১.২ অতর্কিত আততায়ী
‘তুমি নিশ্চিত কি করতে হবে তুমি বুঝতে পেরেছো?’ জাহাঙ্গীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইংরেজ লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বার্থোলোমিউ হকিন্সের সাথে এটা কেবল তাঁর দ্বিতীয় মোলাকাত কিন্তু এটাই তার মাঝে প্রত্যয় উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট যে লোকটা আততায়ীর ভূমিকায় ভালোই উতরে যায়। হকিন্স ভাঙা ভাঙা ভুলভালো পার্সীতে কথা বলে যা সে ইস্ফাহানে পারস্যের শাহের বাহিনীতে ভাড়াটে সৈন্য হিসাবে কাজ করার সময় রপ্ত করেছিল কিন্তু নিজের সন্তুষ্টির স্বার্থে তাকে পরীক্ষা করার জন্য জাহাঙ্গীরের কাছে সেটাই যথেষ্ট।
‘আমি এখন তোমাকে বাংলায় যাবার এবং ফিরে আসবার খরচ হিসাবে পাঁচশ সোনার মোহর দেবো। শের আফগান যখন মারা যাবে তখন আমি তোমাকে আরও এক হাজার মোহর দেবো।’
বার্থোলোমিউ হকিন্স মাথা নাড়ে। তার চওড়া মুখে, সূর্যের খরতাপে লাল, সন্তুষ্টির অভিব্যক্তি। লোকটা যদিও প্রায় দশ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে জাহাঙ্গীর তার গায়ের প্রায় পশুর মত তীব্র দুর্গন্ধ তারপরেও টের পায়। এই ফিরিঙ্গিগুলো গোসল করে না কেন? আগ্রায় তাঁর দরবারে ক্রমশ আরো বেশি সংখ্যায় তাদের আগমন ঘটছে। এই লোকটার মত ইংরেজ, ফরাসী, পর্তুগীজ, এবং স্পেনীশ এবং ধর্মপ্রচারক, ব্যবসায়ী বা ভাড়াটে সৈন্য সে যেই হোক, তাদের সবাই যেন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সম্ভবত এর কারণ তাঁদের পরনের পোষাক। হকিন্সের ঘর্মাক্ত, চওড়া, দেহ কালো চামড়া দিয়ে তৈরি একটা আঁটসাট জামা, হাঁটুর ঠিক উপরে গাঢ় লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা পাতলুন এবং পিঙ্গল বর্ণের পশমের মোজা দিয়ে আবৃত। তাঁর পায়ে রয়েছে ঘোড়ায় চড়ার উপযোগী বহু ব্যবহারে ক্ষয় হয়ে যাওয়া একজোড়া গুলফ পর্যন্ত পরিহিত বুটজুতা।
‘আমি তাকে কীভাবে হত্যা করবো সেটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না?
‘না। একটা ব্যাপারই এখানে প্রধান যে সে মারা গিয়েছে। তুমি যদি তাকে কেবল আহত করো তাহলে আমার কাছে সেটার কোনো মূল্য নেই।
‘আমি গৌড়ে পৌঁছাবার পরে সেখানে কীভাবে আপনার এই শের আফগানকে খুঁজে পাবো?
‘সে শহরের শাসনকর্তা এবং গৌড় দূর্গের সেনাছাউনির অধিপতি। চোখ কান খোলা রেখে অপেক্ষা করলেই তাঁর প্রাত্যহিক জীবনযাপন কালে তুমি তাকে দেখতে পাবে। আর কোনো প্রশ্ন আছে?”
হকিন্স এক মুহূর্ত ইতস্তত করে। আপনি কি আমাকে একটা সনদপত্র দেবেন–সেটা আমার সীলমোহরযুক্ত একটা চিঠি হতে পারে–যেখানে বিবৃত থাকবে যে আমি আপনার অধীনে কর্মরত।
না। শের আফগানের মৃত্যুর সাথে আমাকে যেন কোনোভাবেই জড়িত করা না হয়। আমি তোমাকে তোমার উদ্ভাবনকুশলতার জন্য টাকা দিচ্ছি। তুমি আমাকে বলেছে যে শাহের পক্ষে তুমি এমন অনেক স্পর্শকাতর অভিযান পরিচালনা করেছে।
ইংরেজ লোকটা নিজের স্থূলকায় কাঁধ ঝাঁকায়। আমার তাহলে আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। আমি আগামীকাল যাত্রা শুরু করবো।’
জাহাঙ্গীর যখন কামরায় একা হয় তখন সে ধীর পায়ে তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষের ঝুল বারান্দার দিকে এগিয়ে যায় যেখান থেকে যমুনা নদী দেখা যায়। বার্থোলোমিউ হকিন্স কি সফল হবে? তাকে দেখে যথেষ্ট কঠোর বলেই মনে হয় এবং দরবারের বেশিরভাগ ইউরোপীয়দের মত না, সে ভাঙা ভাঙা ফার্সী বলতে পারে। কিন্তু তার তাকে পছন্দ করার অন্যতম। প্রধান কারণ একটাই-লোকটা একজন ভিনদেশী। সে যদি নিজের লোকদের কাউকে পাঠাতো তাঁরা তাহলে হয়তো বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতো, যদিও সেটা কেবল বন্ধু বা কোনো আত্মীয় এবং সে কি পরিকল্পনা করছে সেটার খবর হয়তো শের আফগানের কাছে পৌঁছে যায় এবং তাকে পলায়ন করার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়। বার্থোলোমিউ হকিন্সের সাথে এমন ভুল হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ এবং হিন্দুস্তানে কোনো গোত্র কিংবা কোনো পরিবারের সাথে তাঁর আত্মীয় সম্পর্কে সংবাদ নেই। হিন্দুস্তানে কোনো পরিবার বা গোত্রের আনুগত্য এবং কোনো মানুষ তাঁর কাছে কিছু পায় না। জাহাঙ্গীর কেন শের আফগানকে মৃত্যু কামনা করে সে বিষয়ে লোকটা কোনো কিছু প্রশ্নই করে নি। এমন আগ্রহহীনতা একটা চমকপ্রদ বিষয়…’
ইংরেজ ভাড়াটে সৈন্যের সাথে তাঁর সাক্ষাৎকারের বিষয়ে জাহাঙ্গীর কাউকে কিছু বলেনি। সুলেইমান বেগকে বিশ্বাস করে তাকে কথাটা সে হয়তো বলতে কিন্তু তাঁর দুধ-ভাই টাইফয়েড রোগে কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছে। খসরুর কিছু অনুসারীর বিরুদ্ধে যারা আগ্রার দক্ষিণপূর্বের জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল সংক্ষিপ্ত একটা অভিযান শেষ করে তারা একত্রে ফিরে আসবার পরেই সে মারা যায়। সেঁতসেঁতে, গুমোট একটা তাবুতে মাত্র বারো ঘন্টা আগে অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে শায়িত সুলেইমান বেগের জীবনের অন্তিম সময়গুলোর কথা স্মরণ করলে যখন বাইরে সীসার ন্যায় আকাশ থেকে বর্ষার অবিরাম ধারা এর ছাদে ঝরে পড়ছে এখনও জাহাঙ্গীরের গা শিউরে উঠে। সে আক্রান্ত হবার পরে এত দ্রুত জ্বরবিকারের শিকার হয় যে জাহাঙ্গীরকেও চিনতে পারে না। তার চিৎকারের দ্যোতনায় টানটান হয়ে থাকা ঠোঁট সাদা থুথুর গেঁজলায় ভরা আর পাতলা একটা চাদরে ঢাকা অবস্থায় দেহটা বিরামহীনভাবে মোচড়ায় আর কাঁপতে থাকে। সে তারপরে একদম নিথর হয়ে যায়, তাকে শেষ বিদায় জানাবার বা নিজের পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পুরোটা সময় বা সম্প্রতি খসরুর বিদ্রোহকালীন অন্ধকার দিনগুলোতে তাঁর বিজ্ঞ এবং আবেগহীন পরামর্শ জাহাঙ্গীরের কাছে কতটা গুরত্বপূর্ণ ছিল সেটা বলার কোনো সুযোগ সে পায় না।
সবকিছু যখন একদম ঠিকভাবে চলছে তখন সে সবার চেয়ে বেশি যাকে বিশ্বাস করতো তাঁর মৃত্যুটা সত্যিই বড় বেদনাদায়ক মনে হয়। সুলেইমান বেগের মৃত্যুর পরে গত দশ মাসে কোথাও আর কোনো বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেনি–এমনকি অসন্তোষের সামান্যতম আভাসও কোথাও দেখা যায় নি। তাঁর সাম্রাজ্য এখন সুরক্ষিত। পারস্যের যুদ্ধমান শাসক শাহ্ আব্বাসের কাছ থেকে কেবল হুমকির আশঙ্কা রয়েছে–যদি আবদুল রহমানের গুপ্তদূতদের আনীত বিবরণী সঠিক হয়–যিনি মোগলদের কাছ থেকে কান্দাহার পুনরায় দখল করার পরিকল্পনা করেছেন। জাহাঙ্গীর সাথে সাথে বিশটা ব্রোঞ্জের কামান আর দুইশ রণহস্তীসহ একটা শক্তিশালী বাহিনী উত্তরপশ্চিম দিকে প্রেরণ করায় নিজের পরিকল্পনা নিয়ে পুনরায় চিন্তা করতে শাহকে বাধ্য করেছে। জাহাঙ্গীরের সৈন্যরা কান্দাহারের উঁচু মাটির দেয়ালের কাছাকাছি পৌঁছাবার পূর্বেই তাঁর টকটকে লাল টুপি পরিহিত বাহিনী পশ্চাদপসারণ করে।
সে এখনও তার দুধ-ভাইয়ের অভাব খুবই অনুভব করে। তাঁর স্ত্রী এবং অবশিষ্ট সন্তানরা থাকার পরেও, তাঁর ক্ষমতা আর বিত্তবৈভব সত্ত্বেও, সে নিঃসঙ্গ বোধ করে–কখনও নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়–সুলেইমান বেগ জীবিত থাকার সময় সে কখনও এমন অনুভব করে নি। তার ছেলেবেলায় সে একদিকে চেষ্টা করেছে তার আব্বাজান আকবরের, এমন একজন মানুষ যিনি জানেন না ব্যর্থতা কাকে বলে, প্রত্যাশা অনুযায়ী নিজেকে প্রমাণ করতে অন্যদিকে তার রাজপুত জননীর যিনি আকবরকে ঘৃণা করতেন তার জনগণের বর্বর নিগ্রহকারী হিসাবে প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করতে গিয়ে তার ছেলেবেলাটা ছিল এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ভরা। তাঁর দাদীজান হামিদা যদি সবসময়ে তখন তাঁর কথা না শুনতো এবং তাকে সাহস না দিতো তাহলে অনেক আগেই সে হয়তো হঠকারী কিছু একটা করে ফেলতো। সুলেইমান বেগই কেবল আরেকজন মানুষ যিনি তাঁর জীবনে এমন একটা স্থান অধিকার করেছিলেন–বিশ্বস্ত আর বিজ্ঞ একজন বন্ধু, সে যার পরামর্শ যতই অপ্রীতিকর হোক, পদোন্নতি আর পুরষ্কারের জন্য মরীয়া, তাঁর অমাত্যদের নিজেদের স্বার্থ সম্পর্কিত পরামর্শের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করতো।
সে আগ্রা দূর্গের কাছে সুলেমান বেগের জন্য বেলেপাথরের গম্বুজযুক্ত সমাধিসৌধ নির্মাণের আদেশ দিয়েছে সেটার নির্মাণ কাজের অগ্রগতি সে গতকালই গিয়েছিল পরিদর্শন করতে। সে নির্মাণ শ্রমিকদের বাটালি দিয়ে পাথরের চাই কাটতে দেখে নতুন করে নিজের বন্ধু বিয়োগের ঘটনা তাকে আপুত করে এবং সে একাকী পুরো সন্ধ্যাবেলাটা নিজের ভাবনায় মশগুল হয়ে থাকে। সুলেইমান বেগের মৃত্যুর মত অন্য কোনো কিছু তাকে জীবনের নশ্বরতা সম্বন্ধে এভাবে সজাগ করতে পারতো না। কোনো মানুষের বয়স যতই অল্পই হোক, বা যতই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কিংবা যতই প্রাণবন্ত হোক জানে না যে তার জীবনের আর কতদিন বাকি আছে। মৃত্যু এসে তাকে শরণ দেয়ার পূর্বেই নিজের জীবন উপভোগ করা ছাড়াও–জীবনের যত বেশি বা অল্প দিনই বাকি রয়েছে–তাকে তাঁর পক্ষে সম্ভব এমন সবকিছু অর্জন করতে হবে এবং সেটা করার জন্য সে নিজেকে কেন তার ক্ষমতা ব্যবহার করতে দেবে না? তার ভাবনা চিন্তা শেষ পর্যন্ত তাকে প্ররোচিত করে বার্থোলোমিউ হকিন্সকে ডেকে পাঠাতে এবং আর কোনো কালক্ষেপণ না করে সে গোপন দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তাঁর উপরে আস্থা আরোপ করে।
জাহাঙ্গীর আকাশের দিকে তাকায় যেখানে প্রতিদিনই বৃষ্টিতে ভারি আর গাঢ় হয়ে থাকা মেঘ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েক সপ্তাহের ভিতরেই পুনরায় বর্ষার বৃষ্টি শুরু হবে। সে আশা করে প্রথমে যমুনা বরাবর তারপরে গঙ্গাকে অনুসরণ করে বাংলা অভিমুখে হকিন্সের যাত্রা এই বৃষ্টির কারণে বিঘ্নিত হবে না। নদীগুলো যদিও শীঘ্রই দু’কুল ছাপিয়ে ফুলেফেঁপে উঠে নৌকাগুলোকে দ্রুত অগ্রসর হতে সাহায্য করলেও নদীর স্রোত তখন আরো বেশি বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠবে। সময়টা এমন একটা অভিযানের জন্য মোটেই উপযুক্ত নয় কিন্তু সে অধৈর্য হয়ে পড়েছে। বার্থোলোমিউ হকিন্স যদি অর্পিত দায়িত্ব পালনে সফল হয়, সে তাহলে একটা জিনিষের–বা বলা ভালো একজন লোকের–অধিকার গ্রহণ করতে পারবে যা তার জীবনকে সম্পূর্ণ করবে, এমনকি যদিও অভীষ্ট অর্জনে তাঁর গৃহীত পদ্ধতি নিয়ে সতর্ক সুলেইমান বেগ হয়তো প্রশ্ন তুলতেন।
*
বার্থোলোমিউ হকিন্স তাঁর চোয়ালের উপরে এইমাত্র হুল ফোঁটান মশাটাকে একটা থাপ্পড় মারে। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে সে দেখে যে সেখানে কালচে লাল রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। বেশ, হতভাগাটার রক্তের সাধ সে, চিরতরে ঘুচিয়ে দিয়েছে যদিও ঝক ঝক রক্তচোষা কীটপতঙ্গের একটার বিরুদ্ধে যারা তাঁর জীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছে এটা একটা ক্ষুদ্র বিজয়। গৌড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রার শেষ পর্যায়ে তার কেনা ঘোড়াটা বেশ বুড়ো, উটের মত এর পাঁজরের হাড় বাইরের দিকে বের হয়ে আছে, কিন্তু তারপরেও গিরিমাটির থকথকে কাদার ভিতরে স্বাস্থ্যবান কোনো প্রাণীর পক্ষেও এর বেশি অগ্রসর হওয়াটা কষ্টকর বলেই প্রতিয়মান হবে। মাথার পেছনে সহস্র মোহরের ভাবনাটাই তাকে এখনও এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আগ্রা ত্যাগ করার পরে সে দু’দুবার দীর্ঘ সময়ের জন্য জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল–তাঁর দেহ, পরনের কাপড় আর বিছানা পর্যন্ত ঘামে ভিজে গিয়েছিল–এবং একবার প্রচণ্ড হুল ফোঁটানোর মত ডায়রিয়া এবং সেই সাথে এমন যন্ত্রণাদায়ক পেট ব্যাথা যে সে শপথ করেছে–এবং সে সত্যিই সংকল্পবদ্ধ–সে উপকূলের কাছে পৌঁছে সে প্রথম যে জাহাজট খুঁজে পাবে সেটাতে চড়ে সে ইংল্যান্ডে স্বদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। কিন্তু সে যখন শেষবার জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল তখন সে অন্তত নৌকায় ছিল এবং সাদা কাপড় পরিহিত, মাথায় সাদা চুলের মায়াবী খয়েরী চোখের অধিকারী একজন হিন্দু পুরোহিত তখন তাঁর সেবা শুশ্রূষা করেছিল। বার্থোলোমিউ পরে পুরোহিতের হাতে একটা মোহর গুঁজে দিতে চেষ্টা করতে লোকটা নিজেকে কেমন গুটিয়ে নেয়। এই দেশটা সে কখনও ভালো করে বুঝতে পারলো না।
ক্রমশ ধুসর হয়ে আসা আলোয় সামনের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে গৌড় অভিমুখী খচ্চরের মালবাহী কাফেলার পেছনের অংশটুকু দেখতে পায় সে নিজেকে যার পেছনে সংশ্লিষ্ট করেছে। বিপদসঙ্কুল এলাকা দিয়ে বণিকেরা নিজেদের মালবাহী পশুগুলোকে এগিয়ে নিতে ব্যস্ত থাকায় তাঁর ব্যাপারে কেউ খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি যা তাঁর জন্য স্বস্তিদায়ক যদিও সে নিজের জন্য একটা গল্প আগেই তৈরি করে রেখেছে–সে একজন পর্তুগীজ আধিকারিক গঙ্গার মোহনার কাছে হুগলিতে অবস্থিত বাণিজ্যিক উপনিবেশে যাবে নীল আর কেলিকোর ব্যবসা বৃদ্ধির সম্ভাবনা যাচাই করে দেখতে। তাকে দেখে কোনোভাবেই কুঠির কর্মকর্তা মনে হয় না–তার চেয়েও বড় কথা তার মাথার কোকড়ানো লালচে-সোনালী চুল আর ধুসর নীল চোখের কারণে তাকে পর্তুগীজও মনে হয় না–কিন্তু একটাই বাঁচোয়া এই লোকগুলো সেটা জানে না। বা তারা এটাও জানে না তার ঘোড়ার পর্যাণের ব্যাগে ইস্পাতের তৈরি চমৎকার দুটো ধারালো খঞ্জর রয়েছে একটা পারস্যে তৈরি যার ফলা এতই ধারালো যে সেটা দিয়ে ঘোড়ার লেজের চুল দ্বিখণ্ডিত করা সম্ভব এবং অন্যটা বাঁকানো ফলাযুক্ত আবরীতে খোদাই করা তূর্কী খঞ্জর–বা তাঁর কাছে এটা যে বিক্রি করেছে সেই তুর্কী অস্ত্র ব্যবসায়ী অন্তত তাই বলেছে–যেখানে লেখা রয়েছে আমি তোমাকে হত্যা করবো বটে কিন্তু তুমি বেহেশতে না দোযখে যাবে সেটা আল্লাহর মর্জির উপরে নির্ভরশীল।
সম্রাটের আচরণ দেখে বোঝা যায় শের আফগান দোযখে গেলেই তিনি খুশি হবেন কিন্তু তিনি কেন লোকটাকে হত্যা করতে চান সেবিষয়ে কিছুই খুলে বলেননি। বার্থোলোমিউ তার চামড়ার মশকের দিকে হাত বাড়ায় এবং এক ঢোক পানি খায়। মশকের পানি উষ্ণ হয়ে আছে আর পূতিগন্ধময় কিন্তু সে বহু পূর্বে এসব বিষয়ে মাথা ঘামান বন্ধ করেছে। সে এখন কেবল একটাই প্রার্থনা করে যে আরেকবার যেন সে পেটের ব্যামোয় আক্রান্ত না হয়। মশকের ছিপি বন্ধ করে সে আবারও জাহাঙ্গীরের কথা ভাবতে শুরু করে, বার্থোলোমিউকে সে তার আদেশ দেয়ার সময় কীভাবে তাঁর সুদর্শন মুখাবয়বের কালো চোখের দৃষ্টিতে একাগ্রতা ফুটে ছিল। তার পরনের বুটিদার রেশমি পোষাক আর হাতের সব আঙুলে আংটি চকচক করলেও, বার্থোলোমিউয়ের কিন্তু মনে হয় যে লোকটা হয়ত তারই মত অনেকটা… একজন যে জানে সে কি চায় এবং সেটা অর্জনে প্রয়োজনে নির্মম হতে হবে। সে সেই সাথে প্রায় মিলিয়ে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন খেয়াল করে–একটা জাহাঙ্গীরের বাম হাতের পেছনের অংশে আর অন্যটা তার ডান দ্রুর উপর থেকে শুরু হয়ে কপালের যেখানে চুল শুরু হয়েছে সেখানে মিলিয়ে গিয়েছে। সম্রাট নিজের হত্যার রীতিনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।
বার্থোলোমিউ সহসা সামনে থেকে কাফেলার লোকদের একে অন্যের উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে শুনে। সে সহজাত প্রবৃত্তির বশে নিজের তরবারি স্পর্শ করে যদি লুটেরার দল–স্থানীয় লোকেরা যাদের ডাকাত বলে–হ্যামলা করে থাকে। লুটেরাদের আক্রমণগুলো সাধারণত সকালের দিকে হয়ে থাকে যখন শেষ মুহূর্তের জড়িয়ে থাকা অন্ধকার ডাকাতদের আড়াল দেয় এবং বণিকেরা সারা রাত পাহারা দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তিন রাত্রি আগের ঘটনা বার্থোলোমিউ ঠিক এমন সময়েই এক দুর্বল গালিচা ব্যবসায়ীকে রক্ষা করেছিল। লোকটা টিপটিপ বৃষ্টির ভিতরে থেমে তার মালবাহী খচ্চরের পালে খোঁড়া হয়ে যাওয়া একটা খচ্চরের পিঠের বোঝা অন্য জন্তুর পিঠে পুনরায় চাপিয়ে দিচ্ছিলেন। লোকটা প্রায় নিজের সমান লম্বা একটা মোড়ানো গালিচা নিয়ে যখন হিমশিম খাচ্ছে তখনই অন্ধকারের আড়াল থেকে দু’জন ডাকাত দুলকি চালে তার দিকে এগিয়ে আসে। তারা তাদের টাটু ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমে, একজন গালিচা ব্যবসায়ীকে এক লাথিতে মাটিতে ফেলে দেয় এবং অন্যজন তাঁর খচ্চরের লাগামগুলো জড়ো করতে থাকে সেগুলোকে নিয়ে যাবে বলে। তারা দুজনেই নিজেদের কাজে এতই মশগুল ছিল তারা বার্থোলোমিউর গাঢ় অন্ধকারের ভিতর দিয়ে দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে আসা খেয়ালই করে নি, যতক্ষণ না বড্ড দেরি গিয়েছে। সে তার ইস্পাতের তৈরি টোলেডো তরবারি বের করে একজন ডাকাতের কাঁধের উপর থেকে তার মাথাটা প্রায় আলাদা করে দেয় এবং পাকা তরমুজের মত অন্যজনের খুলি দ্বিখণ্ডিত করে। ছোটখাট দেখতে গালিটা ব্যবসায়ী কৃতজ্ঞতায় অস্থির হয়ে পড়ে এবং চেষ্টা করে জোর করে তাকে একটা গালিচা উপহার দিতে। কিন্তু বার্থোলোমিই ততক্ষণে নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য আফসোস করতে শুরু করেছে। সে যদি নিজের অভিযান সফল করতে এবং পুরষ্কার লাভ করতে চায় কারো মনোযোগ আকর্ষণ করা তার উচিত হবে না।
কিন্তু এবারে ডাকাতদের কারণে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়নি। চিৎকারটা ভয়ের না স্বস্তি আর আনন্দের চিৎকার। বার্থোলোমিউ তার সামনে সূর্যাস্তের আলো দিনের মত একেবারে মুছে যাবার আগেই নিজের সামনে পর্যবেক্ষণ গম্বুজ দেখতে পায়–তাঁরা গৌড়ে পৌঁছে গিয়েছে। বার্থোলোমিউ তাঁর তরবারির হাতল থেকে হাত সরিয়ে আনে এবং নিজের ঘর্মাক্ত ঘোড়াটার গলায় আলতো করে চাপড় দেয়। এখন আর বেশি দেরি নেই, বুড়ো ঘোড়া কোথাকার।
*
এই সময় আঙিনায় এহেন জটলার মানে কি? গৌড়ের প্রধান তোরণ দ্বারের পাশে প্রতিরক্ষা দেয়ালের ভিতরে একটা ছোট সরাইখানায় বার্থোলোমিউ তাঁর ভাড়া নেয়া ছোট কক্ষের খড়ের গদিতে শুয়ে বিরক্তির সাথে মনে মনে চিন্তা করে। সে বিছানায় উঠে বসে এবং প্রচণ্ডভাবে সারা দেহ চুলকায় তারপরে টলমল করে উঠে দাঁড়িয়ে জুতা পায়ে না দিয়েই বাইরে বের হয়ে আসে। যদিও মাত্র সকাল হয়েছে, বণিকেরা প্রাঙ্গণের ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত একটা বিশালাকৃতি পাথরের চাতালের উপরে নিজেদের পশরা: বস্তা ভর্তি মশলা, থলে ভর্তি চাল, বজরা আর ভূট্টা, সুতি কাপড়ের পিঙ্গল বর্ণের বাণ্ডিল আর ক্যাটক্যাটে ধরনের রেশমের কাপড় সাজিয়ে রাখছে তারা বেচা কেনা শুরু করতে প্রস্তুত। বার্থোলোমিউ কোনো ধরনের আগ্রহ ছাড়াই তাদের পর্যবেক্ষণ করে কিন্তু সে ঘুরে দাঁড়াবে এমন সময় সে খেয়াল করে যে গালিচা ব্যবসায়ীকে সে বিপদ থেকে রক্ষা করেছিল তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
‘জনাব, গৌড় খুব চমৎকার একটা লোকালয়।
‘খুবই সুন্দর, বার্থোলোমিউ অনেকটা যান্ত্রিকভাবে উত্তর দেয়। সে তাঁর কক্ষে ফিরে যাবার জন্য যাত্রা করবে–সে অনায়াসে আরো এক কি দুই ঘন্টা দিব্যি ঘুমাতে পারে–কিন্তু তারপরে তার মনে একটা ভাবনার উদয় হয়। হাসান আলি–এটাই সম্ভবত আপনার নাম, তাই নয় কি?
লোকটা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
হাসান আলি, গৌড় আপনি কেমন চেনেন?
‘জ্বী। আমি বছরে ছয়বার এখানে আসি এবং আমার দুইজন আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই এখানে বেচাকেনা করে।’
তুমি বলেছিলে আমার সাহায্যের প্রতিদান তুমি আমায় দিতে চাও। আমার পথপ্রদর্শক হও। আমি এই এলাকাটা চিনি না এবং পর্তুগালে আমার নিয়োগকারীরা চায় এই এলাকার একটা সম্পূর্ণ বিবরণ আমি তাঁদের পাঠাই।
বার্থোলোমিউ এক ঘন্টা পরে সরাইখানার বর্গাকৃতি খোলা প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে হাসান আলিকে অনুসরণ করে এর উঁচু খিলানাকৃতি তোরণদ্বারের নিচে দিয়ে বাইরে গৌড়ের ব্যস্ত সড়কে এসে দাঁড়ায়। প্রথম দর্শনে শহরের সংকীর্ণ, আবর্জনা পূর্ণ রাস্তা দেখে এলাকাটা সম্বন্ধে একটা বিশ্রী ধারণা জন্মে কিন্তু হাসান আলি, তাঁর মত ছোটখাট একটা লোকের তুলনায় বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে হাঁটতে শুরু করলে, পথ দেখিয়ে তাকে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করলে রাস্তাগুলো ক্রমশ প্রশস্ত হতে থাকে এবং বাড়িগুলোও কোনো কোনোটা আবার দোতলা উঁচু–ক্রমশ আরো দর্শনীয় রূপ ধারণ করে। বার্থোলোমিউ সেইসাথে অবশ্য লক্ষ্য রাখে রাস্তায় তারা সৈন্যদের কতগুলো দল অতিক্রম করেছে। এই সৈন্যরা কোথায় যাচ্ছে?’ সে দুই সারিতে বিন্যস্ত সবুজ পরিকর আর সবুজ পাগড়ি পরিহিত বিশজন সৈন্য পাশ দিয়ে এগিয়ে যাবার সময় সেদিকে ইঙ্গিত করে।
তারা রাতের বেলা শহরের নিরাপত্তা প্রাচীরের প্রহরায় নিয়োজিত সৈন্যদল কিন্তু তাদের এখন পালাবদল হয়েছে এবং তারা এখন তাদের ছাউনিতে ফিরে যাচ্ছে।’
‘ছাউনিটা কোথায়?
‘বেশি দূরে না। আমি আপনাকে ছাউনিটা দেখাবো।
কয়েক মিনিট পরে বার্থোলোমিউ সামনে কুচকাওয়াজের ময়দান বিশিষ্ট অনেকটা দূর্গের মত একটা বর্গাকৃতি লম্বা দালান দেখতে পায়। মাটির ইট দিয়ে নির্মিত এর দেয়ালগুলো প্রায় পঞ্চাশ ফিট উঁচু। সে তাকিয়ে থাকার সময় অশ্বারোহীদের একটা দল, নিঃসন্দেহে তাদের ঘোড়াগুলোকে প্রাত্যহিক অনুশীলনের পরে ফিরে আসছে, দুলকি চালে ধাতব কীলকযুক্ত ভারি দরজার নিচে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে যা ছাউনির একমাত্র প্রবেশ পথ। ছাউনিটা দেখতে চমৎকার।
হ্যাঁ। সম্রাট আকবর, তাঁর বাংলা বিজয়ের পরে–আল্লাহতা’লা তাঁর আত্মাকে বেহেশত নসীব করুন–দালানটা নির্মাণ করেছিলেন। তিনি শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরও মজবুত করেছিলেন এবং আমাদের এখানে যে মনোরম সরাইখানাগুলো রয়েছে সেগুলোও নির্মাণ করেছিলেন। তিনি সত্যিই একজন মহান মানুষ ছিলেন।
‘আমি সে বিষয়ে নিশ্চিত। এখানে কে মোগল সৈন্যবাহিনীর সেনাপতি? সম্রাটের এত অনুগ্রহভাজন তিনি নিশ্চয়ই একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
‘আমি তাঁর নাম জানি না। আমি দুঃখিত।
‘সেটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। আমার কেবল জানবার কৌতূহল হয়েছিল এমন একটা কাজের দায়িত্ব কার উপর অর্পিত হয়েছে। আমার নিজের দেশের তুলনায় হিন্দুস্তান একটা বিশাল দেশ। আমাদের দেশে, একজন সম্রাটের পক্ষে তার নিজের ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা এবং কোথায় কি ঘটছে জানাটা সহজ…’।
‘সেটা সত্যি কথা। সারা পৃথিবীতে আমাদের সাম্রাজ্যের কোনো তুলনা পাওয়া যাবে না।’ হাসান আলি আত্মতুষ্টির সাথে মাথা নাড়ে। এবার চলুন। সরাইখানার বাইরে যেখানে বেশির ভাগ বেচাকেনা হয় সেই বড় বাজার আমি আপনাকে দেখাতে চাই।’
তারা চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে এমন সময় কর্কশ ধাতব তূর্যধ্বনি তাদের দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। কিছুক্ষণ পরেই বারোজন চৌকষ সৈন্য খয়েরী রঙের সুসজ্জিত ঘোড়ায় উপবিষ্ট হয়ে অর্ধবল্পিত বেগে পাশের একটা সড়ক দিয়ে বের হয়ে কুচকাওয়াজ ময়দানের উপর দিয়ে সেনাছাউনির দিকে এগিয়ে যায়। তাদের একজনের হাতে পিতলের একটা ছোট তূর্য রয়েছে তাঁদের আগমনের সংকেত সে এইমাত্র যেটা দিয়ে ঘোষিত করেছে। বারোজনের দলটাকে আরো তিনজন অশ্বারোহী অনুসরণ করছে–চূড়াকৃতি শিরোস্ত্ৰাণ পরিহিত দুজন দীর্ঘদেহী এক লোকের দুপাশে অবস্থান করছে যিনি ডানে বা বামে কোনো দিকেই না তাকিয়ে সোজা তাকিয়ে রয়েছেন এবং সাদা পালকযুক্ত শিয়োস্ত্রাণের নিচে তার লম্বা কালো চুল বাতাসে উড়ছে।
বার্থোলোমিউর নাড়ীর স্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠে। হাসান আলির খোঁজে সে চারপাশে তাকায় এবং ময়লা ধুতি পরিহিত একজন তরমুজ বিক্রেতার সাথে তাকে দর কষাকষি করতে দেখে। বার্থোলোমিউ কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করে কিন্তু তাঁদের কথোপকথনের বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারে না। সে ভাবে, তারা নিশ্চয়ই স্থানীয় কোনো ভাষায় কথা বলছে। এটা কোনোমতেই পার্সী হতে পারে না। তরমুজ বিক্রেতাকে দেখে মনে হয় সে অনেক কিছু বলতে চায়। সে তার সবুজাভ-হলুদ সিলিন্ডারের মত দেখতে ফলের স্তূপের পেছন থেকে বের হয়ে আসে এবং সেনাছাউনির দিকে ইঙ্গিত করে উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলতে থাকে পালকযুক্ত শিরোস্ত্ৰাণ পরিহিত লোকটা তার দেহরক্ষীদের নিয়ে যার ভিতরে এখন অদৃশ্য হয়েছে।
‘মহাশয়, হাসান আলি বলে, ‘সেনাছাউনির আধিকারিকের নাম শের আফগান। আমরা এইমাত্র যাকে যেতে দেখলাম তিনিই সেই ব্যক্তি। তরমুজ বিক্রেতা আমাকে বলেছে সে একজন চৌকষ যোদ্ধা। দুই বছর পূর্বে আমাদের মরহুম সম্রাট এখান থেকে পূর্বদিকে অবস্থিত আরাকানের জলাভূমি আর বনেবাদাড়ে লুকিয়ে থাকা জলদস্যুদের শায়েস্তা করতে তাকে পাঠিয়েছিলেন। এলাকাটা, কুমীর ভর্তি, বিপদসঙ্কুল হলেও শের আফগান লক্ষ্য অর্জনে সফল হন। তিনি পাঁচশ জলদস্যুকে বন্দি করে করেন এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে, তাদের জ্বলন্ত নৌকার চিতায় তাঁদের দেহগুলো নিক্ষেপ করেন।
তিনি কি সেনাছাউনিতেই বসবাস করেন?
না। শহরের উত্তর দিকে, অসিনির্মাতাদের তোরণের কাছে অবস্থিত একটা বিশাল উদ্যানের ভেতরে তাঁর হাভেলী অবস্থিত। এবার চলেন আমরা বাজারের দিকে যাই। সেখানে আপনাকে আগ্রহী করে তোলার মত অনেক কিছুই খুঁজে পাবেন… গতবার আমি এখানে এসে আমি কাঠের উপর অঙ্কিত আপনাদের এক পর্তুগীজ দেবতার প্রতিকৃতি দেখেছিলাম। প্রতিকৃতিটার সোনালী ডানা ছিল…’।
*
বার্থোলোমিউ অলস সময় অতিবাহিত করে। প্রতিদিন এখনও বৃষ্টি হয়, সরাইখানার শান বাধান আঙিনায় বৃষ্টির বড় আর ভারি ফোঁটাগুলো এসে ক্রমাগত আছড়ে পড়তে থাকে। বৃষ্টি পড়া মাঝে মাঝে কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হলে সে মানুষের মাঝে নিজের উপস্থিতি বেশি দৃশ্যমান হওয়া থেকে বিরত রাখতে বাজার থেকে কেনা মস্তকাবরণীযুক্ত গাঢ় খয়েরী রঙের আলখাল্লাটা গায়ে দিয়ে গৌড়ের ভিতরে হেঁটে বেড়ায় যতক্ষণ না সেনাছাউনি আর শের আফগানের হাভেলীর মধ্যবর্তী এলাকার রাস্তার প্রতিটা বাঁক, প্রতিটা গলিপথের নক্সা তাঁর মানসপটে স্থায়ীভাবে বসে যায়। সে সেইসাথে তার সম্ভাব্য শিকারের চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করে যা, আবহাওয়া যখন ভালো থাকে তখন মাঝে মাঝে শিকারে কিংবা বাজপাখি উড়াতে যাওয়া ছাড়া, বিস্ময়কর নিয়মিত বলে মনে হয়। শের আফগান প্রায় প্রতিদিনই দুপুরবেলা কয়েক ঘন্টা সেনাছাউনিতে অতিবাহিত করে। সোমবার ময়দানে সে তার বাহিনীর অনুশীলন পর্যালোচনা করে, তাঁদের নিশানাভেদের দক্ষতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে এবং বুধবার সে শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নির্বাচিত অংশ তদারকিতে ব্যস্ত থাকে।
আগ্রা থেকে সুদীর্ঘ যাত্রাকালীন সময়ে বার্থোলোমিউ প্রায়শই শের আফগানকে হত্যার সবচেয়ে ভালো সুযোগ কীভাবে খুঁজে বের করবে সেটা নিয়ে ক্রমাগত চিন্তা করেছে। সে এমনকি তার সাথে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাঁধাবার কথাও চিন্তা করেছিল যেন গৌড় কোনো ইংলিশ শহর যেখানে কোনো সরাইখানায় তাঁর এবং শের আফগানের সাথে দেখা হওয়া আর ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়া সম্ভব চিন্তা করেছিল ভেবে নিজের মনেই হেসে উঠে। সে এখন লোকটার শারীরিক শক্তির নমুনা প্রত্যক্ষ করা ছাড়াও লোকটা যেখানেই যায় সেখানেই তাঁর সাথে সার্বক্ষনিকভাবে একজন দেহরক্ষী থাকে লক্ষ্য করার পরে ধারণাটা খুব একটা গ্রহণীয় মনে হয় না। সে যাই করুক না কেন ব্যাপারটা গোপনীয় হতে হবে। একটা সুবিধাজনক স্থান হয়ত খুঁজে পাওয়া সম্ভব যেখান থেকে একটা তীর ছোঁড়া কিংবা একটা খঞ্জর নিক্ষেপ করা যাবে কিন্তু সেক্ষেত্রে তাকে সাথে সাথে হত্যা করার কথা বাদই দেয়া যাক, তাকে আহত করার সম্ভাবনাই খুবই সামান্য। জাহাঙ্গীর স্পষ্টই বলে দিয়েছে যে সে শের আফগানকে মৃত দেখতে চায়।
অবশেষে একটা মেঘমুক্ত পরিষ্কার দিনে যখন বৃষ্টিপাত সত্যিই থেমেছে বলে মনে হয় এবং বাতাসে একটা নতুন সতেজতা বিরাজ করছে, বার্থোলোমিউ সমাধানটা খুঁজে পায়। একটা সহজ সরল আর দারুণ স্পষ্ট সমাধান–যদিও এতে তাঁর নিজের বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে–যে সে কেন এটা আগে ভাবেনি চিন্তা করার সময় সে মুচকি মুচকি হাসে।
*
দুই সপ্তাহ পরের কথা, রাত প্রায় এগারটা হবে–রাতের মত সরাইখানার দরজা বন্ধ হবার ঠিক এক ঘন্টা পূর্বে–ঘামের দাগযুক্ত খড়ের বিছানাটায় শেষবারের মত একটা লাথি মেরে যেখানে বহু অস্বস্তিকর রাত সে কাটিয়েছে, বার্থোলোমিউ তাঁর কামরা থেকে গোপনে বের হয়ে আসে। তার গাঢ় রঙের আলখাল্লার নিচে, তাঁর দুটো খঞ্জরের সাথে তাঁর কোষবদ্ধ তরবারিটা একটা ইস্পাতের শেকলের সাহায্যে তাঁর কোমর থেকে ঝুলছে, তাঁর ডান পাশে রয়েছে তূর্কী তরবারি আর বামপাশে ঝুলছে পারস্যের খঞ্জর। সে আলখাল্লার মোটা কাপড় এমনভাবে চিরে দিয়েছে যাতে প্রয়োজনের সময়ে সহজে সেগুলো সে বের করতে পারে।
বার্থোলোমিউ দ্রুত সরাইখানার সামনের খোলা প্রাঙ্গন অতিক্রম করে এবং এর তোরণাকৃতি প্রবেশদ্বারের নিচে ঘুমন্ত দ্বাররক্ষীকে পাশ কাটিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে যার দায়িত্ব ছিল গভীর রাতে নিজেদের শোবার জন্য একটা বিছানা আর তাদের পশুর জন্য আস্তাবলের সন্ধানে আগত আগন্তুকদের প্রতি নজর রাখা। সে বাইরে এসেই দ্রুত চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখে সে একাকী রয়েছে সেটা নিশ্চিত হতে। সে তারপরে সংকীর্ণ, নির্জন সড়ক দিয়ে এগিয়ে যায়। সে বহুবার এই নির্দিষ্ট পথ দিয়ে হেঁটে গিয়েছে এবং সে কুচকাওয়াজ ময়দান আর সেনাছাউনি অতিক্রম করে শহরের উত্তর দিকে এগিয়ে যাবার সময় খুব ভালো করেই জানে রাস্তাটা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। একটা ছোট হিন্দু মন্দিরের সামনে পৌঁছাবার পরে, যেখানে দেবতা গনেশের মূর্তির সামনে পিতলের একটা পাত্রে মোম লাগান সলতে জ্বলছে, বার্থোলোমিউ ঘুরে গিয়ে একটা গলিতে প্রবেশ করে যেখানে দুপাশের বাড়িগুলোর বাইরের দিকে ঝুলে থাকা উপরিতলগুলো এত কাছাকাছি তারা পরস্পরকে প্রায় স্পর্শ করেছে। একটা বাসা থেকে সে একজন মহিলার গুনগুন গানের শব্দ এবং অন্য আরেকটা থেকে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে। এখানে সেখানে জানালা ঢেকে রাখা নক্সা করা কাঠের জালির ভিতর দিয়ে তেলের প্রদীপের কমলা আলো দপদপ করে।
বার্থোলোমিউর পায়ে সহসা নরম কিছু একটা আটকে যায়। একটা কুকুর যার করুণ আর্তনাদ সে আয়েশী ভঙ্গিতে এগিয়ে যাওয়া বজায় রাখলে তাকে অনুসরণ করতে থাকে। তাড়াহুড়ো করার কোনো দরকার নেই আর তাছাড়া একজন ব্যস্ত মানুষ সবসময়ে অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণ করে। গলিপথটা চওড়া হতে শুরু করেছে এবং এটা যতই বৃত্তাকারে বামদিকে বাঁক নিতে থাকে এটা একটা বড় প্রাঙ্গণে এসে মিশে যায়। বার্থোলোমিট দিন আর রাতের প্রতিটা প্রহরে এটা দেখেছে। সে জানে দিনের বেলা গরমের সময় নিজেদের দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয়রত ছোট দোকানদারের দোকানে কতগুলো নিমগাছ ছায়া দেয়, কতগুলো অন্য গলিপথ আর রাস্তা এখানে এসে মিশেছে এবং প্রাঙ্গণের শেষ প্রান্তে তার ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত লম্বা দালানটা ঠিক কতজন লোক পাহারা দেবে। বার্থোলোমিউ মস্তকাবরণী আরও ভালো করে মুখের উপরে টেনে দিয়ে গলির বাঁক থেকে সতর্কতার সাথে প্রাঙ্গণের দিকে তাকায়। অমাবস্যার পরে সদ্য নতুন চাঁদ উঠায় চারপাশ একেবারেই অন্ধকার কিন্তু তার অভীষ্ট বাড়ির ধাতু দিয়ে বাঁধান দরজার দু’পাশে জ্বলন্ত কয়লাদানির আভায় দেখা যায় যে–ঠিক অন্যান্য রাতের মতই–চারজন প্রহরী পাহারায় রয়েছে। আবছা আলোয় আরো দেখা যায় যে প্রবেশপথের উপরে একটা গিল্টি করা দণ্ড থেকে একটা সবুজ নিশান উড়ছে–সে হাসান আলির কাছ থেকে যেমনটা জেনেছে যে এটা সেনাপতির গৃহে অবস্থান করার একটা নিশানা। সবকিছু কেমন নির্জন দেখায়। কোনো ধরনের ভোজসভা বা সমাবেশ যদি আয়োজিত হয়ে থাকে তাহলে তাকে তাঁর পরিকল্পনা আজকের মত বাতিল করতে হবে…
বার্থোলোমিউ যা দেখতে চেয়েছিল দেখার পরে, সে গলির ছায়ার ভেতরে পিছিয়ে আসে এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে, যেদিন থেকে এসেছে সেদিকে তার পায়ের ধাপগুণে এগিয়ে যেতে থাকে। একশ কদমের মত যাবার পরে সে বামদিকে একটা ছোট রাস্তার মুখে এসে দাঁড়ায়। দিনের বেলা রাস্তাটা সজিবিক্রেতায় গিজগিজ করে কর্কশ কণ্ঠে সাগ্রহে পথচারীদের তাঁরা নিজেদের সজির গুণগান করে এবং তাঁদের প্রতিযোগীদের সজির বদনাম করতে থাকে, কিন্তু রাস্তাটা এখন নির্জন আর জনমানবহীন। বার্থোলোমিউ রাস্তা বরাবর হেঁটে যায়, তাঁর পায়ের নিচে সজির পঁচতে শুরু করা পাতায় পিচ্ছিল হয়ে আছে এবং তাদের পচন ক্রিয়ার তীব্র দুর্গন্ধ বাতাসে কিন্তু তাঁর মনে অন্য বিষয় খেলা করছে। এই রাস্তাটা প্রাঙ্গণের পেছন দিয়ে বৃত্তাকারে বেঁকে গিয়েছে। কয়েকশ গজ পরেই শের আফগানের বাড়ির পেছনে একটা মনোরম উদ্যানের পশ্চিম পাশের দেয়ালের কাছ দিয়ে রাস্তাটা অতিক্রম করেছে।
দেয়ালটা বেশ উঁচু–কমপক্ষে বিশ ফিট হবে–কিন্তু সে জানে দেয়ালের ইটের গাঁথুনিতে হাত আর পা-রাখার অজস্র জায়গা থাকায় দেয়ালটা বেয়ে উপরে উঠা সম্ভব। গত দুই রাত্রি সে দেয়ালের উপরে নিজেকে টেনে তুলেছে, একটা স্থান পছন্দ করেছে যেখানে দেয়ালের অন্য পাশে লম্বা একটা বাশের ঝাড় থাকায়, ঘন গাছপালার ভিতরে লাফিয়ে নামা যাবে। পাতাবহুল বাঁশের ভিতর দিয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যাবার সময় সে চোখ কান সজাগ রাখে। বৃক্ষের আন্দোলিত কাণ্ডের ভিতর দিয়ে সে বুদ্বুদ নিঃসরণকারী ঝর্ণাবিশিষ্ট একটা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ আর তারপরে বাড়ির অন্ধকার দেয়াল দেখতে পায়। বাড়ির ভিতরে প্রবেশের জন্য সামনে অবস্থিত ধাতব দরজার মত অবিকল এখানেও আছে কিন্তু দুটো গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। দরজার পাল্লাগুলো খোলা থাকে–যাঁদের পেছনে সে ভেতরের একটা আঙিনার খানিকটা দেখতে পেয়েছে–এবং সেইসাথে দরজায় পাহারার ব্যবস্থাও সামান্য। রাতের বেলা একজন প্রহরী–তার হালকা পাতলা অবয়ব দেখে বার্থোলোমিউ যত দূর বুঝতে পেরেছে একজন যুবকের চেয়ে বেশি বয়স হবে না–দরজার ঠিক ভেতরে একটা কাঠের তেপায়ার উপরে বসে থাকে। তাঁর কাছে কোনো অস্ত্র থাকে বলে মনে হয় না–কেবল একটা ছোট ঢোল থাকে বিপদ বুঝতে পারলে সেটা বাজিয়ে বাড়ির লোকদের সতর্ক করতে।
কিন্তু শের আফগান কি ধরনের বিপদ আশঙ্কা করছেন? তিনি শক্তিশালী আর শান্তিপূর্ণ একটা সাম্রাজ্যের এক শান্ত অঞ্চলে–যদিও সেটা দূরবর্তী–অবস্থিত একটা সেনানিবাসের আধিকারিক। সামনের দরজায় পাহারারত সৈন্যরা অন্য কোনো কিছু না সম্ভবত প্রদর্শনীর জন্য মোতায়েন রয়েছে। সম্রাট এই লোককে কেন মৃত দেখতে চান এবং কেন তিনি–সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একজন–তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার জন্য এই পন্থার আশ্রয় নিয়েছেন বার্থোলোমিউ আরো একবার নিজেকে এই ভাবনায় ব্যপৃত দেখতে পায়। শের আফগান যদি কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে জাহাঙ্গীর কেন তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করছেন না? সবচেয়ে বড় কথা তিনি একজন সম্রাট। কিন্তু যাই হোক এটা নিয়ে তাঁর মাথা না ঘামালেও চলবে। সহস্র মোহর এখানে মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কোনো অঘটন ছাড়াই দেয়ালের কাছে পৌঁছাবার পরে, বার্থোলোমিউ নিশ্চিত হবার জন্য তার চারপাশে আরো একবার তাকিয়ে দেখে যে কেউ আশেপাশে নেই। সে সন্তুষ্ট হয়ে নিজের কালো আলখাল্লাটা তুলে ধরে দেয়াল বেয়ে উঠতে আরম্ভ করে। সে এইবার কোনো কারণে, সম্ভবত কাজ শেষ করার জন্য অধৈর্য হয়ে উঠায় বা উত্তেজনার বশে, হাত রাখার জায়গা ভালো করে বাছাই করতে পারে না। সে যখন প্রায় পনের ফিট উপরে উঠে গেছে, তার ডান হাত দিয়ে আঁকড়ে রাখা একটা ইটের কোণ গুঁড়িয়ে যায় এবং তার প্রায় চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ার দশা হয়। ইটের মাঝে বিদ্যমান ফাঁকে পায়ের আঙুল শক্ত করে গুঁজে দিয়ে এবং বাম হাতে ঝুলে থেকে–সে টের পায় নখের নিচে দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়ছে–সে কোনো মতে নিজের অবস্থান সংহত করে। সে ডান হাত বাড়িয়ে উঁচুতে রুক্ষ উপরিভাগে হাতড়াতে থাকে যতক্ষণ না সে নিরাপদ মনে হয় এমন একটা জায়গা খুঁজে পায়। সে শেষ একটা ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে দেয়ালের উপরে তুলে আনে।
সে মুখ থেকে ঘাম মুছে সতর্কতার সাথে দেয়ালের অপর পাশে নিজেকে নিচু করে, বাঁশ ঝাড়ের মাঝে তাঁর খুঁজে পাওয়া ফাঁকা স্থানে মাটি থেকে যখন দশ ফিট উপরে রয়েছে সে হাত ছেড়ে দেয়। সে উবু হয়ে বসে, হৃৎপিণ্ডের ধকধক শব্দের ভিতরে, শুনতে চেষ্টা করে। কোনো শব্দ নেই, সব চুপচাপ। এটা ভালো লক্ষণ। এখন নিশ্চিতভাবেই মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু এখনও তার পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করার জন্য অনেক সময় বাকি আছে। সে সামান্য নড়েচড়ে নিজের অবস্থানকে একটু আরামদায়ক করে। সে টের পায় একটা ছোট জম্ভ–একটা ইঁদুর বা টিকটিকি হবে–তাঁর পায়ের উপর দিয়ে দৌড়ে যায় এবং মশার চির পরিচিত ভনভন শুনতে পায়। খানিকটা কুচকে, সে সামনের কাজটায় মনোসংযোগের চেষ্টা করে।
রাত যখন প্রায় একটার কাছাকাছি, বার্থোলোমিউ তখন ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে, প্রথমে বাঁশের ঝাড়ের এবং পরে একটা ছড়ান ডালপালাযুক্ত পাতাবহুল আমগাছের আড়াল ব্যবহার করে। চাঁদের আলোয়, সে দেখতে পায় প্রহরীর তরুণ মাথাটা তাঁর বুকের উপরে ঝুঁকে এসেছে এবং সে স্পষ্টতই নিজের তেপায়ার উপরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার পেছনে বাড়ির ভেতরের আঙিনা, দেয়ালের কুলঙ্গিতে রক্ষিত কয়েকটা ক্ষুদ্রাকতি মশালের আলোয় আধো আলোকিত, নিরব আর শান্ত। বার্থোলোমিউ বাগানের উপর দিয়ে দ্রুত বেগে দৌড়ে পানি নির্গত হতে থাকা ঝর্ণার পাশ দিয়ে বাড়ির দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে, দরজার বাম পাশে ঝুল বারান্দার কারণে অন্ধকার হয়ে থাকা একটা জায়গা বেছে নেয়। সে দেয়ালের সাথে পিঠ সোজা করে রেখে এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে সে নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
সে তারপরে গুটি গুটি পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। দরজার কাছে পৌঁছে সে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। সে দ্বাররক্ষীর এতটাই কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে তার মৃদু নাক ডাকার শব্দ অব্দি সে শুনতে পায়। কিন্তু কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। সে মাংসপেশী টানটান করে, দরজার ভিতর দিয়ে সে লাফ দিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে, তরুণ প্রহরীকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে তাকে তুলে বাগানে নিয়ে আসে এবং ডান হাতে শক্ত করে তাঁর মুখ চেপে রেখেছে। একটা শব্দ তুমি করেছছা তো জানে মেরে ফেলবো, সে ফার্সী ভাষায় কথাটা বলে। আমার কথা বুঝতে পেরেছো? সে যখন মাথা নাড়ে তার তরুণ চোখ ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে রয়েছে। বেশ এখন তাহলে তোমার মনিব শের আফগান যেখানে ঘুমিয়ে আছে আমাকে সেখানে নিয়ে চলো।’
তরুণ প্রহরী আবার মাথা নাড়ে। সে বাম হাতে অসহায় তরুণের গলার পেছনের দিক এত জোরে আঁকড়ে ধরে যে তার নখ বেচারার মাংসের গভীর প্রবেশ করে, এবং ডান হাতে মোষের চামড়ার ময়ান থেকে বাকান ফলার তুর্কী খঞ্জরটা বের করে, বার্থোলোমিউ ভেতরের আঙিনার উপর দিয়ে তাকে অনুসরণ করে কোণায় অবস্থিত একটা দরজার নিচে দিয়ে এগিয়ে যায় এবং কয়েক ধাপ পাথুরে সিঁড়ি অতিক্রম করে একটা লম্বা করিডোরে এসে উপস্থিত হয়। সে টের পায় তার আঁকড়ে ধরা হাতের ভিতরে ভয় পাওয়া ভীত কুকুরছানার মত তরুণ প্রহরী কাঁপছে।
‘মহাশয়, এখানেই। এটাই সেই কামরা।’ পিতলের ব্যাঘ্র বসান কালো কোনো কাঠের তৈরি ভীষণ চকচকে দরজাবিশিষ্ট একটা কক্ষের বাইরে ছেলেটা এসে থামে। বার্থোলোমিউর মনে হয় সে মশলাযুক্ত কোনো সুগন্ধ। তাঁর নাকে পেয়েছে–সম্ভবত কুন্দু–এবং সে তরুণ ছেলেটাকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে, আতঙ্কিত খয়েরী চোখে, সে ঘুরে তাকায়। সে কোনো হুশিয়ারি না দিয়েই চিৎকার করে বিপদসঙ্কেত দিতে মুখ হাঁ করে।
বার্থোলোমিউ বিন্দুমাত্র ইতস্তত করে না। সে চোখের পলকে দু’বার হাত চালিয়ে বাম হাতে ছেলেটার মাথা পেছনের দিকে টেনে আনে এবং একই সাথে তার উজ্জ্বল ফলাযুক্ত তূর্কী খঞ্জর ধরা ডান হাতটা উঁচু করে আর মসৃণ ত্বকযুক্ত গলায় চালিয়ে দেয়। উন্মুক্ত ক্ষতস্থান দিয়ে তরুণ প্রহরীর শেষ নিঃশ্বাস বুদ্বুদের মত বের হতে সে নিথর দেহটা মাটিতে নামিয়ে রাখে। পরিস্থিতি ভিন্ন হলে, সে হয়ত তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখতো, কিন্তু এখানে সেই উদারতা দেখাবার কোনো স্থান নেই যেখানে নিজের কোনো ভুলের খেসারত তাকে নিজের জীবন দিয়ে দিতে হতে পারে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে খঞ্জরের ফলাটা নিজের আলখাল্লায় মুছে নেয়। তার সমস্ত চিন্তা জুড়ে এখন কেবল একটাই ভাবনা দরজার চকচক করতে থাকা ব্যাঘ্রখচিত পাল্লার অপর পাশে সে কি দেখতে পাবে। সে শুনেছে যে ‘শের’ মানে ব্যাঘ–যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সে ঠিক জায়গায় পৌঁছেছে এবং শের আফগান মাত্র কয়েক ফিট দূরে রয়েছে।
তার ডান হাতে তখনও খঞ্জর ধরে রেখে, বার্থোলোমিউ বামহাতে ডানপাশের পাল্লার–এটাও আবার বাঘের মতই দেখতে–কারুকার্যখচিত ধাতব অর্গলটা সতর্কতার সাথে নামিয়ে আলতো করে কৌতূহলী একটা ধাক্কা দেয়। দরজার পাল্লাটা নিরবে আর মসৃণভাবে খুলে যেতে সে দারুণ। স্বস্তি পায়। পাল্লাটা যখন ছয় ইঞ্চির মত ফাঁক হয়েছে সে ধাক্কা দেয়া বন্ধ করে। ধুসর সোনালী আলোর একটা স্রোত তাকে জানায় সে যেমনটা আশা করেছিল তেমন অন্ধকার একটা কক্ষে সে প্রবেশ করতে যাচ্ছে না। শের আফগান সম্ভবত দরজার পাল্লাটা ইতিমধ্যেই খুলে যেতে দেখেছে এবং এখন নিজের তরবারি হয়ত কোষমুক্ত করছে…
বার্থোলোমিউ আর বেশিক্ষণ ইতস্তত না করে দরজার পাল্লা ধাক্কা দিয়ে খুলে দিয়ে কক্ষের ভেতর পা দেয়। সোনালী জরির কারুকাজ করা লাল রেশমের পর্দা শোভিত বিশাল একটা কামরা। তাঁর পায়ের নিচে নরম পুরু গালিচা এবং কলাই করা ধূপদানিতে জ্বলন্ত একটা স্ফটিক থেকে ঘোয়ার কুণ্ডলী বাতাসে ভেসে উঠছে। তেল পূর্ণ ব্রোঞ্জের দিয়ায় সলতেগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। কিন্তু বার্থোলোমিউয়ের দৃষ্টিতে এসব কিছুই ধরা পড়ে না। সে কক্ষের মাঝামাঝি পর্দা টেনে এটাকে দুই ভাগকারী প্রায় স্বচ্ছ ধুসর গোলাপি মসলিনের পর্দা ভিতর দিয়ে সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে। কাপড়ের ভিতর দিয়ে সে একটা নিচু বিছানা এবং সেটার উপরে একজন নারী আর একজন পুরুষের, পরস্পরগ্রন্থিত দুটো নগ্ন দেহ, দেখতে পায়। পুরুষটা নিজের রমণক্রিয়ায় এতটাই আবিষ্ট যে বার্থোলোমিউ যদি লাথি মেরেও দরজার পাল্লাটা খুলতে সে ব্যাপারটা খেয়ালই করতো না। মেয়েটা তাঁর পিঠের উপর ভর দিয়ে শুয়ে, সুগঠিত পা দুটো দিয়ে সঙ্গী পুরুষের পেষল কোমর জড়িয়ে রেখেছে যখন সে রমণের মাত্রা বৃদ্ধিতে বিভোর এবং তাঁর প্রেমিকের দেহ দরজার প্রতি তাঁর দৃষ্টিতে ব্যাহত করেছে।
ভাগ্য তাকে এরচেয়ে ভালো আর কোনো সুযোগ দিতে পারতো না। বার্থোলোমিউ কাছে এগিয়ে যাবার সময় ভাবে। সতর্কতার সাথে সে মসলিনের পর্দা অতিক্রম করে এবং পা টিপে টিপে সন্তর্পণে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সে এখন বিছানার এত কাছাকাছি চলে এসেছে যে সে পুরুষ লোকটার দেহের ঘামের চকচকে আভা দেখতে পায় এবং এর ঝাঁঝালো নোতা গন্ধ তাঁর নাকে ভেসে আসে কিন্তু বিছানায় ব্যস্ত পুরুষ আর নারী, যার মাথাটা একপাশে কাত হয়ে আছে, তার চোখ দুটোও বন্ধ, এখনও তার উপস্থিতি সম্বন্ধে একেবারে বেখেয়াল। রমণের মাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে তুঙ্গস্পর্শী অনুভূতির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে শের আফগান উৎফুল্ল ভঙ্গিতে নিজের মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে দেয়। সে মাথা এমন করতেই, বার্থোলোমিউ লাফিয়ে সামনে এগিয়ে আসে, তার মাথার ঘন কালো চুল আঁকড়ে তাকে ধরে তাঁর মাথাটা আরো পিছনের দিকে টেনে আনে এবং গলার শ্বাস নালী একটানে নিখুঁতভাবে দুই ভাগ করে দেয়। বার্থোলোমিউ একজন দক্ষ আততায়ী। গলার মুখ ব্যাদান করে থাকা ক্ষতস্থান থেকে তাঁর উষ্ণ লাল রক্ত ছিটকে আসলে শের আফগান, ঠিক তোরণ রক্ষীর মত, একটা শব্দও করে না।
বার্থোলোমিউ ভারি দেহটা শক্ত করে ধরে, মুহূর্তের জন্য তখন খোলা চোখের দিকে তাকায় নিজেকে নিশ্চিত করতে যে লোকটা আসলেই শের আফগান তারপরে দেহটা ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয় এবং সঙ্গিনী মেয়েটার দিকে মনোযোগ দেয় যে এখন চোখ খুলে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে হাঁটু বুকের কাছে নিয়ে এসে বিছানায় উঠে বসেছে। তাঁর প্রেমিকের রক্ত তাঁর নিটোল স্তনের মাঝে দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে এবং তার কালো চোখের দৃষ্টি বার্থোলোমিউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে যেন বুঝতে চেষ্টা করছে সে এরপর কি করবে। কোনো শব্দ করবেন না এবং আমিও তাহলে আপনার কোনো ক্ষতি করবো না, সে বলে। তাঁর মুখ থেকে একবারের জন্যও দৃষ্টি না সরিয়ে, সে ধীরে ধীরে একটা চাদর নিজের দেহের উপর টেনে নেয় কিন্তু কোনো কথা বলে না।
সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে–একজন মহিলাকে হত্যা করার চেয়ে সে কিছুতেই তরুণ প্রহরীকে হত্যা করতে বেশি আগ্রহী ছিল না–কিন্তু একই সাথে বলতেই হবে সে বিস্মিত হয়েছে। সে আশা করেছিল মেয়েটার মত এমন পরিস্থিতিতে যে কেউ উন্মত্তের মত চিৎকার করবে বা গালিগালাজ করবে কিন্তু যে লোকটা কিছুক্ষণ পূর্বেও পরম আবেগ আর প্রাণবন্ত ভঙ্গিতে আদিম খেলায় মেতে উঠেছিল এখন সেই মেঝেতে জমাট বাধা রক্তের মাঝে নিথর পড়ে রয়েছে দেখে তাঁর যতটা বিপর্যস্ত হওয়া উচিত ছিল তাকে ঠিক ততটা বিপর্যস্ত দেখায় না। তার চোখে মুখে বরং কৌতূহলের একটা অভিব্যক্তি ফুটে রয়েছে। সে টের পায় মেয়েটা তার পরনের গাঢ় রঙের, নোংরা আলখাল্লা এবং রক্ত রঞ্জিত হাত থেকে শুরু করে তাঁর মাথায় পেচানো পিঙ্গল বর্ণের কাপড়ের নিচে দিয়ে বের হয়ে আসা লালচে-সোনালী চুলের বিক্ষিপ্ত গোছা সবকিছু খুটিয়ে লক্ষ্য করছে।
সে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। সে ইতিমধ্যেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশিক্ষণ অবস্থান করে ফেলেছে। মেয়েটার কাছে কোনো লুকান অস্ত্র থাকতে পারে ভেবে সে উল্টো হেঁটে দরজার কাছে পৌঁছে, প্রহরীদের উদ্দেশ্যে তার চিৎকারের শব্দ যেকোনো মুহূর্তে শুনবে বলে সে প্রস্তুত। কিন্তু সে দরজা দিয়ে বের হয়ে এসে, করিডোর দিয়ে নিচে নেমে পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে নিচের নির্জন আর জনমানব শূন্য আঙিনায় পা রাখার পরেই সে কেবল একজন মহিলার তীক্ষ্ণ কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পায় ‘খুন! সে অন্ধকার উদ্যানের ভিতর দিয়ে দৌড়ে যাবার সময় নিজের পেছনে একটা শশারগোল শুরু হবার আভাস শুনতে পায়–লোকের উত্তেজিত গলার আওয়াজ, দ্রুতগামী পায়ের শব্দ–কিন্তু সে এখন প্রায় দেয়ালের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। বাঁশের ঝাড়ের ভিতর দিয়ে গায়ের জোরে এগিয়ে, সে নিজের কাটা ছেঁড়া নিয়ে কোনো চিন্তাই করে না, সে নিজেকে দেয়ালের উপর ছুঁড়ে দেয় এবং এই বার কোনো অসুবিধা ছাড়াই দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে।
শহরের রাস্তায় পৌঁছাবার পরে সে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়। সে শের আফগানের জমাট রক্ত রঞ্জিত নিজের তূর্কী খঞ্জরটা তুলে নিয়ে সেটায় আলতো করে চুমু দেয়। সে এখন সহস্র মোহরের অধিকারী।