২০. কী ছিল পাথরের ডিমে?
ইন্দ্র, জহুরী দণ্ডপথ জীবন্ত জহর ছিলেন বললেই চলে।তিব্বতের মন্ত্র উনি আমাকে দান করেছিলেন, জহুরী চোখ দিয়ে কল্পনাকে যাচাই করে নিয়ে আমার জীবনসঙ্গিনী করে দিয়েছিলেন, আর… আর… আমাকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে গেছিলেন…
হিরে চরিত্র যেমন ছিল তার নখদর্পণে, তেমনিই নারী চরিত্র ছিল না তার অজানা… সেই কারণেই হয়তো ঘরণী আনেননি ঘরে… কুবেরের মন্ত্র সংগুপ্ত রেখেছিলেন মনের কদরে…কিন্তু জীবন যখন ফুরিয়ে আসছে,তখন উপলব্ধি করেছিলেন একটা মহাসত্য… মানবজীবনের মোদ্দা কথাটা কী?… ধারাবাহিকতা… বহমানতা… দিয়ে যাও… হাত বদল করে যাও… শিক্ষক দিক ছাত্রকে… পিতা দিক পুত্রকে… আমরা, এই মানুষরা, দিতে দিতেই চলে যাই… দিতেই হয় ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়।
আমি দার্শনিক হয়ে পড়ছি। বিল ক্লিনটনের একটা কথা মনে পড়ছে। স্মৃতির বোঝা যখন স্বপ্ন দেখার ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায়, মানুষ তখনই বৃদ্ধ হয়। আমিও বোধহয় বুড়িয়ে যাচ্ছি। এত স্মৃতি ভিড় করে আসছে মনের মধ্যে… অথচ কত কাজ এখনও বাকি…..
বন্ধুর কাছে মন হালকা করতে গিয়ে একটু-আধটু অপ্রাসঙ্গিক কথা তো বলবই। অথচ, একেবারে সঙ্গতিবিহীন নয়। ইন্দ্র, তোর ঘটে বুদ্ধি আছে। তুই বুঝবি।
আমি পলিটিক্স এড়িয়ে চলি। কিন্তু কল্পনা, আমার কল্পনা, শয্যায় যে শরীরী প্রহেলিকা… সংকটে যে মহাসচিব… সেই কল্পনাকে টেনে ধরেছিল পলিটিক্স…
পলিটিক্স! ইন্দ্র, আমি ডিক্সনারির পর ডিক্সনারি হাতড়ে পলিটিক্স শব্দটার আসল মানে খুঁজে বেড়িয়েছি। জেনেছি, শব্দটা আসলে দুটো আলাদা শব্দের সংযুক্তি… পলি মানে অনেক, টিক্স মানে ব্লাডসাকারর্স… রক্তশোষকবাহিনি…
এই পলিটিক্স এমনিতেই আমার কাছে বিভীষিকা… দূরে দূরে থাকি. কিন্তু একটু আঁচ তো গায়ে লাগবেই… বিশেষ করে ঘরণী যদি ব্লাডসাকারদের খপ্পরে গিয়ে পড়ে…
ধৈর্য হারাসনি, প্লীজ। ভেতরের এত কষ্ট আর কাকে বলব?
কল্পনা পাথরের দেশের মেয়ে। সে ত্রাটক যোগ জানে, চোখে চোখে সম্মোহন করতে পারে… আমাকে ছাড়া… একটু ভুল হল… একবারই টেনেছিল আমাকে… সবুজ চোখের বাণ মেরে… প্রথম দর্শনেই মরেছিলাম… তারপর থেকে হুঁশিয়ার হয়েছিলাম… ওর তৃতীয় চোখের দিকে তাকিয়ে দুই ভুরুর মাঝের অদৃশ্য ত্রিনয়নের দিকে তাকিয়ে মনের কথা ধরতে চেষ্টা করে যেতাম… তাই… ইন্দ্রনাথ… তাই। আমাকে ঘায়েল করতে পারেনি কল্পনা… পাথরের দেশের মেয়ে কল্পনা… শয্যায়। যে রক্তমাংসের বিদ্যুৎ বল্লরী. সেই কল্পনা…
ইন্দ্র, তুই জানিস… নিশ্চয় জানিস… জগত জুড়ে সন্ত্রাসের জাল ছড়িয়ে পড়েছে আজকাল… এর মধ্যে ধর্মের গন্ধ ছড়ানো রাজনৈতিক উসকানি আছে… সাম্রাজ্যবাদের অভিপ্রায় নিয়ে দূরাত্মা দমনের অছিলায় পরদেশ দখলের মতলববাজি আছে…
তোর কপালে বিরক্তির ভাজ পড়ছে দেখতে পাচ্ছি। তাই বিশদে আর গেলাম না। কামরূপ কামাখ্যার মেয়ে যার মা, সে যে শেষকালে মাতাহারি হয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।
কল্পনা হিরের লেনদেনে হাত মিলিয়ে সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য করে যেতে আরম্ভ করেছিল লুকিয়ে লুকিয়ে… আবার বলছি, ও পাথরের দেশের মেয়ে… তার ওপরে হিরে পাথরের কারবারে জড়িয়ে গিয়ে জেনেছে এক তাঞ্চল… এক দেশ থেকে… আর এক অঞ্চল্ল আর এক দেশে কারেন্সি কীভাবে যায়… হিরে রূপে… মনে পড়ছে? রক্ত ঝরেছে দেশে দেশে… ঝরছে এখনও… কল্পনাতীত অর্থের জোগান। দিয়ে যাচ্ছে হিবে… পাথর রূপী মুদ্রা…
পলিটিক্স… রক্তচোষাদের খপ্পরে পড়ে কল্পনা নজর দিয়েছিল আমার হিরে বাণিজ্যের দিকে। আমি তো হিয়া কামাল হুঁয়া করতাম… এখনও করি… একদামে কিনি, আর এক দামে বেচি… কোথায় সারপ্লাস হিরে… আর কোথায় হিরে মুদ্রার। বড় দরকার, এ খবর আমার মগজে থাকে… কমপিউটারে নয়… যন্ত্রকে আমি বিশ্বাস করি না… আমার বোধহয় মেক্যানোফোবিয়া আছে… হাইটেক ক্রাইমে দুনিয়া ছেয়ে গেছে… ই-মেল, ইণ্টারনেটকে তাই বিশ্বাস করি না… খবরের খনি আমার এই মগজ…।
বেশি বকছি? ক্ষমিও মোরে। কষ্টের কথা প্রিয় বন্ধুকেই বলা যায়। তোকে আগে বলেছি, জহুরি দণ্ডপথ আমাকে ন’টা পাথরের ডিম দিয়েছিলেন। নক্ষত্র এঁকে ন’টা পয়েন্টে বসানোর জন্যে। কাউকে তা বলিনি। কল্পনাকে তো নয়ই। মেয়েদের পেটে কথা থাকে না। তাছাড়া গুরুদেবের নিষেধ ছিল। চুটিয়ে হিরে চালান করে যখন টু-পাইস কামিয়ে যাচ্ছি, একটা অদ্ভুত আর আশ্চর্য খবর চিন্তায় ফেলার মতো খবর, আমার কানে এল।
স্বস্তিকা দেখেছিস? এই চিহ্ন আদতে হিন্দুদের অতি সৌভাগ্য চিহ্ন না, জার্মানদের আদি সৌভাগ্য প্রতীক, এই নিয়ে তর্ক-বিতর্কের ঝড় উঠেছে এখন। আমি সেই ঝড়ের মধ্যে ঢুকছি না, হিন্দুদের স্বস্তিকা এইরকম—
এই স্বস্তিকার মধ্যেও দ্যাখ, ন’টা পয়েন্ট আছে। আচ্ছা… আচ্ছা… দেখিয়ে দিচ্ছি…
স্বস্তিকা শুভশক্তিকে হিরের মধ্যে সংহত করা যায়, আর সেই শক্তিমান হিরে দিয়ে অনেক অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়—এই বিশ্বাসটা এসে গেছে বিশেষ একটা গুপ্ত সমিতির মধ্যে… না, না, সেই সমিতির নাম আমি বলতে পারব না… এই রক্তশোষকদের নাম যত অজানা থাকে, ততই পৃথিবীর মঙ্গল…।
ইন্দ্র, খুব কষ্টের সঙ্গে বলছি, কল্পনা এই গুপ্ত সমিতিতে ভিড়েছে… অথবা গুপ্ত সমিতি কল্পনাকে টেনেছে…।
ফলটা দাঁড়াল কী? স্ত্রী যদি মনে করে, স্বামীর ওপর গোযেন্দাগিরি করবে, কেউ তা রোধ করতে পারে না… খোদ মহাদেবও ভড়কে গেছিলেন পার্বতীর দশরূপ দেখে… মেয়েরা মনে করলে সব করতে পারে… সব করতে পারে… গড়তে পারে… ভাঙতে পারে… অবলীলাক্রমে…
তবে কেন কল্পনার সঙ্গে আমার গাঁটছড়া বেঁধে দিয়ে গেছিলেন জহুরি দণ্ডপথ? অবশ্যই কল্পনাকে টাইট রাখার জন্যে… ভেঙে গড়বার জন্যে… উপাদান তো ভাল…
যাক গে… যাক গে… আবার ছেঁদো কথায় চলে আসছি…
স্বস্তিকা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। লক্ষ্য করেছিস নিশ্চয়, এই চিহ্নে নবম বিন্দুটা উত্তম হিরের পক্ষে স্বাস্থ্যকর… আর, এই হিরে যে ধারণ করবে, সে শুভ শক্তি পরিবৃত থাকবে…
কল্পনার নজর গেল জহুরি দণ্ডপথের দেওয়া নখানা পাথরের ডিমের দিকে—যার মধ্যে আছে ন রঙের হিরে… বালি সাইজের…
ইন্দ্র, তুই আমার প্রাণের বন্ধু, হেজিপেজি মানুষ নস, পেটে কথা রাখতে জানিস, তাই তোকে একটা গুপ্ত খবর বলে রাখি…
আগেই বলেছি, জহুরি দণ্ডপথ এই পাথরের শূন্যগর্ভ ডিমগুলো আনিয়েছিলেন পেশোয়ার থেকে। অনিক্স পাথরের ডিম। কিন্তু নিরেট নয়! ফোঁপরা। প্যাঁচকাটা।
আমি নেমে গেছিলাম এই ট্রেডিংয়ে। হিরে আনা, হিরে বেচা। খনির হিরে এ-বর্ডার, সে-বর্ডার পেরিয়ে পেশোয়ারে ঢুকে, অনিক্স পাথরের ডিমের মধ্যে থেকে, চলে আসত আমার কাছে। আমি বিরাট লাভ রেখে সেই হিরে…অকাট্য। হিরে… চালান দিতাম ঠিক ঠিক জায়গায়… প্রফিট? কল্পনায় আনতে পারবি না…
হিরের গুদোম ছিল ব্যাঙ্গালোরেই… একটা হাই-টেক ইস্পাত সিন্দুকে… সে সিন্দুকের পাল্লা খুলে যেত শুধু আমার ডানহাতের বুড়ো আঙুলের ছাপ সিন্দুক খোলার সঙ্কেতের সঙ্গে মিলে গেলে… খুঁটিয়ে বলতে চাই না… শুধু বুড়ো আঙুলটা বিশেষ একটা জায়গায় চেপে ধরলেই কাজ শুরু হয়ে যেত… সিন্দুকের প্রথম পাল্লা খুললে সামনের চেম্বারে থাকত ছ’টা ডিম… জহুরি দণ্ডপথের দেওয়া ডিম, ভেতরে আছে আর একটা চেম্বার… সেখানে আমার ডানহাতের পুরো পাঞ্জা চেপে ধরতে হতো… এই সেকেণ্ড চেম্বারে বাকি তিনটে ডিম ছাড়াও থাকত বিস্তর অনিক্স পাথরের ডিম। প্রত্যেকটার ভেতরে চালানি হিরে… খনি থেকে চোরাই হিরে… হিরের খনি নিয়ে অনেক কথা তোকে আগে ভ্যাড়ভ্যাড় করে বলেছি। এ ব্যাপারটা মাথায় ঢোকানোের জন্যে…।
একটানা এতগুলো কথা বলে দম নেওয়ার জন্যে একটু যতি দিয়েছিল রবি রে! সুরুৎ করে সেই ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম আমার জেরা—ময়দানের শিল্পমেলা থেকে হাওয়া হওয়া পেশোয়ারি ডিম তুই নিয়েছিলি?