহরগুলোর দামী এলাকায় দেখা যায়। বিশাল জায়গা নিয়ে সাদা বাড়িটা, চারদিক পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেটে একজন দাড়োয়ান বসে ঝিমুচ্ছিল।

ড্রাইভার ছেলেটা দাড়োয়ানের গায়ে হাল্কা টোকা দিতে ধড়ফড় করে উঠে পড়ল বেচারা, কাঁচা ঘুম থেকে উঠেছে, তাই সামনে অচেনা কয়েকজনকে দেখে ভড়কে গেছে দাড়োয়ান।

ড্রাইভার ছেলেটাকে চিনতে পেরে মুখে হাসি ফুটল দাড়োয়ানের। সাংকেতিক ভাষায় কিছু তথ্য আদান-প্রদান হলো দুজনের মাঝে। কিছুক্ষনের মধ্যে ছোট গেট দিয়ে বাড়িটায় প্রবেশ করল রাশেদ আর রাজু। ড্রাইভার ছেলেটাও আসছে পেছন পেছন।

ঘটনা কী রাজু? এই ছেলেটাকে বিশ্বাস করা যায়? প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রাশেদ, রাজু তার পাশাপাশি হাঁটছে।

বাড়িটার সামনে বেশ চমৎকার একটা বাগান, সেখানে চমৎকার সব ফুল ফুটে আছে। বাগানের বুক চিরে সরু রাস্তাটা মিশেছে বাড়ির সিঁড়ির সাথে, সিঁড়ি পাড় হয়ে কাঠের তৈরি বড় একটা দরজা চোখে পড়ল রাশেদের।

হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা অন্যমনস্ক ছিল রাজু।

ঘটনা কিছু না, এই বাড়ির দাড়োয়ানকে ম্যানেজ করে এখানে প্রায়ই টুরিস্ট নিয়ে আসে চরনদাস।

ছেলেটার নাম চরনদাস? কিভাবে জানলি?

ওর বুকে লাগানো ব্যাজটা লক্ষ্য করলেই বুঝতি। আরেকটা কথা, আমার মনে হয় তুই ধরতে পারিসনি ব্যাপারটা?

কি সেটা?

চরনদাস বোবা, বলল রাজু, চরনদাসের দিকে তাকাল। বেশ তৎপর একটা ছেলে, এর উপর ভরসা রাখা যায়। যে ধরনের ঝুঁকি নিয়ে সেই কাঠমুন্ডু থেকে কোদারি গ্রামে নিয়ে এসেছে তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। ড্রাইভিং হুইল নিয়ে রীতিমতো যাদু দেখিয়েছে। এই ছেলেটা এতো ভালো না চালালে হয়তো এততক্ষনে আকরব আলী মৃধার হাতে ধরা পড়তে হতো। লোকটার মতলব যে মোটেই ভালো না তা বলাবাহুল্য।

দাড়োয়ানের কাছ থেকে চাবি নিয়েছিল চরনদাস, দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে ইশারায় রাশেদ আর রাজুকে ডাকল। ভেতরে ঢুকে অবাক হলো রাশেদ, গ্রাম এলাকায় এমন চমৎকার বাড়ি থাকার কথা কল্পনাও করা যায় না, একতলায় নীচের অংশটা ড্রইং রুমের মতো, এক পাশ দিয়ে বাঁকানো সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলার দিকে। উপরে সিলিং এ চমৎকার ঝাড়বাতি ঝুলছে। তবে আলোর সরবরাহ কম, প্রায় সব জানালাই বন্ধ, এটাই হয়তো কারন। লোকজন এখানে তেমন কেউ আসে না তা ছড়ানো ছিটানো আসবাবপত্রের উপর ধুলোর আস্তরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চরনদাসের দেখাদেখি দোতলায় উঠে গেল রাশেদ, রাজু আছে পেছনে। সে বারবার এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে।

 চরনদাস আমাদের এখানে নিয়ে এলো কেন? ফিসফিস করে বলল রাশেদ।

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কোদারি গ্রামে থাকার ব্যবস্থা কী, চরনদাস আশ্বস্ত করেছিল থাকার ব্যবস্থা করে দেবে, রাজু বলল।

এই কথাগুলো কখন হলো তোদের মধ্যে! অবাক হয়ে বলল রাশেদ, এছাড়া চরনদাস তো কথাই বলতে জানে না।

বোবাদের সাথে কথা বলার জন্য সাইন ল্যাংগুয়েজ জানা আছে আমার, হেসে বলল রাজু, সেই কাঠমুন্ডুতে ভাড়া করার সময়ই ওর সাথে আমার এসব আলোচনা হয়েছে, এর জন্য ওকে কিছু বেশি টাকা দিতে হবে আমাদের।

অবাক হলো রাশেদ, দূর থেকে তখন রাজুর হাতের নাড়াচাড়া দেখেছিল মনে পড়ে, সেটা যে বোবাদের সাইনিং ল্যাংগুয়েজ তা মাথায় আসেনি।

দোতলাও অন্ধকার। পাশাপাশি কয়েকটা রুম চোখে পড়ল, সব তালাবন্ধ। একেবারে ডান দিকের একটা কামরার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে চরনদাস। এই রুমটাই আজকের দিনের জন্য তাদের আবাসস্থল হতে যাচ্ছে বুঝতে পারল রাশেদ।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল চরনদাস, একটু পর তার পেছন পেছন ঢুকল রাশেদ আর রাজু।

রুমটা দেখে দুজনেই মোটামুটি অভিভূত। রীতিমতো ফাইভ স্টার হোটেলের রুম হলেও তার সমকক্ষ বলা যাবে রুমটাকে। ঝকঝকে তকতকে করে সাজানো সব আসবাবপত্র, টিভি, এয়ারকুলার, একপাশে ফ্রিজার, সুন্দর-চেয়ার টেবিল। সবচেয়ে পছন্দ হলো পরিপাটি দুটো বিছানা, পাশাপাশি বিছানো, সাদা চাদর পাতা, বালিশগুলো দেখেই মনে হলো নরম-তুলতুলে।

এতো রাজকীয় ব্যবস্থা! কোনমতে বলল রাশেদ, চাপা স্বরে।

থাকলাম না হয় একদিন রাজার হালে, কিন্তু… রাজু বলল, চরনদাসের দিকে তাকিয়ে পেটের দিকে হাত ইশারা করল, এখন পেট ঠান্ডা করার ব্যবস্থা করতে হবে, কি বলিস?

ব্যাগ দুটো একপাশে রেখে বিছানায় বসল রাশেদ, গত রাত থেকে ঠিকমতো ঘুম হয়নি,আজ ঘুমাতে হবে ভালো করে। জানালাগুলো বন্ধ ছিল, উঠে দিয়ে খুলে দিলো রাশেদ, বাইরের সুর্যের আলো এসে পড়ল রুমে। রোদে ঝাঁঝ নেই, বিকেল হয়ে এসেছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকাল, একটু পর সন্ধ্যা নামবে এই এলাকায়। খাবার দাবারের ব্যবস্থা করাটাই আপাতত জরুরী কাজ।

চরনদাসের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দিল রাজু। পাশের বিছানায় বসল। তাকে বেশ উৎফুল্ল মনে হচ্ছে।

এই এলাকাটা একটু ঘুরে দেখা দরকার, রাজু বলল, কোন কু পাওয়া যেতে পারে ড. আরেফিনের, কি বলিস?

আমার মন বলছে ড. আরেফিন এই এলাকায় নেই, তাকে তিব্বতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, রাশেদ বলল। বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছে, ঘুমে চোখ লেগে আসছে তার।

এই ধারনার কারন কী?

তেমন কোন কারন নেই। উনার গন্তব্য ছিল তিব্বত, তাই মনে হলো, হাই তুলল রাশেদ, তবু কাল এই লোকালয়টা একবার ঘুরে দেখা দরকার, তিনি যেহেতু দলবল নিয়ে এসেছিলেন, কোথাও না কোথাও খবর পাওয়া যাবে।

হমম…কথা শেষ করতে পারল না রাজু।

খাবার এলে আমাকে ডাকিস, বালিশে মাথা ঠেকাল রাশেদ, ঘুমাবো এখন।

রাশেদের দিকে তাকাল রাজু। বোঝাই যাচ্ছে এখন যাই বলুক না কেন, মাথায় ঢুকবে না রাশেদের। ক্লান্ত রাশেদ চোখ বোজা মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছে।

*

অধ্যায় ৩২

বার্লিন পতন সমাগত। চারদিক ঘিরে রেখেছে সোভিয়েত বাহিনী। এখানে সেখানে এখনো প্রতিরোধ চালানোর চেষ্টা করছে হিটলারের নাৎসি বাহিনী। কিন্তু তারাও যেন বুঝতে পারছে আর বেশিক্ষন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। যে কোন সময় তাদের বুকের উপর সোভিয়েত বুটের ছাপ পড়তে যাচ্ছে।

পথে ঘাটে লোকজন নেই তেমন একটা। বেশিরভাগ লোক আগেই পালিয়েছে শহর ছেড়ে। সন্ধ্যার পর ভূতুড়ে শহর মনে হয়। ব্ল্যাক আউটে সাহসী কয়েকজন বেরিয়ে এসে দৈনন্দিন খাবার-দাবার যোগাড়ের চেষ্টা করে, মনে মনে হিটলারকে শাপ শাপান্ত করে এমন লোকেরও অভাব নেই। আবার অনেকে আছে যারা ভাবছে এটা সাময়িক। সম্মিলত বাহিনীকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবেন হিটলার, শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছেন।

এখনো যারা এমনটা ভাবে তাদের মধ্যে মাথিল্ডা হোসেনহফ নেই। ছোট একটা ফ্ল্যাটে ছোট রেনল্ডকে নিয়ে অপেক্ষায় দিন যায় তার। কার্ল নিখোঁজ গত কয়েকবছর ধরে। রেনল্ডের জন্মের আগে শেষ দেখা হয়েছিল কার্লের সাথে, বলেছিল খুব শিগগিরি ফিরবে, তিব্বতে যাচ্ছে, বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে। কার্ল ফিরে আসেনি,ফিরে আসবে বলে মনেও হয় না। নাৎসি বাহিনী থেকে পাওয়া কিছু ভাতায় দিন-যাপন হলেও তাকে বেঁচে থাকা বলে না। একটা লন্ড্রিতে কাজ করে যা সামান্য রোজগার হতো গত কিছুদিন ব্যপক সোভিয়েত গোলাবর্ষনে সেটাও বন্ধ। সন্ধ্যার মিইয়ে যাওয়া আলোতে আশার কোন চিহ্ন চোখে পড়ে না মাথিল্ডার। রেনল্ডের জন্য বুক ফেটে যায় তার, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরে পড়ে। সে না থাকলে কিভাবে বাঁচবে রেনল্ড, কে ওর দেখাশোনা করবে? আত্মীয়-স্বজন তেমন কেউ নেই তার, আর এই দূর্দিনে আরেকটা মুখে খাবার জোগাড়ের দায়িত্ব কেউ নেবে না। দম আটকে আসে মাথিল্ডার, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

সন্ধ্যার পরপর রেশনের দোকানে যে লাইন পড়ে সবসময় তার পেছনে স্থান হয়। মাথিল্ডার। ধাক্কা-ধাক্কি, মারামারির পর যেটুকু জোটে তাতে ক্ষুধা মেটে না, রেনল্ডকে খাইয়ে তাই প্রায়ই অভুক্ত থাকতে হয় মাথিল্ডাকে। শুকিয়ে কংকালসার হয়ে গেছে সে, আয়নায় নিজেকে দেখতে ইচ্ছে করে না। সোনালী চুল তাম্রবর্ন ধারন করেছে, নীল চোখ হয়েছে ধূসর। খুব বেশি দিন বাঁচার সম্ভাবনা নেই মনে হয়, প্রায়ই কাশির সাথে রক্ত যায়।

আজ বেরুনোর সময় ছোট রেনল্ডকে সাথে নিলো মাথিল্ডা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বেশ অনেকক্ষন হলো, বাইরে স্ট্রিটল্যাম্পগুলো জ্বলছে, কিন্তু মানুষজন নেই খুব একটা। আজ রেশন বন্ধ। একটু দূরে কার্লের এক বন্ধু থাকে, ওর কাছে কিছু টাকা যদি পাওয়া যায় তাহলে অন্তত রাতটা না খেয়ে কাটাতে হতো না। অন্যসময় রেনল্ডকে একা রেখেই বের হয় মাথিল্ডা, কিন্তু আজ মন টানছিল না। ছেলেটা বাসায় একা একা থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে। শিশুসুলভ কোন আচরন ওর মধ্যে দেখতে পায় না মাথিল্ডা। এই বয়সেই যেন জীবনের ক্রুর চেহারা দেখে ফেলেছে, আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে সবকিছুতে।

তুমি কি চকলেট খাবে, রেনল্ড? ছেলেকে প্রশ্ন করে মাথিল্ডা।

চকলেটের কথা শুনে চোখ দুটো ক্ষনিকের জন্য উজ্জ্বল হয়, তারপর আবার নিজের বিষণ্ণতায় ফিরে যায় ছোট্ট রেনল্ড।

রাতের আকাশ ছিঁড়ে বিদ্যুৎ চমকের মতো গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসে। মে মাসের শেষের দিনগুলোতে আক্রমনের মাত্রা যেন বহুগুনে বেড়ে গেছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে ফুটপাত ধরে দৌড়াতে থাকে মাথিল্ডা। অসুস্থ শরীর হওয়াতে ছোট্ট রেনল্ডের ওজন বহন করতেও তার কষ্ট হয়। কিন্তুযে ধরনের গোলাগুলি শুরু হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে মিত্র বাহিনীর অবস্থান খুব কাছেই।

আরো দুই ব্লক পর কার্লের বন্ধুর বাসা। লোকটা ভালো, মিশুক। কোন ধরনের ঝামেলায় যায়নি কোনদিন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বাসা থেকে বের হওয়া প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে। আর এখন বার্লিন যখন পতনের সম্মুখীন এই লোককে বাসায় না পাওয়ার কোন কারনই নেই। কার্ল প্রায়ই বলতো ভীতুর ডিম তার বন্ধু বরিস। এখন মনে হয় ভীতুর ডিম হওয়াই ভালো, তাতে অন্তত প্রানটা বাঁচে।

হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মাথিল্ডা। আরো একটা ব্লক পার হয়েই বুঝলো ভুল হয়ে গেছে। শহরের এই প্রান্ত মিত্র বাহিনী মোটামুটি দখল করে নিয়েছে। ঠিকঠাক রেডিও শুনলে এই ভুল হয়তো হতো না। কিন্তু ভুল তো ভুলই। তার মাশুল দিতে হলো প্রায় সাথে সাথেই।

বুলেট বিদ্ধ হলে কেমন লাগে সেই ধারনা ছিল না মাথিল্ডার। তাই কিছুক্ষন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর অবাক হয়ে তাকাল লাল হয়ে যাওয়া বুকের দিকে। হাত দিয়ে দেখল, হ্যাঁ, রক্তই। ভিজিয়ে দিচ্ছে পুরো শরীর। বা হাতে রেনল্ডকে ধরা ছিল। ছেলেটা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। বোঝার চেষ্টা করছে কী হয়েছে। মাথিল্ডা বসে পড়ল। ছেলের হাত ধরে কাছে টানার চেষ্টা করল, পারল না। তার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। এটাই কি মৃত্যু?

মাকে টেনে তোলার আপ্রান চেষ্টা করল রেনল্ড। পারলো না। চিৎকার করার চেষ্টা করল, কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হলো না। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, কিন্তু কাঁদছে না সে। মাথিল্ডার চোখ বন্ধ হয়ে গেল, প্রানহীন দেহটা পড়ে রইল পথের ধারে।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রেনল্ড। গোলাগুলির শব্দ আরো বাড়ছে। স্ট্রিটল্যাম্পগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক। গভীর অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। কাঁপছে রেনল্ড। অন্ধকারের মধ্যেই দেখল একদল লোক এগিয়ে আসছে, হাতে অস্ত্র, পেছনে ট্যাঙ্কের সারি।

স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছে রেনল্ড। মায়ের দিকে তাকাচ্ছে, তার মনে হচ্ছে যে কোন সময় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়বে মাথিন্ডা। তাকে কোলে নিয়ে গিয়ে চকলেট কিনে দেবে।

তোমার নাম কি বাছা? ভাঙা ভাঙা জার্মানে একজন লোক বলল, লোকটা তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসেছে। চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। হাতের অস্ত্রটা পেছন দিকে সরিয়ে রেখেছে যাতে তার চোখে না পড়ে।

উত্তর দিলো না রেনল্ড। এমনিতেই কথা বলতে ভালো লাগে না তার। তার উপর চারপাশে অসহ্য শব্দ।

তুমি আমার সাথে যাবে?

এবারো নিশ্চুপ রেনল্ড। হাত দিয়ে দূরে নিজের বাসা দেখাল।

ঐখানে তোমার বাবা আছেন?

না-সূচক মাথা নাড়ল রেনল্ড, বাবাকে সে কখনো দেখেনি। তবে ছবিতে দেখা বাবার সাথে এই লোকটার চেহারার বেশ মিল আছে।

তুমি আমার সাথে যাবে?

হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল রেনল্ড। লোকটা কোলে তুলে নিলো রেনল্ডকে।

আশপাশের বাকি সৈনিকেরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল। সিনিয়র একজন এগিয়ে এলো।

এটা যুদ্ধক্ষেত্র নিকোলাস, দয়া দেখানোর জায়গা না, বেশ কর্কশ সুরে বলল লোকটা।

কোল থেকে রেনল্ডকে নামালো না নিকোলাস।

আমি ওকে একটু নিরাপদ দূরত্বে রেখে আসবো শুধু, নিকোলাস বলল, ওর মা আমাদের গুলিতেই মারা গেছে মাত্র।

এমন অনেক মাতৃহারা শিশু রাশিয়ার পথে পথে ঘুরছে, সিনিয়র বললেন। ঐ ঝোঁপের পেছনে লুকিয়ে আসো। আমরা ফিরে আসা পর্যন্ত যদি বেঁচে থাকে, তাহলে ও তোমার।

রেনল্ডকে কোলে নিয়ে ছুটল নিকোলাস। যুদ্ধ এখনো থামেনি। গোলাগুলি চলছে চরমমাত্রায়। বড় একটা ঝোঁপের আড়ালে রেনল্ডকে দাঁড় করালো নিকোলাস।

লক্ষী ছেলের মতো এখানে থাকবে, এক পা নড়বে না, কথা দাও  রেনল্ডের দুই হাত ধরে বলল নিকোলাস, আমি তোমার জন্য অনেক চকলেট নিয়ে আসবো।

তার জার্মান উচ্চারন ভাঙা ভাঙা হলেও বুঝতে অসুবিধা হয়নি রেনল্ডের। সে অপেক্ষা করেছিল সেখানে চুপচাপ। টানা আঠারোঘন্টা।

কতোদিন আগের কথা, অথচ ঐ বয়সের এই কয়েকটা দিন স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারেনি সময়। নিকোলাস এসেছিল, পরদিন দুপুরে, অবাক হয়ে দেখেছিল ছোট্ট ছেলেটা ঠিক অপেক্ষা করছে তার জন্য। হাত ভরা চকলেট ছিল নিকোলাসের, রেনকে বুকে টেনে নিয়েছিল।

জার্মানী ছেড়ে তার প্রাথমিক আশ্রয় হয়েছিল মস্কোতে। সেখানে কিছুদিন থেকে রেনল্ডকে সাথে নিয়ে নিকোলাস পাড়ি জমায় লন্ডনে। বিয়ে করে মেরি কারসন নামে এক আইরিশ মহিলাকে। রেনন্ডের নাম তখন বদলে রাখা হয় নিকোলাস কারসন। নিকোলাস কারসন নামে পরিচিত হয়ে উঠলে রেনল্ড। সেই নাম এক সময় বিখ্যাত হলো পৃথিবীময়, প্রত্নতত্ত্বে তিনি অর্জন করলেন ডক্টরেট ডিগ্রি, তাকে গুরু মানে পৃথিবীর অনেকেই। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। ঘুরে বেড়ান দেশ থেকে দেশে। তার আসল জার্মান পরিচয় রয়ে গেল সকলের অগোচরে। বড় হয়ে একসময় নিজের আসল পরিচয় খুঁজে বের করলেন তিনি। বাবাকে দেখেননি,মাকেও মনে পড়ে না, শুধু ঝাপসা একটা চেহারা চোখে ভাসে। যেদিন জানতে পেরেছেন আসল পরিচয় সেদিন থেকেই মনে প্রানে তিনি একজন জার্মান। তার জন্মদাতা পিতা যে কাজ অসমাপ্ত রেখে গিয়েছিল এই শেষ বয়সে এসে অন্তত তা সম্পন্ন করার একটা চেষ্টা করতে চান। সেই লক্ষ্যের অনেক কাছাকাছি এসে গেছেন বলা যায়। কিন্তু লক্ষ্যে না পৌঁছান পর্যন্ত কোনভাবেই স্থির হতে পারছেন না তিনি। আজও অস্থির লাগছিল। এছাড়া বিগত কয়েক দশক ধরে থুল সোসাইটিকে নিয়ে কাজ করছেন তিনি। জন্মস্থান জার্মানীতেই থুল সোসাইটি বিলুপ্তপ্রায় একটি সংগঠন। সেই সোসাইটিকে গত কয়েকদশকে ভালো একটি অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। জার্মান জাতি আগের তুলনায় এখন অনেক সুসংহত, আর্থিক কিংবা সামরিক দুদিক দিয়েই। নিজেদের শ্রেষ্ঠতর প্রমানের যে বাসনা হিটলারের ছিল, সেই বাসনা এখনো অনেক জার্মানের মনে সুপ্ত অবস্থায় আছে। তাকে বিকশিত করে নিজেদের শ্রেষ্ঠতর জাতিসত্ত্বা হিসেবে আবারও পরিচয় করিয়ে দিতে চায় থুল সোসাইটি। হিটলার আর তার সাঙ্গপাঙ্গ থুল সোসাইটির ধ্যান-ধারনার উপর ভিত্তি করে যে নাৎসি পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিল, তার প্রয়োগ ছিল অতি মারাত্মক। একটি বিশ্বযুদ্ধ আর কয়েক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুই তার প্রমান। থুল সোসাইটি সরাসরি যুদ্ধে বিশ্বাস করে না, তারা যুক্তি, তর্কে বিশ্বাসে আগ্রহি। এই সংগঠনের একজন প্রানপুরুষ বলা হয়। তাকে, যদিও বেশিরভাগ মানুষের কাছেই নিজের এই পরিচয় লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।

সুরেশকে পাঠিয়েছেন কয়েকজন লোক যোগাড় করতে। লোকজন নিয়ে না আসা পর্যন্ত চুপচাপ বসে থাকতে হবে এই তাঁবুতেই। যে কোন সময় অবশ্য সন্দীপ আর লতিকা চলে আসবে। ছোট তাঁবুতে তিনজনের জায়গা হবে কি না আগে ভাবেননি। তাই বের হয়ে এলেন সাথে সাথে।

বাইরে এসে সন্দীপকে দেখতে পেলেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। এগিয়ে গেলেন তিনি সন্দীপের কাছে।

কি খবর সন্দীপ? কিছু ভাবছেন?

তার প্রশ্নে সংবিত ফিরে পেল সন্দীপ। মনে হচ্ছে বেশ অনেকক্ষন ধরেই এখানে একা দাঁড়ানো সে।

না, কিছু ভাবছি না, হেসে বলল সন্দীপ।

লতিকা কোথায়?

বের হয়নি,তাঁবুতেই আছে।

রান্না করার জন্য সুরেশ যে আগুন জ্বালিয়েছিল তা এখন নিভে গেছে প্রায়, অবশ্য জ্বলন্ত কয়লায় ফুঁ দিলেই আবার জ্বলে উঠবে। আগুনের পাশে সকালে যেখানে বসেছিলেন সেখানেই বসলেন ড. কারসন, ইশারায় সন্দীপকে পাশে বসতে বললেন তিনি। বাধ্য ছেলের মতো চুপচাপ বসল সন্দীপ।

লতিকা বের হয়ে এলো এই সময়।

ড. কারসন, আপনি জানেন কি না জানি না, একসময়… কথা বলতে বলতে থেমে গেল সন্দীপ, লতিকাকে দেখে।

বলুন, কি বলছিলেন।

থাক, অন্যসময় বলবো, বলে উঠে চলে গেল সন্দীপ, লতিকাকে পাশ কাটিয়ে।

লতিকা, ডাকলেন ড. কারসন, এখানে এসো।

লতিকা আসছে, ট্রাউজার, সোয়েটার পরনে মেয়েটাকে বেশ সুন্দর মানিয়েছে। তবে চেহারায় অদ্ভুত বিষণ্ণতা লক্ষ্য করলেন ড. কারসন। সন্দীপের সাথে লতিকার কিংবা প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের কোন একটা ঝামেলা আছে। সুরেশ না আসা পর্যন্ত আজ হাতে কিছুটা সময় আছে। এই বিষয়গুলো জানা দরকার। সামনের দিনগুলোতে পরস্পরের উপর বিশ্বাস খুব গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করবে।

*

অধ্যায় ৩৩

বেশি সঙ্গিসাথির দরকার নেই, শুধু সোহেল আর আহমদ কবিরকে সাথে নিয়ে রওনা হয়েছেন আকবর আলী মৃধা। সামান্য একটুর জন্য শিকার ছুটে গেছে তার। তবে যেখানেই থাকুক, যতোদূরেই যাক, নিস্তার পেতে দেবেন না তিনি বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন, মহান লুসিফারের নামে প্রতিজ্ঞা। গত দুই বছর জেলে থেকে বুঝেছেন রাশেদের কারনে ঠিক কতোটা পিছিয়ে পড়েছেন তিনি। বেশ ভালো একটা দল তৈরি হয়ে গিয়েছিল যারা তার হুকুমে যে কোন করতে রাজি ছিল। জেলখানায় কাটানো সময়গুলোতে বাইরে তৈরি করা সেই দল ভেঙে গেছে। বেশিরভাগ শিষ্যই পুরানো পেশা আর নেশায় ফিরে গেছে। ওদের ফিরে পাওয়ার আশা বৃথা। বাংলাদেশে ঢুকতে গেলেই আবার জেলে যেতে হতে পারে। সেই ঝুঁকি নেয়ার মতো সময় আসেনি।

হুড-খোলা একটা জিপ ভাড়া নিয়েছেন। সামনে সোহেল বসেছে, পেছনে আহমদ কবিরের সাথে বসেছেন আকবর আলী মৃধা। একের পর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছেন তিনি। রাশেদের এতো দূর দেশে আসার কারন জানা বেশ জরুরি তার জন্য। বিশেষ করে তিব্বতের দিকে রওনা দেয়ার কী কারন থাকতে পারে তা মাথায় আসছে না। বড় কোন পর্বতচূড়ায় উঠতে চাইলে অবশ্যই ওদের সাথে শেরপা থাকতো। ন্যূনতম একটা প্রশিক্ষন নেয়ার ব্যাপার থাকতো। কিন্তু নেপালে আসার পর থেকে সে ধরনের কোন কার্যকলাপ চোখে পড়েনি কারো। শুধুমাত্র দেশ ভ্রমনের জন্য নেপাল- তিব্বত ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটাও ঠিক স্বাভাবিক নয়।

তিব্বতে যাওয়ার হাইওয়ে একটাই, এই পথে রাশেদ গেছে বেশিক্ষন হয়নি। এর আগে কখনো নেপালে আসা হয়নি তার, ভালোই লাগছিল চারপাশের প্রকৃতি। অবশ্য মনে খচখচানি নিয়ে প্রকৃতি দেখে মজা পাওয়া যায় না। আহমদ কবিরের দিকে তাকালেন, এই বুড়ো ভামের জন্যই যতো সমস্যা। তিব্বতে যাওয়ার স্পেশাল পাসের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য সাহায্য চেয়েছিল রাশেদ আর বোকা গাধাটা একেবারে সত্যিকারের পাসই এনে দিয়েছে ওদের। বিশ্বাসযোগ্যতা আনার জন্যই নাকি কাজটা করেছে আহমদ কবির। একেবারে গর্দভ মানুষ, ভাবলেন আকবর আলী মৃধা। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে, তার লম্বা চুল উড়ছে হাওয়ায়।

রাশেদকে শাস্তি দেয়ার যে আইডিয়াটা ঠিক করেছেন তা বেশ চমৎকার, অন্য কেউ শুনলে হয়তো ভয়াবহ বলতে পারে, কিংবা তার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে, কিন্তু আইডিয়াটা তার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। যিশুকে যেমন ক্রুশ বিদ্ধ করে মারা হয়েছিল, রাশেদকেও সেভাবে মারবেন তিনি। মহান লুসিফারের কসম।

আর কতোদূর সোহেল? জিজ্ঞেস করলেন সোহেলকে।

ড্রাইভারের দিকে তাকাল সোহেল, সে আসলে জানে না তিব্বত সীমান্ত কতোদূরে, কিংবা কতো সময় লাগবে।

আর ঘন্টা দুয়েক লাগবে,আহমদ কবির উত্তর দিলো।

তিব্বতে যদি যেতে হয় পাসের ব্যবস্থা আছে?

জি, না।

খুব ভালো, আমাদের পাস নেই, অথচ তুমি রাশেদ আর ওর বন্ধুকে পাস করে দিয়েছো!

আসলে…

বাদ দাও, রাশেদের দায়িত্ব আমার, ওর বন্ধুকে তুমি সাবাড় করতে পারবে না? আহমদ কবিরের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন আকবর আলী মৃধা।

সোহেলকে মোটেও অপ্রস্তুত মনে হলো না, এই ধরনের কাজের দায়িত্ব সাধারনত তার উপরই ছেড়ে দেন ওস্তাদ, এবার হয়তো আহমদ কবিরকে কাজ দিয়ে দেখতে চাইছেন।

পিরবো, দৃঢ়তার সাথে উত্তর দিলো আহমদ কবির।

ঠিক আছে, দেখা যাবে। না পারলে কি হবে সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। আকবর আলী মৃধার কথায় প্রচ্ছন্ন হুমকির সুর টের পেল আহমদ কবির।

আমি পারবো।

আকা-বাকা পথে এগিয়ে চলেছে জীপটা। আবহাওয়া ক্রমে শীতল হয়ে আসছে, এই শীতলতার মাঝেও আহমদ কবিরের কপালে ঘাম জমতে দেখা গেল।

আজ রাতটা থেকে কাল যেকোন সময় তিব্বত সীমান্ত পার হবো আমরা, ঘাড় ঘুরিয়ে বলল সোহেল।

আজ রাতেই ওদের খুঁজে বের করতে হবে। তিব্বত পর্যন্ত যাওয়ার ঝামেলা করা যাবে না, বললেন আকবর আলী মৃধা।

জি, ঠিক আছে, সোহেল বলল, তারপরও যদি তিব্বত যেতে হয় সে ব্যবস্থা করা আছে। কিছু স্মাগলারের সাথে পরিচয় আছে, ওরা সীমান্ত পার করে দিতে পারবে বলেছে।

এই তো বুদ্ধিমানের মতো কাজ, হাসলেন আকবর আলী মৃধা।

গত কয়েকদিনে এই প্রথম আকবর আলী মৃধার মুখে হাসি দেখল সোহেল। বেশ ভালো লাগছিল তার, এই লোকটাকে সে নিজের জন্মদাতার চেয়েও বেশি মানে। প্রয়োজনে ওঁর জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে দ্বিধা করবে না সে। রাশেদকে নিজ হাতে তুলে দেবে ওস্তাদের কাছে, নিজের কাছেই সে এ ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

*

অধ্যায় ৩৪

সন্ধ্যার পরপর ঘুম ভাঙল রাশেদের। বিছানায় বসে চারদিকে তাকাল, মনে হচ্ছিল কোন স্বপ্ন দেখছে সে, ঘুম ভাঙলে দেখবে গ্রামের বাড়িতে তার নিজের বিছানায় শোয়া অবস্থায়। কিন্তু এটা স্বপ্ন নয়, বাস্তব। রুমে এখন কেউ নেই। রাজু বাইরে থেকে ফেরেনি এখনো। ফিরলে একটানা এতোক্ষন ঘুমাতে দিতো না, ঠিকই ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিতো। এখানে ঐ ট্যাক্সি ড্রাইভার চরনদাস ছাড়া আর কাউকে চেনার কথা না রাজুর, কিন্তু কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে পনেরো মিনিটের বেশি লাগে না ওর।

রাজু না থাকাতে রুমটা আরো ফাঁকা লাগছে। কোথাও কোন শব্দ নেই, জানালা . খুলে বাইরে তাকাল রাশেদ। চারদিক ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, মনে হয় সন্ধ্যার পর পর এই এলাকার লোকজন কমই বের হয় ঘর থেকে। প্রচন্ড শীতে কাঁপন ধরে যাচ্ছে। খুব বেশি শীতের কাপড় আনা হয়নি,এটাই সমস্যা। রাজু অনেক এনেছে সাথে করে, মনে হচ্ছে রাজুর কাছেই কিছু গরম কাপড় চাইতে হবে। দুজনের আকার-আকৃতি কাছাকাছি, একজনেরটা আরেকজন পড়লে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

বিছানায় বসে বসে আগামীকালের প্ল্যান-প্রোগ্রাম করতে চাইল রাশেদ। মাথায় কিছুই আসছে না, তবে অন্তত আফরোজা আরেফিনকে জানিয়ে রাখা ভালো তাদের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে। সীমান্তবর্তী এই এলাকা অতি সম্প্রতি মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে, তা না হলে খবর দেয়া কঠিন হতো।

মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করলো বাংলাদেশের নাম্বারে, মনে হচ্ছে ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিলেন আফরোজা আরেফিন, কল রিসিভ করতে দেরি করলেন না।

হ্যালো, তোমরা কোথায়? ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন শুনতে পেল রাশেদ।

আমরা তিব্বত সীমান্তের কাছে, আগামীকাল সম্ভবত তিব্বতে ঢুকবো।

কোন খোঁজ খবর?

এখনো কোন খবর পাইনি,কাল আপনাকে কল করে জানাবো।

আচ্ছা, ওপাশের কণ্ঠস্বরটা হতাশ শোনালো রাশেদের কাছে।

রাখি তাহলে, বলে ফোন কেটে দিল রাশেদ।

রাজু ঢুকল এই সময়। তাকে বেশ উফুল্ল দেখাচ্ছিল। হাতে কাগজের প্যাকেট।

তোর জন্য খাবার নিয়ে এসেছি, গরম গরম খেতে হবে, রাজু বলল, টেবিলে প্যাকেটটা রাখতে রাখতে।

কি খাবার?

ভেড়ার মাংস আর রুটি, রুটি অবশ্য বেশ মোটা, খেতে খুব একটা খারাপ লাগেনি আমার কাছে।

বিছানা ছেড়ে উঠল রাশেদ। বেশ অলস লাগছিল। মনে হচ্ছিল আরো কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নিলে ভালো হতো।

আর একটা খবর আছে, রাজু বলল, আসলে দুটো খবর আছে, একটা সামান্য ভালো, আরেকটা খারাপ, কোনটা শুনবি আগে?

খারাপটা।

খারাপ হচ্ছে কিছু লোক এসেছে এখানে, আমাদের কথা জিজ্ঞেস করছে সবাইকে, সম্ভবত কাঠমুন্ডুতে যারা হামলা করেছিল ওরাই হবে। একজনের সাথে আহমদ কবিরসাহেবের মিলে যায়। আমাদের যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পাততাড়ি গুটাতে হবে।

তুই কিভাবে জানলি?

খাবার কেনার পর সিগারেট কিনতে গিয়েছিলাম, ওখানেই শুনলাম, বুঝলাম বলা চলে। এদের ভাষা তো বুঝি না, ইশারায় ঐ দোকানের লোকটা যা বলল তাতে বুঝলাম অন্তত তিনজন লোক আমাদের খোঁজে বের হয়েছে।

তিনজন?

সম্ভবত তোর সেই আকবর আলী মৃধা, আহমদ কবির আর আরেকজন, ওর নাম জানি না।

ভালো খবর কোনটা?

আসলে খুব ভালো খবর না, বলা যায় ভালো তথ্য, ড. আরেফিনরা যেখানে ছিলেন সেখানে গিয়েছিলাম। বেশ কয়েকদিন আগেই দলটা তিব্বতে চলে গেছে। দলের সাথে একটা মেয়েও আছে।

ড. আরেফিন দলের সাথে ছিলেন?

সেভাবে পরিস্কার করে কেউ বলতে পারলো না। আসলে ওরা কারো নাম জানতো না। কয়েকটা ছোট ছোট কটেজ আছে গ্রামের বাইরে। ওখানেই ছিলেন ওরা।

কবে গেছেন?

বেশ কয়েকদিন হলো। চরনদাসকে দিয়ে খবর নিয়েছি, বুঝতেই পারিস, ইশারায় সব কথা বুঝতে হয়েছে।

তাহলে তৈরি হয়ে নে, আমরা এখুনি বেরুচ্ছি।

কোথায়?

তুই না বললি কাঠমুন্ডু থেকে আহমদ কবির আর তার দল চলে এসেছে।

কিন্তু এই সময় আমরা কোথায় যাবো? কিছুই তো চিনি না।

তুই তৈরি হয়ে নে, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি, বলে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল রাশেদ।

মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল রাশেদের। এখান থেকে পালাতে হবে, এক্ষুনি। আকবর আলী মৃধা সময় নষ্ট করার লোক নন, একবার হাতের কাছে পেয়েও ধরতে পারেননি,এবার সুযোগ নষ্ট করবেন না নিশ্চয়ই।

পাঁচ মিনিটের মাথায় বাথরুম থেকে বেরিয়ে তৈরি হয়ে নিলো রাশেদ। রাজু আগে থেকেই তৈরি ছিল। শুধু ব্যাগ দুটো কাঁধে ঝোলালো। টেবিলে খাবারের প্যাকেট থেকে ভেড়ার গোস্ত আর রুটি প্লেটে সাজিয়ে রেখেছিল একটু আগে। খাওয়ার সময় পাওয়া গেল না। রুমে বাতি জ্বালিয়ে রেখেই চুপচাপ দোতলা থেকে নেমে এলো নীচে। দরজার কাছাকাছি আসতেই বুঝলো বেশ দেরি হয়ে গেছে। বেশ কয়েকজন মানুষের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে বাইরে। যে কোন সময় দরজা খুলে ঢুকে পড়বে।

***

প্রথমে কিছুতেই স্বীকার করতে চাইছিল না কোথায় রেখেছে ছেলে দুটোকে। রিভলবার দেখাতেই কাজ হয়েছে। হাজার হোক জানের ভয় সবারই আছে। এমন অজ পাড়া গাঁয়ে এই ধরনের বাড়ি দেখতে পাওয়ার আশা তিনি করেননি। চমৎকার একটা দোতলা বাড়ি। ঢাকার গুলশান-বনানীতে এই ধরনের বাড়ি দেখা যায়।

ছেলেটাকে দূরে রেখে এগিয়ে গেলেন আকবর আলী মৃধা। বোবা ড্রাইভারকে চাইলে মেরে ফেলতে পারতেন, কিন্তু দূর দেশে এসে ঝামেলা করতে ইচ্ছে হলো না। এছাড়া একটা বোবা মানুষ কিইবা ক্ষতি করতে পারে! তার সর্বক্ষনের সঙ্গি সোহেল আছে ডানদিকে, আর বা দিকে আহমদ কবির। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেক আগেই। পৌঁছানোর পরপরই রাশেদ আর রাজুর খোঁজখবর শুরু করে দিয়েছিলেন। খোঁজ পেতে বেশি সময় লাগেনি। গ্রামের একটা খাবারের দোকান থেকে একটু আগেই ওদের একজন খাবার কিনে নিয়ে গেছে, দোকানদার লোকটা ওদের ড্রাইভারকে চিনিয়ে দিয়েছিল। ওকে ধরে ঠিকানা বের করে নিতে সমস্যা হয়নি।

সামনে ছোটমতো উঠোন পেরিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালেন আকবর আলী মৃধা। আশা করছেন ওরা এখনো বাসায় আছে। বের হওয়ার মতো সময় পায়নি। দরজায় দাঁড়িয়ে ইশারায় সোহেলকে কাভার করতে বললেন, ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছেন তিনি। হাতে রিভলবার প্রস্তুত। একটু নাড়াচাড়া দেখলেই বুলেট খরচ করতে দ্বিধা করবেন না তিনি।

দরজায় মৃদু টোকা দিয়ে দেখলেন। ভেতর থেকে আটকানো। সোহেলকে ইশারা করলেন। কাঠের দরজা, ধাক্কা দিয়ে ভাঙা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সোহেলের গায়ে অসুরের শক্তি। টানা কয়েকবার দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেলল দরজাটা। ভেতরে ঢুকলেন তিনি।

নীচ তলা অন্ধকার। রাত হয়ে গেলেও বাতি জ্বালানো হয়নি। রামচরনের কথামতো ছেলে দুটো দোতলার রুমে অবস্থান নিয়েছে। একপাশে প্যাচানো সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। আশপাশে তাকালেন আকবর আলী মৃধা। অন্ধকারে নীচতলাটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে না। সাদা কাপড় দিয়ে আসবাবপত্রগুলো ঢাকা। আহমদ কবির আর সোহেলকে ইশারা করলেন পেছন পেছন আসার জন্য। দোতলায় উঠার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি, চেষ্টা করছেন যাতে কোন শব্দ না হয়। সঙ্গি দুজনকে তৈরি থাকার জন্য ইশারা করলেন।

দোতলার একটা রুমে বাতি জ্বলছে। এই রুমেই আছে রাশেদ আর ওর বন্ধু। বাতি জ্বলছে, তার মানে ওরা এখনো রুমেই আছে। পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন তিনি। পেছনে কাভার দিচ্ছে আহমদ কবির আর সোহেল। আহমদ কবিরের উপর বিন্দুমাত্র ভরসা নেই তার। লোকটা কারো উপর নজরদারি করার জন্য ঠিক আছে, এই ধরনের অপারেশনে একদম অকাজের। যা ভাবছিলেন তাই, হোঁচট খেয়ে দুই ধাপ পেছনে পিছলে পড়ল আহমদ কবির। শব্দহীন বাড়িটায় এই শব্দটুকুই যথেষ্ট। চোখ গরম করে আহমদ কবিরের দিকে তাকালেন তিনি, ইচ্ছে করছিল আগে এই বোকার হদ্দ বুড়োটাকে খতম করতে। সোহেল টেনে ধরেছিল, নইলে একেবারে সিঁড়ির গোড়ায় পড়তো আহমদ কবির।

দোতলায় উঠেছেন আকবর আলী মৃধা। সঙ্গি দুজনও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দুজনকে দুদিকে থাকার জন্য ইশারা করে মাঝখানে থাকলেন তিনি। ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন রুমটার দিকে। দরজা একটু ভেড়ানো। রুমের মধ্যে থেকে কোন শব্দ পাচ্ছেন না তিনি। ওরা কী তাহলে রুমে নেই?

এবার আর ধীর পায়ে না গিয়ে দৌড় দিলেন তিনি, দরজা বরাবর তার রিভলবার তাক করা, অন্যপাশ থেকে একই সাথে দৌড় দিয়েছে সোহেল, বিশাল দেহটা নিয়ে রুমের দরজায় আছড়ে পড়ল সে। দরজাটা নতুন হলেও এই ধরনের ধাক্কা সামলানো কঠিন ছিল। দরজা ভেঙে রুমের ভেতরে পড়ল সোহেল।

রিভলবার হাতে ঢুকে পড়লেন তিনি। রুম ফাঁকা। সোহেল মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছে। বেকায়দা অবস্থায় পড়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছে। হাতে রিভলবার তোলা, কিন্তু তাক করার মতো লক্ষ্যবস্তু নেই।

এখানে কেউ নেই, কোনমতে বলল সোহেল।

ওরা পালাচ্ছে, দরজার বাইরে থেকে আহমদ কবিরের চিৎকার শুনতে পেলেন আকবর আলী মৃধা।

দৌড়ে বাইরে চলে এলেন তিনি। নীচে সদর দরজা দিয়ে একটা ছায়া চলে যেতে দেখলেন, রিভলবার তাক করেও বুঝলেন দেরি হয়ে গেছে, তাই ট্রিগার চাপলেন না।

রাগে-ক্ষোভে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল তার। ওরা নীচ তলায় লুকিয়ে ছিল এতোক্ষন! অন্ধকারে কোন আসবাবপত্রের পেছনে লুকিয়ে ছিল। নীচতলায় না খুঁজে সরাসরি দোতলায় চলে আসাটা বোকামি হয়েছে।

গুলি করতে পারলে না? আহমেদ কবিরের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিলেন তিনি।

রিভলবার উঁচিয়ে দেখাল আহমেদ কবির, জ্যাম হয়ে গেছে।

এটা কী জ্যাম হওয়ার জিনিস? পরীক্ষা করে দেখাব? বলে আহমদ কবিরের দিকে রিভলবার তাক করলেন তিনি।

আহমদ কবিরের চেহারা ছাইবর্ন হয়ে গেল মুহূর্তেই। আর ভুল হবে না, ঢোঁক গিলে কোনমতে বলল আহমদ কবির।

কষ্ট হলেও নিজেকে সামলালেন আকবর আলী মৃধা। এখন ওদের পেছনে যাওয়া যাবে না। সোহেল এখনো মেঝেতে পড়ে আছে। ওকে আগে ঠিক করতে হবে। সোহেলকে কোনমতে ধরে দাঁড় করালেন তিনি।

নিজে হাঁটতে পারবে, না ধরতে হবে? জিজ্ঞেস করলেন।

পারবো।

আহমদ কবিরকে ইশারা করলেন সোহেলকে সাহায্য করার জন্য। কোনমতে খুঁড়িয়ে হাঁটছে সোহেল। হতাশায় মাথা ঝাঁকালেন আকবর আলী মৃধা। দ্বিতীয়বারের মতো হাত থেকে ছুটে গেছে শিকার। তার চেহারায় একই সাথে অদ্ভুত একটা হাসি খেলে গেল। যে শিকার ধরতে যতো কষ্ট, তা শিকার করাও অনেক আনন্দের।

*

অধ্যায় ৩৫

ভোরের প্রথম আলোতে চারদিক ঝকমক করে উঠেছে যেন। দূরের পর্বতচূড়ায় বরফে আলোর ঝিলিক পড়ে হীরের মতো আলোকিত হয়ে উঠেছে। ঠিক এই দৃশ্যগুলো দেখার জন্যই যেন বেঁচে থাকা। যুগের পর যুগ, শতাব্দির পর শতাব্দি। অনেকবার আরো চমৎকার সব দৃশ্য চোখে পড়েছে, কিন্তু প্রতিবারই মনে হয়েছে এই অভিজ্ঞতাটা নতুন, আগের কোনটার সাথে মেলে না।

গুম্ফার বাইরে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে ভাবছিলেন তিনি। যজ্ঞেশ্বর সারারাত ঘুমায়নি,তার পাশেই বসে ছিল নিশ্চুপ হয়ে। বুঝতে পারছিলেন, অপরাধবোধে ভুগছে। বেচারা। কিন্তু এ বিষয়ে আর কোন কথা বলেননি তিনি। যে যার উদ্দেশ্যে এসেছে, সে যেমন সাম্ভালার খোঁজে আছে, যজ্ঞেশ্বর এসেছে অজানা নয়জনের সত্যতা বের করতে আর বিনোদ চোপড়া সাথে আছে পুরানো জিনিসের খোঁজে, ইউরোপের মার্কেটে তার অসংখ্য ফ্যানাটিক আর্টিফ্যাক্ট সগ্রাহকদের কাছে লাখ ডলারে বিক্রি করার আশায়। ওদের উদ্দেশ্য বানচাল করার কোন ইচ্ছে তার নেই, কিন্তু অন্তত বিষয়গুলো জানা থাকলে তার জন্য কাজ করতে সুবিধা হয়।

ভোরের প্রথম আলো ফোঁটার সাথে সাথে যজ্ঞেশ্বর তার নিয়মিত ধ্যানে বসেছে। বিনোদ চোপড়ার ঘুম এখনো ভাঙেনি। এই ধরনের পরিবেশের সাথে খাপ-খাওয়াতে পারেনি লোকটা। ঘুম থেকে উঠে চোখ না খুলে অভ্যাসবশত এখনো কফি খোঁজে বেচারা, তারপর নিজেই বিব্রতবোধ করে।

গুম্ফার ভেতরটা বেশ উষ্ণ, একেবারে শেষ কোনায় গিয়ে বসলেন তিনি। দুইপাশে বেশ কিছু বুদ্ধ মূর্তি চোখে পড়লো, এগুলো পাথরে তৈরি, সম্ভবত কষ্টি পাথর, তিব্বতের এই অঞ্চলে কষ্টি পাথর থাকার কথা নয়, হয়তো অন্য কোথাও থেকে নিয়ে এসেছে। এগুলোর অনেক দাম হবে। তবে বিনোদ চোপড়াকে এখন এসব নিয়ে যেতে দেয়া যাবে না, জিনিসগুলো বেশ ভারি, তাতে গতি কমে যাবে। এছাড়া বিনোদ চোপড়া কিংবা যজ্ঞেশ্বরকে এখন রেখেও যাওয়া যাবে না, তাতে ওদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে এতে কোন ভুল নেই। তার প্রতিদ্বন্ধী সাধারন কেউ নয়, গন্ধ শুঁকে এঁকে চলে এসেছে এতোদূর। যে কোন সময় মোকাবেলা করতে হবে, সেজন্য প্রস্তুত তিনি। কিন্তু তার আগে অন্তত সাম্ভালা খুঁজে বার করা দরকার।

সাথে শেবারনের দেয়া চামড়ার খোল থেকে ম্যাপটা বের করলেন তিনি। দূর্বোধ্য, রহস্যময় আঁকিবুকি। পাশাপাশি নীল রঙা গোলাকার দুটো আকৃতি দেখে এগুলো যে মানস সরোবর আর রাক্ষসতাল হ্রদ তা বুঝতে অসুবিধা হলো না। কিন্তু এছাড়া আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মানস সরোবরে যাওয়ার পথ তার জানা নেই, সম্ভবত যজ্ঞেশ্বর জানলেও জানতে পারে।

বিনোদ চোপড়ার ঘুম ভেঙেছে, লোকটাকে খুব পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে। চোখের নীচে কালো ছাপ পড়েছে, স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে বলা যায়। আরাম-আয়েশে থাকা শরীর তিব্বতের এই বিরূপ আবহাওয়ার বিদ্রোহ করছে মনে হলো।

গুড মর্নিং, লখানিয়া জী, হেঁটে কাছে এলো বিনোদ চোপড়া।

গুড মর্নিং।

আজ সকালের নাস্তা কি হবে বলুন তো, খিদেয় পেট চো চো করছে, একপাশে বসে পড়ল বিনোদ চোপড়া। দেয়ালের দুপাশে সাজানো কষ্টি পাথরের তৈরি কালো রঙের বুদ্ধ মূর্তিগুলো তার চোখে পড়েছে মাত্র।

কাঁপা কাঁপা হাতে একটা মূর্তি হাতে নিলো বিনোদ চোপড়া, তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে।

সোনার চেয়েও এর দাম বেশি, মি. লখানিয়া সিং, বিনোদ চোপড়া বলল, কিন্তু…

কিন্তু কি?

এসব পার্থিব জিনিসের প্রতি আমার লোভ কমে গেছে, যজ্ঞেশ্বরের মতো আমিও সন্ন্যাসী হবে বলে ঠিক করেছি, ধীর কণ্ঠে বলল বিনোদ চোপড়া, বুদ্ধ মূর্তিটা সাবধানে রেখে দিল একপাশে।

হাসলেন তিনি। মাঝে মাঝে অতি বিষয়ী লোকের মধ্যেও বৈরাগ্য ভর করে, কিন্তু সেটার স্থায়িত্ব খুব কম।

তাহলে তো ভালোই হলো, যজ্ঞেশ্বর আপনার মতো একজন বিচক্ষন সঙ্গি পাবে।

এবার হাসল বিনোদ চোপড়া। যজ্ঞেশ্বর মজার লোক, এই মানুষটা কিভাবে সন্ন্যাসী হলো ভেবে পাই না।

সবারই অতীত ইতিহাস আছে, বললেন তিনি, সেটা লুকানো থাকাই ভালো।

হ্যাঁ, বিনোদ চোপড়া বলল, তবে আপনার যে ইতিহাস, সেটাই সবচেয়ে রোমাঞ্চকর হবে বলেই আমার ধারনা।

চলুন উঠি, নাস্তার সন্ধানে নীচের দিকে যেতে হবে।

গুম্ফার বাইরে ধ্যানরত অবস্থায় যজ্ঞেশ্বরকে দেখে গিয়েছিলেন, বাইরে এসে যা দেখলেন তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি।

*

অধ্যায় ৩৬

চারজনের একটা দল নিয়ে ফিরে এসেছে সুরেশ। আশপাশের কোন গ্রাম থেকে টাকার লোভ দেখিয়ে ধরে নিয়ে এসেছে বোঝা যায়। এতো কম সময়ে ফিরে আসবে সুরেশ ধারনাও করেননি ড. কারসন। ভেবেছিলেন সন্দীপ আর লতিকাকে নিয়ে বসবেন, ওদের ভেতরের কথা জানার জন্য। কিন্তু সেটা আপাতত হচ্ছে না। তবে তিনি খুশি। এবার আসল অভিযানে যাওয়ার সময় হয়েছে।

দুটো জীপের একটা এখানেই রেখে যেতে হবে। দ্বিতীয় জীপটা দিয়ে ড্রাইভারকে বিদায় করেছে সুরেশ, বেশ কিছু টাকাও দিয়েছে, সে নিজে যে জীপটা চালিয়ে এসেছিল সেটাকে বড় একটা ঝোঁপের পাশে লুকিয়ে রেখেছে। সহজে বোঝা যায় না, বরফ আর আশপাশের কিছু ঝোঁপ থেকে আনা গাছের ডাল দিয়ে এমনভাবে ঢেকে রেখেছে, হয়তো সে নিজেও পরর্বতীতে সহজে খুঁজে পাবে না। চারজন তিব্বতীর মধ্যে দুজনের বয়স খুবই কম, বাকি দুজন যুবক বয়সী। সবার বেশ ভারি কাপড়-চোপড় পড়া থাকলেও বুঝতে সমস্যা হয় না, ওরা সবাই কঙ্কালসার। তবে কায়িক পরিশ্রমে কোন সমস্যা নেই ওদের। লোকগুলোকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে সুরেশ। তাঁবুগুলো গুটিয়ে নিয়ে বাকি জিনিসপত্র কে কিভাবে বহন করবে তার একটা প্ল্যান করেছে। একমাত্র লতিকা ছাড়া বাকি সবাই কিছু না কিছু ভারি জিনিস বহন করবে বলে ঠিক করা হয়েছে।

আমরা এবার কোথায় যাবো? সুরেশ জিজ্ঞেস করলো ড. কারসনকে।

ড. কারসন কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়েছেন, সেটাতে তার ল্যাপটপসহ আরো বেশ কিছু সরঞ্জাম আছে। হাতে একটা কম্পাস নিয়ে উত্তর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

আমরা যাবো আরো পশ্চিমে, বললেন ড. কারসন, মানস সরোবর আর …

ঠিক আছে, কথার মাঝখানে থামিয়ে দিলো সুরেশ।

সন্দীপ, লতিকা আর ড. কারসনের দিকে তাকাল, তিনজনই প্রস্তুত। সন্দীপকে দেখে মনে হচ্ছে সে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছে না বাকি দুজনের সাথে।

মুটেদের দুজন থাকবে সামনে, মাঝখানে আমি আর সন্দীপ বাবু, তারপর আপনি আর মিস লতিকা, পেছনে থাকবে বাকি দুজন মুটে, কি ঠিক আছে তো? সুরেশ বলল, মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে, ড. কারসনের উদ্দেশ্যে।

ঠিক আছে, ড. কারসন বললেন।

এখন তার গন্তব্য কৈলাস পর্বত। এই পর্বতমালার অন্যপাশে মানস সরোবর আর রাক্ষসতাল হ্রদ। দুটো হ্রদ পাশাপাশি হলেও আশ্চর্য্য বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। একটি স্বাদু পানির তো অন্যটি লবনাক্ত, একটি গোলাকার, অন্যটির আকার অদ্ভুত। আকারে যদিও রাক্ষসতাল বড়, কিন্তু ধর্মীয় দিক থেকে মানস সরোবরের গুরুত্ব আলাদা। হিন্দু, জৈন কিংবা বৌদ্ধ ধর্মে মানস সরোবরের ভূমিকা ভিন্ন ভিন্ন। অন্যদিকে রাক্ষসতাল নিয়ে নানা ধরনের মিথ চালু আছে। তারমধ্যে একটি হলো রাক্ষস রাজা রাবন এখানেই শিবের কাছে বর চেয়েছিলেন, দীর্ঘ তপস্যায় শিব তাকে বর দিতে বাধ্য হয়, তার ফলেই রাক্ষস রাজ রাবন হয়ে উঠে পরাক্রমশালী, লংকাদ্বীপে স্থাপন করে তার রাক্ষস রাজত্ব। এসব উপকথা এই অঞ্চলের মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে।

পাকা রাস্তার বদলে এবার পাহাড়ি পথ, বেশ দূর্গম। বয়স হলেও এখনো শারীরিকভাবে বেশ সক্ষম ড. কারসন। লতিকা হাঁটছে পাশাপাশি, তাকে বেশ সতেজ দেখাচ্ছিল। দুপুর হয়নি এখনো, রোদের তেজ আছে বেশ, সেই সাথে চমৎকার হাওয়া। হাঁটতে মোটেই কষ্ট হচ্ছে না দলটার। সন্দীপকেও বেশ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। চোখে সানগ্লাস, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হাঁটছে, মাঝে মাঝে হিন্দি গানের সুর তুলছে শিস দিয়ে।

হিসেব যতোটা করেছেন তাতে অন্তত সপ্তাহখানেক হাঁটতে হবে গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে হলে, ভাবছেন ড. কারসন। আজ রাতে দলটাকে নিয়ে বসবেন, তার প্ল্যানটা এবার জানাতে হবে সবাইকে। সামনের দিনগুলোতে কঠোর কায়িক পরিশ্রম করতে হবে, তিনি নিজে কতোটা পারবেন তাতেও বেশ সন্দেহ আছে।

অনেক অনেক দূরে কৈলাস পর্বতের উত্তর পাশটা দেখা যাচ্ছে। বরফে ঢাকা সাদা চূড়া। অদ্ভুত হলেও সত্য এখন পর্যন্ত কোন পর্বতারোহি উঠেনি এই পর্বতশৃঙ্গে। ধর্মীয় কারনে কোন উপমহাদেশিয় উঠতে চায়নি,বিশেষ করে এখানেই নাকি শিবের বাসস্থান। আর ইউরোপীয়দের কাছে এই পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা নাকি কোন উচ্চতাই নয়। তবু কেন তারা জয় করেনি এই শৃঙ্গ তা বোধগম্য নয় ড. কারসনের কাছে। কিছু কিছু জিনিস হয়তো জয় না করাই ভালো।

এটাই হয়তো তার শেষ অভিযান। জীবনে অনেক অভিযানে গিয়েছেন, সব অভিযানেই গিয়েছেন একজন বৈজ্ঞানিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, এটাই হয়তো তার প্রথম ও শেষ অভিযান যেখানে তিনি এসেছেন তার পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে। কার্ল হোসেনহফের অতৃপ্ত আত্মা হয়তো এতে শান্তি পাবে।

***

সন্ধ্যার পরপর ভ্যানের পেছনের ডালা খুলল। অল্পক্ষনের জন্য ডালাটা খোলে, তাতে কিছুটা ঠান্ডা বাতাস ঢোকে ভেতরে। সারাদিন পর এই সময়টার অপেক্ষা করেন তিনি।

চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা থাকায় বুঝতে পারছেন না কে ঢুকছে। শক্ত একজোড়া হাত চোখের উপর থেকে বাঁধনটা খুলে দিল। তরুন চাইনীজ অফিসার ঢুকেছে। হাতে ছোট একটা টর্চ দিয়ে তার চোখ বরাবর আলো ফেলছে। এটাও এক ধরনের নিযাতন আর নির্যাতনের ক্ষেত্রে এই অফিসার একজন বিশেষজ্ঞ। অন্তত সেই বৃদ্ধ লামার কথা শুনে তাই ধারনা হয়েছে ড. আরেফিনের। বৃদ্ধ লামার সাথে শেষ যখন কথা হয়েছিল, বৃদ্ধ বলেছিল সে আবার আসবে, কিন্তু এরপর বৃদ্ধের চেহারা আর চোখে পড়েনি। হয়তো আশপাশে কোথাও আছে, কিংবা ড. কারসনের দলের উপর নজর রাখছে। তাকে যেভাবে অপহরন করেছে তাতে মনে হয় না ড. কারসনের দলটাকে ওরা এমনি এমনি ছেড়ে দেবে। ড. কারসনকে বাঁধা দেয়ার কোন না কোন ব্যবস্থা অবশ্যই করেছে বৃদ্ধ লামা।

সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এবার সময় হয়েছে। সুযোগ না খুঁজলে সুযোগ হেঁটে হেঁটে চলে আসবে না। এখানে এই অন্ধকারে ধুকে ধুকে মরার চেয়ে চোঁ করা ভালো, পালানোর চো।

হাত দুটো চেয়ারের সাথে পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল, চাইনীজ অফিসার খুলে ফেলল একটানে। এরপর আবার নতুন দড়ি দিয়ে বাঁধবে। পুরানো দড়ি ছিঁড়ে যেতে পারে, তাই কোন রকম ঝুঁকি নেয় না। প্রতিবার ভেতরে ঢোকানোর সময় নতুন দড়ি দিয়ে হাত বাঁধে, নতুন কালো কাপড়ে বাঁধে চোখ।

দূর্বল পায়ে দাঁড়ালেন ড. আরেফিন। পেছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছে চাইনীজ অফিসার, ভ্যান থেকে নামার জন্য। ওর এক হাতে রিভলবার, অন্যহাতে ড. আরেফিনের ডান বাহু ধরে রেখেছে। পালাবার কোন সুযোগই দিতে চায় না।

কোনমতে লাফ দিয়ে নীচে নামলেন ড. আরেফিন। সামরিক পোশাক পড়া আরো কয়েকজনকে দেখতে পেলেন আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। এদেরকে আগে দেখেননি তিনি, সম্ভবত আজকেই আনা হয়েছে। হতাশায় মুখ কালো হয়ে গেল তার। আজ পালাবেন এমন চিন্তাই করেছিলেন, কিন্তু এতোগুলো লোককে ফাঁকি দেয়া রীতিমতো অসম্ভব একটা কাজ।

চাইনীজ অফিসার নীচে নেমে ইশারায় ডাকলো কাউকে। ড. আরেফিন দেখলেন দুজন সৈন্য এসে তার দুপাশে দাঁড়াল, ওরাই তাকে সামনে নিয়ে যাবে। একটু দূরেই ঘন বন। সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো পাইনের সারি। এমনিতে গাছগুলোর মধ্যে দূরত্ব থাকলেও কিছু জায়গায় ঘনত্ব এতো বেশি যে পাশাপাশি দুজন মানুষ হাঁটা যায় না। ঠিক এমন জায়গায় ওরা তাকে ছেড়ে দেবে পাঁচ মিনিটের জন্য। সেই পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রাকৃতিক ক্রিয়া সারতে হবে। ব্যাপারটাতে যথেষ্ট বিব্রতবোধ করেন ড. আরেফিন, কিন্তু কিছু করার নেই।

নতুন লোকদুটো নাছোড়বান্দা। যে জায়গাটা বেছে নিলেন তার তিন-চার ফুট দূরে ওরা দাঁড়াল। হাত দিয়ে অনেক ইশারা করলেন একটু সরে যেতে, কিন্তু এক বিন্দু নড়ল ওরা। বাধ্য হয়েই কাজ সারলেন ড. আরেফিন। নিজেকে কেমন জন্তুর মতো মনে হচ্ছিল, সার্কাসে যেমন খাঁচার ভেতর থাকে প্রানী তার অবস্থাটাও তেমন। লোক দুটোর দিকে তাকালেন, কাঁধে একে-৪৭ রাইফেল ঝুলছে, প্রস্তুত যে কোন সময় গুলি ছুঁড়তে।

ঘন জঙ্গল থেকে বের হয়ে এলেন তিনি। আবার ফিরতে হচ্ছে অন্ধকার গুহাতে। আজ কোনভাবেই প্ল্যান কার্যকর করা যেতো না। তারচেয়ে আরেকটু অপেক্ষা করে দেখা যাক।

ভ্যানে ঢুকে দেখলেন প্লেটে পাউরুটি আর কলা সাজানো। লাথি দিয়ে ভ্যানের বাইরে ফেলে দিলেন ড. আরেফিন। তরুন অফিসার বাইরে দাঁড়ানো ছিল, তার চেহারায় কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি।

একটু পরেই ভ্যানের পেছনের ডালা বন্ধ হয়ে গেল। অসহায়ের মতো চোখে নতুন কালো কাপড়ের বাঁধন, নতুন দড়িতে পিছমোড়া হয়ে ঘুমিয়ে গেলেন ড. আরেফিন।

***

সন্ধ্যার পরপর পুরো গ্রাম যেন ঘুমিয়ে পড়ে। এলোপাথারি দৌড়াচ্ছে রাশেদ, একটু পেছনে রাজু। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দৌড়াতে সমস্যা হলেও কিছু করার নেই। অন্ধকারে গ্রামের বাইরে চলে এসেছে ওরা। রাজু বারবার পেছন ফিরে দেখার চেষ্টা করছে কেউ পিছু নিয়েছে কি না। কেউ পিছু নেয়নি।

ঐ তিনজন দোতলায় উঠার পরপরই সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা সোফার নীচ থেকে বেরিয়ে এসেছিল রাশেদ। নিঃশব্দে সদর দরজা পার হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু রাজুকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল ওদের কেউ, কণ্ঠস্বর শুনে লোকটাকে আহমদ কবির বলে মনে হয়েছে। রিভলবার হাতে থাকতেও লোকগুলো কেন গুলি করেনি তা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না রাশেদের। হয়তো হাতে-নাতে ধরবে বলে জানে মেরে ফেলতে চায়নি।

এমনিতেই বাড়িটার অবস্থান গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে, বাড়িটার পরপরই আদিগন্ত খোলা প্রান্তর। মাঝে কিছু ঝোঁপ-ঝাড় থাকায় রক্ষা। একটু পরপর এই ঝোঁপগুলোর আড়ালে দাঁড়িয়েছে ওরা, দেখার চেষ্টা করেছে কেউ পিছু ধাওয়া করছে কি না। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, কেউ পিছু ধাওয়া করেনি। খোলা প্রান্তরের শেষ সীমায় পাথুরে টিলা। এখানে বরফের আধিপত্য নেই তেমন। অন্য অনেক জায়গার চেয়ে এই এলাকায় তাপমাত্রাও একটু বেশি। তাই ঘেমে যাচ্ছিল রাশেদ, ব্যাগটা মনে হচ্ছিল অনেক ভারি। মাঝে মাঝে ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু উপায় নেই।

পাথুরে টিলার নীচে এসে দাঁড়িয়েছে রাশেদ। অনেক দূরে গ্রামটা দেখা যাচ্ছে। অল্প কিছু বাতি জ্বলছে নিভছে জোনাকি পোকার আলোর মতো। আজ রাতে আরামের ঘুম হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা আর হচ্ছে না। বিকেলে কিছুটা ঘুমিয়ে নিয়েছিল বলে তেমন ক্লান্তি লাগছিল না রাশেদের। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছিল রাশেদ। রাজু এখনো কিছুটা দূরে। দৌড় থামিয়ে দিয়ে হেঁটে আসছে ক্লান্ত ভঙ্গিতে।

একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসল রাশেদ। পাথুরে টিলার উপর উঠবে কি সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এমনিতে তার সিগারেটের খুব একটা অভ্যাস নেই, কিন্তু এখন মনে হচ্ছিল একটা সিগারেট হলে খারাপ হতো না।

রাজু এসে বসল পাশে, চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ছেলেটাকে দেখে মায়াই হলো রাশেদের। তার কারনে এতদূর এসে ঝামেলায় পড়েছে, তবে ঝামেলায় পড়েছে একথা কখনোই স্বীকার করবে না। মাঝে মাঝে মনে হয় এই ধরনের সমস্যা রীতিমতো উপভোগ করে ছেলেটা।

তোর মতো ঘুমিয়ে নিলেই পারতাম, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল রাজু। এমন আচমকা বিপদ আসবে কে জানতো?

হু, এখন কি করবো আমরা? জিজ্ঞেস করলো রাশেদ, যদিও জানে এই প্রশ্নের উত্তর রাজুর জানা নেই।

আমি ঘুমাবো, রাজু বলল, চারপাশে তাকাল, তুই আমাকে পাহারা দিবি, ঘন্টা তিনেক পর তুই ঘুমাবি, আমি পাহারা দেবো।

তা ঠিক আছে, রাশেদ বলল, কিন্তু তিব্বতে যাওয়ার কি হবে? আদৌ কি তিব্বতে যাওয়া জরুরি? তোর কি ধারনা?

দোস্ত, আমার কোন ধারনা নেই, আমি ঘুমাবো, তুই ব্যবস্থা কর, বলে চোখ বন্ধ করলো রাজু।

ব্যাগে ছোট একটা কম্বল আছে, রাজুর শরীরে জড়িয়ে দিলো রাশেদ। সে নিজে ভারি একটা সোয়েটার বের করে পড়ল। বিকেলে ঘুমালেও টানা তিন ঘন্টা জেগে জেগে পাহারা দেয়া কঠিন একটা কাজ হবে। তবু কিছু করার নেই। ব্যাগ থেকে পিস্তলটা বের করে কোলের উপর রাখল রাশেদ, দৃষ্টি সামনের দিকে। হাত ঘড়ির দিকে তাকাল, বেশি বাজেনি,রাত নয়টা মাত্র। অন্তত বারোটা পর্যন্ত জেগে থাকতে হবে।

রাজু এরমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মনে মনে আগামীকালের প্ল্যান গুছিয়ে নিচ্ছে। রাশেদ। ড. আরেফিন কোদারি গ্রামে নেই, তিনি হয় মারা পড়েছেন নয়তো তিব্বতের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন দলের বাকি সদস্যদের সাথে। ড. কারসনের নেতৃত্বে যে দলটা সাম্ভালার খোঁজে বের হয়েছে ওদের সাথে দেখা হলেই কেবল আসল সত্যটা জানা যাবে।

তিব্বত, রহস্যময় ভূমি, আমি আসছি, মনে মনে বলল রাশেদ।

*

অধ্যায় ৩৭

ধ্যানে মগ্ন যজ্ঞেশ্বর, তার হাত দশেক দূরে দাঁড়ানো বিপদ সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই। ধ্যানে সবসময় মনোযোগ আসে না, তবে তিব্বতে আসার পর থেকে মানসিক অবস্থার দারুন এক পরিবর্তন উপলধ্বি করতে পারছে যজ্ঞেশ্বর, এখানে সে আগের তুলনায় অনেক নিবিষ্ট মনে ধ্যান করতে পারে।

শিকারী যেমন শিকারের কাছাকাছি এসেও অপেক্ষা করে সঠিক মুহূর্তটার জন্য, ঠিক তেমনই এক পরিস্থিতির শিকার হতে যাচ্ছে যজ্ঞেশ্বর। শিকারি এখানে অনেক মনোযোগী, প্রতিটি নিঃশ্বাস নিচ্ছে শিকারের পরিস্থিতি বুঝে। কোথাও কোন শব্দ নেই, বাতাসও বইছে না, সকালের আলো আছে পর্যাপ্ত, শিকারের জন্য একেবারে উপযুক্ত পরিবেশ। এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে শিকারি, হাতে ধারাল একটা কিছু, সকালের আলো তার নগ্ন শরীরে পড়ে যেন প্রতিফলিত হচ্ছে চারপাশে। আর দুএক পা দিলেই শিকারের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে সে।

যজ্ঞেশ্বর যে জায়গাটা বেছে নিয়েছে তা কিছুটা বিপজ্জনক। একেবারে খাদের পাশে। অনেক নীচে ঝর্নার পানি বয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে। আকাশের প্রেক্ষাপটে খোলামেলা জায়গাটা একজন সন্ন্যাসীর ধ্যান করার জন্য আদর্শ হলেও সাধারন মানুষ, বিশেষ করে যাদের উচ্চতাভীতি আছে, তারা এমন খাদের পাশে গিয়েও দাঁড়াবে না কখনো।

ধ্যানমগ্ন অবস্থায়ও নিজের বিপদ অনুভব করতে পারল যজ্ঞেশ্বর, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। চিৎকার করতে গিয়ে দেখল তার গলা থেকে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। অর্ধ নগ্ন একটা মানুষ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, হাতে একটা পাথর খন্ড ধরা, সূচালো পাথর খন্ডটা ধারাল, দিনের পর দিন শান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। লোকটার চেহারা দেখার চেষ্টা করল যজ্ঞেশ্বর, কিন্তু সূর্যের আলোর বিপরীতে চেহারা দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে বিশালদেহী কেউ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, পরনে ছিন্নবিচ্ছিন্ন জিন্সের প্যান্ট, উর্ধাঙ্গে কোন কাপড় নেই।

লখানিয়া সিং এই লোকটাকে এড়িয়ে চলছে, নেপালে ঢোকার পর থেকে কোন খানেই বেশিক্ষন স্থির থাকেনি,বারবার স্থান পরিবর্তন করার কারন এই অর্ধ নগ্ন মানুষটাই, ভাবল যজ্ঞেশ্বর। এমনকি, গতকাল সন্ধ্যায় চমৎকার একটা জায়গা ছেড়ে এখানে আসার পেছনেও আছে এই লোক। তিব্বতের মতো শীতপ্রধান অঞ্চলে কিভাবে একজন মানুষ অর্ধ নগ্ন থাকে তা মাথায় ঢুকছে না তার।

গুম্ফার প্রবেশপথে লখানিয়া সিং-কে দেখতে পেল যজ্ঞেশ্বর, এখনো তাকায়নি এদিকে। কোনমতে ডান হাত নাড়াল যজ্ঞেশ্বর। লখানিয়া সিং দেখতে পেয়েছে কি না বুঝতে পারল না। অর্ধ নগ্ন লোকটা এগিয়ে আসছে, হাতের পাথর খন্ডটা উপরে তুলে ধরেছে, কী হতে চলেছে অনুমান করতে পারছে যজ্ঞেশ্বর, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার মাথায় আঘাত করতে যাচ্ছে…

মাথার উপর থেকে হঠাৎ ছায়াটা সরে গেল, তাকাল যজ্ঞেশ্বর, তার সামনে দাঁড়ানো কেউ নেই। অর্ধ নগ্ন লোকটা হাঁটু গেড়ে বসে আছে। এবার চেহারাটা পরিস্কার দেখতে পেল যজ্ঞেশ্বর। এতো সুন্দর মানুষ হতে পারে ধারনা করাও কঠিন। দেবতার চেহারা বসানো যেন। কিন্তু এই মুহূর্তে লোকটার চেহারায় যন্ত্রনার ছাপ। মাথার একপাশে হাত দিয়ে বসে আছে, রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে হাতটা। ক্রমাগত রক্তক্ষরন হচ্ছে, সম্ভবত ভারি কোন কিছুতে আঘাত পেয়েছে। আচমকা কী সে আঘাত পেল বুঝতে পারছে না যজ্ঞেশ্বর। দূর থেকে কিছু কী ছুঁড়ে দিয়েছে লখানিয়া সিং?

গুফার প্রবেশপথের দিকে তাকাল যজ্ঞেশ্বর, লখানিয়া সিং নেই সেখানে। বিনোদ চোপড়া দাঁড়িয়ে আছে শুধু, দূর থেকেও ওর চেহারায় লেগে থাকা বিস্ময়ভাবটা দৃষ্টি এড়ালো না যজ্ঞেশ্বরের। লখানিয়া সিং কোথায়?

আর একটু পেছালেই খাদ, অন্তত দশফুট চওড়া খাদের অপরপ্রান্তে শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল। যজ্ঞেশ্বর সামনের দিকে তাকাল। বেশ খানিকটা দূরে লখানিয়া সিং-কে দেখা যাচ্ছে। ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। তার প্রতিপক্ষের দিকে।

অর্ধ নগ্ন লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছে, পেছনে একবার তাকিয়ে লখানিয়া সিং-কে দেখল। রক্তে দুই হাত ভিজে গেছে, দুই হাত জিন্সের প্যান্টে মুছে যজ্ঞেশ্বরের দিকে তাকাল।

আমি আবার আসবো, পরিস্কার ইংরেজিতে বলল নোকটা।

এরপরের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না যজ্ঞেশ্বর। তাকে পাশ কাটিয়ে এক লাফে দশ ফুট চওড়া খাদ পেরিয়ে ওপারে চলে গেল অর্ধ নগ্ন লোকটা। পেছন ফিরে তাকাল

একবার, তারপর গভীর জঙ্গলে হারিয়ে গেল।

আপনি ঠিক আছেন? লখানিয়া সিং জিজ্ঞেস করল, হাত দিয়ে টেনে তুলল যজ্ঞেশ্বরকে।

ঠিক আছি। লোকটা কে?

আমি চিনি না।

মুখ কুঁচকে গেল যজ্ঞেশ্বরের।

আপনি কে বলুন তো? ওর মাথায় রক্ত এলো কিভাবে?

হাতের কাছে বড় একটা পাথরের টুকরো ছিল, ওটাই ছুঁড়ে মেরেছিলাম, ঠিক মাথায় লেগেছে।

এতো দূর থেকে নিশানায় লাগিয়ে ফেললেন?

আমার নিশানা খুব পাকা, যজ্ঞেশ্বর জী।

লোকটা কে?

এইসব প্রশ্নের উত্তর পাবেন একসময়, এখন চলুন, বলে হাঁটতে থাকল লখানিয়া সিং।

ধীর পায়ে পেছন পেছন হাঁটছে যজ্ঞেশ্বর। এই দুটো প্রশ্নের উত্তর খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। লখানিয়া সিং আসলে কে? আর অর্ধ নগ্ন মানুষটাই বা কে?

সে কিন্তু একটা কথা বলে গেছে, যজ্ঞেশ্বর বলল।

কী?

সে আবার আসবে।

হাসল লখানিয়া সিং।

আমি জানি। আমি প্রস্তুত।

***

এতোটা কাছাকাছি এসেও নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই অবাক হচ্ছিল মিচনার। নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে। এতে অল্পে কাতর হয়ে পিছু হটা ঠিক হয়নি। সাধারন এক গেড়ুয়ারি তার লক্ষ্যবস্তু নয়। অথচ আসল লোকের পেছনে না ছুটে বৃথা সময় নষ্ট করেছে সে। তার মাশুলও দিতে হচ্ছে এখন। প্রতিদ্বন্ধী লোকটা এতো কাছাকাছি থাকবে বুঝতে পারেনি সে। এছাড়া এতোদূর থেকে এভাবে কেউ নিশানা করতে পারে সেটাও তার ধারনার বাইরে ছিল। এমন আচমকা একটা পাথরের টুকরো এসে লাগবে তা কল্পনাও করেনি মিচনার। সেই পরিস্থিতিতে প্রতিদ্বন্ধীর মুখোমুখি হওয়াটা বোকামি হয়ে যেত। নিজের সর্বোচ্চ শক্তির প্রয়োগ ঘটানোর মতো অবস্থায় থাকলেই কেবল লোকটাকে হারানো সম্ভব। তাই, পালিয়ে এসে খুব একটা ভুল করেনি। মাথার একপাশে এখনো প্রচন্ড ব্যথা। রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে কিছুক্ষন আগে। বেশ ক্লান্তবোধ করছে সে এখন। ছোট একটা গুহার মতো জায়গা বেছে নিয়েছে আপাতত। আজ রাতটা এখানেই কাটাবে।

খাদের অপর প্রান্তে আছে তার প্রতিদ্বন্ধী। লোকটাকে হাল্কাভাবে নিয়ে ভুল করেছে। ওর সঙ্গিরা সাধারন মানুষ। যেকোন সময় ওদের শিকার করা যাবে। তার আগে আসল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হবে। নইলে সব বৃথা। এতো পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে এই এতোদূর আসা, সব।

*

ধ্যায় ৩৮

পথ বন্ধুর, এমনিতে ছোট-খাট পাহাড়-পর্বতে উঠার অভিজ্ঞতা আছে লতিকার, কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে একটানা হেঁটে যাওয়া কিছুটা কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছে তার জন্য। কখনো একটানা উপরের দিকে উঠতে হচ্ছে, কখনো নামতে হচ্ছে নীচে। কৈলাস রেঞ্জের পবতগুলোর উচ্চতা খুব বেশি না হলেও, এখানকার আবহাওয়া বেশ বিরুপ। ঝড়ো বাতাস আর মেঘলা আকাশ এখানে নিত্যসঙ্গি। মাঝে মাঝে ড. কারসনের সাথে টুকটাক কথা হচ্ছে। বেশিরভাগই প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কিত। এমন একজন লোকের সাথে সরাসরি কাজ করতে পারাটাও ভাগ্যের ব্যাপার। যদিও লোকটা সম্পর্কে অদ্ভুত কিছু তথ্য এসেছে হাতে। বলতে গেলে তা বের করার জন্যই লতিকার এতোদূর আসা। কিন্তু এখন পর্যন্ত ড. কারসনের কথাবার্তায় কিংবা আচরনে তেমন কোন ইঙ্গিত পায়নি লতিকা। খুবই প্রানখোলা এবং যুক্তিবান মানুষ মনে হচ্ছে তাকে, অদ্ভুত, অযৌক্তিক কোন ধ্যান-ধারনার বিকাশ এই লোকের দ্বারা সম্ভব না।

বিকেল হয়েছে বেশ অনেকক্ষন হলো। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। হাঁটতে কষ্ট হলেও চেহারায় হাসিখুশিভাবটা বজায় রেখেছে লতিকা। তার কারনে দলের গতি কমে যাক এটা সে চায় না। ড. কারসনকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি বেশ উপভোগ করছেন। মাঝে মাঝে মজার কিছু বলে চাঙা করার চেষ্টা করছেন সবাইকে। সুরেশও সায় দিচ্ছে মাঝে মাঝে। একমাত্র সন্দীপকেই বেশ নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে। সকাল থেকে একেবারে চুপ মেরে আছে। ওর মনের ভেতর কি চলছে বুঝতে পারছে লতিকা। কিন্তু এ ব্যাপারে সে নিজে কোন কথা বলতে রাজি নয়। অতীতে যা ঘটেছে তা অতীতে পড়ে থাক, তাকে আর বর্তমানে টেনে আনার কোন ইচ্ছেই তার নেই।

সন্ধ্যার আগে আগে ইশারা করল সুরেশ। এবার থামতে হবে। জায়গাটা বেশ ভালোই বেছে নিয়েছে সুরেশ। রাত কাটানোর জন্য একেবারে আদর্শ। ছোট একৗ টিলার মাথা, বেশ সমান জায়গাটা, উপরে উঠার রাস্তা একটাই, বাকি তিনপাশ অসমান সেখান দিয়ে কেউ উঠতেও পারবে না, নামতেও পারবে না। এই অঞ্চলে অবশ্য বন জন্তুর আক্রমনের ভয় কম। সে হিসেবে জায়গাটা বেশ নিরাপদ।

আজ রাতে আমরা এখানেই থাকছি, ঘোষনা দিলেন ড. কারসন। লতিকার দিকে এগিয়ে এলেন। কষ্ট হচ্ছে লতিকা?

না, হেসে বলল লতিকা, আমার অভ্যাস আছে।

তোমাকে দেখে কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।

বাবা থাকলে কিন্তু আরো বেশি সমস্যা হতো। হাসলেন ড. কারসন। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে আমরা বসবো।

আমি তৈরি, ড. কারসন।

ড. কারসন চলে গেলেন। তিব্বতি মুটে চারজন মালপত্র নামিয়ে রাখছে। ছোট ছোট তাঁবুগুলো কিভাবে খাটাতে হবে তা দেখিয়ে দিচ্ছে সুরেশ। ড. কারসন সুরেশের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ দেখতে থাকলেন। বাতাসের বেগ বাড়ছে ক্রমশ। এই বেগ আরো বাড়ার আগেই কাজ সারতে হবে।

.

তাঁবুগুলো খাটানো হয়েছে, অন্যদিনের তুলনায় রাতের আকাশ অনেক পরিস্কার, বিকেলে যে ঝড়ো হাওয়া বয়ে গিয়েছিল তা থেমে গেছে অনেক আগেই। যে যার মতো বিশ্রাম সেরে রাতের খাবারের জন্য বেড়িয়ে এসেছে তাঁবু থেকে। অন্যান্য বারের মতো সুরেশের তত্ত্বাবধানেই হচ্ছে সব কিছু। তিব্বতি মুটেরা আলাদা বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।

রাতের খাবার হিসেবে আছে মোটা রুটি আর মাখন। স্থানীয় বাজার থেকে কিনে এনেছিল সুরেশ। সেই সাথে চায়ের ব্যবস্থাও করেছে। ইয়াকের ঘন দুধ দিয়ে তৈরি এই চা খেতে গিয়ে কেমন বমি চলে আসছিল লতিকার। কোনমতে নিজেকে সামলালো সে। আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসেছে দলটা। ড. কারসন কিছু বলবেন বলে গলা পরিস্কার করে নিলেন।

মি. সন্দীপ, আপনাকে বেশ বিষণ্ণ দেখছি, কোন সমস্যা? ড. কারসন বললেন।

অন্যমনস্ক ছিল সন্দীপ, নিজের নাম শুনে তাকাল ড. কারসনের দিকে।

কোন সমস্যা নেই, ড. কারসন, সন্দীপ বলল, আসলে অনেক দিন বাড়ি থেকে এতোদূরে থাকিনি,হয়তো তাই একটু মন খারাপ।

বুঝতে পেরেছি, ড. কারসন বললেন, আর খুব বেশি দিনের ব্যাপার নয়। খুব শিগগিরি ফিরতে পারবেন।

যে কাজে এসেছি তা শেষ করেই ফিরতে চাই, সন্দীপ বলল, চায়ে চুমুক দিতে দিতে।

তা তো অবশ্যই, এই বুড়ো বয়সে মাঠে নেমেছি কি এমনি এমনি, ড. কারসন হাসলেন। কাল ভোরে রওনা দেবো আমরা। আশা করি পরশু বিকেলের আগে কৈলাসের আশপাশে পৌঁছাতে পারবো।

এতো তাড়াতাড়ি পারবো বলে মনে হয় না, সুরেশ বলল, এখানে আরো কিছু সমস্যা হতে পারে, যেমন ঝড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে, এছাড়া…।

এছাড়া…।

চীন সরকার চায় না আমরা এই অভিযানে সফল হই, কাজেই কোন না কোন বাঁধা আসবেই।

আপনি কি করে জানেন, বাঁধা আসবে?

ড. কারসন, কেউ একজন সন্দীপ এবং প্রফেসর সুব্রামানিয়ামকে হুমকি দিয়েছিল, সম্ভবত চায়নীজ এন্টিলিজেন্সের লোক। তারাই সম্ভবত ড. আরেফিনকে অপহরন করেছে। আর আমাদের বিনা বাঁধায় ছেড়ে দেবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না।

আমরা গবেষক, বৈজ্ঞানিক, চোরাচালানী নই, মাদক-ব্যবসায়ী নই। আর এছাড়া চাইলেই তো ওরা আমাদের উপর আক্রমন করতে পারে, যেমন ড. আরেফিনকে অপহরন করেছে।

আপনাকে কেউ চোরাচালানী বা মাদক ব্যবসায়ী বলেনি ড. কারসন। আমাদের উপর আক্রমন না করার একটাই কারন হতে পারে, সেটা হচ্ছে…

ওরা চায় আমরা যেন সাম্ভালা খুঁজে বের করি? লতিকা বলবে পাশ থেকে।

ঠিক তাই। একবার সাম্ভালা খুঁজে বের করে ফেললেই ওরা আক্রমন করবে। ভারত সরকার এখানে কোন সাহায্য করতে পারবে না। অন্য দেশের ভেতর আক্রমন করার কোন ইচ্ছেই সরকারের নেই। তবে আমাকে পাঠিয়েছে সত্যিই সাম্ভালা বলে কোন জায়গা আছে কি না তার সত্যতা যাচাই করতে। সরকারের উঁচু পর্যায়ে সাম্ভালা, নাইন আনোন ম্যান এই ধরনের মিথে বিশ্বাস করেন, এমন অনেক লোক আছে।

তুমি বিশ্বাস করো না?

চোখে না দেখে কিছুই বিশ্বাস করি না আমি, উঠে দাঁড়াল সুরেশ। তার তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেল। হেড কোয়ার্টারে আজকের রিপোর্ট পাঠাতে হবে।

সন্দীপ আর ড. কারসনকে শুভরাত্রি বলে লতিকাও চলে এলো নিজের তাঁবুতে। একটা সিগারেট ধরালো সন্দীপ। ড. কারসনের দিকে বাড়িয়ে দিলো একটা।

সুরেশের উপর ভরসা করা ঠিক হবে না, ড. কারসন? সন্দীপ বলল সিগারেটে টান দিতে দিতে। বিপদে হয়তো ওর কাছ থেকে সাহায্য নাও পেতে পারি আমরা।

আপনার কাছে পিস্তলটা আছে মি. সন্দীপ?

জি, আছে।

ওটা সবসময় কাছাকাছি রাখবেন, বললেন ড. কারসন, উঠে দাঁড়ালেন, আক্রমন যে কোন সময় হতে পারে। আমাদের প্রস্তুত থাকা ভালো।

ড. লতিকা নিরস্ত্র…

ওকে নিয়ে ভাববেন না, ওর ব্যবস্থা আমি করবো, তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেলেন ড. কারসন।

নিভতে থাকা আগুনের পাশে বসে রইল সন্দীপ। সারাদিন পরিশ্রমের পরও তার ঘুম আসছে না, কিন্তু ঘুম খুব দরকার। পরের রাতে ঘুমাতে পারবে কি না সেই নিশ্চয়তা নেই। কাঠমুন্ডুতে যে লোকটা হুমকি দিয়েছিল তার কথা মনে পড়ে গেল। স্রেফ অপহরন করতে চেয়েছিল তাকে, সময়মতো সুরেশ উপস্থিত না হলে এতোক্ষনে ড. আরেফিনের মতো যন্ত্রনাভোগ করতে হতো। মনে হচ্ছে অভিযানে এসে জীবনটাই ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে। ড. আরেফিনের মতো মানুষ বেঁচে আছেন কি না কে জানে।

*

অধ্যায় ৩৯

ভোরে ঘুম ভাঙ্গল রাশেদের। বাজে একটা স্বপ্ন দেখছিল, ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়, অথচ কি স্বপ্নে দেখছিল তাই মনে করতে পারল না। শুধু মনে হচ্ছে অতি ভয়ংকর কিছু স্বপ্নে দেখেছে সে। ছয়টা থেকে নয়টা পর্যন্ত রাজুর পাহারা দেয়ার কথা। কিন্তু পাহারা অনেক দূরের ব্যাপার, রাজুকে এখন টেনে ঘুম থেকে উঠানো যাবে কি না সন্দেহ।

চারপাশ কুয়াশায় ঢাকা, দশ হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। ভারি একটা সোয়েটার গায়ে দিয়েছিল গত রাতে, নইলে এই শীতে এতোক্ষনে জমে যাওয়ার কথা। একটা সিগারেট ধরালো রাশেদ, শীত শীতভাবটা কাটানোর জন্য। কাজ হচ্ছে বলে মনে হলো না। বিরক্তিতে ছুঁড়ে ফেল দিল।

পাথরে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইল রাশেদ, তন্দ্রামতো হচ্ছে। স্বপ্নে কী দেখেছিল মনে করার চেষ্টা করছে। একদম মনে পড়ছে না, শুধু স্বপ্নে তার দাদা আব্দুল মজিদ ব্যাপারির কোন ভূমিকা ছিল এটুকু মনে আছে। কতোদিন বৃদ্ধ দাদার সাথে দেখা হয়নি। বুড়ো মানুষটা কিভাবে হারিয়ে গেলেন সেটাই আশ্চর্য বিষয়। থানা-পুলিশ, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, মাইকিং- কম চেষ্টা করা হয়নি। কিন্তু লোকটা উধাও হয়ে গেছে, যেন কখনো ছিল না।

আধ ঘন্টা পর চোখ খুলল রাশেদ, কুয়াশা কমেনি,বরং আরো ভারি হয়েছে মনে হচ্ছে। এখান থেকে ঠিক কোনদিকে গেলে তিব্বত সীমান্ত অতিক্রম করা যাবে কোন ধারনাই নেই। কাস্টমস একটা চেকপোস্ট আছে, যেহেতু স্পেশাল পাস নেয়া আছে, বৈধভাবেই তিব্বতে ঢোকা উচিত হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আহমদ কবির জানে, তারা দুজন তিব্বতের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। তিনি যে আকবর আলী মৃধাকে নিয়ে চেকপোস্টে তাদের ধরার জন্য অপেক্ষা করবে না সেটার নিশ্চয়তা নেই। পিছু ধাওয়া না করে বরং সেই চেকপোস্টে অপেক্ষা করাই ওদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে, সম্ভবত এই জন্যই গতকাল রাতে পেছনে ধাওয়া করার ঝামেলায় ওরা যেতে চায়নি।

রাজুকে ডাকতে হলো না, এমনিতেই উঠে পড়ল।

সব ঠিক আছে তো? আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, উদ্বিগ্ন স্বরে বলল রাজু।

সব ঠিক আছে, রাশেদ বলল। এখান থেকে যেতে হবে এখন। সীমান্ত পার করতে হবে।

চরনদাস আমাকে চেকপোস্ট কোনদিকে দেখিয়েছিল, উত্তর দিকে সম্ভবত।

সেখানে ওরা নিশ্চয়ই আমাদের অপেক্ষায় থাকবে।

তাহলে কি করবো?

কিছু একটা করতে হবে, তবে সেটা কি এখনই বলতে পারছি না, রাশেদ বলল, এখান থেকে চল আগে।

উঠে দাঁড়াল রাশেদ, সারা শরীর ব্যথা করছে। চোখ লাল হয়ে আছে তা আয়নায় না তাকিয়েই বুঝতে পারছে। কিন্তু কিছু করার নেই। ঢাকায় না ফেরা পর্যন্ত স্বস্তি পাওয়া যাবে না কোথাও।

রাজুও হাঁটছে পাশাপাশি। বাড়িটা যে দিকে ফেলে এসেছিল, তার উল্টোদিকে হাঁটছে ওরা। এমনও হতে পারে আকবর আলী মৃধা এখনো ঐ বাড়িটায় অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। তবে স্বস্তির ব্যাপার হচ্ছে খুব বেশি লোকজন নিয়ে আসেনি আকবর আলী মৃধা। আহমদ কবির ছাড়াও বিশালদেহি একজন যুবক আছে সাথে। আহমদ কবিরকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, বয়স্ক মানুষ, রাজু নিজেই সামলাতে পারবে। কিন্তু ঐ বিশালদেহির সাথে ভুলেও লাগতে যাওয়া যাবে না। শক্ত কাঠের দরজা যে মানুষ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারে, তার সাথে যথাসম্ভব দূরত্ব রাখার চেষ্টা করবে বলে মনে মনে ঠিক করলো রাজু।

ব্যাগ দুটোতে দৈনন্দিন ব্যবহার করার জিনিসপত্র, টাকা আর পাসপোর্ট আছে। ধীরে ধীরে হাঁটছে দুজন। এই এলাকায় সাধারনত ভেড়া আর ইয়াক চড়ায় গ্রামের রাখাল বালকেরা। এমনই একটি ছেলেকে দেখে এগিয়ে গেল রাশেদ।

রাখাল ছেলেটা সাধারন নেপালিদের মতো খাটো নয়, বরং বেশ চমঙ্কার সুন্দর চেহারা। বয়স পনেরোর কাছাকাছি, মুখ হাসি হাসি। সম্ভবত রাশেদ আর রাজুর বেশভুষা দেখে মজা পেয়েছে সে। যেসব পর্যটকরা আসে এখানে, তারা সবাই প্রায়সাহেব, তাদের পোশাক-আশাকে বিন্দুমাত্র ধুলো কখনো চোখে পড়েনি। অথচ এই দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে মাটির সাথে রীতিমতো গড়াগড়ি খেয়েছে ওরা। এলোমেলো চুল, চোখের নীচে কালি পড়ে গেছে এরমধ্যে।

ছেলেটা ইংরেজি জানে না, রাশেদের কথা এক বর্ন বুঝতে পারছে কি না সন্দেহ। উদ্ধার করতে এগিয়ে এলো রাজু। ইশারা ইঙ্গিতে কাস্টমস অফিসে কিভাবে যাওয়া যাবে সেটা জানাই আপাতত মূল লক্ষ্য। কোদারি নামটা বুঝতে পারলেও কাস্টমস অফিস আর তিব্বতে যাওয়ার ব্যাপারটা কোনভাবেই ইশারা ইঙ্গিতে বোঝাতে পারছিল না রাজু।

হতাশ হয়ে ছেলেটাকে রেখে এগিয়ে গেল ওরা দুজন। অচেনা একটা জায়গায় এলোমলোভাবে সারাদিন ঘুরেও কোন লাভ হবে না, অথচ এই এলাকায় ঐ কিশোর ছেলেটা ছাড়া আর কোন মানুষ চোখে পড়েনি এখন পর্যন্ত। ক্ষুধাও পেয়েছে বেশ। গতকাল সন্ধ্যায় রাজু তবু কিছু খেয়েছিল, কিন্তু রাশেদ অভুক্ত সেই দুপুরের পর থেকে। গলা শুকিয়ে কাঠ।

আরো ঘন্টা তিনেক হাঁটল দুজন। অন্তত কয়েক মাইল হাঁটা হয়েছে। রাজু ঠিকমতো হাঁটতে পারলেও কষ্ট হচ্ছে রাশেদের। ওর হাত থেকে ব্যাগগুলো নিয়েছিল রাজু। তাতে কিছুটা হলেও হাঁটতে পারছিল রাশেদ। কোদারি গ্রাম থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে ওরা। অনেক দূরে শুধু উঁচু পাহাড় চোখে পড়ে, মাঝখানের এই সমতল ভূমিটা যেন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গিয়ে মিশেছে। অনেক দূরে, চোখে পড়ে কি পড়ে না এমন একটা ছায়া চোখে পড়ল। হাত নাড়াচ্ছে।

পড়ে গেল রাশেদ, হোঁচট খেয়ে। কিছুটা অবাক হয়েছে রাশেদ নিজেই। রাজু পিছিয়ে এসে তুলে ধরল।

হাত নাড়াচ্ছে কে? কোনমতে বলল রাশেদ।

চরনদাস।

হাত নাড়াতে লাগল রাজু। আপাতত এখানে কিছুক্ষন বিশ্রাম নেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।

সেই ছায়াটাকে এগিয়ে আসতে দেখল রাজু। হ্যাঁ, চরনদাসই! এই বোবা ড্রাইভারই এখন একমাত্র ভরসা।

***

যজ্ঞেশ্বর এখন বেশ স্বাভাবিক, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে এটা বিশ্বাস করতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। গুম হয়ে বসেছিল অনেকক্ষন। এখন আবার বিনোদ চোপড়ার সাথে আড্ডায় মেতে উঠেছে।

তিনি নিজেও বেশ অবাক হয়েছেন, এতো সহজে ঐ মানুষটা চলে যাবে এটা ভাবতেও পারেননি। তবে যে পাথরটা ছুঁড়ে মেরেছিলেন সেটা যে লক্ষ্যভেদ করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। একেবারে মাথায় আঘাত করাতে বোধহয় কিছুক্ষনের জন্য হলেও হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল তার প্রতিদ্বন্ধী, ভাবলেন তিনি। এছাড়া এভাবে পালানোর আর কোন কারন নেই। প্রশস্ত খাদটা এক লাফে পার হয়ে ওপাশের জঙ্গলে নিমিষেই হারিয়ে গেল। তবে এতে নিশ্চিন্ত হওয়ার কোন কারন নেই, অদ্ভুত লোকটা এখন আশপাশেই আছে, একেবারে নাগালের মধ্যে। যে কোন সময় আঘাত আসবে আবার। তবে এবার যজ্ঞেশ্বর কিংবা বিনোদ চোপড়ার উপর আঘাত হানার মতো বোকামি করতে যাবে না তার প্রতিদ্বন্ধী। সরাসরি তাকেই আক্রমন করবে।

প্রতিদ্বন্ধীকে মোকাবেলা করার কোন প্রস্তুতিই নেই তার। বড় একটা পাথরের ফলা নিয়ে বসেছেন তাই। গুম্ফার দেয়ালে হেলান দিয়ে, গোলাকার একটা পাথরের টুকরোর উপর অনবরত শান দিয়ে যাচ্ছেন পাথরের ফলাটায়। একপাশ এরমধ্যে ধারাল হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করে দেখছেন।

খাবার হিসেবে ছোট একটা খরগোশ শিকার করেছিলেন, সেটাই আগুনে পুড়িয়ে নিয়েছে বিনোদ চোপড়া। খাওয়া-দাওয়া সেরে গল্প করছে দুজন। গুফার ঠিক মুখের দিকে বসে আছে ওরা। ভেতর থেকে ওদের হাসি-ঠাট্টা কানে আসছে তার।

পাথরের ধারাল ফলাটা এবার একপাশে রেখে দিলেন তিনি। ছোটখাট জিনিসটা কোমরে গুঁজে রাখার উপযুক্ত করতে হবে। দেয়ালে মাথা ঠেকালেন, ঘুম আসছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ঘুমানো ঠিক হবে না, বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বরের বিশ্বস্ততা নিয়ে ভয় না থাকলেও, কঠিন মুহূর্তে বিপদ সামলাতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। তার।

চোখ বুজলেন, জ্ঞান হারানোর পর কি হয়েছিল সেদিন মনে পড়ে গেল সাথে সাথে।

তুমুল বৃষ্টি, সাথে বজ্রপাত। অন্ধকারের মধ্যে দৌড়াচ্ছিলেন তিনি, যা, তারপর জ্ঞান হারায় মিনোস। তারপর কি হয়েছিল?

কতোক্ষন জ্ঞান ছিল না মনে নেই মিনোসের। চোখ খুলে তাকিয়ে বুঝতে পারল রাত হয়ে গেছে, বৃষ্টি হয়তো থেমেছে অনেকক্ষন আগে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার আর নীরবতা চারদিকে, শীতল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। মাথায় হাত বুলাল মিনোস। প্রচন্ড ব্যথা মাথার পেছন দিকটায়। সারা শরীরে বিভিন্ন জায়গায় কেটে ছড়ে গেছে। অন্ধকারে কি করবে বুঝতে পারছে না। তার হাতে বৃদ্ধের দেয়া সেই মাটির ফলক নেই। সেখানেই আলোকবর্তিকার সন্ধান ছিল। ঝড়ের মধ্যে কোথাও পড়ে গেছে। ঐ জিনিস ছাড়া সেই আলোকবর্তিকার সন্ধান কি পাওয়া যাবে?

কোনমতে উঠে দাঁড়াল মিনোস। পায়ের তলায় পাথরের কুচিগুলো সরে সরে যাচ্ছে, এখানে সেখানে ছোট ছোট গর্তগুলো পানিতে টুইটুম্বুর। অন্ধের মতো দুই পাশে হাত দিয়ে এগুচ্ছে মিনোস। আরেকটু এগিয়ে ডান দিকে পাহাড়ের অমসৃন দেয়ালে হাত ঠেকল। এবার দেয়াল ধরে এগুচ্ছে সে। রাতটা কাটানোর জন্য নিরাপদ একটা জায়গা পাওয়াটাই এখন জরুরি। এই অদ্ভুত এলাকায় কোথায় কোন বিপদ লুকিয়ে আছে তা আগে থেকে বোঝা অসম্ভব। যতো এগুচ্ছে দেয়াল ততো মসৃন হয়ে আসছে, আরো ডান দিকে সরে যাচ্ছে। চোখ খোলা রেখে এভাবে অন্ধের মতো হাঁটতে হয়নি কখনো। বৃদ্ধ হয়তো এইসব ঝামেলার কথা চিন্তা করেই এখানে আসেনি,ধারনা করলো মিনোস।

আরো কিছুদূর যাওয়ার পর পুরোপুরি বাঁক খেয়ে ডান দিকে বেঁকে গেছে দেয়ালটা। সামনে কি আছে কোন ধারনাই নেই মিনোসের। একটু দাঁড়াল এবার, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। কেমন গুমোট গরম চারদিকে। একটু আগেও যে শীতল হাওয়া লাগছিল গায়ে তা যেন হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে। উপরের দিকে তাকাল মিনোস। উপরে আকাশ নেই। চাঁদ কিংবা তারা কিছুই দেখা যাচ্ছে না, এমনকি যে কালো মেঘের দল আকাশকে আড়াল করে রেখেছে সেটাও যেন সীমাহীন।

এবার উঁচু হয়ে থাকা ছোট একটা পাথরের টুকরোয় হোঁচট খেল মিনোস। মসৃন দেয়াল ধরে নিজেকে ঠেকাতে চাইলেও পারল না, পড়ে গেল নীচে। কনুইয়ের দিকে কেটে গেছে বুঝতে পারছে মিনোস। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। একটু দূরেই বাতাসের সো সো শব্দ আসছে, কিন্তু তার বিন্দুমাত্র লাগছে না তার শরীরে। উপরের দিকে তাকাল আবার, হ্যাঁ, এবার বোঝা যাচ্ছে। উপরে আকাশ নেই, সে যে গুহায় ঢুকেছে তার ঘনকালো ছাদ আছে। বেশ অনেকক্ষন আগেই একটা গুহায় ঢুকেছে সে, নিজের অজান্তেই। বাইরের ঝড়-বৃষ্টি থেকে অন্তত এ জায়গাটা নিরাপদ।

মসৃন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসল মিনোস। গুহাটা কতো বড়, সামনে কি আছে, কোন ধারনাই নেই তার। শুধু মনে হচ্ছে, নিয়তিই তাকে টেনে এনেছে এই গুহায়। এখানেই তার মৃত্যু হবে, পৃথিবীর কেউ জানবেও না মিনোস নামের একজন মানুষ এখানে মরে পড়ে আছে।

মৃত্যুকে মোটেও ভয় পায় না মিনোস। শুধু একটাই আফসোস থাকবে, সব কিছু জানার, বোঝার যে ইচ্ছেটা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সেই ইচ্ছেরও মৃত্যু হবে তার মৃত্যুর সাথে সাথে।

আরো অনেককিছু মাথায় আসছিল মিনোসের। কিন্তু সারাদিন পরিশ্রমে শরীর খুব ক্লান্ত। বেশ নিরাপদ একটা জায়গা পেয়ে ঘুম আসছে তার, গভীর ঘুম। এই ঘুম ভাঙবে কি না জানে না মিনোস। কিন্তু ঘুমাতে তাকে হবেই। আরেকটু হেলান দিয়ে বসল মিনোস। ছোট একটা পাথরের টুকরো হাতের মুঠোয় নিলো। আপাতত আত্মরক্ষার জন্য এটুকুই তার সম্বল।

ঘুম ভাঙ্গল হঠাৎ করেই। মনে হচ্ছিল বৃদ্ধ অভিভাবক তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, ধবধবে সাদা পোশাক পরনে, হাতে লম্বা একটা লাঠি। যেন কিছু একটা বলছে তাকে, বিড়বিড় করে, চারপাশে অদ্ভুত সব শব্দ, সেই শব্দের কারনে বৃদ্ধের কথা সব চাপা পড়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধেও উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মিনোস, কিন্তু সেই হাত না ধরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন বৃদ্ধ, অনেকটা ভোজবাজির মতো। পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্ন ছিল, আধো ঘুম আর আধো জাগরনে দেখা অদ্ভুত স্বপ্ন, কারন চোখ খুলে বৃদ্ধকে দেখতে না পেলেও চারপাশে বিকট সব শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার যোগাড়। মনে হচ্ছে পুরো পাহাড় যেন ধ্বসে পড়ছে, পাথরে পাথরে ঘর্ষন হচ্ছে, প্রচন্ড বেগে পানি আছড়ে পড়লে যেমন শব্দ হয় ঠিক সেরকম শব্দ আসছে বাইরে থেকে। এই সময় এমন একটা গুহায় চুপচাপ বসে থাকা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এরচেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পাওয়াটা আরো জরুরি। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, হঠাৎ করেই অন্ধকার গুহাটা ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠলো। আলোর উৎসের খোঁজে চারপাশে তাকাল মিনোস।

গুহার চারপাশের দেয়াল ঝলমল করছে, পুরো দেয়াল জুড়ে কাঁচের মতো স্বচ্ছ কিন্তু দ্যুতিময় বস্তু, যেন দেয়ালগুলো তৈরিই হয়েছে এই স্বচ্ছ পদার্থ দিয়ে। এমনকি উপরে গুহার ছাদও তৈরি একই পদার্থ দিয়ে। হাত দিয়ে ছুঁড়ে দেখল মিনোস। ধারাল স্বচ্ছ কাঁচের টুকরোগুলো থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে, কিন্তু এই আলো আসছে অন্য কোন উৎস থেকে। এই স্বচ্ছ টুকরোগুলো কেবল সেই আলোকে প্রতিফলিত করছে। দেয়াল ধরে ধরে হাঁটতে শুরু করেছে মিনোস। হঠাৎ মনে হলো বাইরের সব শব্দ থেমে গেছে। চারপাশ একদম নীরব। কোথাও অস্বাভাবিকতা আছে, কোন একটা ঝামেলা আছে সামনে, নিজেকে তৈরি করে নিলো সে। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত। লম্বা টানেলের মতো গুহার দেয়াল ছুঁয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে। কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে গুহাটা বোঝা যাচ্ছে না। একটানা চোখ ধাঁধানো আলোয় তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে, মাঝে মাঝে তাই চোখ বন্ধ করে এগিয়ে যাচ্ছে মিনোস। মনে হচ্ছে গুহাটা এবার ঢালু হয়ে নীচের দিকে যাচ্ছে। মেঝে ক্রমশ মসৃন হয়ে আসছে। পা ফেলতে হচ্ছে সাবধানে, যে কোন সময় পা পিছলে গেলে গড়িয়ে নীচের দিকে পড়ে যাবে।

বড় করে নিঃশ্বাস নিলো মিনোস। গুহা ঢালু হয়ে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে, তাই দুহাত দুপাশে দিয়ে দেয়াল আকড়ে ধরে এগুচ্ছে সে, ঘেমে নেয়ে উঠেছে, এখন নীচের দিকে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। উপরের দিকে উঠা প্রায় অসম্ভব, সে ধরনের শারীরিক শক্তিও এখন আর অবশিষ্ট নেই।

সামনে একটা বাঁক, দেয়াল ধরে ধীরে ধীরে বাঁকটা পার হলো মিনোস। গুহাটা আরো ঢালু হয়ে গেছে সামনের দিকে, মনে হচ্ছে আরেকটু সামনেই গুহা শেষ হয়ে যাবে, সেখানে চমৎকার কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য, অথবা অপেক্ষা করছে মৃত্যু। ঘর্মাক্ত হাতে দেয়াল আঁকড়ে ধরতে দারুন কষ্ট হচ্ছে। গুহার এই অংশে আলো আরো উজ্জ্বল, চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আলোর উৎসের কাছাকাছি এসে পড়েছে সে। উত্তেজনায় ঘামতে লাগল মিনোস। আরেকটু এগুলেই কি সেই আলোকবর্তিকার কাছে পৌঁছে যাবে সে? এটাই কী সেই আলো যার দিক-নির্দেশনা বৃদ্ধ দিয়েছিলেন?

হয়তো এক মুহূর্তের জন্য অসতর্ক হয়ে পড়েছিল মিনোস, কপালের উপর জমে থাকা ঘাম মুছতে গিয়ে দেয়াল থেকে হাত ছুটে যাওয়াতে তাল সামলাতে পারলো না সে। মসৃন মেঝেতে নিজেকে আটকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাল। নীচের দিকে গড়িয়ে পড়তে পড়তে মেঝে আকড়ে থাকার চেষ্টা করল। কিন্তু কাজ হলো না। গুহা আরো ঢালু হয়ে নীচের দিকে নেমে গেছে। সেখানেই আলোর উজ্জ্বলতা সবচেয়ে বেশি।

নিজের অজান্তেই চিৎকার করে উঠলো মিনোস।

ঘেমে গেছেন তিনি, যেন ঘোরের ভেতর চলে গিয়েছিলেন। সামনে বসে থাকা দুজন মানুষকে প্রথমে ঠিক চিনতে পারলেন না, যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ চোপড়া উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

আমি ঠিক আছি, অস্ফুট স্বরে বললেন তিনি।

উঠে দাঁড়ালেন, সরে জায়গা করে দিলো যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ চোপড়া। বাইরের খোলা হাওয়ায় একটু দাঁড়াতে হবে। এমন এক অতীতে চলে গিয়েছিলেন যার অনেক কিছুই এখন মনে নেই। চাইলেও এখন আর তা মনে পড়বে না। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। খাদের ওপারের ঘন জঙ্গলের দিকে তাকালেন। দুপুর গড়িয়ে গেছে। কোথাও কোন নড়াচড়া চোখে পড়ল না।

*

অধ্যায় ৪০

সাধারনত দুপুরটা কাটে আচ্ছন্ন অবস্থায় অথবা তন্দ্রায়, এই আচ্ছন্নভাব সন্ধ্যায়ও কাটে না। সকালের নাস্তায় দুটো আইটেম থাকে, পাউরুটি আর কলা। সম্ভবত এইসব খাবারে কিছু একটা মেশায় এরা যা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আজ সেই আচ্ছন্নভাব নেই। নাস্তা দিতে যে লোকটা আসে তার আড়ালে কলা আর পাউরুটি না খেয়ে লুকিয়ে ফেলেছেন। লোকটা টের পায়নি,কিন্তু সেই না খাওয়া কলা আর পাউরুটি এখন বেশ অস্বস্তি তৈরি করেছে। শার্টের বোতাম গলে এখন গেঞ্জি আর শার্টের মাঝামাঝি আছে খাবারগুলো, পাউরুটিতে তেমন সমস্যা না হলেও, কলা এরমধ্যে নরম হতে শুরু করেছে, পুরো শরীরটা চিটচিটে লাগছে। কিন্তু কিছু করার নেই। সেই সন্ধ্যায় যখন বেরুতে পারবেন পাঁচ মিনিটের জন্য তখন এগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে।

আচ্ছন্ন অবস্থায় নেই বলেই আজ সকালে কেমন চাঞ্চল্য অনুভব করছেন তিনি। বাইরে সৈনিকদের হাঁকডাক বেশি শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখানে থাকার সময় শেষ হয়েছে। বেশ কিছুদিন হয়ে গেল ভ্যানটা একই জায়গায় আছে। রাতে প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য বাইরে গেলে আরো কিছু জিপ তার চোখে পড়েছে অবশ্য, সাথে ছোট ছোট কিছু তাঁবু। চায়নীজ অফিসার অল্প কিছু সৈনিক নিয়ে এখানে ঘাঁটি গেড়েছে বেশ কিছু দিন হলো। এক জায়গায় বেশিদিন থাকার নিয়ম হয়তো নেই, কিংবা তাকে নিয়ে অন্য কোন প্ল্যান আছে এদের, ভাবলেন তিনি।

ভ্যানের পেছনের গেট খোলার শব্দে চোখ বন্ধ করলেন তিনি। এখন পুরোপুরি অভিনয় করে যেতে হবে। কেউ একজন উঠেছে উপরে, হেঁটে আসছে তার দিকে। এমনভাবে চোখ খুললেন যেন চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে তার।

হেই প্রফেসর, চোখ খোেল, তরুন চায়নীজ অফিসার বলল।

চোখ খুললেন তিনি, বাইরে যদিও রোদ নেই, তবু অনেকদিন পর দিনের আলো চোখে পড়ল।

ড. কারসনের সাথে যে লোকটা ছিল, সে একটা স্পাই, ভারতীয়, ওর নাম সুরেশ, সে এখন কোথায়?

সুরেশ বলে একজন আছে, কোনমতে বললেন তিনি, কিন্তু সে তো শুধু গাইড মাত্র।

বলতে চাস তুই ওর আসল পরিচয় জানিস না?

সত্যিই জানি না। আমার সাথে খুব একটা কথা হয়নি।

আচ্ছা, মানলাম। এবার বল ড. কারসনের আসল মতলব কি? তিনি কি ভারতীয় সরকারের সাথে মিলে কাজ করছেন নাকি?

আমি জানি না। আমাকে সাম্ভালা খোঁজার জন্য ডেকেছিলেন তিনি, আর কিছু না।

সাম্ভালা! সাম্ভালা! সাম্ভালা! তোরা কি পাগল নাকি? এমন জায়গা আছে। পৃথিবীতে? উত্তেজিত তরুন অফিসার ভ্যানের দেয়ালে সজোরে আঘাত করল। পুরো ভ্যান কেঁপে উঠল।

নড়েচড়ে বসলেন ড. আরেফিন। বহুদিন ধরে একটা জিনিস জানার ইচ্ছে ছিল, এই তরুন চায়নীজ অফিসারের নাম। কখনোই নেমপ্লেট লাগানো অবস্থায় দেখেননি ওকে। আজ দেখলেন। তরুনের নাম চ্যাঙ লি। নামটা ভালোই লাগল।

শোন চ্যাঙ, সাম্ভালা আছে কি নেই আমি জানি না। তবে খুঁজে দেখতে তো কোন সমস্যা নেই, তাই না?

অবশ্যই সমস্যা আছে। অন্য দেশে ঢুকে তোরা ঘাঁটাঘাঁটি করবি এটা আমাদের ভালো লাগবে কেন।

তাহলে আমরা যদি চীন সরকারের অনুমতি চাইতাম, সে অনুমতি কি পাওয়া যেতো?

হাসল চ্যাঙ। বাঁকা হাসি।

আমাদের দেশে কি প্রত্নতাত্ত্বিকের অভাব,হু! ড. আরেফিনের শার্টের কলার খামচে ধরল চ্যাঙ। মজার ব্যাপার কি জানিস, এই প্রথম তোর সামনে নেমপ্লেটটা লাগালাম। কি কারনে বলতে পারবি?

কারনটা অনুমান করতে পারলেও মুখ খুললেন না ড. আরেফিন।

মৃত্যুর আগে তোর জানার অধিকার আছে কার হাতে মারা পড়েছিস তুই, বলে হাসল চ্যাঙ, তোর সঙ্গিসাথিরাও অবশ্য তোর পথ ধরবে। সেই দিকেই যাচ্ছি আমরা।

এতো বিনাকারনে মানুষহত্যা, আর কিছু না…

আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ড. আরেফিন, পারলেন না, বিদ্যুৎ বেগে চ্যাঙের হাত নেমে এলো তার গাল বরাবর। চেয়ারশুদ্ধ কাত হয়ে পড়ে গেলেও জ্ঞান হারালেন না তিনি। ভ্যান থেকে নেমে গেট বন্ধ করে দিলো চ্যাঙ।

সকাল দশটার বেশি বাজে না। মৃদু একটা কম্পন অনুভব করলেন তিনি। ভ্যান চলতে শুরু করেছে।

***

সোহেল, কি অবস্থা তোমার?

ঠিক আছি, বস।

ব্যবস্থা কি?

আজ রাতের মধ্যে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

কিভাবে?

আমাদের নেটওয়ার্কের কিছু সদস্য আছে, যারা চীন-ভারত সীমান্তে চোরাচালান করে। ওদের মাধ্যমেই ওপারে যাবো।

কখন?

আজ রাতে।

আর আহমদ কবির?

সে এখানেই থাকবে। এই লোককে নিয়ে গেলে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি হবে বলে আমার ধারনা।

তোমাকে এতো ধারনা করতে কে বলেছে? আহমদ কবিরও যাবে আমাদের সাথে।

ভুল হয়ে গেছে, আহমদ কবির আমাদের সাথে যাবে।

রাশেদের কোন খবর?

কোন খবর এখনো পাইনি।

ঐ বোবা ড্রাইভারকে আটকে রেখেছো তো?

জি বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল সোহেলের। যে রুমটায় বোবা গাড়িচালককে আটকে এসেছিল একটু আগে গিয়ে দেখে সে রুম ফাঁকা। ছেলেটা পালিয়েছে। কিন্তু সেই তথ্য এখন আকবর আলী মৃধাকে দেয়া যাবে না। তাতে তার নিজের জান নিয়ে টানাটানি পড়তে পারে। কেমন বিনা দ্বিধায় মানুষ খুন করতে পারে আকবর আলী মৃধা যা স্বচক্ষে অনেকবার দেখেছে সে।

তুমি তাহলে যাও, নজর রাখো, বললেন আকবর আলী মৃধা। জিপের পেছনের সীটে হেলান দিয়ে বসলেন। ঘুম আসছে তার, গত রাতে ভালো ঘুম হয়নি,উদ্ভট সব স্বপ্ন দেখেছেন, মাথায় টাক- গেরুয়াধারি কিছু লোক তার চারপাশ ঘিরে রয়েছে, তাদের সবার চোখেই ঘৃনা। যে কোন সময় আক্রমন করতে প্রস্তুত। একটা চেয়ারের সাথে বাঁধা অবস্থায় আছেন তিনি। লোকগুলো ক্রমশ সামনে এগিয়ে আসছে। বুঝতে পারছিলেন তার সময় শেষ হয়ে এসেছে… কিন্তু, স্বপ্নটা পুরো দেখতে পারেননি,তার আগেই ঘুম ভেঙে গেছে। অন্য সময় হলে এই স্বপ্নের মানে বোঝার জন্য চিন্তাভাবনা করতেন হয়তো, কিন্তু এখন সেই সময় নেই। রাশেদকে হাতের মুঠোয় না পাওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছেন না তিনি। ছেলেটার গায়ের চামড়া তুলে তা লুসিফারকে ভেট দেয়ার ইচ্ছে আছে তার। তিলে তিলে মারতে চান ছেলেটাকে।

কোদারি গ্রামের একটু বাইরে অবস্থান করছেন তিনি এখন। ছায়াময় একটা জায়গায় জীপটা রাখা হয়েছে। এখান থেকে বৈধভাবে সীমান্ত পার হয়ে তিব্বতে যাওয়ার সেতু খুব কাছেই। যতোটুকু বুঝতে পারছেন রাশেদ তিব্বতে যাবেই। বোকা আহমদ কবির নিজের হাতে স্পেশাল পাস করে দিয়েছে। ভাবতেই অসহ্য লাগছে। মানুষ এতো বোকা হয় কি করে!

রাশেদকে হাতের মুঠোয় আনতে গিয়ে যদি জাহান্নাম পর্যন্ত যেতে হয় তবু যাবেন আকবর আলী মৃধা। এক অসহ্য রাগে গরগর করতে থাকেন। সোহেলকে পাঠিয়েছেন কিছুক্ষন হলো, কিন্তু ওর উপর পুরো ভরসা রাখতে পারছেন না। শারীরিকভাবে পুরোপুরি ফিট না এখন সোহেল। নেপাল সীমান্ত থেকে কাস্টমস পার হয়ে তিব্বতে ঢোকার পথে যে সেতুটা আছে দূর থেকে তার উপর নজর রাখতে বলেছেন সোহেলকে। রাশেদ আর তার বন্ধু সত্যি তিব্বতে যায় কি না তার উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আহমেদ কবিরকে ইশারায় কাছে আসতে বললেন তিনি। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। হা করে দূরের হিমালয় পর্বতমালার দিকে তাকিয়ে আছে। দূর থেকে হঠাৎ দেখলে পাথরের একটা মূর্তি ছাড়া আর কিছু মনে হবে না। লোকটা তাকে যমের মতো ভয় পায়। অবশ্য ভয় পাওয়ার মতো অনেক কাজ ওর চোখের সামনেই করেছেন তিনি। ভয় পাওয়ার সাথে সাথে তাকে যথেষ্ট ঘৃনাও করে বয়স্ক মানুষটা, জানে, বিশ্বস্ততা আকবর আলী মৃধার কাছে মূল্যবান কোন বস্তু নয়, নিজের প্রয়োজনে যে কাউকে যে কোন সময় খুন করতে পারে। এই ঘৃনা প্রকাশ করার সাহস অবশ্য নেই আহমদ কবিরের।

জীপ চালাতে পারো? আহমদ কবিরকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

জি, পারি।

চালাও তাহলে। কাস্টমস অফিসের সামনে যাও।

জি।

স্টেয়ারিং-এ বসল আহমদ কবির। স্টার্ট দিলো। উত্তর থেকে শীতের হাওয়া এসে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল তাকে। ধীরে ধীরে গতি বাড়াচ্ছে সে। এই শীতেও কপালে ঘাম জমেছে তার।

***

গুহাটা ছোট, আরামদায়ক, উষ্ণ মনে হয়েছিল শুরুতে, এখন তা মনে হচ্ছে না। বাইরে প্রচন্ড শীত থাকলেও গুহার ভেতরকার আবহাওয়া সম্পূর্ণ বিপরীত। কোথা থেকে হাল্কা গরম হাওয়া আসছে। এছাড়া গুহার ভেতর অদ্ভুত একটা গন্ধ। অন্ধকার গুহায় এর আগে অনেক দিন কাটিয়েছে মিচনার, এই জীবন তার কাছে নতুন নয়। গুহার পেছনের পাশটা একেবারে অন্ধকার, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাতাস আসছে সেদিক থেকেই, তারমানে সেখানে কোন ছিদ্র আছে কিংবা গুহাটা আদৌ শেষ হয়ে যায়নি। নিজের সাথে সবসময় দেয়াশলাই রাখে মিচনার। খুব বেশি কাঠি খরচ হয়নি। একটা কাঠি জ্বালাল।

আলোয় পুরো অন্যরকম কিছু দেখল মিচনার। পুরো গুহাভর্তি কংকাল, মানুষের নয়, বেশিরভাগই মনে হয় হরিনজাতীয় প্রানীর। উল্টোদিকে রীতিমতো হাড়ের একটা পাহাড় জমে গেছে। পেছন দিকটায় এবার কাঠিটা ঘোরাল, এবার আরো অবাক হবার পালা। সেখানে কোন দেয়াল নেই, বরং সরু একটা অন্ধকার করিডোের দেখা গেল। একজন মানুষ অনায়াসে সেখান দিয়ে হেঁটে যেতে পারবে। . ভয় বলে কোন কিছু অন্তত মিচনারের অভিধানে নেই। গুহায় জমে থাকা হাড়ের স্তূপ বলে দিচ্ছে এখানে কোন মাংসাশী প্রানী থাকে অথবা প্রানীটা গুহাটাকে কেবল তার উচ্ছিষ্ট রাখার জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছে। সেই মাংসাশী প্রানীটা কি ধরনের হতে পারে তা বোঝা একটু দুরূহ ব্যাপার। বড় ধরনের সাপ, কিংবা ভালুক, নেকড়েবাঘ কিংবা… আর ভাবতে চাইল না মিচনার। যাই হোক না কেন, এই প্রানীটা সম্পর্কে জানা খুব একটা জরুরি নয় তার জন্য। তার আসল লক্ষ্য অন্য কোথাও, খাদের ওপারে যেখানে তার প্রতিপক্ষ তৈরি হচ্ছে তাকে মোকাবেলা করার জন্য। তারপরও কৌতূহল বলে একটা কথা আছে, নিজেকে কোনভাবে আটকে রাখতে পারল না মিচনার। অনেকক্ষন ঘুমিয়ে নিয়েছে এরমধ্যে, কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে দেখা যায় এই অন্ধকার করিডোর কোথাও গিয়ে মিশেছে না কি সেটা কোন কানা গলি।

একটা একটা করে কাঠি জ্বালিয়ে এগুচ্ছে মিচনার। করিডোরে উষ্ণ একটা হাওয়া ঘুরপাক খাচ্ছে, মাঝে মাঝে পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। এমন হতে পারে মাংসাশী প্রানীটা তার গুহায় ফিরে আসবে যে কোন সময় খাবার মুখে নিয়ে। তাই সতর্ক থাকা দরকার, কান খাড়া করে রেখেছে। করিডোরটা ক্রমেই সরু হয়ে এগিয়ে গেছে সামনে। দুপাশের পাথুরে দেয়াল কালো কুচকুচে, হাত দিয়ে দেখল, ভেজা ভেজা।

কাঠি নিভে গেছে, আরেকটা কাঠি জ্বালাতে যাবে এমন সময় অদ্ভুত শব্দটা কানে এলো। ধুপ করে হওয়া শব্দটা গুহার মুখ থেকে এসেছে। যেন ভারি কোন কিছু গুহার মেঝেতে ফেলা হয়েছে। জমে গেল মিচনার। গুহার আসল মালিক কি ফিরে এসেছে, তার খাবার নিয়ে? এবার উল্টোদিকে ফিরল সে, প্রানীটাকে দেখা দরকার। খালি হাতে মোকাবেলা করতে পারবে কি না বুঝে এগুতে হবে। কোন শব্দ যাতে না হয় সেভাবে হাঁটছে মিচনার। কড়কড় করে হাড় ভাঙার শব্দ কানে এলো। দেয়ালের সাথে প্রায় মিশে গিয়ে এগুচ্ছে। শক্তিশালী প্রানী সন্দেহ নেই, বড় ধরনের কিছু হবে। তবে নিজের শক্তি-সামর্থ্যের উপর আস্থা আছে মিচনারের।

আরো এগিয়ে গেল। কান পাতল, মাংস ছিঁড়ে খাওয়ার শব্দ আসছে, এই শব্দটা বেশ প্রিয় তার। নিজেকে পশু মনে হচ্ছে আবার, রক্ত-মাংস, নৃশংসতা, এইসব তার রক্তে মিশে আছে। খুব সাবধানে উঁকি দিলো মিচনার। গুহার মুখে এখনো হাল্কা আলো আছে, দিনের শেষ আলো। সেই আলোয় যা চোখে পড়ল তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল মিচনার। সত্যি সত্যি এমন প্রানী আছে তা চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে। দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে রইল। যে কোনভাবে এই গুহা থেকে বের হতে হবে, এই করিডোর ধরে এগিয়ে যেতে হবে সামনে, ভাগ্য ভালো হলে বের হওয়ার কোন না কোন পথ পাওয়া যাবে। গুহার মুখ দিয়ে বের হওয়ার উপায় নেই, বিশালকায় প্রায় ভালুকের মতো দেখতে এই প্রানীর কথা অনেক আগে শুনেছিল, তার জীবন্ত রুপের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার কোন ইচ্ছেই মিচনারের নেই।

অন্ধকারে পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছে মিচনার। করিডোরের শেষ মাথায় বের হওয়ার কোন পথ আছে কি না জানা নেই, তবু চেষ্টা করতে হবে। নতুবা অপেক্ষা করতে হবে বিশালকায় প্রানীটা কখন বের হবে গুহা থেকে বের হবে সেই সময়ের জন্য। অপেক্ষা করার মতো সময় এখন তার হাতে নেই, খাদের ওপারে প্রতিপক্ষ হয়তো এখনো আছে, সেখান থেকে চলে গেলে আবার তাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *