১.০৯ জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ

১.৯ জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ

‘খুররম, বিবাহিত জীবনের সাথে তুমি মানিয়ে নিয়েছে।’ কথাটা সত্যি, জাহাঙ্গীর শ্বেতপাথরের দাবার ছকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে নিজের পরবর্তী চাল নিয়ে চিন্তা করার অবসরে ভাবে। খুররমকে দেখে পরিতৃপ্ত মনে হয়। জাগতিক সবকিছুর চেয়ে তুমি ভালোবাস এমন একজন রমণীকে খুঁজে পাওয়া বেহেশতের আশীর্বাদ। সে খুবই খুশি যে তাঁর নিজের মত তাঁর সন্তানও এমন আনন্দের সন্ধান লাভ করেছে।

 খুররম মৃদু হাসে কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না। আরো কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে তার একটা হাতিকে সামনের দিকে দুই ঘর বাড়িয়ে দেয়। জাহাঙ্গীর ছেলের চোখে মুখে ফুটে উঠা সন্তুষ্ট অভিব্যক্তি দেখে বুঝে যে তাঁর ধারণা সে একটা মোক্ষম চাল দিয়েছে। বস্তুতপক্ষে, বেটা তাঁর চালে ভুল করেছে। আর দুটো চাল এবং সে তাহলে কিস্তিমাত করবে।

 ‘সুখ তোমায় অসতর্ক করে তুলেছে। গত কয়েক মাস তুমি আমার কাছে দাবায় পরাজিত হও নি কিন্তু আজ রাতে তুমি হারবে। দশ মিনিট পরে খেলা শেষ হয় এবং পরাজিত আর খানিকটা হতাশ খুররম উঠে দাঁড়ায়, তাঁর ঘোড়া নিয়ে আসবার আদেশ দেবে। কিন্তু জাহাঙ্গীর মনে কিছু একটা রয়েছে সে বলতে চায়। সে ঠিক নিশ্চিত নয় আরজুমান্দের সাথে তার বিয়ের কয়েক দিনের ভিতরে এমন একটা সংবাদ শুনে তার ছেলের কি প্রতিক্রিয়া হবে এবং সে জানে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা সে এতদিন স্থগিত করে রেখেছিল। কিন্তু খুররম একজন মোগল যুবরাজ এবং তার অবশ্যই বোঝা উচিত তার আসল কর্তব্য কোথায়…

‘খুররম… তুমি বিদায় নেয়ার আগে আমি তোমায় একটা কথা বলতে চাই।’

কি আব্বাজান?”

সুস্থির হয়ে একটু বসো এবং মন দিয়ে আমি কি বলি শোন। আমি তোমায় যা বলতে যাচ্ছি সেটা আমাদের সাম্রাজ্য এবং আমাদের রাজবংশ উভয়ের জন্যেই মঙ্গলকর।’

খুররমের চোখে মুখে সহসা সতর্ক অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে দেখে, জাহাঙ্গীর খানিকটা বিষণ্ণভাবে চিন্তা করে, কি দ্রুত একজনের মন মানসিকতা পরিবর্তিত হতে পারে। তারা কিছুক্ষণ আগেই আগ্রার নিদাঘতপ্ত রাতে পিতা পুত্রের ভূমিকায় কি চমৎকারভাবে দাবা খেলা উপভোগ করছিল। শাসক হওয়া মানে অবিরত একটা দুঃসহ বোঝা বহন করে চলা… সাধারণ মানুষ থেকে একেবারে আলাদা এবং তাঁদের কাছে একেবারে অজানা একটা চাপ সহ্য করা… কিন্তু সে নিজেকে অন্য কোনো পরিস্থিতির মাঝে কল্পনাও করতে পারে না। সে একেবারেই বাল্যকাল থেকেই, যখন সে বুঝতে শিখেছে সে কে, তখন থেকেই সে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে চেয়েছে। সে নিশ্চিত, খুররমও ঠিক তাই চায়। এহেন উচ্চাশার সাথে সাথে আসে রাজবংশের প্রতি একটা দায়িত্ববোধ, ব্যক্তিগত জীবনে সেটা যতই অনাকাঙ্খিত বা ধ্বংসকারী হোক। জাহাঙ্গীর গভীর একটা শ্বাস নিয়ে বলতে আরম্ভ করে।

*

আগ্রা দূর্গের নিকটে যমুনা নদীর অর্ধ বৃত্তাকার বাক বরাবর নির্মিত খুররমের হাভেলীর হেরেমের প্রাচীর বেষ্টিত উদ্যানে একটা রেশমের চাঁদোয়ার নিচে একটা লম্বা আর নিচু শয্যার উপরে স্থূপীকৃত তাকিয়ার মাঝে আরজুমান্দ শুয়ে রয়েছে। গ্রীষ্মকালের গনগনে উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ শুরু হয়েছে। সে এখানে সেসব অস্বস্তি থেকে নিরাপদ এবং শহরে যারা কাদা বা পোড়ামাটির সাধারণ গুমোট বাড়িতে বাস করে তাদের সে মোটেই ঈর্ষা করে না। মাঝেমাঝে রান্নার আগুন থেকে নির্গত স্ফুলিঙ্গ বাতাসে ঘুরপাক খেয়ে অনেক উঁচুতে উঠে; বাড়িগুলোর শুকনো খড়ের ছাদে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাঁর পরিচারিকা তাকে বলেছে যে তিনদিন আগে দুটো বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে ভেতরে অবস্থানরত মহিলাদের পুড়িয়ে মেরেছে যারা আগুনের লেলিহান শিখার কবল থেকে দৌড়ে বাইরে বের হয় নি পর্দা তথা শালিনতার ভয়ে।

কিন্তু মনখারাপ করা ভাবনার সময় এখন না–যখন সে উফুল্ল থাকে তখনও না। তাঁর দু’হাত নিজের মসৃণ সমতল পেটের উপর আগলে রাখার ভঙ্গিতে রাখা থাকে যেখানে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। সে আট সপ্তাহের গর্ভবতী। খুররমের জন্য তাঁর ভালোবাসা ততটাই পরিপূর্ণ যতটা তার জন্য খুররমের ভালোবাসা। তাকে ছাড়া–সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবার সাথে সাথে সে যে উত্তেজনা অনুভব করে সেটা ছাড়া–সে এখন আর কোনো কিছু চিন্তাও করতে পারে না এবং জানে যে নিজের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করে সে তার কাছে আসবে। তাঁদের বিয়ের রাতে সে যদিও লাজ ছিল, আজকাল তার শারীরিক আকাঙ্খ খুররমের সাথে পাল্লা দেয়। তার আলিঙ্গনের মাঝে নিজের খুঁজে পাওয়া উদ্দামতার জন্য তাঁর লজ্জা পাওয়া উচিত কিন্তু সে তারবদলে গর্ব অনুভব করে, জানে যে তাকেও সে একই রকম আনন্দ জারিত করে।

সহসা সে হেরেমের উদ্যান থেকে প্রাসাদের আঙিনাকে পৃথককারী কাঠের উঁচু তোরণদ্বারের ওপাশে ঢালু পথ বেয়ে উঠে আসা ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পায়। খুররম সম্ভবত একটু আগেই ফিরে এসেছে। তূর্যধ্বনির একটা সংক্ষিপ্ত বাজনা তাকে আশ্বস্ত করে তার ধারণাই সঠিক। উদ্যানের দূরবর্তী প্রান্তে অবস্থিত দরজার পাল্লা খুলে গিয়ে তাকে প্রকটিত করতে, সে সাদা কালো টালি বসান পথের উপর দিয়ে তার দিকে দৌড়ে যাবার সময় সে খালি পায়ের তালুতে টালির উষ্ণতা অনুভব করতে পারে। সে তাকে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে কিন্তু চুম্বন না করে এমন এক অব্যক্ত আবেগে তাকে জড়িয়ে থাকে যে তার চোখে মুখে ফুটে থাকা আন্তরিক অভিব্যক্তি সত্ত্বেও সে ঠিকই বুঝতে পারে কোথাও মারাত্মক কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। ‘খুররম, মালিক আমার কি হয়েছে? কি ব্যাপার?’ সে তাকে আলিঙ্গন থেকে মুক্তি দিলে অবশেষে সে জানতে চায়।

 ‘আমি তোমায় একটা কথা বলতে চাই।’ তাঁর কণ্ঠস্বর কেমন ধারালো শোনায় কিন্তু তার অভিব্যক্তিতে সে তার জন্য ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। ব্যাপারটা যাই হোক না কেন নিশ্চয়ই ততটা খারাপ…

‘আমার আব্বাজান বলেছেন আমার পুনরায় বিয়ে করা উচিত।’

নাহ্…’ মাতৃত্বের সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে নিজের উদর স্পর্শ করে। তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে খুররম তাকে পুনরায় নিজের বাহুর মাঝে টেনে নেয় এবং তাকে নিজের খুব কাছে নিয়ে আসে। আরজুমান্দ…সোনা আমার… এতটা ভেঙে পড়ো না…’

 ‘মেয়েটা কে?

 ‘মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতি সদিচ্ছার স্মারক হিসাবে রাজকুল বধূ হবার জন্য শাহের প্রেরিত এক পার্সী রাজকন্যা। আমার আব্বাজানের ধারণা তাকে প্রত্যাখান করার বোকামীর পরিচায়ক হবে।

কিন্তু খুররম আপনিই কেন? কেন পারভেজ নয়? সে আপনার চেয়ে বয়সে বড়।

‘আব্বাজানকে ঠিক এই কথাটাই আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছেন যে তার সব সন্তানের ভিতরে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে আমিই যোগ্যতম। খসরু বিশ্বাসঘাতক, পারভেজ সুরা আর আফিমে মাত্রাতিরিক্ত রকমের আসক্ত, আর তরুণ শাহরিয়ার ভীতু আর লাজুক। তিনি বলেছেন যে আমি যদি আদতেই পরবর্তী মোগল সম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হই তাহলে তিনি চান আমার সিংহাসনকে যতটা সম্ভব সুরক্ষিত করতে। শাহের পরিবারের সাথে মৈত্রীর সম্বন্ধ ভবিষ্যতে সহায়তা করবে।

 ‘আপনি কি উত্তর দিয়েছেন?

‘আমার আর কিইবা বলার আছে? আমি একজন যুবরাজ এবং আমার আব্বাজানের উত্তরাধিকারী হতে আগ্রহী… আমার পক্ষে কেবল নিজের খেয়াল খুশিমত আচরণ করা সম্ভব নয়। আমি তাকে বলেছি যে আমার আর কাউকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করার আগ্রহ নেই–বলেছি যে মনে প্রাণে আমি তোমাকেই আমার স্ত্রী হিসাবে গন্য করি–কিন্তু আমি তাঁর আদেশ পালন করবো।’

আরজুমান্দ নিজেকে তাঁর আলিঙ্গণ থেকে সরিয়ে নেয়। আপনি তাকে কবে বিয়ে করবেন?

 ‘দরবারের জ্যোতিষী নির্দিষ্ট দিন ঠিক করবে কিন্তু যথাযথভাবে রাজকুমারীর আগ্রায় উপস্থিত হওয়া আর যৌতুকের পরিমাণ নিয়ে সম্মতিতে পৌঁছাবার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের কথা বিবেচনা করলে বলা যায় আগামী কয়েক মাসের আগে নয়। আমার আব্বাজান পরিকল্পনা করছেন তাকে আর তার সাথে আগত সফরসঙ্গীদের পারস্যের সীমান্তে স্বাগত জানাবার জন্য উপযুক্ত সংখ্যক রক্ষীবাহিনী প্রেরণ করবেন।’

“আর আমাকে কি জাফরি কাটা অন্তঃপটের পেছন থেকে দেখতে হবে যে বাসর শয্যার জন্য তাঁর দেহকে তেল আর সুগন্ধি সিক্ত করতে এবং মেহেদী দিয়ে পরিচারিকার দল তাঁর শরীরে আল্পনা করছে?’ আরজুমান্দের পুরো দেহ এখন থরথর করে কাঁপছে এবং সে আর পরোয়া করে না তার অশ্রু সে এখন দেখল কি না।

 ‘আমি আর তুমি দুজনেই হতভাগ্য। আমাদের মত অবস্থানের মানুষ জীবনে খুব কমই ভালোবাসার জন্য বিয়ে করে এবং আমার আব্বাজান ইচ্ছে করলে আমাদের বাধা দিতে পারতেন। সাম্রাজ্যের প্রতি আর তাঁর প্রতি নিজের কর্তব্য থেকে আমি কখনও বিচ্যুত হব না। কিন্তু আমি তোমায় একটা প্রতিশ্রুতি করছি–তুমিই আমার পুরো পৃথিবী। তুমি আমার মুমতাজ–এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যেকোনো রমণীর চেয়ে তুমি আমার কাছে অনন্য–তুমি সেই রমণী যাকে আমি আমার সন্তানদের জননী হিসাবে কামনা করি। এই রাজকন্যা কখনও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবে না, আমি শপথ করে বলছি। সে এখানে নয় অন্য আরেকটা প্রাসাদে বাস করবে। তাঁর কণ্ঠস্বর সামান্য কেঁপে যায় এবং সে তাকে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছতে দেখে।

খুররমের যেকোনো কথার চেয়ে তাঁর এই সামান্য অঙ্গভঙ্গিই তাকে অনেক কিছু বলে দেয়। কিন্তু আরজুমান্দের কাছে পৃথিবী সহসাই একটা খাপছাড়া জায়গা বলে মনে হয়।

*

সে আগে কখনও এমন যন্ত্রণার সাথে পরিচিত ছিল না–দু’জন ধাত্রীর তত্ত্বাবধায়নে তাঁদের কথা অনুযায়ী দায়িত্ব নিয়ে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করার সময় তার শরীর যে শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করছে কেবল সেটাই নয় এর সাথে যুক্ত হয়েছে মাত্র আধ মাইল দূরে আগ্রা দূর্গে খুররম আরেকজনকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করছে সেটা জানা থাকায় অবর্ণনীয় মানসিক কষ্ট। তার পুরো দেহ ঘামে জবজব করছে এবং ব্যাথায় কুঁকড়ে যাবার মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলেও তাঁর মাথায় কেবল একটা কথাই ঘুরছে যে জাহাঙ্গীর তার ছেলের মাথায় বিয়ের তাজ বেঁধে দিচ্ছেন আর পার্সী রাজকন্যা নেকাবের আড়ালে বসে রয়েছে। মেয়েটা যদি অপরূপ সুন্দরী হয়? খুররম কীভাবে যে মেয়েকে জীবনেও দেখেনি তাকে ভালো না বাসবার প্রতিশ্রুতি দেয়?

‘মালকিন, শুয়ে পড়ুন। সুতির ঘামে ভেজা চাদর সে যার উপরে শুয়ে ছিল শক্তিশালী হাত তাকে পুনরায় তার উপরে শুতে বাধ্য করে। সে কোনো কিছু না ভেবেই জানালার কাছে গিয়ে রাতের আকাশ চিরে উৎসবের আতশবাজি দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে বসার চেষ্টা করেছিল। তারা যখন এসব শুরু করবে তার মানে হল যে নতুন বিয়েকে সম্পূর্ণতা দানের সময় আসন্ন…

 ‘আপনার শরীরকে শীথিল করতে চেষ্টা করুন। ব্যাথার জন্য অপেক্ষা করুন। ধাত্রীদের একজন তাঁর উঠে বসবার চেষ্টাকে ভুল করে সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য শক্তি প্রয়োগের আকাঙ্খ ভেবেছে। আরজুমান্দ নিজেকে চুপ করে শুয়ে থাকতে বলে, ধাত্রীরা তাকে ঠিক যেমন করতে বলেছে।

মালকিন, এবার, চাপ দিন!

নিজের দেহের অবশিষ্ট শক্তিটুকু একত্রিত করে এবং দুপাশ থেকে ধাত্রী দুজন তার দুই কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরে থাকলে, আরজুমান্দ তার পক্ষে যত জোরে সম্ভব চাপ দেয়। তার চারপাশের সব কিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে যায়। সে তাকিয়ার উপরে আবার এলিয়ে পড়ে। তার কানে ভেসে আসা এই তীক্ষ্ণ স্বরের কান্না কে করছে? এই আতঙ্কিত শব্দটা কি সেই করছে? সে নিজের চোখ বন্ধ করে এবং পালকের মত নির্ভার হয়ে ভাসতে থাকার একটা অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে…

‘মালকিন…’ একটা হাত আলতো করে তাঁর কাঁধ স্পর্শ করে। সে ভাবে, নির্ঘাত ধাত্রীদের একজন হবে আর চেষ্টা করে নিজেকে সরিয়ে নিতে। কোনো লাভ হয় না–সে কিছুই করতে পারে না। যেকোনো মুহূর্তে ব্যাথাটা আবার শুরু হবে এবং তার মাঝে ব্যাথাটার সাথে লড়াই করার মত আর বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই।

‘আমাদের একা থাকতে দাও, আরেকটা উঁচু আর পুরুষ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। একটা দরজা খুলে আবার বন্ধ হয়ে যায়। সে চোখ খুলে তাকায়। উল্টোদিকের দেয়ালের জানালা দিয়ে চুঁইয়ে প্রবেশ করা সকালের আলোয় প্রথমে তার দেখতে কষ্ট হয়।

 ‘আরজুমান্দ, তোমার কি নিজের স্বামী আর কন্যাকে কিছুই বলার নেই? খুররম চোখ ধাঁধানো আলোর মাঝ থেকে বের হয়ে আসে। তার বাহুতে কারুকাজ করা সবুজ রেশমের কাপড়ে জড়ানো একটা পোটলা। তাঁর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে সে বাচ্চাটাকে তাঁর বাহুতে আলতো করে শুইয়ে দেয়।

*

শীতের সন্ধ্যাবেলা সূর্য যখন অস্তাচলে যেতে বসেছে এবং জাহাঙ্গীর দ্রুত তার মন্ত্রণা কক্ষের দিকে হেঁটে যাবার সময়, যমুনার পানির দিকে তাকিয়ে তার মনে হয় পানিতে বুঝি কেউ স্বর্ণকুচি মিশিয়ে দিয়েছে, জাফরশানকে সমরকন্দের দেয়ালের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তথাকথিত স্বর্ণবাহী নদী এবং যার কথা সে তার মহান পূর্ব পুরুষ মহামতি বাবরের রোজনামচায় পড়েছে–সে ঠিক যেমন কল্পনা করেছে। মোগলদের জন্য সাম্রাজ্য জয় করতে বাবর প্রাণপণ করে যুদ্ধ করেছিলেন এবং তাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করতে আশাবাদী এমন লোক সবসময়েই থাকবে। হিন্দুস্তানের লাল মাটিতে তাঁরা তাঁদের সবুজ নিশান প্রোথিত করার পর থেকে বহুবার তাঁদের যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং এখন তারা আবারও সেই সম্ভাবনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সাম্রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে প্রাপ্ত শান্তি বিঘ্নিতকারী সংবাদ পর্যালোচনার জন্য সে তার সমর উপদেষ্টাদের বৈঠক আহ্বান করেছে।

দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যের মালভূমির ধনী মুসলিম সালতানাত–গোলকুণ্ডা এবং বিশেষ করে আহমেদনগর আর বিজাপুর–সবসময়ে চেষ্টা করেছে নিজেদের স্বাধীনতা আর তারচেয়েও বেশি প্রয়াস নিয়েছে নিজেদের ভূখণ্ডে অবস্থিত রত্নখনির প্রভূত সম্পদ প্রবলভাবে রক্ষা করতে এবং দীর্ঘকাল যাবত মোগলদের জন্য একটা সমস্যা হয়ে রয়েছে। এই রাজ্যগুলো মাঝে মাঝে যদিও পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, কিন্তু অনেকবারই তারা সম্মিলিতভাবে তাদের অধিরাজের বিরুদ্ধে নিজেদের বাহিনী একত্রিত করেছে। তার মনে আছে আকবর তাকে বলেছিলেন কীভাবে তিনি তাদের মোগল কর্তৃত্বের অধীনে এনেছিলেন আর কীভাবে বিজাপুর এবং আহমেদনগরের শাসকেরা সহসা খাজনা পাঠাতে অস্বীকার করায়, তাদের ভূখণ্ডের কিছু অংশ দখল করার জন্য সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে তাঁদের তিনি ভয় দেখিয়েছিলেন।

 দক্ষিণের এই রাজ্যগুলো এখন আবার মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ঝাণ্ডা তুলেছে। শত্রুপক্ষের এবারের সেনাপতি মালিক আম্মার নামে এক অপরিচিত আবিসিনিয়ান। ক্রীতদাস হিসাবে ভারতবর্ষে আগমনের পর সে আহমেদনগরের সুলতানের অধীনে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ক্ষমতার শিখরে উঠে আসে এবং এখন আহমেদনগর আর বিজাপুর উভয় রাজ্যের শাসকরা তাঁদের পক্ষে মোগলদের বিরুদ্ধে গুপ্ত গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তাকে নিয়োগ করেছে। মালিক আম্বার নিজের তুচ্ছ অবস্থান থেকে ক্ষমতার শিখরে উঠে আসায় নিশ্চিতভাবেই সংকল্প, উচ্চাশা আর চারিত্রিক দৃঢ়তার অধিকারী হবার সাথে সাথে অবশ্যই একজন চতুর আর দক্ষ যোদ্ধা। জাহাঙ্গীর ভাবে নিশ্চিতভাবেই পারভেজের চেয়ে ধূর্ত, ছয়মাস পূর্বে মালিক আম্বারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রথমবারের মত অবহিত হবার পরে বিদ্রোহ সমূলে দমন করার আদেশ দিয়ে যাকে দাক্ষিণাত্যে প্রেরণ করেছিল।

জাহাঙ্গীর তার মন্ত্রণা কক্ষে প্রবেশ করার সময় তার সেনাপতি আর উপদেষ্টারা তাকে স্বাগত জানাতে উঠে দাঁড়ালে সে তাদের প্রত্যেকের চেহারায় একায়ত অভিব্যক্তি দেখতে পায়। তাদের ভিতরে ইকবাল বেগের দীর্ঘদেহী অবয়ব, পারভেজের সাথে প্রেরিত তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ আধিকারিকদের অন্যতম, তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর মুখাবয়বের বলিরেখায় চরম পরিশ্রান্তির ছাপ। তাঁর একহাতে পট্টি বাঁধা আর সেটা একটা দড়ির সাহায্যে কাঁধ থেকে ঝোলানো রয়েছে। পট্টির উপরে ভেসে উঠা রক্তের ছোপ দেখে বোঝা যায় তার ক্ষতস্থান এখনও পুরোপুরি সারে নি।

 ‘ইকবাল বেগ, আপনার অভিযানের পুরো প্রতিবেদন আমাদের সামনে পেশ করেন, জাহাঙ্গীর বৃত্তাকারে উপবিষ্ট উপদেষ্টাদের কেন্দ্রে নিজের নির্ধারিত আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে বলে।

‘জাহাপনা, আমি খেদের সাথে জানাচ্ছি মালিক আম্বার আমাদের বাহিনীর ললাটে দুর্ভাগ্যজনক এক পরাজয়ের কলঙ্ক এঁকে দিয়েছে। আমরা অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়েছি এবং আমাদের সহস্রাধিক সৈন্য নিহত হয়েছে আর ততোধিক সৈন্য আহত হয়েছে। আমরা বিশাল একটা ভূখণ্ড হারিয়েছি।’

‘আমাকে ঠিক কি ঘটেছিল বিস্তারিতভাবে খুলে বলো, জাহাঙ্গীর আদেশ দেয়, চেষ্টা করে তাঁর অনুভূত উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কোনো লক্ষণই যেন তার অভিব্যক্তিতে প্রকাশ না পায়।

ইকবাল বেগকে, অবশ্য দৃশ্যত বিপর্যস্ত দেখায়, সে তার অক্ষত হাত দিয়ে নিজে আচকানের প্রান্তদেশ অস্বস্তির সাথে মোচড়ায় নিজের বিপর্যয়ের কাহিনী পুনরাবৃত্তি করার সময়। একদিন সকাল বেলা দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত সংকীর্ণ এক উপত্যকায় আমাদের অস্থায়ী ছাউনিতে আমার লোকেরা তাদের তৈরি করা রান্নার আগুনের চারপাশে জটলাবদ্ধ হয়ে অবস্থান করে, ওম পোহাচ্ছিল আর ডাল এবং চাপাটি সহযোগে যখন সকালের প্রাতরাশ করছিল ঠিক সেই সময় মালিক আম্বারের অশ্বারোহী বাহিনী অতর্কিতে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আপনার সন্তানের আদেশে মোতায়েন করা আমাদের গুটিকয়েক প্রহরী চৌকিকে শস্য মাড়াইয়ের কস্তুনীর সামনে পড়া তুষের ন্যায় ছত্রভঙ্গ করে তারা আমাদের শিবিরের মাঝে উন্মত্তের ন্যায় বিচরণ শুরু করে, আমরা যখন আমাদের কোষবদ্ধ অস্ত্র আর অন্যান্য উপকরণের জন্য সংবেগে ছুটোছুটি করছি বা তাদের উদ্যত তরবারি আর বর্শার ফলা তাবুর অগ্নিকুণ্ড থেকে তুলে নেয়া জ্বলন্ত কাঠের টুকরোর সাহায্যে প্রতিরোধের চেষ্টা করছি, তারা নির্বিচারে আমাদের অসংখ্য সৈন্যকে হতাহত করে।

জাহাঙ্গীর লক্ষ্য করে ইকবাল বেগ যখন তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছে তাঁর মুখ তখন অশ্রুতে ভিজে গিয়েছে। একদল অশ্বারোহী আমার পুত্র আসিফ আর তাঁর গুটিকয়েক সঙ্গীকে কয়েকটা মালবাহী শকটের কাছে কোণঠাসা করে ফেলে তারা যখন সেসব শকটে রক্ষিত সিন্দুকের অর্থ আর অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। সে আর তার সহযোদ্ধারা যদিও বীরত্বের সাথে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল কিন্তু তাঁরা লড়াই করছিল মাটিতে দাঁড়িয়ে আর তাঁদের সাথে ছিল কেবল তরবারি। তাঁরা অশ্বারোহীদের আহত করার জন্য তাদের কাছে যেতেই ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে, মালিক আম্বারের একজন যোদ্ধা আসিফকে তার বর্শার ধারালো ইস্পাতের ফলায় বিদ্ধ করে। আঘাতটা তাকে হতবিহ্বল করে ফেলে, মালবাহী শকটের কাঠের কাঠামোর এতটাই গভীরে প্রোথিত হয় যে বর্শার অধিকারী সেটা সেখানেই পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আমি তার কাছে পৌঁছাবার পূর্বেই আসিফ মারা যায়…’ ইকবাল বেগের কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গিয়ে ধারাবাহিত ফোঁপানিতে পরিণত হয়। জাহাঙ্গীর জানে আসিফ ছিল তার একমাত্র জীবিত সন্তান।

ইকবাল বেগ আরেকদফা কথা থামিয়ে নিজের রুমাল দিয়ে মুখ থেকে অশ্রু মোছে এবং ধীরে ধীরে আত্মসংবরণ করে, সে বলতে শুরু করে। সংগঠিত প্রতিরোধের ন্যূনতম সম্ভাবনা নাকচ করে, মালিক আম্বারের লোকেরা এরপর নিজেরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়। প্রথম দলটা মনোনিবেশ করে আমাদের যত বেশি সংখ্যক রণহস্তী হত্যা করা যায় সেই প্রচেষ্টায়, তাঁরা জম্ভগুলোর মুখে বর্শার ফলা আমূল বিদ্ধ করে কিংবা স্রেফ তাঁদের শূড়গুলো কেটে দেয় যা ছাড়া প্রাণীগুলো বাঁচতে পারবে না। দ্বিতীয় দলটা আমার ছেলে যে মালবাহী শকটের বহর রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে সেখান থেকে নগদ অর্থ আর যত বেশি সংখ্যক অন্যান্য উপকরণ তাঁরা বহন করতে পারবে সেই প্রয়াস নেয় এবং তৃতীয় দলটা আমাদের অস্থায়ী শিবিরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ড থেকে জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে আমাদেরই শিবিরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা এরপরে যেমন ঝড়ের বেগে নেমে এসেছিল ঠিক সেই দ্রুততায় ফিরে যায়। আমাদের পক্ষে হতাহতের সংখ্যা এতবেশি ছিল আর সত্যি কথা বলতে আমাদের আত্মবিশ্বাসে এমনই চিড় খেয়েছিল যে তাদের পিছু ধাওয়া করার মানসিকতাও আমাদের তখন ছিল না। আহত পশুর মত নিজেদের ক্ষতস্থান পরিচর্যা করা ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি নি।

‘তাঁরা এত সহজে কীভাবে আপনাদের শিবিরে হামলা করলো? জাহাঙ্গীর কঠো কণ্ঠে জানতে চায়।

 ‘তারা পাহাড় টপকে এসে আক্রমণ করেছিল বিশাল কোনো বাহিনীর পক্ষে যা অনতিক্রম্য বলে আমরা ধরে নিয়েছিলাম। সেনাপতি মাথা নত করে বলে। জাহাপনা, আমার স্বীকার করে লজ্জা নেই, তাঁরা আমাদের চেয়ে এলাকাটা ভালো করে চিনে।

 ‘আর আমার ছেলে পারভেজ?’

 ‘আক্রমণ যখন শুরু হয় তিনি তখনও নিজের তাবুতেই অবস্থান করছিলেন। তার দেহরক্ষী দল সর্তক আর সশস্ত্র ছিল যেমনটা তারা সবসময়েই থাকে। তারা আপনার সন্তানের তাবুর চারপাশে ভালোমতই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আর তাছাড়া, মালিক আম্বার সহজ লক্ষ্যবস্তুকে আক্রমণের নিশানা করেছিল। আমাদের আরও সর্তক থাকা উচিত ছিল… আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, জাঁহাপনা।

 ‘আমি আপনার মনোভাব অনুধাবন করতে পারছি এবং আপনার সন্তান বিয়োগে আমিও আপনার সাথে শোকাগ্রস্থ। যা হবার হয়ে গিয়েছে। মালিক আম্বারের এই ধৃষ্টতা আর আমাদের ভূখণ্ড থেকে তাকে বিতাড়িত করার প্রতি আমাদের এখন নিজেদের সমস্ত প্রয়াস নিবদ্ধ করতে হবে। এটা কীভাবে সর্বোত্তম উপায়ে হাসিল করা সম্ভব আসুন আমরা সবাই মিলে সেটা আলোচনা করি। আমরা আগামীকাল সকালে আমাদের আলোচনা শুরু করবো।

যুদ্ধ উপদেষ্টাদের সভা শেষ হলে জাহাঙ্গীর খুররমকে অপেক্ষা করতে বলে। এই পরাজয় একটা অপমান যার অবশ্যই প্রতিশোধ নিতে হবে। আমরা যদি এটা করতে ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের প্রতিবেশীরা এমনকি বিদ্রোহভাবাপন্ন সামন্ত রাজ্যগুলোও ব্যাপারটা থেকে প্রেরণা লাভ করতে পারে। আমি পারভেজকে ফেরত আসতে আদেশ দিচ্ছি। যুদ্ধ করার মত মন মানসিকতা তার নেই এবং ইকবাল বেগ যদিও বিষয়টা উল্লেখ করার মত অবস্থানে নেই কিন্তু আমার অন্য সেনাপতিদের কথা যদি ঠিক হয় তাহলে খুব কম সময়েই সে সংযত অবস্থায় থাকে। আমার মনে হয় শিবিরের চারপাশে যথেষ্ট সংখ্যক প্রহরী মোতায়েন আর তাঁর দেহরক্ষীরা যখন সজাগ এবং বাইরে গিয়ে শক্রর মোকাবেলা করছে তখন তার তাবুতে অনর্থক সময়ক্ষেপন উভয়ের পেছনেই তার সুরাপানের একটা ভূমিকা রয়েছে। সে অভিযানের দায়িত্ব লাভের জন্য আমার কাছে রীতিমত অনুনয় করেছিল এবং আমিও ভেবেছিলাম দায়িত্ব লাভ করলে সে নিজেকে শুধরে নিতে চেষ্টা করবে, কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম।

খুররম কোনো উত্তর দেয় না। সে আর পারভেজ যদিও কেবল দুই বছরের ছোটবড়, তাঁরা দুজনে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বড় হয়েছে আর তাদের ভিতরে কখনও কোনো ধরনের ঘনিষ্ঠতা ছিল না। জাহাঙ্গীর আলোচনা চালিয়ে যায়, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার পরিবর্তে তোমায় রাজকীয় সেনাবাহিনীর সেনাপতি করে দাক্ষিণাত্যে প্রেরণ করবো। মহামান্য সম্রাজ্ঞী তাই বলেছেন এবং আমিও তার সাথে একমত যে তুমি তার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য। মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করো এবং তখন দেখবে আরো অনেক সম্মান তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

 ‘আব্বাজান, আমি আপনাকে নিরাশ করবো না, খুররম, জীবনে প্রথমবারের মত স্বাধীন নেতৃত্ব লাভের উত্তেজনা কোনোমতে গোপন করে, বলে।

 ‘খুশি হলাম। আজ থেকে তোমার অভিযান শুরু হওয়া পর্যন্ত–যা আমার ইচ্ছা তোমার জন্য নতুন সৈন্য আর উপকরণ প্রস্তুত হওয়া মাত্র শুরু হোক–আমি চাই যুদ্ধ উপদেষ্টাদের প্রতিটা বৈঠকে তুমি উপস্থিত থাকো।

*

আগ্রা দূর্গ থেকে নিজের হাভেলীর সদর দরজা পর্যন্ত পুরোটা পথ খুররমের তূরীয় আনন্দ বজায় থাকে, সেখানে পৌঁছে সে আরজুমান্দকে কি বলবে সেটা চিন্তা করতে গিয়ে তার আনন্দের সলিল সমাধি ঘটে। তাঁদের কন্যা জাহানারার বয়স মাত্র দুই বছর। তাদের দুজনকে এখানে রেখে যাবার চিন্তাটাই অকল্পনীয়। আর তাছাড়া আরজুমান্দ কি বলবে? কিন্তু সে এমন একটা সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করেছিল আর তার উচিত সুযোগটা গ্রহণ করা। সে যদি আরজুমান্দের মুখোমুখি হতে না পারে তাহলে শত্রুর মোকাবেলা কীভাবে করবে? সে হেরেমের দিকে অগ্রসর হবার সময় নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন করে।

আরজুমান্দ বরাবরের মতই তার জন্য অপেক্ষা করছিল। আজ তাঁর পরনে নীল রঙের স্বচ্ছ পাজামা আর আঁটসাট কাচুলি যার ফলে তার তলপেট অনাবৃত, এবং তার নাভীমূলে হীরকখচিত একটা পোখরাজ জ্বলজ্বল করছে। তার মনে হয় সে বোধহয় আগে কখনও তাকে এত সুন্দরী দেখেনি, ভাবনাটা আজ এজন্যই যে সম্ভবত সে জানে যে তাঁর রূপ উপভোগের বিলাসিতা থেকে সে অচিরেই বঞ্চিত হতে চলেছে।

 সে আশ্লেষে তাঁর অধর চুম্বন করে তারপরে ব্যগ্র ভঙ্গিতে তাঁর দু’হাত ধরে।

 ‘আরজুমান্দ। আব্বাজান আজ আমায় বিশাল এক সম্মানে ভূষিত করেছেন। তিনি আমায় দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধমান রাজকীয় বাহিনীর অধিনায়কত্ব দান করেছেন। আমি যদি এই দায়িত্ব পালনে সফল হই তাহলে সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে তিনি সর্বসম্মক্ষে আমায় তার উত্তরাধিকার হিসাবে ঘোষণা করবেন…’।

সে কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে থাকে তারপরে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, আমি আপনার জন্য গর্ব অনুভব করছি। আপনি আপনার আব্বাজানের প্রত্যাশা ছাপিয়ে যাবেন। আপনাকে কবে নাগাদ রওয়ানা দিতে হবে?

‘অচিরেই। আমার কেবল একটা বিষয়েই আক্ষেপ থাকবে… যে আমাকে আমার স্ত্রী কন্যাকে এখানে রেখে যেতে হচ্ছে।

আরজুমান্দ তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। আপনাকে কেন এমনটা করতে হবে?

‘আমি তোমায়–পাঁচশো মাইল কিংবা তারও বেশি পথ–যা বিপদসঙ্কুল, গরম আর অস্বস্তিকর সেখানে নিয়ে যেতে পারি না। তোমার সেখানেই থাকা উচিত যেখানে আমি জানবো যে তুমি নিরাপদে রয়েছে।’

 ‘খুররম, আপনি যখন বলেছিলেন আপনাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে হবে–যে এটা আপনার কর্তব্য–আমি সেটা মেনে নিয়েছিলাম। আমি এখন আপনাকে বলছি যে আমি অবশ্যই আপনার সাথে যাব–কারণ সেটা আমার কর্তব্য–আর আপনার সেটা মেনে নেয়া উচিত। আমার দাদাজান আর দাদিজান পরিস্থিতি যতই বিপদসঙ্কুল হোক সবসময়ে একত্রে থেকেছেন। তাঁরা ভালো করেই জানতেন যে অন্য যেকোনো সম্ভাবনার চেয়ে তাঁদের পৃথক হওয়াটা সবচেয়ে জঘন্য পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নিসাকেই দেখেন–তাঁরা কখনও পরস্পরের কাছ থেকে পৃথক হোন না। তিনি যখন শিকারে যান এমনকি তখনও তিনি তার সাথে থাকেন। সম্রাটের চেয়ে তিনি একজন দক্ষ নিশানাবাজ আর শিকারী। তারা যখন একা থাকেন তখন তিনি তাঁর সাথে একত্রে ঘোড়ার পিঠে পর্যন্ত আরোহণ করেন। আমি নিশ্চিত তিনি যদি যুদ্ধ যাত্রা করেন তাহলে মেহেরুন্নিসাও তাঁর সঙ্গী হবেন। আমি তাহলে কেন ভিন্ন আচরণ করবো?

‘তুমি শারীরিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী নও। জাহানারার জন্মের সময় তোমায় কঠিন সময় অতিবাহিত করতে হয়েছিল… তোমার এখানে থাকা উচিত যেখানে সবসময়ে সেরা হেকিম পাওয়া যাবে, তোমার আবারও গর্ভধারণ করা উচিত…’।

‘সেরা হেকিম আমাদের সাথেই যেতে পারে। খুররম আমি কাঠের পুতুল নই। আমি এখানে হারেমের স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করি কিন্তু আপনার সাথে একত্রে থাকার আনন্দের সাথে এসব কিছুর তুলনাই চলে না। আমায় যদি নগ্ন পায়ে জাহানারাকে কোলে নিয়ে আপনাকে অনুসরণ করতে হয় আমি করবো আর সেটা খুশি মনেই করবো।’ সে তার কব্জি আঁকড়ে ধরে এবং খুররম তার নখের তীক্ষ্ণতা নিজের পেশীতে বেশ অনুভব করে। সে তাকে কখনও এতটা সংকল্পবদ্ধ দেখেনি, তাঁর কোমল মুখাবয়বে এখন প্রায় যুদ্ধংদেহী একটা অভিব্যক্তি।

 ‘আমার আব্বাজানের সম্ভবত উচিত আমার বদলে আপনাকে মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করা–আপনাকে দারুণ হিংস্র দেখাচ্ছে। সে মুচকি হাসে, আশা করে প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে আরজুমান্দও হেসে ফেলবে, কিন্তু তাঁর অভিব্যক্তি সামান্য শীথিলও হয় না। তার এখন কি করা উচিত? পরবর্তী সম্রাট হিসাবে নিজের যোগ্যতা প্রদর্শনের সুযোগ আব্বাজান তাকে দিয়েছেন… সে যদিও সমরবিদ্যায় প্রশিক্ষণ নিয়েছে, ঘন্টার পর ঘন্টা ওস্তাদের কাছে পূর্ববর্তী মোগল অভিযানের কৌশল অধ্যয়ন করেছে, খঞ্জর, তরবারি, গাদাবন্দুক আর গদা নিয়ে লড়াই করতে জানে কিন্তু সে পূর্বে কখনও কোনো অভিযান পরিচালনা করে নি। তার মনোনিবেশে কোনোকিছু–কোনো ব্যক্তিও–যেন বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। সেই সাথে এটাও সত্যি আরজুমান্দকে এখানে রেখে যাবার অর্থ নিজের দেহের একটা অংশকেই নিজের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। সে যদি একটা বিষয়ে নিশ্চিত থাকে যে প্রতিটা দিনের শেষে সে এখানে তার জন্য প্রতিক্ষা করছে তাহলে সম্ভবত সে আরও পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে আরও দক্ষতার সাথে লড়াই করতে পারবে। সে নিশ্চিতভাবেই আনন্দিত হবে…

‘খুররম…’ তার নখ আরও গভীরভাবে আঁকড়ে বসে।

সবকিছুই সহসা অনেক সহজ হয়ে যায়। তাদের পরস্পরের কাছ থেকে পৃথক হতে হবে না আর সেও তাকে নিরাপদ রাখার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করবে। বেশ। চলো একসাথেই যাওয়া যাক।

 ‘আর সবসময়েই তাই হবে। তাঁর কণ্ঠস্বর আত্মপ্রত্যয়ে গমগম করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *