২.৭ রক্তগঙ্গা
‘আল্লাহ্র সামনে, সম্রাট এবং তাঁর প্রজাদের সামনে আপনি নিজের সম্মানহানি ঘটিয়েছেন। আপনার অবহেলার কারণে অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে গিয়েছে। সম্রাট বন্দি হয়েছেন! মেহেরুন্নিসা পর্দা প্রথা পুরোপুরি অবজ্ঞা করে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে জাহাঙ্গীরের দেহরক্ষীদের বয়োজ্যেষ্ঠ আধিকারিকদের সামনে পায়চারি করে। সে যখন সরাসরি তাদের চোখের দিকে তাকায় তখন তারা বাধ্য হয় দৃষ্টি সরিয়ে নিতে, অবলা কুমারী মেয়ের মত তারা মাথা নিচু করে রাখে। আপনারা কীভাবে নিজেদের সম্মান পুনরুদ্ধার করবেন? কীভাবে আপনারা সম্রাটকে উদ্ধার করবেন? আমি সেতুর উপর দিয়ে পালিয়ে আসবার প্রায় সাথে সাথে মহবত খানের লোকেরা যখন সেতুতে আগুন ধরিয়ে দেয় আপনার দাঁড়িয়ে দেখেছেন। আমরা এখন কীভাবে নদী অতিক্রম করবো? আমাদের যদি ঘোড়া আর হাতিগুলোকে সাঁতরে ওপাড়ে নিয়ে যেতে হয় তবুও আমরা নদী অতিক্রম করবোই। দাঁড়িয়ে থাকবেন না, আমার প্রশ্নের উত্তর দিন?
দীর্ঘ নিরবতা বিরাজ করতে থাকে। জাঁহাপনা।’ দীর্ঘদেহী, বাজপাখির মত নাকের অধিকারী এক বাদখশানি শেষ পর্যন্ত কথা বলে, সে তখনও অবশ্য সরাসরি তাঁর চোখের দিকে তাকান থেকে বিরত থাকে। চার কি পাঁচদিন আগে আমি যখন ঝিলম নদী অতিক্রম করার জন্য উপযুক্ত স্থানের সন্ধানে একটা অগ্রবর্তী রেকি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম তখন এখান থেকে প্রায় মাইলখানেক উজানে আমরা নদী পার হবার জন্য একটা সম্ভাব্য অগভীর স্থান খুঁজে পাই। আমরা জায়গা বাতিল করে দেই কারণ মানুষের জন্য সেখানে পানির গভীরতা বেশি থাকায় পানির ভিতর দিয়ে হেঁটে যাবার সময় স্রোতের টানে ভেসে যাবার একটা সম্ভাবনা ছিল। অশ্বারোহী আর হাতির পক্ষে কেবল সেখান দিয়ে নদী পার হওয়া সম্ভবএবং তারপরেও নদীর তলদেশ পাথুরে আর অসমান। সম্ভাব্য বিপদের ঝুঁকি এড়াবার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়াটা তখন সহজ ছিল এবং এখানে নৌকার সেতু তৈরি করা যেখানে–যদিও পানি অনেক বেশি গভীর-স্রোতের বেগ অনেক কম যেহেতু নদী এপাড়ে অবস্থিত ছোট টিলার কাছে একটা বাঁক নিয়েছে। জাঁহাপনা, আর কোনো উপায় যদি না থাকে আমরা তাহলে সেই অগভীর অংশ অতিক্রম করে আক্রমণের বিষয়টা বিবেচনা করতে পারি।’
‘আপনারা আর কেউ এর চেয়ে ভালো কিছু পরামর্শ দিতে পারবেন? মেহেরুন্নিসা জানতে চায়। নিরবে দেহের ভার এক পায়ের উপর থেকে অন্য পায়ে স্থানান্তরিত করা আর হতাশ দৃষ্টি বিনিময় করা ছাড়া আর কোনো উত্তর পাওয়া যায় না।
‘বেশ তাহলে, সেই অগভীর স্থানেই আমরা যাব–আমি এবং আপনারও নিশ্চয়ই দলত্যাগী, বিশ্বাসঘাতক মহবত খানের হাতে সম্রাটকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিতে চান না। আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে কত সময় লাগবে?
‘আমাদের সাথে কি অস্ত্র রয়েছে আর ওপাড়ে আমরা কি ফেলে এসেছি সেটা মিলিয়ে দেখতে, পানি থেকে আমাদের পক্ষে যতটা সুরক্ষা দেয়া সম্ভব সেজন্য গাদা বন্দুকগুলো আর বারুদ তৈলাক্ত কাপড়ের থলেতে বাঁধতে, অবশিষ্ট রণহস্তীগুলোকে তাদের যুদ্ধের সাজে সজ্জিত করতে এসব খুটিনাটি বিষয়ের জন্য কয়েক ঘন্টা সময় প্রয়োজন… আমরা সন্ধ্যা নামার আগেই প্রস্তুত হতে পারবো কিন্তু সকালবেলা হলে ভালো হয়।
‘আমরা যখন এসব প্রস্তুতি গ্রহণ করবো ততক্ষণ মহবত খান দাঁড়িয়ে না থেকে অন্যত্র যাবার জন্য যাত্রা শুরু করবে না? নিখুঁতভাবে ছাটা দাড়ির অধিকারী এক অল্পবয়সী তরুণ সেনাপতি–সবচেয়ে কমবয়সী যোদ্ধাদের একজন–এতক্ষণে কথা বলে।
না। মহবত খান আর যাই হোক তোমার চেয়ে কম আহাম্মক, মেহেরুন্নিসা বলে। সে খুব ভালো করেই জানে যে সে যদিও সম্রাটকে বন্দি করেছে কিন্তু আমায় বন্দি করতে ব্যর্থ হওয়ায় সে ক্ষমতা দখল করতে ব্যর্থ হয়েছে। ভয় পেয়ো না–সে আমার পরবর্তী পদক্ষেপ দেখার জন্য অপেক্ষা করবে। আমরা সকালবেলায়ই আক্রমণ করবো যাতে তোমাদের কোনো অপদার্থ বলতে না পারে তারা প্রস্তুতি নেয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পায় নি। ইত্যবসরে, নদীর অপর পাড়ের অবস্থান লক্ষ্য করে মাঝে মাঝে গুলিবর্ষণ করা অব্যাহত থাকবে যাতে মহবত খানের। লোকেরা সারা রাত একটা অস্বস্তির ভিতরে কাটাতে বাধ্য হয়। আর সেই সাথে, চারদিকে রেকির দল পাঠাও যাতে সে আমাদের আসল অভিপ্রায় সম্বন্ধে অনুমান করতে ব্যস্ত থাকে। মেহেরুন্নিসার মুখে নির্মম হাসি ফুটে উঠে। সে পরিস্থিতি প্রায় উপভোগই করছে বলা যায়। মহবত খান তাকে সরাসরি সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দিয়েছে এবং পূর্বের মত একজন মধ্যস্থতাকারী সহায়তা তাকে নিতে হচ্ছে না। আমার হাতি আর সেটা হাওদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করো। আগামী কাল আমি তোমাদের সুনাম পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেব এবং আমাদের সম্রাটকে উদ্ধার করবো। তোমাদের ভিতরে হয়তো অনেকেই কাপুরুষ কিন্তু একজন মহিলা যখন নেতৃত্ব দিচ্ছে তখন তাঁরাও নিশ্চয়ই পিছিয়ে থাকবার দুঃসাহস দেখাবে না।
*
‘জাহাপনা, মহবত খান আপনার নাতিদের আপনার সাথে থাকবার অনুমতি দিয়েছেন, প্রবেশ পথের মখমলের পর্দা একপাশে সরিয়ে দীর্ঘদেহী এক রাজপুত কথাটা বলে।
দারা শুকোহ আর আওরঙ্গজেব ইতস্তত ভঙ্গিতে ভেতরে প্রবেশ করে। জাহাঙ্গীর ভাবে, যা কিছু ঘটছে এসব কিছুরই কোনো অর্থ তারা বুঝতে পারছে না। তাবুর ভেতরে তারা তিনজন ছাড়া যখন আর কেউ নেই তখন তিনি হাঁটু মুড়ে বসেন এবং দু’হাতে তাদের দু’জনকে আলিঙ্গণ করেন। ‘ভয় পেয়ো না। তোমাদের কেউ কোনো ক্ষতি করবে না। আমি এখানে আছি আর আমি তোমাদের আগলে রাখবো। আর অচিরেই সম্রাজ্ঞী আমাদের উদ্ধার করবেন। মহবত খানের কবল থেকে তিনি পালিয়ে গিয়েছেন এবং এই মুহূর্তে নদীর অপর তীরে তিনি আমাদের সৈন্য আক্রমণের লক্ষ্যে সজ্জিত করছেন।
আওরঙ্গজেব কোনো কথা বলে না কিন্তু জাহাঙ্গীর অনুভব করেন দারা শুকোহ কেমন গুটিয়ে যায়। সম্রাজ্ঞী মোটেই আমাদের বন্ধু নন–তিনি আমাদের শত্রু। আমি আব্বাজানকে সেরকমই বলতে শুনেছি।
‘তিনি ভুল করেছেন। মেহেরুন্নিসা সম্পর্কে তোমাদের দাদীজান হন আর তোমাদের মঙ্গলের জন্য তিনিও উদ্বিগ্ন। আমাদের সাহায্য করার একটা পথ তিনি ঠিকই খুঁজে বের করবেন… তোমাদের সাহায্য করার জন্য…’ জাহাঙ্গীর আওরঙ্গজেবকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
‘আমার আব্বাজান বলেছেন তিনি কেবল নিজের স্বার্থের কথাই বিবেচনা করেন, দারা শুকোহ্ বলতে থাকে। তিনি সেজন্যই আপনাকে এমন মদ্যপ করে তুলেছেন–যাতে করে তিনি নিজে সব আদেশ দিতে পারেন। তিনি আমাকে বলেছেন কখনও যেন তাকে বিশ্বাস না করি… এবং আমি করিওনা। আমি আর আমার ভাই বাসায় যেতে চাই।’
‘অনেক হয়েছে! আমি তোমাদের আমার কাছে নিয়ে আসতে বলেছিলাম কারণ আমার মনে হয়েছিল তোমরা বোধহয় ভয় পেয়েছো আর এভাবে তোমরা তাঁর প্রতিদান দিলে। দারা শুকোহ্ আমাদের এই বিপদ যখন কেটে যাবে তখন আমি ভুলে যাবার চেষ্টা করবো তুমি এইমাত্র যা বলেছে। কিন্তু আমি দুঃখ পেয়েছি যে আমার ছেলে নিজের মত তোমাদেরও অকৃতজ্ঞ আর উদ্ধত হবার শিক্ষাই দিয়েছে।
জাহাঙ্গীর ঘুরে দাঁড়িয়ে গভীর একটা শ্বাস নেয়। দারা শুকোহর উগ্রতা তাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
*
‘সর্বাধিকারী, নদীর তীর বরাবর তাঁরা এগিয়ে আসছে, মহবত খানের একজন অধস্তন যোদ্ধা পরের দিন সকাল হবার ঘন্টা দুয়েক পরে চিৎকার করে জানায়। মহবত খান তাঁর গুপ্তদূতদের সতর্কতার সাথে অপর তীরের সৈন্য সমাবেশের উপর নজর রাখার আদেশ দিয়েছেন মেহেরুন্নিসা আর জাহাঙ্গীরের দেহরক্ষী বাহিনীর যোদ্ধাদের পরবর্তী পদক্ষেপ অনুমান করার প্রয়াসে। সে নিজে বন্দিদের প্রশ্ন করে–শারীরিক নির্যাতন না তার নতুন শাসকমণ্ডলীর অধীনে পুরষ্কারের প্রলোভন দেখিয়ে–জানতে যে জাহাঙ্গীরের সাথে আগত রাজকীয় বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা সে যেমন তিন হাজার অনুমান করেছিল সেটা সঠিক নয় তাদের সংখ্যা আসলে ছয় হাজার যাদের ভিতরে আনুমানিক দেড় হাজার সৈন্য প্রচুর যুদ্ধ উপকরণসহ তার হাতে বন্দি হয়েছে। তার সাথে দশ হাজার রাজপুত যোদ্ধার বাহিনী থাকায় তাত্ত্বিকভাবে মেহেরুন্নিসার চেয়ে এখন তার লোকবল দ্বিগুণ কিন্তু বাস্তবে সে জানে এই সংখ্যার এক চতুর্থাংশ সেনাছাউনি আর বন্দিদের পাহারা দেয়ার কাজে নিয়োজিত রাখতে হবে। সে অশোক আর তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত দু’শ ধীর স্থির সৈন্যদের বিশেষ করে নির্দেশ দিয়েছে জাহাঙ্গীর আর তার দুই নাতির নিরাপত্তা দিকে লক্ষ্য রাখতে কিন্তু সেই সাথে এটাও নিশ্চিত করতে যে তারা সর্বদা তাঁর হাতের মুঠোয় রয়েছে।
মেহেরুন্নিসার আদেশে বিভিন্ন দিকে অসংখ্য রেকি বাহিনীর প্রেরণে একটা সময় পর্যন্ত সে যদিও বিভ্রান্তবোধ করেছিল, কিন্তু একটা বিষয় তার কাছে ক্রমশ পরিষ্কার হতে শুরু করে যে রাজকীয় বাহিনী আসলে উজানে তাদের দিকের নদীর কিনারে একটা ছোট পাহাড়ের চারপাশে তাদের সমস্ত প্রয়াস একীভূত করছে। সকাল হবার ঠিক আগ মুহূর্তে তাঁর হাতে বন্দিদের একজন স্বেচ্ছায় তাকে অবহিত করে যে রাজকীয় বাহিনী ঝিলম নদী অতিক্রম করার জন্য নৌকার সেতু তৈরি করার পূর্বে সেখানে অবস্থিত নদীর একটা গভীর অংশ দিয়ে নদী পার হবার ব্যাপারটা বিবেচনা করলেও দ্রুত সেটা বাতিল করে দিয়েছিল। মহবত খানের এক মুহূর্ত সময় লাগে অনুধাবন করতে যে মেহেরুন্নিসার আদৌ পলায়নের কিংবা আত্মসমর্পণের কোনো অভিপ্রায় নেই বরং বন্দি স্বামীকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তিনি নদীর সেই গভীর অংশ দিয়েই আক্রমণের একটা পরিকল্পনা করেছেন। তিনি তাঁর স্বদেশী এই পার্সী মহিলাকে সাহসকে শ্রদ্ধা না করে পারেন না। তিনি বস্তুতপক্ষে তাকে তার নিজের স্ত্রীর কথা মনে করিয়ে দেয় এবং এক মুহূর্তের জন্য সেই কঠিন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী মহিলার প্রশান্তিদায়ক সঙ্গ পেতে তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেন। কিন্তু দাক্ষিণাত্য থেকে তাঁর এই আবেগপ্রবণ অভিযাত্রা শুরু করার আগেই তিনি চিঠি লিখে তাকে পারস্যে নিজের আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখার করার অজুহাতে আগ্রা ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তাকে রাজস্তানের আরাবল্লী পাহাড়ী এলাকায় চলে যেতে বলেছিলেন, যেখান থেকে তার সেরা যোদ্ধাদের অনেককেই তার বাহিনীতে যোগ দেয়ায় তিনি জানেন তার স্ত্রী সেখানে নিরাপদেই থাকবে। তিনি একবার যখন নিশ্চিত হন যে নদীর এই গভীর অংশ দিয়েই আগে বা পরে সম্ভাব্য আক্রমণ হতে চলেছে তিনি তখন তার সেরা তবকিদের ভিতরে একহাজার যোদ্ধাকে তাদের আটক করা মালবাহী বহরে খুঁজে পাওয়া গাদাবন্দুক থেকে অতিরিক্ত একটা করে বন্দুক সাথে নিতে আদেশ দেন যাতে তারা দ্রুত দু’বার গুলি বর্ষণ করতে পারে। তিনি তার অন্য লোকদের তাদের গুলি ভরতে সাহায্য করার নির্দেশ দেন, তাঁদের গুলিবর্ষণের হার বৃদ্ধি করার অভিপ্রায়ে। তিনি আশা করেন এভাবে কামানের অভাব পূরণ হবে যদিও রাজকীয় মালবাহী শকটের বহরে তাঁরা ব্রোঞ্জের তিনটি ছোট গজল পেয়েছেন যদিও এর সাথে সামান্যই বারুদ আর গোলা পাওয়া গিয়েছে। তিনি আদেশ দিয়েছেন এগুলো মালবাহী শকটে স্থাপন করে রাতের অন্ধকারে ষাড় দিয়ে টেনে নিয়ে অগভীর অংশের তীরের কাছে অবস্থিত কয়েকটা নিচু মাটির ঢিবির আড়ালে রাখতে বলেছেন, যেখানে তিনি তার বাছাই করা কিছু তবকিকে তাদের অতিরিক্ত বন্দুক আর সাহায্যকারী নিয়ে লুকিয়ে অবস্থান করার আদেশ দিয়েছেন।
যুদ্ধের মুহূর্ত এখন যখন আরো একবার নিকটবর্তী হয় মহবত খান ক্রমশ শান্ত সমাহিত হয়ে উঠেন। তিনি চিৎকার করে নিজের তবকি আর তীরন্দাজদের গুলিবর্ষণ করা থেকে বিরত থাকতে বলেন যতক্ষণ না তিনি নিশ্চিত হন যে তাদের লক্ষ্যবস্তু নিশানার ভিতরে এসেছে আর তিনি তারপরে আদেশ দেন। তাঁর লোকেরা এরপরে যত দ্রুত সম্ভব গুলিবর্ষণ শুরু করে। ছোট কামানগুলোর দায়িত্বে যারা রয়েছে তিনি তাদেরও একই আদেশ দেন, যদিও তিনি জানেন যে অস্ত্রটা ব্যবহারে তাদের অনভিজ্ঞতার কারণে গোলা বর্ষণ করতে তাদের সময় বেশি লাগবে। তিনি এরপরে রাজকীয় বাহিনীর কোনো সৈন্য যদি আক্ষরিক অর্থেই ঝিলম নদী অতিক্রম করতে সক্ষম হয় তবে তাদের যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য অপেক্ষমান অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে মিলিত হবার জন্য অগ্রসর হন।
মহবত খান যুদ্ধবাজ প্রাণীর প্রথম দলটাকে নদীতে নামতে দেখেন, যেখানে নদী প্রায় আশি গজ প্রশস্ত, তিনটা রণহস্তীর একটা দল যাদের প্রত্যেকের দেহ আর মস্তক ইস্পাতের আবরণ দ্বারা আবৃত এবং লাল রঙ করা গজদন্তে ধারালো তরবারি সন্নিবিষ্ট রয়েছে। প্রত্যেকের জন্য দু’জন করে মাহুত রয়েছে যারা তার কানের পেছনে বসে রয়েছে আর নিজেদের অরক্ষিত অবস্থানের কারণে যতটা সম্ভব কুঁকড়ে রয়েছে নিজেদের যতটা সম্ভব ছোট নিশানায় পরিণত করতে। প্রত্যেকটা হাতির পিঠে উন্মুক্ত কাঠের হাওদায় পাঁচজন করে তবকি গাদাগাদি করে অবস্থান করছে। আরো দুটো হাতি প্রথম দলটাকে অনুসরণ করে শীতল পানিতে নামে এবং মহবত খান দেখে যে পেছনে আরো বিশটা কি ত্রিশটা হাতি সারিবদ্ধ অবস্থায় অপেক্ষা করছে। সে ভাবে হাতিগুলোর কিছু হয়তো মালবহনের কাজে ব্যবহৃত হয় যাদের এখন অপরিচিত ভূমিকা পালনের জন্য বাধ্য করা হয়েছে। নদীর তীরে শতাধিক অশ্বারোহী যোদ্ধা সমবেত হয়েছে আর তাদের খুরের আঘাতে জায়গাটা কাদায় পরিণত হয়েছে। তাদের অনেকেই লম্বা বর্শা বহন করছে যার অগ্রভাগে মোগলদের সবুজ নিশান সংযুক্ত রয়েছে। প্রথম সারির মধ্যের হাতিটা কেবল দশ গজ মত অগ্রসর হয়েছে এবং তাঁর লোকেরা এখন গুলিবর্ষণ করা থেকে নিজেদের সংবরণ করে রেখেছে যখন তার বন্দিরা নদীর তলদেশে যে গর্তের কথা বলেছিল খুব সম্ভবত সেগুলোর একটায় জটা সে প্রাণীটাকে হোঁচট খেতে দেখে। প্রাণীটা এমন ভয়ঙ্কর ভাবে দুলে উঠে যে তার পিঠের খোলা হাওদা থেকে দু’জন তবকি দ্রুত বহমান পানিতে আঁছড়ে পড়ে ভাটিতে নৌকার তৈরি সেতুর পোড়া অবশিষ্টাংশের দিকে ভেসে যায়।
মহবত খান জানেন এটাই তার সুযোগ এবং চিৎকার করে গুলিবর্ষণ শুরু করার আদেশ দেন। তবকি আর তীরন্দাজেরা নদী তীরের মাটির ঢালের পেছন থেকে বের হয়ে আসে এবং তাঁদের কাজ শুরু করে। গুলির প্রথম ঝাপটার কয়েকটা সামনের আরেকটা হাতির দুই মাহুতকেই ধরাশায়ী করে আর তারা উভয়েই ঝিলমের ঘুরপাক খাওয়া পানির স্রোতে আছড়ে পড়তে পানি ছিটকে উঠে আর চালকবিহীন জন্তুটা তখন আতঙ্কে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে যেখান থেকে এসেছে সেই উত্তরের তীরের দিকে পুনরায় ফিরে যাবার চেষ্টা করে। জটা ঘুরে দাঁড়াতে সেও পিছলে যায় এবং তার বাম কাঁধ পানির নিচে নিমজ্জিত হয়। ভারি বর্মের কারণে বাধাগ্রস্থ হয়ে সে পুরোপুরি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং পানিতে আধা নিমজ্জিত অবস্থায় ভেসে যায় আর ডুবতে শুরু করলে এর হাওদায় অবস্থানরত তবকিরা পানিতে লাফিয়ে নেমে সাঁতরে যতটা সম্ভব নিজেদের জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করে। প্রথম সারির অবশিষ্ট শেষ হাতিটা অবশ্য অগ্রসর হওয়া অব্যাহত রাখে সেইসাথে তার পেছনে অবস্থানরত হাতিগুলোও যতক্ষণ না গজলের একটা গোলা চতুর্থ সারির একটা একটা হাতিকে তাঁর মুখের অরক্ষিত অংশে আঘাত করে এবং সেও পানিতে আছড়ে পড়ে ঝিলমের জন্তুটার রক্তে ঝিলমের সবুজাভ পানিতে ছোপ ছোপ দাগের সৃষ্টি হয়।
রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনীর অসংখ্য যোদ্ধা ইতিমধ্যে পানিতে নেমেছে এবং তারা আর তাঁদের বাহন হোঁচট খেতে থাকা হাতির পালকে পাশ কাটিয়ে কখনও হেঁটে, কখনওবা সাঁতার কেটে বেশ ভালোই অগ্রসর হতে থাকে। অশ্বারোহীদের কেউ কেউ এমনকি সাহসিকতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে রেকাবের উপর দাঁড়ায় তীর নিক্ষেপ করতে বা–মহবত খানকে মনে মনে বিস্মিত করে–একজন এমনকি লম্বা ব্যারেলের গাদা বন্দুক থেকেও গুলি বর্ষণ করে। মহবত খানের দুই কি তিনজন তবকি ধরাশায়ী হয় এবং ইতিমধ্যে অন্যরা বন্দুকে গুলি ভরার কাজে ব্যস্ত থাকায় নদী তীরের তার দিক থেকে গুলি বর্ষণের হার হ্রাস পায়। এই সুযোগে বেশ কয়েকজন রাজকীয় অশ্বারোহী নদী অতিক্রম করে এপাড়ে চলে আসে।
‘আক্রমণ করো!’ মহবত খান চিৎকার করে উঠে এবং সে তাঁর অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সম্মুখে অবস্থান করে নদীর কর্দমাক্ত তীরের দিকে ধেয়ে নামতে থাকে পানি থেকে উঠে আসা রাজকীয় অশ্বারোহী যোদ্ধাদের আক্রমণ করতে। তাঁর তরবারির প্রথম আঘাত প্রতিপক্ষের একজনের বুকের বর্মে লেগে প্রতিহত হয় কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় আঘাত খয়েরী রঙের একটা ঘোড়ার গলায় গেঁথে গেলে হতভাগ্য জন্তুটা সাথে সাথে পিঠের আরোহীকে শূন্যে নিক্ষিপ্ত করে মাটিতে আঁছড়ে পড়ে। জন্তুটা কিছুক্ষণের জন্য পানির অগভীর অংশে পড়ে থেকে পা ছুঁড়ে, গলার ক্ষতস্থান থেকে গলগল করে রক্ত বের হয়ে পানিতে মিশে যায় কিন্তু তারপরেই নিথর হয়ে যায়। তার চারপাশে নদীর কিনারে অশ্বারোহী যোদ্ধারা লড়াই করছে। একটা ঘোড়া সেখানে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে তাঁর পিঠের রাজকীয় যোদ্ধা পিছলে যায়; একটু দূরে তার এক রাজপুত যোদ্ধা পর্যাণ থেকে ছিটকে যায়, রান্নার জন্য মুরগী শলাকাবিদ্ধ করার মত এক রাজকীয় যোদ্ধা তাকে গেঁথে ফেলে। অন্যত্র দুজন যোদ্ধা অগভীর পানিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করছে, তারা পানিতে একে অপরের মাথা চেপে ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে কেবলই গড়াতে থাকে। একজন তারপরে খঞ্জর বের করতে সক্ষম হয় এবং প্রতিপক্ষের পাঁজরের ঠিক নিচে সেটা আমূল ঢুকিয়ে দেয়। পানিতে আবারও রক্ত এসে মিশে। বিজয়ী যোদ্ধা–মহবত খান স্বস্তির সাথে তাকিয়ে দেখে তাঁরই একজন রাজপুত যোদ্ধা–নিজের উপর থেকে মরণাপন্ন প্রতিপক্ষের দেহটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সারা দেহ থেকে পানি ঝরে পড়া অবস্থায় টলতে টলতে নদী থেকে উঠে আসতে শুরু করে। কিন্তু মহবত খানের স্বস্তি হতাশায় পরিণত হয় লোকটা যখন সহসা হাত দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে পেছনের দিকে উল্টে পড়ে এবং স্রোতের টানে সাথে সাথে ভেসে চলে যায়। আরেকজন রাজপুত যোদ্ধা মহবত খানের এত কাছে প্রায় সাথে সাথেই ঘোড়া থেকে নিচে আঁছড়ে পড়ে যে তাঁর পতনের ফলে ছিটকে উঠা শীতল পানি তাকে প্রায় ভিজিয়ে দেয়। সে চারপাশে তাকিয়ে এহেন নিখুঁত লক্ষ্যভেদের উৎস খোঁজার চেষ্টা করে এবং সে যখন সেটা খুঁজে পায় তার মাথার উপর দিয়ে গাদাবন্দুকের আরেকটা গুলি ভয়াল শিস তুলে উড়ে যায়।
সে তখন দেখতে পায় গুলি কোথা থেকে করা হচ্ছে–প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে নদীর ভেতর দিয়ে মন্থর গতিতে অগ্রসর হতে থাকা একটা অতিকায় পিঠের গিল্টি করা হাওদা। হাওদায় চারটা অবয়র দেখা যায়। সামনে যে রয়েছে তার পরনে কালো রঙের আলখাল্লা। হাওদায় উপস্থিত বাকি তিনজন আদতে পরিচারক, দু’জন ব্যগ্রতার সাথে লোহার শিক দিয়ে গাদাবন্দুকের নলে সীসার বল প্রবিষ্ট করছে তৃতীয় জন গুলি ভর্তি বন্দুক আলখাল্লা পরিহিত অবয়বের সাথে সেটা তুলে দিচ্ছে। মহামান্য সম্রাজ্ঞী, মহবত খান সাথে সাথে বুঝতে পারে। সে সহজাত প্রবৃত্তির বশে এটাও বুঝে যে তিনিও তাকে চিনতে পেরেছেন। ব্যাঘ শিকারী হিসাবে তাঁর দক্ষতা সম্বন্ধে ভালোমতই অবহিত থাকার কারণে সে চেষ্টা করে নিজেকে কুঁকড়ে ছোট করে ফেলতে, নিজের ঘোড়ার কাঁধের উপর নুয়ে পড়ে দুহাতে জন্তুটার গলা আঁকড়ে ধরে। কিন্তু কিছুক্ষণের ভিতরে সে তীক্ষ্ণ একটা যন্ত্রণা অনুভব করে আর সাথে সাথে তার ডান হাতের উৰ্দ্ধাংশ অবশ হয়ে যায় আর ঘোড়াটা সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সে আর তার বাহন উভয়েই আহত হয়েছে।
সে সাথে সাথে নিজেকে শীতল পানিতে আবিষ্কার করে, স্রোতের টানে ভাটির দিকে ভেসে চলেছে। সে ঘোড়া থেকে ছেটকে যাবার সময় যদিও মাথার শিরোস্ত্রাণ হারিয়েছে কিন্তু দেহ রক্ষাকারী বর্মের ভারে সে পানির নিচে তলিয়ে যেতে থাকে। তার কানের ফুটো আর নাসারন্ধ্রে পানি প্রবেশ করেছে এবং সে বহু কষ্টে নিজের মুখ বন্ধ রাখে। তাঁর কানের ভিতরে ততক্ষণে দপদপ যন্ত্রণা শুরু হয়েছে আর তার ফুসফুস বুঝি ফেটে যাবে। তাকে দ্রুত কিছু একটা করে বুকের বর্মটার হাত থেকে রেহাই পেতে হবে। নতুবা পানিতে ডুবে মরার হাত থেকে কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। আঘাত পাওয়া সত্ত্বে সে এখনও নিজের ডান হাত নাড়াতে পারে এবং সে। তার কোমরে গোঁজা খঞ্জরটা হাতড়াতে থাকে। সেটা খুঁজে পাবার পরে সে সাবধানে খঞ্জরটার জেড পাথরের বাটের চারপাশ আঙুল দিয়ে ভালো করে। আঁকড়ে ধরে যাতে ময়ান থেকে টেনে বের করার সময় সেটা তার হাত থেকে পিছলে পড়ে না যায়। বেশ সহজেই খঞ্জরটা বের হয়ে আসে এবং সে প্রথমে একটা বাঁধন কাটে তারপরে দেহের বামপাশে বর্মের আরেকটা চামড়ার বাঁধন কেটে দেয়। বর্মটার একপাশ খুলে যেতে পানির স্রোত সেটা লুফে নেয় এবং ডানপাশের বাঁধন তখনও অটুট থাকায় সে নিজেকে পুরোপুরি বর্মটার হাত থেকে আলাদা করার আগে ঘুরপাক খেতে খেতে পানির নিচে আরও তলিয়ে যায়। সে হাত পা ছুঁড়ে পানির উপর ভেসে উঠে এবং বুক ভরে শ্বাস নেয় কেবল আরেকটা তীক্ষ্ণ আঘাত অনুভব করার জন্য এবং তারপরে পিঠের মাঝামাঝি আরেকটা।
সে আরেকটা ভাসমান দেহের সাথে পেচিয়ে যেতে শুরু করেছে–মরণ যন্ত্রণায় পা ছুঁড়তে থাকা একটা মরণাপন্ন ঘোড়া। মহবত খান বড় একটা শ্বাস নিয়ে আবার পানিতে ডুব দেয় এবার ঘোড়ার দেহের নিচে এবং নদীর তলদেশের একটা পাথর আঁকড়ে সেখানেই অবস্থান করে যতক্ষণ না পানির স্রোতে ঘোড়ার দেহটা ভেসে যায়। সে আবার পানির উপর ভেসে উঠে এবং নদীর পানিতে সাঁতার কাটার ভুল করে বসে। শ্যাওলা আবৃত পিচ্ছিল একটা পাথরে তার পা পিছলে যায় আর সে আবারও পানিতে তলিয়ে যায়। সে এইবার আর ভুল করে না নিজের সামান্য সাঁতারের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তীরের দিকে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু সে নদীর বাঁকের কাছে পৌঁছে গিয়েছে এবং স্রোতের বেগ হ্রাস পেতে শুরু করেছে। সে নিজের শেষ শক্তিটুকু কাজে লাগিয়ে কোনোমতে অগভীর পানিতে পৌঁছায় এবং হাচড়পাঁচড় করে উঠে দাঁড়ায় তার ভেজা কাপড় থেকে পানি চুঁইয়ে পড়ার সময় ডান হাতের ক্ষতস্থান থেকে পড়তে থাকা রক্তের সাথে মিশে যায়।
সে নদীর কর্দমাক্ত তীরে বসে ক্ষতস্থানটা পরীক্ষা করে। সে চর্বি আর লালচে মাংসপেশী দেখতে পেলেও কোনো হাড় দেখতে পায় না। আল্লাহতালা মেহেরবান, কেবল ক্ষতটা কেবল মাংসপেশীতে হয়েছে। সে তারপরে বুকের বর্মের ঘর্ষণজনিত ক্ষত পরিহার করতে গলায় জড়ানো হলুদ পশমের কাপড়টা খুলে নেয়। কাপড়টা পানিতে ভিজে জবজব করছে কিন্তু বামহাতে সে বহু কসরত করে অবশেষে সেটা নিংড়ে নেয় এবং দাঁতের সাহায্যে ডান হাতের ক্ষতস্থানে কোনোমতে সেটা বেধে দেয়। সে তারপরে পেছন থেকে আগত একজন অশ্বারোহীর ছায়া দেখতে পায়। সে নিমেষে বুঝতে পারে অশ্বারোহী যদি সম্রাটের সৈন্য হয় তাহলে তাঁর দফারফা হয়ে যাবে কিন্তু সে যখন ঘুরে দাঁড়ায় সে পরম স্বস্তির সাথে লক্ষ্য করে ব্যাপারটা সেরকম নয়। তাঁর দেহরক্ষীদের একজন খেয়াল করেছিল যে সে পানিতে পড়ে গিয়েছে এবং সে যদি কোনোক্রমে তীরে ভেসে আসে সেজন্য তাকে অনুসরণ করে ভাটিতে এসেছে।
মহামান্য সেনাপতি আপনি সুস্থ আছেন?’ লোকটা জিজ্ঞেস করে।
‘আমার তাইতো মনে হয়, সে বলে যদিও শীত আর আঘাতজনিত অভ্যাঘাতের কারণে সে ইতিমধ্যেই কাঁপতে শুরু করেছে। তোমার ঘোড়াটা আমায় দাও, সে একটু থেমে আবার যোগ করে। সে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালে তাঁর হাঁটু দেহের ভর নিতে অস্বীকার করতে সে আবারও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অশ্বারোহী দ্রুত ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে আসে এবং সে তার কাছে পৌঁছাবার আগেই মহবত খান আবারও পায়ের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তাঁর হাঁটু এইবার দেহের ভর নিতে পারে এবং সে টলমল করতে করতে ঘোড়ার দিকে এগিয়ে যায়। দেহরক্ষীর কাছ থেকে সামান্য সাহায্য নিয়ে সে চার হাতপায়ের সাহায্যে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে। তার পা এতই ঠাণ্ডা হয়ে আছে যে সে তাদের অস্তিত্ব প্রায় অনুভবই করতে পারে না কিন্তু তারপরেও আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সে রেকাবে পা রাখে এবং দেহরক্ষীকে উচ্চকণ্ঠে ধন্যবাদ জানিয়ে নদীর অগভীর অংশের চারপাশে চলতে থাকা যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ফিরে যেতে শুরু করে। জায়গাটা খুব একটা দূরে নয় এবং সে বুঝতে পারে গুলিবিদ্ধ হয়ে পানিতে আঁছড়ে পড়ার পড়ে খুব সম্ভবত সোয়া ঘন্টা সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে এটা দীর্ঘ সময়। সে যতটা বুঝতে পারে তার লোকেরা আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে, সংখ্যাধিক্যের কারণে আর তাদের প্রতিপক্ষকে গুলিবর্ষণের মুখে নদী অতিক্রম করতে হয়েছে বিধায় সেটাই হওয়া উচিত। সে তারপরে রাজেশকে দেখতে পায় এবং ঘোড়া নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যায় এবং শ্রবণ সীমার মধ্যে পৌঁছাতে সে চিৎকার করে জানতে চায়, সোনালী হাওদার হাতিটার কি খবর?
‘আপনার দেহরক্ষীদের একজন আমায় বলেছে যে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আপনি পানিতে পড়ার সাথে সাথে হাতিটার দুই মাহুতের একজন জন্তুটার গলা থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায় এবং অন্যজন, সম্ভবত আহত হওয়ায়, জটাকে ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। হাতিটা ঘুরে আবার মাঝনদীর দিকে চলে গিয়েছে এবং প্রহরীরা সেটাকে আর দেখতে পায় নি।
‘হাতির পিঠে আমাদের মহামান্য সম্রাজ্ঞী ছিলেন, মহবত খান হঠাৎ বলে বসে, বিশাল হাতিটা বা তার পিঠের সোনালী হাওদার সামান্যতম চিহ্নের খোঁজে তাঁর দৃষ্টি নদীর বুকে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের অবশ্যই হাতিটা খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের জানতেই হবে তিনি জীবিত না মৃত।
‘আমাকে জন্মের পর মৃত্যুবরণের জন্য পরিত্যাগ করা হয়েছিল কিন্তু আমি মারা যাই নি। মহবত খান আমাকে হত্যা করা তোমার পক্ষে সম্ভব না, তার পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। মহবত খান বিস্ময়ে চমকে উঠে এবং ঘুরে দাঁড়ায়। যুদ্ধের হট্টগোল আর নদীর বুকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে থাকার কারণে একজন বন্দি নিয়ে তাঁর দেহরক্ষীদের এগিয়ে আসবার শব্দ সে শুনতে পায় নি। মেহেরুন্নিসা বন্দি হলেও তাকে অনুত্তেজিত দেখায়।
মহবত খান তোমায় হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমায় মার্জনা করবে। আমি এইবার তোমাদের হাতে ধরা দিয়েছি নিজের স্বার্থের কারণে ভয়ে নয়। আমায় এখন আমার স্বামীর কাছে নিয়ে চল। আমি আমার লোকদের ইতিমধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছি। কেবল মনে রাখবে তোমার এই ‘বিজয় সাময়িক।