থির বিজুরি – সুবোধ ঘোষ
চিএা রায়ের স্বামী নিখিল রায়। লোকে বলে, হ্যাঁ, তা তো বটেই। বিয়ে যখন হয়েছে তখন স্বামী না বলে আর উপায় কি? কিন্তু আসলে নিখিল রায় হলো একটা সাইফার।
মাত্র চার বছর হলো বিয়ে হয়েছে নিখিলের। আর বিয়ের মাত্র এক মাস পরেই নিখিলের সঙ্গে চিত্রা যেদিন ধানবাদের কাছে এই কলোনিতে কেরানী কোয়ার্টার্সের এই ছোট বাড়িটার ভেতরে এসে ঢুকলো, সেদিন অবশ্য কলোনির সকলেই বলেছিল, হেডক্লার্ক নিখিল রায়ের বউ এসেছে, বড় সুন্দর বউ।
নিখিল রায়ের স্ত্রী বেশ সুন্দরী, সংবাদটা রটে যেতে বেশি দেরি হয়নি। অফিসেও কাজের ফাঁকে নানা মুখের খোশগল্পের মধ্যে মাঝে মাঝে এই প্রসঙ্গটা ঝিলিক দিয়ে উঠত। বাস্তবিক, সত্যিই নিখিল রায় একটা বিদ্যুৎ নিয়ে এসেছে।
—আনলো কোথা থেকে?
যারা জানে তারাই উত্তর দেয়—কলকাতা থেকে।
—কলকাতার দয়া তো খুব, এমন জিনিস এমনিতেই ছেড়ে দিল?
—এসব তো ভাই দয়া-টয়ার ব্যাপার নয়। এসব হলো ভাগ্যির ব্যাপার। খুব ভাগ্যি করেছিল নিখিল রায়।
সেদিন হেডক্লার্ক নিখিল রায়ের ভাগ্যকে অফিসের খোশগল্পগুলি হিংসে করলেও নিখিল রায়ের ভাগ্য তাতে একটুও বিচলিত হয়ে ওঠেনি। পথে বেড়াতে বের হত নিখিল আর চিত্রা। যারা নিখিলকে চেনে, কিন্তু চিত্রাকে কখনো দেখেনি, তারাও দেখেই বুঝে ফেলত, এই সুন্দরী মহিলাই হলো হেড ক্লার্ক নিখিল রায়ের স্ত্রী।
আর দু’ মাস যেতে না-যেতেই সারা কলোনিতে আর একটা সংবাদ রটে গেল খুব ভাল করেই এবং তারপর কলোনি ছাড়িয়ে ধানবাদেরও নানা মহলে, আসরে, কোয়াটারে। বেশ সুন্দর গলা, খুব ভাল গান গাইতে পারে হরিনগর কলোনির এক নিখিল রায়ের স্ত্রী।
—কি নাম যেন ভদ্রমহিলার?
যারা শুনেছে নাম, তারাই উত্তর দেয়,—নাম হলো চিত্রা রায়।
গানের খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে চিত্রা রায় নামটাও খ্যাত হয়ে গেল।
তারপর, চারটি মাস যেতে না-যেতে নানা জলসা ও সভা-সমিতির আহ্বানে আসতে আসতে আর উদ্বোধন সঙ্গীত গাইতে গাইতে চিত্রা রায়ের মুখটাও চিত্রিত হয়ে গেল ছেলেমহল আর মেয়েমহল থেকে শুরু করে শিশুমহলের মনে মনে। পথে চিত্রা রায় যদি একাই বেড়াতে বের হয়, তবুও কেউ আর চিনতে ভুল করে না।—ঐ, উনিই হলেন চিত্রা রায়, নিখিল রায়ের স্ত্রী চিত্রা রায়।
সেদিন এই রকমই ছিল চিত্রা রায়ের পরিচয়। সে পরিচয় নিখিলের নামের সঙ্গেই বাঁধা। কিন্তু এক বছর যেতে না-যেতেই উল্টে গেল সেই পরিচয়।
সন্ধ্যাবেলা মার্কেটের আলোয় ঝলমল একটা দোকানের ভেতরে এসে দাঁড়ায় চিত্রা। জিনিসের দাম নিয়ে দরদস্তুর করে চিত্রা, আর নিখিল দাঁড়িয়ে থাকে চিত্রার পাশে। দোকানের কাঁচের ওপর চিত্রা রায়ের সুন্দর চেহারার প্রতিচ্ছায়া ঝক্মক্ করে।
দোকানের ভেতরেই হোক, আর দোকানের বাইরে পথের ওপরেই হোক, চিত্রাকে আর নিখিলকে দেখতে পেয়ে লোকের মুখে আলোচনা চলে।—ঐ ভদ্রলোক কে মশাই?
—ঐ তো, উনিই হলেন চিত্রা রায়ের স্বামী নিখিল রায়। সরকার অ্যাণ্ড সিন্হার হেডক্লার্ক নিখিল রায়।
এক বছরের মধ্যেই উল্টে গেল পরিচয়। চিত্রারই নামের ছায়ায় ঘুরে বেড়ায় নিখিলের নাম। চিত্রাই হলো আসল অস্তিত্ব, আর তার পাশে আছে নিখিল। চিত্রার নামের গৌরবই মানুষ করে রেখেছে নিখিলকে।
তবু তো মানুষ হয়েই ছিল, আর চিত্রার পাশেই ছিল নিখিল। কিন্তু এক বছর আগের সেই পরিচয়ও একেবারে অন্য রকম হয়ে গেল আর তিন বছরের মধ্যে। তাই তো আজ লোকে বলে, নিখিল রায় একটা সাইফার।
চিত্রার পাশে আর নেই নিখিল। এখন চিত্রার পিছনে পড়ে গিয়েছে নিখিল। সিনেমা দেখতে, বেড়াতে, সভা-সমিতিতে বা মার্কেটে, যেখানে যখন যায় চিত্রা, তখন নিখিল তার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে, কিন্তু পেছনে। নিখিলের সঙ্গে যখন কথা বলে চিত্রা, তখন পেছনে মুখ ফিরিয়ে তাকাবারও কোন দরকার হয় না চিত্রার। চিত্রা যেন তার সম্মুখের পথের বাতাসকে উদ্দেশ করেই কথা বলে,—সঙ্গে টাকা এনেছ তো?
ঠিক শুনতে পায় নিখিল। শুনতে একটু ভুলও হয় না। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, এনেছি।
এতদিনে ধানবাদের কাছে এই হরিনগরে এসে চার বছরের মধ্যেই চিত্রা তার জীবনের সম্মুখের পথ একেবারে অবাধ করে নিয়েছে। অথচ, চার বছর আগে একদিন এক সকালবেলায় হরিনগর কলোনির সব বাড়ির জানালাগুলিতে থরে থরে সাজানো কৌতূহলী চক্ষুগুলি দেখতে পেয়েছিল, হেডক্লার্ক নিখিল চলেছে আগে আগে, আর তার পেছনে মাথা হেঁট করে আস্তে আস্তে হেঁটে চলেছে বড় সুন্দর ও শান্ত আর একটু গম্ভীর একটি মুখ নিয়ে একটি বউ। আর আজ? আজ আর সেই বউয়ের মুখটি দেখতে ঠিক সেই রকম শান্ত তো নয়, আর সেই একটু গম্ভীরতার একটুও আজ আর নেই। বউয়ের মাথার কাপড় যেন এই চার বছরের মধ্যেই কোন্ এক ঝড়ের ঝাপটা লেগে খসে পড়ে গিয়েছে ঘাড়ের উপর। পড়েছে তো পড়েই গিয়েছে, আর উঠতে পারছে না। আজ চিত্রা রায়ই চলে আগে আগে, আর নিখিল পেছনে।
পেছনে হোক, তবু তো চিত্রার সঙ্গেই আছে নিখিল। তবে লোকে বলে কেন, একেবারে সাইফার হয়ে গিয়েছে নিখিল?
লোকে বুঝতে একটু ভুল করেছে। সামান্য একটু বাড়িয়ে বলেছে। সত্যি কথা হলো, সাইফার হয়ে যেতে চলেছে নিখিল। আর আজ অফিস যাবার সময় যখন চিত্রার হাত থেকে একটা চিঠি স্বচ্ছন্দে হাত বাড়িয়ে নিয়েছে নিখিল, তখন আর কোন সন্দেহ নেই যে, এইবার সত্যিই সাইফার হয়ে যাবে নিখিল।
অফিস যাবার জন্য তৈরি হয়ে প্রতিদিনের নিয়মের মত চিত্রার কাছে এসে দাঁড়ায় নিখিল,—তাহলে আসি।
চিত্রা বলে—শোন।
খামে বন্ধ একখানি চিঠি রয়েছে চিত্রার হাতে। হয়তো পোস্ট করতে হবে এই চিঠি। নিখিল বলে—চিঠি পোস্ট করতে হবে?
চিত্রা—না।
নিখিল—তবে?
হাত কাঁপে না চিত্রার, বোধ হয় মনও কাঁপে না। শুধু অন্যমনস্কের মত অন্য দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবে। তারপরেই প্রশ্ন করে—ভুল করবে না তো?
নিখিল—ভুল হবে কেন? কি এমন কঠিন কাজ করতে বলছে যে ভুল হবে?
চিত্রা—তবে শোন।
বলতে গিয়ে চিত্রার গলার স্বর একটুও কাঁপে না।
নির্দেশের প্রতীক্ষায় ব্যগ্রভাবেই চিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিখিল। কিন্তু চিত্রা তাকায় না নিখিলের মুখের দিকে। কিন্তু তাতে কি হয়েছে? এটা নতুন কিছু নয়। আজ চার বছরের মধ্যে এই ঘরের ভেতর ক’দিনই বা নিখিলের মুখের দিকে তাকিয়েছে চিত্রা? আর তার জন্য কোন দুঃখ ও দুশ্চিন্তা জাগেনি নিখিলেরও মনে। আজ নতুন করে হঠাৎ জাগবারও কথা নয়।
চিত্রা বলে—তোমাকে বিশ্বাস করি বলেই বলছি।
নিখিল হাসে—আমাকে বিশ্বাস করবে না তো কাকে করবে?
নিখিল একটু আশ্চর্যই হয়। আজ একেবারে এরকম নতুন একটা প্রশ্ন কেন করছে চিত্রা? আজ পর্যন্ত তার ব্যবহারে এমন কোন ভুল কি দেখতে পেয়েছে চিত্রা, যার জন্য বিশ্বাসের কোন কথা উঠতে পারে? মনে তো পড়ে না নিখিলের, কখনো একটা প্রতিবাদ কবে, কোন অভিযোগ করে কিংবা কোন কথায় উত্তর দিতে একটু দেরি করে চিত্রার মনে কষ্ট দিয়েছে নিখিল।
চিত্রা বলে—তবে, এই চিঠিটা নিয়ে·····
বলতে গিয়ে কেন জানি চুপ করে যায় চিত্রা। বিদ্যুৎ খেলে যায় যে সুন্দর চোখের দৃষ্টিতে, সেই চোখ দুটো যেন হঠাৎ একটা ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়।
কিন্তু তার পরেই আর কিছু নয়। ঝক্ঝক্ করে চিত্রার চোখ দুটো।
চিত্রা বলে—এই চিঠিটা নিয়ে গিয়ে মিস্টার সরকারের হাতে দিতে হবে।
নিখিল—দেব।
চিত্রা—মিস্টার সরকারের টেবিলের ওপর ফেলে রেখে আসলে চলবে না।
নিখিল—না, তাঁর হাতেই দেব।
চিঠি নিয়ে চলে গেল নিখিল। এইবার, আর বেশি দেরি হবে না। বোধ হয় আজ সন্ধে ফুরোতে না-ফুরোতে সত্যি সাইফার হয়ে যাবে নিখিল।
প্রস্তুত হয় চিত্রা—সন্ধে আসতেই বা আর কতক্ষণ! চিঠি নিয়ে চলে গিয়েছে নিখিল, আর চিত্রা জানে, ও চিঠি খুলে পড়বার জন্য মনে একটু কৌতূহলও জাগবে, সেরকম কোন সন্দেহের বস্তু দিয়ে তৈরিই নয় লোকটা। আর যদি কৌতূহল হয়, আর চিঠিটা পড়ে নিখিল তবুও কি কিছু বুঝবে বা মনে করতে পারবে ঐ মানুষ? কখনই না। ‘ভেবে দেখলাম, আপনি আমার আপনজনের চেয়েও বেশি। আমি যাব।’—এইটুকু পড়ে কি-ই বা বুঝবে, আর বুঝেই বা কি করতে পারে নিখিল? এতদিন ধরে সবই দু’চোখে দেখেও যে কিছু বোঝেনি, সে আর ঐ সামান্য কয়েকটা লেখা কথা পড়ে আর কি বুঝবে?
আর বুঝলেই বা। নিখিল চিত্রার সম্মুখ পথের বাধাই যে নয়। বাধা না হয়েই সে ধন্য হয়ে আছে। বাধা দেবে না নিখিল, বাধা দিতে জানে না নিখিল।
নিঃশব্দে স্থির হয়ে ঘরের ভেতর একা দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে ঝক্ঝক্ করে চিত্রার চোখ, দুরন্ত বিদ্যুতের জ্বালার মত সেই বেদনাটাই মনের ভেতর ছটফট করে ওঠে। চার বছর আগে হঠাৎ বাড়ির লোকের এক নিষ্ঠুর ঝোঁক আর সদিচ্ছার আঘাতে যেদিন চূর্ণ হয়ে গেল তার মনের স্বপ্ন, সেই দিনটার কথা আজও জ্বলছে তার মনের মধ্যে। সেদিনের আক্ষেপ, আর ঘৃণা একসঙ্গে মিলে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল তার জীবনের একমাত্র একটা কল্পনার বুকে, সেই ক্ষতের জ্বালা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই অশান্ত হয়ে রয়েছে জীবন। কে বলেছিল ওরকম না বলে-কয়ে আর হঠাৎ ধরে-বেঁধে একটা বিয়ে দিয়ে দিতে ! কি দরকার ছিল? আর যদি বিয়েই দেওয়া হলো, তবে চিত্রার মত মেয়ের জন্য পৃথিবীতে কি আর কোন মানুষ ছিল না? যেন আড়ালে আড়ালে হঠাৎ একটা ষড়যন্ত্র এঁটে ফেললেন জেঠামশাই, আর জেঠাইমা। একটি বারের মত একটি কথাতেও কোন আভাস দিলেন না যে, বাপ-মা-মরা মেয়েকে পার করে দেবার জন্য তাঁরা একটা ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। যদি বিয়ের পিড়িতে বসবার এক মিনিট আগেও বুঝতে পারত চিত্রা, ধানবাদের কাছে এক দেশি কোম্পানির এক ক্লার্ক এসেছেন বরের সাজ পরে, তবে পৃথিবীতে কারও সাধ্য ছিল না যে, চিত্রাকে সেই পিঁড়ির ওপর বসিয়ে দিতে পারে। সেদিনই সেই মুহূর্তে জেঠামশাইয়ের সব চক্রান্তের উৎসব ভেঙে দিত চিত্রা, যেমন করেই হোক।
সেই সন্ধ্যাতে লগ্ন ঘনিয়ে আসবার একটু আগে বরং মিথ্যে কথাই বলেছিলেন জেঠাইমা। ছেলে নাকি খুব ভাল ছেলে, যে শুনেছে এই সম্বন্ধের কথা সে-ই নাকি খুশি হয়েছে।
চিত্রা জানে, কেন এমন কাণ্ড করলেন জেঠামশাই, জেঠাইমা আর, আর সকলেই। লোকের অভিযোগ শুনতে শুনতে আর ভয় পেয়ে পেয়েই এরকম একটা ষড়যন্ত্র করে ফেললেন জেঠামশাই।—এ মেয়েকে বেশি দিন ঘরে পুষে রাখবেন না ধীরেনবাবু। বন্ধুদের আর প্রতিবেশীদের এই অভিযোগের ভয়েই সারা হয়ে গেলেন জেঠামশাই আর জেঠাইমা। তাঁরা যদি বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত না হয়ে উঠতেন, তবে কোন ক্ষতি হত না কারও। জেঠামশাইয়ের না, প্রতিবেশীদেরও আর আত্মীয়দেরও না। আর চিত্রারও না। চিত্রা নিজেই পৃথিবীতে খুঁজে নিত তার জীবনের সঙ্গী।
বেশি খুঁজতে হত না চিত্রাকে। পারুল আর প্রীতির মত মেয়ে যখন নিজের চেষ্টায় মনের মত সঙ্গী খুঁজে নিতে পেরেছিল, তখন চিত্রাই বা পারত না কেন? কিন্তু চিত্রার মনের আশা ও কল্পনাগুলিকে সেটুকু সুযোগও দিলেন না জেঠামশাই।
সুযোগ বড় বেশি করেই আসছিল, তাই তো দুশ্চিন্তিত হয়ে পড়লেন জেঠামশাই। অদ্ভুত মন ওঁদের। চিত্রার বাক্স নানারকম সনামী আর বেনামী চিঠিতে ভরে উঠলো যে! শুনতে পেয়ে আর জানতে পেরে আতঙ্কিত হলেন জেঠাইমা। কিন্তু সে কি চিত্রার অপরাধ? চিত্রা কি জীবনে কোনদিন চেয়েছিল এইসব চিঠি! চিত্রার সুন্দর মুখ দেখে মানুষ যদি পাগল হয়ে যায়, সে দোষ চিত্রার নয়। বরং, জেনে নিশ্চিন্ত হওয়াই উচিত ছিল জেঠাইমার, কোন চিঠিরই উত্তর দেয়নি চিত্রা। কারণ চিঠিদাতাদের কাউকেই একটা মানুষ বলে মনে করতে পারেনি চিত্রা।
বিয়ের পর হরিনগরের এই কলোনিতে প্রথমে এসে চুপ করে বসে ভাবতে ভাবতে একদিন হেসেই ফেলেছিল চিত্রা, সেইসব চিঠির মানুষগুলি যে এই হেডক্লার্ক ভদ্রলোকটির চেয়ে অনেক অনেক বড় মানুষ। আজ তারা হয়তো মুখ টিপে হাসছে। শুনে অবাক হয়ে গিয়েছে পারুল আর প্রীতি, শেষে এটা কি একটা কাণ্ড করে বসলো চিত্রা! সন্দীপের মত এত গুণের রূপের ও টাকার মানুষ, এত বড় একজন চীফ অফিসারের ব্যাকুলতাও যে চিত্রার মন টলাতে পারেনি, সেই চিত্রা বিয়ে করেছে এক দেশি কোম্পানির বড় কেরানীকে, যার মাইনে দু’শো টাকা। প্রেম হলে না হয় বোঝা যেত। কিন্তু প্রীতি আর পারুল জানে, চিত্রা কি সেই মেয়ে যে প্রেমের আবেগে কাঙালের গলায় মালা দেবে। যে-সে একটা লোকের মুখ দেখে মনে প্রেম জাগবে, এমন মনই করেনি চিত্রা।
চার বছর আগে চিত্রার জীবনের আকাঙক্ষা যে ব্যথা পেয়েছিল, সেই ব্যথা মিটে যেতে পারেনি এক মুহুর্তের মতও, বরং দিন দিন আরও অস্থির, আরও মত্ত এবং আরও দুঃসাহসে শাণিত করে তুলেছে চিত্রার সঙ্কল্প।
জীবনে কি চেয়েছিল চিত্রা? আজ এখন নিজের মনকে পরীক্ষা করলে, আর স্মৃতি সন্ধান করলে ঠিক বুঝতে পারবে না চিত্রা, বিয়ের আগে কি ধরনের সুখী জীবন কামনা করেছিল চিত্রা। আজ শুধু মনে হয়, এই কলোনিরই মালিক সরকার অ্যাণ্ড সিন্হা কোম্পানির বারো আনা স্বত্বের অধিকারী বিনায়ক সরকারের মত মানুষের পাশে যদি ঠাঁই পাওয়া যেত, তবে ধন্য হত আর সুখী হত চিত্রার জীবন।
তবে কি বিনায়ক সরকারের টাকার পুঁজির পরিচয় জানতে পেরে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে চিত্রা? না, ঠিক টাকার জন্য তো নয়। বিনায়ক সরকারের চেয়ে বেশি টাকার মানুষ কি ধানবাদের এই বিরাট কয়লা আর শিল্প-রাজ্যের কোন অট্টালিকার মধ্যে নেই? টাকার জন্য নয়। বিনায়ক সরকার শুধু টাকার জন্যই বড় মানুষ নয়। বিনায়ক সরকার বড় সুন্দর ও বড় উজ্জ্বল এক বড় জীবনের মানুষ। ঐ রকমই এক জীবনের আলো হাসি ও উল্লাসের মধ্যে দাঁড়াবার জন্য চিত্রার মন স্বপ্ন দেখে এসেছে। নইলে বড়মানুষ তো কত রকমেরই আছে।
কিন্তু বিনায়ক সরকারের মত মানুষ পৃথিবীতে আর কোথাও আছে কিনা, জানে না চিত্রা। আজ মনে হয়, এই মানুষটি তার প্রসন্ন জীবনের সকল দীপ্তি নিয়ে এইখানে যেন চিত্রার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। সরকার অ্যাণ্ড সিন্হার বারো আনা মালিক, এতগুলি ফ্যাক্টরি যার দৌলত সৃষ্টি করছে দিনরাত, সেই মানুষও স্পষ্ট মুখ খুলেই মনের বেদনা প্রকাশ করেছে চিত্রারই কাছে, এই সব দৌলতই সার্থক হত, যদি চিত্রার মত মেয়ের ভালবাসার একটু ছোঁয়া লাগত তার জীবনে।
তাই জীবনে যাকে দেখে, আর যার মুখের হাসি আর ভাষা শুনে প্রথম মুগ্ধ হয়েছে চিত্রা, তারই কাছে চিঠি দিল এই প্রথম। বিনায়কের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার পরেও তিনটি বছর কেটে গিয়েছে, কিন্তু বিনায়কের আহ্বানে এত স্পষ্ট ভাষায় সাড়া দিতে পারলো চিত্রা, এই প্রথম।
চিঠি দিতে হাত কাঁপবার কথা নয়। চিত্রার হাতের সব দ্বিধা ও ভীরুতা মুছে গিয়েছে অনেক দিন আগেই। বিনায়কের গাড়ি আসবার আগে যে হাত দিয়ে নিজেকে এতদিন সাজিয়ে এসেছে চিত্রা; সে হাত আজ একটা চিঠি দিতে কাঁপবে কেন? শুধু একবার নিঃশ্বাসটা কেমনতর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেন, কিসের জন্য? চিত্রা নিজেই জানে না, কেন।
‘নিশ্চয়ই নিখিলের কথা ভেবে নয়, যে নিখিল চিত্রার জীবনে একটা অস্তিত্বই নয়। বোধ হয় বিনায়কেরই কথা ভেবে। স্ত্রী আছে বিনায়কের, বিবাহিতা স্ত্রী। সেই স্ত্রীকে বর্জন করবার সাধ্যি নেই বিনায়কের। বিনায়কই বলেছে, এইখানেই তার জীবনের দুঃখ একটু জটিল ও গ্রন্থিল হয়ে গিয়েছে। বিনায়কের স্ত্রী মৃদুলা সরকার জীবনে স্বামী ছাড়া আর কিছু বোঝে না। সে এক অদ্ভুত বিস্ময়ের নারী। দশ বছর হলো বিয়ে হয়েছে বিনায়কের ইওরোপ থেকে ফিরে আসার পরেই। বোম্বাইয়ের এক হোটেলে প্রথম দেখা হয়েছিল বিনায়কের সঙ্গে মৃদুলার। সেই যে দেখা, সেই দেখাই মৃদুলার জীবনের পরিণাম রচনা করে দিল। মৃদুলার ভালবাসা বুঝতে সেদিন যদি ভুল করত বিনায়ক, তবে আজ আর পৃথিবীতে থাকত না মৃদুলা। এ কাহিনী নিজেই চিত্রার কাছে অকপটভাবে বলতে কোনো কুণ্ঠা হয়নি বিনায়কের। মৃদুলা নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসার সম্পদ বলে মনে করে বিনায়ককে। সেই মৃদুলাকে অস্বীকার করবার মত শক্তি নেই, আর সে-রকম নির্মম হবার মতও শক্তি নেই বিনায়কের। তাই····তাই বিনায়কের সেই ইচ্ছাই ভাল। বিনায়কের ইচ্ছাই জীবনে বরণ করে নিতে আজ আর মনের মধ্যে কোন কুণ্ঠা নেই চিত্রার। বিনায়কের শুধু একজন আপন-জন হয়ে যাবে চিত্রা। চিত্রার যে হাত কতবার কত আগ্রহে ধরবার জন্য হাত বাড়িয়েছে বিনায়ক, চিত্রার সেই হাত আজ শেষ কুণ্ঠা চিরকালের মত দূরে ছুঁড়ে ফেলবার জন্য সঙ্কল্পে কঠিন হয়েই উঠেছে।
নিখিল আছে, চিত্রার স্বামী নিখিল। নিখিল থাকবে, ঠিক যেমনভাবে সুখী মন নিয়ে আর ধন্য হয়ে সে আছে। চিত্রার পেছনে পেছনে থাকতে হয় নিখিলকে, এই বৃথা সাথীপনার মিথ্যা স্পষ্ট করেই মিথ্যে করে দেওয়া ভাল। আর সঙ্গে সঙ্গে বস্তুহীন ছায়ার মত মানুষটাকে পিছনে পিছনে আসতে দিয়ে লাভ কি? যে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও গিয়ে দাঁড়ালে কোন গর্বের আনন্দ নেই, সেই মানুষকে একটা ছায়ার মত সঙ্গে রেখে লাভ কি?
এইভাবেই আজ একেবারে সাইফার হয়ে যেতে চলেছে নিখিল। অফিসের নানা মুখের খোশগল্পও আজকাল উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।—এই অবস্থার জন্য দায়ী স্বয়ং নিখিল রায়। একটা বিশ্বাসী নির্বোধ। স্বচক্ষে সব দেখেও এতদিনে সাবধান হতে পারলো না, তাই তো···তাই তো স্বামী হয়েও সাইফার হয়ে গিয়েছে নিখিল।
বড়সাহেব বিনায়ক সরকারের চকচকে টুরারের পেছনের সিটে যদি চুপ করে বসে থাকে স্বামী নিখিল রায়, আর স্ত্রী চিত্রা রায় বসে থাকেন সামনের সিটে বড়সাহেবের পাশে, তবে কি এ সন্দেহ না করে থাকতে পারে হরিনগর কলোনির সাধারণ ভদ্রলোক আর অফিসের সাধারণ কেরানীর দল?
বাধা? কে বাধা দেবে চিত্রাকে? বাধা দেওয়া যার কথা, সেই যে সব চেয়ে বেশি বাধ্য। সরকার অ্যাণ্ড সিন্হার হেডক্লার্ক নিখিল রায় যেন স্ত্রী-গরবেই গরবী হয়ে রয়েছেন। ভগবান জানে, লোকটার চোখ কি ধাতুতে তৈরি, আর মনটাই বা কি-রকমের প্রশান্ত মহাসাগর!
চার বছরের মধ্যে কেরানীর বউ হয়ে যে নারী একটু গম্ভীর মুখ নিয়ে অথচ শান্তভাবেই এসেছিল এই কলোনির একটি টালি-ছাওয়া চালের ক্ষুদ্র গৃহে, সেই নারী এ রাজ্যের যত চোখ বিস্ময়ে ধাঁধিয়ে দিয়ে সরকার অ্যাণ্ড সিন্হার বড়সাহেবের পাশে রাজেশ্বরীর মত বসে থাকে। চকচকে টুরারের ইঞ্জিনের গুরুগুঞ্জন ছাপিয়ে ওঠে চিত্রার মুখের হাসি-ফোয়ারার কলনাদ। সরকার ভিলার ফটকে ইউকালিপটাসের ছায়া থেকে সোজা নীল পরেশনাথের পায়ের কাছে তোপচাঁচির লেক পর্যন্ত, বিনায়কের টুরার চিত্রার মুখের মিষ্টি কলরব বুকে নিয়ে ছুটে যায় আর আসে। পেছনের সিটে বসে নিখিলও মাঝে মাঝে হেসে ওঠে।
অফিসের নানা মুখে নানা খোশগল্প মাঝে মাঝে নানা ধিক্কারেও তিক্ত হয়ে ওঠে।—মেয়েটার আর দোষ কি? এরকম বেকুবের হাতে পড়লে সব মেয়েই ওরকম হয়ে যায়।
অফিসের মধ্যেই একজন মাদ্রাজী কেরানীর সঙ্গে একজন বাঙালী কেরানীর একদিন হাতাহাতি হয়ে গেল। মাদ্রাজী কেরানী বলেছিল, বাঙালীরাই এরকম হয়। এই ধরনের মাত্র একটা কথা সহ্য করতে না পেরে টেম্পোরারি মহিম সেই মাদ্রাজীর সঙ্গে সেদিন যে মারামারি কাণ্ড করে বসলো, সেটা স্বচক্ষে দেখেও, আর কারণটা বুঝতে পেরেও হেডক্লার্ক নিখিলের মনে কোন উত্তাপ জাগেনি। কথাগুলো যেন কথাই নয়, একেবারে বাজে মিথ্যা ও কুৎসিত কতগুলি ছোট কল্পনার আক্রোশ। যত ছোট মনের পরিচয়।
নিখিলই যখন এসব চায়, তখন কে আর বাধা দেবে চিত্রার মত মেয়েকে, চোখে যার বিদ্যুৎ খেলে, আর শাড়ি পরার আর বেণী বাঁধবার ভঙ্গীতে ফ্যাশান উথলে পড়ে। হরিনগর কলোনির সকলের চক্ষুতে র্ভৎসনা জাগিয়ে দিয়েছে চিত্রা নামে এক নারীর এই ভয়ানক অভ্যুত্থান। কিন্তু কোন তিক্ততা বিরাগ ও র্ভৎসনা নেই শুধু একজনের চোখে, চিত্রার স্বামী নিখিল রায়ের চোখে।
লোকে আলোচনা করে, অফিসের নানা মুখে একটা হতভম্ব অবস্থাও মাঝে মাঝে ফুটে ওঠে।—এরকম হয়ে গেল কেন নিখিল রায় ? কোনরকম প্রমোশন বা লিফটও তো পাচ্ছে না নিখিল! সরকার অ্যাণ্ড সিন্হার বারো আনা প্রভু বিনায়ক সরকার যদি ইচ্ছা করেন, তবে নিখিলকে এই অফিসের অন্তত সুপারিন্টেন্ডেন্ট করে দিতে পারেন। কিন্তু সে রকম কিছুর আঁচ-আভাসও তো পাওয়া যায় না।
তাই টেম্পোরারি মহিম বলে—সব দোষ ঐ ভয়ঙ্কর বড়সাহেবটির। এইরকম কীর্তি করা ওর অভ্যেস আছে। অনেক করেছেন, আপনারা কোন খবর রাখেন না।
সত্যিই কেউ খবর রাখেন না। টেম্পোরারি মহিম কোথা থেকে এত খবর জানলো কে জানে! হয়তো একেবারে বাজে কথা। ছাঁটাইয়ের লিস্টে নাম চড়েছে বলে রাগের মাথায় যা-তা বলছে মহিম।
মহিম বলে—ওঁদের যে একটি ক্লাব আছে, আর সেই ক্লাবে কি হয়, সে-খবর আপনারা কেউ জানেন না।
তা কেউ জানে না ঠিকই। ক্লাব আছে, মাত্র এইটুকু সকলেই জানে।
মহিম বলে—কারা সেখানে আসে তাও আপনারা কিছু জানেন না।
আসে কত বড়লোক এইটুকু সকলেই জানে। পায়ে-হাঁটা মানুষ সেখানে কখনো আসে না, আসতে পারে না, আসবার নিয়মও নেই।
মহিম বলে—কতগুলো হোমরা-চোমরা অফিসার আসে, আর আসে কতগুলো সাহেব, আর কতগুলো লেডি। আর পিপে পিপে মদ।
—থাম থাম মহিম। বড় বেশি রঙ চড়াচ্ছ তুমি।
মহিম বলে—আমি সত্যি কথা বলছি কি না, সেটা নিখিলবাবুই জানেন। তিনি সেখানে সস্ত্রীক ঘুরে এসেছেন কয়েকবার।
—অ্যাঁ?
সকলে চমকে ওঠে আর বুঝতে পারে আসল দোষ তাহলে নিখিলেরই।
কিন্তু যার জীবনের পরিণাম নিয়ে এত আলোচনা, সেই চিত্রা রায়ের মন এইসব খুঁটিনাটির আর বিচারের অনেক উপরে চলে গিয়েছে। আজও তো ভুলে যায়নি চিত্রা, সেই একটা ঘটনার কথা। বিয়ের পাঁচ মাস আগে দার্জিলিং-এ বেড়াতে গিয়েছিল চিত্রা, জেঠাইমার বোন জয়া-মাসিমার সঙ্গে। লেবং-এর মাঠে চিত্রাকে দেখতে পেয়ে অপলক চক্ষে তাকিয়েছিল কোন এক স্টেটের রাজকুমার। আর সত্যিই, এক ভদ্রমহিলা এসে জয়া-মাসিমাকে ইংরাজি ভাষায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ঐ মেয়ের বাপ কোন্ স্টেটের চীফ?
এই পৃথিবীর এক স্টেটের রাজকুমারী বলে মনে হয়েছিল যে মেয়েকে, সেই মেয়ের শাড়িপরার স্টাইল দেখেই ভয় পেয়ে গেলেন জেঠামশাই। সে-মেয়ের মনের স্টাইলের কোন খবর নিলেন না। খবর নিলে বুঝতে পারতেন জেঠামশাই, চিত্রাকে এভাবে একজন যে-সে লোকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া কি ভয়ানক নিষ্ঠুরতা।
সেই নিষ্ঠুরতাকে ক্ষমা করতে পারেনি চিত্রা। সেই চক্রান্তের দান নিখিল রায় নামে এই ভদ্রলোকটিকে জীবনে আপন বলে মনে মনে গ্রহণ করতে পারেনি চিত্রা। আর এই জন্য মনে কোন দুঃখ নেই চিত্রার। আর দেখে আরও সুখী হয়েছে চিত্রা, এই ভদ্রলোকের মনেও কোন দুঃখ নেই। চিত্রা ডাক দেওয়া মাত্র কাছে এসে দাঁড়ায়, বলা মাত্র চলে যায়, আর আসতে বললেই সঙ্গে আসে নিখিল।
স্বামী নামে পরিচিত এই মানুষটিকে একদিনের জন্য একটি রূঢ় কথা বলতে হয়নি চিত্রার। ভদ্রলোকই সে সুযোগ দেননি চিত্রাকে। নিখিল যেন চিত্রার নীরব চিন্তার বেদনাগুলিকেও শুনতে পায় ; এমনই প্রখর তার কান।
ভোরে, টালি-ছাওয়া চালের ক্ষুদ্রকায় এই বাড়ির ভেতর বারান্দায় চেয়ারের ওপর বসে আর সামনের ছোট টেবিলের ওপর এক পেয়ালা চা রেখে যখন চুপ করে বসে থাকে চিত্রা, তখন যেন ঘরের ভেতরে থেকেও চিত্রার চোখ দুটোকে দেখতে পায় নিখিল। চিত্রার চোখ দুটো যেন উদাস হয়ে কুয়োতলার পেয়ারা গাছটার ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে এসে দেখতেও পায় নিখিল, তার ধারণা মিথ্যে নয়। চিত্রার চা জুড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু চায়ের কাপের দিকে চোখ নেই চিত্রার। অন্যমনা হয়ে কি যেন ভাবছে চিত্রা।
নিখিল আর তার নিজেরই হাতের চায়ের কাপে চুমুক দিতে পারে না।—তোমার চা যে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
নিখিলের কথায় চিত্রার স্তব্ধ হাতটার শুধু চমক ভাঙে। চায়ের কাপ হাতে তুলে নেয় চিত্ৰা। কিন্তু একজন যে হঠাৎ এসে চা খাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিল, সেটা চিত্রা বুঝতেও পারে কি না সন্দেহ। নিখিলের মুখের দিকে তাকায় না চিত্রা। একটা কথা বলবার জন্যও কোন সাড়া জাগে না চিত্রার দুই ঠোঁটে, রক্তগোলাপের আভা দিয়ে আঁকা দুটি ঠোঁট।
এক-একদিন মাঝরাতেই নিজের ছোট ঘর থেকে ব্যস্তভাবে চিত্রার ঘরে ঢোকে নিখিল। ঘুমিয়ে আছে চিত্রা, কিন্তু যেন একটা দুঃখের স্বপ্ন দেখে বিড়বিড় করছে চিত্রা। অস্পষ্ট সেই স্বপ্নাতুর ভাষার মধ্যে যেন অভিমানের মত একটা বেদনা বিড়বিড় করে। পাখা হাতে নিয়ে ঘুমন্ত চিত্রার মাথায় কিছুক্ষণ বাতাস দিয়ে চলে যায় নিখিল।
পরদিন কথায় কথায় নিখিল তার মনের উদ্বেগ প্রকাশ না করে দিয়ে পারে না।—কাল ঘুমের মধ্যে তুমি বড় কষ্ট পেয়েছ।
চুপ করে থাকে চিত্রা, কোন উত্তর দেয় না, আর নিখিলের মুখে এই ধরনের কথাগুলি শুনতে, ভালও লাগে না।
বোধ হয় স্বপ্নের কথাগুলিই মনে পড়ে যায়, তাই। যেন ঘুমের মধ্যেই বড় স্পষ্ট করে দেখতে পায় চিত্রা, নিজেকে আর নিজের মনটাকেও। শাড়িতে আর বেণীতে স্টাইল আছে, মনের শখ-সাধ আর কল্পনাগুলির মধ্যেও স্টাইল আছে, কিন্তু এই স্টাইলগুলিই কি তার জীবনের একমাত্র কাম্য ছিল? বোধ হয় না। ঘুমের মধ্যেই নিজের সাদা-মাটা মনটাকে যেন দেখতে পায় চিত্রা, আর বুঝতে পারে, মনের মত স্বামীর গর্বে গরবিনী হবার একটা আকাঙক্ষা শুধু পড়ে আছে সেখানে। সে আকাঙক্ষা পাথর-চাপা পড়ে এখনো রয়েই গিয়েছে তার পাঁজরের আড়ালে এক কোণে।
নিখিলের কথা শুনে চুপ করে থাকে চিত্রা। বলতে ইচ্ছা করলেও বলে না ; আমার স্বপ্নের খোঁজ নেবার জন্য তোমার আবার এত গরজ কেন?
স্বামীর পরিচয় চিত্রার জীবনে কোন গর্ব আনেনি, আনবেও না কোনদিন। তার জীবনের এই শূন্যতা একটা চিরকেলে শ্মশানের মত মনের মধ্যে জ্বলত, যদি বিনায়ক সরকারের সঙ্গে দেখা না হত একদিন, এক গানের সভায়। চিত্রা জানে, ভাগ্য তাকে অন্তত এইটুকু কৃপা করেছে, অন্তত এইটুকু গর্ব এনে দিয়েছে চিত্রার মনে, বিনায়কের মত মানুষও দুঃখ পায় মনে মনে, চিত্রার মত মেয়েকে জীবনে সঙ্গিনী করতে পারেনি বলে। গর্ব তো বটেই, মৃদুলা সরকারের মত লেডি যার স্ত্রী, সেই বিনায়কও আজ চিত্রাকে পাশে নিয়ে ইউকালিপটাসের ছায়ায় দাঁড়াতে পারলে সুখী হয়ে যায়। হরিনগর কলোনিতে এসে চার বছরের মধ্যেই চিত্রার চোখের বিদ্যুৎ জয়ী হয়েছে। যে-মানুষকে দেখে হাজার মানুষ প্রতিদিন সেলাম, আদাব ও নমস্তে জানায়, যে-মানুষের মুখের দিকে অনেক লেডিই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, যে-মানুষের সঙ্গে সস্ত্রীক অন্তরঙ্গ হবার জন্য অনেক কন্ন্ট্রাক্টর অনেক চেষ্টা করে, সেই মানুষ, সেই বিনায়ক সরকার শুধু বলে, এইবার শুধু তুমি আর আমি চিত্রা, আর কেউ নয় ; মাঝে মাঝে এই আলো আর ধোঁয়ার ভিড় থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে শালবনের কিনারায় ছোট্ট একটি জলস্রোতের কাছে····
হ্যাঁ, তাই হবে। তাই বিনায়কের চিঠির উত্তর দিয়েছে চিত্রা। অনেকবার এই আহ্বানের ভাষা বুকে লুকিয়ে নিয়ে চিত্রার কাছে এসেছে বিনায়কের অনেক চিঠি। আজ প্রথম উত্তর দিল চিত্রা। কারণ, চিত্রার মনে আর কোন প্রশ্ন নেই।
সন্ধ্যার জন্য বিকেল থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিল চিত্রা। আর সন্ধে হবার আগেই বিনয়কের কাছ থেকে চিঠির উত্তর নিয়ে অফিস থেকে বাসায় ফিরলো নিখিল।
জানিয়েছে বিনায়ক, সুখী হলাম চিঠি পেয়ে। আজ আমার সরকার অ্যাণ্ড সিন্হার সিল্ভার জুবিলি। কিন্তু তুমি বুঝবে চিত্রা, আজ আমার জীবনেরই এক তৃপ্তির জুবিলি। কারণ চিঠিতে তোমার মন চিনতে পারলাম, এই প্রথম। গাড়ি যাবে।
চিঠি পড়ার পর চিত্রার চোখে পড়ে, নিখিলের হাতে আর একটি চিঠি রয়েছে। সোনালি অক্ষরে ছাপানো একটি কার্ড।
চিত্রা—ওটা কি?
নিখিল—নেমন্তন্নের কার্ড।
চিত্রা—কার নেমন্তন্ন?
নিখিল—মিস্টার ও মিসেস নিখিল রায়ের।
চিত্রা—তার মানে?
নিখিল—সরকার অ্যাণ্ড সিন্হার সিলভার জুবিলি আজ। সরকার ভিলাতে ককটেল পার্টি আছে। নেমন্তন্ন করেছেন মিস্টার সরকার।
চিত্রা—তোমাকেও?
নিখিল—হ্যাঁ, তাই তো নিয়ম।
চিত্রা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তার পরেই যেন নিজের মনেই বিড়বিড় করে—নিয়ম তো আছে জানি। কিন্তু…।
কিন্তু আর এই নিয়মের অর্থ খুঁজে বের করার কোন অর্থ আজ আর নেই। বেশিক্ষণ অপেক্ষাও করতে হয় না চিত্রাকে। বড়সাহেবের চকচকে টুরার পৌঁছে যায় হেডক্লার্কের কোয়াটারের সম্মুখে। একই সঙ্গে পাশাপাশি হেঁটে গাড়ির ভেতরে গিয়ে উঠে বসে নিখিল আর চিত্রা, মিস্টার ও মিসেস রায়, স্বামী আর স্ত্রী।
গাড়িতে শান্তভাবেই বসে রইল চিত্রা, কিন্তু রাগ হয় বিনায়কের ওপর। আজ এত স্পষ্ট করে জানতে পেরেও এরকম ব্যবস্থা করলো কেন বিনায়ক? চিত্রা রায়ের জীবনের প্রথম প্রণয়ের অভিসারে নিখিল রায় নামে লোকটিকে চিত্রার সঙ্গে কেন যেতে বললো বিনায়ক? বিনায়ককে চিঠি দেবার সময় হাত কাঁপেনি যার, সেই শক্ত মনের চিত্রা রায়ও তার পাশের এই তুচ্ছ একটা অস্তিত্বকে সহ্য করতে কেমন অস্বস্তি বোধ করে।
কিন্তু সব অস্বস্তি মুহুর্তের মধ্যেই দূর হয়ে গেল। ইউকালিপটাসের পাশে মস্ত বড় শামিয়ানা টাঙানো আর আলোয় আলোকিত আসর। চকচকে টুরার যেন একেবারে এক নতুন জগতের সিংহদ্বারে নিয়ে এসে পৌঁছে দিল চিত্রাকে। এগিয়ে এল বিনায়ক, আর বিনায়কের অভ্যর্থনার হাতে হাত দিতেই ঝলক দিয়ে হেসে উঠলো চিত্রার চোখের বিদ্যুৎ।
যেন ছোট ছোট কুঞ্জ দিয়ে সাজানো ছোট একটা জগৎ। প্রতি কুঞ্জের ফুলের স্তবকের মধ্যে বিদ্যুতের রঙিন বাতি জ্বলে। প্রতি কুঞ্জে একটি করে টেবিল আর দুটি চেয়ার। একদিকে নাচের আসর তৈরি করা হয়েছে। ছোট একটি ডায়াস, তার দু পাশে বসে জ্যাজ বাজায় কলকাতার বিলিতি হোটেল থেকে ভাড়া করে আনাননা গোয়ানীজ বাদকের দল।
বিনায়ক সরকার তার হাসিভরা মুখ চিত্রার কানের কাছাকাছি এনে তার জীবনের পরম তৃপ্তির সিলভার জুবিলির অর্থ বুঝিয়ে দেয়।—আজ এই উৎসবের এক কোণে এক টেবিলের পাশে শুধু তুমি আর আমি। আজ পৃথিবী জানবে, তুমিই আমার আপন-জন হয়ে গিয়েছ চিত্রা।
চিত্রার হাসিতে বিদ্যুৎ খেলে যায়।—তাই বলো। আমি ভুল বুঝে তোমার ওপর রাগ করেছিলাম।
বিনায়ক হাসে—আমাকে এখনো ভুল বুঝবে তুমি?
চিত্রা—না, আর কখনো না।
জ্যাজ বাজে মত্ত হয়ে। গেলাসে গেলাসে শেরি আর হুইস্কির পেগ ট্রের উপর সাজিয়ে নিয়ে ছুটাছুটি করে বয় আর বাটলার। সরকার অ্যাণ্ড সিনহার সিলভার জুবিলি বিহ্বল ও উচ্ছল হয়ে ওঠে মদিরতায়। গেলাস হাতে নিয়েই কোন সজ্জন উঠে দাঁড়ান আর টলতে টলতে আর এক টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ান। ওয়েলকাম জানিয়ে সেই টেবিলের সজ্জন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। আর সেই চেয়ারের লেডি খিলখিল করে হেসে ওঠেন।
জ্যাজ বাজে আরও প্রমত্ত হয়ে। অভ্যাগতা লেডিদের শেরিসিক্ত ওষ্ঠে লিপস্টিকের রঙও লাস্যে তরল হয়ে ওঠে। এক একটি টেবিলে এক একটি বিহ্বল যুগলমূর্তি। মিসেস ফর্দুনজীর টেবিলের কাছে উঠে এসে বসেন মিস্টার চৌধুরী। মিসেস চৌধুরী এই টেবিল আর সেই টেবিলের এক এক দম্পতির সঙ্গে হাস্যালাপ বিনিময় করতে করতে গিয়ে বসেন মিস্টার পাত্রের পাশে শূন্য চেয়ারে। দেখা যায়, আসরের ঐ দিকে মিস্টার চ্যাটার্জির সঙ্গে আলাপ করছেন মিসেস পাত্র।
আর চিত্রা বসে থাকে আসবের প্রায় মাঝখানে নীল আলোকের এক স্তবকের কাছে একটি টেবিলে, বিনায়ক সরকারের পাশে।
আর এই নতুন জগতের ভিড়ের মধ্যে কে জানে কোথায় হারিয়ে গেল নিখিল রায়, চিত্রা রায়ের স্বামী মিস্টার বায়!
জানে না চিত্রা, দেখতেও চায় না চিত্রা, আজ তার এই জীবনান্তরের শুভক্ষণে পিছনের কোন মিথ্যা ছায়ার বাধাও আর রাখতে চায় না চিত্রা। পৃথিবীর সব চক্ষুর সম্মুখেই বিনায়কের পাশে বসে চিত্রা আজ অকুণ্ঠচিত্তে জানিয়ে দিতে চায়, সে আজ বিনায়কেরই জীবনের সঙ্গিনী।।
পরিশ্রান্ত জ্যাজ থামে কিছুক্ষণের জন্য। তার পরেই সারা আসর যেন সম্মিলিত কণ্ঠে হুর্রে জানিয়ে অভ্যর্থনা করে এক অতি মাননীয়া আগন্তুকাকে।
চিত্রা জিজ্ঞাসা করে—ইনি কে?
বিনায়ক হাসে—মৃদুলা।
চমকে ওঠে চিত্রা।—মৃদুলারও কি এখানে আসবার কথা ছিল?
বিনায়ক—ছিল বই কি।
চিত্রা—আমাকে তো বলেনি যে, মৃদুলা আসবে এখানে!
বিনায়ক—এর মধ্যে বলবার কি আছে? এটা তো সাধারণ একটা নিয়ম।
চিত্রার মনের প্রথম চমকানি শান্ত হবার পর বুঝতে পারে চিত্রা, হ্যাঁ, এটা তো সাধারণ নিয়ম। সে নিজেও সেই নিয়মেই এখানে এসেছে।
এই টেবিল থেকে ও টেবিল, তারপর আর এক টেবিল, শেরিতে উৎফুল্ল এক-একটি মুখের আনন্দধ্বনিকে যেন বিনম্র ভঙ্গীতে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে আপ্যায়িত করে ঘুরতে থাকেন মৃদুলা সরকার। বিরাট একটি জড়োয়া নেকলেস মৃদুলার গলা জড়িয়ে রয়েছে। ব্রোকেডের একটি স্কার্ফ এলোমেলো হয়ে লুটিয়ে রয়েছে কাঁধের আর পিঠের ওপর। পা টলছে মৃদুলা সরকারের। মৃদুলার এত জমকালো করে সাজানো চেহারাটা কেমন যেন আলুথালু আর উদ্ভ্রান্ত। শুধু একজোড়া ডাগর চক্ষু এদিক-ওদিক তাকিয়ে মাঝে মাঝে কট্কট করে হেসে ওঠে।
নিজের কানেই শুনতে পায় চিত্রা, তার কাছের টেবিলের এক অতিথি তার পার্শ্ববর্তিনীকে বলছেন, মৃদুলা সরকার আজ সকাল থেকে শেরিতে ভাসছেন বলে মনে হচ্ছে?
চিত্রা তাকায় বিনায়কের মুখের দিকে।—মৃদুলার কি হয়েছে বল তো? ও-রকম করছে কেন?
বিনায়ক বলে—চিরকাল যা করে এসেছে, তাই করছে।
চিত্রা—কি?
বিনায়ক—টিপ্সি, মাত্রা বেশি হয়ে গিয়েছে।
আলোর আসরের মধ্যে একটা অন্ধকার যেন ধুকপুক করে উঠলো। এ কি কথা বলছে আজ বিনায়ক তার নিজের মুখে? এই কি বিনায়কেরই গল্পের সেই পতিব্রতা প্রেমিকা স্ত্রী মৃদুলা সরকার?
চিত্রা বলে—তোমার কথা শুনে মৃদুলার সম্বন্ধে আমার অন্যরকম ধারণা হয়েছিল।
বিনায়ক—কি ধারণা হয়েছিল?
চিত্রা—মনে হয়েছিল এইসব শেরিটেরির মানুষ মৃদুলা নয়।
বিনায়ক—শেরি সম্বন্ধেই তোমার মনে ভুল ধারণা রয়েছে ডিয়ার চিত্রা!
চিত্রার মুখের দিকে অদ্ভুত এক অলসভঙ্গীতে তাকিয়ে কথা বলে বিনায়ক। আর বিনায়কের অনুরোধে শেরির গেলাসে চুমুক দিতে গিয়েই থেমে যায় চিত্রা। মনে হয় চিত্রার, শেরির নেশায় টলমল দুটি চক্ষুর দৃষ্টি দিয়ে আর বাঘিনীর মত দুর্দান্ত একটা আগ্রহ নিয়ে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে মৃদুলা সরকার। কটকট করে হেসে উঠছে মৃদুলার চোখ।
দেখতে নেহাত অসুন্দর তো নয় মৃদুলার মুখ, নিজের রূপ সম্বন্ধে চিত্রার মনের ধারণায় যথেষ্ট অহঙ্কার থাকলেও মৃদুলাকে সুন্দর বলেই স্বীকার করতে পারে চিত্রা।
যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল চিত্রা। জ্যাজের শব্দে চমক ভাঙে, আর দেখতে পায়, দূরে দাঁড়িয়ে আসরের মাঝখানে এই টেবিলের দিকেই তাকিয়ে কটকট করে হাসছে মৃদুলার দুই চক্ষু।
থরথর করে কেঁপে ওঠে চিত্রা। প্রশ্ন করে চিত্রা।—মৃদুলা এখানে এসে বসবে নাকি?
বিনায়ক—ওগো না, না, না।
কিন্তু একটা ভয়ের শিহরন যেন ধীরে ধীরে চিত্রার শরীরের রক্তে ঠাণ্ডা সাপের মত সিরসির করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিনায়ক সরকারের পরিণীতা স্ত্রীর এ কি জীবন! বেশ তো অদ্ভুত রকমের উজ্জ্বল জীবন। আলোর মেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে কটকট করে হাসছে যার চোখ।
এদিকে আসে না, ওদিকেই ঘুরে বেড়ায় মৃদুলা। তবু দেখতে ভয় করে চিত্রার, বিনায়কের মত মানুষের পরিণীতা প্রেমিকা হয়েও এরকম হয়ে গেল কেন মৃদুলা? এই কি নিয়ম?
কি যেন সন্ধান করে ফিরছে মৃদুলা। আর টেবিলের পর টেবিলের ছায়া পার হয়ে চলে যাচ্ছে আসরের একেবারে শেষে, একেবারে শামিয়ানার রঙিন ঝালরের গা-ঘেঁষা ছায়া-ছায়া একটি নিভৃতের একটি টেবিলের কাছে।
পাথরের চোখের মতই স্তব্ধ আর অপলক হয়ে তাকিয়ে থাকে চিত্রার চোখ। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখতে থাকে চিত্রা, সুন্দর ব্রোকেডে জড়ানো একটি বাঘিনীর কৌতুহল যেন এতক্ষণে শিকারের সন্ধান পেয়েছে। একটি টেবিলের পাশে মাত্র বসেছিল একজন, তারই পাশে গিয়ে বসলো মৃদুলা। ঢিপ্ করে একটা শব্দ যেন হঠাৎ বেজে উঠলো চিত্রার বুকের ভেতর। ওখানে কেন মৃদুলা? ঐ নিরীহ নির্বোধ মানুষটার কাছে কেন মৃদুলা? হেডক্লার্ক নিখিল রায়ের সঙ্গে আলাপ করে কি লাভ হবে মৃদুলার?
বিনায়ক ডাকে—চিত্রা।
শুনতে পেয়েও মুখ ফিরিয়ে বিনায়কের দিকে তাকায় না চিত্রা। যেন সুদূর এক সংসারের রঙ্গমঞ্চের দিকে এক অদ্ভুত অদৃষ্টের খেলা দেখবার জন্য তাকিয়ে আছে চিত্রা। দেখতে পায় চিত্রা, বয়ের হাতের ট্রে থেকে দুটি গেলাস তুলে নিল মৃদুলা। একটি নিজের কাছে রেখে, আর একটি গেলাস নিখিলের হাতের কাছে সমাদরের ভঙ্গীতে এগিয়ে দেয় মৃদুলা।
—সাবধান! চিত্রার মুখ থেকে যেন তার এই মুহূর্তের অসাবধান মনের এক নতুন দুর্বলতার সুযোগ পেয়ে চমকে উঠলো ছোট্ট একটা অস্ফুট কথা।
বিনায়ক বলে—তুমি এদিকে ঘুরে বসো চিত্রা।
জ্যাজ বাজে মত্ত হয়ে। নাচের আসরে দশজোড়া মূর্তি দুলে দুলে পা ফেলে। কিন্তু চিত্রার মনের চাঞ্চল্য যেন হঠাৎ মূর্ছিত হয়ে পড়েছে, কোন ভাষা আর বাজনার স্বর কানে আসছে না চিত্রার। মনে হয় শুধু, আসরের শেষ দিকে শামিয়ানার ঝালরের কাছে একটা শিশুর বুক একা দেখতে পেয়ে এক বাঘিনী গিয়ে সম্মুখে বসেছে লুব্ধ হয়ে। শেরির নেশায় তৃপ্ত হয়নি মৃদুলা, আরও কিছু খুঁজছে মৃদুলা।
—নো লাইট, ওয়ান মিনিট! কে যেন চেঁচিয়ে ফুর্তির মাথায় হাঁক দিল, সঙ্গে সঙ্গে আসরের সব আলোক যেন একটি ফুৎকারে নিবে গেল।
—এ কি! সেই মুহূর্তে চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায় চিত্রা। হঠাৎ ভীত একটা পাখির আর্তনাদের মত করুণ চিত্রার গলার সেই শব্দ। হঠাৎ অন্ধকার যেন চিত্রার বুকের ওপর তীক্ষ্ণ একটা ছুরির আঘাতের মত লাফিয়ে পড়েছে। চেয়ার থেকে উঠে, যেন ছুটে যাবার জন্যই অন্ধকারের মধ্যে পথ খোঁজে চিত্রা।
বিনায়ক হেসে ওঠে—আঃ, বসো চিত্রা। ম্যানারস্ ভুলে যেও না।
পথ না পেয়ে, আর যেতে না পেরে অন্ধকারের মধ্যেই থমকে দাঁড়িয়ে আসরের শেষ প্রান্তের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে চিত্রা। ঝন্ করে আর্তনাদ করে সশব্দে একটা কাঁচের গেলাস যেন চূর্ণ হলো কোথাও। দপ করে জ্বলে ওঠে আলো।।
এই কয়েকটি মুহূর্তের অন্ধকারে আসরের মধ্যে যেন একটা নাটক চমকে উঠেছিল, তারই চিহ্ন দেখা যায় আসরের দু জায়গায়। ভীত ও উদ্ভ্রান্ত দুটো চক্ষু নিয়ে চিত্রা রায় দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মূর্তির মত আসরের শেষ প্রান্তের এক টেবিলের দিকে তাকিয়ে। আর শেষ প্রান্তের টেবিলের কাছে একটি চেয়ার থেকে যেন হঠাৎ এক রূঢ় আঘাতে উল্টে পড়ে গিয়েছে মৃদুলা সরকার। মৃদুলার গেলাস হাত থেকে ছুটে গিয়ে দূরে পড়েছে, আর চুর্ণ হয়ে গিয়েছে।
তাকিয়ে থাকে চিত্রা রায়ের পাথরের মত স্তব্ধ দুটি চক্ষু। তার পর ধীরে ধীরে বিচিত্র এক হাসির জ্যোৎস্না যেন ফুটে উঠতে থাকে সেই চক্ষে। আসরের সব চক্ষু তাকিয়ে দেখে, সত্যিই এক গরবিনী রাজেশ্বরীর মত ভঙ্গী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা রায়।
হ্যাঁ, গর্ব ছাড়া আর কি? বাঘিনীর আগ্রহ অন্ধকারের সুযোগে মত্ত হয়ে ছুঁতে গিয়েছিল চিত্রা রায়ের স্বামীকে। ভুল করেছে মৃদুলা, বুঝতে পারেনি মৃদুলা, চিত্রা রায়ের স্বামী বড় কঠিন স্বামী।
বিনায়ক ডাকে—এসে বসো চিত্রা।
—হ্যাঁ, বসছি। হেসে হেসেই বিনায়কের আহ্বানে সাড়া দেয় চিত্রা।
কিন্তু এই অন্ধকারে-ভরা কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে নতুন কোন্ গর্ব পেয়ে গেল চিত্রা, যার জন্য এমন করে বিনায়কের দিকে করুণার চক্ষে তাকিয়ে স্বচ্ছন্দে অবাধে নিঃসঙ্কোচে আর মুখর হয়ে হেসে চলেছে চিত্রা!
বোধ হয়, চিত্রাই তখনো বুঝতে পারেনি যে, তার জীবনের সকল ক্ষোভের গভীরে লুকানো সেই বেদনার বিদ্যুজ্জ্বালা হারিয়ে একেবারে স্থির হয়ে গিয়েছে। জ্যাজ বাজে মত্ত হয়ে, নাচের আসরে জোড়া জোড়া নৃত্যপর মূর্তির ছায়া দোলে। চুপ করে, নিজের বুকের ভেতরের অদ্ভুত এক প্রসন্নতার ভারে অলস ও স্নিগ্ধ হয়ে চেয়ারের ওপর বসে থাকে চিত্রা।
আবার নো লাইট। দপ্ করে নিবে গেল সব আলোক।
সঙ্গে সঙ্গে একটা কাঁচের গেলাস চূর্ণ হয়ে যায় অন্ধকারে, একটি চেয়ার উল্টে পড়ে যায়, অন্ধকারের স্পর্ধা দুই হাতের ঘৃণাকঠিন একটি ধাক্কায় শেষবারের মত ধূলিসাৎ করে দিয়েছে চিত্রা রায়।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে চিত্রার দেহ। যেন তার দুঃস্বপ্নমুক্ত জীবনই এতক্ষণে এক গর্বের আবেশে কাঁপছে।
দপ্ করে জ্বলে ওঠে আলো। সারা আসরের চক্ষু দেখতে পায়, বিনায়ক সরকার চেয়ার থেকে উল্টে পড়ে গিয়েছেন, আর তাঁরই হাতের গেলাস ছিটকে পড়ে গিয়ে চূর্ণ হয়েছে।
আসরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শামিয়ানার শেষ প্রান্তের ঝালরের দিকে ছায়া-ছায়া এক নিভৃতে দাঁড়ানো একটি মূর্তির দিকে তাকিয়ে হাত তুলে আহ্বান জানায় চিত্রা।—এস।
সারা আসরের চক্ষু কিছুক্ষণের জন্য বিস্মিত অভিভূত ও একটু বিরক্ত হয়েই দেখতে পায়, আসর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এক ভদ্রলোক আর এক মহিলা। কি-রকম যেন ওদের দু’জনের চলবার আর তাকাবার ভঙ্গী। মনে হয়, একেবারেই ম্যানার্স জানে না।
১৩৬০ (১৯৫৩)