1 of 2

দেবদূত অথবা বারোহাটের কানাকড়ি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

দেবদূত অথবা বারোহাটের কানাকড়ি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

লাল মিঞা

কত বড় জবরদস্ত মানুষ যে লাল মিঞা, তার প্রমাণ একবার তিনি হাসেমকে এমন একখানা কান-চাপাটি ঝাঁপড় মেরেছিলেন যে সেই থেকে হাসেম আর বাঁ কানে শুনতেই পায় না। তখন থেকে তার নাম এককেনো হাসেম। তার সেই নামের মধ্যে লাল মিঞার কীর্তি স্থায়ী হয়ে রইলো। এককেনো হাসেম এখন লাইনের চায়ের দোকানে কাজ করে। ছোঁড়াটা এমন মজার যে যদি সে বাঁ দিক ফিরে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন যতই তাকে ডাকো, সে শুনতে পাবে না। তখন তাকে ধরে ঘুরিয়ে দিতে হয় ডান দিকে।

লাল মিঞার আর একখানা কীর্তির কথা লোকের মুখে মুখে ঘোরে। এই গ্রামে প্রথম নাইলন সুতোর ছিপ এনেছিলেন লাল মিঞা। সেই ছিপ পেতে বসেছিলেন বারো শরিকের পুকুরে। এই পুকুরে যার খুশি ছিপ ফেলে মাছ ধরুক, কিন্তু কেউ চুপচাপে জাল ফেললেই কাজিয়া লেগে যাবে। বারো শরিকের কারুর বাড়ি বিয়ে-সাদি হলে তখনই দেওয়া হবে জাল ফেলার অধিকার।

বিরাট পুকুর, মাছ আর পদ্মপাতায় ভরা। দুপুরবেলা লাল মিঞার ছিপের নীল রঙের সুতোয় টান পড়লো। অমনি বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগলো হুইল। মাছটা সারা দিঘি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। টান দিতে গিয়ে লাল মিঞা ভাবলেন, ওরে বাপস, এটা মাছ না জলদানব? লাল মিঞা নিজে সা-জোয়ান। গাজীর নাম নিয়ে জোরে হ্যাঁচকা টান দিতেই টাল সামলাতে পারলেন না, পড়ে গেলেন জলে। লাল মিঞা জীবনে কখনো হারেন নি। জলের মধ্যে লেগে গেল লড়াই। সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড। লাল মিঞার সারা গায়ে জড়িয়ে গেছে নাইলনের সুতো, সে আর কিছুতেই ছেঁড়ে না, তিনিও উঠে আসতে পারেন না, অন্যদিক থেকে জলদানব তাঁকে টানছে।

শেষ পর্যন্ত লাল মিঞারই জয় হলো। তিনি দু’হাতে বুকের মধ্যে তাঁর শত্তুরকে সাপটে ধরে এক সময় উঠে এলেন। এই অ্যাও বড় কালো হাঁড়ির মতন মাথা, ড্যাব ড্যাবা চোখ, একটা বিরাট কাতলামাছ। পরে ওজন নিয়ে দেখা হয়েছে, ঠিক আট কেজি। অত বড় একটা মাছের সঙ্গে জলের মধ্যে কুস্তি করে কেউ ধরে আনতে পেরেছে, এমন কথা ভূ-ভারতে কখনো শোনা যায় নি। আশেপাশের দশখানা গাঁয়ের মধ্যে এখনো কেউ বড় মাছ ধরলেই লোকে বলে, আরে যা যা, রেকট করেছিল বটে লাল মিঞা, এখনো তাঁকে ছাড়িয়ে যাবার হেম্মৎ কেউ দেখাতে পারে নি।

তবে, এসব লাল মিঞার যৌবনের কথা। এখন তাঁর আসল জোর মামলায়। জমি-জিরেত নিয়ে লাল মিঞার সঙ্গে একবার যে মামলায় জড়াবে, তার গুষ্টির তুষ্টি নাশ হয়ে যাবে।

রাত্তিরবেলা বাড়ি ফিরছেন লাল মিঞা। পরনে সিল্কের লুঙ্গি আর সাদা মলমলের পাঞ্জাবি। পায়ে রবারের পাম্প শু, হাতে তিন ব্যাটারির টর্চ। খানিক আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, রাস্তায় হড়হড়ে কাদা। তার মধ্য দিয়ে গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে হাঁটছেন তিনি। অন্য যে-কেউ আছাড় খেয়ে পড়তে পারে, কিন্তু লাল মিঞা? সে তো একটা বাঘ।

গ্রামে এখন নিশুতি রাত। এর মধ্যে লাল মিঞার টর্চের আলো এদিক-ওদিক ঝিলিক দিচ্ছে। পেয়ারাতলির পাশে একটি একটেরে ঘর, সেখান থেকে হঠাৎ শোনা গেল একটি কচি শিশুগলার কান্না।

ঘৃণায় লাল মিঞা মুখ বাঁকালেন।

সব জায়গায় হাসিনা

রহমান সাহেবের বাড়িতে অতিথি এসেছেন চারজন। রহমান সাহেব কলকাতায় সেটলমেন্ট অফিসে চাকরি করেন। সপ্তাহে একবার বাড়ি ফেরেন, প্রায়ই তাঁর সঙ্গে মেহমান থাকে। আসার পথে আড়বেলের হাট থেকে গোস্ত কিংবা বড় মাছ কিনে আনেন। অনেক রাত পর্যন্ত তাঁর বাড়িতে গান-বাজনা হয়। রহমান সাহেবের বাবা মাত্র ছ’ মাস আগে এন্তেকাল করেছেন। তিনি ছিলেন ভারি কড়া লোক। তিনি পাঁচ ওক্ত নামাজ পড়তেন এবং দানধ্যান করতেন নিয়মিত। তাঁর আমলে পঁয়তিরিশ বছর বয়স্ক রহমান সাহেবও বাড়িতে থাকতেন মুখ বুজে। এখন তিনি যেভাবে চলছেন, তাতে লোকে বলে, বাপের বিষয়সম্পত্তি তিনি দু’দিনেই উড়িয়ে দেবেন।

রহমান সাহেবের স্ত্রী নাজমা পোয়াতী। আম্মার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। এত লোকের রান্নাবান্না করবে কে? বাড়িতে যে ছোট মেয়েটি বাসন মাজতে আসে, তাকে নাজমা বললো, যা তো, হাসিনাকে ডেকে নিয়ে আয়!

পাঁচ মিনিটের রাস্তা। ডাক পেয়েই হাসিনা ছুটতে ছুটতে চলে এলো।

হাসিনা আল্লার এক অপূর্ব সৃষ্টি। সকলেই জানে, তার বয়েস ত্রিশ-একত্রিশের কম নয়। কিন্তু দেখায় ঠিক ষোলো-সতেরো। খুব বেশি মনে হয় তো কুড়ি। রঙটি কালো, কিন্তু সেই কালোর ওপরেই যেন চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ে। শরীরের গড়ন-পেটনও খুব মজবুত। সে কখনো হাঁটে না, সব সময় দৌড়ে দৌড়ে চলে। আর এ মেয়ের কত গুণ! হাতখানা যেন মধু। যা রাঁধবে তাতেই এমন সোয়াদ আসবে যে সবাই চেয়ে চেয়ে খাবে। হাসিনাকে পানি এনে দিতে বলো, পুকুর থেকে দশ ঘড়া পানি তুলে দেবে, তারপরও মুখখানা তার হাসি-হাসি থাকে। সারা বাড়ি মুছে ঝকঝকে তকতকে করে দেবে সে, একবার বলতেও হবে না।

হাসিনা বড়মানুষের দুঃখী মেয়ে। পাড়ায় কারুর বাড়িতে বড় কাজকর্ম থাকলে হাসিনার ডাক পড়ে। সে দু হাতে সতেরো হাতের কাজ করে দেয়। দোতলায় পুকুরের ধারের ঘরটিতে রহমান সাহেব তাঁর মেহমানদের নিয়ে বসেছেন, কখনো হেঁকে পানি চাইছেন, কখনো কাবাব, কখনো একটা দেশলাই, হাসিনা ছুটে ছুটে গিয়ে দিয়ে আসছে সব কিছু। একতলার রান্নাঘরে বসে থাকলেও সে দোতলার হাঁক একবারেই ঠিক শুনতে পায়। কখনো সে দোতলায়, কখনো সে পুকুরঘাটে, কখনো রান্নাঘরে, কখনো বা সে রহমান সাহেবের মাকে পান ঘেঁচে দিচ্ছে। মুখের হাসিটি লেগে আছে ঠিক।

দরজার আড়াল থেকে হাত বাড়িয়ে সে বললো, এই নিন রহমানভাই, আপনি দেশলাই চেয়েছিলেন।

রহমান সাহেব বললেন, ভেতরে আয় না, এত লজ্জা কী?

উঠে গিয়ে তিনি হাত ধরে হাসিনাকে টেনে নিয়ে এলেন ভেতরে। তাঁর চারজন দোস্তের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, এ আমার এক দূরসম্পর্কের বোন হয়। আসলে এ আমার এক শত্রুর মেয়ে। ওর বাবার সঙ্গে আমার মামলা চলছে। ওর বাবা অতি ঘোড়েল লোক, কিন্তু এ মেয়েটা খুব ভালো। আচ্ছা, বলুন তো, এর বয়েস কত?

হাসিনাকে নিয়ে এই খেলাটা সবাই খেলে। বয়েস হলে মানুষের মুখে তার একটা ছাপ পড়বেই। শুধু হাসিনা ব্যতিক্রম।

অতিথিদের মধ্যে কেউ বললো আঠারো, কেউ বললো কুড়ি। এদের মধ্যে যার নিজেরই বয়েস অনেক কম, সেই মীজানুর বললো, কত আর হবে, পনেরো, ষোলো।

রহমান সাহেব হো-হো করে হেসে উঠলেন।

কালো রঙের মেয়ে, তার ওপর পরে আছে একটি কালো শাড়ি। হাসিনা যেন রাত্তিরের সঙ্গে মিশে আছে।

রহমান সাহেব মীজানুরকে বললেন, এর বড় ছেলেটারই বয়েস বোধ হয় চোদ্দ-পনেরো। না রে হাসিনা? এর ছেলেমেয়ে কটি জানেন? তিনটে না চারটে রে?

হাসিনা আঙুলে নখ খুঁটতে খুঁটতে বললো, তিন।

সবাই খুব বিস্ময় প্রকাশ করলো।

রহমান সাহেব বললেন, মীজানুর, তুমি তো বিয়েশাদি করোনি এখনও? একে বিয়ে করবে? কি রে হাসিনা, তোর পছন্দ হয় আমার এই বন্ধুকে? মুখ তুলে দ্যাখ ভালো করে, একে নিকে করবি?

হাসিনা ঘাড় কাত করে বললো, হুঁ!

রহমান সাহেব বললেন, দেখছেন তো, স্বভাবটা ওর একদম বাচ্চার মতন? এরকম বিয়ে-পাগলী মেয়ে আর আমি দেখিনি! একেও অনেকেই বিয়ে করতে চায়। তবে একটা বড় কঠিন শর্ত আছে! সেটা শুনলেই পিছিয়ে যায় সবাই!

লাইনে সন্ধ্যা

কলকাতা শহর থেকে মাত্র সত্তর মাইল দূর হলেও এদিকে ট্রেন চলে না, এদিকে বিদ্যুৎ পৌঁছোয় নি। তবে, দেড় মাইল হাঁটা-পথের পর বড় রাস্তা, সেখান দিয়ে অনেক বাস চলে। এখানে বাস রাস্তাকেই বলে লাইন। যেখানে বাস থামে, তার নাম স্টেশন।

বিকেলের পর গাঁয়ের অনেকেই একবার লাইনের দিকে ঘুরে আসতে যায়। এখানে কিছু দোকানপাট আছে। এখানে এসে কিছুক্ষণ বসলে পাঁচরকম কথা শোনা যায়। কেউ কেউ শখ করে এখানে চা খেতে আসে। বসিরহাট কিংবা এদিকের আড়বেলের বাজারে মাছের দাম, পাটের দাম, আলুর দাম কত, তাও জানাজানি হয়ে যায় এখানে।

সবচেয়ে ঝলমলে দোকানটি বীরেন সাহার। সুঁচ সুতো থেকে শুরু করে ফুটবল পর্যন্ত পাওয়া যায়। সামনে সাজানো সারি সারি কাচের বয়ামে নানারকম লজেন্স ও বিস্কুট। এক-একবার বাস এসে থামে আর বীরেন সাহা চোখ তুলে দেখে। শহরে কে কে গিয়েছিল, কে কোনরকম জিনিসপত্র নিয়ে এলো সঙ্গে করে।

দোকানের সামনে সাত থেকে তেরো বছর বয়েসের তিনটি ছেলেমেয়ে অনেকক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছে হাঁ করে। দুটি ছেলে, একটি মেয়ে, মেয়েটিই ছোট। তিনজনই পরে আছে ছোট ইজের, খালি-গা ওরা। চোখ দিয়ে লজেন্স বিস্কুটগুলো চাটছে।

বীরেন সাহা মাঝে মাঝে ধমক দিয়ে ওঠে, এই, যা যা! কেন দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছিস?

ওরা নড়ে না। মেয়েটার নাক দিয়ে সিকনি গড়াচ্ছে, মেজ ছেলেটা ঘ্যাসর ঘ্যাসর করে চুলকোচ্ছে উরু, সেখানে পাঁচড়া হয়েছে। বড় ছেলেটা ছটফটে ভাবে এদিক-ওদিক তাকায় সর্বক্ষণ। তার রোগা ক্যাংলা চেহারা, কিন্তু মুখচোখ দেখলেই বোঝা যায় বেশ বুদ্ধি আছে। তার নাম জাভেদ।

বীরেন সাহা আবার তাড়া দিয়ে উঠলো, এই, যা যা সর দোকানের সামনে থেকে।

ওরা তবু নড়লো না। ওরা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপর। রাস্তাটা কারুর কেনা নয়!

দোকানে খদ্দের আসছে যাচ্ছে। একটু ফাঁকা হলেই বীরেন সাহার চোখ পড়ে ঐ দিকে। সর্বক্ষণ হ্যাংলার মতন চেয়ে থাকা ঐ তিনটে বাচ্চাকে দেখতে কারুর ভালো লাগে? একটা নুলো ভিখিরি এসে ভিক্ষে চেয়ে পাঁচ নয়া নিয়ে গেল। ওরা ভিক্ষেও নেবে না।

শেষ পর্যন্ত বীরেন সাহা কাচের বয়াম খুলে তিনটে শস্তা লজেন্স বার করে বললো, এই নে, এদিকে আয়, নে তারপর যা!

ছেলেমেয়ে তিনটে তবু এগোলো না। পরস্পরের মুখের দিকে চাইলো একবার, কিন্তু নড়লো না কেউ।

—এ যে দেখছি মহাজ্বালা!

একটু পরেই মোক্ষম অস্ত্র পেয়ে গেল বীরেন সাহা। বসিরহাটের দিক থেকে একটা বাস এসে থামলো, তার থেকে নামতে দেখা গেল লাল মিঞাকে।

বীরেন সাহা বললো, ঐ লাল মিঞা আসছে!

জাভেদ পেছন ফিরে তাকিয়ে সত্যিই রাস্তার ওপারে লাল মিঞাকে দেখতে পেয়ে কেঁপে উঠলো। তাড়া খাওয়া জন্তুর মতন অমনি গ্রামের দিকে ছুটলো পাঁই পাঁই করে। তার ভাই-বোনও তার পেছনে পেছনে ছুট মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

গণি চৌধুরীর মনোবেদনা

যারা শুধু চাষবাস নিয়ে আছে, তাদের ভাগ্যের বিশেষ উত্থানপতন নেই। কোনো কোনো বছর খুব খারাপ যায়, কোনো কোনো বছর খারাপ দিনগুলোও সয়ে যায়। হঠাৎ কোনো বছর যদি পাটের দাম একটু চড়ে, বাজারে আগেভাগে পাট পৌছোনো যায়, তা হলে হাতে কিছু উটকো টাকা আসে। সেই টাকায় ঘরের ছাউনি বদলানোটা হয় সেবার।

গণি খান চৌধুরী তাঁর ভাই রহিমের মতনই আলাদা আলাদা জমি চাষ করে আসছিলেন। এক বছর তিনি খেয়ালের বশে পাটবেচা টাকায় জলকর ডেকে নিলেন। সেবার থেকেই তাঁর ভাগ্য ফিরলো। আজকাল মাছের ভেড়িতেই সোনা ফলে।

এখন গণি চৌধুরীর দোতলা কোঠাবাড়ি। সে বাড়িতে রেডিও আর বন্দুক আছে। তাঁর হাতে সোনার ব্যাণ্ডের হাতঘড়ি। দেশলাইয়ের বদলে লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরান। তাঁর পাঁচ ছেলে, সবাই মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। দুই ছেলে দেখে চাষবাস, আর দুই ছেলে পড়ে থাকে ভেড়িতে। ছোট ছেলেটি ইস্কুলে যায়। গণি চৌধুরীর ইচ্ছে আছে সামনের বছর ফেরিঘাটের নিলামের সময় ডাক দেবেন।

বয়েস হলেও গণি চৌধুরীর শরীরটা মজবুত আছে। দুই বিবিই গত হয়েছেন অকালে। ছেলেরা বড় হয়েছে, তিনি আর নতুন করে শাদির কথা ভাবেন না। ছেলেরা তাঁর যত্নআত্তির কোনো ত্রুটি রাখেনি, তাঁর কাজের বোঝাও হালকা করে দিয়েছে। তিনি এখন পরোপকার করে বেড়ান। মসজিদ সংস্কার, গ্রামে প্রাইমারি স্কুল গঠনের জন্য সরকারের কাছে আবেদন, মাদ্রাসার শিক্ষকদের বকেয়া বেতন—এসব ব্যাপারে গণি চৌধুরী সব সময় খুশি। তেঁতুলগাছের পীরসাহেবের মাজারের সামনে তিনি নিজ ব্যয়ে বসিয়ে দিয়েছেন টিউকল, কাজী কবির ইন্তেকালের পর যে ফাংশান হলো তাতে তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। কেউ বলতে পারবে না নতুন টাকার গরমে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। তিনি দয়ালু মানুষ। গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যান, সকলে সম্ভ্রমের সঙ্গে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে।

সন্ধের দিকে গণি চৌধুরীর একটু জ্বর এসেছে। প্রায়ই এরকম ঘুষঘুষে জ্বর আসে। ডাক্তারকে দেখাতে যাবেন যাবেন করেও হচ্ছে না। চাষীর রক্ত আছে শরীরে, যখন-তখন ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা এখনো রপ্ত করতে পারেন নি। তাঁর দোস্ত গীয়াসুদ্দিন আহমদের জানাজায় যাবার কথা ছিল, তিনি আর গেলেন না। দোতলায় নিজের ঘরে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

কিন্তু বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারলেন না। ছটফট করছেন। কেমন যেন শয্যাকণ্টকীর ভাব। একবার উঠছেন, একবার জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, আবার ফিরে আসছেন বিছানায়। বাড়িটা নিঝুম, ছেলেরা কেউ নেই বাড়িতে। দুই ছেলের বউ নিশ্চয়ই গেছে পাড়া বেড়াতে।

একবার জানলার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এখান থেকে দেখা যায়, তাঁর নিজের বাড়ির চৌহদ্দি, তারপর ফলবাগান, নিজস্ব পুকুর, অনেক দূর বিস্তৃত ধানজমি। সবই তাঁর নিজের জীবনে গড়া। পুকুরের ওপারে তাঁর ভাই রহিমের কাঁচা বাড়িটি যেমন আগে ছিল তেমনিই আছে।

তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এত করেও কী লাভ হলো? সন্ধেবেলা এই যে তাঁর শরীর ছনছন করছে, এই সময় পাশে এসে দাঁড়াবার কেউ নেই। কেউ তাঁর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে আসবে না। শরীরে এত তাগত অথচ শরীর থাকে অনাহারে।

তিনি হতাশভাবে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন। যদি এই সময় কেউ এসে পাশে বসতো, দুটো সোহাগের কথা কইতো! দুই প্রাক্তন বিবির মধ্যে একজনের কথাও গণি চৌধুরীর মনে পড়লো না, তিনি ভাবতে লাগলেন আর একজনের কথা, বড় কোমল তার মুখখানা, তার হাতের আঙুলে যেন জাদু।

হাসিনার পূর্ব ইতিহাস

ষোলো বছর বয়েসে হাসিনার চেহারা যখন ঠিক ষোলো বছরের মেয়ের মতই ছিল, সেই সময় সে এক সন্ধেবেলা লাইনের ধার থেকে মেল বাসে উঠে পালায়। হাসিনা পাকতে শুরু করেছিল তেরো বছর বয়েস থেকে। তার বাড়বাড়ন্ত শরীরের জন্য পাড়ার চাচা আর দুলহাভাইরা একটু গোপন ফুরসত পেলেই তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতো। এইভাবে হাসিনার শরীর গরম হয়ে গেল। ষোলো বছর বয়েসে একটি লম্বা-চওড়া ছেলে তাকে হাতছানি দিতেই সে সরে পড়লো তার সঙ্গে।

দোর্দণ্ডপ্রতাপ লাল মিঞা মেয়ের খোঁজে চতুর্দিকে লোক লাগালেন। বেশি দূরে নয়, হাসিনাকে পাওয়া গেল ইটিণ্ডাঘাটে। ছেলেটি সেখানে ফলের ব্যবসা করে, তার নাম জামালুদ্দিন।

লাল মিঞা ছেলেটিকে টুটি ধরে নিয়ে এলেন। মেয়েকে দিলেন বিষম মার। শেষ পর্যন্ত মেয়ের বদ নসিবের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই জামালুদ্দিনের সঙ্গেই শাদি দিলেন মেয়ের।

কিন্তু জামাল ছেলেটি বড় তেরিয়া। লাল মিঞার ইচ্ছে ছিল ওকে তিনি ঘরজামাই করবেন। তাঁর নিজের পাঁচ মেয়ে আর এক ছেলের মধ্যে ছেলেটাই সবচেয়ে কমজোরী। প্রায়ই সে কাসির অসুখে ভোগে। কিন্তু জামাল রাজি হলো না, সে তার স্বাধীন ফলের ব্যবসায় ফিরে যেতে চায়। শেষকালে এমন হলো, শ্বশুরে-জামাইতে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ।

বিয়ের পাঁচ বছর পর জামালুদ্দিন বেশ ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। ফলের দোকানের আড়ালে সে শুরু করেছিল বন্দুক পিস্তলের চোরাচালানি কারবার। কাছেই বর্ডার, এখানে ঐ সব কারবারের অনেক সুবিধে আছে। বিপদও আছে এই কাজে, কিন্তু এক-একজন মানুষ বিপজ্জনক জীবন কাটাতেই চায়। জামালের চওড়া বুক, চোখে বুদ্ধির দীপ্তি, সে এই পৃথিবীতে হেরে যাবার জন্য আসে নি, সে চায় যতটা সম্ভব ভোগ করে নিতে।

জয়বাংলা হবার সময় তার কাজ কারবারে খানিকটা অসুবিধে হলো। বন্দুক-পিস্তলের তখন জলের দাম। একটা মাসকট একশো টাকায় সেধে সেধে বিকোয়, তিনশো টাকায় এল এম জি। কয়েক বছর পর অবস্থা একটু বদলাবার পর সে বেচাকেনা করতে লাগলো পাইপগান। খুব সস্তার মাল হলেও এতে ঝুঁকি কম, এর বাজার সব সময় তেজী থাকে।

কিছু দিনের জন্য সে মাছের ব্যবসাতেও নেমেছিল। কিন্তু এই নিয়ে তার শ্বশুরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ বাধে। গণি খান চৌধুরী লাল মিঞার বিশেষ দোস্ত। লাল মিঞাও কিছুদিন আগে জলকর নিয়েছেন। এখানকার ভেড়িওয়ালারা নিজেদের স্বার্থেই বাংলাদেশ থেকে মাছের স্মাগলিং আটকাতে চায়। নইলে তাদের মাছের দর নেমে যায় যখন-তখন। এদের হাতে আছে থানা-পুলিশ। জামালুদ্দিন এখানে হেরে গেল।

মাঝে মাঝে ছোটখাটো মারামারিতে জড়িয়ে পড়তো জামালুদ্দিন। তার অসীম সাহস। এইরকম কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামায় সে হঠাৎ প্রাণ হারাতে পারতো, কিন্তু সে মারা গেল মাত্র সাত দিনের জ্বরে। মাথায় অসহ্য ব্যথা নিয়ে দেখা দিল কী এক নতুন রোগ, আর সেই রোগেই সুস্থ সবল মানুষটি মরে গেল দাপিয়ে দাপিয়ে। এক শীতের রাত্রে। ঘরে তখন তার তিনটে বাচ্চা আর যুবতী স্ত্রী।

জামালুদ্দিনের জমা টাকা-পয়সা বা বিষয়-সম্পত্তি কিছুই ছিল না। ফলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে পথে বসতে হলো হাসিনাকে। তার সোমত্থ যৌবনের জন্যই বাড়িতে শুরু হলো চিল-শকুনের উপদ্রব।

লাল মিঞা বাধ্য হয়েই মেয়েকে নিয়ে এলেন নিজের কাছে। মেয়েটার কথা মন থেকে তিনি বাদই দিয়েছিলেন, কিন্তু ঐ মেয়ে যদি হাসনাবাদের বাজারে গিয়ে নাম লেখায়, তাহলে সবাই তো বলবে, দ্যাখো, দ্যাখো লাল মিঞার মেয়ে রেণ্ডি হয়েছে!

লাল মিঞা মেয়ের ঘরে গিয়ে বললেন, বাক্স বিছানা গুছিয়ে নে। আজই যাবি আমার সঙ্গে।

ঘরের মধ্যে কিলবিল করছে তিনটে বাচ্চা। লাল মিঞা ঘৃণায় মুখ বেঁকিয়ে বললেন, ঐ শয়তানের বাচ্চাগুলোকে কোথায় নিয়ে যাবি, ওদের এখানে রেখে যা!

হাসিনা বাপের পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বললো, আব্বা, ওদের আমি কোথায় ফেলে যাবো, ওদের আমি নিজের পেটে ধরিচি। ওদের আর কে আছে?

লাল মিঞা জিজ্ঞেস করলেন, কেন, জামালের নিজের লোক কেউ নেই? তারাই ওদের দেখবে। ওরা আমার কেউ নয়।

হাসিনা বললো, সে মানুষটার তো আপনার জন আর কেউ ছিল না। আছে শুধু এক বুড়ি দাদী, সে চোখে দেখে না ভালো, তার নিজেরই খাবার জোটে না, সে কোথা থেকে ওদের খেতে দেবে?

লাল মিঞা বললেন, তাহলে ওদের রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে যা। অমন কত বাচ্চা রাস্তায় থাকে!

ঘরের এক কোণে বসে জুলজুল করে চেয়ে দেখছে তিনটে বাচ্চা। তিনজনেরই এসব কথা বুঝতে পারার বয়েস হয়ে গেছে।

লাল মিঞা রাগ করে মেয়েকে না নিয়েই ফিরে এলেন। যাক ওরা জাহান্নামে যাক।

খিদের জ্বালা সইতে না পেরে একদিন হাসিনা নিজেই ছেলেমেয়েগুলোর হাত ধরে এসে উপস্থিত হলো বাপের বাড়িতে। তার নিজের মা বেঁচে নেই, কেঁদে পড়লো ছোট আম্মার পায়ের ওপর।

লাল মিঞা প্রথমে একচোট খুব হম্বিতম্বি করলেন। ও মেয়ের মুখদর্শনও করতে চাইলেন না। কিন্তু তার ছোটবিবি নাজমা যখন বললেন, আহা এয়েছে যখন ফেলে তো দিতে পারবে না! বরং খালপাড়ে যে পাট রাখার ঘরটা বানিয়েছিলে, সেটা তো এখন খালি, সেখানে গিয়ে থাকুক—অমনি লাল মিঞা চটে উঠে এক ধমক দিলেন ছোট বিবিকে। কী, তাঁর মেয়ে অতদূরে খালপাড়ে একা থাকবে? শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাবে না?

পেয়ারাবাগানের এক কোণে একটা ঘর তুলে দিলেন লাল মিঞা। সে ঘরের অর্ধেকটা গিয়ে পড়লো রহমান সাহেবদের জমিতে। রহমান আপত্তি জানাতেই মামলা ঠুকে দিলেন লাল মিঞা আর সেই মামলার ঝোঁকে বেশ কিছুদিন মশগুল হয়ে রইলেন তিনি।

হাসিনা বাপের বাড়িতে জায়গা পেল একটি শর্তে। সে তার নিজের ভরণপোষণ পাবে বাপের কাছ থেকে। কিন্তু ছেলেপুলেদের কিছু দেবেন না লাল মিঞা। ওরা তাঁর কেউ নয়, ওরা তাঁর দুশমনের বাচ্চা।

হাসিনা মাঝে মাঝে এবাড়ি-ওবাড়ি কাজ করতে যায়। তখন ছেলেমেয়েরা ঘুরে বেড়ায় আদাড়ে-আঁস্তাকুড়ে। তিনজন সব সময় থাকে এক সঙ্গে। কী হ্যাংলা, কী হ্যাংলা! যেখানে যা-কিছু কুড়িয়ে পায়, সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে নেয় চেটেপুটে। হাসিনা যে-সব বাড়িতে কাজ করতে যায়, সেখানে ওদের যাওয়া নিষেধ। কাজের বাড়িতে তিনটে বাচ্চা ঘুরঘুর করবে, এটা কেউ পছন্দ করে না। তা ছাড়া চোর-ছ্যাঁচোড়ের মতন স্বভাব, কখন কোন জিনিসটা টুক করে সরিয়ে ফেলবে তার ঠিক নেই।

লাইনের ধারে ছেলেমেয়ে তিনটেকে একদিন ভিক্ষে চাইতে দেখে লাল মিঞা প্রবল হুংকার ছাড়লেন। এই বিচ্ছুগুলো তাঁর সুনাম ধ্বংস করতে এসেছে! ওদের বাপ যে-ই হোক, লোকে তো বলবে লাল মিঞার নাতি-নাতনীরা পথে পথে ভিগ্ মেঙ্গে বেড়াচ্ছে।

লাল মিঞা তাঁর বিখ্যাত কান-চাপাটি চড় মারার সুযোগ পেলেন না। তাঁর হুংকার শুনে বাচ্চা তিনটে ইঁদুরের মতন এদিক-ওদিক দৌড়ে পালালো। লাল মিঞা বাড়িতে এসে হাসিনার চুলের মুঠি চেপে ধরলেন।

সেই থেকে বাচ্চাগুলোর ভিক্ষে করা বন্ধ। তারা লুকিয়ে লুকিয়ে লোকের বাড়ির আঁস্তাকুড়ে খুঁটে খায়। বড় ছেলেটা বেশ চতুর হয়ে উঠেছে। এক-একদিন সে বাসের পেছনে চেপে চলে যায় আড়বেলে। সেখান থেকে বেড়াচাঁপার দিকের রাস্তা ধরে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে টুকটাক ভিক্ষে করে আসে। এখানে লাল মিঞা দেখতে পাবে না।

তাও গাঁয়ের দু’চারজন লোকের নজরে পড়ে যায়। একদিন হাসিনা বাগানে শুকনো নারকোলের বালদো কুড়োচ্ছে, সেইসময় গিয়াস তাকে বললো, ও হাসিনা, তোর ছেলে জাভেদকে যে দেখলাম বেড়াচাঁপার রাস্তায় ভিক্ষে করছে? লাল মিঞার কানে গেলে যে একেবারে জবাই করে ফেলবে!

বাণবিদ্ধ পাখির মতন হাসিনা ছুটে গিয়ে পড়লো গিয়াসের পায়ের ওপর। ব্যাকুলভাবে বললো, গিয়াসভাই, বলো না, তুমি আব্বাকে বলো না, আমি ওকে নিষেধ করে দেবো। আর যাবে না।

গিয়াস সস্নেহে তাকে টেনে তুলে বললেন, আরে না না, আমি বলবো না। তুই কি আমার পর? তবে গাঁয়ে কতরকম লোক আছে, কে কখন কথাটা লাল মিঞার কানে তুলে দেবে—তাই তোকে সাবধান করে দিলাম।

সেই সুবাদে গিয়াস হাসিনার বুকে হাত বুলিয়ে নিল ভালো করে। এবং পরদিন কথায় কথায় সেই কথাটা জানিয়ে দিল লাল মিঞাকে। সেবার জাভেদ পার পায় নি, বেধড়ক মার খেয়ে বিছানায় পড়ে ছিল দু দিন।

লাল মিঞা একদিন মেয়েকে ডেকে বললেন, তুই আবার নিকে কর, আমার হাতে ভালো পাত্তর আছে।

হাসিনা সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নাড়লো। অর্থাৎ সে রাজি।

লাল মিঞা বললেন, বাজিতপুরের রজব আলির ছেলে শামসের, খুব বুঝদার মানুষ, লরির ব্যবসা করে, অবস্থা ভালো, তার সঙ্গে কথা বলি?

হাসিনা আবার ঘাড় নাড়লো।

—এই অ্যাণ্ডা-বাচ্চাগুলোর ব্যবস্থা আমি করবো। ওদের আমি পাঠিয়ে দেবো।

—ওরা কোথায় যাবে? ও আব্বা, ওরা তো আমায় ছেড়ে থাকতে পারবে নে!

—ওরা তোর সঙ্গে যাবে নাকি? তুই পাগল হয়েছিস?

—কেন, বাজিতপুরের সেই মানুষ ওদের নেবেন না?

—কেউ নেয়? তিনটে গেঁড়ি গেঁড়ি বাচ্চা সমেত কেউ বউ ঘরে আনে?

—তা হলে ওদের কোথায় ফেলে যাবো? ওরা যে আমার পেটের সন্তান!

লাল মিঞা এমনভাবে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন যেন তিনি এরকম একটি অদ্ভুত নির্বোধ প্রাণী কখনো দেখেন নি। বাড়িতে বেড়ালের বাচ্চা, কুকুরের বাচ্চা বেশি হলে লোকে দূরে পার করে দিয়ে আসে না? এই বাচ্চাগুলোকে একদিন শিয়ালদা স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে এলে আর কোনোদিন ওরা এ জায়গা খুঁজে পাবে না। সেখানে ওরা ভিক্ষে করুক আর যাই করুক কেউ তো জানতে যাচ্ছে না।

এই মেয়েকে নিকে করার জন্য অনেকেই রাজি। মেয়ের যৌবন আছে, গুণ আছে। এখনো ও ইচ্ছে করলেই সাধ-আহ্লাদ মিটোতে পারে। শুধু ঐ এণ্ডিগেণ্ডিগুলোর জন্যে।

হাসিনা আবার কেঁদে ভাসালো। না, ওদের ছেড়ে সে কোথাও নিকে বসতে পারবে না। তারই পেটের নাড়ি কেটে যে ওদের এ পৃথিবীতে আনা হয়েছে।

উপকারী সামসুল

পাশাপাশি দু’খানি গাঁয়ের জন্য একটা প্রাইমারি স্কুল। সেই স্কুল পেরিয়ে এ-পর্যন্ত মাত্র বারোটি ছেলে বড় স্কুলে পড়তে গেছে। তার মধ্যে বদরুদ্দিন শেখের ছেলে সামসুল হক বি-এ পাস দিয়েছে। ভারি ধীর-স্থির বুদ্ধিমান।

লাইনের ধারে চায়ের দোকানে বসে ছিল সামসুল। এমন সময় ধর, ধর, গেল, গেল রব উঠলো একটা। সবাই ছুটে বাইরে এলো। বিকট শব্দে একটা এক্সপ্রেস বাস ব্রেক কষেছে। তার সামনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাচ্চা মেয়ে। এই বাসটা যদি ওকে চাপা দিয়ে যেত, তবু ড্রাইভারের কোনো দোষ দেওয়া যেত না। শেষ মুহুর্তে ব্রেক কষায় ড্রাইভারের সমস্ত অনুভূতি বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। সে বাস থেকে লাফিয়ে নেমে প্রথমে ঐটুকু মেয়েকেই এক চড় কষালো। পরক্ষণেই সে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগলো খুব।

সামসুল জিজ্ঞেস করলো, কার মেয়ে?

পাশে দাঁড়ানো একজন জবাব দিল, লাল মিঞার নাতনী।

সামসুল বললো, এই সন্ধেবেলা ঐটুকু মেয়ে বড় রাস্তার ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে?

একজন বললে, ওরা তো এইখেনেই থাকে। ঐ দ্যাখো না, ওর দুই ভাইও রয়েছে কাছে।

আর একজন বললো, কড়া জান বটে। অন্য কোনো বাচ্চা হলে ঠিকই চাপা পড়তো। কিন্তু হাসিনার ছেলেমেয়েদের কিছুই হয় না। মনে আছে, গত বছর জাভেদকে সাপে কামড়ালো কিন্তু ও ছোঁড়া ঠিক বেঁচে গেল! অ্যাাঁ, তোমার আমার ঘরের ছেলেপুলে হলে বাঁচতো? অ্যাঁ?

অন্য দু’জন অকারণে হেসে উঠলো!

সামসুলের মুখে ছড়িয়ে পড়লো একটা পাতলা দুঃখের ছায়া। ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। সেই মানুষের জীবনের দামও এত তুচ্ছ হয়! একটা বাচ্চা মেয়ে এইমাত্র মরতে মরতে বেঁচে গেল, আর সেই উপলক্ষে এই লোকেরা হাসছে।

সামসুল একা এগিয়ে গিয়ে বাচ্চা মেয়েটির হাত ধরে সরিয়ে আনলো ভিড় থেকে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, এরকম আর কক্ষনো কোরো না। বড় রাস্তা দিয়ে এরকম দৌড়োদৌড়ি করতে নেই। তোমার নাম কী খুকি?

মেয়েটি ফোঁপাতে ফোঁপাতে কী যে বললো কিছুই বোঝা গেল না।

সামসুল ঘাড় নিচু করে আবার জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম কী?

এবার মেয়েটি মিনমিন করে বললো, নাহারুন্নেছা।

—চলো, তোমাকে বাড়ি পৌঁছি দিয়ে আসি।

ওর আর দু’ভাই কাছেই ঘুরঘুর করছিল। তারা খুব উৎসাহের সঙ্গে বললো, আসেন না, আমাদের বাড়ি, রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি।

সন্ধের পর যে-কোনো সম্পন্ন লোকের হাতেই টর্চ থাকে। সামসুলের হাত থেকে টর্চটা কেড়ে নিয়ে জাভেদ আগে আগে দৌড়োলো।

হাসিনার ঘরে টিমটিম করে জ্বলছে কেরোসিনের কুপি। তাতে আলোর চেয়ে ধোঁয়া বেশি। সেই আলোতেই বসে হাসিনা ব্লাউজ সেলাই করছিল, ব্লাউজটা তার গা থেকে এইমাত্র খুলেছে। পুরুষমানুষ দেখে তাড়াতাড়ি শাড়িটা ভালো করে বুকে জড়ালো।

গ্রাম-সম্পর্কে পরস্পর মুখচেনা। সামসুল বললো, তোমার নাম হাসিনা না? তুমি ছেলেমেয়েদের এইভাবে রাস্তায় ছেড়ে দাও কেন?

জাভেদ সোৎসাহে শোনালে দুর্ঘটনা-নাটকটির বিবরণ। তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে তবু এটা একটা ঘটনা। হাসিনা মেয়েকে কোলে জড়িয়ে ধরলো। তারপর সামসুলকে বললো, আপনাকে কোথায় বা বসতে দেবো⋯আমার কপাল পোড়া⋯আমার ছেলেমেয়েগুলোকে কেউ ভালোবাসে না⋯

সামসুল মাটির দাওয়ায় বসে শুনলো হাসিনার সংক্ষিপ্ত জীবনকাহিনী। পেয়ারাবাগানের মাথায় তারকাখচিত আকাশ। পুকুরের জলে খুব জোরে টিপ করে শব্দ হলো। বোধ হয় তাল পড়লো একটা।

সামসুল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কবে যে এই সমাজের উন্নতি হবে। এত অবিচার, এত অন্যায়, এত কুসংস্কার। তবু কিছু তো চেষ্টা করতে হবে প্রত্যেককেই।

সে ছোটখাটো একটি বক্তৃতা শোনালো হাসিনাকে। এইভাবে চললে তো তার দুঃখ কোনোদিন ঘুচবে না। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়াও শিখছে না। ওরা বড় হলে কী কাঙালী হবে? একবার সাপের কামড় বা একবার বাসচাপা থেকে বাঁচলেও কি আর বারবার বাঁচবে? বরং ওরা যদি মানুষ হয়, তবে ওরাই একদিন হাসিনার দুঃখ ঘুচাবে!

হাসিনা জাভেদকে দেখিয়ে বললো, ওটা দু’কেলাস পর্যন্ত পড়েছিল। এখন আর কোথায় বা পড়বে, কেই বা পড়াবে!

সামসুল বললো, ‘ওটা’ বলতে নেই। নিজের ছেলে বা যে-কোনো মানুষ সম্পর্কেই ওরকম ভাবে কথা বলতে হয় না। আর তুমিই বা এত কম আলোয় সেলাই নিয়ে বসেছিলে কেন? চোখটা যে যাবে। দিনের বেলা সেলাই করতে পারো না?

এরপর মাঝে মাঝেই সামসুল আসতে লাগলো হাসিনার কাছে। সারাদিন সে ব্যস্ত থাকে, সদ্য কাজ পেয়েছে পোস্ট অফিসে, তাই আসে সন্ধের পর। জাভেদের জন্য সে এনেছে বই-খাতা, ছোট মেয়েটির জন্য একটা ফ্রক।

দিন পনেরোও কাটলো না, এর মধ্যেই লাইনের ধারের চায়ের দোকান সরগরম হয়ে উঠলো। একদিন সামসুল সেখানে ঢুকে পড়ে শুনলো, সেদিনের প্রধান আলোচ্য বিষয় সে নিজে। একজন টিপ্পনী কেটে বললো, ও সামসুল মিঞা, কেমন জমেছে? হাসিনা বিবির চোখে জাদু আছে তাই না? দেখো, যেন তোমার বিবির কানে কথাটা না যায়?

সামসুলের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তার নিজের শাদি হয়েছে মাত্র দেড় বছর আগে। কলেজে-পড়া মেয়ে। সে কেন একটা গেঁয়ো বিধবার সঙ্গে অন্যায় কাজ করতে যাবে?

দু’তিনজন একসঙ্গে বললো, আহা-হা কী কথাই বললে? নিজের ঘরে বউ থাকলেও বুঝি লোকে অন্য মাগী খোঁজে না? তা হলে তো দুনিয়াটাই বদলে যেত। দেখো, সাবধান, লাল মিঞা যদি টের পায়, তবে জোর করে নিকে দিয়ে দেবে কিন্তু। তখন ঐ তিনটে বাচ্চা সমেত ঘরে তুলতে হবে হাসিনাকে।

সামসুল তর্ক করলো, ঝগড়া করলো, রাগ করে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। কিন্তু পরদিন থেকে সে গুটিয়ে নিল নিজেকে। তাকে নিয়ে সাত নম্বর হলো—যারা নানা কারণে হাসিনাকে সাহায্য করতে গিয়ে পিছিয়ে গেছে আবার।

আমবাগানে

হাসিনা একেবারে পড়ে গেল গণি চৌধুরীর মুখোমুখি। রোজ ভোরবেলা তিনি নিজের বাগান পরিদর্শনে আসেন।

হাসিনার হাতে এক থোকা কাঁচা আম। তাড়াতাড়ি সেটা আঁচলের তলায় লুকিয়ে ফেলে সে চৌধুরী সাহেবের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করলো।

গণি চৌধুরীর কিছুই চোখ এড়ায় না। হাসিনা উঠে দাঁড়াবার পর তিনি তার থুতনি ছুঁয়ে বললেন, আহা, ভালো হোক, মঙ্গল হোক। কটা আম নিলি রে?

হাসিনা ধড়ফড় করে উঠে বললো, ও চাচা, আমি গাছ থেকে নিইনি, মাটিতে পড়ে ছেল, বিশ্বাস করেন, ও চাচা—

গণি চৌধুরী সস্নেহে বললেন, আহা, তাতে কী হয়েছে, নিয়েছিস নিয়েছিস। বেশ করেছিস।

হাসিনার থুতনিটা তুলে ধরবার সময় তিনি দেখেছেন ওর টলটলে দুটি চোখ। ঠিক যেন গহিন কালো দিঘির জল। তা দেখেই তাঁর মনটা নরম হয়ে গেছে।

তিনি আবার বললেন, দেখি, কটা নিয়েছিস? ভয় পাচ্ছিস কেন?

হাসিনা আঁচলের তলা থেকে হাত বার করবার সময় সেই ফাঁকে গণি চৌধুরী দেখতে পেলেন তার বুক। ছেঁড়া ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে যেন পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি মারছে। আরও নরম হলো তাঁর মন।

তিনি বললেন, মোটে চারটে? এ আর এমন কি!

হাসিনা বললো, ছেলেমেয়েগুলোকে একটু টক বেঁধে দেবো—ওরা বড্ড জ্বালায়, আমি বলে দিয়েছি, খবর্দার চুরি করবি নে, নিতে হয় আমি নিজে আনবো, চাচার ঠেঙে চেয়ে নেবো।

গণি চৌধুরী বললেন, ঠিকই তো, দরকার হলে আমার কাছে আসবি, তোর লজ্জা কী…আরও নিবি?

শখ করে তিনি গোলাপখাসের কলম লাগিয়েছিলেন, এই আম ঠিক কাঁচা অবস্থায় টক বেঁধে খাবার জন্য নয়। তবু তিনি নিজের হাতে সেই ছোট গাছের ডাল থেকে আট-দশটা আম ছিড়ে নিয়ে বললেন, নে, আঁচল পাত।

হাসিনা গা মুচড়ে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। গণি চৌধুরী সুন্দর করে হেসে বললেন, নে, আঁচল পাততে লজ্জা করছিস কেন?

হাসিনা আঁচল খুলতেই গণি চৌধুরী তার বুকের দিকে চেয়ে থেকে আমগুলো ঢেলে দিলেন। তারপর হাসিনা যখন পুঁটলি বাঁধতে ব্যস্ত সেই সময় তিনি ওর পিঠে হাত রেখে কাছে আকর্ষণ করে বললেন, কী, খুশি তো?

হাসিনা উঁ উঁ শব্দ করলো।

গণি চৌধুরীর হাত স্বাধীন হয়ে গিয়ে নড়াচড়া করতে লাগলো যেখানে-সেখানে। এর পর আর মাত্র দু’মিনিট লাগলো মাটিতে শুয়ে পড়তে। এত ভোরে কাকপক্ষীও জাগেনি। জাগলেও কেউ আমবাগানের দিকে আসবে না। হাসিনার কোঁচড় থেকে আমগুলো গড়িয়ে গেল, সে অনবরত শব্দ করতে লাগলো উঁ উঁ উঁ।

ব্যাপারটা শেষ হবার পর গণি চৌধুরীর একই সঙ্গে প্রবল উল্লাস এবং দারুণ ভয়ের অনুভূতি হলো। উল্লাস এই কারণে যে এই বয়সেও তাঁর পৌরুষ অক্ষুন্ন আছে। মনে মনে একটা চাপা ভয় ছিলো, হয়তো পারবেন না। কিন্তু তিনি পেরেছেন। আর ভয় এই জন্য যে, সমাজের একটা গণ্যমান্য লোক হয়ে তিনি এটা কী করে বসলেন? কথাটা যদি কোনক্রমে লাল মিঞার কানে ওঠে? লাল মিঞা তাঁর দোস্ত, হাসিনা তাঁর মেয়ের বয়েসী।

ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে এলো অনুশোচনা। হঠাৎ কেন তাঁর মাথা ঘুরে গেল? বেওয়ারিশ মেয়েমানুষ দেখলেই বুঝি মানুষের মনে এরকম দুষ্টু বুদ্ধি জাগে? প্রায়ই তিনি হাসিনার কথা চিন্তা করতেন। কিন্তু সে মনের কথা মনের মধ্যেই ছিল। হঠাৎ এই ভোরবেলা⋯ছি ছি ছি⋯যদি তাঁর ছেলেরা একবার শুনতে পায়, মাথাটা হেঁট হয়ে যাবে সবার সামনে।

একবার তিনি ভাবলেন যা হবার হয়েছে। কী আর করা যাবে! যদি জানাজানি হয়ই, তিনি নিকে করবেন হাসিনাকে। এরকম একটা বিবি পেলে তিনি এখনো বিশ বছর বাঁচতে পারবেন হেসে খেলে। কিন্তু হাসিনার যে ঐ তিনটি ছেলেমেয়ে রয়েছে⋯না, না, সম্ভব না, তাঁর নিজের ছেলেরা কিছুতেই রাজি হবে না, বিষয়সম্পত্তি সব তছনছ হয়ে যাবে। ওরে বাবারে, না, না⋯।

শাড়ি-টাড়ি সামলে হাসিনা উদাসীন দৃষ্টি মেলে বসে আছে। হাঁটুর ওপরে থুতনি। গণি চৌধুরী তার হাঁটু জড়িয়ে ধরে বললেন, ও হাসিনা, এ কথা কারুকে বলিস না রে, তোর ছেলেমেয়েদের আমি দেখবো, তোকে অনেক জিনিস দেবো, কারুকে বলবি না। কিরে কেটে বল, ও হাসিনা, দেখিস, যদি কেউ শোনে, আমাকে দোজখে যেতে হবে।

গণি চৌধুরী এমন আকুলিবিকুলি করতে লাগলেন যে হাসিনা বলে উঠলো, না, চাচা, কাকে কবো একথা? আমার দোষ নেবেন না, আমি বড় হতভাগিনী⋯

—তোকে আমি দেখবো, হাসিনা, তুই শুধু আমার মান রাখিস, কেউ যেন টের না পায়।

—না, চাচা, কেউ না।

—আমি যাই।

গণি চৌধুরী দ্রুতপদে পালিয়ে গেলেন সেখান থেকে।

হাসিনা আরও কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। কত রকম কথা মনে পড়ছে তার। মনে পড়লো জামালুদ্দিনের কথা। ছেলেমেয়ে তিনটের কথা। হাসিনার কি গুনাহ হলো? গণিচাচা কত বড় একটা মানী লোক, তিনি যখন ইচ্ছে করলেন, হাসিনার মতন সামান্য একটা মেয়ে কি না বলতে পারে? সেটা একটা আস্পর্ধা হয়ে যায় না! আর এ কথা সে কাকেই বা জানাবে, তার কসবী বলে নাম রটে যাবে না?

এইরকম আর একটা ব্যাপার হয়েছিল মাসখানেক আগে। রহমান সাহেবের বন্ধু মীজানুর, যে শহর থেকে আসে। মীজানুর না যেন মজনু। লায়লা-মজনু যাত্রার ঠিক মজনুর মতন চেহারা। সে একদিন দুপুরবেলা চুপে চুপে বলেছিল, এতদিন আমি শাদি করিনি, হাসিনা, এবার তোমাকে দেখে আমার সেই ইচ্ছে জেগেছে। আমার মাকে বলেছি। মা ঐ বাচ্চাগুলোর জন্য রাজি হচ্ছেন না। কিন্তু আমি পছন্দ করি তোমার বাচ্চাদের, আমি ওদেরও নিয়ে যাবো, লেখাপড়া শিখবে, মাকে যদি রাজি করাতে পারি।

রহমান ভাই নিচতলায় তাঁর স্ত্রীর পাশে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ওপরের ঘরে মীজানুর সাহেব একা। এক গেলাস পানি দিতে এসে হাসিনা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আড়ষ্ট হয়ে এই কথা শোনে।

—অত দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন হাসিনা। কাছে এসো, একটু গল্প করি তোমার সঙ্গে।

কী সুন্দর করে কথা বলেন মীজানুর সাহেব। মানুষটা সত্যি ভালো। আজকাল প্রায় ফি-সপ্তাহেই ইনি আসেন রহমান ভাইয়ের সঙ্গে। আজ সকালে হাসিনা নিজে দেখেছে যে বারো শরিকের দিঘি থেকে স্নান করে আসবার পথে মীজানুর সাহেব তার মেয়ে নাহারের গাল টিপে আদর করে দিলেন। আহা রে! এ গাঁয়ের কেউ তো হাসিনার ছেলেমেয়েদের ছুঁতেই চায় না, সবাই দুর ছাই করে। মীজানুর সাহেব কোলে তুলে নিয়ে কত আদর করলেন নাহারকে।

যে-ভাবে সকালবেলা মেয়েকে আদর করেছিলেন, ঠিক সেইভাবেই দুপুরে মাকে আদর করতে শুরু করলেন মীজানুর সাহেব। হাসিনা লজ্জা পেয়ে সরে গিয়েছিল।

মীজানুর বললো, চলে যাচ্ছো কেন হাসিনা? এসো, কাছে এসে বসো! তুমি কী মিষ্টি!

এই কথাটা শুনে ফুড়ুক ফুড়ুক করে হাসি উঠে এসেছিল হাসিনার বুক থেকে। পুরুষমানুষের মুখে সে অনেক রকম কথা শুনেছে, সে সুন্দর, সে পটের বিবি, সে লক্ষ্মী সোনা, সে দিনকি মোহিনী, রাতকি বাঘিনী—কিন্তু মিষ্টি? একথা তো কেউ কখনো বলেনি। শহরের লোক এরকমভাবে কথা বলে। মীজানুর সাহেব কত লেখাপড়া জানেন!

মীজানুরের চুমুতে কী সাঙ্ঘাতিক উত্তাপ! বাহুতে প্রবল জোর। আনন্দে অবশ হয়ে যেতে যেতেও হাসিনা বলে, আমায় ছেড়ে দিন, কেউ এসে পড়বে—আমায় বকবে, আমার আবার সর্বনাশ হবে।

—কেউ আসবে না।

সেদিনও হাসিনা খুব জোর করে বাধা দিতে পারেনি। মীজানুর সাহেব কত জ্ঞানীগুণী লোক, শহরে বড় চাকরি করেন। শহরে পয়সা ফেললেই কত সিনেমা-থিয়েটারের খাপসুরত মেয়েদের বগলদাবা করে নিয়ে ঘোরা যায়, সেই সব ফেলে সেই মানুষটা হাসিনার মতন সামান্য একটি মেয়েকে আদর করতে চাইছেন, সেই সময় বাধা দিতে যাওয়াটা ছোটো মুখে বড় কথার মতন হয়ে যায় না? তা ছাড়া মীজানুর সাহেব বারবার বলছিলেন, তুমি ভয় পাচ্ছো কেন হাসিনা, আমি তো তোমাকে বিয়ে করবো, তোমার ছেলেমেয়েদের সুদ্ধু নিয়ে যাবো, মাকে একটু রাজি করাতে পারলেই⋯

আমবাগানে বসে হাসিনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সেটা সুখের না দুঃখের, তা অত বোঝে না হাসিনা।

সে উঠে দাঁড়িয়ে গোলাপখাস কলমের গাছ থেকে আরও কতকগুলো কচি আম পেড়ে ফেললো। যেন এই আমবাগানটা তার নিজের।

পুকুরে চাঁদের ছায়া

ঘরের খুব কাছে শেয়াল ডাকলে হাসিনার ঘুম ভেঙে যায়। শেয়াল এমন জীব, ওরা চুপেচাপে কোথাও যাওয়া-আসা করতে পারে না। মুর্গি চুরি করার লোভে শেয়ালগুলো গেরস্তবাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করে, তার মধ্যে নিজেরাই ডেকে ওঠে এক সময়। অমনি কুকুরগুলো তাড়া করে যায়। তারপর কুকুরের ঘেউ ঘেউ আর শেয়ালের হোক্কা হো মিলে এক বিকট শব্দ-খিচুড়ি তৈরি হয়।

হাসিনা ঘুম ভেঙে উঠে জানলা দিয়ে বলে, হুস্ হুস্!

সেই সময় কোনো কোনোদিন রাত্রে হাসিনা দেখতে পায় সামনের পুকুরটার জলে একটা চাঁদ ভাসছে। ছেলেবেলা থেকে যখনই এরকম দেখেছে হাসিনা, অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে। এই দৃশ্যটা তাকে চুম্বকের মতন টানে। চারপাশে একেবারে নিঝ্ঝুম। পুকুরধারের নারকোল গাছগুলোর পাতায় একটুও সাড় নেই। জোছনার আলোয় পদ্মপাতাগুলোও সাদা সাদা দেখায়। পুকুরের পানি কিন্তু এখন আরও যেন মিশমিশে কালো। তার মধ্যে আপনমনে খেলা করছে একলা একটা চাঁদ।

খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর কেন যেন হাসিনার বুক মুচড়ে আসে। সে সেখানে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদে কিছুক্ষণ।

আবার শুতে আসবার সময় সে ছেলেমেয়েগুলোকে একবার দেখে। মাটিতে কাঁথা পেতে পাশাপাশি শুয়ে আছে ওরা তিনজন। জাভেদ, সিরাজ আর নাহার। গভীর ঘুমের মধ্যেও ওরা চটাপট হাত চালিয়ে মশা মারছে মাঝে মাঝে। ভীষণ মশা। আগের মশারিটা ছিঁড়ে গেছে সেই কবে! কে আর নতুন মশারি দেবে?

বাইরের আকাশের ক্ষীণ আলো এসে পড়েছে ওদের মুখে। এখন পৃথিবীর আর কোনো শিশুর মুখের সঙ্গে ওদের মুখের ঘুমের সারল্যের কোন তফাত আছে? এখন কি কেউ দেখে বলবে, ওরা হতভাগ্য?

সারাদিন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হাসিনার বিশেষ দেখাই হয় না। হাসিনা কাঠ-কুটো কুড়োয়, ঘুঁটে-গুল দেয়, পরের বাড়িতে কাজ করতে যায়। ছেলেমেয়েরা কুকুর-ছাগলের মতন এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়। লাল মিঞার মূল বাড়ির দিকে গেলেই ছোট বিবির কাছ থেকে লাথি-ঝাঁটা খেতে হয় ওদের। এই তো গত শনিবার বাণপুরের হাটে সিরাজটা একটা ষাঁড়ের গুঁতো খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। সেই পাঁচ-ছ মাইল দূরে বাণপুরের হাট, সেখানে ওরা হেঁটে হেঁটে গেছে। হাসিনা এত বারণ করে তবু ওরা কথা শোনে না। সন্ধের পর খিদে পেলে তখন ঠিক বাড়িতে ছুটে আসবে!

সামান্য যা খাবার থাকে, তাই ভাগ করে চেটেপুটে খেয়ে, তারপর প্রায় ঘন্টাখানেক হাসিনা ঠিক একটি বিড়ালী-মাতার মতন ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেলে। সবাই হুটোপুটি করে ঘরের মধ্যে। এমনকি জাভেদটা এখন এত বড় হয়ে গেছে, সেও দস্যিপনা করে মায়ের সঙ্গে। তারপর এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই।

হাসিনা ঘুমন্ত ছেলেমেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আস্তে আস্তে। তার ইচ্ছে হলো, ছেলেমেয়েগুলোকে ডেকে তুলে আবার খেলা করে এখন। অমন আনন্দ হাসিনা আর কিছুতে পায় না।

হাসিনার শরীরে ভরা নদীর মতন যৌবন, তবু এই ছেলেমেয়েদের ছেড়ে সে কক্ষনো কোনো নতুন সোয়ামীর বাড়িতে সুখ ভোগ করতে যাবে না।

হাসিনা আবার জানলার কাছে এসে দাঁড়ালো, সম্মোহিতভাবে চেয়ে চেয়ে দেখে পুকুরের পানিতে একলা একলা চাঁদের খেলা। ও চাঁদ, তুমি কত সুখী, তোমাকে দুবেলা পেট ভরে খাওয়ার চিন্তা করতে হয় না!

সুখেন্দুবাবু

নিম্ন আদালতে লাল মিঞার হার হলো। জমির অধিকার তিনি পেলেন না। পেয়ারাবাগানের সবটা তাঁর নয়। অর্থাৎ হাসিনার ঘরটা ভেঙে দিতে হবে। অবশ্য এত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নন লাল মিঞা। তিনি লড়বেন, তিনি বড় আদালতে যাবেন। ইতিমধ্যে তিনি দুটি পাল্টা মামলা রুজু করেছেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে।

কিন্তু এই উপলক্ষে তিনি মেয়ের ওপর চটে গেলেন আবার। মেয়েটা অপয়া, নইলে গত পনেরো বছরের মধ্যে লাল মিঞা কখনো কোনো মামলায় হারেন নি, এই প্রথম তাঁকে হার স্বীকার করতে হলো। এ যে কত বড় অপমান তা মেয়েছেলেরা বুঝবে না। এ তো শুধু দু-পাঁচশো টাকার ব্যাপার নয়!

লাল মিঞা হাসিনাকে ডেকে সাফ বলে নিলেন, সে যদি কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর পছন্দ করা পাত্রকে নিকে করতে রাজি না হয়, তা হলে তিনি আর ওর খোরাকি যোগাতে পারবেন না। কানাখোঁড়া নয়, রোগভোগা নয়, বয়েসকালের স্বাস্থ্যবতী মেয়ে, এমন মেয়ে কেন নিকে বসবে না? এমন মেয়েকে কোনো বাপ সারা জীবন বসে বসে খাওয়ায়, এমন কথা কেউ কখনো শুনেছে? তা ছাড়া দিনকাল এখন খারাপ।

দিনকাল সত্যিই খারাপ। পাটের দর এ বছর হু-হু করে পড়ে গেছে। ভেড়িতে মাছের আকাল। মাজরা পোকা লেগে ধান একেবারে ছিবড়ে হয়ে গেছে। কারুর মুখে এবার হাসি নেই। গ্রামের চাষীদের মধ্যে যে মানুষটি সবচেয়ে হাসিখুশি সেই রহিমচাচার কপালেও এবার তিনটে ভাঁজ পড়েছে। মাঠের যে-কোনো ফসলই রহিমচাচার কাছে সন্তানের মতন, এবারের রুগ্ণ জীর্ণ ধানক্ষেত দেখে তিনিও কপালে হাত দিয়ে বসেছেন, হা আল্লা!

যে-সব বাড়িতে একজন দু’জন চাকুরে লোক আছে, শুধু তারাই এবার তেমন ধাক্কা খায়নি। চাকরির বাঁধা মাইনেটা তো আছেই। রহমান সাহেবের বাড়িতে প্রতি শনি-রবিবার বন্ধুবান্ধব এলে হাসিনার ডাক পড়তো কাজের জন্য। তখন হাসিনা চাট্টি বেশি করে রঙিন ভাত আর গোস্ত্ নিয়ে আসতো ছেলেমেয়েদের জন্য। তা রহমান সাহেবও কয়েক মাস বাড়ি আসছেন না। তাঁর বউয়ের বাচ্চা হয়েছে, সে আছে এখন জয়নগর-মজিলপুরে তার বাপের বাড়িতে। রহমান সাহেব সপ্তাহান্তে সেখানেই যান। ফলে মীজানুরও আর আসে না।

এই শনিবার রহমান সাহেব আবার এসেছেন, সঙ্গে এনেছেন এক হিন্দু বন্ধু। আবার হাসিনার ডাক পড়লো।

বন্ধুটির নাম সুখেন্দু। ইনি এ অঞ্চলের একজন নামকরা কনট্রাকটর বহু বড় বড় লোকের সঙ্গে চেনাশুনো। গণি খান চৌধুরীর সঙ্গে শেয়ারে এ বছর রহমান সাহেব সুন্দরবন ফেরি সার্ভিস ডেকে নিয়েছেন। অনেক টাকার ঝক্কি। চাষের জমি বেচে রহমান সাহেব ব্যবসায় নেমেছেন, এ সময় সুখেন্দুবাবুর মত লোকদের হাতে রাখা দরকার। হিন্দু বলে সুখেন্দুবাবুর কিছু কিছু অতিরিক্ত সুবিধে আছে। তিনি এস ডি ও-র বউকে বউদি কিংবা পুলিসের এস ডি পি ও-র মাকে মাসিমা ডেকে টিপ করে প্রণাম করে ফেলতে পারেন। তাতেই অর্ধেক কাজ ফতে। টাকা-পয়সা ঘুষের চেয়েও এটা অনেক শক্তিশালী কায়দা।

সুখেন্দুবাবুর লম্বা-চওড়া চেহারা। বয়েস তিরিশের কাছাকাছি। দেখলে মনে হয় বেশ একটি ভালোমানুষ লম্পট। লোকটি ঠিক তাই। মদ আর মেয়েছেলের দিকে অত্যধিক ঝোঁক। এদিকে খুব একটা কুচক্রীও নয়। লোকের ক্ষতি করার জন্য দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে না। বরং মাতাল অবস্থায় অনেককেই বলে বসে, আরে; সব ব্যবস্থা আমি করে দেবো, কোনো চিন্তা নেই। তোমার কী কী চাই, আমাকে বলো না!

সুখেন্দুবাবু এসেছে বিরিয়ানি আর বড় গোস্তের কাবাব খাবার জন্য। রহমান সাহেবকে সে অনেকবার বলেছে, বুঝলে ভাই রহমান, এসব রান্না মুসলমানদের মতন আর কেউ পারে না। কলকাতায় গেলেই আমি একবার আমিনিয়ায় ঢুকে যাই। আমাদের বাড়িতে অবশ্য এসব চলে না, আমার ঠাকুমা বেঁচে, ওরে বাবা, মুর্গি পর্যন্ত চুপি চুপি খেতে হয়।

অবশ্য, বিরিয়ানি আর কাবাবই বড় কথা নয়, সেই সঙ্গে হুইস্কিও এসেছে। সুখেন্দু এত বেশি হুইস্কি সন্ধেবেলার মধ্যেই খেয়ে ফেললো যে, কাবাব-বিরিয়ানি খাওয়ার দিকে তার আর রুচি রইলো না। জিভ এলিয়ে এসেছে, চোখ ঢুলুঢুলু মুখে ফুরফুরে হাসি।

দু’বার হেঁচকি তুলে সুখেন্দুবাবু বললো, আরে, ইয়ে, পানি নেই যে, শুধু শুধু মাল খাবো, একটু পানি আনাও।

রহমান সাহেব বললো, ও জল খাবেন? হাসিনা, এই হাসিনা, এক জগ জল দিয়ে যা তো!

এ গ্রামের বাড়িতে হিন্দু অতিথি বিশেষ আসে না। কখনো দু-একজন কেউ এলে সবাই সচেতন হয়ে যায়, যেন আদর আপ্যায়নে কোনো খুঁত না থাকে। বাচ্চারা কৌতূহলী চোখে তাকায়। বয়স্করা এসে রামায়ণ মহাভারত বিষয়ে তাঁদের জ্ঞানের কথা জানিয়ে যায় অতিথিদের।

হাসিনা এক জগ পানি নিয়ে এলো। রহমান সাহেব একটু বেশী বেশী জোর দিয়ে বললেন, টিউবওয়েলের জল এনেছিস তো? পুকুরের জল আনিস নি তো!

সুখেন্দুবাবু জড়ানো গলায় বললো, ও ঠিক আছে, দাও না।

রহমান সাহেব হাসিনার হাত ধরে ঘরের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো, সুখেন্দুদা, এই মেয়েটিকে দেখুন, দেখছেন তো? বলুন তো এর বয়েস কত?

সেই পুরনো খেলা।

সব শুনে সুখেন্দুবাবু হেসে উঠলো হা-হা করে। বললো, তাই নাকি? সত্যি, একদম বোঝা যায় না?

দু চোখ থেকে দুটি লকলকে জিভ বার করে সুখেন্দুবাবু হাসিনার যৌবনময় শরীরটা চাটতে লাগলো। নেশার ঝোঁকে একবার ভাবলো, হ্যাঁ, একটা সরেস মাল বটে! একে পাওয়া যায় না? কত টাকা লাগবে?

পরক্ষণেই একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা হয়ে বসলো সে। একটা সিগারেট ধরিয়ে নেশা কাটাবার চেষ্টা করলো। মনে মনে বললো, ওরে বাবা, মোছলমানের ঘরের মেয়েছেলে, এদিকে নজর দিতে গিয়ে কি শেষে গর্দানটা খোয়াবো? কোথায় কী গোলমাল হয়ে যাবে, তারপর যদি দাঙ্গা-ফাঙ্গা বেধে যায়? কাজ নেই বাবা! গণি চৌধুরী বলেছে এই শীতে লখনউ বেড়াতে নিয়ে যাবে। সেই ভালো, সেখানে গিয়ে যত খুশি বাঈজী-ফাইজী, তারা একেবারে খানদান মোছলমান, এখানকার কোনো শালা টেরটিও পাবে না।

সুখেন্দুবাবুকে একটু অন্যমনস্ক হতে দেখে রহমান সাহেব হাসিনাকে খানিকটা রসিকতার ভঙ্গিতে বললেন, মীজানুরের সঙ্গে তোর বিয়েটা প্রায় ঠিক করে এনেছিলুম, বুঝলি, কিন্তু ও শালা ট্রান্সফার হয়ে গেল। ব্যাঙ্কের চাকরি তো। ওকে পাঠিয়ে দিয়েছে একেবারে দার্জিলিং, বুঝলি?

হাসিনা ভাবলো, আহা, মীজানুর নিকে করুক বা না করুক, তবু তো সে মুখে অন্তত বলেছিল যে সে ছেলেমেয়েগুলোকেও নিয়ে যাবে? কাল থেকে নাহারের খুব জ্বর। হে খোদাতাল্লা, ওকে তুমি বাঁচিয়ে দিও!

রহমান সাহেব বললেন, তোর জন্য আর একটা পাত্র খুঁজছি। মুশকিল তো ঐ বাচ্চাদের নিয়ে?

সুখেন্দুবাবু চোখ তুলে বললো, কী হয়েছে? এর মধ্যে আবার বাচ্চা এলো কোথা থেকে?

রহমান সাহেব খানিকটা ইতিহাস বিকৃত করলেন।

অমনি সুখেন্দুবাবুর মধ্যে সব করে দেবো ভাবটা জেগে উঠলো। সে একজন মাতালের পক্ষে যতখানি চিন্তিত হওয়া সম্ভব ততখানি চিন্তিত ভঙ্গি করে বললো, হ্যাঁ, এটা একটা প্রবলেম। তিন-তিনটে বাচ্চা সমেত কে আর শাদি করবে? তবে এক কাজ করা যায়? যদি তোমরা রাজি থাকো—

—কী?

—দ্যাখো, দুঃখকষ্টে থাকার চেয়ে, বাচ্চাগুলোকে যদি অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেওয়া যায়—পুটিয়ার যে রাজবাড়িটা ছিল না, সেটা তো গতবারে গভর্নমেন্ট নিয়ে নিয়েছে, সেখানে একটা অনাথ আশ্রম খুলেছে।

—তাই নাকি?

—তাই নাকি মানে? সেখানকার ফার্নিচার সব আমি সাপ্লাই করেছি, আমি জানি না? আমি বলি কি, সেখানে ওদের ভর্তি করে দাও, খাওয়া-দাওয়া পাবে, লেখাপড়া শিখবে।

—সত্যি⋯টাকা পয়সা লাগবে না?

—কিসের টাকা পয়সা? সে সব তো গভর্নমেন্ট দিচ্ছে।

রহমান সাহেব হাসিনার দিকে তাকিয়ে বললেন, সত্যি হাসিনা, এটা কিন্তু খুব ভালো কথা। ভেবে দ্যাখ, ওরা খাওয়াপরা পাবে, লেখাপড়া শিখবে—

হাসিনা চুপ করে রইলো।

রহমান সাহেব আবার বললেন, সুখেন্দুদা, ওদের নেবে সেখানে?

সুখেন্দুবাবু বললো, কেন নেবে না? আলবাত নেবে?

রহমান সাহেব একটু ইতস্তত করে বললেন, মানে, সুখেন্দুদা, তোমাকে খোলাখুলি বলছি, সেখানে মুসলমানের ছেলেমেয়েদের নেয়?

সুখেন্দুবাবু একটা প্রচণ্ড মাতালের হাসি হেসে বললো, আরে অনাথের আবার হিন্দু-মুসলমান কী? অনাথ মানে তো যার কেউ নেই! হে-হে-হে-হে-হে!

রহমান সাহেব কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, না, মানে, বলছিলাম, ওরা তো বেশ বড় হয়ে গেছে, বড় ছেলেটা তো বেশ বড়!

সুখেন্দুবাবু দু হাত তুলে অভয় দানের ভঙ্গিতে বললো, সেসব আমি ম্যানেজ করে দেবো। সব আমি করে দেবো, তোমার কী কী চাই, বলো না?

সে আর একবার ঘোলাটে চোখে দেখে নিলো হাসিনার লোভনীয় যৌবন। বাচ্চা-কাচ্চাগুলোকে কাটিয়ে দিলে যদি মেয়েটা কৃতজ্ঞতা জানাতে তার কাছে আসে⋯যদি একবার⋯যাক গে যাক, না এলো না এলো, লখনউ তো আছেই!

শুধু যাওয়া, শুধু আসা।

সুখেন্দুবাবু যথারীতি পরের দিনই এসব কথা একদম ভুলে গেল। কিন্তু যদিও এসব কথা হয়েছিল রহমান সাহেবের বাড়ির দোতলার ঘরে, তবু কী করে যেন কথাটা রটে গেল গ্রামের মধ্যে। হাসিনার ছেলেমেয়ে তিনটির ব্যবস্থা করার একটা উপায় আছে। পুটিয়ার প্রাক্তন রাজবাড়িতে যে একটা অনাথ আশ্রম হয়েছে, সেই খবরই তো অনেকে রাখতো না। সুযোগ যখন একটা এসেছে, তখন তার সদ্ব্যবহার করা উচিত। বিশেষত খরচাপাতি যখন সব সরকারই দেবে।

কোনো এক রহস্যময় কারণে, এই ব্যাপারে গণি খান চৌধুরীর ছেলেদেরই বেশি উৎসাহ দেখা গেল। হাসিনার ছেলেমেয়ে তিনটে যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়, এটা ভালো দেখায় না। একটা কিছু ব্যবস্থা করা উচিত। তারা ঘুরে ঘুরে জনমত সংগ্রহ করলো। সবাই এ ব্যাপারে একমত। এমনকি, লাইনের চায়ের দোকানে সামসুল হক পর্যন্ত স্বীকার করলো যে, হ্যাঁ, এই ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে ভালো। লাল মিঞা তো একেবারে খেপে উঠলেন। তিনি আজ পারলে আজই দিয়ে আসেন। এণ্ডিগেণ্ডিগুলো বিদায় হলে তিনি হাসিনার সুন্দর ভবিষ্যতের বন্দোবস্ত করে দেবেন। সবাই মিলে হাসিনাকে এমন বোঝালো যে হাসিনা আর না বলতে পারলো না! বিশেষ করে, পরোপকারী সামসুল হক পর্যন্ত এসে বললো, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখবে। মানুষ হবে⋯। এত সব মাথাওয়ালা লোকেরা কি আর ভুল কথা বলে?

সুখেন্দুবাবুকে ধরাধরি করায় সে কিছু সাহায্য করলো, বাকি ব্যবস্থা করে ফেললো গণি খান চৌধুরীর চৌকস ছেলেরা। ফর্ম ফিলাপ করা-টরা শেষ।

একদিন সকালে হাসিনার তিন ছেলেমেয়েকে ভালো করে নাইয়ে, ভালো করে খাইয়ে, নতুন জামাকাপড় পরিয়ে রওনা করে দেওয়া হলো। সঙ্গে গেল গণি খান চৌধুরীর দুই ছেলে আর গিয়াস। অনাথ আশ্রমের অফিসঘরে গিয়ে যখন ওরা কথাবার্তা বলছে, ছেলেমেয়ে তিনটে ভ্যাবাচ্যাকা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে, সেই সময় হঠাৎ সেখানে আলুথালু চুলে, প্রায় পাগলিনীর বেশে হাজির হলো হাসিনা।

সে চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে বলতে লাগলো, ওগো বাবু, ওদের ছেড়ে দাও! ওরা অনাথ নয়। আমি ওদের মা। যাদের মা থাকে, তারা কি অনাথ হয়? ওগো বাবু, তোমাদের পায়ে পড়ি, ওরা আমাকে ছেড়ে কখনো থাকে নি, আমি ওদের পেটে ধরেছি।

ছেলেমেয়ে তিনটি ছুটে গিয়ে হাসিনাকে ঘিরে দাঁড়ালো। অনাথ আশ্রমের কাউন্টারের একজন কেরানী বললো, দিস ইজ কলড ইউনিভার্সাল মাদারহুড! একটা যদি ক্যামেরা থাকতো—

যাবার সময় বাসে চেপে গিয়েছিল ছেলেমেয়েরা। ফেরার সময় এলো হেঁটে। মাঠের মধ্য দিয়ে ছুটতে ছুটতে জাভেদ একটা ফড়িং ধরে ফেললো। হাসিনা বললো, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে হারামজাদা!

তার আগেই ফড়িংটা উড়ে পালিয়েছে। শুধু একটা ডানা ছিঁড়ে রয়ে গেছে ছেলেটার হাতে।

সিরাজ একটা ডোবায় নেমে তুলে আনলো এক গোছা শাপলা। ওতে ভালো তরকারি হয়।

দেবদূত

আজ শবেবরাত। রাত্তিরবেলা বিছানায় শুয়ে খরখরে চোখ মেলে চেয়ে আছে হাসিনা।

আজকের দিনটা তার বড় ভালো কেটেছে। অনেক, অনেকদিন পর এমন একটা চমৎকার দিন।

আজ হাসিনার ডাক পড়েছিল গিয়াসদের বাড়িতে। গিয়াসের দাদীর মতন এমন সুন্দর একটা মানুষ দেখা যায় না। বয়েসের গাছপাথর নেই। চার কুড়ি তো হবেই, টুসটুসে একটা পাকা ফলের মতন চেহারা। এখনো দেখলে বোঝা যায়। এককালে কত ফর্সা রঙ আর কী দারুণ রূপসী ছিলেন উনি। অতিশয় ধর্মপ্রাণ মহিলা। ওঁর বাপের বাড়ি হাজারিবাগ। এ গ্রামে একমাত্র উনিই পরিষ্কার উর্দু বলতে পারেন। শবেবরাতের উৎসব ঐ বাড়িতেই সবচেয়ে বেশি জমজমাট।

কাজ কি কম! সকাল থেকে বাড়ির মেয়েরা বসে যায় চাল গুঁড়ো করতে। তারপর সেই চালগুঁড়ো ছাঁকা হয়। তার পর সেই চালের আটা মেখে তৈরি হয় রুটি। একখানা দু’খানা নয়, শয়ে শয়ে। আজকের পুণ্য দিনটিতে বাড়িতে কোনো প্রার্থী এসে ফিরে যাবে না।

রান্নাঘরে রুটি গড়তে গড়তে ফাঁকে ফাঁকেই হাসিনা উঠে গেছে গিয়াসের দাদীর ঘরে। উনি আজ সারা দিন পবিত্র কোরান পাঠ করলেন। তাঁর শোওয়ার ঘরে মেঝের ওপর ছোট জলচৌকি পেতে বসেছিলেন তার সামনে। এই বয়েসেও কী সরল, উন্নত চেহারা! তিনি লেখাপড়াজানা মহিলা, নিজের হাতে মুক্তোর মতন অক্ষরে কোরানের অনুলিপি প্রস্তুত করেছেন। পবিত্র গ্রন্থ পাঠের সময় তাঁর সুষমামণ্ডিত মুখখানিতে যেন একটা স্বর্গীয় আভা ফুটে ওঠে। হাসিনা সেদিকে মুগ্ধভাবে তাকিয়ে থাকে।

এক-একবার সে বলে, ও দাদীমা, একটু জোরে জোরে পড়েন না, আমরাও একটু শুনি!

দাদীমা চোখ খুলে শান্ত স্বরে বললে, শুনবি, আয় বোস।

তিনি পড়ে পড়ে মানে বুঝিয়ে দেন, হাসিনা বিভোর হয়ে শোনে। এক অপূর্ব অনুভূতিতে তার মন ছেয়ে যায়। মনে হয় যেন এই পৃথিবীতে আর কোনো পাপ নেই, দুঃখ নেই, অশান্তি নেই, আছে শুধু আনন্দ।

রান্নাঘর থেকে ডাক পড়লেই সে ছুটে চলে যায়। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে দাদীমার ঘরে। আগে কখনো সে এত মন দিয়ে কোরান পাঠ শোনে নি। কম বয়েসে মন চঞ্চল ছিল, এখন তো তার বয়েসও তিরিশ পার হয়ে গেল।

গিয়াস মাঝে মাঝে দু-একবার তরল চোখে তাকিয়েছিল তার দিকে। ইঙ্গিত করেছিল একটু গোপনে কাছে আসবার। কিন্তু হাসিনা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিল সেই ডাক। আজ সে ঠিক করেই রেখেছিল, কোনো পুরুষমানুষের কাছে ঘেঁষবে না, মিথ্যে কথা বলবে না, আঁচলের তলায় চুরি করে খাবার আনবে না। সে শুদ্ধ, ভক্তিমতী হয়ে দিনটা কাটিয়ে দেবে।

সেইরকমভাবেই দিনটা গেছে। সারা দিন ধরে গরিব-দুঃখীদের দান করা হয়েছে খাবার। সন্ধেবেলা কতরকম বাজি ফাটানো হলো গিয়াসদের বাড়ির সামনে। পরবের দিনগুলোতে দাদীমা নিজের তোরঙ্গ থেকে টাকা বার করে দেন। উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে হাসিনার ছেলেমেয়েরা জুলজুলে চোখে দেখছিল বাজি-পোড়ানো, আজ আর ওরা কুকুরের মতন তাড়া খায় নি, শেষ অবধি ওরাও পেয়েছিল একটা করে তারাবাজি।

সন্ধের পর আজ আর হাসিনাকে আঁচলের তলায় লুকিয়ে খাবার আনতে হয় নি, তাকে দেওয়াই হয়েছে প্রায় চল্লিশখানা রুটি আর এক ভাঁড় মাংস। গিয়াসদের বাড়িতে কেউ বড় গোস্ত খায় না, ও বাড়িতে বরাবর খাসীর মাংস আসে। সেই মাংসের মধ্যে চাকা চাকা আলু। মাংসের চেয়েও মাংসের ঝোলে ডোবানো আলু খেতে এত ভালোবাসে জাভেদটা!

হাসিনার দু হাত ভর্তি খাবার, আর তার পেছনে পেছনে লাফাতে লাফাতে আসছিল ছেলেমেয়েরা। তাদের আর তর সইছে না, সুলুপ-সালুপ শব্দ করছে জিভ দিয়ে।

তখনও চলেছে কাঙালীর দল। গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে ওরা আসে, লোকের বাড়ি-বাড়ি ভিখ মেঙ্গে বেড়ায়। জানে, আজ কোনো বাড়ি থেকে খালি হাতে ফিরবে না। সেরকম তিনজনের একটা ছোট দলকে থামিয়ে হাসিনা গুনে গুনে ন’খানা রুটি দিয়ে দিল। গিয়াসদের বাড়িতে সারা দিন দান চলেছে, হাসিনা নিজের হাতেও রুটি বিলিয়েছে। কিন্তু সে হলো পরের বাড়িতে পরের জিনিস দেওয়া। তাতে তো হাসিনার নিজের দানের পুণ্য হয় নি। এখন হাসিনা তার নিজের রুটি দান করলো। আহা, খাক, ওরাও খাক।

বড় আনন্দে গেল আজকের দিনটা। ছেলেমেয়েরা তৃপ্তি করে খেয়েছে, তারপর অনেক রাত পর্যন্ত হুটোপুটি করে এই তো খানিক আগে ঘুমোলো। কিন্তু হাসিনা ঘুমোবে না, সে জেগে থাকবে।

আজকের রাতে আশমান থেকে আল্লার ফেরেস্তা নেমে এসে কপালে লিখন দিয়ে যাবেন। আজ দুনিয়ার কোনো মানুষকে খারাপ ভাবতে নেই, আজ কোনো পাপচিন্তা করতে নেই। হাসিনা ঘুমোবে না, যদি স্বপ্নের মধ্যেও কোনো পাপচিন্তা আসে! আর কতদিন এমন দুঃখে দিন কাটবে? এবার যেন একটু সুদিন আসে।

হাসিনা জেগে আছে। সে কল্পনায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ডানায় ভর দিয়ে বাতাস কেটে নেমে আসছেন দেবদূত। তীব্র জ্যোতির্ময় তাঁর রূপ। কখন তাঁর সময় হবে, কখন তিনি হাসিনার ঘরে আসবেন, শুধু সেই প্রতীক্ষা।

আজ আর পুকুরের পানিতে চাঁদের খেলা দেখতে পাওয়া যাবে না। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। প্রতি বছর শবেবরাত-এর রাতেই যেন ঠিক বৃষ্টি পড়ে। তখন পৃথিবী আরও বেশি নিঝ্ঝুম হয়ে যায়। বাইরে বৃষ্টির শব্দ আর ঘরের মধ্যে ছেলেমেয়েদের নিশ্বাসের ভর্‌র ভর্‌র শব্দ।

হঠাৎ এক সময় ঘুলিয়ে উঠলো হাসিনার শরীরটা। পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো সাংঘাতিক ভাবে। কয়েকবার এপাশ-ওপাশ ফিরেও হাসিনা সামলাতে পারলো না নিজেকে। হুড়োতাড়া করে উঠে ছুটে গিয়ে বাইরের দাওয়ায় বসে বমি করলো অনেকটা। বমির সঙ্গে সঙ্গে হাসিনা কাঁদতে লাগলো খুঁ খুঁ করে।

কিছুদিন ধরেই হাসিনা যে সন্দেহ করছিল অথচ কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় নি, শেষ পর্যন্ত সত্যি তাই হলো। হাসিনা এ বমির মর্ম বোঝে। এই জন্যই গত কয়েকদিন ঢিসঢাস করছিল শরীরটা। এর কারণ আর কিছুই না, হাসিনা আবার গর্ভবতী হয়েছে, আবার একটা শত্তুর এসেছে তার পেটে।

পরক্ষণেই সে জিভ কেটে বললো, ছিঃ, এ কথা বলতে নেই। পেটের সন্তান কখনো শত্তুর হতে পারে? ও কথা মনে করাও পাপ। যে আসছে, সে আসুক।

১৩৮৪ (১৯৭৭)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *