গিন্নী – বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়
মেয়ে দেখতে আসছেন পাত্রের জ্যাঠামশাই এবার।
এটা নিয়ে তিনবার হবে। প্রথমে দেখে গেছেন পাত্রের বাবা এবং মামা। বাবা মনে হল একটু সাদাসিধা ঢিলেঢালা মানুষ, নিতান্ত নাকি ছেলের বাপ তাই এসেছেন। মামা কিন্তু এক্সপার্ট মেয়ে-দেখিয়ে। সাধারণ প্রশ্ন এমনি যা সব তা তো হলই, তারপর অঙ্গাদি পরীক্ষাতেও বেশ বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন। বাঁ হাতে ওর ডান হাতটি নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আঙুলগুলি পরীক্ষা করলেন, পরে বাঁ হাতের গুলিও। একটু ঘষে ঘষেই হাতের উলটো পিঠ, মণিবন্ধ পরীক্ষা করলেন, ত্বকের মসৃণতা দেখবার ছলেই অবশ্য, কিন্তু যারা বোঝবার তারা বুঝল, রঙ-পাউডার মাখানো হয়েছে কিনা তারই যাচাই। আসনপিঁড়ি হয়ে বসেছিল, পা-দুটি জড়ো করিয়ে পা দেখলেন, আঙুল দেখলেন। খোঁপা বাঁধা ছিল, ভেতরে পাঠিয়ে খুলিয়ে আনিয়ে চুল দেখলেন। হেঁটেই এসেছে, তবু বিদায় দেওয়ার সময় বললেন— “অত লজ্জা করে হাঁটছ কেন মা, যেমন চলাফেরা করো বাড়িতে, সেইভাবে যাও, লজ্জা কিসের?”
মেয়ে অবশ্য আরও জড়োসড়োই হয়ে গেল খানিকটা, তবে আর টুকলেন না। চার বার তো হল দেখা ; চুল খুলিয়ে আনার মধ্যে চুলও ছিল, চালও ছিল। যারা বোঝবার তারা বুঝল, এলো চুলে এলে খোঁপা বাঁধিয়ে আনাতেন।
খলিফা লোক।
এর পর দেখে গেল পাত্র স্বয়ং এবং তার বন্ধু।
পাত্রটি বাপের মতো অতটা ঢিলেঢালা আর নির্বিরোধী হয়তো নয়, তবে জিজ্ঞাসাবাদের দিকে একেবারেই গেল না। তার কারণ এও হতে পারে যে, তার সমস্ত সময়টা নির্লিপ্তভাবে কিছু না দেখার ভান করে যতটা দেখা যায়, সেই চেষ্টাতেই গেল কেটে। তবে বন্ধুটি খুব চৌকস। পড়াশোনার কথা জিজ্ঞাসা করল, হাতের লেখা দেখল, হাতের কাজ আনিয়ে দেখল, ভেতরে পাঠিয়ে গান শুনে নিল, তারপর আবার এসে যখন বসল, বেশ একটু বিস্মিতভাবেই প্রশ্ন করল, —“আবার ফিরে এলেন যে, এবার আপনি কিছু জিজ্ঞেস করবেন?”
সে হয়তো রসিকতাটুকু পছন্দ করল, তাকেও একটু হেসে উঠতে হল, আর নিরীহ রসিকতাই তো। তবু কাকা সরে গেলেন ; মুখ-আল্গা আজকালকার ছেলে, একটু যাবেই জিভ ফসকে এরকম। সামনে না আসাই ভালো। মেয়েও হেসে ফেলেছিল, কোন রকমে উঠে জড়িতপদে তাড়াতাড়ি চলে গেল। ছেলেটি হাল্কা আসরে একবার সবার দিকে চেয়ে নিয়ে হাত জোড় করে বলল—“আমায় মাফ করবেন, ছেলের ফরমাশ ছিল হাসিটুকু পর্যন্ত দেখাতে, তাই…”
পাত্র কাঁকালে চিমটি কেটে ধরায়—“উঃ, রাস্কেল!” বলে চুপ করে গেল।
এবার আসছেন জ্যাঠামশাই। আসুন, মেয়ে থাকলে দেখানর বিড়ম্বনা মাথা পেতে সহ্য করতেই হয়, কিন্তু এবার সবাই একটু বেশ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। শোনা যাচ্ছে, অত যে খুঁটিয়ে দেখা হল দু দফা, তার নাকি কোনও মূল্য নেই, সব নির্ভর করছে জ্যাঠামশাই কি রায় দেন, তার ওপর। তিনি ছিলেন না, এসেছেন, এবার আসবেন।
মেয়ে-দেখার একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। আজকালকার অভিভাবকেরা এতটা পছন্দ করেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে একটু আলাদা ব্যাপার হয়েছে। ছেলেটি খুবই ভালো, পরীক্ষা দিয়ে এবার ডেপুটি হয়েছে। এদিকে অভিভাবকদের শুধু ভালো মেয়ে দরকার, যতটা সম্ভব সুন্দরী, তারপর যতটুকু সম্ভব শিক্ষিতা। অন্যদিকে একেবারেই লক্ষ নেই।
সেটা যে নেই, তা খুব জানা কথা বলেই কন্যার অভিভাবকেরা অগ্রসর হতে সাহসী হয়েছেন, এক শুধু মেয়ের জোরে। এমন কিছু দূরের ব্যাপার নয়, রিষড়া-শ্রীরামপুর, তাও মাইল দু’য়েকের মধ্যে দু পক্ষের বাড়ি। খোঁজ নেওয়া সহজ, পাওয়া গেছে অনেকখানি, তার মধ্যে এটা পাকাপাকি রকমই জানা গেছে যে, ঐ যে অন্য কিছুর দিকে লক্ষ নেই, সেটা শুধু মুখের কথাই নয়, সত্যই দেখে শুনে গৃহস্থের বাড়ি থেকেই মেয়ে এনেছেন ওঁরা। যাদের এমনি ওঁদের বাড়ির ছেলের নাগাল পাওয়ার কথা নয়।
সহ্য করতে হবে মেয়ে-দেখার বাড়াবাড়ি। জ্যাঠামশাইয়ের পছন্দ হলেও নিশ্চয় মেয়েদের অভিযান। উপায় কী?
কিন্তু খুঁটিয়ে দেখা-শোনার পরও তিনি আসছেন কি করতে সেইটেই আন্দাজ করতে না পেরে সবাই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ওদের দেখাশোনায় একটা যেন বেশ প্ল্যান আছে, দু ব্যাচ যেন দু’রকম উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিল, ওরা যা জানতে চেয়েছিল, এরা সেদিকটা বাদ দিয়ে গেছে ; এরা যেদিকটা ধরেছে, ওরা সেদিক দিয়েই যায়নি। কিন্তু আর বাকিটা কি আছে যে, জ্যাঠামশাই ধরবেন? তাঁর প্রশ্ন কি ধরনের হবে? মেয়েকে সেইমতো প্রস্তুত থাকতে হবে তো।
মেয়েরা আজকাল এসব আরও পছন্দ করে না, কলেজের মেয়েরা তো নয়ই। কেউ কেউ বিদ্রোহই ঘোষণা করে বসে বেশি বাড়াবাড়ি হলে। অন্তত আপত্তি-অভিমান—এটুকু তো থাকেই। দু দফা হল, আর কেন? অঞ্জলি তা করেনি। অবশ্য ওপরে ওপরে ‘বেঁধে মারে সয় ভালো’ ভাবটা বজায় রাখতেই হয়েছে, কিন্তু ভেতরে প্রস্তুতিটা অন্যরকম—যতবার চায়, যাক না পরীক্ষা করে, যত রকমে পারে।
পাত্র হেমন্তর মতো ও-ও তো না-দেখবার ভান করে চক্ষুময় হয়ে দেখছে, বড় ভালো লেগেছে। জ্যঠামশাইয়ের চিন্তাটা ওর কারুর থেকেই কম নয়, পণ্ড করে দেবে নাকি সব স্বপ্ন।
অনেক চেষ্টায় কিছু কিছু আঁচ পাওয়া গেছে। কথাটা যদি সত্য হয় তো যেমন লঘু, তেমনি নিরীহ, চিন্তার বিশেষ কিছু নেই। জ্যাঠামশাই হচ্ছেন পাঞ্জাবপ্রবাসী সেকেলে বাঙালী। দেশবিভাগের পর মীরাটে এসে থাকেন, তারপর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে এইমাত্র কিছুদিন হল দেশে এসে বসেছেন।
এসেই এই ফ্যাচাংটুকু তুলেছেন।
তবে এমন বিশেষ কিছু নয়।
জ্যাঠামশাই একটু ভোজনবিলাসী, ওদিককার জলে এটা করেই দেয়। এসে একটু নিরাশ হয়েছেন। তিনটি বউ এসেছে বাড়িতে, এম-এ আছে, বি-এ আছে, রূপসী তো বটেই, গানও জানে, সূচীশিল্প তো আছেই। কিন্তু অবসরভোগীর একটিমাত্র সাধ ছিল জীবনে, তা ভালো করে মিটল না। রাঁধুনে বউ এল না একটিও। সবগুলিই চলতি ভাষায় ‘মা জনুনী’ একেবারে। তাই ঐ শর্ত জুড়ে দিয়েছেন।
এ আর এমন কী কঠিন শর্ত? গৃহস্থঘরের মেয়ের পড়া বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত। অঞ্জলির অবশ্য এবার বি-এ দেওয়ার বছর, তবে ওকে রান্নাঘরের দিকেই ঠেলে দেওয়া হয়েছে। যতটা সম্ভব ঐ দিকেই থাক আপাতত। বাইরে বাইরে মুখ ভার করতে হয় একটু, কিন্তু ভেতরে ভেতরে এর চেয়েও খাটাচ্ছে নিজেকে অজ্ঞলি। আর সবার পক্ষে না হোক, ওর পক্ষে তো রীতিমতোই কঠিন। পাঞ্জাব-ফেরা বাঙালী, সে শুক্তো-শাকের ঘণ্টর জন্যেই এসে বসেছে শ্রীরামপুরে?
একখানি গুপ্ত খাতা আস্তে আস্তে বোঝাই হয়ে উঠছে। শুক্তো-শাকের ঘন্টের ফরমূলা তো আছেই, তাছাড়া—
ডিমের কাশ্মিরী পরটা। —চারটি ডিম, একপোয়া গমের ময়দা, একপোয়া ছোলার ছাতু, একপোয়া ঘি, পনেরোটি ছোট এলাচ, পনেরোটি কাবাবচিনি ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভেটকি মাছের কোফ্তা কারি—একসের ভেটকি মাছ, চারিটি ডিম, একপোয়া পেঁয়াজ, চারিটি রসুন, পাঁচটি কাঁচালঙ্কা, এক ছটাক টমাটোর রস, পরিমাণমতো গুঁড়ো লঙ্কা ইত্যাদি ইত্যাদি।
মোগলাই মোরগ মোসল্লম (অন্য পাখিরও হয়)—একটি পাখির ওপরকার সব পরিষ্কার করে নিয়ে পেট চিরে ভেতরটাও পরিষ্কার করে নিয়ে নিম্নলিখিত দ্রব্যগুলি পুরে দিয়ে আগাগোড়া সেলাই করে দিতে হবে—পরিমাণমতো পেস্তা, বাদাম, কিশমিশ, পেঁয়াজবাটা, রসুনবাটা ইত্যাদি ইত্যাদি।
দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক কাগজ থেকে সংগ্রহ করছে। কলেজের দুটি অন্তরঙ্গ সাথী সাহায্যও করছে ; বিপদ তো সবার জীবনেই আসতে পারে।
রন্ধনবিদ্যার পড়া তৈরি করতে খুব মেহনত হচ্ছে, পাসের পড়ার চেয়ে কিছু কম নয় ; পরীক্ষার মুখে যে পাসের পড়া।
পরীক্ষা তো এসেই গেল। সেদিন না এসে পড়েন জ্যাঠামশাই।
এসে পড়লেন।
ছ’ ফুট দীর্ঘ মানুষ, তেমনি ওসারও। এতখানি ঘোরালো মুখ, ইয়া বুকের ছাতি, মোটা হাড়কাঠ, টকটকে রঙ ; ষাট-বাষট্টি বছর বয়স হবে, একটি কাঁচা চুল নেই মাথায়, তবু চোখ দুটো যেন জ্বলছে। সাজানো নকল দাঁত নয়, কশের দিকে থাক-না-থাক, সামনে দু’সারি ঝকঝক করছে ; একটু এবড়ো-খেবড়ো, কিন্তু মনে হয় বেশ শক্তই। একজোড়া বেশ পুষ্ট গোঁফ, মাথার চুলের মতোই সাদা ধবধবে।
দেখলে গা-ছমছম করে, অবশ্য যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন, সেকথা ভেবে।
ওরা সব দু’জন দু’জন করে এসেছিল, জ্যাঠামশাই নামলেন একা, ওঁর যেন দোসর নেই কেউ সংসারে। নামলেনও যে, ট্যাক্সিটা একবার খানিকটা বসে গিয়ে স্পিঙে লাফিয়ে উঠে বার দুই-তিন দুলে গেল ; যেন বাঁচল। সবাই সসম্ভ্রমে নিয়ে গিয়ে বৈঠকখানায় বসাল।
নিতান্ত স্বাভাবিক কৌতূহলে অঞ্জলি ওপর ঘরের জানালা থেকে উঁকি মেরে দেখল, তারপর দেরাজ থেকে খাতাটা বের করে ঝুঁকে পড়ল। শাক-শুক্তো বা ছাপার কাগজের শৌখিন কিছু নয়, একেবারে কালিয়া-কোর্মা, দোর্মা—কোর্মা—কাবাবের পাতার ওপর। পরীক্ষায় বসবার আগে ঝালিয়ে নিচ্ছে একবার। কী যে হবে।
মানুষটি যেমন সু-গুরু, তেমনি ভেতরে সুগম্ভীর। প্রথম সাক্ষাতের দু-একটি কথাবার্তায় কণ্ঠস্বরের যা নমুনা পাওয়া গেল, তাতে আর কেউ কথা বাড়াবার সাহস করল না। সবাই তটস্থ হয়ে রইল, ঘরটা থমথম করতে লাগল।
নিতান্ত যে কথা কন না এমন নয়, একবার বললেন—“বড় গরম এখানে। অসহ্য।”
ঘরের সবাই বলে উঠল—“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“কিন্তু তবু আমাদের ওদিককার মতন নয়।”
সবাই বলল—“তা কি হতে পারে?”
একটু চুপচাপের পর প্রশ্ন করলেন— “দেরি আছে কি বেশি?”
প্রায় সকলেই ঘর খালি করে দেখতে ছুটল ভেতরে। বেরিয়ে এল তিনটি ছেলে, একজন বলল—“দিদির বড্ড মাথা ধরেছে⋯দিদি বলছে।”
প্রশ্ন হল—“মাথা ব্যথা? কেন?”
আন্দাজটা বলবে কিনা একটু থতমত খেয়ে গেছে, কাকা বেরিয়ে এলেন, বললেন—“হয়ে এসেছে।”
মুখটা একটু ভার-ভার, বোধ হয় ধমক-ধামক দিতে হয়েছে।
একটু যেন বাড়লও কথা জ্যাঠামশায়ের, বললেন—“বেশি সাজানো হচ্ছে? কি দরকার? দেখে তো গেছেই সবাই, আমি শুধু আমার দরকার মতন⋯”।
মনে হল একটু যেন হাসিই আসছিল, এমন সময় মেয়ের বড়ভাই এসে খবর দিল তোয়ের। কাকা জ্যাঠামশাইকে নিয়ে ভেতরের দিকে এগুলেন। সবাই পেছনে পেছনে চলল। বাড়ির বারান্দায় গালিচা পেতে দেওয়া হয়েছে, সামনে একটি আসন। জ্যাঠামশাই গিয়ে বসলেন গালিচায়, মেয়েকে নিয়ে আসা হল। যথারীতি প্রণাম করে বসল সে, পায়ের তলায় হাতটা যেন আগেকার চেয়ে একটু চেপে বুলিয়ে ; একটু একটু যেন কাঁপছেও।
সিঁথির ওপর হাতটা একটু ভালোভাবেই চেপে নীরবে আশীর্বাদ করলেন জ্যাঠামশাই, বললেন—“খাসা মেয়ে, বাঃ! আচ্ছা বলো তো মা, নিম-ঝোল আর মোচার ঘণ্ট কি করে রাঁধবে—কি কি মশলা, কি কি তার পরিমাণ?”
পরীক্ষার্থীদের ভাষায় একেবারে আন্ইম্পরটেন্ট প্রশ্ন। বুকটা ধড়াস করে উঠল অঞ্জলির। নিম-ঝোল তো ছোঁওয়াও হয়নি, ঘন্ট সম্বন্ধে যা-ও শুনেছে, তাও গেল গুলিয়ে। দু’বার ঢোক গিলল, তারপর ঘাড়টা হেঁট করে বসে রইল।
জ্যাঠামশাই বললেন—“এই তো নয়। আমি বুড়োমানুষ, কোথায় তাড়াতাড়ি ছুটে এলাম—সারা জীবনটা গোস্ত্পরটা খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেছে, এবার বাংলা দেশে গিয়ে মায়েদের হাতে⋯”
সবই কিম্ভূতকিমাকার হয়ে গেছে, এত করে শেষকালে নেহাত যোগ-বিয়োগে ফেল করবে! কাকা দুটো হাত একত্র করে বললেন—“আজ্ঞে না, ঘন্ট -শুক্তো-নিম ঝোল তো একরকম রোজই রাঁধতে হচ্ছে ; ও জানে সব। বলো অঞ্জু, বলো, ভয় কিসের? ⋯”
একেবারে নিস্তব্ধ সব, একটা সূঁচ পড়লে শোনা যায়। পাশের ঘরে মেয়েরা রয়েছে, একটু-আধটু যা চুড়ির ঠুনঠান শব্দ হচ্ছিল, তাও গেছে থেমে, হঠাৎ পরদা ঠেলে ছোট একটি মেয়ে বেরিয়ে এল, বলল—“নাগো, পিছি দানে না, আমি দানি, বাত রেঁদেচি, ঘন্তো রেঁদেচি, বাবা খেয়েচে⋯”
একটা ডুরে শাড়ি পরানো, ভালো করে আঁচড়ানো চুলের ওপর দিয়ে বেড় দিয়ে রাঙা ফিতে বাঁধা, পায়ে আলতা, দু’হাতে দুটি ছোট ছোট খুরি। একটিতে কাদায় মাখানো কি পাতা। একটিতে ছাই। ভাত আবার সাদা হওয়া চাই তো।
সবাই একেবারে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল—“তুই এসেছিস! আঃ, এটাকেও যে একটু ধরে রাখবে। কোথেকে জুটলি তুই!”
কাকা নিজেই ধরে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিলেন, জ্যাঠামশাই হাত তুলে বাধা দিলেন, বললেন—“ছেড়ে দিন ওকে। এসো তো এদিকে ; পিসি বুঝি কিছু জানে না?”
বেশ সপ্রতিভভাবেই মাথা নাড়ল—না।
“তুমি বুঝি সব জান?—ঘণ্ট শুকতো, ডালনা, চচ্চড়ি⋯”
“ছ—ব দানি।”
“আমায় পারবে তো রেঁধে দিতে?”
“হুঁঃ⋯।”
“তাহলে চলো যাই, আর কি⋯”
কোলে তুলে নিয়ে উঠে পড়লেন। কাকা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন—“আজ্ঞে, অঞ্জু জানে সব, কিরকম নার্ভাস হয়ে পড়েছে⋯যদি আরও কিছু জিজ্ঞেস করেন⋯”
“আর কেন মশাই? এমন পাকা রাঁধুনি আমার গিন্নী পেলাম, মা রাঁধতে জানে কি না জানে, সে-খোঁজে আর দরকার?”
পাঞ্জাবী-হাসি পড়ল ফেটে। গিন্নীকে বুকে নিয়ে বৈঠকখানার দিকে এগুলেন।
১৩৬৫ (১৯৫৮)।