১.৪ পার্কের বেঞ্চে

অধ্যায় ৩১

বাসায় চলে এসেছে রাশেদ কিছুক্ষন আগে। পার্কের বেঞ্চে বসে থেকে বেশ ঘুম পাচ্ছিল, কিন্তু বাসায় আসার পর এখন আর ঘুম পাচ্ছে না। বিছানায় কিছুক্ষন গড়াগড়ি করেছে। কিন্তু কাজ হয়নি। দুপুর হয়ে গেছে। একটু পরই খাবারের জন্য ডাইনিং রুমে যেতে হবে, তাই না ঘুমানোই ভালো হবে বলে ঠিক করল সে।

ড. আরেফিন সকালে বের হয়েছিলেন, এখনো ফেরেননি। কখন ফিরবেন কে জানে, মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করল রাশেদ কিছুক্ষন। ফোনটা চালু করা দরকার। বাবার খবর, লিলির খবর নিতে হবে। এরা দুজনেই নিশ্চয়ই খুব টেনশনে আছে। বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে মুখটা তেতো হয়ে গেছে। মাথায় ব্যথা আছে খানিকটা, না ঘুমানোর ফলেই এরকম হয়েছে। একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নিতে হবে মনে করে।

মোবাইল ফোনের চার্জারটা ট্রাভেল ব্যাগ থেকে বের করল রাশেদ, তারপর চার্জে দিল। যাই হোক না কেন, মোবাইল খোলা রাখা উচিত। বাবা কিংবা লিলি কোন বিপদে পড়লে ওরা জানাতেও পারবে না।

বুয়া এসে খাওয়ার জন্য ডেকে গেছে মাত্র। ডাইনিং রুমে ঢুকে দেখল ড. আরেফিনের স্ত্রী বসে আছেন টেবিলে। মনে হচ্ছে অপেক্ষা করছেন রাশেদের জন্য।

একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়ল রাশেদ। ভদ্রমহিলার সাথে সৌজন্যমূলক কথা বলা দরকার। কিন্তু কথা আসছে না তার। একটু অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। তবে গতকাল রাতে ভদ্রমহিলার বুদ্ধিমত্তার জন্যই জানে বেঁচে গেছে সবাই।

‘বাসায় কে কে আছে তোমার?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিনের স্ত্রী। তাকিয়ে আছেন রাশেদের দিকে। গলার সুরটা নরম, স্নেহমাখা।

‘বাবা-মা, দাদু, রাশেদ বলল।’

‘তুমি একা? ভাই-বোন নেই?’

‘না, আমি একমাত্র সন্তান।

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি, কিছু মনে করো না,’ বলে একটু থামলেন মহিলা, ‘তোমরা দুজন কি কোন ঝামেলায় জড়িয়েছ?’

কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না রাশেদ। মহা ঝামেলায় পড়েছে, কিন্তু বলা বোধহয় ঠিক হবে না।

‘ন-না, তেমন কিছু না, সমস্যা হবে না।’ রাশেদ বলল ঢোঁক গিলে।

‘আচ্ছা, ঠিক আছে, খাবার সময় আর প্রশ্ন করবো না। তুমি খাও, আমি দেখি।’ ভদ্রমহিলা বললেন।

বেশ অস্বস্তির সাথে খেয়ে নিলো রাশেদ। যে পরিমান ক্ষুধা পেয়েছিল, সে তুলনায় খেতে পারলো না। ভদ্রমহিলা যথেষ্ট সাধাসাধি করলেন। এমন স্নেহ অনেকদিন পায় না। সে। গ্রামে পড়ে থাকা মায়ের কথা মনে পড়ল, আপন মা’কে তেমন মনে পড়ে না, কিন্তু সৎ মা হলেও তার মুখটা এখন ভেসে উঠলো চোখের সামনে।

দুপুরের খাবারের পর নিজের রুমে চলে এলো রাশেদ। মোবাইল ফোনের চার্জ হয়ে গেছে। কাজেই দুএকটা ফোন করা যেতে পারে।

লিলির নাম্বারে চেষ্টা করল রাশেদ। বন্ধ।

বাবার নাম্বারে ডায়াল করলো এবার। দুটো রিঙ বাজার পরই অনেকদিন পর পরিচিত কণ্ঠটা শুনতে পেল রাশেদ।

‘বাবা রাশেদ, তুমি কোথায়?’ ওপাশ থেকে আজিজ ব্যাপারি জিজ্ঞেস করলেন।

‘আছি, ঠিক আছি, ঢাকায়, আপনি কেমন আছেন? দাদাজান? মা?’

‘আমরা ভালো আছি, তোমার খোঁজে ঢাকা আসছি, হলে গেছিলাম, অনেক পেরেশানিতে আছি বাবা রাশেদ। তুমি ঠিকানা দাও, আমি আসছি।

‘আপনি ঢাকায়? কবে এলেন?’

‘আসছি গতকাল, তোমার ঠিকানা দাও, আমি আসবো।‘

রাশেদ ঠিকানা দিলো। এতো দূর থেকে কষ্ট করে এসেছেন, ঠিকানা না দিলে খারাপ হতো। কতোদিন দেখা হয় না, শেষ দেখা হয়েছিল প্রায় ছয় মাস আগে।

ফোনটা রেখে দিল রাশেদ। বাবা যেকোন সময় চলে আসবেন। চিন্তা হচ্ছে লিলির জন্য। মেয়েটা কি দেশে নেই, না কি কোন ঝামেলায় পড়েছে?

দরজায় নক হলো এই সময়। ড. আরেফিন কি ফিরেছেন? দরজা খুলে অবাক হলো রাশেদ। ড. শাখাওয়াত দাঁড়িয়ে আছেন। হাসি হাসি মুখ করে। পরনে কোট স্যুট। হাতে একটা ব্রিফকেস।

‘আসতে পারি রাশেদ?’

‘প্লিজ, আসুন,’ বলে ভদ্রলোককে ভেতরে ঢুকতে দিলো সে।

একটাই মাত্র চেয়ার রুমটায়। সেটা টেনে নিয়ে বসেছেন ড. শাখাওয়াত।

‘আমি এই পরিবারের খুব ঘনিষ্ট মানুষ। যখন খুশি আসতে পারি। কাল রাতের ঘটনা শোনার পর আর স্থির থাকতে পারিনি, বললেন ড. শাখাওয়াত।

লোকটার কথাগুলো কেমন বানানো, মেকি মনে হলো রাশেদের কাছে। মুখে কথা বলছেন, কিন্তু চোখে মুখে একধরনের চালাকি খেলা করছে।

‘খুব বাজে একটা সময় গেছে গতরাতে, রাশেদ বলল। দাঁড়িয়ে আছে এখনো। সে।

‘ড. আরেফিন চলে আসবেন একটু পরই। ততোক্ষনে একটা কাজের কথা বলতে চাইছিলাম তোমাকে।‘

‘কাজের কথা?’

‘হ্যাঁ, কাজের কথা।

‘বলুন।’

‘তুমি তো জানো প্রত্নতাত্ত্বিক ব্যাপারে আমার আগ্রহ কেমন। তোমার কাছে যে বইটা আছে, তার পাঠোদ্ধার করা জরুরী। পৃথিবীর মানুষকে জানানোর প্রয়োজন আছে এই আবিষ্কারটা সম্পর্কে। কিন্তু ড. আরেফিন নিজের স্বার্থে তা কখনোই হতে দেবেন না। কিন্তু আমি চাই জিনিসটা জনসমক্ষে আসুক।’

‘আমি জানতাম আপনি ড. আরেফিনের খুব ভালো বন্ধু।’

‘এখনো তাই আছি। কিন্তু কাজের ব্যাপারটা ভিন্ন। এমনিতেই সারা দুনিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক ঘরানার সবাই চেনে আমাকে। এক নামে। বাংলাদেশে নৃতাত্বিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ব্যাপারে সব ক্ষেত্রেই আমাকে ডাকা হয়। সে তুলনায় ড. আরেফিন সরকারী অফিসের একজন কর্মকর্তা ছাড়া আর কিছুই না।’

‘কিন্তু যাই হোক না কেন, ড. আরেফিনকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করতে পারবো আমি।’

‘তোমার সমস্যা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু ভেবে দেখো, এখানে বেশ কিছু টাকার ব্যাপারও আছে। আমি তোমাকে রাতারাতি বড়লোক করে দিতে পারি।‘

‘রাতারাতি বড়লোক হবার কোন ইচ্ছা আমার নেই, রাশেদ বলল। বুঝতে পারছে ড. শাখাওয়াত লোকটা যেকোন উপায়েই বইটা নিজের করে নিতে চায়। কিন্তু ড. আরেফিনের সাথে বেঈমানি করার কথা চিন্তা করতে পারছে না সে।‘

‘আপনি যেতে পারেন, ড. আরেফিন আসলে বলবো আপনার প্রস্তাবটার কথা।‘

‘আরেফিন একটা মাথামোটা। টাকার মূল্য ওর কাছে কখনোই ছিল না, এখনো নেই। যাই হোক, আমার প্রস্তাবটার কথা ওকে বলার দরকার নেই। এখানেই এর সমাপ্তি।’ ড. শাখাওয়াত উঠে দাঁড়িয়েছেন। বিছানার উপর ট্রাভেল ব্যাগটা রাখা, তার দৃষ্টি সেখানেই।

‘ঠিক আছে, আপনি না করলে বলবো না, আর বললেও লাভ হতো না।‘

‘ওকে, আমার কার্ডটা রাখো,’ একটা ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে দিলেন রাশেদের দিকে ড. শাখাওয়াত, ‘মন পরিবর্তন হলে একটা ফোন দিও। আমি আসি।’

চলে গেলেন ড. শাখাওয়াত। বিকেল হয়ে আসছে। সারারাত ঘুমানো হয়নি,সারাদিনও না। কিন্তু এখন ঘুমকে বিমুখ করতে ইচ্ছে করলো না রাশেদের। দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মনটা ভীষন খারাপ লাগছে। ড. শাখাওয়াতকে অনেক বিশ্বাস করেন ড. আরেফিন, সেই লোকটাই কি না বিশ্বাসঘাতকের মতো কথা বলে গেল! সামনে আরো কতো কি দেখতে হবে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

***

রাতের মধ্যেই গ্রামে ফিরে এলেন তিনি। একেবারে সাধারন বেশে। কিন্তু কেউই এখন তাকে চিনতে পারবে না। একেবারে বদলে গেছেন, আগাগোড়া। এখানে না এসে তার উপায় নেই। সারাজীবনের সম্পদ এখানেই যত্ন করে রেখেছেন অনেকগুলো বছর। এবার সময় হয়েছে স্থান পরিবর্তন করার। গ্রামে ঢোকার পথে অন্ধকার একটা জায়গা বেছে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। যেখানে দাঁড়িয়েছেন সেখানে ঘন জঙ্গল। সচরাচর কেউ আসে না এখানে। রাত আরো বাড়ার জন্য অপেক্ষা। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে কাজে বের হবেন তিনি। গন্তব্য ব্যাপারি বাড়ি, যার নতুন নামকরন হয়েছে চেয়ারম্যান বাড়ি। নিঃশব্দে সুটকেস দুটো নিয়ে আসতে পারলেই কাজ শেষ। তারপর আর কখনো এখানে পা ফেলা হবে না।

ঘড়ি কিনেছিলেন একটা সস্তায়, অন্ধকারেও দেখা যায়। সময় দেখলেন। বারোটার মতো বাজে। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে এর মধ্যে এটা নিশ্চিত। কিন্তু এখনই বের হওয়া ঠিক হবে না।

সুটকেস দুটো নিয়ে সোজা আবার ঢাকায় চলে যেতে হবে। খুব সকালেই। সেখানে যা ঘটছে তা খুব ভালো কিছু হবে না। রাশেদের হলে গিয়েছিলেন তিনি। খবর নেয়ার জন্য। সেখানে ছিল না রাশেদ। অনেকদিন ধরেই নেই। তারপর হঠাৎ খুঁজে পেলেন ছেলেটাকে। একটা পার্কে বসেছিল। কাছে যেতে পারতেন, চিনতেই পারতো না। কিন্তু ঝুঁকি নেননি। দূর থেকেই ওর উপর নজর রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপাতত। বড় কোন ঝামেলায় জড়িয়েছে, তা না হলে হল ছেড়ে অন্য কারো বাসার থাকার কথা না রাশেদের। এছাড়া বাড়ির সামনে পুলিশের ভ্যান দাঁড়ানো। নিশ্চয়ই ওদের উপর অর্ডার আছে, বাড়িটার দিকে নজর রাখার জন্য। সকালের মধ্যেই তাই ঢাকায় ফিরতে হবে। সোজা চলে যাবেন রাশেদ যে খানে আছে সেই বাড়িটার সামনে। ছেলেটাকে সাহায্য করতে হবে। হাজার হোক, নিজের রক্ত। তাকে এভাবে বিপদে ফেলে চলে যেতে মন সায় দিচ্ছে না। এছাড়া ছেলেটার কথাও ভাবছেন। একেবারে দিশেহারার মতো দেখাচ্ছিল ওকে। ছেলের খোঁজে এসে বুড়ো বাপকে হারিয়ে একেবারে দিশেহারা অবস্থা। ওর দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

রাত তিনটের দিকে বের হলেন তিনি জঙ্গলটা থেকে। অল্প সময়েই চলে এসেছেন নিজের বাড়ির কাছে। এখানেই কেটেছে অনেকগুলো বছর তার। প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে। প্রিয় উঠোনটা পড়ে আছে, ফাঁকা। একপাশে তালাবদ্ধ ছোট ঘরটার দিকে এগুলেন তিনি। সুটকেস দুটো বের করেই পালাতে হবে এখান থেকে। ছেলের বৌ সালেহার ঘুম ভাঙ্গে খুব সকালে। এই ঘরটা খোলা দেখলে সাথে সাথে হৈচৈ শুরু করে দেবে। মেয়েটাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি, একটা উপায় করে দেবেন। ওর জন্য বিশেষ একটা কিছু রেখে আসবেন বলে ঠিক করেছেন। তাতেই মেয়েটার মনোকামনা পূরন হবে।

সুটকেস দুটো বের করে বাইরে চলে এলেন। শেষবারের মতো পুরো বাড়িটার দিকে তাকালেন। পুরানো সব স্মৃতি যেন ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় নেই। যেতে হবে ঢাকায়। এখান থেকে রেল স্টেশন একঘণ্টা লাগবে হেঁটে যেতে। ভোরেই একটা ট্রেন আছে, তাতেই ঢাকায় ফিরতে হবে। যে করেই হোক। রাশেদের সমস্যা শেষ না করে শান্তি পাবেন না তিনি।

*

অধ্যায় ৩২

রাত আটটায় ঘুম ভাঙল রাশেদের। দারুন একটা ঘুম হয়েছে। ঘুম অবশ্য এমনি এমনি ভাঙ্গেনি। দরজায় ক্রমাগত নক করছে কেউ। উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে দিল রাশেদ। ড. আরেফিন দাঁড়িয়ে আছেন।

‘ঘুম হলো?’ ড. আরেফিন বললেন হাসি মুখে।

‘হ্যাঁ, মৃদু স্বরে বলল রাশেদ। এখনো চোখ থেকে ঘুম কাটেনি তার।’

‘তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।’

‘কি সারপ্রাইজ?’

‘তোমার বাবা, বসে আছেন, নিচে ড্রইং রুমে।’

রাশেদের ইচ্ছে করছিল দৌড়ে যেতে। কিন্তু নিজেকে কোনভাবে আটকাল। অনেকদিন পর দেখা হবে আজ বাবার সাথে, দারুন একটা ব্যাপার।

রুম থেকে বের হয়ে এলো রাশেদ। পেছন পেছন ড. আরেফিন।

নিচে এসে রাশেদ দেখল কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছেন আজিজ ব্যাপারি। কেমন উস্কোখুস্কো চেহারা, বয়স যেন কিছুটা বেড়ে গেছে এমনিতেই। স্বাস্থ্যও যেন কিছুটা খারাপ হয়েছে।

রাশেদকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছেন আজিজ ব্যাপারি। ছেলেকে নিয়ে আদরের বাড়াবাড়ি তিনি কখনো করেননি,কিন্তু এবার বোধহয় নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না, জড়িয়ে ধরলেন রাশেদকে।

ড. আরেফিন দেখছিলেন পাশে দাঁড়িয়ে। একটা সোফায় গিয়ে বসলেন তিনি।

একটু স্থির হয়ে আজিজ ব্যাপারির পাশে বসেছে রাশেদ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কেমন একটী দূর্বলতা চলে এসেছে আজিজ ব্যাপারির চেহারায়, আচরনে, যা আগে কখনো চোখে পড়েনি তার।

‘বাবা, কি বিপদে আছো তুমি, খুলে বলো।‘ আজিজ ব্যাপারি বললেন রাশেদের পিঠে হাত দিয়ে।

ড. আরেফিনের দিকে তাকাল রাশেদ। আসলে খুলে বলার মতো কিছু পাচ্ছে না। আজিজ ব্যাপারিকে এতো কিছু খুলে বলতে গেলে উনি আরো টেনশন করবেন এই হচ্ছে তার ধারনা।

গলা পরিস্কার করে নিলেন ড. আরেফিন। বাবা-ছেলে দুজনেই তাকাল তার দিকে।

‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ব্যাপারিসাহেব, কোন সমস্যায় নেই রাশেদ। খুব গোপন একটা কাজের মধ্যে আছি আমরা। কাজটা প্রায় শেষের পথে। আশা করি, বেশিদিন লাগবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে।’ ড. আরেফিন বললেন।

রাশেদ তাকাল তার বাবার দিকে। আজিজ ব্যাপারি বিশ্বাস করেছেন কি না বোঝা যাচ্ছে না। চুপচাপ তাকিয়ে আছেন ড. আরেফিনের দিকে, বিশ্বাস করার চেষ্টা করছেন মনে হলো।

‘ঢাকায় কোথায় উঠেছেন আপনি?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।

‘মগবাজারের একটা হোটেলে।’

‘আচ্ছা, আমার ড্রাইভারকে নিয়ে যান হোটেলে, আপনার জিনিসপত্র নিয়ে আসুন। আপনি এখানেই থাকবেন আমার অতিথি হয়ে, রাশেদের সাথে। তাহলে আপনার আর কোন টেনশন থাকবে না। কাজ শেষ হলে তারপর চলে গেলেন রাশেদকে নিয়ে। ড. আরেফিন বললেন।

মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো বাবা-ছেলে। প্রস্তাবটা ভালো। আজিজ ব্যাপারি ছেলের ব্যাপারে কোন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিলেন না। এখানে থাকলে ছেলে কি করছে না করছে সবই জানা যাবে। কিছুটা চিন্তামুক্ত থাকা যাবে অন্তত।

‘আপনার সমস্যা হবে না?’ জিজ্ঞেস করলেন আজিজ ব্যাপারি।

‘এতো বড় বাড়িটায় মানুষ খুব কম আমরা, আপনারা থাকলে ভালোই হবে।

‘ঠিক আছে, আমি তাহলে হোটেলে যাই,’ উঠে দাঁড়িয়েছেন আজিজ ব্যাপারি। বেশ নিশ্চিন্ত মনে হলো তাকে। ভালো একটা জায়গায়ই আছে তার ছেলে। যেখানে বাড়ির মালিক এতোটা অতিথিপরায়ন সেখানে তার ছেলের খারাপ থাকার কথা না।

ড্রাইভারকে নিয়ে আজিজ ব্যাপারি বের হয়ে যাওয়ার পর নিজের রুমে চলে এলো রাশেদ। ড. আরেফিন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন মোবাইল ফোনে। তার সাথে পরে কথা বললেও হবে, আগে লিলিকে একটা ফোন করা দরকার। এখনো কি ফোন বন্ধ কি না কে জানে, ভাবল রাশেদ।

মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়েছে তখনই ফোনটা এলো। অচেনা একটা নাম্বার থেকে। ধরবে কি ধরবে না চিন্তা করছিল রাশেদ। অবশেষে রিসিভ করলো সে কলটা।

‘হ্যালো?’ ওপাশ থেকে মিষ্টি একটা কণ্ঠ ভেসে এলো। যদিও কণ্ঠটা ঠিক স্বাভাবিক না, তবু চিনতে অসুবিধা হলো না রাশেদের। লিলির গলার স্বর। না চিনতে পারার কারনও নেই। বেশ অবাক হলো সে, একই সাথে আনন্দিতও।

‘হ্যাঁ, লিলি, বলল, তোমার ফোনে বারবার চেষ্টা করছি আমি, কিন্তু বন্ধ, রাশেদ বলল।

‘আমার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শোন রাশেদ। খুব বিপদের মধ্যে আছি আমি। কিডন্যাপ করা হয়েছে আমাকে,’ একটু থামলো লিলি, ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনতে পেল রাশেদ। ওরা বলেছে টাকা-পয়সার জন্য কিডন্যাপ করেনি আমাকে, ওদের দরকার অনেক পুরনো বইটা। সম্ভবত তোমার কাছে আছে।

লিলির কথার সাথে একটা পুরুষ কণ্ঠও শুনতে পেল রাশেদ। লিলিকে ধমকাচ্ছে মনে হলো কেউ।

‘কি বলছো এইসব?’ বিশ্বাস করতে পারছে না রাশেদ, একটা বইয়ের জন্য যে কোন কিছু করতে দ্বিধা করছে না শামীমের পুরানো সহচরেরা।

‘যা বলছে সত্যি বলছে, এবার একটা পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল, বেশ গম্ভীর একটা কণ্ঠস্বর, আজ রাতে আমরা কিছুই করবো না আপনার মেয়েবন্ধুকে নিয়ে। কিন্তু আগামীকাল রাত বারোটার মধ্যে আমরা যদি বইটা না পাই, তাহলে লুসিফারকে তৃষ্ণার্ত রাখবো না আমরা।’

‘প্লিজ, একটু শুনুন, ওকে মারবেন না। আপনারা যাই বলবেন তাই করবো আমি, রাশেদ বলল।

‘কাল সন্ধ্যার মধ্যে জানানো হবে বইটা নিয়ে কোথায় আসতে হবে। বেশি চালাকী করতে যাবেন না। পুলিশকে জানানো হবে মানে আত্মহত্যা করা। আমার কথা কি ক্লিয়ার?

‘হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি আমি, রাশেদ বলল। কাঁপছে সে। ব্যাপারটা নিয়ে লিলিকেও যে এতো ঝামেলায় পড়তে হবে তা মাথায় আসেনি তার।

‘তাহলে পরবর্তী কলের জন্য অপেক্ষা করুন। বাই।’ ফোনটা কেটে গেল।

চুপচাপ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল রাশেদ। বইটা হাতছাড়া করা ছাড়া আর কোন উপায়ই রইল না। সবচেয়ে বড় কথা লিলির জীবন নিয়ে এতোবড় ঝুঁকি নেয়ার কোন অধিকার তার নেই।

ড. আরেফিনকে জানানো দরকার। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলো রাশেদ। তার হাত-পা এখনো কাঁপছে। শামীমকে কিভাবে খুন করেছিল এরা মনে আছে। নৃশংসতার চূড়ান্তে পৌঁছে যাওয়া কিছু মানুষ এরা। মানুষ না বলে পশু বলাই বোধহয় ঠিক হবে।

ড. আরেফিন মনোযোগ দিয়ে একটা পত্রিকা পড়ছিলেন। রাশেদের ব্যস্ত ভঙ্গিতে আসা দেখে তাকালেন ওর দিকে।

‘খুব বড় বিপদে পড়েছি আমরা?’ রাশেদ বলল, নিজেকে এখনো সংযত করতে পারেনি সে।

‘খুলে বলল,’ শান্ত সুরে বললেন ড. আরেফিন।

‘আমার ক্লাসমেট, আমার বন্ধু, লিলিকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। শামীমের খুনিরা করেছে কাজটা, ঐ বইটার জন্য।

‘আমরো তাই ধারনা ছিল, কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম না শুধু,’ ড. আরেফিন বললেন।

‘আপনি জানতেন!’

‘জানতাম বলা ঠিক হবে না। থানায় আখতারসাহেবের সাথে দেখা। মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছেন না বলে পুলিশকে জানাতে এসেছিলেন। তার ধারনা কিডন্যাপ করেছে কেউ, অনেক টাকা হয়তো মুক্তিপন চাইবে।’

‘আপনি আখতারসাহেবকে চেনেন? লিলিকে?

‘আখতার হচ্ছেন আমার আত্মীয়, চাচাতো ভাই, অনেক দুরসম্পর্কের। লিলিকে চিনি ছোট থেকেই।

‘টাকার জন্য কিডন্যাপ করেনি ওরা, প্রায় চেঁচিয়ে বলল রাশেদ।

‘বইটার জন্য করেছে। বুঝতে পারছি, কেন ওরা টাকা চেয়ে কোন ফোন দেয়নি আখতারসাহেবকে, চাইলে যেকোন অংকের মুক্তিপন দিয়ে দিতেন তিনি।

‘এখন আমাদের করনীয় কি?’

‘মেয়েটাকে তুমি ভালোবাস, তুমিই বলো করনীয় কি?’

‘বইটা দিতে যাবো আমি। উদ্ধার করে আনবো লিলিকে।

‘বইটা পেলেই যে লিলিকে ফেরতে দেবে ওরা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এমনকি তোমাকেও মেরে ফেলতে পারে। পুলিশের সাহায্য নিতে হবে আমাদের।

‘কিন্তু পুলিশে খবর দেয়া হয়েছে বুঝতে পারলে এমনিই মেরে ফেলবে মেয়েটাকে।

‘পুলিশে খবর না দিলে অনেক বড় ঝুঁকি নেয়া হয়ে যাবে। এছাড়া, আমার ধারনা, ড. কারসনকে এরাই কিডন্যাপ করেছে বইটার পাঠোদ্ধার করার জন্য।’

‘ড. কারসনকে নিয়ে আপনার ধারনা হয়তো ঠিক, কিন্তু আমি চিন্তা করছি লিলিকে নিয়ে। রাশেদ বলল।

‘বুঝতে পারছি। তুমি যাও, আমি ড. শাখাওয়াতের সাথে আলাপ করে দেখি।’

‘ড. শাখাওয়াতের সাথে কথা বলা ঠিক হবে না। ভদ্রলোককে আমার পছন্দ হয়নি।‘ রাশেদ বলল একটু ঝাঁঝের সাথে। ড. শাখাওয়াতের সাথে বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল তার। লোকটা টাকার গরম দেখায় এবং স্বার্থপর একজন মানুষ।

কথাটা শুনে রাশেদের দিকে তাকিয়েছেন ড. আরেফিন। এ ধরনের একটা কথা রাশেদের কাছ থেকে আশা করেননি তিনি।

‘ওরা আর কি বলেছে?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।’

‘কাল আমাকে ফোন করে জানাবে, কখন, কোথায় যেতে হবে।’

‘ঠিক আছে, আমিও যাবো তোমার সাথে। একা একা কিছু করতে যেও না।’

‘আচ্ছা,’ বলল রাশেদ। উপরে নিজের রুমে চলে আসল সে। এখন কলের জন্য অপেক্ষা। কখন করবে কে জানে। ট্রাভেল ব্যাগটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষন বসে থাকল সে। বইটা আছে, অনেকগুলো টাকাও আছে ব্যাগটায়।

দরজায় নক হলো এই সময়।

আজিজ ব্যাপারি এসেছেন। সাথে একটা ব্যাগ। তাকে বসতে দিল রাশেদ। নিজেও বসল একপাশে। নিজের বাবার এতো চিন্তিত চেহারা এর আগে কখনোই দেখেনি সে।

‘বাবা, আপনি কিছু নিয়ে টেনশনে আছেন?’ জিজ্ঞেস করল রাশেদ।

‘তোমার দাদারে খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘খুঁজে পাচ্ছেন না মানে, বুঝলাম না, সত্যি বুঝতে পারছে না রাশেদ। বুড়ো একটা মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে না কেন।

‘ঢাকায় নিয়া আসছিলাম তাকে, তারপর হারাইয়া গেল।’

‘হারিয়ে গেল?’

‘হ, সাথেই ছিল, হঠাৎ দেখি নাই, নাই তো নাই।’

‘একটা মানুষ কি হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে নাকি? আপনি হয়তো খুঁজে পাননি,বুড়ো মানুষ। তিনি তো ঢাকায় আগে কখনোই আসেননি।‘

‘এখন কি করবো মাথায় আসতেছে না।’

‘আপনি রেস্ট নেন, তারপর দেখি কি করা যায়।‘ রাশেদ বলল।

আজিজ ব্যাপারিকে শুইয়ে দিয়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল রাশেদ। সমস্যা যেন পিছু ছাড়ছে না। বুড়ো মানুষটা নিশ্চয়ই খুব ঝামেলায় পড়েছেন। সাথে কোন টাকা-পয়সা বা কাপড়-চোপড় কিছুই ছিল না। এ অবস্থায় বুড়ো একটা মানুষকে কি পরিস্থিতিতে পড়তে হবে কে জানে।

বড় একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বাবার সাথে এসে শুলো রাশেদ। ঘুম আসছে না। কাল অনেক বড় একটা কাজ আছে। লিলিকে উদ্ধার করতেই হবে। এই বই তার মালিকের কাছে ফিরে যাক।

***

রাত বারোটার দিকে বিশেষ একটা রুম থেকে বের হলো কামরুল। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা তার। জিজ্ঞাসাবাদে বেশ পরিশ্রম আছে। এছাড়া এমনিতেও বেশ পরিশ্রম যাচ্ছে কতো কিছুদিন ধরে। ঢাকা শহরে খুন-খারাপি, রাহাজানি-ছিনতাই যেন বেড়ে গেছে হঠাৎ করে। বড়লোকের উচ্ছখল কিছু ছেলেপেলে আছে অনেকগুলো কেসের পেছনে। ওদের ধরে নিয়ে আসা হয়, কিন্তু গায়ে হাত তোলার আগেই ফোন চলে আসে।

এখনকার কেসটা অন্যরকম। যে ছেলেটাকে ধরা হয়েছে, সে কি বোবা, না ভান ধরে আছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। গত চব্বিশ ঘণ্টায় একটা শব্দও বের করা যায়নি ওর মুখ থেকে। নাম কি, পরিচয় কি, ঠিকানা কোথায়, এখনো কিছুই জানা যাচ্ছে না। দেখতে রাজপুত্রের মতো, কিন্তু স্বভাব একেবারে অন্যরকম। এতো মারা হলো। তারপরও বিনা আপত্তিতে সয়ে গেল। যেন এ ধরনের পিটুনি খেয়ে অভ্যস্ত ছেলেটা। ড. আরেফিনের বাসায় যে হামলা হয়েছে তাতে সাতজনই মারা গেছে, বেঁচে আছে এই একজনই। ছেলেটার মুখ থেকে কিছু বের করতে পারলে সবকিছু অনেক সহজ হয়ে যেত। মৃত মানুষ কথা বলে না, কিন্তু এখন ঐ সাতটা মৃতদেহ খুব গুরুত্বপূর্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের ছবি তুলে থানায় থানায় পাঠানো হয়েছে। কোথাও কোন রেকর্ড আছে কি না দেখার জন্য। কিন্তু এখনো কোন রিপোর্ট আসেনি। এরা সাধারন কেউ ছিল না, দেখলেই বোঝা যায় দাগী সন্ত্রাসী অথবা ছিনতাইকারী ছিল। বিশেষভাবে ট্রেনিং দিয়ে হয়তো এ ধরনের অপারেশনে পাঠিয়েছে কেউ। বিশেষ কোন উদ্দেশ্য ছিল এর পেছনে। এতোগুলো মানুষ ড. আরেফিনের মতো একজন প্রাক্তন ইউনিভার্সিটি শিক্ষকের উপর হামলা করতে যাবে কেন সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। সেই কারনটা বের করা গেলে হয়তো অনেক সহজ হয়ে যেতো সবকিছু। ড. আরেফিন অবশ্য সাধারন একটা ডাকাতি মামলা করে গেছেন। কিন্তু তাকেও বিনা জিজ্ঞাসাবাদে ছেড়ে দেয়া ঠিক হয়নি।

নিজের চেয়ারে এসে বসল কামরুল। আরো একটা সমস্যায় মনটা খারাপ তার। লিলিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লিলির বাবা আশংকা করছেন অপহরন করা হয়েছে তার মেয়েকে। যদিও মুক্তিপন দাবি করে কেউ এখনো ফোন করেনি। মেয়েটা কি তার প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে? হতেও পারে। অপহৃত হলে অবশ্যই ফোন আসতো এতোক্ষনে। মেয়ের প্রেমিককেও খুঁজছে পুলিশ অনেকদিন ধরে। কিন্তু কোন হদিস নেই ছেলেটার। শামীম হত্যা মামলা এমনিই ঝুলছে। এখনো চার্জশিট দাখিল করা হয়নি। রাশেদকে প্রধান আসামী করে একটা চার্জশিট তৈরি করে রেখেছে সে। কিন্তু মন কেন জানি সায় দিচ্ছে না। যতটুকু খোঁজখবর পাওয়া গেছে তাতে এই ছেলের খুন খারাপিতে জড়িত থাকার কথা নয়। কিন্তু মনে হলেই তো হবে না, স্বাক্ষ্য প্রমান লাগবে, এই ছেলে খুনি না হলে অন্য কেউ খুন করেছে, তা খুঁজে বের করতে হবে।

চোখ বন্ধ করে ভাবছিল কামরুল। প্রায় ঘুম চলে আসছিল তার। কনস্টেবলের ডাকে জেগে উঠলো।

‘স্যার, বড় স্যার ডেকেছে আপনাকে,’ কনস্টেবল বলল।

উঠে দাঁড়াল কামরুল। এতো রাত পর্যন্ত বড় স্যার জনাব বজলুল করিম তাহলে এখনো আছেন অফিসে!

বজলুল করিমের রুমে ঢুকে একটু অবাক হলো কামরুল। একেবারে পুলিশি পোশাকে এই রাতে তাকে আশা করা ঠিক না, কিন্তু চোখে ভুল দেখছে না সে। রীতিমতো পোশাক আশাকে সজ্জিত হয়ে এসেছেন ভদ্রলোক। আসার সময় গোসল এবং ক্লিন সেভড হয়ে এসেছেন। তাকে এখন একজন পুলিশ অফিসার মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়ির জামাইয়ের বড় ভাই।

‘কামরুল বসো,’ বেশ সাদর সম্ভাষন জানালেন বজলুল করিম, এটাও খুব অস্বাভাবিক ঘটনা কামরুলের কাছে।

বসে পড়ল কামরুল। তাকিয়ে আছে বসের দিকে, খুব জরুরী কিছু না হলে এতো রাতে বজলুল করিমসাহেব কখনোই থানায় আসেন না।

‘তোমাকে ডেকেছি বিশেষ একটা কারনে,’ বললেন বজলুল করিমসাহেব।

‘জি, স্যার, বলুন।‘

‘যে সাতজন বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে গত রাতে, তাদের মধ্যে পাঁচজনের পরিচয় বের করতে পেরেছি আমরা। এর মধ্যে দুজনের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা ছিল। সাধারন ছিনতাইকারী ছিল ওরা, বাকি তিনজন মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। যদিও গত ছয়-সাত মাস ওদের কারো কোন এক্টিভিটজ ছিল না। কোথাও এদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি,মনে হচ্ছিল এরা খারাপ পথ ছেড়ে সম্ভবত ভালো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ধারনাটা ভুল। এই সময় ওরা অস্ত্র শস্ত্রের উপর ট্রেনিং নিয়েছে, তা না হলে এতো বড় একটা অপারেশনে নামা ওদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, একটু থামলেন বজলুল করিম, যাই হোক, একটা প্রশ্ন আমাকে খুব চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। ওরা ড. আরেফিনের বাসায় এতোটা সংগঠিত হয়ে হামলা করলো কেন? ড. আরেফিন ডাকাতি মামলা করেছেন। যদিও ডাকাতি ওদের আসল উদ্দেশ্য ছিল বলে আমি মনে করি না।’

বজলুল করিমসাহেবকে কখনোই বুদ্ধিমান মনে হয়নি কামরুলের কাছে, এখন মনে হচ্ছে যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা তিনি রাখেন।

‘এখন আমাদের কি করা উচিত বলে তুমি মনে করো?’ প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন কামরুলের দিকে। যেন কামরুলের কাছ থেকেই সমাধান আশা করছেন তিনি।

‘আমার মনে হয় ড. আরেফিনের উপর আলাদাভাবে নজর রাখা উচিত আমাদের, অন্তত কিছুদিনের জন্য। হয়তো গুরুত্বপূর্ন কিছু আমরা পেয়ে যাবো তার কাছ থেকে যা তিনি আমাদের কাছে খোলামেলাভাবে বলতে পারছেন না।’

‘বাহ, মারাত্মক। এমন উত্তরই তোমার কাছ থেকে আশা করছিলাম আমি,’ উঠে দাঁড়িয়েছেন বজলুল করিম। কামরুলের পাশে এসে দাঁড়ালেন।

‘সকালেই সাদা পোশাকে দুইজন অফিসার পাঠিয়ে দাও। যেন ড. আরেফিনের কর্মকান্ডের উপর নজর রাখে এবং প্রতি ঘণ্টায় যেন তোমার কাছে রিপোর্ট করে। গুরুত্বপূর্ন কিছু জানলে সাথে সাথে আমাকে জানাবে তুমি, অ্যাম আই ক্লিয়ার?’

‘জি,স্যার। ক্লিয়ার।’ বলল কামরুল। বজলুল করিমের বুদ্ধিটা পছন্দ হয়েছে তার।

‘এবার বাসায় যাও, রেস্ট নাও। অনেকগুলো পেন্ডিং কেস আছে আমাদের হাতে। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই সব ক্লিয়ার করতে হবে।

‘জি, স্যার।’

রুম থেকে বেরিয়ে আসল কামরুল। সকাল সকাল কাজ শুরু করতে হবে। তার আগে দরকার ভালো একটা ঘুম। রাত অনেক হয়েছে। মোটরসাইকেলটা স্টার্ট দিলো সে।

***

দিনরাত কিছু বোঝা যায় না এখানে। চিরস্থায়ী অন্ধকারে বসবাস করতে করতে বিন্দুমাত্র আলোও সহ্য হচ্ছে না ড. কারসনের। উল্টোদিকের চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকেন মাঝে মাঝে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এরকম একটা মেয়ে তারও আছে। স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ির পর মেয়েটা মায়ের সাথেই থাকে। বছরে একবার দুবার হয়তো দেখা হয়। অপত্য স্নেহ কি জিনিস, তা প্রকাশ করতে পারেননি কোনদিন, কাজ নিয়ে মেতে থেকেছেন সারাজীবন। এখন শেষ বেলায় এসে প্রিয় স্ত্রী আর মেয়ের কথা সারাক্ষন মনে পড়ে। কে জানে তার এই বন্দীদশার কথা ওরা জানে কি না।

মেয়েটা চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। নড়াচড়া করছে না। সুন্দর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। কিছুক্ষন আগেই শয়তানটা এসেছিল। মেয়েটাকে দিয়ে কথা বলালো মোবাইল ফোনে। কথা কিছুই বুঝতে পারেননি। কিন্তু এটুকু বুঝেছেন মেয়েটাকে কারো সাথে কথা বলানো হলো। হয়তো মুক্তিপন বা অন্য কিছু দাবি আছে ওদের।

এতে হয়তো মেয়েটার মুক্তি পাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হলো। কিন্তু তাকে নিয়ে এদের কি পরিকল্পনা তা কিছুতেই মাথায় আসছে না তার। প্রাচীন সেই বইটা কোনদিন উদ্ধার হলে হয়তো এদের কাজে আসবেন তিনি, তারপরও তার মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সম্ভবত মেরে ফেলা হবে তাকে। মানুষের নৃশংসতায় কখনোই অবাক হননি তিনি। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র প্রাণীতে পরিণত হয়েছে মানুষ। সেই আদিকালেও প্রত্নতাত্ত্বিক স্পটেও মানুষের নৃশংসতার অনেক প্রমান দেখেছেন তিনি। তাকে মুক্ত করে দেয়া হলে সেটা অপহরনকারীদের জন্যও ভালো হবে না। নিজেদের। নিয়ে ওরা কোন ঝুঁকি নেবে না। শয়তানের উপাসক এরা, শয়তানের উদ্দেশ্যেই হয়তো বলি দেয়া হবে তাকে।

যাইহোক, আর কিছু মাথায় আসছে না ড. কারসনের। নিজ দেশ থেকে এতো দূরে এসে আত্মীয় পরিজনবিহীন অবস্থায় মারা যেতে কারো ভালো লাগার কথা নয়। যখন মেরে ফেলতে চাইবে তখন একটা অনুরোধ করবেন বলে ঠিক করেছেন তিনি। যেন প্রচন্ড মাত্রায় মরফিন দেয় ওরা, মৃত্যুটা যেন হয় তন্দ্রার ঘোরে। এখন যেমন মরফিনের ছোঁয়ায় শরীরের সব অনুভূতি যেন অকেজো হয়ে গেছে।

চোখ খুলে তাকিয়েছে মেয়েটি। কাঁদছে। নিজেরও কেমন কান্না পেতে লাগল ড. কারসনের।

*

অধ্যায় ৩৩

কমলাপুর রেলস্টেশনে অন্যসব যাত্রীর ভীড়ে এক যুবককে দেখা গেল, দুটো সুটকেস হাতে। এ ধরনের সুটকেস আগে কেউ কখনো দেখেনি,তাই অনেককেই দেখা গেল আড়চোখে তাকিয়ে আছে জিনিস দুটোর দিকে। যুবককে অবশ্য মোটেও ভাবিত বলে মনে হলো না। তার মাথায় নানা চিন্তা ঘুরছে। সুটকেস দুটো নিরাপদ জায়গায় রেখে রাশেদের কাছে যেতে হবে তাড়াতাড়ি। মগবাজারের যে হোটেলটায় আজিজ ব্যাপারি উঠেছিল সেটা মোটামুটি পছন্দ হয়েছে তার। সেখানেই একটা ট্যাক্সি ঠিক করল সে।

সকাল হয়েছে মাত্র। ঢাকা এখনো অনেক শান্ত। ভোরের নির্মল হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো দুলছে এবং নরম রোদে চিকচিক করছে ঢাকার রাজপথ। দশমিনিটেই চলে এলো মগবাজার মোড়ে। সেখানে হোটেলে উঠে বেরিয়ে পড়ল সাথে সাথে। গন্তব্য রাশেদ যে বাড়িটায় উঠেছে সে জায়গাটা। মগবাজার থেকে বেশি দূরে নয়। একটা রিক্সা নিয়ে নিলো যুবক। বেশ ভালো লাগছে তার, যদিও সারারাত ঘুম হয়নি একফোঁটা। অনেকদূর থেকে সুটকেস দুটো টেনে নিয়ে যেতে হয়েছে স্টেশনে। ট্রেনেও ঘুম হয়নি। শিস দিচ্ছিল যুবক। অচেনা এক সুর। এতো অদ্ভুত সুন্দর শিস রিক্সাওয়ালা কখনো শোনেনি,তাই বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে যুবককে দেখছিল।

***

অন্যদিনের মতো ভোরেই ঘুম ভেঙেছে সালেহার। তারপরই সবর্নাশটা চোখে পড়ে। তালাবদ্ধ ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ভেতরে কি ছিল কোন ধারনাই নেই। কিন্তু চোর এসে কিছু না নিয়ে যায়নি তা কিভাবে হবে। হৈচৈ করার আগে ঘরটায় ঢুকল সালেহা। সে বিয়ে হয়ে এই বাড়ি এসেছে অনেক বছর হলো, কিন্তু কোনদিন এই ঘরটা খোলা পাওয়া যাবে কল্পনাও করেনি। তেমন কিছুই নেই ঘরটায়। বড় একটা পালংক ছাড়া। সাজানো গোছানে পালংকটা। সুন্দর চাদর পাতা, পরিপাটি করে। যেন গতকালই কেউ পরিস্কার করে গেছে ঘরটা, ধূলো মাত্র নেই কোথাও।

বিছানার উপর কাগজে মোড়ান কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখল সালেহা। কেন জানি মনে হলো জিনিসটা তার জন্যই রেখে যাওয়া হয়েছে। কাগজটা খুলল সে। অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধে পুরো বাড়িটা যেন মৌ মৌ করে উঠল। জিনিসটা তেমন কিছুই না, গোলাকার একটা চকলেটের মতো দেখতে। জিভে ছুঁইয়ে দেখল সালেহা। মিষ্টি স্বাদের মনে হচ্ছে। আঁচলে লুকিয়ে ফেলল সাথে সাথেই। দরজাটা লাগিয়ে বাইরে চলে আসল। মনে হচ্ছে শ্বশুরের কাজ। কিন্তু তিনি তো আরো দু’একদিন আগেই ঢাকা গেছেন।

মনে কোন সন্দেহ রাখল না সালেহা, যা হবার হবে। মন বলছে চকলেটের মতো এই জিনিসটা খেলেই মনোকামনা পুর্ন হবে তার। খারাপ কিছু হলে মারা যেতে পারে, কিন্তু ঝুঁকিটা নেবে সে।

চকলেটটা মুখে দিল সালেহা। সারা শরীর যেন তার ঝনঝন করে উঠলো সাথে সাথে। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল উঠোনটায়।

***

আজ সকাল সকাল ঘুম ভেঙেছে কামরুলের। একটু দেরি করে ডিউটিতে গেলে অসুবিধা ছিল না। কিন্তু বজলুল করিমের সাথে গতরাতে কি কথা হয়েছিল মনে পড়ে গেল। সাদা পোষাকে ড. আরেফিনের উপর নজর রাখতে বলেছিল বস। সব অফিসারই ব্যস্ত। গোয়েন্দা সংস্থাকে এ বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি,কাজেই সেখান থেকে লোক পাওয়া যাবে না। ড. আরেফিনের সাথে একবার মাত্র দেখা হয়েছে। তিনি খুব লক্ষ্য করেছেন তার চেহারা এমন মনে হলো না। কামরুল ঠিক করল সে নিজেই যাবে। পরচুলা আর নকল গোঁফ আছে বাসায়। নাটক করার অভ্যাস ছিল একসময়। তখন প্রায়ই এসব পড়তে হতো, আলমারির এককোনায় পরচুলা আর নকল গোঁফটা রেখে দিয়েছিল। এখন মাঝে মাঝে কাজে লাগে।

গোসল সেরে, নাস্তা করে তৈরি হয়ে নিল। আটটা বাজতে গেল। ড. আরেফিন যদি এর মধ্যে বের হয়ে যান তাহলে মহামুশকিল। কাপড়-চোপড় পড়ে নিলো ঠিকঠাক মতো। পরচুলা এবং নকল গোঁফও লাগালো। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে কিছুক্ষন দেখল কামরুল। একেবারে অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে মাঝবয়েসি একজন মানুষ, যে ব্যবসা করতে গিয়ে লোকসানের পর লোকসান দিচ্ছে।

নিজের দিকে তাকিয়ে হাসল কামরুল। এখন তাকে দেখে কেউ চিনতে পারবে না। এটা নিশ্চিত। কিন্তু তারপরও একমাত্র বজলুল করিমসাহেবকে জানিয়ে রাখতে হবে, কি করতে যাচ্ছে সে।

বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিলো কামরুল। ড. আরেফিনের বাসা কাছাকাছিই। যেতে বেশীক্ষন সময় লাগবে না।

*

অধ্যায় ৩৪

কালো একটা জিন্স, বুট জুতো আর একটা টি-শার্ট পরেছে রাশেদ। ঘুম ভেঙেছে অনেক সকালে। বাবা আজিজ ব্যাপারি তখনো ঘুমাচ্ছিলেন। ডাকতে ইচ্ছে করল না রাশেদের। অনেক জার্নি করে এসেছে ঢাকায়, রেস্ট নিতে পারেনি,ঘুম থেকে ডেকে তুলে অহেতুক কষ্ট দেয়া হবে।

নাস্তা সেরে নিয়েছে। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে নিচের ড্রইং রুমে বসে আছে। অপেক্ষা শুরু হয়ে গেছে। আজ দিনের মধ্যে যেকোন সময় ফোন আসতে পারে। সেই কল কোনভাবেই মিস করা যাবে না। একজন মানুষের জীবন মরনের প্রশ্ন। আর সেই মানুষ যদি পছন্দের কেউ হয়…

লিলির বাবা কি করছেন কে জানে, এতোক্ষনে পুলিশে খবর দিয়ে দেয়ার কথা। লিলির এক ভাই আছে পুলিশে, নাম জিজ্ঞেস করেনি কোনদিন রাশেদ। পুলিশ নিশ্চয়ই বসে নেই। কিন্তু ওরা কিছু করতে পারবে না। যা করার রাশেদকেই করতে হবে।

খবরের কাগজ দিয়ে গেছে মাত্র। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছিল রাশেদ। ড. আরেফিনের কণ্ঠ শুনে পত্রিকাটা সরিয়ে রাখল।

‘গুড মর্নিং, রাশেদ। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে বললেন ড. আরেফিন।’

‘গুড মর্নিং।

পাশের সোফায় এসে বসেছেন ড. আরেফিন। কাগজে মোড়ান একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলেন রাশেদের দিকে।

‘তোমার নিরাপত্তার জন্য, নাও,’ বললেন তিনি।

হাত বাড়িয়ে জিনিসটা নিলো রাশেদ। বেশ ওজন মনে হলো জিনিসটার। প্যাকেট খুলে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। একটা পিস্তল। ড. আরেফিনের হাতে এর আগে যে পিস্তলটা দেখছিল সে, সেটা না, নতুন একটা পিস্তল এটা।

‘কিন্তু আমি তো চালাতে জানি না,’ রাশেদ বলল।

‘দাঁড়াও, তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি,’ বলে পিস্তলটা নিজের হাতে নিলেন ড. আরেফিন এবং দশ মিনিটের মধ্যে হাতে-কলমে গুলি কিভাবে করতে হয়, কিভাবে বুলেট ভরতে হয়, কোমরে বা পকেটে রাখতে হলে কি কি করতে হয়, শিখে গেল রাশেদ।

পিস্তলটা কোমরে গুঁজে রাখল। কিভাবে রাখতে হবে শিখিয়ে দিয়েছেন ড. আরেফিন। ভদ্রলোক অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপারে এতো খোঁজখবর রাখেন এবং চালাতেও জানেন দেখে অবাক হয়েছে। যে কেউ দেখলে সাদাসিদে একজন মানুষ ছাড়া আর কিছু মনে করবে না লোকটাকে দেখে, কিন্তু ভেতরে ভেততে একজন যোদ্ধা এই লোক, কোন কিছু সহজে ছেড়ে দিতে জানে না।

মোবাইল ফোনটা বুক পকেটে রেখেছে রাশেদ। যে কোন সময় ফোন আসতে পারে, তৈরি থাকতে হবে।

‘রাশেদ, আমি ছুটি নিয়েছি আজকে, আমাদের কাজও অবশ্য থেমে গেছে ড. কারসনের অভাবে,’ রাশেদের উল্টোদিকে সোফায় বসতে বসতে বললেন ড. আরেফিন।

‘জি, আমি জানি,’ রাশেদ বলল।

‘আজ তোমার সাথে আমি যাবো, কিন্তু গাড়ি নেবো না, মোটরবাইক চালাতে জানো তুমি?’ ড. আরেফিন বললেন।

‘অল্প-স্বল্প।’

‘অল্প-স্বল্পে হবে না, ভালো জানতে হবে, আমিই চালাবো তাহলে।’

‘আপনি?’

‘হ্যাঁ, পরিচিত গ্যারেজটায় বলে রেখেছি, ভালো একটা মোটরবাইক দিন দুয়েকের জন্য দিয়ে যাবে আমার কাছে গ্যারেজটার মালিক।

অবাক হলো রাশেদ। রীতিমতো ফিল্মি হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা, যদিও নায়কের ভূমিকায় প্রৌঢ় একজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে।

‘ঠিক আছে, কিন্তু দুটো হেলমেট চাইতে ভুলবেন না।‘

হাসলেন ড. আরেফিন।

উঠে দাঁড়ালেন। পায়চারী করতে থাকলেন।

রাশেদ পত্রিকাটা টেনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আবার। এখন শুধু অপেক্ষা। একটা ফোন কলের। কখন আসবে?

***

একটা হলুদ ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া করেছে যুবক সারাদিনের জন্য। ড. আরেফিনের বাসা থেকে বেশ কিছুটা দূরে অলস ভঙ্গিতে পড়ে আছে গাড়িটা। চালক সিটে বসে ঘুমাচ্ছে। এর পাশেই ছোট একটা চায়ের দোকানে বসে আছে যুবক। একচোখ ড. আরেফিনের বাসার গেটের দিকে। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে বাড়ির বাসিন্দাদের কথা জেনে নিয়েছে। মালিকের নাম ড. আরেফিন কামাল। আগে ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন। এখন বোধহয় কোথাও চাকরী করেন। বাসাটা থেকে কেউ বের হয়নি এখনো। দুপুর গড়াতে চলল। দোকানটায় লোকজন কম, সিগারেটের অভ্যাস না থাকলেও সকাল থেকে এখন পর্যন্ত দশটা বেনসন টেনে ফেলেছে। চা খাওয়া হয়েছে পাঁচ কাপ। খালি মুখে বসে থাকলে দোকানদার হয়তো বসতে দেবে না। মুখটা তেতো হয়ে আছে।

মাথার উপর ঝাঁ ঝাঁ রোদ। রাশেদ কি সমস্যায় পড়েছে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। মজার ব্যাপার হলো কিছুক্ষন পরেই আজিজ ব্যাপারিকে বের হয়ে আসতে দেখল সে ড. আরেফিনের বাসা থেকে। স্বভাবসুলভ ডাক চলে এসেছিল গলা থেকে। শেষ মুহূর্তে কোনমতে নিজেকে থামিয়েছে যুবক। এই দিকেই আসছে আজিজ ব্যাপারি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যুবকের। চিনতে পারবে কি না কে জানে?

সিগারেট নিতে এসেছে আজিজ ব্যাপারি দোকানটায়। এক ঝলক তাকিয়েছিল তার দিকে, কিন্তু চিনতে পারেনি,বা পেছন ফিরে তাকায়নি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যুবক। দেখে বেশ মায়া লেগেছে অবশ্য। চুলে পাক ধরে গেছে আজিজ ব্যাপারির, চামড়া ঝুলে গেছে। বেশ বয়স হয়ে গেছে ওর, ভাবল সে। হয়তো আর বছর দশেক বাঁচবে। নিজের ছেলের কাছেও পরিচয় দিতে না পারা বড় একটা দুঃখ হয়ে থাকল তার কাছে। এদের জন্য কোন কিছু করাই সম্ভব হবে না। প্রকৃতি ব্যতিক্রম সহ্য করে না। সে নিজে অবশ্য ব্যতিক্রম, তাতে তার নিজেরও তেমন হাত ছিল না। এলিক্সির অফ লাইফের উত্তরাধিকারী হয়েছেন তিনি। সেটা আর কারো সাথে ভাগ করে নেয়া সম্ভব না।

বসে বসে তন্দ্রার মতো আসছে, পুরনো কোন স্মৃতিতে ডুবে যাওয়ার আগেই সচেতন হয়ে নড়ে চড়ে বসল যুবক। এখন ভাবালুতার সময় নয়। রামপ্রসাদের খোঁজে এই অঞ্চলে আসা হয়েছিল। সেই খোঁজ এখনো সম্পূর্ন হয়নি। সম্পূর্ন করাও সম্ভব নয়। প্রিয় জুতো-জোড়া এবং প্রাচীন একটা বই নিয়ে পালিয়েছিল রামপ্রসাদ। বইটায় এলিক্সির অফ লাইফের বর্ননা আছে, কিভাবে তৈরি করতে হবে তার বিবরন দেয়া আছে। কিন্তু যে ভাষায় তা লিপিবদ্ধ করা আছে, তা আজকের যুগের মানুষের পক্ষে বের করা সম্ভব না। তিব্বতে যে কাজে যাওয়া হয়েছিল অনেক অনেক আগে, সে কাজ সম্পূর্ন হয়নি,খে-লান ভাতৃসম্প্রদায়ের হয়তো কোন অস্তিত্বও নেই। কিন্তু সাম্ভালার খোঁজে যাবেন তিনি এবার। হয়তো সভ্যতার ছোঁয়ায় পুরো অঞ্চলটাই বদলে গেছে, কিন্তু তারপরও যেতে হবে। এখানে কাজটা শেষ হলেই।

আরো কিছুক্ষন পর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল সে। একটু হাঁটাহাঁটি করা দরকার। অল্পবয়সী একটা ছেলে একটা মোটরবাইকে করে মাত্র ঢুকেছে ড. আরেফিনের বাসায়।

***

মোটরবাইকে করে পনেরো-ষোল বছরের একটা ছেলেকে ঢুকতে দেখল কামরুল। হাল-ফ্যাশানের বাইক। ছেলেটাকে কেন জানি মনে হলো গ্যারেজে কাজ করে এমন কেউ। এর কি কাজ থাকতে পারে এখানে। বজলুল করিমকে বলে বাসার সামনে থেকে পুলিশের পাহারা উঠিয়ে দিয়েছে সে। ড. আরেফিনের বাসা থেকে অল্প দূরে দাঁড়িয়ে আছে কামরুল। দুপুর হয়েছে। ক্ষুধা লেগেছে প্রচন্ড। বাসা থেকে সারাদিন বের হয়নি কেউ। আজব লাগল তার কাছে, যতদূর জানে ড. আরেফিন এখন সরকারী কর্মকর্তা। অফিসে যাননি কেন কে জানে।

ছেলেটা বেরিয়ে এসেছে, এবার মোটরবাইক ছাড়া। তারমানে মোটরবাইকটা রেখে গেছে ড. আরেফিনের বাসায়। নিশ্চয়ই কোন কারন আছে এর পেছনে। ড. আরেফিনের কাছে গাড়ি আছে, সেটা বাদ দিয়ে মোটরবাইকের কি দরকার পড়ল?

সারাদিন এখানেই কেটেছে কামরুলের। খুব ধৈর্যের কাজ। দুটো বাজে প্রায়। চলে যেতে ইচ্ছে করছে। এখানে শুধু শুধু সময়ের অপচয় হচ্ছে মনে হয়। কিন্তু পরক্ষনেই মন পরিবর্তন করল, সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখে যাবে। কোন কাজ মাঝপথে ছেড়ে দেয়া একেবারেই অপছন্দ কামরুলের।

মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো এই সময়।

‘জি,স্যার, বলুন?’ বলল কামরুল। ওপাশে বজলুল করিম আছেন লাইনে।

‘ঠিক আছে স্যার। আমি সন্ধ্যায় আসবো।‘ আরো কিছু কথা বলে রেখে দিল সে।

খবর পাওয়া গেছে, ইউনিভার্সিটি এলাকায় খোঁজ নিতে নিতে এক রিক্সাওয়ালা বলেছে তার রিক্সা থামিয়ে এক ছাত্রিকে জোর করে মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে গেছে কিছু লোক। দুপুর বেলায় নাকি ঘটনা ঘটেছে, ফুলার রোডে। ঘটনাটা লিলির সাথে মিলে যায়। কারন বাড়ি ফেরার পথে ফুলার রোড দিয়েই বেশিরভাগ সময় যাতায়াত করে লিলি। কিন্তু চিন্তা অন্য দিকে, কিডন্যাপ যেহেতু করেছে, তাহলে সন্ত্রাসীরা মুক্তিপন চাইছে না কেন?

তিনটা পর্যন্ত হাটল কামরুল। তারপর রাস্তার ওপাশের একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। ক্লান্ত ছিল, তাই লক্ষ্য করল না একজন যুবক তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

***

ঠিক পাঁচটায় এলো ফোনটা। সারাদিন অপেক্ষা করতে করতে সোফায় বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল রাশেদ। বুক পকেটে থাকা মোবাইলে রিং বাজার সাথে সাথে চমকে গিয়েছিল, এতোটাই যে মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। ড্রইং রুমে টেলিভিশনে হিসটোরি চ্যানেল দেখছিলেন ড. আরেফিন। ঘুরে তাকালেন তিনি।

কলটা রিসিভ করল রাশেদ।

‘হ্যালো,’ ওপাশ থেকে গতরাতে শোনা সেই গম্ভীর কণ্ঠটা ভেসে এলো।

‘জি, বলুন, আপনার কলের জন্যই অপেক্ষা করছি,’ রাশেদ বলল, মনে হচ্ছে হার্টবিট বেড়ে গেছে তার, কপালে ঘাম জমেছে।

‘ভালো, শুনে খুশি হলাম। আরো খুশি হবো বইটা নিয়ে ঠিক আটটায় চলে এলে।’

‘কোথায়?’

‘বেশি দূরে কোথাও না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।’

‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান!!’

‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, নাম শোননি? ওখানে গেটে এসে দাঁড়াবে তুমি। আমি কল দিয়ে জানিয়ে দেবো কি করতে হবে।’

‘ঠিক আছে।’

‘ওকে, বাই।’ কেটে গেছে ফোনটা।

ড. আরেফিনের দিকে তাকাল রাশেদ। ভদ্রলোকের মনোযোগ টিভির দিকে। বিশেষ কিছু দেখাচ্ছে বোধহয়।

‘ফোন এসেছে মাত্র, কথা বললাম,’ রাশেদ বলল, ড. আরেফিনের সোফাটার পাশে দাঁড়িয়ে।

‘কি বলল?’ ঘাড় না ঘুরিয়েই জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।

‘আটটায় যেতে বলল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে!’ ড. আরেফিন এবার তাকালেন রাশেদের দিকে। উদ্যানে কি বাতাস খেতে যাব!’

‘স্যার, আমি কোন ঝামেলা করবো না। বইটা দিয়ে লিলিকে নিয়ে চলে আসবো। আর কিছু না। পিস্তলটা নিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু ব্যবহার করবো না।‘

‘ঠিক আছে, কিন্তু প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো।‘ এবার গম্ভীর গলায় বললেন ড. আরেফিন।

‘আমরা বেরুবো কখন?’

‘জায়গাটা কাছেই, যেতে বেশি সময় লাগবে না। তবুও একটু আগেই বের হবো আমরা। এই ধরো ছয়টার দিকে।‘

‘আপনি তৈরি?’

‘আমি তৈরি, বাইরে বাইকটাও চলে এসেছে।’

‘চলুন তাহলে।‘

বাইরে বেরিয়ে এলো দুজন। সন্ধ্যা হতে চলেছে। মোটরবাইকে স্টার্ট দিয়েছেন ড. আরেফিন, মাঝখানে পোশাক বদলে নিয়েছিলেন, পরনে এখন জিন্সের প্যান্ট, কালো টি-শার্ট। শিক্ষকদের এ ধরনের বেশে দেখে অভ্যস্ত নয় ছাত্ররা। রাশেদেরও একটু অস্বস্তি লাগছে, ভদ্রলোককে একেবারে তরুন মনে হচ্ছে। পেছনে বসে আছে সে।

বাসার গেটের বাইরে আসা মাত্র আরো দুটি যান্ত্রিক বাহন স্টার্ট দিল। হলুদ ট্যাক্সি ক্যাবে বসে আছে এক যুবক, গ্লাস নামিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে, অন্যটা মোটরবাইক। সাধারন পোশাকে কামরুল চালাচ্ছে সেটা।

ড. আরেফিন এবং রাশেদ দুজনেই হেলমেট পরে নিয়েছে, পেছনে আসতে থাকা অনুসরনকারীদের লক্ষ্য করলো না ওরা।

***

একটা মাইক্রোবাস দাঁড়ানো আছে বাংলা একাডেমীর একপাশে। অন্ধকারে দাঁড়ানো গাড়িটা। ঠিকমতো লক্ষ্য না করলে কেউ দেখতে পাবে না। পেছনের দিকে আছে ছয়জন লোক। চেহারায় হিংস্রতা যেন ফুটে বের হচ্ছে। এদের মধ্যে একজনের চেহারা একটু কোমল। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই লোকটা আসলে কোন পুরুষ নয়, একজন মেয়ে। পুরুষ সাজিয়ে আনা হয়েছে। দুপাশ থেকে রিভলবার ধরে আছে দুজন। নির্দেশ আছে মুখ একটু খুললেই যেন গুলি চালিয়ে দেয়া হয়। এই তিনজন বসে আছে মাঝখানের সিটে। বাকি তিনজন সামনের সিটে। এদের হাতেও অস্ত্র তৈরি। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে আছে এই দলের সবচেয়ে বয়স্ক লোকটা। দেখে মনে হচ্ছে নেতা সেই।

একটু পর পর ঘড়ি দেখছে সে। সন্ধ্যা হয়েছে কিছুক্ষন আগে। সামনে ইউনিভার্সিটি, টি.এস.সি চত্বর। টিএসসি’র উল্টোদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢোকার বেশ বড় একটা গেট। সাতটা বাজে মাত্র। পুরো এলাকায় প্রচুর মানুষের আনাগোনা। ছাত্রই বেশি। এছাড়া বেড়াতে আসা মানুষেরও অভাব নেই।

জায়গাটা পছন্দ করার তেমন কোন কারন নেই। এতো বড় ঢাকায় কোন জায়গা খালি নেই। সবখানেই মানুষ। এই এলাকাটা তুলনামূলকভাবে অনেক নির্জন, পথচারী বা যানবাহনের পরিমান অন্য যে কোন এলাকা থেকে কম। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন যে কারন তা হচ্ছে আস্তানা থেকে কাছে।

টেনশন হচ্ছে না আকবর আলী মৃধার। দোয়েল চত্বরের কাছে পুলিশের একটা বেভ্যান সবসময় দাঁড়িয়ে থাকে। এছাড়া টি.এস.সি’তে আছেই। কিন্তু কাজটায় কোন ঝামেলা আশা করছেন না তিনি। ছেলেটা পুলিশে খবর দেবে বলে মনে হয় না। সবার কাছে যে অস্ত্র দিয়েছেন সবগুলোই সাইলেন্সর যুক্ত। রাশেদকে শব্দহীন একটা মৃত্যু উপহার দেয়ার আশা রাখেন আকবর আলী মৃধা। লিলিকেও বাঁচতে দেয়া যাবে না। কোন প্রমান রাখবেন না তিনি। পেছনে কোন সূত্র ছেড়ে যাওয়া যাবে না।

স্বভাবসুলভ আলখেল্লা পরেননি তিনি আজ। কালো জিন্সের সাথে শার্ট পড়েছেন। বয়স অনেক কম লাগছে, মনে হচ্ছে যৌবনকালে ফিরে গেছেন। আরো এক ঘণ্টা অপেক্ষায় কাটাতে হবে। তারপর সত্যি সত্যি হয়তো চিরযৌবন পাওয়ার পথ খুঁজে পাবেন।

***

ট্যাক্সিক্যাবটা ছেড়ে দেয়া হয়েছে কিছুক্ষন আগে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে দাঁড়িয়ে আছে যুবক। আশপাশে অনেক লোকজন, চায়ের দোকান, চটপটির দোকান, এর মাঝে নির্দি কারো উপর নজর রাখা কঠিন। ড. আরেফিন এবং রাশেদ মোটরবাইকটা পার্ক করে একটা চায়ের স্টলে বসে আছে। রাশেদের কাঁধে একটা ব্যাগ। দুজনের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব টেনশনে আছে। কিন্তু কারনটা কি বুঝতে পারছে না যুবক। কারো সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছে মনে হয়। সাড়ে সাতটার মতো বাজে, ঘড়ি নেই, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক তরুণের কাছে জিজ্ঞেস করে নিলো যুবক।

ইচ্ছে করলে এখন রাশেদের পাশে গিয়ে বসা যায়। কিন্তু ঝুঁকি হয়ে যায়, চিনতে পারবে না যদিও। আরো একজনকে মোটরবাইকে করে পিছু নিতে দেখেছে যুবক, সেই ড. আরেফিনের বাসা থেকে। রাশেদ এবং ড. আরেফিনের একটু পেছনে মোটরবাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই লোকটা। এই লোকটার উদ্দেশ্য কি বোঝা যাচ্ছে না। তবে ক্ষতিকর কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না। ঠিক তার মতোই নজর রাখছে। সময় হলেই পরিস্কার হয়ে যাবে সব।

মাথার ভেতরে মৃদু যন্ত্রনা হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে ঝামেলা হতে যাচ্ছে, কিছুক্ষনের মধ্যে। হাতে কোন অস্ত্র নেই। কিন্তু নিজ হাতে বানানো কিছু জিনিস আছে, ছোট ছোট তীর, তীরের মাথায় একধরনের কেমিক্যাল লাগানো। কারো গায়ে একবার ছুঁড়ে দিলে এক সেকেন্ডের ভেতর কাজ শুরু করে জিনিসটা। অবশ করে দেয়। অনেককাল আগে আফ্রিকার কালো মানুষদের কাছে এগুলো বানানো শিখেছিল সে। আজ যেভাবেই হোক, রাশেদকে সাহায্য করতে হবে। একটা সিগারেট ধরালো যুবক। চারদিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন কারো আসার কথা, অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত একজন মানুষ। রাশেদের হাতের মোবাইলটা বেজে উঠলো এই সময়। কান খাড়া করল যুবক। কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না দূর থেকে।

*

অধ্যায় ৩৫

মোবাইলে ফোনটা এলো ঠিক আটটার সময়। রাশেদ তাকিয়ে ছিল স্ক্রিনের দিকেই। রিং হওয়া মাত্রই ধরে ফেলল।

‘হ্যালো, রাশেদ বলছি।’

‘খুব ভালো, এখন কোথায় তুমি?’

‘যেখানে থাকার কথা,’ একটু ঝাঁঝের সাথে বলল রাশেদ।

‘গুড, তোমার সাথে আর কে আছে?’

‘আর কেউ নেই?’

‘ড. আরেফিন, তিনি নেই? বুঝতে পারল রাশেদ, মিথ্যে বলে লাভ হবে না। নিশ্চয়ই ওরা দেখেছে দূর থেকে।’

‘আপনিও নিশ্চয়ই একা আসেননি।

‘হ্যাঁ, আমিও একা আসিনি,যাই হোক, তোমার এর পরের কাজ হচ্ছে পার্কের ভেতরে ঢুকে পড়া, কিন্তু এবার একা ঢুকবে, ড. আরেফিন যেখানে বসে আছেন, সেখানেই থাকবেন।

‘তারপর?’

‘নাক বরাবর হাঁটবে, ঠিক দু’শো পা। তারপর দাঁড়াবে।’

‘তারপর?

‘আমি থাকবো সেখানে, সাথে থাকবে তোমার প্রিয় বান্ধবী লিলি। ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু চালাকী করলে সাথে সাথে বুলেট খরচ করতে দ্বিধা করবো না আমি।’

‘ঠিক আছে, আমি কোন ঝামেলা চাই না। লিলিকে নিয়ে চলে যাবো। ওর যদি কিছু হয় আমি কিন্তু কাউকে ছাড়বো না।’

‘আমাকে হুমকি দিয়ে কিছু করতে পারবে না রাশেদ। অনুরোধ করো, কাজ হবে। যাই হোক, ন’ করার মতো সময় নেই। ঢুকে পড়ো। আমি আসছি।

মোবাইলটা রেখে ড. আরেফিনের দিকে তাকাল রাশেদ।

‘তুমি যাও, আমি পেছনে থাকবো।’

‘একটু দূরত্ব রেখে হাঁটবেন, যাতে ওরা বুঝতে না পারে, রাশেদ বলল।’

‘বুঝবে না।’

রাশেদ ঢুকে গেল গেটের ভেতরে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আগের মতো নেই। এককালের রেসকোর্স ময়দান এখন অনেকটাই আলোকিত। ঘন হয়ে থাকা গাছগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে আলো আসছে। দুশো পা হিসেব করে হাঁটা খুব ঝামেলার কাজ বলে মনে হলো রাশেদের কাছে। বেশ কিছুটা পথ চলে এসেছে সে। পঁচিশ-ছাব্বিশ সাতাশ। পা ফেলছে আর মনে মনে গুনছে রাশেদ। দৃষ্টি সামনের দিকে।

পেছনে হাঁটছে আরো তিনজন। রাশেদের সাথে বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে। একজন আরেকজনের অবস্থান সম্পর্কে বেশি একটা অবগত নয়। আশপাশে আরো অনেক মানুষজন আছে। তাদের আগ্রহের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে আছে রাশেদ। ড. আরেফিন মাথায় একটা ক্যাপ পড়ে নিয়েছেন। পরনে জিন্সের প্যান্ট।

***

পোশাক সচেতন মেয়ে লিলি, ছেলেদের পোশাক আগে কখনো পরে দেখেনি তা নয়। আজ বাধ্য হয়ে পরতে হয়েছে বলে ভালো লাগছে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে। পাশে আকবর আলী মৃধা। একটু আগে মাইক্রোবাসটা থেকে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে লিলিকে। আকবর আলী মৃধা একাই দাঁড়িয়ে আছেন, লিলির কোমরের সাথে সাইলেন্সর লাগানো পিস্তলটা ধরে। অন্য কেউ দেখে বুঝতেও পারবে না, পিস্তলের নলে ঝুলছে একটা মেয়ের জীবন। সাঙ্গপাঙ্গরা আশপাশেই আছে, তৈরি হয়ে। একেকটা গাছের পেছনে কাভার নিয়ে। কাজেই অনেকটা নিরাপদ বোধ করছেন আকবর আলী মৃধা।

আজ তার অনেকদিনের আশা পূরন হতে যাচ্ছে। ড. কারসনকে ব্যবহার করে বইটার পাঠোদ্ধার আজ রাতের মাঝেই করবেন তিনি। তারপর, মনে মনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন তিনি। তারপর…সমগ্র পৃথিবীর উপর রাজত্ব করবেন।

***

রাশেদকে অনুসরন করতে গিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো মনে। ড. আরেফিন এবং মোটরবাইক চালক দুজনকেই দেখতে পেয়েছে সে এখন। এদের কাছ থেকে ক্ষতির শঙ্কা নেই রাশেদের জন্য। এরা রাশেদের উপকারই করতে এসেছে। সমস্যা হচ্ছে যার সাথে দেখা করতে এসেছে রাশেদ তাকে নিয়ে। সেই লোক একা আসেনি। আরো বেশ কিছু লোক নিয়ে এসেছে। যাদের একজনকে এক ঝলক দেখে ফেলেছে যুবক। গাছের আড়াল থেকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে রেখেছে রাশেদের দিকে। হুকুম পাওয়া মাত্র গুলি করবে।

কি করতে হবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। দ্রুত হেঁটে রাশেদ যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকে চলে গেল যুবক। দুজন অস্ত্রধারীকে দেখা গেল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাশেদের দিকে। বিনা শব্দে একজনের পেছনে চলে গেল যুবক। লোকটার সমস্ত মনোযোগ অন্যদিকে। দুহাতে লোকটার মাথা ধরে ফেলল সে, প্রচন্ড শক্তিতে ঘুরিয়ে দিল। মট করে একটা শব্দ হয়েছে মাত্র, ঘাড় ভেঙে গেছে লোকটার। মারা গেছে সাথে সাথে। মাটিতে পড়ে যাতে শব্দ না হয়, সেজন্য লোকটার দেহ আস্তে করে নিচে নামাল যুবক। হাতের পিস্তলটা নিয়ে নিলো। এ ধরনের জিনিস কখনো চোখে পড়েনি তার। কিভাবে চালাতে হয় কে জানে। কোমরে খুঁজে নিলো পিস্তলটা।

লোক আরো আছে, তবে কতজন ঠিক নিশ্চিত হতে পারছে না যুবক। এবার একটু ডানে অন্য একটা গাছের আড়ালে আরেকজনকে দেখা গেল। ঠিক একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, পিস্তল তাক করে। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল যুবক। একটু পরে এই লোকটাকেও মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখা গেল, প্রাণহীন দেহে।

খোলা একটা জায়গায় দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে অপেক্ষা করছে কারো জন্য। এদের একজন বেশ লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান, অন্যজন ছোটখাট, অনেকটা মেয়েলী ধরনের। বোঝা যাচ্ছে এই দুজনই অপেক্ষা করছে রাশেদের জন্য। এদের উল্টোদিকে যেতে হবে, কারন সেখানে আরো একজনকে দেখা যাচ্ছে, গাছের পেছনে দাঁড়ানো, মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। দুজনকে এরমধ্যেই যমঘরে পাঠানো হয়েছে, একেও পাঠাতে হবে। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল যুবক। এবার আর কাছে যাওয়ার ঝুঁকি নেয়া যাবে না। নিজের হাতে বানানো ছোট কিন্তু কাযর্কর অস্ত্রটা ব্যবহার করতে হবে, বিষ মেশানো ছোট ছোট পুঁই। এগুলোর মাথায় মাখানো রয়েছে এক ধরনের বিষ। বাঁশের তৈরি ছোট একটা চোঙ্গার মাধ্যমে ফুঁ দিয়ে ছুঁড়ে দিতে হয়। সুইয়ের মাথা শরীরে ঢোকা মাত্র মারা যাবে যে কোন প্রানী। মানুষ তো শব্দ করারও সময় পাবে না।

***

কামরুলের নজর ড. আরেফিনের দিকে। ভদ্রলোক একদম ভোল্ট পালটে ফেলেছেন। পরিচিত কেউ দেখলে সহজে চিনতেই পারবে না। ছেলেটার পেছন পেছন যাচ্ছেন ড. আরেফিন আর তার পেছনে আছে কামরুল। নিঃশব্দে হাঁটছে সে, ড. আরেফিন বুঝে গেলে এদের আসল উদ্দেশ্য কি ছিল কখনো জানা হবে না। আরো কিছুদূর গিয়ে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়লেন ড. আরেফিন। বার বার উঁকি দিয়ে দেখার চো করছেন সামনে কি হচ্ছে। কামরুলও তাই করেছে। এই প্রথমবার তার মনে হলো এখানে একা আসা ঠিক হয়নি। ব্যাক আপ দরকার। সত্যি সত্যি কিছু ঘটতে চলেছে এখানে। ড. আরেফিনের হাতে জিনিসটা দেখে আরো অবাক হলো কামরুল। কোমর থেকে একটা পিস্তল বের করে হাতে নিয়েছেন ড. আরেফিন। তৈরি হয়ে আছেন যে কোন মূহূর্তে বুলেট খরচ করার জন্য। এখানে খুব বাজে কিছু হয়ে গেলে তার সব দায়িত্ব এসে পড়বে তার ঘাড়ে, ভাবল কামরুল। কাজেই বজলুল করিমকে একটা ফোন করে সব জানিয়ে রাখা ভালো। আট-দশজনের একটা দল পেলে পরিস্থিতি মোটামুটি সামাল দেয়া যাবে।

‘স্যার, হ্যালো, স্যার,’ মোবাইলে ফিসফিস করে বলল কামরুল।

‘জোরে বলো শুনতে পাচ্ছি না, ওপাশ থেকে বজলুল করিমের কণ্ঠ শোনা গেল।

‘আমার কিছু হ্যান্ড লাগবে, এক্ষুনি।’

‘তুমি কোথায়?’

‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, এক্ষুনি পাঠান, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এখানে।’

‘সময় লাগবে না, শাহবাগ মোড় থেকে ব্যাকআপ যাবে তোমার কাছে, অ্যালার্ট থেকো। সাবধান।’

‘ধন্যবাদ, স্যার, রাখি,’ ফোনটা রেখে দিল কামরুল।

নিজের কাছে থাকা পিস্তলটা বের করল সে। তৈরি হয়ে থাকতে হবে। ড. আরেফিনের মতো লোক যদি অস্ত্র বের করতে পারে তাহলে পরিস্থিতি আসলেই হয়তো ভালো না। ঘাম হচ্ছে খুব। খুব বেশি টেনশনে থাকলে এমন হয় তার।

ড. আরেফিন তাকিয়ে আছেন রাশেদের দিকে। দুজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে খোলা একটা জায়গায় দাঁড়ানো। কিন্তু পেছনে তড়িৎগতিতে এপাশ থেকে ওপাশে ছুটে গেল কে? মানুষ দুজন অবশ্য লক্ষ্যই করলো না। কোমর থেকে পিস্তল বের করেছেন তিনি। রাশেদ প্রায় পৌঁছে গেছে ঐ দুজনের দিকে। বোঝাই যাচ্ছে, ছোটখাট গড়নের মানুষটা আর কেউ না, লিলি। মেয়েটাকে পুরুষের বেশে নিয়ে এসেছে যাতে কেউ বুঝতে না পারে। এমনিতেই রাত। অন্ধকারে এই পোশাকে দেখলে কেউ সহজে কিছু বুঝতে পারবে না। বুদ্ধিটা ভালোই করেছে শয়তানের দল। ছোটখাট গড়নের সাথে দাঁড়ানো স্বাস্থ্যবান মানুষটাকেই মনে হচ্ছে নাটের গুরু। শামীমের হত্যাকারী এরাই। হাত নিশপিশ করে উঠলো ড. আরেফিনের। নিশানা কখনো ভুল হয় না তার। এখান থেকে গুলি ছুঁড়ে লোকটা মাথা ফুটো করে দিতে পারেন তিনি। কিন্তু লিলি যতক্ষন পর্যন্ত নিরাপদ না হবে, ততক্ষন ঝুঁকিপূর্ন কিছুই করা যাবে না।

*

অধ্যায় ৩৬

লিলিকে দেখে ইচ্ছে করছিল দৌড়ে যেতে কিন্তু নিজেকে সংযত করলো রাশেদ। তারজন্য মেয়েটা এতো ঝামেলায় পড়েছে। ছেলেদের পোশাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে লিলিকে।

লিলির সাথের লোকটা তাকিয়ে আছে তার দিকে, জ্বলজ্বলে চোখে। অদ্ভুত একটা ঘৃনামিশ্রিত ভয় যেন মেরুদন্ড কাঁপিয়ে দিল তার। এই লোকটাই শামীমের মৃত্যুর জন্য দায়ি। কি নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে ছেলেটাকে। এ ছাড়াও আরো কতো প্রান নিয়েছে এই খুনি কে জানে। মানুষ নামের শয়তান একটা।

আরো একটু সামনে এগুতেই হাত দিয়ে ইশারা করে থামতে বলল লোকটা। লিলির কোমরের কাছে একটা পিস্তল ধরা, দেখতে পেল রাশেদ। ঝুঁকির কোন কাজ করা ঠিক হবে না, মনে মনে ভাবল রাশেদ।

‘ঐখানেই দাঁড়াও,’ বলল লোকটা। দাঁড়াল রাশেদ।

‘আমার জিনিস কোথায়?’

উত্তর দিলো না রাশেদ। সে তাকিয়ে আছে লিলির দিকে। মেয়েটাও তাকিয়ে আছে। মাথা নাড়ছে ডানে বামে, যেন কিছু না বলে রাশেদ।

‘আমার কথা কানে যাচ্ছে না?’ এবার বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো লোকটা। হাত ইশারা করে কাঁধের ট্রাভেল ব্যাগটা দেখাল রাশেদ।’

‘ব্যাগটা এদিকে ছুঁড়ে মারো।’

‘আগে লিলিকে আমার কাছে আসতে দিন।’

‘আগে তুমি ব্যাগটা ছুঁড়ে দাও এদিকে।’

‘আমি নিরস্ত্র, ভয়ের কিছু নেই। আপনি আগে লিলিকে এদিকে আসতে দিন।’

‘না, আমি যা বলছি, তাই করতে হবে।’

‘যদি না করি?’

‘তাহলে প্রথমে তোমার বান্ধবীকে খুন করবো, তারপর তোমাকে। মৃত মানুষের ব্যাগের কোন প্রয়োজন হয় না।’

আশপাশ দিয়ে কিছু লোকজন আসা যাওয়া করছে। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে ওদের দিকে। কিন্তু কিছু লক্ষ্য করে নয়। খুব সাধারন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। কাজেই কারো বোঝার উপায় নেই কি হচ্ছে এই তিনজনের মধ্যে।

রাশেদের মনে হচ্ছে ড. আরেফিনকে পাশে রাখা ভালো ছিল, তাতে অস্ত্রের ভয় লোকটাকে দেখানো যেত। কিন্তু সে পুরোপুরি নিরস্ত্র । ড. আরেফিন যে পিস্তলটা দিয়েছিল সেটা ইচ্ছে করে বাসায় সোফার নিচে রেখে এসেছে। এখন মনে হচ্ছে, খুব ভুল কাজ হয়েছে সেটা।

‘রাশেদ, আমাদের মেরে ফেলুক, কিন্তু বইটা যেন ওর হাতে না পড়ে, ছিঁড়ে ফেলো অথবা আগুনে পুড়িয়ে দাও।’ লিলি বলল লোকটার দিকে তাকিয়ে, যেন চোখের আগুন দিয়েই পুড়িয়ে মারতে চায় লোকটাকে।

লিলির গালে আচমকাই একটা চড় বসিয়ে দিয়েছে লোকটা। পড়ে যাচ্ছিল লিলি, সাথে সাথে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে লোকটা।

‘এর নাম আকবর আলী মৃধা, শয়তানের উপাসক। কোনভাবেই বইটা এই শয়তানের হাতে পড়তে দিও না, রাশেদ, আবার বলল লিলি।

‘তুমি ওর কথা শুনবে না আমার কথা?’ বললেন আকবর আলী মৃধা। আমার কথা শুনলে দুজনকেই মরতে হবে।’

‘ঠিক আছে।‘

‘কী ঠিক আছে?’

‘ব্যাগটা ছুঁড়ে দিচ্ছি আমি, কিন্তু লিলির দিক থেকে পিস্তলটা সরিয়ে নিতে হবে আপনার।‘

‘তোমার শর্তে রাজি না হলে?’

আপনি আমাদের মারবেন ঠিক আছে, কিন্তু নিজেও বাঁচতে পারবেন না। ড. আরেফিন আছেন পেছনে, দূর থেকে লক্ষ্যভেদ করা উনার কাছে ডালভাত।

‘ঠিক আছে, সরাচ্ছি আমি,’ বললেন আকবর আলী মৃধা। পিস্তলটা সরিয়ে নিলেন লিলির দিক থেকে।

‘এবার ছুঁড়ে মারো, লিলিকে ছেড়ে দিচ্ছি আমি।’

‘ঠিক আছে, ছুঁড়ে দিচ্ছি আমি।

কাঁধ থেকে ট্রাভেল ব্যাগটা নামাল রাশেদ। মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে। বইটা হাতছাড়া করতে মন চাইছে না। কিন্তু লিলিকে বাঁচানোর এটাই একমাত্র উপায়।

প্রাচীন বইটা বের করে আনল রাশেদ। হাতে ধরে রাখল কিছুক্ষন। দারুন এক রহস্যের খোঁজ আছে বইটায়। মানবসম্প্রদায়ের ইতিহাস নতুন করে রচনা করার সুযোগ। কিন্তু শয়তানের উপাসক এই বাজে লোকটার হাতেই সমর্পন করতে হচ্ছে জিনিসটা।

‘আপনি আগে লিলিকে ছাড়ুন, ঠিক আমাদের দুজনের মাঝখানে পৌঁছাবে যখন, তখনই বইটা দেবো আমি।’ রাশেদ বলল।

লোকটা বই পাওয়া মাত্র হয়তো লিলিকে গুলি করতে পারে, এমনকি তাকেও। যদিও ড. আরেফিন কাভার দিচ্ছেন, কিন্তু এই পাজি লোকটা সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসেছে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। ওরা আশপাশেই আছে। বইটা আকবর আলী মৃধার হাতে যাওয়া মাত্র গুলি ছুড়বে।

কিন্তু এখন আর কিছু ভাবার সময় নেই। লিলিকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিজের প্রান বিসর্জন দিতেও রাজি রাশেদ। জেনেশুনে একটা মেয়েকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার কোন অধিকার নেই তার।

লিলিকে ছেড়ে দিয়েছেন আকবর আলী মৃধা। একপা দু’পা করে এগিয়ে আসছে লিলি। চারপাশে সব শব্দ যেন থেমে গেছে। নিজের বুকের ধুকপুকানি পরিস্কার শুনতে পাচ্ছে রাশেদ। এখন যে কোন মুহূর্তে যে কোন কিছু হয়ে যেতে পারে।

আরো কয়েক পা এগিয়ে এসেছে লিলি। ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে এখন সে।

বইটার দিকে আরো একবার তাকাল রাশেদ।

তারপর ছুঁড়ে দিল আকবর আলী মৃধার উদ্দেশ্যে।

***

চোখের সামনে সবকিছু স্লো মোশনে হতে দেখল যেন রাশেদ। আকবর আলী মৃধা হাত থেকে পিস্তল ফেলে দিয়েছেন বইটা ধরার জন্য। কিন্তু ধরতে পারলেন না তিনি। চিলের মতো গতিতে কেউ একজন ঝাঁপিয়ে পড়ে বইটা নিয়ে নিলো। তারপর একটা ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে পড়ে রইল কিছুক্ষন। রাশেদ তাকিয়ে আছে বড় বড় চোখ করে, বিশ্বাস হচ্ছে না। আকবর আলী মৃধা চেঁচিয়ে উঠলেন, ফায়ার।

বইটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে মানুষটা। অল্প বয়সী এক যুবক, অন্ধকারে চোখদুটো যেন জ্বলছে।

‘আমার জিনিস, আমি নিয়ে যাচ্ছি,’ রাশেদের উদ্দেশ্যে বলল সে কথাগুলো। চোখগুলো খুব চেনা, খুব আপন মনে হচ্ছিল রাশেদের কাছে।

তারপর দৌড় দিল। চোখের নিমেষেই হারিয়ে গেল সারি সারি গাছের ফাঁকে।

আকবর আলী মৃধা ফেলে দেয়া পিস্তলটা তুলতে গেছেন, কিন্তু পারলেন না। তার হাতের উপর শক্ত বুট পরা একটা পা পড়েছে, ককিয়ে উঠলেন তিনি। পা’এর মালিকের উদ্দেশ্যে তাকালেন উপর দিকে। চিনলেন না, তবে বুঝতে অসুবিধা হলো না আইন শংখলা বাহিনীর লোক, চেহারায় কঠিন একটা ছাপ আছে।

‘হ্যান্ডস আপ,’ বলল সেই লোকটা।

মাথার উপর দুহাত তুলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন আকবর আলী মৃধা। চারপাশে তাকালেন। কিন্তু নিজের শিষ্যদের মধ্যে কাউকে দেখতে পেলেন না। ছয়জন ছিল ওরা। সবাই কি পালিয়েছে?

‘কাকে খুঁজছেন?’ জিজ্ঞেস করল লোকটা।

‘কাউকে না।’

‘যাদের খুঁজছেন তারা সবাই জাহান্নামের পথ ধরেছে।‘

আকবর আলী মৃধা তাকালেন সামনের দিকে। সেখানে মুক্তির আনন্দ দেখতে পেলেন তিনি।

রাশেদ বইটা ছুঁড়ে মারার সাথে দৌড়ে রাশেদের পাশে চলে এসেছিল লিলি। এখন কামরুলকে এখানে দেখে অবাক হলো সে। আকবর আলী মৃধাকে গ্রেফতার করেছে এর মধ্যে।

ড. আরেফিনও চলে এসেছেন রাশেদের কাছে। হাতে পিস্তলটা তৈরি এখনো। অ্যাকশন মিস করেছেন বলে মন একটু খারাপ মনে হচ্ছে।

‘লিলি, তুমি ঠিক আছো?’ কামরুল এসে জিজ্ঞেস করলো লিলিকে। একহাতে হ্যান্ডকাফে ধরে রেখেছে সে আকবর আলী মৃধাকে।

‘ঠিক আছি, কামরুল ভাই,’ রাশেদের দিকে তাকাল লিলি, আমার বন্ধু রাশেদ। রাশেদ, ইনি হচ্ছেন আমার আত্মীয় কামরুল ভাই।

‘শুধু বন্ধু না বিশেষ কিছু?’ হেসে জিজ্ঞেস করল কামরুল।

উত্তর দিলো না লিলি। রাশেদের হাতে হাত রাখল।

‘পুলিশে খবর দেয়া হয়েছে, সবার অজান্তেই এখানে কিছু খুন হয়েছে,’ থামল কামরুল। খুন শুনে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে লিলি।

‘আমি খুন করিনি। যে লোকটা বইটা নিয়ে পালিয়েছে তার কাজ।‘

কামরুল বলল, ‘ছয়টা লাশ পেয়েছি আমি, অসম্ভব শক্তিশালী লোক, ঘাড় মটকিয়ে মেরেছে দুই জনকে। বাকিদের কিভাবে মেরেছে বুঝতে পারিনি এখনো, কোন ধরনের বিষ প্রয়োগ করেছে। কৌশলটা বের করতে হবে। তবে আমাদের এখানে এই ধরনের কৌশলের প্রয়োগ আগে কখনো দেখিনি।

ড. আরেফিনের দিকে তাকাল রাশেদ। কামরুল এবং সেই যুবকের উপস্থিতি কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না তার।

‘আমি নজর রাখছিলাম ড. আরেফিনের উপর। তার পেছনে পেছনেই এখানে আসা। ভাগ্য ভালো, লিলিকেও উদ্ধার করা গেছে।‘

পুলিশের বেশ কিছু সদস্য হাজির হলো এই সময়।

‘আমি এই ক্রিমিনালকে নিয়ে যাচ্ছি, আপনারাও সবাই থানায় আসুন।’ কামরুল বলল।

আকবর আলী মৃধাকে দুদিক থেকে দুজন পাহারা দিয়ে নিয়ে গেল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে। যেখানে পুলিশের গাড়ি অপেক্ষা করছিল।

অন্য একটা গাড়িতে থানার উদ্দেশ্যে রওনা দিল রাশেদ। সাথে লিলি এবং ড. আরেফিন। বড় একটা বোঝা যেন বুকের উপর থেকে নেমে গেছে মনে হচ্ছে। আসল অপরাধিকে ধরা গেছে। কিন্তু সেই যুবক কেন বলল বইটা তার ছিল। মাথায় কিছুই ঢুকছে না তার। হাসল রাশেদ। এই বিষয়ে আর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। বইটা চলে গেছে তার মালিকের সাথে এটাই বড়।

***

থানায় বসে আছে এখন ওরা। লিলির কাছ থেকে ড. কারসনের নাম জানা গেছে। তিনি কোথায় আছেন আকবর আলী মৃধার কাছ থেকে জেনে নিয়েছে পুলিশ। তাকে আনতে পুলিশের একটা স্পেশাল ফোর্স পাঠানো হয়েছে।

লিলির বাবা আখতার হোসেনসাহেবকেও খবর পাঠানো হয়েছে। তিনিও আসছেন।

বজলুল করিমের রুমে বসে আছে তিনজন। রাশেদ, লিলি এবং ড. আরেফিন। কামরুলও আছে।

‘যে আসামীকে আমরা ধরে এনেছি, অনেক বড় প্ল্যান ছিল তার,’ বলল কামরুল।

‘সব বের করে আনবো আমরা। পুলিশ কি জিনিস চেনেনি এই লোক।’ বললেন বজলুল করিম। তার মুখে হাসি ধরছে না।

‘এই লোকটাই শামীমের খুনি।‘ রাশেদ বলল। ট্রাভেল ব্যাগটা থেকে তাকে উদ্দেশ্য করে শামীমের লেখা চিঠিটা বের করে বজলুল করিমের হাতে দিলো সে।

‘আপনার নাম ছিল সন্দেহের তালিকায় একেবারে এক নম্বরে মি. রাশেদ। এই চিঠিটা হয়তো আপনাকে রক্ষা করবে। আমরা চিঠিটা শামীমের হাতে লেখা কি না তা মিলিয়ে দেখবো। সে পর্যন্ত আপনি ঢাকার বাইরে কোথাও যাবেন না।’ বললেন বজলুল করিম।

‘ড. কারসনের অপহরন কেসটাও আমাদের জন্য ছিল বিশাল এক ঝামেলা, বলল কামরুল। সেটাও মিটে যাচ্ছে আশা করি।’

‘আর লিলির কেসটা মিটে গেছে সে তো সামনেই দেখতে পাচ্ছি,’ বললেন বজলুল করিম।

‘জি, স্যার। কিন্তু উদ্যানে আসামীর সঙ্গিসাথিদের খুনিকে ধরতে পারলাম না আমরা। এতে ক্ষিপ্র গতির মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। চোখের নিমেষে হারিয়ে গেল।‘

‘তাকেও বের করবো আমরা, পালিয়ে যাবে কোথায়, এর মধ্যে সব থানায় খবর দিয়ে দেয়া হয়েছে,’ বললেন বজলুল করিম, যাক, আজ একসাথে বেশ কয়েকটা কাজ হয়ে গেল, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি।

‘কিন্তু মি. রাশেদ, আপনাকে যা বলা হলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন আশা করি। ঐ আকবর লোকটার স্বীকারোক্তি না পাওয়া পর্যন্ত শামীমের খুনির সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ যাবে না আপনার নাম। প্রতি সপ্তাহে থানায় এসে হাজিরা দিয়ে যাবেন। এটা একটা ফর্মালিটি।‘

‘ঠিক আছে, আমার কোন সমস্যা নেই।‘

ড. আরেফিনের দিকে তাকাল রাশেদ। ভদ্রলোক এখনো মনমরা হয়ে আছেন। বইটা হারানোর দুঃখ ভুলতে পারছেন না মনে হলো।

‘আরেফিন ভাই, আপনাকে কিন্তু নায়কের মতো দেখাচ্ছে আজ, আপাকে বলতে হবে,’ ঠাট্টা করে বললেন বজলুল করিম।

মুখে হাসি ফুটল ড. আরেফিনের। কিছু বলতে গিয়েও বললেন না।

কিছুক্ষন পর লিলি চলে গেল। তার বাবা এসে নিয়ে গেল তাকে। পুলিশ উদ্ধার করেছে এটুকুই জানলেন ভদ্রলোক। লকআপে আসামীকে দেখে গিয়েছেন। তেমন কোন প্রশ্ন করেননি কাউকে। মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন সুস্থ, স্বাভাবিক অবস্থায় এটাই যেন তার কাছে অনেক কিছু।

রাত বেশি হয়নি। পুলিশের একটা গাড়িতে করে পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব করলেন বজলুল করিম। কিন্তু না করলেন ড. আরেফিন। তার ধারে নেয়া মোটরবাইকটা থানায় আনা হয়েছে। রাশেদকে পেছনে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন তিনি।

আসার আগে কামরুলকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলল না রাশেদ। কিন্তু আসল ধন্যবাদ জানানোর জন্য সেই যুবককে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যার জন্য এক শয়তানের উপাসকের সমস্ত পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে গেছে। একা হাতেই সবকিছু বদলে দিয়েছে লোকটা। যেন রাশেদের পক্ষ হয়ে কাজ করেছে। এই যুবকের পরিচয় হয়তো কোনদিনও জানা হবে না। কিছু কিছু ব্যাপারে রহস্য থাকাই ভালো।

ঝড়ের বেগে মোটরবাইক চালাচ্ছেন ড. আরেফিন। চোখ বুজে আছে রাশেদ, মনে হচ্ছে যেন হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে। আজ শামীম হত্যার আসল আসামী ধরা পড়েছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে।

*

উপসংহার

রমনার ভেতর রাত কাটিয়েছে যুবক। সারারাত প্রায় জেগেই ছিল সে। সকালের দিকে চোখ লেগে আসছিল। কিন্তু ঘুমায়নি। বইটা বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। কতো কতো বছর পর আবার তার হাতে এসেছে জিনিসটা। সেই রামপ্রসাদ বইটা কাজের কিছু নয় বলে ফেলে এসেছিল কোথাও। কতো হাত ঘুরেছে কিন্তু এর মধ্যে কেউ এটার মর্মোদ্ধার করতে পারেনি। কেউ যাতে না পারে, তাই প্রাচীন বইটা কিছুক্ষন আগে রমনার লেকে জলাঞ্জলী দিয়েছে যুবক, টুকরো টুকরো করে। পৃথিবীতে তার মতো মানুষ একজনই যথে। বইটা যতদিন থাকতো ততদিন তার পেছনে ছুটতো মানুষ। কিন্তু এখন আর সে সম্ভাবনা নেই। বইটার আসল রহস্যের খোঁজ আছে তার মাথায়, মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে। সেখান থেকে কেউ আর এর পাঠোদ্ধার করতে পারবে না।

সুটকেস দুটো নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়বে যুবক। দেরি করার সময় নেই। ছয় ছয়টা খুন হয়েছে উদ্যানে। পুলিশ নিশ্চয়ই তাকে খুঁজছে। এখানে, এই ঢাকায় থাকা মানে প্রতিমুহূর্তে ঝুঁকির মধ্যে থাকা। এক্ষুনি এই এলাকা ছাড়তে হবে। ছাড়তে হবে দেশটাও।

তার নিজস্ব কোন পরিচয় নেই, নেই কোন পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট। একসময় পুরো দুনিয়া ঘুরে বেড়ানো অভিযাত্রী এখন ঘুরে বেড়াবে নাম পরিচয়হীন এক যাযাবরের মতো। দেশ থেকে দেশে ঘুরে বেড়ানো এখন আগের মতো সোজা হবে না। সমস্ত পৃথিবীটাকে মানুষ ভাগ করে নিয়েছে। নিজের ভূ-খন্ডে বিদেশি কাউকে আগের মতো সম্মানের চোখে দেখা হয় না।

যুগে যুগে অনেক নাম ধারন করেছে সে, হোরাস, নেবুলাস, মার্কাস ডাসিডিয়াস, সেইন্ট দ্য জারমেইন, মুগওয়া, জারমোনি, এরকম আরো কতশত নাম। সামনে আরো কতো নাম ধারন করতে হবে কে জানে। কিন্তু এই শস্য শ্যামলা ভূমিতেই প্রথমবারের মতো নিজের উত্তরাধিকারী রেখে যাচ্ছে। এখান থেকে যাবার সময় হয়েছে এখন। অনেক দূরে কোথাও।

বহুদিন আগের অসম্পূর্ন এক যাত্রায় গিয়েছিল। সুদূর তিব্বতে। সাম্ভালা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। এবারের যাত্রা হবে সাম্ভালার উদ্দেশ্যে। হোটেল রুমে যাওয়া হয়নি এর মধ্যে। সেখানে সুটকেস দুটো আছে। সুটকেস দুটো নিয়েই বের হয়ে পড়তে হবে।

জন্ম জানা নেই, মৃত্যু অনিশ্চিত। মানুষ হিসেবে তাকে সংজ্ঞায়িত করাটা হয়তো বোকামি হয়ে যাবে। মানুষের মতোই কিন্তু মানুষ বলা যাবে না। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো যুবকের বুক থেকে। একজন না-মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হবে পৃথিবীর আলো বাতাসে।

ভোরের প্রথম আলো এসে পড়ছে চোখে মুখে তার। অনেক কাল পর নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে। পৃথিবী, সংসার, রক্তের সম্পর্ক, সব কিছু থেকে। সুন্দর এই পৃথিবীতে আরো অনেককাল বেঁচে থাকার কথা তার। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বদলে গেছে সবকিছু। তার নিজের ভেতরেও ঘটেছে অনেক পরিবর্তন। কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা মন থেকে একেবারে চলে যায়নি এখনো। নিজের রক্তের এক ধারা রেখে যাচ্ছেন এই শহরে। তাকে দেখে বুকটা ভরে গেছে তার, সাহসী, সৎ এবং বিবেকবান একজন মানুষ হয়ে উঠবে রাশেদ।

লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটছে যুবক। শহর জেগে উঠেছে। যানবাহন, মানুষের ভীড় বাড়ছে। এই ভীড়ের মাঝেই একেবারে হারিয়ে গেল সহস্রাব্দ প্রাচীন এক পথিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *