আমেরিকা – বিমল মিত্র
মিস্টার রিচার্ড বললেন—গল্পটা গোড়া থেকে বলবো, না শেষ থেকে বলবো? কলকাতা থেকে বম্বে যাবার পথেই মিস্টার রিচার্ডের সঙ্গে আলাপ। মাত্র চার ঘণ্টার আলাপ। দমদম থেকে উড়তে শুরু করেছিলুম সন্ধে ছ’টার সময়। ভাইকাউন্ট-এর ভেতরে মিস্টার রিচার্ডের সিট-নাম্বার ছিল থ্রি-সি, আর আমার থ্রি-ডি। একেবারে পাশাপাশি। মিস্টার রিচার্ডের বোধ হয় গল্প করবার মেজাজ ছিল তখন। তিনিই প্রথম আরম্ভ করেছিলেন।
বলেছিলেন—আর ইউ এ ভেজিটারিয়ান? আপনি কি নিরামিষভোজী?
আমি নিরামিষভোজী কি না, তা নিয়ে মিস্টার রিচার্ডের মাথা ঘামানোর কথা নয়। বুঝেছিলাম তিনি গল্প করতে চান পাশের লোকের সঙ্গে। তারপর আস্তে আস্তে অনেক কথা উঠলো। ইণ্ডিয়া স্বাধীন হয়েছে। তেরো বছরে কী কী উন্নতি অবনতি হয়েছে, কী কী হয়নি, তারই ছেঁদো কথা সব। এ-সব বিদেশীদের মুখরোচক আলোচনা। এই প্রথম ইণ্ডিয়ায় এসেছেন মিস্টার রিচার্ড। গৌতম বুদ্ধের দেশ, লর্ড চৈতন্যের দেশ, সোয়ামী ভিভেকানন্দের দেশ, ল্যাণ্ড অব টেম্পলস্। দি গ্রেট ইণ্ডিয়া। ওদিকে ক্যাশমিয়ার আর এদিকে কুমারিকা, দি হিমালয়ান আর দি গ্যাঞ্জেস। বেনারসের সাধু, মথুরার পাণ্ডা, বৃন্দাবনের ভিখারি, দিল্লির টাঙ্গাওয়ালাজ্ ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক প্রসঙ্গ। সব দেখা শেষ করে এসেছিলেন কলকাতায়। কলকাতায় এসে চৌরঙ্গীর একটা হোটেলে উঠেছিলেন। এখন ফিরে যাচ্ছেন নিজের দেশে, আমেরিকায়।
কলকাতার নাম শুনেই একটু কৌতূহল হলো।
জিজ্ঞেস করলাম—কলকাতা কেমন লাগলো আপনার?
মিস্টার রিচার্ড আমার দিকে পাশ ফিরলেন। বললেন—বলবো?
বললাম—বলুন না—
মিস্টার রিচার্ড বললেন—গল্পটা গোড়া থেকে বলব, না শেষ থেকে বলবো?
বললাম—তার মানে?
মিস্টার রিচার্ড বললেন—মাত্র এক দিন ছিলাম কলকাতার হোটেলে, এক দিনের অভিজ্ঞতায় কোনও দেশ সম্বন্ধে কিছু বলা যায় না, কিন্তু প্রথম দিনেই একটা ঘটনা ঘটেছিল—সেই ঘটনাটা বললেই আপনি একটা স্টোরি পেয়ে যাবেন—কারণ শেষটা আমার আর দেখা হয়নি—
বললাম—তা হলে গোড়া থেকেই বলুন—
মিস্টার রিচার্ড বললেন—ঘটনাটা ঘটলো প্রথম নাইটে। প্লেন এসে পৌঁছেছিল বিকেল চারটার সময়। এরোড্রোম থেকে সোজা হোটেলে গিয়ে উঠলাম। বিরাট হোটেল, আগে থেকেই আমার রিজার্ভ করা ছিল রুম। বয়, বাবুর্চি, ম্যানেজার, ক্যাশিয়ার, বোডার সবাইকে দেখলাম—দেখলাম সবাই খুব কেয়ার নিলে আমার—আমি কী খাই, আমি কী খেতে ভালবাসি, আমি হট্ না কোন্ড কী খাবার পছন্দ করি, আমার কখন কী দরকার, সব খবর তারা জিজ্ঞেস করে নিলে— । বিকেল বেলা বেড়াতে গেলাম সিটিতে। গেলাম হগ্ মার্কেটে, দু-একটা জিনিসপত্র কিনলাম—দেখলাম বেঙ্গলীজ আর ফানি পিপল্। ফরেনারদের তারা দেবতা মনে করে এখনও, এই ইণ্ডিপেণ্ডেন্সের তেরো বছর পরেও—
মিস্টার রিচার্ড এবার একটা সিগ্রেট ধরিয়ে নিলেন—
বললাম—তারপর?
মিস্টার রিচার্ড বলতে লাগলেন—চমৎকার লাগলো এই ক্যালকাটা আপনাদের—আগেকার সেই সেকেণ্ড সিটি ইন দি ব্রিটিশ এম্পারায়। পশ্চিম দিকে অত বড় মাঠ, সিটির হার্টের মধ্যে এত বড় খোলা মাঠ কোথাও দেখিনি। গভর্নরস্ হাউসও দেখলাম! আপনাদের লেট্ মহাট্মা গান্টি বলেছিলেন ইণ্ডিপেণ্ডেন্সের পরে ওটা মিউজিয়াম করে দেওয়া হবে। ভেবেছিলাম মিউজিয়ামটা দেখতে যাবো। আমার বেঙ্গলী গাইড বললে—তা নাকি হয়নি। তা না হয়েছে ভালই হয়েছে—এতদিন স্ট্রাগল করে এখন একটু আরাম করাই ন্যাচারাল, শুনলাম আগেকার সবই আছে, সেই গার্ড অব অনার, সেই আট ঘোড়ার বডিগার্ড, সেই এডি-কং, ব্রিটিশ লিগেসির যা কিছু সব ইণ্ডিয়ানরা পুরোদমে ভোগ করছে—। বড় আনন্দ হলো দেখে—অবশ্য দেখলাম আপনারা ময়দান থেকে জেনারেল আউটরামের স্ট্যাচুটা সরিয়ে দিয়েছেন, দিয়ে সেখানে মহাট্মা গানটির স্ট্যাচু বসিয়ে দিয়েছেন—ভেরি গুড, ভেরি গুড—ভারি আনন্দ হলো ক্যালকাটা দেখে—। এতদিন মিস মেয়ো আর আলডাস হাক্সলির বইতে যা পড়েছি, দেখলাম সব মিথ্যে, সব প্রোপাগ্যাণ্ডা—সব ভিলিফিকেশন—আমি সন্ধেবেলা টেরাসের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিটি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম— কবে একদিন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি এই সিটিকে প্রতিষ্ঠা করেছিল, আজ এতদিন পরে কোথায় রইল সেই ব্রিটিশ জাত—আর কোথায় রইল সেই কুইন ভিক্টোরিয়া, যিনি ব্রিটিশ এম্পায়ারের মধ্যে নিয়ে একে জাতে তুলে নিলেন। হিস্ট্রিতে পড়েছি সেদিন নাকি কুইন ভিক্টোরিয়াকে ইণ্ডিয়ানরা ‘মা’ বলে অভিনন্দন জানিয়ে টেলিগ্রাম করেছিল—! আজ সেই কান্ট্রি ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট হয়েছে—এটা ব্রিটেনেরও প্রাইড ইণ্ডিয়ারও গ্লোরি—চমৎকার, বিউটিফুল—
—তারপর?
—তারপর ডিনারের পর নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছি। শোবার আগে আমার বয় আমাকে কফি দিয়ে গেছে। গাইড-বুকটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কত রাত মনে নেই, দরজায় একটা নক্ পড়লো। মনে হলো কে যেন দরজায় টোকা দিচ্ছে—! প্রথমে মনে হলো ভুল শুনছি! খানিক পরে আবার একটা নক্—
উঠে পড়লাম। দরজার ভেতর থেকে বললাম—কে? হুজ দ্যাট?
খানিকক্ষণ চুপ চাপ!
উত্তর না পেয়ে আমি দরজা খুললাম। দেখি আমার বয় হুকুমালী।
হুকুমালী মাথা নিচু করে সেলাম করতে লাগলো বারবার। বিকেল থেকেই হুকুমালী আমর সেবা করছে। বড় ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট। বুঝলাম ব্রিটিশ আমলের ফরেনারদের সার্ভ করে করে হুকুমালী আদব-কায়দায় দুরস্ত্ হয়ে গেছে।
হুকুমালী বললে—হুজুর, গোস্তাকি মাফি হয়—
—কী হুকুমালী? ক্যায়া মাঙতা?
হুকুমালী বললে—একজন সাহেব হুজুরের সঙ্গে মোলাকাত্ করতে চায়—
—কোন সাহেব?
এতক্ষণ দেখতে পাইনি। টেরাসের কোণে অন্ধকারে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। এতক্ষণে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। আমেরিকান হাওয়াই কোট আর ট্রাউজার পরা, ইয়ং ম্যান অব সে থার্টি— বড়জোর তিরিশ বছর বয়েস হবে। গায়ের রঙ ব্ল্যাক ট্যান। হাতে একটা লেদার পোর্টফোলিও ব্যাগ! কাছে এসেই বললে—গুড ইভনিং স্যার, —গুড ইভনিং—
বললাম—গুড ইভনিং! ইয়েস?
ইয়ং ম্যান বললে—ডু ইউ ওয়ান্ট আর্টিস্ট স্যার? আপনি আর্টিস্ট চান?
—আর্টিস্ট!
আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। আর্টিস্ট! কীসের আর্টিস্ট! কীসের আর্ট! ছবি আঁকার জন্যে? আমার ছবি আঁকবে! পোট্রেইট! কিছুই বুঝতে পারলাম না।
জিজ্ঞেস করলাম—আর্টিস্ট?
ইয়ং ম্যান বললে—ভেরি গুড আর্টিস্ট স্যার, ইয়ং অ্যাণ্ড বিউটিফুল—
—তার মানে?
ইয়ং ম্যান বললে—গার্লস স্যার—কলেজ গার্লস—এই ছবি আছে আমার কাছে, এই দেখুন—
বলে পোর্টফোলিও ব্যাগটা খুলে একগাদা ফোটোগ্রাফস্ বার করলে। একগাদা মেয়েদের ছবি। ইয়ং সুইট গার্লস। চমৎকার চেহারা, ওয়েল ড্রেসড্, প্রায় ডজন খানেক—
ছবিগুলো দেখিয়ে বলতে লাগলো—যাকে আপনার ইচ্ছে, পছন্দ করতে পারেন, যাকে ইচ্ছে! সবাই রেসপেকটেব্ল সোসাইটির গার্ল, এই দেখুন, এ হচ্ছে মিস লোলিটা, এর বয়স নাইনটিন, এর বয়স সেভেনটিন, আর এই যে দেখছেন বব্ করা চুল, এ হলো পাঞ্জাবী গার্ল, —সব রকম আর্টিস্ট পাবেন আমার কাছে, চাইনিজ, বার্মিজ, বেঙ্গলী, অল ভ্যারাইটিজ—
আমি চুপ করে আছি দেখে ইয়ং ম্যান আরো বলতে লাগলো—অন্য এজেন্টরাও আপনার কাছে হয়ত আসবে, হয়ত অনেক রকম পিকচার দেখাবে, তবে কী জানেন, আমার কাছে আপনি কোনও ডিজঅনেস্টি পাবেন না—তা ছাড়া আমার স্টক-এর সঙ্গে অন্য এজেন্টদের স্টক-এর তুলনা করলে আপনি নিজেই তফাতটা ধরতে পারবেন—আপনি ফরেনার, আপনাকে ঠকিয়ে অন্তত ইণ্ডিয়ার বদনাম করবো না আমি—
তারপর ছবিগুলো নাড়তে নাড়তে আবার বলতে লাগলো—আপনি হয়ত আমার কথা শুনে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না, ভাবছেন আপনাকে বিদেশী পেয়ে হয়ত আমি এই রাত্তির বেলা ঠকিয়ে দেব, আসলে এ-লাইনে সবাই-ই ঠকায়, তবে আমি নিজের সম্বন্ধে বলতে পারি এইটুকু যে, আমি ভদ্রলোকের ছেলে, আর ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির একজন গ্র্যাজুয়েট—
বলে ব্যাগ খুলে একটা কার্ড বার করলে। বার করে আমার হতে এগিয়ে দিলে।
দেখলাম—কার্ডটায় লেখা রয়েছে—A. C. Chakraverty, Artist Supplier.
হুকুমালী তখনও দাঁড়িয়ে ছিল দূরে। সে এবার সাহস পেয়ে কাছে এগিয়ে এল।
বললে—হুজুর, এ-সাহেব বরাবর এই হোটেলের সাহেবদের সেবা করে আসছে, আজ পর্যন্ত ফ্রান্স, ইংলণ্ড, আমেরিকা থেকে যত সাহেব এসেছে, সকলকে ইনিই আর্টিস্ট সাপ্লাই করেছে—
চক্রবর্তী বললে—এরা সব জানে স্যার, এদের সঙ্গে আমার বহুদিনের কারবার, আমার কাছে কোনও ফ্ৰড্ পাবেন না—বিশ্বাস করে একবার আমাকে টেস্ট করে দেখুন, তারপর কার্ড তো আপনার কাছে, রইলই—
মনে মনে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম তখন। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট ইয়ং, হ্যাণ্ডসাম চেহারা, এ এ-প্রফেসনে এলো কেন? কত জায়গায় তো ঘুরেছি, কায়রো, বেইরুট, ইরান, পিকিং, ফার ইস্ট,মিডল ইস্টের সব শহর দেখেছি, রাত্রেও সেখনাকার হোটেলে কাটিয়েছি। কিন্তু এমন ঘটনা তো কখনও ঘটেনি! এই হোটেলের ভেতরে—
আমি চুপ করে আছি দেখে চক্রবর্তী যেন উৎসাহ পেয়ে গেল হঠাৎ।
বললে—রেট্ সম্বন্ধে আপনি ভাববেন না, আমার ফিক্সড্ রেট বটে, কিন্তু কমপ্যারেটিভলি চীপ্—খুব সস্তা, ঘন্টা পিছু পঞ্চাশ টাকা, ফিফ্টি রুপীজ্—
আমি হঠাৎ বললাম—হোটেলের ম্যানেজারের পারমিশন আছে?
আমার কথাটা শুনে ইয়ং ম্যান্ যেন চমকে উঠলো।
বললে—পারমিশন?
—হ্যাঁ, তুমি যে এই আর্টিস্টের ব্যবসা করছ, হোটেলের ভেতরে ঢুকেছ, ম্যানেজার জানে এটা? ম্যানেজারের অনুমতি আছে?
চক্রবর্তী কী বলবে বুঝতে পারলে না। এবার একবার হুকুমালীর মুখের দিকে চাইলে।
বললে—স্যার, এর জন্যে আর পারমিশনের কী দরকার?
—পারমিশন্ আছে কি না তাই বলো?
আমার গলার আওয়াজে যেন পাজলড্ হয়ে গেল ছোকরা। একটু থতমত খেয়ে গেল। বুঝুন, কী তাজ্জব কাণ্ড আপনাদের হোটেলের ভেতর। ট্যুরিস্টরা আসে ইণ্ডিয়া দেখতে, সবাই জানে তাদের হাতে অনেক টাকা থাকে। ট্যুরিস্ট দেখলেই সবাই সব জিনিসের চড়া দর হাঁকে। সেটার তবু কারণ বুঝতে পারি। সব ইস্টার্ন দেশেই সেটা আছে। তাতে তেমন কিছু দোষ নেই। কিন্তু খাস ক্যালকাটার রেস্পেকটেবল্ হোটেলের মধ্যে এ কী কাণ্ড বলুন তো! আবার বলছে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট! আবার বলছে কলেজ-গার্ল, রেস্পেকটেবল্ সোসাইটির গার্ল! আমার তখনই সন্দেহ হয়েছে! এ-ও নিশ্চয়ই ব্লাফ। আমাকে ট্যুরিস্ট পেয়ে ব্লাফ দিচ্ছে! রাস্তায় ফুটপাথে এরকম ঘটনা ঘটে, তা স্বাভাবিক। কিন্তু একেবারে হোটেলের ভেতরে। তবে কি শেয়ার আছে সকলের! ম্যানেজার, বয়, বাবুর্চি সবাই জড়িত!
আবার বললাম—পারমিশন আছে কি না, বলো শিগগির? কুইক্—
এবার যেন ছোকরা ভয় পেয়ে একটু পেছিয়ে যাবার চেষ্টা করলে।
হুকুমালী এতক্ষণে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল, সে টপ্ করে কোন্ দিকে উধাও হয়ে গেল,
ছোকরাও পালিয়ে যায় দেখে আমি খপ করে তার একটা হাত ধরে ফেলেছি।
বললাম—চলো, ম্যানেজারের কাছে চলো, চলো শিগ্গির—
আমার মূর্তি দেখে ছোকরা ভয়ে শুকিয়ে গেল। মনে হলো যেন কেঁদে ফেলবে।
বললে—আমাকে ছাড়ুন স্যার, আমাকে ছেড়ে দিন স্যার, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি স্যার—
—নো, নেভার!
বলে ছোকরার হাতটা আরো জোরে চেপে ধরলাম। আমার জোরের সঙ্গে পারবে কেন? আমার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেবার জন্যে ছটফট করতে লাগলো সে।
বললাম—তোমাকে আমি পুলিসে হ্যাণ্ডওভার করে দেব, চলো—
ছোকরা বলতে লাগলো—ছাড়ুন স্যার, প্লিজ, আমি আর কোনওদিন আপনার কাছে আসবো না—কথা দিচ্ছি স্যার—
সেই রাত্রের অন্ধকারের মধ্যেও যেন তার মুখটা করুণ হয়ে উঠলো বড়। বড় প্যাথেটিক সে-চেহারা। বড় অসহায়। বুঝলাম এ-ও এদের একরকম ছল। আমার সামনে এমনি কথা দিয়ে পরের রাত্রে আবার কোনও ট্যুরিস্টের ঘরে গিয়ে নক্ করবে। আবার তাকে জিজ্ঞেস করবে—ডু ইউ ওয়ান্ট আর্টিস্ট স্যার? আবার পোর্টফোলিও থেকে ছবি বার করে স্যাম্পেল দেখাবে। এ-রকম ঘটনা আমাদের আমেরিকায় চলে। সেখানে এর চেয়েও বীভৎস কাণ্ড হয়। কিন্তু এখানে, এই ইণ্ডিয়ায়? এ যে আমাদের কাছে ল্যাণ্ড অব লর্ড চৈতন্য, ল্যাণ্ড অব গৌটম বুড্ঢ, ল্যাণ্ড অব মহাট্মা গান্ঢি!
জিজ্ঞেস করলাম—কী করে ঢুকলে তুমি এই হোটেলে? এত রাত্রে?
ছোকরা সবিনয়ে স্বীকার করলে। বললে—হুকুমালীকে বখ্শিশ দিয়ে—
—কত বখ্শিশ দিয়েছ?
ছোকরা বললে—এক টাকা—
তারপর একটু থেমে বললে—আমায় আপনি ছেড়ে দিন প্লিজ, আমি কথা দিচ্ছি আর কখনও আসবো না—বিশ্বাস করুন, আমি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট, অভাবে পড়ে আমি এ-কাজ করেছি—আমার ছেলেমেয়েরা সব ক’দিন ধরে খেতে পাচ্ছে না, আমার ওয়াইফের টি-বি—আমার⋯⋯
বুঝলাম এ-সমস্ত ছল্। এ-সমস্ত বাঁধা বুলি। যখনই ধরা পড়ে যায়, তখনই এইসব বুলি আওড়ায়।
জিজ্ঞেস করলাম—তুমি যে গ্র্যাজুয়েট, তোমার সার্টিফিকেট আছে? তোমার ডিগ্রি আছে? আমাকে দেখাতে পারবে?
—হ্যাঁ স্যার, দেখাবো, আমি কালকে নিজে এসে আপনাকে দেখিয়ে যাবো!
ভাবলাম আমাকে বোকা পেয়েছে। কাল কি আর ছোকরার পাত্তা পাওয়া যাবে!
বললাম—কাল দেখালে চলবে না, আজই দেখাতে হবে!
—আজ?
বললাম—হ্যাঁ, আজই—
ছোকরা বললে—কিন্তু এখন যে অনেক রাত, এত রাত্রে আমি কী করে দেখাবো আপনাকে স্যার? আমার কাছে তো নেই, সে আমার বাড়িতে আছে—
বললাম—আমি তোমার বাড়িতেই যাবো—চলো—
আমার বাড়িতে যাবেন? এত রাত্তিরে?
বললাম—তুমি যে মিথ্যে কথা বলছ না তার প্রমাণ কী? আজ রাত্রেই তোমার বাড়িতে গিয়ে দেখে আসবো—চলো—
ছোক্রা যেন কী ভাবলে খানিকক্ষণ! বললে—আপনি যাবেন?
বললাম—হ্যাঁ যাবো, ট্যাক্সি ভাড়া আমি দেব, তোমার সেজন্যে ভাবতে হবে না। তোমার কথা যদি মিথ্যে হয় তো আমি তোমায় পুলিসে ধরিয়ে দেব—বি কেয়ারফুল।
ছোকরা বললে—কিন্তু আমি তো আপনাকে আমার কার্ড দেখালাম, —
আমারও রাগ হয়ে যাচ্ছিল তখন। বললাম—কথা বলে সময় নষ্ট করবার মত সময় আমার নেই—আইদার তুমি আমাকে তোমার কথার প্রমাণ দাও, নয়ত তোমাকে আমি পুলিসে হ্যাণ্ড-ওভার করে দেব—
—চলুন।
শেষে সত্যিই রাজি হয়ে গেল ছোকরা। বললে—আপনার কিন্তু অনেক রাত হয়ে যাবে, আমার বাড়ি এখান থেকে অনেক দূর—
তা হোক, তবু আমার যেন কেমন জিদ চেপে গেল। মনে হলো যখন ইণ্ডিয়ায় এসেছি, এখানকার আসল লাইফের সঙ্গে খাঁটি পরিচয় হয়ে যাক। সমস্ত হোটেলের বোর্ডাররা তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু নিচের লাউঞ্জ থেকে নাচের গানের শব্দ আসছে। ও-সব আমি অনেক দেখেছি। ইণ্ডিয়ায় এসে ওয়েস্টার্ন নাচ-গানের ওপর কোনও আকর্ষণ আমার তখন নেই, আমি আমেরিকান। এসেছি ইণ্ডিয়ায়—ইণ্ডিয়া দেখবার জন্যে তখন ব্যস্ত। দেখবো লর্ড চৈতন্যের দেশকে, দেখবো লর্ড বুড্ঢের দেশকে। দেখবো ফ্রি ইণ্ডিয়াকে।
তখনও চক্রবর্তীর হাতটা ধরে আছি।
হাতটা থর থর করে কাঁপছে তখনও। কী পাতলা হাত। মনে হলো একটা মোচড় দিয়ে যেন হাতটা ভেঙে ফেলা যায়। যেন ভাল পেট ভরে খেতেও পায় না। তবু মনে হলো যদি পালিয়ে যায়! যদি পুলিসের ভয়ে আমার হাত ছাড়িয়ে রাত্রির অন্ধকারে হারিয়ে যায়। তখন কি আর কোথাও খুঁজে পাবো আমি একে।
দরোয়ান ট্যাক্সি ডেকে দিলে।
ট্যাক্সিতে চড়ে চক্রবর্তীকে বললাম—কোন্ দিকে যেতে হবে ওকে বলে দাও—
চক্রবর্তীর মুখ দিয়ে যেন কোনও কথা বেরোচ্ছে না তখনও। ট্যাক্সিওয়ালা চক্রবর্তীর চেনা মনে হলো। সে জানে কোথায় যেতে হবে। বহুদিন বহু ট্যুরিস্টকে নিয়ে গেছে বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন পাড়ায়। ভেবেছে আমিও তেমনি একজন ট্যুরিস্ট। আমিও যথা-নির্দিষ্ট জায়গায় যাবো, তারপর যথারীতি ঘণ্টা দু-এক সেখানে কাটিয়ে চলে আসবো। চক্রবর্তীকে তার কমিশন দেব। ট্যাক্সিওয়ালাকেও মোটা বখ্শিশ দেব। যা সবাই দিয়ে থাকে। যা নিয়ম আর কি! তাই ট্যাক্সিওলাও লম্বা স্যালিউট করেছিল আমাকে।
এ-সব আমার জানা ছিল। তাই চক্রবর্তীকে বললাম—তুমি ওকে ডেস্টিনেশন বলে দাও চক্রবর্তী—
চক্রবর্তী ড্রাইভারকে জায়গার নাম বলে দিলে। ট্যাকিস হু হু করে চলতে লাগলো।
চক্রবর্তী হঠাৎ কথা বললে।
বললে—স্যার, আপনার কিন্তু কষ্ট হবে খুব—
বললাম—কেন, কষ্ট হবে কেন?
—সে অনেক দূর?
বললাম—কতদূর?
চক্রবর্তী বললে—সে টালিগঞ্জ বলে একটা জায়গা—
টালিগঞ্জ! আমার গাইড-বুকটা খুললাম। আলোয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। নামটা কোথাও পেলাম না। তাতে বোটানিক্যাল গার্ডেন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, লেকস, জু-গার্ডেন, গান্ঢি-ঘাট, ম্যুজিয়াম—সব নাম আছে, কিন্তু টালিগঞ্জের নাম নেই।
বললাম—টালিগঞ্জ কি কলকাতার বাইরে?
চক্রবর্তী বললে—না স্যার, কলকাতার মধ্যে—
—কলকাতার মধ্যে তো গাইড-বুক-এ নাম নেই কেন?
চক্রবর্তী বললে—সেখানে যে ট্যুরিস্টরা কেউ যায় না স্যার! ট্যুরিস্টদের দেখাবার মতন জয়গা নয় যে সেটা—
তা হবে! হয়ত সুবার্ব! শহরের ব্যাক্ওয়ার্ড এরিয়া। ট্যুরিস্টদের সে-সব জায়গা না-দেখানোই ভাল।
খানিক পরে জিজ্ঞেস করলাম—তুমি এত প্রফেশন থাকতে এ-প্রফেশন নিলে কেন?
চক্রবর্তী বললে—আমি চাকরি করতাম স্যার আগে, গভর্নমেন্ট অফিসে চাকরি করতাম, দেড় শো টাকা মাইনে পেতাম—তারপর আমার চাকরি গেল—
—কেন?
চক্রবর্তী বললে—একবার অফিসে স্ট্রাইক হলো, আমিও ধর্মঘট করেছিলাম, আমার টেম্পোরারি চাকরি ছিল, আমাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিলে। বললে, আমি নাকি ডিস্টারবিং এলিমেন্ট। বললে—আমি নাকি কমিউনিস্ট—
চক্রবর্তীর মুখের দিকে চাইলাম।
জিজ্ঞেস করলাম—তুমি কমিউনিস্ট নাকি?
—না স্যার, আমি কমিউনিস্ট নই স্যার, আমি শপথ করে বলছি আপনাকে, আমি কমিউনিস্ট নই। আপ্অন্ গড্ বলছি। আমার ওপর রাগ ছিল আমার অফিসারের। আমি দেখতাম আমাদের অফিসাররা অফিসের স্টেশন-ওয়াগন্ নিয়ে পিক্নিক্ করতে যায়, অফিসের চাপরাশিদের নিজের বাড়িতে নিয়ে বাট্না বাটায়, জল তোলায়, রান্না করায়—তবু আমি কোনওদিন কিছু বলিনি। আমি জানতাম আমাদের ক্লার্ক হতেই জন্ম হয়েছে, আর বড়লোকের ছেলেদের, মিনিস্টারদের রিলেটিভদের অফিসার হবার জন্যে জন্ম! তা-ও আমি কিছু বলিনি। তবু আমি কিছু বলিনি। কারণ আমার তো টেম্পোরারি চাকরি, আমার বিধবা বুড়ী মা আছে সংসারে—আমার ওয়াইফ আছে, দুটো মাইনর ছেলেমেয়ে আছে—আমার ও-সব কথা বলা ক্রাইম—
—তবু তোমার চাকরি গেল?
—হ্যাঁ স্যার, বিশ্বাস করুন, আমি সাত বছর চাকরি করার পরও টেম্পোরারি ছিলাম, তখনও আমার কনফার্মেশন হয়নি, তাই আমার চাকরি গেল। চাকরিও গেল, আর পাঁচ টাকা চাঁদা দিয়েছিলাম স্ট্রাইক-ফাণ্ডে, তা-ও গেল—
বুঝলাম সমস্তই ছলনা। সমস্তই মিথ্যে কথা! সাত বছর চাকরি করার পরও কেউ টেম্পোরারি থাকতে পারে? আর শুধু স্ট্রাইক করার অপরাধেও কারো চাকরি খতম হতে পারে না। পাঁচ টাকা স্ট্রাইক-ফাণ্ডে চাঁদা দিলেও খতম হতে পারে না। তোমরা আমাদের আমেরিকাকে যত বড় ক্যাপিট্যালিস্টদের দেশই বলো, সেখানেও স্ট্রাইক করার জন্যে, ধর্মঘট করার জন্যে চাকরি যায় না। আমি মনে মনে বুঝলাম ছোকরা আমাকে ব্লাফ দিচ্ছে।
তবু মুখে কিছু বললাম না। জিজ্ঞেস করলাম—তারপর?
—তারপর স্যার অনেক দরখাস্ত করলাম অনেক জায়গায়। কোথাও চাকরি পেলাম না। আর কতদিন না-খেয়ে থাকবো! কতদিন ধার করে চালাবো। ধারও কেউ দেয় না আর। বন্ধু-বান্ধবদের তো সকলেরই প্রায় আমার মত অবস্থা! শেষে আমার ওয়াইফ-এর সিরিয়স অসুখ হলো। একদিন উপায় না-দেখে ডাক্তার ডাকলাম। তখন রোগের খুব বাড়াবাড়ি। ডাক্তার দেখে বললে—টি-বি—
আবার ব্লাফ! বুঝলাম ছোকরা ফরেন ট্যুরিস্ট পেয়ে আমার সহানুভূতি আদায় করবার চেষ্টা করছে! আমি এদের চিনি!
—তারপর?
—তারপর এই এজেন্সিটা পেলাম।
বললাম—এজেন্সি মানে?
চক্রবর্তী বললে—হাফ পার্সেন্ট আমি পাই কি না। টোট্যাল ইনকামের ওপর আমি পাই হাফ পার্সেন্ট, বাকিটা জমা দিতে হয় অফিসে গিয়ে—
—তোমার কি অফিস আছে?
—হ্যাঁ স্যার, আমি তো মাত্র কমিশন এজেন্ট। মোটা প্রফিট্ তাদেরই—
জিজ্ঞেস করলাম—কোথায় তোমার অফিস? তারা কারা?
চক্রবর্তী হঠাৎ খুব বিনীত গলায় বললে—তাঁদের আমি নাম বলতে পারবো না স্যার—এক্সকিউজ্ মি—
—কেন?
—না স্যার, আমাকে মাপ করবেন, তাঁদের নাম-ঠিকানা আমি কিছুতেই বলতে পারবো না। আমাকে কেটে ফেললেও না। তাঁরা আমার বিপদের দিনে কাজ দিয়ে সাহায্য করেছেন, অনেক উপকার করেছেন, নইলে এতদিনে আমি পথে বসতাম, তাঁদের নাম আমাকে বলতে বলবেন না স্যার, আমার অধর্ম হবে তাহলে—তাছাড়া আপনি তো চলে যাবেন, তারপর আমাকে কে বাঁচাবে?
ট্যাক্সি চলছিল হু হু করে। কোথায় চলেছি, কোন্ দিকে চলেছি কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। আমার গাইডবুকে এ-দিককার কোনও নির্দেশ নেই।
জিজ্ঞেস করলাম—আর কতদূর?
—আর বেশি দূর নয় স্যার, এসে গেছি—এবার বাঁয়ে চলো সর্দারজী।
তারপর একটু থেমে বললে—বাড়ি তো যাচ্ছি, কিন্তু গিয়ে যে কী দেখবো বুঝতে পারছি না স্যার—
—কেন?
চক্রবর্তী বললে—সেই সকাল সাতটার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়েছি স্যার, দেখেছিলাম আমার ওয়াইফের তখন খুব জ্বর, আজ মা বলেছিল ডাক্তার ডেকে আনতে, বেরোবার সময় বলেছিলাম ডাক্তার ডেকে আনবো—তা সকাল থেকে যেখানে গেছি, সেখানেই শুধু হাতে ফিরে এসেছি। ভোর বেলাই মিস্টার আগরওয়ালার কাছে গিয়েছিলাম। গিয়ে বললাম—খুব ভাল আর্টিস্ট আছে, একবার দেখুন শুধু—তা কিছুতেই শুনলেন না। তিনি বললেন, তাঁর অন্য এনগেজমেন্ট আছে—
অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার কথা বলতে লাগলো চক্রবর্তী। ক্যালকাটার সব বড় বড় লোক, বড় বড় মিল ওনারস্, বড় বড় মার্চেন্টস। সকলে চক্রবর্তীর ক্লায়েন্ট। সকলের কাছেই গিয়ে হাজির হলো। সেই একই কথা, এক প্রস্তাব! ভাগ্য যেদিন খারাপ হয়, সেদিন ওই রকমই হয়। চক্রবর্তীর মনে হলো টাকার যেদিন তার সবচেয়ে বেশি দরকার সেইদিন ভাগ্য যেন তার সঙ্গে যড়যন্ত্র করছে সবচেয়ে বেশি। শেষকালে সারা ক্যালকাটা ঘুরেছে চক্রবর্তী, কোথাও কিছু কাজ মেলেনি। সব জায়গা থেকেই খালি-হাতে ফিরতে হয়েছে তাকে। ভোরবেলা বেরিয়েছে, তারপর সারা দিন আর খাওয়া হলো না। সারা দিনটাই উপোস করে কেটে গেল চক্রবর্তীর।
চক্রবর্তী বললে—অথচ টাকা না হলে আমার চলবে না, শেষে হতাশ হয়ে যখন বাড়ি ফিরবো কি না ভাবছি, হঠাৎ মনে হলো আপনার হোটেলের ভেতরে গিয়ে একবার খবর নিয়ে দেখি কেউ ফরেন ট্যুরিস্ট আছে কি না। হুকুমালী বললে—আজ বিকেলেই একজন আমেরিকান ট্যুরিস্ট এসেছে। তাকে একটা টাকার লোভ দেখিয়ে শেষে আপনার⋯⋯
বললাম—ডোন্ট ট্রাই টু ব্লাফ মি, আমাকে ধাপ্পা দিতে চেষ্টা কোরো না—আমি তোমাকে এখনও সাবধান করে দিচ্ছি—তোমার কান্না শুনে আমি ভুলবো না, আমি আমেরিকান—
চক্রবর্তী বললে—কেঁদে আপনাকে ভোলাতে চেষ্টা করছি না স্যার, কান্না শুনলে আজকাল ইন্ডিয়ানরাও ভোলে না স্যার, বিশ্বাস করুন স্যার, আমি আপনার কাছে মিথ্যে কথা বলবো না, জেলে যেতে আমার একটুও আপত্তি নেই, কিন্তু আমি জেলে গেলে যে মা-বউ, ছেলেমেয়ে সবাই মারা যাবে স্যার—বিলিভ মি, ভগবানের নামে শপথ করে বলছি—
বলতে বলতে চক্রবর্তী হঠাৎ ড্রাইভারকে বললে—থামো—
ট্যাক্সিটা থেমে গেল।
চক্রবর্তী বললে—নেমে আসুন স্যার, এখানটায় বড় কাদা, গাড়ি ভেতরে যাবে না, আর মিনিট পাঁচেক হাঁটতে হবে—
সে এক অদ্ভুত জায়গা। ক্যালকাটা সিটির মধ্যে যে অমন জায়গা আছে, তা আমি কল্পনাও করতে পারতাম না, না দেখলে। চৌরঙ্গীর হোটেলের টেরাসে বসে সে-জায়গার স্বপ্ন দেখাও অসম্ভব।
চক্রবর্তী বললে—আপনি এখানে একটু দাঁড়ান, আমি নিজে সার্টিফিকেটটা এনে দেখাচ্ছি—
কথাটা শুনে আমি চক্রবর্তীর কোটটা চেপে ধরলাম। আমার মনে হলো ছোকরা এবার সত্যিই পালিয়ে যাবার মতলব করছে। বললাম—নো নো আই ডোন্ট বিলিভ ইউ—আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না, আমি যাবো তোমার সঙ্গে—
—তাহলে আসুন—
বলে চক্রবর্তী আমার আগে আগে চলতে লাগলো। আর আমি তার পেছনে। অন্ধকার রাত। দু-একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো আমাদের দেখে। কয়েকটা গরু রাস্তার ওপর বসে বসে জাবর কাটছে। রিস্ট-ওয়াচটার দিকে চেয়ে মনে হলো রাত বোধ হয় তখন দেড়টা—মিড-নাইট—
হঠাৎ চক্রবর্তী পেছন ফিরলে।
বললে—একটা কথা কিন্তু রাখতে হবে স্যার—
আবার ব্লাফ! আবার ধাপ্পা! ভাবলাম এই মিডল্-ক্লাস বেঙ্গলীজ আর ভেরি স্লাই—এদের মতন ধড়িবাজ জাত আর দুনিয়ায় দুটি নেই। কিন্তু আমিও অ্যাডামেন্ট—আমিও নাছোড়বান্দা। ভাবলাম যা থাকে কপালে, আমি এর শেষ দেখবোই—
বললাম—কী কথা?
—দেখুন, বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মাকে বলেছিলুম যে, আমি অফিস থেকে আসবার সময় ডাক্তার নিয়ে আসবো। তা আমি আপনাকে দেখিয়ে বলবো—এই ডাক্তার এনেছি—
বাঙালীদের ধড়িবাজির কাছে হার মানবো না, এই প্রতিজ্ঞা করেই বললাম—ঠিক আছে, চলো—
—আর একটা কথা!
চক্রবর্তী আবার থমকে দাঁড়াল।
বললে—আর একটা কথা, আপনি যেন বলে দেবেন না যে আমি এই আর্টিস্ট-সাপ্লাই-এর কমিশন-এজেন্সি করি!
—কেন? তারা জানে না?
—না স্যার, কেউ জানে না। আমার মা জানে না, ওয়াইফ জানে না, ছেলেমেয়েরা জানে না। এমন কি পাড়ার লোকরাও জানে না—তারা জানে আমি ইনসিওরেন্সের এজেন্সি করি—
বললাম—ঠিক আছে, তোমার কথাই রইল—
আমি তখন যে-কোনো অবস্থার জন্যেই তৈরি হয়ে রয়েছি। সুতরাং আমি আপত্তি করবো কেন?
চক্রবর্তী একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দরজার কড়া নাড়তে লাগলো।
—মা, মা—ওমা—
ভেতর থেকে একটি ফিমেল-ভয়েস্ শোনা গেল।
—কে? খোকা? খোকা এলি?
আমি বাঙলা জানি না। তবু আন্দাজ করতে পারলাম।
দরজা খুলতেই দেখি একজন বুড়ী হাতে লণ্ঠন নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই যেন বিব্রত হয়ে গেল। বুঝলাম—চক্রবর্তীর মাদার।
মা বললে—হ্যাঁ রে, এই এত রাত্তির করতে হয়? আমি এদিকে ভেবে-ভেবে অস্থির, বউমা ছটফট করছে—এই এখন একটু ঘুমলো—
চক্রবর্তী বললে—আপিসের কাজে একটু দেরি হয়ে গেল মা—
বলে চক্রবর্তী ভেতরে ঢুকলো। আমার দিকে চেয়ে বললে—আসুন স্যার—
তারপর মা’র দিকে চেয়ে বললে—এই ডাক্তারবাবুকে একেবারে ডেকে নিয়ে এলাম মা—
চক্রবর্তীর মা আমার দিকে চেয়ে দেখলে এবার ভাল করে। তারপর বললে—হ্যাঁ রে খোকা, তুই সাহেব ডাক্তার আবার নিয়ে এলি কেন, আমাদের পাড়ার ফণি ডাক্তারকে ডাকলেই হত—হোমিওপ্যাথিতেও তো রোগ ভাল হচ্ছে আজকাল—
—তা হোক মা—
বলে আমাকে চক্রবর্তী ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। আমি ঘরের ভেতরের চেহারাটা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ঘরের মেঝের ওপর ছোট-ছোট দুটো বেবি শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে। খালি গা, কম্প্লিটলি নেকেড। বুকের পাঁজরাগুলো গোনা যায়। আর তক্তপোশের ওপর বিছানায় চক্রবর্তীর ওয়াইফ শুয়ে আছে। চোখ দুটো আধ-বোজা। বেশি বয়স নয়—কিন্তু সমস্ত মুখখানা যেন রক্তহীন—ব্লাডলেস। কী প্যাথেটিক সিন। পৃথিবীতে এ-রকম দৃশ্য যে থাকতে পারে, তা আমেরিকানরা ভাবতেও পারে না—কল্পনা করতেও পারে না। একটা ঘরের মধ্যেই সমস্ত । সমস্ত সংসারটা যেন সেই একখানা ঘরের মধ্যেই শেষ। যেন নিশ্বাস, হাওয়া, প্রাণ, আনন্দ, যন্ত্রণা সব একটা ঘরের চারটে দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
চক্রবর্তী হঠাৎ বললে—মা ট্রাঙ্কের চাবিটা দাও তো—।
মা চাবিটা দিয়ে বললে—ট্রাকের চাবিটা আবার কী করবি এখন?
—একটা জিনিস বার করবো।
বিছানার এক কোণে ওপর-ওপর ট্রাঙ্ক সাজানো ছিল দুটো। চক্রবর্তী বিছানার ওপর উঠে চাবি দিয়ে ট্রাঙ্ক খুললে। তারপর ভেতর থেকে সব জিনিসপত্র বার করতে লাগলো একে একে। নানা বাজে জিনিসের স্তুপ। অনেক খুঁজে অনেক চেষ্টা করে বললে—এই যে পেয়েছি স্যার—পেয়েছি—
ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির বি-এ ডিগ্রিখানা গোল করে একটা কাগজে সযত্নে মোড়া ছিল। সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিলে চক্রবর্তী।
আমি সেটা হাতে নিয়ে কিন্তু আর খুলে দেখলাম না। আর খুলে দেখতে প্রবৃত্তিও হলো না। আমি যেন তখন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছি। আমায়. যেন কেউ আফিম খাইয়েছে। আমার যেন সেখান থেকে আর নড়বার ক্ষমতাও নেই। অস্থি-চর্মসার একটা শরীর। প্রাণ তাতে আছে কি নেই বোঝা যায় না। শরীরটা কুঁচকে বেঁকে শুয়ে আছে। মনে হলো ও যেন চক্রবর্তীর ওয়াইফ নয়। ও যেন একজন টি-বি পেসেন্ট নয়। একটা উদ্ধত নোট-অব-ইনটারোগেশন! বিংশ-শতাব্দীর মডার্ন সভ্যতার সামনে যেন একটা সুতীক্ষ্ম নোট-অব-ইন্টারোগেশন ছাড়া আর কিছু নয়।
চক্রবর্তী আমার কাছে সরে এল এবার।
বললে—ওটা খুলে দেখুন স্যার—দেখবেন জেনুইন ডিগ্রি—ভাইস-চ্যান্সেলারের সই আছে নিচেয়—
আমি তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম ঘরের মধ্যে।
চক্রবর্তী চুপি চুপি বললে—আপনি একটা কিছু কথা বলুন স্যার, নইলে আমার মা’র সন্দেহ হবে।
হঠাৎ একটা বেবি কেঁদে উঠলো। চক্রবর্তীর মা গিয়ে কোলে নিয়ে ভুলোতে আরম্ভ করেছে। ততক্ষণে তার কান্না শুনে আর একটা কাঁদতে শুরু করলো। সেই কান্নায় যেন সমস্ত পৃথিবী প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো সেই রাত দেড়টার সময়। ভুলে গেলাম আমি আমেরিকান। ভুলে গেলাম আমি ট্যুরিস্ট, ভুলে গেলাম আমি ফরেনার। ভুলে গেলাম এ আমার প্রোগ্রামের বাইরে। ভুলে গেলাম আমার গাইড-বুকে এ-জায়গার নির্দেশ-সূত্র নেই। তবু সেইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি যেন পাথর হয়ে গেলাম।
—স্যার!
চক্রবর্তীর গলার আওয়াজে আমি যেন আবার আমার সেন্স ফিরে পেলাম।
বললাম—এসো বাইরে এসো—
চক্রবর্তী বাইরে এল আমার পেছন-পেছন।
বললাম—তোমার ওয়াইফকে হসপিটালে পাঠাও না কেন? এ-রোগীকে কি বাড়িতে রাখতে আছে! এক ঘরে ছেলেমেয়ে মা সবাই থাকো, এটাও তো ডেঞ্জারাস—
চক্রবতী বললে—হসপিট্যালে আমার কারো সঙ্গে জানা-শোনা নেই স্যার—কোনও মিনিস্টার যদি একটু লিখে দেন, তাহলেই হয়ে যায়—কিংবা কোনও এম-এল-এ—
আমি আর কী বলবো। পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম—প্রায় সাত শো টাকা রয়েছে। তাড়াতাড়ি টাকাগুলো চক্রবর্তীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম—এই টাকাগুলোও নাও চক্রবর্তী, চক্রবর্তী, কিপ্ ইট্, তোমার ওয়াইফের চিকিৎসা কোরো—
টাকাটা চক্রবর্তীর হাতে জোর করে গুঁজে দিলাম।
চক্রবর্তী কিছুতেই নেবে না। বললে—আমি এ নিতে পারবো না স্যার, এ আপনি কী করছেন—?
শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে তাকে টাকাটা দিয়ে আমি আবার ফিরে এলাম ট্যাক্সিটার কাছে। ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে দিয়েছিলাম।
চক্রবর্তী আমাকে এগিয়ে দিতে এসেছিল। আমি বললাম—আচ্ছা, তোমার ওয়াইফ ছেলেমেয়েদের খেতে দাও না কেন?
চক্রবর্তী হাসলো এতক্ষণে। বললে—ফ্রান্সের রানীও একবার ওই কথা বলেছিল স্যার, বইতে পড়েছি—
আমি বললাম—না, আমি সে-কথা বলছি না—আমেরিকা থেকে আমরা লক্ষ লক্ষ টন গম, চাল, পাউডার-মিল্ক পাঠাই ইণ্ডিয়াতে—সে-সব তো তোমাদের জন্যেই পাঠাই, তা খাও না কেন?
চক্রবর্তী একটু চুপ করে রইল। তারপর বললে—খবরের কাগজে পড়েছি আপনারা পাঠান—
বুঝলাম ঠিক জায়গায় পৌঁছায় না সেগুলো।
বললাম—ঠিক আছে, কাল ছ’টার সময় আমি চলে যাচ্ছি ক্যালকাটা ছেড়ে, তুমি তিনটের সময় আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে পারো? পজিটিভলি ঠিক তিনটের সময়? ইউ মাস্ট!
চক্রবর্তী জিজ্ঞেস করলে—কেন, কী জন্যে বলছেন?
—আমি তোমাকে কিছু টাকা দিতে চাই, আরো কিছু টাকা। যা ছিল কাছে তা তোমাকে দিয়ে গেলাম, কালকে হোটেলে তোমাকে আরো তিন শো দিতে পারি! আই ওয়ান্ট টু হেল্প ইউ—
চক্রবর্তী কিন্তু-কিন্তু করছিল, কিন্তু আমি তাকে রাজি করালাম জোর করে।
ট্যাক্সির ভেতরে আর একবার মনে করিয়ে দিলাম—ঠিক তিনটের সময় এসো কিন্তু, আমি ওয়েট করবো তোমার জন্যে—ঠিক তিনটে—
ঘড়িতে দেখলাম—রাত তখন হাফ-পাস্ড্ টু। আড়াইটে কাঁটায়-কাঁটায়।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতে দেরি হলো। সকালে আর কোথাও বেরোলুম না। হুকুমালী সামনে আসতে একটু সঙ্কোচ করছিল। কিন্তু খানিক পরে সে-সঙ্কোচ কেটে গেল। যে-সব জায়গা দেখবো বলে ঠিক করেছিলাম সে-সব কিছুই দেখা হলো না। হুগলি-রিভার, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বোটানিক্যাল গার্ডেনস, লেকস্, রেস কোর্স, গান্ঢি-ঘাট—কিছুই গেলাম না। রাত্রে যে-বিউটিফুল ক্যালকাটা দেখেছি, তার কাছে আর সব যেন নিষ্প্রভ হয়ে গেল। শুধু টেরাসের ওপর দাঁড়িয়ে গভর্নরস্ হাউসটা দেখতে লাগলাম একদৃষ্টে। আর সামনে ময়দান। ফোর্ট উইলিম, পলাশী গেট—
যথারীতি ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ খেয়ে বিশ্রাম করতে লাগলাম ঘরের মধ্যে। আমার গাইড এসে ফিরে গেল।
বললাম—আমি নিজেই সাইট-সিয়িং করে এসেছি—
হুকুমালীও দু-একবার উঁকি মেরে দেখে গেল।
ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম—তিনটে বাজে। চক্রবর্তী আসবে। বাকি তিন শো টাকা রেডি করে রেখে দিয়েছি পকেটে।
আর যেন দেরি সয় না। ঘড়ির দিকে আবার চেয়ে দেখলাম তিনটে বেজে গেছে। তিনটে পনেরো। তিনটে কুড়ি। থ্রি-থার্টি!
আমি উঠলাম। আর দেরি করা যায় না। এবার এয়ারপোর্টের বাস আসবে। প্লেন ছাড়বে ছ’টায়। তার আগেই তৈরি হয়ে নিতে হবে।
হঠাৎ হুকুমালী এসে একটা চিঠি দিয়ে গেল।
জিজ্ঞেস করলাম—কে চিঠি দিলে?
হুকুমালী বললে একজন বাবু এসে নিচে ম্যানেজারের কাছে চিঠিটা দিয়ে গেছে। চিঠিটা সিল করা। খাম ছিড়তেই অবাক হয়ে গেলাম। ভেতরে আমার দেওয়া সেই সাত শো টাকা। সাতটা এক শো টাকার নোট! আর সঙ্গে একটা চিঠি। লিখেছে এ সি চক্রবর্তী—আর্টিস্ট সাপ্লায়ার।
লিখেছে—
ডিয়ার স্যার,
কালকে আপনার দেওয়া সাত শো টাকা ফেরত পাঠালাম পত্রবাহক মারফত। আজকে তিনটের সময় আপনার সঙ্গে দেখা করার প্রতিশ্রুতিও রাখতে পারলাম না। কারণ কাল শেষ রাত্রের দিকে আমার স্ত্রী মারা গেছে। আপনাকে ধন্যবাদ। ইতি—
এই। এইটুকু শুধু। আর কিছু নয়।
আমি চিঠিখানা আর টাকাগুলো হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছু ভাবতে পারলাম না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আমার যেন জ্ঞান ফিরে এল। হঠাৎ খেয়াল হলো সাড়ে চারটে বেজেছে। হোটলের সামনে এয়ারপোর্টের বাস এসে পৌঁছেছে। হুকুমালী আমার স্যুটকেস নিয়ে নেমে চলে গেল।
বললাম—তারপর?
মিস্টার রিচার্ড বললেন—তারপর তো এই যাচ্ছি—।
তারপর হঠাৎ যেন বড় এক্সাইটেড হয়ে উঠলেন মিস্টার রিচার্ড।
বললেন—কিন্তু আমি আজ আপনাকে বলে রাখছি—দিস্ ইজ রঙ, দিস্ ইজ্ ক্রিমিন্যাল—এ অন্যায়, এ সততা পাপ—এ অনেস্টির কোনও দাম নেই মডার্ন পৃথিবীতে—দিস ইজ রঙ—দিস্ ইজ ক্রিমিন্যালি রঙ—
মিস্টার রিচার্ডের চিৎকারে আশেপাশের অন্য সিট থেকে সবাই আমাদের দিকে চেয়ে দেখলে। কিন্তু আমি চুপ করে রইলাম। ষোল হাজার ফুট ওপরে উঠে মাটির পৃথিবীর মানুষের সমস্যা নিয়ে ভাবাও যেন বিলাসিতা বলে মনে হলো আমার কাছে। এই দামী ডিনার আর লেমন-স্কোয়াশ খেতে খেতে দেশের কথা নিয়ে তর্ক করাও যেন অপরাধ। চোখের জল ফেলাও ক্রাইম! আমি চুপ করে রইলাম তাই।
অনেকক্ষণ পরে মিস্টার রিচার্ড আবার হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন—আচ্ছা একটা কথার জবাব দিন তো?
—কী?
—আমরা যে লক্ষ লক্ষ টন হুইট, রাইস আর পাউডার-মিল্ক পাঠাই ইণ্ডিয়ার গরিব লোকদের জন্যে, সেগুলো কারা নেয়? সেগুলো গরিবদের হাতে পৌঁছয় না কেন? কে তারা? হু আর দে?
এরই-বা আমি কী জবাব দেব! প্লেনের ভেতরে আমরা সব্বাই তো ফরসা দামী কোট-স্যুট-টাই-ট্রাউজার পরে বসে আছি। সবাই মোটা দাম দিয়ে টিকিট কিনেছি। কিনে লেমন-স্কোয়াশ খেয়েছি, টফি খেয়েছি, ডিনার খেয়েছি। ডিনারের পর কফিও খেয়েছি। আমাদের কী অধিকার আছে এ-আলোচনা করবার! ভাবলাম বলি—সাহেব, তুমি একদিনের জন্যে কলকাতা দেখে গিয়েই তোমার এই অবস্থা, আর আমরা জন্ম কাটিয়েছি কলকাতায়, মনুষ্যত্বের এ-অপমান আমরা প্রতি মুহূর্তে দেখছি। তাই আমাদের চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে, আমাদের গায়ের চামড়া মোটা হয়ে গিয়েছে। সুতরাং ও-সব কথা থাক, এসো, অন্য কথা বলি—লেট্ আস্ টক্ শপ্—
কিন্তু সে-সব কথাও বললাম না।
সামনে আলো জ্বলে উঠলো—আলোর মধ্যে লেখা ফুটে উঠলো—ফ্যাসেন্ ইয়োর বেল্ট্স্—
আমরা যে-যার নিজের নিজের পেটে বেল্ট বেঁধে নিলাম।
বাইরে চেয়ে দেখলাম—বম্বে সিটির আলোগুলো হীরের টুকরো হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। প্লেন নামতে শুরু করেছে। স্যান্টাক্রুজে পৌঁছে গেলাম এক-মহূর্তের মধ্যে।
১৩৬৭ (১৯৬০)