১.০৪ রাজকীয় হেরেম

১.৪ রাজকীয় হেরেম

মালকিন, যাবার সময় হয়েছে। অধমের নাম মালা। আমি মহামান্য সম্রাটের খাজাসারা, তাঁর রাজকীয় হেরেমের তত্ত্বাবধায়ক এবং আপনাকে পথ দেখিয়ে ফাতেমা বেগমের আবাসন কক্ষে পৌঁছে দেয়ার জন্য এসেছি আপনি তাঁর খিদমত করবেন। মালা যৌবন প্রায় অতিক্রান্ত দীর্ঘদেহী, মর্যাদাপূর্ণ চেহারার অধিকারিনী এক রমণী। তার হাতের হাতির দাঁতের তৈরি রাজকীয় দফতরের কর্তৃত্বসূচক দণ্ডের শীর্ষদেশে খোদাই করা পদ্মফুলের আকৃতি তার চেহারায় বাড়তি আভিজাত্য যোগ করেছে। মেহেরুন্নিসা তাঁর স্মিত হাসির পেছনে দুর্দান্ত এক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি আঁচ করতে পারে।

সে এবার তাঁর পিতামাতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, আগ্রা দূর্গের নিরাপত্তা প্রাচীরের অভ্যন্তরে গিয়াস বেগের বসবাসের জন্য বরাদ্দকৃত প্রশস্ত আবাসন কক্ষসমূহের আঙিনায় তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁর আম্মিজান লাডলির হাত ধরে রেখেছে। মেহেরুন্নিসা হাঁটু ভেঙে বসে নিজের মেয়ের গালে চুমু দেয়। সে এই মুহূর্তটার জন্য বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে প্রতীক্ষা করেছিল, কিন্তু এখন যখন সময়টা এসেছে, আগ্রা পৌঁছাবার তিন সপ্তাহ পরে, তার মাঝে কেমন একটা উদ্বেগ এমনকি এক ধরনের অনীহা কাজ করতে থাকে। নিজের সন্তানের কাছ থেকে আলাদা হওয়া যে ছিল তার একমাত্র সান্ত্বনা ভীষণ দুঃসহ একটা অভিজ্ঞতা, লাডলী যদিও তাঁর দাদা-দাদী আর আয়া ফারিশার কাছে যত্নেই থাকবে এবং হেরেমে তাঁর সাথে দেখা করার অনুমতি পাবে।

খাজাসারা তাকিয়ে রয়েছে বুঝতে পেরে, মেহেরুন্নিসা নিজেকে বাধ্য করে নিজের আবেগ গোপন করতে, শের আফগানের সাথে তাঁর অতিবাহিত জীবন যা ভালোভাবে করতে তাকে পারদর্শী করে তুলেছে, এবং মুখাবয়ব আবেগহীন রাখতে। লাডলীকে শেষবারের মত একবার আলিঙ্গন করে সে উঠে দাঁড়ায়, তাঁর পিতামাতার দিকে ঘুরে এবং তাঁদেরও আলিঙ্গন করে সে তাঁদের সান্নিধ্য থেকে পিছনে সরে আসবার সময়, গিয়াস বেগের মুখ গর্বে জ্বলজ্বল করতে থাকে। তোমার প্রতি আমাদের শুভকামনা রইলো। তোমার গৃহকত্রীকে ভালোভাবে খিদমত করবে,’ তিনি বলেন।

মেহেরুন্নিসা খাজাসারাকে অনুসরণ করে প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে আসে এবং বেলেপাথরের একপ্রস্থ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে যা আগ্রা দূর্গের প্রাণকেন্দ্রের অভিমুখে খাড়াভাবে উঠে যাওয়া একটা ঢালের পাদদেশে এসে শেষ হয়েছে। কয়েক গজ দূরেই সবুজ রঙের পোষাক পরিহিত ছয়জন মহিলা পরিচারিকা রেশমের কাপড় দিয়ে সজ্জিত একটা পালকির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁরা সবাই দেখতে লম্বা আর চওড়া। সে ইতিমধ্যে পেষল দেহের অধিকারিনী তুর্কি মেয়েদের কথা শুনেছে যারা হেরেম পাহারা দেয়, কিন্তু সে আরেকটু কাছাকাছি যেতে পরিচারিকার দলটা মেয়ে নয়, বরং বিশাল হাত পা বিশিষ্ট এবং না পুরুষ না মেয়েলী, আশ্চর্য ধরনের কোমল মুখের অধিকারী, খোঁজা দেখে সে চমকে উঠে সশব্দে শ্বাস টানে। তাদের সবারই পরনে দামী অলঙ্কার শোভা পায় এবং বেশ কয়েকজনের চোখে কাজল দেয়া রয়েছে। সে খোঁজা আগেও দেখেছে, গৃহপরিচারক হিসাবে নিয়োজিত বা বাজারে লোকদের মনোরঞ্জনের জন্য নাচ গান করে, কিন্তু মেয়েদের মত পোষাক পরিহিত এমনটা আগে কখনও দেখেনি।

মালিকা, এই পালকিটা আপনার জন্য পাঠান হয়েছে, খাজাসারা বলে। মেহেরুন্নিসা পালকিতে উঠে ভেতরের নিচু আসনে আড়াআড়িভাবে পা রেখে বসে। তার চারপাশে রেশমের পর্দাগুলোকে কয়েক জোড়া হাত জায়গা মত গুঁজে দেয় এবং খোঁজার দল পালকিটা নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে সেটা শূন্যে ভেসে উঠে। তাকে নতুন একটা জীবনে বয়ে নিতে পালকিটা খাড়া ঢাল দিয়ে মৃদু দুলুনির সাথে উপরে উঠতে শুরু করতে, সে দেখে সে নিজের হাত মুঠো করে রেখেছে এবং তাঁর হৃৎপিণ্ড এত দ্রুত স্পন্দিত হয় যে তার কানে মনে হয় যেন তার দেহের রক্ত এসে আছড়ে পড়ছে। এত অল্প সময়ের ভিতরে কত কিছু ঘটে গিয়েছে… কাবুলে সে যখন তার সামনে নৃত্য প্রদর্শন করছিল তখন তিনি তাঁর দিকে যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন, ছায়াময় আধো-আলোতে সে চেষ্টা করে জাহাঙ্গীরের সেই কৃশ কিন্তু সুদর্শন মুখমণ্ডল পুনরায় স্মরণ করতে… তাঁর আব্বাজান যেমন দাবি করেছেন এবং সে নিজেও যা প্রত্যাশা করে তিনি কি আসলেই সেভাবে তার ভবিষ্যত? সে শীঘ্রই সেটা জানতে পারবে।

*

‘সম্রাট, আপনি আমাকে কি কথা বলতে চান? আমি আপনার আদেশ লাভ করা মাত্র ফতেপুর শিক্রি থেকে যত দ্রুত সম্ভব এসেছি। সুফি বাবার কণ্ঠস্বর কোমল কিন্তু চোখে ক্ষুরধার দৃষ্টি। এখন যখন বহু প্রতীক্ষিত মুহূর্তটা এসে উপস্থিত হয়েছে, জাহাঙ্গীর কথা বলতে অনীহা বোধ করে। সুফি সাধক, যাকে ধার্মিক ব্যক্তি হিসাবে তার যশের কারণে শ্রদ্ধার বশবর্তী হয়ে সে তার নিজের নিভৃত কক্ষে নিজের আসনের পাশেই আরেকটা তেপায়ায় তাকে বসতে অনুরোধ করেছে, মনে হয় তাঁর নাজুক পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেন এবং কথা চালিয়ে যান, আমি জানি যে আপনি যখন একেবারেই ছোট একটা বালক তখন আপনি আমার আব্বাজানের কাছে নিজের মনের কথা খুলে বলেছিলেন। আমার মনে হয় না যে আমার আব্বাজানের মত আমার ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা আছে বা আমি তারমত অন্তদৃষ্টির অধিকারী, কিন্তু আপনি যদি আমার উপরে আস্থা রাখতে পারেন আমি আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারি।’

ফতেপুর শিক্রির সেই উষ্ণ রাতে জাহাঙ্গীরের ভাবনা ফিরে যায় যখন সে তাঁর প্রশ্নের উত্তর পাবার আশায় প্রাসাদ থেকে দৌড়ে শেখ সেলিম চিশতির বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। আপনার আব্বাজান ছিলেন একজন মহান ব্যক্তি। তিনি আমাকে হতাশ হতে বারণ করেছিলেন, বলেছিলেন যে আমিই সম্রাট হবো। আমি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তাঁর কথাগুলো আমাকে অনেক কঠিন সময় অতিক্রান্ত করতে সাহায্য করেছে।’

 ‘আমার কথাও হয়তো আপনাকে খানিকটা স্বস্তি দিতে পারবে।’

জাহাঙ্গীর সুফি সাধকের দিকে তাকায়–তার রুগ্ন-দর্শন আব্বাজানের চেয়ে অনেক বিশালাকৃতি দেহের অধিকারী একজন লোক। সে প্রায় জাহাঙ্গীরের সমান লম্বা এবং একজন সৈন্যের মতই স্বাস্থ্যবান, কিন্তু জাহাঙ্গীর ভাবে শারীরিক শক্তি কোনোভাবেই তাকে নৈতিক দূর্বলতার প্রতি আরো বেশি ক্ষমাশীল করে তুলতে পারে নি… সে লম্বা একটা শ্বাস নেয় এবং যত্নের সাথে শব্দ চয়ন করে কথা বলতে শুরু করে। আমার আব্বাজান আমাকে যখন কাবুলে নির্বাসিত করেছিলেন আমি সেখানে একটা মেয়েকে দেখেছিলাম, আমার আব্বাজানের এক আধিকারিকের কন্যা। আমি সহজপ্রবৃত্তিতে বুঝতে পারি যে সেই আমার মানসকন্যা আমি যাকে খুঁজছি। আমি যদিও ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে তখন বিয়ে করেছিলাম কিন্তু আমি সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত যে সেই হতো আমার আত্মার সহচরী–আমার অবশ্যই তাকে বিয়ে করা উচিত। কিন্তু সেখানে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। আমার আব্বাজানের একজন সেনাপতির সাথে এর আগেই তার বাগদান সম্পন্ন হয়েছিল এবং আমি যদিও আব্বাজানের কাছে অনুনয় করেছিলাম তিনি আমার খাতিরে তাঁদের বাগদান ভাঙতে অস্বীকার করেছিলেন।

‘সম্রাট, আমরা জানি যে সম্রাট আকবর ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক।

 ‘হ্যাঁ, কিন্তু সবসময়ে এটা বলা যাবে না বিশেষ করে যখন ঘটনার সাথে তার আপন পরিবারের সদস্যদের বিষয় জড়িত। তিনি একেবারেই বুঝতে চেষ্টা করেন নি যে আমার দাদাজান হুমায়ুন তাঁর স্ত্রী হামিদাকে প্রথমবার দেখার পর যেমন অনুভব করেছিলেন আমারও ঠিক একই অনুভূতি হয়েছিল। তিনি হামিদাকে আপন করে নিতে, নিজের ভাই হিন্দালের সাথে পর্যন্ত, তিনিও হামিদাকে ভালোবাসতেন, সম্পর্কছেদ করেছিলেন। হামিদার জন্য নিজের ভালোবাসার কারণে তিনি তাঁর সাম্রাজ্যকে পর্যন্ত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। অনেকেই হয়ত তাকে বোকা বলবে…’ জাহাঙ্গীর তাঁর পাশে হাঁটুর উপর হাত রেখে, সাদা পাগড়ি পরিহিত মাথা সামান্য নত করে বসে থাকা সুফি সাধকের দিকে আড়চোখে তাকায়, কিন্তু তিনি ঠিকই করেছিলেন। তাঁদের বিয়ে হয়ে যাবার পরে তিনি আর হামিদা খুব কম সময়ই পরস্পরের থেকে আলাদা হয়েছেন। তিনি শেষ পর্যন্ত মোগল সিংহাসন ফিরে পাবার আগে পর্যন্ত বিপদসঙ্কুল বছরগুলো তিনি নিরবিচ্ছিন্নভাবে হুমায়ুনের সাথে ছিলেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর পরে হামিদা সিংহাসনে আমার আব্বাজান আকবরের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করার মত সাহসিকতা প্রদর্শন করেছিলেন।

 ‘আপনার দাদীজান ছিলেন একজন সাহসী মহিলা এবং গুনবতী সম্রাজ্ঞী। আপনার মনে হয়েছে যাকে আপনি বিয়ে করতে আগ্রহী হয়েছিলেন তিনি আপনার এমনই যোগ্য সহচর হতেন?

‘আমি এটা জানি। আমার আব্বাজান আমাকে বাধ্য করেছিলেন তাকে উৎসর্জন করতে কিন্তু আমি সম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হবার পরে আমি জানি সময় হয়েছে যখন আমি তার সাথে একত্রে থাকতে পারবো।

 ‘কিন্তু আপনি বলেছেন অন্য আরেকজনের সাথে তার বাগদান হয়েছিল।

সেই লোককে কি তিনি বিয়ে করেন নি?

‘হ্যাঁ।

‘কি এমন তাহলে পরিবর্তিত হয়েছে? তার স্বামী কি মৃত্যুবরণ করেছে?

 ‘হ্যাঁ, তিনি মারা গিয়েছেন। জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকে তারপরে উঠে দাঁড়ায় এবং সুফি সাধকের মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়াবার আগে কিছুক্ষণ অস্থিরভাবে পায়চারি করে। সে খোদাভীরু লোকটার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে যে সে যা বলতে চলেছে তিনি ইতিমধ্যেই সেটা জানেন। তার নাম শের আফগান। সে ছিল বাংলার গৌড়ে আমার সেনাপতি। আমার নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাঁর বিধবা পত্নীকে এখানে বাদশাহী হেরেমে নিয়ে আসবার আদেশ দিয়েছি।’

‘সম্রাট, একজন লোককে হত্যা করা যাতে করে আপনি তার স্ত্রীকে পেতে পারেন একটা গর্হিত পাপাচার। সুফি সাধক তার তেপায়ায় পিঠ খাড়া করে একদম সটান বসে রয়েছে এবং কঠোর একটা অভিব্যক্তি তার মুখাবয়বে।

 ‘এটা কি নরহত্যা? আমি একজন সম্রাট। আমার সমস্ত প্রজার জীবন আর মৃত্যুর উপরে আমার অধিকার আছে।

 কিন্তু সম্রাট হিসাবে আপনি সেই সাথে ন্যায়বিচারের উৎসমুখ। আপনি খেয়ালের বশে বা আপনার সুবিধার জন্য হত্যা করতে পারেন না।

 ‘শের আফগান দুর্নীতিপরায়ন ছিল। তার স্থানে আমার মনোনীত সেনাপতি সে কি পরিমাণ বাদশাহী অর্থ আত্মসাৎ করেছিল তাঁর প্রচুর প্রমাণ আমাকে দিয়েছে। ঘোড়া আর অন্যান্য উপকরণ ক্রয়ের জন্য আমার কোষাগার থেকে প্রেরিত সহস্রাধিক মোহর তাঁর ব্যক্তিগত সিন্দুকে জমা হয়েছে। সে মিথ্যা অভিযোগে ধনী বণিকদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে যাতে করে সে তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে। শের আফগানকে দশ, বিশবার মৃত্যুদণ্ড দেবার মত প্রচুর প্রমাণ আমার কাছে আছে…

 ‘কিন্তু আপনি যখন তাকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন তখন আপনি তার এসব অপরাধ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না?

 জাহাঙ্গীর ইতস্তত করে, তারপরে বলে, ‘না।’

‘সম্রাট, সেক্ষেত্রে–এবং কথাটা সরাসরি বলার জন্য আমার মার্জনা করবেন–নিজের স্বেচ্ছাচারীতাকে ন্যায্যতা প্রতিপাদন করার চেষ্টা করাটা আপনার উচিত হবে না। আত্মগ্ৰাহী আবেগের বশবর্তী হয়ে আপনি কাজটা করেছেন, এর বেশি কিছু না।

কিন্তু আমার দাদাজানের থেকে আমার কৃতকর্ম কি এতটাই আলাদা? আমার অপরাধ কি তার চেয়ে এতটাই নিকৃষ্ট? এক ভাইয়ের কাছ থেকে তিনি একজন রমণীকে-যে তাকে ভালোবাসতো এবং তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত ছিল-ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। হিন্দালকে তিনি যদি বৈরীভাবাপন্ন না করতেন, হিন্দাল নিজে কখনও খুন হতো না।

 ‘আপনার অপরাধ আরও নিকৃষ্ট কারণ আপনি নিজের স্বার্থে একজন লোককে হত্যা করেছেন। আপনি আল্লাহতালার চোখেই কেবল পাপ করেন নি সেইসাথে আপনার কাঙ্কি রমণীর পরিবারের বিরুদ্ধে এবং স্বয়ং সেই রমণীর প্রতিও আপনি পাপাচার করেছেন। আপনি আপনার অন্তরে এটা জানেন, নতুবা কেন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন? তার মুখের দিকে সুফি সাধকের পরিষ্কার খয়েরী চোখ অপলক তাকিয়ে থাকে। জাহাঙ্গীর যখন কিছু বলে না তিনি বলতে থাকেন, আমি আপনাকে আপনার পাপবোধ থেকে মুক্তি দিতে পারবো না… আল্লাহতালাই কেবল আপনাকে মার্জনা করতে পারেন।’

জাহাঙ্গীর মনে মনে ভাবে, সুফি বাবার প্রতিটা কথাই অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। বিশ্বাস করে কারো কাছে মনের গোপন কথাটা বলার প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছিল এবং সে খুশি যে অবশেষে সে এটা করতে পেরেছে, কিন্তু ধার্মিক লোকটা তার অপরাধ হয়ত না দেখার ভাণ করবেন এই আশা করে সে নিজে নিজেকেই প্রতারিত করেছিল। আমি আল্লাহতা’লার ক্ষমা লাভ করার চেষ্টা করবো। আমি দরিদ্রদের যা দান করি তাঁর পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধি করবো। আমি দিল্লি, আগ্রা আর লাহোরে নতুন মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেব।

 আমি আদেশ দেব।’ সুফি বাবা নিজের হাত উঁচু করেন। সম্রাট, এসব যে যথেষ্ট নয়। আপনি বলেছেন আপনি বিধবা রমণীকে আপনার হেরেমে নিয়ে এসেছেন। তাঁর সাথে আপনি কি ইতিমধ্যে সহবাস করেছেন?

না। সে মোটেই সাধারণ কোনো উপপত্নী নয়। আমি আপনাকে যেমন বলেছি, আমি তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক। সে বর্তমানে আমার এক সৎ-মায়ের খিদমতকারী হিসাবে রয়েছে এবং এসব বিষয়ে সে বিন্দুমাত্র অবহিত নয়। কিন্তু আমি শীঘ্রই তাকে ডেকে পাঠাব… আমার অনুভূতির কথা তাকে বলবো…’

না। আপনার প্রায়শ্চিত্তের কিছুটা অবশ্যই ব্যক্তিগত হতে হবে। আপনাকে অবশ্যই আত্ম-সংযমের পরিচয় দিতে হবে। এই রমণীকে এখন বিয়ে করলে আল্লাহতা’লা হয়ত ভয়ঙ্কর মূল্য আদায় করবেন। আপনাকে অবশ্যই নিজের বাসনা দমন করতে হবে এবং অপেক্ষা করতে হবে। আপনি অন্তত ছয়মাস তার সাথে সহবাস করবেন না এবং সেই সময়ে আপনি প্রতিদিন নামায আদায় করবেন আল্লাহতালার মার্জনা লাভ করতে।’ কথা বলে সুফি বাবা উঠে দাঁড়ায় এবং তাকে চলে যাবার জন্য জাহাঙ্গীরের আদেশের অপেক্ষা না করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়।

*

ফাতিমা বেগমের চওড়া মুখটা পার্চমেন্টের মত শুষ্ক আর রেখাযুক্ত এবং তার থুতনির বাম পাশের একটা বিশালাকৃতি তিলে বেশ লম্বা তিনটা সাদা চুল বের হয়েছে। তিনি কি কখনও সুন্দরী ছিলেন–এতটাই সুন্দরী যে আকবর তাকে স্ত্রী করার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন? মেহেরুন্নিসা, নিচু একটা বিছানায় স্তূপীকৃত কমলা রঙের সুডৌল তাকিয়ায় তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় শুয়ে থাকা বয়স্ক মহিলার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে। তার মনে হয় সে হয়ত উত্তরটা জানে। আকবর যদিও নিজের দৈহিক আনন্দের জন্য তাঁর উপপত্নীদের বাছাই করতেন, তিনি বিয়েকে রাজনৈতিক মৈত্রী সম্পাদনের একটা মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতেন। সিন্ধের সীমান্ত এলাকায় একটা ছোট রাজ্যের শাসক ফাতিমা বেগমের পরিবার।

মেহেরুন্নিসা অস্থিরভাবে নড়াচড়া করে। তাঁর কোনো কিছু পাঠ করতে ইচ্ছে করে কিন্তু ফাতিমা বেগম নিজের কক্ষে আলো মৃদুতর রাখতে পছন্দ করেন। খিলানাকৃতি জানালায় ঝুলন্ত মসলিনের পর্দা সূর্যের আলো পরিশ্রুত করে। সে উঠে দাঁড়ায় এবং একটা জানালার দিকে এগিয়ে যায়। সে পর্দার ভিতর দিয়ে যমুনা নদীর হলুদাভ-বাদামি পানির স্রোত এক নজর দেখতে পায়। একদল লোক এর কর্দমাক্ত চওড়া তীর ধরে দুলকি চালে ঘোড়া নিয়ে যাচ্ছে, তাদের শিকারী কুকুরগুলো পিছনে দৌড়াচ্ছে। সে আবারও পুরুষদের তাদের স্বাধীনতার জন্য হিংসা করে। এখানে এই বাদশাহী হোরেমে মেয়েদের এই স্বয়ংসম্পূর্ণ বসবাসের এলাকায়-তাঁর জীবন কাবুলে যেমন ছিল তারচেয়ে বেশি দমবন্ধ করা মনে হয়। হেরেমের ফুলে ফুলে ছাওয়া বাগান আর চত্বরের সৌন্দর্য, এখানের বৃক্ষশোভিত সড়কগুলো এবং চিকচিক করতে থাকা সুগন্ধিযুক্ত পানির প্রস্রবন, বিলাসবহুল আসবাবপত্র–কোনো মেঝে কখনও খালি থাকে না, এবং দরজা আর জানালায় ঝলমলে রেশমের রঙিন পট্টি বাঁধা আর মখমলের দৃষ্টিনন্দন পর্দা থাকা সত্ত্বেও–হেরেমটা কেমন যেন বন্দিশালার মত মনে হয়। রাজপুত সৈন্যরা এখানে প্রবেশের বিশালাকৃতি তোরণগুলো সবসময়ে পাহারা দিচ্ছে এবং দেয়ালের ভেতরে মহিলা রক্ষী আর বৈশিষ্ট্যহীন-মুখাবয়ব এবং চতুর-দৃষ্টির খোঁজারা সবসময় টহল দেয় যাদের উপস্থিতি, এমনকি আট সপ্তাহ পরেও তাঁর কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়।

সে এখনও সম্রাটের কাছ থেকে কোনো কিছু শুনতে না পাওয়ায় সেটা আরো বেশি অস্বস্তিকর মনে হয়… সে তাকে এমনকি এক ঝলকের জন্যও দেখতে পায়নি যদিও সে জানে তিনি দরবারেই রয়েছেন। তিনি কেন তাকে ডেকে পাঠান নি বা এমনকি ফাতিমা বেগমকেও দেখতে আসেন নি যেখানে আসলে তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন যে তিনি অবশ্যই তাকে দেখতে পাবেন? ব্যাপারটা কি তাহলে এমন যে তাঁর আশাগুলো–এবং তাঁর আব্বাজানের আশাগুলোর–আসলে কোনো ভিত্তি নেই? মেহেরুন্নিসা জানালার কাছ থেকে সরে আসবার সময় নিজেই নিজেকে বলে, তাকে অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সে এছাড়া আর কিইবা করতে পারে? তাকে যদি এখানে সাফল্য লাভ করতে হয় সহজপ্রবৃত্তি তাকে বলে এই বিচিত্র নতুন পৃথিবী তাকে বুঝতে হবে। ফাতিমা বেগম তাকে যখনই কোনো কাজ দেবেন তাকে অবশ্যই হেরেম সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সে ইতিমধ্যে আবিষ্কার করেছে যে শান বাঁধানো বর্গাকার আঙিনার তিনদিকে মধুচক্রের মত নির্মিত ঘরগুলো যেখানে ফাতিমা বেগমের বাসস্থান অবস্থিত সেখানে আরো ডজনখানেক অন্য মহিলা বাস করেন যারা কোনো না কোনোভাবে রাজপরিবারের সাথে সম্পর্কিত–খালা, ফুপু, অন্যান্য দূর সম্পর্কের বোন।

 সে সেই সাথে এমন অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করেছে যা তাকে নিশ্চিত করেছে যে মালার গুরুত্ব আর চরিত্র সম্বন্ধে তাঁর আন্দাজ পুরোপুরি সঠিক। খাজাসারা সুগন্ধি আর প্রসাধনী প্রস্তুতি থেকে শুরু করে হিসাবপত্র পরীক্ষা করা, রান্নাঘর তদারকি আর বাজার করা পর্যন্ত হারেমের সবকিছু কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করে। কর্তৃত্বপরায়ণ কিন্তু দক্ষ মালা তার সাহায্যকারীদের ক্ষুদ্র দলটার প্রত্যেক সদস্য আর ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ যেখানে মলমূত্র জমা হয় সেসব পরিষ্কার করার জন্য নিয়োজিত মেয়ে খলুপদের নাম জানে। সেই মহিলা অতিথিদের হেরেমে প্রবেশের অনুমতি দেয়। খাজাসারার অনেক দায়িত্বের ভিতরে এটাও রয়েছে–মেহেরুন্নিসা অন্তত তাই শুনেছে– সম্রাটের সাথে সহবাস করা প্রতিটা মহিলার, যাঁদের ভিতরে তাঁর স্ত্রীরাও রয়েছেন, বিস্তারিত বিবরণী এবং ঘটনাচক্রে কেউ কেউ গর্ভবতী হলে সেই তারিখ সংরক্ষণ করা। সে এমনকি-প্রতিটা কক্ষের দেয়ালের উঁচুতে এই বিশেষ উদ্দেশ্যে স্থাপিত ক্ষুদ্রাকৃতি পর্দার ভিতর দিয়ে তাকিয়ে সহবাস সংখ্যাও লিখে রাখে।

জাহাঙ্গীরের স্ত্রীরা, মেহেরুন্নিসা জানতে পেরেছে যে, হেরেমের পৃথক একটা অংশে চমৎকার সব সুসজ্জিত কামরায় বাস করে যা সে এখনও দেখেনি। তার আব্বাজান কেবল যদি বহু বছর পূর্বেই জাহাঙ্গীরের প্রস্তাবে সম্মতি দিতেন তাহলে সে হয়তো তাদের একজন হতো। তারা সবাই কেমন রমণী এবং তিনি কি এখনও তাদের শয্যায় সঙ্গী হন? নবাগত হবার কারণে সরাসরি কিছু জানতে চাওয়াটা তার জন্য কঠিন কিন্তু হেরেমের প্রধান অবসর বিনোদন হল পরচর্চা এবং সে আলাপচারিতার গতিপথ সহজেই ইচ্ছামত পরিবর্তিত করতে পারে। সে ইতিমধ্যে শুনেছে যে যুবরাজ খুররমের মাতা, যোধা বাঈ একজন রসিক আর সদাশয় মহিলা এবং এটাও জেনেছে যে যুবরাজ পারভেজের পারস্যে জন্মগ্রহণকারী মাতা মিষ্টি খাবার কারণে যার প্রতি তাঁর ভীষণ দূর্বলতা রয়েছে প্রচণ্ড মোটা হয়ে গিয়েছেন কিন্তু নিজের রূপ সম্বন্ধে এখনও এতটাই গর্বিত যে তিনি এখনও বৃদ্ধাঙ্গুলের অঙ্গুরীয়তে স্থাপিত মুক্তাখচিত ক্ষুদ্রাকৃতি আয়নায় যা এখন কেতাদুরস্ত ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের চেহারা বিভোর হয়ে দেখে কাটিয়ে দেন।

সে আরো জেনেছে যে যুবরাজ খসরুর বিদ্রোহের পর থেকে তাঁরা মা মান বাঈ নিজের কামরায় অতিবাহিত করেন এবং পর্যায়ক্রমে খসরু আর তার সন্তানকে অন্য যারা বিপথগামী করেছে তাদের অভিযুক্ত করে দোষারোপ করে সময় কাটান। জোর গুজব রয়েছে মান বাঈ সবসময়ে ভীষণ অস্থির হয়ে থাকেন। একজন মহিলা স্বামী আর সন্তানের বিরোধের মাঝে যার ভালোবাসা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে চিন্তা করতেই খারাপ লাগে, কিন্তু মান বাঈয়ের আরো দৃঢ়তা প্রদর্শন করা উচিত ছিল… মেহেরুন্নিসা নিজের ভাবনায় তখনও এতটাই মগ্ন যে দরজার পাল্লা খুলে ফাতিমা বেগমের বছর চল্লিশের বিধবা ভ্রাতুস্পুত্রী সুলতানা, উত্তেজিত ভঙ্গিতে ভিতরে প্রবেশ করতে সে চমকে উঠে।

 ‘আমি দুঃখিত। ফাতিমা বেগম এখন ঘুমিয়ে আছেন, মেহেরুন্নিসা ফিসফিস করে বলে।

‘আমি সেটা দেখতেই পাচ্ছি। সে যখন ঘুম থেকে উঠবে তাকে বলবে যে আমি পরে আসবো। নীলের একটা চালান সম্বন্ধে জরুরি ব্যবসায়িক ব্যাপারে আমাকে তাঁর সাথে আলোচনা করতে হবে।’ সুলতানার কণ্ঠস্বর শীতল এবং অভিব্যক্তি বৈরীভাবাপন্ন যখন সে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।

মেহেরুন্নিসা হেরেমের বাসিন্দাদের কারো কারো তার প্রতি শীতল ব্যবহার, এমনকি বৈরিতার এবং তাদের কৌতূহলের সাথে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আততায়ীর হাতে নিহত শের আফগানের বিধবা স্ত্রীকে কেন ফাতিমা বেগমের সঙ্গিনী করা হয়েছে সে বিষয়ে দু’জন বয়স্ক মহিলার আলাপচারিতা সে আড়াল থেকে শুনেছে। সে অল্পবয়সী এবং দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী। সে এখানে কি করছে? তুমি নিশ্চয়ই ভেবেছো তারা তাকে পুনরায় বিয়ে দিয়েছে,’ একজন মহিলা মন্তব্য করে। এটা একটা ভালো প্রশ্ন। সে এখানে কি করছে? মেহেরুন্নিসা মনে মনে ভাবে। কামরার অন্য প্রান্তে, ফাতিমা বেগম ঘুমের ভিতরে অবস্থান পরিবর্তন করে নাক ডাকতে শুরু করেন।

*

‘খাজাসারা সবাইকে অবিলম্বে আঙিনায় সমবেত হতে বলেছে, নাদিয়া নামে কৃশকায়, তারের মত দেহের অধিকারী ছোটখাট দেখতে এক মহিলা ফাতিমা বেগমের পরিচারিকাদের একজন, বলে। মালকিন, এমনকি আপনাকেও অবশ্যই আসতে হবে, সে তার বয়স্ক গৃহকত্রীর দিকে শ্রদ্ধার সাথে মাথা নত করে পুনরায় যোগ করে।

 ‘কেন? কি হয়েছে? বিকেলের নাস্তার ব্যাপারটা বিঘ্নিত হওয়ায় ফাতিমা বেগমকে দেখতে মোটেই সুন্দরী মনে হচ্ছে না, মেহেরুন্নিসা ভাবে।

 ‘খোঁজাদের একজনের সাথে হাতে নাতে একজন উপপত্নীকে ধরা হয়েছে। অনেকেই বলাবলি করছে যেমনটা ভাব করে তার চেয়ে সে বেশি পুরুষ, অন্যদের ধারণা তারা কেবল চুমু দেয়া নেয়া করছিল। মেয়েটাকে চাবুকপেটা করা হবে।’

‘আমার যখন বয়স ছিল তখন এসব অপরাধের একমাত্র শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। ফাতিমা বেগমের আপাত কোমল মুখাবয়বে অননুমোদনের ছাপ স্পষ্ট। খোঁজাটার কি হবে?

‘তাকে হাতির পায়ের নিচে পিষে মারার জন্য ইতিমধ্যে কুচকাওয়াজের ময়দানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

‘ভালো, ফাতিমা বেগম বলেন। এটাই যথার্থ এমনটাই হওয়া উচিত।’

ফাতিমা বেগমকে অনুসরণ করতে, মেহেরুন্নিসা দেখে প্রাঙ্গণে ইতিমধ্যে গালগল্প করতে থাকা মহিলারা এসে ভীড় করেছে, তাদের কাউকে উদ্বিগ্ন মনে হয় বাকীদের যখন কৌতূহলী দেখায় এবং তারা বিভিন্ন কৌশলে প্রাঙ্গণের কেন্দ্রস্থলের দৃশ্য ভালোভাবে দেখার জন্য চেষ্টা করছে যেখানে হেরেমের পাঁচজন মহিলা রক্ষী ফাঁসিকাঠের মত দেখতে কাঠের তৈরি একটা কাঠামো স্থাপণ করছে। আমার পেছনে দাঁড়াও, ফাতিমা বেগম মেহেরুন্নিসাকে আদেশ দেন, এবং আমার রুমাল আর সুগন্ধির বোতল ধরে রাখো।

প্রহরীদের একজন এখন তার শক্তিশালী খালি হাতে শাস্তিদানের কাঠামোটা ধাক্কা দিয়ে, এর দৃঢ়তা পরীক্ষা করছে। সে সন্তুষ্ট হয়ে এক পা পিছিয়ে আসে এবং অন্য আরেকজন প্রহরীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে সে ব্রোঞ্জের একটা বিষাণ ঠোঁটে রেখে ফুঁ দিতে সেটা একটা কর্কশ ধাতব শব্দে বেজে উঠে। মেহেরুন্নিসা শব্দের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই আঙিনার ডানদিক থেকে আপাদমস্তক টকটকে লাল রঙের আলখাল্লায় আবৃত হয়ে নিজের স্বভাবজাত মন্থর আর গম্ভীর ভঙ্গিতে হেঁটে খাজাসারাকে প্রবেশ করতে দেখে, সমবেত মহিলারা দু’পাশে সরে গিয়ে তাকে সামনে এগোবার জায়গা করে দেয়। মালার পিছনে, নাদুসনুদুস দেখতে অল্পবয়সী এক মেয়েকে, দুইজন মহিলা প্রহরী দু’পাশ থেকে ধরে টেনে নিয়ে আসে, যার। দু’চোখ থেকে ইতিমধ্যেই অঝোরে অশ্রু ঝরছে এবং তাঁর শোচনীয় অঙ্গস্থিতিই বলে দেয় যে সে নিজেও জানে কোনো ধরনের করুণা তাকে দেখান হবে না। খাজাসারা কাঠের ভয়ঙ্কর দর্শন কাঠামোর দিকে এগিয়ে যাবার ফাঁকে সে আদেশের সুরে বলে, মেয়েটাকে নগ্ন কর। কশাঘাত শুরু করা যাক।

মেয়েটাকে যে প্রহরীরা ধরে রেখেছিল তারা সামনের দিকে ধাক্কা দিয়ে জোর করে তাকে হাঁটু ভেঙে বসতে বাধ্য করে এবং রুক্ষভাবে তাঁর রেশমের অন্তর্বাস খুলে নেয় এবং সূক্ষ মসলিনের তৈরি লম্বা চুড়িদার পাজামার কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলে এবং পাজামা বাঁধার মুক্তাখচিত বেণী করা ফিতে ছিঁড়ে গিয়ে পুরো আঙিনায় সেগুলো ছড়িয়ে যায়। মেহেরুন্নিসার পায়ের কাছে এসে একটা থামে। প্রহরীরা নগ্ন অবস্থায় তাকে টেনে হিঁচড়ে কাঠের কাঠামোটার কাছে নিয়ে যেতে শুরু করতে মেয়েটা চিৎকার করতে শুরু করে, তার দেহ ধনুকের মত বাঁকা হয় আর টানটান হয়ে যায় এবং সে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকলে তার ভারি স্তন আন্দোলিত হতে থাকে কিন্তু প্রহরীদের পেশী শক্তির সাথে তার তুলনায় চলে না এবং তাঁরা অনায়াসে কাঠামোর নিচের প্রান্তের সাথে তাঁর গোড়ালী আর উপরের প্রান্তের সাথে তাঁর দুই কব্জি জোড়া করে চামড়ার শক্ত সরু ফালি দিয়ে বেঁধে দেয়। মেয়েটার লম্বা চুলের গোছা তাঁর নিতম্বের বেশ নিচে পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রহরীদের একজন তার কোমর থেকে খঞ্জর বের করে গলার কাছে ঘাড়ের ঠিক উপর থেকে কেটে দেয় এবং চকচক করতে থাকা পুরো গোছাটা মাটিতে কুণ্ডলীকৃত অবস্থায় পড়তে দেয়। মেহেরুন্নিসা তার চারপাশ থেকে একটা সম্মিলিত আঁতকে উঠার শব্দ শুনতে পায়। একজন মেয়ের কাছে তাঁর চুল পরিত্যাগ করাই–তাঁর শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যের মধ্যে অন্যতম–একটা ভয়ঙ্কর আর লজ্জাজনক বিষয়।

মহিলা প্রহরীদের দু’জন এবার সামনে এগিয়ে আসে, তাঁদের আঁটসাট জামার বাইরের অংশ তারা খুলে রেখেছে এবং কোমরের কারুকাজ করা চামড়ার চওড়া কোমরবন্ধনী থেকে ছোট হাতলযুক্ত গিট দেয়া দড়ির চাবুক বের করে। কাঠামোর দু’পাশে নিজেদের নির্ধারিত স্থানে দাঁড়িয়ে তারা নিজেদের হাত উঁচু করে এবং পর্যায়ক্রমে বন্দির ইতিমধ্যেই কাঁপতে শুরু করা শিহরিত দেহে কশাঘাত শুরু করে। প্রতিবার আঘাত করার সময় তারা উচ্চস্বরে–এক, দুই, তিন–সংখ্যা গুনতে থাকে এবং প্রথমদিকে প্রতিবার বাতাস কেটে হিসহিস শব্দে চাবুকের গিঁটঅলা দড়ি মেয়েটার নরম, মসৃণ ত্বকে কামড় দেয়ার সময় সে চিৎকার করে উঠে যতক্ষণ না সেটা একটানা একটা প্রায় পাশবিক গোড়ানিতে পরিণত হয়। সে বেপরোয়াভাবে কিন্তু বৃথাই মোচড়াবার চেষ্টা করে নিজের দেহকে চাবুকের নাগাল থেকে সরিয়ে নিতে চায়। শীঘ্রই তাজা রক্ত তার মেরুদণ্ড আর পিঠ বেয়ে পড়তে শুরু করে এবং নিতম্বের মাঝ দিয়ে গড়িয়ে তার পায়ের কাছে পাথরের উপরে চকচক করতে থাকে। মেহেরুন্নিসা টের পায় তাঁর চারপাশের প্রাঙ্গণে একটা থমথমে নিরবতা নেমে এসেছে।

‘উনিশ’, ‘বিশ’, প্রহরীরা গুনে চলে, তাঁদের নিজেদের দেহও এখন ঘামের জেল্লায় চিকচিক করছে। চাবুকের পনেরতম আঘাতের সাথে সাথে কড়িকাঠে ঝুলন্ত নিস্তেজ, রক্তাক্ত দেহটা ভয়ঙ্কর চিৎকার করা বন্ধ করেছে এবং অচেতন দেখায়। অনেক হয়েছে, খাজাসারা হাত তুলে বলেন। সে যেমন আছে সেভাবেই নগ্ন অবস্থায় তাকে যাও এবং বাইরের রাস্তায় তাকে ফেলে দাও। বাজারের বেশ্যাপল্লীতে সে নিজের স্বাভাবিক স্থান খুঁজে নেবে। তারপরে সে তার পদমর্যাদাসূচক দণ্ডটা সামনে ধরে আঙিনার ভিড়ের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করলে তার পেছনে সম্মিলিত কণ্ঠের একটা দুর্বোধ্য শব্দের সৃষ্টি হয়।

মেহেরুন্নিসা কাঁপতে থাকে এবং সে সামান্য অসুস্থবোধও করতে থাকে। তাঁর তাজা বাতাস এবং ফাঁকা জায়গা দরকার। ফাতিমা বেগমকে কথাটা বলেই যে সে অসুস্থবোধ করছে, সে দ্রুত খালি হতে থাকা প্রাঙ্গণের একপ্রান্তে অবস্থিত ঝর্ণার কাছে প্রায় দৌড়ে যায় এবং ঝর্ণার মার্বেলের কিনারে বসে সে তার চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়।

মালকিন, আপনি কি ঠিক আছেন?’ সে তাকিয়ে দেখে নাদিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে।

‘হ্যাঁ। ব্যাপারটা আসলে আমি জীবনে এমন কিছু কখনও দেখিনি। আমি জানতাম না যে হারেমের শাস্তি এমন ভয়ঙ্কর হতে পারে।

‘মেয়েটাকে ভাগ্যবান বলতে হবে। কশাঘাতের চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারতো। আপনি নিশ্চয়ই আনারকলির গল্প শুনেছেন।

মেহেরুন্নিসা তাঁর মাথা নাড়ে।

 ‘তাকে লাহোরের রাজকীয় প্রাসাদের ভূগর্ভস্থ কুঠরিতে জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছিল। তাঁরা বলে যে রাতের বেলা আপনি যদি সেখান দিয়ে যান তাহলে তাকে বের হতে দেয়ার জন্য এখনও তার কান্নার শব্দ শুনতে পাবেন।’

“সে এমন কি করেছিল যেজন্য তাকে এভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে?

 ‘সে ছিল সম্রাট আকবরের সবচেয়ে প্রিয় এবং কাঙ্খিত রক্ষিতা কিন্তু সে তাঁর সন্তান, আমাদের বর্তমান সম্রাট জাহাঙ্গীরকে, নিজের প্রেমিক হিসাবে বরণ করেছিল।

 মেহেরুন্নিসা পরিচারিকার দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে। আনারকলি নিশ্চয়ই সেই রক্ষিতার নাম যার আলিঙ্গণের কারণেই জাহাঙ্গীরকে কাবুলে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। মুহূর্তের দুর্বলতার কারণে কি চরম মূল্যই না দিতে হয়েছে… ‘নাদিয়া, ঘটনাটা আসলে কি ঘটেছিল? গল্পের সুযোগ দেখে পরিচারিকার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। সে স্পষ্টতই গল্পটা বলতে পছন্দ করে। অন্যকারো চেয়ে আনারকলির জন্য আকবরের আকর্ষণটা বেশি ছিল। সে একবার আমাকে বলেছিল যে তারা দু’জনে যখন একলা থাকতো তখন তিনি তাকে নগ্ন অবস্থায় কেবল দেয়া অলঙ্কার পরিহিত হয়ে তাঁর নাচ দেখতে পছন্দ করতেন। গুরুত্বপূর্ণ নওরোজ উৎসবের একরাতে তিনি বিশাল এক ভোজসভার আয়োজন করে সেখানে তার এবং তাঁর অভিজাতদের সামনে আনারকলিকে তিনি নাচতে আদেশ করেন। আকবরের সন্তান যুবরাজ জাহাঙ্গীরও অতিথিদের একজন ছিলেন। তিনি আগে কখনও তাকে দেখেননি এবং আনারকলির সৌন্দর্য তাকে এতই মোহিত করে ফেলে যে সে তার আব্বাজানের রক্ষিতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাকে পাবার জন্য মরীয়া হয়ে উঠেন। তিনি সেই সময়ের হেরেমের খাজাসারাকে ঘুষ দেন যে আকবর যখন দরবারে থেকে দূরে ছিলেন তখন আনারকলিকে তাঁর কাছে নিয়ে আসে।

 ‘আর তাদের কেউ দেখে ফেলেছিল। ‘প্রথম প্রথম কেউ দেখেনি, নাহ্। কিন্তু আনারকলির জন্য জাহাঙ্গীরের কামনা বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে তাঁর হঠকারিতাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। খাজাসারা সবকিছু দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে সম্রাটের কাছে সবকিছু বলে দেয়। তিল তিল করে মৃত্যুর বদলে পুরষ্কার হিসাবে দ্রুত তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সম্রাট তারপরে আনারকলি আর জাহাঙ্গীরকে তার সামনে হাজির করার আদেশ দেন। আকবরের দেহরক্ষীদের একজন ছিলেন আমার চাচাজান এবং তিনি সবকিছু দেখেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছেন আনারকলি নিজের জীবন ভিক্ষা চেয়ে অনুনয় বিনয় করেছিল, অশ্রুতে তার চোখের কাজলে সারা মুখ লেপ্টে গিয়েছিল, কিন্তু তার ব্যাপারে আকবর চোখ কান বন্ধ করে ছিলেন। এমনকি জাহাঙ্গীর পর্যন্ত যখন চিৎকার করে বলে যে আনারকলি নয়, সেই দোষী সম্রাট তাকে চুপ করে থাকতে বলেন। তিনি আনারকলিকে একটা ভূগর্ভস্থ কক্ষে রেখে দেয়াল তুলে দিতে বলেন এবং সেখানেই ক্ষুধা তৃষ্ণায় মৃত্যুবরণ করার জন্য ফেলে রাখেন।

 ‘যুবরাজের ভাগ্যে আমার চাচাজান বলেছেন যে সম্রাটের অভিব্যক্তি দেখে সবাই ধরে নিয়েছিল যে আকবর তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেবেন। আনারকলিকে টেনেহিঁচড়ে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়ার পরে উপস্থিত অমাত্যদের মাঝে একটা থমথমে নিরবতা বিরাজ করতে থাকে। কিন্তু তার আসল অভিপ্রায় যাই হোক, তাঁর ক্রোধ যতই প্রবল হোক, শেষ মুহূর্তে আকবর নিজের সন্তানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া থেকে কোনো মতে নিজেকে বিরত রাখেন। তিনি এরবদলে যুবরাজকে নির্বাসিত করেন কেবল তার দুধ-ভাই তার সাথে সঙ্গী হিসাবে গমন করে।

মেহেরুন্নিসা মাথা নাড়ে। আমি জানি। আমার আব্বাজান যখন কাবুলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন তখন তাকে সেখানে পাঠান হয়েছিল।

 ‘কিন্তু আনারকলির গল্পের এখানেই সমাপ্তি নয়, অন্তত আমার মনে হয় না ব্যাপারটা এভাবে…’

 ‘তুমি কি বলতে চাও?

 ‘অন্তত হেরেমের ভিতরে একটা গুজব রয়েছে যে আনারকলির যন্ত্রণা লাঘব করতে জাহাঙ্গীর তার দাদিজান হামিদাকে রাজি করিয়ে ছিল এবং তাকে জীবন্ত সমাধিস্থ করতে দেয়ালের শেষ ইটটা গাঁথার আগে যেভাবেই হোক হামিদা তাঁর কাছে বিষের একটা শিশি পৌঁছে দেন যাতে করে সে দীর্ঘ আর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর বিভীষিকা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।’

বিকেলের বাতাসের সমস্ত উষ্ণতা সত্ত্বেও মেহেরুন্নিসা কাঁপতে থাকে। প্রথমে কশাঘাত এবং তারপরে এই ভয়ঙ্কর গল্প। আমার ফাতিমা বেগমের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত, সে বলে। সে যখন নাদিয়ার সাথে প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে হেঁটে যায়, যেখানে স্থাপিত কড়িকাঠটা ততক্ষণে সরিয়ে ফেলে পাথরের উপর থেকে রক্তের চিহ্ন ধুয়ে ফেলা হয়েছে, তার মাথায় তখনও আনারকলির শোকাবহ ঘটনাই ঘুরপাক খায়। আকবর কি এতটাই উদাসীন আর নির্মম লোক ছিলেন? অন্যেরা তার সম্বন্ধে এমন কথা বলে না এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর আব্বাজানও তাকে এভাবে মনে রাখেন নি। গিয়াস বেগ সবসময়ে মৃত সম্রাটের প্রশংসা করেন এবং বিশেষ করে শাসনকার্য পরিচালনার সময় তিনি যে ন্যায়পরায়ণতা আর ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। আকবর ক্রোধের বশবর্তী হয়ে সম্ভবত আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন এবং একজন সম্রাট হিসাবে নিজের ভাগ্যের উপরে সামান্য নিয়ন্ত্রণের অধিকারী একজন দুর্বল নারীর উপরে এমন আক্রোশপূর্ণ প্রতিশোধ নেয়া থেকে বিরত থাকার বদলে আতে ঘা লাগা একজন সাধারণ মানুষের মত আচরণ করেছেন।

জাহাঙ্গীর… নিশ্চিতভাবে সেই এখানে সবচেয়ে বেশি দোষী? তাঁর চরিত্র সম্বন্ধে এই গল্পটা থেকে সে কি বুঝতে পারে? এটাই বলে যে সে একাধারে হঠকারী, আবেগপ্রবণ আর স্বার্থপর কিন্তু সেই সাথে সে অমিত সাহসী এবং শক্তিমান প্রেমিক। সে পুরো দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে আনারকলিকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিল। সে যখন সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে তখন তাকে আরও কষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে তাঁর পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল সে তাই করেছে। মেহেরুন্নিসা তাঁর চমৎকার দৈহসৌষ্ঠব তাঁর চোখের সেই আবেগঘন চাহনি যা তাঁর সামনে নাচার সময় তাকে বাধ্য করেছিল মুখের নেকাব ফেলে দিতে। পুরো ব্যাপারটাই অদ্ভূত, কিন্তু আনারকলির প্রতি তাঁর অভিশপ্ত ভালোবাসার গল্প কোনোভাবে তাকে তার দৃষ্টি ছোট করে না–বরং প্রায় উল্টো হয়। পৌরুষদীপ্ত শক্তিতে ভরপুর আর এত অমিত ক্ষমতার অধিকারী এমন একটা মানুষের সাথে জীবন কাটান কতটা রোমাঞ্চকর হতে পারে।

একান্ত অনাহূতভাবে অন্যান্য আরো সংযত ভাবনাগুলো প্রায় একই সাথে উঁকি দিতে শুরু করে। আনারকলির গল্প আর তাঁর নিজের ভিতরে কি মনোযোগ নষ্টকারী সাদৃশ্য নেই? জাহাঙ্গীর আনারকলিকে মাত্র একবার দেখেছিলেন এবং সেটাই আনারকলিকে নিজের করে পাবার জন্য তাকে মরীয়া করে ভোলার জন্য যথেষ্ট ছিল এবং তাকে পাবার জন্য তার প্রয়াস ছিল নির্মম। মেহেরুন্নিসাকেও তিনি কেবলই একবারই দেখেছিলেন এবং সেটা আনারকলির মৃত্যুর খুব বেশি দিন পরে নয় এবং তিনি তাকেও পেতে চেয়েছিলেন। সে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে দুটো ব্যাপার এক নয়। জাহাঙ্গীর প্রকাশ্যে এবং যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাঁর আব্বাজানের কাছে তার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। তাঁর আব্বাজান যখন সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল তিনি সেটা মেনেও নিয়েছিলেন। তিনি কি আসলেই মেনে নিয়েছিলেন?

 মেহেরুন্নিসার মস্তিষ্ক এখন ঝড়ের বেগে কাজ করতে শুরু করে। কাবুল থেকে গিরিপথের ভিতর দিয়ে সমভূমিতে নামার সময় তার পাশ দিয়ে অতিক্রমকারী নীল-চোখের সেই অশ্বারোহীকে অনাদিষ্টভাবে সে তার চোখের সামনে আরো একবার দেখতে পায়। সেই সময়ে, সে লাডলির আয়া ফারিশাকে বলেছিল, একটা ভয়ঙ্কর আর ততদিনে ভুলে যাওয়া একটা গুজব, লোকটা কে খুঁজে বের করতে। মাত্র দুই দিন পরেই মেয়েটা তাকে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে জানায় যে নীল চোখের অধিকারী একজন বিদেশী সৈন্য আদতেই দেহরক্ষীদের ভিতরে রয়েছে–একজন ইংরেজ যাকে সম্রাট সম্প্রতি নিয়োগ করেছেন। সেই সময়ে এই সংবাদটা শুনে মেহেরুন্নিসা নিজেকে বুঝিয়ে ছিলেন যে ফারিশার কোথাও ভুল হয়েছে। শের আফগানের কথিত আততায়ী একজন পর্তুগীজ। তাছাড়া, সে নিজেকে আরও বোঝাতে থাকে, এই ফিরিঙ্গিগুলোকে দেখতে প্রায়শই একইরকম লাগে এবং সে আধো আলোকে আর ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কয়েক পলকের জন্য তার স্বামীর আততায়ীকে দেখেছিল। কিন্তু সে এখনও মনে মনে ব্যাপারটা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাঁর স্বামীর গলায় খঞ্জর চালাবার সময় ধুসর চোখের সেই দৃষ্টি সে কীভাবে ভুলে যাবে বা সে যখন সেই চোখ আবার দেখবে তখন কীভাবে তার ভুল হবে?

কিন্তু মেহেরুন্নিসা এখন চিন্তা করে সে কি আসলেই সত্যের কাছাকাছি পৌঁছেছে। আনারকলিকে জাহাঙ্গীর কামনা করতেন এবং তাকে পাবার জন্য তিনি কোনো বাধাই মানেননি। তিনি যদি তাকে, মেহেরুন্নিসাকে, কামনা করে থাকেন, তাহলে তিনি কেন কম নির্দয় হবেন? মেহেরুন্নিসা দ্বিতীয়বারের মত কেঁপে উঠে কিন্তু এবার মৃত রক্ষিতার বদলে তাঁর নিজের কথা চিন্তা করে। জাহাঙ্গীর তাকে এতটাই কামনা করে ভাবতেই ব্যাপারটা তাঁর দেহে শিহরণ তোলে, কিন্তু আনারকলির ভাগ্য দেখে এটাও বুঝতে পারে যে রাজপরিবারের সাথে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পুরষ্কারের পাশাপাশি বিপদও বয়ে আনতে পারে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *