দ্বিতীয় যাত্রা
প্রারম্ভ
অন্ধকারে একটা গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে আছে ত্রিস্তান। তার সাথে আরো কিছু লোক ছিল, কাউকে এখন পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই একেক দিকে চলে গেছে। অথবা মারা পড়েছে।
দূরে কোথাও কিছু শেয়াল ডেকে উঠেছে। এছাড়া কোথাও কোন শব্দ নেই। আছে, পানির শব্দ। শ্রোতস্বিনী মেঘনা পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে। ঘন গাছপালা চারদিকে, পায়ের নীচে এঁটেল কাদা। দাঁড়িয়ে থাকতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে ত্রিস্তানকে। আকাশে চাঁদ নেই। তবে বোঝা যাচ্ছে রাত অনেক হয়েছে। দ্বিপ্রহরের কম হবে না।
নড়াচড়া করার সাহস হচ্ছে না অথচ বড় বড় সব মশা একাধারে কামড়ে যাচ্ছে। পায়ের উপর দিয়ে একটা সাপ চলে গেল মনে হলো একবার। যা কিছুই ঘটুক, জীবিত ধরা পড়া চলবে না ওদের হাতে। ঐ লোকগুলোর উপর প্রচুর অত্যাচার করা হয়েছে। ওরা শোধ নেবে এবার। পরনের পোশাক ছিঁড়ে গেছে। কনুইয়ের কাছটা চটচট করছে, হাত দিয়ে দেখল লিস্তান, রক্ত, কোথাও লেগে ছড়ে গেছে। পায়ে বুটের মতো জুতো ছিল, সেগুলো হারিয়ে গেছে কোথাও। খালি পায়ে হাঁটা সমস্যা, চারদিকে কাদা, আঠার মতো আটকে রাখে নিচের দিকে। মুখে এই কাদা কিছুটা মেখে নিয়েছে ত্ৰিস্তান। অন্ধকারে তাকে খুঁজে পাওয়া তাই কিছুটা কঠিন হবে যে কারো পক্ষে।
সুদূর মাতৃভূমির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কোন ভুলে এখানে মরতে এসেছিল কে জানে। দেশে থাকলেও অবশ্য খুব ভালো কোন জীবনের ভরসা ছিল না। চুরি-ডাকাতি থেকে একটার পর একটা খুনের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। ধরা পড়লে ফাঁসি। এখন অবশ্য মরতেই বসেছে। সঙ্গি সাথি সব শেষ। দলনেতাও নেই। কিন্তু মৃত্যুর আগে এমন একটা কিছু হাতে এসেছে যা একজন সাধারন নাবিকের কল্পনারও বাইরে। বিশাল এক রত্নভান্ডার। যার খোঁজ এখন শুধুমাত্র তার হাতেই আছে। দলনেতা শুধু একটা নক্সা এঁকে দিয়েছে। যে এলাকার নক্সা এঁকেছে তা হাতের তালুর মতো পরিচিত ত্রিস্তানের কাছে। এখন শুধু বেঁচে ফিরতে হবে এখান থেকে। তারপর সরাসরি দেশে ফিরবে। পর্তুগালে না ফিরতে পারলে স্পেনে স্থায়ী ঠিকানা গাড়তে সমস্যা হবে না। অথবা গোয়াও যাওয়া যায়, যদিও তা নিরাপদ হবে না। স্পেনে ফিরতে পারলেই হলো। কিছুদিন পার হলে আবার এখানে আসবে সে। দলবল নিয়ে। এতো বিশাল ধনসম্পদ এভাবে নষ্ট হতে দেয়া যায় না। তিবাও তার দুঃসম্পর্কের ভাই ছিল। গর্ব বেহতো লোকটাকে নিয়ে, বুক ভরা সাহস ছিল, ভয় কাকে বলে যেন জানতো না। পুরো আরাকান থেকে বাংলা একাই সামাল দিত। সাধারন মানুষের কাছে মূর্তিমান এক আতংক ছিল লোকটা। কিন্তু চালে সামান্য ভুলের কারনে আজ তার মাশুল গুনতে হয়েছে জীবন দিয়ে। দুই দিকেই শত্রুতা বাড়ানো ঠিক হয়নি তিবাওয়ের।
ঠিক পাঁচ বছর আগে গোয়ায় নেমেছিল ত্রিস্তান। পঁচিশ বছরের ঝকঝকে যুবক। দেশে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল দিন দিন, তাই ভাইয়ের ডাকে এই জলকাদাময় দেশে আসতে কোন দ্বিধা করেনি। এছাড়া দেশে থেকে প্রিয়তমা রেবেকা’কে অন্য কারো বাহুলগ্না দেখতেও ভালো লাগছিল না। গোয়া থেকে সরাসরি কলকতা হয়ে বাংলায় চলে এসেছিল ক্ৰিস্তান। বিশ্বস্ত একজনকে পাশে পেয়ে খুশি হয়েছিল ভাই তিবাও। বাংলায় জলের উপর ব্রাসের রাজত্ব ছিল যার। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, লুটপাট, খুন কিছুই বাকি রাখেনি। কখনো আরাকান রাজার সাথে থেকেছে আবার কখনো একা। লুট করা ধন-সম্পদ লুকিয়ে এসেছিল কিছুদিন আগে। ফেরার পথে এক এক করে সাথে যাওয়া দশজন সঙ্গিকে খুন করতে হাত একটুও কাঁপেনি তিবাওয়ের। সঙ্গিদের খুন করতে হয়েছে যাতে তারা কেউ সেই ধন-সম্পদের খবর বলে দিতে না পারে। কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেনি তিবাও। আপন ভাই আন্তোনিওকে নিজ হাতে খুন করেছিল। উত্থানের পর পতন আসে। একদিকে মোগল অন্যদিকে আরাকান, দুই দিকে শত্রুতা করে নিজের শেষ ডেকে এনেছিল তিবাও। সন্তান সন্ততি এবং স্ত্রী আরাকানরাজের অনুগ্রহে বেঁচে আছে কিনা জানে না। তাই মৃত্যুর আগ মুহূর্তে একমাত্র কাছের আত্মীয় ত্ৰিস্তানকে দিয়ে গেছে সেই ধন-সম্পদের নক্সা। ত্রিস্তানের বিশ্বাস হচ্ছিল না তখনও। কিন্তু বিশ্বাস না করে উপায়ও নেই। মৃত্যুপথযাত্রী একজন নিশ্চয়ই তার সাথে রসিকতা করবে না।
পার্চমেন্টে আঁকা নক্সাটা চামড়ার একটা খোপে ঢুকিয়ে রেখেছে ত্রিস্তান। বুকে হাত দিয়ে খোপটার অবস্থান আবার পরীক্ষা করে নিলো। চারপাশে এখনো কোন শব্দ নেই। আক্রমনকারীরা কি চলে গেল? স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ছাড়ার আগে পরিচিত একটা শব্দে মাথাটা নামিয়ে নিলো ত্ৰিস্তান। একটা তীর এসে বিঁধেছে গাছের গায়ে, একটু আগে যেখানে তার মাথাটা ছিল। তারমানে ওরা দেখে ফেলেছে!
বৃষ্টি শুরু হয়েছে বড় বড় ফোঁটায়। আশ্রয় ছেড়ে এলোপাথারি দৌড় দিয়েছে ত্রিস্তান। সাঁ সাঁ করে পাশ দিয়ে আরো কিছু তীর চলে গেল। পেছনে যাওয়ার পথ নেই। সামনে স্রোতস্বিনী প্রমত্তা নদী। মরতে রাজি ত্রিস্তান, কিন্তু ধন-সম্পদের নক্সা ঐ লোকগুলোর হাতে পরতে দিতে রাজি না। তিবাওয়ের অনেক কষ্টে জমানো সম্পদ তার শত্রুদের হাতে পরতে দেয়ার আগে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করাও শ্রেয়। পানিতে ঝাঁপ দেয়ার আগে রেবেকার চেহারা ভেসে উঠলো চোখের সামনে, সেই সাথে তিবাওয়ের শেষ নিঃশ্বাস নেয়ার দৃশ্য। আরো কিছু দৃশ্য ভেসে উঠার আগে মেঘনার শীতল পানিতে তলিয়ে গেল সে, সাথে চামড়ার খোপে তিবাওয়ের বিশাল ধন-সম্পদের নক্সাও।
সময়টা ছিল ষোলশ পয়ষট্টি। বাংলায় পর্তুগীজ জলদস্যুদের পরাজয়ের বছর।
*
অধ্যায় ১
একবছর আগে।
চেয়ারে বসে ঢুলছিল লোকটা, কন্সটেবল রহিম। মশার কামড়, পায়ের উপর দিয়ে ইঁদুরের চলে যাওয়া সব উপেক্ষা করে। এভাবে ঘুমিয়ে অভ্যাস করে নিয়েছে, সমস্যা হয় না। কিন্তু আজকের রাতটা কিছুটা অন্যরকম। চুপচাপ চারদিক, লোকজনের আনাগোনাও কম। এরকম ব্যস্ত একটা থানা চব্বিশ ঘন্টাই মুখর থাকে। অথচ আজ শান্ত, যেন কোথাও কোন ঘটনা ঘটছে না। কিন্তু ঘটবে, কিছু একটা ঘটবে। পাশে হাজতে সাতজন কয়েদী, কাউকে এখনো চালান করা হয়নি কোর্টে। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা বেহাল। রিমান্ডে নিয়ে ইচ্ছেমতো ধোলাই করা হলেও কিছুই বের করা যায়নি মুখ থেকে। কেমন বেচারার মতো পড়ে আছে। বাকি হাজতিরা সবাই সাধারন চুরি, ছিনতাইয়ের আসামী। কিন্তু এই একজনের বিরুদ্ধে কেস মারাত্মক। রীতিমতো প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীর মতো নেতৃত্ব দিচ্ছিল আট জনের একটা দলের। আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একটা দল ছিল। দলের বাকি সবাই নিহত হলেও কপাল গুনে বেঁচে গেছে। যদিও পুলিশের এতে লাভ হয়নি বিন্দুমাত্র। একটা কথাও বের কানো যায়নি মুখ থেকে। পুলিশের এমন একটা ধারনা তৈরি করতে পেরেছে লোকটা যে সে বোবা।
হাজতে সবাই ঘুমাচ্ছে, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ঘুমাচ্ছে দু’একজন। বাকিরা কোনমতে মেঝেতে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে।
ঘড়ির কাটা তিনটার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। বাইরে কোথাও করুণ সুরে ডেকে উঠেছে কুকুরের দল। আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠলো হাজতিদের একজন, সবচেয়ে দূর্বল যে। প্রথমে চোখ খুলল, তাকাল চারদিকে। সবাইকে বেঘোরে ঘুমাতে দেখে মৃদু হাসি ফুটল মুখে। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। কালো জিন্সের প্যান্ট পরনে, উপরে কিছু নেই। ফর্সা শরীরটায় পেশিগুলো যেন কিলবিল করছে। এখানে সেখানে আঘাতের চিহ্ন। হেঁটে কিছুটা সামনে এলো। তাকিয়ে আছে কন্সটেবল লোকটার দিকে, বেশ নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। হাজতের লম্বা লম্বা শিকগুলো দুহাতে ধরল, তারপর হাসল। এই শিক দিয়ে তাকে আটকানো যাবে না এই তথ্যটা বোকা পুলিশগুলো জানে না।
কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখা গেল শিক বাঁকিয়ে ধীরে হাজতের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে সে। কন্সটেবল বেচারা টের পায়নি কিছু, ঘুমাচ্ছে। হাসল, এবার বেরুতে হবে থানা থেকে।
দশ মিনিট পর একজনকে বের হয়ে আসতে দেখা গেল থানা থেকে। জিন্সের প্যান্ট পরনে, উপরের অংশে পুলিশের নীল শার্ট, লক্ষ্য করে তাকালে সেখানে কন্সটেবল রহিমের ব্যাজটা দেখা যাবে। হাঁটছে মাথা নীচু করে, যেন খুব তাড়াহু। থানা থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় চলে এলো, পেছনে কেউ তাকিয়ে নেই। আরো একটু সামনে গিয়ে শুন্য রাস্তায় নীল শার্টটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। পেশিবহুল ফর্সা শরীরটা অন্ধকারেও দেখা গেল ঝকঝক করছে। লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটতে থাকল, যেন নিজের গন্তব্য সে জানে, কোন কাজ অর্ধেক ফেলে রাখা তার পছন্দ নয়।
শার্টটা পড়ে রইল রাস্তায়,ট্রাক-বাসের চাপায় পিষ্ট হতে।
*
অধ্যায় ২
সন্ধ্যার পর পর গ্রামের সীমানায় একজনকে দেখা গেল। তরুণ এক যুবাপুরুষ। তীক্ষ্ম চোখ, খাড়া নাক, ফর্সা গায়ের রঙ। চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। লম্বা, ঋজু দেহের মানুষটাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। যেন অনেকটা হেঁটে এসেছে। চোখ কিছুটা লাল, যেন অনেকদিন ঘুমায়নি। গ্রামের শেষ মাথায় বিশাল অশ্বত্থ গাছটার গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তা করছে আরো এগুবে না এখানেই রাত কাটাবে। আরো অনেকদূর যাওয়ার কথা তার, ঠিক পথে এগুচ্ছে না ভুল পথে সেটাও বুঝতে পারছে না। বারবার পুরানো বাড়ির আঙ্গিনায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সে অনেক দূরের ব্যাপার। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এতোদূর এসেছে সে, এখন আর ফেরার পথ নেই। এগিয়ে যেতেই হবে তাকে, যত কষ্টই হোক না কেন।
অশ্বথের গোড়াটা বেশ মোটা। মাথার উপর ছাদের মতো ডালপালা ছড়িয়ে আছে, সেখানে তাকালে আকাশ দেখা যায় না। মনে হয় পুরো আকাশটাকে আড়াল করে রেখেছে এই অশ্বথ গাছটা। চারদিকে জনমানব কেউ নেই। চাইলে এখানে রাত কাটিয়ে দেয়া যায়, কেউ আসে বলে মনে হয় না জায়গাটায়। তবে সাপ-খোপের ভয় আছে। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না এখন। বিশ্রাম দরকার।
গ্রামটা প্রাচীন। বিদ্যুতের আলো পৌঁছেনি এখনো। দূরে কুঁড়ে ঘরগুলোতে কেরোসিনের বাতি জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। মিটিমিটি তারার মতো। গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসেছে তরুণ। এইসব এলাকার লোকজন সন্ধ্যার পরপরই ঘুমিয়ে পড়ে। শেষ রাতের দিকে রওনা দেবে ঠিক করে একটু কাত হয়ে বসল। সঙ্গে থাকা জিনিসপত্রের দিকে তাকাল। বেশ ভারি। এগুলো নিয়েই এতোদূর আসতে হয়েছে তাকে, যেতে হবে অনেকদূর। কোথাও রেখে যাওয়ারও উপায় নেই। বিশ্বাস করা যায় না কাউকে, অবশ্য বিশ্বাস করার মতো কেউ নেইও। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। একা একা বয়ে বেড়াবার মতো কিছু গোপনীয়তা আছে তার, যা কারো কাছে খুলে বলা যাবে না। মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে, পৃথিবীকে জানাতে ইচ্ছে করে নিজের অস্তিত্ব। কিন্তু খুব বিপজ্জনক হয়ে পারে ব্যাপারটা। তার নিজের জন্য, সেই সাথে পৃথিবীর মানুষদের জন্যও। অনেক ইতিহাস বদলে যাবে, যা জেনে এসেছিল মানুষ সারা জীবন ধরে সেই সব বিশ্বাসে চির ধরবে। এরকমটা হতে দেয়া যাবে না। মানুষ নিজেই নিজের অতীত বের করে আনুক, হোক না তা অনুমান নির্ভর, হোক না তার নিজস্ব ধ্যান ধারনার উপর তৈরি করা বিশ্বাসের প্রাসাদ। জ্ঞান-বিজ্ঞান তার নিজের পথেই সত্য খুঁজে বের করবে। সেখানে অহেতুক হস্তক্ষেপ নিষ্প্রয়োজন।
দু’চোখ জুড়ে ঘুম আসছে। চারদিকে তাকিয়ে পরিবেশটা আবার দেখে নিলো তরুণ। সুটকেস দুটোর দিকে তাকাল। যদিও কারো আসার কথা না এদিকে তবু পড়ে থাকা পাতা দিয়ে জিনিস দুটোকে ঢেকে রাখল সে। আরো কিছুক্ষন শুন্য চোখে তাকিয়ে রইল আকাশের পানে। অনন্ত নক্ষত্রবীথির প্রতিটি তারা তার পরিচিত, কেউ কেউ এর মধ্যে ঝরে পড়েছে, জন্ম হয়েছে নতুন তারার। সবকিছু বদলায়, কেবল তারই কোন বদল নেই, পরিবর্তন নেই।
একটু হাসল তরুণ, বিষণ্ণভাবে। তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
*
অধ্যায় ৩
বিকেলের শেষ আলোয় পুরো পৃথিবীটাই যেন বদলে গেছে। বিশেষ করে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে এই সৌন্দর্য্য উপভোগ করার আনন্দই আলাদা। বান্দরবানের কোন এক পাহাড়ের চূড়ার দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ। কেন জানি তার ইচ্ছে করছিল সেখান থেকে ঝাঁপ দিতে। এক হাজার ফুট উঁচু পাহাড়টা, পড়তে পড়তে বেশ কিছুটা সময় লাগার কথা এবং সেটা উপভোগ করার জন্যই ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করছে রাশেদের। মৃত্যুর জন্য নয়। এই জীবনটা তার অনেক প্রিয়, অনেক আপন, এই পৃথিবীকে তার অনেক কিছু দেয়ার আছে, মনে মনে এটাই বিশ্বাস করে সে। কল্পনায় দেখে পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়ছে, একেবারে মাটিতে আঘাত করার আগ মুহূর্তে হঠাৎ ডানা বের হয়ে আসবে পিঠ থেকে, সেই ডানা ঝাঁপটিয়ে সে চলে যাবে ডুবন্ত সূর্যকে ছুঁয়ে আসতে। কি অদ্ভুত চিন্তা! মাথায় টোকা দিল রাশেদ। এইসব হাবিজাবি চিন্তা মাথায় কেন যে ঘুরপাক খায় কে জানে।
ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ হয়েছে কিছুদিন আগে। চাকরি-বাকরির চেষ্টা করার আগে কিছুদিন দেশটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে হয়েছে রাশেদের। শামীমের অনেকগুলো টাকা ছিল তার কাছে। টাকাগুলো শামীমের মায়ের কাছে দিয়ে এসেছে। খুব কেঁদেছিলেন মহিলা, হাউমাউ করে। নিজেও চোখের পানি লুকিয়ে রাখতে পারেনি রাশেদ।
সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে আবার। চাকরি করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আজিজ ব্যাপারি বার বার করে বলে রেখেছেন যে কোন সময় যেন চলে আসে গ্রামের বাড়িতে। চাকরির প্রয়োজন নেই। যে সম্পত্তি করে রেখেছেন তা রাশেদের জন্য যথেষ্ট। বাড়িতে নতুন একজন অতিথিও এসেছে। রাশেদের সৎ ভাই। সালেহার সন্তান। অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। কিন্তু মিরাকল তো ঘটেই। মায়ের জন্য তাই খুশি রাশেদ। একা একা থাকার কষ্ট থেকে বেঁচে গেছে মহিলা।
পিঠে হাত পড়াতে ঘুরে তাকাল রাশেদ। নতুন বন্ধু জুটেছে একজন, রাজু নাম ছেলেটার। হাসিখুশি, প্রানবন্ত। ইউনিভার্সিটির হল ছেড়ে একটা মেসে উঠেছিল রাশেদ, সেখানেই পরিচয়। সারাক্ষন কিছু না কিছু করার জন্য ছটফট করে ছেলেটা। কোথাও স্থির হয়ে বসতে পারে না।
‘কি রে দোস্ত, লিলির কথা মনে পড়ছে?’ রাজু জিজ্ঞেস করল। হাসছে, যেন মজার কোন কথা বলে ফেলেছে।
উত্তর দিলো না রাশেদ। দূরে ডুবতে থাকা সুৰ্য্যটার দিকে তাকাল। লিলি এখন অনেক দূরে। ইংল্যান্ডে, পড়তে গেছে। আদৌ দেশে ফিরবে কি না জানা নেই। অপহরনের সেই ঘটনার পর মেয়েকে দেশে রাখা ঠিক মনে করেননি তার বাবা। লিলি খুব কেঁদেছিল, চেয়েছিল রাশেদও যেন তার সাথে পড়তে যায়। কিন্তু রাজি হয়নি রাশেদ। দেশ ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করেনি তার। এখন ই-মেইল করে প্রতিদিন। মাঝে মাঝে উত্তর দেয় রাশেদ, মাঝে মাঝে দেয় না। কি হবে উত্তর দিয়ে?
‘চল, হোটেলে ফিরে যাই,’ রাশেদ বলল।
‘না ফিরলে কি হয়, চল আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেই, রাজু বলল।
‘তোর কি মাথা খারাপ! তাঁবু আছে আমাদের কাছে? খোলা আকাশের নীচে থাকলে ম্যালেরিয়ায় মরবো দুজনেই, রাশেদ বলল।
‘মরা কি এতোই সোজা! এতো ভয় পাস কেন? আচ্ছা জানিস, এই জঙ্গলে নাকি ভালুক আছে?
‘থাকতেই পারে। এতে অবাক হওয়ার কি আছে?
‘অবাক হওয়ার কিছু নেই! আচ্ছা, না থাকলে নেই। চল ফিরে যাই, কিছুটা অভিমানের সুরে বলল রাজু।
না হেসে পারলো না রাশেদ। ছেলেমানুষের মতো বায়না ধরে রাজু মাঝে মাঝে। এতো বড় হয়েছে কিন্তু এখনো ছোট মানুষের মতো আচরন ওর।
‘চল,’ রাশেদ বলল।
বিরক্ত মুখে পিছু পিছু হাঁটছে রাজু। তার অনেক দিনের শখ জঙ্গলে কিংবা পাহাড়ে রাত কাটানোর। আজ এতদূর এসেও তা হলো না। কি আর করা? সব শখ সবসময় পূরন হয় না।
পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নীচে নেমে এলো দুজন। সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষন হলো। তারপরও আলো-আধারির একটা খেলা চলছে দূরের আকাশে। এখানে জনমানব নেই। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো রাশেদ। কেমন গা ছমছম করা পরিবেশ। ভয় পাওয়ার মতো কোথাও কিছু ঘটেনি। কিন্তু তারপরও কেন জানি মনে হচ্ছে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে যাওয়া দরকার। যেন কেউ পেছন থেকে তাকিয়ে দেখছে তাদের দুজনকে। জংগলে নানা ধরনের অদ্ভুত ঘটনা ঘটে বলে শুনেছে। সবই লোকমুখে বানানো, ভয় দেখানো কথাবার্তা। কিন্তু একা একা থাকার সময় এসব কথাই যেন বেশি মনে পড়ে। রাজুর দিকে তাকাল রাশেদ। পাশেই হাঁটছে, গুনগুন করে গান গাচ্ছে। মুখটা হাসি হাসি। ওর মুখে বিষণ্ণতা কখনো দেখেছে কি না মনে করতে পারলো না রাশেদ। অদ্ভুত এক ছেলে। এই কারনেই ওকে বেশ ভালো লাগে।
‘তুই এতো সিগারেট খাস কেন রে?’ জিজ্ঞেস করলো রাজু, পাশে হাঁটতে হাঁটতে।
‘এতো আর কই? দিনে দু’তিনটের বেশি তো না।’
‘আমি আজ গুনেছি, এর মধ্যে পাঁচটা সিগারেট শেষ, রাত তো বাকিই আছে।’
‘গার্ডিয়ানগিরি কম করিস,’ হেসে বলল রাশেদ, ‘টেনশনের সময় সিগারেট একটু বেশি লাগে।‘
‘টেনশন? কিসের টেনশন?’
উত্তর দিলো না রাশেদ। আসলেই, কিসের টেনশন তার? গত একবছরের মতো হলো টেনশনমুক্ত থাকার চেষ্টা করেছে। সেক্ষেত্রে অনেকটা সফলও সে। পরীক্ষা দেয়ার পর থেকে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আর কোন কাজ করেনি। শামীমকে নিয়ে সেই ঘটনায় যে ধকল গেছে তার ধাক্কা সামলানোর জন্য এই সময়টা প্রয়োজন ছিল। তবে লিলি পাশে থাকলে ভালো হতো। মেয়েটা চলে যাওয়াতে মাঝে মাঝে খুব অস্থির লাগে। সব ছেড়েছুঁড়ে ইংল্যান্ডে চলে যেতে ইচ্ছে হয়।
এছাড়া আরেকটা ব্যাপারেও মন মাঝে মাঝে খারাপ হয়। বৃদ্ধ দাদা আব্দুল মজিদ ব্যাপারির অন্তর্ধান। ঢাকায় এসে সেই যে হারিয়ে গেল আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। বেঁচে আছে না মরেই গেছে কে জানে। কতোবার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে, সন্ধানদাতার জন্য পুরষ্কারের ঘোষনা রাখা হয়েছে তার হিসেব নেই। কিন্তু কোন খবরই পাওয়া যায়নি। লোকটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। দাদার তালা দেয়া সেই টিনের ঘরটাও ভোলা পাওয়া গিয়েছিল। সেখান থেকে কিছু হারিয়েছে বা চুরি গেছে তা বোঝার কোন উপায় ছিল না। কেননা সেখানে কি ছিল তা কেউ জানতো না। যে জানতো তার কোন হদিস নেই। নাকি দাদা নিজে এসে সব নিয়ে গেছেন! সেই ধরনের শারীরিক সামথ্য তার থাকার কথা না।
এ ধরনের নানা চিন্তা ঘুরপাক খায় রাশেদের মাথায়, নানা প্রশ্ন আসে। কিন্তু উত্তর খোঁজার মতো কোন আগ্রহ তৈরি হয় না ইদানিং।
অন্ধকার হয়ে এসেছে এখন। মোবাইল ফোনের টর্চটা জ্বালিয়ে নিয়েছে রাশেদ। চলতে সমস্যা হচ্ছে। চারদিকে শুধু গাছ আর গাছ। আরেকটু নামার পর মনে হলো কিছু একটা যেন ভুল হচ্ছে। পথটা কেমন অচেনা লাগছে। রাজুর দিকে তাকাল রাশেদ, ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা বলতে চাচ্ছে।
‘কিছু বলবি? জিজ্ঞেস করল রাশেদ।’
‘হারিয়ে গেছি আমরা!’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল রাজু।
‘ধুর বোকা। আমরা কি বাচ্চা ছেলে নাকি যে হারিয়ে যাবো?’
উত্তর দিলো না রাজু। সামনের ঘন বনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই পথ দিয়ে পাহাড়ে উঠেনি তারা এটা নিশ্চিত। তারমানে উল্টোদিকে চলে এসেছে।
‘চল সামনে আগাই,’ বলল রাশেদ। মোবাইলের টর্চটা ধরে এগুলো, পেছনে রাজু।
বেশ কিছুক্ষন পাশাপাশি হাঁটলো দুজন। কিন্তু এখন সামনে পেছনে করে হাঁটতে হচ্ছে। যথারীতি সামনে আছে রাশেদ, পেছনে রাজু। ছেলেটা পারলে রাশেদের কাঁধের উপর চড়ে বসে।
প্রথমে পাতলা থাকলেও সামনে গাছগুলো যেন একটা আরেকটার সাথে জড়িয়ে আছে। এছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে জায়গাটা ঢালু হয়ে না নেমে সোজা চলে গেছে, অনেকটাই সমতল। তবে এখানে কেউ আসে না সচরাচর তা বোঝা যাচ্ছে। জোনাকীর আলো জ্বলছে চারদিকে। মোটামুটি অন্ধের মতো পথ চলছে ওরা। সামনে কি আছে কোন ধারনাই নেই।
আরো কিছুদূর যাওয়ার পর গাছের সংখ্যা ক্রমশ কমতে শুরু করলো। দূরে কোথাও মিটিমিট করে হারিকেন জ্বলছে বলে মনে হলো রাশেদের কাছে। আরো কাছে গেলে হয়তো নিশ্চিত হওয়া যাবে। এখানে কারো পক্ষে থাকা অসম্ভব, হ্যারিকেন আসবে কোত্থেকে।
কিন্তু না, হ্যারিকেনের আলো জ্বলছে, ছোট একটা কুঁড়েঘর এখন পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে রাশেদ। রাজুও দেখেছে। সেও কিছুটা অবাক হয়েছে মনে হলো। হঠাৎ রাজুকে পড়ে যেতে দেখল রাশেদ। অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই মনে হলো কেউ এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে, কেমন বোটকা একটা গন্ধ আসছে। ঘুরে দেখতে যাবে তার আগে মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা অনুভব করলো রাশেদ। শক্ত কিছু একটা লেগেছে মাথায়। জ্ঞান হারানোর আগে কালো একটা ছায়া চোখে পড়ল তার।
*
অধ্যায় ৪
নিজের রুমে বসে আছেন ড. আরেফিন। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে অনেকক্ষন হলো। লাইট নেভানো। কম্পিউটার চলছে, তার আলোয় হাল্কা আলোকিত হয়ে আছে রুমটা। স্ত্রী বেড়াতে গেছে ঢাকার বাইরে, ভাইয়ের বাসায়। বেশ কয়েকদিন থাকবে। তাই বেশ একা একা কাটছে দিনগুলো। চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন কিছুদিন হলো। গত্বাঁধা কাজে মন বসছে না। ইচ্ছে আছে দেশের বাইরে কোথাও যাওয়ার, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে। বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব আছে সেখানে, সবচেয়ে বড় কথা ড. নিকোলাস কারসন আছেন সেখানে। তার সাথে সবসময় ই-মেইলে যোগাযোগ হয়। বাংলাদেশে এসে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। যাই হোক, সেখান থেকে বেঁচে ফিরেছেন দেশে। বছর খানেক সময় পার হয়েছে, এর মধ্যে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছেন। ভদ্রলোক। ভারত এবং তিব্বতে যাওয়ার প্ল্যান আছে ভদ্রলোকের। কিন্তু বাংলাদেশে আর আসছেন না এটা নিশ্চিত।
ই-মেইলে ভারতে গিয়ে দেখা করার জন্য অনুরোধ করেছেন ড. কারসন। সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না ড. আরেফিন। তবে মন টানছে। নতুন করে জড়াতে ইচ্ছে করছে কোন অভিযানের সাথে।
একটু আগে শেষ মেইলটা এসেছে ড. কারসনের কাছ থেকে। মেইলটা খুললেন তিনি, সেখানে লেখাঃ
‘প্রিয় ড. আরেফিন,
আশা করি ভালো আছো।
দীর্ঘদিন বিশ্রামে কাটিয়ে বিরক্ত লাগছিল। তাই ইউনিভার্সিটির আরেকটা প্রজেক্টের সাথে জড়িয়ে পড়লাম অবশেষে। শেষবার তোমাকে বলেছিলাম আমার পরবর্তী গন্তব্য হবে ইন্ডিয়া এবং তিব্বত। গন্তব্যে কোন পরিবর্তন হয়নি,আমার সহকারী থাকবে তিনজন, দু’জন ভারতীয় এবং একজন বাংলাদেশি। তোমার অনুমতি না নিয়েই নাম দিয়ে দিয়েছি। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষকে রাজি করাতে অবশ্য বেগ পেতে হয়েছে কারন ঐ সব অনুসন্ধানে তোমাকে নেয়ার কোন সুযোগই ছিল না, কেননা তুমি ভারতের নাগরিক নও, এছাড়া এধরনের কাজে বাস্তবসম্মত কোন অভিজ্ঞতাও তোমার নেই। কিন্তু গবেষনা এবং রহস্যের প্রতি তোমার যে আগ্রহ আমি দেখেছি তাতে মাঝে মধ্যে বিরক্ত হলেও মনে হয়েছে এই অভিযানে তোমাকে আমার দরকার। আরো একটা ব্যাপার তোমাকে বলে রাখা দরকার, আমার সহকারি হিসেবে তোমাকে সামান্য টাকাও দেয়া হবে। যদিও জানি, টাকা-পয়সা নিয়ে তোমার কোন মাথাব্যথা নেই।
আগামীকালের মধ্যে তোমার মতামত জানাতে ভুলো না। যদিও জানি তুমি আসছে, তারপরও নিশ্চিত করো যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।
তোমার উত্তরের অপেক্ষায়…
ড. নিকোলাস কারসন।
মেইলটার উত্তর দেয়ার সময় আছে এখনো। কতোদিনের প্রজেক্ট অথবা ভারত এবং তিব্বতের কোথায় কোথায় যেতে হবে, কি কাজ করতে হবে বিস্তারিত কিছুই লেখেননি ড. কারসন।
সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি করতে করতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন ড. আরেফিন। বছরখানেক আগেই দুর্দান্ত এক বন্দুকযুদ্ধ হয়েছিল এখানে। কি উত্তেজনাময় দিনই না ছিল সেসময়গুলো। জান যেতে পারতো তার। শেষপর্যন্ত সব মিটে গেলেও আসল জিনিসের সন্ধান পাননি তিনি। পাওয়া যাবে বলেও মনে হয় না। যাক সে সব কথা। ড. কারসনের সাথে যোগ দিতে হবে। সেখানে হয়তো দারুন কোন রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছে তার জন্য, কে জানে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি। কম্পিউটারে সামনে বসলেন ড. আরেফিন। মেইল টাইপ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জানালা দিয়ে একটু আগে তাকিয়েছিলেন বাইরে। ঘন অন্ধকারে খেয়াল করেননি,নইলে দেখতেন গাছের আড়াল থেকে কেউ একজন। তাকিয়ে আছে তার রুমটার দিকে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে।
***
প্রফেসর সুব্রমানিয়াম প্রভাকর ঘুম থেকে উঠেন ঘড়ি ধরে, ঠিক সোয়া পাঁচটায়। এতো সকালে ঘুম থেকে উঠার কারন বাইরে হাঁটতে যাওয়ার ইচ্ছা। হেঁটে শরীরের মেদ যদি কিছুটা ঝরানো যায়। প্রায় ছয় ফুট লম্বা তিনি, শরীরটাও তেমন। কালো কুচকুচে একটা পাহাড় বলা যায় তাকে। বিছানার পাশের আলমিরায় বাইরে যাওয়ার জন্য প্রতিরাতে ট্রাউজার এবং পাম্পসু রেখে যায় তার দীর্ঘদিনের সঙ্গি রামহরি। সেগুলো সেভাবেই পড়ে থাকে। এতে ভোরে কোনদিন হাঁটতে বের হয়েছেন বলে মনে পড়ে না। ঘুম থেকে উঠার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আবার ঘুমিয়ে পড়েন, অ্যালার্মটা অফ করে। তারপর আবার উঠেন আটটার দিকে। তখন একটু আফসোস হয় কেন বাইরে থেকে হেঁটে এলেন না, আলসেমীকে প্রশয় দেয়া হচ্ছে, আগামীকাল ভোরে অবশ্যই হাঁটতে বের হবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। সারাদিন বাইরে থেকে রাতে বাসায় ফিরে রামহরিকে বলে রাখেন যেন ট্রাউজার আর পাম্পশু জায়গামতো রাখা হয়। রামহরি হেসে মাথা নাড়ে। গত প্রায় একবছর ধরে আলমিরায় ট্রাউজার আর নীচে পাম্পশু রাখা আছে, আজ পর্যন্ত সরানোর প্রয়োজনবোধ করেনি সে।
ঠিক নয়টায় ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলেন তিনি। ক্লাস নিলেন একটা। টিচার্স লাউঞ্জে বসে আড্ডা দিলেন দীর্ঘদিনের সহযোগী অধ্যাপক আমেদকারের সাথে। তারপর হঠাই পেলেন চিঠিটা। ইংল্যান্ড থেকে এসেছে। পরিচিত এক লোকের কাছ থেকে। খুব একটা আগ্রহবোধ না করলেও খুলতে হলো চিঠিটা, কারন সাথে তার নিজের ইউনিভার্সিটির একটা চিঠিও রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে ভারত, নেপাল এবং তিব্বতে যে অনুসন্ধান পরিচালিত হবে তাতে চেন্নাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে মনোনীত করা হয়েছে। বাকি দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইংল্যান্ডের, অন্যটি ভারতেরই আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়। নৃবিজ্ঞানী এবং পুরাতত্ত্ববিদ হিসেবে প্রফেসর সুব্রমানিয়ামের পরিচিতি আছে, তার দুটো বই পাঠ্য করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। অনুসন্ধানে ভারত থেকে অপর যে লোকটা যোগ দেবে তাকে চেনেন তিনি, কোন এক সময় একসাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু বিচিত্র এক কারনে লোকটাকে একেবারেই সহ্য হয় না প্রফেসর সুব্রমানিয়ামের। সবসময়ই যেন তার পিছু লেগে থাকে। এবারও যেমন সুন্দর একটা কাজে ঝামেলার মতো তার পিছু লেগে থাকবে লোকটা। ইদানিং আর ইউনিভার্সিটির বাইরে গিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে চান না প্রফেসর সুদ্বমানিয়াম, কিন্তু দলনেতার নামটা দেখে কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেছেন। ড. কারসনের সাথে কাজ করার ইচ্ছে তার অনেকদিনের। অন্যদিকে এখন যে পরিমান স্বাস্থ্যের অধিকারী তিনি তাতে কায়িক পরিশ্রমের কোন কাজ তার শরীরে সইবে কি না কিংবা চাইলেও ঠিকভাবে করতে পারবেন কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
যাই হোক, বিষণ্ণ মনে বাসায় ফিরে এলেন। ইংল্যান্ড থেকে আসা চিঠিটা হাতে নিয়ে, চিঠিটা এখনো খোলাই রয়েছে, পড়ার টেবিলে রেখে দিলেন অবহেলায়। যে কোন ধরনের অনুসন্ধানে গেলে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হয়, দৌড়-ঝাঁপ করতে হয়, এসব চিন্তা করেই মাথা কেমন ভো ভো করছে তার। এছাড়া এতোদিন রামহরির। উপর নিজের সব দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন তিনি, সেই রামহরি যদি না যায় তাহলে বিপদ আরো বাড়বে। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একটা চিঠি লিখবেন বলে ঠিক করলেন, সেখানে রামহরিকে তার সঙ্গি হিসেবে নেয়ার অনুমতি চাওয়া হবে। রামহরি যদি যায় তার সাথে কেবলমাত্র তখনই তিনি যেতে রাজি হবেন। তার আগে নয়। সিদ্ধান্তটা নেয়ার পর একটু হাল্কা লাগছে তার।
***
বেশ কিছুদিন ধরেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে সন্দীপ চক্রবর্তীর। এই সব স্বপ্নের কোন মানে নেই। বিদঘুঁটে সব ব্যাপার-স্যাপার মাথায় ঘোরে, কাজেই এইধরনের স্বপ্ন দেখাটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু না। রাত তিনটের দিকে ঘুম ভেঙে যাওয়াতে বিছানা ছেড়ে উঠে ল্যাপটপ খুলে বসল। স্ত্রী সোমা ঘুমাচ্ছে বেঘোরে, একমাত্র ছেলে শান্তনুকে কিছুদিন হলো আলাদা ঘর দেয়া হয়েছে, সেখানেই সে ঘুমায়। কাজেই ল্যাপটপ খুলে বসলে টের পাওয়ার কেউ নেই।
রাতের এই সময়টা ভালো লাগে সন্দীপের। কোন শব্দ নেই কোথাও, বিরক্ত করার কেউ নেই। কাজে মন বসে। অবশ্য এখন কোন কাজ নেই হাতে। আগামীকাল ছুটির আবেদন করবে সে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে, পাক্কা একমাসের ছুটি চাই। ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে যেতে হবে, কলকাতার বাইরে দূরে কোথাও। নেপাল, দার্জিলিং, পুরী অথবা বাংলাদেশে। বাংলাদেশে যাওয়াটা বেশ মজার হবে বলে ধারনা তার। কোন এক কালে পূর্বপুরুষরা সেই বাংলাদেশ থেকেই এসেছিল এখানে, দেশভাগেরও অনেক আগে। এখনো অনেক আত্মীয়স্বজন হয়তো রয়ে গেছে সেখানে, যদিও যোগাযোগ নেই। ঢাকায় অবশ্য কারো সাথে দেখা করার উদ্দেশ্য নিয়ে আসবে না। হোটেলে থেকে দেশের দু’একটা জায়গা ঘুরে আসবে, কক্সবাজার কিংবা সেন্টমার্টিনে যাওয়া যেতে পারে। ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে দেখেছে, খরচও অনেক কম। ব্যক্তিগত মেইলবক্সটা ওপেন করল সন্দীপ। অনেক দিন পর। বেশ কিছু মেইল জমে আছে। কিন্তু বিশেষ একটা মেইলে নজর আটকে গেল তার।
ড. কারসনের মেইল!
ভদ্রলোক এখনো মনে রেখেছেন তাকে! কতোদিন আগের কথা! এতদিন পরে মেইল করার কারনই বা কি!
মেইল খুলে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকল সন্দীপ। অনেক দিন পর দারুন একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। উত্তেজনায় চকচক করে উঠলো তার চেহারা। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো একটা। মেইলটার উত্তর দেয়া দরকার, এক্ষুনি। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।
ছেলেকে ছুটিতে বেড়াতে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা নিমিষেই উধাও হয়ে গেছে, পরের বছর গেলেও হবে। কিন্তু এই সুযোগ বারবার পাওয়া যাবে না।
*
অধ্যায় ৫
চোখ খুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। ভোর হয়েছে সবেমাত্র। কিন্তু এর মধ্যেই তার চারপাশে কমপক্ষে শখানেক মানুষের উপস্থিতি দেখতে পেলেন। তাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখে মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। দু’একজনকে দেখা গেল উদ্বিগ্ন মুখে তার সুটকেসগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। গ্রামের সবলোক যেন একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। শ’খানেক লোক জমা হয়েছে, দূরে আরো লোকজন আসছে দেখা যাচ্ছে, ছেলে বুড়ো সব।
সবার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এই হাসির অর্থ কি তিনি নিজেও জানেন না, বোকার হাসি বলা যেতে পারে। তবে এতে লোকগুলোর মধ্যে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলেন তিনি, কারো কারো চোখ কপালে উঠে গেছে, বাকিদের চেহারায় বিস্মিত হবার ছাপ স্পষ্ট। নিজেদের মধ্যে কয়েকজন ফিসফিস করে কথা বলছে। লখানিয়া লখানিয়া শব্দটা কয়েকবার শুনলেন মনে হলো।
উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙলেন, ভয়ের কিছু নেই এদের। গায়ের সাধারন মানুষ এরা। তার মতো লোক আগে কখনো দেখেনি মনে হচ্ছে, নাকি ঘটনা অন্যকিছু?
এবার উঠে দাঁড়ালেন এবং বিপদে পড়ে গেলেন। কোত্থেকে বুড়ি এক মহিলা ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করেছে তাকে ধরে। বেচারীকে ছেড়ে দিলেন না, পড়ে গেলে ব্যথা পাবে। এতে হিতে বিপরীত হলো। চারপাশের সবাই হাততালি দেয়া শুরু করেছে। এবার বয়স্ক একজন এগিয়ে এলো তার দিকে।
‘তুই লখানিয়া না?’
পরিস্কার হিন্দীতে জিজ্ঞেস করল লোকটা। বেশ লম্বা, মুখে পাকালো গোঁফ, লালচে চুল। সর্দারগোছের কেউ হবে হয়তো।
মাথা নাড়লেন তিনি, বলতে চাইলেন আমি আব্দুল মজিদ ব্যাপারি। কিন্তু গলা দিয়ে কোন কথা বেরুল না। এরা কি তাকে লখানিয়া মনে করছে? লখানিয়া কে?
সবাই কি বুঝলো কে জানে, তবে চার-পাঁচজন লোক এসে তাকে কাঁধে তুলে নিলো। হৈহুল্লোড় শুরু হয়েছে, বুড়ি মহিলা হাসছে এবার, আনন্দের হাসি। হাত তালি দিচ্ছে কেউ কেউ। লাফ দিয়ে কাঁধ থেকে নেমে পড়লেন তিনি। সুটকেস দুটো সাথে রাখতে হবে যে করেই হোক। দু’একজন এসে হাত লাগাতে চাইলে ইশারায় নিষেধ করলেন তিনি। ওরা আর এগুলো না।
সুটকেস দুটো হাতে নিয়ে হাঁটছেন তিনি। পেছনে দলবেঁধে আসছে গ্রামের লোকগুলো। লখানিয়া, লখানিয়া বলে চেঁচাচ্ছে তারস্বরে। বুঝতে পারলেন এখন অন্তত এদের হাত থেকে নিস্তার নেই। কোন এক লখানিয়ার সাথে তার মিল খুঁজে পেয়েছে গ্রামের লোকেরা, বুড়ি মহিলা সম্ভবত লখানিয়ার মা।
যাই হোক, মাতৃস্নেহ কাকে বলে অনেক আগেই বিস্মৃত হয়েছেন। তবে আবছা যে মনে পড়ে না তা নয়। এখন খুবই মনে পড়ছে। দাঁড়িয়ে চোখ দুটো মুছে নিলেন। সেই মায়ের কোলে আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে হলো তার।
পেছনে একদল লোক আর সামনে বুড়ির হাত ধরে হাঁটছেন তিনি। গ্রামের শেষ মাথায় ছোট একটা কুড়ে ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সামনে ছোট উঠোন, একপাশে ছোট একটা রান্নাঘর। এটাই হয়তো লখানিয়ার বাড়ি। যে লখানিয়া হয়তো নিরুদ্দেশ বহু বছর ধরে, যার প্রতীক্ষায় তার বুড়ি মা ছানি পড়া চোখে যাকে দেখে তাকেই নিজের ছেলে বলে মনে করে। নিজেকে লখানিয়া ভাবতে খারাপ লাগছে না। এতে যদি বুড়ির মনের কষ্ট কিছুটা হলেও কমে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকালেন, হাসি মুখে। যেন নিজের বাড়িতে ফিরতে পেরে খুশি।
‘লক্সমী, তোর লখানিয়া ফিরা আইছে,’ সর্দার গোছের লোকটা বুড়িকে জড়িয়ে ধরে বলে।
বুড়ি বাকরুদ্ধ, কথা বলে না, চোখ দিয়ে সমানে অশ্রু ঝরছে।
‘হ্যাঁ, আমি এসেছি, মার কাছে ফিরে এসেছি, আপনারা সবাই যার যার কাজে যান,’ উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বললেন তিনি।
‘লখানিয়া, তুই আমারে চিনস নাই?’ সর্দার লোকটা কাছে এসে বলল। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না তিনি। বুড়ি এগিয়ে এলো সাহায্য করতে।
‘লখানিয়া, এ তোর মামা, জংগু।’
‘মামা, আমি আস্তে আস্তে সব চিনতে পারবো।‘
‘ঠিক আছে, তোমরা থাকো, আমরা যাই, জংগু সর্দার ঘুরে দাঁড়াল। চলেন সবাই। অনেক দিন পর ছেলে ঘরে ফিরছে, মায়ে-ছেলে কথা বলুক।’
সবাই চলে গেলে বুড়ির হাত ধরে ঘরে ঢুকল লখানিয়া। কুড়ে ঘরটা দিনের আলোতেও অন্ধকার। চারদিকে নিদারুন অভাবের ছাপ স্পষ্ট। বুড়ি ঠিকমতো খেতে পায় কি না তাতেও সন্দেহ। ঠিক করলেন লখানিয়া হয়ে এখানেই কিছুদিন কাটিয়ে দেবেন। তারপর দেখা যাক কি হয়।
*
অধ্যায় ৬
সময়টা ১৭৬০ খৃস্টাব্দ। মে মাসের কোন এক দিন।
গ্রীষ্মের দুপুরে যখন ঘুমে চোখ লেগে এসেছিল তখনই দূরে শত্রু জাহাজটা চোখে পড়ল পাখির বাসায় বসে থাকা আন্ডু মিচনারের। বেচারার বয়স অল্প, সারাদিন কাজ ফেলে লাফালাফিতে ব্যস্ত থাকে। তাই শাস্তি হিসেবে পাখির বাসার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সে কাজ অবশ্য ঠিক মতোই করছে মিচনার ছোঁড়া। ওর জন্ম আয়ারল্যান্ডের এক জেলে পরিবারে। কাজ করতে না চাওয়াতে একদিন খুব পেটালেন মিচনার সিনিয়র, ফলাফল জুনিয়র মিনারের ঘর পালানো, জাহাজে খালাসীর কাজ নেয়া। হাসি-খুশি অল্প বয়েসি মিচনার কম সময়েই সবার মন জয় করে নিলো। কিন্তু বাঁদরামি যার স্বভাবজাত তাকে বেশিদিন সহ্য করা কঠিন। ফলে অবধারিতভাবেই ক্যাপ্টেন জেমস হার্ডওয়েল তাকে পাখির বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। এমনতি ক্যাপ্টেন খুব কঠিন মানুষ, নিয়মকানুনের ব্যাপারে খুব কড়া। কিন্তু মিচনারের প্রতি অদ্ভুত এক স্নেহ কাজ করে বলেই হয়তো আরো কঠিন কোন শাস্তি দেননি।
জাহাজটা সাউথহ্যাম্পটন থেকে রওনা দিয়েছে আজ উনত্রিশ দিন হলো। ব্ল্যাক ডাহলিয়া নামের ছোট জাহাজটা একটা সওদাগরী জাহাজ। গন্তব্য অনেকদূর। সেই ভারতবর্ষ।
পথে এর মধ্যেই বেশ কয়েকবার ঝড়ের কবলে পড়লেও ক্যাপ্টেন হার্ডওয়েলের সুদক্ষ চালনায় পার হয়ে গেছে জাহাজটা। কিন্তু এখন সামনে যে সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে তা সেসব ঝড়ের চেয়ে অনেক বড় কিছু। পর্তুগীজ জলদস্যুরা পুরো সাগরে রাজত্ব করছে, সাথে যোগ দিয়েছে কিছু স্প্যানিশ জলদস্যুও। নিজের জাতভাইরাও পিছিয়ে নেই। তবে এক্ষেত্রে স্বাভাবিক একটা নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করে জলদস্যুরা। সেটা হচ্ছে প্রয়োজন না হলে নিজের দেশের জাহাজকে আক্রমন করে না ওরা। কিছু কিছু জলদস্যুরা নিজের দেশের সরকারের পক্ষ হয়েও কাজ করে। বিশেষ করে শত্রু দেশের বানিজ্য জাহাজ কিংবা যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস করতে পারলে সেদেশের রাজাও তোয়াজ করে চলে তাদের। এ ক্ষেত্রে পর্তুগীজরা অনেক এগিয়ে। স্প্যানিশদের সাথে খুব একটা লাগতে যায় না ওরা, হয়তো নিজেদের জাতভাই মনে করে, ওদের মূল লক্ষ্য ইংলিশ অথবা ডাচ জাহাজ।
ডেকে এসে দাঁড়িয়েছেন ক্যাপ্টেন হার্ডওয়েল, চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছেন দূরে। যদিও আন্ডু মিনারের কাছ থেকে শত্রুর খবর এখনো পাননি। আরো কিছু দূর গেলেই আফ্রিকা উপকূল, সেখান থেকে ভারতবর্ষ বেশি দূরে হবে না। কিন্তু এটুকু এলাকাই সবচেয়ে গোলযোগপূর্ন বলে জানেন তিনি। কোনরকম এই এলাকাটুকু পার করতে পারলে আর চিন্তা নেই। তারপরের পুরো জায়গাটায় ইংলিশ জাহাজের প্রাধান্য।
দড়ি বেয়ে নীচে নেমে এসেছে আন্ডু মিচনার। চেহারায় কিশোরছাপটা যায়নি এখনো। উপরে ঠান্ডায় বসে থেকে চেহারায় কেমন নীল কালশিটে পড়ে গেছে।
‘আই, আই, ক্যাপ্টেন,’ ক্যাপ্টেনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মিচনার।
বিরক্তচোখে তাকালেন ক্যাপ্টেন। ছোঁড়া উপর থেকে নীচে নেমে এসেছে কি মনে করে!
‘রিপোর্ট করো।’
‘পর্তুগীজ জাহাজ। সম্ভবত জলদস্যু, স্যার!’
‘কতোদূরে?’ যথাসম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করলেন ক্যাপ্টেন হার্ডওয়েল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ফার্স্ট মেট জনসনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন।
‘মাইলখানেক!’
দাঁড়ালেন না ক্যাপ্টেন, ডেকের একপাশে উঁচু জায়গায় চলে গেলেন। ফার্স্ট মেট জনসন ঘন্টা বাজিয়েছে, পিলপিল করে জাহাজের নাবিক এবং অফিসাররা এসে জমা হয়েছে ডেকে।
‘কামান তৈরি করে, যার যার কাছে বন্দুক আছে প্রস্তুত থাকো। ঐ জলদস্যুদের ছেড়ে কথা বলবো না, জাহান্নামের পথ ওদের দেখিয়ে দেবো আজ,’ উত্তেজিত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন ক্যাপ্টেন। এমনিতে শান্ত মানুষ, কিন্তু রেগে গেলে চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়। একজন নাবিক এসে বন্দুক এগিয়ে দিলো তার হাতে। গুলি ভরা আছে কি
পরীক্ষা করে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিলেন তিনি। তারপর জাহাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, হাতে দূরবীন নিয়ে।
জাহাজের সবাই প্রস্তুত অবস্থায় আছে। কামানের সামনে গোলা রাখা হয়েছে, ক্যাপ্টেনের ইশারা পাওয়া মাত্র ছোঁড়া হবে। পাখির বাসা থেকে নেমে এসেছে মিচনার। উদ্বিগ্ন মুখে তাকাচ্ছে এদিক-সেদিক। জলদস্যুদের আক্রমনের কথা সহকর্মীদের কাছে শুনেছে সে, কিন্তু নিজের সেই অভিজ্ঞতা এতো তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি। ক্যাপ্টেন যতোই বড় কথা বলুক ঐ জলদস্যুদের সাথে পাল্লা দেয়ার মতো অবস্থা ব্ল্যাক ডাহলিয়ার নেই। এখানকার নাবিকরা যুদ্ধবিদ্যায় তেমন পারদর্শী না। কেউ একজন তার হাতে একটা গাদা বন্দুক ধরিয়ে দিলো। এই বন্দুক কিভাবে চালাতে হয় মোটামুটি শিখে নিয়েছিল মিচনার, কিছু দিন আগেই। সেই শিক্ষাটা এখন হয়তো কাজে লাগবে।
শত্রু জাহাজ কাছে চলে এসেছে। ক্যাপ্টেন এখনো কোন সংকেত দেননি আক্রমন করার জন্য, হয়তো আশা করছেন ওটা হয়তো শত্রুদের জাহাজ হবে না। কিন্তু তার সেই ধারনা ভেঙে গেলে যখন শত্রুর জাহাজ থেকে ছোঁড়া কামানের প্রথম গোলাটা জাহাজের প্রধান মাস্তুল ছেদ করে গেল।
রন-হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন, সাথে সাথে কামান দাগা শুরু করলো ব্ল্যাক ডাহলিয়ার কামানচি’রা। বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ছে জলদস্যুর জাহাজ থেকে। আক্রমনের জবাব দেবার আগেই ব্ল্যাক ডাহলিয়ার কয়েকজন আহত হয়ে পড়ে গেল। বন্দুক ছেড়ে এককোনায় লুকাল মিচনার। চারপাশে শোরগোল। কামানের বোমা আর গুলিবর্ষন চলছে সমানতালে। কিছুক্ষন আগে আকাশ পরিস্কার থাকলেও এখন কেমন অন্ধকার করে এসেছে। শত্রুর জাহাজের অবস্থান দেখা যাচ্ছে না।
পরপর আরো তিনটে গোলা এসে পড়ল ঠিক ডেকের মাঝখানে। উড়িয়ে দিয়ে গেল কাঠের পাটাতনটা। জাহাজের পাশেও এসে লেগেছে দু’একটা গোলা। পাগলের মতো গুলি করছে ব্ল্যাক ডাহলিয়ার নাবিকরা, কিন্তু লক্ষ্যবস্তু না দেখে এলোপাথারি গুলিতে শত্রুর কোন ক্ষতি হচ্ছে কি না বোঝা যাচ্ছে না।
ক্যাপ্টেন তার কোমরে ঝোলানো তলোয়ার বের করে এনেছেন। মিচনার তাকিয়ে আছে ক্যাপ্টেনের দিকে। লোকটার কি মাথা খারাপ হয়েছে! গোলাগুলির শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছিল তার। ক্যাপ্টেন চেঁচিয়ে কিছু বলছেন তার নাবিকদের। কিন্তু কেউ কিছু শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। গোলাবারুদও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। একমাত্র ভরসা ওদের রক্ষা করতে এখন যদি কোন ইংলিশ জাহাজ চলে আসে, তাছাড়া এই জাহাজের ডুবে যাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।
জাহাজের পাশে কিছু নৌকা ঝোলানো থাকে সাধারনত, বিপদকালীন সময়ে কাজে লাগানোর জন্য। এই জাহাজেও তাই আছে। কয়েকজন নাবিক চেষ্টায় আছে সেগুলো নীচে নামিয়ে পালিয়ে যেতে। ক্যাপ্টেনের চোখ এড়াল না ওদের এই চেষ্টা। হারামজাদা কাপুরুষের দল বলে ওদের একজনের উপর তলোয়ার তুললেন তিনি, কিন্তু নামাতে পারলেন না। তার আগে পেছন থেকে অন্য এক কাপুরুষ তার পেটে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিয়েছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না মিচনার। তার এতো পছন্দের একজন মানুষ এভাবে বিশ্বাসঘাতকদের হাতে মারা যাবে মানতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু কিছুই করার নেই এখন। ক্যাপ্টেন মারা গেছেন সাথে সাথে। বাকি নাবিকরা ক্যাপ্টেনকে মরতে দেখে লড়াই-এ ক্ষান্ত দিয়ে এখন পালাতে ব্যস্ত।
আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলো মিচনার। জাহাজ ডুবে যাচ্ছে। জাহাজের তলা দিয়ে হুরমুড় করে পানি ঢুকছে। এই জাহাজ ডুবতে বেশিক্ষন লাগবে না। নৌকাগুলোর কোন একটায় উঠা যায় কি না সেই চেষ্টা করতে হবে।
এগিয়ে যাচ্ছিল মিচনার, ছোট মানুষ হওয়াতে কেউ তার দিকে তেমন নজর দিচ্ছিল না। শত্রু জাহাজের গোলাগুলি অবশ্য থেমে নেই। তাই হামাগুড়ি দিতে হচ্ছিল তাকে। কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারলো না। সামনে একজোড়া বুট দেখতে গেল সে, ঠিক তার মুখের সামনে। বুটের মালিকের সন্ধানে উপরে তাকাল মিচনার।
‘কি রে নেংটি ইঁদুর, পালাতে চাস?’
ফার্স্ট মেট জনসনের কুৎসিত চেহারা দেখা গেল।
উত্তর দিলো না মিচনার। উঠে দাঁড়াল ধীরে ধীরে। তারপর হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
হাসল জনসন। ইশারায় যেতে বলল একটা নৌকায়।
ভীত পায়ে আস্তে আস্তে এগুল মিচনার। এই লোকটাকে মোটেও বিশ্বাস করা যায় না। যে কোন সময়ে মত পালটে ফেলতে পারে।
জনসনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই। ঘুরে তাকাতে গিয়েই বুঝতে পারল ধারনা ঠিক। কিন্তু কিছু করার ছিল না। জনসনের ঘুষি ঠিক নাক বরাবর লাগল। সাথে সাথে জ্ঞান হারাল মিচনার।
*
অধ্যায় ৭
অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছে না রাশেদ, তবে বুঝতে পারছে হাতদুটো বাঁধা তার। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কতোক্ষন জ্ঞান ছিল না বোঝা যাচ্ছে না। হাতঘড়িটা দেখতে পেলে বোঝা যেতো, কিন্তু তা সম্ভব নয়।
অনেক গরম জায়গাটা। টপটপ করে ঘাম পড়ছে মাথা থেকে। পানির তেষ্টাও পেয়েছে। কিন্তু পানি দেবে কে? কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। রাজু কোথায়? ওরও তো এখানে থাকার কথা? ভাগ্যভালো মুখ আটকে দেয়নি। রাজুকে ডাকা যাবে। তবে আরেকটা ব্যাপার বুঝতে পারলো রাশেদ অপহরনকারী যেহেতু মুখে কিছু দিয়ে আটকে দেয়নি,তারমানে আশপাশ থেকে বিপদের কোন আশংকা করছে না ওরা।
চুপচাপ থাকার সিদ্ধান্ত নিলো রাশেদ। রাজু হয়তো আশপাশেই আছে। এছাড়া যে তাদের আটকে রেখেছে সেও নিশ্চয়ই আসবে। কে এই লোক? ওদের দুজনকে এভাবে অতর্কিতে হামলা করার কারন কি? ওরা তো কোন ক্ষতি করতে আসেনি। পথ হারিয়ে ফেলেছিল মাত্র।
ডানদিকে কারো নড়াচড়ার শব্দ পেল রাশেদ। নিশ্চয়ই রাজু।
‘রাজু?’ ফিসফিস করে বলল রাশেদ।
কোন সাড়া এলো না অবশ্য। আরেকবার ডাকার আগে বাইরে কারো পায়ের আওয়াজ পেল। চোখ বন্ধ করে ফেলল সাথে সাথে। জ্ঞান ফিরে পেয়েছে এটা বুঝতে দেয়া যাবে না।
দু’জন লোক ঢুকেছে ঘরটায়। আলতো করে চোখ খুলে দেখল রাশেদ। দুজনেই লুঙ্গি পরনে, কালো চাদরে শরীর ঢেকে রেখেছে, অন্ধকারে চেহারা ভালো করে লক্ষ্য করতে পারলো না তার আগেই চোখ বন্ধ করে ফেলতে হয়েছে। তবে এদের একজন তালগাছের মতো লম্বা, অন্যজন ঠিক বিপরীত, অস্বাভাবিক বেঁটে, বামনের কাছাকাছি। অচেতনের ভান করে শুয়ে থাকলেও লোক দুজনের নড়াচড়া বোঝার চেষ্টা করছে রাশেদ। সমস্যা হচ্ছে নিজেদের মধ্যে কোন কথা বলছে না লোকগুলো। এক কোনায় গিয়ে বসেছে। ওরা হয়তো পাহারা দিতে এসেছে, ভাবল রাশেদ। কিন্তু রাজু কোথায় গেল?
নিজেদের মধ্যে কথা বলছে লোকগুলো এখন। ভাষাটা অচেনা লাগল রাশেদের কাছে। উপজাতীয় কোন ভাষা মনে হচ্ছে। কোন কারনে কারো উপর বিরক্ত লোক দুটো এটুকু বুঝতে পারল রাশেদ।
দুজনের একজন উঠে দাঁড়িয়েছে, হেঁটে আসছে তার সামনে, টের পেল রাশেদ। চোখ খোলা যাবে না, দেখা যাক ওরা কিছু করে কি না। তাকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে গেল লোকটা। ঐদিকে কি? এর আগেরবার তাকিয়ে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি রাশেদের।
চোখ খুলল রাশেদ, লোকটার হাতের ছোট হারিকেনের আলোয় পরিস্কার দেখতে পেল ঠিক তার মতোই দুজন লোককে বেঁধে রাখা হয়েছে একটা বাঁশের খুটির সাথে। ওদের একজন রাজু। অন্যজনকে চিনতে পারলো না রাশেদ, তবে দেখে বাঙ্গালীই মনে হচ্ছে। মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ, পোড় খাওয়া চেহারা। রাজু এখনো অচেতন।
বেঁটে লোকটা প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে একটা ছুরি বের করে এনেছে। লম্বা ধারালো ছুরি, হারিকেনের আলোয় চকচক করছে। ছুরি হাতে মধ্যবয়স্ক লোকটার সামনে নাড়াচাড়া করছে যেন যেকোন সময় বসিয়ে দেবে গলায় অথবা বুকে। তার তালগাছের মতো লম্বা সঙ্গিও উঠে দাঁড়িয়েছে এবার, রাশেদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর হাতেও একটা ছুরি দেখতে পেল রাশেদ।
উদ্দেশ্য পরিস্কার। ওরা খুন করবে এবার সবাইকে।
এই ধরনের দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি রাশেদ। মনে মনে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল সে। অসহায়ের মতো মৃত্যু এবং কোন কারন ছাড়াই। কিন্তু মধ্যবয়স্ক লোকটার আকস্মিক কান্ডে হতভম্ব হয়ে গেল রাশেদ সাথে দুই দুষ্কৃতিকারীও।
কোনভাবে নিজের হাতের বাঁধন ছুটিয়ে ফেলেছিল মধ্যবয়স্ক মানুষটা আগেই। সামনে ছুরি নিয়ে যখন খেলা করছিল বেঁটে শয়তান, আচমকা আঘাত করতে দেরি করেনি। দুই হাত এককরে বুকের ঠিক মাঝখানে আঘাত করেছে, তারপর একটু উঠে হাঁটু দিয়ে চোয়ালের ঠিক নীচে বসিয়ে দিয়েছে। কিছু বোঝার আগেই অজ্ঞান হয়ে গেছে বাটকুটা।
মধ্যবয়স্ক মানুষটা উঠে দাঁড়িয়েছে এখন। যে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছিল হাত সেটা ধরে আছে বা’হাতে। রাশেদের সামনে দাঁড়ানো ঢ্যাঙা লোকটা এবার রাশেদকে বাদ দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ছুরি একহাত থেকে অন্য হাতে নিচ্ছে বিদ্যুৎ গতিতে যাতে শত্রু বুঝতে না পারে কোনদিক দিয়ে আক্রমন করবে সে।
মধ্যবয়স্ক লোকটাও কম না, সেও পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে বারবার। দুজন ঘুরছে চক্রাকারে। হারিকেনের আলোয় অদ্ভুত লাগছিল রাশেদের। অচেনা ঐ লোকটাই তার ভরসা, কোনভাবে যদি কিছু হয়ে যায় লোকটার তাহলে লম্বু বদমাশটার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না তাকে আর রাজুকে।
দুজন চক্রাকারে ঘুরছে এখনো। আক্রমন করার আগে পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা করছে যেন। লম্বা হওয়ায় একটু সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বদমাশটা। মাঝে মাঝে ছুরি চালাচ্ছে মাঝবয়েসি লোকটাকে লক্ষ্য করে, পাকা খেলোয়াড়ের মতো এড়িয়ে যাচ্ছে লোকটা। আরো কিছুক্ষন এভাবে চক্রাকারে নিজেদের প্রদক্ষিন করল দুজন।
এরমধ্যে জ্ঞান ফিরে পেয়েছে রাজু। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। রাশেদের সাথে চোখাচোখি হলো এক মুহূর্তের জন্য। বিস্ময়ে বেচারার চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা।
আবারো ছুরি বাড়িয়ে দিয়ে ঘাই দেয়ার চেষ্টা করেছে লম্বা লোকটা। সেই সুযোগে মাথা নিচু করে বসে হাতের দড়িটা লম্বা লোকটার পা বরাবর ছুঁড়ে দিয়েছে মাঝ বয়েসি মানুষটা। কোরবানীর সময় গরুর পায়ে যেভাবে দড়ি ঢোকানো হয় অনেকটা সেরকমভাবে। দুই পা পেঁচিয়ে যাওয়ায় ভারসাম্য রাখতে পারল না লম্বা লোকটা। ধাম করে পড়ে গেল মেঝেতে। এক পাশে রাখা ছোট একটা চৌকির কোনায় মাথাটা লাগল তার।
চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল রাশেদ, লোকটা পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে। মনে হচ্ছিল লম্বুর মাথার খুলি ফেটে গিয়ে মগজ বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি,লম্বু এখনো তাকিয়ে আছে, কপালের একপাশ কেটে গিয়ে দরদর করে রক্ত বের হচ্ছে। হাত থেকে ছুরিটা ছুটে গিয়ে ঠিক রাশেদের পায়ের সামনে এসে পড়েছে।
ধীরস্থিরভাবে রাশেদের সামনে এসে দাঁড়াল মাঝবয়েসি লোকটা, একটু ঝুঁকে ছুরি তুলে নিলো। লম্বা লোকটার কাছে গেল, করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বেচারা, বুঝতে পারছে নিজের ছুরিতেই জান যাবে তার।
কিন্তু ছুরিটা লম্বা লোকটার পেটে না বসিয়ে এর বাট দিয়ে মাথায় আঘাত করলো মাঝ বয়েসি লোকটা। সাথে সাথে চেতনা হারাল লম্বু।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রাশেদ, চোখের সামনে কারো মৃত্যু দেখতে ভালো লাগে না তার।
কৃতজ্ঞতার চোখে মাঝবয়েসি লোকটার দিকে তাকাল রাশেদ।
কিন্তু ওদের দুজনের দিকে ভ্রূক্ষেপ করলো না লোকটা। ছুরিটা কোমরে খুঁজে বেরিয়ে যাচ্ছে ছোট ঘরটা থেকে।
‘আমাদের খুলে দিয়ে যান, প্লিজ,’ চেঁচিয়ে বলল রাশেদ, অনেকটা আর্তনাদের মতো শোনাল তার কণ্ঠস্বর।
ঘুরে দাঁড়াল মানুষটা। দুজনের দিকে তাকাল এক এক করে।
‘নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করে নাও,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল লোকটা।
‘প্লিজ, ওরা মরেনি,অজ্ঞান হয়েছে মাত্র। আপনি চলে যাওয়ার পর বদমাশগুলো জ্ঞান ফিরে পেলে মহা ঝামেলায় পড়ে যাবো আমরা।’
হাসল লোকটা, বয়স হলেও হাসিটা শিশুসুলভ।
‘হুম, ঠিক আছে।‘
রাশেদের দিকে না এসে রাজুর দিকে এগুলো লোকটা। হাতের বাঁধন খুলে দিলো। তারপর রাজুকে ইশারা করল রাশেদের বাঁধন খুলে দেয়ার জন্য।
কিছুক্ষন আগের বন্দী তিনজন এখন মুক্ত। হারিকেনের আলোয় লোকটাকে এবার আরো কাছ থেকে দেখছে রাশেদ। জুলপিতে পাক ধরেছে, চুলে কিছুটা লালচে ভাব মানুষটার এবং সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে লোকটার চোখ। একদম নীল। এই ধরনের নীল চোখা মানুষ আগে কখনো চোখে পড়েনি তার।
‘এখান থেকে বের হয়ে কোন দিকে যাবো?’ জিজ্ঞেস করল রাশেদ।’
‘সেটাও কি আমি বলে দেবো!’
‘আমরা আসলে এই এলাকায় একেবারেই নতুন, কিছুই চিনি না।’
‘ঠিক আছে, তাহলে আমার পেছন পেছন এসো, ঠিক জায়গায় তোমাদের পৌঁছে দেবো।’
রাশেদের সাথে গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে রাজু।
‘ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে মানে? পরপারে পাঠিয়ে দেয়ার মতলব নাকি? ফিসফিস করে রাশেদের কানে কানে বলল রাজু।
হাতে চিমটি কেটে ওকে চুপ থাকার জন্য ইশারা করল রাশেদ।
‘ভয়ের কিছু নেই। চাইলে তোমাদের এখানে ফেলে যেতে পারতাম, তা যখন করিনি তাহলে তোমাদের চিন্তার কিছু নেই।‘
‘এই লোকগুলোর সঙ্গিসাথিরা নিশ্চয়ই আশপাশে আছে, খুব সাবধানে এগুতে হবে,’ রাশেদ বলল।
‘জাস্ট ফলো মি,’ বলল লোকটা, তারপর কুড়েঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
লোকটা বেরিয়ে যাবার পরও কিছুক্ষন স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইল দুজন। একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে, কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
হঠাৎ মনে হলো বেঁটে লোকটা নড়ে উঠেছে। লক্ষ্য করা মাত্রই দৌড়ে দরজার সামনে চলে গেল রাজু। রাশেদও দেরি করলো না। ঐ শয়তানদের হাতে পড়ার চেয়ে মাঝ বয়েসি লোকটার সাথে যাওয়া অনেক নিরাপদ।
*
অধ্যায় ৮
কয়েকদিনের মধ্যেই গোটা গ্রামটা পরিচিত হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েকজনের সাথে রীতিমতো দোস্তিও হয়ে গেছে। সময়টা খারাপ কাটছে না লখানিয়ার। অনেক দিন এরকম জীবনযাপন থেকে দূরে থেকেছেন, এখন কিছুটা উপভোগ করলে ক্ষতি কি।
অ্যাক্সিডেন্টে স্মৃতিশক্তি হারিয়েছেন এরকম ব্যাখ্যা দিয়ে গ্রাম থেকে দীর্ঘদিন দূরে থাকার অজুহাতকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছেন তিনি, সেই সাথে কাউকে ঠিকভাবে চিনতে না পারার পেছনেও একই কারনের কথা বলেছেন। এখন খুব কাছের কাউকে না চিনলেও কেউ কিছু মনে করে না। ধরে নেয় ভুলে গেছে বেচারা। গ্রামটায় তার বন্ধু নিতান্ত কম না, সবচেয়ে বড় কথা বেশ কয়েকজন মেয়েবন্ধুও ছিল প্রাক্তন লখানিয়ার। মেয়েমহলে লখানিয়া যে জনপ্রিয় ছিল এটা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু নিজেকে সামলে রেখেছেন তিনি, যা হয়তো অনেকের কাছে অস্বাভাবিক লাগতে পারে। রাতে চেলো মদ খেয়ে সবাই যখন এখানে সেখানে ঢু মারতে যায় তিনি তখন ফিরে আসেন নিজের কুঁড়েঘরে। লখানিয়ার বুড়ি মা তখনো তার জন্য অপেক্ষায় থাকে খাবার নিয়ে। হ্যারিকেনের আলোয় নিজের হাতে খাইয়ে দেয় শতাব্দি প্রাচীন এক পথিককে যে এখানে তার ছেলের ভূমিকা নিয়েছে।
প্রতারনা করতে ভালো লাগে না তার, কিন্তু এই বুড়ো মানুষটার অপত্যস্নেহকে কোনভাবে অপমান করা তার পক্ষে সম্ভব না। তার চেয়ে এই মাতৃস্নেহ উপভোগ করা অনেক বেশি আনন্দের।
সবাই রাতে ঘুমিয়ে গেলে বাইরের ছোট উঠোনটায় চলে আসেন তিনি। ঘুম আসতে চায় না সহজে কিংবা দীর্ঘদিনের স্মৃতিরা যেন ঘুমকে কাছে আসতে দেয় না। বারবার পুরানো সব কথা মাথায় ঘুরতে থাকে। তার নিজের সেই গ্রাম, সেই নদী, সেই গাছপালা, মানুষ। কোথায়? কতোদূরে?
১৭৬০ খৃস্টাব্দ
প্রচন্ড ঠান্ডায় কাঁপছে মিচনার। কতক্ষন ধরে পানিতে ভেসে আছে মনে করতে পারছে না সে। আশপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলা ঠিক হবে। শুধু কালো পানি। রাতের অন্ধকারে সমুদ্রের পানি যেন অন্ধকারের সাথে মিলেমিশে গেছে। এভাবে আর বেশিক্ষন টেকা যাবে না। এমনিতেই তলিয়ে যাবে সে, সমুদ্রের তলদেশে হারিয়ে যাবে চিরদিনের জন্য। যদিও স্বপ্ন ছিল অনেক কিছু করার, অনেক দেশ দেখার, অনেক কিছু জানার। কিন্তু সবকিছু এখানেই থেমে যাবে। এই ঠান্ডা বরফের মতো শীতল পানিতে।
নির্জীবের মতো আরো কিছুক্ষন ভেসে থাকল মিচনার। ভাবার চেষ্টা করলো কি হয়েছে তার প্রিয় জাহাজটার, সেই সাথে সঙ্গি নাবিকদের। ক্যাপ্টেনের মৃত্যু নিজের চোখেই দেখেছে সে, শত্রুরা নিশ্চয়ই তাদের জাহাজ লুট করে ডুবিয়ে দিয়েছে। অনেকেই নৌকা নিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছে। সেও হয়তো ঐসব দলের মধ্যে থাকতে পারতো। কিন্তু ফাস্ট মেট জনসন…
মাথায় হাত দিয়ে দেখল মিচনার, ঠান্ডায় জমে গেছে সারা শরীর। তাই কিছু অনুভব করতে পারছে না। জনসন একটা ঘুষি বসিয়েছিল, সেই সাথে পেছন থেকে কেউ একজন মাথায় আঘাত করেছিল, মনে পড়ছে না এখন।
হঠাৎ পানির নীচে কিসের আলোড়ন টের পেল। তার চারপাশের পানি কেমন ঘুরছে মনে হচ্ছে, চক্রাকারে। হাঙররা শিকারের চারপাশে প্রথমবার চক্কর দেয় বলে শুনেছে সে। হাঙরের পেটেই যেতে হচ্ছে তাহলে। পায়ে কিসের স্পর্শ পেয়ে শিউরে উঠলো। আর স্থির থেকে লাভ নেই, প্রানপন সাঁতার কাটার চেষ্টা করল মিচনার। কিন্তু পানি যেন জমে আছে, হাত-পা নাড়ানোই সার, একবিন্দু নড়তে পারেনি নিজের অবস্থান থেকে। শক্তি ফুরিয়ে আসছে।
হাঙর নিশ্চয়ই একটা না, অনেকগুলো হবে।
হঠাৎ সব থেমে গেল। ঠিক যেভাবে আলোড়ন শুরু হয়েছিল আচমকা, ঠিক তেমনি সব থেমে গেল। চারপাশে এখন সব স্থির, পানিও স্থির। চারদিকে তাকাল মিচনার। নিকষ অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে বোঝা যাচ্ছে এটা ঝড়ের পুর্বাভাস। বড় ঝড়ের আগে সমুদ্রের পানি এভাবে স্থির হয়ে যায় বলে শুনেছে সে বুড়ো নাবিকদের কাছ থেকে আর সামুদ্রিক প্রানীরাও তা আগে থেকে টের পেয়ে সাবধান হয়ে যায়।
আকাশের দিকে তাকাল মিচনার। কালো অন্ধকার আকাশ, মেঘে ঢেকে আছে। বিদ্যুৎ চমকালো এই সময়। সমুদ্রের পানি আবার নড়তে শুরু করেছে। বড় বড় ঢেউ উঠছে, সেই ঢেউয়ে একবার উপরে ওঠে আবার নীচে নামছে মিচনার। ক্রমাগত লবনাক্ত পানি ঢুকছে পেটে। কিছুই করার নেই ভাগ্যের হাতে নিজেকে সপে দেয়া ছাড়া। আশপাশে স্থলভাগ নেই, থাকলেও হয়তো এই অন্ধকারে তার চোখে পড়বে না।
ঢেউয়ে দুলতে দুলতে ডানদিকে অনেকটা সরে এসেছে মিচনার। প্রানপন চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকার, ভয় পেয়ে লাভ নেই। এবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মুষলধারে। মুখ কিছুক্ষন হা করে থাকল, বৃষ্টির পানিতে জিভ ভেজানোর চেষ্টা। লবনাক্ত পানিতে মুখটা তেতো হয়ে আছে।
আর কতোক্ষন এভাবে ভাসতে হবে জানা নেই, বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা হুল ফোঁটানোর মতো বিধছে মাথায়। গা এলিয়ে দিয়ে চুপচাপ পড়ে রইল মিচনার। ঢেউয়ের মাত্রা বেড়েছে। অসহায়ের মতো উপরে উঠছে আর নামছে সে। মনে আশা ছিল এই বৃষ্টি হয়তো থেমে যাবে আস্তে আস্তে, ঢেউয়ের তেজ কমবে।
কিন্তু না, সে আশায় গুড়েবালি। সবকিছু এলোমেলো করে দেয়ার মতো বিশাল এক সাইক্লোন জন্ম নিচ্ছিল কিছুদিন ধরে। সেটাই এখন আঘাত করার জন্য তৈরি, সেই আঘাতে মিচনার আরো দূরে কোথাও ভেসে গেল।
*
অধ্যায় ৯
কতোক্ষন দৌড়েছে মনে করতে পারছে না রাশেদ, মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে দৌড়াচ্ছে সে। সামনে মধ্য বয়স্ক সেই লোকটা, পেছনে রাজু। লোকটার সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়ানো খুব কঠিন কাজ। এই বয়সেও অনেক প্রানশক্তি ধারন করে বোঝাই যাচ্ছে। চারপাশে ঝোঁপঝাড়, অসমান মাটিতে অন্ধকারে দৌড়ানো খুব কঠিন। আর দৌড়ানো সম্ভব নয় বলে দাঁড়াল রাশেদ। হাফাচ্ছে, বড় করে নিঃশ্বাস নিলো কয়েকবার। রাজু এসে পাশে দাঁড়াল এই সময়।
‘আর পারছি না, দম নিতে নিতে বলল রাশেদ।’
‘আমার অবস্থাও কাহিল।’
‘উনাকে থামতে বল, রাশেদ বলল।’
‘যাক না, উনি থাকলেও সমস্যা হবে না।’
‘লোকটা এতো উপকার করলো আমাদের, অথচ নামটাই জানতে পারলাম না,’ মাটিতে বসে পড়েছে রাশেদ। দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে তার।
‘নাম দিয়ে দরকার নেই, এধরনের লোকের সাথে পরিচিত হওয়া মানেই ঝামেলা।’
বিস্মিত দৃষ্টিতে রাজুর দিকে তাকাল রাশেদ, বন্ধুর মুখ থেকে অনেক দিন পর বুদ্ধিমানের মতো একটা কথা শুনতে পেয়ে।
‘আমরা তাহলে কি করবো?’ রাশেদের পাশে বসতে বসতে বলল রাজু।
চুপ করে থাকল রাশেদ। এখনো উঠার শক্তি পাচ্ছে না সে। সারা শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম নেমে আসছে।
‘কি করবো বল না?’ আবারো জিজ্ঞেস করল রাজু।
‘এখানে বসে থাকাটা নিরাপদ না! ভারি একটা কণ্ঠ শুনতে পেয়ে দুজনেই চমকে সামনে তাকাল। মধ্য বয়েসি একজন দাঁড়িয়ে আছে, একটু আগেও বেশ অনেকটা এগিয়ে ছিল লোকটা। ওদের দুজনকে বসে পড়তে দেখে নিশ্চয়ই থেমেছে লোকটা, ভাবল রাশেদ।
‘কিন্তু আর পারছি না,’ রাজু বলল।
‘পারতে হবে, এই বয়সেই এমন হাঁপিয়ে পড়লে চলবে না,’ কিছুটা ঠাট্টার সুরে কথাগুলো বলল লোকটা।
উঠে দাঁড়াল রাশেদ, এখানে বসে থাকা আসলেই নিরাপদ না।
‘কোনদিকে যাবো?’
‘জাস্ট ফলো মি,’ যেন আদেশ দিল লোকটা।
নির্দ্বিধায় হুকুম মেনে নিলো দুজন। নিকষ অন্ধকারে অচেনা একজন মানুষের পেছনে হাঁটতে থাকল।
***
সন্দীপ তারচেয়ে বয়সে অনেক ছোট, ওকে অনেক আগে থেকেই চেনেন। অন্য লোকটাকে দেখে তেমন ভরসা পেলেন না তিনি, বাংলাদেশ থেকে এসেছে। বেশ নরমসরম চেহারা, ভারিক্কি ভাব নেই। মাঝামাঝি ধরনের স্বাস্থ্য, তবে চোখ দুটোতে দারুন বুদ্ধির ছাপ আছে মনে হলো তাঁর কাছে। সন্দীপ এই বয়সেই গাম্ভীর্য্য জিনিসটা ভালোই আয়ত্ত্ব করে ফেলেছে। বাংলাদেশি ভদ্রলোকের নাম ড. আরেফিন। পরিচয় হওয়ার সময় হেসেছিল লোকটা, হাসিটা বেশ।
তাকে দেখে সন্দীপের মধ্যে তেমন ভাবান্তর দেখতে পেলেন না প্রফেসর সুব্রামানিয়াম। কেমন চুপচাপ, গম্ভীর হয়ে আছে। কি যেন ভাবছে গভীর মনোযোগে। আগের ছটফটে ভাব নেই, এখন বেশ পরিণত, শান্ত মনে হচ্ছে সন্দীপকে।
আজ সকালেই তিনজন এক হয়েছেন দিল্লীর নামী এক হোটেলে। সকালে এসে পৌঁছেছেন তিনি। সন্দীপ আর ঐ বাংলাদেশি ভদ্রলোক এসেছে গতরাতে।
এখন লবীতে বসে তিনজন তিনদিকে তাকিয়ে আছে। যেন কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না।
ড. আরেফিনকে দেখে মনে হচ্ছে উশখুশ করছেন, সঙ্গিদের সাথে পরিচয় হয়েছে কেবল, আরো কথা বলতে চান। কিন্তু চুপচাপ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার দুই সহকর্মী। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা ম্যাগাজিন টেনে নিলেন ড. আরেফিন। ড. কারসন মেইলে লিখেছিলেন সকালে আসবেন, তখন তিনজন যেন তার জন্য লবীতে অপেক্ষা করে। একটু আগে জানা গেছে তার ফ্লাইট ডিলে হয়েছে। সন্দেহ হচ্ছে প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের। ড. কারসন হয়তো ইচ্ছে করেই দেরি করছেন, যদিও এমনটা ভাবার কোন যুক্তি নেই তার কাছে।
‘আর কতোক্ষন অপেক্ষা করতে হবে, এর চেয়ে রুমে ফিরে যাই,’ ড. আরেফিনের দিকে তাকিয়ে বলল সন্দীপ।
উত্তর দেয়ার আগে প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের দিকে তাকালেন ড. আরেফিন। ভদ্রলোক অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। এই দুজনের মধ্যে কোন সমস্যা আছে, কেন যেন মনে হলো তার।
‘আরো কিছুক্ষন দেখি,’ ড. আরেফিন বললেন। ‘আপনি কি বলেন?’ প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
কাঁধ ঝাঁকালেন প্রফেসর। হাসার চেষ্টা করে মুখ বাঁকালেন, যদিও এ দিয়ে তিনি কি বুঝিয়েছেন তিনি নিজেও জানেন না।
উঠে দাঁড়িয়েছেন ড. আরেফিন। সামনে মহাসমস্যা আছে বোঝা যাচ্ছে। এই দুই ইন্ডিয়ান প্রফেসরের সাথে কাজ করা মহা ঝামেলা হয়ে যাবে। ছেলেমানুষের মতো আচরন করছে দুজন। পরস্পরকে ভালো করে চিনেও না চেনার ভান করছে।
‘কেমন আছেন সবাই?’
কণ্ঠটা চেনা মনে হলো ড. আরেফিনের কাছে। ঘুরে দাঁড়ালেন। ভোজবাজির মতো উদয় হয়েছেন ড. কারসন। চমকে গেলেও প্রকাশ করলেন না তিনি।
‘দুঃখিত, অনেকক্ষন বসিয়ে রেখেছি আপনাদের,’ হাসিমুখে বললেন ড. কারসন। এগিয়ে এসে সবার সাথে হাত মেলাচ্ছেন। হাতে একটা ট্রাভেল ব্যাগ। বড় ব্যাগটা ট্রলিতে করে নিয়ে যাচ্ছে বেয়ারা, তারমানে মাত্রই হোটেলে ঢুকেছেন।
‘সন্দীপ, সুব্রামানিয়াম এবং আরেফিন, আপনারা তিনজনই এসেছেন দেখে খুব ভালো লাগছে, একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন ড. কারসন, এমন জায়গায় চেয়ারটা রেখেছেন যাতে তিনজনের মুখোমুখি বসা যায়।
মাথা নাড়াল সন্দীপ, সুব্রামানিয়ামও তাই করলেন। ড. আরেফিন হাসলেন।
‘আমি রুমে যাচ্ছি, ঠিক আধ ঘন্টা পর সবাই আমার রুমে আসবেন, সেখানেই ব্রিফ করবো আমাদের কাজ সম্পর্কে,’ ড. কারসন বললেন। বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।
‘কিন্তু আপনার তো ফ্লাইট ডিলে হয়েছিল?’ জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর সুব্রামানিয়াম।
‘একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু চেষ্টাটা সফল হয়নি মনে হচ্ছে,’ কপট মন খারাপের চেহারা করে বললেন ড. কারসন।
‘আপনার রুম নাম্বার কতো ড. কারসন?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।
নাইন টু টু। আমি উঠি তাহলে, ঠিক ত্রিশ মিনিট পর আশা করছি আপনাদের, বললেন ড. কারসন।
‘ঠিক আছে,’ বললেন ড. আরেফিন। বাকি দুজনের দিকে তাকালেন, উঠে দাঁড়িয়েছে ওরাও।
সন্দীপকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। প্রফেসর সুব্রামানিয়াম দুজনের দিকে হাত নাড়িয়ে চলে গেছেন।
‘কি হলো আপনি রুমে যাবেন না?’ সন্দীপকে জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।
‘একটু বসুন, কিছু কথা আছে, প্রায় ফিসফিস করে বলল সন্দীপ।
অবাক হলেও বসলেন ড. আরেফিন।
‘মনে হচ্ছে আমাদের অনুসরন করছে কেউ,’ গলা আরো নামিয়ে বলল সন্দীপ, এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে।
‘আমাদের? কে অনুসরন করবে?’
‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’
‘হমম, সত্যি বলতে আমি তেমন কোন লক্ষন দেখতে পাইনি এখনো, ড. আরেফিন বললেন।
‘আমি পেয়েছি, কাল রাতে ডিনার করতে নীচে নেমেছিলাম, রুমে ফিরে দেখি আমার জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করা হয়েছে।’
‘রুম সার্ভিস করতে পারে।’
‘তা পারে, কিন্তু ওরা করেনি এটা নিশ্চিত।’
‘কিভাবে নিশ্চিত হলেন?
‘ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোন রুম সার্ভিস পাঠানো হয়েছিল কি না আমার রুমে, সে বলল কাউকে পাঠানো হয়নি।’
‘এতে তেমন কিছু প্রমান হয় না, হয়তো জিনিসপত্র আপনিই নাড়াচাড়া করেছিলেন, পরে ভুলে গেছেন,’ ড. আরেফিন বললেন।
অবাক চোখে তাকাল সন্দীপ। ড. আরেফিন তার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি দেখে সে কিছুটা হতাশ মনে হলো।
‘ঠিক বলেছেন, হতেও পারে। হয়তো আমারই ভুল ধারনা, দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল সন্দীপ।
‘চলুন তাহলে উঠি, উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ড. আরেফিন। পাঁচ মিনিট এর মধ্যে চলে গেছে। ড. কারসনের রুমে যাওয়ার আগে রুমে ফিরে গোসলটা সেরে নিতে চান তিনি, কিন্তু এই সন্দীপ কথা শুরু করলে সহজে থামার পাত্র নয় তা সে বুঝে গেছে কিছুক্ষনের মধ্যেই।
ড. আরেফিন উঠে যাওয়ার পর আরো কিছুক্ষন লবীতে বসল সন্দীপ। কোথায় যেন একটা গন্ডগোল আছে, ধরতে না পারা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না সে।
দূরে কাউন্টারের কাছে শধারী একটা যুবক তাকিয়ে আছে তার দিকে। যদিও তা চোখে পড়েনি সন্দীপের।
সন্দীপ উঠে দাঁড়াতে মোবাইল ফোন বের করল শশ্রুধারী।
*
অধ্যায় ১০
‘আমি রাশেদ, আর ও আমার বন্ধু রাজু,’ নিজেদের পরিচয় দিয়ে মাঝ বয়েসি লোকটার সাথে হাত মেলাল রাশেদ।
উত্তরে নিজের নাম বলার কথা লোকটার, কিন্তু সে ভদ্রতার ধার না ধেরে একটা সিগারেট ধরিয়েছে লোকটা। যেন এর চেয়ে বড় কাজ আর নেই।
চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। প্রায় ঘন্টাচারেক দৌড়ানোর পর পাহাড় পাড়ি দিয়ে সমতলে নেমে আসতে পেরেছিল ওরা। এই লোক না থাকলে ওদের দুজনের পক্ষে তা কখনোই সম্ভব হতো না। পুরো এলাকাটাকে মনে হয় হাতের তালুর মতো চেনে।
‘আমার নাম তানভীর, তানভীর রহমান,’ একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল লোকটা।
হোটেল রুমে এসে পৌঁছেছে ওরা কিছুক্ষন হলো। তানভীর রহমানও নাকি একই হোটেলের বাসিন্দা, শুনে কিছুটা কাকতালীয় মনে হলেও মেনে নিয়েছে রাশেদ, নিজের রুমে ডেকে বসিয়েছে আলাপ করার জন্য। যদিও সারা রাতের পরিশ্রমে শরীর যেন আর মানতে চাইছে না।
ধন্যবাদ, তানভীরসাহেব, কাল রাতে আপনি আমাদের বাঁচিয়েছেন,’ রাশেদ বলল, সমর্থনের জন্য রাজুর দিকে তাকাল। রাজু বিছানার এককোনায় বসে আছে, মুখ ভার করে, কারন বুঝতে পারলো না রাশেদ।
‘ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই, ইটস ওকে,’ সিগারেটে বড় একটা টান দিয়ে বলল তানভীর রহমান।
‘আমরা আসলে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম, কিন্তু আপনি…’
‘আমি…আমি…’ কিছুক্ষন আমতা আমতা করলো তানভীর, মনে হচ্ছে বলতে চাইছে না।
‘ওরা আমাদের আটকে রেখেছিল কেন?’ কথা অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য বলল রাশেদ।
‘সম্ভবত ওরা মাদক অথবা অস্ত্র চোরাচালানী, নিজেদের ঘাঁটির অবস্থান কারো কাছে ফাঁস হয়ে যাক তা ওরা চায়নি।’
‘হুম, হতে পারে, আপনি কিভাবে আটকে পড়লেন তা কিন্তু বলেননি,’ গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করল রাজু, বেশ কিছুক্ষন ধরেই সে চুপচাপ ছিল।
‘পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোরা আমার একটা নেশা বলতে পারো, হঠাৎ ওদের হাতে ধরা পড়ে যাই,’ তানভীর রহমান বলল। আসট্রেতে সিগারেট গুঁজে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
‘আপনার রুম নাম্বার কতো?’
‘দুইশ দুই, এখানে আরো কয়েকদিন আছি, চাইলে এসো, গল্প করা যাবে।’
দরজা খুলে দিল রাশেদ। তানভীর রহমান বের হয়ে গেল রুম থেকে।
রাজুর দিকে ফিরল রাশেদ।
‘তোর কি হয়েছে রে?’ রাজুকে জিজ্ঞেস করল।
‘কিছু না।’
‘কিছু একটা তো হয়েছে।’
‘তুই লক্ষ্য করেছিস ভদ্রলোকের চোখের রঙ, কেমন নীল,’ বলল রাজু, পায়চারি করছে রুমটায়। এছাড়া উনার কথা একেবারেই বিশ্বাস হয়নি আমার, কোথাও কোন ঘাপলা আছে।
‘কি রকম শুনি?’ বিরক্তির সুরে জিজ্ঞেস করল রাশেদ।
‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না,’ হতাশ কণ্ঠে বলল রাজু।
‘তোর আর বুঝে কাজ নেই, নাস্তার অর্ডার দে, নাস্তা খেয়ে ঘুমাবো,’ বলল রাশেদ। তারপর বাথরুমে ঢুকে গেল।
পায়চারি করছে রাজু এখনো। কোথাও একটা খটকা আছে, কি সেটা বের করা পর্যন্ত শান্তি হবে না।
রুমে টেলিফোন সেটটার দিকে তাকাল রাজু। নাস্তার অর্ডার দিতে হবে, সেই সাথে একটা তথ্য জেনে নিলে ভালো হয়।
নাম্বার ঘোরাল।
‘নাস্তা পাঠান চারশ আট নাম্বার রুমে।’
‘পাঠাচ্ছি স্যার।’
‘আরেকটা কথা, দুইশ দুই নাম্বার রুমে যে গেস্ট আছেন তার নাম বলা যাবে?’
‘কেন স্যার, কোন সমস্যা?’
‘সমস্যা নেই। জানা দরকার। হয়তো আপনারও তাতে লাভ হবে।’
‘ভদ্রলোকের নাম লরেন্স ডি ক্রুজ, এই মাত্র বাইরে চলে গেছেন তিনি। কিছু বলতে হবে?
উত্তর না দিয়ে রিসিভারটা রেখে দিলো রাজু। তার ধারনা পুরোপুরি ঠিক, কোথাও কোন সমস্যা আছে।
***
দিনগুলো বেশ কেটে যাচ্ছে লখানিয়ার। কোন চিন্তাভাবনা নেই, সারাদিন এখানে সেখানে গল্পগুজব আর আড্ডায় সময় ভালোই কাটছে। সমস্যা হচ্ছে বুড়ি বায়না ধরেছে বিয়ে করতে হবে। বিয়ে! মনে মনে হাসে লখানিয়া। গত জীবনটা যার সাথে পার করেছেন তার কথা মনে পড়ে যায়। বিয়ে করার কোন ইচ্ছে জীবনে ছিল না। কিন্তু রহিম ব্যাপারির অনুরোধ ফেলতে পারেননি। এবার আর সেরকম কোন ভুল করা চলবে না। যে উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন তা পুরো করতে হবে যে কোন মূল্যে।
তিব্বতে বৃদ্ধ শেবারনের দেয়া সেই চামড়ার খোপটা সুটকেসে আছে। গতরাতেও বের করে দেখছিলেন। সাম্ভালায় যাওয়ার ম্যাপ আছে সেখানে। যদিও কিছু বুঝতে পারেননি ম্যাপটা দেখে। কবে কে ম্যাপটা বানিয়েছিল জানা হয়নি। বৃদ্ধ শেবারন ম্যাপটা পেয়েছিল তার গুরুর কাছ থেকে, সেই গুরুও বোধহয় অন্য কারো কাছ থেকে পেয়েছিল জিনিসটা। এখন হাজার বছর পর এই ম্যাপ দিয়ে সঠিক জায়গা বের করা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। যদিও অসম্ভবকে জয় করার মতো সাহস, শারীরিক শক্তি, ধৈর্য এবং সময় সবই আছে তার হাতে। এখন শুধু বের হওয়ার অপেক্ষা। এখানে থেকে থেকে কেমন মায়া জন্মে যাচ্ছে সবকিছুর উপর।
‘লখানিয়া, খেয়ে যা,’ বুড়ির ডাক এলো বাইরে থেকে।
ছোট খাঁটিয়ায় উঠে বসল লখানিয়া। বুড়ি পারলে নিজের হাতে খাইয়ে দেয় ছেলেকে। ডাল, সজি আর রুটি। তাও অমৃতের মতো লাগে।
বারান্দায় খাবার সাজিয়ে বসে আছে বুড়ি। বড় একটা বাটিতে দুই তিন পদ রাখা, একপাশে কাসার গ্লাসে পানি। ছেলেকে না খাইয়ে বুড়ি খায় না, তাই বুড়ির সামনে পেট পুরে খেয়ে নেয় লখানিয়া।
একপাশে দাঁড়িয়ে গ্লাসের পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিলো লখানিয়া। সেখান থেকেই চোখে পড়ল বুড়ি কাঁদছে।
‘ও মা, তুমি কাঁদো ক্যান?’ জিজ্ঞেস করে লখানিয়া। উত্তর দেয় না বুড়ি, চোখ মুছে খাবার প্লেট এগিয়ে দেয় ছেলের দিকে।
রুটি ছিঁড়ে সবজি দিয়ে খাওয়া শুরু করে লখানিয়া। কিন্তু খাবার নামতে চায় না গলা দিয়ে। আড় চোখে তাকায় বুড়ির দিকে। চোখ এখনো ভেজা ভেজা। যেন কিছু একটা জানে কিন্তু লুকোতে চায়।
‘মা, তুমি এমন করলে আমি কিন্তু খাবো না?’
‘খা বাবা, তুই না খেলে রান্না করে কাকে খাওয়াবো,’ মৃদু স্বরে বলে বুড়ি।
আর কথা বাড়ায় না লখানিয়া। এটুকু বোঝা যাচ্ছে আর সবাইকে ফাঁকি দেয়া গেলেও বুড়িকে ফাঁকি দেয়া যায়নি। মায়ের চোখ ঠিকই নিজের সন্তানকে চিনতে পারে। কিন্তু এসব নিয়ে কথা বলে বুড়ো মানুষটাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছে না।
এখানে আর বেশিদিন থাকা যাবে না। সময় হয়েছে যাত্রা শুরু করার। যাওয়ার আগে সুটকেস দুটোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। এতো ভারি দুটো জিনিস নিয়ে দীর্ঘ যাত্রায় যাওয়ার কোন মানে নেই। শুধু শেবারনের দেয়া খোপটা নিলেই চলবে। সাম্ভালা’র খোঁজ সেখানেই আছে।