হেডমাস্টার – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
টাইপ করা কতকগুলি জরুরি চিঠিপত্রে নাম স্বাক্ষর করছিলাম। টাইপিস্ট পরেশবাবু নিজে এসে সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, আজই চিঠিগুলি ডাকে পাঠাতে হবে। সই করতে করতে একটু ধমকও দিলাম পরেশবাবুকে, ‘একেবারে ছুটির সময় নিয়ে এলেন, এক্ষুনি উঠব ভাবছিলাম।’
পরেশবাবু বোধ হয় তাঁর সহকারীর ঘাড়ে দোষটা চাপাতে যাচ্ছিলেন, বেয়ারা নিতাই এসে সামনে দাঁড়াল।
বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তোমার আবার কি?’
নিতাই বলল, ‘আরো একজন ভদ্রলোকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান, স্লিপ দিয়েছেন।’
একবার তাকিয়ে দেখলাম, অফিসেরই ছোট্ট ভিজিটিং স্লিপ। পেন্সিলে লেখা দর্শনপ্রার্থীর নাম কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকার। দেখা করতে চান নিরুপম নন্দীর সঙ্গে। উদ্দেশ্যটা উহ্য। হয়ত গুহ্য বলেই। নাম দেখে কারো মুখ মনে পড়ল না। ভ্রু কুঞ্চিত করে বেয়ারাকে বললাম, ‘বল বসতে হবে। ব্যস্ত আছি।’ চিঠিগুলিতে নাম স্বাক্ষর শেষ করতে না করতে ক্লিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের বেয়ারা শীতল আর একগাদা চেক এনে হাজির করল। চেকগুলির উল্টো পিঠে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট্যাণ্টের সই চাই।
চটে উঠে বললাম, ‘নিয়ে যাও। এখন সই হবে না।’
বেয়ারা চেকগুলি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে ক্লিয়ারিং-এর ইনচার্জ পরিমলবাবু নিজেই সেগুলিকে ফের বয়ে নিয়ে এলেন, ‘সব ঠিক করে রেখেছি। শুধু আপনার সইটাই বাকি। কাল শনিবার। এসেই তাড়াতাড়ি হাউসে পাঠাতে হবে।’
বললাম, ‘তা জানি, একটু আগে পাঠালেই পারতেন। এর পর থেকে কোন কাগজপত্রে দুটোর পর আমি আর সই করব না।’
পরিমলবাবু মুখ কালো করে বললেন, ‘অমনিতেই আমার ডিপার্টমেন্টে একজন লোকে শর্ট আছে। তারপর বিনয়বাবু আজ আসেননি। সব ঠিকঠাক করে আনতে দেরি হয়ে গেল। এখন শুধু আপনার সইটা হলেই হয়ে যায়।’
শুধু সই, ভাবখানা এই, আমরা এত পরিশ্রম করেছি, আর আপনি শুধু সইটা করতে পারবেন না! সংক্ষেপে কেবল নিজের নামটুকু স্বাক্ষর করতে এত কষ্ট বোধ করছেন আপনি। কিন্তু সই করাটা যে সব সময় সহজ এবং প্রীতিপ্রদ নয় সে ধারণা এদের নেই।
মনে পড়ল ছেলেবেলায় নাম স্বাক্ষর করতে শিখে যেখানে-সেখানে দেয়ালে-কপাটে, বাবার নতুন পঞ্জিকায়, পুরনো দলিলে, নিরুপম নন্দীকে অমর করে রাখবার কি চেষ্টাই না করেছি। কিন্তু ঠেকে ঠেকে এখন শিক্ষা হয়ে গেছে। যত্রতত্র নাম স্বাক্ষর করতে আজকাল সহজে স্বীকৃত হই না। অনেক কুণ্ঠা, অনেক কার্পণ্য প্রকাশ করি। তা সত্ত্বেও অফিসের রাশি রাশি কাগজপত্রে নিত্যই যখন নাম স্বাক্ষর করতে হয়, তখন আর নামটাকে নিজের নাম বলে মনে হয় না, এমনকি অক্ষরপরিচয়ের ওপর ঘৃণা জন্মে যায়।
স্বাক্ষর-পর্ব শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, হঠাৎ টেবিলের ওপর সেই চিরকুটটি চোখে পড়ল। কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকার। জ্বালাতন করে ছাড়লে। বেয়ারাকে ডেকে বললাম, ‘কে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন বাইরে। আসতে বল।’
একটু পরেই ভদ্রলোক আমার চেম্বারের কাটা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন। তাঁকে দেখবার সঙ্গে সঙ্গে আমি উঠে দাঁড়ালাম, ‘একি মাস্টারমশাই, আপনি!’
আমাদের সাগরপুর এম ই স্কুলের হেডমাস্টার।
মাস্টারমশাই ততক্ষণ আমার সামনের চেয়ারটায় বসে বললেন, ‘বসো, কয়েকদিন ধরেই আসব আসব ভেবেছিলাম। শেষ পর্যন্ত এসে পড়লাম।’
ছেলেবেলার শিক্ষক। জোড় হাতে নমস্কার চলে না। পায়ে হাতে প্রণামই বিধেয়। কিন্তু ইউরোপীয় পোশাকে, প্রণামের প্রাচ্য পদ্ধতির অনুসরণ অশোভন না হোক, অসুবিধাজনক। তবু একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়ালাম। তারপর এগিয়ে এসে নিচু হয়ে মাস্টারমশাইর পামশু ঢাকা পায়ে দুটো আঙুল ছোঁয়ালাম। আঙুলে অবশ্য ধুলো লাগল না কিন্তু মনে হলো, নতুন কেনা টাইয়ের আগাটা মেঝের ধুলোয় মাখামাখি হয়ে গেছে।
সত্যিই পায়ের ধুলো নিই কি না দেখবার জন্য মাস্টারমশাইও এতক্ষণ অপেক্ষা করে ছিলেন। এবার নিঃসংশয় হয়ে হাত ধরে বসিয়ে বললেন, ‘থাক থাক, সিটে বস গিয়ে। ভাল তো সব?’ নিশ্চিন্ত হয়ে আত্মপ্রসাদে এবার একটু হাসলেন মাস্টারমশাই। আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম সামনের দুটো দাঁত মাস্টারমশাইর পড়ে গেছে। মনে পড়ল দাঁতের ওপর ভারি যত্ন ছিল মাস্টারমশাইর। নিমের ডাল ভেঙে রোজ সকালে দাঁত মাজতেন। লবঙ্গ, হরীতকী ছাড়া কোন দিন পান খেতে তাঁকে দেখিনি। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দাঁতের অধ্যায়টা একেবারে লাইন বাই লাইন মেনে চলতেন মাস্টারমশাই। তবু দন্তপঙ্ক্তিতে ভাঙন ধরেছে।
ফিরে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে বললাম, ‘দুটো দাঁত পড়ে গেছে দেখছি।’
মাস্টারমশাই ইংরেজিতে স্বীকৃতি জানালেন, ‘ইয়েস, আই হ্যাভ লস্ট টু অব দেম। কিন্তু আরগুলো সব শক্ত আছে।’
শেষ কথাটায় মাস্টারমশাইর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ফুটে উঠল। মৃদু হেসে বললাম, ‘তারপর স্কুলের খবর কি বলুন। কেমন চলছে?’ মাস্টারমশাই একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘স্কুল? তুমি কি দেশগাঁয়ের কোন খবরই রাখ না নাকি?’
অপরাধীর ভঙ্গিতে বললাম, ‘না, শিগগির কোন খবরটবর—’
মাস্টারমশাই সংক্ষেপে গম্ভীরভাবে বললেন, ‘স্কুল আমি ছেড়ে দিয়েছি।’
বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘সেকি স্যার, আপনি স্কুল ছাড়লেন?’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘হ্যাঁ ছেড়ে এসেছি। এসেছি যখন সবই বলব, সবই শুনবে। তার আগে যে-জন্য আসা। একটা চাকরি-বাকরি যোগাড় করে দাও নিরুপম। তোমাদের অফিসে আছে নাকি খালিটালি কোন জায়গা?’
‘আমাদের অফিসে?’ মাস্টরমশাইর মুখের দিকে আমি একটুকাল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তিনি কি পরিহাস করছেন? কিন্তু পরিহাসের সম্পর্ক তো নয়। তা ছাড়া ঠাট্টা-পরিহাসের মত মুখের ভাবও তাঁর এখন নেই। দাঁতগুলো শক্ত থাকা সত্ত্বেও গাল দুটো ভাঙা-ভাঙা, চোয়াল জেগে উঠেছে। গভীর রেখা পড়েছে কপালে। কালো লম্বাটে মুখখানায় কেমন এক ধরনের করুণ শীর্ণতা। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, কিন্তু কালোর চেয়ে সাদা রঙের ভাঁজই চুলে বেশি। হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা খেলাম। হেডমাস্টারমশাইও বুড়ো হয়েছেন। তাঁর যুবক বয়সের কিশোর ছাত্র ছিলাম আমরা। মাস্টারমশাইর বার্ধক্যে নিজের বয়োবৃদ্ধি সম্বন্ধে যেন নতুন করে সচেতন হয়ে উঠলাম।
কিন্তু একি বলছেন মাস্টারমশাই! পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে বয়স। এই বয়সে তিনি নতুন করে চাকরিতে ঢুকবেন। মাথায় কি ওঁর—। মাস্টারমশাইর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম, ‘স্কুল ছেড়ে এলেন কেন?’
মাস্টারমশাই রূঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘ছেড়ে এলাম কেন? ছাড়ব না কি স্ত্রী-পুত্র নিয়ে এই বুড়ো বয়সে না খেয়ে মরব? তাই বল তোমরা?’
বেয়ারা একবার দোর ঠেলে উঁকি দিয়ে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুটা বাজে। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘চলুন মাস্টারমশাই, বেরুনো যাক। যেতে যেতে সব শুনব।’
ডালহৌসি স্কোয়ারের মোড় থেকে দক্ষিণ কলকাতাগামী ট্রাম ধরলাম। তারপর মাস্টারমশাইর পাশাপাশি বসে শুনতে লাগলাম সাগরপুর এম ই স্কুল আর তার হেডমাস্টারের ইদানীংকার ইতিহাস।
পাকিস্তানের হুজুগে গাঁয়ের বেশিরভাগ হিন্দু ছাত্র চলে আসায় স্কুলের ছাত্রসংখ্যা প্রায় দশ আনি কমে গেছে। বাকি ছয় আনির মধ্যে অর্ধেকের বেশি ছাত্রের কাছ থেকে নিয়মিত মাইনে আদায় হয় না। একমাত্র সরকারী সাহায্য পঞ্চাশ টাকা ভরসা। এম ই স্কুলের পাঁচজন মাস্টারের মধ্যে সেটা বাঁটোয়ারা হয়। সাহায্য বৃদ্ধির জন্য জেলা শহরে গিয়ে ধরাধরি করেছেন হেডমাস্টারমশাই, কিন্তু ইনস্পেক্টর এসে স্কুল পরিদর্শন করে রিপোর্ট দিয়েছেন স্কুলের যা ছাত্রসংখ্যা তাতে পঞ্চাশের চাইতে বেশি সাহায্য সাগরপুর এম ই স্কুল আশা করতে পারে না। চার মাইল দূরে হোসেনপুরের নতুন এম ই স্কুলের ছাত্রসংখ্যা সাগরপুরের দেড়া। অথচ সে স্কুলের বরাদ্দ পঞ্চাশের চাইতে এখনো পাঁচ টাকা কম আছে।
কিন্তু এতেও হেডমাস্টারমশাই ঘাবড়াননি। টুকটাক করে চালিয়ে নিচ্ছিলেন সংসার। সব চেয়ে বড় ভরসা ছিলেন স্কুলের সেক্রেটারি নিত্যনারায়ণ চৌধুরী। চৌধুরীবাড়ির টিউশনিও গোড়া থেকেই বাঁধা ছিল হেডমাস্টারমশাইর। নিত্যনারায়ণবাবুর ছোট ভাইদের থেকে শুরু করে তাঁর ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনীদের পর্যন্ত হেডমাস্টারমশাই পড়িয়েছেন। প্রথমে পনের টাকায় আরম্ভ করেছিলেন। চৌধুরীমশাইর নাতি-নাতনীর সংখ্যা বছরের পর বছর বাড়তে থাকায় টিউশনির টাকার অঙ্কও বেড়ে বেড়ে পঁয়ত্রিশ পর্যন্ত উঠেছিল। স্কুলে লিখতে হত ষাট, মিলত চল্লিশ। মাইনের সঙ্গে টিউশনির এই উপুরি টাকার সংযোগে সংসার চলত।
কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর চৌধুরীরাও শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়লেন। ছেলেরা পুত্ৰকলত্র নিয়ে কেউ কলকাতা, কেউ এলাহাবাদ, কেউ দিল্লী পর্যন্ত পাড়ি দিল। নিত্যনারায়ণ নিজেও এলেন শহরে। হেডমাস্টারমশাই বললেন, ‘আপনারা সবসুদ্ধ চলে গেলে চলবে কি করে? আমরা কি করব?
নিত্যনারায়ণ বললেন, ‘তাই তো, মাস্টার, তোমার সমস্যাটা তো রয়েই গেল। বাড়িতে ছেলেপুলে তো কেউ রইল না। পড়বে কে?’
নিত্যনারায়ণের চার বছরের নাতনী পাপড়ি পয়সার লোভে দাদুর পাকা চুল বেছে দিচ্ছিল, সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এল। ‘কেন দাদু, সরকারকাকা রইলেন, দারোয়ান মন বাহাদুর রইল, ঝি রইল, মাস্টারমশাই তাদেরই তো পড়াতে পারবেন।’
নিত্যনারায়ণ হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন, ‘শুনলে? শুনলে মাস্টার? আমার দিদিমণির কথা শুনলে?’
কিন্তু নিত্যনারায়ণের হাসিতে সমস্যাটার সমাধান হয়নি। চৌধুরীরা চলে আসবার পর কুণ্ডুপাড়ায় হেডমাস্টারমশাই পাঁচ টাকার আরো দুটো টিউশনি পেয়েছিলেন, কিন্তু নেননি। সেকেণ্ড মাস্টারমশাইর মাস্টারি ছাড়াও মাতুল সম্পত্তি আছে, থার্ড মাস্টারমশাইর আছে মুদী দোকান, হেডপণ্ডিতের উপার্জনক্ষম দুই ছেলে, সেকেণ্ড পণ্ডিত শ্ৰীবিলাস চক্রবর্তীর যজমানি আর গুরুগিরি, কিন্তু হেডমাস্টারমশাইর সম্বল ছিলেন চৌধুরীরা। তিনি সব চেয়ে বেশি নিঃসম্বল হলেন। এদিকে পোষ্যের সংখ্যা অনেক।
গোড়ার দিকে তিনটি মেয়ে। তাদের দুটিকে অবশ্য পার করেছেন। একটি আছে এখনো ঘাড়ের ওপর। তারপর পর পর ছেলে হয়েছে তিনটি। বড়টির বয়স সবে সাত।
হেডমাস্টারমশাই বললেন, ‘দেখলে বিধাতার মার। এমন অসময়ে ছেলেপুলেগুলি হল—। নইলে গীতাকে কোন রকমে পার করতে পারলে আমার আর ভাবনা ছিল কি। ওই হতচ্ছাড়াগুলোর জন্যই তো—’
বুঝতে পারলাম ছেলেদের ভরণ-পোষণের ভাবনায় শেষ পর্যন্ত দেশ আর মাস্টারি দুই-ই তাঁকে ছেড়ে আসতে হয়েছে। মনে পড়ল এই হেডমাস্টারির ওপর কি মমতাই না ছিল মাস্টারমশাইর। টিচার হিসাবে সুখ্যাতি ছিল বলে রতনপুরে আর রাধাগঞ্জের দুইটি হাই স্কুলে মাস্টারমশাই চানস পেয়েছিলেন। কিন্তু যাননি। হাই স্কুলে তো আর হেডমাস্টার হয়ে যেতে পারবেন না। একবার আমাদের সাগরপুর এম ই স্কুলকেও হাই স্কুল করবার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু সব চেয়ে বেশি বাধা দিয়েছিলেন হেডমাস্টারমশাই নিজে। কমিটির মিটিং-এ বক্তৃতা দিতে উঠে বলেছিলেন, ‘এ প্রস্তাব নিতান্তই অযৌক্তিক। এ গাঁয়ে হাই স্কুল চলবে না, চলতে পারবে না। যদি-বা চলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবে। কিন্তু অখ্যাত একটি হাই স্কুলের চাইতে কীর্তিমান, খ্যাতিমান একটি এম ই স্কুলকে আমি বহুগুণে বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি।’
হেডমাস্টারের কথায় যুক্তি ছিল, দাঁড়াবার ভঙ্গিতে দৃঢ়তা ছিল ; কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর মনের কোণের গোপন দুর্বলতাটুকু টের পেতে কমিটির অন্যান্য সভ্যদের দেরি হয় নি। এই নিয়ে তাঁরা কেবল গা টেপাটিপিই করেন নি, আড়ালে আবডালে টিপ্পনীও কেটেছিলেন, এম ই স্কুল হাই স্কুল হলে আমাদের হেডমাস্টারের হেডটুকু যাবে যে? হেডমাস্টার সব ছাড়তে পারে, কিন্তু সাগরপুর এম ই স্কুলের ইন্দ্রত্ব কিছুতেই সে ছাড়তে রাজি নয়।
সেই ইন্দ্রপদও হেডমাস্টারমশাইকে ছেড়ে আসতে হল।
হাজরা রোডের মোড়ে ট্রাম থামতেই হেডমাস্টারমশাই উঠে দাঁড়ালেন, ‘এখানে নামতে হবে আমাকে। হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রীটে বাসা, চল না নিরুপম। গীতা, গীতার মা তোমাকে দেখলে সবাই খুশি হবে। ওরাই তো আমাকে ঠেলে পাঠাল তোমার কাছে। গীতা কার কাছ থেকে যেন তোমার ঠিকানা যোগাড় করেছিল।’
মনে পড়ল না গীতার চেহারা, যখন মাইনর ক্লাসে পড়তাম দু তিনটি ছোট ছোট ফ্রক পরা মেয়ে দেখেছিলাম হেডমাস্টারমশাইর। হয়ত তাদেরই কেউ হবে, কিংবা তাদেরও পরে জন্মেছে। কিন্তু গীতাকে মনে না পড়লেও তার মার কথা মনে পড়ল। লুকিয়ে লুকিয়ে তখন সবে নভেল পড়তে শুরু করেছি, নায়িকার রূপবর্ণনা পড়তে পড়তে, হেডমাস্টারমশাইর স্ত্রীর কথা মনে হত। অমন সুন্দরী বউ আমাদের গাঁয়ের চৌধুরীবাড়িতেও ছিল না।
একটু চুপ করে থেকে বললাম, ‘কাজ ছিল একটু সন্ধ্যার দিকে, আচ্ছা চলুন, দেখে যাই বাসা।’
কালীঘাটের টিনের বস্তি। তারই ভিতরে একখানা ঘর ভাড়া নিয়েছেন হেডমাস্টারমশাই। সামনে খোলা দাওয়ায় তোলা উনানে রান্না উঠেছে।
হেডমাস্টারমশাই বাইরে থেকে সাড়া দিয়ে ঢুকলেন, ‘আলোটা ধর গীতা, দেখ এসে নিরুপমকে নিয়ে এসেছি।’
ছোট্ট একটি হ্যারিকেন লণ্ঠন হাতে এগিয়ে এল আঠারো উনিশ বছরের একটি মেয়ে, পিছনে পিছনে কৌতূহলী গুটি দুই ছেলেও এসে দাঁড়াল, হলুদ মাখা হাতে মাথায় আঁচল টানতে টানতে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন একটু পুষ্টাঙ্গী একজন মহিলা। চিনতে পারলাম ইনিই মাস্টারমশাইর স্ত্রী।
মাস্টারমশাই বললেন, ‘নিরুপম নন্দী, আমার স্কুল থেকে থার্টিটুতে স্কলারশিপ পেয়েছিল। ফার্স্ট হয়েছিল ডিস্ট্রিক্টের মধ্যে। মনে আছে আমাদের বারান্দার তক্তপোশে রাত জেগে জেগে বৃত্তির পরীক্ষার পড়া পড়ত? নিরুপম নন্দী আর নুরুদ্দিন সিকদার। আচ্ছা নিরুপম, নুরুদ্দিন কোথায় আছে বলতে পার?’
মাথা নেড়ে বললাম, ‘না।’
তারপর নিচু হয়ে পায়ের ধুলো নিতে গেলাম মাস্টারমশাইর স্ত্রীর।
তিনি দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, ‘থাক থাক।’
একবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে তিরস্কারের সুরে বললেন, ‘তোমার নুরুদ্দিন ফুরুদ্দিন এখন রাখ তো!’
তারপর আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন, ‘আমাদের খুবই মনে আছে। তোমার বৃত্তি পাওয়া কীর্তিমান ছাত্রের দলই মাস্টারমশাইদের একেবারে ভুলে গেছে।’
মাস্টারমশাইর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম এই চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর বয়সে আগেকার সেই স্বাস্থ্য আর সৌন্দর্যের সামান্যই অবশিষ্ট আছে। মাস্টারমশাইর মত অবশ্য অতটা চেহারা খারাপ হয়নি, দাঁত পড়েনি, কি চুলও পাকেনি। কিন্তু কঠিন জীবনসংগ্রামের ছাপ প্রৌঢ়ত্বকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছে। তা সত্ত্বেও হাসিটুকু ভারি ভালো লাগল, ভারি মিষ্টি লাগল অভিযোগের ভঙ্গিটুকু।
বললাম, ‘ভুলব কেন, তবে নানারকম কাজকর্মের চাপে খোঁজখবর আর নিয়ে ওঠা হয় নি।’
‘ওরা কি দাঁড়িয়ে থাকবেন মা! বসতে বল না তক্তপোশে।’
মুখ ফিরিয়ে তাকালাম। এই বোধ হয় মাস্টারমশাইর মেয়ে গীতা। মায়ের মত অত সুন্দরী নয়। রঙটা একটু ময়লা। কিন্তু মায়ের চেয়ে স্বাস্থ্যবতী। দীর্ঘ দোহারা চেহারায় মুখের ডৌলে নাক চোখের সুন্দর গড়নে সোল সতের বছর আগেকার আর একটি তরুণী গৃহিণীর কথা মনে পড়ল। জ্যামিতির উপপাদ্য মুখস্থ করতে করতে হ্যারিকেনের তেল যখন ফুরিয়ে যেত, সলতে আসত নিবু নিবু হয়ে তখন মাস্টারমশাইর স্ত্রী উঠে এসে বোতল থেকে আমাদের হ্যারিকেনে তেল ঢালতে ঢালতে বলতেন, ‘আর পারিনে। বৃত্তি পেয়ে মাস্টারমশাইকে মহারাজ করবেন। কাল থেকে বোতলে করে বাড়ি থেকে তেল নিয়ে এস নিজেরা। আমি আর এক ফোঁটা তেলও দিতে পারব না।’
কিন্তু নিপুণ হাতে হ্যারিকেনের মুখটুকু আটকে দিয়ে আমাদের মুখের দিকে চেয়ে স্নিগ্ধস্বরে বলতেন, ‘নিরু, নুরুদ্দিন ; তোমাদের বোধ হয় খুব মশা লাগছে। মশারি টাঙিয়ে দিয়ে যাব? মশারির মধ্যে বসে পড়বে?’
নুরুদ্দিন জবাব দিত, ‘না মাসিমা। মশারির মধ্যে গেলেই শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। তার চেয়ে মশার কামড় বরং ভালো।’
মাসিমা হেসে উঠতেন, ‘প্রায়ই বিবেকের কামড়ের মত, তাই না? ওদিকে ঘরের মধ্যে মশারির ভিতরে আর একজনকে বিবেকে কামড়াচ্ছে। অতিষ্ঠ হয়ে তিনিও উঠে এলেন বলে।’
মাসিমা চলে গেলে আমি আর নুরুদ্দিন পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতাম। মাইনর ক্লাসে পড়লে কি হয়, গোঁফের রেখা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ঠোঁটে। গাঁয়ের ছেলে আন্দাজে আভাসে তখন থেকেই একটু আধটু সব বুঝতে শিখেছি।
তক্তপোশে পা ঝুলিয়ে বসে চা জলখাবার খেতে খেতে মাস্টারমশাইর আরও খানিকটা ইতিহাস শুনলাম মাসিমার মুখে। চৌধুরীরা ছেড়ে এলেও মাস্টারমশাই স্কুল ছাড়তে ইতস্তত করছিলেন, বলছিলেন, ‘স্কুলের কি দশা হবে।’
মাস্টারমশাইর স্ত্রী রাগ করে বলেছিলেন, ‘যে দশা হয় হোক। আমাদের দশাটা কি তোমার চোখে পড়ছে না? স্কুলের ভাবনা কি, তুমি চলে গেলে সেকেণ্ড মাস্টার হোক থার্ড মাস্টার হোক একজনকে ওরা হেডমাস্টার বানিয়ে নেবে। ভারি তো বিদ্যা লাগে তোমার ওই এম ই স্কুলের হেডমাস্টারিতে।’
মাস্টারমশাই তবুও বলেছিলেন, ‘কিন্তু—’
‘কিন্তু টিন্তু বুঝি না, তুমি থাক তোমার হেডমাস্টারি নিয়ে, আমি চললাম। ছেলেপুলে নিয়ে না খেয়ে মরতে পারব না।’
মাসিমার দুই দাদা থাকেন ভবানীপুরে। একজন উকিল, আর একজন পুলিস ইনস্পেক্টর, তাঁদের সঙ্গে চিঠি লেখালেখি করলেন মাসিমা, তাঁরা বললেন, ‘বেশ চলে এস, একটা গতি হবেই।’
কিন্তু থাকবার মত ঘর নেই বাড়িতে। সপ্তাহ দুই থাকবার পর নানারকম অসুবিধা হতে লাগল। দাদারা বললেন, ‘অন্য একটা ঘরটর কোথাও খুঁজে নে। আমরা যা পারি কিছু কিছু—’
এদিকে ঘরও মেলে না শহরে। অনেক খোঁজাখুজির পরে শেষে এই হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রীটের গলিতে মিলেছে বাসা। এই তো ঘর— আলো নেই, হাওয়া নেই, জল আনতে হয় রাস্তার কল থেকে। তবু মাসে মাসে এরই ভাড়া গুনতে হয় কুড়ি টাকা। ছ’ মাসের ভাড়া আগাম দিতে হয়েছে বাড়িওয়ালাকে। মাঝখানে পাড়ার একটা রেশনের দোকানে খাতা লেখার চাকরি পেয়েছিলেন মাস্টারমশাই কিন্তু দু’ মাস যেতে না যেতে কি সব গণ্ডগোলে গভর্নমেন্ট সে দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। এখন মাসখানেক ধরে একেবারে বেকার।
মাসিমা বললেন, ‘তোমরা একটা ব্যবস্থা ট্যবস্থা এবার করে দাও নিরুপম।’
বললাম, ‘আচ্ছা দেখি। আমাদের টালিগঞ্জ হাই স্কুলের সেক্রেটারির সঙ্গে মোটামুটি জানাশোনা আছে। তাঁকে বলে-টলে সেই স্কুলে যদি মাস্টারমশাইকে—’
মাস্টারমশাই প্রতিবাদ করে উঠলেন, ‘না নিরুপম, আর মাস্টারি নয়। না খেয়ে মরব, তবু মাস্টারি আর জীবনে করব না। কেরানিগিরি থেকে কুলিগিরি যা বল করতে রাজি আছি। কিন্তু মাস্টারি আর নয়। সাতাশ বছর ধরে মাস্টারি করার সুখ তো দেখলাম। যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়।’
মাসিমা বললেন, ‘উনি মাস্টারি আর করতে চাইছেন না। অন্য কোন কাজকর্ম—’
আমি কিছু বলবার আগে গীতাই তার মাকে মৃদু তিরস্কারের স্বরে বলল, ‘কি যে বল মা, নতুন অফিসে ঢুকবার মত বয়স কি স্বাস্থ্য আছে নাকি বাবার!’
মাস্টারমশাই ধমক দিয়ে বললেন, ‘না নেই, ওকে বলেছে নেই। কি হয়েছে আমার স্বাস্থ্যের। দেখ তো নিরুপম, ছেলেবেলাও তো দেখেছ, এখনো দেখ।’
বলে মাস্টারমশাই পাঞ্জাবির আস্তিন গুটিয়ে তাঁর বাইসেপ দেখালেন আমাকে, ‘ইট ইজ অ্যাজ স্ট্রং অ্যাজ এভার। দেখ টিপে দেখ। তোমার প্রায় ডবল বয়সী হব তো আমি। কিন্তু বাজি রেখে বলতে পারি এখনো তুমি যতটা হাঁটতে পারবে, দৌড়তে পারবে তার চেয়ে বেশি ছাড়া কম পারব না আমি। কলেজ জিমন্যাসিয়ামে একদিনও কেউ আমাকে গরহাজির হতে দেখেনি। বয়স হয়েছে বলে শরীরের সেই ফরম-টরম একেবারেই কি ধুয়ে মুছে গেছে? স্পোর্টস-এও কারো চেয়ে কম যেতাম না। ফুটবলে অফেনসের চেয়ে ডিফেনসই আমাকে অবশ্য বেশি খেলতে হত। আমি যেদিন গোলে না দাঁড়াতাম—’
এবার স্ত্রীর ধমক খেলেন মাস্টারমশাই। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আঃ থাম, ওসব কে শুনতে চাইছে তোমার কাছে।’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘মাসেলটা একটু টিপে দেখই না নিরুপম।’
মাসেলের চাইতে মাস্টারমশাইর বাহুর ওপর দিয়ে যে রগগুলো জেগে উঠেছে তাই আমার বেশি চোখে পড়ল। তবু বললাম, না না না, শরীর তো বয়সের তুলনায় সত্যিই বেশ ভালো আছে আপনার। তা ছাড়া বয়সটাই বা কি। ওদের দেশে তো শুনি ষাট বছরে জীবন কেবল আরম্ভ হয়। আপনার কত হবে? বছর পঞ্চান্ন—’
মাস্টারমশাইর স্ত্রী বললেন, ‘না না না! এই বৈশাখে সবে একান্নতে পড়েছেন।’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘এক্সাক্টলি, জাস্ট ফিফ্টিওয়ান। কিন্তু দৌড়ে, সাঁতারে যে-কোন একুশ বছরের ছেলের সঙ্গে যদি তুমি আমাকে পাল্লা দিতে বল—’
মাস্টারমশাইর স্ত্রী আবার বিরক্ত হয়ে উঠলেন, ‘কি যা তা বলছ। অফিসের চাকরিতে দৌড়ঝাঁপের জন্য কে ডাকতে যাচ্ছে তোমাকে!’
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘তবে ওঁর মত ইংরেজি লিখতে আমি কাউকে আর দেখিনি নিরুপম। আমার বড় দাদা এম এ বি এল হলে কি হবে, ইংরেজিতে ওঁর সঙ্গে পেরে ওঠে না। লেখার বাঁধুনি তো দূরের কথা, হাতের লেখাটাই যেন কেমন কাঁচা কাঁচা, আমাদের মেয়েদের মত। কিন্তু ওঁর লেখা সম্বন্ধে সে কথা কেউ বলতে পারবে না। আর লেখেনও খুব তাড়াতাড়ি। পাড়ার লোকের পক্ষ থেকে সেদিন ডাস্টবিন দেওয়া সম্বন্ধে কর্পোরেশনে একটা দরখাস্ত করেছিলেন। টাইপ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাতের লেখা কাগজটা আছে এখানে। কাগজখানা আন দেখি গীতা, দেখা তোর নিরুপমদাকে।’
গীতা কাগজখানা খুঁজতে লাগল।
মাস্টারমশাই তাঁর স্ত্রীর দিকে চেয়ে একটু হাসলেন, ‘আমার ছাত্রের কাছে আমার বিদ্যার সার্টিফিকেট আর দিতে হবে না তোমাকে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত লেখার ব্যাপারে নিরুপম যেমন ছিল স্লো, তেমনি ওর হাতের লেখা ছিল কদর্য। ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম ওকে নিয়ে। একটা বছর স্কুলের স্কলারশিপটা বুঝি বাদই যায়। অথচ অঙ্ক, বাঙলা, ইতিহাস, ভূগোল সব বিষয়েই ভালো। কেবল ইংরাজি। ভাবলাম দু’বছরে একটা বিষয়ে কি আর টেনে তুলতে পারব না? থার্ডমাস্টার, পণ্ডিতমশাই সব হাল ছেড়ে দিলেন, কিন্তু আমি অত সহজে ছাড়বার পাত্র নই। হাতের প্রত্যেকটি অক্ষর ধরে ধরে শুধরে দিয়েছি, বেত মেরে মেরে মুখস্থ করিয়েছি গ্রামারের প্রত্যেক রুল।’
মাস্টারমশাই আমার দিকে তাকিয়ে পরম আত্মপ্রসাদে ফের হাসলেন, ‘গ্রামারে আর বোধ হয় তোমার ভুল হয় না, না নিরুপম?’
ভাষার গ্রামারের কথা জানি না, জীবনের গ্রামারে এখনো যথেষ্ট ভুলভ্রান্তি হয়। কিন্তু সেকথা মাস্টারমশাইর কাছে স্বীকার না করে নিজের বৈয়াকরণিক বিশুদ্ধিতার কথাই ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম।
ফেরার সময় সরু গলির মোড় পর্যন্ত দু’জনেই এলেন পিছনে পিছনে। মাস্টারমশাইর স্ত্রীর হাতে হ্যারিকেন লণ্ঠন। বিদায়ের আগে তিনি আর একবার বললেন, ‘তোমার ভরসাতেই কিন্তু রইলাম নিরুপম।’
বললাম, ‘আচ্ছা, সাধ্যমত চেষ্টা করব।’
‘চেষ্টা নয়, কিছু একটা তোমাকে করে দিতেই হবে। সবই তো শুনলে।’
বললাম, ‘আচ্ছা।’
প্রথমে মার্চেন্ট অফিসের দু’চারজন বন্ধুকে বললাম মাস্টারমশাইর কথা। কেউ কেউ মুচকি হাসল ; কেউ বা সশব্দে। মার্টিনের সতীশ বলল, ‘এতই যদি গুরুভক্তি নিজের ব্যাঙ্কেই নিয়ে নাও না কেন।’
ধরলাম জেনারেল ম্যানেজার মিঃ গুপ্তকে। লোকজন নেওয়ার ভার তাঁরই হাতে।
তিনিও প্রথমে হাসলেন, ‘বলছ কি নন্দী! একান্ন বছর বয়সে নতুন চাকরি। তার পর সাতাশ বছরের মাস্টারি। শুনি ওই কাজ বার বছর করলেই নাকি—।ব্যাঙ্কের এসব ফিগার ওয়ার্ক-টোয়ার্ক তিনি কি পারবেন? তা ছাড়া খাটুনিও তো কম নয়।’
বললাম, ‘তিনি বলছেন, মাস্টারি ছাড়া তিনি সব পারবেন, সব করবেন। মাস্টারিতে নাকি তাঁর বিতৃষ্ণা এসে গেছে। যাই হোক আমাদের ব্যাঙ্কে ওঁকে একটা চান্স আপনার দিতেই হবে মিস্টার গুপ্ত।’
‘আচ্ছা, তুমি যখন বলছ অত করে দেখা যাক।’
ইন্টারভিউর জন্য আর চিঠি পাঠান হল না। মুখেই খবর দিয়ে এলাম। সবাই খুব খুশি।
গীতা বলল, ‘না, নিরুপমদা, চা না খেয়ে যেতে পারবেন না।’
মাস্টারমশাইর স্ত্রী বললেন, ‘দেখ দেখি বৈয়মটায় সুজি আছে খানিকটা। আর ওই টিনের কৌটোর মধ্যে চিনি আছে।’
বললাম, ‘আবার ওসব কেন? শুধু চা হলেই তো হত।’
‘ওই চা-ই, চা ছাড়া আর কি-ই বা তোমার সামনে ধরে দেওয়ার শক্তি আছে।’
চায়ের সঙ্গে একটু হালুয়াও প্লেটে করে সামনে এনে রেখে দিল গীতা।
মৃদু হেসে বললাম, ‘মিষ্টিমুখটা চাকরি হওয়ার পরে করালেই তো ভালো হত।
গীতা কোন জবাব দিল না, তার মা বললেন, ‘তুমি যখন রয়েছ, ও চাকরি হওয়ার মধ্যেই। তা ছাড়া চাকরির জন্য কি! গরিব মাস্টারমশাইর বাসায় অমনিতেই না হয় একটু চা আর খাবার খেলে। তাতে জাত যাবে না!’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘মাস্টারি ছেড়ে দিলাম, তবু মাস্টার মাস্টার করা ছাড়লে না তোমরা।’
মাস্টারমশাইর স্ত্রীও এবার হাসলেন একটু, ‘আহা ছেড়ে দিলেও নিরুপমের তো মাস্টারমশাই তুমি।’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘এখনো আছি, কিন্তু দু’ দিন বাদে চাকরিটা যদি হয়েই যায় ওদের ওখানে, তখন আর মাস্টার নয়, কলিগ, সাবঅরডিনেট।’
চাকরি হলও। মিঃ গুপ্ত খুবই ভদ্রতা করলেন। ইন্টারভিউতে নামধাম ছাড়া বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কেবল বলেছিলেন, ‘এতদিনের মাস্টারি ছাড়লেন কেন, তা ছাড়া ব্যাঙ্কের কাজকর্ম কি আপনার ভালো লাগবে!’
মাস্টারমশাই জবাব দিয়েছিলেন, ‘মাস্টারির মনোটনির তুলনায় সব কাজই বোধ হয় ভালো।’
মিঃ গুপ্ত মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘বেশ দেখুন, কেমন লাগে।’
বিশেষভাবে ধরে পড়ায় মাইনের বেলায়ও বেশ একটু খাতির করলেন মিঃ গুপ্ত, আমাদের ব্যাঙ্কে সাধারণত আণ্ডার গ্র্যাজুয়েটদের স্টার্টিং ষাটে। জেনারেল ম্যানেজারকে বললাম, ‘কিন্তু ওঁর নিজের বয়সই তো প্রায় ষাট হতে চলল, এই বয়সে ষাট টাকা দিয়ে উনি করবেন কি, তা ছাড়া অতগুলি পোষ্য।’
ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে খানিকক্ষণ কি পরামর্শ করে আরও খানিকটা দাক্ষিণ্য দেখালেন জেনারেল ম্যানেজার। স্পেশাল কেস হিসাবে গণ্য করে ষাট থেকে উঠলেন পঁচাশিতে। বললেন, ‘দেখি কাজকর্ম কি করেন না করেন তারপর দেখা যাবে।’
সপরিবারে মাস্টারমশাই কৃতজ্ঞতা জানালেন। এম ই স্কুলে সারা জীবন থাকলেও এত টাকা পেতেন না মাস্টারমশাই।
চৌধুরীদের টিউশনির টাকা ধরেও সংখ্যাটা অতখানি উঁচুতে পৌঁছত কি না সন্দেহ। খবর পেয়েই কালীবাড়িতে ডালা পাঠিয়েছিলেন মাস্টারমশাইর স্ত্রী। গীতার চায়ের সঙ্গে ফুলের পাপড়ি সুদ্ধ প্রসাদের অংশটুকুও পেলাম।
গীতা মৃদুস্বরে বলল, ‘মা ভারি খুশি হয়েছেন।’
বললাম, ‘আর তুমি?’
গীতা বলল, ‘আমাকে একটা চাকরি জুটিয়ে দিন, আমিও হব।’
হেসে বললাম, ‘খুশি হবার জন্য জুটিয়ে অবশ্য তোমাকে কিছু একটা দিতে হবে, কিন্তু সেটা চাকরি কি না তাই ভাবছি।’
ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে গীতা একটু আরক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট সরল গদ্যে বলল, ‘না নিরুদা, আজকালকার মেয়েদের আর কিছু জুটিয়ে দিয়ে খুশি করবার দরকার হয় না। তার চাইতে একটা কাজকর্মের সন্ধান দিলেই তারা সব চেয়ে বেশি খুশি হয়।’
প্রথমে পরিমলবাবুর ক্লিয়ারিং ডিপার্টমেন্টেই দিলাম মাস্টারমশাইকে, তিনি তোক চেয়েছিলেন। অন্যান্য ডিপার্টমেন্টেও অবশ্য লোকের দরকার। তবু পরিমলবাবুকেই সবচেয়ে আগে খাতির করলাম।
পরিমলবাবু কিন্তু অ্যাসিস্ট্যান্ট পেয়ে খুব খুশি হলেন না। বললেন, ‘শেষ পর্যন্ত একজন চুলপাকা বুড়োকে পাঠালেন আমার ডিপার্টমেন্টে?’
পরিমলবাবুর নিজের বয়সও চল্লিশ বিয়াল্লিশের কম হবে না, ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে আছে। মাঝে মাঝে ছেলের সন্ধান করেন আমার কাছে।
হেসে বললাম, “অত বয়স বিচার করছেন কেন পরিমলবাবু? জামাই তো আর নিচ্ছেন না, অ্যাসিস্ট্যান্টই নিচ্ছেন। বয়স দিয়ে কি হবে, আপনার কাজ চলে গেলেই হল। গোড়াতে একটু দেখিয়ে শুনিয়ে দেবেন, তাহলেই হবে।’
ছুটির পরে ডালহৌসির মোড়ে মাস্টারমশাইর সঙ্গে দেখা। দেখলাম এই বয়সে প্রায় তরুণ জামাইর মতই সেজেছেন মাস্টারমশাই। যখন স্কুলে পড়েছি, তখন এত পারিপাট্য দেখিনি। ইস্ত্রি করা সাদা পাঞ্জাবিতে কালো বোতাম লাগানো। ঝুলন্ত কোঁচাটা নিপুণ হাতে কোচানো, পায়ের পামশুটা পুরনো হলেও সদ্য পালিশে চক্চক্ করছে। গোঁফদাড়ি নিখুঁতভাবে কামানো। চুলটাও বোধ হয় আজই ছেঁটেছেন। সেলুনের ছটি বেশ বোঝা যায়। স্কুলে যখন ছিলেন, তখন জামা থাকত বোতাম থাকত না, হয়তো দু’ পাটি চটির দু’খানা পায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়তেন।
বললাম, ‘অফিস কেমন লাগছে মাস্টারমশাই?
মাস্টারমশাই একটু হাসলেন, বললেন, ‘ভালোই তো।’
ট্রামের প্রথম বেঞ্চে পাশাপাশি বসে হঠাৎ বলে ফেললাম, ‘একদিনেই মাস্টারমশাই যেন আমূল বদলে গেছেন। স্কুলের অন্যান্য মাস্টারমশাইরা আপনাকে দেখলে এখন আর চিনতে পারবে না।’
মাস্টারমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কেন?’
বললাম, ‘তখনকার পোশাক-পরিচ্ছদের সঙ্গে একেবারেই তো কোন মিল নেই কি না। এবার দাঁত দুটো বাঁধিয়ে নিলেই’—মনে হল ঠিক আগেকার দিনের মত ক্রুদ্ধ চোখে মাস্টারমশাই আমার দিকে তাকালেন।
একটু লজ্জিত হলাম। এতখানি প্রগল্ভতা হঠাৎ না দেখালেও পারতাম। তখনকার দিনে হেডমাস্টারমশাইর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতাম না, আর এখন দিব্যি ঠাট্টা-তামাসা করছি। এতখানি আধুনিকতা মাস্টারমশাই সহ্য করতে পারবেন কেন।
ক্ষমা চাইতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু দেখলাম মাস্টারমশাইর তাকাবার ভঙ্গিটা এরই মধ্যে বেশ বদলে গেছে।
মনে হল আমার দিকে চেয়ে মাস্টারমশাই একটু হাসলেন, বললেন, ‘ও আমার সাজসজ্জার কথা বলছ। তুমি বুঝি ভেবেছ এসব আমি নিজের গরজে নিজের হাতে করেছি?’
বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘তবে? ও গীতা বুঝি?’
মাস্টারমশাই মাথা নেড়ে রহস্যগভীর স্বরে বললেন, ‘তাও নয়।’
বললাম, ‘তবে?’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘লাবণ্য, আই মিন গীতার মা,’ মাস্টারমশাইর স্ত্রীর নামটা এবার মনে পড়ে গেল। তখনকার দিনে লাবণ্যলেখা সরকারের নামে প্রায়ই চিঠি যেত ডাকে। গাঁয়ের পোস্ট-অফিসে পিওন ছিল না। পোস্টমাস্টারের হাত থেকে আমরাই চিঠি নিয়ে তাঁকে পৌঁছে দিতাম। ভারি সুন্দর লেগেছিল নামটি। লাবণ্যলেখা, মনে হয়েছিল তাঁর স্বভাবের সঙ্গে, চেহারার সঙ্গে নামটি চমৎকার মানিয়ে গেছে। এছাড়া তাঁর অন্য কোন নাম যেন কল্পনাই করা যেত না।
এতদিন বাদে স্ত্রীর নাম আমার সামনে উচ্চারণ করে ফেলে মাস্টারমশাই নিজেও যেন ভারি লজ্জিত হয়ে পড়লেন। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকালেন বাইরের দিকে, গড়ের মাঠের ওপারে গঙ্গা, গঙ্গার ওপারে লাল হয়ে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। লজ্জায় কি আরক্ত দেখাচ্ছে মাস্টারমশাইর মুখ, না কি এ রঙ সূর্যাস্তের। একটু বাদে ফের মুখ ফেরালেন, মাস্টারমশাই বললেন, ‘এসব গীতার মার কাণ্ড! প্রথমে খুব বাধা দিয়েছিলাম, বলেছিলাম এসব কি, লোকে হাসবে যে। সে জোর করে বলল, না হাসবে না। আর হাসে যদি হাসলই বা। এতদিন নিজের হাতে বেশভূষা করে তোক হাসিয়েছ, আজ না হয় আমার জন্যই হাসালে।’
আমি প্রতিবাদ করে বললাম, ‘না না হাসবার কি হয়েছে মাস্টারমশাই।’
মাস্টারমশাই আমার কথা যেন শুনতে পাননি, নিজের মনেই বললেন, ‘ভাবলাম ওর কোন সাধ আহ্লাদ তো মেটেনি, আজ যদি এভাবে একটু মেটাতে চায় মেটাক।’
মনে হল আমার পাশে বসে আমাদের ছেলেবেলার বেত হাতে সেই কড়া হেডমাস্টার কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকার আর কথা বলছেন না, অন্নচিন্তায় কাতর পঞ্চাশ বছরের কোন প্রৌঢ় কেরানিও নয়, ইনি সম্পূর্ণ আর একজন। স্ত্রীর অপূর্ণ সাধ আহ্লাদের কথা জীবন-সায়াহ্নে যাঁর মনে পড়ে গেছে।
কথায় কথায় এম ই স্কুলের হেডমাস্টারের জীবনের আর এক গোপন অধ্যায় আমার কাছে উদঘাটিত হল।
লাবণ্যলেখা তখন গীতা, গোবিন্দের মা নন, এমন কি আমাদের শ্রদ্ধেয় হেডমাস্টারমশাইর স্ত্রীও নন; সিটি কলেজের তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র কৃষ্ণপ্রসন্নের শখের ছাত্রী তখন লাবণ্য।
কৃষ্ণপ্রসন্ন তখন কলেজ হস্টেলে থাকে। স্ত্রী-স্বাধীনতার পক্ষে ডিবেটিং ক্লাবে জোর বিতর্ক করে। জিমনাশিয়ামে বার বার বারবেলের খেলা দেখায়। ফুটবলে তেমন আসক্তি না থাকলেও টিমের ক্যাপ্টেন জোর করে তার হাতে তুলে দেয় গোলরক্ষার দায়িত্ব, এসব ছাড়া অবসর বিনোদনের আরও একটু জায়গা আছে কৃষ্ণপ্রসন্নের, শ্যামবাজারের নলিনী সরকার স্ট্রীটের একটি দ্বিতল বাড়ির দক্ষিণ খোলা একখানা ঘরে। বাড়িটি একেবারে নিঃসম্পর্কিত নয়। জেঠতুতো বোনের শ্বশুরবাড়ি। দিদির শ্বশুরের সেজো মেয়ে লাবণ্য। চৌদ্দ উতরে পনেরয় পড়েছে। পড়াশুনোয় ভারি আগ্রহ। কিন্তু দিদির শ্বশুরমশাই এসব বিষয়ে ভারি রক্ষণশীল। মেয়েকে ইংরেজি স্কুলের দু তিন ক্লাস পড়িয়েই স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। এনে তুলে দিয়েছেন পাকা দাড়িওয়ালা এক বুড়ো মাস্টারের হাতে। কৃষ্ণপ্রসন্নের পরম ভাগ্য দিদির শ্বশুরবাড়িতে যাতায়াত শুরু করার দিন পনের যেতে না যেতেই সেই বুড়ো মাস্টারের শক্ত অসুখ হল। দিদির শ্বশুরের মত বর আর দেবরেরা সেকেলে নয়। তাঁরা বললেন, ‘লাবুর পরীক্ষা এসেছে, কৃষ্ণপ্রসন্ন, তুমিই একটু ওকে দেখিয়ে শুনিয়ে দাও না।’
কৃষ্ণপ্রসন্ন জিভ কেটে বলেন, ‘ওরে বাবা, থিয়েটার-বাড়ি থেকে নারদের এক গোছ পাকা দাড়ি তাহলে ধার করে আনতে হয়।’
কিন্তু দাড়ি ধার করবার দরকার হল না। দিদি আর দিদির শাশুড়ির সার্টিফিকেটে কৃষ্ণপ্রসন্নই তরুণ হয়েও বসতে শুরু করল সেই বুড়ো মাস্টারের পরিত্যক্ত চেয়ারে। প্রথমে কেউ কোন কথা বলে না, কেউ কারো দিকে তাকায় না, বইয়ের দিকে দু’জনেই চোখ নিচু করে থাকে, কিন্তু চোখের দৃষ্টি যে ছাপার অক্ষরে আবদ্ধ থাকে না। তারপর মাস তিনেক বাদে ফের যখন সেই বুড়ো মাস্টারমশাইর আসবার কথা হল লাবণ্য বলল, ‘আমি আর তাঁর কাছে পড়ব না।’
কৃষ্ণপ্রসন্ন বলেন, ‘তবে কার কাছে পড়বে?’
‘এখন যার কাছে পড়ছি।’
‘বারে, আমি কি সারা জীবন মাস্টারি করব নাকি?’
লাবণ্য হেসে বলল, ‘করবেই তো, মাস্টারির মত এমন মহৎ কাজ আর নেই।’
কিন্তু দু’বছর বাদে গাঁয়ের এম ই স্কুলে হেডমাস্টারি নেওয়ার সময় এই লাবণ্যই সবচেয়ে বেঁকে দাঁড়িয়েছিল। জেঠতুতো বোনের মধ্যস্থতায় লাবণ্য তখন শুধু আর কৃষ্ণপ্রসন্নের ছাত্রীই নয়, সাগরপুর সরকারবাড়ির বউ হয়ে ঘরে এসেছে। আর বি এ পরীক্ষা দিতে বসে এক জ্ঞাতি ভাইয়ের মুখে স্ত্রীর ডবল নিউমোনিয়ার খবর পেয়ে পরীক্ষার হল ছেড়ে একেবারে দেশে চলে এসেছে কৃষ্ণপ্রসন্ন। বাবা বললেন, ‘ইচ্ছা করেই আমরা খবর দিইনি। পরীক্ষার চেয়ে তোর বউ বড় হল?’
কৃষ্ণপ্রসন্ন বলল, ‘স্ত্রীর জীবনের চাইতে আমার পরীক্ষা বড় নয়।’
রোগটা ঠিক ডবল নিউমোনিয়া ছিল না। অল্প দিনেই লাবণ্য উঠে বসল এবং উঠে বসেই বলল, ‘তোমার পরীক্ষার কি হল?’
কৃষ্ণপ্রসন্ন জানাল পরীক্ষা সে দেয়নি।
লাবণ্য বলল, ‘ছি ছি ছি, আমার জন্য তুমি পরীক্ষা বন্ধ করলে? আমি মুখ দেখাব কেমন করে? তুমি এক্ষুনি ফের কলকাতায় চলে যাও।’
কৃষ্ণপ্রসন্ন অতদূর গেল না। তখন দক্ষিণপাড়ার চৌধুরীদের উদ্যোগে নতুন এম ই স্কুল হচ্ছে গাঁয়ে। নিত্যনারায়ণ তাকে ধরে বসলেন, ‘তোমার কলেজ খোলার তো ঢের দেরি। তার আগে আমাদের স্কুলটা একটু ঠিকঠাক করে দিয়ে যাও।’ তারপর কতবার কলেজ খুলল, বন্ধ হল। কিন্তু কৃষ্ণপ্রসন্নের আর যাওয়া হল না। লাবণ্য বলেছিল, ‘তুমি কি সত্যিই মাস্টারি নিলে?’ কৃষ্ণপ্রসন্ন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটু হেসেছিল, ‘নিলামই বা। মাস্টারিই তো সব চেয়ে মহৎ বৃত্তি।’
বাড়ির আর গাঁয়ের সব লোক জানল বউকে এক মুহূর্ত ছেড়ে থাকতে পারবে না বলেই কৃষ্ণপ্রসন্ন বিদেশে গেল না। এমন স্ত্রৈণ পুরুষ আর দুটি নেই। লাবণ্য জানল অবশ্য অন্য কথা। তারপর— তার একটানা সাতাশ বছর।
হাজরা রোডের মোড়ে নেমে যাওয়ার আগে ফের সাতাশ বছরের পরের একটু খবর দিয়ে গেলেন মাস্টারমশাই, হেসে বললেন, ‘ছেলেমেয়েদের চোখের আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে গীতার মা চুপি চুপি আমাকে কি জিজ্ঞেস করেছিল জানো নিরুপম?’
বললাম, ‘কি জিজ্ঞাসা করেছিলেন?
মাস্টারমশাই একটু হাসলেন, ‘আচ্ছা, নিরুপমের মত সবাই কি স্যুট পরে আসে? তার মানে সবাই যদি স্যুটধারী হয়, তাহলে আমারও পরিত্রাণ নেই। তাহলে তাঁর বড় বউদির কাছ থেকে তাঁর দাদার পুরনো একটা স্যুট ধার করে আনবেন আর তাঁর বউদিদের মতই নিজের হাতে টাই বাঁধবেন আমার গলায়।’
হেসে বললাম, ‘সামনের মাসে আপনাকে একটা স্যুট আমি করিয়ে দেব মাস্টারমশাই।’
‘পাগল নাকি? এই ধুতি-পাঞ্জাবির চোটেই অস্থির। দু’বার করে নিজের হাতে কেচেছে, পাশের বাসার ইস্ত্রিটা চেয়ে এনে ইস্ত্রি করেছে, কেবল কি তাই? কোঁচাটা পর্যন্ত নিজের পছন্দমত কুঁচিয়ে দেওয়া চাই। বলে কি জানো! এ তো তোমার গাঁয়ের স্কুল নয়, শহরের অফিস।’ হেডমাস্টারমশাই ফোকলা দাঁতে একটু হাসলেন। তা সত্ত্বেও দাঁতের সেই বিশ্রী ফাঁক আমার চোখে তেমন যেন আর বিসদৃশ লাগল না। কারণ সাতাশ বছর আগেকার সেই লাবণ্য আর কৃষ্ণপ্রসন্ন আমার মনকে তখনো আচ্ছন্ন করে রয়েছে।
কিন্তু মাস্টারমশাই সম্বন্ধে এই রোমান্টিক আচ্ছন্নতা বেশি দিন বজায় রইল না। সপ্তাহখানেক যেতে না যেতেই ঝড়ের বেগে ক্লিয়ারিং-এর পরিমলবাবু আমার চেম্বারে এসে ঢুকলেন।
বললাম, ‘ব্যাপার কি পরিমলবাবু?’
‘আচ্ছা নিরুপমবাবু, ক্লিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ আমি না কৃষ্ণপ্রসন্নবাবু?’
বললাম, ‘আপনি, এ তো সবাই জানে।’
‘কিন্তু কৃষ্ণপ্রসন্নবাবু জানেন না। জানলেও মানেন না।’ তারপর অভিযোগের পূর্ণ বিবরণ দিলেন
পরিমলবাবু। অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়েও কথায় কথায় তাঁর সমালোচনা করেন মাস্টারমশাই। ছোকরা কর্মচারিদের সামনে তাঁর ইংরেজির ভুল ধরেন। কথাবার্তার খুঁত ধরেন। মুহূর্তে মুহূর্তে কাজের ব্যাঘাত হয়। পরিমলবাবু বললেন, ‘লোকের আমার আর দরকার নেই মশাই। একজন লোক শর্ট নিয়ে আমি আজীবন কাজ করতে রাজি আছি। রাত দশটা পর্যন্ত থাকতে হয় তাও স্বীকার। কিন্তু এই বুড়োকে আপনি সরিয়ে নিন। দুষ্ট গরুর চেয়ে আমার শূন্য গোয়াল ভালো।’
পরিমলবাবুকে যেতে বলে মাস্টারমশাইকে ডেকে পাঠালাম। তাঁর মুখও থমথম করছে।
বললাম, ‘ব্যাপার কি মাস্টারমশাই? পরিমলবাবুর সঙ্গে নাকি আপনি ঝগড়া করেছেন।’
মাস্টারমশাই উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘ঝগড়া? ওকে যে বেতিয়ে পিঠ লাল করে দিইনি আমি সেই ওর—’
বাধা দিয়ে বললাম, ‘থামুন থামুন। করেছেন কি তিনি?’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘প্রথম তো এক লাইনও ইংরেজি লিখতে পারবে না। একটা সেনটেনসে দুটো বানান ভুল, তিনটে গ্র্যাম্যাটিক্যাল মিসটেক্। শুধরে দিলেও শুনবে না, কেবল উড়ো তর্ক।’
বললাম, ‘ব্যাঙ্কে ভুল ইংরেজি লিখলে ক্ষতি নেই মাস্টারমশাই। ফিগারে ভুল না হলেই হল।’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘বেশ, লিখছে লিখুক ভুল ইংরেজি। তা না হয় নাই ধরলাম। কিন্তু ছেলের বয়সী সব ছোকরা। তাদের সঙ্গে প্রকাশ্য অফিসের মধ্যে এসব কি ইয়ার্কি! ভদ্রঘরের মেয়েদের কথা নিয়ে, সিনেমা স্টারদের নিয়ে এমনকি ব্রথেলের—। ছি ছি ছি। এসব তুমি সহ্য করতে বল নিরুপম?’
আদিরসে পরিমলবাবুর একটু বেশি আসক্তি আছে। আট ন’ঘণ্টা কলম পিষে পিষে অন্তরাত্মা যখন শুকিয়ে আসে, ঝিমিয়ে আসে, অল্পবয়সী কেরানির দল তখন স্ত্রী-ভূমিকাবর্জিত ব্যাঙ্কে নানা ধরনের মেয়েদের প্রসঙ্গ আর যৌনজীবনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে তিনি নিজের এবং সহকর্মীদের কলম মন দুই-ই রসাপ্লুত করেন। এ খবরটা আমি জানি। কিন্তু পরিমলবাবু কাজকর্মে ভারি দক্ষ লোক। ক্লিয়ারিং মেলাতে ওঁর মত যোগ্যতা আর কারো নেই ব্যাঙ্কে।
মাস্টারমশাইকে বললাম, ‘এখানে সবাই কলিগ। অত বাদ-বিচার—’
মাস্টারমশাই তেমনি তীব্র কণ্ঠে বললেন, ‘কলিগ, তাই বলে স্থানকালপাত্র ভেদ নেই? অশ্লীল অশ্রাব্য আলোচনায় ছেলের বয়সী ছাত্রের বয়সী সব ছোকরাদের মাথা চিবিয়ে খেতে হবে? ফের যদি পরিমলবাবুর মুখে আমি এইসব কুৎসিত কথা শুনি, আমি থাপ্পড় মেরে গাল ভেঙে দেব। হাতাহাতি হয়ে যাবে আমার সঙ্গে।’
গম্ভীরভাবে বললাম, ‘আচ্ছা যান আপনি। আমি এর ব্যবস্থা করব।’
সেইদিনই মাস্টারমশাইকে স্থানান্তরিত করলাম বিল ডিপার্টমেন্টে। পরিমলবাবু থেকে তাঁর অল্পবয়সী সহকারীরা সবাই খুশি।
‘বাঁচিয়েছেন নিরুপমবাবু। আর এক সপ্তাহ মাস্টারমশাইর সঙ্গে থাকলে আমরা পাগল হয়ে যেতাম। লোক আপনি পারেন দেবেন, না পারেন না দেবেন, কিন্তু মাস্টারটাস্টার আর পাঠাবেন না।’
কিন্তু দিন পাঁচ ছয়ও কাটল না। বিল ডিপার্টমেন্টেও ফের গোলমাল উঠল। বিলের ইনচার্জ ননীবাবু এসে গম্ভীর মুখে নালিশ করলেন, ‘মাস্টারমশাইকে সরিয়ে নিন। ওঁর দ্বারা আমার কাজ চলবে না।’
মাস্টারমশাই নামটা এরই মধ্যে সমস্ত ব্যাঙ্কে ছড়িয়ে পড়েছে।
বললাম, ‘কি হয়েছে ননীবাবু!’
‘আরে মশাই, নিজে কাজকর্ম কিছু বুঝবেন না, বুঝতে চেষ্টা করবেন না। কেবল আমার দোষ ধরবেন। কার দ্বারা কতটুকু কাজ হয় না হয়, আমি জানি, আমি বুঝি। ডিপার্টমেন্টের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ব্যাপারে উনি কেন মাথা গলাতে আসেন বলেন তো। ওঁর সঙ্গে কাজ করা ইমপসিব্ল। বিল থেকে হয় ওঁকে আপনি সরিয়ে নিন, না হয় আমাকে সরান। আপনি যদি কোন ব্যবস্থা না করেন, আমি জেনারেল ম্যানেজারের কাছে রিপোর্ট করব।’
গম্ভীরভাবে বললাম, ‘আচ্ছা যান আপনি, আমি সব দেখছি।’ মাস্টারমশাইকে ডেকে পাঠিয়ে বললাম, ‘ব্যাপার কি, আপনার নামে ফের কমপ্লেন এসেছে।’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘কমপ্লেন? আমি ননীবাবুর বিরুদ্ধে কমপ্লেন করছি। মানুষ না ব্রুট।’
বললাম, ‘ব্যাপারটা কি?’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘ব্যাপার কি আর। ক্লিক, কেবল ক্লিক। জন পাঁচেক মাত্র লোক ডিপার্টমেন্টে। তার মধ্যে দুটো ক্লিক। একজন আর একজনের বিরুদ্ধে লাগাচ্ছে ইনচার্জের কাছে। কিন্তু ননীবাবু তো হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট। তাঁর তো উচিত নিরপেক্ষ থাকা, সুবিচার করা। কিন্তু পক্ষপাত তাঁরই সব চেয়ে বেশি। নির্মল বলে একটি ছেলে আছে। সবে ম্যাট্রিক পাস করে আই কম-এ ভর্তি হয়েছে। ছেলেটি একটু স্পষ্টবক্তা। সেই জন্য ননীবাবুর যত আক্রোশ তাঁর ওপর।’
বললাম, ‘তা থাক, আপনি ওর ভিতরে না গেলেই তো পারেন।’
মাস্টারমশাই উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘বল কি তুমি? না গেলেই পারি? আমার চোখের সামনে ছেলেটাকে এমন করে নির্যাতন করবে আর আমি কোন কথা বলব না? পাঁচটার মিনিট কয়েক আগে থেকে ননীবাবু এমন করে কাজ চাপাবেন ওর ঘাড়ে যে সপ্তাহে ছেলেটির চার-পাঁচ দিন কলেজ কামাই হয়। এই তো একরত্তি ছেলে, খাটাতে খাটাতে ওর জিভ বের করে ফেলেছেন ননীবাবু। কথা না বলে কোন মানুষে পারে?’
বললাম, ‘ননীবাবু জেনারেল ম্যানেজারের নিজের ভাগ্নে। তিনি যদি কোন রিপোর্ট টিপোর্ট করেন তাহলে কিন্তু শত চেষ্টা করেও আমি আপনার চাকরি রাখতে পারব না মাস্টারমশাই, মাস্টারির মায়া যখন ছেড়েছেন, একেবারে ছাড়ুন। অফিসে এসে আর কক্ষনো মাস্টারি করবেন না মাস্টারমশাই।’
আমার শাসনের ভঙ্গিতে মাস্টারমশাই বেশ একটু ঘাবড়ে গেলেন, ‘না বাবা, দোহাই তোমার, চাকরি-টাকরির যেন কোন গোলমাল না হয়। তুমি বরং ননীবাবুকে আমার হয়ে—।আচ্ছা আমিও না হয় তাঁর কাছে ক্ষমা চাইব।’
বললাম, ‘ক্ষমা চাওয়ার হয়ত দরকার হবে না, কিন্তু খুব সমঝে চলবেন।’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘আচ্ছা নিরুপম, তাই চলব। কিন্তু খবরদার, তুমি যেন আমার বাসায় গিয়ে অফিসের এসব গোলমালের কথা বল না বাবা। গীতার মা শুনলে—।’
হেসে মাস্টারমশাইকে নির্ভয় দিয়ে বললাম, ‘না, তিনি এসব জানতে পারবেন না।’
কিন্তু দু’দিন বাদে ফের মাস্টারমশাইর নামে ননীবাবু অভিযোগ করলেন। তিনি ফের ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করেছেন। তাঁকে নিয়ে কাজ করা অসম্ভব।
সুতরাং আবারও অন্য ডিপার্টমেন্টে বদলি করতে হল মাস্টারমশাইকে।
মাস্টারমশাই মুখ ভার করে বললেন, ‘বারবার তুমি আমারই দোষ দেখছ নিরুপম। শাস্তি দিয়ে আমাকেই সরাচ্ছ।’
বললাম, ‘তা ঠিক নয় মাস্টারমশাই, কিন্তু অফিসের একটা ডিসিপ্লিন আমাকে মেনে চলতে হবে। ননীবাবু এখানকার পুরনো লোক আর খুব এফিসিয়েন্ট হ্যাণ্ড। তা ছাড়া জেনারেল ম্যানেজারের—।’
মাস দু’য়েকের মধ্যে ব্যাঙ্কের প্রায় সমস্ত ডিপার্টমেন্টেই মাস্টারমশাইকে ঘুরিয়ে আনলাম। লেজার, লোন, ফিক্সড-ডিপজিট, অ্যাকাউন্টস, ডেসপ্যাচ—কোন বিভাগই বাদ রইল না, কিন্তু সব জায়গা থেকে অভিযোগ আসতে লাগল। মাস্টারমশাই সর্বত্রই অপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। তিনি কেওস সৃষ্টি করছেন অফিসে। তাঁকে নিয়ে কাজ করা অসম্ভব। কর্তৃপক্ষের কাছেও তাঁর নামে রোজ নানা ধরনের অভিযোগ যেতে শুরু করল।
ভারি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। মাস্টারমশাইর চাকরি বুঝি আর রাখা গেল না।
এর মধ্যে একদিন তাঁর বাসায় গেলাম। খেতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন মাস্টারমশাইর স্ত্রী। নানারকম তরকারি বেঁধে পাতের চার ধারে সাজিয়ে দিয়ে স্নিগ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘উনি কেমন কাজকর্ম করছেন নিরুপম?’
আশায় উৎসুক তাঁর দুটি চোখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ফের ভাত মাখতে মাখতে মুখ নিচু করে জবাব দিয়েছিলাম, ‘ভালোই।’
তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল স্বরে বলেছিলেন, ‘কেমন, বলিনি গীতা? ইচ্ছা করলেই উনি পারবেন।’
গীতা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেছিল, “বাঃ রে, পারবেন না আমি বলেছি নাকি?’
কিন্তু ডেসপ্যাচ থেকেও যখন ক্রমাগত অভিযোগ আসতে লাগল আমি মাস্টারমশাইকে ডেকে বললাম, ‘কেয়ার-টেকার প্রফুল্লবাবু কাজ ছেড়ে দিয়েছেন, আপনি তাঁর জায়গায় কাজ করুন, বেয়ারাদের দেখাশোনা করবেন।’
মাস্টারমশাই অভিমানের সুরে বললেন, ‘সমস্ত না শুনে না জেনে বার বার তুমি আমাকেই জব্দ করছ নিরুপম। ডেসপ্যাচার ভুবনবাবু সেদিন কানাই বেয়ারাকে সামান্য কারণে যেভাবে গালাগালি করছিলেন তা কোন ভদ্রলোক করে না, কোন ভদ্রলোকে তা সইতেও পারে না, আমি আপত্তি করেছিলাম, তাই বুঝি তিনি এসে লাগিয়েছেন?’
বললাম, ‘সে যাক, আপনি আজ থেকে বেয়ারাদের ভার নিন। ওরা কখন আসে যায় লক্ষ রাখবেন, যে ডিপার্টমেন্টে যে ক’জন বেয়ারার দরকার হয় ঠিকমত হিসাব করে দেবেন। দেখবেন কেউ যেন কাজে ফাঁকি না দেয়, চুপচাপ বসে থাকে। এই হল মোটামুটি কাজ। বোধ হয় এতে আপনার কোন অসুবিধা হবে না।’
রাগে অভিমানে মাস্টারমশাই যেন কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। তারপর বললেন, ‘তার মানে তুমি আমাকে অপমান করছ। তার মানে বেয়ারাদের সর্দারি করা ছাড়া আর কোন কাজের যোগ্য বলে তুমি আমাকে মনে করছ না।’
বিরক্ত হয়ে ফাইল থেকে মাথা তুলে বললাম, ‘কি মনে করছি না করছি সেসব আলোচনা পরে আর এক সময় করব মাস্টারমশাই। আপাতত আমি ভারি ব্যস্ত।’
মাস্টারমশাই বেরিয়ে গেলেন।
প্রথম দিন-কয়েক বেয়ারাদের কাছ থেকেও অভিযোগ আসতে লাগল, মাস্টারমশাই বড় রূঢ়ভাষী। হাজিরা সম্বন্ধে ভারি কড়াকড়ি তাঁর। চাল-চলন আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে ভারি খুঁতখুঁতে। একদিন নাকি কি একটা বেফাঁস কথা বলে ফেলার জন্য শীতলকে চড় মেরেছিলেন।
কিন্তু সপ্তাহ দুই বাদে অভিযোগের ধরনগুলি অন্য রকম হতে শুরু করল। মাস্টারমশাই বেয়াবাদের হয়ে প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে ঝগড়া করছেন। কোন বেয়ারাকে একটু রাগ করবার উপায় নেই, কড়া কথা বলবার উপায় নেই, মাস্টারমশাই তেড়ে এসে প্রতিবাদ করবেন। কোন ব্যক্তিগত কাজকর্মে তাদের পাঠান চলবে না। মাস্টারমশাই বলেন, ‘তাহলে অফিসের কাজ সাফার করে। বাবুদের কেবল পান সিগারেট যোগাবার জন্য ওদের রাখা হয় নি।’
ক্লিয়ারিং-এর পরিমলবাবু এসে একদিন বললেন, ‘ভালো চান তো বেয়ারাদের সার্দারি থেকে এখনো মাস্টারমশাইকে সরিয়ে আনুন, আশকারা দিয়ে দিয়ে ওদের উনি মাথায় তুলে ছাড়বেন।’
বললাম, ‘আচ্ছা যান। দেখছি।’
ইয়ার ক্লোজিং-এর সময় কাজ সারতে সারতে রাত প্রায় আটটা হল। অফিসের আর সব ডিপার্টমেন্ট চলে গেছে। নিজের ডিপার্টমেন্টের দু’জন সহকর্মীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। খানিকটা যেতেই মনে পড়ল দেরাজটা চাবি বন্ধ করে আসিনি। কতকগুলি জরুরি চিঠি টেবিলেই পড়ে আছে। সহকর্মীদের ছেড়ে দিয়ে আমি ফের এসে ঢুকলাম অফিসে। গেটের কাছে দারোয়ান খৈনি টিপছে, মাথা নিচু করে সেলাম জানাল।
দেরাজে চাবি বন্ধ করে ফিরে আসছি, হঠাৎ লক্ষ করলাম অফিসের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ডেসপ্যাচ ডিপার্টমেন্টের কাছাকাছি আলো জ্বলছে। মৃদু আলাপ শোনা যাচ্ছে জনকয়েকের, বেয়ারাদের জনকয়েক অফিস বিল্ডিং-এই রাত্রে থাকে। ছাতের ওপর রান্নাবান্না করে, খায়-দায়। ভাবলাম তারাই আড্ডা দিচ্ছে।
ফিরে আসছিলাম, হঠাৎ কানে গেল, ‘আচ্ছা, স্বাধীনতা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ জানো তোমরা?’ একি, এ যে মাস্টারমশাইর গলা। এত রাত্রে মাস্টারমশাই কি করছেন! এখানে! কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম।
দেখলাম সাত আটটা ছোট ছোট টুল পেতে শীতল, বিপিন, নিবারণ, কানাই এবং আরও কয়েকজন মাস্টারমশাইকে প্রায় ঘিরে বসেছে। ডেসপ্যাচারের চেয়ারটায় বসেছেন মাস্টারমশাই। সবাইকে ছাড়িয়ে কাঁচাপাকা চুলে ভর্তি তাঁর মাথাটা উচু হয়ে উঠেছে। বেয়ারাদের কারো হাতে খাতা পেনসিল, ব্যাঙ্কেরই সব বাতিল কাগজপত্র। কারো হাতে খড়ি আর স্লেট। আমাকে দেখে মাস্টারমশাই আর ছাত্রের দল সবাই স্তব্ধ হয়ে রইল।
মুহূর্তকাল আমিও কোন কথা বলতে পারলাম না। তারপর বললাম, ‘এসব কি হচ্ছে মাস্টারমশাই! ক্লাস নিচ্ছেন নাকি?’
মাস্টারমশাই অপ্রতিভ হয়ে অপরাধীর মত উঠে দাঁড়ালেন, ‘না না ক্লাস-ফ্লাস কিছু নয়। অমনিই ওদের একটু দেখিয়ে দিচ্ছিলাম। অফিস ডিসিপ্লিনটা ভালো করে আয়ত্ত করানোই অবশ্য আমার উদ্দেশ্য। কিন্তু তার জন্য আক্ষরিক শিক্ষাটাও কিছু কিছু দরকার, কি বল?’
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম।
মাস্টারমশাই বললেন, ‘এদের মধ্যে একটি ছেলে কিন্তু অদ্ভুত মেরিটরিয়াস। আমাদের এই কানাই, চেন ওকে?’
বার তের বছরের কালো, রোগাপানা একটি ছেলের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘চিনি।’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘অদ্ভুত মাথা। ইংরেজি বল, অঙ্ক বল, সব বিষয়ে সমান উৎসাহ। এইসব ছেলেকে দিয়েই স্কলারশিপের অ্যাটেম্পট নিতে হয়। প্রায় ক্লাস সিক্সের স্ট্যাণ্ডার্ডে আছে। জানো, খানিকটা কেয়ার নিতে পারলে ওকেও ডিস্ট্রিক্টের মধ্যে ফার্স্ট করে তোলা যায়।’
বেরিয়ে আসছিলাম, দেখি মাস্টারমশাই আমার পিছনে পিছনে এসেছেন। আমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মাস্টারমশাই বললেন, ‘চল, আমিও যাচ্ছি, একটা রিকোয়েস্ট নিরুপম, এসব কথা যেন গীতার মা কি জেনারেল ম্যানেজারের কানে না যায়।’
মনে মনে হাসলাম, প্রথম মাস্টারিও মাস্টারমশাই এমনি লুকোচুরির ভিতরেই শুরু করেছিলেন।
১৩৫৬ (১৯৪৯)