অধ্যায় ২১
পথঘাটের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। গত এক বছরে পৃথিবী এগিয়ে গেছে অনেক, তার কল্পনার চেয়েও দ্রুত গতিতে। তারহীন ছোট যন্ত্রের মাধ্যমে এখন নিমেষেই মানুষ পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে কথা বলতে পারে। চলার জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক মোটরযান, প্লেনসহ অনেক কিছু। এখন পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো অনেক সহজ।
তবু আগের সেই ভ্রমনগুলো ছিল অসাধারন। তার সাথে কোন কিছুরই তুলনা চলে না। এক দেশ থেকে আরেকদেশে যাওয়া, পথে নানা ধ্বনের বিপদের সম্মুখীন হওয়া, নানা ধরনের অ্যাডভেঞ্চার থেকে মানুষ এখন বঞ্চিত হচ্ছে। শেষবার তিব্বতে যাওয়ার পথটা ছিল বন্ধুর। সঙ্গি রামপ্রসাদকে সঙ্গে নিয়ে কতো পথ পাড়ি দিয়ে সেই রহস্যের দেশে গিয়েছিলেন তার হিসেব নেই।
তিব্বত সম্পর্কে নানা ধরনের বই-পুস্তক জোগাড় করেছেন ইতিমধ্যে। সেগুলো পড়ছেন, বদলে যাওয়া পৃথিবীতে কোথায় কি হচ্ছে কিংবা হয়েছে তা জানার চেষ্টা করছেন। এককালের স্বাধীন তিব্বত এখন চীনের আয়ত্তে। রীতিমতো পৃথিবী থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে জায়গাটাকে। স্বাধীনতাকামী মানুষ তাদের নেতা দালাইলামার নেতৃত্বে বের হয়ে এসেছে সে দেশ থেকে, এখন ভারতবর্ষ তাদের থাকার ঠিকানা হলেও মন পড়ে থাকে তিব্বতের বুফে ঢাকা পাহাড় চূড়ায়।
শহরটা পাঁচ হাজার ফুট উপরে, নাম মাইরাং, মেঘালয়ের ছোট শহর। এখানেই একটা হোটেলে আছেন তিনি গত কয়েকদিন ধরে। হোটেলটা একটা পাহাড়ের উপর। জানালা খুললেই দূরে বড় বড় পাহাত্রে চূড়া চোখে পড়ে। এই রাজ্যের রাজধানী শিলং থেকে মাইরাংয়ের দূরত্ব পয়তাল্লিশ কিলোমিটার। বৃষ্টি প্রধান এলাকা, যদিও চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টির হার সবচেয়ে বেশি। গত কয়েকদিন হোটেল রুমে বসে এসব নিয়েই পড়াশোনা করছেন তিনি। হোটেলে উঠার রেজিস্টারে নিজের নাম লিখিয়েছেন লখানিয়া সিং। এই নামই এখন তার পরিচয়।
বিকেলে হাঁটতে বের হবেন বলে ঠিক করেছিলেন। পাহাড়ি এলাকা, খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশের এই জনপদ অনেক সুন্দর, চারপাশে লোকজনের ছড়াছড়ি। বেশিরভাগ লোকজনের থ্যাবড়া নাক, ছোট চোখ। বোঝাই যায় এরা এখানকার স্থানীয় খাসিয়া। অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা লোকজনও আছে বেশ। টুরিস্টের সংখ্যাও যথেষ্ট।
বের হতে গিয়েও থেমে গেলেন। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রুমে টিভি ছেড়ে দিলেন। কিভাবে রিমোট চালাতে হয় জানেন না, তবু এখানে সেখানে টিপতে লাগলেন। পরিচিত একটা জায়গা দেখে স্থির হয়ে গেলেন হঠাৎ করে। ঠিক যেমন দেখেছিলেন তেমনটা নয়, তবে অনেক কাছাকাছি। অনেক অনেক আগের স্মৃতি মনে পড়ে গেল।
সময়টা খৃস্টপূর্ব ৩৯৯।
গ্রীষ্মের দুপুরে এথেন্সের পথে হাঁটতে গিয়ে দ্রুত বোধ করছে যুবক হেকাক্লিস। সব যেন চুপচাপ, অতিমাত্রায় শান্ত। কোথাও মানুষজনের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। গতকিছুদিনের ঘটনায় এমনিতেই এথেন্সবাসীর মন ভালো নেই। স্পার্টার সাথে পেলোপনেশীয় যুদ্ধে পরাজয়ের কারনে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সব দিক থেকেই চাপের মধ্যে আছে তারা। এর সাথে তাদের সবার প্রিয় এবং অপ্রিয় ব্যক্তিটি এভাবে হঠাৎ চলে যাবে এ কথা তারা চিন্তাও করতে পারেনি। ঝড় থেমে যাওয়ার পর চারপাশ এখননীরব, নিপ।
নিজেকে জানো বলেছিলেন তিনি, সদা হাস্যময়, কঠিন পরিস্থিতিতেও ব্যঙ্গ করতে যার একটুও বাঁধে না সেই ব্যক্তিটি এখন আর নেই। পুরো জীবনটা সাদাসিদেভাবে কাটিয়ে শেষ পুরস্কারটা পেলেন মৃত্যু। তার মৃত্যুতে এখন পুরো শহর শোকাহত। এই শোক খুব সহজে কাটবার নয়, এমনকি হাজার বছর পার হলেও।
হাঁটতে হাঁটতে শহরের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে হেকাক্লিস। ডেলফির মন্দিরও আজ খালি। পুরোহিত আর কিছু শিষ্য বসে আছে। চোখ বন্ধ করে কোন কিছু পড়ছেন পুরোহিত। মন দিয়ে জছে শিষ্যরা। এদের অধিকাংশকেই চেনে হেকাক্লিস। সক্রেটিসের সামনে এরা মনোযোগী শ্রোতার মত বসে থাকতো, প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে জ্ঞান আহরনের চেষ্টা ছিল সবার মধ্যে। সে নিজেও এই দলের একজন অংশ। আজ তিনি নেই, তার শিক্ষা আছে। তার তৈরি করা ছাত্র আছে যারা তার জ্ঞানকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেল হেকাক্লিস। লক্ষন ভালো নয়। পিথিয়াদের কেউ থাকলে জেনে নেয়া যেতো। অবশ্য তার ক্ষেত্রে পিথিয়ারা আজ পর্যন্ত কোন মন্তব্য বা ভবিষ্যতবানী করেনি। তার চোখের দিকে তাকিয়েই ওরা বুঝে যায় সীমাহীনকে নিয়ে ভবিষ্যতবানী করার ক্ষমতা তাদের নেই।
পুরোহিত সোলনিয়াস কথা বন্ধ করে তাকিয়ে আছে হেকাক্লিসের দিকে। কিছু একটা জিজ্ঞেসকরতে চায়, হেঁটে সামনে গিয়ে দাঁড়াল হেকাক্লিন্স।
‘আমাদের এখনকরনীয় কি জনাব সোনিয়াস?’ প্রশ্ন করল সে।
‘অপেক্ষা, সময় সব ক্ষত পূরন করে দেয়,’ বিমর্ষ গলায় বললেন পুরোহিত। সামনে বসা শ্রোতারা সবাই চুপ করে বসে আছে, কারো মুখে হাসি নেই। সদাহাস্য কুসতদর্শন এক লোক তাদের শোকে সাগরে ভাসিয়ে চলে গেছে।
‘এই বিচারের প্রতিবাদকবো আমরা?’ বলে উঠলো কেউ একজন।
‘হ্যাঁ, প্রতিবাদ হবেই।আরেকজন বলল।’
‘মেনেস, লাইক আর আনতুসকে ছাড়বোনা।
‘বিচারকদেরও ছাড়বো না।’
উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠছে তরুণ এথেন্সবাসীরা। নিজেদের চোখের সামনে প্রিয় সক্রেটিসের এমন মৃত্যু তারা কেউ মানতে পারছে না।
‘হেকাক্লিস, আমাদের এখন কি করা উচিত?’ তরুণদের মধ্যে থেকে জিজ্ঞেস করল একজন।
‘সক্রেটিস আমার শিক্ষক ছিলেন, যা শিখেছি সব তার কাছ থেকে, আমরা তার শিক্ষাকে ধরে রাখবো, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবো, আত্মমর্যাদাশীল থাকবো। যেমন তিনি থেকেছিলেন।’
‘কিন্তু যারা তার প্রান নিলো তার কোন বিচার হবে না?’
‘তিনি নিজে শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছিলেন, যতোদূর জানি বিবেকের কাছে তিনি ছিলেন পরিস্কার একজন মানুষ। তার শাস্তির রায় যারা দিয়েছিলেন তাদের একজন আজ আত্মহত্যা করেছেন।’
‘আমরা প্রতিশোধ চাই?’
‘তিনি প্রতিশোধকামী ছিলেন না, তিনি ছিলেন শিক্ষক, জ্ঞানের পূজারি। এই দেশ আজ তাকে সম্মান দিতে পারেনি,একদিন সেই অভাব বুঝবে।‘
‘জনাব হেকাক্লিস, আপনি আসুন,’ তরুণদের মধ্যে কেউ একজন বলল।
হেকাক্লিস বুঝতে পারছে তার কথা ভালো লাগছে না রক্ত গরম এই সব তরুণদের কাছে।
‘আমি আসি,’ পুরোহিত সোলনিয়াসের উদ্দেশ্যে বলে বেরিয়ে এলো হেকাক্লিস।
চাইলে প্লেটোর কাছে যাওয়া যায়। সক্রেটিসের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য। কোন কিছু লেখালেখি করতে পছন্দ করতেন না সক্রেটিস, তাঁর বেশিরভাগ কথা লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব নিয়েছিল প্লেটো। এমনকি মৃত্যুর আগে বিচারকদের সামনে বলা কথাগুলো সক্রেটিসের জবানবন্দি হিসেবে লিখে রেখেছিল প্লেটো। গত কিছুদিন ধরে অবশ্য কারো সাথে দেখা করছে না প্লেটো, নিজেকে ঘরে বন্দি করে রেখেছে। প্রিয় শিক্ষকের এভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না।
দুপুরের রোদে হাঁটতে খারাপ লাগছে না হেকাক্লিসের। কিছুটা উদ্বিগ্নবোধ করছে ডেলফির মন্দিরে তরুণদের কথাবার্তা শুনে। সবাই উত্তেজিত অবস্থায় আছে। সরকার নিজের সমালোচনার কণ্ঠ রোধ করতে একজনের মৃত্যু কার্যকর করেছে। প্রয়োজনে আরো রক্ত ঝরাতে দ্বিধা করবে না এই সরকার। এক্ষেত্রে তার কিছু না কিছু করনীয় আছে। এমনিতেই এথেন্সের অবস্থা এখন টালমাটাল, এর মধ্যে সক্রেটিসের মৃত্যু যেন ঘিয়ে আগুন ঢেলে দিয়েছে।
ঘোড়ার গাড়ি যাচ্ছে পাশ দিয়ে। দেখেই চিনতে পারল হেকাক্লিস। মেনেতুসের গাড়ি। সরকারের একজন প্রভাবশালী কর্তা। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের মধ্যে একজন ছিল এই মেনেতৃস। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, তীক্ষ্ম চোখ আর খাড়া নাক চেহারায় অনেকটা বাজপাখির সাদৃশ্য এনে দিয়েছে। সাথে দেহরক্ষি আছে দুজন, সরকার থেকেই সম্ভবত দেয়া হয়েছে। তারমানে সরকার গন্ডগোলের আশংকা করছে।
পা চালাল হেকাক্লিস। প্লেটোর কাছে যেতে হবে। এখন একমাত্র প্লেটোই পারে সক্রেটিসের আদর্শকে সামনে নিয়ে যেতে। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই সক্রেটিসের ব্যতিক্রম প্লেটো, তবে আইনকে নিজের পথে চলতে দিতে তাদের কারোই আপত্তি নেই। সাধারন জনগন এবং তরুণ সম্প্রদায়কে শান্ত করতে হবে। শহরে কোন রকম অরাজকতা হতে দেয়া যাবে না। স্বয়ং সক্রেটিস কখনো ধ্বংসাত্মক পথে অগ্রসর হননি,তিনি নিশ্চয়ই চাইতেন না তাঁর অনুসারীরা ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠুক।
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততোক্ষণে। চারপাশ থেকে লোক আসতে শুরু করেছে। রাস্তায়। সবার লক্ষ্য মেনেতুসের দিকে। আজ মেনেহুসকে বাঁচানোর মতো কেউ নেই।
দৌড়ে মেনেতুসের ঘোড়ার গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল হেকাক্লিস।
‘জনাব মেনেতুস, এক্ষুনি চলে যান এখান থেকে,’ হেকাক্লিস বলল।
‘তার আগে বলো তুমি কে? তোমাকে তো কখনো দেখিনি এথেন্সে,’ রাগী গলায় বলল মেনেতুস। গদিতে আরো আরাম করে বসেছে।
‘অধমের নাম হেকাক্লিস।’
‘স্পার্টান নাকি?’
‘না, আমার পরিচয়…’ আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না হেকাক্লিস। কোথা থেকে চার-পাঁচজন লোক টেনে হিঁচড়ে মেনেতুসকে নামিয়ে আনলো ঘোড়ার গাড়ি থেকে। দেহ রক্ষি দুজন তাকিয়ে আছে, বুঝতে পারছে এখন সাহায্য করতে গেলে তাদের জীবনও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
মেনেতুসের চারপাশে এখন কমপক্ষে পঞ্চাশ জন লোক জমে গেছে। সবার মুখে প্রচন্ড ঘৃনা দেখতে পেল হেকাক্লিস। এরা আজ কোনমতেই ছাড়বে না মেনেহুসকে। অযথা রক্তপাত পছন্দ করে না হেকাক্লিস, কিন্তু এদের থামানোর পথও জানা নেই তার।
এরচেয়ে এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়া ভালো। স্পার্টায় যাওয়া যায়, কিংবা পারস্যের দিকে। আশি বছর আগে স্পার্টার সম্রাট লিওনাইডেস মাত্র তিনশ সৈনিক নিয়ে দেশ রক্ষা করতে বের হয়েছিল, যোদ্ধাদের সেই নগর-রাস্ট্র এখন অনেক পরিণত, বিশেষ করে রাজনৈতিক এবং সামাজিক মাপকাঠিতে এথেন্সের তুলনায় অনেক এগিয়ে গেছে।
পেছনে মারামারি শুরু হয়ে গেছে। কয়েকজন ইতিমধ্যে মেনেতুসের উপর চড়াও হয়েছে। সরকারি কিছু লোকও চলে এসেছে মেনেতুসকে রক্ষা করার জন্য। এই সময় এখানে থাকাটা নিরাপদ না, ইতিহাসে চমকপ্রদ সব ঘটনার স্বাক্ষ্য হতে তার ভালো লাগে, আজকের এই মারামারি তার পছন্দ না, সক্রেটিসেরও নিশ্চয়ই পছন্দ হতো না এইসব মারামারি। লোকটা জ্ঞানের খেলা খেলত, মানুষের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করতো, উত্তরের আকাংখা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতো। সেই লোকটাই এখন নেই। মানবসম্প্রদায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের সান্নিধ্যের লোভেই এই এথেন্স নগরীতে তার আগমন, সেই মানুষই যখন নেই তখন এখানে থাকাটা বৃথা।
ধীর পায়ে হেঁটে চলল হেকাক্লিস। অন্য কোথাও যেতে হবে, দূরে কোথাও। টিভি বন্ধ করে দিলেন তিনি। ডেলফির মন্দিরটা দেখে অনেক পুরানো কথা মনে পড়ে গেল। মন্দিরটা একটা ধ্বংসস্তূপ এখন। অথচ একসময় ভবিষ্যতবানী পাওয়ার আশায় দূর দুরান্ত থেকে প্রতিদিন অনেক লোকের আগমন হতো। স্বয়ং আলেকজান্দার দ্য গ্রেট এখানে এসেছিলেন ভবিষ্যত জানার আশায়। পিথিয়া তখন বলতে চায়নি। আলেকজান্দারের হুমকিতে ভবিষ্যতবানী করতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন সুন্দরি পিথিয়া, তবে ভবিষ্যতবানীটি মোটেই চমৎকার কিছু ছিল না। দূর দেশে আলেকজান্দার অল্প বয়সেই মারা যাবে এটাই ছিল পিথিয়ার ভবিষ্যতবানী। আলেকজান্দার ক্রোধান্বিত হয়েছিলেন, কিন্তু এপেলোর মন্দিরে একজন পিথিয়াকে শাস্তি দেয়া সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। পরবর্তীতে পিথিয়ার ভবিষ্যতবানী সত্যি হয়েছিল। আজ সে স্থান ধ্বংসস্তূপ। এথেন্স ছিল দার্শনিকদের সূতিকাগার। মানব ইতিহাসে সক্রেটিসের পর প্লেটো আর এরিস্টেটলের দর্শনে পশ্চিমা বিশ্ব সমৃদ্ধ হয়েছে। তবে সক্রেটিসের করুন মৃত্যু প্লেটোর জীবনে দারুন এক ছাপ রেখে গিয়েছিল এটা তিনি জানেন।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা। একটা রেইনকোট কেনা দরকার। মেঘালয়ের এই শহরে প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। তাই বেশিরভাগ সময় হোটেলে বন্দি অবস্থায় সময় কাটাতে হচ্ছে। তবে আর কয়েকদিন। এখানে সময় ফুরিয়ে এসেছে তার।
*
অধ্যায় ২২
রাত দশটার দিকে বাসায় ফিরলো রাশেদ। সারা সন্ধ্যা বাইরে হেঁটে ক্লান্ত। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে চিন্তা করছিল কি করা যায়। কাজে নেমে পড়তে হবে। প্রফেসর আরেফিনের সাথে যোগাযোগ করে তার মতামত জানতে হবে। তিনি নিশ্চয়ই এসব ব্যাপারে কিছু না কিছু জানেন। গত বছরের ঘটনার পর আর তেমন যোগাযোগ থাকেনি প্রফেসরের সাথে। সরকারি চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছেন প্রফেসর এটুকু শুধু জানা আছে। সেবার প্রফেসরের সাহায্য না পেলে কি যে হতো কে জানে।
দরজা নক করতে সবুজ খুলে দিল। টি-শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরনে, মুখে এলোমেলো দাঁড়ি। বয়স কম হলেও বেশ ভারিক্কি ভাব চেহারাটায়। সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে থাকে, একাডেমিক বইয়ের বাইরে সাধারন বই পড়াতেও বেশ আগ্রহ ছেলেটার। এখন যেমন পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছে।
‘কি রে সবুজ, রাতের খাওয়া দাওয়া হয়েছে?’ ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল রাশেদ।
‘কখন। তোমাদের জন্য বসে থাকবো নাকি? তোমরা কখন না কখন আসো!’
‘কেন, রাজু আসে নি?’
‘না, রাজু ভাইয়া তো আসেনি।‘
ভেতরে ঢুকে কাপড়-চোপড় বদলালো রাশেদ। নিজের বিছানায় বসে কিছুক্ষন ভাবলো। রাজুর এতোক্ষনে চলে আসার কথা। অন্তত একটা ফোন তো করবে!
‘সবুজ, এদিকে আয়,’ ডাকল রাশেদ।
পড়ার টেবিল ছেড়ে বাধ্য ছেলের মতো এগিয়ে এলো সবুজ।
‘তুই বাসায় এসেছিস কখন?’
‘সাড়ে সাতটার দিকে, টিউশনি শেষ করেই চলে এসেছি,’ সবুজ বলল।
‘আচ্ছা, তুই যা,’ বলল রাশেদ। মোবাইল ফোনটা হাতে নিলো। ডায়াল করল রাজুর নাম্বারে।
মোবাইল বন্ধ। পরপর তিনবার চেষ্টা করল রাশেদ। ফলাফল একই। তাকে না জানিয়ে বাইরে থাকে না রাজু। আর সেরকম কোন জায়গাও নেই রাজুর থাকার মতো। দশটার উপর বাজে, এই সময় রাজুর না ফেরা, মোবাইল ফোন বন্ধ থাকা কোন ভালো লক্ষন নয়।
রাজুর আরো দু’একজন বন্ধু আছে, তাদের নাম্বারে ডায়াল করল রাশেদ। কেউ কিছু জানে না, দেখা কিংবা কথা হয়নি রাজুর সাথে কারো। তাহলে রাজু গেল কোথায়?
‘ভাইয়া, খাবার টেবিলে বাড়া আছে,’ সবুজ এসে দাঁড়িয়েছে সামনে, টের পায়নি রাশেদ।
‘ফ্রিজে রেখে দে, আমি খাবো না।‘
‘আচ্ছা,’ বলে চলে গেল সবুজ। ডাইনিং রুমে টেবিলে প্লেট নাড়াচাড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল রাশেদ।
আরো কয়েকবার রাজুর মোবাইলে ডায়াল করল। একই অবস্থা। ফোনটা বিছানার এক কোনায় ছুঁড়ে মারল রাশেদ। বিরক্ত লাগছে। এই ধরনের টেনশন ভালো লাগে না তার। এর আগেও শামীমকে নিয়ে এই ধরনের টেনশনে পড়তে হয়েছিল। ফলাফল ছিল খুবই খারাপ।
ঘন্টা খানেক বিছানায় এপাশ-ওপাশ করলো রাশেদ। ড. আরেফিনের সাথে কথা বলা দরকার। পার্চমেন্টের নক্সাটা এখন তার কাছে আছে, জিনিসটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিল না সে। যদিও এখন মনে হচ্ছে যথেই গুরুত্ব দেয়া উচিত। ভদ্রলোকের মোবইলে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে বন্ধ পাওয়া গেল। তাই টেলিফোন নাম্বার ডায়াল করলো রাশেদ।
‘হ্যালো, আমি রাশেদ বলছি, ড. আরেফিনকে চাচ্ছি,’ রাশেদ বলল।
‘উনি তো দেশের বাইরে গেছেন,’ ওপাশ থেকে মহিলার কণ্ঠ শোনা গেল।
‘কবে আসবেন?’
‘তিনমাসের জন্য গেছেন, ইন্ডিয়ায়।’
‘আচ্ছা, কোন নাম্বার আছে, যোগাযোগের জন্য?’
ভদ্রমহিলা একটা ই-মেইল আই ডি বলল রাশেদকে, যোগাযোগের এটাই একমাত্র পথ, কারন ড. আরেফিন কাউকে তাঁর ইন্ডিয়ার মোবাইল নাম্বার দিতে বারন করেছেন।
ফোন রেখে দিল রাশেদ। ড. আরেফিন ঢাকায় নেই এটা একটা বড় দুঃসংবাদ। তার কাছে। বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল রাশেদ। পায়চারি করছে। মাথায় একরাশ দুঃচিন্তা রাজুকে নিয়ে। লরেন্স ডি ক্রুজ হয়তো তাদের মিথ্যে বলেনি,এই পার্চমেন্টে সত্যিই হয়তো গুপ্তধনের ঠিকানা বলা আছে। রাজু হয়তো এখন বিপদে পড়েছে। এমনিতেই ক্লান্ত, পায়চারি করতে করতে ঘুম এসে যাচ্ছে তার। বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে ডুবে গেল কিছুক্ষনের মধ্যেই।
রাশেদের ঘুম ভাঙল সকাল সাতটায়। পুরো ফ্ল্যাটে শুনশান নিরবতা। সবুজ পাশের রুমে ঘুমাচ্ছে নিশ্চয়ই। উল্টোদিকে রাজুর খাটের দিকে তাকাল রাশেদ। খালি বিছানা, গতরাতে কেউ ঘুমায়নি বোঝা যাচ্ছে। এরকম কখনো হয়নি,অন্তত ফোন করে জানায় রাজু। অজানা এক আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো রাশেদের।
বিছানা ছেড়ে ব্রাশ করে নিলো রাশেদ। নাস্তা বাইরে গিয়ে করলেও হবে, বুয়া আসবে একটু পর, কিন্তু পেট চো চো করছে। নীচের হোটেলে খেয়ে নিলেই চলবে। ইউনিভার্সিটির হলে যেতে হবে, মাঝে মাঝে শহিদুল্লাহ হলে থেকেছে রাজু, ওর কোন এক বড় ভাইয়ের সাথে।
দরজা খুলে বাইরে যেতে গিয়ে একটু থমকে দাঁড়াল। পার্চমেন্ট কাগজের বাক্সটা বাসায় রেখে যাওয়া বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। নিজের সাথে রাখতে পারলে সবচেয়ে ভালো। রুমে ঢুকে ছোট একটা বাজে জিনিসটা ভরে নিলো রাশেদ। এবার নিশ্চিন্তে বাইরে যাওয়া যায়।
সকাল হলেও আলোয় ঝলমল করছে চারদিক, মনে হচ্ছে যেন দশটা-এগারোটা বাজে। অনেকদিন এতো সকালে ঘুম থেকে উঠা হয় না। নীচের হোটেলের মালিক রাশেদকে দেখে দাঁত বের করে একটা হাসি দিল।
‘ভাইজান, নাস্তা করবেন নি?’
‘হ্যাঁ, পরোটা, ডিম আর চা দিতে বলল,’ বলল রাশেদ, কোনার দিকের একটা টেবিলে গিয়ে বসে পড়ল। এখান থেকে বাইরের রাস্তাটা পরিস্কার দেখা যায়। এই সকালেও ঢাকা অনেক ব্যস্ত। লোকজন হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠছে, নামছে। কর্মস্থলে যাওয়ার তাড়া ভীষন। ঠিক এই কারনেই চাকরি করতে ইচ্ছে করে না তার, নিয়ম মেনে কাজ করতে হবে ভাবতেই ভালো লাগে না, নিজের স্বাধীনতায় অন্য কারো হস্তক্ষেপ ভালো লাগে না। কিন্তু একটা কিছু তো করতে হবে, সারা জীবন বাপের উপর ভর দিয়ে থাকা ঠিক হবে না। ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ, বন্ধুবান্ধবেরা অনেকেই বেসরকারি চাকরিতে ঢুকে যাচ্ছে, কেউ কেউ বিসিএস-এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। দু’একজন বিয়ে করেছে। একমাত্র সেই পড়ে রয়েছে পেছনে। জীবনে তেমন কোন উচ্চাশা নেই তার। সব কেমন যেন খাপছাড়া হয়ে গেছে শামীমের মৃত্যুর পর থেকে।
গরম পরোটা আর ডিম ভাজা চলে এসেছে। অনেক দিন হোটেলে সকালের নাস্তা করা হয় না, তাই ভালোই লাগছে খেতে। নাস্তা করতে করতে রাস্তার দিকে চোখে চলে গেল রাশেদের। চার-পাঁচজন মানুষের ছোট একটা দল দেখা যাচ্ছে, ছোটখাট গড়নের, টাইট জিন্স পরনে, চেহারায় মারদাঙ্গা একটা ছাপ আছে। হোটেলের সামনে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছে লোকগুলো। কথা বলছে না নিজেদের মধ্যে, তবে ইশারা করছে। একজন আরেকজনকে বুঝতে পারল রাশেদ। যে বিল্ডিং-এ থাকে সে থাকে সেটার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে লোকগুলো। উদ্দেশ্য খুব সুবিধার মনে হচ্ছে না। ওদের সাথে অস্ত্র থাকা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু না। নিজেকে একটু আড়ালে সরিয়ে নিলো রাশেদ। সাথে থাকা মোবাইল ফোনটা তুলে সবুজকে ডায়াল করলো। রিং হচ্ছে, ধরছে না। ঘুমাচ্ছে বোধহয়। আরো একবার কল করলো, এবার ফোন ধরল সবুজ।
‘সবুজ, তাড়াতাড়ি নীচে আয়,’ যথাসম্ভব গলা নামিয়ে বলল রাশেদ।
‘রাশেদ ভাই, নীচে কেন?’ ঘুমজড়িত গলায় বলছে সবুজ।
ধমক দিতে গিয়ে থেমে গেল রাশেদ। ঘুমের ঘোরে হয়তো বুঝতে পারবে না।
‘এক্ষুনি উঠে পড়, শার্টটা পড়ে নীচে হোটেলে চলে আয়।’
‘ভাইয়া, কোন সমস্যা?’
‘যা বলছি, কর, নইলে বিপদে পড়বি।’
‘ঠিক আছে, আসছি।’
লাইন কেটে গেল। চুপচাপ বসে অপেক্ষা করছে রাশেদ। নাস্তা এখন গলা দিয়ে নামবে না। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। দৃষ্টি বিল্ডিংটার দিকে। ছয়তলার বা দিকের ফ্ল্যাটটায় থাকে ওরা। লোকগুলো ঢুকে গেছে ভেতরে। বাড়িটায় কোন গার্ড নেই। একজন সুপারভাইজার থাকে সে আসে এগারোটার দিকে। সবুজ এখনো নীচে নামেনি। উত্তেজনায় চায়ের কাপে চুমুক দিতে ভুলে গেছে রাশেদ। বান্দরবানে হোটেল রুমে হামলা করেছিল তারাই হয়তো এদের পাঠিয়েছে। ওরা এসেছে রাশেদের কাছ থেকে পার্চমেন্টের বাক্সটা উদ্ধার করে নিয়ে যেতে। রাজুর না ফেরার পেছনেও হয়তো এদেরই হাত আছে। পুরো ব্যাপারটা নিছক কল্পনাও হতে পারে। তবে খারাপ ব্যাপারগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে সত্যে পরিণত হয়।
সবুজকে আসতে দেখা যাচ্ছে। লুঙ্গি আর শার্ট পরনে, ঐ লোকগুলোকে পাশ কাটিয়ে গেট দিয়ে বের হয়ে এসেছে মাত্র। রাশেদকে না পেয়ে সবুজকে পেলে ওরা নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা বলতো না। কিন্তু এখানকার ঠিকানা ওরা পেল কি করে? রাজুকে নিয়ে ভয়টা তাহলে অমূলক নয়। নিশ্চয়ই ওদের হাতে ধরা পড়েছে রাজু, ওর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছে লোকগুলো।
হোটেলের সামনে আসতেই সবুজকে চুপচাপ থাকতে ইশারা করল রাশেদ।
‘ভাইয়া, ঘটনা কি? ঐ লোকগুলো কারা? কেমন ভালো মনে হচ্ছে না,’ চুপচাপ রাশেদের পাশে বসে বলল সবুজ।
‘আমারও তাই ধারনা।‘
‘আপনারা কোন ঝামেলায় জড়িয়েছেন? কাল রাতে রাজু ভাই ফিরলো না, এখন অচেনা কতোগুলো লোক আমাদের ফ্ল্যাটে যাচ্ছে।‘
‘নাও তো যেতে পারে,’ রাশেদ বলল।
‘আপনি নিশ্চিত না হলে আমাকে ডেকে পাঠাতেন না,’ সবুজ বলল, ওয়েটারকে ইশারায় চা দিতে বলল।
‘ওরা বের হয়ে গেলে তুই ঢুকে যাস, তোর চিন্তার কিছু নেই, তবে আমাকে সরে যেতে হবে।‘
‘কোথায় যাবেন?’
‘জানি না, তবে এখনই যাওয়া দরকার। তুই রাজুর কোন খবর পেলে আমাকে জানাবি।’
‘ঠিক আছে,’ বলল সবুজ।
বিল দিয়ে বেরিয়ে আসল রাশেদ। চড়া রোদ উঠে গেছে। সাথে কাঠের ছোট বাক্সটা ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু এখানে আর থাকা যাবে না। ওরা নিশ্চয়ই নজর রাখবে। পালাতে হবে এখান থেকে, রাজুর খোঁজ নিতে হবে। সেই সাথে লরেন্স ডি ক্রুজেরও। লোকটা বেঁচে আছে না মরে গেছে কে জানে।
হাঁটতে যাবে হঠাৎ কি মনে করে পেছনে ফিরে তাকাল রাশেদ। লোকগুলো ফিরে এসেছে এর মধ্যে। সে তাকানো মাত্র একজনের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল, সেই লোকটা যাকে রাজু অজ্ঞান করে দিয়ে এসেছিল বান্দরবানের হোটেলে। লোকটাও তাকে চিনতে পেরেছে সাথে সাথে।
‘ধর ওকে,’ সঙ্গিসাথিদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলল লোকটা।
আর দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। দৌড় দিল রাশেদ। সামনে ঝড়ের বেগে একটা লোকাল বাস যাচ্ছে। একবার বাসের পাদানিতে পা দিতে পারলে আর ধরতে পারবে না ওরা। একহাতে দরজার কাছের একটা হাতলে ধরে পা বাড়িয়ে দিল রাশেদ। ভেতর থেকে কেউ একজন টান দিয়ে ঢুকিয়ে নিল তাকে।
‘কি ভাইজান, মরার কি খুব শখ নাকি?’ কন্ডাক্টর লোকটা বলল।
উত্তর দিলো না রাশেদ। বলার কিছু নেই। বাসের সব যাত্রী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কয়েকজন বেশ বিরক্তও। লোকজন ঠেলে মাঝখানের দিকে চলে গেল রাশেদ। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। চার-পাঁচজনের দলটা তাকিয়ে আছে তার দিকে। চেহারায় রাগ আর হতাশী। একপাশে কালো একটা মাইক্রোবাস দাঁড়ানো দেখা যাচ্ছে। সেটার দিকে যাচ্ছে এখন ওরা। হয়তো বাসটাকে ফলো করবে। ছাড় পাওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীন। মাথা খাঁটিয়ে কাজ করতে হবে। ওদের হাতে ধরা পড়া চলবে না। বাসের সামনের কাঁচে ফার্মগেট লেখা আছে, ওখানেই নামতে হবে। তারপর যা হবার হোক।
*
অধ্যায় ২৩
ভোরে রওনা দিয়েছে দলটা। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। বাইরে দাঁড়ানো দুটি পিক আপ জাতীয় গাড়ি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। সাথে সাথে রওনা দিয়েছে দলটা। ঘড়িতে তখন কাটায় কাটায় ছয়টা।
রাতে ভালো ঘুম হয়নি ড. আরেফিনের। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটিয়েছেন। একধরনের উত্তেজনা কাজ করছে মনে। সামনে ভয়াবহ ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হবে মনে হচ্ছে। পেছনে এরমধ্যেই লোক লেগে গেছে। আসলে এই ধরনের অভিযানগুলো গোপনে করা অনেকক্ষেত্রেই দুরূহ হয়ে পড়ে। হয়তো ড. কারসনের উপর অনেকদিন ধরেই কেউ নজর রাখছিল। ভারতে আসার উদ্দেশ্য জানতে চেয়েছিল। গতরাতে প্রফেসরের রুম থেকে ল্যাপটপ চুরি করে এখন তাদের যাত্রার উদ্দেশ্য জানতে বাকি নেই অনুসরনকারির। হয়তো আজ সকালেও তাদের পেছন পেছন আসছে লোকটা।
নিজের একজন সহকারি আগেই যোগাড় করে রেখেছিলেন ড. কারসন। আজ ভোরেই লোকটা হাজির হয়েছে পিক-আপগুলো নিয়ে। পর্যটকদের সাথে গাইডের কাজ করে লোকটা, ঝুনঝুনওয়ালা টুরস এন্ড ট্রাভেলস, ওর কোম্পানীর নাম। দারুন চালু মানুষ, চোখে-মুখে কথা বলে। সপ্রতিভ। প্রথম দেখায় খারাপ লাগেনি লোকটাকে। বয়স চল্লিশের নীচেই হবে। মহারাষ্ট্রের লোক। প্রফেসর আর সন্দীপকে এক গাড়িতে দেয়া হয়েছে, সাথে প্রফেসরের সহকারি রামহরিও আছে। অন্য গাড়িটাতে ড. কারসনের সাথে আছেন তিনি আর ড. কারসনের গাইড বা ব্যবস্থাপক সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা। অদ্ভুত নাম, আগে কখনো শোনেননি ড. আরেফিন। বিচিত্র দেশ, লোকজনের নাম বিচিত্র তো হবেই।
ভোরে রওনা দেয়াতে নাস্তা করা হয়নি কারো। তাই পথের মাঝে কোথাও থেমে নাস্তা করে নেবেন বলে ঠিক করেছেন ড. কারসনের সাথে কথা বলে। গাড়ি দুটো একটানা চলেছে সাড়ে দুইঘন্টার মতো। নয়টার মতো বাজে এখন। ড্রাইভারদেরও একটু বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। ড্রাইভার দুজনের একজন নেপালি আরেকজন পাঞ্জাবী। নেপালি ড্রাইভার ভালো ইংরেজি জানে, রাস্তাঘাটও চেনে। দুজনেই সুরেশের পরিচিত।
ড. কারসনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন ড. আরেফিন। ভদ্রলোকের চোখে এখনো ঘুম লেগে আছে। বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে বেচারাকে।
‘ক্লান্ত লাগছে?’
‘না। আসলে রাতে ভালো ঘুম হয়নি,’ হেসে উত্তর দিলেন ড. কারসন।
‘এরপর নাস্তা সেরে নেবো আমরা, এরপরের স্টপেজে,’ ঝুনঝুনওয়ালা বলল। সে সামনের সীটে বসেছে। গায়ে চক্রাবক্রা শার্ট, জিন্সের প্যান্ট, মাথায় হ্যাট, চোখে কালো চশমা। দেখতে বেশ দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে হিন্দি গানের সুরে শিস বাজাচ্ছে।
‘রাত আমরা কোথায় কাটাবো, আসলে আমরা যাচ্ছি কোথায়?’ বেশ উত্তেজনা নিয়ে প্রশ্ন করলেন ড. আরেফিন।
ড. কারসন উত্তর দিলেন না। হাসলেন, মৃদু হাসি, যেন ড. আরেফিনের কথায় মজা পেয়েছেন।
‘ড. আরেফিন, অধৈর্য হবেন না, যাত্রা সবে শুরু। শুরুতে আমরা যাবো ধর্মশালায়।‘
‘ধর্মশালা? আচ্ছা। আমাদের জিনিসপত্র কোথায়? খননকাজে তো অনেক কিছু লাগবে।’
‘সব নেয়া হয়েছে। অন্য গাড়িটায়। আপনি চিন্তা করবেন না। এই ধরনের অভিযানে কি কি দরকার পড়তে পারে সব জানা আছে আমার।’
‘আমি জানি চিন্তার কিছু নেই,’ ড. আরেফিন বললেন। তাকালেন জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। সুন্দর দৃশ্য চারদিকে। একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষন আগে।
জায়গাটার নাম সামালখা। ন্যাশনাল হাইওয়ের একপাশে ছোট একটা শহর। দিল্লি থেকে দূরত্ব মাত্র বাহাত্তর কিলোমিটার। রাস্তার পাশে ছোট একটা রেস্টুরেন্ট দেখে গাড়ি থামাতে ইশারা করেছে ঝুনঝুনওয়ালা।
গাড়ি থেকে নেমে চারপাশে তাকালেন ড. আরেফিন। হাইওয়ের পাশে চমৎকার একটা জায়গায় রেস্টুরেন্টটা। সামনে আরো কিছু গাড়ি পার্ক করা। সন্দীপ আর প্রফেসরকে তাদের গাড়ি থেকে নামতে দেখা গেল। দুজনেই গম্ভীর, কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। ছোট মানুষের মতো আচরন, ভাবলেন ড. আরেফিন।
সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালার পেছন পেছন রেস্টুরেন্টে ঢুকল সবাই। শুধু ড্রাইভার দুজন বাইরে রয়ে গেল গাড়িগুলোকে পাহারা দিতে। হাইওয়েতে প্রায়ই গাড়ি চুরি হয়। সাবধানে থাকার জন্য ওদের রেখে আসা হয়েছে। সবার নাস্তা শেষ হলে পরে ওরা। দুজন নাস্তা করবে।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে ভালো লাগল ড. আরেফিনের। ছিমছাম নিরিবিলি পরিবেশ। আরো বেশ কিছু লোকজন আছে, তবে ভেতরটা অন্ধকার বলে কাউকে ঠিকমতো দেখতে পেলেন না। তা না হলে কোনায় বসে থাকা শত্রুধারী তার চোখ এড়াতে পারতো না।
১৭৬০ খৃস্টাব্দ
রাত হচ্ছে ঘুমানোর সময়। কিন্তু এইসব জাহাজে সবার কাজ ভাগ করে দেয়া থাকে। যদিও জাহাজ এখন চলছে না, কিন্তু সার্বক্ষনিক কিছু লোক আছে পাহারায়। ডেকে, জাহাজের পেছনে এবং সামনে। পাখির বাসায়ও একজন আছে। যদিও এদের এখন জেগে থাকার কথা, কিন্তু এরা সবাই ঘুমাচ্ছে। আসলে এই মধ্য রাতে বিপদের আশংকা করছে না কেউ।
মিচনার জেগে আছে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে বাংকারে। ঠিক সময়টার অপেক্ষা করছে। এখানে কোথাও ঘড়ি নেই, সময় আন্দাজ করে নিতে হয়। যখন মনে হলো বারোটা বেজে গেছে বাংকার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মিচনার। নাবিকেরা সবাই ঘুমাচ্ছে, নাক ডাকিয়ে। সারাদিন প্রচন্ড পরিশ্রমের পর এই ঘুমটা ওদের কাছে খুব জরুরি। সাবধানে পা ফেলে উপরে ডেকে চলে এলো মিচনার। ডেকের একপাশে একজন দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারলো জেগে নেই লোকটা।
আকাশে চাঁদ উঠেছে। দিনের আলোর মতো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবকিছু। মাঝখানে মাস্তুলের গোড়ায় বড় বড় তিনটা কাঠের পিপে দেখা যাচ্ছে। মিচনার জানে এগুলোতে কি আছে। বারুদ আর গোলা। হেঁটে সামনের দিকে গেল সে। জাহাজ এখন স্থির হয়ে আছে। ডেক থেকে নীচে পানির দিকে তাকাল। স্থির পানিতে সুন্দর চাঁদটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। পুকুরের মতো শান্ত পানি এখানে।
হেঁটে জাহাজের পেছনের অংশে চলে এলো মিচনার। এখানে কেউ নেই। কোনার দিকে দুটো বড় কাঠের পিপের দিকে চোখ পড়ল। কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। পিপেগুলো। মৃদু হাসি ফুটল মিচনারের মুখে। সাধারনত এভাবে রাখা হয় না বারুদে ভরা পিপে। তাতে বৃষ্টির পানিতে বারুদ ভিজে নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, তার ধারনা আগামী কয়েকদিন অন্তত বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই এই এলাকায়।
দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে আবার হেঁটে সামনে এলো মিচনার। পকেটে দেয়াশলাইটা চুরি করেছিল পাশের বাংকারে শুয়ে থাকা নাবিকের কাছ থেকে। এখন কাজে লাগবে জিনিসটা। ডেকের হোল্ডে আরো বেশি পরিমান বারুদের মজুদ থাকার কথা। হোল্ডে তালা দেয়া। গায়ের জোরে চেষ্টা করলো কয়েকবার মিচনার, খোলার জন্য। কিন্তু খোলা সহজ না, আর যে শব্দ হবে তাতে দাঁড়িয়ে ঘুমানো লোকটা টের পেয়ে যেতে পারে। এরচেয়ে সহজে যে কাজটা করা সম্ভব সেটা করাই ভালো মনে হলো তার কাছে।
ডেকের পাশে দাঁড়াল মিচনার। আজ প্রতিশোধ নিতে হবে। এই জলদস্যুরা নিজেদের অপ্রতিরোধ্য মনে করে। বিনা কারনে ব্ল্যাক ডাহলিয়াকে ধ্বংস করে দিয়েছে এই এল মাতানকা। নিজের পালিয়ে যাওয়ার পথটা দেখে নিলো আরেকবার। ছোট নৌকা যেটায় করে এই জাহাজে এসেছে সেটা তৈরি আছে। শুধু দড়িটা কেটে নীচে নামিয়ে নিলেই হবে। দু’পাশে আরো বেশ কিছু নৌকা আছে, সেগুলোর ব্যবস্থা করা দরকার। ছোট একটা ছুরি দিয়ে বাকি নৌকাগুলোর দড়ি কেটে ধীরে ধীরে নীচে নামিয়ে দিলো মিচনার। বদমাস নাবিকগুলোর পালানোর পথ বন্ধ। যাত্রীবিহীন নৌকাগুলো মৃদু স্রোতে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে জাহাজটা থেকে।
ডেকের সামনে এসে দাঁড়াল মিচনার। পকেট থেকে দেয়াশলাইয়ের প্যাকেটটা বের করলো। সময় এসে গেছে। একটা কাঠি বের করে ধরালো। এবার শুধু জায়গামতো ফেলতে হবে। ডেকের উপর রাখা তিনটা পিপের মাঝখানেরটার উপর জ্বলন্ত কাঠিটা ছুঁড়ে দিল। এবার আরেকটা ধরিয়ে ডেকের হোন্ডের ফাঁক গলিয়ে ঢুকিয়ে দিল। পুরো পৃথিবী কেঁপে উঠলো যেন হঠাৎ। প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়েছে বারুদে ঠাসা পিপে তিনটা। আগুন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। হোল্ডের দিকে তাকিয়ে আছে মিচনার। আসল ধাক্কাটা ওখান থেকেই আসার কথা। দশ সেকেন্ডের বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। এবার বিস্ফোরনের মাত্রাটা হলো দ্বিগুনের বেশি। পুরো জাহাজ কেঁপে উঠেছে। তলা ফেটে গেছে বোঝাই যাচ্ছে। জাহাজের নাবিকেরা উঠে পড়েছে প্রথম বিস্ফোরনের সাথে সাথে। ডেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমানো নাবিক সংবিত ফিরে পেয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। হাতে খোলা তলোয়ার। মিচনারই যে এই বিস্ফোরনের হোতা বুঝতে দেরি হয়নি তার।
কিন্তু দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় নেই মিচনার। একের পর এক বিস্ফোরন কাঁপিয়ে দিচ্ছে পুরো জাহাজটাকে। প্রধান মাস্তুল কড়াত করে ভেঙে পড়েছে দুজন নাবিকের উপর। আর দেরি করা ঠিক হবে না। দৌড়ে নৌকাটায় উঠে দড়ি কেটে দিল। নীচের পানিতে ঝপাৎ করে পড়েছে নৌকাটা। কয়েকজন নাবিক রেলিং ধরে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাস করতে পারছে না বোবা আইরিশটা তাদের জাহাজের ধ্বংসের কারন।
পুরো জাহাজটাই ভেঙে পড়ছে, একটু একটু করে। নাবিকদের আহাজারিতে ক্রমে ভারি হচ্ছে রাতের আকাশ। নৌকার বৈঠা দিয়ে জোরে টানছে মিনার। নাবিকদের কয়েকজন এরমধ্যে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে তার নৌকার দিকে আসার চেষ্টা করছে। দু’একজন ডুবন্ত জাহাজ থেকেই তার উদ্দেশ্যে গুলি ছুঁড়ছে। পাশ দিয়ে কয়েকটা গুলি চলে গেছে। আরেকটু হলেই লাগতে পারতো শরীরে। গায়ের সব শক্তি দিয়ে বৈঠা চালাচ্ছে মিচনার। এই এলাকা পার হতে হবে তাড়াতাড়ি।
নিরাপদ দূরত্বে এসে জাহাজের দিকে তাকাল মিচনার। প্রায় ডুবে গেছে জাহাজটা। উপরের কিছু অংশ এখনো ভেসে আছে। কিছু নাবিক সাঁতার কাটছে। কিছু তলিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যটা ভালো লাগল মিচনারের কাছে। ক্যাপ্টেনের মৃত্যুর বদলা নেয়া হয়েছে। এখন সে স্বাধীন, মুক্ত। পৃথিবীর যে কোন জায়গায় যেতে পারে। কোথাও কোন পিছুটান নেই। আয়ারল্যান্ডের সেই বাড়ি বহুদূর। সেখানে আর কখনোই যাওয়া হবে না তার।
ছয় মাস আগে
‘এতো সুন্দর জিনিস আগে চোখে পড়েনি আমার,’ হেসে বলল বিনোদ চোপড়া। ব্যাব্রাশ করা ঝকঝকে চুল, মুখে অকৃত্রিম হাসি।
‘মাত্রই আমাদের এই মিউজিয়ামে এসেছে, মি. কারসনের উপহার হিসেবে, সহকারি কিউরেটর উত্তর দিল।
‘মি. কারসন, নামটা পরিচিত।’
‘ড. নিকোলাস কারসন, ভদ্রলোক প্রত্নতত্ত্ববিদ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ান।’
‘ঠিকানা দেয়া যাবে?’
‘দুঃখিত। সম্ভব না।’
‘ঠিক আছে,’ কিছুটা বিব্রতবোধ করল বিনোদ চোপড়া। এই মহিলার কাছ থেকে এরকমটাই আশা করেছিল সে। বিস্তারিত জানতে চাই এই জুতোজোড়া সম্পর্কে।
‘দেখুন, নীচেই সব লেখা আছে।’
‘ষোড়শ শতকে তৈরি। কিন্তু এতো চমৎকার হীরে কিভাবে এই জুতোগুলোতে…’
মঁসিয়ে, এখানে যা লেখা আছে এর বেশি কিছু আমি জানি না, কাঠখোট্টা উত্তর দিল মহিলা।
‘ঠিক আছে, আমি আসলে এগুলোর ব্যাপারে খুব আগ্রহি। বিশেষ করে এই জুতোজোড়া পাওয়া গেছে আমাদের এলাকায়, মানে ভারত উপমহাদেশে। সেই সময় এই ধরনের জুতা কিভাবে ওখানে গেল সেটাই ভাবছি।‘
‘ভাববারই বিষয়। অন্যদিকে কিছু কাজ আছে আমার, কিছু মনে করবেন না,’ বলল মহিলা, তারপর চলে গেল গটগট করে।
কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বিনোদ চোপড়া। অ্যান্টিক নিয়ে তার প্রচুর পড়াশোনা। কিন্তু এই ধরনের অ্যান্টিক তার চোখে পড়েনি কখনো। ড. কারসনকে। খুঁজে বের করতে হবে। খুব কঠিন কাজ হবে না সেটা। সে নিজেও একজন সৌখিন প্রত্নতত্ত্ববিদ, যার উদ্ধার করা বেশিরভাগ জিনিসই ইউরোপ-আমেরিকার বিলিয়নেয়ারদের নিজস্ব কালেকশনকে সমৃদ্ধ করেছে। ভারত তার নিজের দেশ হলেও সেখানে তার নামে হুলিয়া আছে, প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু চুরি করার দায়ে। প্যারিসে নিজের স্থায়ী নিবাস করে নিয়েছে, যেখানে ব্যুভর আছে তার আশপাশে থেকে কাজ করা। সুবিধাজনক। ইউরোপীয় অ্যান্টিক শিকারীরা তাকে পছন্দ করে। প্রতিটি জিনিসের সঠিক ইতিহাস তার জানা। ড. কারসনের পেছনে লাগতে হবে। এই ভদ্রলোক নিশ্চয়ই আরো অনেক কিছু জানেন।
লুভর মিউজিয়ামের বাইরে এসে দাঁড়াল বিনোদ চোপড়া। নীচের বেসমেন্টে তার মার্সিডিজটা পার্ক করা। সেদিকে না গিয়ে সরাসরি চার্লস দ্য গল এয়ারপোর্টে চলে গেল। ড. কারসনের সাথে দেখা করতে হবে। গন্তব্য লন্ডন।
*
অধ্যায় ২৪
ফার্মগেটে এসে নেমে পড়ল রাশেদ বাস থেকে। চারদিকে প্রচুর মানুষ। গিজগিজ করছে। জনস্রোতে মিশে যেতে হবে। ঐ লোকগুলো কালো একটা মাইক্রোবাসে করে বাসের পেছন পেছন আসছিল। এখনো হয়তো আশপাশে আছে। মাথা নীচু করছে হাঁটছে রাশেদ। মিরপুরে যাওয়ার পথে লোকজনের সংখ্যা বেশি। প্রায় শদুয়েক লোক বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। ভিড়ের মাঝে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করল রাশেদ। একটা বাসের কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। কিছু চোখে পড়ছে না। এতে লোজন আর গাড়িঘোড়ার মাঝে নির্দিষ্ট কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। কালো মাইক্রোবাসটাকে খুঁজছে তার চোখ জোড়া। ওরা নিশ্চয়ই আশপাশে আছে। আবার এমনও হতে পারে রাশেদ যে বাসে উঠেছিল সেটা ফলো করে চলে গেছে সামনে।
গরমে ঘামছে রাশেদ। এখনো মাত্র সকাল। সারাদিন পড়ে রয়েছে। বাসায় ফিরে যাওয়াটা বিপদজ্জনক হতে পারে। ওরা কাউকে বাসার সামনে নজর রাখতে পাঠাতে পারে, অসম্ভব কিছু না। সবচেয়ে ভয় লাগছে রাজুকে নিয়ে। বেচারা হয়তো ঝামেলায় পরে গেছে। নইলে এতোক্ষনে অন্তত একবার তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতো।
একটার পর একটা বাস আসছে, যাত্রি বোঝাই হয়ে চলে যাচ্ছে। এভাবে কতোক্ষন এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে বুঝতে পারছে না রাশেদ। একটা সিগারেট ধরাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু কাউন্টারের পেছনের নিরাপদ জায়গাটা থেকে সরতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে এই জায়গাটাই নিরাপদ। কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করা লোকটা বারবার তাকাচ্ছে তার দিকে, সন্দেহের দৃষ্টিতে। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে আছে, কোন টিকিটও কেনেনি,ব্যাপারটা সন্দেহ করার মতোই। সন্দেহ বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে একটা টিকিট কিনে ফেলল রাশেদ, মিরপুরের। তারপর এমনভাবে চারদিকে তাকাতে থাকল যেন কোন বন্ধুর এখানে আসার কথা, তারা একসাথে মিরপুরে যাবে।
এই সময় দূরে কালো মাইক্রোবাসটা চোখে পড়ল। রাস্তার উল্টোদিকে, খুব ধীর গতিতে চালাচ্ছে চালক, ভেতরে বসা লোকগুলো চারপাশে তাকিয়ে খুঁজছে কাউকে। পেছনে গাড়ির জ্যাম লেগে গেল ওদের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই যেন। কয়েকটা বাস ক্রমাগত হর্ন চেপে যাচ্ছে।
এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা নিরাপদ মনে করলো না রাশেদ। একটা বাস এসে পড়েছে, টিকিট নিয়ে লাইনে থাকা লোকগুলো ঝাঁপিয়ে উঠার চেষ্টা করছে বাসটাতে। যেন খুব বিরক্ত এমন ভঙ্গিতে বাসের দিকে এগিয়ে গেল রাশেদ। বেশ কিছু লোকের সাথে ঠেলাঠেলি করে উঠে পড়ল বাসে। বসার জায়গা নেই। কোনমতে একপাশে দাঁড়াল রাশেদ। জানালা দিয়ে তার দৃষ্টি বাইরের দিকে। কালো মাইক্রোবাসের লোকগুলো এখনো খুঁজছে তাকে তা আর বলে দিতে হবে না। নিজেকে পাশে দাঁড়ানো লোকজনের মাঝে যথাসম্ভব আড়াল করার চেষ্টা করল।
বাস ছেড়ে দিয়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রাশেদ। আপাতত এই এলাকা ছেড়ে দিতে পারলে বাঁচে। মিরপুরে নেমে পড়ে একটা কিছু করতে হবে। তবে কেন জানি মনে হচ্ছে আপাতত ফ্ল্যাটে ফেরা ঠিক হবে না। থাকার ব্যবস্থা করতে হবে অন্য কোথাও। কিছু মাথায় আসছে না। ঢাকায় কোন আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব নেই। চাইলে হোটেলে উঠা যায়। এ সময় লিলি থাকলে ভালো হতো। এর আগের বার লিলি অনেক সাহায্য করেছিল।
কিছুক্ষন পরই কয়েকজন যাত্রী নেমে যাওয়াতে বসার সিট পেল রাশেদ, জানালার পাশে। বাইরে থেকে চমঙ্কার বাতাস আসছে। ঘুম আসছিল রাশেদের। সিটে হেলান দিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
***
ধর্মশালা এখন ভারতের বুকে ছোটখাট এক তিব্বত। ছোট লাসা বলে ডাকে কেউ কেউ। চৌদ্দতম দালাই লামার স্থায়ী আবাস। হাজারো তিব্বতি সেখানে থাকে। ভারত সরকারের চীন নীতি তিব্বতিদের এখানে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। তিব্বতের সরকার এখান থেকেই পরিচালিত হয়ে আসছে ১৯৬০ সাল থেকে। দালাই লামা এখানে চলে আসেন ১৯৫৯ সালে।
আরো অনেক তথ্য ঘাটাঘাটি করছেন ড. আরেফিন। তাদের প্রত্নতাত্ত্বিক কাজের সাথে ধর্মশালার কোন যোগসূত্র আছে এটা পরিস্কার। কিন্তু সেটা ঠিক কি বুঝতে পারছেন না। একমাত্র ড. কারসন জানেন তিনি কি করতে যাচ্ছেন। সাম্ভালা তিব্বতের একটা মিথ, তাই হয়তো আপাতত ধর্মশালায় যাচ্ছেন ড. কারসন, আরো তথ্য যোগাড়ের জন্য, আপাতত এটাই ব্যাখ্যা হতে পারে।
সামালখা থেকে রওনা দিয়েছেন অনেকক্ষন হলো। দুপুরের আগে আর কোথাও থামার সম্ভাবনা নেই। একটু পরপর পেছনে তাকিয়ে প্রফেসরদের গাড়িটা দেখে নিচ্ছেন ড. আরেফিন। অল্প দূরত্ব বজায় রেখে চলছে পেছনের মাইক্রোবাসটা।
সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা ঘুমাচ্ছে। ড. কারসন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। তাকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে। যেন মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছেন।
ল্যাপটপ খুলে মেইল চেক করছেন ড. আরেফিন। বেশ কিছু মেইল এসেছে দেখা যাচ্ছে। স্ত্রীর মেইলটা খুলে পড়লেন। সব খবর ভালো, কোথাও কোন সমস্যা নেই দেখে স্বস্তি পেলেন। এরমধ্যে রাশেদ একবার যোগাযোগ করেছিল বলে জানিয়েছে তার স্ত্রী। রাশেদ! অনেকদিন পর। এতোদিন পর তার সাথে যোগাযোগ করার কারন কি? অবশ্য এমনি খবরাখবর নেয়ার জন্যও ফোন করতে পারে। রাশেদের কথা মনে পড়তেই গতবছরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে পড়ে গেল। অমরত্বের সন্ধানে তিনি নিজেও কতোটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ভাবতে এখন অদ্ভুত লাগছে। আসলেই কি সেরকম কোন ব্যাপার আছে? এবারও বলা যায় এক মিথের পেছনে ছুটতে এসেছেন তিনি। ফলাফল হয়তো শুন্য, কিন্তু নিজেকে এই ধরনের কাজে ব্যস্ত রাখতে খারাপ লাগে না। ঘরে বসে বসে বই পড়ার চাইতে পৃথিবী দেখে বেড়ানো অনেক ভালো।
‘ড. আরেফিন, ড. কারসন ডাকলেন মৃদু স্বরে।’
‘জি, বলুন।’ ল্যাপটপ বন্ধ করে বললেন ড. আরেফিন।’
‘আমরা ধর্মশালায় কেন যাচ্ছি বলুন তো?’
‘জানি না।’
‘সেখানে একজন শেবারনের সাথে দেখা করবো। তার কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যাবে।’
‘শেবারন?’
‘মন্দিরের পুরোহিত। জানি না কতটুকু সাহায্য করবে।’
‘আমরা অনুরোধ করবো সবাই মিলে।‘
‘না, তা করা যাবে না। আমি একাই যাবো। অনেক মানুষ দেখলে হয়তো কথা বলতে রাজি হবে না।’
‘হুম, তাও হতে পারে।’
‘আপনার কি গতবছরের ঘটনা মনে আছে?’
‘মনে আছে।’
‘আমার ধারনা দুটো ব্যাপার কোন না কোনভাবে একটা আরেকটার সাথে জড়িত।’
‘কিরকম?
‘গতবার এক কালো জাদুকরের পাল্লায় পড়েছিলাম। অমরত্বের খোঁজে হন্যে হয়ে গিয়েছিল লোকটা।
‘হ্যাঁ।’
সেখানে আরো একজনকে দেখতে পেয়েছিলাম আমি। অদ্ভুত একটা মানুষ। দেখতে সুদর্শন, সুঠাম দেহের অধিকারী, কিন্তু নিষ্ঠুর।
‘আপনি যার কথা বলছেন বুঝতে পারছি। সেই লোকটাই আমার বাসায় আক্রমনের নেতৃত্ব দিয়েছিল।’
‘তাকে কি পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল?’
‘হ্যাঁ। এখন হয়তো জেলে আছে।
‘হুম। সেই লোকটাকে আমার বিশেষ কিছু মনে হয়েছে। লোকটা কথা বলতো না, কিংবা বলতে পারতো না। কিন্তু তার চোখ দুটো ছিল অসাধারন। মনে হয় অনেক কিছু দেখেছে ঐ চোখ দুটো দিয়ে।‘
‘হঠাৎ সেই লোকের কথা মনে হওয়ার কারন কি?’
‘জানি না। মনে হলো তাই বললাম।‘
চুপ করে রইলেন ড. আরেফিন।
‘সাম্ভালা আর অমরত্ব, দুটো বিষয় পরস্পর সম্পর্কিত, ড. কারসন বললেন, ‘তাই এই বিষয়ে তথ্য জোগাড় করা একটু কঠিন হবে।’
‘হোক কঠিন। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করবো ড. কারসন।‘
মৃদু হেসে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন ড. কারসন।
‘সুরেশ, এরপর আমরা কোথায় থামবো?’ ড. আরেফিন জিজ্ঞেস করলেন সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালাকে। একটু আগে মনে হচ্ছিল ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এতোক্ষন ড. কারসনের সাথে তার যেসব কথাবার্তা হয়েছে সবই কানপেতে শুনেছে সুরেশ।
‘এরপর পানিপথ, তারপর কাঠিয়াল, আম্বালা, চন্ডিগড়, হোসিয়ারপুর, কাংরা, শেষে ম্যাকলডগঞ্জ।‘
‘তাহলে তো অনেক পথ বাকি।’
‘জি স্যার। তাই তো ঘুমিয়ে নিচ্ছি। আপনিও ঘুমান।‘
চলন্ত গাড়িতে কখনো ঘুম আসে না ড. আরেফিনের। ল্যাপটপ খুলে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল ঘাঁটাঘাঁটিতে।
***
হোটেলে একটা রুম ভাড়া নিলো রাশেদ। আপাতত এছাড়া কোন উপায় নেই। ঢাকায় চেনা কেউ নেই আর। ড. আরেফিন থাকলে তিনি হয়তো সাহায্য করতে পারতেন।
হোটেল রুমটা ছোট, কোনমতে একটা খাট রাখা, পাশে ছোট একটা বাথরুম। মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে বনবন করে। এই মুহূর্তে পছন্দসই হোটেল খুঁজে বের করার মতো সময় নেই রাশেদের হাতে। টাকা-পয়সার তেমন কোন সমস্যা না। বাবা চেয়ারম্যান হওয়ার পর টাকা পাঠানোর পরিমান বেড়ে গেছে।
রুমে ঢুকে কিছুক্ষন বিছানায় বসে থাকল রাশেদ। চিন্তা করছে কি করা যায়। হাতের ব্যাগটা খাটের নীচে ঢুকিয়ে দিল অবহেলায়। এই জিনিসটাই সব ঝামেলার মূল বলে মনে হচ্ছে।
দুপুর হয়ে গেছে, খিদে পেয়েছে, কিন্তু নীচে যেতে ইচ্ছে করছে না। এই সব ছোট হোটেলে রুমে খাবার পাঠায় কি না কে জানে। উঠতে যাবে মোবাইল ফোন বেজে উঠলো এই সময়।
‘হ্যালো,’ অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছে, তাই যথাসম্ভব নীচু স্বরে বলল রাশেদ।
‘আপনি কোথায়?’
‘কাকে চান, আপনি কে?’
‘আমি তানভীর, ন-না, স্যরি, লরেন্স ডি ক্রুজ।’
‘লরেন্স? আপনি এখন কোথায়?’
‘আমি ঢাকায়।‘
‘কিভাবে সম্ভব!’ রাশেদের গলায় বিস্ময় ঝরে পড়ল, ‘সেইদিন না দেখলাম মারা যাবার মতো অবস্থা।
‘অবস্থা এখনো খারাপ। কোনমতে ঢাকায় এসেছি।’
‘আচ্ছা, বলুন কি করতে পারি?’
‘আমার জিনিসটা ফেরত দাও।’
‘ফেরত দেবো?’
‘অবশ্যই এটাই তো কথা হয়েছিল তাই না।’
‘যদি না দেই?’
‘দেখো, এমনিতেই তোমার এক বন্ধু মহা ঝামেলায় আছে। এখন যদি আমি তোমার পেছনে লাগি তাহলে কিন্তু সামলাতে পারবে না।’
‘রাজুর কি হয়েছে?
‘যতোটুকু জানি সঞ্জয়ের পাল্লায় পড়েছে। এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে কি না কে জানে?
‘কি বলছেন? বিশ্বাস করি না।’
‘বিশ্বাস তো করার কথা। আমার ধারনা তোমার পেছনেও এরমধ্যে লোক লেগে গেছে।‘
‘আপনি এতো কিছু জানেন কি করে?’
‘সঞ্জয়ের দলে আমার লোক আছে। এখন তুমি যদি সঞ্জয়ের পাশাপাশি আমাকেও শত্রু বানিয়ে ফেলো তাহলে কিছু বলার নেই।‘
‘আপনার জিনিস আপনি নিয়ে যান।‘
‘নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই আমার, তুমি এসে দিয়ে যাও, আমি, কাঁঠালবাগানে থাকি।’
‘দেখা যাক, আমি আপনাকে বিকেলে ফোন দেবো।’
‘ঠিক আছে, রাখলাম। এখন আর বেশি কথা বলতে পারছি না।‘
ফোন রেখে দিল রাশেদ। লরেন্স লোকটাকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, এছাড়া ঐ লোকের হাতে নক্সাটা দিয়ে দিলেও সঞ্জয়ের লোকেরা তাকে ছেড়ে দেবে কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আপাতত জিনিসটা হাতছাড়া না করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হলো রাশেদের কাছে।
নীচে নেমে এসে ছোট একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকল রাশেদ। খেয়ে দেয়ে আবার একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে। সামনে অনেক ঝামেলা আছে মনে হচ্ছে।
***
পুরো ব্যাপারটাই ঝামেলা মনে হচ্ছে ড. আরেফিনের কাছে। ঠিক যে রকম প্রত্নতাত্ত্বিক কাজের ধারনা করা হয়েছিল সেরকম কিছু হচ্ছে না। কেমন নিশ্চুপ মনে হচ্ছে ড. কারসনকে। বাকি দুজনও চুপচাপ। যেন কোন আগ্রহ নেই কাজে। অথচ মনে মনে উত্তেজনায় ফুটছেন ড. আরেফিন। তার আসল আগ্রহ সাম্ভালার প্রতি। কিন্তু ড. কারসন এখন রওনা দিয়েছেন ধর্মশালার উদ্দেশ্যে। সাম্ভালা আর যেখানেই হোক ধর্মশালার ধারে কাছে নেই এটা অন্তত নিশ্চিত ড. আরেফিন।
গাড়ি চলছে স্বাভাবিক গতিতে। আরো অনেক পথ বাকি। চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে ভালোই লাগছে ড. আরেফিনের কাছে। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন ড. কারসনের দিকে। ভদ্রলোক ঘুমিয়ে নিচ্ছেন। সামনের সীটে সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালাও ঘুমাচ্ছে, নাক ডেকে। চলন্ত গাড়িতে নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে পারাটা রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হয় ড. আরেফিনের কাছে।
এখানে এসে মোবাইলের সীম বদলে নিয়েছেন ড. আরেফিন। নাম্বারটা শুধু কয়েকজনের কাছে আছে। তাই খুব বেশি একটা কল আসে না। ঢাকায় স্ত্রীকে দিয়ে রেখেছেন। প্রতিদিন সকাল, দুপুর আর রাতে তিনবার কথা হয়। এর বাইরে প্রফেসর সুব্রামানিয়াম, সন্দীপ আর ড. কারসনের কাছে আছে নাম্বারটা। তাই হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠাতে কিছুটা অবাক হলেন ড. আরেফিন। একটু আগেই স্ত্রীর সাথে কথা হয়েছে তার, এতো তাড়াতাড়ি কল করার কথা না।
ফোনটা এসেছে সন্দীপের নাম্বার থেকে। ড. কারসনের দিকে তাকালেন তিনি, ভদ্রলোক বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন, টের পাবেন না মনে হয়।
‘হ্যালো, সন্দীপসাহেব, বলুন, চাপা গলায় বললেন ড. আরেফিন।
‘চোখকান খোলা রাখবেন ড. আরেফিন, মনে হয় আমাদের পিছু নিয়েছে কেউ,’ ওপাশ থেকে একই রকম সুরে সন্দীপের কণ্ঠ শোনা গেল।
‘তাই! আপনি নিশ্চিত?’
‘হোটেলের সেই লোকটা, আমি নিশ্চিত।’
‘ঠিক আছে, মনে থাকবে।‘
ফোন রেখে দিলেন ড. আরেফিন। একটা লোক দিল্লী হোটেল থেকে তাদের পিছু নিয়েছে, এমনকি প্রফেসরের রূম থেকে ল্যাপটপ চুরি করেছে, অথচ এই ব্যাপারে কোন উচ্চবাচ্য করছেন না ড. কারসন, ব্যাপারটা আশ্চর্য্য লাগছে ড. আরেফিনের কাছে। লোকটা এখনও তাদের পিছু নিয়েছে, উদ্দেশ্য জানতে পারলে অনেক সুবিধা হতো।
রেডিওতে হিন্দী গান বাজছে। গানের তালে তালে হাতে তাল ঠুকছে ড্রাইভার, একবনও বুঝতে পারলেন না ড. আরেফিন। এসি চলছে, কিন্তু তারপরও গরম লাগছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। সকালে গলায় টাই পড়েছিলেন, এবার টাইয়ের নটটা একটু ঢিলা করে নিলেন।
‘বাবু, খারাপ লাগছে?’ ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা, লোকটা কখন ঘুম থেকে উঠেছে টের পাননি তিনি।
‘না, তেমন কিছু না। গরম লাগছে।’
‘গাড়ি থামাবো।
‘না, গাড়ি চলুক,’ বললেন ড. আরেফিন। ড্রাইভারের পাশের মিররে পেছনে তাকালেন। প্রফেসরদের গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। তার পেছনে আরো একটা গাড়ি চোখ এড়াল না তার। হয়তো এই গাড়িটাই পিছু নিয়েছে তাদের।
শার্টের বোতাম খুলে একটু আরাম করে বসলেন ড. আরেফিন। এখন অসুস্থ হওয়া চলবে না। সামনে অনেক কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য।
.
১৭৬০ খৃস্টাব্দ
আফ্রিকা উপকূল।
সন্ধ্যার পর ঘুম ভাঙল মিচনারের। বালিতে শুয়ে পড়েছিল সে নৌকা থেকে নেমেই। টানা দুই দিন নৌকা চালিয়ে সারা শরীর অস্থির হয়ে উঠেছিল বিশ্রাম নেয়ার জন্য। পিপাসায় সাগরের নোনা পানি দিয়েই চালিয়ে দিয়েছে, এছাড়া পেটে এক দানাও পড়েনি কয়েকটা দিন। সবচেয়ে খারাপ লাগছিল ঘুম না হওয়াতে। তাই তীরে পৌঁছে আর দেরি করেনি মিচনার। নৌকাটাকে পাড়ে লাগিয়েই সোজা লম্বা এক নারকেল গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়েছে। তপ্ত দুপুরেও ঘুম আসতে দেরি হয়নি তার। এখন ঘুম ভাঙতে চোখ কচলে উঠে বসলো সে। চারপাশে কালো কালো কিছু প্রানী ঘোরাফেরা করছে। আবার ঠিকমতো তাকাল। কালো প্রানী আর কেউ না, কিছু মানুষ। ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। মাথায় ঝাকড়া চুল, শীর্ন দেহ, ঝকঝকে দাঁত। এই সন্ধ্যাবেলায়ও ওদের দাঁতগুলো যেন ঝকঝক করছে। ওরা দূর থেকে দেখছে তাকে, অবাক দৃষ্টিতে। হয়তো এই রকম সাদা চামড়ার মানুষ ওদের চোখে পড়েনি কখনো। তাই কাছে আসতেও ভয় পাচ্ছে। আয়ারল্যান্ডের কথা মনে পড়ে গেল। এই কালো মানুষেরা সেখানে তার বাড়িতে চাকরের কাজ করে। মানুষ হিসেবে ওদের কোন মর্যাদাই দেয়া হয় না। ঐ লোকগুলোকে আফ্রিকা থেকে চালান করা হয়েছে। এটা নিশ্চয়ই আফ্রিকা। ক্যাপ্টেন বলেছিল আফ্রিকান উপকূল আরে বেশি দূরে নয়। বাচ্চাগুলোর কৌতূহল বেশি, দু’একজন সামনে এসেও আসছে না, ভয় পাচ্ছে। বাকিরা দূরে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছে।
উঠে দাঁড়াল মিচনার, আড়মোড়া ভাঙল। পরনের কাপড় ছিঁড়ে গেছে, খালি পায়ে বালিতে হাঁটতে কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে তীর ছেড়ে মূলভূমির দিকে হাঁটতে থাকল সে। পেছনে একদঙ্গল ছেলেমেয়ে। ওরা যখন আছে ওদের বাবা-মা’রাও আছে আশেপাশে। হঠাৎ কানের পাশ দিয়ে কিছু একটা চলে গেল বলে মনে হলো মিচনারের কাছে। তীর। আফ্রিকানরা তীরের মাথায় বিষ মেশায় বলে শুনেছে কোথাও, তাই দেরি না করে একেবেকে দৌড়াতে থাকল সে। চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। বড় কিছু নারকেল গাছ ছাড়া আড়াল নেয়ার কোন জায়গা নেই। একটা তীর আসার পর আরো কিছু ছুটে এসেছে তার দিকে, সব কটাই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে এখন পর্যন্ত। কিন্তু কততক্ষন তীরের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে সন্দেহ আছে। তাই দৌড় বাদ দিয়ে দু’হাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল মিচনার। আত্মসমর্পনের এই ভাষা সব যোদ্ধাই চেনে, অন্তত এই অবস্থায় কেউ তার দিকে দিকে তীর ছুঁড়বে না বলে ধারনা করলো মিচনার।
বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ হাত তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। বাচ্চাগুলো উধাও হয়ে গেছে এরমধ্যে। হয়তো ওদের বাবা-চাচারা আশপাশেই আছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিচনার। ওরা হয়তো দেখতে চাইছে তার আচার-আচরন। এদিক সেদিক দেখলেই তীর দিয়ে গেঁথে ফেলতে দ্বিধা করবে না।
কালো লোকটা কোথা থেকে তার সামনে এসে দাঁড়াল বুঝতে পারেনি মিচনার। লম্বায় তার সমান হবে, তবে লিকলিকে শরীর। ঝকঝকে দাঁত আর একমাথা কোঁকড়া চুল। হাতে ছোট একটা ধনুক, কাঁধে ঝোলানো বেশ কিছু তীর দেখা যাচ্ছে।
ইশারায় কিছু একটা বলল কালো লোকটা, বুঝতে পারলো না মিচনার। এবার আরো কিছু লোককে দেখা গেল, অন্ধকার কুঁড়ে উদয় হয়েছে যেন। সবাই দেখতে একইরকম প্রায়, বয়স বোঝা যায় না, নিজেদের মধ্যে কথা বলছে যা মিচনারের বোঝার বাইরে।
এবার অন্য একজন এগিয়ে এসেছে, লোকটাকে দলের প্রধান মনে হলো, একটু ভারিক্কি চেহারা, স্থূল শরীর। তাকে দেখে বাকি সবাই সরে দাঁড়িয়েছে।
‘হেই তুই, এখানে এলি কেমন করে?’ পরিস্কার ইংরেজিতে বলল লোকটা।
অবাক হলেও প্রকাশ করলো না মিচনার।
‘জাহাজ ডুবে গেছে। কোনমতে এখানে এসেছি,’ ক্ষীনস্বরে বলল মিচনার।
‘যমের কাছে এসে পড়েছিস, সাদা চামড়া পেলে আমি সেটা তুলে নেবো বলে কসম কেটেছি,’ বলল লোকটা, ইশারা করলো সঙ্গিসাথিদের। এগিয়ে এসে মিচনারের হাত আঁকড়ে ধরল দুজন।
‘আমাকে মেরে ফেলবেন?’
‘এখানে না, আগে গ্রামে ফিরি। সবার সামনে তোর চামড়া ছুঁলে নেবো, হারামজাদা।
উত্তর দেয়া সমীচিনবোধ করলো না মিচনার। সাদা চামড়ার উপর বেজায় আক্রোশ লোকটার। এখন চুপচাপ এদের সাথে যাওয়াই ভালো। পরে সুযোগ বুঝে পালাতে হবে। সেই সুযোগ পাওয়া যাবে কি না কে জানে।
*
অধ্যায় ২৫
সন্ধ্যার দিকে হাঁটতে বের হয়েছেন তিনি। সারাদিন হোটেল রুমে থেকে হাফ ধরে যায়, যদিও সময়টা একেবারে অযথা নষ্ট হচ্ছে না। পড়াশোনা করে সময় কাটাচ্ছেন আপাতত। ভালো কিছু বই কিনেছেন স্থানীয় বইয়ের দোকান থেকে, ওরা বলেছে আরো ভালো বই তারা এনে দেবে। বই পড়ে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। চলে যাওয়ায় সময় এসে গেছে।
যে রাস্তায় হাঁটছেন রাস্তাটা ফাঁকা থাকে সন্ধ্যার দিকে। যদিও আজ অনেক মানুষজন দেখা যাচ্ছে। সবাই কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে হাঁটছে মনে হচ্ছে। আরো দূরে বড় একটা বট গাছের তলার বেশ কিছু মানুষের জটলা দেখতে পেলেন তিনি। শান্ত, নিরুত্তাপ এই শহরে এই কদিনে এতো লোক কোথাও একসাথে দেখতে পাননি তিনি। তাই কিছুটা অবাক হলেন।
দ্রুত পা চালালেন। বটগাছের গোড়া ঘিরে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। ভিড় ঠেলে কিছুটা কাছে যেতেই বুঝতে পারলেন ঘটনা। এক সাধু পুরুষ ঘাটি গেড়েছে। শহরের কিছু লোকজন এরমধ্যে সাধু লোকটার চারপাশে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে নিয়েছে, যাতে কেউ খুব কাছে যেতে না পারে।
ভিড়ের মধ্যেই লোকটার চেহারা দেখার চেষ্টা করলেন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আবো অন্ধকারে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না চেহারা। এছাড়া দাঁড়িগোফ আর লম্বা চুলের আড়ালে এদের সত্যিকার চেহারা কেউ দেখেছে কি না সন্দেহ আছে। তিনি আবার উঁকি দিলেন। সৌম্য চেহারা, সাধুদের যেমন হয়, পাকা চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে, মুখ
ভর্তি কাঁচাপাকা দাঁড়িগোফ।
ভিড়ের মধ্যে পাশের লোকটাকে গুতো দিলেন আস্তে করে।
‘উনি কে?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন।
‘যজ্ঞেশ্বর সন্ন্যাসী। কেন আপনি নাম শোনেন নি?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মধ্য বয়স্ক লোকটা।
‘জি না, শুনিনি।’
‘তাহলে শুনে রাখুন। উনি যেমন তেমন সাধু নন। পাঁচশ বছর বয়স উনার। প্রতিবছর একবার করে এই শহরে আসেন। কাউকে ভালো লাগলে তার উপকার করে যান।’
‘তাই?’
‘হুম। বহু সাধু দেখেছি। কিন্তু ইনি অন্যরকম জিনিস। সাবধানে কথা বলতে হয়।’
‘আচ্ছা। পাঁচশ বছর ধরে বেঁচে আছেন?’
‘আমি তো তাই শুনেছি,’ এবার হেসে বলল মধ্য বয়স্ক লোকটা। আমার মনে হয় এতো বছর বয়স হবে, এগুলো বানানো কথা। তবে লোকটা অনেক কিছু জানে।’
‘কি জানে?’
‘আপনি যে কোন প্রশ্ন করতে পারেন, উত্তর পেয়ে যাবেন।’
‘কি বলছেন, সত্যি নাকি?’
‘এটাও বানানো কথা, মধ্য বয়স্ক লোকটা বলল, হাসলো আবার। লোকজন এসব কথা বানাতে পছন্দ করে। আবার কে জানে সত্যিই লোকটা হয়তো অনেক কিছু জানে।’
‘আচ্ছা।’
‘জয় বাবা যজ্ঞেশ্বর। আমি যাই,’ বলল মধ্য বয়স্ক লোকটা। তার বেরিয়ে গেল ভিড় ঠেলে।
কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। লোকজন অনেক কিছুই বানিয়ে বলে, বলতে পছন্দ করে। কিন্তু কথাগুলোয় বিন্দুমাত্র সত্যতা নেই এটাও হয়তো ঠিক না।
ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। উল্টোদিকের মেহগনি গাছের গোঁড়ায় গিয়ে দাঁড়ালেন। এখন থেকে যজ্ঞেশ্বর সন্ন্যাসীকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। ভিড় বাড়ছে ক্রমশ। এখন মাত্র সন্ধ্যা। রাত বাড়ার সাথে সাথে ভিড় নিশ্চয়ই কমে আসবে। তখন এই সাধু পুরুষের সাথে কথা বলবেন বলে ঠিক করলেন তিনি। এখন অপেক্ষা করার পালা।
***
পুরানো একটা বাড়ি, দোতলা। শতাব্দি প্রাচীন তো হবেই। চারপাশের বিশাল বিশাল অ্যাপার্টমেন্টগুলোর পাশে নিতান্তই ভাঙাচোরা একটা জিনিস বলা যায়। একটু আগে এসএমএস-এ এই ঠিকানাটা পেয়েছে রাশেদ। কাঁঠালবাগানের ঢাল ধরে নেমে কিছুটা হেঁটে গেলেই বাড়িটা চোখে পড়ে। বাড়িটার সামনে ছোট একটু উঠোন, চারপাশ গাছগাছালিতে ভরা। গেটের সামনে কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল রাশেদ। ঢোকা ঠিক হবে কি না কে জানে। আসল জিনিসটা সাথে আনেনি ইচ্ছে করে। লোকটাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করার মতো সময় এখনো আসেনি। রাজুর ব্যাপারে যা বলেছে তাও সঠিক কি না বোঝা যাচ্ছে না। তবে ঝামেলা কিছু আছে সামনে এটা নিশ্চিত।
একটা সিগারেট ধরাল রাশেদ। ছোট লোহার গেটটা অনেক পুরানো, তবে মজবুত। গেটে কড়াৎ করে শব্দ হওয়াতে চমকে সরে দাঁড়াল রাশেদ। বৃদ্ধ এক লোক দাঁড়িয়ে আছে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাশেদের দিকে। বয়স একশ’র কম হবে না বুড়োর, ভাবল রাশেদ। চোখ ঘোলা, তবে একসময় চোখের মনি নীল ছিল তা বোঝা যাচ্ছে।
‘ভেতরে যান,’ প্রায় আদেশের সুরে বলল বৃদ্ধ।
সিগারেট ফেলে দিয়ে গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল রাশেদ। এতো নিরিবিলি ছিমছাম জায়গায় এর আগে কখনো গেছে কি না মনে করতে পারলো না। বাইরে রোদ থাকলেও এখানে গাছের কারনে রোদের কোন দাপট নেই। বড় বড় কিছু গাছ পুরো বাড়িটাকে ছায়া দিয়ে রেখেছে।
বৃদ্ধ আগে আগে যাচ্ছে পথ দেখিয়ে। লম্বা শরীরটা দড়ি পাকানো, এখনো যথেষ্ট শক্তি ধরে বোঝা যাচ্ছে। নীচতলায় ঢোকার আগেই লম্বা টানা বারান্দার পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। বৃদ্ধের পেছন পেছনে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো রাশেদ। এখানেও লম্বা বারান্দা, একপাশে টানা কয়েকজোড়া কাঠের দরজা। কয়টা রুম আছে। আন্দাজ করতে পারলো না রাশেদ।
বারান্দায় গোল একটা টেবিল, মার্বেল পাথরের। দুপাশে গোলাকার দুটি চেয়ার। একটায় বসার জন্য ইশারা করলো বৃদ্ধ। তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চারদিকে তাকাল রাশেদ। এখান থেকে বাইরের রাস্তাটা সুন্দর দেখা যায়। তবে দূরে হওয়াতে তেমন শব্দ আসে না। উপরের দিকে তাকাল এবার। ছাদ বেশ উপরে, লম্বা রডে একটা ফ্যান ঝোলানো, যদিও ফ্যানটা এখন ঘুরছে না। মনে হচ্ছিল যে কোন সময় ফ্যানটা রড থেকে খুলে নীচে পড়ে যাবে, ঠিক তার মাথার উপর।
‘কি খবর রাশেদ?’
প্রশ্নটা শুনে চমকে তাকাল রাশেদ। একটু দূরেই লরেন্স দাঁড়িয়ে আছে। আগের চেয়ে শীর্ন দেখাচ্ছে, তবে কিছুদিনে বিশ্রামে গায়ের রঙ বেশ উজ্জ্বল। চেহারাটা হাসি হাসি, যেন অনেক দিন পর পুরানো বন্ধুর দেখা পেয়েছে।
‘ভালো, আপনি কেমন আছেন?’
‘দেখতেই পাচ্ছো, তেমন কিছু হয়নি,পেটে গোটাকয়েক সেলাই পড়েছে। নড়তে কষ্ট হয়।’
‘আমাকে ডেকেছেন কেন?’
‘আমার জিনিস কই?’
‘সাথে নেই। ভয়ের কিছু নেই সাবধানে রেখেছি।’
‘আচ্ছা, আমার জিনিস নিয়ে আমার সাথেই চালাকি,’ বলল লরেন্স, রাশেদের উল্টোদিকের চেয়ার বসল।
‘কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না, বিশেষ করে রাজু গায়েব হয়ে যাওয়ার পর থেকে।
‘রাজুকে তো আমি গায়েব করিনি।’
‘সেটা বুঝবো কি করে?’
‘কিছু কিছু জিনিস বিশ্বাস করতে হয় রাশেদ। আমি যেমন তোমাদের দেখেই বিশ্বাস করেছিলাম, তোমাদের প্রানে বাঁচিয়েছিলাম, আশা করি ভুলে যাওনি।’
‘তা ভুলিনি।’
‘তাহলে যাও, আর দেরি করো না। যে হোটেলে উঠেছে সেখান থেকে আমার জিনিস নিয়ে এসো। পারিবারিক সম্পত্তি ওটা।’
‘আমি হোটেলে উঠেছি আপনি জানলেন কি করে?’
‘তুমি যেখানে থাকো সেখানে খবর নিয়েছি। এছাড়া ঢাকায় তোমার তেমন কেউ নেই যাবার মতো।’
‘ঠিক আছে, বুঝলাম। আমি তাহলে আসি।’
‘তুমি হোটেল থেকে একবারে এখানে চলে এসো। দুজনে বসে প্ল্যান করে কাজ করতে হবে। বুঝতেই পারছো সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যেতে পারছি না আমি।
‘রাজুর কি হয়েছে?’
‘এখনো বেঁচে আছে এটুকু জানি। কোথায় আছে তা বলতে পারছি না। সেটা তোমাকেই খুঁজে বের করতে হবে।’
‘হ্যাঁ। এর আগে এক বন্ধুকে হারিয়েছি আমি।’
‘যাওয়ার আগে নাস্তা করে যাও,’ বলবে লরেন্স ট্রলিতে চা বিস্কিট নিয়ে বৃদ্ধকে ঢুকতে দেখা যাবে।’
‘ইনি আমার চাচা,’ বৃদ্ধকে পরিচয় করিয়ে দেবে লরেন্স, ‘এঞ্জেল ডি ক্রুজ। আমার বাবার ছোট ভাই।’
কিছু বলবে ভেবেও বলল না রাশেদ। চায়ের কাপ হাতে নিলো। সন্দেহ হচ্ছিল চায়ে কিছু মেশানো আছে কি না। পরমুহূর্তে খুব বেশি সন্দেহপ্রবন হয়ে যাচ্ছে বলে নিজেকেই সাবধান করলো সে।
চা খেয়ে বাইরে চলে এসেছে রাশেদ। কিছুক্ষন এলোপাথারি এদিক-সেদিক হাঁটল। বারবার বোঝার চেষ্টা করলো পেছনে কেউ অনুসরন করছে কি না। নিশ্চিত হওয়ার পর একটা সিএনজি নিয়ে রওনা দিলো মিরপুরের উদ্দেশ্যে।
***
সন্ধ্যার পর ছোট একটা হোটেলের সামনে দাঁড়াল মাইক্রোবাসটা। দিল্লি থেকে ছয়শ কিলোমিটার দূরের ধর্মশালায় একদিনেই হয়তো পৌঁছানো যায়। কিন্তু এই যাত্রার ধকল নিতে চাচ্ছেন না ড. কারসন। তাই চন্ডীগড়ে এসে সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালাকে বললেন আজ রাত এখানেই কাটাতে চান। বাকিদেরও তেমন আপত্তি নেই। বিশেষ করে প্রফেসর সুব্রামানিয়াম বিশ্রাম না নিয়ে আর এক কিলোমিটার যেতেও রাজি হচ্ছিলেন না। সেই ভোরে রওনা দিয়েছেন দিল্লি থেকে, একদিনে এতো পরিশ্রম আগে কখনো করেননি।
দোতলায় পাশাপাশি রুম নেয়া হলো। রাত হয়ে গেছে। সারাদিনের পরিশ্রমের পর একা একা কিছুটা সময় সবারই দরকার ছিল। নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আগে ফ্রেশ হয়ে নিলেন ড. আরেফিন। এখানকার আবহাওয়ার সাথে ঢাকার আবহাওয়ার। তেমন কোন পার্থক্য নেই, কিন্তু এরপর থেকে ধর্মশালার যতো কাছে যাবেন তাপমাত্রা ততো কমতে থাকবে। সারাদিন ইন্টারনেটে বসে ধর্মশালা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন, খুব যে সফল হয়েছেন তা বলা যাবে না। তবে অনেক কিছুই জানা গেছে। জায়গাটা মনোরম, প্রাকৃতিক পরিবেশ অসাধারন, এটা নিঃসন্দেহে বলা যাবে। ব্রিটিশরাজ জায়গাটাকে গ্রীষ্মকালীন পিকনিক স্পট হিসেবে ব্যবহার করতো একসময়। এছাড়া এখানে ছিল শুখাদের প্রথম ব্যাটালিয়ন। ১৯০৫ সালে ধর্মশালা আর এর পার্শ্ববর্তী কাংরা উপত্যকায় ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে প্রায় কুড়ি হাজার লোক মারা যায়। এখানকার বাগসুনাগ মন্দিরসহ ইউরোপীয়দের তৈরি বাড়িঘর দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গুর্খারা শহরটি আবার তৈরি করে। ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসে এই গুর্খারা বিশেষ একটি জায়গা দখল করে আছে, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের ন্যাশনাল ইন্ডিয়ান আর্মির বড় একটা স্থান দখল করেছিল গুর্খা ব্যাটালিয়নের সদস্যরা।
আরো অনেক তথ্য মাথায় ঘোরাঘুরি করছিল, ঘুমও আসছিল। যদিও এই সময়টা ঘুমাতে ইচ্ছে করে না ড. আরেফিনের। চাইলে বাইরে ঘুরে আসা যায়। সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা আছে, গোটা চন্ডীগড় শহর নাকি তার হাতের তালুর মতো চেনা। চাইলে ওকে নিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু লোকটাকে ঠিক বিশ্বাসী মনে হয়নি। মনে হয় অতি ধুরন্ধর একটা মানুষ, বিশেষ কোন উদ্দেশ্য আছে লোকটার মনে মনে।
দরজায় টোকা পড়ায় কিছুটা বিরক্ত হলেন ড. আরেফিন। আরো কিছুক্ষন বিশ্রাম নেয়ার ইচ্ছে ছিল। দরজা খুলে প্রফেসর সুব্রামানিয়ামকে দেখে বিরক্তির পরিমানটা আরো কিছুটা বাড়ল। খেয়াল না করলে বোঝা যাবে না, কিন্তু এর মধ্যেই ভদ্রলোক যে পান করে এসেছেন তা বোঝা যাচ্ছে।
‘বসতে পারি ড. আরেফিন?’ বললেন প্রফেসর সুব্রামানিয়াম, উত্তরের তোয়াক্কা না করে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।
দরজা বন্ধ করে বিছানার এক কোনায় বসলেন ড. আরেফিন। ভদ্রলোক এখন কেন এলেন বোঝা যাচ্ছে না।
‘ঐ সন্দীপ চক্রবর্তীকে আমার পছন্দ নয়, থেমে থেমে বললেন প্রফেসর। কাল আমি ঐ মাইক্রোতে যাবো না।’
‘তাহলে আমি যাবো, আমার কোন সমস্যা নেই, ড. আরেফিন বললেন।’
‘ভালো, আমি আসি,’ বলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর।
দরজা বন্ধ করে চুপচাপ কিছুক্ষন বসে থাকলেন ড. আরেফিন। এই দুজনের মধ্যে সমস্যাটা আসলে কি নিয়ে তা জানতে পারলে ভালো হতো। কোন না কোন সমাধান হয়তো বের করা যেতো। খিদে পেয়েছে, রুম বয়কে বললেই খাবার পাঠিয়ে দেবে। এছাড়া পাশেই বেশ কিছু ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট চোখে পড়েছিল। সেখানে গিয়েও খাওয়া যায়।
রুম থেকে বেরিয়ে এলেন ড. আরেফিন। দোতলার বারান্দা থেকে নীচে তাকালেন। দূরে সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে। হেঁটে রাস্তা পার হয়ে কোথাও যাচ্ছে। বারবার তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক। চেহারায় চোর চোর ভাব, যেন ধরা পড়তে চাচ্ছে না। একটা থামের আড়ালে সরে এলেন ড. আরেফিন। সুরেশের গতিবিধির উপর নজর রাখতে হবে। কিছু একটা সমস্যা আছে কোথাও। ড. কারসনকে সাবধান করতে হবে, হয়তো ভুল লোককে বিশ্বাস করার মাশুল দিতে হতে পারে তাদের সবাইকে।
আবার তাকালেন। দূরের অন্ধকারে সুরেশকে এখন দেখা যাচ্ছে না। লোকটা হাওয়া হয়ে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেন ড. আরেফিন। পাশের রেস্টুরেন্টের দরজায় সন্দীপ দাঁড়িয়ে আছে, হাতে সিগারেট, বরাবরের মতো গম্ভীর মুখে। সন্দীপের সাথে সুরেশ সম্পর্কে আলাপ করতে হবে। এখন পর্যন্ত সন্দীপকে মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে, কিন্তু মন বলছে কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না, কাউকে না।
*
অধ্যায় ২৬
রাত একটা বাজে। ছোট এই শহরটার জন্য অনেক রাত। যজ্ঞেশ্বর সন্ন্যাসীর সামনে এখন আর কোন দর্শনার্থী নেই। শেষ জন চলে গেছে একটু আগে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে সব দেখেছেন তিনি। সন্ন্যাসী কারো সাথে কথা বলেনি। শুধু শুনেছে আর আশির্বাদের ভঙ্গিতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। লোকটা কারো কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা, খাবার-দাবার কিছুই নেয়নি। এতে কিছুটা অবাক হয়েছেন তিনি। এধরনের নির্লোভ মানুষ অনেক দিন চোখে পড়েনি তার। ভারতবর্ষে এখনো নিঃস্বার্থ এবং জাগতিক চেতনার উর্ধে মানুষ আছে তাহলে। আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
বিশাল এক বট গাছের তলায় আস্তানা গেড়েছেন সন্ন্যাসী। চারপাশ শুনশান। ঝি ঝি পোকা আর ব্যাঙের ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। দীর্ঘ সময় ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে পা ব্যথা হয়ে গেছে তার। যজ্ঞেশ্বর ঘুমুতে যায় নিশ্চয়ই, তার আগেই লোকটার সামনে হাজির হতে হবে। হেঁটে রাস্তা পার হলেন তিনি। পঞ্চাশ গজ দূরে থাকতেই তাকে দেখতে পেয়েছে সন্ন্যাসী। বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। দূর থেকেই সন্ন্যাসীর চোখে অবাক দৃষ্টি দেখতে পেলেন তিনি। চমকৃত হলেন। এই সন্ন্যসী খুব সাধারন সন্ন্যাসী নন।
কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ালেন তিনি।
‘আপনার সাথে দেখা হয়ে যাওয়া পরম ভাগ্যের ব্যাপার, বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বলল যজ্ঞেশ্বর সন্ন্যাসী। আশা করি ভালো আছেন।’
অবাক হলেন তিনি, কিন্তু চেহারায় কোন ভাবান্তর প্রকাশ পেল না।
‘আসুন, বসুন,’ বলে ইশারায় সামনে বসতে বলল সন্ন্যাসী। নিজেও বসল মাটিতে আসন গেড়ে।
কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে বসলেন তিনি। তাকিয়ে আছেন সন্ন্যাসীর দিকে। বোঝার চেষ্টা করছেন যজ্ঞেশ্বরের মনে আসলে কি চলছে।
‘আমার কথায় হয়তো অবাক হয়েছেন,’ যজ্ঞেশ্বর বলে চলল, ‘আমি আপনার কথা শুনেছি। অনেক শুনেছি। মানবসভ্যতায় আপনার অনেক অবদান।
‘আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না,’ বললেন তিনি, ‘আমার নাম লখানিয়া সিং। সাহায্যের আশায় এসেছি আপনার কাছে।
‘আমি আপনাকে সাহায্য করবো? সেই সৌভাগ্য কি আমার হবে?’
‘এভাবে বলবেন না প্লিজ,’ অনুরোধ করলেন তিনি।
‘ঠিক আছে বলুন কি করতে পারি,’ যজ্ঞেশ্বর সন্ন্যাসী বলল।
চারপাশে তাকালেন তিনি। চমৎকার জোছনা আজ। যজ্ঞেশ্বরের চেহারাটা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছেন। মাথায় জট পাকানো চুল, মুখে ঘন দাঁড়ি। মোটা ভু আর খাড়া নাক। গায়ের রঙ একসময় টকটকে ফর্সা ছিল বোঝা যায়।
‘আপনি খুব ভালো ইংরেজি জানেন, বললেন তিনি।’
‘ধন্যবাদ। আসলে ইউরোপে একসময় ছিলাম কিছুদিন। তারপর…’
‘তারপর?’
‘না, তারপর কি হয়েছিল সেটা বলা বারন।’
‘ঠিক আছে, না বললেও অসুবিধা নেই।’
যজ্ঞেশ্বরের চেহারায় কিসের যেন ছাপ পড়েছে, যেন কষ্ট পাচ্ছে খুব। হয়তো অতীত কোন স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি নিজের অজান্তেই।
‘আপনি আমাকে কিভাবে চেনেন?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘আমরা জানি আপনি এসেছিলেন। অনেক অনেক আগে এবং আপনি আবার আসবেন সেটাও আমরা জানি।
‘আমরা মানে?’
‘আমি একা নই। আমার গুরু আছেন, তার অনেক শিষ্যের মতো আমিও জানি আপনি আছেন, আসবেন কোন একদিন। আমার গুরু হয়তো তার গুরুর কাছে আপনার কথা শুনেছেন।’
‘আপনি কি নিশ্চিত আমিই সেই লোক?’
‘হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত।’
‘আপনার কাছে আসার কি কারন থাকতে পারে বলে ধারনা আপনার?’
‘সাম্ভালা!’
অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। এতো নিখুঁত উত্তর আশা করেননি তিনি। ভাবছিলেন হয়তো আন্দাজে কথা বলছে, ভড়কে দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু শেষ শব্দটা উচ্চারন করার সাথে সাথে জমে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো তার।
‘সাম্ভালা? আপনি কিভাবে জানেন?’
‘আমি আর কিছু জানি না। শুধু এই শব্দটা শুনেছিলাম গুরুর কাছ থেকে।’
‘আচ্ছা।’
‘আপনার গুরু তিনি এখন কোথায়?
‘জানি না। জানার প্রয়োজনও বোধ করি না,’ বলে হাসল যজ্ঞেশ্বর সন্ন্যাসী, ‘যখনি মনে পরে তিনি চলে আসেন।’
‘কিভাবে চলে আসেন?’
‘মনের মাঝে চলে আসেন, খুব গভীরভাবে ডাকতে হয়। তাকে দেখি, প্রশ্ন করি তারপর আবার তিনি হাওয়ায় মিলিয়ে যান।’
হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুদূর চলে এসেছেন দুজন। সামনে বিশাল এক ঢাল, তারপর বিশাল এক উপত্যকা। জোছনার আলোয় কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। যজ্ঞেশ্বরের চেহারায় অদ্ভুত ধরনের বিষণ্ণতা দেখতে পেলেন তিনি।
‘আপনি হাজার বছর ধরে আমাদের দেখছেন, এই জগতের আসল উদ্দেশ্য কি?’
উত্তর দিলেন না তিনি। কতো বছর ধরে পৃথিবী দেখছেন সেই হিসেব এখন নিজের কাছেই নেই, কি দেখেছেন আরো কি দেখতে হবে সেটাও অজানা। তবে এতো দীর্ঘ সময়েও জগত সৃষ্টি বা এর কোন উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন ধারনা করতে পারেননি। হয়তো এমন দিন আসবে যেদিন মানুষ সব জেনে যাবে। সেদিনই হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে।
‘আমি জানি না, আসল উদ্দেশ্য কি। আমি একজন পরিব্রাজক। দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই।’
‘বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আমার কাছে এসেছেন আপনি। যদি কিছু মনে না করেন খোলাখুলি বলতে পারেন।’
চাঁদের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলেন তিনি। যজ্ঞেশ্বরের কথাবার্তা ভালো লেগেছে, কিন্তু নিজেকে কারো কাছে উন্মুক্ত করে দেয়ার সময় এখনো আসেনি।
‘আমি আপনার সাথে কিছুদিন থাকবো বলে ঠিক করেছি,’ বললেন তিনি, পুরো ভারতবর্ষ ঘুরে দেখবো।
‘আমার কোন আপত্তি নেই,’ যজ্ঞেশ্বর বলল। তবে আমার রাত কাটে গাছতলায়, মানুষের দেয়া খাবারে বেঁচে থাকি। এই জীবন আপনার ভালো লাগবে না।
‘দেখা যাক ভালো লাগে কি না,’ বললেন তিনি, ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘হোটেলে যাচ্ছি আমার কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসতে।
যজ্ঞেশ্বরকে একা রেখে হাঁটতে শুরু করেছেন তিনি। হোটেলে সামান্য যা কিছু আছে তা নিয়ে আসতে হবে। এই যজ্ঞেশ্বরই তাকে সাম্ভালার খোঁজ দিতে পারবে হয়তো।
.
১৭৬০ খৃস্টাব্দ
ছোটখাট একটা গ্রাম। গোটাকয়েক ছনের ঘর এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিতে আছে। মিচনারকে নিয়ে দলটা যখন গ্রামে পৌঁছাল তখন রাত হয়ে গেছে। পুরো গ্রামের লোকজন জড়ো হয়েছে গ্রামের মাঝখানের একটা ফাঁকা জায়গায়। আগুন জ্বালানো হয়েছে। আগুনের চারপাশ ঘিরে গ্রামের উৎসুক জনতা এক হয়েছে। হাল্কা আলোয় কালো কালো মুখগুলো চোখে পড়ল মিচনারের। এদের অধিকাংশই সাদা চামড়ার মানুষ দেখেনি এটা নিশ্চিত। নারী-পুরুষ সবার গায়ে লজ্জা নিবারনের সামান্য কাপড়টুকু নেই এবং এতে তারা লজ্জাবোধও করছে না। সবার কৌতূহল মিচনারকে নিয়ে।
।এরা হয়তো মানুষখেকো। এরকম জাতির কথা বহুবার শুনেছে মিচনার জাহাজের নাবিকদের কাছে। এদের হাতেই হয়তো তার মৃত্যু লেখা আছে। তবে সাগরে এতো ঝড়ঝঞ্জার পরও যেহেতু সে বেঁচে আছে এতো সহজ হবে না তাকে মেরে ফেলা।
দলনেতা লোকটা সবার সামনে হাঁটছে। মাঝখানে মিচনার, চারপাশে কয়েকজন ঘিরে ফাঁকা জায়গাটার দিকে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। চারপাশে তাকাচ্ছে মিচনার। এখান থেকে পালানো সহজ হবে না। চারপাশ ফাঁকা, দৌড়ে বেশিদূর যেতে পারবে না সে। এরা ধরে ফেলবে। কাজেই পালিয়ে না গিয়ে অন্য কোন কৌশলে বাঁচা যায় কি না সেই চেষ্টা করে দেখতে হবে।
নিজের লোকজনদের মাঝে গিয়ে হুঙ্কার দিলো দলনেতা। উত্তেজিত কণ্ঠে কিছু একটা বলল। একটু আগে যেসব চেহারায় বিস্মিতভাব দেখেছিল এখন সেখানে তীব্র ঘৃনা দেখতে পেল মিচনার। হয়তো তার চামড়া সত্যি সত্যি খুলে নেবে বলে ঘোষনা দিয়েছে দলনেতা, কিন্তু সেটা নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় নেই।
আগুনের চারপাশ ঘিরে থাকা মানুষগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। তারা সাদা চামড়ার মানুষটার শেষ পরিণতি দেখতে চায়। মিচনারকে ঠিক মাঝখানে রেখে তাকে বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে কিছু লোক। হঠাৎ কোন একটা শব্দে এলোমেলো হয়ে গেল সবকিছু। সাঁ সাঁ শব্দে বেশ কিছু তীর গেঁথে ফেলেছে মিনারের পাশের দুজনকে। উবু হয়ে মাটিতে বসে পড়েছে মিচনার। চারপাশে ভয়ানক হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে হঠাৎ করেই। লোকজন পড়িমরি করে পালাচ্ছে। কোন মতে মুখ তুলে তাকাল মিচনার। ছোট ছোট ঘরগুলোকে আগুনের শিখা গ্রাস করেছে। দলনেতা লোকটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে, বুঝতে পারছে না কি করবে। তার হাতে একটা বর্শা। কিন্তু অন্ধকারে যারা আক্রমন করেছে তাদের কেউ কাছে আসছে না। বীরদর্পে হুঙ্কার দিচ্ছে দলনেতা।
মাটিতে বুকে হেঁটে এগুচ্ছে মিচনার। এখান থেকে পালাতে হবে। তার রক্ষীদের কেউই এখন আশপাশে নেই। যে যার মতো জীবন নিয়ে পালাচ্ছে। এই গ্রামের কোন শত্রুপক্ষ আক্রমন করেছে হয়তো। আকস্মিক এই আক্রমন ঠেকানোর মতো কৌশল জানা নেই লোকগুলোর। ফলে একের পর একজনকে তীরবিদ্ধ হয়ে পড়ে যেতে দেখল মিচনার। বুকে হেঁটে গা বাঁচিয়ে অনেকদূর চলে এলো সে। গ্রামের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটা এখন আর ফাঁকা নেই। তীরবিদ্ধ বেশ কিছু লাশ সেখানে পরে আছে। দলনেতা চেঁচাচ্ছে, সঙ্গিসাথিদের ডাকছে। কিন্তু তার কথায় কান দেয়ার মতো কেউ নেই। সবাই পালাচ্ছে, মিচনারও।
আরো কিছুদূর বুকে হেঁটে ছোট খাট একটা ঝোঁপ চোখে পড়লো মিচনারের। ঐ ঝোঁপের আড়ালে একবার যেতে পারলে পারলে তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে যে। কারো জন্য।
পেছন ফিরে তাকাল মিচনার। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছে ছোট কুড়ে ঘরগুলোয়। সেই আলোয় মুখে রঙচং মাখা কিছু লোককে দেখতে পেল। এরাই আক্রমনকারী। কাঁধে তীরধনুক, হাতে লম্বা বর্শা। যারা এখনো মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে মৃত্যু যন্ত্রনায় তাদের গেঁথে ফেলছে বর্শা দিয়ে। দু’একজনের হাতে ধারাল তলোয়ারও দেখতে পেল মিচনার। বেশ কিছু পুরুষ আর মহিলাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে। টেনে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন মিলে।
ঝোপ আর বেশি দূরে নয়। হঠাৎ গুলির শব্দে চারপাশ কেপে উঠলো যেন। অবাক হলো মিচনার। অসভ্য এই বর্বরদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র আসার কথা না। ঝোঁপের পেছনে গিয়ে তাকাল সে। এবার সাদা চামড়ার কয়েকজনকে দেখা গেল। হাতে পিস্তল আর চাবুক। বন্দিদেরকে চাবুক দিয়ে আঘাত করছে। দূর থেকেও ওদের বিশ্রীভাষায় গালাগালি শুনতে পেল।
এরা দাস ব্যবসায়ী। এই অঞ্চল থেকে কালো মানুষদের ধরে নিয়ে যাবে ইউরোপে। বিক্রি করবে। ঝোঁপের পেছনে চুপচাপ বসে থাকল মিচনার। সবাই না যাওয়ার আগে এখান থেকে নড়া যাবে না। আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠেছে। সুন্দর হাওয়া বইছে। ঘুমে চোখ লেগে আসছিল মিচনারের। চোখ বুজে কিছুক্ষন ভাবার চেষ্টা করল মিচনার। এখান থেকে পালিয়ে কোথায় যাবে সে? সবই তো অচেনা। তার সেই চিন্তায় ব্যঘাত ঘটলো মাথায় শীতল কিছু একটা স্পর্শ পেয়ে। লম্বা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মুখে চুরুট ঝুলছে। হাতের পিস্তলটা ঠিক তার কপালে ঠেকানো।
*
অধ্যায় ২৭
উদ্দেশ্যহীন কোন কিছুই করতে ভালো লাগে না রাশেদের। অথচ এখন ঠিক সেরকম একটা পরিস্থিতির শিকার সে। চাইলেও সবকিছু ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। কাঁঠালবাগানের বাড়িটার গেট দিয়ে ঢোকার সময় অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি হচ্ছিল। যা করতে যাচ্ছে তা হয়তো ঠিক হচ্ছে না। শুধু রাজুর কথা ভেবে সরে যেতে পারছে না। এমনিতে গুপ্তধন বা এই জাতীয় কেচ্ছা তার ভালো লাগে না কখনো। কিন্তু লরেন্সের কথামতো গুপ্তধনের নক্সা এখন তার কাছে। সেই নক্সার পেছনে কিছু লোকও লেগে গেছে ইতিমধ্যে।
দোতলার কোনার একটা রুম দেয়া হয়েছে রাশেদকে। বাইরে থেকে খাওয়া দাওয়ার ঝামেলা সেরে এসেছিল, তাই রুমে ঢুকেই সটান বিছানায় শুয়ে পড়ল রাশেদ। লরেন্সের সাথে রাতে আর দেখা হবে না, এঞ্জেল ডি ক্রুজ একটু আগে তাই বলে গেল। লোকটা দেখতে প্রাচীনকালের জলদস্যুর মতো। চেহারায় মায়া-দয়ার চিহ্নমাত্র নেই। শুধু জলদস্যুর পোশাক পরাতে পারলেই হতো। কাটা কাটা চেহারায় খুনে চোখ দুটি যেন অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করে। এরা আসলেই যে ইউরোপীয়ের বংশধর তা এদের চোখ আর গায়ের রঙ দেখলেই বোঝা যায়।
বালিশের নীচে ছোট বাক্সটা রেখে শুয়েছে রাশেদ। তার ঘুম খুব পাতলা, সামান্য শব্দেই ঘুম ভেঙে যায়। বালিশের নীচে জিনিসটা সবচেয়ে নিরাপদ তাই। এঞ্জেলকে নিয়ে ভয়, লোকটা না ঘুমের মধ্যে আক্রমন করে বসে। তাই উঠে দরজাটা ঠিকমতো লাগানো হয়েছে কি না পরীক্ষা করে দেখল রাশেদ। জানালাও লাগানো, বাইরে থেকে কারো ঘরে ঢোকা সম্ভব না।
অনেকক্ষন শুয়েও ঘুম আসছিল না রাশেদের। কেমন একটা অস্বস্তি, পরিচিত জায়গায় না ঘুমাতে পারলে এমন হয় তার, প্রথম প্রথম ঘুম আসতেই চায় না। নানা ধরনের চিন্তা আসছিল মাথায়। এই লরেন্স লোকটাকে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। আবার রাজুও উধাও। সে হয়তো দারুন বিপদের মধ্যে আছে, এতো দিনে খারাপ কিছু ঘটেও যেতে পারে। শামীমের সাথে যেমনটা হয়েছিল। বাবার কথা মনে পড়ছে। আব্দুল আজিজ ব্যাপারি এখন ভালো আছেন, চেয়ারম্যান হিসেবে ভালো কাজ করছেন বলে শুনেছে রাশেদ। যদিও নুরুদ্দিন নামে ছোট একটা ছেলে আর জয়নাল নামে এক লোকের মারা যাওয়ার জন্য বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে আব্দুল আজিজ ব্যাপারিকে। বৃদ্ধ দাদার কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। শেষ কবে দেখা হয়েছিল মনে পড়ছে না। কোথায় আছে, বেঁচে আছে কি না কেউ জানে না।
আরো অনেক আবোল-তাবোল চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল রাশেদ। ঘুম ভাঙল দরজায় ক্রমাগত ধাক্কানোর শব্দে। যেন দরজা ভেঙে ফেলতে চাচ্ছে। চাপা গলায় কারো ডাক শুনতে পাচ্ছে রাশেদ। বিছানায় উঠে বসল। কি করা উচিত ঠিক করতে পারছে না। এভাবে ধাক্কাতে থাকলে দরজা এমনিতেই ভেঙে যাবে। তারচেয়ে উঠে গিয়ে খুলে দেয়া ভালো।
চাপা গলার স্বরটা চিনতে পারল সে-লরেন্সের গলা। কিন্তু এতো রাতে এভাবে দরজা ধাক্কানোর মানে কি? দরজার কাছে গিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল রাশেদ।
আবারো ধাক্কা পড়ছে। দরজার ছোট একটা কি-হোল দিয়ে তাকাল রাশেদ। লরেন্সকে দেখা যাচ্ছে, ক্রাচে ভর দিয়ে কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারেও চেহারাটা কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। আস্তে আস্তে দরজা খুলল রাশেদ, একটু পিছিয়ে এলো সম্ভাব্য বিপদের আশংকায়। ক্রাচ নিয়েই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকেছে লরেন্স, পেছনে এঞ্জেল ডি ক্রুজ। দুজনের চেহারায় উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট।
‘কি ব্যাপার, তুমি দরজা খুলছিলে না কেন? গরগর করে জিজ্ঞেস করল লরেন্স।’
‘কেন? কি হয়েছে?’
‘আমাদের এক্ষুনি যেতে হবে।’
‘কোথায়?’
‘সে কথা পরে শুনলেও চলবে। এখন তৈরি হয়ে নাও।’
‘আমি শুধু একটা ব্যাগ নেবো।’
‘ঠিক আছে, ব্যাগ নিয়ে চলো।’
‘কে কে যাচ্ছি আমরা?’
‘আমি, তুমি আর আঙ্কেল,’ লরেন্স বলল। ‘সঞ্জয় যে কোন সময় এখানে অ্যাট্যাক করতে পারে।’
‘আপনি জানলেন কি করে?’
‘তোমাকে তো আগেই বলেছি। বিশ্বস্ত লোক আছে আমার সঞ্জয়ের দলে।’
‘আচ্ছা।’
‘তুমি তৈরি?’
ব্যাগটা বিছানার একপাশে ছিল, তাতে বালিশের নীচ থেকে ছোট বাক্সটা ভরে ফেলল রাশেদ।
‘হ্যাঁ, তৈরি।’
‘চলো তাহলে।’
‘কি সে যাবো আমরা?’
‘মাইক্রো আছে একটা, রুম থেকে বেরুতে বেরুতে বলল লরেন্স।’
‘আপনি নিশ্চয়ই এখন গাড়ি চালাতে পারবেন না।’
‘আমি চালাবো তোমাকে কে বলেছে? আঙ্কেল এঞ্জেল আছেন না, তিনি চালাবেন।
অবাক হয়ে বৃদ্ধ এঞ্জেল ডি ক্রুজের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল রাশেদ। মৃদু হাসি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেছে বদ্ধ। পেছনে লরেন্স। দোতলা বাড়িটা পুরো অন্ধকার। সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলো তিনজন। ছোট একটা গ্যারেজ থেকে ঝরঝরে একটা মাইক্রোবাস বের করে আনল এঞ্জেল।
লরেন্স তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু এখন কারও কিছু নেই। আপাতত লরেন্সকে অনুসরন করতে হবে। ঘড়ির দিকে তাকাল রাশেদ। বারোটার মতো বেজে গেছে। বাইরে কোলাহল কিছুটা কম। অচেনা অজানা দুটো মানুষের সাথে রওনা দিয়েছে সে, কপালে কি আছে কে জানে, দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো রাশেদের বুক চিরে।
***
সকালে ব্রেকফাস্টে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি ড. আরেফিনের। এক কাপ চা শুধু। এখন দুপুর বারোটা বাজতে চলল। খিদেয় পেটে ছুঁচো নাচছে। কথামতো প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের সাথে রওনা দিয়েছেন তিনি। সন্দীপ আছে ড. কারসনের সাথে। এই গাড়িতে প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের সহকারি রামহরিও আছে অবশ্য। লোকটা চালু, তবে গাড়িতে চড়ামাত্রই কেন জানি নেতিয়ে পড়ে। কথা বলে না, তবে যখন বলা শুরু করে তখন ভালোই লাগে শুনতে। হিন্দি জানে না রামহরি। মাদ্রাজি ভাষায় কথা বলে যার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারাও কঠিন ড. আরেফিনের জন্য।
মাঝে মাঝে সামনে তাকাচ্ছেন ড. আরেফিন, ল্যাপটপে ইন্টারনেট চালু রেখেছেন। বিভিন্ন জিনিস ঘাটাঘাটি করছেন, তবে মনোযোগ দিতে পারছেন না। মনে হচ্ছে কোথাও কোন সমস্যা আছে।
নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন প্রফেসর। এই দুপুর বেলায়ও এভাবে কেউ ঘুমাতে পারে! আড় চোখে মাঝে মাঝে প্রফেসরের দিকে তাকাচ্ছেন ড. আরেফিন। লোকটা সহজ সরল নাকি বেশি চালাক বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। এর চেয়ে সন্দীপ অনেক বেশি সাবলীল, চেহারায় একটা গাম্ভীর্য্য ধরে রাখার চেষ্টা করলেও সহজে মেশা যায়। এই দুজনের মাঝখানের সমস্যাটা কি সেটা ধরতে পারলে অনেক কিছু বোঝা যেত, কিন্তু কেউ মুখ খুলবে বলে মনে হয় না।
সামনের গাড়ি থেমেছে। সম্ভবত চাকা পাংচার। তাই বাধ্য হয়ে গাড়ি থামাতে বাধ্য হলো ড্রাইভার। এক নাগাড়ে বসে থেকে হাতে পায়ে খিল ধরে যাচ্ছিল, এই সুযোগে একটু হেঁটে নেয়া যাবে ভেবে গাড়ি থেকে নামলেন ড. আরেফিন।
তাদের গাড়িগুলো থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে আরো একটি গাড়ি থেমেছে লক্ষ্য করলেন ড. আরেফিন। সন্দেহের কিছু না থাকলেও দূর থেকে গাড়িটার যাত্রীদের দেখার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু ড্রাইভার ছাড়া বাকি যাত্রীদের দেখা যাচ্ছে না।
সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা ব্যস্ত ভঙ্গিতে মোবাইলে কথা বলছে কারো সাথে। ড. কারসন মাত্র নেমেছেন মাইক্রোবাস থেকে। তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন ড. আরেফিন।
‘আমাদের আর বেশি সময় লাগবে না,’ মৃদু হেসে বললেন ড. কারসন। ‘চলে এসেছি প্রায়।’
‘আচ্ছা।’
‘প্রফেসর কি করছেন গাড়িতে বসে?’
‘ঘুমাচ্ছেন।’
‘ও। ঘুমাক। সামনে আমাদের অনেক কাজ।’
‘জি। যদি কিছু মনে না করেন একটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছিলাম?’ হেসে ড. আরেফিনের দিকে তাকালেন ড. কারসন।
‘সমস্যা নেই। বলুন।’
‘আমাদের এই গবেষনার কথা আর কেউ কি জানে?
‘আগেই বলেছি আমার ইউনিভার্সিটি জানে। এমনকি সুব্রামানিয়াম আর সন্দীপের ইউনিভার্সিটিও জানে।
‘যদি সাম্ভালা খুঁজে পাই আমরা তাহলে কি করবো?
হা হা করে হেসে ফেললেন ড. কারসন। আপনি এটা নিশ্চিত থাকুন আমরা সেখানে কোন শুটিং স্পট বানাবো না।’
বোকার মতো প্রশ্ন করেছেন বলে নিজেকেই ধমক দিতে ইচ্ছে করল ড. আরেফিনের।
‘মানে বলতে চাচ্ছিলাম, তারপরের পদক্ষেপ কি হবে?’
‘সেটা আসলে আমিও জানি না। সত্যি সত্যি যদি জায়গাটা থেকে থাকে, তাহলে তা ঢাকঢোল পিটিয়ে সারা পৃথিবীকে জানানো প্রয়োজন মনে করি না আমি।‘
‘এই ধরনের একটা সত্য তাহলে হয়তো চিরদিনের জন্যই ঢাকা পড়ে থাকবে?’
‘কিছু কিছু সত্য লুকিয়ে রাখাই ভালো,’ পাশ থেকে বলল সন্দীপ। সে এতোক্ষন পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল।
‘এতে হয়তো আমাদের ইতিহাসই বদলে যেতে পারে, মানবসভ্যতা এক নতুন মোড় নিতে পারে।‘
‘তা পারে। তবে এর কুফলও রয়েছে,’ ড. কারসন বললেন।
‘কি রকম?’
‘সারা পৃথিবী যদি এমন একটা জায়গার কথা জেনে যায় যেখানে ক্ষুধা নেই, মৃত্যু নেই, তাহলে দলে দলে লোক চলে আসবে এখানে। একটা অরাজকতার সৃষ্টি হবে।‘
‘সেটা অবশ্য ঠিক।‘
‘আসলে আমরা জানি না সামনে কি আছে। সাম্ভালা হয়তো সত্যিই একটা মিথ, আরো লক্ষ লক্ষ মিথের মতো। কাজেই সত্যি জিনিসটা আছে কি না নিশ্চিত হবার পরই আমরা একটা সিদ্ধান্তে যাবো,’ ড. কারসন বললেন। সুরেশের দিকে তাকিয়ে আছেন। ড্রাইভার স্পেয়ার চাকা লাগিয়ে নিয়েছে এর মধ্যে।
‘চলুন যাওয়া যাক, ড. কারসন বললেন।’
‘হ্যাঁ,’ বললেন ড. আরেফিন। হেঁটে পেছনের মাইক্রোটার দিকে এগিয়ে গেলেন।
একটু পর দুটো গাড়ি স্টার্ট দিলো। আয়নার পেছনের গাড়িটার অবস্থান লক্ষ্য করছিলেন ড. আরেফিন। ঐ গাড়িটাও স্টার্ট দিয়েছে। এখন আর সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তাদের অনুসরন করছে কেউ।
***
যজ্ঞেশ্বরের সঙ্গে সময় খারাপ কাটছে না। এমনিতে তিনি নিজে চুপচাপ মানুষ, কিন্তু যজ্ঞেশ্বর আলাপি। তার অভিজ্ঞতার ভান্ডারও বিচিত্র সব কাহিনীতে ভরপুর। রাতে যখন লোকজন কমে আসে, তখন সারাদিনের নির্বাক যজ্ঞেশ্বর যেন প্রান ফিয়ে পায়। কথা বলতেই ভালো লাগে লোকটার বুঝতে পেরেছেন তিনি, তাই আগ্রহি শ্রোতার ভূমিকায় ভালোই কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। নানা ধরনের গল্পের পশরা নিয়ে বসে যজ্ঞেশ্বর, এর মধ্যে অনেক কাহিনীই অলৌকিক, সেখানে তার নিজের গুনগানও থাকে।
মেঘালয়ের ছোট শহর ছেড়ে যজ্ঞেশ্বরের সাথে রওনা দিয়েছেন তিনি। হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যজ্ঞেশ্বর মাঝে মাঝে বিরতি দিচ্ছে যেখানে তার ভক্ত সংখ্যা প্রচুর। সেখানে একটানা দু’তিন থেকে আবার যাত্রা করেন দুজনে। এভাবেই চলছে। খাওয়া-দাওয়ার অভাব হয় না, ভক্তরা প্রচুর খাবার নিয়ে আসে। তবে বেশিরভাগ সময়ই সেসব খাবারে রুচি হয় না তার। যজ্ঞেশ্বর খাবারের ব্যাপারে রীতিমতো আগ্রহি। ভক্তদের সামনে কোনকিছু মুখে না তুললেও ভক্তরা যাওয়ার পর হামলে পড়ে খাবারের উপর। তিনি সামান্য কলা কিংবা আপেল খেয়ে নেন।
রাত হয়েছে। যজ্ঞেশ্বর ধ্যানে বসেছে। কিছুক্ষন আগেও প্রচুর ভক্ত ছিল সামনে। ধমকা-ধমকি করে তাড়াতে হয়েছে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতবাসীকে দেখে অবাকই লাগে তার। এরা এখনো শিক্ষার আলো পায়নি। নানা ধরনের সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। এখানে বাল্যবিবাহ চলছে, যৌতুক চলছে, পুত্রসন্তানের জন্য বিশেষ আবেদন-নিবেদন যজ্ঞেশ্বরকে সামলাতে হয়। সব কিছুরই সমাধান আছে যজ্ঞেশ্বরের কাছে। শুধু হাত তুলে আশীর্বাদ করে ভক্তদের, তাতেই নাকি ওদের মনোকামনা পূর্ন হবে। শুনে মনে মনে হাসেন তিনি।
জায়গাটা মেঘালয়ের সীমানার দিকে। বড় একটা টিলার উপর ঘাঁটি গেড়েছে যজ্ঞেশ্বর। চারদিক গাছগাছালিতে ঢাকা। রাতের অন্ধকারে গা ছমছমে একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। টিলার পুবে ছোট একটা গ্রাম। বৈদ্যুতিক আলোয় ছোঁয়া এখনো পায়নি গ্রামটা। সেখান থেকে আর আশপাশের দু’তিনটে গ্রাম থেকে সারাদিন পিলপিল করে মানুষ এসেছে। এখন এই রাতে চারদিক নীরব, শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।
গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। ভাবছেন যজ্ঞেশ্বরের সাথে এভাবে চলে আসা ঠিক হলো কি না। যজ্ঞেশ্বর অনেক কিছুই জানে, কিন্তু সেই জানা যেন অনেকটাই ভাসা ভাসা। ঠিক গভীরে যেতে পারেনি এখনো। হয়তো সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে এখনো। যজ্ঞেশ্বরের দীক্ষাগুরুর দেখা পেলে হয়তো অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলতো। কিন্তু গুরুর সাথে দেখা করার কোন ভাবলক্ষন পাওয়া যাচ্ছে না।
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন, ধ্যান ছেড়ে যজ্ঞেশ্বর কখন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাননি।
‘কি ভাবছেন আকাশের দিকে তাকিয়ে?’ পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো যজ্ঞেশ্বর।
‘কিছু না। আচ্ছা, জগতের সবই কি মায়া?’
‘এই প্রশ্নের উত্তর আমার চেয়ে ভালো জানেন আপনি। আমিও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে যাচ্ছি, পাইনি।’
‘সবাই বলে আপনার বয়স নাকি পাঁচশো বছর?’ যজ্ঞেশ্বরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘আমাদের দেশের মানুষের এটাই সমস্যা। যে কোন কিছুকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করতে ভালোবাসে। পাঁচশো বছর বেঁচে থাকলে বেঁচে থাকার খায়েশ মিটে যেতো।
হাসলেন তিনি কথাটা শুনে। বেঁচে থাকার ইচ্ছে তার এখনো মরে যায়নি। এখনো অনেক কিছু দেখার বাকি, বোঝার বাকি, শেখার বাকি।
‘আপনার গুরু এখন কোথায়?’
‘তিনি এখন ধর্মশালায়।’
‘ধর্মশালা? জায়গাটা কোনদিকে?’
‘আপনি যাবেন?’
‘আপনার গুরুর সাথে দেখা হওয়া খুব দরকার।
‘ঠিক আছে। আমরা আস্তে আস্তে সেদিকে এগুচ্ছি। তবে তিনি সেখানে থাকবেন কি না কে জানে।
‘কোথায় যান তিনি?’
‘আমরা স্ন্যাসীরা এক জায়গায় বেশিদিন থাকি না। বিচিত্র এই পৃথিবী, এর মানুষ। এগুলো না দেখলে জীবনটাই বৃথা।‘
‘তা ঠিক।’
‘ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল সকাল সকাল রওনা দেবো।’ বলে উঠে পড়েছে যজ্ঞেশ্বর।
ঘুমানোর জন্য ছোট্ট একটা কাঁথা ব্যবহার করে যজ্ঞেশ্বর, নিজের জন্যও একটা জোগাড় করেছেন তিনি। আজ রাতে ঘুম আসছে না। এরকম খোলা প্রান্তরে ঘুমানো অনেক কঠিন একটা ব্যাপার। যজ্ঞেশ্বরের সমস্যা হয় না, শোয়ামাত্র নাক ডাকা শুরু করে। কিন্তু তার ঘুম আসে না। অদ্ভুত সেই জায়গাটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। সারা পৃথিবী ঘুরে দেখেছেন, কিন্তু এই একটি মাত্র জায়গায় পা পড়েনি তার। এই যাত্রায় তা পূরন করতেই হবে যে করেই হোক।
আঘো ঘুম আর জাগরনে রাতটা পার করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মশার কামড়ে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। যজ্ঞেশ্বর এতো নির্বিকারভাবে ঘুমায় কি করে কে জানে। উঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন পায়চারি করলেন তিনি। রাশেদের কথা মনে পড়ছে, ছেলে আজিজ ব্যাপারির মুখটা ভেসে উঠছে বারবার। ওরা ভালো আছে নিশ্চয়ই, যদিও রাশেদকে নিয়ে খুব একটা ভরসা পাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে বড় কোন বিপদে পড়তে যাচ্ছে ছেলেটা। গতবার বাঁচানোর জন্য তিনি ছিলেন, এই বার ছেলেটা একা, সব প্রতিকুলতা একাই সামলাতে হবে রাশেদকে।
দূরের আকাশে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বললেন তিনি। সেখানে তারারা জ্বলছে মিটিমিটি, যেন হাসছে তার দিকে তাকিয়ে।
*
অধ্যায় ২৮
এতো চমৎকার একটা জায়গা দেখবেন কল্পনাও করেননি ড. আরেফিন। এ যেন ছবির মতো সাজানো। সবুজ আর সাদা মিলেমিশে এক হয়ে গেছে যেন। মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দূরের পাহাড় দেখছেন তিনি। চূড়ায় সাদা বরফের টুপি পড়ানো পাহাড়গুলো যেন ডাকছে কাছে যাওয়ার জন্য। শীতকাল মাত্র শুরু, ঠান্ডা বাতাস কেমন শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে। আঁকাবাঁকা পথ, খুব সাবধানে চালাতে হচ্ছে ড্রাইভারকে। ঘন্টাখানেক হলো হাইওয়ে থেকে বাঁক নিয়ে ধর্মশালার পথে এসেছে গাড়িটা। এই এলাকা দু’ভাগে ভাগ করা, আপার ম্যাকলডগঞ্জ আর লোয়ার ম্যাকলডগঞ্জ। আপার ম্যাকলডগঞ্জকেই সাধারনত ধর্মশালা বলা হয়ে থাকে আর এখানেই তিব্বতের অস্থায়ী রাজধানী করেছেন চৌদ্দতম দালাইলামা।
কুয়াশার মতো মেঘে মাঝে মাঝে ঢেকে যাচ্ছে গাড়িটা। ভালো লাগছে ড. আরেফিনের। এই অভিযানে না আসলে এতো চমৎকার দৃশ্য দেখা হতো না। দূরে দেবদারু গাছ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, আর আছে পাইন, ইউক্যালিপটাস গাছ। লম্বা লম্বা একেকটা গাছ যেন আকাশ ছোঁয়ার সাধ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে তাকালেন, প্রফেসর সুব্রামানিয়াম ঘুমাচ্ছে, সামনের সীটে বসা তার সাগরেদ রামহরিরও একই অবস্থা। ওদের ঘুম ভাঙানোর প্রয়োজনবোধ করলেন না ড. আরেফিন। হয়তো এই সমস্ত জায়গা ওদের পূর্বপরিচিত।
মাঝে মাঝে পেছনে তাকিয়ে ড. কারসনের গাড়িটা দেখে নিচ্ছেন তিনি। আরো কিছুদূর এগুলেই শহর, বলেছিল সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা। যদিও অনেকক্ষন হয়ে গেলেও শহরের কাছে এখনো পৌঁছেনি গাড়ি এটা নিশ্চিত।
মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো এই সময়। অচেনা নাম্বার। ঢাকা থেকে কেউ করেছে সম্ভবত। রিসিভ করলেন ড. আরেফিন।
‘হ্যালো।‘
‘আমি, কেমন আছো?’ স্ত্রীর গলা পরিস্কার চিনতে পারলেন।
‘কোন নাম্বার থেকে কল করেছো?’
‘বাইরে থেকে। বাসার অবস্থা কি জানো?’
‘কেন? কি হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করতে গিয়ে গলা কেপে উঠলো ড. আরেফিনের।
‘লন্ডভন্ড অবস্থা। পুরো বাড়ি এলোমেলো। বিশেষ করে তোমার রুম তছনছ করে ফেলেছে।‘
‘আমার রুম? কারা করেছে? তোমরা কোথায় ছিলে?’
‘আমি আর বুয়া সকালে বাইরে গেছি, গুলশানের দিকে। বাসা লক করে গিয়েছিলাম। বেশিক্ষন থাকিনি,ঘন্টাখানেক পরে এসে দেখি এ অবস্থা।‘
‘কি কি নিয়ে গেছে?’
‘সব ঘেঁটে দেখলাম। কিছুই নেয়নি।’
‘কিছুই নেয় নি?’
‘না। শুধু ঘাঁটাঘাঁটি করেছে, এলোমেলো করেছে। সম্ভবত কিছু একটা খুঁজছিল।’
‘তুমি পুলিশ ডেকেছো?’
‘না। ডাকিনি।’
‘তোমার ভাগ্নে রাসেলকে নিয়ে এসো। একা একা এই বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না।’
‘ওপাশ থেকে হাঁফানোর শব্দ পাচ্ছেন।’
‘শুনতে পাচ্ছো আমার কথা?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।’
‘কারা তোমার পেছনে লেগেছে আরেফিন?’ শান্ত স্বরে ওপাশ থেকে প্রশ্ন এলো।
‘জানি না।‘
‘ঠিক আছে। তবে একটাই কথা, সাবধানে থেকো। আর যতো তাড়াতাড়ি পারো চলে এসো।
‘চেষ্টা করবো।’
‘ঠিক আছে, রাখি তাহলে।‘
ফোন রেখে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে রইলেন ড. আরেফিন। ঝড় বয়ে যাচ্ছে মাথায়। কে বা কারা করতে পারে এই কাজ! এমন কোন শত্রু নেই তার, সাধারন ডাকাতেরা আসেনি এটা নিশ্চিত। টাকা-পয়সা, সোনা-গয়না কিছুই খোয়া যায়নি। তাহলে কিসের খোঁজে এসেছিল কেউ?
কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছিলেন না। হঠাৎ আচমকা ব্রেক করেছে গাড়িটা। হুমড়ি খেয়ে সামনে পড়ে যেতে যাচ্ছিলেন, কোনমতে নিজেকে সামলে নিলেন ড. আরেফিন। ঘুম ভেঙে গেছে প্রফেসর আর তার সহকারীর। অবাক চোখে চারপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি হয়েছে। তেমন কিছুই হয়নি। একটা বেড়াল রাস্তা পার হচ্ছিল, ওটাকে বাঁচাতে গিয়েই আচমকা ব্রেক কষতে হয়েছে ড্রাইভারকে। ভারতীয় মানুষ, কোথাও যাত্রার সময় বেড়াল পথ কাটলে সেটাকে অশুভ হিসেবে দেখে ওরা। কাজেই রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করালো ড্রাইভার। কিছু না বলে নেমে পড়লেন ড. আরেফিন। বাকি দুজনও নামলো।
ড. কারসনের গাড়িটা এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। হন্তদন্ত হয়ে নেমে এসেছেন ড. কারসন।
‘কি ব্যাপার, এভাবে হঠাৎ নেমে গেলেন কেন আপনারা?’
‘গাড়ির সামনে দিয়ে বেড়াল রাস্তা পার হয়েছে। কাজেই কিছুক্ষন পর ছাড়া রওনা দেয়া যাবে না,’ গম্ভীর মুখে বললেন প্রফেসর।
‘কি বলছেন? একজন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হয়েও এই ধরনের বিশ্বাস আছে আপনার?’
‘জি, আছে,’ বললেন প্রফেসর, সমর্থনের জন্য চারদিকে তাকালেন। সবাই আসলে একটু বিশ্রাম চাচ্ছিল, কাজেই সমর্থন পেতে সমস্যা হলো না প্রফেসরের। ঠিক হলো আধ ঘন্টা রাস্তার পাশে অপেক্ষা করে তারপর রওনা দেবে দলটা।
কিছু করার নেই, তাই চারপাশের পরিবেশটা দেখে নিচ্ছিলেন ড. আরেফিন। সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালার দিকে চোখ পড়লো এই সময়। লোকটা মোবাইল ফোনে কথা বলছে কারো সাথে। পাশে দাঁড়িয়েও একটা অক্ষর বুঝতে পারলেন না ড. আরেফিন। মনে কেমন সন্দেহ দানা বাঁধছে, এই লোকটাকে চোখে চোখে রাখতে হবে।
*
অধ্যায় ২৯
১৭৬৭ খৃস্টাব্দ,
পর্তুগীজ শাসিত মোজাম্বিক
মিচনারের দিনগুলো খারাপ কাটছে না। সারাদিন কাজ আর রাতে ঘুম। পশুর মতো খাটতে পারে সে, তাই রাতে ঘুমও খারাপ হয় না। এক ঘুমে রাত কাবার। গত কয়েকবছরে তার শরীর আরো শক্ত, পেশীবহুল হয়েছে, চেহারায় এসেছে স্থিরতা। সাদা চামড়ার লোক হিসেবে বাকিদের চেয়ে তার অবস্থান অনেকটাই ভালো। ইচ্ছে করলেই এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারে মিচনার, কিন্তু সঠিক সময়ের অপেক্ষায় রয়েছে সে। এখান থেকে যাওয়ার সময় এখনো আসেনি। তবে সময় ঘনিয়ে এসেছে এটা নিশ্চিত।
গত কয়েক বছরে নিজের মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে মিচনার। পরিবর্তন না বলে পরিবর্তনহীনতা বলা ভালো হবে। কালোদের দেশে আসার পর অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেলেও তার চেহারায় কোন পরিবর্তন আসেনি। ইচ্ছে করলে না খেয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারে সে, তাতে কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু কেউ যাতে বুঝতে না পারে এজন্য খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়নি সে। গত কিছুদিন ধরে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখছে মিচনার, প্রতিদিন একই স্বপ্ন দেখার কী মানে সে জানে না, জানতেও চায় না। বিশেষ একজন অনন্ত জ্ঞানের অধিকারি-তাকে খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে তাকে, তাহলেই তার মুক্তি মিলবে। কিন্তু মুক্তি চায় না মিচনার, এই জীবনটা তার ভালোই লাগছে। ক্ষুধা নেই, প্রেম নেই, আপন কারো ভালোবাসা নেই, আছে শুধু অনির্দিষ্টকাল বেঁচে থাকার সম্ভাবনা। তারপরও এই বেঁচে থাকাটাই পরম আনন্দের। এই জীবন ক’জনের ভাগ্যে মেলে।
পর্তুগীজ সেটেলাররা কালোদের এই দেশ ভালোই দখলে রেখেছে। এখান থেকে কালোদের তারা চালান দেয় নিজেদের অন্যান্য কলোনীগুলোতে। বিশেষ করে দক্ষিন আমেরিকার ব্রাজিলে জাহাজ ভরে ভরে দাস পাঠাচ্ছে তারা। ভারত যেমন বিখ্যাত তার মসলার জন্য, ব্রাজিল বিখ্যাত হয়েছে উঠেছে সেখানকার চিনিশিল্পের কারনে। পুরো ইউরোপে চিনি সরবরাহের দায়িত্বে আছে ব্রাজিলের কালো মানুষেরা। তবে ইদানিং নৌপথে ফরাসি আর ডাচরাও এগিয়ে এসেছে। দাস সংগ্রহের সবচেয়ে ভালো উৎস তাদের নজর এড়িয়ে যায়নি। ফলে সংঘর্ষ অনেকটাই অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এখন দেখার বিষয় পর্তুগীজরা তাদের দখল বজায় রাখতে পারে কি না। আগে আরবদের সংস্পর্শে এসে অনেক কালো মানুষই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছে। পর্তুগীজরা এখন এদের ঘাটায় না, বরং একসাথে মিলে মিশে কাজ করার চেষ্টা করে। লিসবনে মোজাম্বিককে আলাদা স্টেটের মর্যাদা দেয়া হয়েছে, যেমন দেয়া হয়েছে ভারতের সমুদ্রবর্তী অঞ্চল গোয়াকে।
সন্ধ্যার পর পর কাজ শেষ করে ছোট তাঁবুর মতো ঘরটায় এসেছে শুয়েছে। মিচনার। গ্রীষ্মকাল, বাইরে একবিন্দু বাতাস নেই। ছোট একটা হাতপাখা বানিয়ে নিয়েছিল সে কতোদিন আগে। জিনিসটা কেমন নেতিয়ে গেছে, আগের মতো ভালো বাতাস পাওয়া যায় না। কামরাটায় একাই থাকে মিচনার, পাশাপাশি অন্য কামরাটায় থাকে গঞ্জালেজ, পাতত আর ডি ক্যাসিয়াস। তিনটাই হাড়ে হারামজাদা। সারাদিন মাথায় বদ বুদ্ধি কিলবিল করে ওদের। দিনে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, রাতে গ্রাম থেকে মেয়ে মানুষ তুলে নিয়ে এসে ফুর্তি করে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ওদের জ্যান্ত পুতে ফেলতে। কিন্তু নিজেকে সামলায় মিচনার। মাথা গরম করে কিছু করার সময় এখনো আসেনি। সাত বছর পার হয়ে গেছে এখানে। আরো কিছুদিন থেকে যাওয়া যায়।
বাইরে হঠাৎ হট্টগোলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মিচনারের। পরপর দু’বার গুলির শব্দও পাওয়া গেল। বিছানায় উঠে বসল মিচনার। পরনের প্যান্ট গলিয়ে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। চারদিকে আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। অন্ধকারে এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছে লোকজন। ছোট্ট একটা ক্যাম্প এটা। খুব বেশি সৈন্য রাখা হয় না পাহারা দেয়ার জন্য। স্থানীয় নেতাদের সাথে আপোষের মাধ্যমে এখানে কাজ করে পর্তুগীজ প্রশাসন। কাজেই সাহায্য পাবার সম্ভাবনা এখন নেই বললেই চলে।
তাঁবুর একপাশে আড়ালে চলে এলো মিচনার। বিছানা ছাড়ার আগে গাদা পিস্তলটা সাথে নিতে ভোলেনি। কিন্তু আক্রমনকারীদের সাথে সামান্য এই অস্ত্র নিয়ে দাঁড়ানো নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। কাজেই চুপচাপ সবকিছু পর্যবেক্ষন করার সিদ্ধান্ত নিলো। পাশের কামরা থেকে বেশ হৈ চৈ ভেসে আসছে। কালো কয়েকজন টেনে হিঁচড়ে বের করে এনেছে পাতো আর গঞ্জালেজকে। হাতের বর্শা দিয়ে একটু পরপর খোঁচা দিচ্ছে, বিশ্রীভাষায় গালাগাল করছে। বোঝাই যাচ্ছে এই তিন শয়তানকে শায়েস্তা করার জন্য আক্রমন করেছে স্থানীয় কালোরা। সোয়াহিলি গোত্রের লোক ওরা, এমনিতে শান্ত, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। কিন্তু মা-বোনদের ইজ্জতে হাত দিলে কেউই সেটা সহ্য করে না। ছোট এই পর্তুগীজ ক্যাম্পটা আজ সেটাই প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে।
আট থেকে দশ জন পর্তুগীজকে ক্যাম্পের মাঝে জড়ো করা হয়েছে। তাদের ঘিরে আছে সোয়াহিলী যোদ্ধারা। মুখে রঙ মেখে, হাতে লম্বা বর্শা কিংবা বাঁকানো তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। পাতো আর গঞ্জালেজকে আলাদা করা হয়েছে বাকিদের কাছ থেকে। লোকগুলোর মাঝে ডি ক্যাসিয়াসকে চোখে পড়ল না। হয়তো পালিয়েছে সময়মতো, ভাবলো মিচনার।
স্থানীয় বাদ্যযন্ত্রে যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছে কেউ, অতর্কিত হামলায় জয় পেয়েছে যযাদ্ধারা। এখন উদযাপন করার সময়। পাতো আর গঞ্জালেজ ছাড়া বাকিদের একে একে মেরে ফেলল ওরা। বর্শার আগা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে। বেশি সময় লাগলো না। এরা সবাই নিরাপরাধ, সাধারন পর্তুগীজ নাগরিক, এতো দূর দেশে আনা হয়েছে। চাষাবাদের কাজে লাগানোর জন্য। এরাই মারা গেল প্রথমে। এবার আসল অপরাধিদের পালা। পাতত আর গঞ্জালেজ এতোক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বজাতিদের মৃত্যু দেখছিল। এখন নিজেদের মরন কাছে এসেছে দেখে কাঁপতে লাগল ভয়ে।
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এসব দেখবে না পালাবে ঠিক করতে পারছিল না মিচনার। পালানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তবে শয়তান দুটোর শাস্তি দেখে যেতে পারলে ভালো লাগতো। অত্যাচারীর সাজা হবেই।
পিছনে মৃদু ফোঁপানোর মতো আওয়াজ শুনে তাকাল মিচনার। উবু হয়ে বসে আছে কেউ, তাঁবুর পেছনে। কাঠামোটা চেনা চেনা লাগছে। একটু এগিয়ে গেল। এবার পরিস্কার হলো, ডি ক্যাসিয়াসের চেহারাটা। কাঁদছে। বুঝতে পারছে মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে, এখান থেকে পালাতে পারবে না। যে কোন সময় ধরে ফেলবে সোয়াহিলি যোদ্ধারা। মিচনারকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন, যেন বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।
‘ওদের মেরে ফেলেছে?’ কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ডি ক্যাসিয়াস।
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল মিচনার।
‘এবার আমার পালা। আমি পালাতে পারবো না, নিজে নিজেই বলছে ডি ক্যাসিয়াস। তুমি পালাও মিচনার। তোমার কোন দোষ না থাকলেও ওরা তোমাকে ছাড়বে না।’
উত্তরে কিছু বলল না মিচনার। ইশারায় উঠে দাঁড়াতে বলল ডি ক্যাসিয়াসকে। অবাক হলেও উঠে দাঁড়াল ডি ক্যাসিয়াস। মিচনার ততোক্ষনে বুকে হেঁটে এগুতে লাগল সামনে, দেখাদেখি ডি ক্যাসিয়াসও আসতে লাগল পেছন পেছন।
বেশ কিছুদূর এসে একবার তাকাল মিচনার। পাতোর মাথা আলাদা হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর গঞ্জালেজের মাথা নিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করছে এক সোয়াহিলি যোদ্ধা।
এখানে আরো কিছুদিন থাকার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু স্বপ্নের সেই কণ্ঠস্বরের নির্দেশমতো আরো পূবে যাওয়ার সময় চলে এসেছে। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা ক্যাম্পটাকে পেছনে ফেলে ঘন জঙ্গলে হারিয়ে গেল মিচনার, অনেক দিন পর সঙ্গি পেয়েছে সে, ডি ক্যাসিয়াস বিনা প্রশ্নে অনুসরন করছে মিচনারকে।
***
বুড়ো এঞ্জেল ভালো গাড়ি চালায়। সারারাত চালিয়ে এসেছে, অথচ একবারও ঝাঁকিতে ঘুম ভাঙ্গেনি রাশেদের। ঠিক এগারোটায় ঘুম ভাঙল। পাহাড়ি একটা বাঁক পার হচ্ছে। তখন মাইক্রোবাসটা। এসব পথ আর বাঁক যেন মুখস্থ এঞ্জেলের। দক্ষ হাতে পার হয়ে যাচ্ছে একেকটা বাঁক। হাই তুলে পাশে তাকাল রাশেদ। লরেন্স ঘুমাচ্ছে এখনো, ক্রাচটা একপাশে সরানো। অন্যপাশে ছোট একটা ল্যাপটপ, সাথে ওয়ারলেস ইন্টারনেট সংযোগ আছে।
জায়গাটা পরিচিত রাশেদের। এই কয়েকদিন আগেই রাজুকে সাথে নিয়ে এসেছিল। আবার বান্দরবনে যাচ্ছে সে। এবার অপরিচিত দুজনের সাথে। এভাবে বিশ্বাস করে এদের সাথে আসা ঠিক হলো কি না একবারও ভেবে দেখেনি কেন ভেবে অবাক হচ্ছে এখন রাশেদ। অবশ্য রাতের পরিস্থিতি এমন ছিল চিন্তা করার খুব বেশি সুযোগ ছিল না।
আর অল্প গেলেই বান্দরবন শহর। চিন্তার কিছু নেই, তাই আবার হেলান দিয়ে বসে পড়ল রাশেদ। ঘুমিয়ে গেল কিছুক্ষনের মধ্যেই।
গভীর বনে ছুটছে রাশেদ, কিছু একটা ধাওয়া করছে পেছনে। অন্ধকার বনের আরো ভেতরে চলে যাচ্ছে, দৌড়াতে গিয়ে পায়ে কাঁটা ফুটছে, এখানে সেখানে কেটে যাচ্ছে, কিন্তু কোন কিছুকেই গ্রাহ্য করছে না। এক নাগাড়ে ছুটে যাচ্ছে রাশেদ, পেছন ফিরে দেখার চেষ্টা করছে কে ধাওয়া করছে তাকে, কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু বন কাঁপিয়ে কিছু একটা আসছে তাকে ধরতে। দেখা যাচ্ছে, চেহারাটা পরিচিত, খুবই পরিচিত, কিন্তু মনে করতে পারছে না কে লোকটা। হঠাৎ পুরো পৃথিবী যেন কেঁপে উঠলো, ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল রাশেদ। ঘামছে, পানির পিপাসা পেয়েছে খুব। বিছানার পাশে ছোট একটা সোফায় বসে আছে লরেন্স, ল্যাপটপে কাজ করছে। রাশেদের দিকে তাকাল।
‘ঘুম ভাঙল এতোক্ষনে?’ বলল লরেন্স, ব্যস্ত হয়ে পড়ল আবার ল্যাপটপে।
উঠে দাঁড়াল রাশেদ। তাকাল রুমটার দিকে। চমৎকার একটা হোটেল রুম। বেশ বড় আর খোলামেলা। জানালা দিয়ে আলো এসে পড়েছে।
‘আপনি এই রুমে?’
‘আংকেল আর আমি ডাবল একটা রুম নিয়েছি, তিনি ঘুমাচ্ছেন,’ বলল লরেন্স, ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়ে, একটু শব্দেই উনার ঘুম ভেঙে যায়, তাই তোমার রুমে এসে বসেছি।’
‘হোটেলে ঢুকেছি কখন আমরা?’
‘বারোটার দিকে।
‘আমার তো কিছুই মনে নেই,’ মাথা ঝাঁকাল রাশেদ, মাইক্রোবাস থেকে নেমে হোটেল রুমে আসা, এই রকম কিছু মনে পড়ছে না কেন। লরেন্স নিশ্চয়ই কোলে করে নিয়ে আসেনি তাকে?
‘ঘুমের ঘোরে ছিলে, তাই টের পাওনি,’ বলল লরেন্স।’
‘আমার ব্যাগ কোথায়?’
‘আমার কাছে।’
আর কথা বাড়াল না রাশেদ, চুপচাপ বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। এতো গভীর ঘুমের কারন এবার কিছুটা আন্দাজ করা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই খাবারে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল লরেন্স যাতে তার ব্যাগটা নিতে পারে। সফল হয়েছে লোকটা। ঐ ব্যাগটা ছাড়া তার আর কোন মূল্য নেই এখন লরেন্সের কাছে। ব্যাগটা আবার ফেরত পেতে হবে। নইলে রাজুকে বাঁচানোর কোন অবলম্বনই থাকবে না তার কাছে।
বাথরুম থেকে বের হয়ে নীচে নেমে এলো রাশেদ। খাওয়া-দাওয়া করা দরকার। লরেন্স বা ওর চাচার হাত থেকে কিছু খাওয়া যাবে না।
হোটেলের রিসেপশনে দাঁড়াল রাশেদ। বাইরে যাওয়া যায় খাবারের জন্য, প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে ম্যানিব্যাগটা দেখে নিলো। বেশ কিছু টাকা-পয়সা আছে। সাথে। চলতে সমস্যা হবে না।
দুপুর গড়িয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় চলে এসেছে রাশেদ। একটু দূরে মোটামুটিমানের একটা হোটেল দেখা যাচ্ছে। পেছনে ফিরে তাকাল একবার। তার তিনতলা হোটেল রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে একজন। লরেন্স। ঘুরে হাঁটতে থাকল রাশেদ। লোকটার ভাবসাব ভালো ঠেকছে না। রাজুর বিপদ বলে, নইলে এতোক্ষনে ঢাকায় চলে যেতে পারতো রাশেদ। গুপ্তধনের খোঁজ করার ইচ্ছে তার কোন কালেই ছিল না, এখনো নেই। লরেন্স তার চৌদ্দপুরুষের ধন উদ্ধার করে ধনী হয়ে যাক, তাতে তার কিছু যায় আসে না।
অন্যমনস্কভাবে হাঁটছে রাশেদ। পেছনে ষন্ডামার্কা অনুসরনকারীকে তাই লক্ষ্য করলো না।
***
এবার একটানা হাঁটা। এতে সমস্যা নেই তার, বরং হাঁটতেই বেশি ভালো লাগে। গতবার ভারতবর্ষ যেমন দেখেছিলেন এবার অনেক পরিবর্তন চারদিকে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে প্রত্যন্ত গ্রামে। ট্রেন চলছে, বাস চলছে, আকাশে উড়োজাহাজ। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের দিন শেষ, টরেটক্কা টেলিগ্রাম এমনকি ডাক ব্যবস্থাও অচল প্রায়। হাতের মুঠোয় থাকা ছোট একটা যন্ত্রে পুরো পৃথিবী যেন ধরা পড়েছে। জিনিসটা ছেলের হাতে দেখেছেন। কিন্তু হাতে নিয়ে দেখা হয়নি,প্রয়োজনবোধ করেননি আসলে। এখনো যে প্রয়োজন আছে তা নয়, কাকে ফোন করবেন তিনি। কারো নাম্বারই তো জানা নেই। আর পরিচয়ই বা দেবেন কি? আব্দুল মজিদ ব্যাপারি এখন হারিয়ে যাওয়া এক বৃদ্ধের নাম।
যজ্ঞেশ্বর এবার আর কোথাও থামবে না, গন্তব্য ধর্মশালা। কথা প্রসঙ্গে জানতে পেরেছেন ধর্মশালার পুরানো নামই বাগসু। যজ্ঞেশ্বরের গুরু নাকি এখন সেখানেই আছে। দিনের বেলা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেন দুজনে আর রাতে হাঁটেন। যজ্ঞেশ্বরের কোন ক্লান্তি নেই হাঁটায়। কাঁধে ছোট একটা ঝোলা আর হাতে ত্ৰিল নিয়ে অবিরাম হেঁটে যায়।
বিকেল হয়ে গেছে। মেঠোপথের ধারে ছোট একটা হোটেলে খেয়ে নিয়েছে যজ্ঞেশ্বর। খিদে লাগলেও খাবারের ধরন দেখে পছন্দ হয়নি তাই খাওয়া হয়নি তার। মোটা রুটি আর সজি-ডাল। পুষ্টিকর খাবার সন্দেহ নেই, কিন্তু খাবারের উপর মাছি উড়ছিল বলে খাওয়ার শখ মিটে গেছে।
নিজের ছোট চাদর পেতে শুয়ে আছেন তিনি। মৃদু মন্দ বাতাসে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। যদিও এই সময়ে ঘুমানো ঠিক হবে না। ঘুম আর আধো ঘুমে দূরে পরিচিত মানুষটাকে আসতে দেখলেন তিনি। যজ্ঞেশ্বর আসছে। হেলে দুলে হাঁটে, অনেকটা সেই মানুষটার মতো।
.
খৃস্টপূর্ব ৩২৩ সাল
ব্যবিলনের আকাশে ঝকঝকে চাঁদ। জুন মাসের মৃদু গরমে শহরবাসি মোটেও বিরক্ত নয়। কিছুদিন হলো এখানে অবস্থান করছেন পুরো গ্রীক এবং পারস্য অধিপতি মহান আলেকজান্দার। নেবুচাঁদনেজারের প্রাসাদে তাই দিনরাত কড়া পাহারা। আলেকজান্দারের সৈন্যরা শহরের বাইরে তাঁবু গেড়েছে, সেনাপতিদের রাখা হয়েছে রাস্ট্রীয় অতিথিশালায়।
মহান আলেকজান্দার গত তেরো বছরের একটানা অভিযানে ক্লান্ত। ক্লান্ত তাঁর সৈনিকেরাও। তারা বাড়ি ফিরতে চায়। ভারত অভিযানে গিয়ে তাই এই কারনেই আর সামনে অগ্রসর হননি আলেকজান্দার। স্ত্রী রোক্সানার চেহারা দেখার আকুলতা আর সিংহাসনের উত্তরাধিকারি জন্ম নেয়ার সময় পাশে থাকার ইচ্ছেয় ম্যাসিডোনিয়া যাবেন তিনি। সেখানে আরো কিছুদিন বিশ্রামের পর আবার বেরুবেন নিজের সীমানা আরো বাড়ানোর জন্য।
দেয়ালে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে পার্সিয়াস। আলেকজান্দারের যুদ্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রনাদাতা। যে কোন যুদ্ধের আগে তার সাথে পরামর্শ করতে ভোলেন না মহান আলেকজান্দার। গত তেরো বছর ধরে আলেকজান্দারের সাথে আছে সে। কোন যুদ্ধে পিছ পা হতে দেখেনি সে তার সম্রাটকে। বরং সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখেছে। দারিয়ুস তার বিশাল সেনাবাহিনি নিয়েও পারস্যকে রক্ষা করতে পারেনি। যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেছে। তার পুরো পরিবার আলেকজান্দারের দারুন ভক্তও। এমনকি দারিয়ুসের এক বোন আলেকজান্দারের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ।
এই ব্যক্তি পুরো পৃথিবী জয় করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসবে, এই বিশ্বাস তার আছে। বয়স মাত্র বত্রিশ। নিজের বয়সের কথা চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো পার্সিয়াসের বুক চিরে।
কাল সকালে বন্ধু মেদিয়াসের প্রাসাদে যাওয়ার কথা। মেদিয়াস আলেকজান্দারের অন্তরঙ্গ বন্ধু। লোকটাকে কখনো বিপজ্জনক মনে হয়নি পার্সিয়াসের কাছে। কিন্তু ইদানিং কেন যেন অজানা এক আশংকা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে। মনে হচ্ছে কোথাও কোন ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠছে। বিশেষ করে এন্টিপাটার আলেকজান্দারের অনুপস্থিতিতে মেসিডোনিয়া আর গ্রীসে অরাজকতা সৃষ্টির পায়তারা করছে, এই খবর কানে এসেছে পার্সিয়াসের। এমনকি আলেকজান্দারের মা চিঠি পাঠিয়েছেন এন্টিপাটারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। আলেকজান্দার শুনে রাগে চিড়বিড় করে উঠেছে, ডেকে পাঠিয়েছে এন্টিপাটারকে, জবাবদিহি করার জন্য। কিন্তু নিজে না এসে এক ছেলেকে পাঠিয়েছে এন্টিপাটার। ব্যাপারটা কিছুটা হলেও অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে পার্সিয়াসের মনে।
এন্টিপাতার আলেকজান্দারের বাবার আমলের লোক, যে কোন কাজে তার উপর ভরসা করতেন সম্রাট ফিলিপ। ছেলের শিক্ষার দায়িত্ব তিনি দিয়েছিলেন এরিস্টেটলের উপর, যে এরিস্টেটল আবার এন্টিপাটারেরও গুরু ছিল। আলেকজান্দারের মা অলিম্পিয়ার সাথে এন্টিপাটারের বিশেষ সম্পর্কের ব্যাপারে কানাঘুষা শোনা গিয়েছিল, এমনকি অনেকে ধারনা করে আলেকজান্দারের সত্যিকার বাবা হচ্ছে এন্টিপাটার।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আলেকজান্দারের সাথে দেখা করার কথা ভাবল পার্সিয়াস। দীর্ঘদিন পরিশ্রমের পর এবার সত্যিই একটু অবসর কাটাতে চাইছে আলেকজান্দার। সেই অবসর কোনভাবে নষ্ট করতে দিতে রাজি নয় পার্সিয়াস, কিন্তু ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ন, কেননা এর সাথে সম্রাটের জীবন-মরনের প্রশ্ন মিশে আছে।
প্রাসাদে যে কোন সময় প্রবেশের অধিকার আছে পার্সিয়াসের, আর রাতের এই সময়টা হয়তো নিরিবিলিতে পাওয়া যাবে মহান সম্রাটকে। কাজেই দ্বিধা না করে দৃঢ় পদক্ষেপে প্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়াল পার্সিয়াস। রক্ষীরা বিনাবাক্য ব্যয়ে ঢুকতে দিল তাকে।
প্রবেশপথে দেখা হয়ে গেল আলেকজান্দারের অন্যতম অ্যাডমিরাল নিয়ারচুসের সাথে। বোঝাই যাচ্ছে যথে’ পরিমান পান করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে কিছুটা। পার্সিয়াসকে দেখে এগিয়ে এলো।
‘কি হে পার্সিয়াস, এতো রাতে? হেড়ে গলায় জিজ্ঞেস করল নিয়ারচুস।’
‘একটু কাজ ছিল।’
‘ক্যাসান্দার আছে ভেতরে, যাও দেখ কথা বলতে পারো কি না।’
‘ক্যাসান্দার? এতো রাতে?’
‘বাপের সাফাই গাইতে এসেছে। আমি বলে এসেছি ওর কথা কানে না তুলতে।’
‘আচ্ছা, আমি যাই।’
‘যাও, কাল দেখা হবে মেদিয়াসের ওখানে, বলে টলতে টলতে বেরিয়ে গেল নিয়ারচুস। প্রাসাদের বাইরে ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়ানো ছিল। উঠে চলে গেল।
কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে আবার হাঁটতে থাকল পার্সিয়াস। ক্যাসান্দারের এতো রাতে উপস্থিতি ভালো ঠেকল না তার কাছে।
প্রাসাদের একাংশ অন্ধকার। দোতলার একটা রুমে আলো জ্বলছে। আলেকজান্দার জেগে আছেন তাহলে। ভীরু পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো পার্সিয়াস। সিঁড়িতে লোলাসের সাথে দেখা হলো। ক্যাসান্দারের ভাই, এন্টিপাটারের ছেলে। হাবাগোবা টাইপের। সম্রাটের দেখাশোনা করে, খাবার-দাবার পরিবেশনের দায়িত্বে আছে। রুপোর ট্রে-তে কিছু খাবার আর পেয়ালা দেখা যাচ্ছে। সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে লোলাস, যাতে কিছু পড়ে না যায়। পার্সিয়াসকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত মনে হলো বেচারাকে। যেন কোন অপরাধ করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে। ওকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত গতিতে উঠে গেল পার্সিয়াস, বয়স তার চল্লিশের উপর হলেও শারীরিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী।
রুমের প্রহরীরা আটকালো না পার্সিয়াসকে। ভেতরে ঢুকে কিছুটা থমকে গেল। আলেকজান্দার একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। এই কদিনেই বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে, যদিও মাত্র তেত্রিশ চলছে তার। একটু দূরে ক্যাসান্দার দাঁড়ানো, বিমর্ষ চেহারায়। পার্সিয়াসকে দেখে মুখে হাসি ফুটল আলেকজান্দারের।
‘কি ব্যাপার পার্সিয়াস’ মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন আলেকজান্দার।
‘মহানুভব, আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।’
ক্যাসান্দারকে ইশারায় চলে যেতে বললেন আলেকজান্দার। কিছুটা বিরক্ত দৃষ্টিতে পার্সিয়াসের দিকে তাকিয়ে বের হয়ে গেল ক্যাসান্দার। এই সময় রুমে লোলাস ঢুকল, খাবার-দাবার নিয়ে।
‘তুমি পরে এসো,’ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন আলেকজান্দার।
নীরবতা নেমে এলো কামরায়। কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছিল না পার্সিয়াস।
‘কি বলতে চেয়েছে বলো, আলেকজান্দার বললেন।’
‘মহানুভব, ম্যাসিডোনিয়া আর এথেন্সে বিদ্রোহ দানা বাঁধছে…..’
‘এসব আমি জানি।
‘মহানুভব, এই মুহূর্তে কাউকে কাউকে আমাদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা উচিত। বিশেষ করে ক্যাসান্দার, লোলাস…’
‘ক্যাসান্দার, লোলাস… ওরা পিঁপড়ে! আমার কি ক্ষতি করবে?’
‘তা ঠিক। তবে আগামী কয়দিন খুব সাবধানে থাকতে হবে। কোথাও কোন ষড়যন্ত্র দানা বাঁধছে।’
‘তোমার আগের অনেক পরামর্শ কাজে লাগিয়ে আমি উপকৃত হয়েছি। তবে এটা বিশ্বাস করতে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে ক্যাসান্দার আর লোলাসের মতো অপদার্থ আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে।’
‘আর মেদিয়াস…’
‘ওর সম্পর্কে কিছু বলতে হবে না। সে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমার ক্ষতি হোক এমন কিছুই সে করবে না।’
চুপ করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল পার্সিয়াস। আলেকজান্দারের সামনের বিপদ সম্পর্কে সে নিজেও ততোটা নিশ্চিত নয়, আর ধারনার উপর ভর করে একজন বিশ্বজয়ী সম্রাটের সাথে কথা বলা যায় না। তবে মেদিয়াস সম্পর্কে আসলে বলার কিছু নেই। সম্রাটের প্রতি তার আনুগত্য প্রশ্নাতীত, কিন্তু আগামীকাল সেখানে সাবধানে থাকার কথা বলতে চেয়েছিল সে সম্রাটকে।
‘আর কিছু বলবে?’
‘জি না, মহানুভব। আমি আসি।’
‘কাল সারাদিন আমি মেদিয়াসের ওখানে কাটাবো। তুমি চলে এসো।’
‘জি।’
‘এবার তুমি যাও, আমি গোসলে যাবো।
চুপচাপ বেরিয়ে এলো পার্সিয়াস। এখানে থাকার দিন শেষ হয়েছে। এই প্রথমবারের মতো সম্রাট তার কথায় কর্ণপাত করলো না। কিছুটা রাগ হচ্ছিল নিজের উপর। কিন্তু যথেষ্ট প্রমান কিংবা কোন আলামত নেই তার কাছে।
বাইরে পুরো জোছনা। শহরের একপাশে সারি সারি তাঁবু, সেখানে নিজের তাঁবুতে গিয়ে শুয়ে পড়লেই হয়। কিন্তু আজ রাতে কিছু ভালো লাগছে না। শেষবারের মতো ব্যবিলনের আকাশের দিকে তাকাল। সেখানে অজগ্র তারা জ্বলছে, নিভছে। ব্যবিলনের শূন্যদান এর মধ্যেই প্রায় বিলীন হয়ে গেছে, অদূর ভবিষ্যতে এই শহর কোথায় তলিয়ে যাবে তার নিশ্চয়তা নেই। এখান থেকে অনেক দূর চলে যেতে হবে। আর পেছনে তাকানোর মানে নেই, হাঁটতে হাঁটতে অদ্ভুত সুন্দর শহরটা পেরিয়ে এলো সে।
যজ্ঞেশ্বরের হেলেদুলে হাঁটা দেখে নিয়ারচুসের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। সেদিন রাতে এভাবেই হাটছিল নিয়ারচুস। তার সাথে আর কোনদিন দেখা হয়নি। সেই রাতে চলে আসার দশদিনের মধ্যে আলেকজান্দার মারা যান। কি কারনে মারা যান তা কেউ বের করতে পারেনি। সম্ভবত খাদ্যে বিষক্রিয়া, কিংবা অজানা কোন জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন, কেউ তা বের করতে পারেনি। শুধু অসম্ভব ব্যথায় শেষ ক’দিন কষ্ট পেয়েছিলেন এই দ্বিগ্বিজয়ী যোদ্ধা। অনেক দূরে বসেও সব খবর পেয়েছিলেন তিনি। কষ্ট পেয়েছিলেন, কিন্তু এর বেশি কিছু না। লোকটাকে সাবধান থাকতে বলেছিলেন, শোনেনি।
যজ্ঞেশ্বর এসে দাঁড়িয়েছে সামনে, চেহারা আনন্দে ঝলমল করছে।
‘আপনার জন্য একটা খবর আছে?’
‘কি খবর?’ শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন তিনি।’
‘আমার গুরুজি ধর্মশালায় আছেন এখন। থাকবেন আর দুদিন।’
‘দুদিন হেঁটে আমরা পৌঁছাতে পারবো ধর্মশালায়?
‘হেঁটেই যেতে হবে তার কোন মানে নেই। রাতে বাস ছাড়বে, কালকের মধ্যে চন্ডিগড় পৌঁছাতে পারবো আমরা। সেখান থেকে অন্য কোনভাবে ধর্মশালায় যাওয়া যাবে।
‘ঠিক আছে, বাস ছাড়বে কয়টায়?’
‘এগারোটায়।’
‘আপনি তৈরি হয়ে নিন। আমি এর মধ্যে টিকিটের ব্যবস্থা করে আসি।’
‘আমি সবসময় তৈরি।
হেসে তাকাল যজ্ঞেশ্বর, যেন এরকম একটা উত্তরই আশা করছিল সে। চাদর ভাঁজ করে ছোট ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এখান থেকে বাসস্টপ বেশ খানিকটা দূরে। এইটুকু পথ হেঁটে যেতে হবে। যজ্ঞেশ্বরও তার তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিয়েছে।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। আর তিনি বের হয়েছেন অচেনার উদ্দেশ্যে।
***
ছোটবেলা থেকেই অদ্ভুত নেশা ছিল আকাশের। পুরানো জিনিসপত্র সংগ্রহ করা। সেটা নবাবী আমলের মুদ্রাই হোক, বিশেষ কোন স্ট্যাম্প অথবা পুরানো কোন চিত্রকর্ম। সেই অদ্ভুত নেশা একসময় কিভাবে পেশায় রুপ নিলো নিজেও টের পায়নি বিনোদ। ততদিনে ব্যবসাটার সাথে জড়িয়ে গেছে দারুনভাবে। ভারতের এমন কোন প্রত্নতত্ত্ববিদ অথবা সৌখিন সংগ্রাহক নেই যে তাকে চেনে না। কিন্তু সম্রাট আকবরের ব্যবহৃত একটা তলোয়ার বিক্রি করতে গিয়ে দারুন বিপদে পড়ে যায় সে। ইন্ডিয়ান গোয়েন্দা সংস্থার পেতে রাখা ফাঁদ থেকে কোনমতে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যায় নেপালে। সেখান থেকে সোজা লন্ডন, প্যারিস। এরপর ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক অ্যান্টিক চোরাকারবারিদের দলে জড়িয়ে যায়। তৈরি করে নিজের এক শক্ত নেটওয়ার্ক। সারা দুনিয়া থেকে মাল আসে তার কাছে, চোরাই পথে। সেগুলো সঠিক জায়গায় বিক্রি করার দায়িত্ব তার। মুনাফা খারাপ না, প্যারিসে নিজের বিশাল বাড়ি, লন্ডন আর মাদ্রিদে অ্যাপার্টমেন্ট, দুবাইয়ে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা এরকম আরো অনেক সম্পদ গড়ে তুলেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু অ্যান্টিক ব্যবসা থেকে নিজেকে সরাতে পারেনি। এটা যেন তার রক্তে মিশে আছে।
প্রায় পনেরো বছর পর ভারতে পা রেখেছে সে। আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ নেই আর। বাবা-মা মারা গিয়েছিলেন অনেক আগেই। একভাই সুইডেনে থাকে, ব্যবসা করে, বোনটা থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। এছাড়া ছুটো-ছাটা আত্মীয়স্বজন যারা আছে তারা এখন আর তাকে দেখে চিনতে পারবে না এটা নিশ্চিত। বিনোদ খান্না থেকে বিনোদ চোপড়া নাম বদলে নিয়েছিল অনেক আগেই। কাজেই এমিগ্রেশন কিংবা অন্য কোথাও ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই। আর পনেরো বছর আগের একটা ঘটনার কথা মনে করে নেই পুলিশ বাহিনী। দেশে হাজার হাজার অঘটন ঘটছে।
ধর্মশালায় পৌঁছেছে বেশিক্ষন হয়নি। ম্যাকলডগঞ্জে এর আগের বার যখন এসেছিল তখন এতোটা সাজানো গোছানো ছিল না। এখন পর্যটকদের জন্য চমৎকার সব হোটেল তৈরি হয়েছে, প্রফেশনাল গাইড আছে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। ড. কারসন যে হোটেলে উঠেছেন তার উল্টোদিকের ছোট রেস্টহাউসটায় উঠেছে বিনোদ চোপড়া। একটানা গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত। এখন বিশ্রাম নেয়া দরকার।
*
অধ্যায় ৩০
১৭৯৯ খৃস্টাব্দ
সন্ধ্যায় ঘরে ঢুকে কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো মিচনার। অন্যদিন ঘরে আলো জ্বলে, ছোট একটা হ্যারিকেনের আলোয় ঘরটাকে প্রানময় মনে হয় মিচনারের কাছে। অথচ আজ অন্ধকার ঘরটায় ঢুকেই বুঝতে পেরেছে কিছু একটা ঠিক নেই। ঘরের দুপাশে ছোট দুটি বিছানা পাতা, পাশে ছোট একটা টেবিল। দেয়ালে জিশু খৃস্টের ছোট একটা মূর্তি টানানো। ডি ক্যাসিয়াসের কাজ।
ছোট বিছানায় ডি ক্যাসিয়াস শুয়ে আছে, শুকনো দড়ির মতো। সারা শরীরে শুধু হাড় ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। চোখ গর্তে ঢুকে গেছে। সাদা দাড়ি আর চুলে মুখভরা। হাত নেড়ে ইশারায় মিচনারকে কাছে ডাকল ডি ক্যাসিয়াস।
চুপচাপ পাশে গিয়ে বসল মিচনার। গত বত্রিশ বছর ধরে তার সঙ্গি ডি ক্যাসিয়াস। এই সময়ে ডি ক্যাসিয়াস তরুণ থেকে বৃদ্ধে পরিণত হয়েছে, যদিও তার কোন পরিবর্তন ঘটেনি এই দীর্ঘ সময়ে। মৃত্যুর সাথে এখন অবিরাম যুদ্ধ চলছে এই বৃদ্ধের, যে কোন সময়ে হেরে যেতে পারে। এতো দীর্ঘ সময় একসাথে থেকে মিনারের রহস্য জানে ডি ক্যাসিয়াস।
‘কাছে এসো, বেলো, ইশারায় মিচনারকে ডাকল ডি ক্যাসিয়াস।’
সামনে গিয়ে দাঁড়াল মিচনার। এই দীর্ঘ সময়ে নিজের নাম কখনো বলেনি তাই বেলো নামে ডাকে তাকে ডি ক্যাসিয়াস।
‘তোমার মতো আমারও বাঁচার সাধ হয়, কাশির দমকে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল ডি ক্যাসিয়াসের।
চুপ করে রইল মিচনার। কিছু বলার নেই, বহুবার শুনেছে এই কথা।
‘আমি মরলে এখান থেকে চলে যেও,’ ডি ক্যাসিয়াস বলল, ‘যৌবনে অনেক পাপ করেছি, হয়তো নরকে যাবো। তোমার কি ধারনা নরক বলে কিছু আছে?
‘আমি জানি না।’
‘ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করবেন। তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো, বেলো?’
‘জানি না।’
‘এই অমর জীবন নিয়ে কি করবে তুমি? আমি তো এখানেই মরে পচে মিশে যাবো। তাতেও কোন আক্ষেপ নেই, কিন্তু কোন অর্থ ছাড়া এই অসীম জীবন কিভাবে কাটাবে তুমি?’
‘জানি না।
‘পৃথিবীতে একমাত্র তুমি সেই সৌভাগ্যবান, একই সাথে দুর্ভাগাও যাকে অসীম জীবন দিয়েছেন ঈশ্বর।’
‘আমি একা নই।’
‘তুমি একা নও!’ বিস্ময়ে ডি ক্যাসিয়াসের চোখ বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর ছেড়ে।
‘না, আমি একা নই।’
‘দারুন। সেই লোকও তাহলে একই সাথে সৌভাগ্যবান এবং দুর্ভাগাও।’
‘আমি ওকে শেষ করে দেবো।’
‘একজন অমর কি মরতে পারে?’
‘শুধু আমার হাতেই তার মরন সম্ভব।
‘কিন্তু ওকে মারতেই হবে কেন? তুমি কি তাকে চেনো? সে তোমার কোন ক্ষতি করেছে?
ছোট হ্যারিকেনটা জ্বালাল মিচনার। এতো প্রশ্নের জবাব দিতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু উত্তর জানা তার নিজের কাছেও অনেক জরুরি।
‘জানি না কেন মারতে হবে। আমার মাথার ভেতর কে যেন বলে, লোকটাকে খুঁজে বের করতে, মেরে ফেলতে।
‘তুমি কি চাও?’
‘আমার চাওয়ার কিছু নেই। সে যা চাইবে তাই করতে হবে আমাকে।’
‘সে কে?’
‘আমার মাথার ভেতর যে কথা বলে।’
দম নিতে কষ্ট হচ্ছে ডি ক্যাসিয়াসের। পাশে গিয়ে বসল মিচনার। হ্যারিকেনের মৃদু আলোতে ডি ক্যাসিয়াসের চেহারাটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। শীর্ন হাতদুটো নিজের হাতে নিলো মিনার।
‘আমাকে পানি দাও,’হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ডি ক্যাসিয়াস।
উঠে গিয়ে পানি এনে দিলো এক গ্লাস। আজ রাতটা টিকবে না ডি ক্যাসিয়াস এটা নিশ্চিত। চিন্তিত মুখে করনীয় কি হবে ভাবছে মিচনার।
‘এখন আমি যা অনুভব করছি তার স্বাদ তুমি পাবে না, বেলো, মৃদু কণ্ঠে বলল ডি ক্যাসিয়াস। তার চেহারা হঠাৎ সুন্দর হয়ে গেছে, হাসিতে ভরে গেছে মুখ। এর নামই তাহলে মৃত্যু…’
শীর্ন হাত দুটো এলিয়ে পড়েছে মিচনারের হাতে। হাসি হাসি মুখটা কাত হয়ে পড়েছে একদিকে। জানালা দিয়ে সুন্দর জোছনার আলো এসে পড়েছে ঘরে। দারুন এক হাহাকার আছন্ন করে ফেলল মিচনারকে। জীবন অনেক সুন্দর। কিন্তু মৃত্যুও কি খুব অসুন্দর হবে? অসুন্দর হলে বন্ধুর চেহারাটা এতো হাসিখুশি কেন?
ডি ক্যাসিয়াসের খোলা চোখ দুটো আলতো করে বন্ধ করে দিলো মিচনার। মৃতদেহের সৎকার করতে হবে। তারপর বেরিয়ে পড়তে হবে।
এই অঞ্চলের লোকজন তাদের জানতো বাপ-ছেলে হিসেবে, যদিও চেহারায় মিল খুঁজে পায় কি কেউ। কিন্তু তা নিয়ে কারো মনে প্রশ্নও জাগেনি। দক্ষিন আফ্রিকার এই অঞ্চল দূর্গম। দূরের কয়লা খনিতে কাজ করে দু’পয়সা রোজগার করতো মিচনার। সেটা শুধুই ডি ক্যাসিয়াসের জন্য। নিজের জন্য তার কিছু লাগে না। এখন ডি ক্যাসিয়াস নেই, শুধু শুধু কাজ করার প্রয়োজনও নেই।
ছোট কুঁড়েঘর লাগোয়া এক চিলতে উঠোনে কবর খুঁদল মিচনার। তারপর সাদা চাদরে পেচিয়ে ডি ক্যাসিয়াসের লাশটা নামিয়ে দিলো নীচে। প্রার্থনা অনেক আগেই ভুলে গেছে। তবু কবর দেয়া হয়ে গেলে কিছুক্ষন তারপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল মিচনার। ঈশ্বর বলে সত্যিই যদি কেউ থেকে থাকে তাহলে ডি ক্যাসিয়াসের আত্মার শান্তি হোক, এই বলে প্রার্থনা করলো মিচনার। সে নিজে ক্যাথলিক খৃস্টান পরিবারের ছেলে হলেও এখন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস কিংবা ধর্মীয় কাজে কোন বিশ্বাস নেই তার। জীবনটা এখন ঘুম, কাজ, খাওয়া এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
বিষণ্ণ মনে ছোট ঘরটায় এসে দাঁড়াল মিচনার। এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার মতো কিছুই নেই। শুধু কিছু স্মৃতি পড়ে আছে এখানে-সেখানে। ডি ক্যাসিয়াসের কাপড় চোপড়, বাইবেল, জিশু খৃস্টের মূর্তি।
আস্তে আস্তে আরো পূবে যেতে হবে। মাথার ভেতর অনবরত যে কথা বলে তার কথামতো এগুতে হবে।
বাইরে এসে কবরটার দিকে তাকাল মিচনার। ছোট একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে। পাশ থেকে গাছের দুটো ডাল ভেঙে ক্রুশের মতো করে বানিয়ে কবরের উপর বসিয়ে দিলো সে। ডি ক্যাসিয়াসের ছেলে থাকলে তাই করতো।
রাত হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলো মিচনার। আরো পুবে যেতে হবে। যেখানে মিলবে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা।
***
শহরটা ছবির মতো সুন্দর। ম্যাকলডগঞ্জের এই অঞ্চলটা আলাদা এক তিব্বত। পথে ঘাটে তিব্বতিরা হাঁটছে, ঘুরছে। অনেকে সাধারন তিব্বতি পোষাক পরনে, অনেকের পরনে প্যান্ট-শার্ট। দোকানগুলোতে হিন্দির পাশাপাশি তিব্বতি ভাষায় সাইনবোর্ড টানানো। সুন্দর পরিচ্ছন্ন একটা শহর।
বিকেলের একটু আগে শহরে পৌঁছেছে তাদের গাড়িগুলো। ড. আরেফিন গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা বিস্মিত হয়ে তাকিয়েছিলেন। ভারতের বুকে এ যেন ছোটখাট এক তিব্বত। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে কাংরা ভ্যালীর উপরের অংশে শহরটা। চারপাশে দেবদারু, ওক আর পাইন গাছ। দূরে ধওলাধর পর্বতের ধবল চূড়া দেখা যায়।
পাহাড়ের গা ঘেষে পুরানো আমলের একটা হোটেল বুক করে রেখেছিল সুরেশ। সেই হোটেলের রুমে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন ড. আরেফিন। কাজ শুরু হয়নি এখনো। অভিযানের মাত্রই শুরু। কিন্তু এরই মধ্যে দেশের জন্য প্রবল টান অনুভব করছেন। ধর্মশালার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন টানছে না এখন। ড. কারসনের সাথে বসতে হবে। এখানে আসার কারন একবার বলেছনে ড. কারসন কিন্তু সেটাকে যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। কিছু একটা বলেননি ড. কারসন, হয়তো লুকোচ্ছেন কিংবা পরে বলবেন, ঠিক এরকম ধারনা হচ্ছে ড. আরেফিনের।
জানালা দিয়ে পুরো কাংরা উপত্যকা দেখা যাচ্ছে। যেদিকে তাকাচ্ছেন শুধু সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে পাহাড় চূড়ায় সাদা আভাস। জানালা দিয়ে শীতল হাওয়া এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তাকে।
রুমের টেলিফোন বেজে উঠলো এই সময়।
‘ড. আরেফিন? হ্যালো, ওপাশ থেকে ড. কারসনের গলা শুনতে পেলেন।’
‘জি, বলুন।’
‘আপনি তৈরি হয়ে নিন, আমরা বাইরে যাবো।’
‘প্রফেসর আর সন্দীপ?’
‘প্রফেসর ঘুমাচ্ছেন আর সন্দীপ এখন বাইরে যাবে না। আপনি চলুন।
‘ঠিক আছে, আমি আসছি,’ বলে ফোনটা রেখে দিলেন ড. আরেফিন। তৈরিই ছিলেন, শুধু হাল্কা একটা চাদর জড়িয়ে নিলেন। স্ত্রী বুদ্ধি করে জিনিসটা দিয়ে দিয়েছিল ব্যাগে।
রুম লক করে ড. কারসনের রুমের দিকে হাঁটতে থাকলেন তিনি।
সুরেশকে সাথে নিয়ে বের হয়েছেন ড. কারসন। সাথে আছেন ড. আরেফিন। পাশাপাশি হাঁটছেন দুজন, ধীর পায়ে। বিকেলের আলোর তেজ কমছে। যে কেউ দেখলে ভাববে পর্যটকদের সাধারন বৈকালিক ভ্রমন। ড. কারসনের দিকে মাঝে মাঝে আড় চোখে তাকাচ্ছেন ড. আরেফিন। ড. কারসনের চোখ যেন কিছু একটা খুঁজছে। পরিচিত কোন মুখ, কোন স্থাপনা কিংবা অন্যকিছু, বুঝতে পারছেন না ড. আরেফিন। এই সাধারন হাঁটাহাঁটিতে তাকে নিয়ে আসার কোন কারন বুঝতে পারছেন না তিনি।
একটু দূরত্ব রেখে হাঁটছে সুরেশ, সিগারেট ফুঁকছে। বোঝাই যাচ্ছে এই এলাকার প্রতিটি ইঞ্চি সে চেনে, কাজেই বেশ আরাম করে হাঁটছে, কোন তাড়া নেই যেন।
আরো বেশ কিছুটা হাঁটার পর চমৎকার একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন ড. কারসন। ইংরেজি, তিব্বতি আর হিন্দিতে লেখা সাইনবোর্ড ঝোলানো বাড়িটার সামনে। নিজেদের স্থাপত্যরীতিতে বাড়িটা বানিয়েছে তিব্বতিরা। নীচ থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। সিঁড়ির পাশে ছোট দুটি ঝাউগাছ। আরো একটু উপরে উঠলে বিশাল কাঠের দরজা। বাড়ির সামনের সাইনবোর্ডে লেখা ‘লাইব্রেরি অব তিবেতিয়ান ওয়ার্ক্স অ্যান্ড আর্কাইভস’। এই মুহূর্তে বন্ধ দরজাটা। এখানে তিব্বতের যাবতীয় প্রাচীন বইপত্র, পুঁথি এবং ঐতিহ্য ধারন করে এমন সব কিছু রাখা আছে। তিব্বতের প্রাচীন ভাষা থেকে শুরু করে ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান, ফিলোসফি ইত্যাদি নানা বিষয়ে এখানে ক্লাসও নেয়া হয়। শিক্ষকদের সবাই তিব্বতি। অনেকে ডক্টরেট করা বাইরের ইউনিভার্সিটি থেকে। নিজেদের সংস্কৃতি যেন হারিয়ে না যায় সেজন্য দালাই লামা ১৯৭০ সালে তৈরি করেছেন এই আর্কাইভস। এখানে ড. কারসনের নিশ্চয়ই কোন কাজ আছে, ভাবছেন ড. আরেফিন। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একটু দূরে, কারসন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করেছেন, ড. আরেফিন এবং সুরেশ ঝুনঝুনুওয়ালাকে ইশারায় নিষেধ করেছেন উঠতে।
ঠিক পনেরো মিনিট পর বেরিয়ে এলেন ড. কারসন, চিন্তিত চেহারায়। হাতে ছোট একটা খাম। হলদে হয়ে যাওয়া খামটা কোটের পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটছেন ড. কারসন। পাশাপাশি হাঁটছেন ড. আরেফিন। লোকটার গম্ভীর চেহারা দেখে কিছু বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছেন না। কিছুটা দূরত্ব রেখে হাঁটছে সুরেশ।
আরো কিছুটা দূরত্ব রেখে হাঁটছে আরেকজন। ক্লিন শেভড। গায়ে ভারি জ্যাকেট পরা। মাথায় ক্যাপ।
* * *
বেশ কিছুক্ষন আগে রুমে ফিরেছে রাশেদ। লরেন্সকে যেভাবে রেখে গিয়েছিল সেভাবেই বসে আছে এখনো। সামনে ল্যাপটপ। চেহারা দেখে লোকটার মনের ভাব বোঝার চেষ্টা করলো রাশেদ। লরেন্সের চেহারা স্বাভাবিক। কোন উত্তেজনা, আনন্দ বা দুঃখ কিছুরই যেন ছাপ পড়ে না সেখানে। একমনে কিছু একটা নিয়ে কাজ করছে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কি নিয়ে?
ল্যাপটপের পাশে ছোট ব্যাগটা দেখে চমকে উঠলো রাশেদ। ওকে না বলে জিনিসটা নিয়ে নিয়েছে, আবার সেটা সামনে রেখে দিয়েছে দেখে কিছুটা অবাক হলো। এই ব্যাগটাই আপাতত তার সম্বল। যে কোনভাবেই হোক এর দখল নিতে হবে আবার।
‘কি করছেন আপনি ল্যাপটপে?
‘কাজ করছি,’ সাদামাটা উত্তর দিল লরেন্স।
‘সেটাই তো জানতে চাচ্ছি, কি কাজ?’
‘এই অঞ্চলের একটা ম্যাপ নিয়ে কাজ করছি।’
‘ম্যাপ তো চাইলে আমরা ঢাকা থেকে কিনে নিয়ে আসতে পারতাম।‘
‘তা পারতাম,’ এবার মুখ তুলে রাশেদের দিকে চাইলো লরেন্স, ‘সেটা কি ভাবিনি মনে করেছো?’
উত্তর দিলো না রাশেদ। ছোট ব্যাগটা এখনো ভোলা হয়নি। ভেতরে পার্চমেন্ট কাগজটা বের করেনি তাহলে।
‘রাশেদ, তুমি বাংলায় পর্তুগীজদের সম্পর্কে কিছু জানো?’
‘তেমন কিছু না। বইতে যা পড়েছি।’
‘কি পড়েছো?’
‘পর্তুগীজ জলদস্যুদের কথা। ওরা বাংলায় লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল।’
‘ওদের নেতা কে ছিল জানো?’
‘না। জানার দরকার পড়েনি।’
‘ওদের দলনেতা ছিল তিবাও। এক হিসেবে সে আমার পূর্বসুরি।‘
‘আচ্ছা। জানতাম না।‘
‘এই পার্চমেন্ট অনেক গুরুত্বপূর্ন। জিনিসটা পড়েছিল এঞ্জেল আংকেলের কাছে। তিনি কোন গুরুত্ব দেননি। আমার বাবাও না। কিছুদিন আগে পুরানো জঞ্জালের মাঝে একে আবিষ্কার করি আমি।’
‘আচ্ছা।’
‘তুমি ভেবো না পার্চমেন্ট নিয়ে নিয়েছি বলে তোমার বন্ধুকে আমি খুঁজে বের করবো না। সঞ্জয়ের সাথে লড়াই করার জন্য আমার একজন সঙ্গি দরকার। এঞ্জেল বুড়ো হয়ে গেছে। তাই আমার সেই সঙ্গিটা হচ্ছো তুমি।
‘আমি কখনো লড়াই করিনি।’
‘লড়াই করোনি,সেটা জানি। কিন্তু তোমার কারনে কিছুদিন আগে বড় এক অপরাধি ধরা পড়েছিল, বিদেশি এক নাগরিককে অপহরন করেছিল সে। ঠিক বলেছি?’
‘আপনি কি করে জানলেন?’
‘খবর না নিয়ে কাজ করি না আমি। আর পত্রপত্রিকায় এই খবরগুলো খুব মন দিয়ে পড়েছিলাম।’
চুপ করে রইল রাশেদ। ব্রিটিশ অধ্যাপক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ড. কারসনের অপহরনের খবরটা পত্রিকার মাধ্যমে সবাই জানে। এর ভেতরের খবর কেউ জানে না।
‘আমাকে কি করতে হবে?’
‘তেমন কিছুই না। শুধু থাকতে হবে আমার সাথে।’
‘যতোক্ষন রাজুকে ফিরে না পাবো, আমি আছি।’
আবার ল্যাপটপে ব্যস্ত হয়ে পড়ল লরেন্স। চুপচাপ জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল রাশেদ। অন্ধকার হয়ে গেছে অনেক আগেই। বাইরে তাই কিছু দেখা যাচ্ছে না। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে বাবা আব্দুল আজিজ ব্যাপারির নাম্বারে চোখ পড়লো। বেশ কিছুদিন হলো কথা হয় না। মায়ের সাথেও কথা বলা দরকার। কিন্তু এখন কিছুই ভালো লাগছে না। চাইলে লিলিকে ফোন করা যায়। ওখানে এখন কয়টা বাজে কোন ধারনা নেই। তাই ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল রাশেদ।
‘রাশেদ?’
‘বলুন।‘
‘কাল সকাল থেকে কাজে নেমে পড়তে হবে।’
‘কি কাজ?’
‘সেটা পরেই বলবো। তোমার কাজ হবে আমার সাথে থাকা। আমি যা করতে বলবো করবে। তোমার কোন ক্ষতি হবে না এটুকু বলতে পারি।’
‘ঠিক আছে। দেখা যাক।‘
আরো কিছুক্ষন ল্যাপটপে কাজ করে বের হয়ে গেল লরেন্স। বেশ রাত হয়ে গেছে। রুম সার্ভিসে ফোন করে খাবার পাঠাতে বলল রাশেদ।
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে। লরেন্সের সাথে কোথায় যেতে হবে কে জানে?
***
টানা দুইদিন ভ্রমনে ক্লান্ত তিনি। এই অঞ্চল কিছুটা শীতপ্রবন, তাই ঘাম কম হয়। চারদিকে উঁচু পাহাড়, মাঝখানে ছবির মতো সুন্দর এই জায়গাটা। এখানে এসে সোজা হোটেলে উঠেছেন তিনি। যজ্ঞেশ্বর গাইগুই করছিল, সন্ন্যাসীরা থাকবে খোলা আকাশের নীচে। কিন্তু কোনমতে রাজি করিয়েছেন ধর্মশালায় যে কয়েকটা দিন থাকবেন হোটেলেই থাকতে হবে। এখানে বাইরে প্রচন্ড শীত, গাছতলায় থাকাটা যে সুখকর হবে না সেটা যজ্ঞেশ্বরও ভালো বুঝতে পেরেছে। তাই শুরুতে গাইগুই করলেও রাজি হয়েছে। ছোট একটা পাহাড়ের একপাশে হোটেলটা পছন্দ হয়েছে তার। অনেকটা ইউরোপীয় ঘরানায় তৈরি। সম্ভবত সাদা চামড়ার পর্যটকদের কথা ভেবে বানানো হয়েছে হোটেলটা। চারপাশে সাধারন ভারতবাসীর সাথে তিব্বতিদের সমান পদচারনা তাকে কিছুটা বিস্মিত করেছে। এর আগে যখন এসেছিলেন অঞ্চলটা ছোটখাট একটা গ্রামের বেশি কিছু ছিল না। এখন রীতিমতো একটা শহরে পরিণত হয়েছে।
হোটেল রুমে বসে যজ্ঞেশ্বরের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। এখনো বিছানায় শুয়ে আছে। নরম তুলোয় তৈরি লেপের উম হয়তো বহুদিন পায়নি যজ্ঞেশ্বর, তাই ঘুম কাটতে চাইছে না সহজে। রুম হিটার থাকার কারনে বাইরে যতো শীতই থাকুক রুমের তাপমাত্রা উষ্ণ। জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরে লোকজনের পদচারনা দেখছেন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে। দূরের পাহাড় চূড়ায় বরফ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। তিব্বত এখান থেকে বেশি দূরে নয়। কিন্তু এখন সেখানে যাওয়া খুব সহজ হবে না। সাধারন তিব্বতিরাই নিজেদের দেশে আগুন্তক। বিদেশি পর্যটকদের তিব্বত ভ্রমনের জন্য নিতে হয় নানা ধরনের সুপারিশ। সেই দিন এখন আর নেই।
মেঘালয়ে থাকা অবস্থায় নিজের একটা পাসপোর্ট বানিয়ে নিয়েছেন তিনি। টাকা দিলে এখানে সব কিছু পাওয়া যায়। কাজেই তিব্বতে যাওয়া নিয়ে ভাবছেন না তিনি।‘সাম্ভালা’র সন্ধানে তিনি পাতালেও যেতে রাজি। কেউ তাকে আটকাতে পারবে না।
জানালার বাইরে রাস্তাটায় পরিচিত একটা মুখ দেখে চমকে গেলেন তিনি। একে তিনি কোথাও দেখেছেন। কোথায়? মনে পড়ছে না। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেখেছিলেন এই লোকটাকে। রাশেদ এরই বাসায় ছিল। মাঝবয়েসি লোকটা দেখতে শান্ত প্রকৃতির। তবে বিপদে পড়লে ভয় পায় না সেটা বোঝা গিয়েছিল সেদিন। এই লোক এখানে কেন? সাথে ইউরোপীয় একজনকেও দেখা যাচ্ছে। লোকটা কে? দুজনের কারো নাম জানা নেই তার। পেছনে অনুসরন করছে। আরো একজন। সিগারেট হাতে। প্রথম দুজনের খুব কাছেই আছে লোকটা। রাশেদের পরিচিত মানুষটা এখানে কি করতে এসেছে? বাগসুতে কি কাজ থাকতে পারে ওর? শুধুই ভ্রমন নাকি অন্যকিছু?
পর্দার আড়ালে নিজেকে সরিয়ে ফেললেন তিনি। উপরের দিকে তাকালেই হয়তো দেখতে পাবেন ওরা। আচ্ছা, আরেকজনও তো আছে পেছন পেছন। বোঝাই যাচ্ছে অনুসরন করছে এই তিনজনকে। বাহ, খেলা দেখি জমে গেছে। নিশ্চয়ই কোন কাজে এসেছে এরা। নইলে এদের পেছনে লোক লাগার কথা না।
ইউরোপীয় লোকটা বয়স্ক, গম্ভীর মুখ। সাধারন পর্যটক নয়, নিশ্চয়ই কোন কাজে এসেছে। এই লোকের সাথে বাংলাদেশি ভদ্রলোকের সম্পর্ক কি সেটাই ভাবিয়ে তুলল তাকে। নিশ্চয়ই সাধারন কোন কাজে আসেনি ওরা। চোখ রাখতে হবে ওদের উপর।
লখানিয়া সিং নামেই পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। বয়সও এখন অনেক কম। তরুণ দেহ নিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো চলতে পারেন। জানালা থেকে সরে গিয়ে একপাশে রাখা সোফাটায় এসে বসলেন। ওরা কোন হোটেলে উঠেছে দেখা দরকার। এখানে আসার আগে যজ্ঞেশ্বরের পরামর্শমতো ভারি একটা সোয়েটার কিনেছিলেন। সেটা পড়ে নিয়ে বেরিয়ে এলেন রুম থেকে।
তখনো দৃষ্টিসীমার বাইরে যায়নি ওরা। তিনিও হাঁটতে থাকলেন, সাধারন পর্যটকের মতো। ওদের উদ্দেশ্য জানতে হলে ওদের উপর লক্ষ্য রাখতে হবে। সেটা কিভাবে করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাস্তার দু’পাশের দোকানগুলোতে বাতি জ্বলে উঠেছে।
ওদের হোটেলটা কাছেই। তিনজনকে ভেতরে ঢুকে যেতে দেখলেন তিনি। অপর অনুসরনকারী উল্টোদিকের হোটেলটায় ঢুকে গেল।
রাস্তার পাশের ছোট একটা দোকান থেকে এক জোড়া দস্তানা কিনলেন তিনি। কান ঢাকা টুপি, কালো চশমা, ছোট মানিব্যাগ, এই ধরনের আরো বেশ কিছু জিনিস কিনে নিলেন। হাতে বানানো নানা ধরনের জিনিস শোভা পাচ্ছে দোকানটায়, বেশিরভাগই বৌদ্ধমূর্তি। চারপাশে তাকিয়ে সব ঠিক আছে কি না দেখে নিচ্ছেন। হোটেল থেকে আর কেউ বের হয়নি। তারপরও আরো কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।
কেউ বের হলো না। চলে আসতে যাবেন তখন দেখতে পেলেন উল্টোদিকের হোটেল থেকে অনুসরনকারি লোকটা বের হচ্ছে। দুই হাত পকেটে দিয়ে হনহন করে হাঁটছে লোকটা। পিছু নেবেন কি না চিন্তা করছেন। হাতে কাজ নেই, তাই পিছু নেয়াই ভালো হবে।
হঠাৎ কাঁধে কারো হাত পড়ায় পেছনে ঘুরে তাকালেন তিনি।
***
মৃত্যু এতো সহজ নয়, যদি নিজ থেকে ধরা না দেয় শত চেষ্টাতেও কাছে পাওয়া যায় না তাকে। চোখ খুলে ঝকঝকে আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল লিস্তানের। বেঁচে আছে কি না বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু সত্যিই বেঁচে আছে সে। জায়গাটা স্বর্গ না নরক কোনটাই নয়। গত পাঁচ বছর ধরে এই অঞ্চলটাই তার নিজের দেশ। এখানেই মরে মিশে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল।
উঠে বসতে কষ্ট হচ্ছিল ত্রিস্তানের। পা ভেঙে গেছে মনে হচ্ছে। পিঠেও ভীষন ব্যথা। ডান হাতে ধরে রাখা জিনিসটা দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। সেই চামড়ার খোল, তিবাওয়ের দেয়া। পানিতে ভিজে কেমন নেতিয়ে পড়েছে। ভেতরের পার্চমেন্টের কি অবস্থা কে জানে।
কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে। পা ভাঙ্গেনি। মচকে গেছে। হেঁটে নদীর পাড় বেয়ে উপরে চলে এলো ত্রিস্তান। পরনের পোশাক শতচ্ছিন্ন, কোমরে এখনো ঝুলছে তলোয়ার রাখার খোপ। একটানে খোপটা ছিঁড়ে ফেলে দিল। কারো সাথে যুদ্ধ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আর। সব শেষ হয়ে গেছে। সোনাদ্বীপ এখন মগদের দখলে। পরিচিত বন্ধু আর নাবিকদের নিজের চোখে কচুকাটা হতে দেখেছে। যুদ্ধ শুরু করলেও টিকতে পারেনি ওরা। পানিতে পর্তুগীজদের অসাধারন দাপট হলেও ডাঙ্গায় অস্ত্রচালনায় তারা বড় অসহায়। তিবাওয়ের মৃত্যুর পর নেতৃত্ব দেয়ারও কেউ ছিল না। কাজেই নৃশংস মৃত্যু এড়াতে পালালো তারা, ঘরবাড়ি, স্ত্রী-সন্তান শত্রুদের হাতে ফেলে। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। সে নিজে বেঁচে আছে কি করে সেটাই আশ্চর্য্য।
একটু দূরেই কিছু ঘরবাড়ি চোখে পড়ল। এসব এলাকায় কিছুদিন আগেও ডাকাতি করে গেছে লিস্তান। এখানে তাকে হাতের নাগালে পেলে কেউ ছেড়ে কথা কইবে না। নদীর ধার ঘেষে বড় কাশবন। সেখানে একটা ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়াল সে। দূর থেকে দেখার চেষ্টা করছে। এখন পর্যন্ত কোন মানুষ চোখে পড়েনি। মগদের ভয়ে সবাই পালিয়েছে হয়তো।
খিদে পেয়েছে খুব। আশপাশে কোন ফলের গাছও চোখে পড়ছে না। দূরের বাড়িটার পাশে কিছু কলাগাছ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এতোদূর নিজে নিজে যেতে পারবে বলে বিশ্বাস হচ্ছে না। পা মচকে গেছে বলে ধারনা হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে ধারাল কিছুতে কেটে গেছে পা। একটু হাঁটার কারনে রক্ত বেরিয়ে প্যান্ট লাল হয়ে গেছে।
কাশবনের আড়ালে ছোট একটা জায়গা পরিস্কার করে নিয়ে শুয়ে পড়ল ত্রিস্তান। রোদের তাপ কমলে পরে বের হওয়া যাবে। পিপাসায় গলা শুকিয়ে গেছে। চোখের উপর গনগনে আগুনের হলকা ছড়াচ্ছে সুৰ্য্য। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রাখল লিস্তান।
কতোক্ষন ঘুমিয়েছে মনে নেই। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার পর। ঝি ঝি পোকার ডাক ছাড়া কোন শব্দ নেই। একটু দূরে বয়ে যাওয়া পানির শব্দও পাওয়া যায়ে। উঠে চারপাশে তাকাল ত্রিস্তান। দূরে ঘরবাড়িগুলো অন্ধকার। কোথাও আলো জ্বলেনি। হয়তো এই গ্রামটা এখন পরিত্যক্ত। আরাকানদের অত্যাচারে সবাই পালিয়েছে কোথাও।
একটা ক্রাচের মতো বানিয়ে নেয়া দরকার, তাতে হাঁটতে সুবিধা হতো। কিন্তু সেজন্য এই কাশবন ছেড়ে বেরুতে হবে। খিদেও লেগেছে বেশ। অন্ধকারে কোনমতে হাঁটতে থাকল লিস্তান। কেউ দেখছে কি না সেদিকে লক্ষ্য রাখছে। অনেকদূর হাঁটার পর মনে হলো কেউ একজন তাকে অনুসরন করছে। বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে, কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। অশরীরি কোন আত্মার উপস্থিতি উড়িয়ে দিতে পারছে না। কেমন একটা ভয় জেঁকে ধরেছে তাকে।
আরো একটু হাঁটার পর দাঁড়িয়ে গেল ত্ৰিস্তান। কাশবন থেকে কেমন সরসর আওয়াজ আসছে। চাঁদের আবছা আলোয় কাউকে যেন দেখতে পেল কাশবনের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে। একজন না, অন্তত দুজন হবে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ত্রিস্তান। ভূতপ্রেতকে সে সবসময়ই ভয় পায়। অন্তত তলোয়ার আর পিস্তল দিয়ে এর মোকাবেলা করা যায় না। মনে সাহস রাখতে হবে।
মানুষের মতো দুটি আকৃতি বেরিয়ে এসেছে কাশবন থেকে।
ভয় কেটে গেল ত্রিস্তানের। বয়স্ক এক লোক, সাথে অল্পবয়েসি একটা মেয়ে। হিন্দু হবে। ধুতি পরনে লোকটা ভয়ে ভয়ে এগুচ্ছে সামনে। হাতে একটা লাঠি। আত্মরক্ষার অস্ত্র। মনে মনে হাসল লিস্তান। শরীরে এখনো যা শক্তি আছে তাতে এই বুড়োকে ঘায়েল করতে কোন সমস্যা হবে না। অল্পবয়েসি মেয়েটার হাতে একটা কাঁচি। ওটাই ভয়ের জিনিস।
ত্রিস্তানের দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। বোঝার চেষ্টা করছে তার অবস্থা। দু’হাত উঁচু করে আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে দাঁড়াল ত্রিস্তান। এখন তার দরকার খাবার, আশ্রয়। কারো সাথে যুদ্ধ করার সময় নয় এখন।
কাঁচি উঠিয়ে এগিয়ে আসছিল মেয়েটা, তাকে আটকালো বৃদ্ধ। এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না ভিনদেশি মানুষটাকে। কিছুদিন আগে এরাই তাদের সর্বশান্ত করে ছেড়েছে।
দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ত্রিস্তানের, পায়ে কোন জোর পাচ্ছে না। দু’হাত উচিয়ে রেখে বসে পড়ল সে। মাথা ঘুরাচ্ছে। চোখে অন্ধকার দেখছে। হাতে চামড়ার খোপটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে।
বৃদ্ধ আর অল্পবয়েসি মেয়েটা এগুচ্ছে ধীর পায়ে। দুজনেই প্রস্তুত। একটু এদিক সেদিক দেখলেই আঘাত করতে দ্বিধা করবে না। কিন্তু আরো কিছুদূর এগুতেই দেখতে পেল মাটিতে শুয়ে পড়েছে ভিনদেশি। চোখ বন্ধ। বেঁচে আছে কি না বোঝার জন্য এগিয়ে এলো বৃদ্ধ।