মীন পিয়াসী – অন্নদাশঙ্কর রায়
সমবয়সিনীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই তিনি থতমত খেয়ে পা সরিয়ে নিলেন। রুক্ষ স্বরে বললেন, “থাক, থাক। ও কী! ও কী!”
তারপর মিষ্টি হেসে বললেন, “চিনতে পারছিনে তো!”
চিনতে কি বিমোহনও পারছিল! ওটা হলো আন্দাজে ঢিল। প্রণাম না করে নমস্কার করলে পরে হয়তো পরিতাপ করতে হতো। গুরুপত্নীকে প্রণাম না করে নমস্কার! আগেও দু’এক জায়গায় এই ধরনের ভুল হয়েছে। কী লজ্জা!
কিন্তু আন্দাজটাও অকারণ নয়। সেই যে ছেলেটি একটু আগে ওকে দেখেই ছুট দিয়েছিল সেটি অবিকল ওর মাস্টারমশায়ের ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি। খোকার প্রস্থানের পর যার প্রবেশ তিনি নিশ্চয় খোকার মা। সুতরাং গুরুপত্নী। সুতরাং প্রণম্যা। কবে কিশোর বয়সে তাঁকে একবার কি দু’বার দেখেছিল, পঁচিশ বছর বাদে তাঁর মুখ মনে থাকার কথা নয়। তা হলেও তাঁর বয়সটা কোনো মতেই তার সমান হতে পারে না। সে কি তবে ভুল মানুষকে প্রণাম করেছে? না ইনি দ্বিতীয় পক্ষ?
বলল, “নাম শুনলে হয়তো চিনতে পারবেন। আমি বিমোহন। বিমোহন সরকার।”
“ওমা, বিমোহনবাবু!” সমবয়সিনীর দুই চোখ জ্বলে উঠল। “কী কাণ্ড, বলুন দেখি। আমি মীনু। মীনাক্ষী।”
মীনাক্ষী? মাস্টারমশায়ের ছোট শালী? কতবার বাইরে থেকে ওর কণ্ঠস্বর শুনেছে। কিন্তু কোনোদিন একে চাক্ষুষ করেনি। তখনকার দিনে বারো-তেরো বছর বয়সের পর মেয়েদের পর্দার আড়ালে রাখা হতো। মাস্টারমশায়ের বাড়ির ভিতরে তাঁর প্রিয় শিষ্য বিমোহনেরও যাতায়াত ছিল না। সদর ও অন্দরের মাঝখানে অলিখিত ব্যবধান।
মেয়েটি এসেছিল ম্যালেরিয়ার দেশ থেকে দিদির কাছে থেকে শরীর সারাতে। পরে শোনা গেল পাত্রের অন্বেষণও চলছে। এমন কথাও একদিন বিমোহনের কানে এলো, তোমার এই ছাত্রটির সঙ্গে কি হয় না? মাস্টারমশায় চাপা গলায় বলছেন, অত কাছাকাছি বয়সের ছেলেমেয়েদের বিয়ে হওয়া কি ভালো?
যথাকালে এক দোজবরের গলায় বেচারিকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বিমোহন শুনে ব্যথিত হয়েছিল। কত কালের কথা! এই সেই মীনাক্ষী। একেই সে ভক্তিভরে প্রণাম করেছে। হা হা! হাসি পাচ্ছিল বিমোহনেরও।
হাসি চেপে গম্ভীরভাবে বলল, “আপনিও ইচ্ছা করলে পালটা প্রণাম করতে পারেন। কিন্তু আগে বলুন তো, মাস্টারমশায় কেমন আছেন? আউট অফ ডেঞ্জার?”
মীনাক্ষী বলল, “হাঁ, সঙ্কট কেটে গেছে।”
উপরে যেতে যেতে বিমোহন বলল, “আমি জানতুম না যে মাস্টারমশায় এখন কলকাতায়। কাল এক বিয়েবাড়িতে নরেনের মুখে শুনলুম তাঁর গুরুতর অসুখ। অত রাত্রে এসে হাজির হলে তাঁকে ও আপনাদের ডিস্টার্ব করা হতো। রাতটা কোনো মতে কাটিয়ে ভোরবেলা এক পেয়ালা চা খেয়েই বেরিয়ে পড়েছি।”
“জামাইবাবু,” মীনাক্ষী বলল, “জ্বরের ঘোরে আপনার নাম করছিলেন। কিন্তু আমরা কেউ আপনার ঠিকানা জানতুম না। অবস্থা যদি ভালোর দিকে না যেত আপনি আজ এসে তাঁকে দেখতে পেতেন না।”
গৃহকর্তা বঙ্কিমবাবুর সঙ্গেও পরিচয় হলো। মীনাক্ষীর স্বামী। শুভ্রকেশ, স্থবির ও স্থাবর। তাঁর প্রথম পক্ষের সন্তানসন্ততির সঙ্গেও। বউমারা মাথায় ঘোমটা তুলে প্রণাম করে সরে গেলেন। মীনাক্ষীর একটি মাত্র কন্যা। সে তার শ্বশুরালয়ে। তারপর সেই খোকার সঙ্গে আলাপ। মাস্টারমশায়ের কনিষ্ঠ দুলাল। নামটিও দুলাল।
মাস্টারমশায় সারা কর্মজীবন পশ্চিমে কাটিয়েছেন। পৈতৃক বাড়ি তাঁর কলকাতার কাছেই। এবার চিকিৎসার সুবিধার জন্যে ভায়রাভাইয়ের বাড়িতে ওঠা। অসুখটা তিনি পশ্চিমেই বাধিয়েছিলেন। ঠিকমতো রোগনির্ণয় হয়নি। নিজে তো চিরদিন নির্বিকার। দিদির চিঠি পেয়ে মীনাক্ষী গিয়ে জোর করে নিয়ে আসে। নইলে এ-যাত্রা তাঁর উদ্ধার ছিল না। এখন আর ভয় নেই। তবে দুর্বল।
বিমোহনকে যখন মাস্টারমশায়ের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো ততক্ষণে তাঁর প্রাতঃকৃত্য সারা হয়েছে। তিনি শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। বিমোহনকে দেখে তাঁর মুখ হাসিতে ভরে গেল। সে হাসিতে অসীম স্নেহ, অকপট ভালোবাসা। বিমোহন তাঁর পায়ে হাত দিতেই তিনি তার হাতখানা খপ করে ধরে ফেলে বললেন, “কাছে এসো। এইখানে বসো।” তিনি তার হাত ধরে থাকলেন। সে খাটের উপর বসল।
“জানো বিমোহন,” মাস্টারমশায় ধীরে ধীরে বললেন, “ওরা আমার জন্যে গঙ্গাজল আনিয়ে রেখেছিল। আমার মুখে দেবার জন্যে।”
বিমোহন চমকে উঠে বলল, “তাই নাকি? এতদূর?”
মাস্টারমশায়ের মুখে অন্তজ্যোতি। আপনাতে আপনি মগ্ন। বললেন, “গঙ্গাজলে আমার কী হতো, বিমোহন! তাতে কি আমার পিপাসা মিটত!”
কথাটা কোন অর্থে বললেন বিমোহন ভাবছিল। শুনল, “কবীরের দোঁহা পড়েছ? সেই যে আছে—
পানীমে মীন পিয়াসী
দেখি লাগত হাসি
তেমনি আমারও দশা। আমি যে রসের সরোবরে ডুবে আছি। তবু আমার তৃষার অবধি নেই। আচ্ছা, বিমোহন, তুমি তো ইংরেজি কবিতা ভালোবাসতে। বল দেখি,এর অনুরূপ কোন্ কবির কোন্ কবিতায় আছে?”
বিমোহনের মনে পড়ল না। তার ছাত্রত্ব কবে ঘুচে গেছে। সে তো শিক্ষকতা করে না যে পড়াতে পড়াতে মনে গেঁথে যাবে।
“ফ্রান্সিস টমসন পড়নি? আচ্ছা, শোন। মনে করিয়ে দিচ্ছি। যদি পড়ে থাক।
O world invisible, we view thee,
O world intangible, we touch thee,
O world unknowable, we know thee,
Inapprehensible, we clutch thee!
Does the fish soar to find the ocean,
The eagle plunge to find the air—
কেমন? কতকটা কবীরের মতো কি না?”
মাস্টারমশায় তন্ময় হয়ে আবৃত্তি করে যেতে লাগলেন। বিমোহনের একটু একটু করে মনে পড়তে থাকল। যেন পূর্বজন্মের স্মৃতি। যখন সে স্কুলের ছাত্র, এসব কবিতা তার বোধগম্য নয়, পাঠ্য তো নয়ই, তখনো মাস্টারমশায় তাঁর প্রিয় শিষ্যকে সযত্নে কবিতা বেছে বেছে পড়ে শুনিয়েছেন।
স্বভাবতই তিনি প্রফুল্ল। সব সময় মুখে হাসিটি লেগে আছে। বিমোহন লক্ষ করল তাঁর মুখে হাসি, কিন্তু চোখে জল। রোদ আর বৃষ্টি। কী জানি কেন তারও চক্ষু সজল হলো। কবীর বললে কী হবে, দেখে হাসি লাগে না। বরং কান্নাই পায়। মাছ জলে বাস করে, জল তার চারদিকে, তবু তার জলতেষ্টা গেল না। কবে যাবে? কিসে যাবে?
“বিমোহন”, নীরবতা ভঙ্গ করলেন মাস্টারমশায়, “এক দরজা বন্ধ না হলে আরেক দরজা খোলে না । জীবনের পরেও জীবন আছে, যেমন জলের পরও জল আছে। চারদিকেই জল। চারদিকেই জীবন। জলের এক নাম জীবন। যেমন জাহ্নবী জীবন।” এই বলে একটু মাস্টারি করলেন।
“দরজা খোলার কথা কী বলছিলেন, সার?”
“ওঃ । হাঁ। বলছিলুম এক দরজা বন্ধ না হলে আরেক দরজা খোলে না। কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। কতবার যে এরকম ঘটল আমার এই ষাট বছরের জীবনে। এবার জীবনের দরজাটাই বন্ধ হয়ে যাবে, তারপর জীবনেরই দরজা খুলে যাবে। এও যেমন জীবন সেও তেমনি জীবন। কোনো ভেদ নেই বিমোহন। কিছুমাত্র ভেদ নেই। জল আর জল আর জল। মাছ এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে যায়। সাত ঘাটের জল খায়। কোথাও তার তৃষা মেটে না। সেইজন্যেই বলা হয়েছে, পানীমে মীন পিয়াসী।”
বিমোহন চুপ করে শুনে যেতে লাগল, তিনি বলে যেতে লাগলেন কতকটা আবোল-তাবোল মিশিয়ে। সেসব আমরা বাদসাদ দিতে পারি।
“দেখি লাগত হাসি। যাঁরা সর্বদর্শী তাঁদের তো হাসি পাবেই। আমারও হাসি পায়। যদিও আমি অবোধ। বুঝলে, বিমোহন, চারদিকে এত ভালোবাসা, এত স্নেহপ্রেম। প্রভু, আমি কি এর যোগ্য। প্রভু, আমার যে কান্না পায়! আমি তো তোমাকে এত ভালোবাসিনি। তুমি কেন আমাকে এত ভালোবাসো? এই যে একটি বালক বিমোহন, এ পঁচিশ বছর পরে ছুটে এসেছে আমাকে দেখতে। কাল সারারাত জেগে কাটিয়েছে। প্রভু, আমি কি এর যোগ্য?”
বিমোহন তাঁকে বাধা দিল না। তাঁর চোখে জল ঘনিয়ে এলো আবার।
“ওহে বিমোহন, এককালে আমার ধারণা ছিল, এসব আমার পাওনা। আমার ন্যায্য দাবি। ভালোবাসা এক ছটাক কম পড়েছে দেখলে আমি বিষম রাগ করেছি, বলেছি, এরা অকৃতজ্ঞ! রাগ করে কথা বলা বন্ধ করেছি, ভাত জল বন্ধ করেছি। ভেবেছি, এইসব করলে ওরা আমাকে ভালোবাসবে। পাগলামি আর কাকে বলে! প্রভু, তুমি যে ভালোবাসো সে তোমার করুণা। তোমার গ্রেস। ওহে বিমোহন, গ্রেস কাকে বলে, জানো তো? ক্রিশ্চানদের গ্রেসতত্ত্ব তোমাকে একদিন বোঝাব। আমি যে যোগ্য বলে তুমি আমাকে ভালোবাসো তা নয়। আমি অযোগ্য, তা সত্ত্বেও তুমি আমাকে ভালোবাসো। এত যে ভালোবাসো, তবু আমার পিপাসা মিটল না। এ-পারে যখন মিটল না, ও-পারেও কি মিটবে? আমার তো বিশ্বাস হয় না। রস আমাকে ঘিরে রয়েছে, আমিই অরসিক।”
এর পরে আবার একটু মাস্টারি। “বুঝলে, বিমোহন? একেই বলে অরসিকেষু রসস্য নিবেদনম্।”
মীনাক্ষী এসে বিমোহনের জন্য ঠাঁই করে দিয়ে খেতে ডাকল। বিমোহন অনুযোগ করল, “এসব কেন? আমি তো চা-টা খেয়েই বেরিয়েছি।”
মীনাক্ষী বলল, “চা খেয়েছেন, কিন্তু টা খাননি। এখন খেতে আজ্ঞে হোক। চা-টা দুই খেতে হবে।”
ওটা অবশ্য অরসিকেষু রসস্য নিবেদনম্ নয়। বিমোহন তা প্রমাণ করে ছাড়ল। ওদিকে মাস্টারমশায় সামান্য একটু পথ্য করলেন। ফলের রস। তাঁর দেহ শীর্ণ হতে হতে শয্যায় মিশিয়ে গেছে। যেন বালুশয্যায় শীতের ক্ষীণস্রোতা নদী।
“তুমি তো জানো শরীর আমার কোনো কালেই পটু ছিল না।” এই বলে তিনি নিজেই নিজের সংশোধন করলেন, “না, না, তা কেন বলব? ছেলেবেলায় আমি বেশ হৃষ্টপুষ্ট ছিলুম। বড় হয়েও ফুটবল-ক্রিকেট খেলেছি। হাই জাম্প, লং জাম্প করেছি। কেবল পড়াশুনোয় নয়, খেলাধুলোয় নাম করেছি। শরীর অপটু হলে কেউ পারে মোমবাতি দু’দিক থেকে জ্বালাতে?”
খেতে খেতে বিমোহন বলল, “আপনার কলেজ-জীবনের ফোটো দেখেছি। গ্রুপ ফোটো। হকি স্টিক হাতে। দিব্যি জোয়ান চেহারা।”
মাস্টারমশায়ের চোখে-মুখে হাসি। “শিবপুরের সঙ্গে খেলায় জিতেছি। তামাশা নয়। মীনু মানতে চায় না। বলে ওটা ফোটোগ্রাফির ট্রিক। হাঁ, এককালে দারুণ খেলেছি। দারুণ খেটেছি। দারুণ খেয়েছি। কিন্তু তারপর কী হলো, শোন। বি-এ পরীক্ষার ক’দিন আগে আমাদের হস্টেলের একটি ছেলের টাইফয়েড হয়। সেকালে টাইফয়েডকে লোকে যমের মতো ভয় করত। কেউ তার সেবা করতে যাবে না। আমিও কি যেতুম? গেলুম আমি ডন সোসাইটির সভ্য বলে। যেখানে একজন বিপন্ন সেখানে আরেক জন তাকে বাঁচাবার জন্যে প্রাণপণ করবে। চাচা, আপনা বাঁচা, এ যদি নীতি হয় তবে দেশ কোনোদিন স্বাধীন হবে না। ঐ করেই দেশ গেছে।”
“তারপর?” বিমোহন উদ্বিগ্নভাবে জানতে চাইল।
“তারপর আমারও হলো। বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে। অনেকদিন ভুগে উঠলুম। কিন্তু পূর্বস্বাস্থ্য ফিরে পেতে দেরি হতে লাগল। চেঞ্জে পাঠিয়ে দেওয়া হলো পশ্চিমে একটি পাহাড়ে জায়গায়। বিমোহন, জীবনে আমি কখনো পেছিয়ে যাইনি। বার বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। বার বার বেঁচে গেছি। তবে অক্ষত রয়েছি, এমন কথা বলতে পারব না। ক্ষতিটা শরীরের উপর দিয়েই গেছে। মনের দিক দিয়ে ক্ষতিপূরণ হয়েছে। চরিত্রের উন্নতি হয়েছে। উপলব্ধির কোটায় মোটা মুনাফা জমেছে। তোমার এই গরিব মাস্টারমশায়টিও একজন মিলিয়নেয়ার। খবরদার, ফাঁস কোরো না কিন্তু। ইনকম ট্যাক্সওয়ালারা টের পেলে ধরবে।”
বিমোহনও তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে হাসল। তার মনে ছিল মাস্টারমশায় তাকে প্রায়ই বলতেন, হস্টেলের ছেলেদের অসুখ-বিসুখে এগিয়ে যেতে। বলতেন, সেটাও শিক্ষার অঙ্গ। পড়ার ক্ষতি হয় হবে। পরে পুষিয়ে নেওয়া যাবে। অপূরণীয় ক্ষতি হলেও পেছিয়ে যাওয়া উচিত নয়। যারা পেছিয়ে যায় তারা মানুষ হয় না। তিনি তাঁর ছাত্রদের মানুষ করবেন বলেই শিক্ষাব্রত নিয়েছেন। সেইভাবেই দেশকে স্বাধীন হতে সাহায্য করছেন।
“সে বছর বি-এ পরীক্ষা দেওয়া হলো না, যদিও সসম্মানে পাস করার জন্যে তৈরি ছিলুম আমি। চেঞ্জ থেকে ফিরে এসেই ঝাঁপিয়ে পড়লুম স্বদেশী আন্দোলনে। সে কী উন্মাদনা! কার সাধ্য এড়ায়। অরবিন্দের মতো মহাপুরুষদের সংস্পর্শে আসা কি কম সৌভাগ্য! আর রবীন্দ্রনাথের মতো মহাকবিদের! তিনি কি শুধু মহাকবি। তিনি মহাঋষি।
“দক্ষিণ আফ্রিকায় বসে মহাত্মা গান্ধী লক্ষ করছিলেন বাঙালীর সেই সংগ্রাম। তিনিও কি তার থেকে প্রেরণা পাননি? তে হি নো দিবসঃ গতাঃ। বাঙালীর সেদিন আর হবে না। তেমন পবিত্র অন্তঃকরণ কোথায়?”
রাজনীতি এসে পড়ছে দেখে বিমোহন প্রসঙ্গটার মোড় ঘুরিয়ে দিল। “সার কি তা হলে পূর্বস্বাস্থ্য ফিরে পেয়েছিলেন?”
“আরে, না, না। সেই কথাই তো বলতে যাচ্ছিলুম। তুমি বাধা দিলে কেন? অবিশ্রাম গ্রামে গ্রামে ঘুরে আমার আহার-নিদ্রায় অনিয়ম ঘটল। অনিয়মই অস্বাস্থ্যের মূল। তাতে প্রতিরোধশক্তি ক্ষয়ে যায়। রোগজীবাণু সহজেই জয়ী হয়। তারপর তাকে হটানোর জন্যে কতকগুলো অ্যালোপ্যাথিক দাওয়াই। চোরকে তাড়াতে ডাকাতকে ডাকা। কী বলছিলুম? আহারনিদ্রায় অনিয়ম ঘটল। দেখি আমার ঘুষঘুষে জ্বর হচ্ছে। আমাকে আবার পাঠিয়ে দেওয়া হল পশ্চিমে। সেই ছোট শহরে। পাহাড়ের কোলে। সেখানে বাসা করে থাকি। একমাত্র সাথী একটি চাকর। কিন্তু প্রকৃত সাথী যত রাজ্যের বই কাগজ। সবাই ভালোবেসে পাঠায়। সে এক মোচ্ছব। পাঠ্যপুস্তকের এলাকার বাইরে কলেজের গণ্ডির বাইরে কত বড় একটা মহাজগৎ আমার অপেক্ষায় ছিল। সুস্থ সবল ভালো ছেলে হলে কি তার খোঁজ পেতুম?”
মাস্টারমশায় মনে মনে কী যেন খুঁজলেন, তারপর বললেন, “আমার জীবনের উচ্চাভিলাষ ছিল এম-এ-তে সব ক’টা প্রতিযোগীকে পরাস্ত করে স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে বিলেত যাব। বিলেত থেকে ডিগ্রি নিয়ে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রোফেসার হব। সে উচ্চাভিলাষ একটু একটু করে অলকাপুরীর প্রাসাদচুড়ার মতো আকাশে মিলিয়ে গেল। নজরে পড়ল রামগিরি। যেখানে আমি নির্বাসিত যক্ষ। এবারকার চেঞ্জ তিন-চার মাসের জন্যে নয়। তিন-চার বছরও লেগে যেতে পারে। কলেজে ফিরতে স্পৃহা ছিল, কিন্তু ভালো পাস করার শক্তি ছিল না। তা বলে আমার জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো অগত্যা নয়।”
তাঁর গৃহিণী এসে তাঁকে আর কথা না বলতে অনুরোধ জানিয়ে গেলেন। বিমোহনও তা শুনে উঠি-উঠি করছিল। তিনি তাকে বসতে ইশারা করলেন।
“পাহাড়ের দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে আমার দৃষ্টি খুলে গেল। এ যে রূপের সায়র। আমি যেন ছোট একটি মাছ। আমি এর মাঝখানে হারিয়ে গেছি। কূলে ফিরে যাবার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। কূল কোথায় যে কূলে ফিরে যাব! আর কূল আমার কে যে আমি কূলে ফিরে যাব! আমি যে মাছ। আমি তো ডাঙার জীব নই। ডাঙায় ফিরে যাবার প্রশ্ন ওঠেই না। আর সেখানে গেলে আমি বাঁচব কেন? জলের মাছ কি ডাঙায় বাঁচে? খালি ছটফট করে, কখন আবার জলের কোল পাবে। আমি প্রথমেই স্থির করে ফেললুম যে, জলের মাছ হয়ে জলে বাস করব। ওই পাহাড়ের দেশেই বসতি করব। তার পরের প্রশ্ন, চলবে কি করে? খাব কী?”
“কেন? পোকামাকড় খাবেন! মাছ যখন আপনি।” মীনাক্ষী বিমোহনের দিকে চেয়ে সমর্থন আশা করল। কিন্তু বিমোহন অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।
“ওগো, পোকামাকড় খেতে কি আমার আপত্তি ছিল? আমি যখন মাছ। কিন্তু অন্তত একটা চাকরও তো রাখতে হবে। আর আমার সেই আদরের কুকুর ভুলি কী খাবে? ভুলি, তোমাকে আমি ভুলিনি। আমাকে তুমি সঙ্গ দিয়েছ, পাহারা দিয়েছ, সে কি আমি ভুলতে পারি? আহা, তোমার সেই উচ্ছ্বসিত ভালোবাসা। আমি কি তার যোগ্য।”
“ভুলিকেই বিয়ে করলে পারতেন।” মীনাক্ষী কটাক্ষ করল।
“পারলে কি করতুম না, ভেবেছ? ওর প্রায় আট-দশটি প্রার্থী ছিল। ও যখন পথ দিয়ে যেত তখন সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থীদের মিছিল চলত। একটি চলমান স্বয়ংবরসভা। ওহে বিমোহন, চলমান শব্দটা কি শুদ্ধ না অশুদ্ধ? চলন্ত স্বয়ংবরসভা। উঁহু।”
বিমোহন রায় দিল, “মাস্টারমশায়, আপনি যাই বলবেন তাই শুদ্ধ হবে।”
মাস্টারমশায় খুশি হয়ে বললেন, “বাংলা আমার সাবজেক্ট নয়। আমি বরাবর ইংরেজি নিয়েই মত্ত। স্বদেশী আন্দোলনের পাণ্ডা হলে কী হয়, আমার হৃদয় পড়ে থাকত ইংরেজি কবিতায়। ওদের সাম্রাজ্য-টাম্রাজ্য সব যাবে। কিছু টিকবে না। কিন্তু কবিতা? আহা, অমৃত! অমৃত! আমি সেই অমৃতসাগরে ডুবে থাকতুম। মাছের মতো। বই ছেড়ে আমার উঠতেই গা করত না। মংরা আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে নাওয়াত, খাওয়াত। আহা মংরার সে কী স্নেহ! কোনোদিন কি ভুলতে পারব তোমাকে। মংরা, আমি কি তোমার স্নেহের যোগ্য। কীই বা দিয়েছি তোমাকে। মাসে তিন টাকা করে মাইনে। আর দু’বেলা দু হাঁড়ি ভাত। মাঝে মাঝে হাঁড়িয়া।”
মীনাক্ষী হো-হো করে হেসে উঠল। বিমোহন তাকে বকুনি দিতে গিয়ে হি-হি করে হাসল। মাস্টারমশায় ক্ষুন্ন হয়ে বললেন, “ওটা কি হাসির কথা হলো? যার যা খাদ্য। ইংরেজ বীয়ার খায় শুনলে কেউ হো-হো করে? চল্লিশ বছর বয়স হলো, মীনাক্ষী। এখনো ম্যানার্স শিখলে না।”
তা শুনে মাস্টারমশায়ের ছোট ছেলে দুলাল হেসে উঠল। তার মা তাকে ও ঘর থেকে ভাগিয়ে দিলেন। তার বাপকে বললেন, “লক্ষ্মীটি, এইবার থামো।”
বিমোহন গাত্রোত্থান করছে দেখে মাস্টারমশায় তাকে আবার ইশারা করলেন গাত্রভার নামাতে। বললেন, “কত কাল পরে এসেছ। বোসা একটু।”
সে বলল, “আপনার কষ্ট হচ্ছে।”
“আরে, না, না, কষ্ট কিসের? এ যাত্রা স্বর্গারোহণ করছিনে, এটা নিশ্চিত। ওরা ভুল আশঙ্কা করেছিল। আমি ঠিক জানতুম যে, এখনো আমার যাবার সময় হয়নি। এ পৃথিবী তার আগে আমাকে তার পরম ঐশ্বর্য দেখাবে। আমি সেই ঐশ্বর্য-পারাবারের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে থাকব। কীট্সের সেই কবিতা মনে আছে?
Or like stout Cortez when
with eagle eyes
He stared at the Pacific
—and all his men
Looked at each other with
a wild surmise—
Silent, upon a peak in Darien.
মাস্টারমশায় শুধু যে আবৃত্তি করলেন তা নয়, অভিনয়ও করলেন। সেই নীরবতা, সেই নীরব চাউনি। তাঁর ইশারায় বিমোহনও মূকাভিনয় করল। যেন তিনিই করটেজ, আর সে ও মীনাক্ষী করটেজের সেনানী।
কিছুক্ষণ পরে তিনি পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন। “এ পৃথিবী একদিন আমাকে তার ঐশ্বর্য-পারাবারের মীন করবে। আমি তার আনন্দলীলার সাক্ষী হব। আনন্দ! আনন্দ! চারদিকে আনন্দ। আমি সেই আনন্দ-পারাবারের মীন। যেদিকেই সাঁতার কাটি সেদিকেই আনন্দ। আনন্দ ভিন্ন আর কিছু নেই। নিরানন্দ কোথায় তা দেখতে হলে আনন্দের বাইরে যেতে হয়। কিন্তু আনন্দের বাইরে কি যাওয়া যায়? না, একবার সেই অবস্থায় পৌঁছতে পারলে আর যাওয়া যায় না। আনন্দের ভিতরে আমি, আমার ভিতরে আনন্দ। বাইরে। বাইরে বলে কোনো কথাই নেই। ভিতরে। ভিতরে। সমস্তই ভিতরে। একবার সে অবস্থায় পৌছতে পারলে হয়, যখন পৃথিবী দেখবে তার পরম ঐশ্বর্য।”
খেই হারিয়ে গেছল। বিমোহন ধরিয়ে দিল। বলল, “তা হলে পরীক্ষা আর আপনি দিলেন না। অথচ আমরা জানি যে আপনি বি-এ পাস।”
“পরীক্ষা।” তিনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “পরীক্ষা একটা দিতে হয়েছিল বইকি। সেই ছোট শহরে একটি মিডল স্কুল ছিল। লাইব্রেরি ছিল না। মাস্টারমশায়রা আমার লাইব্রেরি থেকেই বইপত্র নিয়ে গিয়ে পড়তেন। সেই সূত্রে আলাপ। একদিন তাঁরাই প্রস্তাব করলেন আমি যেন ওখানে ইংরেজির ক্লাস নিই। মাস্টার বলে আমার নামও তাঁদের খাতায় উঠল। তাতে আমার সুবিধে হলো এই যে, আমি প্রাইভেট বি-এ পরীক্ষা দেবার অনুমতি পেলুম। পড়া তো আমার আগেই তৈরি ছিল। খাটতে হলো না, শুধু একবার চোখ বুলিয়ে যেতে হলো। তখনকার দিনে বছর বছর পাঠ্য বদলাত না। পাস করলুম। উইথ ডিস্টিংশন। তখনকার দিনে বি-এ পাসের একটা মহিমা ছিল। ডিস্টিংশন শুনলে লোকে সমীহ করত। না চাইতেই আমাকে হেডমাস্টার করা হলো। মিডল স্কুলের হেডমাস্টার বি-এ পাস, সেকালে ওটা ছিল একটা অপরূপ ব্যাপার। আসলে ওদের মতলব ছিল এক এক করে হাই স্কুলের ক্লাস খোলা। মর্যাদা বাড়িয়ে দেওয়া। হলোও তাই। কয়েক বছর পরে আমি হাই স্কুলের হেডমাস্টার।”
“তাতে আপনারও মর্যাদা বাড়ল।” বিমোহন মন্তব্য করল।
“আমি কি তার পিয়াসী ছিলুম হে?” তিনি বিনম্রভাবে বললেন, “ধনসম্পদ মানমর্যাদা সব একদিকে। অন্য দিকে আমার কাতর প্রার্থনা যে, আমি যেন ভুলির ভালোবাসার, মংরার ভালোবাসার যোগ্য হতে পারি। যেন ছেলেদের ভালোবাসার যোগ্য হতে পারি। সহকর্মীদের ভালোবাসার যোগ্য হতে পারি। যেন আকাশভরা সৌন্দর্যের, পাহাড়ঘেরা সৌন্দর্যের যোগ্য হতে পারি। আমার সেই চালাঘরটিকেও নমস্কার করে বলতুম, বাসা, তুমি তো খাসা, আমি যেন তোমার যোগ্য হতে পারি। এক টুকরো জমিতে আমার বাগান। বাগানকে নমস্কার করে বলতুম, বাগান, তুমি আমার নন্দনবন, আমি যেন তোমার যোগ্য হতে পারি। সত্যি বলছি, বিমোহন, সেই ঘুষঘুষে জ্বর থেকে মুক্ত হয়ে অবধি আমি সর্বদা সকলের কাছে হাত জোড় করেই রয়েছি। তোমরা, আমার ছাত্ররা, কি জানতে যে আমি তোমাদেরও মনে মনে নমস্কার করেছি? তোমরা নমস্কার করার পর যে প্রতিনমস্কার সেটা বাহ্য। তার আগেই তোমাদের আন্তরিক নমস্কার করতুম।”
বিমোহনের চোখ জলে ভরে গেল। সে বলল, “কিন্তু আপনি তো খুব কড়া শাসক ছিলেন। আমারি তো কানে টান দিয়ে মাথাটাকে ঘোরাতেন। বেড়াল যেমন করে ইঁদুরকে খেলায় আপনার হাতও তেমনি করে আমার মাথাটাকে খেলাত।”
মীনাক্ষী খিলখিল করে হাসল। “স্বামী হিসেবেও কম কড়া নাকি?”
মাস্টারমশায় হেসে বললেন, “স্বামী হলো স্ত্রীর মাস্টার। মাস্টারদের দরকার হলে একটু কড়া হতে হয় বইকি। তোমার মাস্টারের মতো অত ভালোমানুষ হওয়া কি ভালো?”
বিমোহন বলল, “সার, আমরা জানতুম যে, আপনি আমাদের ভালোবাসতেন। তাই আপনার শাসনও আমাদের ভালো লাগত। কানমলার জন্যে কান নিশপিশ করত।”
“ওমা। তাই নাকি!” মীনাক্ষীর চোখে কৌতুক।
“তখনকার দিনে, বিমোহন বলল, “আমরা বড়াই করতুম এই বলে যে, সার স্বয়ং আমাদের কান মলে দিয়েছেন।”
“ওটাও একরকম ডিস্টিংশন।” পরিহাস করল মীনাক্ষী।
মাস্টারমশায় অন্যমনস্ক ছিলেন। বললেন, “তোমাদের স্কুলে যখন হেডমাস্টার করে আমাকে নিয়ে যায় তখন আমার যেতে ইচ্ছে ছিল না। লোকে বলবে, টাকার জন্য আমি আমার নিজের হাতে গড়া স্কুল ছেড়ে গেলুম। ছাত্রদের পক্ষে কত বড় খারাপ আদর্শ। তা ছাড়া, ছাত্ররাও তো বলতে পারে, সার, কেন আপনি আমাদের ছেড়ে যাচ্ছেন? টাকার জন্যে কি কেউ সন্তানকে ছাড়ে? কী যে অশান্তি বোধ করেছি! আসলে হয়েছিল এই। বাড়ি থেকে বার বার বিয়ের জন্যে তাগাদা আসছিল। শরীর যখন নীরোগ তখন বাধা কিসের? আমিও ভেবে দেখেছিলুম যে, ভুলিকে সঙ্গিনী করে সারা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায় না। আর মংরার হাতের রান্নাও সারা জীবনের পথ্য নয়। শরীরের মত চাইলুম। সে বলল, নারীর নিপুণ পরিচর্যা না হলে আমি যে-কোনো দিন বিদ্রোহ করতে পারি। ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলুম। তিনি বললেন, বিয়ে করার চেয়ে না করাই বেশি রিস্কি। দেশে গিয়ে বিয়ে করলুম। তারপর আবিষ্কার করলুম যে, ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়, ভালো বাসা চাই। ভালো মাইনে চাই। স্কুল কর্তৃপক্ষ বুঝলেন আমার অবস্থা। কিন্তু আমাকে এসব দিতে গেলে ঘাটতি পড়ে। সহকর্মীদের দাবি পূরণ করতে হয়। আমি এতদিন একটা সুদৃষ্টান্ত ছিলুম। হয়ে দাঁড়াই কুদৃষ্টান্ত। তাঁরাই আমার জন্যে অন্যত্র চেষ্টা করেন।”
“আমরা কিন্তু ছেলেবেলা থেকে আপনাকে আমাদের স্কুলেই দেখে এসেছি। স্কুল আর আপনি অভিন্ন।” বিমোহন আত্মীয়ের মতো বলল।
“তা যদি বল তোমাদের স্কুল থেকেও চলে যাবার কথা উঠেছিল। আরো ভালো অফার এসেছিল। আরো ভালো ব্যবহার পেতুম। যাইনি কেন, জানো? মনে মনে সংকল্প করেছিলুম, সাংসারিক প্রয়োজনকে অযথা বাড়তে দেব না। ডালভাত খেয়ে যদি চলে যায় মাছভাত খাব না। চাদর গায়ে দিয়ে যদি চলে যায় জামা গায়ে দেব না। চটি পায়ে দিয়ে যদি চলে যায় জুতো পায়ে দেব না। তোমাদের কতবার বলেছি, ধুতির কোঁচা গায়ে জড়িয়ে ক্লাসে আসতে। তাতে চাদরের খরচ বাঁচে। খালি পায়ে আসতেও বলতুম। তাতে চটির খরচ বাঁচে। প্রলোভন দমন করতে না শিখলে মানুষ হওয়া যায় না বিমোহন। তোমাদের শেখাব কী করে, যদি নিজে না শিখি? তবে তোমাদের স্কুল কর্তৃপক্ষের ব্যবহারে মাঝে মাঝে জ্বালাতন হয়েছি। ইস্তফা দিতে গেছি। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়েছে তোমাদের মুখ। শাশুড়ির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হলেও বউ কি তার বাছাদের ছেড়ে যায়? সহ্য করতে হয়। তবে হাঁ, অন্যায় আদেশ বা হস্তক্ষেপ হলে অন্য কথা। সেক্ষেত্রে প্রতিরোধ করা কর্তব্য। তাও করেছি।”
গুরুপত্নী এবার আদরের ধমক দিয়ে বললেন, “থামো। ঢের হয়েছে।”
বিমোহন বলল, “আজ তা হলে আসি, মাস্টারমশায়। আরেক দিন দেখা করব।”
তিনি তাকে আবার কাছে বসিয়ে প্রগাঢ় স্নেহে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। দিতে দিতে কানে হাত দিলেন। মাথাটাকে দোলালেন। সে ধন্য হয়ে গেল।
তারপর বললেন, “বিমোহন, এই সংসারসমুদ্রে অমৃতও আছে, গরলও আছে। আমি অমৃত পান করেছি। গরলও কি পান করিনি? তবে সে গরলও আমার কপালগুণে অমৃত হয়ে গেছে। পান করে অমৃতফল পেয়েছি।”
বিমোহন বিস্মিত হয়ে শুধাল, “তা কী করে হবে, সার?”
“সেইটেই তো আর্ট। তুমি আর্টিস্ট, আলোছায়ার কারবারী। তুমি কি জানো না কেমন করে রূপান্তর ঘটাতে হয়? বিমোহন, আমি অনেক দুঃখ পেয়েছি। অনেক শোক। দেশের ও দশের ভালো করতে গিয়ে অনেক মনোভঙ্গ। কদর্যতার সঙ্গে লড়তে গিয়ে অনেক জ্বালা। জীবনের কয়েকটা মূল নীতি রক্ষা করতে গিয়ে অনেক লাঞ্ছনা। কিন্তু সেসব আমার রসের রসায়নে রূপান্তরিত হয়ে অমৃত হয়ে গেছে। আমার ভিতরে যেন এক পরশমণি আছে। লোহাকেও সে সোনা করে দেয়। তোমার ভিতরেও আছে। মীনাক্ষীর ভিতরেও আছে। সকলের ভিতরেই আছে।”
মীনাক্ষী প্রতিবাদ করে বলল, “আমার ভিতরে নেই।”
তার জামাইবাবু বললেন, “আছে, তবে জান্তি পারো না।”
হাসাহাসি পড়ে গেল। মাস্টারমশায় বিমোহনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখের তারা শুকতারার মতো উজ্জ্বল থেকে ক্রমে আরো উজ্জ্বল। বিমোহনের মনে হতে থাকল তিনি তার কাছে শুয়ে থাকলেও তাঁর আত্মা কোন সুদূর আকাশে। তাঁর চোখের সঙ্গে তার চোখের দূরত্ব কোটি কোটি আলোকবর্ষ।
সে বলতে চাইল, “মাস্টারমশায়, আমাদের বহু ভাগ্য যে, আপনি আমাদের মধ্যে রয়েছেন।” কিন্তু সত্যি কি তাই? তিনি বেঁচে আছেন বলেই কি মধ্যে রয়েছেন? তিনি অনেক যোজন দূরে চলে গেছেন। কোটি কোটি যোজন।
মাস্টারমশায় যেন ধ্যানস্থ হয়ে বললেন, “আমরা অমৃতের পুত্র। গরলকেও আমরা অমৃতে পরিণত করতে পারি। এর কিমিয়াবিদ্যা এমন কিছু দুরূহ নয়। চেষ্টা কর, তুমিও পারবে। হৃদয়কে খোলা রেখে দাও। শত্রুকেও সেখানে প্রবেশ করতে দাও । জ্ঞানের জন্য যেমন মন খোলা রাখতে হয়, তা সে যতই অপ্রীতিকর হোক না কেন, অমৃতের জন্যে তেমনি হৃদয়। বিষ হয়ে ঢুকবে, অমৃত হয়ে বেরোবে।”
বিমোহন বিমুগ্ধ হয়ে শুনছিল। তার উঠতে পা সরছিল না। ওদিকে মাস্টার-মাসিমা অস্থির বোধ করছিলেন। বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। প্রাক্তন ছাত্র তো একটি দুটি নয়, এই কলকাতা শহরেই এক শ’টি । সবাইকে এত সময় দিলেই হয়েছে ।
“আশীর্বাদ করুন,” বলে বিমোহন তাঁর পায়ে হাত দিল।
“শত শত বার।” তিনি আশীবাদ করলেন। তারপর বললেন, “এসো মাঝে মাঝে। আমাদের ফিরতে দেরি আছে।”
“আসব নিশ্চয়।” এই বলে বিমোহন কোনো মতে পা দুটোকে টেনে বার করে আনল। পিছন ফিরে তাকাল। মাস্টারমশায় তখনো তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে। কে জানে, কোন আসমানের দুটি তারা সুধাবর্ষণ করছে।
মাস্টার-মাসিমাকেও প্রণাম করল বিমোহন। মীনাক্ষীর কাছে বিদায় নিতেই সে বলল, “আবার আসছেন কবে শুনি?”
“যেদিন বলবেন।” বিমোহন বলল, “বাড়ির মালিক যখন আপনি।”
“থাক, আরেকদিন এর উত্তর দেব।” সে দ্ব্যর্থবাচকভাবে বলল।
“আমিও মীন পিয়াসী।” দ্ব্যর্থবাচকভাবে বলল বিমোহন। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।
মীনাক্ষীর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। মাস্টামশায়ের সঙ্গে হলো পাঁচ বছর পরে দেওঘরে। সেখানে তিনি একটা নতুন ধরনের আশ্রম স্থাপন করে সপরিবারে বাস করছিলেন। জনা দশ-বারো ছাত্রছাত্রী থাকে। পড়ে শহরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে, যার যেখানে রুচি। ফিরে আসে সন্ধ্যার আগে। বেরিয়ে যায় বেলা ন’টার পরে।
“এ কী আমার কাজ!” মাস্টারমশায় এমন স্বরে বললেন যেন ক্ষমাভিক্ষা করছেন। “করতে হচ্ছে মহাত্মাজীর আত্মার তৃপ্তির জন্যে। তাঁকে যারা সরিয়ে দিয়েছে তারা যদি মনে করে থাকে যে, তাঁর কাজ বন্ধ হয়ে যাবে তবে তারা ভুল করছে।” এবার তাঁর কণ্ঠে রৌদ্ররস এলো। তিনি বজ্ৰাদপি কঠোর।
বিমোহন স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। মাস্টার কি শেষকালে পলিটিসিয়ান হলেন!
“আশ্রমে পড়াশুনা হয়তো হবে। হয়তো হবে না। পুজোপার্বণ হয়তো হবে। হয়তো হবে না। জপতপ হয়তো হবে। হয়তো হবে না। সুতো কাটা হয়তো হবে। হয়তো হবে না। কিন্তু একটি ক্ষেত্র আছে, সেখানে আর ‘হয়তো’ নয়। সেখানে ‘অবশ্য’। আশ্রমে মানুষ মানুষকে হিংসা করবে না, মানুষ পশুকে হিংসা করবে না, পশু পশুকে হিংসা করবে না। দৃষ্টান্ত দেখানোর ভার মানুষের উপরে। মানুষকে দৃষ্টান্ত দেখানোর দায়িত্ব ঋষির উপরে। আমি তো ঋষি নই, তবে কেন আমার এ দায় গায়ে পেতে নেওয়া? অনেক চিন্তা করেছি, বিমোহন। অনেক ইতস্তত করেছি। এড়াতে পারিনি। আমার তো কোনো উচ্চাভিলাষ নেই। তা হলে ভয় কাকে? উচ্চাভিলাষই একমাত্র শত্রু।”
বিমোহন বিমোহিত হলো না। তার স্বভাবটা ছিদ্রান্বেষীর। জানতে চাইল আশ্রমে হাড়ি ডোমদেরও ঠাঁই আছে কি না। উত্তর পেলো, “আছে। আছে। তবে এই মুহূর্তে নয়। আর কিছুদিন পরে।” জানতে চাইল ক্রিশ্চান মুসলমানদেরও জায়গা হবে কি না। উত্তর পেলল, “হবে। হবে। তবে আজ এখনি নয়। আরো কিছুদিন পরে।”
তখন বিমোহন বলল, “মাস্টারমশায়, মানুষে মানুষে ঘৃণা যদি থাকে তবে এই মুহূর্তেই তাকে দূর করা দরকার। দিনকের দিন আরো দেরি হয়ে যাবে। ঘৃণারই প্রত্যক্ষ রূপ হিংসা। আর হিংসারই অপ্রত্যক্ষ রূপ ঘৃণা। ভারতবর্ষের মতো এত ঘৃণা আর কোন দেশে আছে? তাই তো আশঙ্কা হয়, হিংসাকে অহিংসা দিয়ে থামানো যাবে না।”
মাস্টারমশায় মর্মাহত হলেন। বললেন, “তা হলে তুমিই আশ্রমের দায়িত্ব নাও।”
বিমোহন হাত জোড় করে বলল, “আপনি প্রণম্য। কিন্তু আপনার এই আদেশটি আমি পালন করতে অক্ষম। আমি আর্টিস্ট। আর আপনিও অধ্যয়ন অধ্যাপনা নিয়ে থাকলেই পারতেন। আমার স্টুডিওতে, আপনার স্কুলে হাড়ি ডোম মুসলমান ক্রিশ্চান সকলের স্থান আজ এখনি আছে। মাস্টারমশায়, বিষয়টা যদি জরুরি হয়ে থাকে তবে আশ্রম জরুরি নয়, স্কুলই জরুরি। স্টুডিওই জরুরি। আমি যে কাজ নিয়ে আছি তা সাংঘাতিক জরুরি কাজ। আমি আর কিছু পারি না পারি সৌন্দর্যের ভোজে সব মানুষকে এক পঙ্ক্তিতে বসিয়ে দিয়েছি। আমার প্রদর্শনীতে কেউ অন্ত্যজ নয়, কেউ বিধর্মী নয়, কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ নয়। আঁকি যখন তখন কাউকে বাদ দিইনে। কারো উপর পক্ষপাত দেখাইনে।”
তিনি বার বার মাথা নাড়লেন। অনেকক্ষণ নীরব থেকে তারপর আবেগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “ঈশ্বর জানেন আমার অন্তরে ভেদবুদ্ধি নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি এ দায় বহন করতে পারব না। তা হলে আশ্রম তুলে দিই। কী বল?”
“মাস্টারমশায়, আমি বলবার কে!” বিমোহন বিমূঢ় হলো।
“আমার মনে হচ্ছে তোমার আজ এখানে আসাটা তোমার ইচ্ছায় নয়, আমার ইচ্ছায় নয়। তাঁরই ইচ্ছায়। তুমি আমার চোখ ফুটিয়ে দিতে এসেছ। কিন্তু, বাবা, স্কুল নিয়ে থাকা আর আমার দ্বারা হবার নয়। বয়স হয়ে গেছে। অবসর নিতে বাধ্য না করলে হয়তো আরো কয়েক বছর হেডমাস্টারি করতুম। কিন্তু একদিন না একদিন ছেড়ে দিতে হতোই। ততঃ কিম্? আশ্রম হলো সেই ততঃ কিমের উত্তর। তা তোমার কথা শুনে বুঝতে পারছি, উত্তরটা দেশের স্বার্থে নয়, আমারই স্বার্থে। আমারই একটা অকুপেশন আর কী! তুমি আমাকে ভাবিয়ে দিলে, বিমোহন। তুমি এখন পূর্ণবয়স্ক আর আমি তো দ্বিতীয় শৈশবের সন্নিকটবর্তী। গুরু হবার কথা তোমারই। শিষ্য হবার কথা আমারই! না, না। অভিমান করে বলছিনে। নির্জলা সত্য। আমি আর মাস্টারি করব না, বিমোহন। আমি ছাত্র হব। শিখব। ভয়ানক ইচ্ছা করে আর্টের ছাত্র হতে।”
“সার, আমাকে লজ্জা দেবেন না,” বলে বিমোহন আবার হাতজোড় করল।
মাস্টারমশায়ের চুল একটিও পাকেনি। দাঁত একটিও পড়েনি। শিরদাঁড়া তেমনি খাড়া। চোখের তারা তেমনি উজ্জ্বল। বার্ধক্যের লক্ষণ কোথায়! তবু বোঝা যায় যে, বয়স হয়েছে। বললেন, “দেখ, বিমোহন, প্রকৃতির সঙ্গে চালাকি খাটে না। বয়স হয়েছে এটা গোড়ায় মেনে নিয়ে তার পরে প্রকৃতির সঙ্গে কথা কইতে হয়। বলতে হয়, প্রকৃতিঠাকরুন, তোমারও তো বয়স হয়েছে। কেমন করে তুমি এমন কর্মিষ্ঠা হলে? জানতে পাই তোমার রহস্য? রহস্য আর কিছু নয়, ছন্দ। যে বয়সের যে ছন্দ। এ বয়সেরও একটা ছন্দ আছে। সেটা আবিষ্কার করতে পারলে বয়সের দ্বারা পরাস্ত হতে হয় না। আমাকে সেটা আবিষ্কার করতে হবে। তা হলে আর দ্বিতীয় শৈশবে ফিরে যাব না। আরো পূর্ণবয়স্ক হব। ব্রাউনিং মনে আছে?”
শীতকালের বিকেল। পড়ন্ত রোদ। গাছতলায় বসে গুরুশিষ্যসংবাদ ; মাস্টারমশায় উদ্দীপ্তকণ্ঠে আবৃত্তি করতে আরম্ভ করলেন।
Grow old along with me!!
The best is yet to be,
The last of life, for which the
first was made:
Our times are in His hand
Who saith ‘A whole I planned,
Youth shows but half; trust,
God; see all, nor be afraid!’
অস্তরাগের ছটায় মাস্টারমশায়ের মুখ অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছিল। তিনি যেন অন্য কোনো জগতের অধিবাসী। তাঁর চোখে অপার্থিব আভা। আবৃত্তি সারা হলে কিছুকাল মৌন থেকে বললেন, “ওহে বিমোহন, আমাকে সমস্তটাই দেখে যেতে হবে।”
বিমোহনের মনে পড়ল, সে বলল, “সার, সেই যে সেবার বলেছিলেন, পৃথিবী আপনাকে তার পরম ঐশ্বর্য দেখাবে। আপনি হবেন আনন্দ-পারাবারের মীন।”
তিনি তদগত হয়ে স্মরণ করলেন। “হাঁ, পৃথিবীর সঙ্গে আমার সেই রকমই কথা আছে।”
“সে কি কথা রেখেছে?”
“আশায় আশায় আছি। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।”
“একটুখানি আভাস কি তার পেয়েছেন, সার? পরম ঐশ্বর্যের?”
“তা কি আর পাইনি। এই তো সেদিন দেখা গেল, পিস্তলের গুলি বুকে বিঁধছে, সাধুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি বলছেন, হে রাম! হে রাম! অন্তরে অসীম প্রেম, নয়নে অশেষ ক্ষমা। পৃথিবীকে বলি, পৃথিবী, এর পরেও কি তুমি বেঁচে থাকতে বল? দেখাতে পারবে আরো মহান দৃশ্য? পৃথিবী উত্তর দেয়, বেঁচে থাকলে দেখবে। তাই তো বেঁচে আছি। নইলে বাঁচতে কে চায়, বল? আমার জীবনটাই যে ব্যর্থ।”
বিমোহন স্তম্ভিত হলো। “সে কী, মাস্টারমশায়!”
“বিমোহন, দুঃখে শোকে আমার ভিতরটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। সেই শতছিদ্র গাগরী দিয়ে আমি শ্রীরাধার মতো যমুনার জল ভরেছি। আনন্দ? হাঁ, আনন্দ এরই নাম। আনন্দ পেয়েছি। তবু যখন পিছন ফিরে তাকাই তখন দেখি জীবনটা নিয়ে কত কী করতে পারা যেত, কী এমন করা গেল! বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্যে চিরকালের মতো স্বাস্থ্যভঙ্গ হলো। কিন্তু হলো কি তা রদ? চল্লিশ বছর পরে আবার যে-কে-সেই। বরং আরো খারাপ। বঙ্গভঙ্গের উপর ভারতভঙ্গ। কই, রদ করার জন্যে কেউ আমাদের যুগের মতো ত্যাগব্রত নিয়েছে? তপস্যা করেছে? কোথাও সত্যিকার বেদনা দেখছ? তা হলে কেন আমরা জীবন ক্ষয় করলুম? কার জন্যে করলুম? যা অনিবার্য তাই যদি হবে তবে নিবারণের জন্যে কেন এই জীবনপাত?”
বিমোন সান্ত্বনা দিতে যাচ্ছিল, তিনি তাকে নিরস্ত করে বললেন, “জানি, তার ফলে স্বাধীনতা সুগম হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার স্বরূপ তো দেখছ। প্রত্যেকটি স্কুলে বাবুয়ানার বান ডেকে চলেছে। আমরা তা হলে আধপেটা খেয়ে খালি গায়ে থেকে খালি পায়ে হেঁটে কার কী মঙ্গল করলুম? নিজেদের কিছু খরচ বাঁচে এই কি ছিল আমাদের ফন্দি? তা হলে আজ আমার চালচুলো নেই কেন? একটা আদর্শের জন্যে বিত্ত উৎসর্গ করে কী ফল হয়েছে শুনবে? মেয়ে বলছে, আমার ভালো বিয়ে হতে পারত, বাবার টাকা ছিল না, টাকার জন্যে চেষ্টা ছিল না, তাই হলো না। ছেলে বলছে, আমার ভালো চাকরি হতে পারত, বাবার টাকা ছিল না, টাকার জন্যে চেষ্টা ছিল না, তাই হলো না। ওরা এখন কোমর বেঁধে উঠে-পড়ে লেগেছে, টাকা করবে, ওদের ছেলেদের যাতে ভালো চাকরি হয়, মেয়েদের ভালো বিয়ে হয়। আমার আশ্রমে আমার নিজেরই নাতিনাতনী নেই। লজ্জায় লোকের কাছে মাথা হেঁট হয়ে যায়।”
মাস্টারমশায় বিমোহনের ওজর আপত্তি কানে তুললেন না। বললেন, “না, বিমোহন, আমি আত্মপ্রতারণা করব না। আমার যুগ গেছে, আমি পিছনে পড়ে আছি। আমিও একদিন যাব। তবে যাবার আগে দেখে যাব পৃথিবী আমাকে কী দেখাতে চায়। দেখে আনন্দের সঙ্গে চলে যাব। আনন্দের সাগরে।”
“তখন,” বিমোহন আশা করল, “আপনার পিপাসা মিটবে।”
তিনি তার কান ধরে ঝাঁকানি দিয়ে বললেন, “পিপাসা আমার তখনো মিটবে না, বিমোহন। কখনো মিটবে না। এ-পারেও না। ও-পারেও না। আমি আনন্দলহরীতে ভাসব আর ডুবব আর সাঁতরাব আর খেলব। কিন্তু বার বার পান করেও জলপিপাসা আমার মেটবার নয়। আমি যে পানীমে মীন পিয়াসী।”
ওদিকে মাসিমার কাছে খবর পৌঁছেছিল যে, বিমোহন এসেছে। জলখাবারের ডাক এলো। সে যদিও মীন নয়, তবু পানীয় পিয়াসী।
“বিমোহন,” মাস্টারমশায় তার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, “তোমাকে একটা গুহ্য কথা বলি। ব্রহ্মস্বাদ যতবার পাই ততবার পেতে সাধ যায়। ব্রহ্মবিহারে তৃপ্তি নেই। মরণ এর কাছে কিছু নয়। ও আমি একলাফে পেরিয়ে যাব।”
১৩৬৬ (১৯৫৯)