২৪. জহুরি যখন যযাতি হতে চায়
কল্পনা বলছে–
ইন্দ্ৰদা, দাদা বলেই এখনও সম্বোধন করব, বন্ধু রূপে তো রইলেন, অন্য রূপে নাই বা পেলাম…পেলে বর্তে যেতাম। তেরিয়া পুরুষদের আমার বড় পছন্দ-পুরুষ মানুষ ন্যাতাজোবড়া হলে কি মানায়? পুরুষ হবে কাটাগাছ অথবা কাটা গোলাপের মত… তুলতে গেলে আঙুলে ফুটবে… কিন্তু খোঁপায় মানায় ভাল।
ভুরু কুঁচকোবেন না। অপ্রিয় সত্যি বলছি তো, তাই মনে ধরছে না। তোয়াজ করা আমার ধাতে নেই।
অথচ একদা তোয়াজ করেই আমাকে থাকতে হয়েছে। কাকে জানেন? জহুরি দণ্ডপথ নামক ঋষিপ্রতিম বৃদ্ধটাকে। তাঁর চুল সাদা, ভুরু সাদা, দাড়ি সাদা। মুখের চামড়ায় কিন্তু যৌবন-কান্তি। কীভাবে এহেন যৌবনশ্রী ধরে রেখেছিলেন জানেন? একটু-আধটু আফিংয়ের জন্যে শুধু নয়। উনি যযাতি-প্রক্রিয়া আয়ত্ত করেছিলেন।
গোড়া থেকেই তাহলে শুনুন। জহুরি দণ্ডপথ অতি অমায়িক, অতি সজ্জন, অতি দয়ালু। এইটাই জানে জগজন। তিনি খুঁজে খুঁজে অনাথা রূপসীদের এনে হিরের কারখানায় কাজ করান, তাদের খাওয়া-পরা-থাকার ভার নেন। বিয়ের ব্যবস্থা করে দেন। দুর্নাম নাকি সুনামের আগে যায়, এমন একটা কথা আছে। কিন্তু তার বিপরীতটাও সত্যি বটে। সুনাম দুর্নামকে চাপা দিয়ে রাখে।
জহুরি দণ্ডপথ আসলে যে কি বস্তু, তা কেউ টের পায়নি। যারা টের পেয়েছে, তারা জীবন গেলেও মুখে প্রকাশ করতে পারেনি। যেমন আমি পারিনি। এখন পারছি কেন? আমার পেটের ছেলে গায়েব হয়েছে বলে। ইন্দ্রদা, জহর কারখানার তরতাজা মেয়েরা পালা করে প্রতি রাতে যেত জহুরি দণ্ডপথের অঙ্গ সংবাহন করতে। যাকে বলে ম্যাসাজ-তাই সারা শরীর ডলে দিয়ে একই শয্যায় থাকতে হতো—এর বেশি আর যেতেন না বৃদ্ধ—অক্ষম ছিলেন বলে।
কিন্তু কেন এই মনোবিকলন? বৃদ্ধ বয়েসে কেন হেন ভ্রষ্টাচার?
তার একটা সুযুক্তি খাড়া করেছিলেন জহুরি দণ্ডপথ। বলতেন, দ্যাখো মেয়ে, পুরাণ ঘাঁটলে অনেক বিজ্ঞান জানা যায়। যযাতি লোকটা মুখ বজ্জাত ছিলেন না। তিনি জানতেন, যুবতীদের শরীর থেকে যে প্রাণজ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়, তা যুবকদের যেমন সক্ষম রাখে, তেমনি বৃদ্ধদের জরা এগোতে দেয় না। বিলেত আমেরিকায় নাকি এই টেকনিকেই ইয়ং বিউটিদের পার্সোন্যাল সেক্রেটারি বানিয়ে রাখা হয়। কল্প বিজ্ঞানের একজন আমেরিকান বৈজ্ঞানিক তো ছ’জ বিউটিফুল যুবতীকে দিয়ে নিয়মিত বডি ম্যাসাজ করাতেন—তার জরা তাকে কাবু করতে পারেনি। পুরু আসলে নাকি হাজার বছর বাঁচেননি—ছেলের হাজার উপপত্নীদের পর নিয়েছিলেন যৌবন টনিক নিংড়ে নিয়ে নিজেকে তাজা রেখেছিলেন। হাজার শব্দটা গল্পে চলে এসেছে অন্যভাবে।
এইসব বুকনি সয়ে গিয়ে হাসি মুখে তার অঙ্গ সংবাহন করে যেতাম আমার পালা এলেই। নিশিযাপনও করতাম একই শয্যায়। কুমারী থাকতে পেরেছি কেন, তা আগেই বলেছি।
আমার পালা পড়ত বেশি। আমার এই হিলহিলে বিউটির জন্যে। আমাকে বলতেন, তুই একটা পাহাড়ি সাপ। জাপটে থাক। টের পাই শিরশির করে বিদ্যুৎ ঢুকছে ভেতরে।
কিন্তু বুড়ো বড় খলিফা। কখনও আমার চোখে চোখে তাকাতেন না। পাছে ঘোর সৃষ্টি করে পেট থেকে কথা বের করে নিই। তবে, আমার শরীরের বিদ্যুতেও বোধহয় সম্মোহন আছে। বোধহয় কেন, নিশ্চয় আছে। আপনি বড় হুঁশিয়ার, ইন্দ্রদা, তাই আমাকে টাচ করেন না। চান্স দেওয়া সত্ত্বেও।
জহুরি দণ্ডপথ আমার এই বডি-কারেন্টে এক-একদিন বেহুশ হয়ে যেতেন। প্রলাপ বকুনির মতো ছাড়া-ছাড়া কয়েকটা কথা বলতেন। যেমন, মন্ত্রগুপ্তি… মন্ত্রগুপ্তি… নয় হিরে তো নয়, ওরা নবগ্রহ… অসাধ্য সাধন করতে পারে… ছয়। হিরে দিয়েও নয়ছয় করা যায়…
ঘোর কেটে গেলে, ভোর হয়ে গেলে, আমার চোখে চোখ রেখে বলতেন—কিছু বলেছি নাকি? শুনে যদি থাকিস, চেপে থাকিস। তোর সঙ্গে ভাল ছেলের বিয়ে দেব। এমন বাচ্ছা তোর পেটে আসবে যে অসম্ভবকে সম্ভব করবে।
এইভাবেই রাসলীলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন বুড়ো। দোষ কী। শ্রীকৃষ্ণ যদি ষোল হাজার গোপিনীর দৃষ্টান্ত রেখে যান, আমাদের মতো বিনা মাইনের মেয়েদেরকে দিয়ে বডি ম্যাসাজ তো করাবেনই—শুধু বিয়ের লোভ দেখিয়ে।
যাকগে, যাকগে, যথা সময়ে পেলাম আপনার বন্ধু রবিকে! সোজাসাপটা মানুষ। আঁচ করলাম, ওকেই মন্ত্রগুপ্তি দিয়ে গেছেন গুরু দন্ডপথ। যেহেতু আমি কিছুটা জেনে ফেলেছি, তাই আমাদের যুগলবন্দি করে রাখলে ঘরানা হয়ে গুপ্ত থেকে যাবে মন্ত্রগুপ্তি।
হিরে নিয়ে সেঁটে ঘেঁটে আমি নিজেও কিন্তু জেনে ফেলেছিলাম আর একটা ব্যাপার। হিরে শোধনের এক অক্ষরের মন্ত্র। একটা ওঁ-কারের ছ’টা পয়েন্টে ছ’টা হিরে বসিয়ে ওঁ জপ করে গেলে বিশ্বশক্তি চলে আসে হিরের মধ্যে দিয়ে শরীরের মধ্যে। হিরে শোধন হয় কিনা বলতে পারব না। তবে, শরীর-মন অন্যরকম হয়ে যায়। প্রাঞ্জল করতে হবে? এই দেখুন, এঁকে দেখাচ্ছি—
ছ’টা পয়েন্টে ছ’টা হিরে বসালে হিরের শক্তি আর ওঁ-কারের শক্তি এক হয়ে গিয়ে অন্য একটা শক্তি এনে দেয় ভেতরে। হিরে নিয়ে কাজ করার সময়ে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে এই কাণ্ড করতাম। তাই আপনার বন্ধুকে চট করে কজা করতে পেরেছিলাম। জহুরি দণ্ডপথও তো ঘোরের মধ্যে বলেছিলেন, ছয় হিরে দিয়ে নয়ছয় করা যায়।
তারপর কত চেষ্টা করলাম। ভবি ভোলবার নয়। তাই একদিন একটু চান্স পেয়েই ওরই বুড়ো আঙুল দিয়ে সিন্দুকের পাল্লা খুলিয়ে লোপাট করলাম ছ’খানা ডিম। বাকিগুলো হাতানোর আগেই ওর ঘোর কেটে আসছে দেখে আর এগোইনি। আর একবার চান্স নেব, ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু বড় হুঁশিয়ার মাল আপনার এই বন্ধুটি। আমাকেই নাি চার্জ করে বসল। সোজা বললে, হয় ডিম দাও, নয় ভাগো।
তাই ভেগেছি, ছেলেকে নিয়ে। আপনাকে পকেটে এনে ওকেও প্যাচে ফেলবার প্ল্যান যখন কষছি, ছেলে গেল চলে…
কে নিয়েছে তাকে? ডিম যার, নিশ্চয় সে। ছেলের বাপ।
আপনি তাকে ফিরিয়ে আনুন। আপনার বন্ধুকে খবর দিন। সে যা চায়, তাই পাবে, তাই পাবে—ফিরিয়ে দিক আমার ছেলেকে।