২৭. হোকাস পোকাস নয় এই কিডন্যাপিং
বাড়ি ফিরেই ফোন করলাম প্রেমচাঁদকে—কমব্যাট এক্সপিরিয়েন্স খার আছে, এমন একজনকে পাঠা। কুইক। সোমনাথ কিডন্যাপড়। সন্দেহভাজন আমি।
সেকেণ্ড কয়েক কোনও জবাব দিল না দুর্ধর্ষ বন্ধু। বললে তারপর, সুফি যাচ্ছে।
সুফি মানে একটা টেরর। শরীরী আতঙ্ক। আমি তার নাম দিযেছি, অ্যালোপেসিয়া হাল্পে। কারণ, সে নির্লোম মানুষ।
তার হাত পা আর আগ্নেয়াস্ত্র চলে সমান তালে, প্রায় লাইটনিং স্পীডে। যখন প্রতিপক্ষ থ’ হয়ে যায় তার লোমহীন অবয়ব দেখে।
এমন মানুষকেই আমার এখন দরকার। প্রতিপক্ষকে সমঝানো দরকার, ঘাঁটিয়েছ কাকে। তার নাম ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
কল্পনার মুখ থেকে বুঝি সব রক্ত নেমে গেল পায়ের দিকে, আমার কথা শেষ হওয়ার পর। একটি কথাও না বলে রিসিভার তুলে কনট্যাক্ট করেছিল রবি রে-কে—এখুনি এস। সোমনাথ কিডন্যাপড হয়েছে।
এবার শোনা যাক সোমনাথের কাহিনি—তার জবানিতে?
ইন্দ্রনাথকাকুর বাড়ির নিচে গেমস ফ্রিক নিয়ে তন্ময় হয়েছিলাম। বেশ নিরিবিলি জায়গা। চারদিকে মানুষ-টানুষ নেই। যেদিকে তাকাই শুধু পাহাড় আর জঙ্গল। মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। এমন জায়গায় এসে আমার অনেক কথা মনে পড়ে যায়। খুব ছেলেবেলার কথা। আমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করত বাবা আর মা। চোখের মণি ছিলাম দু’জনেরই। এখন একজনের। কী যে হল। মা বলে, বাবাকে আর মনে রাখবার দরকার নেই। মনে কর, তোর বাবার জায়গায় এসেছে ইন্দ্রনাথ কাকু। দেখছিস তো তোকে কত ভালবাসে। কত কিছু কিনে দেয়। তোর আগের বাবা তোর খোঁজও নেয় না।
‘আগের বাবা’ কথাটা আমার কানের মধ্যে খচ খচ করে লাগে। আগের বাবা’ আবার কী? বাবা তো একজনই হয়। বাবার জন্যেই তো আমি জন্মেছি। আমি কি বাচ্ছা ছেলে? কিছু বুঝি না? বাবা কখনও পাল্টায়? মা ওই সব ধানাইপানাই বলে আমার মনটাকে কাকুর দিকে ঘুরিয়ে দিতে চায়। আমি যেন কাকুকে বাবার মতো দেখতে শিখি। ভালবাসি। আপন করে নিই। তাহলে মায়ের সুবিধে হবে। কী সুবিধে হবে, তা কি আমি জানি না? আমি অত বোকা নই। মা তো বাবাকে ডিভোের্স করেছে। নাকি, বাবা ডিভোের্স করেছে মাকে পরিষ্কার জানি না। তবে, খুব চেঁচামেচি হয়ে গেছিল দু’জনের মধ্যে। হিরে নিয়ে নিশ্চয়। হিরে… হিরে শব্দটা আড়াল থেকে কানে এসেছিল। মা নাকি বাবার হিরে নিয়েছে। কী আশ্চর্য! বাবা তো মাকে অনেক গয়না দিয়েছে। হিরেও নিশ্চয় দিয়েছে। তাতে এত মাথা গরম করবার কী আছে? দোযটা বাবার।
কিন্তু মা যখন গয়নার বাক্স খুলে নাড়াচাড়া করে, হিরে তো আমি দেখিনি। একদিন জিজ্ঞেস কবেছিলাম—মা, হিরেগুলো কোথায়? মা আমাকে ঠাস করে চড় মেরে ছিল। তারপরেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল। কী কান্না! কী কান্না!
সেই থেকে হিরে নিয়ে আর কোনও কথা আমি বলি না। আমার যখন ছ’বছর। বয়স, তখন এইসব ব্যাপার ঘটেছিল। তারপর মা চলে এল এই পাহাড়ে। বাবাকে আর দেখিনি। কষ্ট হয়। কিন্তু মুখে বলি না।
এমন সময়ে এলেন ইন্দ্রনাথকাকু। মস্ত গোয়েন্দা। হিরে খুজতে নাকি? আমার সন্দেহ হয়। নাকি, আমার মাকে বিয়ে করতে? মায়ের রকমসকম দেখে বুঝতে পারি, মা চায় তাই। ইন্দ্রনাথকাকুকে বিয়ে করতে।
আচ্ছা, হিরেগুলো ইন্দ্রনাথকাকুর কাছে নেই তো? গোয়েন্দা তো। হয়তো হারিয়ে যাওয়া হিরে উদ্ধার করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। সেই লোভ দেখিয়ে মাকে বিয়ে করতে চাইছেন। গোয়েন্দারা সব পারে।
কিন্তু আমি তো তক্কে তক্কে থাকি। ইন্দ্রনাথ কাকু আমাদের বাড়িতে থাকেন না কেন? হিরে যাতে মায়ের হাতে না পড়ে, নিশ্চয় সেইজন্যে। এই দশ বছর বয়েসে আমি কচি খোকা নই। নজরে নজরে রাখি ওঁকে আর মাকে। একবারও মায়ের গা ছেন না ইন্দ্রনাথকাকু। সব সময়ে তফাতে থাকেন। রাত হলে অন্য বাড়িতে। এ বাড়িতে শুধু আমি আর মা। অনেক আগে আমরা তো তিনজনে এক সঙ্গেই থাকতাম। আমি, বাবা আর মা।
গোয়েন্দার ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে চেয়েছিলাম একদিন। ইন্দ্রনাথকাকুর জিনিসপত্র হাঁটকে দেখছিলাম যদি হিরে-টিরে পাওয়া যায়। কিন্তু ধরা পড়ে গেছিলাম। বকেননি। উল্টে আমাকে একটা সিলভার স্টার প্রেজেন্ট করেছিলেন। পঞ্চকোণ রজত নক্ষত্র। বেশ ভারি। বলেছিলেন, বীরত্ব দেখিয়ে পুরস্কার পেয়েছিলাম। তোকে দিলাম। বীরপুরুষ হবি—এই স্টারের জোরে।
পকেটে রাখি সেই স্টার। কোণগুলো বড় ধারালো। গায়ে ফুটে যায়। কিন্তু নিজেকে মস্ত গোয়েন্দা মনে হয়। মহাবীর। শক্তিমান। টিভির শক্তিমানের মতো যা খুশি করতে পারি।
গেমস ফ্রিক চালিয়ে রেখে এইসব যখন ভাবছি, আচমকা কে যেন আমার মুখ চেপে ধরল পিছন থেকে। চোখেও হাত চাপা দিল। ঝটকান মেরে তুলে নিল শূন্যে। সাঁ সাঁ করে এত তাড়াতাড়ি বয়ে নিয়ে গেল আমাকে যেন আমি একটা সোলার পুতুল। এমনভাবে খামচে ধরেছিল, একটুও নড়তে পারিনি, চেঁচাতে পারিনি। আমি টিভির শক্তিমান, কিন্তু আমাকে যেন পোকা বানিয়ে ফেলেছিল। প্রথমটা হকচকিয়ে গেছিলাম। তারপর স্পষ্ট মনে হল, নিশ্চয় ইন্দ্রনাথকাকু কিছু একটা মতলব এঁটেছেন আমাকে নিয়ে।
শুন্যপথে আমাকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে, একটুও আওয়াজ করতে না দিয়ে, ঢাল বেয়ে নামিয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল একটা গাড়ির মধ্যে। দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেছিল দরজা। আওয়াজ শুনে বুঝেছিলাম, বেশ ভারি দরজা। গাড়িটাও নিশ্চয় তাই। আঠালো ফিতে দেওয়া হয়েছিল আমার মুখের ওপর। তারপর একটা থলি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল মাথা গলিয়ে—যাতে কিছু দেখতে না পাই। ফিতে সেঁটে দেওয়া হয়েছিল হাত আর পায়েও। কিন্তু লড়ে গেছিলাম। ফিতে যাতে লাগাতে না পারে, তাই হাত-পা ছুঁড়েছিলাম। কিন্তু চোখে না দেখলেও বুঝেছিলাম, একজন নয়, অনেকজন আমাকে কাবু করে রেখেছে। আরও বুঝেছিলাম, রযেছি একটা ভ্যান গাড়ির মধ্যে। ডিজেল তেলের গন্ধ পাচ্ছিলাম।
তারপরেই গাড়ি চলতে শুরু করেছিল। ড্রাইভিং আরম্ভ হয়ে গেছিল। যে লোকটা আমাকে খামচে-খুমচে ধরে রেখেছিল, সে বললে, কেউ দেখে ফ্যালেনি তো?
ড্রাইভার যেখানে বসে, জবাবটা এসেছিল সেইদিক থেকে-না।
এই লোকটাই তাহলে আমাকে কাঁক করে ধরে তুলে এনেছে।
যে লোকটা আমাকে পিষে মারছিল, সে বললে, ও ছেলে, নিশ্বাস নিতে পারছ তো? ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বল।
আমি তখন ভয়ে কাঠ। কিছু করিনি।
ড্রাইভ যে করছিল, সে বললে, বুকে হাত দিয়ে দেখলেই তো হয়—হার্ট চালু থাকলেই বেঁচে আছে। এক পাটি জুতো ফেলে এলে পারতাম।
যে আমাকে ধরে রেখেছিল, সে বললে, খেলনাটা তো ফেলে এসেছ, ওতেই হবে। জুতোর চেয়ে বড় প্রমাণ।
গাড়ি নেমে গেল নিচের দিকে। আবার উঠল ওপর দিকে। মিনিট কয়েক পরে দাঁড়িয়ে গেল। কান দিয়ে শুনলাম আর একটা লোক উঠে এল গাড়ির মধ্যে।
তিনজনেই কথা বলছে হিন্দিতে। কিন্তু হিন্দি যাদের মাতৃভাষা, তাদের মতো নয়। স্কুলে আমি হিন্দি শিখেছি। তফাত বুঝতে পারি। এক-একজনের হিন্দি বুকনি এক-এক রকম। নানান অঞ্চলের লোক নিশ্চয়।
একজন বললে, ইন্দ্রনাথ রুদ্রকে দেখতে পাচ্ছি।
আর একজন বললে, করছে কী?
ঢাল বেয়ে নামছে। গেমস ফ্রীক তুলে দেখছে। বাড়ির দিকে ছুটছে।
এরপর আসবে মা।
মায়ের নাম করতেই আমি ছটফটিয়ে উঠেছিলাম। পরে মাকেও তুলে আনবে নিশ্চয়। ফিতে থেকে দু’হাত টেনে বের করবার চেষ্টা করেছিলাম। এই লোকগুলোকে লাফিয়ে শায়েস্তা করে মাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, পুলিশকে খবর দিতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু আমাকে পোকার মতো পিষে রেখেছিল প্রথম লোকটা। যে আমাকে তুলে এনেছিল। তার গায়ে অসুরের মতো জোর।
গাড়ি থেমেছিল অনেক অনেক পারে…
ড্রাইভ করছিল যে, তার গলার আওয়াজ চোয়াডে। বললে, এবার ফোন করা যাক।
শুনতে পেলাম, দরজা খুলে সে নেমে গেল। ফিরে এল একটু পরেই। বললে, কান ফতে।
ফের স্টার্ট নিল গাড়ি। নেমে গেল ঢাল বেয়ে নিচের দিকে। আবার উঠল এঁকাবেঁকা পথে ঘুরে ঘুরে। ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। রোলিং শাটার তোলবার আওয়াজ শুনলাম। নিশ্চয় গ্যারেজ খুলছে। গাড়ি এগিয়ে গেল। ইঞ্জিন বন্ধ হল। পিছনের দিকে লোলিং শাটার নেমে আসার আওয়াজ শুনলাম।
আমার পায়ের ফিতে খুলে দিল একজন। বললে, আয়।
এই সময়ে টানা হ্যাচড়ায় থলি সরে গেছিল চোখের ওপর থেকে।
দেখলাম, রয়েছি একটা গ্যারেজের মধ্যে। গাড়িটাও দেখলাম। সাদা রঙের ভ্যান গাড়ি। ধুলো বোঝাই। পাশের দিকে নীল রঙে কি যেন লেখা। পড়বার আগেই হ্যাচকা টানে সরিয়ে এনে আমাকে নিয়ে গেল একদিকে।
কর্কশ কণ্ঠে বললে, সামনে সিঁড়ি। পা তোল।
বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে টের পেলাম সিডির ধাপ।
কিন্তু নড়ছি না দেখে আমাকে ঝটকান মেরে কাধে তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে নামিয়ে দেওয়া হল মেঝেতে।
চোখের ওপর থেকে থলি ফের একটু সরে গেছিল। দেখতে পেলাম একটা ফাঁকা ঘর। ছোট্ট। ফার্নিচার-টার্নিচার নেই।
কিন্তু একটা চেয়ার ছিল পিছনে। আমাকে ঠেলে বসিয়ে দিল তাতে।
হেঁড়ে গলা বললে, থলি তোল। ছোঁড়ার মুখটা দেখি।
পিছন থেকে একজন টেনে তুলল থলি। আমি দেখলাম, আমার সামনে দাঁড়িয়ে এক পেল্লায় পুরুষ। খুব ঢ্যাঙা, মাথাটা প্রায় ঠেকছে গ্যারেজের ছাদে। খুব কালো। কপালে, চোখের নিচে, দু’গালে গোল গোল কালচে দাগ-যে ছ্যাকা মেরে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। চামড়া পুড়ে গেছিল। এখন শুকিয়ে গেছে। বীভৎস! মাথায়, গালে, ভুরুতে-কোথাও চুল নেই।
আমি শিউরে উঠেছিলাম। কানেব কাছে একজন বললে—আফ্রিকার কাফ্রি। বদমাইসি করিসনি। কাঁচা খেয়ে নেবে।
কাফ্রি দানোটা চিবিয়ে চিবিয়ে হিন্দিতে বললে, ঢুকিয়ে দাও বাক্সে। সঙ্গে সঙ্গে একজন ফের ফিরে জড়িয়ে দিল আমার দু’পা এক করে। মাথায় তুলে নিয়ে গেল বাইরে—ঠাণ্ডা বাতাসে। তখন নিশ্চয় রাত নেমেছে। শীত কড়া। ঠেলেঠুলে আমাকে ঢুকিয়ে দিল একটা কফিনের মতো প্লাস্টিক বাক্সের ভেতরে। উঠে বসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ধাক্কা মেরে শুইয়ে দিল চিৎ করে। ডালা বন্ধ করে দিল মাথার উপর। বুঝলাম, শূন্যে তুলে নিয়ে যাচ্ছে বাক্কা। তারপর স্পষ্ট টের পেলাম, বাক্স ফেলে দিল কুয়োর মতো একটা গর্তের নিচে। দড়াম করে বাক্স আছড়ে পড়ল নিচে। কী যেন ঝুরঝুর করে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে লাগল বাক্সের ওপর। আমার মুখের ইঞ্চি কয়েক ওপরে বাক্সের ডালার ওপরে। বেড়েই চলল সেই প্রপাত-শব্দ।
গায়ে কাঁটা দিয়েছিল তখনই।
বুঝেছিলাম, জ্যান্ত কবর দিচ্ছে আমাকে।