১.০৮ ‘প্রাসাদের নূর’

১.৮ ‘প্রাসাদের নূর’

জাহাঙ্গীর তাঁদের বিয়ের পরের দিন সকালে অলসভাবে আড়মোড়া ভাঙে তারপরে তার পাশে নিরাভরণ হয়ে শুয়ে থাকা মেহেরুন্নিসার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। তাঁর ত্বকের মুক্তোর মত আভা দেখে তার দিকে আড়াআড়িভাবে ঘুরে থাকা তার কোমর স্পর্শ করতে তাঁর খুব ইচ্ছা হয় কিন্তু সে তার ঘুম ভাঙাতে চায় না। ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর নিটোল স্তনের উঠা নামা, পুরু ঐ ঠোঁট, ছোট খাড়া নাক আর চওড়া ভ্রু যুগল দেখতে তার ভালোই লাগে। সে নিশ্চিত, তার কমনীয় মুখশ্রী দেখতে তার ভিতরে কখনও বিরক্তি উদ্রেক হবে না। সে নিশ্চিত, দ্বিতীয়বারের মত খসরুর বিদ্রোহ প্রচেষ্টা দমন আর মান বাঈয়ের মৃত্যুর ঠিক পরপরই, তাদের বিয়েটা অবশ্যই তার জীবন আর তাঁর রাজত্বকালের একটা নতুন সূচনার স্মারক হয়ে থাকবে। সে তার নিজের এবং তাঁর সাম্রাজ্যের জন্য যত স্বপ্ন দেখেছে সবকিছু সে তাকে পাশে নিয়ে সফল করবে।

মেহেরুন্নিসা সহসাই তার বড় বড় চোখ দুটো খুলে সরাসরি তার দিকে তাকায়।

‘তোমার কাছে আমি একটা ওয়াদা করতে চাই,’ সে বলে।

 ‘সেটা কি?

 ‘সেটা হল যে আমি আর কখনও বিয়ে করবো না। আমার যদিও আরও অনেক স্ত্রী রয়েছে কিন্তু তুমিই হবে আমার শেষ স্ত্রী। মেহেরুন্নিসা তাকে চুম্বন করার জন্য সামনের দিকে ঝুঁকে আসে কিন্তু নিজের অভিপ্রায়ে সফল হবার আগে সে বলতেই থাকে, দাঁড়াও মেয়ে আমার আরও কিছু বলার আছে। আমাদের বিয়ে স্মরণীয় করতে দরবারে আজ থেকে সবাই তোমায় নূর মহল হিসাবে জানবে।’

 মেহেরুন্নিসা উঠে বসে। নূর মহল মানে প্রাসাদের আলো। এটা একটা বিশাল সম্মানের…’

‘আমার রক্ষিতাদের মত কথা বলো না, যাদের মুখে মুখ আর অন্তরে অভিলাষ আর ছলনা। সে এমনভাবে তাকায় যেন সে ভেবেছিল তিনি তাঁর সাথে ঠাট্টা করছেন কিন্তু তিনি মোটেই ঠাট্টা করছেন না এবং বলতে থাকেন, তার কণ্ঠস্বর গম্ভীর, তোমার কৃতজ্ঞতা আমি চাই না। এই উপাধিটা আমি পছন্দ করেছি কারণ তুমি আমার জীবনে আলোকচ্ছটা বয়ে এনেছো। তোমার জন্য দরবারের একজন অলঙ্কার প্রস্তুতকারী তোমার নতুন নামযুক্ত একটা সীলমোহর প্রস্তুত করছে–হাতির দাঁতের উপর পান্নাখচিত… এটা আমার হৃদয়ে এবং আমার দরবারে তুমি যে স্থান দখল করে রেখেছো সেটা প্রকাশ করবে। কিন্তু আমার কাছে তুমি সবসময়ে মেহেরুন্নিসাই থাকবে। আমার এখনও মনে আছে আমার মরহুম আব্বাজানের দর্শনার্থী কক্ষের একটা স্তম্ভের পেছনে দাঁড়িয়ে আমি তোমার আব্বাজানকে পারস্য থেকে তার যাত্রার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে শুনছি–কেমন করে, তুমি ভূমিষ্ঠ হবার প্রায় সাথে সাথে, তিনি এমন বেপরোয়া পরিস্থিতির ভিতরে ছিলেন যে তোমায় তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন, এবং কীভাবে বৈরী আবহাওয়া আর নেকড়ের মুখে তোমায় ফেলে যাবার ভাবনা সহ্য করতে না পেরে তোমার জন্য আবার ফিরে এসেছিলেন… আমার কাছে তখন মনে হয়েছিল যদিও আমি তখন কেবলই একজন বালক যে অদৃষ্ট তোমার জীবনে একটা ভূমিকা পালন করেছে। অদৃষ্ট আমার পরিবারেও ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। আমার প্রপিতামহ বিশ্বাস করতেন যে এখানে এই হিন্দুস্তানে একটা সাম্রাজ্যের সন্ধান পাওয়া তাঁর অদৃষ্টে রয়েছে। আমার আর আমার সন্তানদের অদৃষ্ট উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সেই সাম্রাজ্যের উন্নতি বিধান করা।

 ‘আমি আপনাকে সাহায্য করবো, মেহেরুন্নিসা বলে, প্রতিটা শব্দ সে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে। নিয়তি তাকে প্রভাব আর প্রতিপত্তি লাভের একটা সুযোগ দান করেছে তার মত খুব মেয়েই যা লাভ করে এবং সে সুযোগটা হাতছাড়া করবে না।

জাহাঙ্গীর উঠে বসে এবং কাঁধের উপর থেকে নিজের কালো চুল আঁকিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসে, তার নগ্ন অবয়বের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতে তাঁর মেজাজ আরো একবার হাল্কা হয়ে উঠে। এটা আমাদের বাসর রাতের শয্যা। আমি গম্ভীর বিষয় নিয়ে বড় বেশি কথা বলছি। আমরা এখন কেবল একজন নববিবাহিত পুরুষ আর নববধূ, আর আমি এখন কেবল তোমার সাথে আবারও মিলিত হতে চাই।

মেহেরুন্নিসা তাঁর দিকে দু’বাহু বাড়িয়ে দেয়।

*

সাল্লা চিরুনি দিয়ে তার লম্বা চুল আঁচড়ে দেবার সময় মেহেরুন্নিসা তাঁর চোখ বন্ধ করে রাখে। সে আর্মেনিয়ান মেয়েটাকে তাঁর সঙ্গিনী করতে সমর্থ হওয়ায় সে খুব খুশি হয়েছি কিন্তু মালার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার চেয়ে সন্তুষ্টিজনক আর কিছুই হতে পারে না। তার বিয়ের তিন সপ্তাহ পরে যমুনা নদী দেখা যায় এমন একটা বুরুজে নিজের নতুন আর বিলাসবহুল আবাসন এলাকায়–যেখানে একসময় জাহাঙ্গীরের দাদিজান হামিদা বাস করতেন–সে খাজাসারাকে ডেকে পাঠায়।

‘তুমি যেভাবে রয়েছে ঠিক সেভাবেই বিদায় নেবে। সবকিছু রেখে যাবে, মেহেরুন্নিসা, মালা তাকে যা বলেছিল ঠিক সেই শব্দগুলোই পুনরাবৃত্তি করে, তাকে বলেছিল। খাজাসারা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

 ‘কিন্তু আপনি আমাকে বরখাস্ত করতে পারেন না। আমি আমার দায়িত্ব সততা আর বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে পালন করেছি।’

 ‘তুমি তোমার ক্ষমতা বড্ড বেশি উপভোগ করো।

খাজাসারার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। সে প্রত্যুত্তরে কিছু একটা বলবে বলে মনে হয় কিন্তু বুঝতে পারে সেটা বলাটা মোটেই বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে না এবং মাথা ঝাঁকিয়ে সে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।

 ‘তুমি কিছু একটা ভুলে যাচ্ছো।

মালা থমকে যায় এবং সে যখন তার মাথা ঘুরিয়ে পুনরায় মেহেরুন্নিসার দিকে তাকায় দেখে যে তার চোখ ক্রোধের অশ্রুতে চিকচিক করছে। ‘মহামান্য সম্রাজ্ঞী, সেটা কি?

 “তোমার কর্তৃত্বের দণ্ড।

 মেহেরুন্নিসা বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় মেহেদি রঞ্জিত হাত বাড়িয়ে দেয়, এবং মালা অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতির দাঁতের কারুকাজ করা দণ্ডটা তাঁর দিকে এগিয়ে দেয় তার স্পর্শের কারণে সেটা তখনও উষ্ণ হয়ে রয়েছে।

 ‘মালকিন–এই জুঁই ফুলগুলি আমি কি আপনার চুলে গেঁথে দেবো? সাল্লা তার আবলুস কাঠের তৈরি চিরুনি বাতাসে আন্দোলিত করে জানতে চায়।

মেহেরুন্নিসা মাথা নাড়ে। সাল্লার চপল আঙুলগুলো নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠতে সে আরো অনেক আনন্দময় স্মৃতির মাঝে নিজের মনকে হারিয়ে যেতে দেয়। জাহাঙ্গীরের সাথে তার বিয়ের রাতটা শের আফগানের সাথে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটা থেকে কতই না আলাদা প্রকৃতির। তাঁর তখন অনেক অল্প বয়স, অনেক অনভিজ্ঞ, বিশেষ করে পুরুষরা যা পছন্দ করে। শের আফগানের কাছে কেবল নিজের সন্তুষ্টিই মূখ্য ছিল। জাহাঙ্গীর একজন কুশলী প্রেমিক কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা সে তার প্রতিটা প্রণয়স্পর্শের মাঝে তার ভালোবাসার আবেগ অনুভব করতে পারে। সে প্রতিদিনই তাকে উপহার পাঠায় এবং তাকে বলে, তোমার যদি কিছু পছন্দ হয় তুমি কেবল মুখ ফুটে সেটা বলবে আর সেটা তোমার হবে। একজন সম্রাজ্ঞী হিসাবে, তার ভাবতে ভালোই লাগে, শ্রেষ্ঠ সবকিছু সে চাইলেই পেতে পারে। সে এই জাঁকালো দরবারে নিজের অবস্থানের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারবে।

 কিন্তু কি হবে সেই অবস্থান? জাহাঙ্গীর মনেপ্রাণে যা কামনা করে সেই আত্মার আত্মীয় সে কীভাবে হবে? সে হুমায়ুন আর হামিদার মাঝে বিদ্যমান আন্তরিক সম্পর্কের কথা বলেছে। তার কাছে হুমায়ুন আর হামিদা কেবল দুটি নাম, কিন্তু তাকে তাদের ব্যাপারে আরও অনেক কিছু জানতে হবে, জাহাঙ্গীর তাকে যেভাবে কামনা করে তাকে চেষ্টা করতে হবে সেভাবে নিজেকে পরিবর্তিত করতে আর তার মাঝে দিয়েই সে নিজের অস্থির আকাঙ্খা আর উচ্চাশাগুলো পূরণ করতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা তাঁর প্রতি তাঁর ভালোবাসা যেন বজায় থাকে। সেটা ছাড়া আর কিছুরই কোনো মূল্য নেই…।

তার জন্য–এবং তাঁর পরিবারের জন্য এই মুহূর্তে সম্ভাবনাগুলো-অসীম বলে প্রতিয়মান হয়। জাহাঙ্গীর তার আব্বাজানকে রাজকীয় কোষাধ্যক্ষ হিসাবেই কেবল পূর্নবহাল করেন নি সেই সাথে নতুন অনেক খেতাবে তাকে ভূষিত করেছেন যার ভিতরে রয়েছে ইতিমাদ-উদ-দৌলা উপাধি, যার মানে সাম্রাজ্যের স্তম্ভ। খুররমের সাথে আরজুমান্দের বিয়ের ব্যাপারে সে অচিরেই উদ্যোগ নেবে কিন্তু কোনো তাড়াহুড়ো করতে যাবে না… কেউ যেন বলতে না পারে যে নতুন সম্রাজ্ঞী অধিষ্ঠিত হতে না হতেই তিনি নিজের পরিবারের সমৃদ্ধির জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। হেরেমে যদিও সবাই এখন তার সাথে শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ করে, সে জানে জাহাঙ্গীরের সাথে তার বিয়ের ফলে নিশ্চিতভাবেই অনেকেই নারাজ হয়েছে। জাহাঙ্গীরের অন্যান্য স্ত্রীদের মত তার জন্ম কোনো অভিজাত বংশে হয় নি। খুররমের আম্মিজান, যোধা বাঈ, একজন রাজপুত রাজকুমারী, অন্যদিকে তাঁর বড়ভাই পারভেজের আম্মিজান, সাহিব জামালের জন্ম প্রাচীন এক মোগল অভিজাত বংশে। তাঁদের সাথে এখন পর্যন্ত তাঁর কেবল একবারই দেখা হয়েছে–উভয়েই তাঁর আবাসিক এলাকায় সৌজন্যমূলক দেখা করতে এসেছিল–সে তখন তাদের আনুষ্ঠানিক শিষ্টাচার আর রসিকতার নিচে চাপা তাচ্ছিল্য আর সতর্কতা আঁচ করতে পেরেছে।

 ‘পারস্য থেকে তোমার আব্বাজানের কপর্দকশূন্য অবস্থায় মোগল দরবারে আগমন করাটা ছিল একটা অসাধারণ ঘটনা, মেহেরুন্নিসার দেয়া রূপার তবকযুক্ত খুবানির তশতরী থেকে একটা তুলে নেয়ার সময় যোধা বাঈ তাঁর বৃত্তাকার মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে রেখে কথাটা বলে।

‘আমার আব্বাজান ছিলেন একজন অভিজাত ব্যক্তি যার নিজের দেশে অদৃষ্ট কখনও তার উপরে সদয় হয় নি। তিনি ভাগ্যবান মৃত সম্রাটের অনুগ্রহ তিনি লাভ করেছিলেন।

বস্তুতপক্ষে, তোমাদের পুরো পরিবারটাই ভাগ্যবান বলতেই হবে। যোধা বাঈয়ের মুখের হাসি একটু যেন টানটান হয়ে উঠে।

 ‘সেটা সত্যি কথা, অবশ্য এসব কিছুই আল্লাহতা’লার মেহেরবানি, মানুষের এতে কোনো হাত নেই, মেহেরুন্নিসা প্রত্যুত্তরে বলে এবং খুররমের সুন্দর চেহারার প্রশংসা করে আলোচনার মোড় খুররমের দিকে ঘুরিয়ে দেয়।

যোধা বাঈ, একজন মমতাময়ী আর সন্তানগর্বে গর্বিত মা হবার কারণে খানিকটা নমনীয় হন, কিন্তু তারপরেই সরাসরি মেহেরুন্নিসার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, এটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ যে আমার সন্তান যেন ভালো কোনো বংশে বিয়ে করে। তার ধমনীতে একই সাথে মোগল রাজবংশ আর ক্ষমতাবান রাজপুত গোত্রের রক্ত বইছে।

মেহেরুন্নিসা শিষ্টাচার বজায় রেখে সম্মতি জানায় কিন্তু সে ঠিকই বুঝতে পারে যোধা বাঈ আসলে কি বোঝাতে চেয়েছে–আরজুমান্দকে বিয়ের ব্যাপারে খুররমের আকাঙ্খ সে সমর্থন করে না। সে এখন বিয়েটাকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আরো অনেক বেশি সংকল্পবদ্ধ।

পারভেজের আম্মিজান তুলনামূলকভাবে মৃদুভাষী। সাহিব জামালের ঘন পাপড়িযুক্ত কালো চোখের মণিতে মেহেরুন্নিসা এক ধরনের উদ্ধত কৌতূহল লক্ষ্য করে, যদিও সে অনেক কম প্রশ্ন করে। সে কেবল নিজের আর নিজের পরিবার সম্পর্কে তাঁর পূর্বপুরুষেরা কীভাবে বাবরের সাথে তাঁর হিন্দুস্তান অভিযানে অংশ নিয়েছিল–কেবল সেই কথাই বয়ান করে। সে একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয় যে মেহেরুন্নিসা তাঁর কাছ থেকে সামান্যতম ঘনিষ্ঠতা প্রত্যাশা না করলেই ভালো। আমি নিরূপদ্রব, নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করি, সাহিব জামাল বিড়বিড় করে বলে। আমার স্বাস্থ্য খুবই নাজুক আর সঙ্গত কারণেই আমার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা খুবই সীমিত।

তাদের এই বিদ্বেষের কিছুটা অবশ্য অল্পবয়স্কা, সুন্দর মুখশ্রীর অধিকারী প্রতিপক্ষের প্রতি যৌবনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া দু’জন রমণীর স্বাভাবিক ঈর্ষা। মেহেরুন্নিসা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে নিজেই হেসে ফেলে। সে জুই ফুলের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে…সে কোনোমতেই তাদের বৈরীতাকে দ্বারা নিজেকে প্রভাবিত হতে দেবে না এবং সে ইতিমধ্যে ইয়াসমিনার, জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সন্তান শাহরিয়ারের উপপত্নী মাতা, সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেছে। সে ছেলেটাকে যতটুকু দেখেছে তাতে তাঁর মনে হয়েছে দেখতে অস্বাভাবিক রকমের সুদর্শন হলেও, অতিরিক্ত প্রশ্রয়ের কারণে ছিচকাদুনে হয়ে উঠেছে এবং যখনই কোনো কিছু তার মনঃপুত হবে সে সোজা দৌড়ে গিয়ে মায়ের কাছে নালিশ জানাবে–যদি তাঁর শিক্ষকদের কথা বিশ্বাস করতে হয় এবং সেইসাথে পড়ালেখায় ভীষণ দুর্বল। তাকে হেরেম থেকে সরিয়ে নিয়ে এবার আলাদা থাকবার বন্দোবস্ত করতে হবে। কিন্তু ইয়াসমিনাকে সে এসব কিছুই বলেনি, স্পষ্টতই ছেলের প্রতি তাঁর প্রবল ভালোবাসা।

 সাল্লা তার চুল বাঁধা শেষ করতে, মেহেরুন্নিসা তার আলখাল্লার নিচে লাল মখমলের ময়ানে আবদ্ধ ইস্পাতের হালকা খঞ্জরটার অস্তিত্ব অনুভব করে যা সে পোষাকে নিচে লুকিয়ে রেখেছে। ফাতিমা বেগমের সাথে অবস্থান করার সময় সে নাদিয়ার কাছে হেরেমের অনেক ঝগড়া আর ঈর্ষার কাহিনী শুনেছে। এক অল্পবয়স্ক সুশ্রী রক্ষিতাকে নিয়ে একটা গল্প রয়েছে যাকে তাঁর প্রতিপক্ষ এক খোঁজাকে উৎকোচ দিয়ে পাথুরে বারান্দা থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। আকবরের এক অল্পবয়স্কা স্ত্রীকে নিয়ে অন্য আরেকটা গল্প প্রচলিত রয়েছে যার খাবারে তার এক শত্রু কাঁচের গুড়ো মিশিয়ে দেয়ায় যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে বেচারীর মৃত্যু হয়েছিল। না, খঞ্জর বহন করাকে কোনোভাবেই বাড়াবাড়ি বলা যাবে না বা বাস্তবিক পক্ষেই খাদ্য পরীক্ষক হিসাবে কাউকে নিয়োগ দেয়া যার কাজ হবে বিয়ের উপহার হিসাবে প্রাপ্ত মিষ্টান্ন আর ফলমূল পরীক্ষা করা যা এখনও প্রতিদিন অজস্র পরিমাণে আসছে। অবশ্য সে যখন জাহাঙ্গীরের সাথে আহার করে তখন সে নিরাপদ। সম্রাটের খাদ্য প্রস্তুতকে কেন্দ্র করে বিশদ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে, যার ভিতরে রয়েছে বাদশাহী রাধুনিদের পরিহিত বিশেষ ধরনের খাটো হাতার আলখাল্লা থাকে যাতে করে সবসময়ে তাঁদের হাত দৃশ্যমান থাকে যাতে করে জাহাঙ্গীরের টেবিলে খাবারের পাত্রগুলো বয়ে নিয়ে যাবার আগে রসুইখানায় খাবারের পাত্র বহনকারীদের চোখের সামনে ময়দার লেই দিয়ে সেগুলোর মুখ বন্ধ করার সময় তারা খাবারে বিষের গুড়ো মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে না পারে। সে যখন একা থাকবে বিপদের সম্ভাবনা তখনই আর তাকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।

*

মেহেরুন্নিসা, আধঘন্টা পরে উঁচু-চূড়াযুক্ত একটা রূপালী হাওদায় উপবিষ্ট অবস্থায় আগ্রা দূর্গের ঢালু পথ দিয়ে নিচে নেমে আসবার সময়, উত্তেজনা আর গভীর সন্তুষ্টির একটা যুগপত অনুভূতিতে জারিত হয়। বাঘ শিকারে জাহাঙ্গীরের সাথে যোগ দেয়ার জন্য সে যখন প্রথমবার প্রস্তাব করেছিল, জাহাঙ্গীরের চোখে মুখে নিখাদ বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠেছিল। কোনো রাজকীয় মোগল রমণী এমন কিছু আগে কখনও করে নি, সে কোনোমতে তাকে বলে।

 ‘কিন্তু কেন নয়? আমি কেন প্রথম হতে পারি না? আমার পক্ষে যতখানি সম্ভব আমি আপনার সঙ্গী হতে এবং আপনার সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চাই। আর তাছাড়া, ব্যাপারটা আমার কাছে দারুণ উত্তেজক বলে মনে হয়েছে।’

 ‘আমি বিষয়টা ভেবে দেখবো, তিনি তাকে বলেন, কিন্তু সে নিশ্চিত বুঝতে পারে তার অনুরোধ তাকে কৌতূহলী করে তুলেছে। জাহাঙ্গীর পরের দিন তাকে হাতির দাঁতের আর আবলুস কাঠের কারুকাজ করা বাটযুক্ত অবিকল দেখতে একজোড়া মাস্কেট উপহার দেয় এবং তাকে বলে যে সে তার শিকারের জন্য এই বিশেষ হাওদা নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন। হাওদাটার চারদিকে প্রশস্ত খোলা জায়গা রয়েছে এবং তাকে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে রাখতে যদিও পাতলা কাপড়ের পর্দার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে পর্দাগুলো বড় বড় পিতলের আংটা থেকে ঝোলানো হয়েছে এবং শিকারের সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে তাকে তার অস্ত্র তাক করার সুযোগ দিতে সেগুলোকে দ্রুত একপাশে টেনে সরিয়ে দেয়া সম্ভব।

 মেহেরুন্নিসা বন্দুক ছোঁড়া মকশো করার সময় জাহাঙ্গীর তার প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তিনি শিকারের সময় নিজের হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে পর্দা ঘেরা হাওদায় তার সাথে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়ায় বিষয়টা তার আনন্দ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের পেছনে হেরেমের দু’জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত খোঁজা বসে রয়েছে যারা যত দ্রুত সম্ভব তাদের শিকারের মাস্কেট গুলি ভর্তি করতে সক্ষম।

‘তোমায় উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। জাহাঙ্গীরের ঠোঁট তার গলার পাশে আলতো করে ছোঁয়া দিয়ে যায়।

‘আমি আসলেই খুশি। আজ আমি জীবনের প্রথম শিকার করতে সংকল্পবদ্ধ।

 ‘আমাদের ভাগ্য হয়ত প্রসন্ন নাও হতে পারে। আজ সকালে আমার শিকারীরা বাঘের যে দলটাকে দেখেছিল তারা হয়ত ইতিমধ্যে অন্যত্র সরে গিয়েছে।

প্রথমে মনে হতে থাকে যে জাহাঙ্গীরের কথাই বোধ হয় ফলতে চলেছে। তাঁদের সামনে দুলকি চালে ছুটতে থাকা শিকারীর দল বাঘের দলটার কোনো নিশানাই খুঁজে পায় না। আগ্রা ত্যাগ করার প্রায় তিনঘন্টা পরে জাহাঙ্গীর হয়তো ফিরে যাবার আদেশ দিতো কিন্তু মেহেরুন্নিসা ব্যাকুল কণ্ঠে অনুরোধ করে, আরেকটু। অনুগ্রহ করে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখি। দেখেন, আজ সকালে যে পাহাড়ের কাছে বাঘের দলটা দেখা গিয়েছিল আমরা প্রায় তার কাছে পৌঁছে গিয়েছি…’

জাহাঙ্গীর তার ব্যগ্রতা দেখে মুচকি হাসে। বেশ, দেখা যাক।

 প্রথম দর্শনে গুটিকয়েক কণ্টকযুক্ত ঝোঁপ বিশিষ্ট বালিয়াড়ি-সদৃশ্য প্রান্তর দেখে খুব একটা সম্ভাবনাময় বলে মনে হয় না। বাঘের জন্য এখানে পর্যাপ্ত আড়াল নেই। কিন্তু তারপরেই হঠাৎ পায়ের নিচের মাটি কয়েকটা বিশাল ধুসর রঙের পাথরের দিকে উঠতে শুরু করেছে যার মাঝে তেঁতুল গাছ জন্মায়। তাঁদের বহনকারী হাতিটা সহসাই দাঁড়িয়ে পড়ে এবং জাহাঙ্গীর শিকারীর কথা শোনার জন্য হাওদা থেকে নিচে ঝুঁকে আসে।

 ‘তাঁরা তাজা পায়ের ছাপ খুঁজে পেয়েছে। তাঁরা সাথে করে নিয়ে আসা ছাগলের একটা মৃতদেহ পাথরের কাছে রাখতে চলেছে, জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণ পরে ফিসফিস করে বলে। আমরা এখানে বাতাসের স্রোতের দিকে অপেক্ষা করবো।’

সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে বাতাসের মৃদুমন্দ প্রবাহ তেঁতুল গাছের মাঝে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করে কিন্তু আর কোথাও কোনো শব্দ বা নড়াচড়া দৃষ্টিগোচর হয় না। মেহেরুন্নিসা এরপরেই একটা তীব্র, কস্তরীবৎ গন্ধ পায় এবং জাহাঙ্গীর আরও একবার ফিসফিস করে বলে, তারা আসছেন… চেয়ে দেখো… দু’জন, পাথরের ভিতরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

মাস্কেটগুলো আমাদের হাতে দাও এবং মোম লাগানো সুতোয় আগুন জ্বেলে প্রস্তুত রাখো, সে খোঁজা দু’জনকে আদেশ দেয় এবং এক ঝটকায় হাওদার পর্দা সরিয়ে দেয়। মেহেরুন্নিসা দ্রুত ভারসাম্যের জন্য হাওদার প্রান্তে নিজের অস্ত্রের কারুকাজ করা লম্বা ইস্পাতের ব্যারেল আলম্বিত করে এবং পলিতার পাতলা ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্য পরীক্ষা করে। তারপরে, জাহাঙ্গীর তাকে যেভাবে শিখিয়েছে সেভাবে সামনের দিকে অবনত হয়ে, সে ব্যারেল বরাবর তির্যকদৃষ্টিতে তাকায়। পাথরের আড়াল থেকে নিশ্চিতভাবেই এইমাত্র দুটো কালো আর কমলা রঙের আকৃতি বের হয়ে এসেছে। বাঘ দুটো, নিজেদের পিঠের অতিকায় চেটালো অস্থির মাঝে মাথা নিচু করে রেখে, ধীরে এবং সতর্কতার সাথে মৃত ছাগলটার দিকে এগিয়ে আসছে। সে জ্বলন্ত মোমের সুতার জন্য পেছনের দিকে হাত বাড়াতে যাবে তখনই জাহাঙ্গীর বলে, না, এখন নয়। তুমি যদি তাড়াহুড়ো করো তাহলে তুমি হয়তো তাদের ভয় পাইয়ে দেবে।

 নিজের কানের ভেতর রক্তের দবদব শব্দ শুনতে শুনতে অপেক্ষা করাটা রীতিমত অত্যাচার মনে হয়। বাঘ দুটো ইতিমধ্যে ছাগলের মৃতদেহটার কাছে পৌঁছে গিয়েছে এবং তারা মাংসের ভিতরে নিজেদের দাঁত বসাবার সাথে সাথে সে টের পায় তাঁদের সতর্কতায় একটা ঢিলেমী এসেছে।

‘এখন!’ জাহাঙ্গীর বলে। তুমি ডানপাশের বাঘটাকে নিশানা করো। আমি বাম পাশেরটাকে সামলাচ্ছি।’

 মেহেরুন্নিসা তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা খোঁজাটার কাছ থেকে মোম দেয়া জ্বলন্ত সুতাটা নিয়ে সে তার লক্ষ্যবস্তুর চওড়া বুকে জমে থাকা ছাগলের রক্ত নিশানা করে। সে গুলি করার সাথে সাথে আকষ্মিক তীক্ষ্ণ একটা শব্দ শুনতে পায়, এবং তারপরেই তাঁর গুলিবিদ্ধ বাঘটা একপাশে কাত হয়ে পড়ে যায়, জন্তুটার সাদা গলা তাজা লাল রক্তে ক্রমশ লাল হয়ে উঠে। জাহাঙ্গীরের গুলি করা বাঘটাও প্রায় একই সময়ে বিকট একটা গর্জন করে হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং কিছু সময় থরথর করে কাঁপার পরে নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে, গোলাপি আর কালচে রঙের জীহ্বা জন্তুটার আধ খোলা মুখ থেকে বের হয়ে থাকে। নতুন এক ধরনের আন্ত্রিক রোমাঞ্চ মেহেরুন্নিসার ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ চমকের মত বয়ে যায়। জ্বলজ্বলে চোখে এবং ঠোঁট ভাঁজ করে সে জাহাঙ্গীরের দিকে ঘুরে তাকায়।

 তাঁদের বহনকারী হাতির পেছন থেকে ঠিক সেই সময়ে উচ্চ স্বরগ্রামের একটা প্রলম্বিত চিৎকার ভেসে আসে এবং পিঙ্গল বর্ণের মাদী ঘোড়ায় উপবিষ্ট এক তরুণ কর্চি মাস্কেটের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে তাঁদের পাশ দিয়ে দ্বিগ্বিদিক শূন্য হয়ে ঘোড়া হাঁকায়। তাঁদের হাতিটা আতঙ্কিত হয়ে শুড় উঁচু করে এবং পা নাড়ায় কিন্তু মাহুত কোনোমতে তাকে শান্ত করে। কনুই আর গোড়ালী উন্মত্তের ন্যায় ঝাপটাতে ঝাপটাতে তরুণ অশ্বারোহী বৃথাই লাগাম টেনে ধরতে চেষ্টা করে। হতভাগ্য লোকটাকে নিজের ঘোটকীর মাথার উপর দিয়ে নিখুঁতভাবে সামনের দিকে মৃত বাঘ দুটোর কয়েক গজের ভিতরে আছড়ে পড়ে সেখানেই বিমূঢ়ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে মেহেরুন্নিসা আরেকটু হলেই হেসে ফেলেছিল। মেহেরুন্নিসাকে সহসাই সহজাত একটা প্রবৃত্তি অধোমুখ হয়ে পড়ে থাকা তরুণের বদলে উপরে পাথরের দিকে তাকাতে বলে। কালো আর কমলা রঙের কিছু একটা সেখানে নড়াচড়া করছে। ‘আমার অন্য মাস্কেটটা দাও-জলদি!’ হাতে ধরা মাস্কেটটা ফেলে দিয়ে সে খোঁজার হাত থেকে নতুন আরেকটা নেয় এবং দ্রুত দু’বার নড়িয়ে হাওদার প্রান্তদেশে সেটা স্থাপণ করে এবং পাথরের দিকে ব্যারেলটা তাক করে। বাঘটা যখন নিচে পড়ে থাকা পরিচারক যুবককে লক্ষ্য করে, যে তখনও মাটিতে পড়ে রয়েছে, বিশাল একটা বক্ররেখায় লাফ দিতে বোঝা যায় এটা আগের দুটোর চেয়েও বিশালদেহী মেহেরুন্নিসা একেবারে সময়মত নিশানা স্থির করে। সে গুলি চালায়। সে তাড়াহুড়োর কারণে নিজেকে ঠিকমত অবলম্বন প্রদান করতে ভুলে গিয়েছিল এবং মাস্কেটটা থেকে গুলিবর্ষণের সময়ের পশ্চাদাভিঘাত তাকে পিছনের দিকে ছিটকে ফেলে দেয়। সে টলমল করে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে বাঘটা পরিচারক ছেলেটার দেহের উপরে, যে এই মুহূর্তে নিজেকে প্রাণপনে মুক্ত করতে চেষ্টা করছে, আড়াআড়িভাবে পড়ে রয়েছে।

দারুণ নিশানাভেদ। তুমি ঠিক আছে তো?’ জাহাঙ্গীর জানতে চায়। জোরে শ্বাস নিতে নিতে সে মাথা নাড়ে। আমায় তুমি সবসময়ে বিস্মিত করো।’ তিনি মেহেরুন্নিসার দিকে নিখাদ প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আমার চেয়েও দ্রুত তোমার প্রতিক্রিয়ার গতি।

 ‘বাঘটা একটা হুমকি ছিল। আমি সহজাত প্রবৃত্তির বশে যা করার করেছি।’

 ‘বাঘের বদলে যদি একটা লোক থাকতো তাহলেও কি তুমি গুলি চালাতে? হ্যাঁ, যদি সে আমার শত্রু হয়… বা আপনার, তাহলে কেন নয়।

*

খুররম তার হবু-স্ত্রীর এই চিত্রকর্মটা উপহার হিসাবে পেয়ে খুশিই হবে, জাহাঙ্গীর প্রতিকৃতিটা খুটিয়ে অবেক্ষণ করার সময় মনে মনে চিন্তা করে যা মুসক খান, তাঁর দরবারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর, তাঁর ব্যক্তিগত আবাসন কক্ষে কারুকাজ করা রোজউডের একটা কাঠামোর উপর সাজিয়ে রেখেছে। ইংল্যান্ড নামে বহুদূরের একটা ছোট রাজ্যের শাসক সম্প্রতি দরবারে কিছু উপহার প্রেরণ করেছেন যার ভিতরে তার নিজের আর তার পরিবারের প্রতিকৃতিও রয়েছে। তাঁদের আঁটসাঁট পোষাক আর উঁচু-চূড়াযুক্ত এবং পালকশোভিত ঢেউ-খেলান প্রান্তযুক্ত টুপিতে যদিও তাদের দেখতে অদ্ভুত লাগলেও, তার চারপাশে যারা রয়েছে তাঁদের প্রতিকৃতি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার ধারণাটা জাহাঙ্গীরের পছন্দ হয়েছে এবং সে বেশ কয়েকটা প্রতিকৃতি তৈরীর নির্দেশ দিয়েছে। মোল্লারা ব্যাপারটা পছন্দ করে নি, তাদের দাবি মনুষ্য সৃষ্টি এমন প্রতিকৃতি স্রষ্ঠার দৃষ্টিতে তাঁর প্রতি কটাক্ষপূর্ণ, কিন্তু তাকে তুষ্ট করতে উদ্গ্রীব কিছু অমাত্যের দল, এখন আবার পাগড়ির অলঙ্কার হিসাবে নিজেদের সম্রাটের প্রতিকৃতির অলঙ্কৃত অনুচিত্র পরিধান করতে আরম্ভ করেছে।

আরজুমান্দের মুখাবয়ব যত্নের সাথে পর্যবেক্ষণ করে, জাহাঙ্গীর মেহেরুন্নিসার সাথে একটা সাদৃশ্য খুঁজে পায়, যদিও তাঁর কাছে মনে হয় তাঁর স্ত্রীর মুখাবয়বে বিদ্যমান ঐশ্বরিক সৌন্দর্য এখানে অনুপস্থিত যা তাঁদের বিয়ের ছয় মাস পরে তাকে এখনও ক্রমাগতভাবে মুগ্ধ করছে। মেহেরুন্নিসার সাথে সে নিজেকে সম্পূর্ণ বোধ করে যেমনটা সে আগে কখনও অনুভব করে নি। তাঁর ভালোবাসা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। মেহেরুন্নিসা যে কেবল তার মানসিক স্থিতি বুঝতে পারে তাই নয় সে সেটা পরিবর্তনও করতে সক্ষম। সে যদি কখনও বিষণবোধ করে তাহলে সে তাকে হাসাতে পারে। সে যদি কোনো কারণে উদ্বিগ্ন হয় সে। তখন সুন্দর কথা বলেই কেবল তার দুশ্চিন্তা প্রশমিত করে না সেই সাথে বাস্তবসম্মত বিচক্ষণ পরামর্শও দেয়–কখনও কোনো কিছুতেই উত্তেজিত হয় না এবং সবসময়েই প্রাসঙ্গিক। সে তার উজির মাজিদ খান এবং মন্ত্রিপরিষদের বাকি সদস্যদের সাথে সাথে তার পরামর্শ শোনার জন্যও প্রায় সমান সময় ব্যয় করে, যাদের কথা থেকে তাকে ব্যক্তিগত স্বার্থ প্রণোদিত বক্তব্য থেকে বিজ্ঞ জনোচিত পরামর্শ আলাদা করতে হয়। এক মাসের ভিতরে সে তার পরামর্শ অনুযায়ী আরজুমান্দ বানুর সাথে তাঁর সন্তান খুররমের বিয়ের অনুমতি প্রদান করবে। যোধা বাঈ তাকে বোঝাতে চেয়েছিল যে বিয়েটা মোটেই পাল্টাপাল্টি ঘরে হচ্ছে না কিন্তু তার সংকল্প লক্ষ্য করে সে তার বেশি কিছু বলেনি।

সে ইতিমধ্যে দিনও ঠিক করে ফেলেছে–১০ মে, ১৬১২, তাঁর জ্যোতিষীরা তাকে নিশ্চয়তা দিয়েছে দিনটা নববিবাহিত দম্পতির সর্বাত্মক শান্তি নিশ্চিত করবে। মোগল দরবারে এখন পর্যন্ত যা প্রত্যক্ষ করেছে তাঁর ভিতরে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করাই এখন কেবল তার দায়িত্ব। নিজের সন্তানের খাতিরে সে কেবল এমন আয়োজন করবে না সেই সাথে নিজের পরিবারকে এভাবে সম্মানিত হতে দেখে মেহেরুন্নিসা যে আনন্দ লাভ করবে সেটাও একটা বড় কারণ।

*

খুররম তাঁদের বাসর কক্ষে মিহি তাঁর দিয়ে তৈরি পর্দার কাছেই একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার পরনে কেবল ব্রোকেডের সুবজ রঙের একটা আলখাল্লা যা কোমরের কাছে একটা সরু সোনার পরিকর দিয়ে বাঁধা, পর্দার পেছনে আরজুমান্দ বানুর পরিচারিকারা তাকে তাঁদের বিয়ের পূর্ণতা অর্জনের জন্য প্রস্তুত করছে। সে নিজের হাতের দিকে তাকায়, সেদিনই সকালে তার আম্মিজান সৌভাগ্যের স্মারক হিসাবে সেখানে মেহেদী আর হলুদের সাহায্যে বিভিন্ন নক্সা এঁকে দিয়েছেন। সে এখনও জ্বলজ্বলে মুক্তোর তৈরি বিয়ের তাজ পরিধান করে রয়েছে যা আব্বাজান তাঁর মাথায় বেঁধে দিয়েছিলেন, সে দূর্গ থেকে হীরক খচিত মাথার সাজ পরিহিত হাতিতে, যা গ্রীষ্মের সূর্যালোকে সাদা আগুনের মত গনগন করছে, উপবিষ্ট হয়ে আসফ খানের প্রাসাদের উদ্দেশ্যে গমনকারী বিয়ের বিশাল শোভাযাত্রাকে অনুসরণ করার জন্য রওয়ানা দেবার ঠিক আগ মুহূর্তে। তাঁর হাতির ঠিক আগেই কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে চলেছে তূর্যবাদক আর ঢুলীর দল, পেছনে রয়েছে সোনালী তশতরীর উপরে স্তূপ হয়ে থাকা মশলা বহনকারী পরিচারকদের সারি, তারপরে খুররমের বন্ধু আর দুধ-ভাইয়েরা সবাই একই রকম দেখতে কালো স্ট্যালিয়নে উপবিষ্ট।

বিয়ের অনুষ্ঠান আর আনুষ্ঠানিকতা উদ্যাপন মনে হয় যেন শেষ হবে না–মোল্লাদের সুললিত কণ্ঠের গম্ভীর উচ্চারণ, ফিসফিস করে বিয়েতে আরজুমান্দের সম্মতি প্রদান, গোলাপজলে তাঁর হাত ধুয়ে দেয়ার কৃত্যানুষ্ঠান এবং শুভ মিলন নিশ্চিত করতে হাতলবিহীন পানপাত্র থেকে পানি পান, সবশেষে ভোজসভা আর উপহার আদানপ্রদান। চকচক করতে থাকা পর্দার পরতের আড়ালে তার পাশে বসে থাকা আরজুমান্দের দিকে সে আড়চোখে তাকায় বুঝতে চেষ্টা করে তার মনে কি ভাবনা খেলা করছে। সে শীঘ্রই অবশ্য সেটা জানতে পারবে। সে তাকে প্রায় পুরোপুরি লাভ করেছে… তার হৃৎপিণ্ড ধকধক করে এবং সে বিস্মিত হয়ে অনুধাবন করে কতটা অনিশ্চিত সে বোধ করছে, খানিকটা হয়ত বিচলিত…তার প্রত্যাশা এত বেশি যে তাঁর ভয় হয় সবকিছু বোধহয় মিলবে না। আরজুমান্দ বানুর সাথে সহবাসের অভিজ্ঞতা যদি শেষ পর্যন্ত বিশেষ কোনো দ্যোতনা লাভ না করে তাহলে কি হবে? তার আপন মা, সচরাচর যিনি হাসিখুশি থাকেন, খুব বেশি কিছু প্রত্যাশা না করার জন্য তাকে সতর্ক করে দিয়েছেন, কিন্তু সে জানে সবকিছুর পরে তাকে শেষ পর্যন্ত নিজের সহজাত প্রবৃত্তির উপরেই ভরসা রাখতে হবে। মেহেরুন্নিসাকে যোধা বাঈ অপছন্দ করেন এবং তার পরিবারের আরেকজন মহিলার সাথে নিজের ছেলের বিয়েকে তিনি স্বাভাবিক কারণে তাই স্বাগত জানাননি। আম্মিজানকে যখন বলা হয় যে মেহেরুন্নিসা জাহাঙ্গীরকে তার শক্তি আর নিঃশ্বাসের সৌরভের কারণে প্রশংসা করেছে তখন সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আম্মিজানকে বলতে শুনেছে যে বহুভোগ্যা একজন রমণীর পক্ষেই কেবল এমন তুলনা করা সম্ভব।

একজন পরিচারিকা অবশেষে হেঁচকা এক টানে পর্দা সরিয়ে দেয়। আরজুমান্দ গজদন্তবর্ণের রেশমের একটা তাকিয়ায় একেবারে নিরাভরণ হয়ে শুয়ে রয়েছে, তার লম্বা চুল কাঁধের উপরে খোঁপা করে বেঁধে দেয়া হয়েছে। তার দেহ সুগন্ধি তেলের কারণে মৃদু দীপ্তি ছড়ায় যা তার ত্বকে মালিশ করা হয়েছে–এই আনুষ্ঠানিকতা উদ্দেশ্য কেবল নববধূকে তার স্বামীর কাছে আকর্ষণীয় করে তোলাই নয় সেই সাথে রতিক্রিয়ার জন্য তাকে প্রস্তুত আর উত্তেজিত করে তোলা। হেরেমের পরিচারিকারা নিজেদের কাজ বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছে। খুররম তাঁর নিটোল স্ত নযুগলের উঠা নামা, কিশমিশের মত ছোট স্তনবৃন্তের টানটান আকর্ষণ এবং তাঁর চোখের দ্যুতিময়তা লক্ষ্য করে।

‘আমাদের একা থাকতে দাও, সে পরিচারিকাদের আদেশ দেয়ার সময় ঠিকই বুঝতে পারে যে তারা তাদের পাতলা নেকাবের ভিতর দিয়ে কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সে তারপরে ধীরে শয্যার দিকে এগিয়ে যায় এবং আলখাল্লার পরিকরের বাধন খুলে সেটাকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেয়। সে তাঁর নবপরিণীতা বধূর পাশে শোয়, তার খুব কাছে তাকে স্পর্শ না করে। তাকে পুরোপুরি নিজের করে পাবার আগে সে তাকে কিছু বলতে চায় যদি কথাগুলো বলার মত শব্দ সে খুঁজে পায়। সে এক কনুইয়ের উপর উঁচু হয়ে তার জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখের মণির দিকে তাকায়। আরজুমান্দ। আমার আগামী অনাগত সময়ে যাই লেখা থাকুক আমি তোমায় ভালোবাসব এবং রক্ষা করবো। আল্লাহতালা যতদিন আমাদের একসঙ্গে থাকার ক্ষণ নির্দিষ্ট করেছেন ততক্ষণ আমার নিজের চেয়ে তোমার সুখই আমার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হবে। আমি শপথ করে বলছি।

‘আর আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আমি নিজেকে আপনার যোগ্য স্ত্রী হিসাবে প্রমাণ করবো। আমার আব্বাজান প্রথম যখন আমাকে বলেন যে আপনি আমাকে বিয়ে করতে আগ্রহী আমি ভয় পেয়েছিলাম… আপনার সাথে আমার যোজন ব্যবধান, আপনি এমন একটা পৃথিবীর মানুষ যা আমার কাছে একেবারেই অজানা…কিন্তু আমার চাচাজানের বিশ্বাসঘাতকতা যখন আমাদের পরিবারের জন্য অসম্মান বয়ে আনে তখনও আপনি আমায় ভুলে যাননি। আজ রাতে আমি নিজেকে আপনার কাছে নিবেদন করবো যতটা সম্পূর্ণভাবে এবং যতটা বিশ্বস্ততার সাথে একজন মেয়ের পক্ষে করা সম্ভব। তার সুন্দর মুখশ্রী প্রায় মলিন দেখায় কথাটা বলার সময়।

‘আর কথা নয়, খসরু ফিসফিস করে বলে এবং তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়।

*

মালকিন। যুবরাজ খুররম আর তাঁর নবপরিণীতা বধূর বাসর শয্যার নিরীক্ষণ সমাপ্ত হয়েছে। বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে এবং আরজুমান্দ বানু বাস্তবিকই একজন কুমারী ছিল। মেহেরুন্নিসা আর জাহাঙ্গীরের সামনে নতজানু হয়ে খুররমের হেরেমের তত্ত্বাবধায়ক কথাগুলো বলার পরে নতুন দম্পতির সন্ত নি কামনায় প্রথাগত মোনাজাত করে। দোয়া করি আল্লাহতা’লা তাঁদের যেন এত সন্তান দেন যাতে নববধূ রাজবংশের রত্নগর্ভা হিসাবে ভাস্বর হয়ে থাকে। মেহেরুন্নিসা জাহাঙ্গীরের দিকে তাকিয়ে প্রণয়মিশ্রিত হাসি হাসে। সে একজন সম্রাজ্ঞী এবং তাঁর ভাইঝি সম্রাটের প্রিয় সন্তানের স্ত্রী। ভবিষ্যত এত সম্ভাবনাময় আগে কখনও মনে হয় নি…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *