১.৩ এক বিধবা নারী
‘আপনার স্বামীর মৃতদেহ গোসল করিয়ে আমরা তাকে দাফনের জন্য প্রস্তুত করেছি, হেকিম এসে বলেন। আমি ভেবেছিলাম যে আমরা তাকে কফিনে শোয়াবার পূর্বে আপনার আদেশ অনুযায়ী সবকিছু যে ঠিকমত পালিত হয়েছে আপনি সে বিষয়ে নিজেকে নিশ্চিত করতে চাইবেন।’
‘ধন্যবাদ।’ মেহেরুন্নিসা সামনে এগিয়ে আসেন এবং তাঁর স্বামীর মৃতদেহের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। অনুগ্রহ করে আমাকে একটু একা থাকতে দিন…’ তাকে যখন সবাই একা রেখে যায় সে মৃতদেহের উপর ঝুঁকে আসে এবং শের আফগানের মুখটা খুটিয়ে দেখে, যা এমন নৃশংসভাবে মৃত্যুবরণ করা একজন লোকের তুলনায় বেশ প্রশান্ত দেখায়। হেকিম আর তার সহকারীরা মৃতদেহ পরিষ্কার করার সময় কর্পূর দেয়া যে পানি ব্যবহার করেছে মেহেরুন্নিসা তাঁর রুক্ষ গন্ধ টের পায়।
‘আপনাকে এভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে বলে আমি সত্যিই দুঃখিত, সে ফিসফিস করে আপন মনে বলে, কিন্তু আমি মোটেই দুঃখিত নই আপনার কবল থেকে আমি মুক্তি পেয়েছি। আততায়ী যদি আপনার বদলে আমায় হত্যা করতো আপনি হয়তো ব্যাপারটা পরোয়া করতেন না। সে এক মুহূর্তের জন্য তার স্বামীর গালে আঙুলের অগ্রভাগ দিয়ে স্পর্শ করে। ‘আপনার ত্বক এখন শীতল কিন্তু আপনি সবসময়ে আমার এবং আমার কন্যার প্রতি শীতল অভিব্যক্তি প্রদর্শন করেছেন, ছেলে না হয়ে জন্মাবার জন্য আপনার কাছে যার কোনো গুরুত্বই ছিল না…’
মেহেরুন্নিসা চোখের কোনে কান্নার রেশ অনুভব করে, কিন্তু এই কান্না শের আফগানের জন্য নয়। সে যদিও আত্ম-করুণা অপছন্দ করে তবুও অক্ষর উপস্থিতি তাঁর নিজের জন্য এবং এমন একজন লোকের সাথে অতিবাহিত জীবনের নষ্ট সময়ের জন্য যে তার দেয়া যৌতুক কুক্ষিগত করার পরে তাকে নিজের বাসনা আর ক্ষমতা প্রদর্শন করার একটা বস্তুতে পরিণত করেছিল। লোকটার সাথে যখন তাঁর বিয়ে হয়েছিল তখন তার বয়স মাত্র সতের বছর। তাঁর প্রতি বিয়ের পরে লোকটার নিশ্চেতন উদাসীনতা বা–সে যদি কখনও অভিযোগ করার স্পর্ধা দেখাত–তাঁর রীতিবিবর্জিত আর দুর্বিনীত নিষ্ঠুরতার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে এবং সে অসুস্থবোধ করে। আততায়ীর হামলার পরে ছয় ঘন্টাও এখনও অতিবাহিত হয়নি। তাঁর মানসপটে পুরো দৃশ্যটা এখনও দগদগে আর প্রাণবন্ত হত্যাকারীর চোখ-পারস্যের মার্জারের মত ধুসর নীল রং–সে যখন তাঁর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তার খঞ্জরের ফলার রূপালী ঝিলিক, শের আফগানের কণ্ঠনালীর ক্ষতস্থান থেকে তার নগ্ন দেহে ছিটকে আসা উষ্ণ লাল রক্ত, তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে তার স্বামীর মুখে ফুটে উঠা নিখান বিস্ময়। পুরো ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে সে তখন ভয় পাবার সময়ই পায়নি, কিন্তু এখন যখন তার মনে হয় যে খুনী ইচ্ছা করলেই নিজের রক্তাক্ত খঞ্জর তার দিকে তাক করতে পারতো সে শিহরিত হয়। তরুণ দ্বাররক্ষীকে হত্যা করার সময় আততায়ী ক্ষনিকেন জন্য দ্বিধা করে নি…
অনুগত সৈন্যরা ইতিমধ্যে শহর তন্ন তন্ন করে হত্যাকারীর সন্ধান করেছে। তাঁর বর্ণনা থেকে একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে যে হত্যাকারী যেই হোক লোকটা ভিনদেশী। একজন নীল চোখঅলা লোকের সন্ধান ইতিমধ্যেই পাওয়া গিয়েছে–কারও মতে লোকটা পর্তুগীজ-শহরের সরাইখানায় লোকটা গত বেশ কয়েকদিন ধরেই অবস্থান করছিল কিন্তু এখন একেবারে যেন বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে… গ্রীষ্মের নিদাঘ তপ্ত দিন হওয়া সত্ত্বেও মেহেরুন্নিসা উষ্ণতার জন্য নিজেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে, সে তাঁর স্বামীর মৃতদেহের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ায় এবং সে যখন কিছু চিন্তা করতে চায় তখন যেভাবে পায়চারি করে সেভাবে হাঁটতে থাকে। তার কাছে হত্যাকারীর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার অভিপ্রায়। হত্যাকাণ্ডটা কি বড় কোনো অভ্যুত্থানের পূর্বাভাষ? গৌড় কি অচিরেই আক্রমণের সম্মুখীন হবে? যদি তাই হয়, তাহলে তাঁর নিজের এবং তাঁর কন্যার জীবনও হয়তো হুমকির সম্মুখীন হবে।
বা এমনও হতে পারে শের আফগানের মৃত্যু কারো ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার ফসল? তাঁর স্বামী প্রচুর শত্রু তৈরি করেছিলেন। সে প্রায়ই তার কাছে দম্ভোক্তি করতে কীভাবে সে নিজেকে ধনী করতে রাজকীয় অর্থ তছরূপ করার পাশাপাশি প্রজাদের কাছ থেকে নিজের এক্তিয়ারের বেশি খাজনা আদায় করেছে। সে তাকে আরও বলেছিল গৌড়ের উত্তরের ডাকাত সর্দারদের অবাধে ডাকাতির সুযোগ দিয়ে কীভাবে তাঁদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছিল, এবং মেহেরুন্নিসা জানে যে গত বর্ষা মওসুমে বৃষ্টি শুরু হবার ঠিক আগ মুহূর্তে, বেশ কয়েকজন ধনী বণিক আগ্রায় অভিযোগ জানাতে তাঁদের চাপে পড়ে, সে তার কথার বরখেলাপ করে অবিশ্রান্তভাবে ডাকাতদের ধাওয়া করতে শুরু করেছিল এবং সে যাদের হত্যা করেছিল হুশিয়ারী হিসাবে তাদের ছিন্ন মস্তক শহর রক্ষাকারী প্রাচীরের উপরে গেঁথে রেখেছিল। শের আফগান নিহত হওয়ায় অনেক লোকই খুশি হয়েছে, কিন্তু তাকে তার নিজের শয়নকক্ষে হত্যা করার মত সাহস কার হতে পারে?
কক্ষের বাইরে থেকে বেশ কয়েকটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে–শবাধারের নির্মাতারা সম্ভবত শবদেহের মাপ নিতে এসেছে–মেহেরুন্নিসা জোর করে এসব ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনে। আগামী দিনগুলোতে সে অবশ্যই তার নিজের এবং তাঁর মেয়ের প্রতি কোনো ধরনের হুমকির বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে একজন শোকাতুর বিধবার ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে। তার পরিবারের সম্মানের বিষয়টা এর সাথে জড়িয়ে আছে। সে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কৃত্যানুষ্ঠান একজন বিবেকবান স্ত্রীর মতই পালন করবে এবং তাকে দেখে কারো মনে কোনো ধরনের সন্দেহের উদ্রেক হবে না যে নিজের অন্তরে সে মুক্তির আনন্দ ছাড়া কোনো রকমের দুঃখ অনুভব করছে না।
*
জাহাঙ্গীরের নিভৃত কক্ষে ধুলিতে আচ্ছাদিত চুল নিয়ে ভ্রমণজীর্ণ বার্থোলোমিউ হকিন্স উপস্থিত হয়। যদিও মাঝরাত অতিক্রান্ত হতে চলেছে, ফিরিঙ্গি লোকটার আগমনের সংবাদ শুনে জাহাঙ্গীর তার খবরের জন্য অস্থির হয়ে রয়েছে।
‘বেশ, কি অবস্থা বলো?
‘সুলতান, কাজটা সম্পূর্ণ হয়েছে। আমি নিজ হাতে তার কণ্ঠনালী চিরে দিয়েছি।’
‘কেউ তোমাকে দেখে ফেলেনি তো?
‘তাঁর শয্যাসঙ্গী এক রমণী ছাড়া আর কেউ দেখতে পায়নি।’
জাহাঙ্গীর পলকহীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, মুখে সহসা ভীতিবিহ্বল অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। তুমি তার কোনো ক্ষতি করোনি?
না, সুলতান।
‘তুমি পুরোপুরি নিশ্চিত?
‘আমি আমার জীবনের দিব্য করে বলতে পারি।’
বার্থোলোমিউর চেহারায় ফুটে উঠা বিমূঢ়তা জাহাঙ্গীরের দৃষ্টি এড়ায় না। স্পষ্টতই বোঝা যায় লোকটা সত্যি কথাই বলছে। সে ক্রমশ স্বস্তির সাথে শ্বাস নিতে আরম্ভ করে। তুমি তোমার দায়িত্ব ভালোমতই পালন করেছে। আগামীকাল সকালে আমার কচিদের একজন তোমাকে তোমার অর্থ পৌঁছে দেবে…’ তাঁর মনে সহসা অন্য একটা ভাবনা খেলা করতে সে কথা শেষ করে না। তুমি এখন কি করবে বলে ঠিক করেছো? নিজের দেশে ফিরে যাবে?
‘সুলতান, আমি ঠিক নিশ্চিত নই।’
‘তুমি যদি আমার দরবারে অবস্থান করো তাহলে আমি তোমাকে আরও অনেক কাজ দিতে পারি। তুমি যদি আমার অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমত পালন করো যা তুমি ইতিমধ্যেই একবার করেছো, তুমি নিজের জাহাজ কিনে দেশে ফিরে যাবার মত ধনী আমি তোমায় করে দিতে পারি।’ বার্থোলোমিউ হকিন্সের রোদে পোড়া মুখ থেকে তার সমস্ত ক্লান্তি মুছে গিয়ে সহসা তাঁর চোখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। জাহাঙ্গীর মনে মনে ভাবে, সে একসময় যেমন বিশ্বাস করতো মানুষকে বুঝতে পারাটা আসলে ততটা কঠিন নয়।
*
শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে পর্যাপ্ত সংখ্যক গালিচা আর পশমের কম্বল থাকা সত্ত্বেও, মেহেরুন্নিসাকে খাইবার গিরিপথের ভিতর দিয়ে কাবুল অভিমুখে বহনকারী গরুর গাড়িটা মোটেই আরামদায়ক ছিল না। সে বাংলা থেকে শুরু হওয়া এই দীর্ঘ যাত্রাটা কখন শেষ হবে সেই অপেক্ষা করছে। তাঁর মেয়ে লাডলী বেগম, ফারিশার কোলে মাথা রেখে, মেয়ের লালনপালনের জন্য নিয়োজিত পার্সী মহিলা, যে জন্মের সময় থেকে তাঁর তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্বে রয়েছে, অঘোরে ঘুমিয়ে আছে। বাচ্চা মেয়েটা নদীপথে নৌকায় গঙ্গার উপর দিয়ে পশ্চিমমুখী এবং তারপরে যমুনা নদীর উপর দিয়ে উত্তরমুখী যাত্রা খুবই উপভোগ করেছিল, কিন্তু শেষ ছয়শ মাইল স্থলপথে ভ্রমণের জন্য তাঁরা দিল্লির কাছে নৌকা থেকে অবতরণের পর থেকেই মেয়েটা ক্রমশ খিটখিটে হয়ে উঠেছে। গরুর গাড়ির ছইয়ের অভ্যন্তরে চতুর্দিক মোটা পর্দা দিয়ে ঘেরা থাকায়, ভিতরটা শ্বাসরুদ্ধকর আর অন্ধকার। ছয় বছরের লাডলী বেগমের এখনও বোঝার বয়স হয়নি যে তাঁদের সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে রাখতে অবশ্যই পর্দা টানা থাকতে হবে। দিনের শেষে যাত্রা বিরতি করতে যখন অস্থায়ী ছাউনি স্থাপন করা হয় মেয়েটা কেবল সেই সময়টুকু খানিকটা উপভোগ করে এবং কাঠের উঁচু অস্থায়ী কাঠামো দিয়ে মেয়েদের জন্য পৃথক করা স্থানে সে তখন কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করতে পারে।
কিন্তু তারা অন্ততপক্ষে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। তারা মওসুমের প্রথম তুষারপাতের পূর্বেই গিরিপথ অতিক্রম করবে। শীতের প্রকোপ কাবুলে ভীষণ তীব্র। মেহেরুন্নিসার তাঁর বাবার বাড়ির ছাদের প্রান্তদেশে মানুষের হাতের মত মোটা ঝুলন্ত তুষারিকার কথা এখনও মনে আছে এবং শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের বাইরে তুষার শুভ্র বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে মাঝে মাঝে খাবারের সন্ধানে ক্ষুধার্ত নেকড়ে ছাড়া আর বেশি কিছু চলাফেরা করতো না। যদিও বাংলার উষ্ণ আর স্যাঁতসেঁতে বাতাসের মাঝে গালে কনকনে শীতল বাতাসের স্পর্শ পেতে এবং শ্বাস নেয়ার সময় হিমশীতল বাতাসের কুণ্ডলী দেখতে তার বহুবার ইচ্ছে হয়েছে।
সে যখন গৌড় ত্যাগ করে রওয়ানা হয়েছিল তখনও শের আফগানের হত্যাকারীর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি এবং হত্যাকাণ্ডের পেছনের অভিপ্রায় সম্বন্ধেও কোনো কিছু জানা যায় নি। পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ থাকায় সে স্বস্তি পেয়েছিল এবং একই সাথে গৌড় এখন তাদের থেকে বহুদূরে থাকায় সে খুশি। তাঁর দীর্ঘ যাত্রার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি তাঁর আব্বাজানই গ্রহণ করবেন বলে সে আশা করেছিল এবং সে কারণেই তিনি যখন তাকে চিঠি লিখে জানান যে গৌড়ের পশ্চিমে গঙ্গার তীরে মুঙ্গের দূর্গ থেকে রাজকীয় সৈন্যের একটা বহর কাবুল পর্যন্ত পুরোটা পথ তার সাথে অবস্থান করবে সে তখন সত্যিই বিস্মিত হয়েছিল। মহামান্য সম্রাট তোমার দুঃখ ভারাক্রান্ত পরিস্থিতিতে তোমার জন্য শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁর ইচ্ছা তুমি দ্রুত আর নিরাপদে তোমার পরিবারের কাছে ফিরে আসো, তার আব্বাজান চিঠিতে লিখেছিলেন। সম্রাট আমাকে আমার প্রত্যাশার অতীত অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন। তোমার জন্য আমার আশীর্বাদ রইল। চিঠিতে গিয়াস বেগের দস্ত খত আর কাবুলের কোষাধ্যক্ষের বিশাল সীলমোহর দিয়ে সেটা বাঁধা ছিল।
মেহেরুন্নিসা, তাঁর দীর্ঘ যাত্রা পথে, প্রায়শই তাঁর আব্বাজানের কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করেছে। তাঁদের পরিবারের প্রতি সম্রাটের এই উদারতার উৎস সম্ভবত কাবুলে বর্তমান সম্রাটের, তখন তিনি যুবরাজ, অতিবাহিত সেই মাসগুলোতে নিহিত যখন তার আব্বাজান সম্রাট আকবর-তাকে সেখানে নির্বাসিত করেছিলেন। যুবরাজের আগমনের বহু পূর্বেই গুজব ছড়িয়ে গিয়েছিল, আকবরকে ভীষণভাবে ক্রুদ্ধ করেছিলেন জাহাঙ্গীর। কাবুলের শাসনকর্তা, সাইফ খানের স্ত্রী মেহেরুন্নিসার আম্মিজানকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে ছিল যে আসলেই কি ঘটেছিল–যুবরাজ তার আব্বাজানের একজন উপপত্নীর সাথে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়েছিলেন। তাকে নির্বাসিত করে শাস্তি দেয়া হলেও মেয়েটার কপালে জুটেছিল মৃত্যুদণ্ড…
তার আব্বাজানের বাড়ির নিয়মিত অতিথিতে পরিণত হয়েছিলেন যুবরাজ। শহরের দূর্গপ্রাসাদ থেকে যুবরাজের রওয়ানা হবার সংবাদ নিয়ে বার্তাবাহক যখন উপস্থিত হতো তখন তাঁদের প্রস্তুতির কথা এখনও তাঁর দিব্যি মনে আছে–কীভাবে তাঁর আম্মিজান ধূপদানিতে মূল্যবান ধূপ জ্বালাতে আদেশ দিতেন, কীভাবে তাঁর আব্বাজান নিজের দামী আলখাল্লাগুলোর একটা পরিধান করতেন এবং তাকে অভ্যর্থনা জানাতে দ্রুত প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে যেতেন। একটা রাতের কথা তাঁর বিশেষভাবে মনে আছে তার আব্বাজান–যিনি তাকে কোনো আভাসই দেননি তিনি কি চান সে সম্বন্ধে–তাদের সম্মানিত অতিথির জন্য পারস্যের ধ্রুপদী নাচের একটা প্রদর্শনের জন্য তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর পরিচারিকার দল তার চুল ভালো করে বেঁধে আর সুগন্ধি ধোয়া দিয়ে সুরভিত করলে সে বিচলিত বোধ করার সাথে সাথে উত্তেজিতও হয়েছিল। সে সোনালী বৃক্ষের নৃত্য প্রদর্শন করেছিল, তার দু’হাতে বাঁধা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সোনালী ঘন্টা, শরতে গাছ থেকে বনের মাটিতে ঝরে পড়া সোনালী পাতায় আসন্ন শীতের হিমশীতল বাতাসের দ্বারা সৃষ্ট আলোড়ন প্রতীকায়িত করেছিল।
সে নাচের মুদ্রা ঠিক করতে এতই মগ্ন ছিল–ভীষণ জটিল একটা নাচ যা নিখুঁত করতে সে তাঁর ওস্তাদজির কাছে ঘন্টার পর ঘন্টা অভ্যেস করেছে–যে নাচের শুরুতে সে সরাসরি যুবরাজের দিকে তাকায়নি। তারপরে যখন, নাচের আবেশ তাকে আচ্ছন্ন করতে আরম্ভ করে, সে যুবরাজের চোখের দিকে নিজের চোখ তুলে তাকায়, মেহেরুন্নিসা তার দৃষ্টির ঐকান্তিকতা অনুভব করতে পারে। সেই সময়ে সে কোনো কারণে বুঝতে পারে নি এবং এখন, এত বছর পরেও, ব্যাপারটা বোধগম্যতার বাইরেই রয়েছে, সে তার নেকাব ইচ্ছে করেই ফেলে দিয়েছিল। তিন বা চারবারের জন্য এর বেশি নয়–সে যুবরাজকে নিজের মুখ দেখতে দিয়েছিল এবং সে জানে তিনি এতে খুশিই হয়েছিলেন।
সম্রাট আকবর এর কিছু দিন পরেই, নিজের সন্তানকে আগ্রা ফিরে আসবার আদেশ দেন। মেহেরুন্নিসাও ততদিনে শের আফগানের সাথে তাঁর আসন্ন বিয়ের নানা ভাবনায় আপ্লুত হয়ে পড়েছে। মোগল রাজদরবারে কপর্দকশূন্য অবস্থায় আগত এক পার্সী অভিজাত ব্যক্তির মেয়ের জন্য এরচেয়ে উপযুক্ত সম্বন্ধ আর হতে পারে না। সম্রাটের অধীনে চাকরি এবং কাবুলের উপর দিয়ে অতিক্রমকারী বণিকদের সাথে বিভিন্ন ব্যবসায়ী উদ্যোগের কারণে তাঁর আব্বাজান যদিও যথেষ্ট সম্পদ অর্জন করেছিলেন, নিজের মেয়েকে তিনি বিশাল যৌতুক দিতে পারলেও–দশ সহস্র সোনার মোহর–তাঁর নিজের কোনো জমি, কোনো বিশাল মহল ছিল না। শের আফগান অন্য দিকে প্রাচীন এক মোগল অভিজাত বংশের সন্তান, তাঁর প্রপিতামহ বাবরের সাথে, প্রথম মোগল সম্রাট, তার হিন্দুস্তান অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। মেহেরুন্নিসা তাঁর আসন্ন বিয়ের প্রস্তুতির জন্য সে যুবরাজকে–বা সম্রাটকে যা এখন তিনি–জোর করে নিজের মনের এক কোণে সরিয়ে দিয়েছিল: সত্যি হতে পারতো এমন এক মধুর বাঁধনহারা কল্পনা।
গরুর গাড়িটা সহসা সশব্দে কম্পিত হয়। মেহেরুন্নিসা ভাবে, গাড়ির সামনের কোনো একটা চাকা হয়ত বড় কোনো শিলাখণ্ডের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। এই যাত্রাটা যখন শেষ হবে সে তখন আন্তরিকভাবেই খুশি হবে।
*
মেহেরুন্নিসা তাঁর আব্বাজান তার জন্য তাবরিজ থেকে সম্প্রতি আগত এক বণিকের কাছ থেকে পার্সী কবি ফেরদৌসের সংগৃহীত কবিতার যে খণ্ডটা ক্রয় করেছেন একপাশে সরিয়ে রাখে, উঠে দাঁড়ায় এবং আড়মোড়া ভাঙে। কোনো একটা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে, সে তার আব্বাজানের বাসার সমতল ছাদে উঠতে শুরু করে, মেহেদী দেয়া নাঙা পায়ের নিচে পাথরের নিচু ধাপের উষ্ণতা সে দারুণ উপভোগ করে। সে ছাদে উঠে প্রথমেই উত্তরের দিকে তাকায়। তুষারাবৃত পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে সেখানে শহরের তত্ত্বাবধায়নে পাহাড়ের রুক্ষ চূড়ায় স্থাপিত ভয়ালদর্শন দূর্গপ্রাসাদ অবস্থিত।
সে গৌড়ে থাকাকালীন সময়ে প্রায়ই এই স্থাপনাটার কথা ভাবতো–এর নিরেট শক্তিশালী দেয়ালের ক্ষুদ্রাকৃতি রন্ধগুলোর কাবুলের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা চোখের সাথে কি ভীষণ মিল। দূর্গপ্রাসাদটা যদিও শাসনকর্তার বাসভূমি, তাঁর আব্বাজান তাকে বলেছে স্থাপনাটার কোথাও বিলাসিতার নামগন্ধও খুঁজে পাওয়া যাবে না–বাবরের আগমনের বহু পূর্বে নির্মিত পাথরের শীতল একটা দূর্গ যেখান থেকে বাবর তাঁর হিন্দুস্তান অভিযান সূচনা করেছিলেন। সে যাই হোক তার ইচ্ছা এমন বিশাল একটা উচ্চাকাঙ্খ যেখানে অঙ্কুরিত হয়েছিল সেই স্থানটার ভেতরটা সে যদি একবার ঘুরে দেখতে পেতো। বিজয়ের অভিপ্রায়ে আয়োজিত যুদ্ধযাত্রায় দূর্গপ্রাসাদের ভিতর থেকে মোগল সৈন্যের স্রোত বের হয়ে আসছে যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বদলে দেবে নিশ্চয়ই সেটা দেখার মতই একটা দৃশ্য ছিল? নিজের উচ্চাকাঙ্খকে বাস্তবে রূপান্তরিত হতে দেখে বাবরের অভিব্যক্তি কেমন হয়েছিল?
এবং সে কি কখনও সত্যিই হুসটা বুঝতে পারবে? সে যদি তার বড়ভাই আসফ খানের মত, এখন শাহী সেনাবাহিনীতে একজন সেনাপতি এবং এখান থেকে হাজার মাইল দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যে একটা অভিযানের দায়িত্ব পালন করছেন, বা তার ছোটভাই মীর খানের মত, গোয়ালিওরের শাহী সেনানিবাস যেখানে সম্রাটের সন্তান খসরুকে অন্তরীণ রাখা হয়েছে সেখানে দায়িত্ব পালন করছে, একজন পুরুষ হিসাবে জন্ম গ্রহণ করতো, সে তাহলে হয়তো পৃথিবীর আরো অনেক কিছু দেখতে পেতো, আরো অনেক বেশি কিছু বুঝতে পারতো… তার আব্বাজানও তাহলে সম্ভবত পারস্য থেকে আগ্রা অভিমুখে বিপদসঙ্কুল যাত্রাপথে জন্মের সাথে সাথে তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে পথের মাঝে পরিত্যাগ করতো না, কাজটা করতে তাঁর যতই অনিচ্ছা থাকুক, এবং ভাগ্য আর একজন বন্ধুবৎসল বণিক তাকে উদ্ধারের সুযোগ দিলে তিনি তখন যতই আনন্দিত হোন। তাঁর প্রতি আব্বাজানের ভালোবাসার চেয়ে তিনি সেই মুহূর্তে নিজের নিরাপত্তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন এই ভাবনাটা–এবং সে ভালো করেই জানে বাবা-মা দুজনেই তাকে ভীষণ ভালোবাসে–এমন একটা ব্যাপার যা সবসময়েই তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। বাংলায় তার তিক্ত অভিজ্ঞতা এর সাথে যুক্ত হতে, সে জানে, মানুষ আর তাঁদের অভিপ্রায়ের বিষয়ে তাঁর মাঝে নৈরাশ্যবাদী একটা মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। সঙ্কটকালে খুব কম মানুষই নিজেকে ছাড়া অন্য আর কিছু ভাববার সামর্থ্য রাখে।
আর তাছাড়া, একজন রমণীর জীবন, তাঁর নিজের জীবন, এখানে তাঁর আব্বাজানের বাসায় কিংবা পরবর্তীতে গৌড়ে অবস্থান কালে শের আফগানের হেরেমে, যেখানেই হোক ভীষণ সীমাবদ্ধ। সে যখন থেকে বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে তার দারুণ কৌতূহল… পশ্চিমে তাঁদের পরিবারের আদি বাসস্থান পারস্য সম্বন্ধে আর কীভাবে শাহ্ সেই সাম্রাজ্য শাসন করেন; উত্তর-পূর্বদিকে সমরকন্দের গম্বুজ আর মিনারগুলোয় আসলেই কি সে গল্পগাথায় যেমন শুনেছে নীল, সবুজ আর সোনালী রঙ ঝিলিক দেয়। তাঁর আব্বাজান–সে যখন তাকে জোর করে তার নথিপত্রের সামনে থেকে তুলে আনতে পারতো–তার প্রশ্নের যথাসাধ্য উত্তর দিতে চেষ্টা করতেন কিন্তু সে আরো অনেক বেশি কিছু জানতে চায়। পাঠাভ্যাস তার হতাশা প্রশমিত করতে সাহায্য করেছে। গৌড়ে স্বপ্নভঙ্গের প্রথম ধাক্কা সামলে নেয়ার পরে শের আফগানের সাথে জীবন অনেক সহনীয় করে তুলেছিল তাঁর সংগৃহীত পাণ্ডুলিপিগুলো। কিন্তু পাণ্ডুলিপিগুলো সেই সাথে তাঁর অস্থিরতা, তাঁর অসন্তোষও বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার পঠিত সবকিছু–পর্যটকের রোজনামচা, এমনকি কবিতা–তার আগে থেকেই প্রাঞ্জল কল্পনাকে আরো উদ্দীপিত করে, ইঙ্গিত দেয় জীবন গৌড়ে সেনাপতির হারেমে ভালোবাসাহীন সহবাস কিংবা তার পৈতৃক বাড়িতে ঘরোয়া আনন্দফুর্তির চেয়েও অনেক বেশি সম্ভাবনায় উদ্বেল।
সে সহসা নিচের আঙিনায় একটা হৈচৈ এর শব্দ শুনতে পায়। মেহেরুন্নিসা ছাদের উপর দিয়ে লাল আর কমলা রঙের পর্দার দিকে দ্রুত হেঁটে গিয়ে যা পথচারীদের দৃষ্টি থেকে আঙিনা সংলগ্ন ছাদের অংশটা ঘিরে রেখেছে, উঁকি দিয়ে নিচে তাকায়। একজন সেনাপতি আর নিশানা-বাহকের নেতৃত্বে রাজকীয় অশ্বারোহীদের একটা বহর নিচের আঙিনায় প্রবেশ করছে। অশ্বারূঢ় সৈন্যরা ঘোড়া থেকে নামতেই তাঁর আব্বাজানের সহিসেরা বাড়ির ভেতর থেকে দ্রুত বের হয়ে এসে লাগামগুলো ধরে এবং কিছুক্ষণ পরেই স্বয়ং গিয়াস বেগের কৃশকায় দীর্ঘদেহী অবয়ব সেখানে উপস্থিত হয়। চকিতে মাথা নত করে এবং ডানহাতে নিজের বুক স্পর্শ করে সে সেনাপতিকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যায়। লোকগুলো কেন এসেছে? সে মনে মনে ভাবে।
আগত অন্য সৈন্যরা আঙিনার চারপাশে হাঁটাহাঁটি শুরু করে, গল্পগুজব আর হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠে আর বৃদ্ধ ফল বিক্রেতার কাছ থেকে কেনা আখরোট–তাঁর মুখের বলিরেখার মতই তাঁর বিক্রীত বাদামগুলো কোঁচকানো–ভেঙে খুঁটে খুঁটে খেতে থাকে, যে সচরাচর সেখানেই নিজের পসরা সাজিয়ে বসে। কিন্তু সে যতই কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করুক তাদের কোনো কথাই বুঝতে পারে না। সময় অতিবাহিত হতে থাকায় এবং রাজকীয় সেনাপতি তাঁর আব্বাজানের সাথেই অবস্থান করায়, মেহেরুন্নিসা পুনরায় মেয়েদের আঙিনায় নেমে আসে এবং তাঁর তেপায়ার উপরে বসে পড়ার জন্য আরো একবার পাণ্ডুলিপিটা হাতে তুলে নেয়। আঙিনায় ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ হতে শুরু করতে এবং দু’জন পরিচারিকা তেলের প্রদীপের সলতেয় আগুন জ্বালাতে শুরু করছে তখন মেহেরুন্নিসা তাঁর আব্বাজানের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। মুখ তুলে তাকাতে, সে দেখে তাকে ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছে।
‘আব্বাজান, কি ব্যাপার?
তিনি পরিচারিকাদের চলে যাবার ইঙ্গিত করেন তারপরে লম্বা আঙুলগুলো দিয়ে নীলা বসান সোনার আঙুরীয়টি অস্থির ভঙ্গিতে ঘোরাবার মাঝে, তাঁর পাশে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে পড়েন, সে তার জন্মের পর থেকেই তাকে বাম হাতের তৃতীয় আঙুলে অঙ্গুরীয়টি পরিধান করতে দেখে আসছে। সে পূর্বে কখনও তাঁর আব্বাজানকে–সাধারণত শান্ত আর সংযত–এমন অবস্থায় দেখেনি। তিনি কথা শুরু করার আগে কিছুক্ষণ ইতস্তত করেন, তারপরে এমন একটা স্বরে কথা বলতে শুরু করেন যা মোটেই তাঁর স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর নয়। আমি তোমায় গৌড়ে যে চিঠিটা পাঠিয়েছিলাম তোমার কি সেটার কথা স্মরণ আছে? তোমায় বাসায় পৌঁছে দিতে নিরাপত্তা সহচর হিসাবে রাজকীয় সৈন্য প্রেরণ করায় সম্রাটের উদারতায় আমি যে বিস্মিত হয়েছিলাম…?
‘হ্যাঁ।
‘আমি তোমায় তখন পুরো বিষয়টা খুলে বলিনি…সম্রাটের সম্ভাব্য অভিপ্রায় কি হতে পারে সে সম্বন্ধে আমার একটা ধারণা ছিল।
‘আপনি কি বলতে চাইছেন?
‘এই কাবুল শহরে কয়েকবছর আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল–যার সাথে তোমার একটা সম্পর্ক রয়েছে। আমি বিষয়টা তোমাকে কখনও বলিনি কারণ আমার মনে হয়েছিল বিষয়টা না জানাই তোমার জন্য উত্তম। ঘটনাপ্রবাহ যদি ভিন্ন হতো তাহলে আমি একাই বিষয়টা সম্বন্ধে অবহিত থাকার ব্যাপারটা আমার মৃত্যুর সাথে সাথে করে নিয়ে যেতাম… আমাদের বর্তমান সম্রাট তখনও কেবল একজন যুবরাজ, আমাদের এই কাবুলে নির্বাসিত, সে সময়ে আমি আর তিনি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। আমি যদিও ছিলাম তাঁর আব্বাজানের একজন মামুলি কোষাধ্যক্ষ, আমার মনে হয়েছিল একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হিসাবে তিনি আমার সঙ্গ উপভোগ করেন–আমাকে একজন বন্ধু হিসাবেও হয়ত বিবেচনা করেন। সেজন্যই একরাতে আমি তোমায়, আমার একমাত্র মেয়ে হিসাবে, তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য নাচতে বলেছিলাম। আমার একমাত্র অভিপ্রায় ছিল আমার সাধ্যের শেষপ্রান্তে গিয়ে তাকে শুভেচ্ছাজ্ঞাপন করা। কিন্তু অচিরেই–খুব সম্ভবত পরের দিনই, আমি ঠিক নিশ্চিত নই–তিনি আমার সাথে দেখা করতে আসেন… তিনি কি দাবি করেছিলেন তুমি কি ধারণা করতে পারো? গিয়াস বেগের দৃষ্টিতে ক্ষুরধার তীক্ষ্ণতা।
না।
তিনি তাঁর স্ত্রী হিসাবে তোমায় পেতে চেয়েছিলেন।’
মেহেরুন্নিসা এত দ্রুত উঠে দাঁড়ায় যে তার তেপায়া একপাশে উল্টে যায়। তিনি আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিলেন…?
‘হ্যাঁ। কিন্তু আমি তাকে বলেছিলাম তোমার সাথে ইতিমধ্যে শের আফগানের বাগদান সম্পন্ন হয়েছে–যে আমার পক্ষে কোনোমতেই এই অঙ্গীকারের অবমাননা করা অসম্ভব…’
মেহেরুন্নিসা দু’হাত আঁকড়ে ধরে, বাড়ির ভিতরের আঙিনায় অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে থাকে। তার আব্বাজান জাহাঙ্গীরকে মুখের উপর না বলেছিলেন… বাংলার পূতিগন্ধময় উষ্ণ আবহাওয়ায় অনুভূতিহীন, নিষ্ঠুর শের আফগানের স্ত্রী হবার বদলে সে মোগল রাজদরবারের, সবকিছু যা গুরুত্বপূর্ণ তাঁর কেন্দ্রের কাছাকাছি, এক যুবরাজের স্ত্রী হতে পারতো। কেন? তিনি এটা কীভাবে করতে পারলেন? তাকে এমন নির্মমভাবে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করার পেছনে তার কি অভিপ্রায় কাজ করেছিল? সমস্ত পরিবারের সাথে সাথে তিনি নিজেও এই সম্বন্ধের ফলে উপকৃত হতেন… ‘আমার উপরে তুমি রাগ করেছে এবং সম্ভবত তোমার রাগ করাটা সঙ্গত। আমি জানি শের আফগানের সাথে তোমার বিয়েতে তুমি সুখী হওনি, কিন্তু আমার পক্ষে সেটা আগে থেকে বোঝা সম্ভব ছিল না। আমার মনে হয়েছিল আমি যা করেছি সেটা করা ব্যতীত আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। আর তাছাড়া, যুবরাজ নিজেও তখন তাঁর আব্বাজানের নির্দেশে নির্বাসিত। তোমায় বিয়ে করার জন্য তাকে তার আব্বাজানের অনুমতি নিতে হতো এবং তাঁর পক্ষে তখন অনুমতি লাভ করাটা অসম্ভব ছিল। সেই সময়ে ম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হবার বদলে তাঁর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবারই সমূহ সম্ভাবনা ছিল। সম্রাটের কাছে তার সাথে আত্মীয়তা করার বিষয়টা আমাদের পরিবারের জন্য সুখকর নাও হতে পারতো। গিয়াস বেগ দম নেয়ার জন্য থামেন।
মেহেরুন্নিসার কাছে তাঁর আব্বাজানের মুষলধারে এখনকার এই সাফাই দেয়ার ভিতরে একটা স্ববিরোধিতা চোখে পড়ে। যুবরাজ জাহাঙ্গীরের প্রস্তাব আব্বাজান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের সম্মান বাঁচাতে নাকি নিজের স্বার্থে? কিন্তু সে বেশিক্ষণ ভাববার সময় পায় না তিনি আবার কথা শুরু করেন।
‘আমার অন্য আরো কিছু বলার আছে সেটা আগে শুনে নাও তারপরে তুমি হয়তো আমার প্রতি এত বিরূপ মনোভাব পোষণ করবে না। সম্রাট আমাকে তাঁর রাজকীয় খাজাঞ্চিখানার নিয়ন্ত্রক হিসাবে নিয়োগ দিয়ে, আগ্রা যাবার আদেশ দিয়েছেন। তাঁর আব্বাজানের চোখ সহসা অশ্রুসজল হয়ে উঠে–মেহেরুন্নিসা আগে কখনও তার আব্বাজানের চোখে অশ্রু দেখেনি। ‘গত বিশটা বছর এবং আরো বেশি সময়–আমরা সপরিবারে প্রথম এখানে আসবার পর থেকেই–আমি সবসময়ে সেই মুহূর্তটার কথা ভাবতাম যখন আমাকে আমার গুণাবলীর জন্য স্বীকৃতি দেয়া হবে এবং আমি গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে মনোনীত হবে। আমি সেই আশা ত্যাগ করেছিলাম এবং পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখেছিলাম… কিন্তু আরো বিষয় আছে। সম্রাট লিখেছেন যে তুমি রাজকীয় হেরেমে সম্রাট আকবরের একজন বিধবা পত্নীর সঙ্গিনী হবে। বাছা আমার, আমার মনে হয় না তোমায় তিনি ভুলতে পেরেছেন। এখন তুমি যখন বিধবা আর তিনি একজন সম্রাট, তিনি এখন সেই পদক্ষেপ নিতে পারেন যেটা তিনি যখন কেবল যুবরাজ আর তুমি অন্য আরেকজন লোকের প্রতি অঙ্গীকারবন্ধ থাকায় তখন করতে পারেন নি।
*
ছয়দিন পরের কথা, মেহেরুন্নিসা তাঁর পালকিতে শুয়ে রয়েছে যখন ভারতবর্ষের সমভূমিতে অবতরণের প্রথম পর্যায়ে সংকীর্ণ পাথুরে খুদ গিরিপথের ভিতর দিয়ে তাকে আর তার ঘুমন্ত মেয়ে লাডলী বেগমকে বহনকারী পালকিটা দ্রুত এগিয়ে চলেছে গিলজাই উপজাতির আটজন শক্তসমর্থ লোকের চওড়া নির্ভরযোগ্য কাঁধে পালকির বাঁশের দণ্ড অবস্থান করছে। তাকে ঘিরে রাখা বুটিদার গোলাপি পর্দা বাতাসে আলোড়িত হতে সে এক ঝলকের জন্য বাইরের খাড়াভাবে নেমে যাওয়া, নুড়িপাথরপূর্ণ ঢালে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত চিরহরিৎ ওকের ঝোঁপঝাড় দেখতে পায়। পালকিবাহকেরা প্রায় দৌড়াবার ভঙ্গিতে চলার সময় গান গাইতে গাইতে, তাঁরা পালকির দুলুনিতে একটা নিয়মিত ছন্দ বজায় রেখেছে। সে আশার করে জাহাঙ্গীরের অভিপ্রায়ের বিষয়ে তাঁর আব্বাজানের ধারণাই যেন সত্যি হয়। তার ধারণা সত্যি হোক সেটা সে নিজেও চায় কিন্তু তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সে শিখেছে যে পুরুষমানুষ পরিবর্তনশীল। শের আফগানও তাঁদের বিয়ের প্রথম কয়েকমাস যতক্ষণ তাঁর প্রতি তার আগ্রহ ছিল একজন মনোযোগী স্বামী, স্নেহপরায়ন প্রেমিক ছিলেন… সে হয়তো জাহাঙ্গীরকেও আর মোহিত করতে পারবে না। পুরুষমানুষেরা অল্পবয়সী নারীদেহ পছন্দ করে। সে তখন ছিল ষোল বছরের এক কিশোরী; এখন চব্বিশ বছরের একজন রমণী।
তার ভাবনার জাল ছিন্ন করে তাকে বহনকারী বহরের পেছন থেকে বিপদসঙ্কেতজ্ঞাপক সনির্বন্ধ চিৎকার আর গাদা বন্দুকের গুলির শব্দ ভেসে আসে। তার বেহারারা গান গাওয়া বন্ধ করে তাঁদের অগ্রসর হবার গতি বৃদ্ধি করতে পালকিটা ভীষণভাবে দুলতে আরম্ভ করে। একহাতে লাডলিকে অভয়দানের ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরে সে পর্দার একটা ধার উঁচু করে বাইরে উঁকি দেয় কিন্তু ধুসর নুড়ি আর পাথর ছাড়া সে কিছুই দেখতে পায় না। পুরোটা সময় গাদা বন্দুকের শব্দ আর চিৎকার আরো প্রবল হয় এবং কাছে এগিয়ে আসতে থাকে। তারপরে বহরের পেছন থেকে একজন অশ্বারোহী তীব্রবেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে পালকির পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, এতই কাছ দিয়ে যে সে লোকটার ঘোড়ার ঘামের গন্ধ পায় এবং প্রাণীটার খুরের আঘাতে ছিটকে উঠা ধুলো তাঁর চোখে এসে পড়ে এবং সে কাশতে শুরু করে। লোকটা চিৎকার করছে, মালবাহী বহরে ডাকাতেরা হামলা করেছে। তিনজন মানুষ আর দুটো মালবাহী উট ভূপাতিত হয়েছে। সেখানে দ্রুত আরো সৈন্য প্রেরণ করো!’
মেহেরুন্নিসা তার চোখ থেকে ধুলো ঘষে ফেলে পিছনের দিকে তাকায় কিন্তু তার দৃষ্টি থেকে মালবাহী বহরটা ফেলে আসা পথের একটা তীক্ষ্ণ বাকের আড়ালে অদৃশ্য হয়েছে। এই গিরিপথগুলো বর্বর আফ্রিদি উপজাতির কারণে কুখ্যাত যারা পর্যটকদের ছোট ছোট বহর লুণ্ঠন করে থাকে কিন্তু রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর প্রহরায় সুরক্ষিত একটা বহরে হামলা করাটা নিঃসন্দেহে হঠকারী। তারা জানে না তারা কাদের উপরে হামলা করতে এসেছে… বা হয়তো তারা জানে। কাবুলের ধনী কোষাধ্যক্ষের ভ্রমণের সংবাদ সম্ভবত তাঁদের হামলায় প্ররোচিত করেছে। ছায়াগুলো দীর্ঘতর হতে শুরু করেছে। সূর্য আর এক কি দুই ঘন্টার ভিতরে চারপাশের পাহাড়ের চূড়ার নিচে হারিয়ে যাবে। তাদের বহরের পেছনে অবস্থিত মালবাহী শকটগুলোকে হয়ত আক্রমণ করা হয়েছে তাদের তাড়াহুড়ো করে সংকীর্ণ খুদ গিরিপথের আরো গভীরে নিয়ে যাবার অভিপ্রায়ে যেখানে অন্ধকারের ভিতরে হামলাকারীদের আরেকটা বিশাল দল ওত পেতে রয়েছে? লাডলী আর তাঁর নিজের এবং বহরের সাথে তাঁর সামনে ভ্রমণরত তাঁর পিতামাতার–বিপদের ভাবনা তাকে কিছুক্ষণের জন্য নিথর করে দেয় এবং তারপরে সে দ্রুত চিন্তা করতে শুরু করে। সে কীভাবে নিজেকে আর নিজের কন্যাকে রক্ষা করবে? তার সাথে কোনো অস্ত্র নেই। লাডলী ঘুম থেকে জেগে উঠলে সে মেয়েকে নিজের কাছে টেনে নেয়। লাডলী বিপদের সম্ভাবনায় কাঁটা হয়ে থাকা মায়ের উৎকণ্ঠা টের পাওয়া মাত্র ফোঁপাতে আরম্ভ করে। শান্ত হও, মেহেরুন্নিসা তার কণ্ঠে একটা উৎফুল্লভাব ফুটিয়ে বলে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর তাছাড়া, কান্নায় কখনও কারো উপকার হয় নি।
ঠিক সেই মুহূর্তে চিৎকার করে কেউ একজন থামবার নির্দেশ দেয়। তার বেহারারা এত দ্রুত দাঁড়িয়ে পড়ে যে মেহেরুন্নিসা হুমড়ি খেয়ে সামনের দিকে উল্টে পড়ে। তাঁর হাত থেকে লাডলী ছিটকে যায় এবং পালকির কাঠামো গঠনকারী বাঁশের বাঁকানো চক্ৰবলয়ের একটার সাথে তার কপাল গিয়ে এত জোরে ধাক্কা খায় যে কিছুক্ষণের জন্য সে চোখে ঝাপসা দেখে। নিজেকে সুস্থির করে সে লাডলীকে জোর করে পালকির মেঝেতে শুইয়ে দেয়। এখানে চুপ করে শুয়ে থাকো!’ সে এরপরে পর্দার ভেতর থেকে সারসের মত মাথা বের করে বাইরে তাকিয়ে দেখে যে তাঁর সামনে পুরো বহরটা থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবকিরা ঘোড়া থেকে মাটিতে নামতে শুরু করেছে এবং বন্দুক পিঠের উপরে আড়াআড়িভাবে ঝুলিয়ে নিয়ে, নুড়িতে আবৃত ঢাল বেয়ে হুড়মুড় করে উপরে উঠার চেষ্টা করে, তাদের পায়ের আঘাতে পাথরের টুকরো আর বালু আলগা হতে থাকে, উপরের দিকে বিক্ষিপ্ত পড়ে থাকা কয়েকটা পাথর তাদের গন্তব্য যেখানে তারা খানিকটা হলেও আড়াল পাবে। রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনীর একটা দল এমন সময় তার পাশ দিয়ে দ্রুতবেগে তাঁদের বহরের পেছনের দিকে ছুটে যায় যেখানে লড়াইয়ের শব্দ প্রতি মুহূর্তে তীব্রতর হচ্ছে। পথটা এখানে এতই সংকীর্ণ যে তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তারা এক সারিতে বিন্যস্ত হতে বাধ্য হয়। বিশাল একটা কালো ঘোড়ায় উপবিষ্ট হাতে ইতিমধ্যেই উদ্যত তরবারি আর উদ্বিগ্ন মুখাবয়বের এক তরুণ অশ্বারোহী দলটার একদম শেষে রয়েছে।
মেহেরুন্নিসা ভাবে, লাডলীকে সাথে নিয়ে পর্দার তোয়াক্কা না করে তাঁর কি। নিজের পিতামাতার গাড়ির দিকে দৌড়ে যাওয়া ঠিক হবে, কিন্তু পরমুহূর্তে সে ধারণাটা নাকচ করে দেয়। তাদের মাথার উপরে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোনো নিশানাবাজের কাছে তারা এর ফলে নিজেদের কেবল অরক্ষিত প্রতিপন্ন করবে। লড়াইয়ের গতিপ্রকৃতি পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত নড়াচড়া করার কোনো মানেই হয় না। সে এর বদলে পালকির চারপাশের পর্দা পুনরায় ভালো করে টেনে দেয়। সময় গড়িয়ে ধীরে ধীরে আধো অন্ধকারের আবর্তে এগিয়ে যায়। পুরোটা সময় গাদা বন্দুকের শব্দ–কখনও মনে হয় কাছে এগিয়ে আসছে, কখনও মনে হয় দূরে সরে যাচ্ছে–এবং সৈন্যদের অগ্রসর আর পিছিয়ে আসবার তীক্ষ্ণ আদেশের ব্যাপারে কান খাড়া করে রাখার, সাথে যুক্ত হয় তার কপালের যন্ত্রণা যেখানে ইতিমধ্যে বিশাল মাপের একটা আলুর সৃষ্টি হয়েছে, সে নিজেকে বাধ্য করে লাডলিকে পারস্যের লোকগীতি জোর গেয়ে শোনাতে।
তাঁদের বহরের পেছন থেকে চিৎকার আর গুলিবর্ষণের শব্দ অবশেষে থিতিয়ে আসতে আরম্ভ করে, কিন্তু এর মানে কি? সে তারপরে শুনতে পায় নিজের পালকির কাছে ঘোড়ার খুরের শব্দ, বিজয়ীর হাঁকডাক এবং সেখানে অবস্থানরত বেহারা আর সৈন্যদের উল্লাসের জবাব দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। হামলাকারী নিশ্চয়ই মেরে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে… সে আরো একবার পর্দার আড়াল থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখে রাজকীয় অশ্বারোহীরা বিজয়ীর বেশে ফিরে আসছে। সে তাকিয়ে দেখে বেশ কয়েকজনের ঘোড়ার, যাঁদের ভিতরে সেই তরুণ আধিকারিকও রয়েছে, পর্যাণের উঁচু হয়ে থাকা বাঁকানো অংশে তাঁদের হাতে যারা নিহত হয়েছে তাদের ছিন্ন মস্তকগুলো চুল বাঁধা অবস্থায় ঝুলে রয়েছে, তাদের গলার কর্তিত অসমান অংশ থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। কিন্তু দলটার শেষ অশ্বারোহী যে তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে। লোকটা একটা ছোট আঁটসাট চামড়ার জ্যাকেটে অদ্ভুতভাবে সজ্জিত এবং তাঁর মাথায় চুড়াকৃতি মোগল শিরোস্ত্রাণের সাথে গলা রক্ষা করতে সংযুক্ত ধাতব শৃঙ্খলের বর্মের বদলে রয়েছে গোলাকৃতি একটা শিরোস্ত্রাণ। সে এগিয়ে তার পাশাপাশি আসতে, লোকটা মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। একজোড়া ধুসর, মার্জার সদৃশ্য নীল চোখ তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে।