২.২ কলঙ্কিত যুবরাজ
উষ্ণ পৃথিবীর বুকে বৃষ্টি পড়ার সোঁদা ঘ্রাণ-বর্ষার অভ্রান্ত গন্ধ–প্রতিমুহূর্তে মনে হয় তীব্র হচ্ছে তারা যতই বাংলার পূতিগন্ধময় ভূমির উপর দিয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলেছে, খুররম তার সৈন্যসারির সামনে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যাবার সময়, কাঁধের উপর দিয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে তার বাহিনীকে সেখানে কষ্ট করতে দেখে, মনে মনে ভাবে। গত কয়েক মাসে তাঁর বাহিনীর লোক সংখ্যা কমে পাঁচশ কি ছয়শ হয়েছে। মহবত খান আগ্রা থেকে বিশাল এবং সুসজ্জিত একটা বাহিনী–কারো কারো সংবাদ অনুযায়ী বিশ হাজার সৈন্য আর তিনশ রণহস্তী–নিয়ে তাকে পশ্চাদ্ধাবন করে বন্দি করার জন্য রওয়ানা হয়েছেন এই সংবাদটা তার বাহিনীর অনেক সৈন্যকে পক্ষত্যাগ করতে প্ররোচিত করেছে।
মহতাব খানের সাথে খুররমের একবারই দরবারে দেখা হয়েছিল কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সে তাঁর সাহসিকতার কথা শুনেছে। লোকটা একজন পার্সী যে শাহের অনুগ্রহ বঞ্চিত যতক্ষণ না হয়েছিল, গিয়াস বেগের মত, সে তার অধীনে কর্মরত ছিল এবং পরে মোগল দরবারে চলে এসেছে। লোকটা সব বিচারেই ঝুঁকি গ্রহণ করতে ভালোবাসে, আবেগপ্রবণ মাঝে মাঝে যা হঠকারিতার পর্যায়ে পড়ে, কিন্তু সবসময়ে সাফল্য লাভ করেছে–অন্তত এখন পর্যন্ত তাই বাস্তবতা। তাঁর দুই হাজার রাজপুত যোদ্ধার চৌকষ অভিজাত বাহিনী বলা হয়ে থাকে তার প্রতি নিবেদিত প্রাণ। একজন বহিরাগত এবং মুসলমান হিসাবে তিনি যদি জাফরান রঙের পোষাক পরিহিত এসব অকুতোভয় হিন্দু যোদ্ধাদের মুগ্ধ করতে পারেন যাঁরা নিজেদের সূর্য আর চন্দ্রের সন্তান বলে বিশ্বাস করে, তাহলে বাস্তবিকই তিনি একজন প্রেরণা সঞ্চারী নেতা। খুররম ভাবে, অবাক হবার কিছু নেই, যে তার নিজের লোকদের অনেকেই মানে মানে সটকে পড়েছে। কিন্তু সত্যিকারের সমর্থকদের একটা ক্ষুদে বাহিনী লড়াইয়ে অনিচ্ছুক একটা বিশাল বাহিনীর চেয়ে অনেক ভালো।
সে গলার পাশে একটা কীট দংশন অনুভব করতে, সে হাত দিয়ে সেটাকে আঘাত করে এবং নিজের আঙুলের দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে রক্ত লেগে রয়েছে। সে কখনও এমন ক্লান্ত বা এতটা হতাশ বোধ করে নি। তার আব্বাজান তাকে কলঙ্কিত অপরাধী হিসাবে ঘোষণা করে সাম্রাজ্যের প্রতিটা লোককে তাঁর প্রতিপক্ষে পরিণত করেছেন। তার মাঝে অসহায়তার সাথে মিশে থাকা ক্রোধের একটা অনুভূতি বাড়তে থাকে। তাঁর আব্বাজান কীভাবে তাকে, নিজের পক্ষে সাফাই দেয়ার কোনো সুযোগ না দিয়ে, এতটা নিষ্ঠুরভাবে, এতটা প্রকাশ্যে অবমানিত আর ত্যাজ্য করেন? আব্বাজানকে নিয়ে, তার সাফল্য সে একটা সময় গর্ব অনুভব করতে সেসব আর মাঙ্গলিক জন্ম কীভাবে এমন প্রতিহিংসাপরায়ণ তিক্ততায় রূপান্ত রিত হলো? তার আব্বাজান যাই বিশ্বাস করতে চান না কেন, তিনি মেহেরুন্নিসার ক্রীড়ানক বই আর কিছু নন। সে জাহাঙ্গীরকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং আফিম আর সুরার জন্য তার দুর্বলতাকে শান্ত রেখে, সে তার সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। আর তিনি যা কিছু চান সবই ঘটে চলেছে। আসফ খানের কাছ থেকে প্রাপ্ত একটা চিঠি অনুযায়ী, আসিরগড় থেকে যার বার্তাবাহক খুররমের পশ্চাদপসারনকারী বাহিনীকে অনুসরণ করেছিল, দুই মাস পূর্বে, জাহাঙ্গীর শাহরিয়ারকে ডেকে এনে তাঁর মস্তকে রাজকীয় উষ্ণীষ স্থাপন করে তাকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করেছে। আর এখানেই বিষয়টা শেষ হয় নি। শাহরিয়ারের সাথে মেহেরুন্নিসার মেয়ে লাডলীর বিয়ের দিন দরবারের জ্যোতিষীরা নির্ধারণ করেছে এবং নববর্ষের উৎসব উদ্যাপনের মাঝে যা অনুষ্ঠিত হবে।
সে আর তার পরিবার, ইত্যবসরে, নিজেদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছে সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরে সম্ভবত এমনকি তাঁদের যেতে হতে পারে। মেহেরুন্নিসা তাকে ঠিক তার প্রপিতামহ হুমায়ুন এবং তার আগে বাবরের মত ভূমিহীন যাযাবরে পর্যবসিত করেছে। কিন্তু তিনি জয়ী হবেন না। হুমায়ুন আর বাবরের মত একদিন সে ঠিকই রাজত্ব করবে। জাহাঙ্গীর তার যা ইচ্ছা বলতে বা করতে পারেন কিন্তু সে, খুররম, একমাত্র কেবল তাঁর চার ছেলের ভিতরে সম্রাট হবার জন্য উপযুক্ত এবং তার আব্বাজান তার আনুগত্য সত্ত্বেও সেই অধিকার বাতিল করেছেন।
খুররম সহসা পেছন থেকে একটা গুঞ্জন শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকায়। মালপত্র বোঝাই একটা মালবাহী শকটের একটা চাকা কাদায় আঁটকে গিয়েছে। তার লোকজন যদি দ্রুত সেটা কাদা থেকে তুলতে না পারে তারা তাহলে সেটাকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হবে। তাঁর আব্বাজানের পিছু ধাওয়াকারী সেনাবাহিনীর সাথে নিজেদের দূরত্ব বাড়িয়ে তোলাটা এই মুহূর্তে খাদ্য কিংবা অন্য কোনো অনুষঙ্গের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ছোট বাহিনী অন্ততপক্ষে কামানবাহী শকট টেনে নিয়ে অগ্রসরমান বড় বাহিনীর তুলনায় দ্রুত এমন একটা ভূখণ্ডের উপর দিয়ে অগ্রসর হতে পারে যা বর্ষার বৃষ্টির ফলে যা গত দুই মাস ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে হবার কারণে আরও বেশি মাত্রায় বন্ধুর হয়ে উঠে, বিল আর জলাভূমি বিশাল বাহিনীর জন্য প্রায় দুর্গম একটা এলাকা হয়ে উঠেছে। সে পূর্বদিকে এই একটা কারণেই আসবার সিদ্ধান্ত নেয়। মহবত খানের বাহিনী যদি তাকে অনুসরণ করে বাংলায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়ও সে নৌকার আশ্রয় নিতে পারবে এবং উপকূলের আরও দক্ষিণে আশ্রয় খুঁজে দেখবে। সে মাত্র দুই সপ্তাহ পূর্বে একটা বিস্ময় উদ্রেককারী একটা চিঠি পেয়েছে–মালিক আম্বারের কাছ থেকে মৈত্রীর প্রস্তাব। যুদ্ধক্ষেত্রে আপনি আর আমি ছিলাম যোগ্য প্রতিপক্ষ,’ আবিসিনিয়ার অধিবাসী সেনাপতি চিঠিতে লিখেছে। আমরা এখন কেন তাহলে সহযোদ্ধা হতে পারবো না?’ খুররম চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি কিন্তু সে আবার প্রস্তাবটা বাতিলও করে নি। মালিক আম্বার আর তাঁর পৃষ্টপোষকেরা, দাক্ষিণাত্যের শাসকবৃন্দ, তাঁদের সমর্থনের জন্য বেশ ভালো রকমের সুবিধা দাবি করবেন বলাই বাহুল্য কিন্তু তাদের সমর্থনের সাহায্যে সে তাঁর আব্বাজানের বিরোধিতা করার শক্তি অর্জন করতে পারবে। কিন্তু নিজের অবস্থান পুনরুদ্ধারে যা ন্যায্যত তাঁর আপাত দৃষ্টিতে সেটা যদিও তাঁর একমাত্র পথ বলে প্রতিয়মান হলেও, সে কি আসলেই মোগল সাম্রাজ্যের বহিশত্রুর সাথে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একত্রিত হতে পারে।
তার লোকেরা যখন মালবাহী শকটটা কাদা থেকে তোলার জন্য সবলে টানছে খুররম অনুভব করে সে হতাশায় রীতিমত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। সে তাঁর দেহরক্ষীদের এমনকি অনুসরণ করতে না বলেই নিজের ঘোড়ার পাঁজরে গুঁতো দেয় এবং সামনে কাদার কারণে প্যাঁচপেচে ধ্বনির সৃষ্টিকারী ভূখণ্ডের উপর দিয়ে অর্ধবল্পিত বেগে ছুটে যায়। গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টির মাঝে মাত্র আধমাইল যাবার পরেই সে পানির একটা স্রোত দেখতে পায়। মুখের উপর থেকে বৃষ্টির পানি সরিয়ে সে আরও ভালো করে তাকিয়ে দেখে। অবশেষে এটা নিশ্চয়ই মহানন্দা নদী… সে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সুসংবাদটা দেয়ার জন্য ফিরে আসতে যাবে এমন সময় বাতাসের মাঝে দিয়ে একটা তীর উড়ে আসে, অল্পের জন্য তাঁর মাথায় আঘাত করা থেকে তীরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় কিন্তু তার মনের শান্তির বারোটা বাজিয়ে দেয়। তারপরে আরেকটা–কালো শরযষ্টি আর কালো পালকযুক্ত–তার পর্যাণের থলেতে ভোতা একটা শব্দ করে গেঁথে যায় আবহাওয়ার কারণে যার গিল্টি করা চামড়ায় ছত্রাক জন্মেছে এবং কয়েক ইঞ্চির জন্য তাঁর উরু বেঁচে যায় যখন তৃতীয় আরেকটা তীর তাঁর বাহনের সামনের পায়ের ঠিক সামনেই কাদাতে এসে আছড়ে পড়ে। সে তার ঘোড়ার গলার কাছে নিচু হয়ে এসে জন্তুটাকে ঘুরিয়ে নেয়ার জন্য লাগাম শক্ত করে টেনে ধরে, প্রাণীটাকে সৈন্যসারির দিকে বল্পিতবেগে ফিরিয়ে নিয়ে চলে, পুরোটা সময় ভয়ে প্রতিটা স্নায়ু টানটান হয়ে থাকে যে আরেকটা তীর পেছন থেকে তাকে আঘাত করবে এবং তাঁর স্বপ্নের অকাল সমাপ্তি ঘটাবে। সে ঘোড়া দাবড়ে ফিরে আসার সময় পুরোটা পথ নিজেকে নিজের আহাম্মকির জন্য অভিশাপ দিতে থাকে। তার উচিত ছিল গুপ্তদূতদের আগে পাঠান।
আক্রমণকারী সে হতে পারে? তার আব্বাজানের কোনো হুকুমবরদার, তাকে বন্দি করার জন্য ঘোষিত পুরষ্কার দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে হালকা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দ্রুত ঘোড়া হাকিয়ে এসে তাদের দলটাকে পেছন থেকে ধরে ফেলেছে। মহবত খান আর তার বাহিনীও হতে পারে, বিচিত্র নয়? যদি তাই হয়ে থাকে, সে চড়া মূল্যে তার বিসর্জন দেবে। প্রায় এক যুগ পরে যেন মনে হয় আসলে এক মিনিটেরও কম সময় অতিক্রান্ত হয়েছে সে তার সৈন্যসারির দিকে এগিয়ে যায়। সে শুনতে পাবার মত দূরত্বে পৌঁছানো মাত্র চিৎকার করে উঠে, ‘সামনে তীরন্দাজ রয়েছে। আমরা হামলার সম্মুখীন হয়েছি। সৈন্যবহরের অগ্রযাত্রা বন্ধ রাখো। বৃষ্টির মাঝে আমাদের গাদাবন্দুক কোনো কাজে আসবে না। নিজেদের তীর আর ধনুক প্রস্তুত রাখো।’ নিজের লোকদের মাঝে পৌঁছে, সে তীর নিক্ষিপ্ত হবার দিক আর নিজের মাঝে ঘোড়াটা রেখে পর্যাণের উপর থেকে সে নিজেকে নামিয়ে আনে।
তাঁর লোকেরা নিজেদের বাহনের লাগাম টেনে ধরতে আর নিজ নিজ অস্ত্রের উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতে, খুররম নদীর দিকে আবার তাকায় কিন্তু কিছু দেখতে পায় না। আক্রমণকারীরা হয়ত ইতিমধ্যে সরে পড়েছে… কিন্তু ঠিক তখনই বাতাসে শীষ তুলে আরো তীর উড়ে আসে যেন তার এমন ধারণাকে তাচ্ছিল্য করতে। খুররমের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণ কর্চির শ্বাসনালীতে এসে একটা তীর বিদ্ধ হয় এবং সে নিজের গলা আঁকড়ে ধরলে তার আঙুলের ফাঁক গলে বন্ধুদ্বের মত রক্ত গড়িয়ে আসে। আরেকটা তীর মালবাহী একটা খচ্চরের গলায় বিদ্ধ হয় এবং জন্তুটা পুরু কাদায় হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবার আগে বিকট স্বরে মর্মস্পর্শী ভঙ্গিতে ডাকতে থাকে।
খুররমের প্রথমেই মনে হয় আরজুমান্দ আর বাচ্চাদের কাছে ছুটে যায়। তারা যে গরুর গাড়িতে রয়েছে তার চারপাশের পুরু চামড়ার আবরণ অন্ত তপক্ষে তীরের হাত থেকে তাদের খানিকটা হলেও সুরক্ষা দেবে। একটা শস্যবাহী শকটের পেছনে নিচু হয়ে এবং কাদার ভিতরে খানিকটা দৌড়ে, খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে সে আরজুমান্দ আর তাদের মেয়েরা যে গাড়িতে রয়েছে সে সেটার কাছে পৌঁছে। সে কাছে গিয়ে উঁচু হয়ে ভারি পর্দাটা একপাশে সরিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। জাহানারা আর রোসন্নারাকে দু’হাতে আগলে রেখে আরজুমান্দ এক কোণে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে রয়েছে, তাঁর খোলা মুখে ইতিমধ্যেই আর্তনাদ দানা বাঁধতে আরম্ভ করেছে যতক্ষণ না সে দেখছে কে উঁকি দিয়েছে।
‘আমরা হামলার মুখে পড়েছি, আমি জানি না কারা বা কেন আক্রমণ করেছে, খুররম জোরে শ্বাস নিতে নিতে অতিকষ্টে বলে। গাড়ির পাটাতনে শুয়ে থাকো, এবং আমি আবার ফিরে আসা পর্যন্ত সেখানেই শুয়ে থাকবে। যাই ঘটুক না কেন বাইরে বের হবে না। আরজুমান্দ মাথা নাড়ে। পর্দা ছেড়ে দিয়ে, খুররম উবু হয়ে দেহের মাঝ বরাবর বেঁকে দৌড়ে আরেকটা গাড়ির কাছে যায় যেখানে তাঁর ছেলেরা আর তাদের আয়ারা রয়েছে। আরজুমান্দকে সে একটু আগে যে নির্দেশ দিয়ে এসেছে সেই একই নির্দেশ শুনে তার ছেলেরা গোল গোল চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে যখন এসব করছে তখনই আরেকটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠের আর্তনাদ শুনে সে বুঝতে পারে আরেকটা তীর লক্ষ্যভেদ করেছে।
কাদায় মাখামাখি অবস্থায়, সে আবারও শস্যবাহী শকটের নিরাপত্তায় ফিরে আসে এবং, দ্রুত স্পন্দিত হৃৎপিণ্ডে, নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে। চটচটে আঠালো কাদায় মুখ নিচের দিকে দিয়ে তার আরও দু’জন লোক হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। আরেকজন–নিকোলাস ব্যালেনটাইন, দ্রুত হাতে কাজ করতে থাকায় ফ্যাকাশে হাত তার নিজের রক্তে লাল হয়ে আছে–নিজের পায়ের গুলে হাতের খঞ্জর দিয়ে সজোরে খোঁচা দিচ্ছে চেষ্টা করছে তীরের অগ্রভাগ কেটে ফেলতে। তাঁর কাছেই আরেকটা খচ্চর একপাশে কাত হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে, পাগুলো উন্মত্তের ন্যায় মাটিতে আছড়াচ্ছে। সে কিছু ভাববার আগেই আরো তীর তাদের ওপরে উড়ে এসে, একজন সৈন্যের পিঠে আঘাত করে, আরেকটা আরজুমান্দের গাড়ির একটা চাকার কেন্দ্রস্থলে ভোঁতা শব্দ করে গেঁথে যায়। তারপরে, সহসাই তীর নিক্ষেপ বন্ধ হয়। আক্রমণের পুরোটা সময় বৃষ্টির বেগ ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে, ছোট ছোট জল ভর্তি ডোবা থেকে ছিটকে উঠা পানি সবকিছু ভিজিয়ে দিচ্ছে। তীরন্দাজদের জন্য, তাদের ইতিমধ্যে ভেজা আঙুলের পক্ষে ভেজা ধনুকের ছিলায় তীর সংযোগ করা, এর ফলে কষ্টকর হয়ে উঠেছে।
কি ঘটছে? ক্লান্ত ভঙ্গিতে সে মাথা তুলে, অঝোর বর্ষণের মাঝে সে নদীর দিক থেকে ধীর গতিতে দুলকি চালের চেয়ে বেশি জোরে নয় অশ্বারোহীর একটা দলকে এগিয়ে আসতে দেখে। বৃষ্টির ইস্পাতের ন্যায় আবরণের কারণে তাঁর পক্ষে ধারণা করা কঠিন হয় ঠিক কতজন লোক রয়েছে দলটায়। তার বাহিনীর শক্তি যাচাই করতে সম্ভবত তাঁদেরও একই ধরনের মুশকিলের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। খুররম দাঁতে দাঁত চেপে ভাবে, বেশ, তাঁরা শীঘ্রই সেটা বুঝতে পারবে।
‘ঘোড়ায় ওঠো এবং আমায় অনুসরণ করো, সে তার ঘোড়ার দিকে দৌড়ে যাবার অবসরে দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলে এবং হাচড়পাঁচড় করে ভেজা পর্যাণে পুনরায় আরোহণ করে। তোমরা বাকিরা, পণ্যবাহী শকটগুলো পাহারা দাও আর আহতদের শুশ্রূষা করো।’ খুররম আর তার দেহরক্ষীর দল কয়েক মুহূর্তের ভিতরে তাঁদের অচেনা শত্রুর দিকে ধেয়ে যেতে থাকে, তাদের ঘোড়ার খুরের আঘাতে ছিটকে উঠা পানি আর কাদা তাঁদের চারপাশে উড়তে থাকে। নিচু হয়ে থাকো, সে তার ঘোড়ার গলার কাছে ঝুঁকে এসে চিৎকার করে, তরবারি কোষমুক্ত এবং উষ্ণ বৃষ্টির ফোঁটা তার মুখে গড়িয়ে যায়। নরম কাদায় তার ঘোড়া যদি কোনো কারণে হোঁচট খায় সেজন্য হাঁটু দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে রেখে সে চোখ সরু করে তাঁর আক্রমণের নিশানা খুঁজতে থাকে।
বৃষ্টির ভিতর দিয়ে খুররম আর তার লোকেরা বের হয়ে আসলে, তাঁরা তাঁদের আক্রমণকারীদের দিক থেকে বিস্মিত আর আতঙ্কিত চিৎকার শুনতে পায়। তাঁদের আক্রমণকারীরা সাথে সাথে উন্মত্তের ন্যায় নিজেদের ঘোড়ার লাগাম টানতে শুরু করে, নিজেদের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাঁদের দিক থেকে পুনরায় নদীর দিকে পালাতে শুরু করে। খুররম নিজের ঘোড়াকে দ্রুত ছোটার জন্য তাড়া দিয়ে সে একটা কাঁটা ঝোঁপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে যার গায়ে একটা ময়লা গাগড়ির কাপড় আটকে রয়েছে। সে একটা বাঁক ঘুরে পুরো দলটাকে প্রথমবারের মত ঠিকমত দেখতে পায়: শিরোস্ত্রাণবিহীন ত্রিশ কি চল্লিশজন মানুষ, ধনুক আর তীরের তূণ এখন তাঁদের পিঠে ঝুলছে, হাত আর পা ব্যস্ত কাদার মাঝে যতটা দ্রুত ছোটা যায় নিজেদের ঘোড়াগুলোকে ছোটাবার চেষ্টায়–কিন্তু নিজেদের মোগলদের ভালোজাতের ঘোড়ার কাছ থেকে নিজেদের মাঝে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার জন্য সেটা যথেষ্ট নয়। খুররম আর তার লোকেরা তাঁদের দিকে ধেয়ে যাবার সময় নির্মম সন্তুষ্টির সাথে সে ভাবে তারা তার শিকার। একটা লোক ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যায় এবং খুররমের দেহরক্ষীদের একজনের ঘোড়ার খুরের নিচে তার খুলি ফাটার শব্দ সে শুনতে পায়। দ্রুত অন্য আরেকজন যার বাদামি রঙের ছোট টাটু ঘোড়াটা প্রাণপণে ছোটার চেষ্টা করছে এগিয়ে গিয়ে খুররম গায়ের জোরে আঘাত করতে লোকটার পিঠে একটা বিকট ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সে তার তরবারির এক ঝটকায় দ্বিতীয় আরেকজনকে কবন্ধ করে দেয়–বাদামি রঙের একটা রুক্ষ চোব্বা পরিহিত হাড্ডিসার একটা লোক যার পালাবার সময় গতি শ্লথ করে তাদের পিছু ধাওয়াকারীরা কত দূরে রয়েছে দেখার দুর্মতি হয়েছিল। তাঁর ছিন্ন মাথাটা একটা ডোবায় গিয়ে পড়ে এবং মস্তকহীন দেহটা ধীরে ধীরে পর্যাণ থেকে পিছলে যেতে শুরু করে এবং কয়েক মুহূর্ত পরে সেটাও কাদার মাঝেই উল্টে পড়ে। খুররম নিজের চারপাশে তার লোকদের নিজেদের শান দেয়া ধারালো ইস্পাতের আয়ুধের সাহায্যে আক্রমণকারীদের স্রেফ কচুকাটা করতে দেখে যার বিরুদ্ধে পাল্লা দেয়ার মত প্রতিপক্ষের কাছে কিছুই নেই। চারপাশের মাটিতে কর্দমাক্ত বৃষ্টির পানির ছোট ছোট নহরে উজ্জ্বল, তাজা টকটকে লাল রক্ত এসে মিশছে।
সে আর তাঁর লোকেরা পাঁচ মিনিটের কম সময়ের ভিতরে তাঁদের শত্রুদের প্রায় সবাইকে হত্যা করে সামান্য কয়েকজন কেবল প্রাণে বেঁচে যায় যারা নদীর তীর বরাবর অবস্থিত ঝোঁপের ভিতরে কোনোমতে পালিয়ে যেতে পেরেছে।
খুররম তাঁর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের লোকদের মূল সৈন্যসারির কাছে ফিরে যাবার নির্দেশ দিতে যাবে এমন সময় সে প্রায় ত্রিশ ফিট দূরে মরা ডালপালার একটা স্তূপের নিচে মানুষের নড়াচড়া লক্ষ্য করে। আক্রমণকারীদের একজন নিশ্চয়ই ঘোড়া হারাবার পরে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। খুররম নিজের রক্তাক্ত তরবারিটা আরো একবার ময়ান থেকে বের করে এবং ঘোড়া থেকে দ্রুত নেমে এসে ডালপালার স্তূপের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে সবকিছু এখন আপাত স্থির হয়ে রয়েছে। সে যখন মাত্র দশ ফিট দূরে তখন সে মন্থর ভঙ্গিতে ডানদিকে বৃত্তাকারে ঘুরতে আরম্ভ করে। উবু হয়ে ডালপালার মাঝে উঁকি দিয়ে সে একজনকে তাঁর দিকে পিঠ দিয়ে গুঁড়ি মেরে শুয়ে থাকতে দেখে, তীর আর তৃণ পাশেই রাখা এবং ডানহাতে একটা খাঁজকাটা শিকারের ছুরি ধরে রয়েছে। খুররমের উপস্থিতি সম্বন্ধে তার মাঝে কোনো ধরনের সন্দেহের উদ্রেক ঘটে না যতক্ষণ না তাঁর তরবারির ইস্পাতের অগ্রভাগ তাঁর পিঠে গিয়ে গুতো দেয়।
‘ওঠে দাঁড়াও এবং বের হয়ে এসো, খুররম ফার্সী ভাষায় আদেশ দেয়। সে শীঘ্রই জানতে পারবে এরা তাঁর আব্বাজানের প্রেরিত সৈন্য নাকি অন্য কেউ। লোকটা যখন কোনো উত্তর দেয় না সে তখন প্রশ্নটা হিন্দিতে করে এবং তরবারি দিয়ে লোকটা মাংসে একটা খোঁচা দিলে বেচারার ইতিমধ্যে নোংরা জোব্বায় রক্তের দাগ ফুটে উঠে। তাঁর শত্রু এতক্ষণে হাউমাউ করে উঠে এবং ডালপালা একপাশে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত হাচড়পাড় করে পায়ের উপর ভর দিয়ে ওঠে দাঁড়ায় এবং ঘুরে দাঁড়াবার আগে খঞ্জরটা হাতে ধরে রেখেই পাগলের মত পালাবার পথ খুঁজতে শুরু করে। লোকটা খর্বাকৃতি এবং তারের মত পাকানো শরীরের অধিকারী এবং বাম কানে একটা সোনার মাকড়ি রয়েছে। খঞ্জরটা ফেলে দাও, খুররম চিৎকার করে বলে। লোকটা আদেশ পালন করলে খুররম লাথি দিয়ে সেটাকে দূরে সরিয়ে দেয়। কে তুমি? আমায় আর আমার লোকদের কেন তোমরা আক্রমণ করেছো?
‘কেন করবো না? আমাদের এই জলাভূমির ভিতর দিয়ে এমন আহাম্মকের মত যদি কেউ ভ্রমণ করে আমরা কি করতে পারি।’
খুররম ভাবে, যাক এরা তাহলে কেবল স্থানীয় ডাকাতের দল, যদিও মারাত্মক বিপজ্জনক, পেছনে পথের উপরে পড়ে থাকা নিজের আহত আর মৃত সাথীদের কাদার উপরে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকার দৃশ্য স্মরণ করে। এই দুর্বিনীত দুবৃত্তকে তার অপরাধের মাশুল দিতে হবে কিন্তু সেটা এখনই নয়। তোমাদের নেতা কে? তোমাদের গ্রামই বা কোথায়?
‘আমাদের একটাও নেই। আমরা প্রত্যেকে স্বাধীন মানুষ। আমরা এই অঞ্চলে বিচরণ করি আর যখন এবং যেখানে আমাদের পছন্দ হয় সেখানে অস্থায়ী শিবির স্থাপন করি।’
‘তোমাদের কতজন লোক এখানে রয়েছে?
‘আমরা একটা ক্ষুদ্র দল যারা রান্নার জন্য শিকার করতে বের হয়েছিলাম। আপনার দলের সাথে আমাদের ভাগ্যক্রমে দেখা হয়েছে। আমরা আপনাদের বণিকদের একটা কাফেলা ভেবে ভুল করেছিলাম। আমরা যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতাম আপনারা সেখানে কতজন মানুষ রয়েছেন তাহলে আমরা কখনও এত অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে আপনাদের আক্রমণ। করার নির্বুদ্ধিতা দেখাতাম না। কিন্তু শীঘ্রই আমাদের আরও ভাইয়েরা আসবে–আমাদের শত শত ভাই, আপনাদের উপর আমাদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে। আপনি বুঝতেও পারবেন না তারা ওঁত পেতে রয়েছে একেবারে শেষ মুহূর্তের আগ পর্যন্ত। তারা আপনাদের শিবিরে হানা দিয়ে আপনার সৈন্যদের হত্যা করবে, আপনার দ্রব্য লুট করবে–এবং আপনাদের মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করবে।
লোকটা কথা বলার মাঝেই হঠাৎ একপাশে লাফ দেয়, বেপরোয়া ভঙ্গিতে কাদায় আধা নিম্মজিত অবস্থায় পড়ে থাকা তার খঞ্জরটার কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করে। তাঁর আঙুল মাত্র বাট আঁকড়ে ধরতে যাবে যখন খুররম তার তরবারির ফলা সজোরে লোকটার পেটে ঢুকিয়ে দেয়। লোকটা পেছনের দিকে কাদার উপরে উল্টে পড়ে এবং কয়েক মুহূর্ত ধড়ফড় করে, রক্ত তাঁর জর্দার দাগ লাগা দাঁতের মাঝ দিয়ে বুদ্বুদ্ধের মত উঠে আসে, চোখ বিস্ফারিত, তারপরে নিথর হয়ে সেখানেই পড়ে থাকে।
খুররম ঘোড়ায় চেপে পথের দিকে ফিরে আসবার সময় ডাকাত লোকটা যা বলেছে সেসব নিয়ে চিন্তা করে। আসলেই কি এঁদের আরো লোক এখানে রয়েছে–কোনো এক ধরনের লুটেরা বাহিনী–নাকি পুরোটাই লোকটার অসার বাগাড়ম্বর? সে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে পারে না। তারা আজ রাত নামার আগেই এগিয়ে গিয়ে নদী অতিক্রম করবে। সে কোনো নিরাপদ স্থানে পৌঁছাবার আগে আর কতবার তাকে ডাকাত দলের খেয়ালের শিকার হতে হবে–ভয়ঙ্কর অপরাধীর দল তার আব্বাজান ঠিক তাকে যেমনটা ঘোষণা করেছেন? তার আব্বাজান তাঁর সাথে কি আচরণ করেছেন সে বিষয়ে তিক্ততা এবং তার কতটা পতন হয়েছে এসব ভাবনা ঘোড়ায় চেপে যাবার সময় তার মনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রাখে।
*
দুই ঘন্টা পরে, মৃতদের সমাধিস্থ করার পরে এবং গুপ্তদূতেরা এসে ডাকাতদের আর কোনো উপস্থিতির লক্ষণ না দেখতে পাবার কথা জানালে, সৈন্যসারি নদীর দিকে সংক্ষিপ্ত পথ অতিক্রম করে। বেশ চওড়া নদী–কিন্তু বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও খুব একটা গভীর না, গুপ্তদূতেরা নদীর যে অগভীর অংশ খুঁজে বের করেছে সেটা চার ফিটের বেশি গভীর নয়। অগম্ভীর হলেও, পানিতে বেশ স্রোত রয়েছে এবং মাঝ নদীতে অমসৃণ পাথরের খণ্ড মাথা উঁচু করে রয়েছে। খুররম নিজের ঘোড়ার সামর্থ্য পরীক্ষা করার জন্য দ্রুত বহমান পানির দিকে এগিয়ে যাবার জন্য তাকে তাড়া দেয়। সে স্বস্তির সাথে লক্ষ্য করে জটা পানির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে–তারা যদি সতর্ক থাকে তাহলে তাঁরা নদী অতিক্রম করতে পারবে। প্রথমে একদল সৈন্য পাঠাও অন্য পাড়টা সুরক্ষিত করতে, সে তাঁর দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধানকে আদেশ দেয়। আমরা তারপরে কেরাঞ্চিগুলো–গরু টানা মালবাহী গাড়ি-পাঠাতে আরম্ভ করবো।’
খুররম খুব শীঘ্রই নদীর অপর তীরে জ্বলন্ত মশাল দেখতে পায়–এটা আসলে সংকেত যে মূল পারাপার শুরু করার জন্য ওপাশটা নিরাপদ। বৃষ্টিও থেমে গিয়েছে এবং আকাশে এমনকি এক টুকরো নীল আকাশও দেখা যায় গাড়োয়ানরা যখন মালবাহী শকটগুলো টেনে আনা ষাড়ের প্রথম দলটাকে পানিতে নামার জন্য তাড়া দিতে শুরু করে। প্রতিবাদমুখর জন্তুগুলো কষ্টকর মন্থরতার সাথে নড়া শুরু করে কিন্তু কোনো অঘটন ছাড়াই অপর পাড়ে পৌঁছে যায়। খুররম এরপর মালবাহী খচ্চরের একটা দলকে পাঠায়, কেবল হালকা বোঝা পিঠে চাপানো রয়েছে যেহেতু ভারি মালপত্র আগেই কেরাঞ্চিতে করে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। পানির স্তর যদিও তাদের পেটের ওপরে ওঠে আসে নদীর একটা জায়গায় জম্ভগুলোর কয়েকটা বর্শার অগ্রভাগ দিয়ে খোঁচা দিতে হয় অগ্রসর করতে কিন্তু এই দলটাও অপর তীরে পৌঁছে যায় যেখানে তাঁরা কুকুরের মত নিজেদের গা থেকে পানি ঝরতে শুরু করলে তাঁদের গলায় ঝোলান ঘন্টাগুলো ঝনঝন শব্দে বাজতে থাকে।
খুররম একটু স্বস্তি পায়। অবশিষ্ট শকটগুলোয় কেবল মানুষ রয়েছে এবং মালবাহী শকটের চেয়ে অনেক হালকা। ভাগ্য ভালো হলে দিনের মত বিপদ কেটে গিয়েছে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে এখনও দিনের আলো বেশ ভালোই আছে। রাত নামার পূবেই তারা নদীর তীর আর নিজেদের মাঝে দুই কি তিনমাইলের একটা ব্যবধান তৈরি করতে পারবে এবং সে একটা নিরাপদ স্থানে শিবির স্থাপণ করবে আর রাতে প্রহরী মোতায়েন রাখবে। আহত লোক নিয়ে প্রথমে দুটো শকট নদী অতিক্রম করে। নিকোলাস ব্যালেনটাইন, তার পরনের চোগায় সে যেখানটা কেটেছে তার ভিতর দিয়ে তার পায়ের গুলে বাধা রক্তাক্ত পট্টিটা দেখা যায়, প্রথম কেরাঞ্চির গাড়োয়ানের পাশে বসে রয়েছে, পানির নিচে লুকিয়ে থাকা পাথর আর ভেসে আসা কাঠের টুকরো যা পানিতে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে আগেই লক্ষ্য করার জন্য সে সতর্ক চোখে তাকিয়ে রয়েছে। খুররমের তিন পুত্র আর তাদের আয়াদের বহনকারী কেরাঞ্চি এরপরে নদী অতিক্রম করে। তারা যখন নদীর অপর তীরে পৌঁছে তখন অবশেষে আরজুমান্দের শকটের পালা আসে।
শকটটাকে বহনকারী চারটা বিশালদেহী সাদা ষাড় পানিতে নামলে খুররম তাঁর ঘোড়াকে সেটার পেছনে নদীতে নামতে তাড়া দেয়, কোনো ধরনের বিপদ হলে সে কাছাকাছি থাকতে চায়। ধাতু দিয়ে বাধান বিশাল চাকাগুলোর যখন ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করে তাঁদের ভিতর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। গাড়োয়ান ধারালো পাথরের খণ্ড এড়িয়ে যাবার জন্য বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করে। কিন্তু কেরাঞ্চিটা যখন প্রায় মাঝ নদীতে একেবারে সামনের দুটো ষাড়ের একটা পিছলে পড়ে এবং জন্তুটার হাঁটু আধা বেঁকে যায়। গম্ভীর ডাক ছেড়ে ষাড়টা নিজেকে সামলে নেয় এবং একগুঁয়ে ভঙ্গিতে টানতে থাকে। খুররম পর মুহূর্তেই নদীর অপর তীর থেকে আতঙ্কিত চিৎকার শুনতে পায় এবং লোকজনকে দৌড়ে পানির দিকে আসতে দেখে। তাঁরা যেদিকে ইশারা করছে উজানে সেদিকে তাকিয়ে ফেনায়িত পানিতে ভেসে প্রচণ্ড গতিতে তাঁদের দিকে পানিতে উপড়ে আসা বিশাল একটা ডালপালাযুক্ত পাতাবহুল গাছ সে ভেসে আসছে দেখতে পায়। সে দৃশ্যটা ঠিকমত অনুধাবন করার আগেই গাছটা আরজুমান্দের কেরাঞ্চির বাম দিকে একটা রাম ধাক্কা দেয়। কেরাঞ্চির পেছনের চাকার স্পোক টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং পানির ভিতরে শকটা আস্তে আস্তে কাত হয়ে পড়ে, বিশাল গাছটা সামান্য কিছুক্ষণ এর উপরে আটকে থাকে কিন্তু তারপরেই স্রোতের বেগ তাঁর প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে সেটাকে ভাটির দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
খুররম নিজের আতঙ্কিত ঘোড়ার পাঁজরে পাগলের মত গুতো দিয়ে উল্টে পড়া শকটের কাছে গিয়ে দেখে যে উন্মত্তের ন্যায় হাচড়পাঁচড় করতে থাকা ষাড়গুলো পানির নিচে আটকা পড়েছে। ষাড়গুলোর জোয়ালের বাঁধন কেটে দাও, সে চিৎকার করে গাড়োয়ানকে বলে। নিজের ঘোড়া থেকে তারপরে লাফিয়ে নেমে, সে ভাঙা স্পোকের একটা ধরতে সক্ষম হয় এবং কেরাঞ্চির বামপাশের যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেটাই সবলে নিজে টেনে তুলে কিন্তু পানির নিচে থেকে যেটা উঠে আসে সেটা কেরাঞ্চির উপরিভাগ। সে খাপ থেকে খঞ্জর বের করে মোটা চামড়ার আচ্ছাদনে একটা আঁকাবাঁকা পোচ দিয়ে ভিতরে উঁকি দেয়। প্রবল বেগে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকা পানি আরজুমান্দের চিবুক পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে এবং তাঁর লম্বা চুল তাঁর চারপাশে স্রোতের মত ভাসছে, সে কেরাঞ্চির মূল কাঠামোর একটা কাঠের পোলিন্দ ডান হাত দিয়ে ধরে রয়েছে এবং বাম হাতে পানির উপরে রোসন্নারাকে ধরে রেখেছে। জাহানারা আরেকটা কাঠের পোলিন্দ দু’হাতে আঁকড়ে ধরে ঝুলছে।
খুররম তার পেছন থেকে অনেকগুলো কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে শুনে–তাকে সাহায্য করার জন্য অন্যেরা আসছে। জাহানারা তাঁর কাছেই রয়েছে সে নিজের ডানহাত মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দেয়। কেরাঞ্চি ছেড়ে দিয়ে তুমি বরং আমায় ধর,’ সে আতঙ্কিত মেয়েকে বলে যে এক মুহূর্ত ইতস্তত করে তারপরে তাকে আঁকড়ে ধরে। সে তাকে তুলে বাইরে বের করে আনে এবং কেরাঞ্চির পাশে ঘোড়া নিয়ে উপস্থিত এক সৈন্যের হাতে তাকে তুলে দেয়। সে এরপর আবার কেরাঞ্চির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। আরজুমান্দ চেষ্টা করো একটু কাছে আসতে যাতে করে আমি তোমার কাছ থেকে রোসন্নারাকে নিতে পারি। সে আধো আলোয় আরজুমাদের চোখ দেখতে পায় এবং তার কষ্ট করে শ্বাস নেয়ার শব্দ শুনতে পায় যখন সে হাত পুরোপুরি না ছেড়ে দিয়ে ডান হাতটা কড়ি কাঠের উপর দিয়ে পিছলে নিয়ে এসে রোসন্নারাকে তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। খুররম নিচু হয়ে নিজের মেয়ের বাহু ধরতে পারে এবং মেয়েটা যদিও ব্যাথা পেয়ে কেঁদে উঠে সে তাকে কেরাঞ্চির বাইরে টেনে বের করে আনে।
কিন্তু খুররম যখন ঘুরে দাঁড়িয়ে রোসন্নারাকে তার আরেকজন লোকের হাতে তুলে দিতে যাবে কেরাঞ্চির কাঠামো পুনরায় ভীষণভাবে দুলতে শুরু করে। তাঁর পা পিছলে যায় এবং সে টের পায় স্রোতের শক্তি রোসন্নারাকে তাঁর কাছ থেকে ছিটকে সরিয়ে নিচ্ছে। সে কোনোমতে আবারও দু’পায়ের উপরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উন্মত্তের মত চারপাশে তাকায়। রোসন্নারা! সে চোখের উপর থেকে পানি মুছতে মুছতে চিৎকার করে। রোসন্নারা! সে প্রথমে তাকে দেখতে পায় না কিন্তু পানির ভিতরে সে লাল কিছু একটা দেখে–তার পরনের কোট–এবং তারপরেই তাকে দেখে স্রোতের টানে ভেসে যেতে।
আরজুমান্দ তাঁর ক্ষিপ্ত আর্তনাদ শুনতে পায় এবং নিজেকে কেরাঞ্চির ভিতর থেকে টেনে বাইরে বের করে আনে, তাঁর গালের একটা ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়ছে। রোসন্নারা–আমার মেয়ে কোথায়? সে হাহাকার করে উঠে। খুররম ভাটির দিকে ইশারা করে। এখানেই থাকো। আমি তাকে উদ্ধার করছি। কিন্তু খুররম তার কথা শেষ করার আগেই আরজুমান্দ উত্তাল নদীর স্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে যদিও একজন দক্ষ সাঁতারু–আগ্রায় তাঁর হাভেলীর হেরেমের সাঁতারকুণ্ডে সে সাঁতার কাটতে ভালোবাসতো–কিন্তু এখানের এই তীব্র স্রোতের বিরুদ্ধে সে কিছুই করতে পারবে না আর ইতিমধ্যে স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেছে আর তাছাড়া পানির নিচে লুকিয়ে থাকা পাথর রয়েছে।
খুররম দ্রুত নিজের সিদ্ধান্ত নেয়। সে হাচড়পাঁচড় করে অপর পাড়ে গিয়ে পানি থেকে ওঠে আসে যেখানে ইতিমধ্যে তার বেশিরভাগ সৈন্য পৌঁছে গিয়েছে এবং চিৎকার করে তার জন্য একটা ঘোড়া নিয়ে আসতে বলে এবং তাঁর দেহরক্ষীদের আদেশ দেয় তাকে অনুসরণ করতে। ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠেই পুরু কাদার ভিতর দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে যেতে থাকে আর পুরোটা সময় মথিত হতে থাকা পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। নদীটা আর মাত্র কয়েকশ গজ সামনে বাম দিকে গাছপালার ভিতরে তীক্ষ্ণ একটা বাঁক নিয়েছে। স্রোতের বেগ সেখানে কম থাকার কথা এবং সে দেখতে পায় মাঝনদীতেও পানির উপরে লম্বা লম্বা ডাল ঝুঁকে রয়েছে। আরজুমান্দকে এক টুকরো কাঠ আঁকড়ে ভাসতে দেখে তার হৃৎপিণ্ড ধক করে উঠে এবং তার থেকে একশ গজ দূরে একটা লাল কাঠামো–একটা পুতুলের চেয়ে কোনোমতেই বড় হবে না–সেটা রোসন্নারার। তারা বাকের কাছে পৌঁছাবার আগেই তাকে অবশ্যই সেখানে পৌঁছাতে হবে…
সে বাঁকের উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছোটালে গাছের ডালপালা তাঁর মুখে চাবুকের মত আঘাত করে। নিজের ঘোড়াকে চক্রাকারে ঘুরিয়ে নিয়ে বেমক্কা তাকে থামিয়ে সে লাফিয়ে তার পিঠ থেকে নেমে আসে এবং নদীর উপরে ঝুলে থাকা একটা গাছে প্রাণপণে উঠতে শুরু করে। একটা চওড়া, মসৃণ ডালে যা পানির তিন ফিট উপরে রয়েছে সে বহুকষ্টে আরোহণ করে তাঁর ভর যতক্ষণ বহন করতে পারবে বলে তাঁর মনে হয় সে একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সে তারপরে ডালটা একহাতে তখন আঁকড়ে রেখে সে নিজের দেহ স্রোতের ভিতরে নামায় এবং ঘুরে উজানের দিকে তাকায়। সে একেবারে ঠিক সময়মত এসেছে। মেয়েটা এক পুটলি ভেজা লাল ত্যানার মত দেখায়। সে নিজের খালি হাতটা রোসন্নারা দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে প্রথমে রোসন্নারার পরনের লাল পোষাকটা ধরে এবং তারপরে তার এক হাত। এক হাতে মেয়েকে পানির ভিতর থেকে বাইরে আনতে তাঁর পুরো শক্তি প্রয়োজন হয় এবং পানি থেকে তুলে সে তাকে ডালের উপর বসায় এবং তারপরে সে নিজে উঠে বসে। মেয়ের কষ্ট করে শ্বাস নেয়ার শব্দ শুনে সে স্বস্তি লাভ করে। মেয়ের দেহ নিস্তেজ হয়ে রয়েছে কিন্তু সে বেঁচে আছে। তার সৈন্যদের একজন পাশের আরেকটা ডালে উঠে আসতে সে তার কাছে মেয়েকে দেয়।
রোসন্নারাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবার সাথে সাথে খুররম আবার ডাল বরাবর সামনের দিকে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করেছে। সে আরজুমান্দকে পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে, কাঠের টুকরোটা এখনও সে আঁকড়ে রয়েছে কিন্তু সে অনেক দূর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে তার পক্ষে তাকে ধরা সম্ভব হবে না। সে যখন ঠিক তার বরাবর পৌঁছে খুররম পানিতে লাফিয়ে নেমে তার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। নদী এখানে বেশ গভীর কিন্তু সে যেমনটা আশা করেছিল বাঁকের কারণে এখানে স্রোত বেশ দুর্বল। দশবারে সে আরজুমাদের পাশে পৌঁছে যায়। বাম হাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরে, সে বলে, কাঠের টুকরোটা ছেড়ে দাও। আমি তোমায় ধরেছি।’ সে তাঁর কথামত কাজ করে এবং খুররম ডান হাত চালিয়ে আর দুই পায়ে যত জোরে সম্ভব লাথি মেরে তীরের দিকে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করে। তার চোখে এতবেশি পানির ঝাপটা লাগে যে কেবল তীরের সবুজ অস্পষ্টতা আর আরজুমান্দকে কোনোভাবে ছুটতে না দেয়া ছাড়া সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারে না।
সে তারপরে কিছু একটা তাঁদের দিকে বাড়িয়ে রাখা হয়েছে দেখতে পায়। ‘জাহাঁপনা, বর্শার হাতলটা আঁকড়ে ধরেন, একটা কণ্ঠস্বর প্রাণপণে চিৎকার করে বলে। সে হাত বাড়াতে তার আঙুল কাঠের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। সে তারপরে বর্শার হাতল শক্ত করে আঁকড়ে ধরলে, টের পায় তাকে কেউ টানছে। সে আর আরজুমান্দ কিছুক্ষণ পরেই কাদার উপরে শুয়ে হাপরের মত শ্বাস নিতে থাকে। আরজুমান্দের ডান বাহুর উদ্ধাংশ ছড়ে গিয়েছে এবং বেশ রক্ত পড়ছে পানিতে কোনো পাথরের সাথে যেখানে সে আঘাত পেয়েছে এবং তাঁর গালেও জখম হয়েছে কিন্তু তার উচ্চারিত শব্দগুলো হলো, রোসন্নারা… আমার মেয়ে ঠিক আছে? খুররম কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। কর্দমাক্ত আর ভিজে জবজবে অবস্থায়, কাঁপতে কাঁপতে তারা যেমন রয়েছে সেভাবেই নিরব কৃতজ্ঞতায় একে অপরকে আঁকড়ে ধরে।