০৭. যমজ হিরে
অভিশপ্ত এই হিরে জগত বড় বেশি টেনে ধরেছিল রবিকে। তাই বুঝি এমন মন্দ ভাগ্য কৃষ্ণমেঘ রচনা করে গেছে ওর বিবাহিত জীবনে। মনে হয় বুঝি এক কল্পিত নাটক, যার মধ্যে সত্যের ছিটেফোঁটাও নেই। নিছক মিথ্যানৃত্য নিয়ে বুঝি রচনা করতে বসেছি এই কাহিনি।
কিন্তু তা তো নয়। হে পাঠক, হে পাঠিকা, বিশ্বাস করুন, এই আপাত আজব কাহিনি অলীক নয়। রতি পরিমাণেও। শিহরণ যদি জাগ্রত হয়, জানবেন তার মূলে আছে নিখাদ সত্য…এবং তা অবিশ্বাস্য।
হিরে নিয়ে, হিরের জন্মকথা নিয়ে শ্বাসরোধী ঘটনামালা সাজিয়ে যাওয়ার পরেই পকেট থেকে একটা পেপার প্যাকেট বের করে আমার সামনে রেখেছিল হিরে বণিক রবি রে। আদতে হিরে বণিক—মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ তার বহিরাবরণ। ছদ্মবেশ। বড় খলিফা…বড় ধুরন্ধর এই রবি রে।
পেপার প্যাকেটটা আমার সামনে রেখে দ্রিমি দ্রিমি মন্থর স্বরে রবি বলেছিল, ইন্দ্র, অ্যাংগোলায় যারা হিরে খুঁজে বের করে, এদের বলা হয় গ্যারিমপিরোস। জাতে এরা পর্তুগিজ। একদিন মোলাকাত ঘটল এমনই এক গ্যারিমপিরোসের সঙ্গে। পরনে টি-শার্ট আর জিনস। এই যে পেপার প্যাকেটটা তোর সামনে রাখলাম, এটা পেয়েছিলাম তার কাছেই।
প্যাকেট খুলে বের করেছিল একটা হিরের দানা-মুরগিকে যে দানা খেতে দেওয়া হয়—সাইজে চেহারায় সেইরকম।
এই দ্যাখ। বলে, পেপার প্যাকেট খুলে হিরের দানাটা আমাকে দেখিয়েছিল রবি রে। চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গেছিলাম আমি।
রবি আমার নিথর চক্ষু তারকার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে গেছিল—ইন্দ্র, ছোট্ট এই পাথরটার ওজন সাড়ে তিন ক্যারাট। আদতে হিরে কিনা, তা যাচাই করার জন্যে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল টেন পাওয়ার ম্যাগনিফাইং গ্লাস–হিরে বাণিজ্যে যে জিনিসটা অপরিহার্য। হিরে চিনতে হলে, বিশেষ এই আতস কাচ দরকার ‘ আমি সেই কাচের মধ্যে দিয়ে যা দেখেছিলাম, তা আমার চক্ষু চড়কগাছ কবার পক্ষে যথেষ্ট।
আমি বলেছিলাম, রবি, তুই তো একটা পয়মাল। সহজে তাজ্জব হোস না। কি দেখেছিলি?
দেখেছিলাম দুটো হিরে গায়ে গায়ে জুড়ে রয়েছে। গলে গিয়ে জুড়ে গেছে। ধরণী তার জঠরের কল্পনাতীত তাপ দিয়ে দুটো দু’রকমের হিরেদের একসঙ্গে জুড়ে রেখে দিয়েছে।
আজ, এতদিন পরে, সেই কাহিনি লিখতে বসে আমার মনে হচ্ছে, রবি যেন ওর ভবিষ্যৎ প্রত্যক্ষ করেছিল সেই যমজ হিরের মধ্যে। দুটো দুরকমের হিরে। একটা ও নিজে, আর একটা ওর ভাগ্যাকাশের শনি নক্ষত্র-কল্পনা।
রোমন থাক। সেদিনের কথায় আসি।
রবি বলে গেছিল—যমজ হিরে নিয়ে শুরু হয়েছিল দর কষাকষি! খনি শ্রমিক গ্যারিমপিয়োস যে হিরে বণিকের সামনে যমজ হিরে দেখিয়েছিল, তার নাম কাবেনজেলি। ছোট্ট একটা পকেট ক্যালকুলেটর বের করে সে খুটখাট করে হিরের দাম ফুটিয়ে তুলেছিল স্ক্রীনে। সাড়ে সাতশ ডলার। টেবিলের ওপর দিয়ে ক্যালকুলেটর ঠেলে দিয়েছিল হিরে যে খুঁড়ে তুলেছে—তার দিকে। সে দাম চেয়েছিল ২২০০ ডলার। ক্যালকুলেটর যাতায়াত করেছে টেবিলের এদিক থেকে ওদিকে। ওদিক থেকে এদিকে। দাম উঠেছে পড়েছে নিঃশব্দে—মুখে কোনও কথা নেই। শেষ পর্যন্ত রফা হয়েছিল ১৬০০ ডলারে। যমজ হিরে আমার পকেটে এল ২০০০ ডলারের বিনিময়ে। মস্ত ঝুঁকি নিলাম। হিরে ব্যবসাতে আজ যে রাজা, কাল সে ফকির হয়ে যেতে পারে, ফকির হয়ে যেতে পারে রাজা।
রবির চোখে চোখ রেখে আমি বলেছিলাম, তুই কি হয়েছিস?
যমজ হিরেকে পকেটে চালান করতে করতে রবি বলেছিল, এই মুহূর্তে রাজা। কেন না, ডবল দামের খদ্দের এসে গেছে হাতে।
বেরসিকের মতো আমি বলে ফেলেছিলাম, রবি, হিরে নিয়ে তুই কি শুধু দালালিই করেছিস? খনি থেকে হিরে তোলা দেখিসনি?
অট্টহেসে রবি তখন বলে গেছিল ওর দুর্ধর্ষ জীবনের অনেক গুপ্ত কাহিনি। যে সব কাহিনি প্রকাশ্য হলে ওর জীবন বিপন্ন হতে পারে। হিরে তোলার জাহাজে চেপে ও পাড়ি দিয়েছে মরুভূমির উপকূল থেকে আঠারো মাইল দূরের সমুদ্রে। সেই মরুভূমির নাম নামিবিয়া। দেখেছে কীভাবে সতেরো ফুট চওড়া ড্রিল ঢুকে যাচ্ছে দক্ষিণ আটলান্টিকের তিনশো ফুট গভীরে। টেনে তুলছে প্রতি ঘণ্টায় তিনশো মেট্রিক টন সমুদ্রতল—একটানা-বিরামবিহীনভাবে—দিনে আর রাতে-সাতদিন, সাতৃরাত।
ভাসমান খনি? নিরুদ্ধ নিঃশ্বাসে বলেছিলাম আমি।
হ্যাঁরে! গত দশ কোটি বছরে অরেঞ্জ নদী কত হিরে ধুইয়ে নামিয়েছে সাগরের জলে, তার একটা হিসেব করে নেওয়া হয়েছিল আগেই—পরিসংখ্যান হিসেব। সেই হিসেবেই ভাসমান খনি ভেসেছিল সাগরের জলে মাসে উনিশ হাজার ক্যারাটের হিরে তোলার টার্গেট নিয়ে…
উনিশ হাজার ক্যারাট!
আজ্ঞে।
হিরের ঝলকানি চোখ ঝলসে দেয়নি?
দূর! হিরে তো দেখিনি।
তবে?
শুধু পাথর আর সাগরের জঞ্জাল!