২.০৮ বিভেদের সূচনালগ্ন

২.৮ বিভেদের সূচনালগ্ন

‘জাহাপনা, আমি আবারও আপনার সমঝোতার জন্য আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। রাজেশ অশ্বশালার আধিকারিক হিসাবে যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করবে–নিঃসন্দেহে আলিম দাসের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষতার সাথে লোকটা একে দূর্নীতিপরায়ণ তার উপরে ঘোড়াও ঠিকমত চিনে না। মহবত জান মাথা নত করে অভিবাদন জানায় এবং তারপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরবার হল ত্যাগ করে। জাহাঙ্গীর এত সহজে রাজেশকে বহাল করতে রাজি হয়েছে দেখে সে অবাক হয়েছে। বস্তুত পক্ষে ঘোড়া সম্পর্কে রাজেশের জ্ঞান পূর্ববতী আধিকারিকের চেয়ে সামান্যই বেশি আর তার মাঝেও অর্থগৃধনুতার লক্ষণ রয়েছে এবং নিজের অবস্থান ব্যবহার করে সেও হয়তো লাভবান হতে চেষ্টা করবে। অল্প কয়েকজন আধিকারিকই এর উপরে উঠতে পারে। কিন্তু নিদেন পক্ষে সে খারাপ না, আর তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত আধিকারিকের জন্য এই বহালটা একটা উপযুক্ত পুরষ্কার।

শ্রীনগরের হরি প্রাবত দূর্গে নিজের বিলাসবহুল আবাসন কক্ষের দিকে সে হেঁটে যাবার সময়, মহবত খান রাজপরিবারকে বন্দি করার পরের মাসগুলোর ঘটনাবলী গভীরভাবে ভাবে। সে অনেক ভাবনা চিন্তার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাঁরা একসাথেই শ্রীনগর অভিমুখে তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখবে। তারা তাদের স্বাভাবিক যাত্রা বজায় রাখলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে যে কোথাও কোনো অনভিপ্রেত অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটে নি সেই সাথে তারা যদি আগ্রা বা লাহোর ফিরে যায় তাহলে কীভাবে অন্যান্য অমাত্য আর আধিকারিকদের প্রশ্নের উত্তর দেবে সেই দায় থেকে তাকে মুক্তি দেবে। কাশ্মীরের সুবেদার তার একজন পুরান সহযোদ্ধা এবং পারস্যের তাবরীজ থেকে আগত। সে উভয় কারণেই তাকে সম্ভাব্য সমব্যথী হিসাবে ভেবে নিয়েছে এবং সেটাই হয়েছে, অবশ্য দামী উপহার আর পদোন্নতির প্রস্তাবে সেটা আরও জোরদার হয়েছে।

তাঁর নিজের কাছে সবচেয়ে কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছে–এবং এখনও সেটার সমাধান হয়নি–নিজের এই নতুন প্রাপ্ত ক্ষমতা কীভাবে ব্যবহার করবে সেটা নিয়ে; কীভাবে তাঁর এই নিয়ন্ত্রণকে অস্থায়ী তকমা মুক্ত করা যায়। সে জাহাঙ্গীর বা মেহেরুন্নিসার সাথে যখন কথা বলে তারা তাঁর পরামর্শ বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়। তারা কেবল একবারই আপত্তি জানিয়েছিল যখন সে তাদের কয়েকজন ঘনিষ্ট পরিচারককে পরিবর্তনের বা কাশ্মীর যাত্রায় তাদের সাথে আগত অবশিষ্ট দেহরক্ষীদের বরখাস্ত করার প্রস্তাব করেছিল। সে তাদের অভিপ্রায় বাহ্যিক ভাবমূর্তির কারণে মেনে নিয়েছিল এবং তাদের পরিচারক আর দেহরক্ষীরা তাঁদের সাথেই রয়েছে।

জাহাঙ্গীরের স্বাস্থ্য অবশ্য বেশ দুর্বল। তিনি সামান্যই আহার করেন কিন্তু আফিম আর সুরা পানের মাত্রা তাঁর দিন দিন বেড়েই চলেছে। মহবত খান চোখের সামনে দেখতে পায় যে আটান্ন বছর বয়সের একজন পুরুষের পুরো দেহে মাদকের বাহুল্য তাঁদের ছাপ ফেলতে শুরু করেছে। দিনের অধিকাংশ সময় পারিপার্শ্বিকের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ আর ঝাপসা চোখের পাশাপাশি আজকাল প্রায়ই কাশির দমকে তাঁর শরীর কুঁকড়ে যায়। তিনি অবশ্য এখনও দাবি করেন যে কাশ্মীরের পাহাড়ী বাতাসে তাঁর ফুসফুস পরিষ্কার হয়ে যাবে, কিন্তু মহবত খানের মনে হয় সুন্দর পাহাড়ী উপত্যকার উপকারী প্রভাব কার্যকর হতে বেশি সময় নিচ্ছে।

সম্রাট এখনও অবশ্য মাঝে মাঝে যখন তিনি মাদকের প্রভাব থেকে মোটামুটি মুক্ত থাকেন, তখন সামরিক বিষয়ে বিচক্ষণ পরামর্শ দিয়ে এবং তাঁর অমাত্য আর আধিকারিকদের চরিত্র এবং ব্যর্থতা সম্বন্ধে তীক্ষ্ণ মন্তব্য করে মহবত খানকে চমকে দেন। গাছপালা আর পশুপাখি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের নিয়মকানুন বিশেষ করে কাশ্মীর সম্বন্ধে সম্রাটের বিশদ জ্ঞান দেখে পার্সী সেনাপতি যারপরনাই মুগ্ধ হয়।

জাহাঙ্গীর একবার মাত্র একবারই মহবত খানকে তার বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন। তারা দুজনে একদিন ডাল হ্রদের তীরে ঘোড়ায় চেপে পাশাপাশি ভ্রমণ করছিলো, দেহরক্ষীরা তাঁদের একটু পিছনে অবস্থান করছে তাদের উভয়ের সাথে সবসময়ে যাদের অবস্থান করা সম্রাটের পলায়ন রোধ করার ক্ষেত্রে আর আততায়ীর হাত থেকে তাঁর নিজের সুরক্ষার কারণে মহবত খানের কাছে বিচক্ষণতার পরিচায়ক বলে মনে হয়েছে, যখন জাহাঙ্গীর সহসা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মহবত খান, তুমি কি এখনও যা চাও সেটা চাইবার ক্ষেত্রে সতর্ক হতে শিখেছো? আমিও অসীম ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইতাম যখন সেটা তখনও আমার হয়নি। আর আমি যখন সেটার অধিকারী হলাম, আমি দেখলাম সেই ক্ষমতা নিয়ে কি করবো সেটা ঠিক করা আরো বেশি কঠিন, কাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করবো এমনকি নিজের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠদের ভিতরে যারা রয়েছে তাদের বিষয়েও কখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারি নি।

মহবত খান এই স্বীকারোক্তির সততা অনুধাবন করে মুখ কুঁচকায় কিন্তু জাহাঙ্গীর বোধহয় সেটা লক্ষ্য করেননি এবং তিনি বলতে থাকেন, ‘ক্ষমতা বেশিরভাগ লোকেরই অবক্ষয় ঘটায়। আমি জানি আমার ক্ষেত্রে এটা হয়েছে, আর সেজন্যই আমার স্ত্রীর প্রস্তুত করা আফিম আর সুরার মিশ্রণের ভিতর দিয়ে এর কেন্দ্র থেকে সরে যেতে পেরে আমি আনন্দিত। সম্রাজ্ঞীর উপরে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব অর্পণ করাটা ছিল পরম স্বস্তিদায়ক আর তিনিও এখন সেই দায়িত্ব থেকে মুক্ত কারণ তুমি সেটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। আমি তোমায় সতর্ক করে দিতে চাই, ক্ষমতা নিঃসঙ্গতার দ্যোতক–বা আমার কাছে অন্তত তাই মনে হয়েছে। জাহাঙ্গীর এক মুহূর্ত কি যেন ভাবে তারপরে আবার বলতে শুরু করে। সম্ভবত আমি যে সময় এটা লাভ করেছিলাম ততদিনে আমি নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করতে শুরু করায় সেটা আরও বেশি করে মনে হয়েছিল। আমার দাদিজান হামিদা সদ্য মৃত্যুবরণ করেছেন–আমার একটা বিশাল আশ্রয়স্থল ছিলেন– অবশ্যই আমার আব্বাজানের মতই… যদিও আজ পর্যন্ত আমি জানি না তিনি আমায় কি আসলেই ভালোবাসতেন–এবং আমি তারপরেই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, আমার দুধ-ভাই সুলেমান বেগকে হারাই। আমার কোনো সন্তানের সাথে আমার কোনো ধরনের ঘনিষ্ঠতা জন্মায় নি বা আমার স্ত্রীদের সাথে। আমি কিছু দিন আমার কর্তৃত্বের মাঝে মহিমান্বিত হয়ে ছিলাম আর কখনও–এখন আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই–ক্ষমতার প্রয়োগে ছিলাম নির্মম আর খামখেয়ালী। তারপরে আমি মেহেরুন্নিসাকে বিয়ে করি। আমি তাকে ভালোবাসতাম এবং এখনও ভালোবাসি। আমার বিশ্বাস, তিনিও, আমায় ভালোবাসেন…আমায় সেই সাথে আমার ক্ষমতাকেও ভালোবাসেন। তিনি যত বেশি ক্ষমতার অধিকারী হতে চেয়েছেন আমি তার হাতে ততবেশি ক্ষমতা তুলে দিয়েছি। আমি কি ভুল করেছিলাম…?

 জাহাঙ্গীর যত দীর্ঘ সময় কথা বলে তাঁর কণ্ঠস্বর ততই সমাহিত এবং অন্তবীক্ষপ্রবণ হয়ে উঠে আর একটা পর্যায়ে তিনি কথা বন্ধ করে সূর্যের আলোয় ডাল হ্রদের ঝিকমিক করতে থাকা পানির মাঝামাঝি কোথাও একটা অনির্ণেয় বিন্দুর দিকে আবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। মহবত খান কোনো উত্তর দেয় না এবং জানে যেকোনো উত্তর প্রত্যাশা করাও হয় নি বা তার কোনো প্রয়োজনও নেই।

সম্রাজ্ঞীর কি মনোভাব? সে ভাবতে চেষ্টা করে। সে যখনই জাহাঙ্গীরের সাথে কথা বলার সুযোগ পেতো তখনই তিনি সেখানে নিয়মিতভাবেই উপস্থিত থাকতেন এবং তাঁর সামনে কোনো ধরনের পর্দা বজায় রাখার ভান। পুরোপুরি ত্যাগ করতেন, যদিও বাকি সময় তিনি হেরেমের নির্জনতার মাঝে প্রত্যাবর্তন করতেন। তাঁদের যখনই দেখা হয়েছে তিনি অকপট চোখে তার চোখের দিকে তাকিয়েছেন এবং কখনও কখনও বিশেষ করে যখন তিনি বলতেন যে সম্রাটের ক্ষমতা তিনি ধারণ করেন, যে তিনি তাঁরই আদেশ পালন করেন, তাঁর চোখে সে যে অভিব্যক্তি দেখেছে তাকে কল্পনা করতে বাধ্য করেছে যে নিয়ন্ত্রণ লাভের একটা অনুষঙ্গ হিসাবে তাকেও প্রলুব্ধ করার ধারণা কখনও হয়ত তিনি অলস মনে চিন্তা করেছেন। তাঁর এখন মাত্র চল্লিশ বছর বয়স, তাঁর নিজের চেয়ে বয়সে মাত্র কয়েক বছরের বড় এবং রমণীদের যখন বয়স হয় বা তাদের শরীরে মেদ জমে তখন প্রায়শই যেমন হয়ে থাকে যে মোমবাতির গা বেয়ে গড়িয়ে নামা মোমের মত তাঁদের মাংসপেশী ঝুলে পরতে শুরু করে তেমনটা তার ক্ষেত্রে এখনও হয় নি। সে অবশ্য প্ররোচনার ধারণাটা কল্পনা হিসাবে বিবেচনা করে মন থেকে কঠোর ভাবে ঝেড়ে ফেলে কিন্তু তারপরেও এখনও তাদের যখন দেখা হয় সেই নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তিনি যখন মৃদু কণ্ঠে কথা বলেন এবং হাসেন সে সাধারণত, কোনো অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই, তার অনুরোধের প্রতি সম্মতি দেয়, যেমনটা অবশিষ্ট দেহরক্ষীদের মোতায়েন রাখার ক্ষেত্রে দিয়েছে।

 তিনি কি সম্রাটকে ভালোবাসেন? হ্যাঁ, সম্ভবত তিনি তাকে ভালোবাসেন। তিনি অবশ্য তাকে আফিমে আসক্ত করে তুলেছেন। তিনি অবশ্যই সম্রাটের ক্ষমতা উপভোগই করেন এবং মোটেই লাজুক নন তার ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারটা মানুষকে জানাতে। সে বহুবার এটা প্রত্যক্ষ করেছে। অবশ্য তিনি যখন তাঁর কপাল মুছে দেন বা তার অসুস্থতার সময়ে তিনি যখন তার সামনে থুতু ফেলার জন্য পিকদানি তুলে ধরেন তখন সে তার চোখে মুখে ভালোবাসার ছায়া দেখতে পেয়েছে। তাঁর নিজের মত বোধহয় তাঁরও অভিপ্রায়গুলো তালগোল পাকান। তারা যখন দক্ষিণে লাহোর অভিমুখে ফিরতি পথে দীর্ঘ যাত্রা শুরু করবে তখন হয়তো সবকিছু অনেক প্রাঞ্জল হয়ে উঠবে, যা আর বেশি দিন বিলম্বিত করা যাবে না। রাতের বেলা আজকাল বেশ শীত পড়ছে এবং শরতকাল প্রায় শেষ হয়ে আসছে। তাকেও ততদিনে নিজের কর্তব্য করণীয় সম্বন্ধে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। সম্রাটকে তার দলবলসহ বন্দি করার বিষয়ে সে সতর্কতার সাথে পরিকল্পনা করেছিল, সে অনুধাবন করে নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্বন্ধে সে যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করে নি আর এখন কীভাবে নতুন মিত্র অর্জন করা যায় আর ক্ষমতার বলয়ে নিজের জন্য একটা নিরাপদ স্থান সৃষ্টির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হীনতার কারণে সে প্রায় অথর্ব হয়ে পড়েছে। কাশ্মীরে তার আগমনের পরে আসফ খানের নিকট তাঁর জামাতার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য বার্তা প্রেরণ করা ছাড়া সে আর কিছুই মূলত করে নি, চিঠিতে সে খুররমকে তাঁর সন্তানদের সুস্বাস্থ্য আর তাঁদের সাথে ভালো আচরণের বিষয়ে নিশ্চিত করেছে এবং রাজপরিবারের প্রতি তাঁর সার্বিক আনুগত্যের সাথে সাথে খুররমের অবস্থান বিশেষভাবে অনুধাবনের বিষয়ও জানিয়েছে। মহবত খান গভীরভাবে চিন্তা করে তার মন ঠিক করে যে এক সপ্তাহের ভিতরে নিচের সমতলের উদ্দেশ্যে তাদের যাত্রা শুরু করা উচিত।

*

কাশ্মীর ত্যাগ করতে আমার খারাপই লাগবে।’

 ‘যদিও আমরা এখানে বন্দি ছিলাম।’

‘হ্যাঁ। কোনো কিছুই এর সৌন্দর্যকে হরণ করতে পারবে না এবং মহবত খান আমাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল।’

 ‘তাকে সেই শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য কোনো মূল্য দিতে হয় নি। সে যদি আপনার কাছে জানতে চাইতো যে আপনি কাশ্মীর ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত কিনা তাহলে সেটা হতো প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন। সে তার পরিবর্তে যাত্রার দিনটা কেবল মার্জিতভাবে ঘোষণা করে গেল যেন আমরা তার ভৃত্য।

‘আমাদের পক্ষে এখানে আর বেশি দিন অবস্থান করা সম্ভব হতো না, তাঁর প্রতি কোনো ধরনের পক্ষপাত প্রদর্শন না করেও বলতেই হয়। আর কয়েক সপ্তাহের ভিতরেই গিরিপথে শীতের প্রথম তুষারপাত শুরু হয়ে যাবে।’

 ‘সত্যি। যাই হোক, মহবত খানের ধৃষ্টতা সত্ত্বেও, আমরা এখান থেকে বিদায় নেওয়ায় আমি আনন্দিত। আমাদের পরিকল্পনার সাফল্য সমতলে আমাদের প্রত্যাবর্তনের উপরে নির্ভর করছে। মেহেরুন্নিসা উঠে বসে এবং তাঁর স্বামীর জন্য গোলাপজলে সামান্য পরিমাণ আফিম মিশ্রিত করতে থাকে। কাশ্মীর ত্যাগ করে আমরা যখন নিচে নামতে থাকবো আপনি তখন মহবত খানের যেকোনো অনুরোধের প্রতি সম্মতি প্রদর্শনের কথাটা স্মরণ রাখবেন, আপনি পারবেন’না? পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় এখন যখন ঘনিয়ে এসেছে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে তাঁর মনে সন্দেহ উদ্রেক করে এমন কোনো কিছুই আমরা করবো না বা বলবো না।

 ‘অবশ্যই। সে যাই হোক, মহবত খান খুব সামান্যই অনুরোধ করে।

 ‘আপনি সেই সাথে আপনার নাতিদের সামনে অবশ্যই সতর্ক থাকবেন। বাচ্চারা তাদের শোনা উচিত নয় এমন কিছু শোনার ব্যাপারে এবং তারপরে লোকজনকে মুগ্ধ করার জন্য সেটা বোকার মত বলতে ভীষণ পারদর্শী।

 ‘আমি কিছুই বলিনি।

 ‘ভালো। তারপরেও অবশ্য ঝুঁকি থেকেই যায় যে তারা তাদেরকে তাদের বাবা-মা’র কাছে ফেরত পাঠাবার বিষয়ে মহবত খানকে রাজি করাবার জন্য তাঁরা আড়ি পেতে শুনেছে এমন কিছু হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করবে–বিশেষ করে দারা শুকোহ্। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি সে মহবত খানের সাথে ঘুরতে, তাঁর কাছে যুদ্ধের গল্প শুনতে ভীষণ পছন্দ করে এবং সে সবসময়েই তাকে প্রশ্ন করতে থাকে।’

 ‘দারা বুদ্ধিমান আর কৌতূহলী ছেলে। আর তাছাড়া, সব বাচ্চারাই কি প্রশ্ন করে না? আমি করতাম, আমার বেশ মনে আছে। পুরোটাই বড় হয়ে উঠার একটা অংশ।’

‘সম্ভবত। কিন্তু আমাদের তারপরেও সতর্ক থাকতে হবে, বিশেষ করে আমরা যখন আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের নিকটবর্তী হতে শুরু করেছি।’

‘আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা যদি তোমার এসব ষড়যন্ত্রের পরিবর্তে মহবত খানের সাথে কোনো ধরনের সমঝোতা, একটা সুবিধাজনক উপযোজনে উপনীত হতে পারতাম। ‘আপনি এমনভাবে বলছেন যেন মহবত খানকে বিশ্বাস করা যায়। তার মনে আসলেই কি রয়েছে সে বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না।’

 ‘তোমার নিশ্চয়ই মনে হয় না যে সে আমাদের কোনো ক্ষতি করতে চায়?

‘সে একজন মার্জিত ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং সে নিঃসন্দেহে একজন দক্ষ সেনাপতি, কিন্তু একটা বিষয় কখনও ভুলে যাবেন যে সে সর্বোপরি একজন বিশ্বাসঘাতক যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে যা জোর করে নয়, আপনিই কেবল প্রদান করতে পারেন। সে সেইসাথে বিশাল একটা ঝুঁকি নিয়েছে, যা–সে যদি অকাট মূর্খ না হয়ে থাকে–সে অবশ্যই বুঝতে পেরেছে। সে যদি নিজের বিপদ বুঝতে পারে তাহলে কে জানে সে তখন ঝোঁকের বশে কি করবে? আর তাছাড়া, আমার “ষড়যন্ত্র” আপনি যে নামেই সেটাকে অভিহিত করেন পরিস্থিতির সাথে মানানসই। মেহেরুন্নিসা গোলাপজল আর আমি একটা গোলাপি বোতলে নিয়ে আঁকায় তারপরে সেখান থেকে খানিকটা ঢেলে নিয়ে সেটা তাঁর হাতে তুলে দেয় এবং তার গায়ের সূক্ষ নক্সা করা কাশ্মিরী শালটা আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে দেয়। জাহাঙ্গীরের কাশিটা বেড়েছে এবং বাতাসে শীতের প্রকোপ বাড়ছে।

 ‘আপনি আমার মত আপনার ভূমিকা পালন করবেন, আপনি করবেন’না? সে আবেদনের সুরে বলে। মহবত খান আমার সম্বন্ধে ভীষণ সতর্ক কিন্তু সে আপনাকে শ্রদ্ধা করে…’

*

জাহাঙ্গীর ঝিলমের উত্তর তীর থেকে তাঁর প্রিয় হাতি বজ্রদায়িনীর হাওদায় উপবিষ্ট অবস্থায়, মহবত খান আর অশোকের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দক্ষিণের তীরে মাটির একটা ঢিবির উপরে তাঁরা দু’জন নিজ নিজ ঘোড়ায় নিরুদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে উপবিষ্ট অবস্থায়, কাশ্মীর থেকে ফিরতি পথের একেবারে শেষ পর্যায়ে ঝিলমের উপরে তাঁরা যে নতুন নৌকার সেতু নির্মাণ করেছে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে। নদীতে এখন স্রোত অল্প এবং বসন্তের চেয়ে অনেকবেশি সংকীর্ণ এবং তারা সেতুর তলদেশ নির্মাণের জন্য দড়ি দিয়ে একসাথে বাঁধার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক নৌকা বেশ সহজেই সংগ্রহ করতে পেরেছে এবং তারপরে একত্রে বাঁধা নৌকাগুলোর উপরে অস্থায়ী ছাউনির নানা বাতিল টুকরো আর কাঠেরখণ্ড তক্তার মত বিছিয়ে দিয়েছে। আহাওয়া এখনও সদয় আচরণ করেছে এবং গিরিপথ আর উপত্যকার ভিতর দিয়ে দ্রুত নিচে নেমে এসেছে। গাছের পাতা এখানে লাল আর সোনালী বর্ণ ধারণ করতে আরম্ভ করেছে এবং স্থানীয় লোকজন আপেল আর নাশপাতির ফলন ঘরে তোলা আর আঙুর ও আখরোট শুকানোর কাজও শেষ করেছে যার জন্য এই এলাকাটা পুরো ভারতবর্ষে বিখ্যাত। কৃষকেরা তাদের শস্যাগারে ভূট্টা, মূলা আর খড় রুক্ষ শীতকালের দীর্ঘ সময়টায় নিজেদের আর নিজেদের গৃহপালিত পশুদের আহারের জন্য মজুদ করছে। একটা প্রায় শান্তসমাহিত যাত্রা যা প্রায় সকলের মনকেই শান্ত করে তুলেছে। মেহেরুন্নিসা আপাতদৃষ্টিতে ফার্সী কবিতাচর্চায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে, সে কেবল জাহাঙ্গীরের জন্য অস্থায়ী ছাউনি ত্যাগ করে বাইরে থেকে শরতের ফুল আর কীটপতঙ্গের নমুনা সংগ্রহ করতে পরিচারকদের আদেশ দিতে নিজের আবাসন এলাকা থেকে বাইরে বের হোন, সে মহবত খানকে জানিয়েছে যে সম্রাট শরতের সৌন্দর্যে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন উদ্যমে প্রাকৃতিক জগৎ সম্বন্ধে তাঁর চর্চা আবার শুরু করেছেন।

মহবত খান সেদিনই সকালের দিকে জাহাঙ্গীরকে জানিয়েছিল যে সন্ধ্যা নামার অনেক আগেই প্রত্যেকে ঝিলমের অন্য তীরে পৌঁছে যাবে, এবং পরের দিন সকালে তারা লাহোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে পারবে। সে তারপরে অশোককে আর তার বাহিনীর এক তৃতীয়াংশের অগ্রবর্তী একটা বাহিনী নিয়ে সেতু অতিক্রম করে, সে রাজেশকে রেখে যায়–সেদিন যার পেছনের দিকের নেতৃত্ব দেবার প্রস্তাব মহবত খান কৃতজ্ঞতার সাথে আর কোনো রকম চিন্তাভাবনা না করেই গ্রহণ করেছিল–রাজকীয় পরিবার আর তাঁদের প্রতিরক্ষা সহচরদের যখন আদেশ দেয়া হলে ওপারে পাঠবে এবং সেই সাথে সবার শেষে সে অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে নিজে সেতু অতিক্রম করবে।

সেতুর দিকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে জাহাঙ্গীর খয়েরী রঙের একটা বিশাল স্ট্যালিয়নে উপবিষ্ট বেগুনী পাগড়ি পরিহিত দীর্ঘদেহী এক রাজপুতকে লক্ষ্য করে, সেতুটা তাঁর ঘোড়ার খুরের নিচে দুলে উঠতে প্রাণীটা ঘাবড়ে গিয়ে ছটফট করে উঠে, সেতু অতিক্রম করে পুনরায় উত্তর দিকে ফিরে আসছে। সে সম্ভবত রাজপরিবারকে ওপাড়ে নিয়ে যাবার জন্য মহবত খানের কাছ থেকে রাজেশের কাছে আদেশ নিয়ে আগত বার্তাবাহক। রাজপুত অশ্বারোহী বাস্তবিকই জাহাঙ্গীরের হাতির কাছ থেকে কয়েক ফিট দূরে সাদা একটা ঘোড়ায় আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উপবিষ্ট রাজেশের দিকে এগিয়ে যায়, এবং সম্রাট অনুভব করেন যৌবনে যুদ্ধ শুরু আগে তাঁর হৃৎপিণ্ড যেভাবে স্পন্দিত হতো ঠিক সেভাবেই একটু দ্রুত যেন স্পন্দিত হচ্ছে।

 ‘রাজেশ, সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীকে নদীর ওপাড়ে নিয়ে যাবার জন্য মহবত খান তোমায় আদেশ দিয়েছেন।

রাজেশ মনে হয় যেন এক যুগ ধরে ইতস্তত করে। সে তারপরে বলে, তার কণ্ঠস্বর টানটান শোনায় আর আবেগের কারণে উঠানামা করে, মহবত খানকে গিয়ে বলবে আমি পারবো না… আমি বোঝাতে চাইছি আমি করবো না…’ জাহাঙ্গীর নিরুদ্বিগ্ন হয়। মেহেরুন্নিসার পরিকল্পনা কাজ করেছে। মেহেরুন্নিসার তত্ত্বাবধানে তাঁর নিজের রাজেশের সমর্থন লাভের চেষ্টার পাশাপাশি তাকে প্ররোচিত করা আর দীর্ঘসময় ধরে করা ষড়যন্ত্র কাঙ্খিত ফল দিয়েছে। দারুণ একটা মহিলা বটে যাহোক। মেহেরুন্নিসা যদি পুরুষ হতেন তাহলে দারুণ একজন প্রতিপক্ষ হতেন নিঃসন্দেহে।

রাজেশ কথা বলা চালিয়ে যায়, এখন যখন বিরোধের সূচনা হয়েছে অনেক সহজে সে শব্দ চয়ন করতে পারে। মহবত খানকে বলবে যে রাজকীয় দায়িত্বের অধিকারী হবার কারণে, বর্তমানে অশ্বশালার প্রধানের দায়িত্ব প্রাপ্ত হওয়ায়, কেবল সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীর প্রতিই আমার কর্তব্য রয়েছে। সম্রাট আমায় আর আমার পঞ্চাশজন লোককে ভবিষ্যত পদোন্নতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যদি তাঁর কাছেই আমরা কেবল জবাবদিহি করি। আমি স্থানীয় অনুগত জায়গীরদারদের বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করবো যারা সম্রাটের পক্ষে এমনকি এই মুহূর্তেও সমবেত হচ্ছে। মহবত খানের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত, কিন্তু তার প্রতি অতীত আনুগত্যের খাতিরে আমি তোমাকে নিরাপদে আর কোনো ক্ষতি না করেই ফিরে যেতে দিয়েছি তাকে গিয়ে অবশ্যই বলবে এবং সেই সাথে এটাও বলবে যে তুমি নদী অতিক্রম করার পরে তুমি আর তোমার সাথের অন্য বিদ্রোহীদের প্রতি তার ন্যায়সঙ্গত ক্ষমতাবলে গুলিবর্ষণের আদেশ দানের পূর্বে আমি সম্রাটকে আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে রাজি করেছি।’

মহবত খানকেও নদীর অপর পাড়ে গভীর চিন্তায় ডুবে থাকতে দেখা যায়। জাহাঙ্গীর আর মেহেরুন্নিসা যদিও শান্তভাবেই তাঁর কর্তৃত্ব মেনে নেয়া অব্যাহত রেখেছিলেন নিজের অবস্থান কীভাবে আরও জোরদার করা যায় সেই সম্বন্ধে নিজের সাথে নিজে যুক্তিতর্কের অবতারণা করতে গিয়ে সে নিজের কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে। সম্রাট ঠিকই বলেছিলেন যে কর্তৃত্বের অধিকারী হবার মানেই একাকিত্ব বরণ করা। সে বুঝতে পারে অন্যদের সাথে পরামর্শ করতে বা নিজের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করতে সে অপারগ, আশঙ্কা করে যে সেটা করলে বিষয়টাকে হয়তো তার সিদ্ধান্ত হীনতা বা দুর্বলতা হিসাবে দেখা হবে। একটা পর্যায়ে যা তাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি কালক্ষেপণের দিকে নিয়ে গিয়ে যাত্রাকালীন সময়ের রসদ আর খাবারের মত মামুলি বিষয়ে অত্যাধিক মাত্রায় মনোনিবেশে বাধ্য করে। সে এখন তাঁর ঘোড়াকে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে নেয় এবং নৌকার সেতুর উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত পথ অনুসরণ করে নামতে শুরু করে। সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী অচিরেই নদী অতিক্রম করা শুরু করবেন।

 সে সেতুর কাছে পৌঁছে যখন মৃদু দুলতে থাকা নৌকার সেতুর উপর দিয়ে বেগুনী পাগড়ি পরিহিত রাজপুত অশ্বারোহীকে মন্থর ভঙ্গিতে ফিরে আসতে দেখে সে বিস্মিত হয়, এবং ওপাড়ে তাকিয়ে অনুসরণ করার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কোনো লক্ষণ রাজপরিবারের মাঝে দেখতে ব্যর্থ হয়। এসব কি হচ্ছে? সে লাফিয়ে নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে আসে এবং বার্তাবাহক অশ্বারোহী সেতুর উপর থেকে নেমে আসা মাত্র তাঁর দিকে দৌড়ে যায়। তরুণ রাজপুত যোদ্ধা তোতলাতে তোতলাতে রাজেশের বক্তব্য পেশ করতে ক্রোধে মহবত খানের মুখ বিকৃত দেখায় এবং সে তাঁর অশ্বচালনার দাস্তানা সজোরে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে।

মেহেরুন্নিসা তাকে কৌশলে পরাস্ত করেছে। সে এতটা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় কীভাবে দিলো? সহসা দিবালোলাকের মত বিষয়টা তার কাছে পরিষ্কার হয় যে ফুল আর কীটপতঙ্গের জন্য তিনি যখন পরিচারকদের তদানুসারে প্রেরণ করতেন তারা তখন আসলে সমর্থকদের কাছ থেকে চিঠি বা বার্তা আদান প্রদান করছিলো। সে এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে যে রাজদম্পতির অনুরোধে জাহাঙ্গীরের অবশিষ্ট রাজকীয় দেহরক্ষীদের কোনো ধরনের ভাবনা চিন্তা না করে বহাল রাখার মূল্য এখন তাকে দিতে হচ্ছে। রাজেশ তার সাথে কীভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলো? মেহেরুন্নিসা তাকে কীভাবে বশ করলেন? সম্রাটইবা কীভাবে তার অধীনস্ত যোদ্ধাকে নিজের পক্ষে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করলেন?

মহবত খান ক্রোধে অন্ধ হয়ে থাকলেরও অচিরেই এসব প্রশ্নের উত্তর বেশ ভালো করেই অনুধাবন করতে পারে। অর্ধগৃধনু রাজেশের কাছে ক্ষমার প্রতিশ্রুতি আর সে নিজে নিজের জন্য যা অর্জন করেছে তার চেয়ে বেশি পদোন্নতি ছিল যথেষ্ট। তার লোকেরা, যারা বেশির ভাগই একটা দরিদ্র রাজপুত রাজ্যের অধিবাসী রাজেশের পিতা যেখানের রাজা। রাজেশের প্রতিই তাঁরা মূলত অনুগত। বিশ্বাসঘাতকতার কারণ যাই হোক সেটা নিয়ে বিষণ্ণ হবার সময় এখন না। তাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে আর সেটা কার্যকর করতে হবে। বোধোদয় হবার সাথে সাথে তার মাঝে নতুন উদ্যমের সূচনা হয়। সেতু পুড়িয়ে দাও, সে চিৎকার করে অশোককে আদেশ দেয়, রাজেশ আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। দুপুরের রান্নার জন্য জ্বালান চুল্লি থেকে প্রজ্জ্বলিত কাঠের টুকরো নিয়ে এসো। আমি নিজে প্রথমে আগুন দেব।

 বিমূঢ় অশোক ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আদেশ পালন করতে গেলে, মহবত খান অন্য আরেকটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর ক্রোধ আর প্রতিশোধের অদম্য আকাঙ্খ সত্ত্বেও সে সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীকে পুনরায় বন্দি করার আর কোনো চেষ্টা করবে না। সে সেখানেই কেবল যুদ্ধ করতে শিখেছে যেখানে শত্রু আর মিত্রের মধ্যে পরিষ্কার ভেদ রেখা বর্তমান আর প্রতিটা আঘাতের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া রয়েছে, দরবারের সতত পরিবর্তশীল আর অনিশ্চিত প্রেক্ষাপটে সে লড়াইয়ের উপযুক্ত নয়। জাহাঙ্গীর ঠিকই বলেছিলেন। সর্বোময় ক্ষমতার জন্য আকাঙ্খর সফলতা আপন শাস্তির উল্টো পিঠ। সে আর তার সাথের অবশিষ্ট লোকেরা, এখন যখন তারা সংখ্যা অল্প, পাহাড়ের ভিতরে পশ্চাদপসারণ করবে। সে সেখানে একবার পৌঁছাবার পরেই কেবল নিজের ভবিষ্যত সম্বন্ধে চিন্তা করবে… সিদ্ধান্ত নেবে কার প্রতি সে নিজের আনুগত্যের প্রস্তাব দেবে, কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সর্বোময় নেতার দায়িত্ব যার কাছে অর্পণ করবে।

*

‘তোমার ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে। আমি তোমায় অভিনন্দন জানাই,’ সেই রাতে জাহাঙ্গীর বলেন। মেহেরুন্নিসাকে জয়োল্লসিত দেখায়। তিনি ব্যাঘ্র শিকারের সময় সাফল্যের সাথে শিকার সমাপ্ত করার পরে প্রায়ই তার চোখে মুখে ঠিক এমনই অভিব্যক্তি দেখেছেন। মহবত খান–তাঁর অন্যতম সেরা আর সবচেয়ে বুদ্ধিমান সেনাপতিকে, মেহেরুন্নিসা কীভাবে সহযোগিতার ভান করে কৌশলে পরাস্ত করেছে চিন্তা করে তিনি হাসেন, তাঁর সাফল্য এমনই অনায়াস যে মহবত খানকে মনে হয়েছে সে ঝিলমের পানিতে একটা বেশ বড় ট্রাউট মাছ সম্রাজ্ঞীর মায়ার কাছে পরাভূত।

‘আমি মহবত খানকে এসব কিছু শুরু হবার দিনই সতর্ক করেছিলাম যে তার বিজয় সাময়িক। আমি আশা করি আমার কথা সে মনে রেখেছে।

 ‘আমি নিশ্চিত সে রেখেছে। তোমার কি মনে হয় সে এখন কি করবে?

 ‘আমি জানি না। আমার সন্দেহ হয় সে নিজেও সেটা জানে। সে যদি সাম্রাজ্য ত্যাগ করে, তাহলে বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে, সম্ভবত পারস্যেই আবার ফিরে যাবে। সে অবশ্যই জানে যে তাঁর এই অপরাধের জন্য সে কোনোভাবেই শাস্তি এড়াতে পারবে না এবং আপনি লাহোরে নিরাপদে পৌঁছান মাত্রই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আপনি সৈন্য প্রেরণ করবেন।’

জাহাঙ্গীর মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। মেহেরুন্নিসা ঠিকই বলেছে। মজবত খান একটা সুযোগ দেখতে পেয়ে সেটা গ্রহণ করেছিল। তাকে যদি এর জন্য শাস্তি দেয়া না হয় তাহলে অন্যরা হয়ত বিদ্রোহের জন্য প্ররোচিত হতে পারে। কিন্তু এমন একটা ঘটনা ঘটার সুযোগই তৈরি হবার কথা না। তিনি সম্ভবত বৃদ্ধ হচ্ছেন… ভাবনাটা উঁকি দিতেই তার বিজয়োল্লাস খানিকটা হ্রাস পায়। তিনি যখন তার রাজধানীতে ফিরে যাবেন তখন তাকে অবশ্যই সবাইকে দেখাতে হবে যে নিজের সাম্রাজ্যের উপর এখনও তার অটুট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু তিনি নিজেকে আপাতত নিরুদ্বিগ্ন থাকতে পরামর্শ দেন–আজ রাতে তিনি আর মেহেরুন্নিসা তাঁদের এই নতুন প্রাপ্ত স্বাধীনতা কেবল উপভোগ করবেন এবং তাদের এই সাফল্য উদ্‌যাপন করার জন্য দারা শুকোহ্ আর আওরঙ্গজেবও তাঁদের সাথে যোগ দেবে।

 ‘আমার নাতিদের আমার কাছে নিয়ে এসো, তিনি একজন কচিকে ডেকে আদেশ দেন। কয়েক মিনিট পরে ছেলে দুটো তাবুর ভেতর প্রবেশ করে এবং জাহাঙ্গীর পর্যায়ক্রমে তাদের দু’জনকেই আলিঙ্গণ করেন। এটা দারুণ একটা মুহূর্ত, তিনি তাদের বলেন।

 ‘কেন, দাদাজান?’ দারা শুকোহ জানতে চায়।

জাহাঙ্গীর তার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় মনে মনে ভাবেন যে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যা কিছু ঘটেছে ছেলেদের কাছে সেসব নিশ্চয়ই বিচিত্র বলে প্রতিয়মান হয়েছে, আমরা আমাদের শত্রু মহবত খানকে কৌশলে পরাস্ত করেছি এবং আমাদের স্বাধীনতা পুনরায় অর্জন করেছি।

 ‘মহবত খান কি আমাদের শত্রু ছিল? দারা শুকোহকে বিস্মিত দেখায়।

 ‘হ্যাঁ, জাহাঙ্গীর উত্তর দেয়। সে আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদের বন্দি রেখেছিল এবং আমার পরামর্শদাতা হিসাবে কাকে আমার মনোনীত করা উচিত আর সেই সাথে কীভাবে আমার সাম্রাজ্য পরিচালনা করা উচিত সেই নির্দেশ সে আমায় দিতে চেয়েছিল।

কিন্তু আমি ভেবেছিলাম… মানে আমি বলতে চাইছি আপনি যেভাবে তাঁর সাথে কথা বলতেন… আপনারা পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠেছেন।

জাহাঙ্গীর মুচকি হাসে। না। সেটা ছিল ভান। একজন শাসককে তিনি যা চান সেটা অর্জন করতে অনেক সময় ছলনার আশ্রয় নিতে হয়। তোমরা। আরো বড় হলে এটা বুঝতে পারবে। এখন, এসো একটু মিষ্টি মুখ করবে–আওরঙ্গজেব তুমিও এসো।

তিনি বাদামের গুড়ো দেয়া কেকের পুর দেয়া শুকনো খুবানি ভর্তি একটা রূপার তশতরি তাঁদের দিকে এগিয়ে দিতে, আওরঙ্গজেব যদিও একমুঠো খুবানি নেয় কিন্তু দারা শুকোহ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে তখনও চিন্তিত দেখায়, সে তারপরে বলে, আমার আব্বাজান আপনার কাছে আমাদের প্রেরণ করার আগে আপনার সম্বন্ধে অনেক কিছু বলেছেন।

 জাহাঙ্গীর আড়ষ্ট হয়ে যায়। কি বিষয়ে?

‘আপনি আমাদের দাদাজান আর সম্রাটই কেবল না আপনি একজন মহান মানুষ। আমরা তাই সবসময়ে আপনাকে যেন সম্মান প্রদর্শন করি। মহবত খান কি সেটাই করতে ভুল করেছিল? সে কি আপনাকে সম্মান প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছিল?

জাহাঙ্গীর মাথা নাড়ে, কিন্তু তার মন তখন অন্য কোথাও পড়ে রয়েছে। খুররম কি আসলেই তাঁর সম্বন্ধে এসব বলেছে? যদি তাই হয়, সেটা কি তাঁর ছেলেরা যেন তাকে বিরক্ত না করে সেজন্যই সে কেবল বলেছে নাকি কথাগুলো সে সত্যিই বিশ্বাস করে?

*

ভীমবর শহরের কাছে উত্তরপশ্চিমের সমভূমির উপর স্থাপিত তাঁর অস্থায়ী শিবিরের উপরের আকাশ আতশবাজিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে জাহাঙ্গীর সেদিকে তাকিয়ে থাকে। শাহরিয়ার আর লাডলি তাদের শিশু কন্যা–জাহাঙ্গীর কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ভূমিষ্ট–এবং লাহোর পর্যন্ত বাকি পথটা তাকে পাহারা দেয়ার জন্য দশ হাজার সৈন্যের শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে দু’দিন আগে তাদের সাথে এসে যোগ দিয়েছে। তাঁর সবচেয়ে বয়য়াজ্যেষ্ঠ বেশ কয়েকজন অমাত্য আর আধিকারিকও তাঁদের সাথে রয়েছে। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টা এখন যখন সন্দেহের উর্ধ্বে, মেহেরুন্নিসা পরামর্শ দেয় তাদের আগমন আর মহবত খানের কাছ থেকে পরিত্রাণ দুটো ঘটনা উদ্যাপনু করতে একটা ভোজসভার আয়োজন করতে এবং তিনি সাথে সাথে সম্মতি দেন। সবশেষে সবচেয়ে বড় আতশবাজিটা বিস্ফোরিত হয়ে রাতের আকাশে লাল আর বেগুনী আলোক বিন্দু ছড়িয়ে দিতে জাহাঙ্গীর পরিতৃপ্ত বোধ করেন। মহবত খানের বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও, নিজের সাম্রাজ্যের উপরে তার নিয়ন্ত্রণ এখনও অটুট রয়েছে। মহবত খান এক মাস আগে দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় পালিয়ে যাবার পর সেখান থেকে আর প্রকাশ্যে বের না হওয়ার বিষয়টা তার গুপ্তদূতেরা এসে নিশ্চিত করার ব্যাপারটাই কেবল না সেই সাথে তার আধিকারিকেরাও সংবাদ নিয়ে এসেছে যে খুররম দক্ষিণের প্রদেশে শান্তই রয়েছে, তারা সেই সাথে আরো জানিয়েছে যে গুজরাতের মোগল সুবেদার সেখানের একটা বিদ্রোহ প্রচেষ্ট কঠোর হস্তে দমন করেছে এবং সাম্রাজ্যের অন্যত্র শান্তি বিরাজ করছে।

আতশবাজি–উত্তরে পেশোয়ার আর খাইবার গিরিপথ অভিমুখে ভ্রমণকারী চিনা বণিকদের একটা কাফেলার কাছ থেকে আজ রাতের ফুর্তির উপক্রম হিসাবে যা কেনা হয়েছে–পোড়ান শেষ হতে জাহাঙ্গীর ভোজের আয়োজন নিজে তদারক করে। সে বিশাল শিবিরের একেবারে মধ্যখানে, তাঁর টকটকে লাল তাবু থেকে পঞ্চাশ গজ সামনে, রাজকীয় মঞ্চ স্থাপনের আদেশ দিয়েছে এবং সোনালী কাপড় দিয়ে পুরো মঞ্চটা মুড়ে দিতে বলেছে। নিচু রাজসিংহাসন আর তার পাশে শাহরিয়ারের জন্য সূক্ষ কারুকাজ করা একটা তেপায়া ইতিমধ্যেই সেখানে রাখা হয়েছে। একপাশে কিছুটা দূরে, মেহেরুন্নিসা আর তার মেয়ে লাডলীর আহারের জন্য সোনালী জরির কারুকাজ করা সবুজ রেশমের পর্দা দিয়ে একটা এলাকা ঘিরে দেয়া হয়েছে। পরিচারকেরা এখনও ব্যস্ত ভঙ্গিতে মঞ্চের সামনে জাহাঙ্গীরের বয়য়াজ্যেষ্ঠ সেনাপতি আর উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের জন্য রূপার থালা আর পানপাত্র সজ্জিত একটা লম্বা নিচু টেবিলের চারপাশে সোনালী জরির কারুকাজ করা লাল মখমলের তাকিয়া বিন্যস্ত করছে। নিম্নপদস্থ আধিকারিক আর অমাত্যদের জন্য আরেকটু পেছনে পাতা টেবিলগুলোর সজ্জায় আড়ম্বর একটু কম আর তাঁর বাকি লোকদের জন্য অন্য ভৃত্যরা শিবিরের অন্যত্র খাবারের বন্দোবস্ত করছে।

মাংস ঝলসানোর গন্ধ–হরিণ, ভেড়া, হাস, মোরগ আর ময়ূরী–ইতিমধ্যেই শতাধিক ভোলা উনুনের উপর স্থাপিত মাংসভর্তি শিক থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। বহনযোগ্য তন্দুরী উনুনের ভেতর টক দই আর মশলা দিয়ে মাখান মাংস দেয়া হয়েছে আরও রসনাতৃপ্তভাবে প্রস্তুত করতে। বিশাল সব হাড়িতে শুকনো কাশ্মীরী ফলের–খুবানি, চেরী আর সুলতানা–সাথে মশলার গন্ধযুক্ত বিভিন্ন পদ ইতিমধ্যেই টগবগ করে ফুটছে। ময়দা মাখিয়ে তাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি করে গরম গরম অবস্থায় রুটি টেবিলে নিয়ে আসা যায়। চাল আর গোলাপজল আর গুড়ো করা কাঠবাদাম আর দুধ দিয়ে তৈরি ক্ষীরের পাত্র, কোনো কোনোটার উপরে সোনার তবক দেয়া কাপড় দিয়ে ঢাকা রয়েছে। হা, সবকিছু যেমনটা হওয়া উচিত তেমনই হয়েছে। জাহাঙ্গীর সন্তুষ্টির শব্দ করে সম্মতি জানায় এবং নিজের তাবুতে ফিরে যায় যেখানে ভোজসভার জন্য তাকে সজ্জিত করতে তাঁর কর্মিরা অপেক্ষা করছে।

এক ঘন্টা পরে, তাঁর আধিকারিকেরা নিজেদের আসন গ্রহণ করতে, তূর্যধ্বনির সাথে সাথে রাজকীয় তাবুর কানাত পুনরায় উঠে যায় এবং ভেতর থেকে চারটা পালকি বের হয়ে আসে প্রতিটাই চারজন করে বেহারা বহন করছে। প্রথম পালকি দুটো তাবুর সামনের মঞ্চের কাছে থামে। পরের পালকি দুটো, যেগুলোয় পর্দা দেয়া, পেছনে নিয়ে যাওয়া হয় যাতে মেহেরুন্নিসা আর লাডলি দর্শনার্থীদের দৃষ্টি এড়িয়ে পর্দা ঘেরা এলাকায় প্রবেশ করতে পারে। শেষবারের মত তূর্যধ্বনির গগনবিদারী একটা আওয়াজের সাথে সাথে জাহাঙ্গীর ধীরে ধীরে নিজের পালকি থেকে নিচে নামতে দ্বিতীয় পালকি থেকে হালকাঁপাতলা অবয়বের শাহরিয়ার নেমে আসে তাঁর সাথে যোগ দিতে। যুবরাজ মঞ্চে আরোহণ করে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে যাবার সময় সম্রাটকে সাহায্য করে।

জাহাঙ্গীর সিংহাসনে উপবিষ্ট হবার আগে এক মুহূর্তের জন্য মাথার উপরে কালো মখমলের মত আকাশের বুকে জ্বলজ্বল করতে থাকা তারকারাজির দিকে তাকায়। তিনি কি অলীক কল্পনা করছেন নাকি সত্যিই আজ রাতে তারকারা উজ্জ্বলভাবে দীপ্তি ছড়াচ্ছে, তার সাফল্যের উদ্‌যাপনকে নিজেদের রূপালি প্রভা দিয়ে সম্মান জানাচ্ছে? তিনি তাঁর পরে ইঙ্গিতে সবাইকে চুপ করতে বলেন এবং কথা শুরু করেন, তাঁর কণ্ঠস্বর কঠোর। আমরা আজ রাতে এখানে আমার প্রিয় পুত্র শাহরিয়ারের আগমন আর কুটিল মহবত খানের আধিপত্য থেকে আমাদের পরিত্রাণ উদ্যাপন করতে সমবেত হয়েছি। তার অপরাধ ক্ষমা করা হয়নি কিংবা কেউই তার কথা ভুলে যায়নি। তার শাস্তি কেবল স্থগিত রয়েছে।’ তিনি কথা থামিয়ে নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখার সময় মোগলদের সবুজ রঙের পোষাক পরিহিত রাজেশকে উৎকণ্ঠিত দেখেন, তাঁর খালি অক্ষিকোটরের উপরে সবুজ রঙেরই একটা পট্টি রয়েছে। তাঁর এক চোখের দৃষ্টি তাঁর সামনে রক্ষিত রূপার থালার উপর নিবদ্ধ এবং সে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে নিজের পোষাকের একটা বোম অনবরত মোচড়াচ্ছে।

‘কিন্তু এটা অতীতের ঘটনাবলী এবং তাদের পরিণতি রোমন্থনের সময় না। সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জাহাঙ্গীর কথা বলার সময় লক্ষ্য করেন শাহরিয়ার নিজের তেপায়ার উপরে একটু নড়ে বসে, কিন্তু রাজকীয় তাবু ত্যাগ করার সময় মেহেরুন্নিসার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে শাহরিয়ার তার উত্তরাধিকারী এই বিষয়টার পুনরাবৃত্তি করবেন না। আজ রাতে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই–বিশেষ করে তার কাশির প্রকোপ যখন কমে এসেছে এবং তিনি নিজের মাঝে অনেকবেশি প্রাণশক্তি অনুভব করছেন। শাহরিয়ার সম্বন্ধে মেহেরুন্নিসার ক্রমাগত আর মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা সত্ত্বেও জাহাঙ্গীর তাকে যেসব দায়িত্ব দিয়েছিলেন সুচারুভাবে সেগুলো সম্পাদনে তাঁর পারঙ্গমতা মাঝে মাঝে তার পিতাকে আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে যে তাকে যদি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হয় তাহলে সে সাম্রাজ্যকে সমৃদ্ধির পথে নেতৃত্ব দেয়ার মত যথেষ্ট যোগ্যতা বা বুদ্ধির অধিকারী। তার সদ্য আগত অমাত্যদের কেউ কেউ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে, কাশ্মীরে তাঁর বন্দিত্বকালীন সময়ে শাহরিয়ারের সিদ্ধান্তহীনতা আর নিষ্ক্রিয়তার খবর জানানোয় সেই ধারণা আরও প্রবল হয়েছে।

মেহেরুন্নিসাকে যদিও তিনি কিছুই জানাননি, কিন্তু তিনি মনে মনে চিন্তা করতে শুরু করেছেন নিজের আব্বাজানের বিরুদ্ধে তাঁর নিজের বিদ্রোহের পরে তিনি যেমন তার সাথে সব বিরোধের মীমাংসা করেছিল সেভাবে কি তার আর খুররমের মাঝে একদিন সবকিছু আবার আগের মত হতে পারে না। দারা শুকোহর কথা তাকে ভাবতে বাধ্য করেছে… হৃদয়ঙ্গম করতে যে সম্ভবত উভয় পক্ষেরই ভুল হয়েছে। খুররমের প্রতি এক সময় তার মনে যে ভালোবাসা ছিল সেটা আবার জাগ্রহ হতে শুরু করেছে, তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে তাঁর জন্ম কত মঙ্গলময় ছিল… সে কেমন সাহসী যোদ্ধা আর নেতা ছিল… সে নিজেকে আজ্ঞানুবর্তী কিন্তু মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষমতাহীন শাহরিয়ারের চেয়ে বাবরের প্রতিষ্ঠিত বংশের ধারা এগিয়ে নেয়ার জন্য অনেক বেশি যোগ্য হিসাবে প্রমাণ করতে পারতো। তিনি নিজেকে হয়ত ঠাকাচ্ছেন কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে…

নিজের দিবাস্বপ্নে বিভোর জাহাঙ্গীরকে একজন আধিকারিকের ইঙ্গিতপূর্ণ কাশি বর্তমানে এবং তিনি যা বলতে চেয়েছিলেন সেই মুহর্তে ফিরিয়ে আনে। আমার বিশ্বাস আমরা একটা স্বর্ণযুগের সূচনা দেখতে যাচ্ছি। আমাদের ভেতরের শত্রুরা পরাস্ত হয়েছে আর আমাদের বহিশত্রুরা আমাদের সীমান্তে আক্রমণ করতে ভীত। আমাদের মহান সাম্রাজ্যের প্রজাদের জন্য শান্তি আর সমৃদ্ধি অপেক্ষা করছে। আজ রাতে আমি তোমাদের এটাই বলতে চেয়েছি। কিন্তু সেই সাথে আরও কিছু আছে…তোমাদের সবার সামনে আমি আমার সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নিসাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই যিনি আমাদের সৌভাগ্যকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসতে আমায় দারুণ সাহায্য করেছেন। পারিবারিক জীবনের বাইরে মেয়েরা সাধারণত এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়না কিন্তু তিনি আমায় জীবনের সবক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন এবং আমি সেজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।’

জাহাঙ্গীর তারপরে নিজের দু’হাত শূন্যে তুলে চিৎকার করে উঠে, ‘মোগলদের জিন্দাবাদ! মোগল সামাজ্য জিন্দাবাদ!’ মোগল সাম্রাজ্য দীর্ঘজীবি হোক! সমবেত জনতার মাঝ থেকে সাথে সাথে ভেসে আসে, ‘পাদিশাহ জাহাঙ্গীর জিন্দাবাদ। সম্রাট জাহাঙ্গীর দীর্ঘজীবি হোন! জাহাঙ্গীর নিজের সিংহাসনে আসন গ্রহণ করতে উদ্দাম চিৎকারে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠে। বহু বছর আগে আগ্রা দূর্গের ঝরোকা বারান্দায় সম্রাট হিসাবে নিজের প্রথম উপস্থিতির ক্ষণটার কথা তার আবার মনে পড়ে যায়। কতটা পথ তিনি অতিক্রম করে এসেছেন। ভালো আর মন্দ কত অভিজ্ঞতাই না তার হয়েছে। তাঁর আব্বাজান আকবরের যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করার যে শপথ সে নিয়েছিল সেটা পুরোপুরি সম্পূর্ণ করতে তিনি আর কত কিছু অর্জন করতে চান। ঠিক তখনই ঝলসানো মাংসের সুগন্ধ তাঁর নাকে ভেসে আসে। একজন পরিচারক চুনিলাল ডালিমের কোয়া দিয়ে সাজান হরিণের মাংসের একটা পাত্র তার সামনে নামিয়ে রাখে। আজই অনেকমাসের ভিতরে প্রথমবারের মত তিনি খাবারের জন্য জোরালো রুচি অনুভব করেন। অনভ্যস্ত অভিরতি নিয়ে তিনি খেতে শুরু করেন।

*

তিনঘন্টা পরে মেহেরুন্নিসা যখন, জাহাঙ্গীরের শারীরিক দুর্বলতাকে বিব্রত না করতে, শয্যা থেকে ধীরে আর ধৈর্যসহকারে উঠে বসে যেখানে অনেকদিন পরে তারা পরস্পরের সঙ্গসুখ উপভোগ করেছে তখনও তাবুর বাইরে থেকে ভোজসভার আনন্দ মুখরিত শব্দ ভেসে আসে। তিনি এরপরে, রাতের বেলা সচরাচর তিনি যা করে থাকেন, তার জন্য গোলাপজলের সাথে আফিম মিশ্রিত করেন এবং গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে তিনি মিশ্রণটা ধীরে ধীরে পান করেন, মেহেরুন্নিসা আবারও যখন তাঁর পাশে এসে শয্যা গ্রহণ করে তখন তার মুখে প্রশান্তির একটা হাসি ফুটে থাকতে দেখে। এখন, নিজের রেশমের আলখাল্লাটা ভালো করে শরীরে জড়িয়ে নিয়ে মেহেরুন্নিসা তাঁর স্বামীর মুখের দিকে তাকায়। তাঁর কৃতজ্ঞতা–তার বেশিরভাগ বক্তৃতার মত, তাঁর সামনে আগে অনুশীলন করেন নি–মেহেরুন্নিসাকে গভীরভাবে আপুত করেছে। তাদের সামনে এখনও অনেকগুলো বছর রয়েছে এবং তার সাহায্যে সেগুলো হবে তাঁর জীবনের মহোত্তম। তারপরে… বেশ, সিংহাসনে অধিষ্ঠিত শাহরিয়ারকে নিয়ে–সে যেন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয় সেটা তিনি নিশ্চিত করবেন–তখনও তিনি সাম্রাজ্যের সবচেয়ের ক্ষমতাবান মানুষ হিসাবে বিদ্যমান থাকবেন। শাহরিয়ারের বোধশক্তি খুব একটা প্রখর না এবং লাডলির সাহায্যে তিনি সহজেই তাকে নিজের মত করে গড়ে নিতে পারবেন। খুররম আর মিষ্টি আরজুমান্দ এবং তাঁদের দুই সন্তানের ভাগ্যের ব্যাপারে যারা এই মুহূর্তে তাবুর অন্য আরেকটা অংশে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তিনি পরে সিদ্ধান্ত নেবেন। সুখকর ভাবনায় মশগুল হয়ে তিনি ঘুরে দাঁড়ান এবং নিজের পর্দা ঘেরা শয়ন এলাকার দিকে হেঁটে যান।

*

‘হেকিমকে ডেকে নিয়ে এসো।

 চিৎকারটা ছড়িয়ে যেতে মেহেরুন্নিসা নিজের বিছানায় উঠে বসেন। তিনি উঠে বসতে পরিচারিকাদের একজন তার বিছানার চারপাশের বৃত্তাকার পর্দা সরিয়ে দেয় এবং উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, ‘সম্রাজ্ঞী, জলদি আসেন। আমাদের সম্রাট। তিনি অসুস্থ।’

মেহেরুন্নিসা সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায় এবং তাঁর ঘুমের সময়ে পরিহিত কামিজের উপরে সবুজ রেশমের আলখাল্লাটা জড়িয়ে নিয়ে, দ্রুত পায়ে তারপরে জাহাঙ্গীরের শয়ন কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। তিনি চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন, ঠোঁটের কোনো দিয়ে বমির একটা পাতলা রেখা গড়িয়ে পড়ছে। হেকিম ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছে এবং জাহাঙ্গীরের একান্ত পরিচারক যে শয্যার কাছেই শুয়ে থাকে বলছে, আমি একটু আগে তাকে কাশতে শুনেছি কিন্তু তারপরে সবকিছু শান্ত। আমি প্রতি ঘন্টায় যেমন তাকে এসে দেখে যাই সেরকম একটু আগে এসে তাকে এভাবে দেখতে পাই।’

হেকিম মুখ তুলে তাকান এবং মেহেরুন্নিসাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বলেন, ‘সম্রাজ্ঞী, সম্রাট ইন্তেকাল করেছেন। তিনি নিশ্চয়ই কাশির সময় বমি করেছিলেন এবং তারপরে শ্বাসরুদ্ধ হয়েছেন। আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব না।’

মেহেরুন্নিসার মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীর মৃত… যে মানুষটা তাকে কখনও প্রত্যাখ্যান করে নি, সবসময়ে তাকে কামনা করেছে, তাকে কখনও পরিত্যাগ করার কথা কল্পনাও করে নি এবং সবসময়ে তার ভাবনা আর ইচ্ছার প্রতি মনোযোগী থেকেছে সে আর নেই। তিনি হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে এবং আঙুলের উল্টো দিক দিয়ে তার উষ্ণতা হারাতে থাকা মুখ স্পর্শ করতে তার গাল বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে শুরু করে–ভালোবাসার, বিহ্বলতার আর সর্বস্ব হারাবার অশ্রু। তিনি কিছু সময়ের জন্য কান্না আর শোকের মাঝে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন, তারপরে অন্য আরেকটা ভাবনা ধীরে ধীরে তার বিক্ষিপ্ত চেতনায় আকৃতি লাভ করতে শুরু করে। এখন কি হবে? জাহাঙ্গীর ইচ্ছাকৃত ভাবে না হলেও তাকে পরিত্যাগ করেছেন। তাকে আরো একবার অবশ্যই নিজেকে আর নিজের অবস্থানকে সুরক্ষিত করতে হবে। তিনি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখের অশ্রু মুছে ফেলেন, উঠে দাঁড়ান এবং নিজেকে খানিকটা সুস্থির করে নিয়ে তারপরে শান্ত কণ্ঠে বলেন, শাহরিয়ার আর লাডলিকে ডেকে নিয়ে এসো।

 এক কি দুই মিনিট পরে তরুণ দম্পতিকে ভেতরে নিয়ে আসা হয়, তাঁদের বিমূঢ় চোখের তারায় বিভ্রান্তি, ঘুম আর আতঙ্ক মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। মেহেরুন্নিসা কালক্ষেপণ না করে কথা বলতে শুরু করে। তোমরা দেখতেই পাচ্ছো, সম্রাট ইন্তেকাল করেছেন। শাহরিয়ার, তুমি যদি তার স্থানে অভিষিক্ত হয়ে শাসন পরিচালনা করতে চাও তাহলে তোমরা দু’জনেই অবশ্যই আমি যা বলছি ঠিক তাই করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *