এম্পায়ার অভ দা মোগল – দি টেনটেড থ্রোন (কলঙ্কিত মসনদী কথা)
অ্যালেক্স রাদারফোর্ড / অনুবাদ: সাদেকুল আহসান কল্লোল
অনুবাদকের উৎসর্গ স্নেহস্পাদেষু রাকিবুল হাসান
প্রধান চরিত্রসমূহ:
জাহাঙ্গীরের পরিবারের সদস্যবৃন্দ
আকবর, জাহাঙ্গীরের পিতা এবং তৃতীয় মোগল সম্রাট
হুমায়ুন, জাহাঙ্গীরের দাদাজান এবং দ্বিতীয় মোগল সম্রাট
হামিদা, জাহাঙ্গীরের দাদিজান
কামরান, হুমায়ুনের সৎ-ভাই, জাহাঙ্গীরের দাদাজান।
আসকারি, হুমায়ুনের সৎ-ভাই, জাহাঙ্গীরের দাদাজান
হিন্দাল, হুমায়ুনের সৎ-ভাই, জাহাঙ্গীরের দাদাজান
মুরাদ, জাহাঙ্গীরের ভাই
দানিয়েল, জাহাঙ্গীরের ভাই।
খসরু, জাহাঙ্গীরের জ্যেষ্ঠ পুত্র
পারভেজ, জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় পুত্র
খুররম (পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান), জাহাঙ্গীরের তৃতীয় পুত্র
শাহরিয়ার, জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠ পুত্র
মান বাঈ, জাহাঙ্গীরের স্ত্রী এবং খসরুর জন্মদাত্রী মাতা
জোধা বাঈ, জাহাঙ্গীরের স্ত্রী এবং খুররমের জন্মদাত্রী মাতা
শাহিব জামাল, জাহাঙ্গীরের স্ত্রী এবং পারভেজের জন্মদাত্রী মাতা।
মেহেরুন্নিসা (নূরজাহান এবং নূর মহল নামেও পরিচিত) জাহাঙ্গীরের শেষ স্ত্রী
মেহেরুন্নিসার পরিবার
লাডলি, শের আফগানের ঔরসে মেহেরুন্নিসার কন্যা
গিয়াস বেগ, রাজকোষাগারের আধিকারিক এবং মেহেরুন্নিসার পিতা
আসমত, মেহেরুন্নিসা আর তার ভাইদের জননী
আসফ খান, আগ্রা সেনানিবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক এবং মেহেরুন্নিসার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা
মীর খান, মেহেরুন্নিসার কনিষ্ঠ ভ্রাতা।
আরজুমান্দ বানু, মেহেরুন্নিসার ভাস্তি, আসফ খানের কন্যা এবং খুররমের (শাহ জাহান) স্ত্রী।
শের আফগান, বাংলার গৌড়ে অবস্থিত সেনানিবাসের আধিকারিক এবং মেহেরুন্নিসার প্রথম স্বামী
জাহাঙ্গীরের অমাত্য, সেনাপতি আর সুবেদার
সুলেমান বেগ, জাহাঙ্গীরের দুধ-ভাই
আলী খান, মানডুর সুবেদার
ইকবাল বেগ, দাক্ষিণাত্যে অবস্থানরত একজন জ্যেষ্ঠ সেনাপতি
মহবত খান, পারস্য থেকে আগত আর জাহাঙ্গীরের সেরা সেনাপতিদের অন্যতম।
মাজিদ খান, জাহাঙ্গীরের উজির এবং ঘটনাপঞ্জির রচয়িতা
ইয়ার মহম্মদ, গোয়ালিয়রের সুবেদার
দারা শুকোহ, খুররমের (শাহ জাহান) জ্যেষ্ঠ পুত্র
শাহ শুজা, খুররমের (শাহ জাহান) দ্বিতীয় পুত্র
আওরঙ্গজেব, খুররমের (শাহ জাহান) তৃতীয় পুত্র
মুরাদ বকস্, খুররমের (শাহ জাহান) কনিষ্ঠ পুত্র
জাহানারা, খুররমের (শাহ জাহান) জ্যেষ্ঠ কন্যা
রওন্নারা, খুররমের (শাহ জাহান) কনিষ্ঠ কন্যা
বাদশাহীহারেমের অভ্যন্তরে
মালা, খাজাসরা, রাজকীয় হারেমের তত্ত্বাবধায়ক
ফাতিমা বেগম, সম্রাট আকবরের বিধবা স্ত্রী
নাদিয়া, ফাতিমা বেগমের পরিচারিকা
সাল্লা, মেহেরুন্নিসার আর্মেনীয় সহচর
খুররমের অন্তরঙ্গ সহচর
আজম বকস্, আকবরের একজন প্রাক্তন বৃদ্ধ সেনাপতি
কামরান ইকবাল, খুররমের একজন সেনাপতি।
ওয়ালিদ বেগ, খুররমের অন্যতম প্রধান তোপচি
অন্যান্য চরিত্র
আজিজ কোকা, খুসরুর সমর্থক
হাসান জামাল, খসরুর সমর্থক
মালিক আম্বার, মুক্তি লাভ করা আবিসিনীয় ক্রীতদাস এবং বর্তমানে মোগলদের বিরুদ্ধে দাক্ষিণাত্যের সালতানাতের সম্মিলিত বাহিনীর সেনাপতি
শেখ সেলিম চিশতি, সুফি সাধক, এবং নিজেও একজন সুফি সাধকের পুত্র।
মোগল দরবারে আগত বিদেশী
বার্থোলোমিউ হকিন্স, ইংরেজ সৈনিক এবং ভাগ্যান্বেষনকারী
ফাদার রোনাল্ডা, পর্তুগীজ পাদ্রী।
স্যার টমাস রো, মোগল দরবারে প্রেরিত ইংরেজ রাজদূত
নিকোলাস ব্যালেনটাইন, স্যার টমাস রো’র সহচর
.
প্রথম পর্ব – রমণীকুল মাঝে এক প্রভাকর
১.১ বালিতে রক্তের দাগ
উত্তরপশ্চিম ভারতবর্ষ ১৬০৬ সালের বসন্তকাল
জাহাঙ্গীর তার টকটকে লাল বর্ণের নিয়ন্ত্রক তাবুর চাঁদোয়ার নিচে দিয়ে মাথা নিচু করে বাইরে বের হয়ে আসে এবং আধো-আলোর ভিতরে উঁকি দিয়ে দূরের পর্বতের শৈলশিরাময় অংশের দিকে তাকায় যেখানে তার জ্যেষ্ঠপুত্র খুররমের সৈন্যবাহিনী শিবির স্থাপন করেছে। পরিষ্কার আকাশের নিচে প্রায় মরুভূমির মত এলাকাটার ভোরের বাতাসে শীতের প্রকোপ ভালোই টের পাওয়া যায়। জাহাঙ্গীর এতদূর থেকেও শিবিরের এদিক সেদিক চলাচল করতে থাকা অবয়ব ঠিকই লক্ষ্য করে, তাদের কারো কারো হাতে জ্বলন্ত মশাল রয়েছে। রান্নার জন্য এর মধ্যে বেশ কয়েক স্থানে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। শৈলশিরার একেবারে শীর্ষদেশে একটা বিশাল তাবুর সামনে ভোরের আধো আলোর প্রেক্ষাপটে বেশ কয়েকটা নিশানকে উড়তে দেখা যায়, খুব সম্ভবত খুররমের ব্যক্তিগত আবাসস্থল। সহসা ভোরের বাতাসের মত শীতল একটা বিষণ্ণতাবোধ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় জাহাঙ্গীরকে আপুত করে তুলে। পরিস্থিতির এমন পরিণতি কেন হল? কেন আজ তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে আপন পুত্রের মোকাবেলা করতে হবে?
তার আব্বাজান আকবরের মৃত্যুর পরে, মাত্র পাঁচমাস আগেই, বহুদিন ধরে সে কামনা করেছিল এমন সবকিছুর উপরে শেষ পর্যন্ত তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজবংশের চতুর্থ মোঘল সম্রাট হিসাবে তার নাম ঘোষণা করা হয়। জাহাঙ্গীর, এই নামে সে রাজত্ব পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার মানে পৃথিবীর সংরোধক। পশ্চিমে বেলুচিস্তানের পাহাড়ি এলাকা থেকে পূর্বে বাংলার নিম্নাঞ্চল এবং উত্তরে কাশ্মীরের জাফরানশোভিত ফসলের মাঠ থেকে দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যের লাল মাটির শুষ্ক মালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত একটা সাম্রাজ্যের অধিশ্বর হবার অনুভূতিটাই দারুণ। দশ কোটি মানুষের প্রাণ তার অনুবর্তী কিন্তু সে কারো অনুবর্তী নয়।
সম্রাট হিসাবে প্রথমবারের মত নিজের প্রজাদের সামনে নিজেকে উপস্থাপনের নিমিত্তে আগ্রা দূর্গের ইন্দ্রকোষ ঝরোকায় সে যখন পা রাখে, এবং নিচে যমুনার তীরে ভীড় করে থাকা মানুষের ভীড় থেকে সম্মতির সমর্থন ভেসে আসে, তাঁর আব্বাজান মৃত সেই বিষয়টাই তখন প্রত্যয়াতীত মনে হয়। আকবর সমৃদ্ধ আর জাক-জমকপূর্ণ একটা সাম্রাজ্য নির্মাণ করেছিলেন সমস্ত বিপদ আর প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে রেখে। আকবর বেঁচে থাকার সময় জাহাঙ্গীরের যেমন প্রায়শই মনে হতো সে কখনও আকবরের ভালোবাসা পুরোপুরি অর্জন করতে পারে নি কিংবা তার প্রত্যাশা অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারে নি, আকবরের মৃত্যুর পরে তার মনে এখন সহসাই সন্দেহের মেঘ ঘনীভূত হয় যে এখন সেটা আদৌ তার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু সে চোখ বন্ধ করে এবং নিরবে একটা প্রতিজ্ঞা করে। আপনি আমাকে সম্পদ আর ক্ষমতা দান করেছেন। আপনার যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে আমি নিজেকে প্রমাণ করবো। আপনি আর আমার পূর্বপুরুষেরা যা নির্মাণ করেছেন আমি সেটা রক্ষা করবো এবং বর্ধিত করবো। নিজের কাছে নিজের এই প্রতিজ্ঞার ব্যাপারটা তাঁর আত্মবিশ্বাসকে শাণিত করে তুলে।
কিন্তু এই ঘটনার সপ্তাহখানেকের ভিতরেই প্রথম আঘাত আসে, কিন্তু কেএনা আগন্তুক নয় বরং তাঁর নিজের আঠারো বছরের ছেলেই সেই আঘাতটা হানে। বিশ্বাসঘাতকতা–এবং এর ফলে সৃষ্ট বাতাবরণ সবসময়েই একটা নোংরা ব্যাপার, কিন্তু নিজের সন্তানই যখন সেটার উদ্গাতা তখন এর চেয়ে জঘন্য আর কিছুই হতে পারে না। মোগলদের যখন একত্রিত থাকার কথা তখন পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করে মোঘলরা অনেক সময়ে নিজেরাই নিজেদের প্রবল শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এই একই বিন্যাসের পুনরাবৃত্তি সে কখনও, কিছুতেই অনুমতি দিতে পারে না এবং এখন তাঁর রাজত্বের সূচনা লগ্নে সে সবাইকে দেখিয়ে দিতে চায় যে পারিবারিক অবাধ্যতার বিষয়টা সে ভীষণ ঐকান্তিকতার সাথে গ্রহণ করেছে এবং কত দ্রুত আর পুরোপুরি সে এই বিদ্রোহীদের দমন করবে।
বিগত কয়েকটা সপ্তাহ তাঁর নিজের বাহিনী আর তাঁর পুত্রের বাহিনীর মাঝে দূরত্ব হ্রাস করার অভিপ্রায় ছাড়া আর কিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সে আর তার বাহিনী গতকাল সন্ধ্যাবেলা খসরুর নাগাল পায় এবং সে যেখানে শিবির স্থাপন করেছে সেই শৈলশিরাময় অংশটা ঘিরে ফেলে। আপন সন্তানের বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়ে সে যতই চিন্তা করে ততই গা গুলিয়ে ওঠা ক্রোধের একটা ঢেউ তার উপরে এসে আছড়ে পড়ে এবং পায়ের গোড়ালী দিয়ে সে বালুকাময় মাটিতে সজোরে আঘাত করে। সে সহসা নিজের পাশে তার দুধ-ভাই সুলেমান বেগের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’ সে জানতে চায়, অবদমিত আবেগের কারণে তাঁর কণ্ঠস্বর রুক্ষ শোনায়।
রাতেরবেলা খসরুর শিবিরের কাছাকাছি আমাদের গুপ্তদূতদের যারা গিয়েছিল তাদের কাছ থেকে সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে শুনছিলাম।
‘তারা তাহলে, কি বললো? আমার ছেলে কি অনুধাবন করতে পেরেছে যে সে আমাদের নাগাল থেকে পালাতে পারবে না এবং তাকে অবশ্যই নিজের বিদ্রোহের পরিণতি ভোগ করতে হবে?
“জ্বী। সে যুদ্ধের জন্য নিজের বাহিনীকে প্রস্তুত করছে।’
‘সে আর তাঁর সেনাপতিরা কীভাবে নিজেদের সৈন্যদের বিন্যস্ত করছে?
‘শৈলচূড়ায় বেলেপাথরের তৈরি হিন্দুদের কয়েকটা স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। তাঁরা এগুলোর চারপাশে নিজেদের মালবাহী শকটগুলোকে উল্টে দিয়েছে এবং নিজেদের তবকী আর তিরন্দাজদের সুরক্ষিত রাখতে এবং তাঁদের কামানগুলোকে আড়াল করতে মাটির অবরোধক নির্মাণ করছে।
তার মানে আক্রমণ করার পরিবর্তে তারা আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে?’
‘জ্বী। তাঁরা জানে এটাই তাদের সাফল্যের শ্রেষ্ঠ সুযোগ। খসরু কিংবা তাঁর প্রধান সেনাপতি আজিজ কোকা কেউই নির্বোধ নয়।’
‘আমার কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করা ছাড়া, জাহাঙ্গীর তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে।
‘আমি কি আমাদের বাহিনীকে আসন্ন আক্রমণের জন্য এখনই বিন্যস্ত হবার আদেশ দেব?
‘আমি সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে, শৈলচূড়ার উপরে পানি কিংবা ঝর্ণার কোনো উৎসের ব্যাপারে আমরা কি কিছু জানি?
‘গতকাল সন্ধ্যাবেলা আমাদের সাথে কেবল একজন পশুপালকের দেখা হয়েছিল আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম। সে বলেছে নেই কিন্তু বেচারা এতটাই আতঙ্কিত ছিল যে আমি যা শুনতে চাই বলে তার কাছে মনে হয়েছিল সে হয়ত সেটাই তখন বলেছিল। অবশ্য, চূড়াটার সর্বত্রই লাল ধূলো আর পাথর মাঝে মাঝে কেবল কয়েকটা মৃতপ্রায় গাছ আর বিক্ষিপ্তভাবে জন্মানো ঘাস রয়েছে।
‘পশুপালক লোকটা তাহলে হয়তো ঠিকই বলেছে। সেক্ষেত্রে, তাঁদের সাথে যৎসামান্য যতটুকু পানি রয়েছে সেটা নিঃশেষ করার জন্য আমরা বরং এখনই তাঁদের আক্রমণ করা থেকে আরো কিছুক্ষণ বিরত থাকি তারা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের ভাগ্য নিয়ে চিন্তা করুক। খসরুর মতই, তাঁরা সবাই অল্পবয়সী আর যুদ্ধে অনভিজ্ঞ। এমনকি যুদ্ধের ভয়ঙ্কর বিভীষিকাও তাঁদের কল্পনাকে ছাপিয়ে যাবে।’
‘হয়ত, কিন্তু আমাদের দেয়া আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে আমি যেমনটা আশা করেছিলাম তারা ঠিক সেভাবে সাড়া দেয়নি।
জাহাঙ্গীর চোখমুখ কুঁচকে কিছু একটা ভাবে। গত সন্ধ্যায় সে সুলেমান বেগের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিল খসরুর শিবির লক্ষ্য করে বার্তাবাহী তীর নিক্ষেপ করার ব্যাপারে যেখানে লেখা থাকবে যেকোনো নিম্নপদস্থ সেনাপতি কিংবা কোনো সৈন্য যারা সেই রাতে খসরুর শিবির ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করবে তাদের প্রাণ রক্ষা পাবে। দ্বিতীয় কোনো সুযোগ দেয়া হবে না। কেউ যেন মনে না করে যুদ্ধের পরে কারো প্রতি কোনো ধরনের করুণা প্রদর্শন করা হবে।’
কতজন আত্মসমর্পণ করেছে?
‘হাজারখানের চেয়ে সামান্য কিছু কম হবে, বেশিরভাগই অপ্রতুল অস্ত্র আর পোষাক পরিহিত পদাতিক সৈন্য। অনেকেই সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ হয়েছে যারা খসরুর বাহিনী অগ্রসর হবার সময় উত্তেজনা আর লুটের মালের বখরার আশায় তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিল। স্বপক্ষত্যাগী একজন বলেছে কীভাবে পালাবার চেষ্টা করার সময় ধৃত এক কিশোর সৈন্যকে খসরুর আদেশে শিবিরের জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে এবং বর্শার সুতীক্ষ্ণ অগ্রভাগ দিয়ে তাকে অগ্নিশিখায় ঠেসে রাখা হয়েছিল যতক্ষণ না তার চিৎকার স্তব্ধ হয়ে যায়। তার অঙ্গার হয়ে যাওয়া দেহটা এরপরে শিবিরের। ভেতরে প্রদর্শিত করা হয় অন্যদের তারমত পালাবার প্রয়াস গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে।
‘খসরুর সাথে এখন তাহলে কতজন লোক রয়েছে?
‘স্বপক্ষত্যাগী লোকটার বক্তব্য অনুযায়ী বারো হাজার। আমার মনে হয় সংখ্যাটা কমিয়ে বলা হয়েছে কিন্তু তাঁদের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই পনের হাজারের বেশি হবে না।’
‘তাঁদের চেয়ে এখনও আমাদের তিন কি চার হাজার লোক বেশি রয়েছে। নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের পেছনে গুঁড়ি মেরে প্রতিক্ষারত খসরুর সৈন্যদের চেয়ে আক্রমণকারী হিসাবে, অনেকবেশি অরক্ষিত থাকার কারণে আমাদের সৈন্যদের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য এই সংখ্যাটা যথেষ্ট।
জাহাঙ্গীর তার নিয়ন্ত্রক তাবুতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার জন্য যখন তাঁর পরিচারক, তাঁর কর্চির জন্য অপেক্ষা করার সময় যখন পায়চারি করছে তার মনে একের পর এক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য সে কি সম্ভাব্য সবকিছু করেছে? একজন সেনাপতির জন্য আত্মবিশ্বাসে ঘাটতির মতই অতিরিক্ত-আত্মবিশ্বাসও বিশাল একটা হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। গতকাল অনেক গভীর রাত পর্যন্ত তিনি আর সুলেইমান বেগ যে পরিকল্পনা করেছেন সেটা কি সম্রাট হিসাবে তার প্রথম যুদ্ধে তাকে বিজয়ী করার জন্য যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হবে? খসরুর বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়ে তিনি কেন পূর্বেই প্রস্তুত ছিলেন না? আকবর যখন বেঁচে ছিলেন খসরু তাঁর দাদাজানের অনুগ্রহভাজন হবার চেষ্টা করেছিল, তার উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত হবার আশায়। আকবর যখন তাঁর পরিবর্তে জাহাঙ্গীরকে নির্বাচিত করেন, খসরু আপাত দৃষ্টিতে সেটা মেনে নিলেও সে আসলে নিজের সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিল। আগ্রা থেকে পাঁচ মাইল দূরে সিকানদারায় তাঁর দাদাজানের বিশাল সমাধিসৌধ নির্মাণের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের বাহানা দেখিয়ে সে তার পুরো বাহিনী নিয়ে আগ্রা দূর্গ থেকে বের হয়ে যায়। সিকানদারা অভিমুখে না গিয়ে সে উত্তর দিকে সোজা দিল্লির উদ্দেশ্যে ঘোড়া হাঁকায়, পথে যেতে যেতে নতুন সৈন্য নিয়োগ করে সে তার বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে।
জাহাঙ্গীর যখন চূড়ান্ত আদেশ দেয়ার জন্য তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতিদের একত্রিত করে সূর্য তখন আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছে। আবদুর রহমান, আপনি, অশ্বারোহী বকি আর তীরন্দাজদের একটা বাহিনীর সাথে আমাদের রণহস্তির দলকে নেতৃত্ব দিয়ে পশ্চিম দিকে নিয়ে যাবেন শৈলচূড়া যেখানে ধীরে ধীরে সমভূমির সাথে এসে মিশেছে। আপনি সেখানে অবস্থান গ্রহণের পরে, শৈলচূড়ার হলরেখা বরাবর অগ্রসর হয়ে, খসরুকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করবেন যে এটাই হবে, যেমনটা প্রচলিত রণনীতিতে অনুসৃত হয়, আমাদের আক্রমণের প্রধান অভিমুখ।
‘কিন্তু এটা একটা ভাওতা। খসরুর সৈন্যদের যতবেশি সংখ্যায় সম্ভব নিবিষ্ট রাখার জন্য এটা একটা কৌশল। আমি আপনাকে শত্রুর সাথে পুরোপুরি নিবিষ্ট দেখার পরে, সুলেইমান বেগ আর আমি আমাদের আরেকদল অশ্বারোহী নিয়ে রওয়ানা দেব। প্রথমে, আপনাকে সহযোগিতা দেয়ার জন্য আমরা পশ্চিম দিকে যাবার ভান করবো কিন্তু তারপরেই আমরা ঘুরে গিয়ে সরাসরি আমাদের সামনে চূড়ার শীর্ষে অবস্থিত খসরুর তাবু অভিমুখে আক্রমণ করার জন্য পেয়ে যাব। ইসমাঈল আমল, এখানে অতিরিক্ত বাহিনীর নেতৃত্বে আপনি অবস্থান করবেন এবং লুটপাটের কোনো প্রয়াস থেকে আমাদের শিবিরকে রক্ষা করবেন। আপনারা সবাই কি নিজেদের ভূমিকা ঠিকমত বুঝতে পেরেছেন?
“জ্বী, সুলতান, সাথে সাথে প্রত্যুত্তর ভেসে আসে।
‘তাহলে আল্লাহতালা আমাদের সহায়। আমরা ন্যায়ের পক্ষে রয়েছি।
*
আধ ঘন্টা পরে, জাহাঙ্গীর পুরোদস্তুর যুদ্ধের সাজে সজ্জিত অবস্থায়, তাঁর ইস্পাতের শিরোস্ত্রাণের নিচে ঘামতে থাকে এবং ইস্পাতের কারুকাজ করা বক্ষ–এবং পৃষ্টরক্ষাকারী বর্ম তার দেহখাঁচা আবৃত করে রেখেছে। নিজের সাদা ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায়, বিশাল প্রাণীটা খুর দিয়ে অস্থিরভাবে কেবলই মাটিতে আঘাত করছে যেন আসন্ন লড়াইয়ের আভাস আঁচ করতে পেরেছে, সে আবদুর রহমানের বাহিনীকে তূর্য ধ্বনি, ক্রমশ জোরালো হতে থাকা ঢোলের আওয়াজ আর মন্দ্র বাতাসে পতপত করে উড়তে থাকা সবুজ নিশানের মাঝে, সঙ্ঘবদ্ধভাবে অগ্রসর হতে দেখে। আগুয়ান বহরটা বিস্তৃত শৈলশিরার পাদদেশের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করতে খসরুর তোপচিরা নিকটবর্তী অবস্থান থেকে আক্রমণকারীদের লক্ষ্য করে নিজেদের অপেক্ষাকৃত বড় কামানগুলো থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করলে বাতাসে সাদা ধোয়া ভাসতে দেখা যায়।
অবশ্য, স্পষ্টতই বোঝা যায় যে গোলন্দাজেরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং তড়িঘড়ি করে আগেই কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা থেকে নিজেদের তারা বিরত রাখতে পারে না কারণ আবদুর রহমানের অগ্রবর্তী দলের অনেক সামনে তাদের নিক্ষিপ্ত গোলাগুলো এসে আছড়ে পড়ে ঝর্ণার মত উপরের দিকে ধুলো নিক্ষেপ করে। কিন্তু তারপরেই জাহাঙ্গীরকে আতঙ্কিত করে তুলে তাঁর আগুয়ান একটা রণহস্তী ইস্পাতের বর্ম দিয়ে আবৃত থাকা সত্ত্বেও হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়ে, বিশাল প্রাণীটা ভূপাতিত হবার সময় পিঠের হাওদাটাকে একপাশে ছিটকে ফেলে দেয়। আরো একটা হাতি মাটিতে পড়ে যায়। জাহাঙ্গীরের কাছে মনে হয় আক্রমণ বুঝি ব্যর্থ হতে চলেছে কিন্তু তারপরেও বিশাল প্রাণীগুলোর কানের পেছনে বসে থাকা মাহুতের দল প্রাণীগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার আদেশ দিতে, অবশিষ্ট হাতিগুলো তাদের ভূপাতিত সঙ্গীদের পাশ কাটিয়ে তাদের দেহের তুলনায় বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠে যাওয়া পথ দিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। মাঝে মাঝে ধোয়ার কুণ্ডলী সৃষ্টি হতে বোঝা যায় যে হাতিগুলোর হাওদায় স্থাপিত ছোট কামান, গজনলগুলো থেকে গোলা বর্ষণ করা হচ্ছে। জাহাঙ্গীর একই সময়ে লক্ষ্য করে তার অশ্বারোহী যোদ্ধারা পর্বত শিখরোপরি পথ দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে, তারা লাল মাটির জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা অবরোধক লাফিয়ে অতিক্রম করার সময় সবুজ নিশানগুলো উঁচুতে তুলে ধরে এবং বর্শার ফলা সামনের দিকে বাড়িয়ে রাখে এবং খসরুর অশ্বারোহীদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। উভয়পক্ষেই প্রচুর হতাহত হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দুলকি চালে আরোহীবিহীন ঘোড়াগুলো ছুটে যায় আবার কিছু ঘোড়া আক্রমণকারীদের অগ্রসর হবার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। জাহাঙ্গীরের দৃষ্টি ক্রমেই যুদ্ধক্ষেত্রের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া সাদা ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় কিন্তু তার আগেই সে একদল অশ্বারোহীকে দেখতে পায়, মধ্যাহ্নের সূর্যকিরণে তাঁদের বক্ষস্থল আবৃতকারী বর্ম চিকচিক করছে, খসরুর তাবুর সামনে নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করে দ্রুত আবদুর রহমানের আক্রমণের মুখে তাঁদের সহযোদ্ধাদের অবস্থান মজবুত করতে পশ্চিম দিকে এগিয়ে যায়। তার উপরেই যুদ্ধের সন্ধিক্ষণ নির্ভর করছে।
‘আমাদের এবার যাবার সময় হয়েছে, জাহাঙ্গীর ময়ান থেকে তাঁর পূর্বপুরুষের ব্যবহৃত ঈগলের মাথাযুক্ত হাতল বিশিষ্ট তরবারি আলমগীর টেনে বের করার মাঝে সুলেইমান বেগের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে রেকাবের উপরে দাঁড়িয়ে নিজের তূর্যবাদকের উদ্দেশ্যে সেটা আন্দোলিত করে তাঁদের অগ্রসর হবার সংকেত ঘোষণা করতে বলে। জাহাঙ্গীরের সাদা ঘোড়া অচিরেই আস্কন্দিত বেগে ছুটতে শুরু করে, আবদুর রহমানকে সহায়তা দানে পূর্বে পরিকল্পিত মেকী যুদ্ধের ঢঙে ছোটার সময় জন্তুটার খুরের আঘাতে মাটিতে থেকে ধুলো উড়তে থাকে।
যুদ্ধের সমূহ সম্ভাবনায় জাহাঙ্গীরের নাড়ীর স্পন্দন দ্রুততর হতে থাকে। তার বয়স ছত্রিশ বছর হতে চলেছে কিন্তু তাঁর পূর্বপুরুষেরা এই বয়সে যত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন সে তার তুলনায় অনেক কম যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে, তাকে সামরিক নেতৃত্ব প্রদানে তাঁর আব্বাজানের অস্বীকৃতি এর জন্য আংশিক দায়ী এবং আংশিক দায়ী রাজ্য পরিচালনায় আকবরের সাফল্য যার ফলে মোগলদের খুব কমই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতে হয়েছে। সাম্রাজ্য যেহেতু তার সেই কারণে নেতৃত্বও তার এবং সে সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে আজ গুঁড়িয়ে দেবে।
জাহাঙ্গীর তার সাদা ঘোড়া নিয়ে নিজের দেহরক্ষীদের মাঝ থেকে সামনে এগিয়ে যায় এবং তারপরে তাঁদের ইঙ্গিত করে ঘুরে গিয়ে পর্বতের শীর্ষে অবস্থিত শৈলশিরা বরাবর উঠে গিয়ে সামনের দিকে আক্রমণ করতে। তারা সবাই যখন আক্রমণ করতে ব্যস্ত, জাহাঙ্গীর পর্যাণের উপর মোড় দিয়ে পিছনে তাকিয়ে একজন অশ্বারোহী যোদ্ধা আর তাঁর খয়েরী রঙের ঘোড়াকে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখে, স্পষ্টতই বোঝা যায় খুব দ্রুত আর তীক্ষ্ণ বাঁক নিতে গিয়ে তাদের এই অবস্থা। মাটিতে পড়ে থাকা খয়েরী ঘোড়ার গায়ে আরেকটা ঘোড়া হোঁচট খায়, পাগুলো বাতাসে অক্ষম আক্রোশে আঘাত করে বিশাল জটা প্রাণপনে উঠার চেষ্টা করে। নিমেষের ভিতরে ভূপাতিত জন্তু আর তাঁদের আরোহীরা শৈলশিরার ক্রমশ খাড়া হয়ে উপরের দিকে উঠে যাওয়া পথ দিয়ে আক্রমণের বেগ ধীরে ধীরে জোরালো করতে আরম্ভ করলে তাদের পায়ের নিচে হারিয়ে যায়।
জাহাঙ্গীর তার হাতের তরবারি আলমগীর সামনে দিকে বাড়িয়ে ধরে, দূর্ঘটনা এড়াতে নিজের সাদা ঘোড়াটার গলার কাছে নিচু হয়ে ঝুঁকে এসে, পাহাড়ী ঢালটার গায়ে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ছোটবড় পাথরের টুকরো এড়িয়ে যেতে মনোনিবেশ করে। সে তারপরেই পটকা ফাটার মত কড়কড় একটা শব্দ শুনতে পায় এবং একটা হিস শব্দ তুলে তার কানের পাশ দিয়ে গাদাবন্দুকের গোলা অতিক্রম করে। সে মাটির তৈরি প্রতিবন্ধকতার প্রথম সারির প্রায় কাছে চলে এসেছে। সে তার হাতে ধরা লাগাম আলগা করে দিয়ে ঘোড়র কানের কাছে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে। সামনের প্রতিবন্ধকতা লাফিয়ে অতিক্রম করতে সাহস দেয়, যা খুব বেশি হলে ফুট তিনেক লম্বা হবে। ঘোড়াটা যেন এই আদেশের অপেক্ষায় ছিল এবং সাথে সাথে লাফ দেয়। প্রতিবন্ধকতার উপর দিয়ে লাফিয়ে অতিক্রম করার সময় সেটার পিছনে লুকিয়ে থাকা শত্রুপক্ষের এক দীর্ঘদেহী তবকিকে লক্ষ্য করে জাহাঙ্গীর তরবারি চালায় বেচারা তখন মরীয়া হয়ে নিজের গাদাবন্দুকের লম্বা নল দিয়ে সীসার একটা নতুন গুলি ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়ে সেটাকে পুনরায় গুলিবর্ষণের উপযোগী করার চেষ্টা করছে। লোকটা নিজের অভীষ্ট উদ্দেশ্য কখনই অর্জন করতে পারবে না, জাহাঙ্গীরের তরবারির প্রচণ্ড আঘাত লোকটার অরক্ষিত ঘাড়ের পেছনের অংশে কামড় বসায়, হাড়ের ভিতর দিয়ে একটা বীভৎস মড়মড় শব্দ করে এবং হতভাগ্য লোকটার কাঁধের উপর থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
জাহাঙ্গীর হাপড়ের মত শ্বাস নিতে নিতে শৈলশিখরের চূড়ার দিকে আস্কন্দিত বেগে ঘোড়া হাঁকায় এবং যে তাবুটাকে খসরুর নিয়ন্ত্রক তাবু হিসাবে সে করেছে, সেটা তখনও আধমাইলের মত দূরে, এমন সময় সহসাই তার বাহনের গতি মন্থর হতে আরম্ভ করে। সে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রাণীটার বামপাশ ফুড়ে দুটো তীরের ফলা বাইরে বের হয়ে রয়েছে। ক্ষতস্থান থেকে গাঢ় লাল বর্ণের রক্ত ইতিমধ্যেই কুলকুল করে গড়াতে আরম্ভ করে প্রাণীটার সাদা চামড়ায় একটা দাগের জন্ম দিয়েছে। জাহাঙ্গীরের তখন নিজের সৌভাগ্য নিয়ে চিন্তা করার মত বিলাসিতার সময় নেই–তার বাম হাঁটু থেকে মাত্র এক কি দুই ইঞ্চি দূরে একটা তীর বিদ্ধ হয়েছে–তার আগেই ঘোড়াটা হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়তে আরম্ভ করে এবং বিশাল জন্তুটা মাটিতে ভূপাতিত হবার সময় এর নিচে চাপা পড়ার হাত থেকে বাঁচতে সে লাফিয়ে উঠে পর্যাণ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। মাটিতে আছড়ে পড়ার সময় জাহাঙ্গীর তাঁর শিরোস্ত্রাণ আর তরবারি দুটোই খোয়ায় এবং পাথুরে মাটিতে বেকায়দায় অবতরণ করায় তার বুক থেকে সব বাতাস বের হয়ে যায়।
জাহাঙ্গীর মাটিতে বার বার গড়াতে গড়াতে নিজেকে কুকড়ে ফেলে একটা বলে পরিণত করতে চেষ্টা করে এবং সে তার দস্তানা আবৃত হাত দিয়ে পেছনের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের ঘোড়ার খুরের আঘাত থেকে নিজের মাথা বাঁচাতে চেষ্টা করে যারা তাকে অনুসরণ করে আক্রমণে উদ্যত হয়েছে। ধাবমান ঘোড়ার পাল আর খণ্ডযুদ্ধের মূল এলাকা থেকে বেশ খানিকটা দূরে ঢাল বরাবর নিচের দিকে বেশ খানিকটা দূরত্ব অতিক্রম করার পরে ঢালের পাশে অবস্থিত পাথরের একটা স্তূপের সাথে ধাক্কা লেগে তার যন্ত্রণাদায়ক পতনের বেগ স্তব্ধ হয় কিন্তু তা সত্ত্বেও, দুদ্দাড় ভঙ্গিতে ধাবমান একটা খুর তার পিঠের ইস্পাতের বর্মে আঘাত করে। বিমূঢ় আর বিভ্রান্ত এবং কানের ভিতরে হাজারো ঘন্টা ধ্বনি আর চোখে অস্পষ্ট দৃষ্টি নিয়ে সে টলমল করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সময় সে কাছাকাছি অবস্থিত কালো পাথরের আরেকটা স্তূপের পেছন থেকে একজন লোককে উঠে দাঁড়াতে দেখে এবং একটা তরবারি বাতাসে আন্দোলিত করতে করতে তাঁর দিকে ধেয়ে আসে, স্পষ্টতই তাকে চিনতে পেরেছে এবং তাকে হত্যা কিংবা বন্দি করতে পারলে প্রাপ্য সম্মান আর সম্পদ অর্জনে একচিত্ত।
জাহাঙ্গীর সহজাত প্রবৃত্তির বশে তাঁর পরিকরের দিকে হাত বাড়ায় যেখানে রত্নখচিত ময়ানে তার খঞ্জরটা রয়েছে। সে পরম স্বস্তিতে আবিষ্কার করে সেটা এখনও সেখানেই রয়েছে এবং চাপদাড়ি আর কালো পাগড়ি পরিহিত রুক্ষ-দর্শন এবং স্থূলকায়–লোকটা তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই সে সময়মত খঞ্জরটা ময়ান থেকে বের করে। জাহাঙ্গীর লোকটার প্রথম আক্রমণের ঝাপটা কৌশলে এড়িয়ে যায় কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তার পা পিছলে যায় এবং আবারও মাটিতে আছড়ে পড়ে। তাঁর হামলাকারী সুযোগ বুঝতে পেরে এবার দু’হাতে নিজের ভারি দুধারী তরবারি আঁকড়ে ধরে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটা জাহাঙ্গীরের গলায় নামিয়ে আনতে চেষ্টা করে কিন্তু সে আঘাত করতে গিয়ে বড় তাড়াহুড়ো করায় জাহাঙ্গীরের বক্ষস্থল রক্ষাকারী বর্মে লেগে লোকটার আনাড়ি অভিঘাত পিছলে গেলে, লোকটা নিজেই নিজেকে ভারসাম্যহীন করে তোলে। জাহাঙ্গীর তার নাগরা পরিহিত পা দিয়ে প্রাণপনে লাথি হাঁকায় এবং তার প্রতিপক্ষের দু’পায়ের সংযোগস্থলে লাথিটা মোক্ষমভাবে আঘাত করলে সে নরম পেশীতন্তুর একটা তৃপ্তিকর স্পর্শ অনুভব করে। লোকটা তাঁর হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিজের থেতলে যাওয়া অণ্ডকোষ খামচে ধরে, চরাচর স্তব্ধকারী ব্যাথায় হাঁটুর উপর কুকড়ে দু’ভাঁজ হয়ে আসে।
জাহাঙ্গীর নিজের সুবিধাজনক অবস্থার সুযোগ নিয়ে, তাঁর আক্রমণকারীর অরক্ষিত পায়ের গুলের শক্ত মাংসপেশীতে হাতের খঞ্জর দিয়ে দ্রুত দু’বার আঘাত করায়, লোকটা টলমল পায়ে একপাশে সরে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। জাহাঙ্গীর ধুলি আচ্ছাদিত মাটির উপর দিয়ে হাচড়পাঁচড় করে এগিয়ে এসে নিজেকে লোকটার উপরে আছড়ে ফেলে এবং লোকটার কণ্ঠার হাড়ের ঠিক উপরের অরক্ষিত কণ্ঠনালীতে খঞ্জরের লম্বা ফলাটা আমূল গেঁথে দেয়। ফিনকি দিয়ে কিছুক্ষণ রক্ত উৎক্ষিপ্ত হয় আর তারপরে লোকটা নিথর ভঙ্গিতে মাটিতে পড়ে থাকে।
প্রাণহানির ঝুঁকি থেকে ভারমুক্ত হয়ে জাহাঙ্গীর যখন তার চারপাশে তাকায় তখনও সে চার হাতপায়ের উপর ভর দিয়ে রয়েছে এবং ঘন ঘন শ্বাস টানছে। সে তার ঘোড়র উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ার পরে অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে মনে হলেও আসলে পাঁচ মিনিটও অতিবাহিত হয়নি। মূল লড়াইটা বোধহয় শৈলচূড়ার বেশ খানিকটা উপরের দিকে সংঘটিত হচ্ছে। সে যদিও তখনও চোখে ঝাপসা দেখছে তার ভেতরেই সে বেশ কিছুটা দূরে অশ্বারোহী একটা অবয়বকে লক্ষ্য করে দ্রুত এগিয়ে আসছে এবং, ঝাপসা চোখে সে যতটা বুঝতে পারে, লোকটার সাথে আরেকটা অতিরিক্ত ঘোড়া রয়েছে। জাহাঙ্গীর টলমল করতে করতে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং নতুন কোনো আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেকে প্রস্তুত করতে চেষ্টা করে কিন্তু তারপরেই সে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। জাহাঙ্গীর, আপনি কি সুস্থ আছেন?’ সুলেইমান বেগের কণ্ঠস্বর।
‘হ্যাঁ, আমার তো তাই মনে হয়… আপনার সাথে কি পানি আছে?
সুলেইমান বেগ তাঁর দিকে পানিপূর্ণ একটা চামড়ার তৈরি মশক এগিয়ে দেয়। জাহাঙ্গীর দু’হাতে মশকটা আঁকড়ে ধরে, সেটা উপুড় করে ধরে ব্যগ্রভাবে পানি পান করে।
‘আক্রমণের সময় এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠা আপনার মোটেই উচিত হয়নি। আপনি আমাকে আর আপনার দেহরক্ষীদের পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সম্রাট নিজেকে এভাবে অরক্ষিত করতে পারেন না।’
‘এটা আমার লড়াই। আমার নিজের ছেলে আমার শাসন অমান্য করে বিদ্রোহ করেছে এবং তাকে দমন করাটা আমার দায়িত্ব, জাহাঙ্গীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, তারপরে জানতে চায়, ‘লড়াইয়ের কি খবর? অতিরিক্ত ঘোড়াটা আমাকে দাও। আরো একবার আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে আমাকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে।’
‘আমি ঘোড়াটা আপনার জন্যই এনেছি–এবং আমি আপনার তরবারিও উদ্ধার করেছি, জাহাঙ্গীরের দিকে তরবারি আর ঘোড়ার লাগাম এগিয়ে দিয়ে, সুলেইমান বেগ বলে। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত যে আপনি সুস্থ রয়েছেন?
‘হ্যাঁ, জাহাঙ্গীর যতটা অনুভব করে কণ্ঠে তাঁর চেয়ে বেশি নিশ্চয়তা ফুটিয়ে বলে। অতঃপর সে তাঁর নতুন বাহন, খয়েরী রঙের উঁচু, ছিপছিপে ঘোড়ার পর্যাণে সুলেইমান বেগের সহায়তায় চার হাত পায়ের সাহায্যে বহু কষ্টে আরোহণ করে। সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে তাঁর মাথা থেকে বিভ্রান্তির মেঘ অপসারিত হওয়ায় সে স্বস্তি বোধ করে, তারপরে সুলেমান বেগ আর নিজের কতিপয় দেহরক্ষী যারা ইতিমধ্যে তাঁর পাশে এসে অবস্থান গ্রহণ করেছে তাদের নিয়ে সে পুনরায় শৈলশিখরোপরি পথ দিয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করে যেখানে কয়েকটা তাবুর চারপাশে দারুণ লড়াই জমে উঠেছে। খসরুর অনুগত লোকেরা সেখানে দারুণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সে দেখে দু’পক্ষের যোদ্ধাদের বহনকারী ঘোড়াগুলো দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় তাদের আরোহীরা পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে। খসরুর বেশ কয়েকজন অশ্বারোহী যোদ্ধা, সম্ভবত জাহাঙ্গীর আর সুলেইমান বেগকে চিনতে পেরে তাবুর চারপাশের লড়াই থেকে সরে আসে এবং তাঁদের আক্রমণ করতে আস্কন্দিত বেগে নিচের দিকে নামতে নামতে চিৎকার করে খসরু জিন্দাবাদ’, যুবরাজ খসরু দীর্ঘজীবি হোন!
একজন সরাসরি জাহাঙ্গীরের দিকে ধেয়ে আসে। হাত আর পা আন্দোলিত করে, উন্মত্তের ন্যায় ঘোড়া হাঁকিয়ে লোকটা ধেয়ে আসতে, জাহাঙ্গীর লক্ষ্য করে সে আর কেউ না আজিজ কোকার ছোট ভাই। তরুণ যোদ্ধা আরেকটু কাছাকাছি এসে জাহাঙ্গীরকে লক্ষ্য করে সে নিজের হাতের বাঁকানো তরবারি দিয়ে তাকেই লক্ষ্য গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত হানতে সম্রাট মাথা নিচু করে আঘাতটা এড়িয়ে যান এবং তাঁর মাথার দুই ইঞ্চি উপর দিয়ে তরবারির ফলাটা বাতাসে শূন্যের ভিতর দিয়ে কক্ষপথে ঘুরে আসে। অশ্বারোহী আক্রমণকারী পাহাড়ের ঢাল দিয়ে নিচের দিকে আক্রমণের জন্য ধেয়ে আসার সময় গতিপ্রাবল্যের কারণে জাহাঙ্গীরকে অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে, জাহাঙ্গীর পর্যাণের উপর কোমর থেকে দেহের উধ্বাংশ এক মোচড়ে ঘুরিয়ে নেয় এবং লোকটাকে বাধা দিতে তরবারির তীব্র বিপ্রতীপ আঘাত করতে তাঁর ঊর্ধ্ববাহুর হাড় মাংসের গভীরে তরবারির ফলা প্রবেশ করে, হাতটাই দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আক্রমণকারী লোকটা তার বাহনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, তরুণ যোদ্ধা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে জাহাঙ্গীরের শিবিরের দিকে ধেয়ে নামতে থাকে যতক্ষণ না শিবিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উল্টানো মালবাহী শকটের পেছনে ইসমাইল আমলের মোতায়েন করা জাহাঙ্গীরের তবকিদের একজনের নিশানা ভেদী দুর্দান্ত একটা গুলি তাকে পর্যাণ থেকে ছিটকে দেয়।
জাহাঙ্গীর নিজের চারপাশে তাঁর চিরাচরিত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে যে অন্য আক্রমণকারীদের হয় তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে কিংবা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে উপরের দিকে পশ্চাদপসারণে বাধ্য করা হয়েছে। অনেকগুলো নিথর দেহ মাটিতে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ধুসর শ্মশ্রুমণ্ডিত, লাল আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘদেহী একটা লোক কাছেই পিঠের উপর ভর দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে পড়ে রয়েছে। তার উদরের ভেতর থেকে বর্শার একটা রক্তাক্ত ফলা বের হয়ে আছে। জাহাঙ্গীর লোকটাকে চিনতে পারে, তুহিন সিং, তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দেহরক্ষীদের একজন–তাঁর আম্মাজানের মাতৃভূমি আম্বার থেকে আগত এক রাজপুত যোদ্ধা।লোকটা প্রায় সিকি শতাব্দি যাবত তাকে পাহারা দিয়েছে এবং এখন যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর জন্য প্রাণ দিয়েছে। কয়েক গজ দূরেই, লাল ধুলির মাঝে ক্ষীণদর্শন একটা অবয়ব তীব্র যন্ত্রণায় মোচড় খায় এবং তাঁর দেহ আক্ষিপ্ত হয়, তাঁর পায়ের গোড়ালী মাটিতে পদাঘাত করছে এবং দৃঢ়মুষ্ঠিতে নিজের উদর আঁকড়ে রয়েছে যেখান থেকে লালচে-নীল রঙের নাড়িভূড়ি বের হয়ে আসতে চেষ্টা করছে। লোকটা অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে নিজের মাকে ডাকছে। ইমরানের শুশ্রুবিহীন বিকৃত মুখটা, আজিজ কোকার একেবারেই অল্পবয়সী ভাই, চিনতে পেরে জাহাঙ্গীর আঁতকে উঠে জোরে শ্বাস নেয়। তার বয়স কোনোমতেই তের বছরের বেশি হবে না এবং নিশ্চিতভাবেই আগামীকালের সূর্যোদয় দেখার জন্য সে বেঁচে থাকবে না।
খসরু, আজিজ কোকা আর তাদের সহযোগী ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমতার প্রতি অপরিণামদর্শী মোহের কারণে এতগুলো তাজা প্রাণের অকাল মৃত্যুতে তাঁদের প্রতি চরাচরগ্রাসী এটা ক্রোধ জাহাঙ্গীরকে আপুত করে তোলে। জাহাঙ্গীর তার খয়েরী ঘোড়াটার পাজরে গুঁতো দিয়ে ঢাল দিয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করার আগে সুলেইমান বেগ আর নিজের দেহরক্ষীদের চিৎকার করে আদেশ দেয় তাকে অনুসরণ করতে। সে অচিরেই খণ্ডযুদ্ধের নিয়ামক স্থানে পৌঁছে, তার চারপাশে ইস্পাতের ফলা মৃত্যুর সিদ্ধান্ত করছে। জাহাঙ্গীরের তরবারি আলমগীর প্রতিপক্ষের এক অশ্বারোহীর গলায় একটা মোক্ষম ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিতে সেখান থেকে ছিটকে উঠা রক্তে তাঁর মুখ ভিজে যেতে সে কয়েক মুহূর্ত চোখে কিছুই দেখতে পায় না। সে দ্রুত হাতের আস্তিনে চোখ মুছে নিয়ে, ইস্পাতের ফলার প্রতিদ্বন্দ্বীতা, চিৎকার আর আর্তনাদে মুখরিত এলোপাথাড়ি লড়াইয়ের দিকে ধেয়ে যায়।
ঘাম আর বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ তাঁর নাসারন্ধ্রে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয় আর বাতাসে আধিপত্য বিস্তারকারী লাল ধুলো তাঁর চোখে ক্রমাগত গুল ফোঁটাতে থাকলে তার কাছে শত্রু মিত্রে প্রভেদকারী সীমান্ত প্রায় বিলীন হয়ে আসে। কিন্তু সে সুলেইমান বেগ আর দেহরক্ষীদের বেষ্টনীর মাঝে অবস্থান করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আলমগীরের চূড়ান্ত একটা আঘাত যা খসরুর এক লোকের হাঁটুর উপর মোক্ষমভাবে ছোবল দিয়ে, পেশীত আর অস্থিসন্ধির গভীরে কেটে বসে যায় এবং আঘাতে প্রচণ্ডতায় আরো একবার জাহাঙ্গীরের হাত থেকে তরবারির হাতল প্রায় ছুটে যাবার দশা হয়, আর সেই সাথে জাহাঙ্গীর যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম ব্যুহ অতিক্রম করে। সে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে যে মাত্র চারশ গজ দূরে পর্বত শৃঙ্গের চূড়ায় খসরুর তাবুগুলোর অবস্থান। অবশ্য, সে যখন তাকিয়ে রয়েছে, দেখতে পায় বিশাল একদল অশ্বারোহী তাবুগুলো পরিত্যাগ করে শৈলচূড়ার অপর পাশে হারিয়ে যায়। অশ্বারোহীদের দলটা যখন চলে যাচ্ছে সে দেখে–বা তার মনে হয় সে দেখেছে–খসরু তাদের মাঝখানে অবস্থান করছে।
‘ওদের ধাওয়া কর। কাপুরুষগুলো পালিয়ে যাচ্ছে, সে নিজের খয়েরী ঘোড়ার পাঁজরে গুঁতো দিয়ে সুলেমান বেগ আর নিজের দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে। বিশাল জটা ইতিমধ্যে অবশ্য, কিছুক্ষণ আগে সংঘটিত যুদ্ধের ধকল সামলাতে নাকের পাটা প্রসারিত করে, ভীষণভাবে হাঁপাতে শুরু করেছে, এবং এই ঘোড়াটা যার স্থান নিয়েছে তাঁর আগের সেই সাদা ঘোড়ার মত স্বাস্থ্যবান আর তেজী এটা না। সে যখন পর্বত শীর্ষের চূড়ায় পৌঁছে, জাহাঙ্গীর শৈল শিখরের পাদদেশে মোতায়েন করা তাঁর যোদ্ধাদের একটা প্রতিরক্ষা ব্যুহের সাথে পলায়নকারী দলটাকে সংঘর্ষে লিপ্ত অবস্থায় দেখে। কিছুক্ষণের ভিতরেই মরিয়া দলটা প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে বের হয়ে আসে, তাদের মাত্র একজন যোদ্ধা হত হয়েছে যার আরোহীবিহীন ঘোড়াটা লাগাম মাটিতে পরা অবস্থায়, মূল দলটার পেছন পেছন দৌড়াতে থাকে, সমভূমির উপর দিয়ে খুব কাছাকাছি অবস্থানে বিন্যস্ত হয়ে উত্তরের দিকে এগিয়ে যায়।
জাহাঙ্গীর খয়েরী ঘোড়াটার পাঁজরে পুনরায় গুতো দিয়ে ধাওয়া শুরু করলেও সে মনে মনে ঠিকই বুঝতে পারে পুরো প্রয়াসটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তার কুলাঙ্গার সন্তান নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। পলায়নের যে কোনো প্রয়াস বাধাগ্রস্থ করতে সে কেন আরো বেশি সংখ্যক অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করে নি? তাকে তারপরেই পরম স্বস্তিতে ভাসিয়ে মোগলদের সবুজ নিশান–খসরুর নিজের প্রতীকচিহ্ন হিসাবে দাবি করা বেগুনী নয়–উড়িয়ে সে দেখে একদল অশ্বারোহী পশ্চিম দিক থেকে অনিবার্য মুখোমুখি সংঘর্ষের অনিবার্য পথ বরাবর আবির্ভূত হয়। আবদুল রহমানও নিশ্চয়ই আগেই দলটার গতিবিধি দেখতে পেয়েছিল এবং তাঁদের পাঠিয়েছে। তারা খুব দ্রুত পলায়নপর দলটার সাথে নিজেদের দূরত্ব হ্রাস করতে থাকে। জাহাঙ্গীর তার দেহরক্ষী আর সুলেইমান বেগকে সাথে নিয়ে নিজের ক্লান্ত ঘোড়াটাকে পর্বত শিখরের শৈল শিরার দূরবর্তী প্রান্তের ঢালের দিকে ছোটার জন্য তাড়া দেয়। কিন্তু সে শৈল শিরার পাদদেশে পৌঁছাবার পূর্বেই, খসরুর লোকেরা তাদের পশ্চাদ্ধাবনকারীদের নিকট হতে চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করে এবং তাঁদের পেছনে ধুলার একটা মেঘের সৃষ্টি করে, উত্তরপূর্ব দিকে আস্কন্দিত বেগে ছুটতে থাকে। জাহাঙ্গীর তখন খসরুর চার বা পাঁচজন পশ্চাদ্রক্ষীকে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে উদ্যত তরবারি মাথার উপরে আন্দোলিত করে আবদুর রহমানের বাহিনীর দিকে ছুটে যায় উদ্দেশ্য একটাই নিজেদের জীবনের বিনিময়ে পলায়নের জন্য তাদের সহযোদ্ধাদের কিছুটা সময় করে দেয়া।
সে কয়েক গজ দূরত্ব অতিক্রম করার পূবেই এই সাহসী লোকগুলোর একজন, হাত দুপাশে ছড়িয়ে, তাঁর কালোর ঘোড়র উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে, ধাওয়াকারীদের দলে আবদুর রহমানের বিচক্ষণতার কারণে প্রেরিত অশ্বারোহী তীরন্দাজদের কোনো একজনের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে এবং জাহাঙ্গীর কেবল বুঝতে পারে রেকাবের উপরে দাঁড়িয়ে তাঁরা তাঁদের আয়ুধ শূন্যে ছুড়ছে। খসরুর আরেক অনুগত যোদ্ধার বাহন কিছুক্ষণ পরেই আরোহীকে মাথার উপর দিয়ে ছিটকে দিয়ে, ভূপাতিত হয়। অন্য যোদ্ধারা তাঁদের আক্রমণের অভিপ্রায়ে নিজেদের ছুটে চলা অব্যাহত রাখে এবং আবদুর রহমানের অগ্রবর্তী অশ্বারোহীদের মাঝে আছড়ে পড়তে তারা নিজেদের সারির ভিতরে একটা শূন্যস্থানের সৃষ্টি করে তাদের মোকাবেলা করতে এবং ঘিরে ফেলে, তাঁদের অগ্রসর হবার গতি এর ফলে শ্লথ হয় কি হয় না। জাহাঙ্গীরের লোকেরা এক মিনিটেরও কম সময়ের ভিতরে ঘোড়ার গলার কাছে মাথা নিচু করে রেখে আবারও বল্পিত বেগে ছুটতে শুরু করে বিদ্রোহীদের বেশ কয়েকজনের মৃতদেহ আর ঘোড়া এলোমেলোভাবে তাঁদের পেছনে পড়ে থাকে। খুসরুর অনুগত যোদ্ধারা তাদের শত্রুদের কমপক্ষে দু’জনকে নিজেদের সাথে মৃত্যুর ছায়ায় টেনে নিয়েছে, কিন্তু তাঁদের সাহসিকতা খসরুকে বাঁচাতে পারবে না। আবদুর রহমানের বাহিনী পালাতে থাকা দলটার এখন প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে এবং আরো দু’জন পশ্চাদ্ক্ষীর, একজনের ঘোড়ার সাথে সংযুক্ত দণ্ডে খসরুর বেগুনী নিশান উড়ছে, ভবলীলার সমাপ্তি ঘটে, সম্ভবত অশ্বারোহী তীরন্দাজদের নৈপূণ্যের শিকার। নিশান-বাহকের পা তার ঘোড়ার রেকাবে আটকে যায় এবং সে লাল ধুলার উপর দিয়ে প্রায় একশ গজ হেঁচড়ে যাবার সময় বেগুনী নিশানটা তার পেছনে উড়তে থাকে। রেকাবের চামড়ার বাঁধন এরপরে ছিঁড়ে যেতে হতভাগ্য লোকটা আর তার বহন করা নিশানা দোমড়ানো মোচড়ানো অবস্থায় নিথর হয়ে পড়ে থাকে।
জাহাঙ্গীর তার খয়েরী রঙের ঘোড়াটাকে যখন তাড়া দেয়, যা পশ্চাদ্ধাবনের প্রয়াসের কারণে আরো জোরে জোরে শ্বাস নেয়, সরু পাজর হাপরের মত উঠানামা করে, সে দেখে খসরুর লোকেরা আবারও একপাশে সরে যায় কিন্তু তারপরেই করকটে বৃক্ষাদির একটা ঝাড়ের কাছে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। সে প্রথমে ভাবে প্রতিপক্ষ বোধহয় সেখানে অবস্থান নিয়ে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু তারপরে তাঁদের চারপাশে বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের ন্যায় আন্দোলিত হতে থাকা ধুলোর মাঝে সে মাটিতে পরে থাকা পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্রের ঝিলিক দেখতে পায়। আজিজ কোকার নিষ্পাপ কিশোর ভাই আর আবদুর রহমানের অগ্রবর্তী বাহিনীকে যারা আক্রমণ করেছিল সেইসব সাহসী লোকদেরমত, আরো অনেককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে তারা এখন নিজেদের মূল্যহীন জীবন বাঁচাতে আত্মসমর্পণ করতে চাইছে। জাহাঙ্গীর চোখে মুখে একটা ভয়াবহ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে নিজের খয়েরী ঘোড়াটা থেকে এর প্রাণশক্তির শেষ নির্যাসটুকু নিংড়ে নিতে পায়ের গোড়ালী দিয়ে নির্মমভাবে পরিশ্রান্ত জন্তুটার পাঁজরে গুতো দিয়ে ভাবে অপদার্থগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে সত্যিকারের পুরুষের মত মৃত্যুবরণ না করার সিদ্ধান্তের জন্য ভীষণ আফসোস করবে।
*
‘আমার সামনে তাঁদের হাজির করো।’
জাহাঙ্গীরের দেহে লড়াইয়ের স্বেদবারি তখনও উষ্ণতা হারায়নি এবং হৃৎপিণ্ড ক্রোধে উদ্বেল, সে বৃক্ষাদির ঝাড়ের নিচের ছায়া থেকে দেখে যে তাঁর সৈন্যরা খসরু, তাঁর প্রধান সেনাপতি, আজিজ কোকা এবং তাঁর অশ্বপালের আধিকারিক, হাসান জামালকে টেনে হেঁচড়ে সামনের দিকে নিয়ে আসে এবং তাঁর সামনে ধাক্কা দিয়ে তাঁদের হাঁটু মুড়ে বসিয়ে দেয়। সম্রাটের দিকে বাকি দু’জন যদিও চোখ তুলে তাকাবার সাহস দেখায় না, খসরু তার আব্বাজানের দিকে সানুনয়ে তাকিয়ে থাকে। তাদের পেছনে, খসরুর ত্রিশজনের মত লোক যারা তাঁর সাথে আত্মসমর্পণ করেছিল, তাঁদের পরনের কাপড় থেকে ছিঁড়ে নেয়া টুকরো কিংবা পর্যাণে ব্যবহৃত কম্বলের ফালি দিয়ে ইতিমধ্যে তাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা হয়েছে। জাহাঙ্গীরের সৈন্যরা নির্মমভাবে ধাক্কা দিয়ে তাঁদের মাটিতে বসিয়ে দেয়। জাহাঙ্গীর বন্দিদের ভেতর সহসা দীর্ঘকায়, পেশল দেহের অধিকারী একজন লোককে চিনতে পারে, লোকটার দাড়ি মেহেদী দিয়ে লাল রঙ করা। তার মনে পড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে লোকটাকে নিমেষের জন্য দেখেছিল, মুখে নির্মম হাসি ফুটিয়ে, নিজের ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়া অল্প বয়সী এক তরুণ যোদ্ধার উদর বর্শা দিয়ে এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়ার আগে, যে তাঁর সামনে আতঙ্কিত আর অসহায় অবস্থায় পড়ে ছিল, হাতের বর্শা দিয়ে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে খোঁচা দিচ্ছে।
চরাচরগ্রাসী এমন একটা ক্রোধ জাহাঙ্গীরকে আপুত করে যে সে কিছুক্ষণের জন্য ঠিকমত কিছুই চিন্তা করতে পারে না। সে যখন নিজের উপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় তখন তার মাথা জুড়ে কেবল একটাই বিষয় কীভাবে এমন নিশ্চেতন বিদ্রোহীকে যথাযুক্ত নির্মমতার সাথে শাস্তি দেবে। তারপরে সে যথাযথ শাস্তি খুঁজে পায়। মোগলরা পুরুষানুক্রমে জঘন্যতম অপরাধীদের শিশু হত্যাকারী, ধর্ষণের মত অন্যান্য অপরাধকারী–শূলে দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। প্রথম মোগল সম্রাট, বাবর, তাঁর প্রপিতামহ, বিদ্রোহী আর দস্যুদেরও এই শাস্তি দিতেন–এই লোকগুলোরও ঠিক একই রকম শাস্তি প্রাপ্য। আত্মসমর্পণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের বিদ্রোহ চালিয়ে গিয়েছে, তাঁদের বর্শার ফলায় সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ সেইসব অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের বিদ্ধ করেছে। তাদের এবার বুঝতে দেয়া হোক শূলবিদ্ধ হবার অনুভূতি। একই আতঙ্ক আর যন্ত্রণা তাঁরাও সহ্য করুক। একমাত্র এভাবেই ন্যায়বিচার সম্ভব। সে বিষয়টা নিয়ে আর চিন্তাভাবনা না করে ক্রোধে কর্কশ হয়ে থাকা কণ্ঠে তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে, এই গাছগুলো থেকে তোমাদের রণকুঠার আর তরবারি ব্যবহার করে শক্ত কাষ্ঠ দণ্ড প্রস্তুত কর। দণ্ডগুলো মাটিতে ভালোমত পুঁতে দাও। তোমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব সেগুলোকে সূচালো করো কিংবা দণ্ডগুলোর অগ্রভাগে বর্শার ফলা সংযুক্ত করে নরকের কীট এই বিদ্রোহীদের সেইসব দণ্ডে বিদ্ধ কর। কাজটা করতে হবে এবং এখনই সেটা করতে হবে। আমার পুত্র আর তাদের, তার দুই প্রধান সহযোগীকে কেবল রেখে যাও। নিজেদের নিয়তি সম্পর্কে তারা অবহিত হবার পূর্বে নিজেদের লোকদের যন্ত্রণা তাদের দেখতে দেয়া হোক। তারা অন্যদের কেমন দুর্ভোগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে সে বিষয়ে তারা সামান্য হলেও অনুধাবন করবে ভবিষ্যতের গর্ভে তাঁদের জন্য কি অপেক্ষা করছে তার পূর্বাভাষ।’
তার সৈন্যরা আদেশ পালনে দ্রুত ব্যস্ত হয়ে উঠে, রণকুঠার দিয়ে কেউ গাছ কাটতে আরম্ভ করে, অন্যরা তাৎক্ষণিকভাবে হাতের কাছে যা কিছু খুঁজে পায় এমনকি কেউ শিয়োস্ত্রাণ দিয়েই শূলের জন্য গর্ত তৈরি করতে মাটি খুড়তে আরম্ভ করলে বাকিরা তখন বন্দিদের শক্ত করে ধরে মাঠের উপর দিয়ে তাঁদের সবলে টেনে নিয়ে যায়, জাহাঙ্গীর তার বাহুর উপরে সুলেইমান বেগের হাত অনুভব করে। জাহাঙ্গীরের দুধ-ভাই কোনো কিছু বলার আগেই সে বলে, না, সুলেইমান বেগ, এটা কার্যকর করতেই হবে। তারা নিজেরাই শাস্তিটা বয়ে এনেছে। তাঁরা কোসো ধরনেরই করুণা প্রদর্শন করে নি। আমিও করবো না। আমি অবশ্যই একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবো।’
জাহাঙ্গীর তাকিয়ে দেখে খসরু, তখনও হাঁটু ভেঙে বসে রয়েছে, কাপুরুষোচিত আতঙ্কের একটা অভিব্যক্তি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। নিজের সন্তানের বিশ্বাসঘাতকতা, এত বিপুল সংখ্যক সৎ লোকের অনর্থক আত্মত্যাগের কথা চিন্তা করে, সে বহু কষ্টে খালি হাতে তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে নিজেকে সংযত রাখে। পাঁচ মিনিটের মত কেবল প্রায় অতিক্রান্ত হয়েছে তারপরেই জাহাঙ্গীরের চারজন তোক উন্মত্তের মত ধ্বস্তাধ্বস্তি আর লাথি ছুঁড়তে থাকা বন্দিদের প্রথমজনকে–গাট্টাগোট্টা, রোমশ দেহের এক লোক যার পরনের কাপড়ের অধিকাংশই তাঁরা ছিঁড়ে ফেলেছে–শূন্যে অনেক উঁচুতে তুলে ধরে। তারা তারপরে তাদের পুরো শক্তি প্রয়োগ করে বর্শা আর কাঠের দণ্ডের সাহায্যে তড়িঘড়ি করে নির্মিত শূলগুলোর একটার উপরে তার দেহটা নিয়ে আসে। লোকটার মলদ্বারের কাছের নরম মাংসে যখন শক্ত তীক্ষ্ণ অংশটা প্রবিষ্ট হয়, তাঁর চিৎকারে–মানুষের চেয়ে পশুর সাথেই বেশি মিল–চারপাশের বাতাস বিদীর্ণ হয়। জাহাঙ্গীরের লোকেরা যখন হতভাগ্য বন্দির পা ধরে নিচের দিকে টানতে শুরু করে, সবেগে নির্গত রক্তে নিচের মাটি লাল করে, দণ্ডটা লোকটার কণ্ঠার হাড়ের কাছ দিয়ে দেহের বাইরে বের হয়ে আসে। তারপরে আরো বেশি সংখ্যক বিদ্রোহীদের যখন শূলবিদ্ধ করা হলে নাড়িভূঁড়ির বিদারণের এবং আতঙ্কিত মানুষজনের বিষ্ঠার, যারা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেদের নাড়িভূঁড়ির উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, দুর্গন্ধ বাড়তে আরম্ভ করে। কিন্তু জাহাঙ্গীর, সে তখনও আপন ক্রোধে অধীর হয়ে রয়েছে এবং নিষ্ঠুর ন্যায়পরায়ণতা বিষয়ে একচিত্ত, এসব কিছুই লক্ষ্য করে না।
খসরুর এবার বিভীষিকা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার পালা যার জন্য তাঁর মাত্রাছাড়া উচ্চাকাঙ্খ দায়ী। জাহাঙ্গীর সামনের দিকে হেঁটে আসে এবং নিজের হাঁটু গেড়ে বসে থাকা সন্তানকে কাঁধ ধরে টেনে তুলে নিজের পায়ের উপরে তাকে জোর করে দাঁড় করিয়ে দেয়। দেখো, তোমার কারণে সবার কি দুর্গতি। কেবল তোমার কারণেই এই লোকগুলো কষ্ট পাচ্ছে। দণ্ডগুলোর মাঝ দিয়ে হেঁটে যাও… হাঁটতে শুরু কর,’ খসরুর মুখের একেবারে সামনে নিজের মুখ নিয়ে এসে, সে চিৎকার করে। তারপরে, নিজের সন্তানকে ছেড়ে দিয়ে, শূলের অভিমুখে সে তাকে একটা ধাক্কা দেয়। কিন্তু খসরু, তাঁর বাহুদ্বয় শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখে এবং দুচোখ প্রাণপনে বন্ধ করে রাখা, ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। জাহাঙ্গীর সাথে সাথে নিজের দেহরক্ষীদের কয়েকজনকে চিৎকার করে ডাকে। সবগুলো শূলের পাশ দিয়ে তাকে হেঁটে যেতে এবং পুনরায় ফিরে আসতে বাধ্য কর। সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে কাজটা করবে। সবগুলো মৃতদেহের দিকে তাঁর তাকাবার বিষয়ে নিশ্চিত হবে…’
দু’জন প্রহরী সাথে সাথে দু’পাশ থেকে খসরুর হাত শক্ত করে ধরে এবং শূলের দিকে তাকে নিয়ে যায়। খসরুর মাথা প্রতি পদক্ষেপের সাথে নিচের দিকে ঝুঁকে আসে কিন্তু প্রতিবারই কয়েক পা হাঁটার পরে তাঁর প্রহরীরা শূলের উপর যন্ত্রণায় মোচড়াতে আর পা ছুঁড়তে থাকা এবং এটা করার কারণে নিজেকে আরো বেশি করে শূলবিদ্ধ করতে থাকা, তাঁর মৃত্যু পথযাত্রী সমর্থকদের কোনো একজনের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে যায়, এবং সৈন্যদের একজন খসরুর মাথা চুল ধরে পেছনের দিকে টেনে এনে, তাকে দেখতে বাধ্য করে। কিন্তু স্পষ্টতই বোঝা যায় খসরুর যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। জাহাঙ্গীর তাঁর সন্তানকে প্রহরীদের বাহুর মাঝে ঝুলে পড়তে এবং তারপরে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে। সে অনুমান করে খসরু জ্ঞান হারিয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে। আমার ছেলেকে এখানে ফিরিয়ে নিয়ে এসো, সেই সঙ্গে আজিজ কোকা আর হাসান জামালকে।
জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণ পরে, তাঁর সামনে পুনরায় নতজানু হয়ে থাকা তিনজনকে খুটিয়ে দেখে। খসরুকে চাঙ্গা করতে প্রহরীদের একজন পানির মশকে রক্ষিত উপাদান তার উপরে নিক্ষেপ করায় তার লম্বা কালো চুল ভেজা। সে মড়ার মতো ধুসর আর থরথর করে কাঁপছে এবং দেখে মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে বমি করবে। চারপাশের শূল থেকে ভেসে আসা যন্ত্রণার তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, যেখানে অবশিষ্ট বিদ্রোহীদের তখনও শূলবিদ্ধ করা অব্যাহত রয়েছে, ছাপিয়ে তাঁর কথা সবার কাছে পৌঁছে দিতে জাহাঙ্গীর নিজের কণ্ঠস্বর একটু উঁচু করে বলে, তোমরা সবাই একজন প্রজা তাঁর জমিদারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধের দোষে দোষী–সশস্ত্র বিদ্রোহ। তুমি
‘আমি কেবল একজন প্রজা না… আমি আপনার পুত্র…’ খসরু মিনতি জানায়, তাঁর একদা সুদর্শন তারুণ্যদীপ্ত মুখাবয়বে বিভীষিকার একটা অবিমিশ্র মুখোশ।
‘খামোশ! সন্তানের অধিকার দাবি করার পূর্বে নিজেকে প্রশ্ন করো তুমি কি সন্তানের যোগ্য আচরণ করেছে। তুমি কোনোভাবেই নরকের ঐ কীটগুলোর চেয়ে সহনশীল আচরণের উপযুক্ত নও যাদের নিদারুণ যন্ত্রণার জন্য আমি নই, বা তোমার পাশে যে দু’জন দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা দায়ী, কেবল তুমি দায়ী। আজিজ কোকা, হাসান জামাল, আপনারা একসময়ে আমার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন কিন্তু আপনাদের সেই অঙ্গীকার আপনারা ভঙ্গ করেছেন। তার দিকে অসহায়ভাবে তারা তাকিয়ে থাকে, সে কথা বলা বজায় রাখলে তাদের চোখে ভয় খেলা করতে থাকে, কোনো ধরনের করুণার প্রত্যাশা করবেন না, কারণ আমার কাছে প্রদর্শনের মত কোনো অজুহাত নেই। বিশ্বাসঘাতক আর অনবধান উচ্চাকাঙ্খী মানুষের পাশাপাশি পশুর অন্ধ মূঢ়তা আপনাদের ভিতরে কাজ করেছে। আপনাদের কুৎসিত পশু প্রবৃত্তি প্রতীকায়িত করতে আপনাদের লাহোর নিয়ে গিয়ে সেখানে বাজারে আপনাদের উলঙ্গ করা হবে এবং একটা ষাড় বা গাধার সদ্য ছাড়ানো চামড়ার ভিতরে ঢুকিয়ে সেলাই করা হবে। তারপরে গাধার পিঠে উল্টো করে বসিয়ে দিনের খরতাপে তোমাদের শহরের প্রধান সড়ক দিয়ে প্রদক্ষিণ করানো হবে আমার অনুগত প্রজারা যেন তোমাদের অপমানের সাক্ষী হতে পারে এবং অনুধাবন করতে পারে আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তোমাদের অভিপ্রায় কতটা হাস্যকর ছিল।
জাহাঙ্গীর দু’জনকে আঁতকে উঠতে শুনে। তাদের শাস্তি দেয়ার ধারণাটা সে কথা শুরু করার ঠিক আগ মুহূর্তে আকস্মিক প্রেরণার একটা ঝলকের মত তার কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সে জানে তার দাদাজান হুমায়ুন অপরাধের উপযুক্ত শাস্তিবিধান করতে অভিনব এবং কখনও উদ্ভট উপায় খুঁজে বের করতে পারার জন্য নিজেকে নিয়ে গর্ব বোধ করতেন। সেও এখন সেটা পারে। সে অবশ্য অপকর্মের সহযোগীদের নিয়ে আর কোনো সময় নষ্ট করতে আগ্রহী নয় আর তাই ঘুরে খুসরুর দিকে তাকায় যে দু’হাত অনুনয়ের ভঙ্গিতে জোড়া করে, বিপদে মিহমান লোকের মত ফুঁপিয়ে কাঁদছে এবং বিড়বিড় করে কিছু বলছে জাহাঙ্গীর ঠিক বুঝতে পারে না কিন্তু যা শুনে দুর্বোধ্য মনে হয়। সে নিজেকে সংযত করে উঠে দাঁড়িয়ে, তার সন্তানকে তাঁর অনিবার্য বিপর্যয়ের মাঝে প্রেরণ করবে যে শব্দগুলো সেগুলো উচ্চারণ করতে নিজেকে প্রস্তুত করে।
‘খসরু, তুমি বৈরী বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে একটা বাহিনী গঠন করেছিলে যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য আমাকে–তোমার আব্বাজান এবং ন্যায়সঙ্গত মোগল সম্রাট ক্ষমতাচ্যুত করা এবং তোমার জন্য আমার সিংহাসন জবরদখল করা। রক্তপাত ঘটাবার জন্য তুমিই দায়ী এবং ন্যায়পরায়ণতার স্বার্থে তোমাকে রক্তেই এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে। তার কণ্ঠস্বরের রুক্ষতার অকৃত্রিমতা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই এবং তাঁর উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ তাঁর সংকল্প ব্যক্ত করে। খসরু নিজেও সেটা ভালো করেই জানে এবং ভয়ে সে নিজের মূত্রথলির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। জাহাঙ্গীর তাকিয়ে দেখে খসরুর পরনের সুতির পাজামায় একটা গাঢ় দাগ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে এবং টপটপ করে পড়তে থাকা প্রস্রাব মাটিতে জমে হলুদ একটা ডোবার সৃষ্টি করে।
খসরু যে মানসিক অবস্থায় নিজেকে নিয়ে এসেছে সেজন্য করুণার একটা স্রোতধারা তাকে জারিত করে। যদিও কিছুক্ষণ আগেও খসরুর শিরোচ্ছেদের আদেশ দেয়ার পুরো অভিপ্রায় তার মাঝে বিরাজ করছিল, সহসাই সে আর তার মৃত্যু কামনা করে না। ইতিমধ্যে যথেষ্ট রক্তপাত আর দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে… কিন্তু আমি তোমার জান বখশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সে নিজেকে বলতে শুনে। তুমি আমার সন্তান এবং আমি তোমাকে হত্যা করবো না। তোমাকে এর পরিবর্তে কারাগারে বন্দি করে রাখা হবে যেখানে অনাগত মাস বছরের গণনায় তুমি সীমালঙ্নের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনার প্রচুর সময় পাবে যা তোমাকে তোমার স্বাধীনতা আর সম্মান খোয়াতে বাধ্য করেছে।’
খসরু, আজিজ কোকা আর হাসান জামালকে সরিয়ে নিয়ে যাবার পরে জাহাঙ্গীর তার দুধ-ভাইয়ের দিকে ঘুরে তাকায়, যে তখনও পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুলেইমান বেগ, শূলবিদ্ধ বন্দিদের যারা এখনও বেঁচে রয়েছে, আমার সৈন্যদের আদেশ দাও তাঁদের কণ্ঠনালী কেটে দিতে। তাঁরা যথেষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করেছে। তাদের মৃতদেহগুলোকে একটা সাধারণ কবরে দাফন করে, শূলগুলো তুলে ফেলে তার উপরে তাজা মাটি ছড়িয়ে দাও। যুদ্ধে যারা আহত হয়েছে–শত্রু কিংবা মিত্র নির্বিশেষে আমাদের হেকিমদের তাঁদের চিকিৎসা করতে বলো। আজ কি পরিমাণ রক্তপাত হয়েছে তাঁর কথা আমি ভুলে যেতে চাই।’
*
এক সপ্তাহ পরে, বারগাত দূর্গে অবস্থানের সময় যে স্থানটা, সে তার বাহিনীকে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে পুনর্গঠিত হবার সময় দিতে, অস্থায়ী সদরদপ্তর করেছে, জাহাঙ্গীর লাহোরের শাসনকর্তার কাছ থেকে সদ্য প্রাপ্ত দীর্ঘ চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে পাঠ করে যেখানে আজিজ কোকা আর হাসান জামালের ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটার বিবরণ রয়েছে। জাহাঙ্গীর চিঠিটা পড়ার সময়ে, পুরো দৃশ্যপটটা মানসচক্ষে দেখতে পায়–নিজেদের আভিজাত্য ভুলে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা দু’জন লোক, যাদের কাছ থেকে তাদের সমস্ত মর্যাদা কেড়ে নেয়া হয়েছে, সদ্য ছাল ছাড়ান তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত রক্তাক্ত পশুচামড়ার ভিতরে তাঁদের ঢুকিয়ে সেলাই করে দেয়া হয়েছে। প্রদেশের শাসককর্তা জানিয়েছেন, পশুর মাথাটা তখনও চামড়ার সাথে যুক্ত ছিল এবং তাঁদের শহরের ভিতর দিয়ে প্রদক্ষিণ করাবার সময় উপস্থিত লোকজন যখন বিদ্রূপ করে আর পঁচা তরকারি আর পাথর তাঁদের দিকে ছুঁড়ে মারে তখন চামড়ার ভিতরে বন্দিদের প্রতিটা ব্যর্থ বেপরোয়া প্রয়াসের সাথে সাথে পশুর মাথাগুলো উদ্ভট ভঙ্গিতে আঁকি খায়। আজিজ কোকা, গাধার চামড়া দিয়ে তাকে মুড়ে দেয়া হয়েছিল, প্রচণ্ড গরমে চামড়াটা শুকিয়ে সংকুচিত হলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। মোষের চামড়ার ভিতর থেকে হাসান জামালকে টেনে বের করার সময় তিনি বেঁচে থাকলেও প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। তিনি এখন লাহোরের ভূগর্ভস্থ কারাপ্রকোষ্ঠে রয়েছেন। শাসনকর্তা, তার চিঠির একেবারে শেষে, জানতে চেয়েছে জাহাঙ্গীর কি হাসান জামিলকে প্রাণদণ্ড দিতে আগ্রহী।
জাহাঙ্গীর মন্থর পায়ে জানালার দিকে হেঁটে যায় এবং বালুকাময়, নিরানন্দ দৃশ্যপটের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার এখন পুরো ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় আছে, নিজের আরোপিত শাস্তির নৃশংসতায় সে খানিকটা লজ্জিত বোধ করে যদিও তাঁরা এই শাস্তির উপযুক্ত এবং অন্যান্য বিদ্রোহীদের বিদ্রোহ প্রয়াস থেকে বিরত রাখবে। সে যখন ক্রোধে উন্মত্ত তখন ক্ষণিকের উত্তেজনায় কাজটা হয়েছে। তার আবেগ এখন অনেক প্রশমিত তার কেবলই মনে হতে থাকে সে যদি ভিন্নভাবে ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করতে পারতো। একজন দুর্বল শাসকই কেবল করুণা প্রদর্শনের ব্যাপারে ভীত হতে পারেন… সে হাসান জামালের মৃত্যু কামনা করেছিল। লোকটা যে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে সেটা কেবল অলৌকিক কোনো কারণে সম্ভব হয়েছে কিন্তু এটা তাকে ক্ষমাশীলতা প্রদর্শনের একটা সুযোগ দিয়েছে যা খসরুর বিদ্রোহের কারণে তাঁর অমাত্যদের ভেতরে সৃষ্ট বিরোধ প্রশমিত করার কাজ শুরু করবে। সে তখনই একজন খুশনবিশকে ডেকে পাঠায় এবং লাহোরের শাসনকর্তার কাছে নিজের জবাব শব্দ করে পাঠ করতে থাকে। হাসান জামালকে যথেষ্ঠ শাস্তি দেয়া হয়েছে। তাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে।’
জাহাঙ্গীর আবার কক্ষে একা হওয়া মাত্র সে গভীরভাবে চিন্তা করে, নিজের সন্তানকে সে কঠোর শিক্ষা দিয়েছে, কিন্তু খসরু কি বিষয়টা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে? সে গোঁয়ার, স্বেচ্ছাচারী, আত্মদর্পী এবং সবচেয়ে বড় কথা উচ্চাভিলাষী। তার নিজেরই খুব ভালো করে জানা আছে যে উচ্চাকাঙ্খ সহজে গোপন করা যায় না। তার আব্বাজান আকবর তাকে হয়ত তাঁর আরাধ্য সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করবেন এই ভয়ের কারণে নিজের জীবনের প্রায় বিশটা বছর কি সে যন্ত্রণায় দগ্ধ হয় নি? সে নিজে কি বিদ্রোহ করে নি? সে ঠিক যেমনটা করেছিল, খসরুকে জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে যে সে কি তাকে, তার জ্যেষ্ঠ সন্তানকে, বিদ্রোহী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করবে। এবং এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রচুর সময় পাওয়া যাবে। আল্লাহতা’লা সহায় থাকলে, সে এখনও আরও বহু বছর বেঁচে থাকবে।
কিন্তু তাঁর অন্য সন্তানদের কি মনোভাব? তাঁর আব্বাজানের সাথে তার বিরোধ দীর্ঘ সময়ের জন্য তাঁদের কাছ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আকবরের দরবারে তার প্রত্যাবর্তনের পরে একজন পিতা আর তার সন্তানদের ভিতরে সম্পর্ক যতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া উচিত সেভাবে সম্পর্ক পুনর্গঠন করাটা তাঁর কাছে বেশ কঠিন বলে মনে হয়। বহু বছর পূর্বে মরমী সুফি সাধক শেখ সেলিম চিশৃতির, যিনি তাঁর নিজের জন্ম সম্পর্কে পূর্বেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, জাহাঙ্গীরকে বলা কথাগুলো তাঁর মানসপটে ঝলসে যেতে সে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনিশ্চিত এক যুবরাজ হিসাবে সে বৃদ্ধ লোকটার কাছে পরামর্শের জন্য গিয়েছিল। তোমার চারপাশে যারা রয়েছে তাদের লক্ষ্য করো। তুমি কারো উপরে নির্ভর করার ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকবে এবং বিশ্বাসের উপর কোনোকিছু ছেড়ে দিবে না, রক্তের বন্ধনে তুমি যাদের সাথে সম্পর্কিত এমনকি তাঁদের কাছ থেকেও… এমনকি তোমার যারা সন্তান হবে,’ বিজ্ঞ সুফি সাধক বলেছিলেন। ‘উচ্চাকাঙ্খর সবসময়ে দুটো দিক রয়েছে। এটা মানুষকে মহত্বের দিকে ধাবিত করে কিন্তু তাদের আত্মাকে বিষাক্তও করতে পারে…’ তার এই সতর্কবাণীর প্রতি মনোযোগ দেয়া উচিত। সর্বোপরি, সুফি সাধক যা কিছু সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সে সবের অধিকাংশই ইতিমধ্যে ঘটেছে। সে বাস্তবিকই সম্রাট হয়েছে এবং তাঁর সন্তানদের একজনকে উচ্চাকাঙ্খ আদতেই কলুষিত করেছে।
খসরুর প্রতি তাঁর ক্রোধের তীব্রতা সম্ভবত এ কারণেই এত বেশি তীব্র। তাঁর মনে আছে কীভাবে খসরুর সাথে যুদ্ধের মাত্র দু’দিন আগে, তাঁর সৈন্যরা একটা ছোট মাটির দেয়াল ঘেরা গ্রাম দখল করেছিল। সেই গ্রামের পলিত কেশ সর্দার জাহাঙ্গীরের সামনে প্রণত হবার পরে, তার পরনের খয়েরী রঙের অধধায়া আলখাল্লার একটা পকেট থেকে তিনটা তামার পয়সা বের করে দাবি করে সেগুলো তাকে খসরুর গুপ্তদুতের একটা বাহিনী দিয়েছে। সে নিজের আনুগত্যের স্মারক হিসাবে দৃশ্যত কম্পিত আঙুলে জিনিষগুলো ধরে জাহাঙ্গীরের হাতে তুলে দেয়। জাহাঙ্গীর মুদ্রাগুলো খুটিয়ে দেখতে খেয়াল করে যে আপাত ব্যস্ততায় তৈরি করা প্রতিটি মুদ্রায় খসরুর প্রতিকৃতি খোদাই করা রয়েছে এবং খসরুকে হিন্দুস্তানের সম্রাট ঘোষণা করে প্রতিকৃতির চারপাশে বৃত্তাকারে বাণী মুদ্রিত রয়েছে। জাহাঙ্গীর ক্রোধে এতটাই উন্মত্ত হয়ে উঠে যে মুদ্রাগুলো কাছে রাখা ধৃষ্টতা দেখাবার কারণে সর্দারকে চাবুক মারার আদেশ দেয়, কামারশালায় তখনই মুদ্রাগুলোর আকৃতিনাশ করতে আদেশ দেয় এবং একটা ফরমান জারি করতে বলে যে ভবিষ্যতে কারো কাছে এমন মুদ্রা পাওয়া গেলে সেগুলো রাখার দায়ে শাস্তি হিসাবে তার ডান হাতের আঙুলগুলো কেটে নেয়া হবে। সুলেইমান বেগ সদারকে ক্ষমা করার জন্য জাহাঙ্গীরকে রাজি করাবার আগেই সর্দারের হাড্ডিসার দেহ কোমর পর্যন্ত নগ্ন করে গ্রামের চৌহদ্দির ভিতরে অবস্থিত একমাত্র গাছের সাথে বাধা হয় আর জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে শক্তিধর দেহরক্ষী হাতে সাত বেণীর চাবুক নিয়ে বাতাসে শিস তুলে কশাঘাতের মহড়া দিতে থাকে। সে খুবই ভাগ্যবান সুলেইমান বেগকে সে তার যৌবনের সময় থেকে পাশে পেয়েছে–একজন বিশ্বস্ত বন্ধু যে তার মেজাজ মর্জি সহজপ্রবৃত্তিতে আঁচ করতে পারে এবং এখন বিজ্ঞ পরামর্শদাতা হিসাবে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখছেন।
কিন্তু পারভেজ আর খুররম–খসরুর চেয়ে খুব বেশি ছোট না খোল আর চৌদ্দ বছর বয়স–তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তাঁদের সৎ-ভাইয়ের প্রচেষ্টা এবং সেজন্য তাঁর প্রদত্ত শাস্তি সম্বন্ধে তারা কি চিন্তা করছে? পারভেজের জননী মোগলদের এক প্রাচীন গোত্রের মেয়ে হলেও খসরুর মত, খুররমের জননী রাজপুত রাজকন্যা এবং খুররম বড় হয়েছে আকবরের কাছে যিনি প্রকাশ্যে তাকে বিশেষ প্রশ্রয় দিতেন। দুই যুবরাজ বিশেষ করে খুররম, মনে করতেই পারে সিংহাসনে তাঁদের দাবি খসরুর মতই জোরালো। অন্ত ত তার সবচেয়ে ছোট ছেলে শাহরিয়ারের উচ্চাকাঙ্খ সম্বন্ধে তাঁর এখনই উদ্বিগ্ন হবার প্রয়োজন নেই এটাই যা স্বস্তির বিষয়, সে এখনও শাহী হারেমে তার জননী, জাহাঙ্গীরের উপপত্নির সাথে বাস করছে।
তাকে যত শীঘ্রি সম্ভব আগ্রায় নিজের অল্পবয়সী সন্তানদের কাছে ফিরে যেতে হবে। খসরু আর তাঁর অনুসারীদের প্রতি আপোষহীন আচরণের দ্বারা সে প্রতিপাদন করেছে যে সম্রাট হিসাবে সে কোনো ধরনের মতদ্বৈধ সহ্য করবে না। কিন্তু সেইসাথে সে এখনও যে একজন স্নেহময় পিতা সে অবশ্যই তাঁদের সেটাও দেখাবে আর খসরুর বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই কেবল সে এমন নির্মম আচরণ করতে বাধ্য হয়েছিল…