২২. কিডন্যাপার কে?

২২. কিডন্যাপার কে?

অবশ্যই বন্ধু হিসেবে।

মোহিনী মেয়ে কল্পনা আমার কাছে ঘ্যান ঘ্যান করেছিল ডিভোর্সি হয়ে যাওয়ার অনেক… অনেক পরে। রবি রে-র পেট থেকে একটু একটু করে সব কথাই তদ্দিনে আমার বের করা হয়ে গেছিল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হিরে নিয়ে ঝগড়া লাগতেই পারে। গয়নাগাটিতে আর শাড়ি-টাড়িতে মেয়েদের আকর্ষণ চিরকালের। সেকাল থেকে একাল-সব কালেই মেয়েরা এই রূপটা পাল্টাতে পারেনি। সুতরাং ওইসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আমার মাথা ঘামানো দরকার মনে করিনি।

কল্পনার আহ্বান ফেলেও দিতে পারিনি। সব মেয়েরাই প্রয়োজনে দ্রৌপদী গোত্রের হয়ে যেতে পারে, এ রকম একটা বিকৃত ধারণা আমার মতো মেয়ে-বিরূপ পুরুষের মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে। এটা এক ধরনের রোগ। মনের রোগ। আমার তো তাই মনে হয়।

কিন্তু কল্পনার ছেলেটা হাওয়া হয়ে যাওয়ার পর ছেলে চোর যখন টেলিফোনে শুধু ডিম চেয়ে বসল, তখন আমার টনক না নাড়িয়ে পারিনি।

রাঘব বোয়াল বিগ ব্রেন আসরে নামেনি তো? অথবা, রবি রে স্বয়ং?

বিগ কোয়েশ্চেন, তাই গা ঝাড়া দিয়েছিলাম। তখন কি জানতাম, আমাকেই কিডন্যাপার ঠাউরে খোদ রবি রে আসবে তেড়ে?

কবিতা বউদি, প্রিয় লেখক বন্ধু মৃগাঙ্কর প্রেম করে বিয়ে করা বউ, সুযোগ পেলেই আমাকে খোঁটা দিয়ে দিয়ে বলে, আমি নাকি একটা ভিজে বেড়াল… তক্কে তক্কে থাকি… চান্স পেলেই মহিলারূপিনী মৎস্য শিকার করি।

এসব খোঁচা আমি গায়ে মাখি না। আমি হলাম গিয়ে লক্ষ্যভেদী। অর্জুনের মতো। টার্গেট ছাড়া অন্যদিকে তাকাই না। সেই টার্গেটে উপনীত হতে গেলে যদি মহিলা-সহায়কের প্রয়োজন হয়, আমি দ্বিধা করি না। ওসব ঘেঁদো নীতির কমপ্লেকা আমার ভেতরে নেই।

কল্পনাকে অবলম্বন করেছিলাম সেই কারণেই। ফরাসি ছুটি নিয়ে ফেলেছিলাম। কর্তব্যের খাতিরে তাকে বন্ধুত্ব দিতে হিমালয়ে প্রস্থান করেছিলাম। নীড় রচনা করেছিলাম পৃথক আবাসনে। সে কথা আগেই বলেছি।

কল্পনা কি আমাকে ফাঁদে ফেলতে চায়নি? চেয়েছিল… চেয়েছিল… চেয়েছিল। কিন্তু আমি তো কখনও ওরসবুজ চোখের চাহনিতে নিষিক্ত হইনি—সে সুযোগ দিইনি।

অথচ ও কক্ষনো আগুনের সজীব ফুলকির মতো আমার সামনে আসেনি… আজকালকার শ্রীমতিদের মতো… বডি ল্যাংগুয়েজ আমাকে দেখাতে যায়নি… আজকালকার চটকদার চট্টালিকাদের মতো…

একদিনের কথা মনে আছে। সেদিন কল্পনা সবুজ শাড়ি পরে, দুই চোখের তারার েসবুজ প্রদীপ জ্বালিয়ে, দুই কর্ণাভরণে সবুজ পাথর দুলিয়ে, এমনকী নাকের পাটাতেও সবুজ পাথরের রোশনাই ছড়িয়ে… সবুজে সবুজ হয়ে… সবুজ বনলতার মতো আমার দেহকাণ্ডকে ঘিরে ধরতে চেয়েছিল…।

অথচ, সবুজ আগুন ছিল না কোথাও… না তনুমদিরায়, না বাক্যসুধায়… স্নিগ্ধতার এমন রূপ কখনও দেখিনি… আমাকে বলেছিল নিবিড় নৈকট্যের প্রলেপ মাখানো সহজ স্বরে—ইন্দ্রনাথদা, আমরা কি যুগলবন্দি হতে পারি না?

আমি নিপ্রদীপ স্বরে বলেছিলাম–বন্ধু স্ত্রী আমার বোনের মতো।

ও বলেছিল, এখন আমি মুক্ত…

বনচর…

কুরঙ্গী। ঈষৎ নতনয়না হয়ে অপাঙ্গে তাকিয়ে শুভ্র ভঙ্গিমায় জুড়ে দিয়েছিল কল্পনা—আমার তো কুরঙ্গ প্রয়োজন।

আমি বলেছিলাম, তাহলে ফিরে যাও আমার বন্ধুর কাছে।

তখনও ও আমার চোখের দিকে নিষ্পলক চাহনি মেলে রেখেছিল। আমি কিন্তু সেই সবুজ চুম্বকের দিকে ফিরেও তাকাইনি। রবির কাছে যে শুনে নিয়েছিলাম, কল্পনা ত্রাটক যোগসিদ্ধা। বনের পশুকেও বশ করতে পারে। কিন্তু আমি নিজেকে একটা অখাদ্য মনে করি। তাই চোখে চোখ রেখে নীতিহীন হতে চাইনি।

ছোট নিঃশ্বেস ফেলে কল্পনা বলেছিল, আমি নাকি দ্রৌপদী গোত্রের মেয়ে? তাই নাকি? আমার মুচকি জবাব। তবে কেন মহাভারতীয় পন্থায় এই শূন্য জীবনকে পূর্ণ করব না?

কারণ, মহাভারতীয় কাহিনির সমাজ এখন অতীতে চলে গেছে—জুরাসিক যুগের ডাইনোসরদের মতো এখন এই প্রথা অনুসরণ করা মানেই ডাইনি খেতাব অর্জন করা।

রেগে গিয়েও চোখের চাহনিতে তার আভাসটুকুও জাগতে দেয়নি কল্পনা। আমি বাজি ফেলে বলতে পারি, এই মেয়ে যদি সুচিত্রা সেনের সামনে ইণ্টারভিউ দিতে যেত, তাহলে বাংলার অভিনয় শিল্পের জগতে যে আকাল চলছে, তা আর থাকত না।

হযবরল বকছি? কাকেশ্বর কুচকুচে বলেই ধরে নিন আমাকে। কাককে কেউ পোষে না, মানুষ মাত্রই কাককে অবহেলার চোখে দেখে। অথচ চির অবহেলিত। এই কাক এই পৃথিবীতে নিজের জায়গা বজায় রেখে দিয়ে নিজের কাজটুকুই করে চলেছে। আমাকেও করতে দিন। আমার কাজ? পরোপকার। পকেটে কিছু আসুক আর না আসুক।

কল্পনার প্রেমের ভণ্ডামিতে তাই আমি ভুলিনি। আমি কাক, কাকের মতোই থেকেছি। তার অনিন্দ্য মুখশ্রী, তার কমনীর তনু, তার স্নিগ্ধ লাবণ্য, তার শিহরণ জাগানো আঁখিপাত, আমার শরীর থেকে উষ্ণ জ্যোতি বের করতে পারেনি। আমি একটা ফিলামেন্ট কাটা বিদ্যুত্বাতি। আমি একটা প্রতারক। যখন প্রেমের অল্প অভিনয় করি, রমণী যখন অপরাধের কুয়াশা রচনা করে, আমি তখন তা আমার এই যৎকিঞ্চিৎ অভিনয় শিল্প দিয়ে ছিন্নভিন্ন করি। তাই আমি অর্জুন হয়েও নই, বহু রমণীর পিপাসা মেটাতে ব্যগ্র নই।

কিন্তু আমি পাথর নই। আমার ভেতরেও সুর খেলা করে। আমার ভেতরেও কথা খেলা করে। তাই লিখছি। মনের কথা লিখে যাচ্ছি, তাতে তৃপ্তি পাচ্ছি। কথার এই ঝরণাধারা যদি আপনার মধ্যে অতৃপ্তি জাগায়, তাহলে হে পাঠক এবং হে পাঠিকা, অক্ষরের অরণ্য থেকে চক্ষু তুলে নিয়ে প্রবেশ করুন আমার মনের মধ্যে… দেখতে পাবেন—আমি কে, আমি কী, আমি কেন?

অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করবেন, আমি শ্রীহীন এই ইন্দ্রনাথ রুদ্র, আদতে একটা বিকট বিশ্রী জিজ্ঞাসা চিহ্ন… এই রূপ নিয়ে আমি কারণ অন্বেষণ করি অপরাধের অন্ধকারে…

যেমন করছি এখন…

 

ছেলে চোর, সোমনাথকে যে অপহরণ করেছিল, সেই রাস্কেলটা, আমাকে টেলিফোন করেছিল, সে কথা এই কাহিনির প্রথম দিকে লিখেছি। ব্ল্যাক বিজনেস স্যুট পরে সবুজনয়না কল্পনা চিটনিস দুই তারকা রন্ধ্রে উৎকণ্ঠার মশাল জ্বালিয়ে আমার দিকে যে চেয়েছিল—সে কথাটা অবশ্য লিখিনি, আমি নিজেই যে তখন টেনশনের ধিকিধিকি আগুন জ্বালিয়ে ফেলেছি মগজের মিলিয়ন বিলিয়ন কোযে কোযে। ছেলে চুরি তো আজকাল একটা লাভজনক ব্যবসা। রাজত্বে যখন রাশ থাকে না, মানুষের মজ্জাগত অপরাধগুলো কিলবিল করে ছড়িয়ে পড়ে বাজে। লেটেস্ট র্যানশম তো পঞ্চাশ লাখ টাকা। অপিচ এমন কাণ্ড-কাহিনি আমি শুনিনি। কিডন্যাপার বুক ফুলিয়ে চাইছে অর্ধকোটি মুদ্রা। এই মরুদ্যানে!

তাই আমি ভেবেছিলাম, কিডন্যাপার কোটি কয়েক মুদ্রা চেযে বসবে সোমনাথ-মূল্য বাবদ। হিরে বণিকদের পুত্রের দাম হিরে দিয়েই হয়। কোহিনুর-টোহিনুর টাইপের হিরেও চেয়ে বসতে পারত।

কিন্তু সে চাইল কী?

ডিম! চেয়েই, টেলিফোন নামিয়ে রাখল।

অগত্যা আমাকে ফ্ল্যাশব্যাকের পর ফ্ল্যাশব্যাক দিয়ে আগের কাহিনী পিণ্ডদের টেনেমেনে আনতে হয়েছে সময়ের এই আক্রাগণ্ডার বাজারে। মিনি গল্পের যুগে এই ম্যাক্সি ফ্ল্যাশব্যাক আদৌ প্রয়োজনীয় ছিল কি না, সমঝদার পাঠক (এবং পাঠিকা) নিশ্চয় তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছেন।

ডিম। যে ডিম নিয়ে তুফান রচনা করেছে কল্পনা সুন্দরী, যে ডিম পাচারে অংশ নিয়ে ছোটখাটো যক্ষরাজ হয়ে বসেছে দোস্ত রবি রে (যদিও তার দেহের গঠন কুৎসিত নয়, সে এক চক্ষু নয়, অষ্টপদের অধিকারীও নয়)—সেই ডিম চাইছে কিডন্যাপার–অতিশয় কর্কশ গলায়।

কিডন্যাপারদের কণ্ঠস্বর কর্কশই হয়—সায়গল-হেমন্ত-পঙ্কজের মতো হয় না। কিন্তু তার বাচনভঙ্গী আর বাক্য সংযমের তারিফ না করে পারিনি। সে চায় শুধু ডিম। টেলিফোন নামিয়ে রেখে মুক্তিপণের স্বরূপ শোনালাম কল্পনাকে। সে বিবর্ণ হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *