দাম্পত্য সীমান্তে – সতীনাথ ভাদুড়ী
মাছি ছোটে দূষিত ক্ষতের গন্ধ পেয়ে। নিবারণও চেষ্টা-তদবির করে বদলি হয়েছিল আজবপুর পোস্টাফিসে। ডাক-তার বিভাগের খবর, সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় পার্সেল, বিলি না হয়ে ফেরত যায়, এই পোস্টাফিস থেকে।
সত্যিই আজব জায়গা আজবপুর। আধখানা পড়ে ভারতে, আধখানা নেপালে। নেপালের লোক এই স্টেশন থেকে রেলগাড়িতে চড়ে; এখানকার পোস্টাফিসে চিঠি ফেলতে আসে। এখানকার লোক নেপালে বাজার করতে যায় ; মদ খেতে যায়। কাজেই এখানকার লোকের চালচলনও অন্যরকমের। এরা ভোজালি দিয়ে তরকারি কোটে ;পুলিসের লোক দেখলে ভয় পায় না ;আবগারি বিভাগের লোক দেখলে হেসে পানের দোকানে নিয়ে যায়। এইরকম আবহাওয়াই নিবারণ পোস্টমাস্টারের পছন্দ।
অসীমার পছন্দ নয় ; কিন্তু উপায় কি। যেমন মানুষের হাতে মা বাপ তাকে সঁপে দিয়েছে! ছোটবেলায় ঠাকমা নাতনীকে ঠাট্টা করে বলতেন—দেখিস, তোর সঙ্গে এমন বরের বিয়ে দেবো যে, সে রাতে মদ খেয়ে এসে তোকে লাঠিপেটা করবে। অসীমা বলত—ইস্! ঝাঁটা মেরে তাকে বাড়ি থেকে বার করে দেবো না! তার কপালে ঠাকমার কথাই ফলল শেষ পর্যন্ত। বিয়ের পর প্রথম যেদিন জানতে পারে স্বামীর নেশা করার কথা, সেদিন খুব কেঁদেছিল। অমন সুন্দর যার চেহারা, সে মানুষে আবার মদ খায়!
তারপর গত সাত বছরে আরও কত কি জেনেছে, কত কি শিখেছে, কত কি করেছে। যার স্বামীর নেশার খরচ মাইনের চেয়েও বেশি, তাকে অনেক কিছু নতুন করে শিখতে হয়। ইচ্ছা থাক, আর না-ই থাক।
এখানকার লোকে পোস্টমাস্টারকে মাস্টারসাহাব বলে। সেই জন্যই বোধ হয় সে প্রথম রাত্রিতেই স্ত্রীর উপর মাস্টারি ফলিয়েছিল, শিখিয়ে-পড়িয়ে তাকে একটু চালাক-চতুর করে নেবার সদুদ্দেশ্যে। বলেছিল, “হাবাতেদের সঙ্গে খবরদার আলাপ কোরো না! আলাপ-পরিচয় করতে হয় তো বড়লোকের সঙ্গে। যার হাতে কিছু আছে, তার হাত থেকেই না কিছু আসতে পারে। আমল না পেলেও, বড়লোকের বাড়ির আড্ডার এক কোনায় আমি ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটিয়েছি প্রত্যহ, খবরের কাগজের উপর মুখ গুঁজে। সময়ে কাজে লেগেছে।”
তখনই অসীমার মনে হয়েছিল—এমন কার্তিকের মত যার চেহারা, স্বভাব তার এমন কেন? আগে থেকে এত মতলব ফেঁদে কি সবাই কাজ করতে পারে?
যে স্বামী প্রথম রাত্রিতেই এই কথা বলে, সে যে শুধু মুখের উপদেশ দিয়ে ক্ষান্ত থাকবে না, এ জানা কথা। এখানে আসবার পরই নেপালবাজারের শেঠজীকে একদিন বাড়িতে এনে পরিচয় করিয়ে দিল অসীমার সঙ্গে। তারপর একটু চায়ের জল চড়াতে বলে বেরিয়ে গেল থলে নিয়ে বাজার করতে। ফিরল ঘণ্টা দুয়েক পর।
উপরওয়ালা ইনস্পেক্শনে এলে, তার জন্যও হুবহু এই ব্যবস্থা।
এ স্বামীকে চিনতে কি কারও দেরি লাগে! সবচেয়ে খারাপ লাগে তার সম্বন্ধে স্বামীর এই নিস্পৃহতার ভাব। সে দেখতে সুরূপা নয়। সেই জন্যই বোধ হয় তার মনের এই দিকটা আরও বেশি স্পর্শাতুর। তবে নিবারণ রাত্রিতে আটটার মধ্যে বাড়ি ফেরে, এত দুঃখের মধ্যেও এইটাই তার একমাত্র সান্ত্বনা ।
কিন্তু আজ হল কি?
সমীর ঠাকুরপো সেই সাড়ে সাতটা থেকে যাই-যাই করছে। সে বলেছে—“বোসো না। এত কি বাড়ি যাবার জন্য তাড়া পড়েছে! তবু তো এখনও বিয়ে করনি। তোমার দাদাকে আসতে দাও, তারপর যেও।”
বেশ লাগে তার সমীর ঠাকুরপোর সঙ্গে গল্প করতে। রেলস্টেশনের মালবাবুর ভাই। আই-কম পাস করে চাকরির চেষ্টা করছে। রোজ আসে। রান্নাঘরে বসে বউদির সঙ্গে গল্প করে।
আটটা বাজল, নটা বাজল। তবু নিবারণের ফেরবার নাম নাই। অসীমা জানে যে নিবারণ আজ আলোয়ান মুড়ি দিয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ আজ কিছু কাঁচা পয়সা সে হাতে পাবে। সেই জন্যই দেরি হচ্ছে। না তো? ছ বছরের ছেলে ফনটে ; সে অত রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে পারবে কেন। খাওয়া হলে, সবাই এল শোবার ঘরে। ঘরের কোনায় স্বামীর খাবার ঢেকে রেখে আবার তারা বসল সুখ-দুঃখের গল্প করতে। জিমি কুকুরটা অনবরত ডাকছে।
দশটা বাজল। তবু নিবারণ আসে না। মশারির ভিতর কেন যেন ফনটের ঘুম আসছে না আজ কিছুতেই।
“কটায় খাও তুমি রোজ ঠাকুরপো?”
“ঘরে রুটি ঢাকা থাকে, যখন খুশি খাই ”
“তবে আর এত উসখুস করছ কেন, যাবার জন্য?”
“না, অনেক রাত হল। দাদার আজ হল কি?”
“কে জানে! কোথাও কোন ড্রেনেটেনে পড়ে রয়েছে বোধ হয়!”
কথার মধ্যে বিরক্তি সুস্পষ্ট। নিবারণের মদ খাওয়ার কথা এখানে সবাই জানে। একথা বলতে সমীর ঠাকুরপোর কাছে লজ্জা নাই। পাছে আবার সমীর নিবারণের বাইরে রাত কাটানোর অন্য অর্থ করে নেয়, সেই জন্যই অসীমা মদ খাওয়ার দিকটার উপর জোর দিয়ে কথাটা বলল। স্বামী বাইরে রাত কাটায়, একথার জানাজানিতে শুধু বাইরের লোকের কাছেই লজ্জা নয়, নিজের কাছেও নিজে ছোট হয়ে যেতে হয়।
হঠাৎ অসীমার খেয়াল হল যে, ফনটের সম্মুখে তার বাপের মদ খাওয়ার গল্প করাটা ঠিক নয়। “চল ঠাকুরপো, আমরা ওঘরে গিয়ে বসি। কি রে, ফনটে, তোর ভয় করবে না তো আমরা ওঘরে গিয়ে বসলে? মাঝের দরজা তো খোলাই থাকল।”
মাঝের দরজা খুলে তারা গিয়ে বসল পোস্টাফিসের ঘরে। “জিমি! চুপ করলি না! জ্বালাতন।”
এই মানসিক অবস্থা ; এমন দরদী শ্রোতা ; নিজের দুঃখের কথা বলবার সময় অসীমার চোখের জল বাধা মানেনি। এগারটার পর সে নিজে থেকেই সমীরকে চলে যেতে বলেছিল। যাবার সময় সমীর আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিল—“দাদা রাত্রিতে আসবেন ঠিকই। বারোটা, একটা হতে পারে।”
“সে তো নিশ্চয়ই।”।
বলে নিজের কানেই বেখাপ লাগল কথাটা। এত জোর দিয়ে কথা বলবার কোন দরকার ছিল না। শুধু সমীরকে কেন, নিজের মনকেও সে ফাঁকি দিতে চায়। নিজেকে স্তোক দেবার জন্য ঘরের আলোটা শোবার আগে নেবাল না। নেবানোর অর্থ হত, নিবারণ যে আজ আসবেও না, খাবেও না, এ বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ।⋯খাটের তলায় ইঁদুর খুটখুট করে। ডাকঘরে ঘড়ি বাজে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে কত কি ভাবে ; আর চোখের জলে বালিশ ভেজে সারারাত।⋯পণমূল্যের অতিরিক্ত তার কি আর কোন দামই নাই স্বামীর চোখে? ⋯ স্বামী সব চেয়ে বেশি ভালবাসে মদ। তারপর টাকা। কিন্তু তারপর ? ⋯
জিমিটারও আজ হল কি? সেও সারারাত ডেকে ডেকে সারা।
শেষ রাত্রিতে চোখের পাতা কখন যেন বুজে এসেছিল। ঘুম ভাঙল হঠাৎ। এখনও ভাল করে সকাল হয়নি। ফনটে হাত দিয়ে ঠেলছে। দরজায় কড়ানাড়ার শব্দ। মনের তিক্ততা ঘুমিয়েও কাটেনি। কড়ানাড়ার শব্দের অধীর রূঢ়তা, মেজাজ আরও খারাপ করে দেয় অসীমার।
“জেগে রয়েছিস—উঠে দরজাটা খুলে দিতে পারিস না! বুড়ো ধাড়ি ছেলে!”
চুল ধরে টানাটা এত অপ্রত্যাশিত এই ভোরবেলাতে যে ফনটে কাঁদতে ভুলে গেল।⋯ রামদেনীর মা কড়া নাড়লে এর আগেও তো কতদিন মাকে ডেকে তুলে দিয়েছে। তার জন্য কোনদিন তো মাকে রাগ করতে দেখেনি।⋯মশারি থেকে বেরিয়ে, দুমদুম করে পা ফেলে মা দরজা খুলে দিতে গেল। খটাং করে শব্দ হল। রাগ করে খিল খুললে ওই রকম শব্দ হয়। জিমিটা নিশ্চয়ই ছুটে রেরিয়ে গেল বাইরে। ওকি। মা এমন দৌড়িয়ে ঘরে ঢুকল কেন? বিড়াল আসেনি তো! ⋯মা খপ করে একখান পুরনো খবরের কাগজ টেনে নিল। ঢাকা তুলে বাবার জন্য রাখা ভাতগুলোকে খবরের কাগজের উপর ঢালছে। খবরের কাগজে আবার ভাত রাখে নাকি লোকে? জিমির জন্য নিশ্চয়ই। মা আড়চোখে দরজার দিকে তাকাচ্ছে। মা মিছামিছি ভয় পাচ্ছে, জিমি বুঝি এখনই ঘরে ঢুকে ওই ভাত্ খেয়ে নেবে। জিমি যে চলে গিয়েছে বাইরে।⋯
মশারির ভিতর থেকে ফনটে সব দেখছে। যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। মার কাণ্ডকারখানা আজ সে ঠিক বুঝতে পারছে না।⋯একমুঠো ভাত মা আবার থালায় রাখল। ডাল তরকারি দিয়ে মেখে সেই ভাতের দলাটাকে সারা থালার উপর একবার বুলিয়ে নিচ্ছে। ডাঁটা-চচ্চড়িটা থালার একপাশে রেখে আঙুল দিয়ে একটু ছড়িয়ে দিল। মা দরজার দিকে তাকাচ্ছে ভয়ে ভয়ে। একবার মশারির দিকেও তাকাল। ওকি! মা ডাঁটা চিবুচ্ছে! এই সাতসকালে! বাসিমুখে। ভুল দেখছে নাকি সে? না, ওই তো ডাঁটার ছিবড়ে বার করে থালার ওপর রাখলে। মা তার মশারির দিকে তাকাচ্ছে। এরকম সময় মার দিকে তাকাতে নাই ; লজ্জা পাবে। তাই ফনটে চোখ ফেরাল জানলার দিকে। রামদেনীর মা আসছে জানলার দিকে।⋯
অসীমা সত্যিই তাকিয়েছিল মশারির দিকে। সে দেখছিল, বাইরে থেকে বোঝা যায় নাকি, এখন মশারির ভিতর কে আছে, না আছে। না। যাক! তবু নিশ্চিন্ত হতে পারছে কোথায় অসীমা। মুহূর্তের মধ্যে সে কতদিক সামলাবে! তার মত অবস্থায় যে পড়েছে সেই জানে। সে বুঝতে পারেনি যে দরজার কড়া নাড়ছিল রামদেনীর মা। ভেবেছিল বুঝি ফনটের বাবা। হঠাৎ ঘুম ভাঙবার পর ঠাহর পায়নি। ভাগ্যে ঠিকেঝি রামদেনীর মা কোনদিনই শোবারঘরে ঢোকে না।
জল খানিকটা মেঝেতে ফেলে, ডাল-তরকারি-মাখানো হাতটা ডুবিয়ে ধুয়ে নিল গ্লাসের মধ্যে অসীমা। রামদেনীর মা দোরগোড়ায়। এঁটো থালাবাসনগুলো তার হাতে দেবার সময় অসীমা চোখ নামিয়ে নেয়। কুয়াতলায় মুখ ধুতে যাবার আগে শোবারঘরের দরজা আবজে দিতে ভোলে না। স্বামী রাত্রিতে ফেরেনি এই কথাটা ঝিকে জানুতে দিতে চায় না সে।
বীরবাহাদুর নেপালী বাইরে থেকে ডাকে, “মাইজী!”
এই ডাকঘরের ঠিকানায় নেপাল এলাকার যে সমস্ত চিঠিপত্র আসে, সেগুলোকে ঘরোয়া ব্যবস্থায় বিলি করবার জন্য বীরবাহাদুর প্রত্যহ নিয়ে যায়। তার কাঁধে ডাকের ঝুলি। জিমি লেজ নাড়তে নাড়তে তার গায়ে ওঠবার চেষ্টা করছে। রামদেনীর মা কাজ সেরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। বীরবাহাদুরকে বলে গেল—“আজ বোধ হয় একটু দেরি হবে মাস্টারসাহেবের। এখনও ঘুমুচ্ছে। কাল রাতে বোধ হয় চলেছে খুব।” বোতল থেকে মদ ঢালবার মুদ্রা দেখিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়।
অসীমা এসে দাঁড়িয়েছে।
“বীরবাহাদুর, তুই একটু ঘুরেঘেরে আয়।”
ঠোঁটের কোনায় হাসি এনে চোখের ইশারায় বীরবাহাদুর বুঝিয়ে দিল যে রামদেনীর মা বহু দূরে চলে গিয়েছে ; অত সাবধান হয়ে কথা বলবার দরকার আর নাই।
“মাস্টারসাহেবের কথাতেই তাড়াতাড়ি এলাম সাইকেলে। তিনি আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন। হেঁটে আসছেন কিনা।”
কেন তাকে তাড়াতাড়ি পাঠিয়েছে সে-কথার কোন মূল্য নাই অসীমার কাছে।
“দেখা হল কোথায়, মাস্টারসাহেবের সঙ্গে?” জিজ্ঞাসা করবার সময় কুণ্ঠায় বীরবাহাদুরের মুখের দিকে সে তাকাতে পারে না।
“আমার বাড়িতেই তো তিনি সারারাত।”
মনটা হালকা হালকা লাগে।
“সারা-রাত?”
বীরবাহাদুর অধৈর্য হয়ে পড়েছে। মাথায় তার গুরুদায়িত্ব। ডাকের থলে থেকে একটা পার্সেল বার করতে করতে বলে—“এটাকে দেবার জন্য কাল রাতেও একবার এসেছিলাম।”
“রাত্রিতে? ক’টার সময়? কেন? খুব দরকারী নাকি?”
দরকারী না হলে কি আর অত রাতে নিয়ে এসেছিলাম। মাস্টারসাহেব তখন নেশায় চুর। উনি কি তখন আসতে পারেন।”
“তবে রাত্রিতে দিলি না কেন?”
একটু দ্বিধাজড়িত স্বরে সে বলল—“দেখলাম ডাকঘরের মধ্যে আপনি আর মালবাবুর ভাই গল্প করছেন। বাইরের লোকের সম্মুখে তো জিনিসটা দিতে পারি না আপনার হাতে। রাতদুপুরে পোস্টাফিসের সম্মুখে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকারও বিপদ আছে। তাই চলে যেতে হল। গিয়ে মাস্টারসাহেবকে বলতেই তিনি চটে আগুন মালবাবুর ভাইয়ের উপর। ওই নেশার মধ্যেও, জ্ঞান টনটনে। বলে ভোজালি লে আও বীরবাহাদুর! অভী লে আও! খুন করব ছোঁড়াটাকে আমি! কী চিৎকার! সে কি সামলান যায়!”
শিহর খেলে গেল অসীমার সারা দেহে। বহু আকাঙিক্ষত অথচ অনাস্বাদিত একটা জিনিসের স্বাদ সে পাচ্ছে। খুব ভাল লাগছে শুনতে। ও থামল কেন। আরও বলুক।
ভয়ের অভিনয় করে সে বলে—“তাই নাকি! ওরে বাবারে! তাহলে কী হবে! তাহলে আমি কী করি! তখনই আসছিল নাকি ভোজালি নিয়ে?”
বীরবাহাদুর এ প্রসঙ্গ চাপা দিতে চায়। “না, না, কিছু ভাববেন না মাইজী। নেশায় যে মানুষ হাঁটতে পারছে না, সে মানুষ তখন আসছে ভোজালি নিয়ে মারতে! আপনিও যেমন!”
“না না বীরবাহাদুর। যত নেশাই করুক, জ্ঞান মাস্টারসাহেবের টনটনে থাকে। জানি তো তাকে।”
“থাকে তো থাকে !”
তাড়া দিয়ে উঠেছে বীরবাহাদুর। বাড়িতে আগুন লাগলেও বাজে গল্প করা ছাড়বে না এই মেয়েমানুষের জাতটা! সে কাজের কথা পাড়ে।
“এই নিন মাইজী পার্সেলটা। সব ঠিক করা আছে। আপনি শুধু সেলাইটা করে রেখে দিন। এখনই। একটুও দেরি করবেন না। মাস্টারসাহেব এই এলেন বলে। এসেই সেলাইয়ের উপরের গালা মোহরগুলো ঠিক করে বসিয়ে দেবেন। শেঠজী রাত দশটার সময় মাস্টারসাহেবের কাছে একটা জরুরি খবর পাঠিয়েছিলেন। সেই জন্যই না এত তাড়া।”
জরুরি খবর? আর বলতে হবে না। মুহূর্তের মধ্যে অসীমা বুঝে গিয়েছে খবরটা কিসের। কেনই বা বীরবাহাদুরকে নিবারণ তখনই পাঠিয়েছিল। আসবার মত অবস্থা থাকলে নিজেই আসত। ইনস্পেক্শন অফিসার ডাকঘর খুলবার সময়ের আগে বোধ হয় আসবেন না। অফিসারদের সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করতে হয়, সব অসীমার জানা। পার্সেলটা সেলাই করতে আধঘণ্টা সময় লাগবে না।
“ফনটে, জামাজুতো পরে নে! বীরবাহাদুর, ফনটেকে একটু বেড়াতে নিয়ে যা তো!”
অসীমা ঘরে ঢুকল চুল আঁচড়ে শাড়ি বদলে নিতে। চায়ের জল একটু পরে চড়ালেই হবে।
কিন্তু সময় আর পাওয়া গেল না। সবে সেলাই করতে বসেছে পার্সেলটা—মোটরগাড়ি এসে থামল পোস্টাফিসের সম্মুখে। একখান ছোট, একখান বড় গাড়ি। এ তো কেবল ‘ইনস্পেক্শন’-এর উপরওয়ালা নয়! এ যে অনেক লোক! ডাক বিভাগের অফিসার ; আবগারি বিভাগের অফিসার ; পুলিসের অফিসার ; নিবারণ নিজে ; পুলিস কনস্টেবল! পথে দেখা হয়ে গিয়ে থাকবে নিবারণের সঙ্গে। তাহলে তো স্বামীর সমূহ বিপদ! এত বড় বিপদের মুখে অসীমা কোনদিন পড়েনি। হে মা কালী, বাঁচাও! ভয়ে কি করবে ঠিক করতে পারে না। পার্সেলের ভিতরের গাঁজার পুঁটুলিটাকে সে কয়লাগাদার নিচে রাখে। পার্সেলের উপরের ন্যাকড়ার মোড়কটাকে উনুনের মধ্যে ফেলে দেয়। হে মা কালী, গালা আর ন্যাকড়াপোড়া গন্ধটা যেন হাওয়ায় পোস্টাফিসের উলটো দিকে উড়ে যায়! এখন একবার নিবারণের সঙ্গে একলা দেখা করতে পারলে সুবিধা হত। বাড়ি ঘিরে ফেলেছে পুলিসে। গুটিগুটি লোক জমতে আরম্ভ হয়েছে। নিবারণ অফিসারদের বলছে—অফিসের চাবি বাড়িতেই আছে ; সে সঙ্গে করে নিয়ে যায়নি বাড়ি থেকে বার হয়ে যাবার সময় ; বাড়ির ভিতর দিয়েও পোস্টাফিসের ঘরে ঢোকবার আর একটা দরজা আছে ; বাড়িতে আছে স্ত্রী আর একটি ছয় বছরের ছেলে ; আর বাইরের লোকের মধ্যে আসে ঠিকেঝি রামদেনীর মা। পুলিস এখন স্ত্রীর সঙ্গে নিবারণকে দেখা করতে দিতে রাজি নয়। একজন এসে অসীমার কাছ থেকে পোস্টাফিসের চাবি চেয়ে নিয়ে গেল।
ডাকঘরে টেবিলে দুটি চায়ের কাপ। “এ আবার এখানে কোথেকে এল।” বলেই নিবারণ কাপ দুটোকে টেবিলের নিচে নামিয়ে রাখল। অফিসাররা পার্সেল সংক্রান্ত খাতাপত্র দেখতে চাইলেন।
“কালকের তারিখে, এই যে এত নম্বরের পার্সেল সম্বন্ধে লিখেছেন—এই নামের কোন ব্যক্তি ওখানে নাই—এটা আজ কলকাতায় ফেরত পাঠান হবে প্রেরককে—দেখি সেই পার্সেলটা।”
সিন্দুক থেকে সেটাকে বার করে দিতে গেল নিবারণ। শেষকালে মুখ কাঁচুমাচু করে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে সেটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
পাশের ঘর থেকে অসীমা সব শুনতে পাচ্ছে। নিবারণ নিজেই প্রথম কথা তুলল—নিশ্চয়ই পার্সেলটা কেউ চুরি করেছে। তার মনে আছে যে সে কাল পার্সেলটা সিন্দুকে রেখেছিল। তারপর সারারাত সে বাড়িতে ছিল না। বাইরের তালা যখন ভাঙা নয়, তখন চোর নিশ্চয়ই ঢুকেছে বাড়ির ভিতর দিক দিয়ে।
বীরবাহাদুরের কাছ থেকে স্বামীর সম্বন্ধে নতুন একটা খবর পাবার পর থেকে, অসীমার মনে নতুন নেশা লেগেছে। আসন্ন বিপদের মুখেও সে নেশার আমেজ কাটেনি। মাঝের খোলা দরজা দিয়ে নিবারণের চোখ-মুখের ভাব সে একবার দেখে নিল। মনে হল যেন ঈর্ষার রেশের সন্ধান পাচ্ছে সেখানে। বাড়ির হাটে তার নিজের ফেলা নিজের মূল্যের প্রথম স্বীকৃতি।
অফিসাররা এইবার বাড়ির ভিতর ঢুকলেন অসীমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবার জন্য। তার বেশভূষার আড়ম্বর প্রথমেই তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
“কাল বিকালের পর থেকে পোস্টাফিসের ঘরে কেউ ঢুকেছিল?”
“না।”
স্বামীর চোখের লেখা দেখার নেশা তখন অসীমাকে পেয়ে বসেছে।
হাঁ-হাঁ করে উঠেছে নিবারণ, কি বলতে হবে, স্ত্রীকে তার ইঙ্গিত দেবার জন্য।
“মেয়েমানুষ। ভয়ে মিছে কথা বলছে হুজুর।”
“মিছে কেন হতে যাবে। কেউ ঢোকেনি ওঘরে।”
“কেউ ঢোকেনি তো দুটো চায়ের কাপ কেন ছিল টেবিলের উপর?”
চটে উঠেছে নিবারণ।
“ও কালকে দুপুরের। তুমি যে দু’পেয়ালা চা খেয়েছিলে একসঙ্গে।”
ঘরের বাক্স-পেঁটরা সার্চ করা হল। অফিসার শুধু বললেন—“নতুন নতুন জরিদার বেনারসী শাড়ি আপনার অনেকগুলো দেখছি।”
“হ্যাঁ, ওগুলো বিয়ের সময় পাওয়া।”
এছাড়া আর কোন কথা বার করা গেল না অসীমার মুখ থেকে। ফনটেকে ডাকা হল।
টফি, লজেঞ্জুস খেয়ে, সে বলল যে সমীরকাকা কাল রাত্রিতে মার সঙ্গে ওঘরে গল্প করছিল আর মা মাতালের ভয়ে কাঁদছিল। বাসিমুখে ডাঁটা চিবুবার কথা যে বলতে নাই তা সে জানে। দারোগার প্রশ্নের উত্তরে রামদেনীর মা বলল যে, কাল রাত্রিতে সমীর এখানে ছিল।
“তাহলে আপনাদের স্বামী স্ত্রী দু’জনকেই থানায় যেতে হয় আমাদের সঙ্গে। আরও অনেক কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে।”
ফনটেকে অফিসার গাড়ির সম্মুখে নিজের পাশে বসিয়ে নিলেন। অসীমা আর নিবারণ বসল ভ্যানের পিছন দিকে। পথ থেকে পুলিস সমীরকেও ভ্যানে তুলে নিল। সে বসল একা অন্য দিককার বেঞ্চে। সবাই নির্বাক। ধুলো উড়িয়ে গাড়ি চলেছে। সে ধুলো খেতে খেতে মালবাবু সাইকেল চালিয়ে আসছেন গাড়ির পিছনে পিছনে। সমীর গাড়ির বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার বেঞ্চের দিকটায় ছায়া ; আর অসীমাদের বেঞ্চের দিকটায় রোদুর পড়েছে। হঠাৎ অসীমা উঠে সেই বেঞ্চটাতে গিয়ে বসল। ভাবে মনে হল যে সে রোদের হাত থেকে বাঁচতে চায়। বসবার সময় অসীমা স্থির লক্ষ রেখেছে নিবারণের চোখের উপর। নিবারণও তার দিকে তাকিয়ে। যাতে পুলিসরা না দেখতে পায় সেই জন্য সে হাতখানা বেঞ্চের নিচে নামিয়ে স্ত্রীকে ইশারা করল সমীরের দিকে আরও ঘেঁষে বসতে। স্ত্রীর উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসাসূচক ব্যঞ্জনাও তার চোখমুখে নির্লজ্জ ছাপ ফেলেছে। ঈর্ষার চিহ্নও নাই সেখানে।
যা ভাবতে ভাল লাগে, সেইটাকেই সত্যি বলে ধরে নিয়েছিল এতক্ষণ অসীমা। এতক্ষণে মিষ্টি ভুলের নেশা কাটে। চূড়ান্ত অপমানে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে।
“কেন, ওর কাছে ঘেঁষে বসব কেন? হুকুম?” অসীমা এসে ধপ করে বসল নিবারণের পাশে। তারপর আবার উঠে দাঁড়াল গাড়ির পার্টিশনের লোহার জাফরি ধরে।
“শুনছেন পুলিসসাহেব, এই লোকটাই চুরি করেছে—এই ঠগ, জোচ্চোর, মাতালটা। অন্যর ঘাড়ে দোষ চাপাতে চায়, আমাকে দিয়ে মিথ্যা কথা বলিয়ে। সব সত্যি কথা বলব আমি। আমার জেল হয় হোক। কলকাতার লোকদের সঙ্গে এর, আর নেপালবাজারের শেঠজীর সাট আছে। যেসব লোক সাতজন্মেও এখানকার নয়, তাদের নামে কলকাতা থেকে পার্সেল আসে। এখানে সে নামের লোক পাওয়া যাবে কোথায়! ফেরত যায় সেসব পার্সেল। পার্সেলে আসে রেশমী শাড়ি, টাকা, আরও কত কি। সেসব এই মাতালটার মজুরি। সেটা বার করে নিয়ে এরা পার্সেলের মধ্যে ভরে দেয় নেপালের সস্তা গাঁজা। যে গাঁজার দাম নেপালে চার পয়সা, তার দাম কলকাতায় দেড় টাকা। কলকাতা থেকে যে মিথ্যা পার্সেল পাঠায় সে-ই আবার গাঁজাভরা পার্সেল ফেরত পায়। অনেক দিন থেকে এই করে আসছে এরা। আমার মুখ বন্ধ করবার জন্য আমাকে দিয়ে গাঁজা ভরা পার্সেল সেলাই করায়। যাদের হাতে এত লোকজন, যারা সিলমোহর বাঁচিয়ে সেলাই কাটতে জানে, তারা কি আর সেলাই করবার একটা লোক পেত না ইচ্ছা করলে! শুধু আমার মুখ বন্ধ করবার জন্য আমায় রেশমী শাড়ি দিয়েছে। লোকটা কি কম বদমাইস! তিন বছর পরে কি করবে সেসব ওর আজকে থেকে ছককাটা থাকে। একটা কথাও লুকবো না আমি হুজুর। গলায় পাথর বেঁধে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছে মা-বাপে! বিয়ে না ছাই! ইচ্ছা করে যেখানে দু’চোখ যায় চলে যেতে! পারিনি শুধু ফনটেটার মুখ চেয়ে। জেলে ওকে আমার কাছে থাকতে দেবেন পুলিসসাহেব! তাহলেই আমি সব সত্যি কথা বলব।…”
এতক্ষণে নিবারণ কথা বলল।
“কি পরিমাণ বদ দেখছেন তো হুজুর মেয়েমানুষটা। নাগরকে বাঁচিয়ে স্বামীকে জেলে পুরতে চায়।” তার মুখে উদ্বেগের চিহ্ন পর্যন্ত নাই।
১৩৬৭ (১৯৬০)