০৪. কল্পনার ছলনা কাহিনি

০৪. কল্পনার ছলনা কাহিনি

রবি আমার থুতনি নেড়ে দিয়ে বলত, কল্পনা আমার কল্পনা, ছলনাময়ী ললনা, কামরূপ থেকে কী শিখে এলে, বল না প্রিয়া, বল না!

আমি ওর বিদ্যুৎ চঞ্চল চোখে চোখ রেখে বলতাম, পঞ্চবাণ, পঞ্চবাণ!

ও বলত, কী নাম? কী নাম?

আমি বলতাম, সম্মোহন, উন্মাদন, শোষণ, তাপন আর স্তম্ভন।

ও বলত, তোমার ঘোট ঘোট চোখে তাই বুঝি এত বিদ্যুৎ।

আমি রেগে যেতাম। এই একটি ব্যাপারে খোঁচা মারলে মেজাজ খিঁচড়ে যেত। হ্যাঁ, আমার চোখ ছোট। একটু তেড়চাও বটে। মায়ের দিক থেকে পেয়েছি। মা ছিল হিমালয়ের মেয়ে। হিমকন্যাদের চোখ ওই রকমই হয়। দীঘল চোখ যাদের থাকে, তাদের মনের তল খুঁজে পাওয়া যায়। চোখ যে মনের আয়না। খুদে চোখে সেই মন সবটুকু ভেসে ওঠে না। আমারও ওঠে না। আমি গহন গভীর মনের অতল কোণে লুকিয়ে রেখে দিতাম আমার আসল চাহিদা। আমি চাই হিরে…এই পৃথিবীর জঠর থেকে তুলে আনা কঠোর পাথর, যার জলুস আর যার হিপনোটিক দ্যুতি বাড়িয়ে দিক আমার কামরূপ বিদ্যা।

না, কামরূপ-টামরূপ আমি যাইনি। কিন্তু চলমান চুম্বকের মতো যে কোনও পুরুষকে আমি টেনে ধরে নিংড়ে নিতে পারি। তাতেই আমার আনন্দ, তাতেই আমার আবেশ।

রবি রশ্মিকে আমি টেনে ধরেছিলাম ঠিক এই মতলবেই। সে যে নিখাদ হিরে, তা তো আমা;, জহুরি চোখ দিয়েই যাচাই করে নিয়েছিলাম। আমরা মেয়েরা এই একটি ব্যাপারে ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা রাখি। বিশেষ করে আমি রাখি। কারণ আমি হিমালয়ের মেয়ে। পুরাণ-টুরাণে আমাদেরকেই বলা হয়েছে বিদ্যাধরী। হিমলোক থেকে নেমে এসে মর্ত্যলোকের সুধা পান করে গেছি চিরকাল। করছি এখনও, নিংড়ে নিচ্ছি এই হীরক-যুবক রবি রে’র সত্তা থেকে।

নানান নিভৃত জায়গায় প্রেমালাপের সময়ে রবি আমাকে বলে গেছে ওর হীরক অনুসন্ধানের শিহরণ জাগানো কাহিনি। ওর মুখেই শুনেছি, হিরে ওকে টানে…ওর অণু-পরমাণুতে টান ধরায়। ও বোধহয় আগের জন্মে জহুরি ছিল…মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে হিল্লিদিল্লি ঘুরতে ঘুরতে বোম্বাইয়ের জহর বাজারে যেদিন থেকে ঢুকেছে, সেইদিন থেকে পূর্ব-পূর্ব জন্মের নেশা যেন ওকে পাগল করে দিয়েছে। ও যখন হিরে নিয়ে কথা বলত, তখন সত্যিই যেন ও আর এক মানুষ হয়ে যেত…ওর চোখের তারায় তারায় হিরের জলুস, হিরের কিরণ, হিরের কাঠিন্য দেখতে পেতাম।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, হিরের কাঠিন্য। কঠিন কঠোর কুলিশ কালো হয়ে যেত ওর দুই কনীনিকা। ওর অতীতু আমি জানি। আমাকে বলেছে মরণকে ও ডরায়নি। আজও ডরায় না। তাই প্রাণের পরোয়া না করে হিরের টানে ঢুকে গেছিল হিরের জগতে।

ময়দানে বসে একদিন ও পকেট থেকে রুমাল বের করে আমার মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলেছিল, কল্পনা, হিরে ছুঁইয়ে তোমাকে বরণ করলাম।

আমি আমার ছোট ছোট চোখে বিপুল বিস্ময় জাগিয়ে বলেছিলাম, হিরে চুইয়ে? ছোঁয়ালে তো রুমাল।

ও বলেছিল, হাত পাতো।

আমি পেতেছিলাম। রুমাল ঝেড়ে একটা হিরে আমার হাতে ফেলে দিয়েছিল দুষ্টু রাজা রবি রে। আমার এই ছোট ছোট চোখ জোড়া নিশ্চয় সেদিন পদ্মদীঘির মতো বড় হয়ে গেছিল। পড়ন্ত রোদে যেন হাজার সূর্য ঝিকমিকিয়ে উঠেছিল আমার হাতের ছোট্ট তেলোয়।

অপলকে চেয়েছিলাম চৌকোণা ধোঁয়াটে সাদা পাথরটার দিকে। বলেছিলাম, অস্ফুট স্বরে, হিরে! এইরকম!

ঠোঁটের কোণে কোণে ওর সেই বিচিত্র কুহেলি হাসি ভাসিয়ে রবি বলেছিল, আরও আছে। দেখবে? বলে, আমার জবাবের প্রতীক্ষা না করে ঘাসের ওপর রুমাল পেতে, ছোট্ট একটা ডিবে বের করেছিল পকেট থেকে। নিতান্ত অবহেলায়। ডিবে উপুড় করে দিয়েছিল রুমালের ওপর।

স্তম্ভিত নয়নে দেখেছিলাম রাশিকৃত খুদে হিরে। বিষম তাচ্ছিল্যে খুদে বজ্ৰমণিদের সাজিয়ে একটা পিরামিড তৈরি করেছিল আমাকে বোবা বানিয়ে রেখে।

‘বজ্ৰমণি’ শব্দটা ওর কাছেই শিখেছিলাম। ওষুধের কারবারে নেমে হিরে নিয়ে ওর এই মাতামাতি প্রথম প্রথম আমার ভাল লাগেনি। বেপরোয়া ও চিরকাল, ওর মুখেই শুনেছি, যা ভাল মনে করেছে। তাই করেছে। কারও কথায় কান দেয়নি। কিন্তু হিরের জগতে এইভাবে যে ঢুকে গেছে, তা তো জানতাম না।

আমার ছোট ছোট চোখের বিস্ময়-বিস্ফোরণ দেখতে দেখতে রবি বলে গেছিল—কল্পনা, কুচি কুচি এই হিরেদের প্রত্যেকের একটা করে ইতিহাস আছে।

আমি বিহুল গলায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, পেলে কোত্থেকে?

কঙ্গোর অ্যাংগোলান হিরের খনি থেকে।

কঙ্গোর হিরে! কলকাতার ময়দানে!

ও আমার কথা যেন শুনতেই পেল না। বলে গেল আপন মনে-অকট্যাহেড্রাল পাথর। প্রত্যেকটায় আছে আটটা দিক—প্রতিটা দিক সমান মাপের। অষ্টহস্ত পাথর—হিরে…আমার হিরে!

যেন আবিষ্ট গলায় কথা বলে যাচ্ছিল রবি রে…সেইদিন…সেই পড়ন্ত রোদের রোশনাইতে দুই চোখের হিরে ঝিকমিকিয়ে পকেট থেকে বের করেছিল একটা ছোট্ট ডিজিট্যাল স্কেল-দাঁড়িপাল্লা আর একটা পরিষ্কার সাদা কাচ। হিরের পিরামিডের পাশে রেখেছিল এক-তা সাদা কাগজ। খুদে চিমটে দিয়ে একটা হিরে তুলে নিয়ে কাচের প্লেটে রেখে, কাচটা রেখেছিল সাদা কাগজের ওপর।

বলেছিল, কল্পনা, এইভাবেই দেখতে হয় হিরের মধ্যে কলঙ্ক আছে কি না।

ফস করে আমি বলে ফেলেছিলাম, যেমনভাবে দেখেছ আমার ভেতরটা?

তুমি? নিষ্কলঙ্ক হিরে…আপন মনে, যেন ঘোরের মাথায় বলে গেছিল হিরে-পাগল রবি রে। প্রেমে পড়লে পুরুষমাত্রই অন্ধ হয়ে যায়। আমার মতো কাচকে তাই হিরে ভেবে নিয়েছিল। মেয়েরা চিরকাল এইরকমই হয়। এই আমার মতো। মুনিঋষিরও মতিভ্রম ঘটে।

মরুক গে। হিরের কথায় আসা যাক।

খুদে চিমটে দিয়ে আর একটা হিরে তুলে নিয়ে আমার পলকহীন খুদে চোখের সামনে নাড়তে নাড়তে আবিষ্ট স্বরে বলে গেছিল হিরে ধুবন্ধর রবি রে—এটার নাম মাকবর।

আকবরের হিরে নাকি?

ন্যাকার মতো কথা বলো না। আকবর হিরে-সমঝদার ছিলেন বলেই তার স্মৃতি রাখবার জন্যে এর নাম মাকবর।

দাম?

কথাটা তুলেও তুলল না রবি। বলে গেল আপন মনে-বড় কঠিন…বড় কঠিন এই হিরেরা—এদের গায়ে আঁচড় কাটতে হলে চাই আর একটা হিরে…হির ছাড়া হিরের গায়ে দাগ কাটতে কেউ পারে না।

কেউ পারে না বললে কেন? চোখের চকমকিতে ঝিলিক ছিটিয়ে আমি বলেছিলাম। আমি তো পেরেছি।

চোখে চোখে চেয়ে রবি রে বলেছিল, কারণ তুমি নিজেই যে বজ্ৰমণি।

আমি কিন্তু সেদিন, সেই ময়দানে, সূর্যদেবের পাটে বসার আলোয়, রবির চোখে দেখেছিলাম খুদে খুদে বজ্ৰমণি।

বজ্ৰমণি চোখেই আমার দিকে অনিমেষে চেয়ে থেকে ও বলে গেছিল, হিরে মহাশয়দের আর একটা গুণ আছে, কল্পনা।

কি গুণ, হে মোর বজ্ৰমণি?

বড় ঠাণ্ডা—বড় ঠাণ্ডা। ছুঁলেই হাত থেকে তাপ টেনে নেয়।

যে হেয়, তাকেও পাথর বানিয়ে দেয়?

হ্যাঁ।

আজ, এতদিন পরে সন্দেহ হয়, রবি রে কি নসত্রাদামুস বিদ্যে জানে? ভবিষ্যৎ দেখতে পায়? আমি, এই কবোষ্ণ কল্পনা, একদিন যে কঠিন প্রস্তর হয়ে যাব–কি ও দিব্য নয়নে দেখতে পেয়েছিল? নাকি, আলগোছে বলে ফেলেছিল আমাদের নিয়তি! কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *