১.০৬ নিহন্তার খড়গ

১.৬ নিহন্তার খড়গ

মালকিন, উঠুন।’ কেউ একজন যেন তাঁর কাঁধ ধরে প্রবল ভাবে ঝাঁকাতে থাকে এবং মেহেরুন্নিসার মনে হয় সে কি স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু ঘুম ঘুম চোখ খুলে সে নাদিয়াকে তাঁর উপর ঝুঁকে থাকতে দেখে।

‘কি হয়েছে? কেন তুমি আমার ঘুম ভাঙালে?’ পরিচারিকাটা তাঁর শয্যার পাশে রাখা মার্বেলের তেপায়ার উপরে একটা জ্বলন্ত তেলের প্রদীপ রেখেছে এবং কক্ষের আওয়াজির ভিতর দিয়ে প্রবাহিত উষ্ণ বাতাসে এটা কম্পমান একটা কমলা রঙের আভার জন্ম দিয়েছে।

আপনার কাছে একটা চিঠি এসেছে। হেরেমের প্রবেশ দ্বারে যে বার্তাবাহক এটা পৌঁছে দিয়েছে সে বলেছে এটা যেন অবিলম্বে আপনাকে দেয়া হয়। মেহেরুন্নিসা খেয়াল করে পরিচারিকা কথাগুলো বলার সময় কৌতূহলের কারণে প্রায় থরথর করে কাঁপছে। সে বিছানায় উঠে বসে, তাঁর হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন সহসাই বেড়ে গিয়েছে এবং নাদিয়ার হাত থেকে তার জন্য ধরে রাখা সীলমোহর করা কাগজটা নেয়। রাতের অন্ধকারে যে সংবাদ আসে সেটা কেবল দুঃসংবাদই হতে পারে। সে যখন চিঠিটার ভাঁজ খুলছে তখন তাঁর আঙুল মৃদু কাঁপে এবং সে তার ভাইঝির ঝরঝরে হস্তাক্ষর দেখা মাত্র চিনতে পারে। চিঠিটা খুব ব্যস্ততার মাঝে লেখা হয়েছে। পুরো চিঠিটা বেমানান কালির দাগ আর বেশ কয়েকটা শব্দ কেটে দেয়া হয়েছে।

ফুপিজান, ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটেছে। আমার আব্বাজান সামরিক প্রয়োজনে দিল্লি গিয়েছেন এবং আমার আর আমার দাদিজানের পক্ষে আর কারো মুখাপেক্ষী হওয়া সম্ভব নয়। আজ রাতের বেলা আমি যখন দূর্গে আমার পিতামহের আবাসস্থলে অবস্থান করছিলাম তখন প্রহরীরা আমার দাদাজানকে গ্রেফতার করতে এসেছিল। তারা দাবি করে গোয়ালিওরে নিজের কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে সম্রাটকে হত্যা করার অভিপ্রায়ে যুবরাজ খসরু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটা ষড়যন্ত্রে তাঁর ভূমিকা রয়েছে এবং রাজকীয় কোষাগার দখল করতে তাঁর সাহায্যের জন্য খসরু তাকে তাঁর উজির হিসাবে নিয়োগ করে তাকে পুরস্কৃত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তুমি ভালো করেই জানো আমার দাদাজান কেমন মানুষ–সবসময়েই ভীষণ শান্ত, ভীষণ সম্মানিত। তিনি আমাদের দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করে নিরবে তাঁদের সাথে গিয়েছেন কিন্তু আমি ঠিকই দেখেছি তিনি কতটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন এবং সেইসাথে তিনি ভয়ও পেয়েছেন।

 চিঠিতে আরও কিছু লেখা রয়েছে, কিন্তু মেহেরুন্নিসা ইতিমধ্যে যতটুকু পড়েছে সেটুকুই সে টায়টোয় কোনোমতে আত্মীভূত করে। তার আব্বাজান গিয়াস বেগ, যিনি প্রথমে আকবর আর পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরের অধীনে দুই দশকের বেশি সময়কালব্যাপী এমন বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সম্রাটকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করার কারণে… এটা একেবারেই অসম্ভব। তাঁর মুহূর্তের জন্য মনে হয় সে এখনও বোধহয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রয়েছে এবং পুরো ব্যাপারটাই একটা অদ্ভুত দুঃস্বপ্ন, কিন্তু মুশকিল হল আশেপাশেই কোথাও একটা মশা উচ্চ স্বরগ্রামে ক্লান্তিকরভাবে গুনগুন করছে আর নাদিয়া সবসময়ে যে সুগন্ধি ব্যবহার করে থাকে সেটার তীব্র কস্তুরি গন্ধ, সন্দেহাতীতভাবে বাস্তব।

 ‘এটা কি? আশা করি কোনো দুঃসংবাদ নেই? নাদিয়া জানতে চায়, তার চোখ উত্তেজনায় চক চক করছে।

 ‘আমাদের পারিবারিক একটা ব্যাপার। তুমি এখন যেতে পারো, কিন্তু প্রদীপটা রেখে যাও আমি যেন পড়ার জন্য আলো পেতে পারি।’

মেহেরুন্নিসা যখন নিশ্চিত হয় যে পরিচারিকা বাস্তবিকই চলে গিয়েছে সে তার মুখের উপর থেকে নিজের লম্বা কালো চুলের গোছা সরিয়ে নিয়ে পুনরায় আরজুমান্দের লেখা চিঠিটার দিকে তাকায়, ধীরে ধীরে চিঠিটার পুরো বিষয়বস্তু আত্মস্থ হতে আরম্ভ করতে তাঁর হাত পায়ের রক্ত নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে। তাঁর আব্বাজানের জীবন হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর তাঁদের পুরো পরিবার ধ্বংস কিংবা আরো মারাত্মক পরিণতির মুখোমুখি এসে উপনীত হয়েছে। যুবরাজ খুররমের সাথে আরজুমান্দের বিয়ের ধারণাই এখন হাস্যকর হয়ে পড়েছে, এবং তাঁর নিজের আশা আকাঙ্খও… সে এক মুহূর্তের জন্য তখনও আন্দোলিত হতে থাকা জরির কারুকাজ করা পর্দার দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না, প্রতি মুহূর্তে তার কেবলই মনে হতে থাকে যেকোনো মুহূর্তে পর্দার নাজুক কাপড় একপাশে সরিয়ে হেরেমের প্রহরী আর খোঁজার দল ঝড়ের বেগে ভেতরে প্রবেশ করবে তাকেও গ্রেফতার করতে।

তাকে এখন অবশ্যই মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আরজুমান্দের চিঠিখানা শক্ত করে ধরে সে পড়তে থাকে। আমার দাদাজানকে তাঁরা নিয়ে যাবার সময় সেখানে আগত প্রহরীদের একজন তাকে বলেছিল, আপনার ছোট ছেলে মীর খানকে দুই দিন পূর্বে একই অভিযোগে গোয়ালিওরে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় আগ্রায় নিয়ে আসা হয়েছে। দুশ্চিন্তায় আমার দাদাজান প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ফুপুজান দয়া করে আমাদের সাহায্য করেন। আমাদের কর্তব্য করণীয় সম্পর্কে সত্ত্বর আমাদের অবহিত করবেন। চিঠিটার শেষে দ্রুত টানে আরজুমান্দ লেখা।

মেহেরুন্নিসা শয্যা থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং চিঠিটা যত্নের সাথে ভাঁজ করে তেপায়ার উপরে তেলের প্রদীপের পাশে রাখে। সে তারপরে মন্থর পায়ে হেঁটে বাতায়নের কাছে যায় এবং সূর্যের তাপে তখনও উত্তপ্ত হয়ে থাকা বেলেপাথরের সংকীর্ণ পার্শ্বদেশে হাত রাখে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে দু’জন মহিলা প্রহরীকে হেরেমের আঙিনায় পরিক্রমণ করতে দেখে, তাদের আলকাতরায় চোবানো ছেঁড়া কাপড়ের মশালের আলোয় তাদের চারপাশে নৃত্যরত ছায়ারা ছড়িয়ে যায়। দরবারের সময়রক্ষক, ঘড়িয়ালীকে সে কাছাকাছি কোথাও থেকে ঘণ্টার সংকেত ধ্বনি করতে শুনে–একবার, দুইবার, তিনবার… সে আকাশের দিকে তাকালে সেখানে আকাশের মসিকৃষ্ণ গভীরতার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে উজ্জ্বল তারকারাজির অসংখ্য নক্সা ছড়িয়ে থাকতে দেখে। পৃথিবীর সমস্যাবলী থেকে এত দূরবর্তী, তারকারাজির দূরাগত শীতল সৌন্দর্য কীভাবে যেন তাঁর মাঝে শক্তি জোগায়, তাকে শান্ত করে এবং আরো পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে তাকে সাহায্য করে।

তাঁর আব্বাজান গিয়াস বেগ, সম্মান আর অতিমাত্রায় অনুগত, নিরপরাধ, সে নিশ্চিত। তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সেটা নিঃসন্দেহে ভুল বোঝাবুঝি কিংবা ঈর্ষাপ্রসূত। কিন্তু তাঁর ছোট ভাই মীর খানের অভিযোগের বিষয়টার ব্যাখ্যা কি হতে পারে? সে নিশ্চিতভাবে কিছুই বলতে পারে না। কাবুলে তাঁরা একসাথে বড় হয়েছে। সে সবসময়েই জানে যে তার এই ছোটভাইটা তার কিংবা আসফ খানের মত বুদ্ধিমান–কিংবা তাদের মত মানসিক শক্তির অধিকারী হয়নি। মীর খান আত্মাভিমানী এবং নিজের এই সীমাবদ্ধতা সে কখনও স্বীকার করে না। সে খুব ভালো করেই জানে তাকে কত সহজে ভুল পথে পরিচালিত করা সম্ভব। তারা যখন ছোট ছিল তখন কতবার যে সে তাকে তার নিজের নয় বরং তার স্বার্থে তাকে হঠকারী কাজে প্রলুব্ধ করেছে। তার জন্য ফল সংগ্রহ করতে ভাইকে সে একবার খুবানির গাছের পচা ডাল বেয়ে উঠতে প্ররোচিত করেছিল মনে পড়তে সে আপন মনে হেসে উঠে। সেই ডাল তার ভাইকে নিয়ে নিচে ভেঙে পড়েছিল।

 অনেকদিন আগের সেসব কথা। মীর খানের এতদিনে বিচক্ষণ আর বিবেচক হবার কথা, কিন্তু আসাফ খান যেমন অল্প বয়সেই উন্নতি করেছিলেন তেমন সাফল্য সে লাভ করে নি। হতাশা, বড় ভাইয়ের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে আর হতাশার কারণেই কি বিশাল পুরষ্কারের মিষ্টি প্রলোভনে ভুলে সে অবাস্তব কোনো ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছিল? তাঁর জানার কোনো উপায় নেই। তাঁর ছোট ভাই তাঁদের আব্বাজান গিয়াস বেগের মতই নিরপরাধও হতে পারে। তাকে বিচার করতে গিয়ে সে কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো করতে চায় না। এখন কি করণীয় সেটাই বরং ঠাণ্ডা মাথায় আর যুক্তি সহকারে ঠিক করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর নিজের এবং তার পরিবারের ভাগ্য–এমনকি হয়তো তাঁদের জীবন–এখন একটা সরু সুতার মাথায় ঝুলছে। তার এখন কোনোভাবেই হঠকারীতা প্রদর্শন করা চলবে না, কিন্তু হাত পা গুটিয়ে বসে থাকাটা হয়তো প্রাণঘাতি প্রতিপন্ন। হতে পারে…

সে দিল্লিতে আসাফ খানকে সবকিছু জানিয়ে চিঠি লিখতে পারে। তিনি হয়তো ইতিমধ্যেই এখানকার পরিস্থিতি সম্বন্ধে অবহিত হয়েছেন এবং এই মুহূর্তে আগ্রার পথে ঘোড়া নিয়ে ধুলোর ঝড় তুলে ছুটে আসছেন। তাঁরা একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নিবে তাঁদের পরিবারকে এই বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে তাঁদের কি করা উচিত। তাছাড়া এই ষড়যন্ত্রে তিনিও হয়তো জড়িয়ে পড়েছেন এবং এখন হয়তো বন্দি রয়েছেন। নাহ্, আসাফ খানের ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটা জানার জন্য সে অপেক্ষা করবে না। তাকে এবং তাকে একলাই যা করার করতে হবে।

নিজের ছোট কক্ষে প্রায় ঘন্টাখানেক অস্থিরভাবে পায়চারি করার পরে, দিগন্তের কোণে ভোরের ধুসর আলোর রেখা উঁকি দিতে মেহেরুন্নিসা পা আড়াআড়িভাবে রেখে তার লেখার টেবিলের সামনে এসে বসে। সে সবুজ অনিক্স পাথরের দোয়াতদানিতে–তাঁর আব্বাজান দোয়াতদানিটা তাকে উপহার দিয়েছিল–নিজের কলমটা ডুবিয়ে নিয়ে আরজুমান্দের উদ্দেশ্যে দ্রুত কয়েকটা কথা সাজিয়ে লিখে। তোমার আব্বাজান ফিরে আসা পর্যন্ত আমার দাদিজানের কাছে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করো এবং আমার কাছ থেকে পুনরায় কোনো সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত কিছু করবে না। আমার উপরে আস্থা রাখো। সে লেখাটা শেষ করেই ভিজা কালি শুষে নেয়ার জন্য বালির মিহিগুড়ো সেটার উপরে ছিটিয়ে দিয়ে, কাগজটা ভাজ করে এবং গালার লম্বা একটা টুকরো উত্তপ্ত করে সেটা ফোঁটায় ফোঁটায় ভজের উপরে ফেলে এবং নিজের মোহর দিয়ে সেটার উপরে ছাপ দেয়, পারস্যে বহু শতাব্দি যাবত তাঁদের পরিবারে ব্যবহৃত ঈগলের প্রতীক মোহরটায় খোদাই করা রয়েছে। সে মোহরটা কদাচিত ব্যবহার করে কিন্তু এখন ব্যবহার করলে কারণ তাঁদের পরিবারের গৌরবোজ্জল দীর্ঘ অতীতের কথা অহঙ্কারী ঈগলটা, সে যা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু আরজুমান্দের কাছে প্রকাশ করে নি সেটা করার জন্য পদক্ষেপ নিতে তাকে সাহস জোগায়।

সে পুনরায় দোয়াতদানি থেকে লেখনীটা তুলে নিয়ে জাহাঙ্গীরের উদ্দেশ্যে আরেকটা চিঠির মুসাবিদা শুরু করে। মহামান্য সম্রাট, আপনাকে এই চিঠি লেখার সাহস আমার কখনও হতো না যদি না আমার পরিবারের প্রতি আমার ভালোবাসা এবং তাঁদের সম্মান রক্ষার জন্য তাঁদের প্রতি আমার ভিতরে একটা কর্তব্যবোধ কাজ করতো। মহামান্য সম্রাট, অনুগ্রহ করে আমাকে একবার দেখা করার অনুমতি দেন। গিয়াস বেগের কন্যা, মেহেরুন্নিসা। সে চিঠিটার আবার ভাঁজ করে এবং গালা গরম করে আর কিছুক্ষণ পরে রক্ত-লাল গালার নরম ফোঁটায় গলে পরতে শুরু করে।

*

যন্ত্রণাদায়ক মন্থরতায় দিনটা অতিবাহিত হতে থাকে। চারপাশ অন্ধকার করে শীঘ্রই সন্ধ্যা নামবে। মেহেরুন্নিসা ভাবে, সবাই নিশ্চয়ই জানে কি হয়েছে। ফাতিমা বেগম আজ তাকে ডেকে পাঠান নি। বাস্তবিকপক্ষে কেউই তাঁর কাছেই আসে নি, এমনকি সদা-উৎসুক নাদিয়ারও আজ কোনো পাত্তা নেই। তাদের ভিতরে নিশ্চয়ই গিয়াস বেগের পরিবারের সাথে বেশি খাতিরের ব্যাপারে একটা ভয়ের সংক্রমণ ঘটেছে, তার মানে এই না যে সেও বিষয়টা পাত্তা দেয়। একজন পরিচারিকাকে চিঠির সাথে একটা স্বর্ণমুদ্রা ঘুষ দিয়ে এবং জাহাঙ্গীরের উজির মাজিদ খানের কোনো পরিচারিকার হাতে চিঠিটা পৌঁছে দিতে বলে সাথে এটাও বলবে যে গিয়াস বেগের মেয়ের কাছ থেকে চিঠিটা এসেছে, কিন্তু তারপরেও জাহাঙ্গীরের কাছে চিঠি লেখার পরে প্রায় বারোঘন্টা অতিবাহিত হতে চলেছে। মাজিদ খানের বিষয়ে সে যা কিছু শুনেছে তার মনে হয়েছে যে মাজিদ খান একটা বিবেকসম্পন্ন মানুষ, যিনি গত কয়েকমাস যাবত তাঁর আব্বাজানের বাসার একজন নিয়মিত অতিথি ছিলেন, কিন্তু তিনিও এখন হয়তো গিয়াস বেগের সাথে একটা দূরত্ব বজায় রাখবেন। উজির মহাশয় একটা জ্বলন্ত মোমবাতির শিখায় চিঠিটা ধরে রেখে, তাঁর শেষ আশাটাও ভষ্ম করে দিচ্ছে সে কল্পনা করে।

 ‘এই মুহূর্তে আমার সাথে চলেন। মেহেরুন্নিসা চমকে ঘুরে তাকায়। খাজাসারাকে প্রবেশ করতে সে শুনেনি এবং মালাকে তাঁর কাছ থেকে মাত্র চার ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে কেঁপে উঠে। সে তার হাতের কর্তৃত্বের নিদর্শনসূচক দণ্ড দিয়ে দরজার দিকে ইঙ্গিত করার সময় তাঁর চোখে মুখে একটা আবেগহীন অভিব্যক্তি ফুটে থাকে। মেহেরুন্নিসার পরনে নীল রেশমের তৈরি তাঁর সবচেয়ে সুন্দর আলখাল্লা রূপার জরি দিয়ে যার উপরে সোলোমী ফুলের নক্সা করা ভাগ্যক্রমে যদি সম্রাট দেখা করার জন্য তাকে ডেকে পাঠান সেই কথা ভেবে, কিন্তু মালার কঠোর মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে তাঁর সন্দেহ হয় যে মালা আদতেই তাকে সেজন্যই ডাকতে এসেছে। রাজকীয় হেরেম থেকে সে সম্ভবত বহিস্কৃত হতে চলেছে, সেক্ষেত্রে সে কোনোভাবেই নিজের প্রিয় জিনিষগুলো যেমন অনিক্সের সবুজ দোয়াতদানি আর বিশেষ করে তাঁর অলঙ্কারগুলো ফেলে যাবে না। সে দামী একটা কাশ্মিরী শাল, আসাফ খান তাকে দিয়েছিলেন, তুলে নিয়ে নিজের অলঙ্কারের বাক্সের দিকে হাত বাড়ালে খাজাসারা তখন অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে বলে, কিছু নিতে হবে না। তুমি যেভাবে রয়েছে ঠিক সেভাবেই আমার সাথে এসো। নিজেকে কেবল অবগুণ্ঠিত করে নাও।

মেহেরুন্নিসা শালটা নামিয়ে রাখে এবং নেকাব বেঁধে নিয়ে নিজের চোখ আজ্ঞানুবর্তীভাবে নত করে রাখে। মালার সবুজ আলখাল্লায় আবৃত লম্বা অবয়বকে অনুসরণ করে নিজের আবাসন কক্ষ থেকে বের হয়ে এসে, দরদালান দিয়ে এগিয়ে গিয়ে হেরেমের আঙিনা অতিক্রম করার সময়, যেখানে ইতিমধ্যেই সাঁঝের ঝাড়বাতি জ্বালান হয়েছে, সে ভাবে আমার জীবনের তাহলে এভাবেই সমাপ্তি ঘটবে। তীর্যক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে, কটু মন্তব্য শুনে, কান্নায় তাঁর চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে কিন্তু সে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে ধীরে সুস্থে গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা তুলে দাঁড়ায়। খাজাসারা যদিও দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে কিন্তু বেত্রাহত কুকুরের মত তাড়াহুড়ো করে সে হেরেম থেকে বের হয়ে যাবে না।

কিন্তু তখনই সে খেয়াল করে যে তাঁদের ঠিক উল্টো দিকে অবস্থিত হেরেমের দরজার দিকে মালা তাকে নিয়ে যাচ্ছে না। সে বরং দ্রুত বামদিক দিকে বাঁক নেয় এবং নিচু ধাপ বিশিষ্ট একপ্রস্থ সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় যা দূর্গের এমন একটা অংশের দিকে উঠে গিয়েছে মেহেরুন্নিসা আগে কখনও দেখেনি। তার বক্ষপিঞ্জরের সাথে তার হৃৎপিণ্ড ধাক্কা খায়। মালা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? খাজাসারা সিঁড়ির একেবারে উপরের ধাপে পৌঁছে থামে এবং কাঁধের উপর দিয়ে পিছনের দিকে ঘুরে তাকায়। ‘পা চালিয়ে এসো। মেহেরুন্নিসা তাঁর নীল আলখাল্লার ঝুল সামলে নিয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। সে উপরে উঠে এসে একটা প্রশস্ত চতুরে নিজেকে আবিষ্কার করে। ঠিক উল্টো দিকে দুই পাল্লা বিশিষ্ট উঁচু একটা দরজা যার গায়ে কমদামি পাথর বসান রূপার পাতা ঝলমল করছে। মালা দরজার বাইরে প্রহরারত চারজন রাজপুত প্রহরীকে দ্রুত কিছু একটা বলার সময় মেহেরুন্নিসার দিকে ইঙ্গিত করে।

 প্রহরীরা দরজার পাল্লা খুলে দেয়। মালা দরজার নিচে দাঁড়িয়ে মেহেরুন্নিসার এগিয়ে আসবার জন্য অপেক্ষা করে, তারপরে তাঁর কব্জি আঁকড়ে ধরে তাকে নিয়ে দু’পাশে বুটিদার রেশমের পর্দা দেয়া একটা প্রশস্ত অলিন্দ দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। পুরুষ ময়ুরের মত দেখতে, যার ছড়ান পেখমে পান্না আর নীলা বসান, সোনার দাহকে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা ধূপ আর মশলার সুগন্ধে অলিন্দের বাতাস ভারি হয়ে আছে। তাদের সামনে আরো একজোড়া দরজা পেছনের দরজার চেয়ে আরও উঁচু আর চওড়া আর পাল্লার উপরে সোনার পাতের উপরে কচ্ছপের খোলা আর হাতির দাঁতের কারুকাজ করা। দরজার সামনে ইস্পাতের ফলাযুক্ত বর্শা হাতে দশজন রাজপুত প্রহরী ঋজু আর স্থির ভঙ্গিতে সামরিক কায়দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ‘আমরা কোথায় এসেছি?’ সে মালার কাছে ফিসফিস করে জানতে চায়।

রাজকীয় হেরেমে মহামান্য সম্রাটের এটা ব্যক্তিগত প্রবেশ পথ। এই দরজা দিয়ে তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষে যাওয়া যায়।

‘তুমি আমাকে সম্রাটের কাছে নিয়ে চলেছো?

 ‘হ্যাঁ। তোমার সাথে কি করা হবে সন্দেহ নেই তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন।

মেহেরুন্নিসা কিছুই শুনতে পায় না। সে সম্রাটের সামনে উপস্থিত হবার পূর্বে মূল্যবান সময়ের যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেই অবসরে জাহাঙ্গীরের কাছে চিঠিটা লেখার পর থেকেই তাকে বলার জন্য সে নিজের মনে যে কথাগুলো আউড়ে এসেছে সেগুলোই আরেকবার স্মরণ করে নেয়। বিশাল দরজাটার সোনালী পাল্লা দুটো এখন ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। মালা একপাশে সরে দাঁড়ায় এবং তাকে একলাই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। সে মাথা উঁচু করে দরজার নিচে দিয়ে এগিয়ে যায়।

বিশাল কক্ষের দূরবর্তী প্রান্তে সম্রাট একটা নিচু মঞ্চে উপবিষ্ট। মেহেরুন্নিসা আশা করেছিল কর্চি, পরিচারকদের, এমনকি প্রহরীও হয়তো দেখতে পাবে সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতকের মেয়ে আর বোনের হাত থেকে সম্রাটকে সুরক্ষিত রাখতে, কিন্তু কক্ষে তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই। বাতায়ন দিয়ে আগত আলোয় দীর্ঘায়িত হতে থাকা ছায়া আর মোমবাতির কাঁপতে থাকা আলোর কারসাজিতে তাঁর পক্ষে জাহাঙ্গীরের অভিব্যক্তি বোঝাটা কঠিন করে তুলে। সে তাঁর কাছ থেকে তখনও পনের ফিট দূরে থাকার সময়ে, মেহেরুন্নিসা যেমন ঠিক করে রেখেছিল সেভাবেই মুখ নিচের দিকে রেখে তাঁর সামনে ছুঁড়ে দেয়, তাঁর খোলা চুল তার চারপাশে উড়ছে। সেইসাথে সে তার পরিকল্পনা অনুসারে জাহাঙ্গীর কথা বলা পর্যন্ত অপেক্ষা করে না।

‘সম্রাট আমার সাথে দেখা করার মহানুভবতা প্রদর্শনের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি এখানে এসেছি আপনার সামনে আমার আব্বাজান গিয়াস বেগের পক্ষে সাফাই দিতে। আমি আমার জীবনের দিব্যি দিয়ে বলতে পারি যে আপনার, তাঁর শুভাকাঙ্খি, যিনি তাকে সবকিছু দিয়েছেন, ক্ষতি হয় এমন কোনো কিছু তিনি কখনও করবেন না। আমার আব্বাজান কখনও নিজের পক্ষে সাফাই দিবেন না তাই আমাকেই সেটা করতে হলো। আমি কেবল ন্যায়বিচার কামনা করছি।’ মেহেরুন্নিসা স্থির হয়ে পুরু গালিচায় মুখটা আরো গুঁজে দিয়ে, দুই হাত দু’পাশে ছড়িয়ে, যেভাবে ছিল সেভাবেই থাকে।

তাঁর সামনের ছায়াচ্ছন্ন বেদীতে উপবিষ্ট লোকটার কাছ থেকে কোনো শব্দ ভেসে আসে না। সে মাথা তুলে তাকাবার ইচ্ছাকে জোর করে দমন করে কিন্তু সে যখন কেবল ভাবতে শুরু করেছে যে তার দিকে না তাকিয়ে তার পক্ষে আর থাকা সম্ভব না ঠিক তখনই তার শক্তিশালী হাত নিজের বাহু নিচে সে অনুভব করে, তাকে পায়ের উপরে দাঁড় করাবার জন্য তুলছে। সে চোখ বন্ধ করে থাকে। তিনি যখন তাঁর এত কাছে অবস্থান করছেন তখন সে তার মুখে করুণার পরিবর্তে দোষারোপের অভিব্যক্তি দেখবে সেই ভয়ে চোখ খুলে তার মুখের দিকে তাকাতে পারে না। তাঁর কাঁধ থেকে হাত সরে যায় কিন্তু তারপরেই সে টের পায় তিনি তাঁর নেকাবের একটা পাশ সরিয়ে দিচ্ছেন। সে চোখ খুলে তাকায় এবং জীবনে দ্বিতীয়বারের মত তার চোখে চোখ রাখে। কাবুলে বহু বছর আগে দেখার পর থেকে তার মনে গেঁথে থাকা সেই মুখ সে সামনে দেখতে পায়। মুখাবয়বে বয়সের ছাপ পড়ায় আরও বেশি সুদর্শন দেখায় কিন্তু এই মুহূর্তে সেখানে কঠোর আর শীতল একটা অভিব্যক্তি ফুটে রয়েছে যার দিকে তাকিয়ে সে সহসাই অসুস্থবোধ করে এবং নিস্তেজ হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর তার দিকে আগ্রহের সাথে তাকিয়ে কিন্তু তাঁর ভাবনার বিন্দুমাত্র চিহ্ন মুখে ফুটে উঠে না। সে কয়েক মুহূর্ত পরে ঘুরে দাঁড়ায় এবং নিজের বেদীতে উঠে সেখানে পুনরায় আসন গ্রহণ করে। আপনার আব্বাজান আর ভাইজান দু’জনকেই জেরা করা হয়েছে।’

‘আমার আব্বাজান কোনো অপরাধ করতে পারেন না, মেহেরুন্নিসা নিজের কণ্ঠস্বর শান্ত আর সংযত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে কোনোমতে বলে। কে তাকে অভিযুক্ত করেছে?

‘গোয়ালিওর দূর্গের প্রধান আধিকারিক। তাঁর গুপ্তচরেরা আড়িপেতে আমার ছেলেকে আপনার ভাই মীর খানের সাথে আলোচনা করতে শুনেছে যে পারস্যের শাহের কাছে যদি কান্দাহার সমর্পণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় তাহলে কি সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সাহায্য করতে তিনি রাজি হবেন। আপনার ভাই উত্তর দেয় যে পারস্যের রাজদরবারে গিয়াস বেগের এখন প্রভাব রয়েছে… সে ইঙ্গিত দেয় সে তাকে ষড়যন্ত্রে অংশ নিতে হয়তো রাজি করাতে পারবে।’

মেহেরুন্নিসার মুখ ক্রোধে রক্তিম হয়ে উঠে। সে চোখের সামনে পুরো পরিস্থিতিটা স্পষ্ট দেখতে পায় একজন যুবরাজের বিশ্বাসভাজন হতে পারার গর্বে মীর খান এতটাই উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে যে সে যেকোনো কিছু করবে বা বলবে…মেহেরুন্নিসা থুতনি উঁচু করে। এমন একটা ধারণা ঘৃণার অযোগ্য। মীর খান কেবল নিজেকে একজন কেউকেটা হিসাবে জাহির করতে চেয়েছে। আমি ভূমিষ্ঠ হবার আগেই আমার আব্বাজান পারস্য ত্যাগ করেছেন। তিনি পারস্যের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের একজন আধিকারিক নিযুক্ত হবার পরে আর যোগ্যতার সাথেই তিনি নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে যদি ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত করা সম্ভবও হয়–যা তিনি কোনোভাবেই হবেন না–আর পুরো বাপারটা কোনো অর্থ বহন করে না যেখানে তার নাতনির সাথে যুবরাজ খুররমের বিয়ের হতে চলেছে সেখানে আপনার বিরুদ্ধে আপনার অন্য সন্তানকে সমর্থন করে তাঁর কি লাভ?

জাহাঙ্গীর তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেহেরুন্নিসা ভাবে তার জন্য যদি এখনও কোনো অনুভূতি তার ভিতরে অবশিষ্ট থাকেও সেটা তিনি ভালোভাবেই গোপন রেখেছেন।

 ‘আপনার কথায় যুক্তি রয়েছে কিন্তু আপনি এতটা উত্তেজিত হয়ে তর্ক করার আগেই আমি ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ষড়যন্ত্রের বিষয়ে গিয়াস বেগ কিছুই জানেন না, জাহাঙ্গীর অবশেষে কথা বলে। আমি তাকে বহুদিন ধরেই চিনি এবং বিশ্বাস করি তিনি একজন সৎ লোক।

 মেহেরুন্নিসা ভাবে, আমার আব্বাজান নিরাপদ। তার চারপাশের সবকিছু এক নিমেষের জন্য মনে হয় যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠে এবং সে নিজের চোখের উপর হাত রাখে, নিজেকে শক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে।

কিন্তু আপনার ভাইয়ের ব্যাপারে এটা প্রযোজ্য নয়…’

 ‘আমার ভাইজান…’।

 ‘মীর খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সে প্রথমে যদিও সবকিছু অস্বীকার করেছিল, একটা সময় পরে… জেরার একটা পর্যায়ে… সে স্বীকার করে যে আমার বিশ্বাসঘাতক সন্তান যুবরাজ খসরু তাকে বিপুলভাবে পুরস্কৃত করার লোভ দেখিয়ে আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্রে তাকে অংশ গ্রহণ করতে বলে এবং সে রাজি হয়।

মেহেরুন্নিসা কথা বলে না।

 ‘আপনি এখানে ন্যায়বিচার চাইতে এসেছেন। এইমাত্র আপনি প্রমাণ করেছেন যে আপনি কতটা বিবেচনাবোধের অধিকারী। আমার স্থানে আপনি থাকলে কি করতেন?

সে কোনো কথা না বলে গাঢ় নীলের জমিনে ঘন লাল ফুলের নক্সা করা পুরু গালিচার দিকে তাকিয়ে থাকে যখন হাসতে হাসতে খুবানি গাছের পচা ডাল বেয়ে এগিয়ে গিয়ে তার জন্য কয়েকটা ফল পারতে এগিয়ে যাওয়া উৎফুল্ল, ভাবনাহীন মীর খানের বালক বয়সের স্মৃতি, তাকে প্রায় দৈহিক যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে। সম্রাট। তার কণ্ঠস্বর শান্ত, সংযত, আতঙ্কের লেশমাত্র নেই সেখানে। আপনার সামনে পছন্দের কোনো সুযোগ নেই। মীর খান একজন বিশ্বাসঘাতক। তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করুন। আপনার স্থানে আমি থাকলে তাই করতাম।

 ‘আপনি চিঠিটে আপনার পরিবারের প্রতি আপনার ভালোবাসার কথা উল্লেখ করেছেন। ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য পরামর্শ দেয়াটা কি একজন স্নেহময়ী বোনের উপযুক্ত কাজ?

 ‘পারস্যে একটা প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে: “একটা গাছে যদি বাছে ফল ফলে তাহলে বাগান বাঁচাতে হলে গাছটা কেটে ফেল।” মীর খান তাঁর সম্রাট হিসাবে আপনার প্রতি নিজের কর্তব্য পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সেই সাথে নিজের পরিবারের প্রতিও সে তার দায়িত্ব পালন করে নি। সে একটা কীট আক্রান্ত বৃক্ষ। তাঁর বাকি পরিবার হল প্রবাদে উল্লেখ করা উদ্যান।

 ‘বেশ কথা। আপনার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ হবে। জাহাঙ্গীর ঝুঁকে পড়ে তার পেছনে রাখা পিতলের একটা ঘন্টা তুলে নিয়ে সেটা বেশ জোরে বাজায়। ঘন্টার ধাতব শব্দ দুই কি তিনবার বোধহয় ধ্বনিত হয়েছে বেদীর ডানদিকে অবস্থিত একটা দরজা দিয়ে একজন কর্চি কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে।

 ‘আদেশ করুন, সম্রাট?

‘বিশ্বাসঘাতক মীর খানকে আমার সামনে হাজির করা হোক।’

 মেহেরুন্নিসা কিংবা বেদীর উপরে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা জাহাঙ্গীর কেউ কোনো কথা বলে না অপেক্ষার সময়গুলো যখন অতিবাহিত হয়। নিজের জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম বিপর্যয়ের পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করে। এখন বোধহয় সন্ধ্যা সাতটা বাজে–আরজুমান্দ বানুর আতঙ্কিত চিঠি নাদিয়া তাকে পৌঁছে দেয়ার পরে পনের ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। সে মানসিকভাবে যদিও পরিশ্রান্ত কিন্তু তার এখন কোনোভাবেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা চলবে না। সে এই পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে কেবল শক্ত থেকেই বের হয়ে আসতে পারবে এবং নিজেকে আর নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে পারবে।

পুরুষ কণ্ঠস্বর আর আগুয়ান পায়ের শব্দ এক ঝটকায় তাকে তার ভাবনা থেকে বের করে আনে। কর্চি সেই একটা দরজা দিয়ে কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করেছে এবং তারপরে দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করে বলে, “মীর খানকে ভিতরে নিয়ে এসো।

দু’জন প্রহরী নিজেদের মাঝে তৃতীয় আরেকজনকে টেনে ভিতরে নিয়ে আসে। মোমবাতির দপদপ করতে থাকা আলোয় তারা যখন বেদীর দিকে এগিয়ে যায় মেহেরুন্নিসা তখন নিজের উপর রীতিমত বলপ্রয়োগ করে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া থেকে বিরত থাকতে। সে যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রহরীরা তার পাশে এসে দাঁড়ায় এবং তাদের মাঝের লোকটা ঠেলে সামনের দিকে মাটিতে ফেলে দেয়। মীর খান কোনো বাধা না দিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। বস্তুতপক্ষে, তাকে দেখে মনে হয় না যে তার জ্ঞান আছে। সে যখন সামনের দিকে টলমল করে আছড়ে পড়ে সেই অবসরে মেহেরুন্নিসা তাঁর কালচে, রক্তাক্ত মুখ দেখতে পায়। তার পরনের কাপড় ছেঁড়া, তাঁর পিঠে আগুনের ছ্যাকার লাল ক্ষত, সম্ভবত তপ্ত লোহার সাহায্যে সৃষ্ট। সে নিজেকে প্রবোধ দেয় মীর খানকে নিজের ভুলের মাশুল অবশ্যই দিতে হবে–যে তাকে অবশ্যই উৎসর্গ করতে হবে যাতে বাকি সবাই তারা রক্ষা পায়–কিন্তু তার পাশে মেঝেতে নিজের অত্যাচারিত ছোট ভাইকে পড়ে থাকতে দেখাটা সহ্য করাও তাঁর জন্য কষ্টকর হয়ে উঠে। জাহাঙ্গীর মীর খান নয় বরং তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে বুঝতে পেরে, সে প্রাণপণে আত্মসংবরণের চেষ্টা করে। সম্রাট কিছুক্ষণ পরে বন্দির দিকে তাকায়।

 ‘মীর খান, নিজের সাফাই দিতে তোমার কি বলার আছে?

 মীর খানের পুরো দেহ থরথর করে কাঁপছে। প্রহরীদের একজন তাঁর মাথার লম্বা কালো চুলের ঝুটি ধরে এবং তার মাথাটা তুলে ধরে। মহামান্য সম্রাটের প্রশ্নের জবাব দাও।’

মীর খান বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য কিছু একটা বলে এবং প্রহরী নিজের জুতো পরা পা তুলে এবার তার পেটে সজোরে একটা লাথি বসিয়ে দেয়। সে এইবার কয়েকটা শব্দ স্পষ্ট করে উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়। সম্রাট, আমাকে ক্ষমা করুন।

 ‘বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠে না। একজন বিশ্বাসঘাতকের মৃত্যুই তোমার প্রাপ্য। তোমায় প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করার পরামর্শ এমনকি তোমার নিজের বোনও দিয়েছে।’ মীর খান হতাশ চোখে তার দিকে তাকালে মেহেরুন্নিসা কুঁকড়ে যায়। আমার উচিত ছিল তোমাকে হাতির পায়ের নিচে পিষে ফেলা কিংবা শূলে দেয়া যেমনটা আমি আমার সন্তানের পূর্ববর্তী বিদ্রোহের সমর্থকদের করেছিলাম যাঁদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়ার মত বুদ্ধিও তোমার নেই।’ জাহাঙ্গীরের কণ্ঠস্বর হিম শীতল শোনায়। মীর খানের পাশে বসে তাকে আগলে ধরে একটু আগে যা বলেছিল সেসব ভুলে গিয়ে ভাইয়ের জীবনের জন্য করুণা ভিক্ষা করা থেকে মেহেরুন্নিসা অনেক কষ্টে নিজেকে বিরত রাখে। জাহাঙ্গীর অবশ্য এসবে ভ্রূক্ষেপ না করে বলতে থাকে, কেবল তোমার বোনের খাতিরে যার মত সাহসী তুমি কখনও হতে পারবে না আমি তোমাকে এই জীবন থেকে তোমার প্রাপ্য ধীর আর যন্ত্রণাদায়ক নিস্কৃতির হাত থেকে রেহাই দিলাম। মৃত্যুর পূর্বে তোমার কি কিছু বলবার আছে?

 মীর খান অনেক কষ্ট করে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসে কিন্তু সে যখন কথা বলে সেগুলো না তার বোন না সম্রাটকে উদ্দেশ্য করে বলা। কথাগুলোর মাঝে কোনো প্রকার ক্ষোভ কিংবা ক্রোধ না থাকায় সে হাফ ছেড়ে বাঁচে। ‘মেহেরুন্নিসা… আমাকে ক্ষমা করে দিও…’

 ‘ভাইজান, আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তার মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকায় কথাগুলো ধীরে নিঃসৃত হয়।

 ‘আর আমাদের আব্বাজান আর আসাফ খানকেও বলে দিও আমায় যেন মার্জনা করে। ষড়যন্ত্রের বিন্দুবিসর্গ সম্বন্ধে তারা জানতো না… এবং আমাদের আম্মাজানকে জানিয়ে তাকে আমি ভালোবাসি আর আমার জন্য যেন কষ্ট না পায়। মীর খান এখন ফুঁপিয়ে কাঁদছে, অশ্রুধারায় তার মুখের শুকনো রক্ত গলতে শুরু করে।

‘জল্লাদকে ডেকে পাঠাও, জাহাঙ্গীর আদেশ দেয়। লোকটা নিশ্চয়ই এতক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করেছিল কারণ সাথে সাথে কালো পাগড়ি ধাতব-বোম শোভিত আটসাট জামা পরিহিত দীর্ঘদেহী একটা লোক দুই মাথাযুক্ত একটা কুঠার হাতে ভেতরে প্রবেশ করে এবং তার অন্য পেষল হাতে মনে হয় একটা পশুর চামড়া মুড়িয়ে ধরা রয়েছে।

 ‘সম্রাট?

 ‘এই লোকটার শিরোচ্ছেদ কর।

জাহাঙ্গীরের আদেশ শুনে মীর খান পুনরায় মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। জল্লাদ লোকটা এবার চামড়াটার ভাঁজ খুলে, তারপরে বেদীর সামনে থেকে গালিচাটা সরিয়ে দিয়ে সেখানে পাথরের মেঝের উপরে যত্ন নিয়ে চামড়াটা বিছিয়ে দেয়। সে প্রস্তুত হতে প্রহরীদের উদ্দেশ্যে মাথা নাড়ে। মীর খান তখনও ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো যখন প্রহরীরা তাকে পুনরায় ধরে এবং টেনে সামনের দিকে চামড়ার উপরে নিয়ে আসে। তোমার গর্দান বাড়িয়ে দাও, জল্লাদ আদেশের সুরে বলে। একজন প্রহরী তার ডান হাতটা দেহের কাছ থেকে টেনে ধরলে যা এখন ভীষণভাবে কাঁপছে অন্য প্রহরীও তাঁর বাম হাতটা একইভাবে টেনে ধরতে, মেহেরুন্নিসা লক্ষ্য করে তার ভাই দারুণ সাহসের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ধীরে নিজের গলা বাড়িয়ে দেয়। জল্লাদ তাঁর ঘাড়ের উপর থেকে কালো চুলের গোছা সরিয়ে দেয় তারপরে, সন্তুষ্টচিত্তে পিছিয়ে এসে কুঠারটা হাতে তুলে নেয়। সে তারপরে যত্নের সাথে কুঠারটার ওজন নিজের হাতে ভারসাম্য অবস্থায় রেখে কাঁধের উপর দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জাহাঙ্গীরের দিকে তাকাতে সে বোঝা যায় কি যায় না এমনভাবে মাথা নাড়ে।

মেহেরুন্নিসা মোমের আলোয় বাঁকা ফলাটা ঝলসাতে দেখে যখন জল্লাদ কুঠারটা এক মোচড়ে নিজের মাথার উপর তুলে ধরে। হন্তারক ফলাটা নামিয়ে আনতে সে টের পায় তার গালের পাশ দিয়ে বাতাসের একটা ঝাপটা বয়ে যায়, তারপরে ফলাটা তার ভাইয়ের গলা নিখুঁতভাবে দ্বিখণ্ডিত করতে হাম আর মাংসের সাথে ইস্পাতের সংঘর্ষের ভোঁতা আওয়াজ সে শুনতে পায় এবং আরো একটা মৃদু ভোঁতা শব্দের সাথে তাঁর ছিন্ন মস্তক মাটিতে আঘাত করতে উজ্জ্বল রক্ত ছিটকে উঠতে দেখে। মেহেরুন্নিসা কিছুক্ষণ নিথর দাঁড়িয়ে থাকে। তারপরে স্বস্তিকর একটা অনুভূতি–জল্লাদ লোকটা নিজের কাজ ভালোই জানে। তাঁর ভাই কষ্ট পায় নি। সে তাকে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর হাত থেকে নিকৃতি দিয়েছে। সে তাকিয়ে দেখে জল্লাদ দ্রুত মীর খানের ছিন্ন মস্তক আর দেহটা চামড়া দিয়ে ঢেকে দেয় এবং একজন প্রহরীর সাহায্যে সেগুলো কক্ষ থেকে সরিয়ে নেয়। আয়তাকার পাথরের খণ্ডের উপরের পড়ে থাকা কয়েক ফোঁটা রক্তই কেবল সাক্ষী দেয় যে কিছুক্ষণ আগে এখানে একজনের জীবনাবসান হয়েছে।

 ‘সবকিছু মিটে গিয়েছে, মেহেরুন্নিসা শুনতে পায় জাহাঙ্গীর বলছেন। ‘আপনি এবার হেরেমে ফিরে যেতে পারেন।’

মেহেরুন্নিসার অনুভব করার আর চিন্তা করার সব শক্তি যেন বিলীন হয়েছে। সে অন্ধের মত আদেশ পালন করে, কক্ষের দূরবর্তী প্রান্তের অতিকায় সোনালী দরজার দিকে টলতে টলতে এগিয়ে যায় যা ইতিমধ্যে তার জন্য খুলতে শুরু করেছে।

 হেরেমে নিজের কক্ষে ফিরে এসে যা সে ভেবেছিল আর কখনও দেখতে পাবে না মেহেরুন্নিসার কিছুটা সময় লাগে অবশেষে কান্নায় ভেঙে পড়তে। নিজের ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ড প্রত্যক্ষ করা খুবই কঠিন। নিজেকে সুস্থির রাখার জন্য সে তার হাতের নখ দিয়ে যেখানে আঁকড়ে ধরেছিল সেখান থেকে এখন রক্তপাত শুরু হয়েছে। কিন্তু মীর খান নিজেই নিজেকে এই বিপর্যয়ে আপতিত করেছে। সে দোষী আর ন্যায়বিচার সম্পন্ন হয়েছে। তাকে বাঁচাবার জন্য তার কিছুই করার ছিল না এবং সেই চেষ্টা করতে গেলে সে সম্ভবত নিজেকে আর সেই সাথে তাঁদের পুরো পরিবারকে বিপদগ্রস্থ করে তুলতো। তাঁর আব্বাজান যেমন শিশুকালে তাকে মরুভূমিতে পরিত্যাগ করেছিলেন তাঁদের বাকি পরিবারকে বাঁচবার একটা সুযোগ দিতে, তাকে ঠিক সেভাবেই মীর খানকেও উৎসর্গ করতে হয়েছে। তাঁর বিচক্ষণতার মানে এই নয় যে সে ভাইকে ভালোবাসে না, যতই দুর্বল আর বোকা সে হোক। কিন্তু এখন কি করণীয়? জাহাঙ্গীরের সাথে সাক্ষাতের বিষয়ে সে এতদিন ধরে যে স্বপ্ন দেখছিলো তা অবশেষে পূরণ হয়েছে কিন্তু সে যেমন কল্পনা করেছিল তার থেকে একেবারে ভিন্ন একটা প্রেক্ষাপটে। ভবিষ্যতের গর্ভে তার জন্য… বা তাঁর পরিবারের জন্য… কি অপেক্ষা করছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *