বত্রিশ নম্বর বিছানা – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
খবর পেয়েছি মাস্টারমশাই অসুস্থ, খুবই অসুস্থ। যাবো যাবো করে আর যাওয়াই হয় না। আসলে আর তেমন আকর্ষণ নেই আর কি। যখন গান শিখতুম, তখন একটু তালিম পাবার জন্যে, সকাল, বিকেল, সন্ধে হত্যা দিয়ে পড়ে থাকতুম। কোনও গানের মুখটা পেয়েছি, অন্তরাটা পাইনি, ঘুরে ঘুরে হয়রান হচ্ছি। ভীষণ মেজাজী মানুষ ছিলেন। অসম্ভব রাশভারী। আর তেমনি শৌখিন। জীবনে কোনও সময় কারুর সঙ্গে আপোস করেননি। বেতারে যে সময় প্রকৃত গুণীরা প্রকৃত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরিবেশন করতেন, যে সময় কলকাতা ‘ক’-তে রাত দশটার পর কখনও কখনও বড়ে গোলাম আলির কণ্ঠও শোনা যেত, তখন আমার ওস্তাদজীও বেতারশিল্পী ছিলেন। এক নম্বর শিল্পী। সেই সময় রেডিও এত সস্তা ছিল না। বেশ অর্থবান মানুষের বাড়িতেই বড় বড় ভালভ-সেট থাকত। ওস্তাদজীর গান আছে শুনলেই রাত দশটার সময় সব কাজ ফেলে ছুটতুম পাড়ার শেষ প্রান্তে গঙ্গার ধারে, জমিদার ঊষাপ্রসন্ন চৌধুরীর বাড়িতে। ভেতরে ঢোকার অনুমতি ছিল না। গেটের পাশে রাস্তার ধারে একটা ঘর ছিল। সেই ঘরে বাজত হল্যাণ্ডের বিশাল রেডিও। নিখুঁত গমগমে আওয়াজ। ঘর অন্ধকার, একটিমাত্র জানালা খোলা। সেই জানালার পাশটিতে চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনতুম। প্রথমে গম্ভীর ঘোষণা। তখন ঘোষক আকাশবাণী বলতেন না। বলতেন অল ইণ্ডিয়া রেডিও। সঙ্গীত পরিবেশন করছেন, শঙ্করনারায়ণ। পশ্চিমী শিল্পীদের ঢঙে মাস্টারমশাই চট্টোপাধ্যায় পদবীটা ত্যাগ করেছিলেন। রাগ মালকৌষ। তিন তাল। সঙ্গে সঙ্গে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। গুরুজী বলতেন, মালকোষ হল শ্মশানের রাগ। মধ্যরাতে সেইভাবে গাইতে পারলে ভূত নামে।
নির্জন রাস্তার ধারে, জমিদারবাবুর আউট হাউসের জানালা ঘেঁষে একা দাঁড়িয়ে আছি। পশ্চিমে গঙ্গা। ভূতুড়ে বাতাসের ডানা মাঝে মাঝে ঝাপটা মেরে যাচ্ছে। জমিদার-বাড়ির বিশাল বাগানে মেহগিনি গাছের ডালে পেঁচা ডাকছে থেকে থেকে। আর অসম্ভব সুরেলা গলায় মাস্টারমশাই গাইছেন, এ আয়ে পি মোরে মন্দারয়া। তবলায় আছেন কেরামতুল্লা খাঁ সায়েব। সারেঙ্গিতে সগিরুদ্দিন ওস্তাদ। তিনসপ্তকে গলা খেলছে আগুনের মত। অন্ধকার ঘরে কে বসতেন জানি না। মাঝে মধ্যে তাঁর তারিফ শুনতুম, আহা, আহা। যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতকে এমন জাতে ঠেলা হয়নি। শিল্পীকে অনেকটা সময় দেওয়া হত আলাপের বিস্তারের। খেয়ালের পর ঠুংরি হত। মাস্টারমশাই মিশ্র-গারায় ঠুংরি ধরেছেন, ‘অব না মানত শ্যাম’। গিরিজাবাবুর এক নম্বর ছাত্র ছিলেন। ঠুংরির সময় অদ্ভুত কায়দায় গলাটাকে ভেঙে সরু করে নিতেন। মিড় আর মোচড়ে পাগল করে ছেড়ে দিতেন। আমার মনে পড়ে ঠুংরি গাইবার সময় মাস্টারমশাইয়ের চোখ দিয়ে জল ঝরত। কেঁদে ফেলতেন। চোখের সামনে যেন দেখতে পেতেন, রাধাকৃষ্ণের মান-অভিমানের পালা। শ্রোতাকেও দেখিয়ে ছাড়তেন। বেশ মনে পড়ে, মাস্টারমশাই নিজের ঘরটিতে বসে ঠুংরি গাইছেন। ঘর অন্ধকার। আমরা কয়েকজন কার্পেটের ওপর বসে আছি ছাড়া ছাড়া। অদ্ভুত ভালো, সাড়ে তিন অক্টেভের, স্কেলচেঞ্জ, কাপলার হারমোনিয়াম ছিল তাঁর। মাদার অফ পারলসের কাজ করা। তাঁর কাছে এই হারমোনিয়ামটি ছিল সন্তানের চেয়ে প্রিয়, দেবতারও অধিক। কারুর হাত ঠেকাবার উপায় ছিল না। সিল্কের রুমাল দিয়ে থেকে থেকে পরিষ্কার করতেন। সব সময় ঝকঝক করছে। ঢাকনার ওপরে, পাশে রুপোর সূক্ষ্ম কাজ। গুরুজী গাইছেন মিশ্র খাম্বাজে ঠুংরি ‘কৌন গলি গয়ো শ্যাম’। কিছুক্ষণের মধ্যে সারা ঘরটা যেন। উড়ে চলে যেত বৃন্দাবনে। মনে হত, চাঁদনী রাতে নির্জন যমুনার ধারে বসে আছি। অলৌকিক সব ক্ষমতা ছিল তাঁর। কতদিন আমরা নূপুরের শব্দ শুনেছি। শুনেছি চুড়ির শব্দ। এই নিয়ে আবার মাস্টারমশাইয়ের সামনে আদিখ্যেতা করার উপায় ছিল না। ভীষণ অসন্তুষ্ট হতেন। বলতেন, যে-কোনও মানুষ সুরে সিদ্ধ হলে ও-সব হয়। এ-সব হইচই করার ব্যাপার নয়। প্রচারেরও প্রয়োজন নেই। সঙ্গীত ঈশ্বর-উপাসনার মাধ্যম। শ্রোতা ঈশ্বর।
একদিনের ঘটনা। প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের পুরনো এক বাগানবাড়িতে গুরুর গুরু এসেছেন। ওস্তাদ দিলীপচাঁদ বেদী। গুরুজী আমাকেও নিয়ে গেছেন সঙ্গে। বিশাল ফরাসপাতা ঘরে গুরু-শিষ্যে মিলন। মনে হয় বহুদিন পরে। সেই দেখেছিলাম গুরুভক্তি কাকে বলে। সন্ধে হয়ে গেছে। বেদীজী মনে হয় রেওয়াজ করছিলেন। আমরা বসলাম একপাশে। গুরুর গুরু বললেন, ‘দেখি একটু শোনাও। রেওয়াজ কেমন চলছে দেখি।’
মাস্টারমশাই প্রণাম করে গুরুর অনুমতি নিয়ে মারু বেহাগে ধরলেন, ‘কাল নহি আয়ে’। বেদীজী ধরলেন তবলা। এক তালে চলেছে। মাস্টারমশাই বিভোর হয়ে গেছেন। দু চোখ বোজানো। মাঝে মাঝে যখন খুলছেন চোখ দুটো জলে টলটল করছে। কি ভীষণ অভিমান, কাল নহি আয়ে। বেদীজীও বিভোর। নিমেষে দু’জন মানুষ কোন জগতে চলে গেলেন! শুধু গেলেন না, যাবার সময় পুরো ঘরটাকে তুলে নিয়ে গেলেন।
হঠাৎ কি খেয়াল হল, মাস্টারমশাইয়ের পিঠের দিকে তাকালাম। দেখি, ধবধবে ফরাসের ওপর মাস্টারমশাইয়ের সিল্কের পাঞ্জাবির নিচের অংশ পড়ে আছে, আর তার ওপর স্থির হয়ে শুয়ে আছে, আট-দশ ইঞ্চি লম্বা আর সেই অনুপাতে চওড়া লাল টকটকে একটা তেঁতুলে বিছে।
তেঁতুলে বিছে মোটেই সুশ্রী নয়। এখনকার কালের ঘড়ির চওড়া স্টিল-ব্যাণ্ডের মতো। গেঁটে গেঁটে। দেখলেই শরীর হিম হয়ে যায় ভয়ে।
আমি চিৎকার করে উঠলুম, ‘গুরুজী বিছে। আপনার পাঞ্জাবির ওপর বিছে।’
বেদীজী তাকালেন, তাকিয়ে হাসলেন।
মাস্টারমশাই একবার মাত্র তাকালেন। দৃষ্টিতে আগুন। ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
গান চলতে লাগল। বিছে শুয়ে রইল পাঞ্জাবির ওপর। আর আমি সিঁটিয়ে রইলুম ভয়ে। দেড়ঘণ্টা পরে গান থামল। সারা ঘর সুরে কাঁপছে। শেষটায় বিছেটিছের কথা আমারও মনে ছিল না। হঠাৎ বিছেটা পাঞ্জাবি ছেড়ে উঠে এল। নেশায় যেন টলছে। চলতে পারছে না। একপাশ দিয়ে গুটি গুটি চলে এল একেবারে আসরের মাঝখানে। দুই গুণীকে যেন প্রণাম জানাতে এসেছে।
বেদীজী বললেন, ‘কি এখনও তোমার মন ভরেনি। তাহলে আর একটু শোনো।’
বেদীজী ধরলেন গান, আমার মাস্টারমশাই ধরলেন তবলা।
বেদীজী গাইলেন বাগেশ্রী, ‘বিরাহা না জ্বালা’। দু’জন সাধক-শিল্পী। শ্রোতাও দু’জন। আমি আর একটা টকটকে লাল তেঁতুলে বিছে।
গুরুর কৃপায় গান শিখতে না পারি, সুরের কান তৈরি হয়েছে। আর এই বোধ হয়েছে, সুর দিয়ে তাঁর চরণ যত সহজে ছোঁয়া যায়, অন্য কোনও সাধনা দিয়ে অত সহজে ছোঁয়া যায় না। তবে একটা কথা—সঙ্গীত নিয়ে ব্যবসা করলে শাপভ্রষ্ট হতে হয়।
মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে রেডিওর গোলমাল হয়ে গেল। হঠাৎ কর্তৃপক্ষ বললেন, গ্রেড ঠিক করার জন্যে পরীক্ষা নেওয়া হবে আবার। মাস্টারমশাই প্রশ্ন করলেন, কে নেবে সেই পরীক্ষা? কর্তৃপক্ষ বললেন, প্যানেল আছে। মাস্টারমশাই বললেন, সেই বিচারকগোষ্ঠীতে তো আমার থাকা উচিত। নিজেই নিজের পরীক্ষা কিভাবে নোবো!
ফর্ম ফেরত দিয়ে চলে এলেন। জীবনে আর কখনও ও-তল্লাট মাড়াননি।
অনেকে বললেন, তেমন অর্থ না থাক প্রচার তো ছিল। এত অহঙ্কার কি ভালো!
মাস্টারমশাই বলেছিলেন, অহঙ্কার নয়, অন্যায় আর অপমানের প্রতিবাদ। জাতশিল্পী না খেয়ে মরবে তবু অর্থ আর প্রতিপত্তির কাছে মাথা নোয়াবে না।
গুরুজীর কাছে একদিন এক বড়লোক এলেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে। মেয়ে গান শিখবে। খুব সেজেগুজে, নানারকম গয়নাটয়না পরে এসেছে। কোনও এক ওস্তাদের কাছে গান শিখত আগে। গা দিয়ে ভুরভুর করে সেন্টের গন্ধ বেরুচ্ছে।
মাস্টারমশাই একপলক তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এর গান হবে না। আপনি বরং নাচটাচ শেখান।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘কেন কেন?’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘এর চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। যে-বিনয় থাকলে কিছু শেখা যায় সেই বিনয়টাও এর নেই।’
‘কেন মাস্টারমশাই?’
‘আমাকে প্রণাম করেছে? আপনি,ওকে প্রণত হতে শিখিয়েছেন কোনওদিন? এই তো ঘরে আমার আরও তিনজন ছাত্রী বসে রয়েছে, কেউ ওর মতো সেজেছে? অসভ্যের মতো সেন্ট মেখেছে? শুনুন, অর্থ দিয়ে সঙ্গীত কেনা যায় না। সাধনা দিয়ে বরণ করতে হয়।’
ভদ্রলোক চলে যেতে যেতে বললেন, ‘আমি পশ্চিমা ওস্তাদ রেখে মেয়েকে গান শেখাবো, আর আপনি যদি বেঁচে থাকেন দেখিয়ে যাবো, ও আপনার চেয়েও বড় শিল্পী হয়েছে।’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘হলে আমি খুশি হবো। তবে হবে না।’
সেই ভদ্রলোক পরে অর্থ আর প্রতিপত্তির জোরে মাস্টারমশাইয়ের পয়লা নম্বর শত্রু হয়েছিলেন। অমুকের ছাত্রী এই সুবাদে মেয়েকে দিয়ে বড় বড় কনফারেন্সে গান গাইয়েছেন। রেকর্ড বের করিয়েছেন পয়সা দিয়ে। অনেক চেষ্টা করেছেন, হয়নি কিছুই। আর যতই কিছু না হচ্ছে, সমালোচকরা,একেবারে তুলোধনে ছেড়ে দিচ্ছেন, ততই সেই ক্ষমতাশালী ভদ্রলোক, আর সেই কুৎসিত সুন্দরী, দু’জনে দু’রাস্তায় মাস্টারমশাইয়ের ক্ষতি করতে শুরু করলেন। ভদ্রলোক, ইংরেজিতে যাঁদের বলা হয় ‘ইনফ্লুয়েনসিয়াল’, সেই জাতের। রেডিওর সমস্ত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা আর মিটমাটের আশা ভেস্তে দিলেন। রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি বানচাল হয়ে গেল। ওই মেয়েটি জনে জনে বলে বেড়াতে লাগল, মাস্টারমশাই মদ্যপ এবং চরিত্রহীন। ছাত্রীদের সুযোগ পেলেই অন্যভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। সেই ইনফ্লুয়েনসিয়াল মানুষ ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে বড় বড় কনফারেন্স মাস্টারমশাইয়ের অংশ গ্রহণ বন্ধ করে দিলেন। মাস্টারমশাইয়ের ভ্রূক্ষেপ নেই। সারাদিন রেওয়াজ করছেন। গান লিখছেন। সুর দিচ্ছেন। আর সমঝদার কাউকে পেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেয়ে শোনাচ্ছেন, বিশুদ্ধ রাগরাগিণী। দেখাচ্ছেন সুরের সূক্ষ্ম প্রয়োগ। একেবারে আত্মভোলা শিল্পী। কে সংসার চালাচ্ছে, কিভাবে চলছে, বাইরের লোকের জানার উপায় ছিল না।
সেটা জানতেন তাঁর স্ত্রী। এই দুঃসময়ে তাঁর মুখের দিকে তাকালে মনে হত পাথরের মুখ দেখছি। স্থির দুটি চোখ। মুখে হাসি নেই, বিরক্তি নেই, কোনও ভাবই নেই। কাপের পর কাপ চা করে চলেছেন। মাস্টারমশাইয়ের প্রিয় খাদ্য ছিল পরোটা মাংস আর প্রতিদিনই তিন-চারজন অতিথি বাঁধা ছিল। কারুর না খেয়ে ফেরার উপায় ছিল না।
মাস্টারমশাইকে দেখে মনে হয়েছিল, বড় শিল্পীমাত্রেই শিশুর মতো। রাগের চেয়ে অভিমান বেশি। এই দেনাপাওনার পৃথিবীতে কে কার অভিমানের তোয়াক্কা করে! কার দায় পড়েছে গুণী শিল্পীকে বাড়ি বয়ে এসে সম্মান জানাবে! পাবলিসিটি আর ম্যানিপুলেশানের যুগ। মাস্টারমশাই এই সামান্য বৈষয়িক ব্যাপারটাই বুঝতে চাইলেন না। কেউ যদি বলতেন, সামান্য একটু কমারসিয়াল হও, মাস্টারমশাই তাঁর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিতেন।
একবার এক চিত্রপরিচালক মাস্টারমশাইকে সঙ্গীতপরিচালক করলেন। বহুকাল পরে বউদির মুখে হাসি ফুটল। হঠাৎ একদিন নির্জনে আমাকে বলে ফেললেন, ‘সুমন, এতদিন পরে একটু আশার আলো দেখা গেল। মিউজিক ডিরেক্টার কত টাকা পায় সুমন?’
‘হাজার পনেরো-কুড়ি নিশ্চয় দেবে।’
‘যাক তাহলে কিছু গয়না ছাড়িয়ে নেওয়া যাবে।’
অন্যমনস্ক বলে ফেলেই ভয়ে কিরকম বিবর্ণ হয়ে গেলেন। তারপর হঠাৎ আমার হাত দুটো ধরে বললেন, ‘সুমন, তোমাকে ভেতরের কথা কিছু বলে ফেলেছি ভাই, উনি যেন কোনও রকমে জানতে না পারেন। তাহলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে।’
একদিন গিয়ে দেখি, ঘরে যে বড় কাশ্মিরী কার্পেটটা পাতা থাকত, সেটা নেই। তার জায়গায় পাতা হয়েছে একটা জুট কার্পেট। এক ফাঁকে ভেতরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ‘বউদি, সেই সুন্দর কার্পেটটা?’
ছলছলে চোখে তাকালেন। কি ব্যাপার?
ব্যাপার শুনে স্তম্ভিত। সেই চিত্রপরিচালক হাজার পাঁচেক টাকা অ্যাডভান্স করেছিলেন। মাস্টারমশাই সিচুয়েশান বুঝে অনেক খেটে অসাধারণ সুর করেছিলেন। ডিরেক্টার, প্রডিউসার শুনতে এলেন। সঙ্গে এলেন শিল্পীরা, যাঁরা গাইবেন। কাপের পর কাপ চা, ভূরিভোজ। গান শুনে প্রডিউসার বললেন, ‘সুর আপনার ভালই হয়েছে, তবে বড় সেকেলে। এসব সায়গল-টায়গলের আমলে চলত। এখন মডার্ন জিনিস চাই। বেশ লাগাই। গান হিট না করলে ছবি ঝুলে যাবে। যে-গান সকলের মুখে মুখে ঘুরবে সেই গানই হিট গান। আপনি এক কাজ করুন, ভাল ভাল ইংরেজি গানের রেকর্ড শুনুন।’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘আর সেই সুরে বাঙলা শব্দ বসিয়ে যাই।’
‘এগজ্যাক্টলি।’
‘ও কাজটা আপনিই তাহলে করে নেবেন। মশা মারার জন্যে কামান দাগার প্রয়োজন কি? আপনার পেশাটা কি আলুর ব্যবসা। না মাছের ভেড়ি?’
রেগে গেলে নম্র, পরিহাসপ্রিয় মানুষটি কারুর তোয়াক্কা করতেন না। অসম্ভব দুর্মুখ হয়ে যেতেন। সেই পরিচালক ভদ্রলোক তাঁর প্রযোজককে নিয়ে সরে পড়লেন। মাস্টারমশাই ঘরের মূল্যবান কার্পেটটি বেচে পরিচালকের অ্যাডভান্স ফিরিয়ে দিলেন। শুধু কার্পেট বেচে হল না, স্ত্রীর একটি গহনাও বেচতে হল। বউদির মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। আবার সেই পাথরপ্রতিমা। পৃথিবীর যে অঞ্চলে ছ মাস রাত, সেখানে ছ মাস দিনও হয়। মাস্টারমশাইয়ের জীবনে একটানা রাতই বয়ে গেল। দিনের আলোর ঝিলিক আর দেখা গেল না।
অনেকেই উপদেশ দিলেন, ‘কিছু বড়লোক ছাত্রছাত্রী ধরুন। তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শেখান, তা না হলে বাড়িতে বসে গানের ক্লাস করলে, ছাত্রছাত্রীরা আসবে, দু-একমাস শিখবে, আর টাকা মেরে ফুড়ুত ফুড়ুত পালাবে। এই পণ্ডশ্রমের কোনও মানে হয় না।’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘গান আমি ফিরি করতে পারব না।’
মাস্টারমশাইয়ের প্রচার যত কমতে লাগল, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও তত কমে এল। খুবই স্বাভাবিক। গান আর ক’জন শিখতে চায়! সবাই চায়, নামী গুরুর গর্বে গর্বিত হতে। যারা কিছু শিখেছিল, তারা ঘর পাল্টাল। কিছু নতুন এসে জুটল, যাদের জীবনে গান হবে না। হবে কালোয়াতি অঙ্গভঙ্গী আর ভড়ং। মাস্টারমশাই তাদের অসাক্ষাতে বলতেন, ‘এরা আমার গলাকাটা চেলা। এ তানা যোবানাতেই যৌবন শেষ। ভূপালি ছেড়ে আর উঠতে হবে না।’
মাস্টারমশাই এই সময় অদ্ভুত এক কাণ্ড করলেন। অনিল মজুমদার ছিলেন মাস্টারমশাইয়ের গুরুভ্রাতা। অনিলবাবু সুকণ্ঠ আর সুঅভিনয়ের জন্যে সিনেমার নায়ক হয়েছিলেন। গোটা দুই ছবি দারুণ হিট করেছিল। নায়ক হবার গৌরবে বোতল ধরেছিলেন। ঘরে ঘরে তখন তাঁর ফিলমের গান রেকর্ডে বাজছে। বেশিরভাগই বিরহের গান। ক্লাসিক্যাল ভাঙা হালকা সুর। যে সুরে যে-গানের নাম রাখা হল রাগপ্রধান। যে ফুল ফুটিতে হায়, শুকায়েছে মূল। একটু বেশি সার পড়ে গেল গাছে। বোতলের নির্যাস। লিভার আর কণ্ঠ, দুটোই দেবে গেল। সেই সঙ্গে সে যুগের এক প্রখ্যাত চিত্র-কাহিনীকারের সংসর্গে নায়ক অনিলকুমার (সিনেমায় তিনি অবশ্য খুব একটা রোমাণ্টিক নামে পরিচিত হয়েছিলেন) মরফিনে অভ্যস্ত হয়েছিলেন। জীবন আর জীবিকা, দুটোরই খোলনলচে যখন প্রায় খুলে এসেছে, হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে, ঘোলাটে দুটো চোখ গভীর গর্তে অনিত্য জীবনের সন্ধানে ঢুকে গেছে, নায়কের আপেল-লাল গাল ভাঙা গটাপার্চার পুতুলের মতো তুবড়ে গেছে, তখন সেই নায়ককে একদিন সোনাগাছির এক রূপসীর বাড়ি থেকে বকেয়া মিটিয়ে উদ্ধার করে আনা হল। তিনি তখন কাকের গলায় কথা বলেন, কাকতাড়ুয়ার মতো চেহারা। সারা শরীরে পাপের ‘ব্ল্যাকওয়াশ’।
সেই অনিলকুমার আমার কাঁধে ভর রেখে কাঁপতে কাঁপতে গাড়ি থেকে নামলেন। আমি আর শ্যামল মুকুজ্যে ছিলুম মাস্টারমশাইয়ের ডান হাত। আমরা দু’জনেই বুঝেছিলুম, গলা থাকলেই গান হয় না। সাধনা চাই। সাধনার জন্যে চাই নিষ্ঠা আর ধৈর্য। শেষের গুণ দুটিরই বড় অভাব। আমরা ছুটে ছুটে আসতুম মানুষটিকে ভালবেসে। এমন পরিপূর্ণ শিল্পী কমই দেখা যায়। যত অভাব বাড়ছে, যত দুঃখ বাড়ছে, যত শত্ৰু বাড়ছে, তত যেন প্রতিভা আর গলা খুলে যাচ্ছে। সুরের জ্ঞান, তাল আর লয়ের জ্ঞানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গান নিয়ে বসলে জগৎ ভুল হয়ে যেত। আর ছেলেমানুষি! তারও কোনও তুলনা ছিল না। পয়সা হাতে পেলেই একেবারে আমিরী চাল। সংসারে সব ঢন ঢন করছে, হাতিবাগান থেকে কিনে নিয়ে এলেন বাহারী গাছ, কিনে নিয়ে এলেন ময়ূর। কিনে নিয়ে এলেন দামী আতর। বাড়িতে চা নেই, এসে গেল দামী ফিনফিনে কাপডিশ। এমন একজন মানুষকে ভাল না বেসে পারা যায়!
আমরা দু’জনে গিয়ে অনিলকুমারকে উদ্ধার করে আনলুম সেই মেয়েমানুষের ঘর থেকে। মাঝে-মধ্যে একস্ট্রা হিসেবে কাজটাজ করত। সাধ ছিল নায়িকা হবে। অনিলকুমার সেই আশ্বাসই দিয়েছিলেন। বোতলেই অনিলবাবু ফ্ল্যাট হয়ে গেলেন, তা আর কি হবে! মেয়েটি ভাল, তবে কতদিন আর টানবে এই ভেস্তে যাওয়া নায়ককে। ঘরে কেউ থাকলে খদ্দেরপাতি আসা বন্ধ হয়ে যায়। খদ্দের না এলে খাবে কি? তবু অনিলকুমারকে বিদায় জানাতে গিয়ে মেয়েটি কেঁদে ফেলেছিল।
অনিলকুমার ঘরে ঢুকেই কাঁপতে কাঁপতে শুয়ে পড়লেন। হলুদবর্ণ চেহারা। কবে যেন চুলে কলপ। দিয়েছিলেন, সব উঠে গিয়ে চুলের রঙ পিঙ্গল বর্ণ। পরে আছেন ফুলকারি করা লুঙ্গি, লেসের কাজ করা চুড়িহাতা সাদা পাঞ্জাবি। ময়লা। খামচানো খামচানো। হলুদের ছোপধরা। সেই প্রথম এমন একজনকে দেখলুম, যিনি নিজেকে নষ্ট করে, ধ্বংস করে গর্বিত। যেন কত বড় একটা কাজ করে ফেলেছেন!
যতটা সম্ভব নায়কের স্টাইলেই ভূমিশয্যা নিয়ে অনিলকুমার কাকের কর্কশ গলায় বললেন, ‘আনলে তো আমাকে, সামলাতে পারবে তো! আমার আবার অনেক ফ্যাচাং।’
ধীরে ধীরে ফ্যাচাং বেরুতে লাগল। মিনিটে মিনিটে সিগারেট চাই। দামী বিলিতি ছাড়া চলবে না। দুধ ছাড়া চা চাই ক্ষেপে ক্ষেপে, ঢুকু ঢুকু। অনিলবাবুর ধারণা, তাঁর শরীরের এই মর-মর অবস্থার কারণ, অসম্ভব পরিশ্রম, বিশ্রামের অভাব। চিকেন-টিকেন খেলে দু-দিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
মাস্টারমশাই তো উদ্ধার করেই খালাস। প্রাণ যায় বউদির। মুখে কোনও প্রতিবাদ নেই। পনেরো মিনিট, কুড়ি মিনিট অন্তর চা। চিকেন, সরু চালের ভাত। রাতের ফুলকো লুচি। সে এক রাজসূয় যজ্ঞ।
একান্তে মাস্টারমশাইকে একদিন জিজ্ঞেস করলুম, ‘আর কতদিন টানবেন? কি হবে মাস্টারমশাই এই এক পড়তি প্রতিভাকে বয়ে?’
স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। ফর্সা ধারালো মুখ ধীরে ধীরে লাল হচ্ছে। ভেবেছিলুম অন্য সবাইকে যা করেন আমাকেও তাই করবেন, বলবেন, বেরিয়ে যাও। জীবনে আর এ-মুখো হবে না। সেই প্রথম দেখেছিলুম রাগ সংযত করলেন। শান্ত গলায় বললেন, “শোনো, হীরে পাঁকে পড়ে থাকলেও হীরে।’
এই একটিমাত্র কথা বলে উঠে চলে গেলেন।
এরপর মাস্টারমশাই জীবনের শ্রেষ্ঠ ভুলটি করলেন, বাড়ির একটা অংশ ভাড়া দিয়ে দিলেন। পরিচিত লোককেই দিলেন। ছোট, ভদ্র পরিবার। বন্ধুস্থানীয়। ভাড়া মেরে দেবার সম্ভাবনা নেই। জানতেন না, বস্তু-পৃথিবী সব সময় গাণিতিক নিয়মে চলে না। ভদ্রর অভদ্র হতে বেশি সময় লাগে না। সহবতের সামান্য এদিক-ওদিক হলে মাস্টারমশাই অসন্তুষ্ট হন। সামান্য জোরে কথা হলেই অসন্তুষ্ট হয়ে ভুরু কুঁচকে তাকান, সেখানে ওই ভাড়াটে বন্ধুর স্ত্রী লাউড স্পিকারের গলায় কথা বলেন। উঠতি বয়সের মেয়েটি প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ায় আর গৃহকর্তা সময় পেলেই হারমোনিয়াম নিয়ে হেঁড়ে গলায় আধুনিক গান করেন। যেন জানাতে চান, সঙ্গীতে আমার প্রতিভাও কিছু কম নয়। মাঝে-মধ্যে কোথা থেকে এক ফক্কড় তবলিয়া ধরে আনতেন, সেদিন হত এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। সপরিবারে সবাই গান গেয়ে যাচ্ছে। যার যা প্রাণ চায়। তবলায় ত্যাড়াং ত্যাড়াং চাঁটি। গুবগুবাগুব বাঁদর নাচানো বোল। কখনো এ মণিহার। পরক্ষণেই কোয়েলিয়া গান থামা। কোয়েলিয়া থামতে না থামতেই, আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ।
এদিকে মাস্টারমশাই কপাল টিপে বসে আছেন। সামনে হারমোনিয়াম। আর ওদিকে তাকিয়ায় আড়কাত নায়ক অনিলকুমার। পরনে মাস্টারমশাইয়ের ফিনফিনে ধুতি, সাচ্চা হীরা, আদ্দির পাঞ্জাবি। বউদির গয়না বেচা টাকায় চিকেন আর দাদখানি চালের ভাত খেয়ে চেহারার চেকনাই ফিরেছে। তবে গলা ফেরেনি। কাকের গলা।
এর মধ্যে একদিন এক কাণ্ড হল। ওই ঢাল-পেটা-তবলিয়া, ওদিক থেকে এদিকে চলে এল। ঝাঁকড়া চুল। স্নো, পাউডার মাখা ডাঁসা মুখ। গা দিয়ে ভরভর করে সিগারেটের গন্ধ বেরোচ্ছে।
ঘরে ঢুকেই বললে, ‘এই যে দাদা, গানটান হবে না?’
দাদা, দাদা বলে কথা বললে মাস্টারমশাই ভীষণ রেগে যান।
রাগ চেপে মাস্টারমশাই বললেন, ‘হলে কি হত?’
‘একটু সঙ্গত করতুম আর কি। তেমন গাইয়ে পাই না তো!’
মাস্টারমশাই আমাকে বললেন, ‘তবলাটা বের করে দাও তো!’
তবলায় গোটা দুই চাঁটি মেরেই সেই মোরগমার্কা ছেলেটি, মোরগ কথাটা মাস্টারমশাইয়ের কাছেই শেখা, মানে বেশ বাহারী, হাঁকডাক আছে, কিন্তু ডিম নেই, ইতি-উতি তাকিয়ে বললে, ‘পাউডার আছে, পাউডার?’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘অবশ্যই আছে।’
দু হাতের তালুতে বেশ করে পাউডার ঘষে, এপাশে, ওপাশে দুলতে দুলতে বিরাট ওস্তাদের মতো বললে, ‘নিন, ধরুন।’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘তবলাটা আগে সুরে বাঁধে।’
রুপোর হাতুড়িটা এগিয়ে দিলেন। ঠোকাঠুকি চলল। এদিকটা ওঠে, তো ওদিকটা নামে। কিছুতেই মেলে না। ছেলেটি ভীষণ সমঝদারের মতো বললে, ‘এটাকে একদিন দোকান থেকে টানিয়ে আনবেন। গোলমাল করছে।’
মাস্টারমশাই মুচকি হেসে বললেন, ‘তাই নাকি!’
বাঁয়াটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে, একবার এদিকে, একবার ওদিকে গোটা দুই ঠোক্কর মেরে সুর সমান করে ছেলেটির দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন, ‘এদেশের এই নিয়ম, যে গাড়ি চাপে সে গাড়ি সারাতে জানে না। বিদেশে যে চাপে সে সারাতেও জানে।’
মাস্টারমশাই গান ধরতে যাবেন, এমন সময় সেই ভাড়াটে বউটি এসে গেল। এক ধরনের সুন্দরী আছে যারা সুন্দরী; কিন্তু ঘিনঘিনে সুন্দরী। দেখলেই শরীরটা কেমন করে ওঠে। পোশাক-আশাক, তাকানোর ধরন, বসার কায়দা, থেকে থেকে মাথার ওপর দু’হাত তুলে খোঁপা ঠিক করার নামে বুক দেখানো।
এসো, বসো কোনও অভ্যর্থনাই করলেন না মাস্টারমশাই, সোজা গান ধরলেন, সেই সাংঘাতিক গান, ‘ঝন নন নন নন পায়েল বাজে’। যে গানের সমটা আছে আড়িতে ঢুকে। সম ভেবে ছেলেটি যতবার ঠেকা মারে, ততবারই মাস্টারমশাই মাথা নাড়েন, উহুঁ উহুঁ। আবার ধরেন। ছেলেটি এবারও সম ধরতে পারে না। এদিকে সেই ভাড়াটে বউ হারমোনিয়ামের সামনে বসে, কখনও বেলোয় হাত ঠেকাচ্ছে, কখনও পাশে রুপোর কাজ-করা লতাপাতায় আঙুল বোলাচ্ছে।
মহিলার দুঃসাহস দেখে ভয়ে মরি। অন্য কেউ হলে মাস্টারমশাই হয়তো একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে সামনে ঝুঁকে পড়ে মাদার অফ পারলসের কাজ করা বিডের সৌন্দর্য দেখছে, আর সেই সময় ব্লাউজ ফাঁক হয়ে বুকের গভীর অংশ প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। মহিলার ঠিক পেছনেই তাকিয়ায় কাত হয়ে আছেন অভিনেতা অনিলকুমার।
একবার মনে হল বলি, মাস্টারমশাই সমটা ধরিয়ে দিয়ে আপদ চুকিয়ে দিন। ওই অর্বাচীনের সঙ্গে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্পর্ক নয়। অনিলকুমার থেকে থেকে বলে উঠছেন, এবারও মিস করলে। আর মহিলার খিলখিল হাসি। লাল ডুরে শাড়ি। খাটো ব্লাউজ। অনিলকুমার লোলুপ চোখে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দিক থেকে কি দেখছেন বেশ বুঝতে পারছি। এই অসভ্যতা অনিলকুমারের ভাল লাগতে পারে, মাস্টারমশাই কেন সহ্য করছেন!
দুঃসময় যখন আসে এইভাবেই আসে। আদর্শবান, নীতিবাগীশ মাস্টারমশাই দুর্বল হয়ে পড়লেন। ওই তরুণী ফিচেল বধূটির নাম ললিতা। সেই ললিতাকে নিয়ে হঠাৎ মেতে উঠলেন অকারণে। শুধু বলেছিল, আমাকে গান শেখাবেন, মাস্টারমশাই অমনি উঠেপড়ে লেগে গেলেন গান শেখাতে। মাঝে মাঝে আমাদের বলতে লাগলেন, ভারি সুন্দর কণ্ঠ। মাথাও আছে। যদি একটু খাটে আমার এক নম্বর ছাত্রী হবে। আর অনিলকুমার বলতে লাগলেন, তোমাকে আমি বাঙলা ছবির এক নম্বর নায়িকা করে দোব। তোমার এমন ফিগার, তোমার এমন গলা। মহিলা মাস্টারমশাইকে জর্দাপান ধরাল। ভোজনবিলাসী মাস্টারমশাইকে রাতবিরেতে টেনে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে লাগল। সঙ্গী অনিলকুমার। মহিলার স্বামীটি বোকা বোকা; কিন্তু ভাল রোজগার। অর্থের অভাব নেই। পান-দোষ ছিল। নায়ক অনিলকুমার হয়ে গেলেন বোতলের বন্ধু। বাড়ির পরিবেশ একেবারে বিষিয়ে গেল। রাতের বেলা দুই মাতালের হল্লা। ললিতার বেতালা, বেসুরো গান, অসভ্যতা, নেকামি, আদিখ্যেতা আর মাস্টারমশাইয়ের অন্ধ তারিফ।
নিরীহ, দুর্বল বউদি চুপ করে থাকতে থাকতে একদিন ফেটে পড়লেন। একটা নেশাখোর, মাতাল, লম্পট দিনের পর দিন বসে বসে খাচ্ছে, মাঝরাতে বমি করে ঘর ভাসাচ্ছে, শুয়ে শুয়ে লাখ-বেলাখের গল্প চলছে, সব কিছুর একটা শেষ আছে। এভাবে আর কতদিন চলবে! আর তো বেচার মতো, বাঁধা দেবার মতো কিছু নেই। এদিকে গোদের ওপর বিসফোড়া, বিনা পয়সার ছাত্রী ললিতা। তাকে নিয়ে এমন মেতে উঠেছেন, অন্য সব ছাত্রছাত্রী আসাই ছেড়ে দিয়েছে।
এই ধুম ঝগড়ার মাঝখানে ললিতা এক কাণ্ড করে বসল, মাস্টারমশাইয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললে, ‘মাস্টারমশাই চলুন চলুন, আপনি আমার কাছে থাকবেন, এই অশিক্ষিতা মহিলা আপনার প্রতিভার কি বুঝবে?’
এমনই আশ্চর্য, মহিলার সেই ডাকে সাড়া দিয়ে তখনকার মতো মাস্টারমশাই চলেও গিয়েছিলেন। বউদি আমাকে ডেকে পাঠালেন। সবাই সরে পড়েছে ঘৃণায়, আমি তখনও লেগে আছি। ঘৃণা আনার চেষ্টা করছি পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে, একটা কালো মেঘ এসেছে, সময়ে সরে যাবে। কয়লা যতই ধোও তার কালি যাবার নয়; কিন্তু মাস্টারমশাই যে সোনা। শিল্পীরা রোমাণ্টিক হন। বউদি একেবারেই সাদাসিধে। ভাল করে সাজতে পারেন না। মুখে কখনও পাউডারের প্রলেপ দেখিনি। বউদি যেন চিরকালের মা। নায়িকা হবার কোনও গুণ নেই। কোনও ছলাকলা জানা নেই। ললিতা ঠিক তার উল্টো। তার ভেতর মা নেই। আছে নায়িকা। যখনই কাপড় পরে, পরে কুঁচি দিয়ে। ফিনফিনে দামী শাড়ি ছাড়া পরে না। দামী জর্দা ছাড়া খায় না। শরীর দেখাতে জানে। অন্যের শরীরে আগুন ধরাবার সহজ কিছু কায়দা জানে। অসম্ভব উচ্চাকাঙ্ক্ষী। স্বপ্ন দেখে। নায়িকা হবে। শিল্পী হবে। স্বামীটা ভোঁদাই। গাবদাগোবদা। হেঁড়ে গলায় চেঁচায়। বোকা-বোকা কথা বলে। মোটা দাগের মানুষ। আবার মাস্টারমশাই ঠিক তার উল্টো। যেন গন্ধর্ব নায়ক। কখনও গেঞ্জি লুঙ্গি পরতে দেখিনি। মুখে সামান্য দাড়ি কখনও দেখিনি। যখনই দেখিছি, মনে হয়েছে এখুনি হয়তো বেড়াতে বেরোবেন। ললিতা সহজেই তাই ঢুকে গেছে মাস্টারমশাইয়ের মনে। মাস্টারমশাইও ঢুকে গেছেন ললিতার মনে। জীবন এমন এক তীর্থভ্রমণ, একটু পা হড়কালেই গভীর খাদে।
বউদি ডেকে বললেন, ‘তুমি আমাদের টিকিট কেটে ট্রেনে তুলে দেবে নিপু। আর না, আমি আমার ভায়ের কাছে হাজারিবাগে চলে যাই।’
সিদ্ধান্ত শুনে মাস্টারমশাই ছুটে এলেন না থামাবার জন্যে। অভিমানে টনটনে হয়ে আছেন। শুধু বললেন, ‘জীবনে আমি কারুর কাছে মাথা নিচু করতে শিখিনি, করবও না। আমি আমি। তুমি তুমি। যার যেখানে খুশি চলে যাক।’
অনিলকুমার সিনেমার হাসি হেসে বললেন, ‘এই তো মরদকা বাত। আমাদের ললিতাবাঈ যদ্দিন আছে তদ্দিন আর ভয় কিসের!’
বউদি সত্যিই চলে গেলেন। ছেলে আর মেয়ে তাকাতে তাকাতে গাড়িতে উঠল। সাজানো সংসার পড়ে রইল। সঙ্গে কিছুই নিলেন না। প্রায় এক বস্ত্রে গৃহত্যাগ। বউদির পোষা বেড়ালটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। আর ময়ূরটা সেইদিনই প্রথম পেখম মেলল।
স্টেশন পর্যন্ত বউদি বেশ শক্ত রইলেন। ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে আর পারলেন না। চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ফেললেন। ট্রেন ছেড়ে দিল। জানালায় দুই কিশোর-কিশোরীর ছলছলে মুখ। আমার মনে হয়েছিল অশ্রুবিন্দুর মালা গাঁথতে গাঁথতে ট্রেনটা দূর থেকে দূরে চলে গেল।
বউদির ছেড়ে যাওয়া সংসারের পুরো দখল নিয়ে নিল ললিতাবাঈ। সে এক দেখার মতো ব্যাপার হল। সমস্ত পবিত্রতা উড়ে গেল। সাধনার পীঠস্থানের চেহারা হল বাঈজী-বাড়ির মতো। অনিলকুমার ও-তল্লাটে মদ্যপান করতেন, এখন এ-তল্লাটেই চুর হয়ে থাকেন। দশটার পর থেকেই শুরু হয়, চলে মাঝরাত পর্যন্ত।
এর মধ্যেই একদিন পরিকল্পনা হচ্ছে শুনলুম, টাকা-পয়সা যোগাড় করে ফিল্ম করা হবে। সেই ছবির সঙ্গীত পরিচালক হবেন মাস্টারমশাই। আগেরবারের প্রত্যাখ্যানের প্রতিশোধ নেওয়া হবে। এমন সুর করবেন যা অন্তত দশ-বিশ বছর বাঙলার আকাশ বাতাস একেবারে মাত করে রাখবে। সেই ছবিতে আবার ফিরে আসবেন অনিলকুমার। কাঁপতে কাঁপতে, টলতে টলতে। আর দেখা যাবে আনকোরা একটি নতুন মুখ। নায়িকার ভূমিকায়, ললিতা। লাস্যময়ী, ললিতা। কাহিনী, চিত্রনাট্য, সঙ্গীত ও পরিচালনা, শঙ্করনারায়ণ। প্রযোজনা, শঙ্কর-ললিতা প্রোডাকশানস। মাস্টারমশাই বাগানসহ বাড়ি বাঁধা রাখবেন মারোয়াড়ী বোথার কাছে। ললিতার ভোঁদা স্বামী লাখ দুয়েক যোগাড় করবে। তারপর দেখা যাবে। অনিলকুমার অল্প নেশার ঘোরে নির্লজ্জের মতো বললেন, ‘ললিতার এমন শরীরের বাঁধুনি! একজনের সঙ্গে দিনসাতেক শুলেই লাখচারেক বেরিয়ে আসবে। কি গো ললিতে, পারবে না! নায়িকা হবে অথচ বিছানায় উঠবে না তা কি হয়! ইটস এ গেম।’
হাজারিবাগের ঠিকানায় সব জানিয়ে বউদিকে একটা চিঠি দিলুম। দিন যায়, উত্তর আর আসে না। এদিকে মাস্টারমশাই ছেলেমানুষের মতো মেতে উঠেছেন। কাহিনী তৈরি। এক প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পীর ব্যর্থ জীবনকাহিনী। নায়ক অনিলকুমার। নায়িকা ললিতা—সঙ্গীতশিল্পীর প্রেমিকা। যার সঙ্গে কিছুতেই আর মিলন হয় না। নায়িকা হল সিম্বল। শিল্পীর জীবনের অ্যাম্বিশান, ছলনাময়ী সাফল্য, সোনার হরিণ। ট্র্যাজেডিতে সমাপ্ত। গূঢ় অর্থ, শিল্পীর জীবনে সাফল্য আসতে পারে না। যেদিন আসে সেই দিনই তার মৃত্যু। নায়িকার সঙ্গে নায়কের মিলন হচ্ছে মৃত্যুশয্যায়। কুড়িখানা গান থাকবে। বেশিরভাগ শুটিং হবে ঘাটশিলায়।
শঙ্কর-ললিতা প্রোডাকশানস রেজেস্ট্রি হয়ে গেল। একদিন অবাক হলুম শুনে, ললিতা মাস্টারমশাইকে তুমি বলছে। আর অনিলকুমার ভোঁদা স্বামীটিকে সব সময় মদে চুর করে রাখছেন আর পার্শ্বচরিত্রে যেসব মহিলা শিল্পী অভিনয় করবেন তাঁদেরই একজনকে সঙ্গে জুতে দিয়েছেন লাগাম ধরার জন্যে। নেশা চটে গেলে সিনেমা কোম্পানির প্লাস্টার খুলে যেতে পারে। তাছাড়া রিহার্সাল আছে। নিজের তালিম। পর্দায় প্রেমের আগে ললিতার সঙ্গে একটু ঝালিয়ে নেওয়া উচিত।
হঠাৎ মাস্টারমশাই একদিন আমাকে বললেন, ‘তোমার বাবাকে বলো না আমাদের ছবিতে কিছু টাকা ইনভেস্ট করতে। এ ছবি বেরুনো মাত্রই হিট করবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। গান আর চোখের জলে সিওর সাকসেস।’
অনিলকুমার বললেন, ‘খানিকটা দেবদাস, খানিকটা বৈজুবাওরা।’
আর ললিতা বললে, ‘আমার এই পোজ।’
এমন পোজ দেখালে, ঠাণ্ডা শরীর গরম হয়ে গেল। সেই আমার শেষ দিন। বহু চেষ্টায় যে ঘৃণা আসেনি সেদিন এক কথায় এসে গেল। স্পষ্ট দেখতে পেলুম, মাস্টারমশাইকে ঘিরে বেশ ভাল একটা পাপচক্র তৈরি হয়েছে। ময়ূরটা না খেতে পেয়ে প্রায় বকের মতো হয়ে গেছে। বেড়ালটার লেজ হয়ে গেছে টিকটিকির মতো। সারা বাড়িতে ধূপধুনোর গন্ধের বদলে, মদ, পেঁয়াজ, রসুন, আতর আর কামের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।
বউদিকে সহজে ভুলতে পারিনি, তাই ছুটে গেলুম হাজারিবাগে। গিয়ে বুঝলুম কেন উত্তর পাইনি। কলকাতা থেকে আসার পরই পক্স হয়েছে। এদিকে আবার বউদির ভাই মাস্টারমশাইয়ের অন্ধ ভক্ত। অনিলকুমারের ফ্যান। আমাকে স্পষ্ট বললেন, ‘শিল্পীর জীবন, সেণ্টিমেন্ট বোঝার ক্ষমতা দিদির নেই। ছাত্র থাকবে, সুন্দরী ছাত্রী থাকবে। ছাত্রীরা ভালও বাসতে পারে। অত অভিমানী হলে চলে না। জামাইবাবু মহৎ, উদার, তাই অনিলকুমারকে আশ্রয় দিয়ে বাঙলার চিত্রজগতের উপকার করেছেন। আর সিনেমা করা! ওইটাই তো ওনার লাইন। নো রিক্স নো গেন। দিদি দিনকতক এখানে থাক, সুস্থ হোক, রাগ পড়ুক, তখন কলকাতায় রেখে আসব।’
সহজ সরল সমাধান। আমার কি। যা হবার তাই হোক॥
বহুদিন অপেক্ষা করলুম। আমার গুরুজীর সেই মিউজিক্যাল আর বেরলো না। আমার বিয়ে হল। সংসারী হলুম। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। বাইরে বদলি হলুম, আবার কলকাতায় ফিরে এলুম, আবার বাইরে গেলুম। সময় তো আর বসে থাকে না কারুর জন্যে। আমাদের অফিস ক্লাবের ফাংশানে হঠাৎ শুনলুম অনিলকুমার আসছেন। বিগত যুগের রোমাণ্টিক নায়ক। গান গাইবেন বলে আনা হচ্ছে। তবে এখন আর গলাটলা নেই। অভাবী মানুষ, স্রেফ কিছু পাইয়ে দেবার উদ্দেশ্যেই উদ্যোক্তাদের এই উদারতা।
শনিবার এলেন তিনি। শরীরে আর কিছু নেই। তবু হারমোনিয়ামে বসলেন। নিজেরই কিছু হিট গান গাইবার চেষ্টা করলেন। একালের ছেলেমেয়েরা হাসাহাসি করলে। আমার কিন্তু কান্না পেয়ে গেল! হায় জীবন! সেই রূপ, সেই যৌবন, সেই সব পাপ, মদ, মেয়েছেলে, অহঙ্কার, কোথায় গেল। কাল সব হরণ করে নিয়েছে। গানের এক-একটা লাইন আবৃত্তির মতো করে বলছেন আর হাঁপাচ্ছেন। মাইক্রোফোনে শ্বাস টানার সে কি শব্দ! ক্লাব-সেক্রেটারিকে ডেকে বললুম, ‘কেন টর্চার করছেন মানুষটাকে। সাহায্যের নামে এর চেয়ে বড় অপমান আর কি হতে পারে!’
সেক্রেটারি মঞ্চে উঠে ফিসফিস করে কি বললেন।
অনিলকুমার ভীষণ মাথা দোলালেন। যা বললেন স্পষ্ট ভেসে এল মাইকে। ‘না, না, আমি গান শোনাতে এসেছি। গান না শুনিয়ে টাকা নোবো কি করে!’
এরপর আপ্রাণ চেষ্টা করলেন প্রথম জীবনের সেইসব অসাধারণ গান সেইভাবে গাইতে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। শীর্ণ মুখ লাল হয়ে গেছে। শেষে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। কাল মানুষের পরাক্রমশালী শত্রু। তার সঙ্গে কেউ পেরেছে আজ পর্যন্ত! অমিতাচারী অনিলকুমার তো শিশু।
মঞ্চ থেকে নেমে আসার পর চা খেয়ে সামান্য সুস্থ হলেন। জিজ্ঞেস করলুম, ‘শঙ্করনারায়ণ এখন কোথায়! কেমন আছেন তিনি।’
প্রথমে চিনতেই পারলেন না! যেন জীবনে নাম শোনেননি। শেষে অনেক ভেবে বললেন, ‘শুনেছি শঙ্কর ঘোষ লেনে থাকে। আপনি চেনেন নাকি?
ভদ্রলোক আমাকেও চিনতে পারলেন না। তাজ্জব! অথচ কতদিন আমাকে ঝাঁটা বালতি ধরিয়েছেন। অন্য সব কিছুর বেলায় স্মৃতি কাজ করছে, আর আমার বেলায়, মাস্টারমশাইয়ের বেলায় বিশ্বাসঘাতকতা করছে। এই রকমই হয় বুঝি!
শঙ্কর ঘোষ লেনে গিয়ে সেদিন খুঁজে খুঁজে ওস্তাদ শঙ্করনারায়ণের ডেরা আবিষ্কার করলুম। ছোট্ট দোতলা বাড়ি। ভেঙে পড়ে যাবার মতো হয়েছে। যে-কোনও দিন কর্পোরেশান নোটিস দেবে। কড়া নেড়ে নেড়ে হাত ব্যথা হয়ে গেল। সন্ধেবেলাই সব ঘুমিয়ে পড়েছে! ফিরেই আসবো কি না ভাবছি, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে একটি মেয়েও এল সেই বাড়িতে। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি সাড়া পাননি তো?’
বললুম, ‘না, অনেকক্ষণ কড়া নাড়ছি।’
মেয়েটি আমাকে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। ভীষণ অস্বস্তি। শেষে জিজ্ঞেস করল, ‘কাকে চান?’
‘আমার মাস্টারমশাই শঙ্করনারায়ণ কি এই বাড়িতে থাকেন?’
‘থাকতেন।’
‘এখন কোথায় থাকেন, বলতে পারবেন?’
‘হাসপাতালে।’
‘আপনি তাঁর কে হন?’
‘মেয়ে।’
মেয়েটি দরজার পাশ থেকে গোটাকতক ইট তুলে দোতলার বারান্দায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে লাগল। কোনওটা দরজায় লাগছে। কোনওটা জানালায়। ভেতরে মানুষের সাড়া পাওয়া গেল। দরজা খুলে যিনি পাশে সরে দাঁড়ালেন, প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে মনে হল বউদি। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। মাথার চুল সব পেকে গেছে।
মেয়েটি বললে, ‘ভেতরে আসুন। আমার মা, চিনতে পারছেন? চোখে খুবই কম দেখেন, আর কিছুই প্রায় শুনতে পান না।’
অতীত আর তেমনভাবে জোড়া লাগল না বর্তমানের সঙ্গে। শুধু দেখলুম বউদির বয়েস ঝিঁকি মেরে আরও কুড়ি বছর সামনে এগিয়ে গেছে। মাস্টারমশাইয়ের বড় ছেলে শ্রূতিধর। শুনে শুনে গাইয়ে হয়ে গেছে। প্রায় বাউণ্ডুলে হয়ে আজ বোম্বাই, কাল দুবাই, পরশু দিল্লি এই করে বেড়াচ্ছে। মা আর মেয়ে আর এই ভাঙা বাড়ি। বাড়িটা আবার ছিল মাস্টারমশাইয়ের এক বিধবা ছাত্রীর। তিন-চার বছর আগে ক্যানসারে মারা গেছেন। যাবার আগে তিনি দান করে গেছেন বাড়িটা। মনে হল, এই দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেও একটা অশান্তি লুকিয়ে আছে। মেয়েটি বড়লোকের বউ ছিল। বিধবা হবার পর, বয়সে মাস্টারমশাইয়ের কাছে ভজন শিখতে আসে। ঈশ্বর এইভাবেই সেবা করার জন্যে সেবক-সেবিকা পাঠিয়ে দেন। এই নিভা বোস এসে না পড়লে মাস্টারমশাইয়ের কি হত বলা শক্ত। রাস্তা দিয়ে যেমন বাদ্য-বাজনা করে মিছিল চলে যায়, সেইভাবে মাস্টারমশাইয়ের জীবনের ওপর দিয়ে চলে গেছে একদল জোচ্চোর, লম্পট, সুবিধেবাদী, ধান্দাবাজ। তারপর সেই নির্জন পথ ধরে ফিরে এসেছে তাঁর প্রকৃত আপনজন, একজন, দু’জন হিতকারী। ঘরে মা কালীর বিশাল পট। সব গেছে। শেষ পর্যন্ত বুক দিয়ে আটকাতে পেরেছেন, সেই হারমোনিয়াম আর একটি বিশ্বাস—’তুমি আছ, তাই আছি, নহিলে কেমনে বাঁচি।’
বউদির সেই পক্সে কান আর চোখ দুটোই গেছে। সাংঘাতিক দয়াই হয়েছিল। সারা মুখ গর্ত-গর্ত। বসে থাকতে থাকতেই রবিন নামের একটি যুবক এল। ছাপা শাড়ির ব্যবসা করে। ছেলেটি ভাল। মনে হল, মাস্টারমশাইয়ের মেয়েকে বিয়ে করবে। দু’জনের কথাবার্তা শুনলেই মনে হবে, স্বামী-স্ত্রী। এই অসহায় দুটি প্রাণী ওই ছেলেটির ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছে।
উঠে পড়লুম। আর জি কর, বেড নাম্বার বত্রিশ।
আজ আর হবে না। সময় পেরিয়ে গেছে। কাল বিকেলের আগে দেখতে যেতে পারব না। রাত প্রায় আটটা নাগাদ বেরিয়ে এলুম সেই বিষণ্ণ ভাঙা বাড়ি থেকে। মাস্টারমশাইয়ের থাকার স্পর্শ সর্বত্র। ড্যাম্প, নোনাধরা দেয়াল কিন্তু পরিষ্কার তকতকে। সব ছিমছাম সাজানো। টেবিলে টেবিল ক্লথ। জানালায় পর্দা। দেরাজের মাথায় নেটের ঢাকা। ভাঙা বারান্দার রেলিং-এ লতানে পাতাবাহার। খাঁচায় মুনিয়া। মাস্টারমশাইয়ের বেঁচে থাকার মধ্যে বেশ একটা স্টাইল ছিল। শুধু বিশ্বাস নয়, পালন করতেন ওমর খৈয়ামের সেই উপদেশ—দুটো পয়সা পেলে ফুল কিনো এক পয়সার।
পরের দিন ভিজিটিং আওয়ারস শেষ হবার পনেরো মিনিট আগে গেলুম হাসপাতালে। জেনারেল ওয়ার্ড। বেড নাম্বার বত্রিশ। যাকেই জিজ্ঞেস করি বলে এগিয়ে দেখুন। বিশাল হলঘর। পাশাপাশি পাশাপাশি ময়লা ময়লা কুশ্রী বিছানা। এখানে ওখানে কাপড়-জামা ঝুলছে। ভাঙা ভাঙা মিটসেফ। আরশোলা ঘুরছে। কেউ বিছানায় বসে আছে উদ্ভ্রান্তের মতো, কেউ শুয়ে আছে অচেতন। বিছানার তলায় গামলায় গামলায় উপচে পড়ছে আবর্জনা। কিঁচকিঁচ শব্দে পাখা ঘুরছে। ভ্যাপসা গন্ধ। এর পায়ের তলায় ওর মাথা। সম্পূর্ণ উদাসীন একটা ব্যবস্থার মধ্যে মৃত্যুপথযাত্রী কিছু স্বজন পরিত্যক্ত মানুষ।
মাস্টারমশাইকে তখনও খুঁজে পাইনি। এর পায়ের তলা দিয়ে ওর মাথার সামনে দিয়ে ঘিনঘিন করে ঘুরছি। আর ভাবছি অমন একজন শৌখিন মানুষকে এই ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে গেল। হঠাৎ ডানপাশে তাকিয়ে দেখি একটা থামের আড়ালে, ঝরঝরে লোহার খাটে, ময়লা বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে আছেন মাস্টারমশাই। পরনে ফুল-ফুল লুঙ্গি, ময়লা গেঞ্জি। মানুষটি এতটুকু হয়ে গেছেন ভুগে ভুগে। তার ওপর পা দুটো মুড়ে পেটের কাছে রেখেছেন। সম্পূর্ণ বেহুঁশ যেন। দাঁড়িয়ে আছি পায়ের দিকে। মুখের সামান্য অংশ চোখে পড়ছে। কি অসহায় ছবি! আমার হাতে ছিল কিছু ফুল, এক বাক্স মিষ্টি। এই হরিহরচ্ছত্রের মেলায় কে কার! হাতের ফুল যেন লজ্জা পেয়ে গেছে।
একজন সিস্টারকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘এর বাড়ি থেকে কেউ আসে নি?’
‘দেখতেই তো পাচ্ছেন?’
‘এইভাবে পড়ে আছেন?’
‘হ্যাঁ আছেন। আমি কি করব?’
মহিলা চলে গেলেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলুম, যদি উঠে বসেন, যদি ফিরে তাকান, বাড়ির কেউ যদি এসে পড়ে। সময় সামনের দিকে না চলে পেছন দিকে চলছে। সেই শঙ্করনারায়ণ। গৌরবর্ণ জ্বলজ্বলে মানুষ। সিল্কের পাঞ্জাবি, হীরে-বসানো সোনার বোতাম। অনামিকায় হীরের আংটি, হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল চালাবার সময় ঝিলিক মারছে। সেই মেজাজ। সেই পাগল করে দেওয়া গান।
ঘণ্টা শেষ হয়ে গেল। আশ্চর্য, কেউ আজ এল না বাড়ি থেকে। মাস্টারমশাই সেই একইভাবে পড়ে আছেন ময়লা বিছানায়, একপাশে ফিরে। ভাঙা মিটসেফের অপরিষ্কার মাথায় সন্দেশের বাক্সটা বাখলুম। পাশের বিছানার ভদ্রলোক মৃদু গলায় বললেন, ‘কেন রাখছেন! এখুনি চুরি হয়ে যাবে। নিয়ে যান।’
জিজ্ঞেস করলুম, ‘ইনি এইভাবে পড়ে আছেন?’
‘অবস্থা ভাল নয় ভাই। সেভাবে চিকিৎসাও হচ্ছে না। আর কি হবে, শেষটায় তো মানুষের এই পরিণতি রে ভাই।’
ভদ্রলোক হাঁপাতে লাগলেন। শেষে চোখ বুজলেন। পাশের টুলে বসে মধ্যবয়সী এক মহিলা পান চিবোচ্ছিলেন, নিরাসক্ত মুখে। পানভরা গলায় বললেন, ‘চুপ করো। তোমাকে আর কাব্যি করতে হবে না।’
আমি সেই ফুলের গুচ্ছটা সন্তর্পণে বালিশের পাশে রেখে চলে এলুম। কেবলই মনে হতে লাগল, আমার তেমন পয়সা থাকলে, মাস্টারমশাইকে এখুনি কোনও নার্সিংহোমে বদলি করতুম। উপায় নেই। ভীষণ জড়িয়ে পড়েছি।
পরের দিন আবার আমাকে চলে যেতে হল কলকাতার বাইরে। তবে এই সান্ত্বনা, আমার কর্তব্য আমি করেছি। গেছি। দেখেছি। ফুল আর মিষ্টি রেখে এসেছি।
তিনদিন পরে ফিরে এসে, বিকেলের দিকে সোজা হাসপাতালে। একটা অপরাধবোধে ভুগছি। সেদিন তো কোনও কথা হল না। নিঃশব্দে চলে এসেছি পায়ের তলা থেকে। দেখি আজ যদি কথা হয়।
জেনারেল ওয়ার্ড, বেড নাম্বার বত্রিশ। আবার সেই বিশ্রী হল। বিছানার পর বিছানা। রোগ, রোগী, দুর্গন্ধ। থামের পাশের ঘুপচিতে সেই বিছানা। বেড নাম্বার থার্টি টু। বিছানায় মাস্টারমশাইয়ের বদলে অন্য রোগী। থলথলে এক বৃদ্ধ। বুকে হাত রেখে চিত হয়ে শুয়ে আছেন।
সিস্টারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তিনদিন আগে এই বিছানায় যে ভদ্রলোক ছিলেন তিনি কোথায় দিদি?’
দিদি বলায় মহিলা একটু নরম হলেন। মুখের দিকে তাকালেন। কি জানি কেন চিনতেও পারলেন। মনে হয় আমার এই রোগা মুখে ভারী গোঁফের জন্যে।
সিস্টার বললেন, ‘সেদিন বিকেলে আপনিই তো এসেছিলেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘বালিশের পাশে ফুল রেখেছিলেন?’
ভয় পেলুম। ফুল রাখার জন্যে খারাপ কিছু হল কি? ভয়ে ভয়ে বললুম, ‘হ্যাঁ।’
‘ভালই করেছেন। মৃতের পাশে প্রথম ফুল আপনিই রেখেছিলেন।’
‘মারা গেছেন?’
‘আপনি যখন এসেছিলেন, তার একটু আগেই উনি মারা গিয়েছিলেন।’
নীরবে, নিঃশব্দে ভরা নদীর কূল থেকে নৌকো খুলে যাবার মতো, প্রদোষের ম্লান আলোয় শঙ্করনারায়ণ চলে গেলেন। বড় অভিমানী ছিলেন। কাউকে জানতেও দিলেন না। বিদায় জানাতেও কেউ এল না। জীবনপারাবারের তীরে কেউ এসে দাঁড়াল না। বলল না, ‘আবার এসো।’
বত্রিশ নম্বর বিছানার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম অনেকক্ষণ। ওই বিছানা! একদিন হয়তো আমাকেও শুতে হবে অমনি এক শয্যায়। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আমি শুয়ে আছি পাশ ফিরে, হাঁটু মুড়ে। পাশে ভাঙা মিটসেফ। আরশোলা। ভাঙা টুল। তোবড়ানো পাত্র। সব গুঞ্জন ম্লান হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আমার মেয়ে তার প্রেমিকের সঙ্গে গল্প করছে। আমার ছেলে ছুটছে জীবিকার পেছনে। আমার স্ত্রী তখন জানালার ধারে বসে দিবাশেষের আলোয় আপ্রাণ চেষ্টা করছে সরু একটা ছুঁচে সুতো পরাবার। পারছে না। বারে বারে দিশা হারাচ্ছে। আর অচেনা, অজানা কেউ একটি পুষ্পস্তবক সন্তর্পণে রেখে যাচ্ছে প্রাণহীন বালিশের পাশে।
১৩৯২ (১৯৮৫)