১৯. উৎকণ্ঠার মন্ত্র আর মত্ততার নৃত্য

১৯. উৎকণ্ঠার মন্ত্র আর মত্ততার নৃত্য

কল্পনা নাম্নী কন্যা যে বিশেষ কঠিন পদার্থ দিয়ে নির্মিত, এই তত্ত্ব আহরণ করতে বিলক্ষণ সময় লেগেছিল রবি রে নামক দুদে সেলসম্যানের। যে নাকি মানুয চরিয়ে খেয়েছে, দেশে দেশে ঘুরে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, তার মতো চৌকস সেয়ানা ধুরন্ধর চক্ষুষ্মন ব্যক্তিকেও ঘোল খাইয়ে দিয়েছে এই কল্পনা… কল্পনা চিটনিস।

প্রিয় বন্ধু বলেই প্রথম মধুরাতের মধুকথা আমার কানে যৎকিঞ্চিৎ উপুড় করেছিল রবি। সখীদের নিয়ে, হীরক, কারিগর বান্ধবীদের নিয়ে, কল্পনা সেই রজনীতে রমণ নৃত্য নেচে গেছিল রবির সামনে।

রমণীয় শব্দটাকে ইচ্ছে করেই একটু ছোট করলাম—এক কথায় লাখো কথা বলার জন্যে।

জহুরি দণ্ডপথ মানুষটা ছিলেন সত্যিই হিরের টুকরো। এই সংসারের পাথর-নুড়ির মধ্যে এমন হিরের কণা আচমকা এসে যায় বরাতে। রবি রের বরাত এই দিক দিয়ে বিরাট। জহুরি দণ্ডপথ হিরে চেনেন। তাই রবি নামক হিরের টুকরোকে বেছে নিয়েছিলেন। যে মন্ত্র কানে কানে বর্ষণ করেছিলেন, তা যুণ যুগ ধরে আতীব্র উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করে গেছে মন্ত্রধারীদের মনের মধ্যে। ব্যতিক্রম ছিলেন ” জহুরি দণ্ডপথ। তিনি দাবপরিগ্রহ করেননি। চিরকুমার। এবং জিতেন্দ্রিয়। কিন্তু হয়তো অনুক্ষণের উৎকণ্ঠার নিরসনের জন্যে নিশীথে শয়নকালে কিঞ্চিৎ অহিফেন সেবন করে যেতেন। নিয়মিত মাত্রা ছাড়িয়ে।

কল্পনার লকেট রবি রের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়ার আগে, বৈদিক বিবাহের মাধ্যমে, কানে কানে অনা মন্ত্র শুনিয়ে গেছিলেন আশ্চর্য এই বৃদ্ধ। যার সংক্ষিপ্তসার-বস রবি, যে মন্ত্র তোমাকে দান করে গেলাম, এ মন্ত্র তুমি দান করবে শুধু তোমার ঔরসজাত সন্তানকে।

রবি অবাক গলায় বলেছিল—তাহলে আমাকে শেখালেন কেন?

বৃদ্ধ বলেছিলেন, কারণ তুমি আমার পূর্বজন্মের পুত্র।

আপনি জাতিস্মর?

নিগুঢ় হেসেছিলেন জহুরি দণ্ডপথ। বলেছিলেন, বেশি জানতে চেও না। আশীর্বাদ করছি, রহস্যে রহস্যে রসময় হোক তোমার জীবন। নিজেই উদ্ধার করবে অনেক গুপ্তজ্ঞান। কিন্তু সাবধান। যা জানবে, তা পাঁচ কান করবে না। কল্পনার কানেও ঢালবে না।

এই বাণী তিনি রবির কানে বর্ষণ করেছিলেন মধুরাত শুরু হওয়ার কিছু আগে। শুতে চলে গেছিলেন—যথারীতি অহিফেনের কৌটো হাতে নিয়ে।

আর, রঙ্গিণী নৃত্য শুরু হয়েছিল তারপরেই। কল্পনার কাজের সহচরীরা গানে আর নাচে মাতিয়ে তাতিয়ে দিয়েছিল রবিকে। সেই আসরে আলো ছিল নিভু নিভু, কিন্তু আলো জ্বলছিল প্রতিটি মেয়ের চোখে। বুঝি নক্ষত্র ঝলসে যাচ্ছিল প্রতি কন্যার কটিদেশের রত্ন আভরণে—প্রায় অনাবৃত চারু অঙ্গের প্রতিটি প্রদেশ ঝলকিত হচ্ছিল উদ্দাম উচ্ছল উদ্বেল নৃত্যের বিপুল ছন্দের মহাতালে। রঙ্গিণীদের কেন্দ্রে ছিল স্বয়ং কল্পনা। বরতনুতে আভরণ যত ছিল, আবরণ ছিল না সেই অনুপাতে। চকিত কটাক্ষের অব্যক্ত চাহিদা ফুটে ফুটে উঠছিল, ঠিকরে যাচ্ছিল প্রতিটি স্পন্দিত রোমকূপ থেকে। ফুলে ফুলে উঠছিল নাকের পাটা-নাসিকারন্ধ্রে বয়ে যাচ্ছিল বসন্তবনের হরিণীর দীর্ঘনিশ্বাস… গানে আর কথায়, উল্লোল ছন্দ। আর দেহভঙ্গিমায় যেন বলে যাচ্ছিল কল্পনা—আমি বীর্যবতী, আমি বীরভোগ্যা, ডান হাতে নাও আমার সুধা, বামহাতে চূর্ণ করো আমার দেহপাত্র… অট্টহেসে পূর্ণ করো আমার শূন্য গর্ভ… ও গো মধুপ্রিয়… পান করো আমার শরীরের মধু… আদিম বর্বরতায় কঠিন হোক তোমার শরীর … নিষ্ঠুর নিপীড়নে নিংড়ে নাও আমাকে…ঝড় হেঁকে উঠুক তোমার অঙ্গে প্রত্যঙ্গে, কামনার ঘূর্ণিপাকে এসে যাও তুমি আমার মাঝে… তোমার শরীরের লৌহদূর্গে আমি হতে চাই বিবরবাসী… বাজুক দামামা তোমার রুধিরে পেশিতে… মেতে যাও নির্মাণ নেশায়… ঝংকারে টংকারে ক্রেংকারে হুঙ্কারে মত্ততার এই নৃত্যের অবসান ঘটুক মহামিলনে।

মধুরাতের এ রকম প্রলাপ পাঠক এবং পাঠিকার অজানা নয়। যুগ যুগ ধরে এমন মধু মত্ততা চলে আসছে বিয়ের বন্ধনে নর এবং নারী কাছাকাছি হওয়ার পর থেকেই। ফুলকিতে ফুলকিতে স্কেয়ে যায় উভয়ই… দাবানলের পর আসে প্রশান্তি…

 

রবি বললে, ইন্দ্র, আমি হিসেব করে দেখেছি, সেই রাতেই আমি বাবা হওয়ার বীজ বপন করেছিলাম।

আমি অট্ট অট্ট হেসে বলেছিলাম-হে বীর, লহ মোর প্রণাম।

রবি বললে, এসব কথা সবাইকে বলা যায় না। তুই একটা উঁাড়শ, তাই বললাম। পরের দিন সকালে দেখা গেল জহুরি দণ্ডপথ বডি ফেলে রেখে পালিয়েছেন।

আফিং বেশি খেয়ে?

কি করে বলি? ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে তো কোনও কথা ওঠেনি। আমি খবর পেয়েই দৌড়েছিলাম।

রণক্লান্ত যোদ্ধার মতো?

নো ইয়ার্কি, মাই ফ্রেণ্ড। ঘরে ঢুকে দেখলাম, প্রশান্ত মহিমায় দেহত্যাগ করেছেন এ কালের ভীষ্ম। ব্রহ্মতালুর কাছে উড়ছে মাছি। চোখের পাতা খোলা।

একটু থেকে আমি বললাম, তারপর?

তারপর?

গুম হয়ে গেছিল রবি। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়নি। আমি গুঁতিয়ে গেছিলাম—ডিম চুরি হল কবে? কীভাবে?

থেমে থেমে সেদিন যা বলেছিল রবি, তা নিগূঢ় রহস্যে আবৃত এক কষ্ট-কাহিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *