২.১০ পিতার যত অনৈতিকতা

২.১০ পিতার যত অনৈতিকতা

লাহোর, জানুয়ারি ১৬২৮

মেহেরুন্নিসা রাভি নদীর তীর দেখতে পাওয়া যায় প্রাসাদের দ্বিতীয় তলায় নিজের আবাসন কক্ষে মখমল মোড়া নিচু একটা ডিভানে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন। তার তলবে সাড়া দিয়ে লাহোরের দিকে নিজেদের বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসা অনুগত রাজাদের কাছ থেকে আগত সর্বশেষ প্রতিবেদন পড়ে রয়েছে। শাহরিয়ারের নাম উল্লেখ করেই যদিও তলব পাঠানো হয়েছে, যাকে চারমাস আগে লাহোরের মসজিদে শুক্রবারের জুম্মার নামাজের সময় সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে, এবং সঙ্গত কারণেই একইভাবে তাকে সম্বোধন করেই উত্তরগুলো এসেছে কিন্তু তার আব্বাজান যতটা আগ্রহ প্রদর্শন করতে সে সেগুলোর প্রতি তাঁর কিয়দংশ আগ্রহও দেখায় না। জাহাঙ্গীরের কথা স্মরণ করতে মেহেরুন্নিসা শোক আর দুঃখ অনুভব করে যা তাঁর মৃত্যুর পরে তাকে কখনও পুরোপুরি ছেড়ে যায় নি আবার বাড়তে শুরু করে। এই আবেগের গভীরতা আর অটলতা তাকে বিস্মিত করেছিল যতক্ষণ না সে বুঝতে পারে তার জন্য জাহাঙ্গীরের ভালোবাসা কতটা ব্যাপক ছিল। নিজের স্বাধীনতার প্রতি তাঁর গর্ব সত্ত্বেও সে তাঁর প্রতি নির্ভরশীল ছিল ঠিক যেমন তিনি তার উপরে নির্ভরশীল ছিলেন। সে তাকে এই কারণেই তার ক্ষমতার সাথে তাকেও এজন্য ভালোবাসতো।

সে যতটা আন্দাজ করেছিল শাহরিয়ার শাসক হিসাবে তারচেয়েও দুর্বল হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করে, বাহ্যিক আড়ম্বর আর অহমিকার কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করেছে। সে দিনের বেশিরভাগ সময় নিজের আপাতস্বীকৃত সুদর্শন দেহসৌষ্ঠবে ধারণের জন্য পোষাক আর অলঙ্কার নির্বাচনে ব্যয় করে অথবা তারই মত নির্বোধ সঙ্গীদের নিয়ে চটুল আমোদপ্রমোদ আর শিকারে ব্যস্ত থাকে। সাম্রাজ্যের কোনো বিষয় তাকে একেবারেই বিব্রত করে না। মেহেরুন্নিসার এজন্য আনন্দিত হওয়া উচিত ছিল কিন্তু বস্তুতপক্ষে এটা সন্তুষ্টিরও অযোগ্য। সে যখন তাঁর পরামর্শদাতাদের নিয়ে বৈঠকে বসে তখন সরকারি আর সামরিক উভয় বিষয়ে তাঁর অজ্ঞতা এত নগ্ন আর শোচনীয়ভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে এর ফলে তার উপরে অনুগামীদের আস্থা আর বিশ্বাস চোট খায়। মেহেরুন্নিসা লাডলির সাহায্যে যতটা সহজভাবে সম্ভব করে তাকে যে সারসংক্ষেপ আর পরামর্শ সরবরাহ আর সেগুলো পুনরাবৃত্তি করে সে হয় সেগুলোর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেয় না অথবা পরামর্শদাতাদের সামনে স্নায়বিক চাপের কারণে সামান্য তাঁর যতটুকু বুদ্ধি রয়েছে সেটুকুও তাকে একলা ফেলে ঘুরতে বের হয়।

মেহেরুন্নিসা আরো একবার নারী হবার কারণে তার ওপরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার জন্য গভীরভাবে আক্ষেপ প্রকাশ করে। সে যদি কেবল পরামর্শদাতাদের বৈঠকে অংশ নিতে পারতো… কিন্তু সে জানে সে সেটা পারবে না, উচিতও হবে না, অনর্থক আক্ষেপ বা হতাশায় কালক্ষেপণ। খুররম যদিও খসরুকে পরাজিত করেছে আর লাহোরের উদ্দেশ্যে আপাত অনুকম্পাহীনভাবে এগিয়ে আসছে তারপরেও করদ রাজ্যের রাজা আর অগ্রগণ্য অভিজাতদের অনেকেই উত্তরাধিকারজনিত বিরোধের ফলাফল সম্বন্ধে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা তারপক্ষে যোগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। বস্তুতপক্ষে, যদি তার সমর্থকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত চিঠির বক্তব্য বিশ্বাস করতে হয়, আরো অনেক সশস্ত্র যোদ্ধার দল লাহোরে এসে তার বাহিনীর সাথে অচিরেই যোগ দেবে। তার সাথে যারা ইতিমধ্যে যোগ দিয়েছে তাদের সাথে সাথে আর বেশ ভালো পরিমাণ অর্থপ্রদানের জন্য সে লাহোরের বিশাল কোষাগারের সম্পদ নিয়োগ করেছে, সেই সাথে খুররম পরাজিত হবার পরে আরও দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। লাহোরের চারপাশে যদিও কোনো নিরাপত্তা প্রাচীর নেই, শাহরিয়ারের আধিকারিকেরা তাঁর নির্দেশনায় নদীর তীরে অবস্থিত প্রাসাদকে সুরক্ষিত দুর্ভেদ্য করার কাজে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে, প্রাসাদের চারপাশে মাটি আর কাঠের শক্ত চোখা খুঁটার সাহায্যে শক্তিশালী বেড়া নির্মিত হয়েছে এবং তাদের কাছে লভ্য সবধরনের কামানের জন্য সেখানে বিপুল সংখ্যক কামানের মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য শস্যের সাথে বারুদ আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণও বিপুল পরিমাণে মজুদ করা হয়েছে। সে যদি উন্মুক্ত প্রান্তরে খুররমকে মোকাবেলা করতে শাহরিয়ার আর তাঁর সেনাপতিদের আকস্মিক নিষ্ক্রমণ থেকে বিরত রাখতে পারে তাহলে খুররমের বাহিনী যখন প্রথম আক্রমণ করবে তখন তাকে প্রতিরোধ এবং সেই সাথে নিজেদের নিশ্চায়ক আক্রমণ সূচনা করার পূর্বে তার বাহিনীকে হীনবল করার একটা ভালো সম্ভাবনা তাদের রয়েছে। শাহরিয়ারের মাঝে এবং তার মাধ্যমে তাঁর সেনাপতিদের মাঝে অবরোধ মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট সংকল্প আর আস্থা সঞ্চারিত করাই এখন তার মূল কাজ যাতে তারা বিশ্বাস করে যে তারাই শেষে বিজয়ী হবে। সৌভাগ্যবশত সে সেনাবাহিনীর জন্য অনুকূল সামরিক সত্ত্বা আর আস্থা যথেষ্টই ধারণ করে।

 সে আরো অনুধাবন করেছে যে দারা শুকোহ আর আওরঙ্গজেব তাঁর কাছে থাকায় এটা তাকে একটা বাড়তি সুবিধা দান করেছে। কামরান তাঁর সৎ-ভাই সম্রাট হুমায়ুনের বিরুদ্ধে নিজের অসংখ্য বিদ্রোহের মাঝে একবার হুমায়ুনের শিশু সন্তান, ভবিষ্যত সম্রাট আকবরকে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একবার কাবুলের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপর প্রদর্শন করেছিল হুমায়ুনকে শহর আক্রমণ করা থেকে নিরস্ত করতে যা আরেকটু হলেই সফল হতে চলেছিল। সে অবশ্যই এতদূর যাবে না–অন্ততপক্ষে যতক্ষণ না মারাত্মক জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয়–কিন্তু আকবরের গল্পটা তার চেয়ে খুররম আরো ভালো করে জানে বিধায়, সে জানে যে সে এমনটা করতে পারে এই ভাবনাটা খুররমের মনে কি ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাচ্চা দুটো অবশ্য ইতিমধ্যে আরেকটা উদ্দেশ্য সিদ্ধিতে সাহায্য করেছে–সেটা হল শাহরিয়ারকে কাছে রাখা এবং পৃথক শান্তি চুক্তি সম্পাদনে তার সামান্যতম প্রচেষ্টা সম্ভাবনাকেও নাকচ করে দেয়া। লাডলিকে একজন মধ্যস্থতাকারী হিসাবে ব্যবহার করে–যে সৌভাগ্যবশত মায়ের প্রতি তাঁর নিরঙ্কুশ আনুগত্য থেকে এখনও সামান্যতম বিচ্যুতির লক্ষণও প্রকাশ করে নি–সে শাহরিয়ারকে নিশ্চিতভাবে বুঝিয়েছে যে দুই কিশোর যুবরাজ এতটাই আকর্ষণীয় আর অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা তাঁদের এতই বেশি যে দরবারে তাঁদের প্রকাশ্য উপস্থিতি, তাঁদের আব্বাজানের সাথে তাদের চেহারার প্রচুর মিল থাকায় তাঁর অমাত্যদের মাঝে তার স্মৃতি জাগরত করে, তার নিজের অবস্থানের জন্য মানহানিকর হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। সে সেই সাথে। তাকে পরামর্শের ছলে বুঝিয়েছে যে তারা হয়ত পালিয়ে যেতে পারে বা তাদের উদ্ধার করার কোনো প্রচেষ্টা হতে পারে। শাহরিয়ার এরফলে অত্যন্ত ব্যগ্র হয়ে উঠে দু’জনকে প্রাসাদের একটা নির্জন অংশে আলোবাতাসহীন দুটো পৃথক কক্ষে দিনের চব্বিশ ঘন্টা প্রহরাধীন অবস্থায় তাদের আটকে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

মেহেরুন্নিসা নিজের অবস্থানের শক্তি সম্পর্কে অবগত থাকায় উৎসাহিত হয়ে মনে মনে ভেবে রাখা কিছু কূটনৈতিক পদক্ষেপ সম্বন্ধে চিন্তা করে। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো যদি খুররমের বিরুদ্ধে শাহরিয়ারের পক্ষে বিরোধে হস্তক্ষেপ করে তাহলে ভূখণ্ডগত ছাড়ের প্রস্তাব দিয়ে তার নিজের–নাকি আনুষ্ঠানিকভাবে শাহরিয়ারের উচিত প্রতিনিধি প্রেরণ করা? কান্দাহার আর পার্শ্ববর্তী ভূখণ্ডের বিনিময়ে পারস্যের শাহ খুশি মনে এটা করবে। দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের হয়ত তাদের বাজেয়াপ্ত করা ভূখণ্ড ফিরিয়ে দেয়ার প্রস্তাবে সাড়া দিতে পারে–তার অবস্থান একবার সংহত হলে যা তারা পুনরায় দখল করতে পারবে এবং তাদের সেনাপতি মালিক। আম্বারের বয়স হলেও এখনও প্রাণবন্ত রয়েছেন, হয়তো তাদের পক্ষে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দান করতে পারেন। খুররম আর তার ভিতরে অমীমাংসিত বিরোধ রয়েছে। পর্তুগীজ বা ইংরেজরা হয়তো শুল্ক ছাড়ের বিনিময়ে তাদের জাহাজে মারাত্মক আধুনিক কামান সজ্জিত করে তাদের নাবিকদের প্রেরণ করতে পারে। যাচাই করে দেখার জন্য অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। শাহরিয়ারের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, সে তাকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত রাখতে চায়। আর তাছাড়া, জাহাঙ্গীরের হয়ে এতগুলো বছর সেই শাসন করেছে।

*

খুররম নিজের টকটকে লাল নিয়ন্ত্রক তাবুতে একটা নিচু টেবিলের চারপাশে আসফ খান আর মহবত খানের সাথে বসে রয়েছে। তাবুর পর্দাগুলো যদিও সোনালী দড়ি দিয়ে আটকে আটকানো রয়েছে, সে তারপরেও রাভি নদীর পানি বিকেলের সূর্যের আলোয় ঝলমল করতে দেখে এবং তার ওপারে দাঁড়িয়ে রয়েছে লাহোর প্রাসাদ যা এখন বৃত্তাকার প্রাচীর আর নিরাপত্তা ব্যবস্থা দ্বারা আবৃত। সে টেবিলের উল্টোদিকে নিরুদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে বসে ভেষজ ঔষধিমিশ্রিত পানি সে বলেছে তার মাতৃভূমি পারস্যে বলকারী পানীয় হিসাবে এটা ভীষণ জনপ্রিয় চুমুক দিতে থাকা মহবত খানের দিকে তাকায়। তাঁদের প্রথম সাক্ষাতের সময় তারা দুজনেই আড়ষ্ট আর আনুষ্ঠানিক ছিল, বলার অপেক্ষা রাখে না দু’জনের ভিতরেই পারস্পরিক সন্দেহ কাজ করেছে, যা হয়ত প্রতিদ্বন্দ্বি সেনাপতিদের মাঝে প্রত্যাশিত যারা বহু বছর ধরে বিরুদ্ধ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছে। মহবত খান সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে নিজেকে আড়ালে রেখেছিল এবং পেছনে অবস্থান করেছে যতক্ষণ না আসফ খানের সহজিয়া উপস্থিতির কারণে যিনি খুররমের সাথে নির্দিষ্টস্থানে মিলিত হবার কিছুক্ষণ পূর্বে মহবত খানের সাথে যোগ দিয়েছেন, পুরো পারিপার্শ্বিকতা সহজ হয়ে উঠে। তারা দু’জনে এখন কোনো ধরনের সংবোধ ছাড়াই পেশাগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে সক্ষম হচ্ছে এমনকি কোনো বিশেষ কৌশলের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের সময় নিজেদের বৈরীতার সময়ের উদাহরণও তারা উল্লেখ করছেন। খুররম ভাবে, এটাই ভালো হয়েছে। খসরুর বাহিনীর উপরে তাঁর আক্রমণ একটা হঠকারী পদক্ষেপ ছিল এবং তাঁর লোকদের সাহসিকতার কারণেই সেবার তার পরাজয় এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। লাহোরে মেহেরুন্নিসা আর শাহরিয়ারের মোতায়েন করা বাহিনী অনেকবেশি শক্তিশালী এবং তাঁদের দক্ষতার সাথে নির্মিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খসরুর তড়িঘড়ি নির্মিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চেয়ে অনেক উন্নত। তাকে অবশ্যই নিজের ব্যগ্রতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং যতটা কম সম্ভব সুযোগের প্রত্যাশা না করে যত্নের সাথে পরিকল্পনা করতে হবে।

 মহবত খান, আমরা আগেই একমত হয়েছি যে প্রতিপক্ষের গুলিবর্ষণের মাঝে নদী অতিক্রমের ব্যাপারটা জড়িত থাকায় সামনাসামনি আক্রমণ করলে আমাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হবে, কিন্তু আপনি আমাদের কোথায় রাভি অতিক্রম করার পরামর্শ দেবেন?

 ‘আমি লাহোরের উজানে আর ভাটিতে দুই স্থানে নদী পার হবার পরামর্শ দেবো যাতে উভয়দিক থেকে একসাথে আমরা শহর আক্রমণ করতে পারি। আমরা ইতিমধ্যে দুটো সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত সংখ্যক নৌকা আর পাটাতন সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি।’

 ‘মহবত খান আপনার পরিকল্পনাটা ভালোই, কিন্তু আমরা কত দ্রুত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে পারবো?

 ‘একরাতে।

‘আপনি বলতে চাইছেন আমি যদি এই মুহূর্তে আদেশ দেই তাহলে সকালবেলায় আমরা আক্রমণ করতে পারবো?

 ‘হা। আমাদের লোকেরা ভালোমত প্রশিক্ষিত এবং আমাদের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আর অন্যান্য অনুষঙ্গ মালবাহী শকটের বহর থেকে ইতিমধ্যে নামিয়ে নেয়া হয়েছে।’

‘বেশ তাহলে, দিনটা আগামীকালই হোক। আমি যদি ভাটির পারাপারের নেতৃত্ব দেই তাহলে আপনি কি উজানের পারাপারের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন?

 ‘অবশ্যই।

 ‘কিন্তু খুররম আক্রমণকারী দলের একটার নেতৃত্ব দিয়ে আপনার কি নিজেকে ঝুঁকির মাঝে ফেলা উচিত হবে? আপনি কি এখানে আমাদের গোলন্দাজদের তত্ত্বাবধান করে এবং সর্বময় নেতৃত্ব গ্রহণের মাধ্যমে কি অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবেন না?’ আসফ খান তাদের কথার মাঝে বলে।

 ‘পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক হতো তাহলে হয়তো আপনার কথাই ঠিক ছিল, কিন্তু এটা মোটেই স্বাভাবিক সময় না। আমি সম্রাট হবার সাথে সাথে একজন পিতাও বটে। মেহেরুন্নিসা আর শাহরিয়ার আমার দুই সন্তানকে বন্দি করে রেখেছে। আমি নিজে তাঁদের কাছে যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছাতে চাই। তোপচিদের নেতৃত্বের বিষয়ে আপনার উপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে, তারা যেন তাদের গোলাবর্ষণ প্রতিরক্ষা প্রাচীর আর কামানের মঞ্চের প্রতি নির্দিষ্ট রাখে এবং শাহরিয়ার আমার সন্তানদের–আপনার নাতিদের–বন্দি করে রাখতে পারে এমনসব স্থান পরিহার করে এই বিষয়টা কেবল নিশ্চিত করবেন।

*

পরের দিন খুব সকালবেলা খুররম লাহোরের আড়াই মাইল ভাটিতে রাভি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকে যখন তার লোকেরা কয়েকটা দলে বিভক্ত হয়ে স্থানীয় জেলেদের কাছ থেকে বড় অংকের পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দখল করা নৌকার ক্ষুদে বহরে সন্তপণে আরোহণ করতে শুরু করে। সৈন্যরা নিরবে বৈঠা পানিতে নামাতে থাকে এবং বেশির ভাগ নৌকার সাথে সংযুক্ত রিফু-করা এবং তপ্পি মারা সুতির একক পাল তুলে দেয়। সে তার লোকদের প্রথমে নদী পার হবার এবং শাহরিয়ারের বাহিনীর কাছ থেকে কোনো ধরনের প্রতিরোধের বিরুদ্ধে অবতরণের জায়গাটা নিরাপদ করার দায়িত্ব দিয়েছে এবং তারপরে আংশিক নির্মিত সেতুর একটা অংশ তাঁরা টেনে ওপারে নিয়ে যাবে এবং নিরাপদে সেটাকে ওপারে টেনে নিয়ে গিয়ে নোঙরের সাহায্যে নিরাপদ করে তার দিকের তীর থেকে ইতিমধ্যে বর্ধিত সেতুর অংশের সাথে যুক্ত করার জন্য প্রস্তুত করবে। তার লোকেরা রাতের বেলা যখন নদীর তীর বরাবর এগিয়ে এসে নৌকার সেতুর প্রাথমিক নির্মাণকাজ আরম্ভ করে তখন তারা কোনো ধরনের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় নি। সূর্যোদয়ের পরেও–সকালের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের বুকে একটা কমলা গোলক–এমনকি দূরবর্তী তীরের পাড়ের দিকে নেমে আসা নিম্নমুখী নিচু মাটির ঢিবির মাঝেও শাহরিয়ারের বাহিনীর আগমনের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। অবশ্য, তার মানে এই নয় যে তারা অবতরণকারী দলকে অতর্কিতে আক্রমণের জন্য গোপনে ওঁত পেতে অপেক্ষা করছে না। বর্ষাকালে খুবই অল্প বৃষ্টিপাত হওয়ায়, বছরের এই সময়ের তুলনায় নদীতে অন্তত পানির স্তর অনেক নিচুই রয়েছে এবং নদীর পানি এই মুহূর্তে দুইশ ফিটের বেশি প্রশস্ত হবে না।

খুররম তাকিয়ে দেখে যে তীর থেকে নৌকার প্রথম বহরটা যাত্রা শুরু করেছে, বৈঠা হাতে মাঝিদের পিঠ ওঠানামা করছে। প্রতিটা নৌকায় দুই তিনজন করে তবকি গলুইয়ের কাছে শুয়ে গুলিবর্ষণের জন্য তাঁদের লম্বা-নলযুক্ত বন্দুক প্রস্তুত অবস্থায় রেখে ওপাড়ের তীর বরাবর আনত করে রেখেছে। স্রোতের বাধা সত্ত্বেও, যা এখনও বেশ প্রবল, কয়েক মিনিটের ভিতরেই প্রথম নৌকাটার–লাল রঙ করা বেশ বড় একটা নৌকা–সামনের অংশ তীরের দিকে অগ্রসর হতে থাকার সময়েও প্রতিপক্ষের সাথে কোনো মোকাবেলা হয় নি। কয়েকজন সৈন্য নৌকার ধারে টলমল করতে করতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, অগভীর পানিতে লাফিয়ে নেমে পানির ভিতর দিয়ে হেঁটে তীরে যাবার জন্য যখন খুররমের কানে পরপর কয়েকটা গুলির শব্দ ভেসে আসে। নৌকার একপাশে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা লোকদের ভিতরে একজন পানি ছিটকে দিয়ে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, পেছনে অবস্থানরত নৌকাগুলোয় আরো তিনজন তাকে অনুসরণ করে।

খুররম ঠিক যেমনটা সন্দেহ করেছিল, তীর থেকে প্রায় শ’খানেক গজ দূরে মাটির ঢিবিগুলোর একটার পেছন থেকে গুলি করা হয়েছে। গুলির পরপরই এক ঝাঁক তীর উড়ে আসে কিন্তু, তার মাথা ঝড়ের বেগে কাজ করতে শুরু করে, খুররম দেখে স্বস্তি পায় যে তীরের সংখ্যা ত্রিশের বেশি হবে না। স্পষ্টতই অপর তীরে শত্রুপক্ষের বড় কোনো বাহিনী ওঁত পেতে নেই। তার নিজের লোকেরা এখন তরবারি হাতে যত দ্রুত সম্ভব দৌড়াতে আরম্ভ করেছে এবং উন্মুক্ত তীরের উপর দিয়ে উপরের মাটির ঢিবির দিকে উঠে যাচ্ছে। তারা যখন প্রায় তিন চতুর্থাংশ পথ অতিক্রম করেছে তখন আরো গাদাবন্দুক ঢিবির পেছনের নিরাপদ স্থান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে গর্জে উঠে এবং খুররমের বেশ কয়েকজন সৈন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যাদের ভিতরে একেবারে সামনে বাঁকানো তরবারি আন্দোলিত করে ছুটতে থাকা–সবুজ আলখাল্লা পরিহিত দানবাকৃতির এক যোদ্ধাও রয়েছে। লোকটা অবশ্য কিছুক্ষণের ভিতরেই আবার উঠে দাঁড়িয়ে তার ঊর্ধ্বমুখী ধাওয়া শুরু করে, কিন্তু সে বা অন্যকেউ মাটির ঢিবির শীর্ষদেশে পৌঁছাবার আগেই খুররম একদল অশ্বারোহীকে দেখতে পায়–সম্ভবত চল্লিশজনের একটা দল–ঢিবির পেছন থেকে বের হয়ে এসে লাহোরের অভিমুখে দ্রুত গতিতে ফিরে যাচ্ছে। তারা নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে দূরবর্তী পাহারাচৌকি এবং তারা যদি অনুরোধ করেও থাকে তাদের সাহায্যার্থে অতিরিক্ত সৈন্য প্রেরণ করা হয় নি।

 ধাবমান দলটার একেবারে পেছনের অশ্বারোহী, উপরের দিকে হাত ছুঁড়ে এবং পর্যাণ থেকে সামনের দিকে ছিটকে পড়ে, সম্ভবত গাদাবন্দুকের গুলির আঘাতে। আরেকটা ঘোড়া–খয়েরী রঙের–পিঠের আরোহীকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে মাটিতে আঁছড়ে পড়ে, কিন্তু বাকিরা করকটে গাছের ঝাড়ের পেছনে অক্ষত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। খুররম জানে যে মেহেরুন্নিসা যদি ইতিমধ্যে না জেনে থাকে কিন্তু সে অচিরেই সতর্ক হয়ে যাবে যে খুররম আর তার লোকেরা নদী অতিক্রম করেছে। জলদি, সে তার একজন সেনাপতিকে তাড়া দেয়। দূরবর্তী তীরের দিকে নৌকা সেতুর অংশটা টেনে নিয়ে যাওয়া শুরু করো। আমাদের বাহিনীকে নদী পার হবার জন্য প্রস্তুত হতে বলল। সময় নষ্ট করা যাবে না।

*

দুই ঘন্টা পরে, খুররম নদীর দূরবর্তী তীরে অবস্থান করে। তাঁর লোকেরা দ্রুত নৌকা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। সেতুর অংশ বিশেষ যদিও এর সাথে শক্ত শনের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা ছোট নৌকায় অবস্থানরত মাঝিরা স্রোতের উল্টো দিকে দাঁড় টেনে সুস্থির রেখেছে, সেতুটা তৈরির উদ্দেশ্যে সার্থক হয়েছে। সেতুটা যদি এখন ছিঁড়েও যায়, তার অধিকাংশ অশ্বারোহী, অনেকগুলো রণহস্তী আর এমনকি তার ছোট কামানের বেশ কয়েকটা ইতিমধ্যেই নদী অতিক্রম করেছে–লাহোর প্রাসাদের চারপাশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় হামলা শুরু করার জন্য পর্যাপ্ত।

 খুররম তার সেনাপতিদের নিজের চারপাশে জড়ো করে, সবাই তারই মত যুদ্ধের জন্য মুখিয়ে রয়েছে, সে তাঁদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত একটা বক্তৃতা দেয়। এটা জেনে রাখো। আজকের দিন আমার জীবনের সবচেয়ে সঙ্কটপূর্ণ দিন। আজকের দিনাবসানে আমি তোমাদের সহায়তায় রাজকীয় সিংহাসনে অধিকার নিশ্চিত করবো এবং আমার প্রিয় সন্তানদের উদ্ধার করবো অথবা এই প্রয়াস বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমি মৃত্যুবরণ করবো। কিন্তু আমি জানি যে তোমাদের সহায়তায় আমি সফল হবই। আমি যখন সফল হব, লাহোরের কোষাগার থেকে তোমাদের প্রত্যেককে আমি চোখ ধাঁধানো উপহার প্রদান করবো এবং সেইসাথে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলকারী আমার সৎ-ভাইয়ের সমর্থকদের জমি বাজেয়াপ্ত করে আমি তোমাদের মাঝে বণ্টন করবো।

 মনে রাখবে, আমাদের পরিকল্পনা কিন্তু একেবারে সহজ সরল। আমরা যেই মাত্র আসফ খানের নেতৃত্বে রাভি নদীর ওপারে প্রাসাদের নিরাপত্তা বেষ্টনী লক্ষ্য করে কামানের গোলাবর্ষণের শব্দ শুনতে পাব, আমরা আর মহবত খানের লোকেরা বার্তাবাহক আমায় জানিয়েছে তিনি উজান দিয়ে নিরাপদেই নদী অতিক্রম করেছেন যুগপৎ বিপরীত দিক থেকে নিরাপত্তা বেষ্টনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বো।’

খুররম কয়েক মিনিট পরেই আসফ খানের কামানের গোলাবর্ষণের গমগম শব্দ শুনতে পায়। পুরোভাগে তাঁর চারজন দেহরক্ষী নিয়ে সবাই গাঢ় সবুজ রঙের বিশালাকৃতি নিশান বহন করছে এবং পিতলের লম্বা বাদ্যযন্ত্রে গগনবিদারী আওয়াজ সৃষ্টিকারী চারজন তূর্যবাদক নিয়ে, সে তার লোকদের একেবারে সামনে অবস্থান করে তার কালো ঘোড়ার পাজরে গুঁতো দেয় সামনে এগিয়ে যেতে। সে শীঘ্রই নদীতীরের জমাট বাঁধা অনাবৃত কাদার উপর দিয়ে আস্কন্দিত বেগে ঘোড়া ছোটাতে থাকে। সে যখন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যায় তার হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিকের চেয়েও জোরে স্পন্দিত হতে থাকে এবং আসন্ন লড়াইয়ে পুরোপুরি মনোসংযোগ করতে তাঁর রীতিমত কষ্ট হয়। সে কেবলই মনে মনে চিন্তা করতে থাকে প্রাসাদের কোথায় সে তাঁর সন্তানদের খুঁজে পাবে যদি সাফল্যের সাথে সে প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।

সে খুব ভালো করেই জানে যে তাকে বর্তমান পরিস্থিতির উপরে মনোনিবেশ করতে হবে এবং সে যদি নিজের সন্তানদের রক্ষা করা আর নিজেকে এবং নিজের লোকদের নিরাপত্তার লক্ষ্য অর্জন করতে চায় তাহলে তাকে সামনে এগিয়ে গেলে চলবে না, সে নিজের ঘোড়ার লাগাম একটু টেনে ধরে। সে তারপরে আসফ খান আর শাহরিয়ারের তোপচিদের মাঝে কামানের গোলা বিনিময়ের ফলে সৃষ্ট কুণ্ডলীকৃত ধোয়ার মেঘের মাঝে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করে। নিরাপত্তা প্রাচীরের ভিতরে অবস্থিত প্রাসাদ সামনে আর মাত্র মাইল দূরে রয়েছে। শাহরিয়ারের লোকেরা অবশ্য মনে হয় যেন নিরাপত্তা প্রাচীর আর তার বর্তমান অবস্থানের ভিতরের সব ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে গোলাবর্ষণের জন্য নিজেদের একটা পরিষ্কার মাঠের সুবিধা দিতে। গুঁড়িয়ে দেয়া বাড়িঘরের জমে থাকা ভাঙা টুকরো যা পরিষ্কার করা হয় নি তাঁর অশ্বারোহীদের গতি শ্লথ করে দেয়, এবং সে হতাশ হয়ে ভাবে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কাছাকাছি পৌঁছাবার আগে তাঁদের অনেকেই পৃথিবী থেকে নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তারা যদি ঘোড়া থেকে নেমে শেষ আটশ গজ পায়ে হেঁটে এগিয়ে যায় তাহলে জমে থাকা ভাঙা ইটের স্তূপ তাদের আঁড়াল দিবে।

 সে নিজের ঘোড়াকে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে নিয়ে তাঁর লোকদের অগ্রগামী দলটাকে ঘোড়া থেকে নামার আদেশ দেয়। প্রতি ছয়জনে একজন লোককে ঘোড়াগুলোকে দড়ি দিয়ে বাঁধার জন্য পেছনে রেখে সে অবশিষ্ট লোকদের নেতৃত্ব দিয়ে একটা ধ্বংস স্তূপ থেকে আরেকটার দিকে এগোতে থাকার সময় কোমরের কাছ থেকে সামনের দিকে বেঁকে থাকে। তার পুরো দূরত্বে দশ ভাগের এক ভাগও অতিক্রম করার আগেই শাহরিয়ারের তাঁদের দেখতে পায় এবং তাদের কামান আর গাদাবন্দুকের নিশানায় পরিণত করে। খুররম একটা দেয়ালের অবশিষ্টাংশের পেছনে নিজেকে নিক্ষেপ করে। সে সেখানে আড়াল নেয়ার মাঝে সে দেখে ভাঙা ইটের একটা স্তূপের পেছনে লুকিয়ে থাকা তার একজন যোদ্ধা হঠাৎ ধপ করে বসে পড়ে, সম্ভবত প্রতিহত হওয়া কোনো গুলি আঘাত করেছে যেহেতু তাঁর সামনের দিক ভালোমতই সুরক্ষিত। তারপরে, নিজের দাস্তানা পরিহিত হাত আন্দোলিত করে নিজের লোকদের তাকে অনুসরণ করার ইঙ্গিত দিয়ে, যা তাঁরা সাহসিকতার সাথে করে, খুররম উঠে দাঁড়ায় এবং পুনরায় সামনের দিকে দৌড়াতে শুরু করে, আঘাত এড়াবার জন্য একটা ধ্বংসস্তূপ থেকে আরেকটার দিকে দিকে এগিয়ে যাবার সময় প্রতিপক্ষের নিশানা লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে সে খানিকটা এঁকেবেঁকে দৌড়ায়।

দুই মিনিট পরে সে যখন পুনরায় একটা নিম গাছের কাণ্ডের পেছনে ঘামে জবজবে অবস্থায় দম নেয়ার জন্য থামে যা কামানের গোলার আঘাতে ভূপাতিত হয়েছে, সে ততক্ষণে আরো ছয়শ গজের মত দূরত্ব অতিক্রম করেছে, গাদাবন্দুকের গুলি আর তীরের ঝাঁক শিস তুলে তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করে। সে তার বামগালে যাকে ঘামের একটা ধারা বলে মনে করেছিল সেটাকে সে তার গলায় ঝোলান মাখন রঙের বড় রুমাল দিয়ে মুছতে গিয়ে কাপড়ে রক্তের দাগ দেখতে পায়। সে হাতের দাস্তানা খুলে মুখে আঙুল দিয়ে খুঁজে দেখতে গিয়ে বাম কানের পাশে একটা ক্ষত আবিষ্কার করে, যা অবশ্য সামান্য ছড়ে যাবার ক্ষত, সম্ভবত কামানের কিংবা বন্দুকের গুলির কারণে ছিটকে আসা উড়ন্ত ইটের টুকরোয় সৃষ্টি। গাছের গুঁড়ির পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে সে দেখে যে নিরাপত্তা বেষ্টনী পর্যন্ত বাকি পথটায় তেমন আর কোনো আড়াল নেই যা প্রায় চারফিট উঁচু কিন্তু রাভি নদীর ওপাড় থেকে আসফ খানের কামানের গোলায় যার অনেকস্থানই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে দেখা যায়।

 খুররম তার চারপাশে সমবেত লোকদের দম ফিরে পাবার জন্য কয়েক মিনিট সময় দিয়ে তূর্যবাদকদের চিৎকার করে আদেশ দেয় আসফ খানকে পূর্ব নির্ধারিত সংকেত পাঠাতে যে তারা এবার নিরাপত্তা প্রাচীর আক্রমণ করবে আর তাই তাঁর কামানগুলোকে সেখানে গোলাবর্ষণ করা থেকে বিরত রাখতে। সে এরপরে নিশানাবাহকদের তাদের বিশাল সবুজ ঝাণ্ডা উঁচু করার আদেশ দেয়। সে এরপরে উঠে দাঁড়ায় এবং দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় মাথা নিচু করে নিরাপত্তা প্রাচীর লক্ষ্য করে আরো একবার দৌড়াতে শুরু করে। গাদাবন্দুকের গুলি আবারও তার পাশ দিয়ে বাতাসে শিস তুলে ছুটে যায় এবং একটা তীর তার বুকের বর্মে প্রতিহত হয়ে ছিটকে যায়। সে এর এক মুহূর্ত পরেই নদীর পাড়ে প্রায় অদৃশ্য একটা ইঁটের টুকরোয় হোঁচট খায় এবং প্রায় হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ে। নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে সে প্রায় সাথে সাথেই এরপর নিরাপত্তা প্রাচীরের কাছে পৌঁছে যায়। নিজের পেষল হাতের সাহায্যে দেহের পুরো ভর তুলে সে প্রাচীরের উপর দু’পা ফাঁক করে উঠে বসে এবং লাফিয়ে অন্যপাশে নেমে আসে। সে পায়ের উপর আলতো ভর দিয়ে লাফিয়ে নিচে নামার প্রায় সাথে সাথে দীর্ঘদেহী এক তবকির আক্রমণের মুখে পড়ে। গাদাবন্দুকটায় গুলি না থাকায় সে সেটাকে উল্টো করে ধরে এবং খুররমকে লক্ষ্য করে নলটা দিয়ে লাঠির মত তাকে আঘাত করতে চেষ্টা করে যে গোড়ালীর উপর ভর দিয়ে পেছনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে আঘাতটা এড়ায় আর সেই সাথে নিজের তরবারি ঢ্যাঙা লোকটার বিশাল পেটের গভীরে ঢুকিয়ে দেয়। সে তার রক্তাক্ত অস্ত্র লোকটার দেহ থেকে হ্যাঁচকা টানে বের করে আনতে ক্ষতস্থান থেকে সশব্দে বায়ু নির্গত হয়। খুররম তারপরে তাকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে আরেকজনকে নিজের বাকান তরবারি মাথার উপর উত্তোলিত করতে দেখে। খুররম আবার পেছনে সরে যাবার চেষ্টা করার সময় পিছলে গিয়ে নিজের গোড়ালী মচকায় এবং একপাশে কাত হয়ে পড়ে যায়। সে মাটিতে পড়লে প্রতিপক্ষ তাঁর সামনে আবির্ভূত হয়ে আঘাত করার প্রস্তুতি নিতে সে মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে গড়িয়ে একপাশে সরে যায়। লোকটা তরবারি তার মাথার পাশের মাটিতে গেঁথে যায়। খুররম তাঁর নিজের তরবারি দিয়ে লোকটা পায়ে আঘাত করে এবং লোকটাও এবার ভূপাতিত হয়। খুররম আপ্রাণ চেষ্টা করে দ্রুত হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসে প্রতিপক্ষ মাটিতে পড়ে থাকায় তরবারিটা গলা লক্ষ্য করে তাঁর পক্ষে যত জোরে সম্ভব নামিয়ে আনে। রক্ত কিছুক্ষণ গলগল করে বের হতে থাকে তারপরে লোকটা চিরতরে নিথর হয়ে যায়।

খুররম হাচড়পাঁচড় করে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং নিজের চারপাশে তাকালে, সে দেখে যে নিরাপত্তা প্রাচীর এখন তার লোকদের দখলে এবং সর্বত্র তাদের প্রতিপক্ষ লড়াই ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে এবং প্রাণপণে প্রাসাদের নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে। সে এরপরে নিজের সামনে থোয়ার ভিতর দিয়ে মোগলদের সবুজ নিশান আবির্ভূত হতে দেখে। মহবত খানের রাজপুত যোদ্ধারা অন্যপাশ দিয়ে নিরাপত্তা প্রাচীর ভেঙে ফেলেছে। প্রাসাদের মূল তোরণদ্বার আক্রমণ করো, খুররম চিৎকার করে বলে, উত্তেজনা আর ধোয়ায় তাঁর কণ্ঠস্বর কর্কশ শোনায়, এবং নিজের লোকদের সাথে নিয়ে সে মচকানো গোড়ালীর ব্যাথা সহ্য করে যতটা দ্রুত সম্ভব সামনের দিকে দৌড়াতে শুরু করে, পুরোটা সময় তবকি অথবা তীরন্দাজদের আক্রমণের সামনে পড়ার আশঙ্কা করতে থাকে। তাকে অবাক করে দিয়ে অবশ্য কোনো তীর অথবা সীসার গুলি ধেয়ে আসে না। শাহরিয়ারের বাহিনী যেন শূন্যে মিলিয়ে গিয়েছে। তারা কি যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে ফেলেছে নাকি তারা পূর্বনির্ধারিত কোনো পরিকল্পনা অনুযায় ভেতরের কোনো শক্তঘাঁটি অভিমুখে বা অতর্কিত হামলার জন্য নির্ধারিত স্থানে পশ্চাদপসারণ করছে?

খুররম দৌড়াবার সময় মাটিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় অসংখ্য গাদাবন্দুক আর তরবারি পড়ে থাকতে দেখে। সে উল্টে রাখা শকট আর অন্যান্য প্রতিরক্ষা অবস্থান পাশ কাটিয়ে যায়, যার কোনোটা কামান সজ্জিত যেখান থেকে তোপচি আর সেই সাথে তবকিরা মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করতে পারতো, কিন্তু একটা গোলা বর্ষণ না করেই যা পরিত্যক্ত হয়েছে। শাহরিয়ারের লোকেরা আসলেই পালাতে শুরু করেছে। খুররম শীঘ্রই প্রাসাদের উঁচু, ধাতব কীলক সজ্জিত কাঠের দরজার দিকে এগিয়ে যায় যা এখন খোলা এবং আপাতদৃষ্টিতে অরক্ষিত। সে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ভাবে, তাঁর বিজয় হয়েছে। নিজের সন্তানদের এখন তাকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু সহসা তাঁর পাশে দৌড়াতে থাকা দেহরক্ষী একটা পাথরের টুকরো এড়াবার জন্য দিক পরিবর্তন করে তাঁর সামনে চলে আসে এবং পরমুহূর্তেই হাত পা ছড়িয়ে সামনের মাটিতে পড়ে থাকে। লোকটার দেহ এড়িয়ে যাবার জন্য ঘুরে যাবার সময় খুররম নিচের তাকিয়ে দেখে লোকটা ঠিক কপালের মাঝখানে গুলি বিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সে এটা নিয়ে আর কিছু ভাববার অবকাশ পায় না তার আগেই সে তোরণগৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

*

মেহেরুন্নিসা প্রাসাদের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত নিজের আবাসন কক্ষের গবাক্ষ থেকে সরে দাঁড়ায় এবং শুক্তির রঙিন খোলা দিয়ে নক্সা করা বাটের গাদাবন্দুকটা নামিয়ে রাখে যা দিয়ে সে প্রচুর বাঘ শিকার করেছে। তার নিশানা এত দূর থেকেও লক্ষ্যভেদ করেছে। খুররমের সামনে দেহরক্ষীটা এভাবে কেন এগিয়ে এলো? সে তাকে দেখতে পেয়ে যুবরাজকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে এটা অসম্ভব। তার মন তারপরে এখন যখন প্রাসাদের পতন হয়েছে যা প্রতি মুহূর্তে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে আবার বরাবরের মত সক্রিয় হয়ে উঠে নিজেকে রক্ষা করার উপায় নিয়ে ভাবতে শুরু করে। খুররম আর তার লোকেরা শীঘ্রই তন্নতন্ন করে প্রাসাদে তল্লাশি চালান শুরু করবে তার সন্তানকে, তাকে এবং শাহরিয়ারকে খুঁজতে।

 শাহরিয়ার কোথায়? সে ব্যক্তিগতভাবে সৈন্য পরিচালনা করে নি, বা সে লাডলির সাথেও নেই যে তাঁর সন্তানদের নিয়ে পাশের কক্ষে অবস্থান করছে সে জানে। তাদের কারো উপরে তাঁর পক্ষে নির্ভর করা সম্ভব না বরং তাকে অতীতের মত আবারও নিজের বুদ্ধির উপরেই নির্ভর করতে হবে। সে ভালো করেই জানে যে তাঁর গাদাবন্দুকের গুলিটা অনেক অর্থেই একটা দূরপাতী গুলি ছিল। সে যদি এমনকি খুররমকে হত্যা করতে সক্ষমও হতো তাহলেও বোধহয় তাঁর লোকেরা আত্মসমর্পণ করতো না। তারা বরং–আরজুমান্দ আর তার ভাই আসফ খানের তাড়াহুড়োর কারণে–দারা শুকোহকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করতো। তার তাহলে কি, নিজের গাদাবন্দুকটায় গুলি ভরা এবং তাঁর আবাসন কক্ষের দরজা দিয়ে তাঁরা ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করলে প্রথমজনকে হত্যা করে, লড়াই করেই মৃত্যুবরণ করা উচিত? না। সে তার জন্মের পর থেকে অসংখ্যবার বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েও বেঁচে রয়েছে। সে এখনও মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত নয়। একটা শান্ত, সমাহিত আর তীক্ষ্ণধী মন মারাত্মক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে আর সেটাকে স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে। অসহায় নারী’ হিসাবে তাঁর অবস্থান একবারের জন্য হলেও তাকে সাহায্য করবে। সে জানে তাঁর কি করা উচিত…

*

খুররম তাঁর কয়েকজন দেহরক্ষীকে নিয়ে প্রাসাদের দ্বিতীয় তলার দিকে নেমে যাওয়া সাদা মার্বেলের দুই প্রস্থ সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নিচে নামতে শুরু করে যেখানে, তোরণগৃহের হট্টগোলের ভিতরে কিছুক্ষণ চিন্তা করার পরে তাঁর মনে পড়েছে রাজকীয় আবাসন কক্ষগুলো অবস্থিত। সে নিজের সন্তানদের খোঁজে একটামাত্র গবাক্ষ দ্বারা আলোকিত একটা স্থাপক পথের দু’পাশে অবস্থিত হাতির দাঁতের কারুকাজ করা দরজা একটার পর একটা খুলে দেখতে থাকে। তারা কোথায়? মেহেরুন্নিসা আর শাহরিয়ার কি নিজেদের নিরাপদ অতিক্রমণ নিশ্চিত করতে তাদের জিম্মি হিসাবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে গোপনে সরিয়ে ফেলেছে। নাকি তারচেয়েও জঘন্য, তাঁর সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁদের তাঁরা হত্যাই করেছে? সে ভাবে, মেহেরুন্নিসার কারণে সে সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারে না, নিজের অজান্তেই তার হাত তরবারির বাট আঁকড়ে ধরে।

সে প্রথম যে কক্ষটায় প্রবেশ করে সেটা পুরোপুরি ফাঁকা এবং জানালা দিয়ে প্রবাহিত হওয়া বাতাসে কেবল মাত্র মসলিনের পদাই আন্দোলিত হচ্ছে। দ্বিতীয় কক্ষটাও শূন্য এবং তৃতীয়টাও যদিও উপুড় হয়ে থাকা একটা রূপার পানপাত্র আর মাটিতে গড়িয়ে পড় শরবত দেখে বোঝা যায় যে কক্ষের বাসিন্দা একটু আগেই তাড়াহুড়ো করে জায়গাটা ত্যাগ করেছে। সে কক্ষটা থেকে তরবারি হাতে বের হয়ে আসতে স্থাপন পথ বরাবর দূরে অবস্থিত একটা দরজা খুলে যায় এবং ভেতর থেকে পিঠ সোজা করে কালো কাপড়ে আবৃত একটা নারী মূর্তি বের হয়ে আসে একটা মাখন রঙের শাল দিয়ে তাঁর মুখ ঢাকা। অবগুণ্ঠিত রমণী মাথা উঁচু করে তার দিকে স্থির পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে শুরু করে। খুররম প্রায় সাথে সাথে অবয়বটা অঙ্গস্থিতি আর সৌশাম্য দেখে বুঝতে পারে যে সেটা স্বয়ং মেহেরুন্নিসা। সে তাকে আটকাবার আদেশ দেয়ার আগেই সে তাঁর শাল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তার কাছ থেকে বারো ফিট দূরে মেঝের উপর নিজেকে নিক্ষেপ করে।

 ‘খুররম, আমি আত্মসমর্পণ করছি। কাঙ্খিত সিংহাসন এখন কেবল তোমার। তোমার যা ইচ্ছা আমার সাথে করতে পারো,’ সে বলে কিন্তু তারপরে যোগ করে, কিন্তু তার আগে তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাইবে দারা শুকোহ আর আওরঙ্গজেব কোথায় আছে?

খুররম অপলক তাকিয়ে থাকে। মেহেরুন্নিসা কি তাঁর একমাত্র সম্ভাব্য দরকষাকষির অনুষঙ্গ তাঁর সন্তানদের নিজের জন্য কোনো ধরনের ছাড় না চেয়েই সমর্পণ করবেন?

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। তারা কোথায় আছে?

 ‘প্রাসাদের পূর্বভাগে বৃত্তাকার বেলেপাথরের গম্বুজের ভূগর্ভে অবস্থিত দুটো ছোট কক্ষে শাহরিয়ার তাদের বন্দি করে রেখেছে। তারা চব্বিশ ঘন্টা প্রহরাধীন অবস্থায় রয়েছে, যদিও শাহরিয়ার আর তার লোকেরা সাহসের যে নমুনা দেখিয়েছে সেটা বিবেচনা করে বলা যায় প্রহরীরা নিজেদের জান বাঁচাতে এই মুহূর্তে নাক বরাবর ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাচ্ছে। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তোমার সন্তানেরা সুস্থ আছে, যদিও আলো বাতাসের অভাব আর বন্দি থাকার কারণে খানিকটা ফ্যাকাসে আর রোগা হয়ে গিয়েছে।’

 ‘তুমি নিশ্চয়ই আমার কাছে মিথ্যা বলছো না, বলছো কি?’ খুররম আশা আর ভয়ের মাঝে দোদুল্যমান অবস্থায়, চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে। সবকিছুই কেমন বেশি সহজ মনে হচ্ছে। এটাও কি মেহেরুন্নিসার অনেক চালাকির একটা–কোনো ধরনের ফাঁদ?

‘আমি কেন মিথ্যা বলতে যাব? সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। তুমিই চূড়ান্ত বিজয়ী। তোমার ক্রোধের কারণ হয়ে আমি সম্ভাব্য কি সুবিধা লাভ করতে পারবো? তুমি এখন আগে তাঁদের কাছে যাও।’

 ‘এই রমণীকে হেরেমে আটকে রাখো। আমি পরে তার ভাগ্য নির্ধারণ করবো, খুররম সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নিচে নেমে তোরণগৃহের নিচে দিয়ে বের হয়ে সূর্যালোকিত প্রাঙ্গণে যাবার আগে তাঁর লোকদের আদেশ দেয়। সে শাহরিয়ারের কিছু সৈন্যকে সেখানে হাত পিছমোড়া অবস্থায় আসনসিঁড়ি করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকতে দেখে যখন তাঁর লোকেরা অন্যদের খুঁজছে আর ধৃত অস্ত্র জমা করছে।

হা, পশ্চিম প্রান্তে একটা বৃত্তাকার গম্বুজ রয়েছে এবং, হ্যাঁ, সেখানে মনে হচ্ছে মাটির নিচে ভূ-গর্ভের দিকে একপ্রস্থ সিঁড়ি নেমে গিয়েছে। খুররম সেদিকে দৌড়ে যায় এবং একবারে দুটো করে ধাপ টপকে নিচে নামতে শুরু করে, কিন্তু শেওলা-আবৃত নিচের একটা ধাপে তার পা পিছলে যায় এবং সে আবারও গোড়ালি মচকায়। নিজেকে গড়িয়ে পড়ার হাত থেকে কোনোমতে রক্ষা করে, সে চারপাশে তাকিয়ে একটা নিচু খিলানের পেছনে সেঁতসেঁতে, ছাতার গন্ধযুক্ত, অন্ধকার গলি দেখতে পায়। সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিজের দেহরক্ষীদের নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। সেটা একটা কানা-গলি কিন্তু দেখা যায় দুপাশে একটা করে দরজা রয়েছে। প্রতিটা দরজার উপরিভাগ কেটে লোহার ছোট গরাদ বসানো হয়েছে এবং দুটো দরজাই লোহার শেকল দিয়ে আটকানো।

 ‘দারা আর আওরঙ্গজেব, খুররম চিৎকার করে উঠে, “তোমরা কি ভিতরে আছো?’

 কোনো উত্তর শোনা যায় না। সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে সে ডান দিকের দরজার উপরের লোহার গরাদের ভিতর দিয়ে উঁকি দেয়। আওরঙ্গজের গরীব গ্রামবাসীর গৃহে যেমন পাওয়া যায় সেরকম দড়ির একটা চারপায়ায় শুয়ে রয়েছে, একটা নোংরা খয়েরী কাপড় তার মুখে গোঁজা আর তার দু’হাত দেয়ালের সাথে শিকল দিয়ে আটকানো। চারপায়ার নিচে মল-মূত্রে কানায় কানায় ভরা একটা পিতলের পাত্রের পাশেই মাটির বাসনে আধ-খাওয়া একটা চাপাতি পড়ে রয়েছে। খুররম অন্য গরাদের ভিতর উঁকি দেয়ার সময় নিজের সন্তানকে জীবিত দেখার স্বস্তির সঙ্গে তাঁদের সাথে কেউ এমন আচরণ করতে পারে দেখে সৃষ্ট ক্রোধ মিশে যেতে থাকে এবং দেখে দারা শুকোহ একইভাবে মুখ আর হাত বাধা অবস্থায় সেখানে রয়েছে।

 দরজাগুলো ভেঙে ফেলো, সে চিৎকার করে তার সাথের দেহরক্ষীদের আদেশ দেয়। একজন–স্থূলদেহী রাজপুত–দুটো দরজাই পর্যায়ক্রমে গায়ের পুরো শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতে শুরু করে কিন্তু খুব একটা লাভ হয় না। অন্য আরেকজন তারপরে একটা লম্বা লোহার দণ্ড খুঁজে বের করে এবং দারা শুকোহর দরজার শিকলের ভেতর সেটা প্রবিষ্ট করায় এবং প্রবল একটা গর্জনের সাথে তীব্র মোচড় দিয়ে শিকলের একটা আংটা খুলে ফেলে। দরজা খোলা মাত্র খুররম তাঁর সামনের লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে পূতিগন্ধময় কামরার ভেতরে প্রবেশ করে। সে কাঁপা কাঁপা আঙুলে দ্রুত তার মুখের বাঁধন খুলতে শুরু করে যখন অন্য দেহরক্ষীরা হাতের শিকল ভেঙে ফেলে। দারা শুকোহ, তুমি এখন নিরাপদ, সে, প্রাণপণে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত যখন মুখের বাঁধন খুলতে সফল হয়, বলে। দারা শুকোহ, একই সময়, তাঁর হাতের বাধন খুলে যেতে-আবেগে তাঁর পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে–দু’হাতে তার আব্বাজানের গলা জড়িয়ে ধরে। আওরঙ্গজেবকে অন্য দেহরক্ষীরা কিছুক্ষণ পরে মুক্ত করতে সক্ষম হলে সে দৌড়ে ভাইয়ের প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে এবং দু’জনকেই জড়িয়ে ধরে। খুররম স্বস্তি এবং আনন্দের অশ্রু আর চেপে রাখতে পারে না। কিন্তু বর্ণনার সাথে তাদের এই আপাত সাদৃশ্যের মাঝেও সে লক্ষ্য করে যে তাঁদের চোখ কোটরাগত এবং তাদের যেমন স্বাস্থ্য হওয়া উচিত তারা তারচেয়ে কৃশকায়।

 কয়েক মিনিট পরে যে সময়টা তারা কেউই কোনো কথা বলতে পারে না খুররম জানতে চায়, তোমাদের কতদিন এভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে? ‘আব্বাজান, চৌদ্দদিন, দারা শুকোহ বলে, তার কণ্ঠস্বর মুখে কাপড় গোঁজা থাকার কারণে এখনও রুক্ষ আর কর্কশ।

‘আমাদের তখন থেকেই একহাত দেয়ালে বাধা অবস্থায় এসব প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কয়েক ঘন্টা আগে আমাদের দু’হাত বেধে মুখে কাপড় গোঁজা হয়েছে, আওরঙ্গজেব খুলে বলে।

‘তোমাদের বন্দি করার আদেশ কে দিয়েছিল?

 ‘আমাদের প্রথম যখন এখানে নিয়ে আসা হয় তখন প্রহরীদের একজন আমায় বলেছিল শাহরিয়ারের আদেশে, দারা শুকোহ বলে। প্রহরীটা আমার সাথে ভালো আচরণ করতো আর হাতকড়া পরাবার আগে কব্জিতে নরম কাপড় জড়িয়ে দিতে। তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করে সদয় আচরণ করবেন।’

‘আমি দেখবো তাকে যেন কঠোর শাস্তি দেয়া না হয়। সে কি তোমায় বলেছিল যে শাহরিয়ার তোমায় কেন বন্দি করছে?

‘আমরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারি অথবা আমাদের কেউ উদ্ধার করতে না পারে যাতে সে আমাদের জিম্মি হিসাবে ব্যবহার করতে পারে,’ দারা শুকোহ বলে এবং তারপরে এক মুহূর্ত পরে বলে, ‘আব্বাজান, আমার মনে হয় শাহরিয়ার কিছুক্ষণ আগে আমাদের নিয়ে যাবার জন্য এখানে এসেছিল। দরজার শিকল ধরে কেউ এমনভাবে নাড়াচাড়া করছিল যেন শিকল খুলতে চেষ্টা করছে এবং আমার মনে হয় প্রহরীদের উদ্দেশ্যে আমি একটা কণ্ঠস্বরকে জিকার করতে শুনেছি। কিন্তু তারা কেউ আসে নি এবং সেও দরজা খোলার কোনো উপায় খুঁজে পায় নি।

 ‘সেটা হয়ত ভালোই হয়েছে। ভয় আর আতঙ্কে জর্জরিত অবস্থায় সে কি করে বসতো তার কোনো ঠিক নেই, খুররম বলে, মেহেরুন্নিসার পরিবর্তে তার সমস্ত ক্রোধ ক্রমশ শাহরিয়ারের উপরে পুঞ্জীভূত হতে থাকে। তিনি অন্তত তাঁর মুখোমুখি হবার সাহস দেখিয়েছেন এবং এটুকু বোঝার মত শুভবুদ্ধি তার অন্তত রয়েছে যে কখন তিনি পরাস্ত হয়েছেন এবং তাঁর সন্তানদের অবস্থান প্রকাশ করা। নিজেকে সন্তানদের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে, সে বলে, চলো তোমাদের উপরে সূর্যের আলোয় নিয়ে যাই। আমি শাহরিয়ারকে খুঁজে বের করার সময় তোমরা গোসল করে খাবার খাবে।

 তাঁরা দ্রুত ভূ-গর্ভস্থ সেঁতসেঁতে কক্ষ ত্যাগ করে এবং সিঁড়ি দিয়ে উপরের আলোয় উঠে আসে, দুই ছেলেই বেশ কয়েকদিন অন্ধকারে থাকায় তারা সূর্যের দীপ্তি থেকে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে রাখে।

 তারা উপরে উঠে আসবার এক কি দুই মিনিট পরে, খুররম দেখে হেরেমের দিক থেকে একজন মহিলাকে রূঢ়ভাবে ধাক্কা দিয়ে প্রাঙ্গণের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে। তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় কল্পনা করার চেষ্টা করা মেহেরুন্নিসা নিরবে নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে তাঁর কাছে নিজেকে সমর্পণ করার সত্ত্বেও আবার নতুন করে কি নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে। সে, অবশ্য, শীঘ্রই বুঝতে পারে এই রমণী মেহেরুন্নিসার চেয়ে লম্বা এবং তার কাঁধও বেশ চওড়া। প্রহরীরা তাকে খুররমের কাছে টেনে নেয়ার সময় সে তার গায়ের সব শক্তি দিয়ে বাঁধা দিতে চেষ্টা করছে, নিজের পা ফেলতে অস্বীকার করছে এবং প্রাণপনে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। সে যখন আরেকটু কাছে আসে খুররম দেখে তাঁর চিবুকে খোঁচা খোঁচা দাড়ি রয়েছে যা এমনকি সবচেয়ে লোমশ মহিলার থাকার কথা নয়। মেয়েমানুষের পোষাক পরিহিত একজন পুরুষ–শাহরিয়ার, তার তার সুদর্শন মুখাবয়ব ডান চোখের চারপাশ ফুলে বেগুনী হয়ে উঠার কারণে, যা প্রায় বন্ধ হয়ে আছে, নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সে স্পষ্টতই সুবোধ বালকের মত ধরা দেয় নি।

 ‘তোমরা একে কোথায় খুঁজে পেয়েছো?’ শাহরিয়ারকে ধরে রাখা প্রহরীদের একজনকে খুররম জিজ্ঞেস করে, যে ইতিমধ্যে হাঁটু ভেঙে বসে পড়েছে এবং তাঁর দু’হাত অনুনয়ের ভঙ্গিতে পরস্পরকে আঁকড়ে রয়েছে।

 ‘আমরা সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নিসা, তার কন্যা লাডলী এবং লাডলীর সন্তানকে বন্দি করার পরে হেরেমে তল্লাশি শুরু করি। আমরা সেখানে এমন কাউকে দেখতে পাইনি যার সেখানে থাকার অধিকার নেই যতক্ষণ না আমরা সেখানের সর্বশেষ আর সবচেয়ে ছোট কক্ষের সামনে উপস্থিত হই। আমি ভেতরে প্রবেশ করি। কক্ষটায় ময়লা কাপড় আর অপরিষ্কার বিছানার চাদর পরিষ্কার করতে পাঠাবার আগে জমা করা হয়। প্রথমে সবকিছুই ঠিকঠাক আছে বলে মনে হয়, কিন্তু আমি যখন বের হয়ে আসবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছি, দরজার কাছে ধোয়ার জন্য রাখা বিশাল একটা সাদা কাপড়ের স্তূপের ভেতরে একটা হাল্কা একটা নড়াচড়া আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এতই মৃদু যে ইঁদুর হওয়াও বিচিত্র না কিন্তু আমি ব্যাপারটা অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ, আমি খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি কাপড়ের স্তূপে যখন লাথি মারি, আমার পা মাংসে আঘাত করে এবং একজন মহিলা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং পালাতে চেষ্টা করে, সে পালিয়ে যাবার সময় আমার মুখে খামচে দিয়ে যায়। আমি পেছন থেকে তাঁর কাঁধ চেপে ধরি এবং তাকে কাপড়ের স্তূপের উপর চিৎ করে ফেলে দেই এবং সে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য আমি তার দুপাশে দু’পা রেখে, হাঁটু ভেঙে বসে পড়ি। কে তুমি? কেন তুমি পালাতে চেষ্টা করছো?” আমি চিৎকার করে জানতে চাই। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমায় ধর্ষণ করবে। আমি একজন কুমারী এবং তোমার মত একজন অভদ্র যোদ্ধার লালসার শিকার হবার কোনো ইচ্ছা আমার নেই,” সে বেশ উঁচু স্বরে বলে। আমি যদিও আগে কখনও কোনো মেয়ের এমন কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনিনি, তারপরেও আমি তাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে শুরু করি কিন্তু আমি দাঁড়াতে গেলে সে হাঁটু দিয়ে আমার কুঁচকিতে আঘাত করে। আমি ব্যাথায় দু’ভাজ হয়ে কুঁকড়ে গেলে সে ধাক্কা দিয়ে আমায় একপাশে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে কিন্তু আমি তাকে ধরে ফেলি। সে এরপরে আমার বাহু কামড়ে দেয়। সেই সময়েই তার নেকাব আলগা হয়ে যায় এবং আমি দেখি সে আসলে একজন পুরুষ এবং আমি তাকে জোরে ঘুষি মারি। সে এরপরে আর ধ্বস্তাধ্বস্তি করার চেষ্টা করে নি।

 ‘তুমি ভালো কাজ করেছো, খুররম বলে। শাহরিয়ারের দিকে তাকিয়ে সে এরপরে জানতে চায়, আর শাহরিয়ার, নিজের পক্ষে সাফাই দেয়ার জন্য তোমার কি বলার আছে?

আমায় মাফ করে দাও, তার সৎ-ভাই মিনতি করে, খুররমের দিকে সে সানুনয়ে তাকিয়ে রয়েছে।

তুমি আমার সন্তানদের সাথে যে আচরণ করেছে তারপরে কেন আমি তোমায় ক্ষমা করবো? তোমার এতবড় স্পর্ধা তুমি নির্দোষ যুবরাজদের সাথে সাধারণ অপরাধীদের মত আচরণ করেছো?”

 ‘আমি এসব করিনি। আমি কেবল

 ‘কেবল কি?

‘মেহেরুন্নিসার আদেশ অনুসরণ করেছি।’

 ‘দেখা যাক তাঁর এসম্বন্ধে কি বলার আছে। সম্রাজ্ঞীকে এখানে নিয়ে এসো, খুররম সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীদের একজনকে আদেশ দেয়। তাকে কয়েক মিনিট পরে খুররমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, এখনও তাকে শান্ত আর সমাহিত দেখায়। এই কীট বলছে সে কেবল আপনার আদেশ পালন করেছে।’

 ‘বেশ, তাকে সেগুলো উপস্থাপন করতে বলেন। কি ধরনের পুরুষ মানুষ হলে তবে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে নিজেকে সে মেয়েদের আঁচলের পেছনে লুকিয়ে রাখতে পারে? আমি কি পরামর্শদাতাদের সভায় অংশগ্রহণ করেছি? আমি কি তোমার সন্তানদের হাতকড়া পরাবার আদেশ দিয়েছি? তাদের প্রহরীদের জিজ্ঞেস করো–যদি তুমি তাদের খুঁজে পাও।

তার ছেলেরা তাকে কি বলেছে সেটা মনে করে, খুররম ভাবে, যুক্তিসঙ্গত কথা। বেশ শাহরিয়ার, এই অভিযোগের জবাব দাও।’

 ‘কিন্তু আমি জানি তিনি ঠিক এটাই চেয়েছিলেন… যে আমার কার্যকলাপ তাকে এবং লাডলীকে প্রীত করবে। আপনার অধপতন আর অপমান মেহেরুন্নিসাকে প্রহৃষ্ট করেছে। তিনি নিজে এর পেছনে ছিলেন, সবাই সেটা জানে।’

‘মেহেরুন্নিসা, এটা কি সত্যি?

 ‘বহু বছর যাবত আমি তোমার বন্ধু নই। আমি অবশ্যই সেটা স্বীকার করি। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত শত্রুতা কিংবা সংকীর্ণ আক্রোশের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করি। আমাদের সবার উচিত প্রথমে নিজের দিকে তাকানো। আমি আমার নিজের স্বার্থরক্ষায় কাজ করেছি… সেটা করতে গিয়ে আমি তোমার আর আরজুমান্দের স্বার্থহানির কারণ হয়েছি কিন্তু সেটা মূল উদ্দেশ্য ছিল না সেটা ছিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। হ্যাঁ, আমি হয়তো তোমার অধিকাংশ দুর্ভোগের জন্য দায়ী এবং হ্যাঁ, আমি সেজন্য মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত… কিন্তু তোমার জানা উচিত যে তোমার সন্তানদের প্রতি আচরণের মাঝে সংকীর্ণ, বিদ্বেষপূর্ণ পরিশোধন করা আমার চরিত্রের সাথে মানানসই না।’

 খুররম ভাবে, এটা নিশ্চিতভাবে সত্যি। দারা শুকোহ তাকে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে বলেছে যে বন্ধুভাবাপন্ন প্রহরী তাকে বলেছিল যে শাহরিয়ার ব্যক্তিগতভাবে তাকে নির্দেশ দিয়েছে যে তাদের প্রকোষ্ঠে সরবরাহ করা খাবার যেন রাজকীয় রন্ধনশালা থেকে পাঠান না হয় কেবল চাপাতি আর পানি আর তাদের ডিভানের পরিবর্তে চারপায়া। তার মাঝে আবারও ক্রোধ পুঞ্জীভূত হতে শুরু করে যখন সে জানতে চায়, মেহেরুন্নিসা যা বলেছে সেটা কি সত্যি?’ শাহরিয়ার কোনো উত্তর দেয় না। তোমার মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য, খুররম তাকে বলে, এবং তারপরে মেহেরুন্নিসার দিকে ঘুরে জানতে চায়, ‘কেন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে না সেজন্য সাফাই হিসাবে আপনার কিছু বলার আছে?

মেহেরুন্নিসা নিজেকে ইস্পাতের ন্যায় কঠোর করে তুলে ঠিক যেমনটা সে করেছিল বহুবছর আগে জাহাঙ্গীরের সামনে তার নির্যাতিত, রক্তাক্ত, কুচক্রী ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার সময়। শাহরিয়ারের জন্য তার কিছুই করার নেই। তাঁর নিজেকে আর মেয়েকে এবং নাতনিকে বাঁচার একটা সুযোগ দিতে হলে শাহরিয়ারকে উৎসর্গ করা প্রয়োজন।

 ‘একজন মেয়ের পরামর্শের কি মূল্য আছে, তার কার্যকলাপ মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য। তাকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থই হল তোমার সিংহাসনের জন্য হুমকি হতে পারে এমন একজনকে বাঁচিয়ে রাখা। তোমার পূর্বপুরুষদের প্রদর্শিত উদারতার ফলে সৃষ্ট বিপদের কথা মনে রেখো। কামরান আর হুমায়ুন, খসরু আর তোমার আব্বাজানের কথা চিন্তা করো। বিদ্রোহী একবার ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করলে সে আবার সেটা চাইবে। তুমি, তোমার প্রিয়তমা আরজুমান্দ আর তোমার সন্তানেরা শাহরিয়ারের বিদায়ের ফলে নিরাপদে ঘুমাতে পারবে। তুমি নিজেও মনের গভীরে ভালো করেই সেটা জানো। তুমি শাহরিয়ারকে মৃত দেখতে চাও, এবং খসরুকেও। আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি… প্রশ্ন হলো সেটা স্বীকার করার মত সাহস কি তোমার আছে? বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন সেটা করতেই হবে। তোমার বিবেককে নতজানু করতে আমার শব্দগুলো ব্যবহার করতে পারো যদি তুমি এতই দুর্বল হও যে সেটা করা প্রয়োজন হয়। একজন নারী দোষের ভাগীদার হোক। কেন নয়?

খুররমের মাথার ভিতরে মেহেরুন্নিসার শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। হ্যাঁ, নিজের অন্তরে যদিও সে জানে তাঁর আব্বাজানের শূন্য সিংহাসন অধিকার করার জন্য সে তার সৎ-ভাইদের প্রতি ভিন্ন আচরণ প্রদর্শন করতো না, তারা যদি মারা যায় এবং তাদের হুমকি চিরতরে লোপ পায় তাহলে সে খুশিই হবে। আর হ্যাঁ, অন্যকারো উপরে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব। চাপিয়ে দেয়ার মত আকাঙ্খ পোষন করার মত সে দুর্বলই বটে যাতে নিজের স্বার্থপরতার গভীরতার মুখোমুখি হবার তার কোনো প্রয়োজন হয়… কিন্তু সে যদি একজন সম্রাট হতে চায় তাহলে তাকে দায়িত্বের বোঝ নিতেই হবে। কিছু সময় পরে যে সময়টায় কেউই কোনো কথা বলে না, সে বলে, শাহরিয়ায়, এখন তোমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে–এজন্য নয় যে তোমার অপরাধ এমনই গুরুতর বরং রাজবংশ, আমার আর আমার সন্তানদের খাতিরে। প্রহরী তাকে নিয়ে যাও। তরবারির আঘাতে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে। দ্রুত আর নিখুঁতভাবে এটা করবে।

 শাহরিয়ার জ্ঞান হারিয়েছে বলে মনে হয় এবং প্রহরীরা নিচু হয়ে ঝুঁকে তাকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করে। প্রাঙ্গণের অর্ধেক অতিক্রম করার পরেই সে চিৎকার শুরু করে, তাদের মুঠোর মাঝে বেঁকে যায়, লাথি মারতে চেষ্টা করে। কোনো কারণে, হয়তো যা ঘটছে সেজন্য নিজের সংকল্প আর দায়িত্ব প্রদর্শনের জন্য, খুররম নিজেকে বাধ্য করে প্রহরীরা যতক্ষণ না তার সৎ-ভাইকে নিয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় ততক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে। সে তারপরে মেহেরুন্নিসার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। সে এখনও তাঁর দিকে শীতল আর অবজ্ঞার সাথে তাকিয়ে রয়েছে, চোখ সংহত আর ঠোঁটদ্বয় পরস্পরের শক্ত করে চেপে বসে আছে। কিন্তু সে যখন তাকে খুটিয়ে দেখে, খুররম অনুভব করতে শুরু করে যে তিনি একজন বৃদ্ধ মহিলা। তার চোখের নিচে ফোলা এবং তার কালো চোখের মণি কিনারার দিকে ধুসর হতে শুরু করেছে। তার উপরের ঠোঁট পাতলা ফিনফিনে চুলে আবৃত এবং তার মুখের চারপাশে বলিরেখা পরা আরম্ভ হয়েছে। তাঁর চোয়াল ঝুলতে শুরু করেছে। তিনি একজন বয়স্ক বিধবা যার কাছ থেকে তার রূপের মত ক্ষমতাও পুরোপুরি হ্রাস পেতে শুরু করেছে, তার যতই এখনও ঘটনাবলী প্রভাবিত করার আকাঙ্খ থাকুক। শাহরিয়ারের মত তিনি মৃত্যু ভয়ে ভীত নন। তাকে উপেক্ষা করাই হয়ত আরো বড় শাস্তি হবে। সে দেখুক কোনো কিছুর জন্য তাকে এখন কত কম গুরুত্ব দেয়া হয়।

 ‘মেহেরুন্নিসা, আপনার জন্য, রাজকীয় বিধবার কাছে যেমন প্রত্যাশিত আপনি সেভাবে নির্জনে আপনার শোক পালন করবেন। আমি আপনার জন্য একটা দূরবর্তী স্থান খুঁজে বের করবো যেখানে আপনি হয়তো আপনার ক্ষতি আর আপনার পাপের মাঝে মধ্যস্থতা করতে পারবেন এবং পৃথিবীর কর্মকাণ্ড দ্বারা কোনোভাবেই বিব্রত না হয়ে যা শীঘ্রই আপনার কথা বিস্মৃত হবে, আল্লাহর উপাসনায় মগ্ন থেকে পরপারের ডাকের জন্য অপেক্ষা করবেন।’

 মেহেরুন্নিসাকে যখন নিয়ে যাওয়া হয় সে কোনো কথা বলে না। সে যা চেয়েছিল আরো একবার ঠিক তাই পেয়েছে। সে বেঁচে থাকবে। অবশ্য, তার নিয়তির বাস্তবতা যখন সে অনুধাবন করতে আরম্ভ করে তখন সে কল্পনা করতে শুরু করে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবার চেয়ে এখনই কি মৃত্যুবরণ করাটা তার জন্য ভালো হতো। মৃত্যু অবধারিত। সে কেন তাকে এখন ডেকে নিয়ে এলো না যখন সে জানতো সেটা করতে পারবে? একবারের মত হলেও কি সে সাহস দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে? এটা এমন একটা প্রশ্ন যা তাকে তাড়িত করতে থাকবে।

*

সেই রাতে, রাজকীয় আবাসন এলাকায় বসে নিজের লোকদের উৎফুল্ল পানাহারের আওয়াজ শুনতে শুনতে খুররম মোমের আলোয় দুটো চিঠির মুসাবিদা করে। প্রথমটা আরজুমান্দের কাছে, দীর্ঘ আর প্রেমপূর্ণ এবং তাঁদের সন্তানদের নিরাপত্তা আর কীভাবে সে সিংহাসন নিরাপদ করেছে সেই সংবাদ। তার রাজধানীতে তাঁর অভিষেকের প্রস্তুতির জন্য যত শীঘ্রি সম্ভব সে তাঁদের অবশিষ্ট সন্তানদের নিয়ে আগ্রার বাইরে তার সাথে মিলিত হবার জন্য চিঠিটায় তাকে আসতে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় চিঠিটার প্রাপক বুরহানপুরের সুবেদার এবং অনেক সংক্ষিপ্ত আর অনেকবেশি বিষণ্ণ।

*

তূর্যনিনাদের ঝঙ্কারে খুররম, আওরঙ্গজেব আর দারা শুকোহকে নিয়েআগ্রা থেকে পাঁচ মাইল দূরে সিকান্দ্রা গ্রামে অবস্থিত তাঁর শিবিরে লাল তাবুর ভেতর থেকে মাথা নিচু করে দ্রুত বের হয়ে আসে। তাঁর প্রিয় দাদাজান আকবরের সমাধিসৌধের কাছে–আকাশের বুকে ভেসে থাকা বিশাল বেলেপাথরের তোরণদ্বার নিম গাছের মাঝ দিয়ে দৃশ্যমান–সিকান্দ্রাকে খুররমের কাছে মনে হয় আগ্রায় তার বিজয়দীপ্ত প্রবেশের পূর্বে যাত্রাবিরতির সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। অনাড়ম্বর সৈন্যদের তাবু আর সামরিক শৃঙ্খলায় পরিচালিত এটা কোনো সামরিক অভিযানের শিবির নয়, বরং একটা বিশাল তাবুর শহর যেখানে তাঁর বিজয় উদ্যাপনের উৎসব ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তার তাবুর চারপাশে সবদিকে ছড়িয়ে থাকা অনুগত অভিজাত ব্যক্তি আর সেনাপতিদের তাবুর শীর্ষে সবুজ মোগল নিশান পতপত করে উড়ছে। দুই সপ্তাহ পূর্বে লাহোর থেকে তাঁর আগমনের পর থেকেই ভোজসভা আর মনোরঞ্জনের জন্য মক্তহস্তে ব্যয় করা হচ্ছে, আগ্রার কোষাগার থেকে, যার ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে যার চাবি এখন তাঁর কাছে রয়েছে। অভিষেকের অপেক্ষায় অপেক্ষমান মোগল সম্রাটের ডাকে সাড়া দিয়ে অনুগত রাজাদের আগমনের ফলে প্রতিদিনই তাঁর শিবিরের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আর অবশেষে অন্য সবার চেয়ে যার আগমনের জন্য সে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্ষায় ছিল ঘনিয়ে এসেছে। সে মধ্যাহ্নের উজ্জ্বল সূর্যালোকে আরজুমান্দকে তার যাত্রাপথের শেষ কয়েক মাইল বহন করে আনবার জন্য জাঁকজমকের সাথে সজ্জিত যে হাতি প্রেরণ করেছিল সেটার পান্না বসান রূপার হাওদা চিকচিক করতে দেখে। তাঁর হাতির সামনে মহবত খানের রাজপুত যোদ্ধাদের একটা দল রয়েছে আর পেছনে তার সন্তানের কোনো হাতিতে রয়েছে সে ঠিক বুঝতে পারে না যাঁদের ভিতরে রয়েছে তার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র মুরাদ বকস যাকে সে এখনও দেখে নি। তাঁর পরিবার অবশেষে পুনরায় একত্রিত হচ্ছে এই ভাবনাটায় মোগল সিংহাসনে আরোহণের মুহূর্তের কথা সে যখন চিন্তা করে তারচেয়েও বেশি আনন্দে তাকে আপুত করে তুলে। সে আওরঙ্গজেব আর দারা শুকোহর দিকে তাকিয়ে হাসে, উভয়ের পরনে এই মুহূর্তের জন্য উপযুক্ত রূপার জরির কারুকাজ করা পাগড়ি আর কোট। তোমাদের আম্মাজান। তিনি আসছেন,’ সে মৃদু কণ্ঠে বলে।

 আরজুমান্দের হাতির আগমন উপলক্ষ্যে হেরেমের তাবুর সামনে স্থাপিত প্রায় বিশ ফিট উঁচু চূড়াযুক্ত একটা তাবুর দিকে তাদের নিয়ে এগিয়ে যায়। আরজুমান্দকে বহনকারী হাতিকে তাঁর সোনালী রঙ করা কানের পেছনে বসে থাকা দুই মাহুত তাঁদের হাতের লোহার দণ্ডের সাহায্যে দক্ষতার সাথে বিশাল তাবুর দিকে নিয়ে আসবার সময় খুররম তার দুই সন্তানের কাঁধে হাত দিয়ে নিজেকে জোর করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করে। খুররম আর তার দুই সন্তানকে অনুসরণ করে অচিরেই হাতিটা তাবুর ভেতর করতে, পরিচারকেরা পর্দা আবার যথাস্থানে টেনে দেয়। খুররম অপেক্ষা করে যখন মাহুতেরা বিশাল প্রাণীটাকে হাঁটু মুড়ে বসায় এবং দ্রুত গলার উপর থেকে পিছলে নিচে নেমে এসে সোনার গিল্টি করা নামবার জন্য ব্যবহৃত কাঠের টুকরো জায়গামত স্থাপন করে যা প্রস্তুত অবস্থায় রাখা ছিল। তারপরে, পরিচারকেরা বুকে উপরে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত রেখে তাদের দিকে মুখ করে পেছনে হেঁটে তাবু থেকে বের হয়ে যায়।

খুররম বুকে হৃৎপিণ্ড মাদলের বোল তুলে স্পন্দিত হতে থাকলে, সে ধীরে কাঠের খণ্ডের ধাপ বেয়ে উপরে উঠে মুক্তোখচিত সবুজ রেশমের পর্দা ধীরে টেনে সরায়। আরজুমান্দের চোখের দিকে তাকিয়ে সে কোনো কথা বলতে পারে না। হাওদার মাঝে ঝুঁকে এসে সে তাকে আলিঙ্গন করে তার উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় আশ্লেষে চুম্বন করে। আমি এই মুহূর্তটার জন্য কতদিন ধরে অপেক্ষা করছি…মাঝে মাঝে মনে হতো যে এটা বোধহয় আর কখনও আসবে না। কিন্ত এখানে আরো দু’জন রয়েছে যারা আমার চেয়েও দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে রয়েছে, সে তাকে অবশেষে নিজের আলিঙ্গন থেকে মুক্তি। দেয়ার সময় ফিসফিস করে বলে। সে হাওদার রূপার দরজা খুলে দেয় এবং তাঁর মেহেদি রঞ্জিত হাত ধরে একসাথে ধাপ বেয়ে নিচে নামে। নিজের সন্তানদের দিকে তাকিয়ে ইতিমধ্যে তাঁর চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। তাররে, তাবুর ভেতরে প্রজ্জ্বলিত অসংখ্য তেলের প্রদীপের কোমল আলোয় সে দারা শুকোহ আর আওরঙ্গজেবকে ভালো করে দেখে, তাঁদের ইতস্তত দেখায়, হয়ত খানিকটা লাজুকও… কান্নার মাঝেই হাসির অভয় ফুটিয়ে সে তাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, আর তারা এবার তাঁর কাছে দৌড়ে ছুটে আসে।

*

তিন রাত পরে, পরস্পরের সঙ্গসুখ উপভোগের পরে তাঁরা যখন পাশাপাশি শুয়ে আছে, আরজুমান্দ ধীরে উঠে বসে। তার মুখের উপর থেকে কালো চুলের একটা গোছা সরিয়ে সে খুররমের চোখের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। আমি কি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?

 ‘অবশ্যই।

আমরা যখন সিকান্দ্রা অভিমুখে এগিয়ে আসছিলাম, আমার এক পরিচারিকা আমায় এমন একটা কথা বলেছে যা বিশ্বাস করতে আমার রীতিমত কষ্ট হয়েছে–সে বুরহানপুর থেকে সদ্য আগত এক বার্তাবাহকের কাছ থেকে একটা গল্প শুনেছে। আমি গল্পটার কথা যতই ভুলতে চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই সেটাকে মন থেকে দূর করতে পারছি না।’

‘কি গল্প? আরজুমান্দের কণ্ঠে এমন একটা সুর ছিল যা খুররমকে বাধ্য করে উঠে বসতে।

‘গল্পটা হল খসরুর পরিচারকেরা তাকে তার কক্ষে একদিন সকালে মৃত অবস্থায় খুঁজে পেয়েছে যেখানে তাকে আপনি বন্দি করে রেখেছিলেন।

 খুররম কোনো কথা না বলে একমুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপরে: ‘গল্প নয় সত্যি। আমার সৎ-ভাই মারা গিয়েছে, সে আবেগহীন কণ্ঠে বলে।

‘কিন্তু গল্পটা হল তাকে আপনার আদেশে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।’

 খুররম আবারও চুপ করে থাকে। দ্বিতীয় চিঠিটায়–বুরহানপুরের সুবেদারের কাছে যেটা সে পাঠিয়েছিল–খসরুকে যতটা কম কষ্ট দিয়ে সম্ভব হত্যা করার আদেশ ছিল। সে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আদেশটা দিয়েছিল কিন্তু সে নিশ্চিত ছিল যে নিজের স্বার্থে তার পরিবারের মঙ্গলের জন্যই তাকে এটা করতে হবে। কিন্তু পরবর্তীতে সে যখন সংবাদের জন্য অপেক্ষা করছে যে তার অভিপ্রায় পালিত হয়েছে, সে কল্পনা করতে শুরু করে খসরুর কি অনুভূতি হয়েছিল নিজের কক্ষের দরজা অপ্রত্যাশিতভাবে খুলে যেতে… নিজের আংশিক প্রতিবন্ধী দৃষ্টি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে… ভাবতে চেষ্টা করছে তার সাথে কারা দেখা করতে এসেছে… হয়তো ভেবেছিল তাঁর স্ত্রী জানি বুঝি এসেছে। তার সৎ-ভাই কখন বুঝতে পারে খোলা দরজা দিয়ে প্রেমময় স্ত্রী নয় হন্তারক আততায়ী প্রবেশ করেছে? খসরু কীভাবে মারা যায়? তার একমাত্র আদেশ ছিল মৃত্যু যেন ব্যাথামুক্ত হয়। তরবারির ফলার দ্রুত আঘাত নাকি বুকের গভীরে খঞ্জরের মারাত্মক খোঁচায় সেটা সম্পন্ন হয়েছে? বিষের পাত্র থেকে জোর করে অনিচ্ছুক ঠোঁটে পান করার হয়েছে নাকি বালিশ দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করা হয়েছে?

সে অবশ্য, একটা বিষয় অনুধাবন করে প্রয়োজনের উপরে আবেগকে স্থান দেয়া ঠিক হবে না আর এভাবে চিন্তা করাও। খসরু তার অবশ্যই একজন সম্ভাব্য আর বিগত বিদ্রোহী হিসাবে বিবেচনা করতে হবে–একজন জীবন্ত। আর অনুভূতিশীল মানুষ হিসাবে নয়। কিন্তু পরে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে খসরুর মৃত্যুর খবর যখন তার কাছে পৌঁছায়, একটা নতুন উদ্বেগ তার মাঝে জন্ম নেয়। শাহরিয়ারকে নিয়ে তাঁর সামনে মেহেরুন্নিসা দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় যা বলেছিল সেই কথাগুলো তাকে আসলেই কতটা প্রভাবিত করেছে? সে। কি তার অনুভূতি নিয়ে খেলা করেছিল যখন সেগুলো নিজের বিজয়ে আর সন্তানদের সাথে একত্রিত হবার কারণে টানটান অবস্থায় ছিল এবং সুযোগ বুঝে তাকে এমন কিছু একটা করতে বাধ্য করেছে যার জন্য সে সারা। জীবন অনুতপ্ত হবে ঠিক যেভাবে সে তার আব্বাজানকে প্রভাবিত করতো? না, সে নিজেকে আবার জোর করে বোঝায়। সে নিজে কেবল এই অবশ্যম্ভাবী সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর সেটা যুক্তিসঙ্গত ছিল।

 ‘আমি তোমায় মিথ্যা বলতে পারবো না। সবই সত্যি। কিন্তু আমি আমাদের আর আমাদের সন্তানদের রক্ষা করার জন্য এসব করেছি। খুররম চুপ করে থাকে তারপরে জোর করে আবার বলতে থাকে। আর আরো কিছু রয়েছে… যার সম্বন্ধে আমি মাত্র গতকালই জানতে পেরেছি। খসরুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন সম্পন্ন করে, জানি নিজের কক্ষে ফিরে গিয়ে আত্মহত্যা করেছে–বলা হয়েছে যে শীতের প্রকোপ থেকে তাঁর কক্ষকে উষ্ণ রাখতে যে জ্বলন্ত কয়লার পাত্র ছিল সেখান থেকে সে জ্বলন্ত কয়লা ভক্ষণ করেছে।

আরজুমান্দের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে এবং সে মাথা নাড়তে থাকে। ‘খুররম, আপনি এটা কীভাবে করলেন? মৃত্যুবরণের কি নির্মম উপায়। আমি নিজেই যেন গলায় জ্বলন্ত কয়লার উত্তাপ অনুভব করছি সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে, আমার ফুসফুস ঝলসে দিচ্ছে। নিজের অন্তিম মুহূর্তে কি ভয়ঙ্কর, ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা তাকে ভোগ করতে হয়েছিল।

 জানির মৃত্যু–বিশেষ করে যেভাবে সেটা হয়েছে–তাকেও আবেগআপ্লুত করে তুলেছিল যখন সে প্রথম খবরটা শুনে, কিন্তু সে কেবল কোনোমতে বলে, আমি তাকে মারবার আদেশ দেই নি।

‘কিন্তু খসরুকে হত্যা করার জন্য আপনার আদেশের ফলেই এটা হয়েছে… আমি আপনাকে যেমন ভালোবাসি জানিও তাকে ঠিক তেমনই ভালোবাসতো। একজনের জীবন নেয়া পাপ, আমি জানি, এবং আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি যে আপনি মারা যাবার পরে আমি যেন আমার সন্তানদের খাতিরে বেঁচে থাকার সাহস দেখাতে পারি, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি কতটা শোক তাকে আপ্লুত করেছিল।

খুররম আরজুমান্দের বিহ্বল মুখের দিকে তাকায়। সে এইমাত্র যা বলেছে তা সত্যি। তার কারণেই জানির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সে যতই সন্দিহান হোক–কিংবা অপরাধবোধ–তাকে সেসব থেকে মুক্ত হতে হবে এবং শক্ত থাকতে হবে। আমি সবকিছুই আমার সন্তানদের কথা ভেবে করেছি। তাঁরাই আমাদের ভবিষ্যত–আমাদের রাজবংশের ভবিষ্যত, সে বলে, নিজের মন থেকে নিজের জীবন আর শাসনকে নির্বিঘ্ন করতে সে এসব করেছে সেই চিন্তা জোর করে মন থেকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু বাস্তবে বোধহয় সেই অভিপ্রায়গুলো মিলে যায়। অল্প মানুষই–এমন কি একজন সম্রাটও–তাদের মনের গহনে আর অভিপ্রায়ের মাঝে নিঃশঙ্কভাবে উঁকি দেয়ার মত শীতল সাহস রাখেন, সবাই নিজেদের কার্যকলাপের স্বপক্ষে বাগাড়ম্বরপূর্ণ সাফাই দিয়ে নিজেদের সাথে ছলনা করতেই পছন্দ করেন। ‘আমি দোয়া করি খসরু আর বিশেষ করে জানির যেন বেহেশত নসীব হয়, আরজুমান্দ বলে, আর আমি এটাও দোয়া করি যেন আল্লাহ আপনাকে মার্জনা করেন এবং আপনাকে বা আপনার সন্তানদের কোন শাস্তি না দেন।

 ‘আমিও সেই দোয়াই করি, খুররম বলে। সে জীবনে কখনও এভাবে অন্তর থেকে কিছু বলে নি এবং তাঁর বিয়ের পরে সে কখনও এতটা নিঃসঙ্গ বোধ করে নি। তাঁর আব্বাজান আর দাদাজান ক্ষমতার নিঃসঙ্গতা সম্বন্ধে এই কথাই তাকে বলেছিলেন। তাকে আর কখনও এই অনুভূতি ছেড়ে যাবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *