ডিভোর্সি ললনা কল্পনা চিটনিস
আমি ইন্দ্রনাথ রুদ্র, লিখে যাচ্ছি আমার এই কাহিনি, নিজের কলমে। বড় গোপন কাহিনি যে। মৃগাঙ্ককে দিয়ে লেখালে সে তাতে জল মেশাবে অথবা কল্পনার রং মেশাবে। তার ওপর আছে কবিতা বউদির টিটকিরি। সে আর এক জ্বালা।
পুরুষ মানুষ যে ভীষ্ম হয়ে থাকতে পারে, সহজ এই ব্যাপারটা আমার এই অন্তর-টিপুনি দেওয়া বউদিটি কিছুতেই বুঝতে চায় না। মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা রাখতে হয় বইকি। নইলে কি সমাজের মধ্যে থাকা যায়? মেয়েরা আছে বলেই আমরা এই পুরুষরা টিকে আছি। নইলে কোনকালে ফৌত হয়ে যেতাম। তবে হ্যাঁ, একটু গা বাঁচিয়ে চলতে হয়। সেটা একটা আর্ট। ঈশ্বরের কৃপায়, আমি সে আর্টে আর্টিস্ট।
কল্পনা চিটনিস গ্যাংটকের মেয়ে। মানুষ হয়েছে ব্যাঙ্গালোরে। বিয়ে করেছিল কলকাতার রবি রে-কে। ওদের একটা ছেলেও হয়েছিল। ছেলেটার নাম সোমনাথ। তারপর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সোমনাথের বয়স এখন দশ।
কল্পনা সিকিম-গ্যাংটক-ব্যাঙ্গালোর-কলকাতা-গুজরাতের কালচারে মিশ খাওয়া এক আশ্চর্য কন্যা। তার সবুজ পাথরের মতো আশ্চর্য চোখে যখন তখন সবুজ বিদ্যুৎ নেচে নেচে যায়। ঝকঝকে মুক্তোর মতো সারি সারি দাঁতে ফুটফুটে বোদ্দর যখন তখন ঝলসে ওঠে। কথায় শোনা যায় জলতরঙ্গ, দেহতরঙ্গে মণিপুরী নৃত্য। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বড় পোক্ত এই কল্পনা। একটা জীবন্ত প্রহেলিকা।
সে আমাকে ভালবাসে। আমি মনে মনে তা বুঝি। কিন্তু আমি তাকে সেহ করি, আমার ছোট বোনের মতো। সে জানে, আমি ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই সীমার বাইরে কখনও পা দেয় না। ফলে, আমাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা বড় মধুর–সীমার মাঝে অসীম তুমি, বাজাও আপন সুর।
কল্পনা আমার কাছে একদিন একটা প্রবলেম নিয়ে এসেছিল। আমি নাকি প্রবলেম-শুটার ওর চোখে। আমার কাছে আমি একটা ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো।
সে যাক। কল্পনা এসে বললে, দাদা, ঘর তো ভাঙল। এখন ছেলেটাকে তো বড় করতে হবে।
আমি হুশিয়ার হয়ে গেলাম। বললাম, তা তো বটে। তা তো বটে! কল্পনা নিশ্চয় থট-রিডার। মন-পঠন বিদ্যায় পোক্ত। সব মেয়েরাই তাই হয়। আমার মতে, ওদের অগোচর কিছু থাকে না। যষ্ঠ ইন্দ্রিয় শুধু ওদেরই আছে।
মুক্তো দাঁতে কাঞ্চনজঙ্ঘার কিরীট একটু দেখিয়ে আর হাসিতে অল্প কিরণ ছড়িয়ে কল্পনা বলেছিল, পাহাড়ি জায়গায় থাকতে হবে। ছেলেকে নিয়ে একলা থাকা যায়?
হুঁশিয়ার হয়ে গেলাম। বললাম, পাহাড়ি মেয়ে তুমি, পাহাড়ে থাকতে ভয় কিসের?
ও বললে, তা নয়, ইন্দ্রদা। এমনই একটা কাজ নিয়েছি, যে কাজে হামেশাই ঘরের বাইরে থাকতে হবে। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোরার কাজ। বাড়িতে সোমনাথ একলা থাকবে কী করে? একা রেখে যাওয়াটা কি সমীচীন?
দেবকন্যা স্টাইলে এমনই ললিত ভঙ্গিমায় প্রস্তাবনাটা উপস্থাপন করেছিল কল্পনা যে, আমি কানাগলিতে আটকে গেছিলাম। স্মার্টলি বলেছিলাম, কী করাতে হবে?
আমার সঙ্গে থাকতে হবে। আলাদা ফ্ল্যাটে। কাছাকাছি দু’টো ফ্ল্যাটে।
ভাইবোনের মতো—ওর চোখের তারায় আমার ছায়া দেখতে দেখতে আমি সাত পাকে বাঁধা না থাকার আভাস দিয়ে গেছিলাম।
মধুর হেসে ও বলেছিল, আপনি বড় ভীতু। তাই হবে।
হ্যাঁ, আমি ভীতু। তাই হোক।
এই হল সূচনা। এই কাহিনির আগের কাহিনি। এবার আসা যাক আসল কাহিনিতে।
তারপর আমাদের এক অঞ্চলে থাকা শুরু হয়েছিল এমন একটা জায়গায়, যার পাশেই একটা গভীর খাদ।
ঘটনার শুরু যে সময়টা থেকে, সেই সময়টায় বড্ড বেশি শব্দহীন হয়েছিল অত গভীর খাদটা। শিকারি পাখি-টাখি ছিল না একটাও। অন্য সময়ে মাথার ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে যায় বাতাসে গা এলিয়ে দিয়ে—সেদিন কোনও আকাশচারীকে দেখতে পাইনি। বুনন কুকুরের মতো দেখতে নেকড়েগুলোর গান-টান শোনা যাচ্ছিল না। দরজার সামনের তালঢ্যাঙা পাইন গাছে যে পাচাটা থাকে, সেই মহাশয়ও আমার নাম-টাম জিজ্ঞেস করেনি। আমার চাইতে চৌকস যে কোনও মানুষ এই সবই যে আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস, তা আঁচ করে ফেলত নিশ্চয়। কিন্তু আমার ব্রেনে সেই সিগন্যাল আসেনি।
কনকনে ঠাণ্ডাটা বড় ভাল লাগছিল বলেই কুঁদ হয়েছিলাম। বহু নিচের গ্যাংটকের দিকে চোখের পাতা না ফেলে তাকিয়েছিলাম। হিমালয়ের মহান সৌন্দর্য এমনই একটা আবেশ রচনা করে গেছিল মনের মধ্যে যে, এই নৈঃশব্দ্য যে, আগুয়ান ডেঞ্জারের রেড সিগন্যাল, তা বুঝতে পারিনি। অথচ আমার বোঝা উচিত ছিল। আত্মহারা হয়ে যাওয়াটা আমার ধাতে নেই। সেদিন তা হয়েছিলাম। কাজটা ভাল করিনি।
হেঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, খতম হল ক’জন?
পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছিল দুমদাম ঘুষোঘুষির আওয়াজ আর গাঁক-গাক চেঁচানির মতো গলাবাজি। সোমনাথের গলা ভেসে এল সব আওয়াজ ছাপিয়ে, কী?
তোর হিরোইন জানে মারল ক’জনকে?
কথাটা যার দিকে ছুঁড়ে দিলাম, সে রয়েছে আমার কাছ থেকে বিশ ফুট দূরে। আমি কিচেনে, সোমনাথ লিভিংরুমে। তাই চেঁচাতে হল ফুসফুস ফাটিয়ে। ওকেও কথা বলতে হচ্ছে চিল-চিৎকার করে। এইভাবেই চলছে পাঁচদিন ধরে। কেন না, সোমনাথের মা সোমনাথকে সামলানোর ভার আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। মামা। সামলাক ভাগ্নেকে। এর মধ্যে রঙ্গ কিসসু নেই। কিন্তু কঙ্গো ড্যান্সে পোক্ত এই ভাগ্নেকে সামাল দেওয়া কি চাট্টিখানি কথা।
আমি অবশ্য জীবনের এই নতুন অধ্যায়ের নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের দিকে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছি। গোয়েন্দাগিরি করে করে এত হেদিয়ে গেছি যে, লোকালয় থেকে কিছুদিন দূরে থাকতে পারলে বাঁচি।
লম্বা লম্বা পা ফেলে গিয়ে দাঁড়ালাম লিভিংরুমের সামনে। বললাম, তোর ওই যন্তরে ভলুম কন্ট্রোল নেই?
সোমনাথ তখন যে বস্তুটা নিয়ে তন্ময় হয়ে রয়েছে, তার নাম গেমস ফ্রীক। এতই নিবিষ্ট যে আমার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সময়ও নেই। গেমস ফ্রীক এক হাতে, কন্ট্রোল নাড়ছে আর এক হাত দিয়ে। অ্যাকশন ফুটে ফুটে উঠছে বিল্ট-ইন কমপিউটার স্ক্রীনে। বস্তুটা ওকে দিয়েছি গতকাল। সেই থেকে এক নাগাড়ে খেলেই চলেছে। খেলুক। কিন্তু খুব যে একটা আমোদ পাচ্ছে, তা নয়। কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে আমারও।
খেলাটা এনে দিয়েছিলাম ওর খপ্পর থেকে একটু রেহাই পাওয়ার জন্যে। গুতিয়ে গুতিয়ে আমাকে নিয়ে যেত পাহাড়ি জায়গায়—মার্শাল আর্ট শেখবার মতলবে। আশ্চর্য এই মল্লশিল্প জানা থাকলে আখেরে কাজ দেয়। তাই ওকে কিছু কিছু শিক্ষা দিয়ে গেছি। আবার সক্কালবেলা স্কুলেও নিয়ে গেছি, বিকেলবেলা স্কুল থেকে নিয়ে এসেছি। বাকি সময়টা সিকিমের রান্না বেঁধেছি। ব্রুস উইলির মুভি দেখেছি। মামা-ভাগ্নের অট্ট অট্ট হাসিতে ঘর প্রায় চৌচির হয়েছে। আর এখন গেছে আমার চোখের আড়ালে—যাতে আমি দেখতে না পাই। বিটকেল গেম যে ওকে খিটকে করে তুলেছে তা তো মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। বসলাম পাশের সোফায় বললাম, চল, এক চক্কর ঘুরে আসি।
প্রস্তাবটা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আর এক কান দিয়ে বের করে দিল বিচ্ছু সোমনাথ। আবার এলাম অন্য কথায়, আমার গপ্পো শুনবি? তোর মায়ের কথা?
আমার গাপ্পো মানে ডেঞ্জারাস মানুষদের সঙ্গে আমার কাজ কারবারের কথা। এই তো সেদিন, গরমের শেষের দিকে, কল্পনা আর সোমনাথকে খুনের ফিকিরে ছিল ভুটিয়া গুণ্ডা দোঙ্গা জং! মানুষ মেরে বড় উল্লাস পায় দোঙ্গা জং। একেবারে পিশাচ। তার খপ্পর থেকে বাঁচবার জন্যেই নাকি আমার দ্বারস্থ হয়েছিল কল্পনা। কি করে ফেরাই? জানি ও আমাকে মনে মনে ভালবাসে। ডিভোর্সের আগে থেকেই ওর মনে রং ধরিয়ে ফেলেছি আমার অজান্তে। সোমনাথের বয়স যখন মাত্র ছ’বছর, তখনই আর পুরোনো বর নিয়ে ঘর করতে পারেনি কল্পনা। এই হিমালয় অঞ্চলেই দ্রৌপদী নামে একটা গোত্র আছে। বাড়ির এক বউ সব ক’টা ভাইকে বিয়েও করতে পারে। তিব্বতী আর নেপালি মেয়েরা তো এ ব্যাপারে অনেক আগুয়ান। রাখঢাক রাখে না সোয়ামি বদল করা বা একাধিক গোপন অথবা প্রকাশ্য সোয়ামি রাখার ব্যাপারে। কল্পনা চিটনিসের রক্তে রয়েছে সেই টান। ফলে, ছ’বছরের ছেলেকে নিয়ে ছেড়েছে এক স্বামীকে। খুনে গুণ্ডা পিছনে লেগেছে সেই থেকে। রঙ্গমঞ্চে আমার আবির্ভাব তারপরেই। ঠেঙারে ঠেকাতে। কিন্তু মালাবদলের ব্যাপারে আমি নেই। আমি যে ভীষ্ম। নির্ভেজাল। ব্যাসদেব নই। এই ভদ্রলোকের ‘সৎকর্ম’, মায়ের হুকুমে, কারও অজানা নয়। সুতরাং সেই পুণ্য প্রসঙ্গ থেকে বিরত রইলাম।
ঢ্যাঁটা সোমনাথ মা’কে নিয়েও কথা বলতে চাইল না আমার সঙ্গে। কথা ঘুবিয়ে দিল অন্যদিকে—ওই দ্যাখো, মামা। নষ্টরানি খেপেছে।
নষ্টরানি যাকে বলছে সে একটা কালিকা টাইপের মেয়েছেলে। যেমন কালো, তেমনি মারকুটে। এলো চুল পাকিয়ে পাকিয়ে বহু বল্লমের মতো ঝুলিয়ে রেখেছে পিঠে। ভীষণাকৃষ্ণা করাল রূপে একাই লড়ে যাচ্ছে তিন-তিনজন পেশিপুষ্ট জোয়ানের সঙ্গে। আশপাশে কাঁটা ঝোপ, দূরে দূরে খোঁচা খোঁচা পাহাড়। রুদ্রাণীর গলা চিরে যে হিস-হিস লড়াই-চিকার ঠিকরে আসছে, তা ইলেকট্রনিক হুঙ্কার…কিন্তু গায়ের রক্ত জল করে দেয়।
আমি বলেছিলাম, শয়তানের কারখানায় তৈরি মেয়েছেলে মনে হচ্ছে।
সোমনাথ বললে, বদলা নিচ্ছে রানি। ওর বোনকে যে বেচে দিয়েছে বদমাস মেয়ে-কারবারিরা।
বাচ্চাদের ইলেকট্রনিক খেলার মধ্যেও মেয়েপাচারের গল্প। গোল্লায় গেল দেশটা। আমার চোখের সামনেই করালী কন্যার ছুরির কোপে তিন দুশমনের রক্ত ছিটিয়ে গেল কমপিউটার স্ক্রীনে। বীভৎস।
কন্ট্রোলের স্টপ বোতাম টিপে-দিলাম। বন্ধ হল নারকীয় খেলা। বললাম, সোমনাথ, তুই আর তার মা বিপদের মধ্যে আছিস। কিন্তু আমি তো আছি।
তুমি তো আগলে রেখেছ—আমাকে আর মাকে।
আমার চোখে চোখে চেয়ে চেয়ে বলে গেল দশ বছরের সোমনাথ। সরল চাহনি। কিন্তু কথাটা বক্র। বহু রকমের অর্থবহ। যার ঔরসে জন্ম, মা তাকে ভালবাসে না। বাসে আমাকে। সোমনাথের তা অজানা নয়। ছোটরা বোঝে অনেক। ওদের মনের তল খুঁজে পায় ক’জন?
মনের ভেতরকার মোচড়টাকে বাইরে টেনে না এনে হাসিমুখে বললাম, মা তো ক’দিন পরেই ফিরবে। চ, খাবি চ।
খেলাটা শেষ করে নিই। নষ্টরানি কি মার মারছে, মামা।
দ্যাখ।
চলে এলাম কিচেন রুমে। শুনে গেলাম নষ্টরানির চিল-চিৎকার। বেধড়ক পিঠছে। রসিয়ে রসিয়ে রণরঙ্গিনী সেই মূর্তি দেখছে সোমনাথ। নিশ্চয় মা’কে কল্পনা করে নিচ্ছে সেই জায়গায়। দুশমন সংহার করছে মা।
মিনিট তিনেক পরেই মোবাইলে ভেসে এল কল্পনার কণ্ঠস্বর। কাজের মধ্যে একটু ফুরসৎ পেয়েই ছেলের খোঁজ নিচ্ছে। সামলাতে পারছি তো দামাল ভাগ্নেকে?
কল্পনা কাজ করে লোকাল টেলিভিশন স্টেশনে। নিউজ কমেন্টেটর। এখানে সেখানে গিয়ে চালু ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে খবর বলে যায় মুখে মুখে। আইন পড়া আছে। পড়েছে ব্যাঙ্গালোরে। আমার সঙ্গে ওর আলাপ সেইখানেই। ডিভোর্সের আগে একটা কুটিল কেসের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে গিয়ে।
ছেলের খবর নিয়ে আর আমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছেটা মিটিয়ে নিয়ে লাইন ডিসকানেক্ট করে দিল কল্পনা।
গেলাম লিভিংরুমে, সোমনাথকে, খবরটা দেওয়ার জন্যে। কিন্তু ঘর ফাকা। বাড়ির বাইরে গেলাম। এখানকার পাইন গাছের তলায় খেলতে ভালবাসে সোমনাথ। কিন্তু কেউ নেই সেখানে। মুখ হাঁ করে রয়েছে পাশের গিরিখাদ। হাঁক দিলাম গলা চড়িয়ে, সোমনাথ?
জবাব দিল না সোমনাথ।
মা টেলিফোন করেছিল। কাজ শেষ। এবার আসছে।
সোমনাথ নিশ্চুপ।
বাড়ির এ পাশ ও পাশ দেখে নিয়ে ফিরে গেলাম ভেতরে। গেস্ট রুমে উকি মারলাম। কেউ নেই। বাথরুমেও কেউ নেই। ফের গেলাম রাস্তায়। এ রাস্তায় গাড়ি আসে কম। পাশেই তো খাদ।
সোমনাথ! মা ফোন করেছিল। বাড়ি ফিরছে।
মায়ের ভয় দেখালাম। ছেলে কিন্তু অভিমানী। জবাব দিল না।
গঞ্জালো নামে এক বিদেশি ভদ্রলোক থাকেন পাশের বাড়িতে। এই দেশটাই এখন তার স্বদেশ। মাতৃভূমির নাম মুখেও আনেন না। তাঁর দুই ছেলে সোমনাথের সমবয়সি। তাদের সঙ্গে খেলতে গেলে সোমনাথ আমাকে বলে যায়। একটু নিচের ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে গেলেও আমাকে জানিয়ে যায়। খোলা রাস্তায় কদাচ যায়। খাদের ধারের সরু রাস্তার ওপর কল্পনার এই বাড়ি থেকেই খাদ দেখা যায়, তাই খাদের ধারেও ছেলেটা একা কখনও যায় না।
ফোন করলাম পাশের বাড়ির মিস্টার গঞ্জালোকে। সোমনাথ সেখানেও নেই। ঘড়ি দেখলাম। কল্পনা ফোন করেছিল চারটে বাইশে। এখন চারটে আটত্রিশ। এইটুকু সময়ের মধ্যে উবে গেল ছেলেটা। জানলা দিয়ে তাকালাম পাহাড়ের দিকে। কিন্তু পাহাড় তো ফাঁকা।
টেলিফোন এল মিস্টার গঞ্জালোর। তার ছেলেরাও দেখেনি সোমনাথকে। উনি নিজেই বেরোচ্ছেন খুঁজতে। প্রতিবেশী সজ্জন হলেই জগত সুন্দর। সুতরাং আমার চিন্তা কিসের?
চিন্তা কিন্তু কুটকুট কামড় বসিয়ে গেল মনের মধ্যে। একটু পরেই পাহাড় থেকে ফোন করে গঞ্জালো সাহেব জানালেন, সোমনাথ ওখানেও নেই।
এবার আমি নিজেই উঁকি দিলাম খাদের মধ্যে। কিনারা খুব গড়ানে নয়। তবু যদি গড়িয়ে গিয়ে যায়, এই চিন্তায় নরম মাটিতে পা বসিয়ে বসিয়ে নামতে নামতে হাঁক দিলাম আবার, সোমনাথ, কোথায় তুই?
ঢালু খাদের এদিকে সেদিকে ওয়ালনাট গাছ আছে অনেক। ঠিক যেন খাদের বাঁকা আঙুল। সোমনাথকে অনেকবার গল্পচ্ছলে বলেছিলাম, এইসব গাছের গায়ে একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে নিলে খাসা হতো। তাই আবার ডাক দিলাম–সোমনাথ! কোথায় তুই?
মনে হল যেন অনেক দূর থেকে একটা গলা ভেসে এল। পা ভেঙে পড়ে আছে হয়তো কোথাও।
সোমনাথ! সোমনাথ!
গাছের পাতার খসখস আওয়াজ ছাড়া কোনও শব্দ নেই। তারপরেই আবার গলাবাজি। যান্ত্রিক স্বর। এবার চিনলাম। গেমস ফ্রিক খেলার সেই কালিকারানি চেঁচিয়ে যাচ্ছে। গেলাম সেখানে। পেলাম গেমস ফ্রিক। সোমনাথ নেই।
কল্পনার চোখে মুখে নাকে চিবুকে সিকিমি টান থাকতে পারে, কিন্তু কথাবার্তায় খাঁটি বাঙালি। শিক্ষাদীক্ষা যে এই কলকাতায়। মঙ্গোলীয় বাঙালি ছাঁচে ঢালাই হয়ে গেছে। ফলে, সে সত্যিই একটা বস্তু। নইলে বাঙালি বর জুটিয়ে নেয়। এখন আমাকে কজায় আনার ফিকিরে আছে।
সোমনাথ দশে পা দিয়েছে। শিক্ষাদীক্ষা বাংলা আর ইংরেজিতে চলনসই, কানাড়া ভাষাও জানে। স্কুলে শিখেছে। তাই একটা চিরকুটে বাংলায় লিখলাম, সোমনাথ, এখানে থাকবি। তোকে খুঁজতে যাচ্ছি।
চিরকুট রাখলাম কিচেন ঘরের মেঝেতে। তারপর গাড়ি হাঁকিয়ে গেলাম গিরিপথ দিয়ে ওকে খুঁজতে। সূর্য ঢলে পড়ছে। ছায়ার জগত বেড়েই চলেছে। যেন শলি ঢেলে ভরাট করা হচ্ছে খাদের গভীরতা।
হয়তো তেড়ালি মচকেছে ছেলেটার। খাদ বেয়ে উঠতে পারেনি। পা টেনে টেনে নেমে গেছে আরও নিচে। ঠাঁই নিয়েছে কারও ডেরায়। পাহাড় যে ওর। আত্মীয়। পাহাড়েই আছে। উবে যায়নি। দশ বছর যার বয়স, সে এভাবে নিপাত্তা হয় না।
বাড়ির নিচের রাস্তায় পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে রাখলাম। রাস্তায় নামলাম। আলো আরও তাড়াতাড়ি চম্পট দিচ্ছে। অন্ধকার গাঢ়তর হচ্ছে। চোখ চালাতে বেগ পাচ্ছি। হেঁকে ডাকলাম, সোমনাথ?
এখানে বাড়ি আছে তিনটে। প্রথম দুটোয় নেই সোমনাথ। তৃতীয় বাড়ির মালকিন বললে, পিছনের চত্বরটা দেখে যেতে। না, সেখানেও নেই ছেলেটা!
আবার স্টিয়ারিং ধরলাম। দু’পাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছি। একটার পর একটা আলো জ্বলে উঠছে রাস্তায়। রাস্তা তো একটা নয়, অনেক। ছেলেটা কোন রাস্তায় সেঁধিয়েছে, বুঝব কী করে। মহা মুশকিলে পড়লাম। দু’বার গাড়ি দাঁড় করালাম। দুজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করলাম। না, কেউ দেখেনি জিনস আর সোয়েটার গায়ে দেওয়া কোনও ছেলেকে। এদিকে যে ঠাণ্ডা বাড়ছে। সোয়েটার এখন যথেষ্ট নয়।
বাড়ি ফিরলাম। সোমনাথ ফেরেনি। রান্নাঘরের মেঝেতে চিরকুট পড়েই আছে। কেউ ছোঁয়নি।
টহলদার প্রাইভেট সিকিউরিটিকে ফোনে জানিয়ে দিলাম। পাহাড়ি অঞ্চল তো। বেআইনি কাববারের ডিপো। তাই প্রাইভেট সিকিউরিটির বেশ রমরমা।
অনেকটা হালকা হলাম। ওরা ফোনে ফোনে খবর নেবে। সজাগ হয়ে গেল গোটা অঞ্চল।
ঠিক এই সময়ে বাড়ি ফিরল কল্পনা। অনেকটা পথ এসেছে গাড়িতে। ব্ল্যাক বিজনেস স্যুট ধসক গেছে। মুখে শ্রমক্লান্ত হাসি, সোমনাথ কোথায়?
ঘড়ি দেখলাম। ছ’টা বেজে দু’মিনিট। মোবাইলে কথা বলেছিলাম ঠিক একশো মিনিট আগে। বললাম, সোমনাথকে পাওয়া যাচ্ছে না।
কল্পনার মঙ্গোলীয় চোখ দুটো একটু বিস্ফারিত হল। মুখে কথা নেই। মা যে। ভেতরে যে কি হচ্ছে, বাইরে ফোটাচ্ছে না। আমি ছোট্ট করে রিপোর্ট দিলাম। যা-যা করেছি ছেলেটার খোঁজে, সব বললাম। সব শেষে বললাম, এবার পুলিশকে টী
টেলিফোনটা বেজে উঠল ঠিক এই সময়ে! কল্পনা ছিটকে যাওয়ার আগেই আমি গেলাম। রিসিভার তুললাম। অপর দিক থেকে অমার্জিত কণ্ঠস্বরে বললে, ইন্দ্রনাথ রুদ্র নিশ্চয়? গুড। সোমনাথ এখন আমাদের খপ্পরে। ফিরিয়ে দেব। দাম চাই।
কত? গলা না কাঁপিয়ে বলেছিলাম।
ডিম, বলেই রিসিভার নামিয়ে রাখল ছেলে চোর।