1 of 2

গাঢ় নিরুদ্দেশে – দিব্যেন্দু পালিত

গাঢ় নিরুদ্দেশে – দিব্যেন্দু পালিত

ট্রেন ছাড়বে সেই সাড়ে-ন’টায় তবু সাতটা, সাড়ে-সাতটা থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল নীপা। ইতিমধ্যে একবার তাড়া দিয়েছিল দেবাশিসকে। মেরুনে কালোয় কিছু রহস্যময় সিল্কের শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে লিভিং রুমে এসে দেখল ভঙ্গিতে তখনো কোনো নড়াচড়া নেই দেবাশিসের। চা খেতে খেতেই টেনে নিয়েছিল কী একটা ম্যাগাজিন, চোখ এখনো সেখানেই। মনে হয় তন্ময়, সামান্য চিন্তিতও। দু’ আঙুলের ভাঁজে পুড়তে থাকা সিগারেটের ছাইয়ের বহরই এরকম ভাবায়। বিরক্তও কি?

দু’এক মুহূর্ত স্বামীকে লক্ষ করে নীপা বলল, ‘তুমি তৈরি হবে না?’

‘এত তাড়া কেন!’ অসাবধানে সিগারেটের ছাইটা ট্রাউজার্সের ওপরেই পড়ল। চোখ তুলে দেবাশিস বলল, ‘যাবে তো ফাস্ট ক্লাসে, রিজারভেশনও আছে। সাড়ে-আটটায় বেরুলেই চলবে।’

‘সাড়ে-আটটায়! তারপর জ্যামে পড়লে!’

‘ছ’টায় বেরুলেও জ্যামে পড়তে পারো।’ দেবাশিস একটু থামল এবং বলল, ‘আজকাল হাওড়া স্টেশনে যেতে অত সময় লাগে না।’

ব্রা-র হুকটা ঠিকঠাক লাগেনি। অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করায় পিছনে হাত বাড়িয়ে ব্লাউজ টানল নীপা। কথাগুলো সাবলীলভাবে বললেও গাম্ভীর্য টাল খায়নি দেবাশিসের। ইদানীং এরকমই দেখছে ওকে; সাঁইত্রিশ-আটত্রিশেই পঞ্চাশের মতো। এবারের যাওয়াটা ঠিকঠাক হবার পর থেকেই যেন ফ্লেকসিবিলিটি কমে গেছে ঘাড়ের। এর পরে বেশি কিছু বললে কথা-কাটাকাটিতে পৌঁছতে পারে।

মনঃস্থির করতে সময় নিল নীপা। তারপর বলল, ‘যেতে ভালো না লাগলে বলো। রমেনকে ফোন করে বলে দিই আমাকে তুলে নিয়ে যেতে। ও তো এই রাস্তা দিয়েই যাবে—

নীপার কথায় কিছু ছিল হয়তো, অস্পষ্ট হাসল দেবাশিস। সিগারেটে টান দিয়ে বলল, ‘ট্যাক্সিতে উঠে একাও যেতে পারো। স্বাধীন জেনানা, আর কাউকে দরকার হবে কেন!’ স্ত্রীকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলল, ‘রাতের ট্রেনেও কি এত সেজে যেতে হয় নাকি! দামি শাড়িটা নষ্ট হতে পারে—’

আট বছর আছে একসঙ্গে। দেবাশিস তাকে যতটা চেনে নীপাও তার চেয়ে কিছু কম চেনে না ওকে। জানে কোনটা ওর বলার কথা, কোনটা শুধুই লেজুড়। এখনো বুঝল শাড়ির প্রসঙ্গটা কাজের নয়, আসলে সাজটাই ঢুকেছে মাথায়। এর আগের কথাগুলো বলেছিল রমেনকে উহ্য রেখে। রমেন তার পাখোয়াজী; তানপুরা, পাখোয়াজ নিয়ে সঙ্গেই যাচ্ছে। গানে-বাজনায় এক ধরনের পরস্পর-নির্ভরতা আছে অবশ্য, তার বেশি নয়। দেবাশিস হয়তো অন্যরকম ভাবে।

নিজেকে আড়াল করতে করতে নীপা বলল, ‘সারাক্ষণ শুধু সাজতেই দেখছ আমাকে!’

বলেই নিজেকে মেয়ে বলে চিনতে পারল নীপা। রবীন্দ্রনাথের কিছু গান যেমন তার ভীষণ প্রিয়, প্রসঙ্গ থাক না থাক খেয়াল-খুশিতে ইচ্ছে করে গাইতে, প্রায় অভ্যাসে, তেমনি, সাজগোজ নিয়ে কেউ টুকলেই এই কথাগুলিই অবিকল বেরিয়ে আসে মুখ দিয়ে। অবশ্য, তখনই তার মনে হলো, দেবাশিসের কথাগুলো শুধুই ঠেস দেবার জন্যে নাও হতে পারে। শাড়িটা নিশ্চয়ই দামি, রাতটা কাটাতে হবে ট্রেনে, এই শাড়ি পরেই শোয়াবসা সবকিছু—সকালে আর শ্রী বলে থাকবে না কিছু। সাধারণ নীল-সাদাটা সকাল থেকে মনে মনে বেছে রাখলেও এই যে একটু আগেই মত বদলালো, আর বেছে নিল এই শর্ট কালারের শাড়িটা, তার পিছনে নিজেকে যা স্বাভাবিক তার চেয়ে আরও একটু ভালো করে সাজিয়ে তোলার ইচ্ছেও কাজ করেনি কি?

নীপা আয়নার সামনে এলো। সে সুন্দরী নয়, তার গায়ের রঙও শ্যাম-ঘেঁষা। তা হলেও, আকর্ষণ বিচারে এর পরের মাপকাঠিগুলো তার পক্ষেই সায় দেয়। পরিচয় লুকোলে এই টান-টান চেহারা আর মাপা স্বাস্থ্যের দিকে তাকিয়ে কেউ কি বলবে বয়সটা তার তিরিশই! আট বছর আগে যখন গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় শুরু করেছিল, তখন কাগজে কি ফলাও করে লেখেনি তাকিয়ে দেখার মতো সপ্রতিভ এই নবাগতা গায়িকা-অভিনেত্রী মঞ্চে থাকবার জন্যেই এসেছেন! এই যে সপ্রতিভতা—নাকি আরও কিছু, এর চেয়ে বেশি আর কি দিতে পারে সৌন্দর্য! তখনো ভাবেনি, পাড়ার অভিনয় থেকে তুলে যে-দেবাশিস তাকে মঞ্চে এনেছিল, বিয়ের ফাঁসে টেনে সে-ই আবার মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেবে তাকে। ঈর্ষা? নাকি অন্য কোনো জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছিল দেবাশিস? এক জট খুলতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েছিল নতুন জটে, যাতে, তারই প্ররোচনায় একেবারে অন্যরকম গান গাইতে গাইতে ক্রমশ আবার মঞ্চে এসে দাঁড়াবে নীপা? গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে, ⋯জীবন তোমার সুরের ধারায় সেথায় পড়ক লুটে! তখন, সত্যি, গলায় উঠে আসা নিঃশব্দ গুঞ্জন থামিয়ে নীপা ভাবল, কে জানত সম্পর্কের ভিতরেও ক্রমশ ঢুকে পড়বে আর একরকম সম্পর্ক, টানাপোড়েন—গ্রুপ থিয়েটারের একদা দাপুটে অভিনেতা দেবাশিস মিত্র এখন স্টেজে দাঁড়িয়ে কী করছে না করছে তা নিয়ে কোনো কৌতূহল থাকবে না তার, আর দেবাশিসও কোনো-কোনো অসতর্ক মুহূর্তে বলে ফেলবে, প্রেম পূজা প্রকৃতির দাড়িনাড়া চাতুরিতে ন্যাকামি যতটা আছে তার সিকি ভাগ আর্ট থাকলেও বাঙালি মেরুদণ্ড কাকে বলে চিনত! অবশ্য তারা স্বামী-স্ত্রী।

যেন সেটা বুঝবার জন্যেই ক্লিপের আগায় বাঁ দিক ঘেঁষা সিঁথিতে সরু সিঁদুররেখা টানল নীপা। সংস্কার? হয়তো। এবং গুনগুনিয়ে উঠল। শাড়ির মেরুনের সঙ্গে ম্যাচিং খয়েরি টিপটা জায়গায় বসাতে বসাতে দেখল, চওড়া কাঁধে স্যাণ্ডো গেঞ্জির ওপর পাটভাঙা গেরুয়া পাঞ্জাবি চড়াচ্ছে দেবাশিস। পুরুষালি পুরুষ; প্রথম অঙ্ক দ্বিতীয় দৃশ্যে মঞ্চে ঢুকছে গলার গমক জানিয়ে। নীপা তাকিয়ে। আজকাল ও পাজামার পরিবর্তে ট্রাউজার্স পরে।

‘কী গান বলতে পারো?’

‘এ পরীক্ষাটা যে-কেউই দিতে পারে।’ নিচু মুখে পাঞ্জাবির ঝুল ধরে টানতে টানতে দেবাশিস বলল ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে—। মনোনীতা হবার অপেক্ষায় বিয়ের কনে, পাড়ার লাগাতার সাইকেল চালানোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, এমনকি হঠাৎ খদ্দের ধরে ফেলা ময়দানে দাঁড়ানো বেশ্যাও—

আত্মবিশ্বাস মেশানো হতাশার ধরন; নীপা এইভাবেই বুঝে নিল। জয়টা তারই, না হলে আটটা বাজতে না বাজতে নিজেকে তৈরি করে নিত না দেবাশিস। সব ঠিকঠাক চললে সামনের তিনটি রাত দুটো দিন দেখা হবে না তাদের। কাল, এই সময়, এলাহাবাদে, সামনে মাইক নিয়ে, তানপুরা আর পাখোয়াজের সঙ্গতের মধ্যে, সম্ভবত সে মঞ্চে থাকবে। ঘটনাটা মনে থাকল, অন্তত এই গানটা সে গাইবে না।

‘তবু একবারও বললে না নীপা নামের কেউ একদিন গেয়েছিল গানটা, আর জলের দিকে তাকিয়ে তুমি ভাবছিলে কখন গান শেষ হবে, কখন জাপটে ধরবে আমাকে—’

পিছন থেকে হঠাৎই এগিয়ে এসে দু’হাতের বেড়ে দেবাশিসকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় নীপা। বলল, ‘বলো, ঠিক বলেছি কি না!’

‘এত খুশি যে!’

আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল দেবাশিস। দৃষ্টি নীপারই ওপরে।

নীপা বলল, ‘সত্যি খুশি দেখছ?’

‘অভিনয়ও হতে পারে।’

‘না, তা নয়।’ বাইশ থেকে তিরিশে পৌঁছে গেল নীপা, দ্রুত। বলল, ‘জানো কার সঙ্গে একই স্টেজে গান গাইব কাল?’

‘তন্ময় চৌধুরী, রবীন্দ্রসঙ্গীতে যে শ্যামাসঙ্গীতের আমদানি করেছে—’

‘যাঃ! এভাবে বোলো না।’ নীপা এখন শান্ত। আবার আয়নার দিকে মুখ করে ঘাড় বেঁকিয়ে আঁচল ঠিক করল। তারপর বলল, ‘তন্ময়দা যাচ্ছে নতুন বিয়ে করা বউকে নিয়ে হনিমুন করতে—’

নীপা সরে যেতে এগিয়ে গিয়ে চিরুনিটা তুলে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত হলো দেবাশিস। উৎসাহ দেখালো না।

‘অপরেশবাবু।’ গভীর গলায় নীপা বলল, ‘বন্দ্যোপাধ্যায়?’

‘অপরেশ ব্যানার্জি! এইসব ফালতু ফাংশনেও উনি যান নাকি!’

‘যাবেন না শুনেছিলাম। আজ টিকিট দিতে এসে ওরা বলল যেতে রাজি হয়েছেন। ওঁর কোন আত্মীয়ের চিঠি নিয়ে দেখা করেছিল, সেইজন্যেই হয়তো—’

‘তার মানে হলে লোক না জোটা পর্যন্ত তোমাদের গাইতে হবে। তারপর উনি, উনিই সব। এসব ফাংশনে তোমার যাওয়া উচিত নয়। অবশ্য—‘আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে দেবাশিস বলল, ‘আমি এসব বলবার কে!’

দু’পায়ে ঠিকঠাক দাঁড়িয়েছে মনে হলেও মাঝে মাঝে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে দেবাশিস। অপরেশের নাম নীপা এর আগে বলেনি। হয়তো সেইজন্যেই। একটু পরেই বেরুতে হবে তাদের, এটা ঝগড়া করার সময় নয়। কিন্তু, লুকিয়ে খোঁচা দেবার জন্যে সময় অসময় বুঝবার দরকার হয় না।

নীপা পাল্টা দেবার কথা ভাবল না। হাতে পারফিউমের শিশি, গলার নিচে স্প্রে করতেই সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। বলল, ‘পাগল তো ওই একজনই করতে পারেন। ভাবলে গা সিরসির করে, এই সেদিনও ওঁর অটোগ্রাফ নেবার জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়েছি। আর আজ—’

‘এক ট্রেনে—একই মঞ্চে—’

‘তুমি সব ব্যাপারেই এমন সারকাসটিক কেন!’ ভুরু তুলে তাকাল নীপা, ‘কারুর কাউকে ভালো লাগতে পারে না!’

‘পারে। কখনো কখনো নিশ্চয়ই পারে।’ বলার ঝোঁকে এখন শব্দগুলোকে ছেঁকে তুলছে দেবাশিস। নীপার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ‘সুযোগ যখন পেয়েছ তখন এই ভালো লাগাটাকে কাজেও লাগাতে পারো। উনি তো শুনেছি, রেডিওর অ্যাপ্রুভিং কমিটিতে আছেন, তোমাকে বি-হাই করার উমেদারিটাও করে নিতে পারো এই সুযোগে—’

কিছু বা বিরক্ত, জবাব না দিয়ে বাথরুমে গেল নীপা। দেবাশিস তাকে কেরিয়ারিস্ট ভাবে। ফিরে এসে জল খেল। ফ্ল্যাটটা ঠিক আছে কি না দেখে নিল ঘুরেফিরে। রান্নাঘরের দিকে গিয়ে কিছু নির্দেশ দিল প্রৌঢ়া কাজের লোকটিকে। এই তিনদিন সংসারের দায়িত্ব তার, দেবাশিসের হেফাজতও। অবশ্য এটাকে যদি সংসার বলা যায়। একসঙ্গে থাকা, যখন থাকা তখনই দেখা হওয়া এবং কথা বলা, হঠাৎ-হঠাৎ চলে আসা একরাশ স্তব্ধতা; রাতের বিছানায় কখনো-সখনো শরীর নামক দুটি পাথরের ঘষাঘষিতে যে বন্য আগুন জ্বলে ওঠে তা চকমকিই, নিবতে দেরি হয় না। গানে নির্বাসন না নিয়ে সে যদি গ্রুপ থিয়েটারেই থেকে যেত, দেবাশিসের সঙ্গে সঙ্গে, জীবন কি অন্যরকম হত তাহলে?

আবার ঘরে ফিরে দেখল, বড় সুটকেসটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেবাশিস।

‘প্রায় দু’মন ভারী! মাত্র তিনদিনের জন্য এত কি ঠেসেছো?’

‘আমার ভার আরও বেশি না!’

কথাটা বলে পায়ে চটি গলিয়ে এবং হ্যাণ্ডব্যাগটা হাতে নিয়ে অন্যমনস্ক লঘুতায় দেবাশিসের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা করল নীপা। না পেয়ে বলল, ‘ভয় নেই। গৃহত্যাগ করব না।’

‘তাহলে গৃহ আছে!’ এবারও বলার জন্যেই বলা। কাছাকাছি পেয়ে বাঁ হাত বাড়িয়ে আলতো ভঙ্গিতে নীপার পিঠে রেখে দেবাশিস বলল, ‘এই স্যুটকেস নিয়ে ট্যাক্সির জন্যে ছুটোছুটি করতে হবে। সুতরাং—’

নীপা ঘড়িতে চোখ রাখল। সোয়া আটটা।

কপাল ভালো, বাড়ির নিচেই এক ভদ্রলোক নামছেন ট্যাক্সি থেকে। সময়মতো পৌঁছুতে পারার সম্ভাবনায় নিশ্চিন্ত হয়ে নীপা ভাবল, এরকম কখনো-সখনোর উপলক্ষে এখনো তাকে পৌঁছে দেয় দেবাশিস। তার নিরাপত্তার কথা ভেবে, যেহেতু স্ত্রী, নাকি অন্য কোনো কারণে? এই তিনদিন, যখন সে দূরে থাকবে, কোনোভাবেই যোগাযোগ রাখা সম্ভব হবে না, তখন তার সম্পর্কে কোন্ কোন্ কথা ভাববে দেবাশিস, কী করবে? নাকি এটা শুধুই এর দায়িত্ব পালন, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর, তার বেশি কিছু নয়—ক্রমশ নিরপেক্ষতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে দেবাশিস! হতে পারে। দূরে, প্রায় বিদেশে গাইতে যাচ্ছে স্ত্রী, কিন্তু এর মধ্যে একবারও খোঁজ করেনি কোথায় উঠবে কিংবা কোন কোন গান গাইবে। বাড়িতে থাকলে প্রতিদিনের রেওয়াজ তার কানে পৌঁছয় না এমন হতে পারে না; তবু একবারও বলেনি এটা ভালো, কিংবা, ওটা আরও ভালো হতে পারত। এরকম কেন হয়! ও বোঝে না এমন তো নয়। আট বছর আগে, কিংবা, তার পরেও কিছুদিন পর্যন্ত গান ব্যাপারটা দেবাশিসই বুঝত।

নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার নিতে গিয়ে একটা সুগন্ধ উঠে এলো নীপার নাকে। জুঁই ও বেলফুলের মাঝামাঝি এই গন্ধ, হালকা উগ্রতা মেশানো; কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে দেয় না।

দেবাশিসের স্বভাব, একবার চুপ করলে চট করে কথা বলে না। এখনো তেমনি, চোখ সামনে, সিগারেটে টান দিলে ক্ষীণ আগুনের ঔজ্জ্বল্য চিনিয়ে দেয় কেউ আছে, পাশে। নীপা পাশ ফিরে তাকাল, কিন্তু ট্যাক্সির প্রায়ান্ধকারের মধ্যে দেবাশিসের তামাটে ঘাড় আর মুখের একদিক ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। পাঞ্জাবী ড্রাইভারের টান-টান পিঠের ওপর দিয়ে তার চোখ চলে গেল রাস্তায়। ভিক্টোরিয়ার পাশের রাস্তা দিয়ে রেড রোডের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। মার্কারির রশ্মিতে আলোর চেয়ে বেশি ছায়া। গতিই এনে দিচ্ছে আরামবর্জিত, ঈষৎ তপ্ত হাওয়ার ঝলক। আবার দেবাশিসের মুখে চোখ পড়ায় নিজের মধ্যে কেমন এক কাঠিন্য ও বিরক্তি অনুভব করল নীপা। এই অনুভূতি কেমন তা সে নিজেও বুঝতে পারে না; শুধু এটুকু ছাড়া যে একসঙ্গে থাকা এবং একাত্ম হওয়ার মধ্যে বস্তুত সম্পর্ক নেই কোনো—যে-লোকটির সঙ্গে সে এখন যাচ্ছে, আট বছরের অভ্যাস ছাড়া তার ওপর কতটা নির্ভর করতে পারে, কিংবা আদৌ পারে কি না সে সম্পর্কে তার মনে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। জ্বালাহীন এক ধরনের অভিমান ছড়াতে শুরু করেছিল তার শরীরে। ক্রমশ শুকিয়ে এলো গলা এবং নিজের দিকে, রাস্তায়, দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে নিতে নীপা বুঝতে পারল, চোখ ঝাপসা না হলে দৃশ্যগুলো পরিষ্কারই দেখতে পেত সে।

স্টেশনে পৌঁছে এবং তার পরেও বেশ কিছুক্ষণ ভিতরের কাঠিন্য থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারল না নীপা। দলটা ভারীই বলতে হবে। অপরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, তন্ময় চৌধুরী এবং তাকে নিয়ে গানের তিনজন ছাড়া সাহিত্যিক অমলেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং দু’জন রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকও যাচ্ছেন সঙ্গে—এই মুহূর্তের মানসিক অনিশ্চয়তায় নাম দুটো এসেও হারিয়ে গেল। কম্পার্টমেন্টের মধ্যে বসে, কুলি, ট্রলি ও যাত্রীদের পরস্পরবিরুদ্ধ কথাবার্তা, লোকাল ট্রেনের আসা এবং ছেড়ে যাওয়ার শব্দের মধ্যে নিজের স্বাভাবিকতা ঠিক রেখেও নিশ্চিত কোনো আহ্লাদে নিজেকে জড়াতে পারল না সে। একই কম্পার্টমেন্টে পাঁচটা খুপরি, সামনে টানা করিডোর। তন্ময়ের স্ত্রী মাধুরীর সঙ্গে খুচরো আলাপ করতে করতে দুলে উঠল ট্রেনটা। তখনই মনে পড়ল দেবাশিসকে শেষ দেখেছিল প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অপরেশের সঙ্গে কথা বলতে। ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে দেখে এখন সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো করিডোরে, জানলায় ঝুঁকল এবং দেবাশিসকে খুঁজে নিয়ে হাত নাড়ল। দেবাশিস তাকাল, কিন্তু সামান্য ঘাড় হেলানো ছাড়া আর কোনো অভিব্যক্তি ফুটল না তার মুখে। এমনও হতে পারে দেবাশিস তাকে দ্যাখেই নি। ট্রেন স্পীড নেবার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেল দেবাশিসের মুখ; দু’এক মুহূর্তের জন্যে চোখের মধ্যে তার পাঞ্জাবি ও ট্রাউজার্সের রঙটুকু ধরে রাখল নীপা। সম্ভবত সিগারেটও ছিল হাতে। বুঝতে পারল না এই বিলম্বিত ব্যবহারে সে দেবাশিসকে কোনোভাবে আঘাত করল কি না। কিছুদিন থেকে নিজের যে-কোনো আচরণ নিয়েই সংশয় দেখা দিচ্ছে মনে। মনে হচ্ছে এটাই সেই বারুদ যা জ্বলে ওঠার জন্যে তৈরিই ছিল, কাঠিটা সে নিজেই ছুঁইয়ে দিল।

‘কী, কর্তাকে ছেড়ে যেতে মন কেমন করছে নাকি?’

সেই একই গলা, গভীর ও তরঙ্গিত, চেনামাত্র নিজেকে জানলা থেকে সরিয়ে নিল নীপা।

সামনে অপরেশ। পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত, লম্বা, সবল চেহারা, মুখের গড়নে দার্ঢ্য, ব্যাকব্রাশ করা চুল, পুরু ফ্রেমের চশমার আড়ালে প্রায় পরিচিত, স্মিত দুটি চোখ। তার পিছনে তন্ময়। উদ্যোক্তাদের একজন, অনিলবাবু, যিনি যোগাযোগ করছিলেন, হুক্ লাগাচ্ছেন দরজায়। দরজা-খোলা টয়লেট থেকে ফেনোলের রাসায়নিক গন্ধ উঠে আসছিল।

প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে ইয়ার্ডে ঢুকে পড়েছে ট্রেনটা। লাইন বদলের শব্দের মধ্যে এগিয়ে এসে তন্ময় বলল, ‘অপরেশদা, আপনি বোধ হয় জানেন না, নীপাও এককালে অভিনয় করত স্টেজে—’

‘তা-ই!’ কৌতূহলের দৃষ্টিতে নীপার দিকে তাকাল অপরেশ। খুপরিতে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘গান টানল কেন! অভিনয়ে গ্ল্যামার বেশি—ফিল্মে গেলে তো কথাই নেই—’

স্বগতোক্তির ধরনে বলা, তবু, সরাসরি ওর চোখে চোখ রাখায় নীপার ধারণা হলো উত্তরটা তার কাছেই আশা করছে অপরেশ। দ্বিধান্বিত গলায় বলল, ‘গানই ভালো লাগে—’

‘তাহলে তো ভালোই।’ অপরেশ বলল, কিন্তু স্ট্রাগল করতে পারবেন তো? রবীন্দ্রসঙ্গীতে শ্রোতা যত না তার চেয়ে বেশি শিল্পী। কম্পিটিশনও সাংঘাতিক।’

অপরেশ এমনভাবে প্রশ্নটা তুলল যেন ইন্টারভিউ নিচ্ছে—ঠিকঠাক জবাব না দিলে নম্বর কাটা যাবে। এতজনের সামনে বলেই ভালো লাগল না। নীপা এড়িয়ে যেতে চাইল। বলল, ‘আমাকে আপনি বলবেন না—’

‘বেশ।’ আপার বার্থ দুটো নামানো। মাধুরীর পাশে নীপা, উল্টোদিকে জানলা ঘেঁষে অপরেশ, পাশে তন্ময়, স্লাইডিং দরজা চেপে ধরে অনিলবাবু দাঁড়িয়ে। স্পীড ও লাইন পরিবর্তনের ঝোঁকে দুলছে গাড়িটা। সিগারেট ধরিয়ে অপরেশ বলল, ‘আমার কথায় কিছু মনে করলে না তো?’

‘কেন!’

‘তোমার বয়স কম। কী হাড্ডাহাড্ডি কম্পিটিশন এখনই হয়তো তা বুঝতে পারছ না। আমাদের সময় এরকম ছিল না—’

এবার আর জবাব খুঁজল না অপরেশ। খানিক জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে ধোঁয়া ছাড়ল। তারপর, মুখ ফিরিয়ে, অনিলকে দেখতে দেখতে বলল, ‘ও মশাই, আমার টীম ঠিক উঠেছে তো?’

‘হ্যাঁ, স্যার। সব একই জায়গায়। আপনার তিনজন, তন্ময়দা আর নীপাদির দু’জন—সব স্লীপারে। আমি নিজে দেখে এসেছি—’

‘ভালো করে দেখবেন। ওরা খুব সেনসেটিভ। আমরা ফার্স্ট ক্লাসে, ওরা স্লীপারে—একটা কমপ্লেক্স সৃষ্টি হয়। তার জেরে যদি বাজনায় তাল কাটে তাহলেই হয়েছে!’

‘যা বলেছেন।’ তন্ময় বলল, ‘আমি তো বলেছিলাম আমাকেও স্লীপারে দিতে—’

অন্যমনস্কতার মধ্যে নীপা দেখল, ভুরু নাচিয়ে তন্ময়কে কী ইশারা করছে মাধুরী। সম্ভবত বেফাঁস কিছু বলা থেকে বিরত করল।

‘সাধ্য থাকলে আমরা সবাইকেই ফার্স্ট ক্লাসে নিয়ে যেতাম।’

নীপা অনিলের দিকে তাকাল এবং মনে করার চেষ্টা করল রমেনের যাওয়া নিয়ে তার সঙ্গে কী কথা হয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের কোনো ভাবনায় স্থির থাকতে পারল না। চিন্তার ভিতরের অস্পষ্টতা থেকে এই প্রথম ট্রেনের সহিংস গতি অনুভব করল সে। বাস্তবিকই ট্রেনটা এত দ্রুত ছুটছে যে শব্দে প্রখর না হয়েও গতির চাপে দুলে উঠছে মাঝে মাঝে। অন্যমনস্কতার মধ্যে অন্যদের বলা কথাগুলো সূত্রহীন টুকরোর মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল তার আশপাশে। দেবাশিস হয়তো ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেছে এতক্ষণে। নীপা ভাবল, পৌঁছেছে কি? মনে পড়ল মাঝে মাঝেই দেবাশিসের দেড়টা দুটো করে বাড়ি ফেরা, হাজার অনুযোগ অভিযোগেও উদাসীন, তার দুশ্চিন্তাকে আমল না দেওয়া এবং দু’জনের মাঝখানে নেমে আসা হঠাৎ নৈঃশব্দ্য। কেমন, তা দুর্বোধ্য। কিন্তু আছে, থাকে; রক্তে কিংবা শিরাপ্রবাহে করে তোলে অসহিষ্ণু। সেই একই নৈঃশব্দ্য এখনো আলাদা করে দিল নীপাকে। কাঁধের দু’দিকে, ঘাড়ে, মাথার মধ্যিখানে এবং হাত দুটিতে অদ্ভুত এক অবসাদ অনুভব করল সে। সম্ভবত ঘুম আসছে, সম্ভবত ট্রেনের দুলুনিতে। আর কোনো কারণেও হতে পারে।

হঠাৎ অপরেশের সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ায় গলা পর্যন্ত উঠে আসা ছোট ছোট হাইগুলোকে চাপা দিয়ে নড়েচড়ে বসল নীপা। ঠিক জানে না কতক্ষণ, কিন্তু অপরেশের দৃষ্টি যে এতক্ষণ তারই ওপরে নিবদ্ধ ছিল তাতে সন্দেহ নেই কোনো। সামান্য অস্বস্তি বোধ করল সে, চোখ ফিরিয়ে নিল জানলার দিকে। অন্ধকার এবং চকিতে পিছলে যাওয়া আলোর ভিতর থেকে ছিটকে আসা হাওয়ায় তাপ নেই। তৃপ্তিও নেই। নিয়মমাফিক যান্ত্রিকতায় খুপরির ভিতরেও ঘুরছে চারটে পাখা। জোরে হুইস্‌ল্‌ দিয়ে ট্রেনটা একটা ছোট স্টেশন পেরিয়ে যাবার সময় আকস্মিক বোর্ডে নামটা পড়বার চেষ্টা করল নীপা; পারল না, তারও আগে ফিরে এলো অন্ধকার। মনে পড়ল আজই বেরুবার আগে অপরেশকে নিয়ে দেবাশিসের সঙ্গে কথা হয়েছিল তার। সে কি বলেছিল কারুর কাউকে ভালো লাগতে পারে না! কেন বলেছিল এখন তার তাৎপর্য খুঁজে পাচ্ছে না। তখন চোখ দুটো আস্তে আস্তে নেমে এলো নিজেরই শরীরে, কোলে ও হাঁটুতে, শাড়ির মেরুন কালো রঙে।

মাধুরী বলল, ‘নীপাদি, আমরা কি এবার নিজেদের জায়গায় চলে যাবো?’

‘যাবে?’

‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুম পেয়ে গেছে।’

তাকেই বলা, তবু তন্ময়কে দেখে মনে হয় মাত্র কিছুদিন আগে বিয়ে করা স্ত্রীর যে-কোনো ভঙ্গি ও কথা বলা সম্পর্কে খুবই সজাগ; এ কথাটাও শুনতে ভুল করেনি।

‘সত্যিই ঘুম পাচ্ছে নাকি! মোটে তো দশটা!’

‘আমি বলিনি। আপনার বউ বলেছে—’

তন্ময় অপ্রস্তুত। মুখ দেখে মনে হবে মাধুরীও। অন্য কোনো প্রসঙ্গে না গিয়ে দ্রুত গলায় বলল, ‘তুমি তাহলে আমার সুটকেসটা ক্যূপেতে দিয়ে দাও। তোমার চাদর আর এয়ারপিলোটা বের করে দিই। তুমি তো এখানেই থাকবে?’

মাধুরীর কথায় অনেকক্ষণের মধ্যে এই প্রথম চাপা কৌতুক ছড়িয়ে পড়ল নীপার মুখে।

‘তন্ময়দা, আমি কিন্তু জায়গাটা ছেড়ে দিতে পারি।’

‘আরে না, না। তা কী করে হয়! আফটার অল, লেডিজ বলে কথা—’

‘আমার কিন্তু এই আলাদা ট্রিটমেন্ট ভালো লাগে না।’

অপরেশ সম্ভবত অন্যমনস্ক ছিল, ব্যাপারটা বুঝতে পারে নি। এখন ওদের দেখতে দেখতে বলল, ‘কী নিয়ে কথা হচ্ছে?’

‘কিছু নয়।’ তন্ময় বলল, ‘নীপা আর মাধুরীর সীট পড়েছে ওদিকে—একটা ক্যূপেতে—’

‘কেন! এখানে তো চারটে বার্থ?’

অনিল এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। অপরেশের প্রশ্নে বিব্রত, কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলল, এর মধ্যে দুটো আসানসোলের কোটা—ওখান থেকে লোক উঠবে—’

‘তা এরকম অ্যারেঞ্জমেন্ট হলো কেন! সবাই মিলে একসঙ্গেই তো যেতে পারতাম!’

‘না, মানে—’, অনিল ইতস্তত করল, ‘আপনার যাওয়ার ব্যাপারটা তো কালই কনফার্মড হলো, তাই একটু রিঅ্যারেঞ্জ করতে হয়েছে—’

‘আপনি কোথায়?’

‘পাশেরটায়, অমলেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মানে, ভদ্রলোক এই সেদিন হার্ট-অ্যাটাক থেকে সেরে উঠলেন তো! ওঁর স্ত্রী বলেছেন আমি যেন ওঁর সঙ্গে সঙ্গেই থাকি—’

খানিক অনিলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল অপরেশ। তারপর বলল, ‘দেখেছেন! অমলেন্দুবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলব ভেবেছিলাম—একেবারেই ভুলে গেছি। যাই একবার, দেখা করে আসি। নিশ্চয়ই শুয়ে পড়েননি?’

‘না, না।’ অপরেশকে উঠতে দেখে অনিল বলল, ‘সাড়ে দশটায় ঘুমের ওষুধ খাবেন, তারপর শোবেন—’

অপরেশ বেরিয়ে গেল, পিছনে পিছনে অনিলও। হাবেভাবে বোঝা যায় ওদিকে অমলেন্দু, এদিকে অপরেশকে নিয়ে টেনসনে আছে লোকটা। সম্ভবত দেবাশিসের কথাই ঠিক, লোকজন জড়ো না হওয়া পর্যন্তই নীপা, তন্ময়দের দরকার হবে। তারপর উনি, উনিই সব! কথাগুলো হুবহু ফিরে এলো কানে। কেন যেন মনে হলো নীপার, অপরেশ আগেই রাজি হয়ে গেলে তার কিংবা তন্ময়ের ডাক পড়ত না।

স্লাইডিং দরজাটা যেখান পর্যন্ত ঠেলা হয়েছিল ট্রেনের দোলায় সেখান থেকে ফিরে আসছে আস্তে আস্তে। একটি শিশুকে দু’ হাতে ধরে টয়লেটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ফর্সা, একটু বা মোটা চেহারার এক যুবতী। চেহারা ও পোশাকে অবাঙালি মনে হয়। মুহূর্তের মধ্যে আড়াল হয়ে গেল করিডোর। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একা, নিঃশব্দ খুপরিতে ভেসে বেড়ানো সিগারেটের ধোঁয়ার অস্পষ্ট গন্ধ পেল নীপা। আবার ফিরে এলো দেবাশিস এবং অন্যমনস্ক হবার চেষ্টায়, ট্রেনের শব্দ। নিঃশ্বাসের চাপ সহ্য করতে করতে নীপা ভাবল, দূরত্ব বাড়ছে। প্রশ্নটা যদি কিংবা হয়তো নিয়ে নয়, প্রায় নিশ্চিত; অন্তত দু’বছর আগেও সে এরকম ভাবেনি।

মাধুরীর মুখ জানলার দিকে ফেরানো। সামনে তন্ময়, কাঁধ থেকে ঝোলানো হাত দুটো সীটের ওপর, চোখ মেঝের দিকে। এখন কথা বলতে হলে নীপাকেই বলতে হবে।

‘অপরেশদার এই ব্যাপারটা ভালো লাগল না?’

‘কোন্‌টা?”

‘এই যে অমলেন্দুবাবুর সঙ্গে দেখা করবার জন্যে নিজেই এগিয়ে যাওয়া? ওঁর নিজের নামডাকও তো কম নয়।’

তন্ময় হাসল। কিছু বলবার আগে সোজাসুজি নীপাকেই দেখল।

‘ওটা ওঁর পাবলিক রিলেশান্‌স্‌। স্বার্থের জন্যে করা। তুমি বোধ হয় জানো না অমলেন্দুবাবু একটা বড় কাগজের সঙ্গে যুক্ত, যার সার্কুলেশন চার লাখ। ওঁর একটি কথায় অপরেশদার ছবি সমেত বড় রাইট-আপ বেরুতে পারে—’

‘জানি।’ নীপা বলল, কিন্তু অপরেশদা বোধ হয় এসব ব্যাপার পেরিয়ে এসেছেন—’

‘আজই তো আলাপ হলো, তুমি ওঁকে কতটুকু চেনো! লোকটা পাবলিসিটির কাঙাল—’

নীপা জবাব দিল না। বাইরে, একটানা অন্ধকারের মধ্যে অনেকক্ষণ আলো চোখে পড়েনি। তবু, তাকিয়েই থাকল। গতি কমিয়ে জোরে হুইস্‌ল্‌ দিচ্ছে ট্রেনটা। সম্ভবত সিগন্যাল পায় নি। পুরোপুরি থেমে যাবার আগেই ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করল আবার।

‘যাই বলো—’, মাধুরী বলল, ‘ওঁর গান আজকাল আমার ভালো লাগে না। একদম ফ্ল্যাট।’

‘অপরেশ ব্যানার্জি?’

‘নীপার সামনে এসব কথা বোলো না।’ মাধুরীর হঠাৎ-মন্তব্য চাপা দেবার জন্যে ইশারা করল তন্ময়। তারপর বলল, ‘তোমার ঠাট্টা নীপা বুঝবে না। ও অপরেশদার ব্লাইন্ড ফ্যান।’

‘সত্যি!’ হাত বাড়িয়ে নীপার জানুতে চাপ দিয়ে মাধুরী বলল, ‘কিছু মনে করলে না তো?’

মাধুরীর বয়স কম নয়, কিন্তু, নতুন বিয়ের কারণেই হয়তো, গায়ে পড়ার ধরনটা যায় নি। তার ওপর সারাক্ষণ নীপাদি, নীপাদি করছে। কী ভাবছে মাধুরী, ওতে বয়স লুকোনো যায়? এসব ভাবলেও বিরক্তি আড়াল করে নীপা বলল, ‘মনে করব কেন! ভালো লাগা না-লাগা ব্যাপারটা যার যার নিজের।’

‘আসলে কি জানো, ভদ্রলোক সম্পর্কে যা শুনেছি তাতেই ওঁর সম্পর্কে ধারণা খারাপ হয়ে গেছে—’

‘কী শুনেছ!’

‘ওই যে, স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন না—’

‘আঃ!’ প্রায় চেঁচিয়ে বলল তন্ময়, ‘ওটা ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। অনেক স্বামী-স্ত্রীই একসঙ্গে থাকে না। তা ছাড়া, এগুলো গসিপও হতে পারে—’

নীপা বুঝল, তন্ময়ের অস্বস্তি মাধুরীর কথায় যতটা না তার চেয়ে বেশি তার সামনে বলা নিয়েই। ভাবতে পারে কথাগুলো অপরেশের কানেও পৌঁছুবে। ওকে আশ্বস্ত করার জন্যেই বলল, ‘গসিপ তো প্রত্যেকের নামেই কিছু-না-কিছু থাকে, তন্ময়দা। যে যত বড় তার সম্পর্কে রটনাও তত বেশি—’

‘এগুলো তো আর আমার কথা নয়—’, বিব্রত ভঙ্গিতে মাধুরী বলল, ‘চারদিকে যা শুনি তাই বললাম।’

‘সেজন্যে নয়। লোকটা এখানে আছে বলেই বললাম। না হলে এসব কথা আকছার আলোচনা হয়।’ তন্ময় উঠে দাঁড়িয়েছিল। বার্থের নিচে নিজেদের স্যুটকেসটা কোথায় আছে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘নীপা, তোমারটাও পৌঁছে দেবো নাকি?’

‘থাক। আমিই নিয়ে যাবো পরে—’

অপরেশ ফিরে এলো। মুখে চাপা হাসি। ইতিমধ্যে আল্‌গা করেছে বুকের বোতামগুলো; গলার নিচে ওর গেঞ্জি ও রোমশ বুক চোখ এড়ালো না নীপার।

‘বুঝলে তন্ময়, এই ভদ্রলোক, অমলেন্দু মুখার্জি, খুব ইন্টারেস্টিং।’ আগের জেরেই কথা শুরু করল অপরেশ, ‘একবার একসঙ্গে পাটনায় গিয়েছিলাম, ট্রেনেই। গেঁজিয়ে আর হুইস্কি খেয়ে রাত প্রায় কাবার। সব মনে আছে। আমাকে বললেন, আমি সঙ্গে যাচ্ছি বলে ঘুম হবে না—সারা রাত হুইস্কির গন্ধ নাকে আসবে—! এই হার্ট অ্যাটাকটাই সব মাটি করে দিয়েছে—’

তন্ময় স্যুটকেসটা বের করে এনেছিল। খানিক ঝুঁকে, খানিক দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল অপরেশের দিকে।

‘এনেছেন নাকি সঙ্গে?’

‘কী, হুইস্কি? তুমি তো জানো, রোজ দু’ পেগ অন্তত না খেলে—’, কথাটা শেষ করার আগেই থেমে গেল অপরেশ। সচেতন হয়ে বলল, ‘সরি, আপনাদের সামনে—’

অপরেশ যে সত্যি কুণ্ঠিত তা ধরা পড়ে ওর সম্বোধন-বিভ্রমে। ওকে চুপ করে যেতে দেখে মাধুরী বলল, ‘আমরা কিছু মনে করিনি। আপনি খান না!’

‘আপনি খেলে আমিও খাবো।’ তন্ময় বলল, ‘অপরেশদা, আপনি অমলেন্দুবাবুর কথা বললেন। সেবার পাটনায় কিন্তু আমিও গিয়েছিলাম। অবশ্য একই ট্রেনে নয়—। মাধববাবুর বাংলো মনে পড়ে?’

‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। তুমিও ছিলে—’

অপরেশ যেখানে শেষ করল, সেখানেই থেমে গেল কথা। সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্ক, ওর মুখের এবং দৃষ্টির হঠাৎ পরিবর্তন চোখ এড়ালো না নীপার। নিজের স্বতঃস্ফূর্ততায় নিজেকে একটু বেশিই খুলে ধরেছিল, সম্ভবত অনুতপ্ত সেজন্যে—যদিও এমন কিছু বলেনি যা অশোভন কিংবা অস্বাভাবিক। এমনও হতে পারে, প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতির একটা পর্যায়ে পৌঁছে স্বাভাবিকতার ধারণাও যায় পাল্টে। তুমি অপরেশ ব্যানার্জি, যে-উচ্চতায় পৌঁছে ছড়িয়ে দাও গানের মাধুরী, স্পর্শ করো স্তব্ধতা, সেইটেই তোমার, আসল জায়গা; তুমি সাধারণ নও, সুতরাং সাধারণ হওয়া মানায় না তোমাকে। এই মুহূর্তে হয়তো এইরকমই কোনো ভাবনা কাজ করছে অপরেশের মনে; হয়তো নয়। খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, সাফল্যের শেষ মর্যাদায় পৌঁছুনো এই মানুষটির ব্যক্তিত্বের ভিতরের চেহারাটি নীপার কাছে স্পষ্ট নয়; অপরেশকে সে চেনে শুধুই তার গানের মধ্যে দিয়ে, সুরের সাবলীলতায়, কণ্ঠ-মাধুর্য যেখানে কথায় এনে দেয় আনন্দ, দুঃখ, যন্ত্রণা, হাহাকার। সে শুধুই লক্ষ করতে পারে অপরেশের চোখমুখের আকস্মিক বিষণ্ণতা। একটু আগের ঘটনার সঙ্গে এই পরিবর্তনের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কি না সে কী করে বুঝবে! বস্তুত নিজেকে, নিজের সমস্যাগুলোকেও কি ঠিকঠাক চিনতে পারছে!

নিজের মধ্যে ফিরে এলো নীপা। একা। আপাত-কঠিন হয়ে থাকার মধ্যেও তার শরীরে ছড়াতে লাগল একরকম দোলা—ঘুম-পাওয়া এবং না-পাওয়ার মাঝামাঝি কোনোখানে আছে এক জাগিয়ে রাখা ক্লান্তি, অননুভূত অভিজ্ঞতায় এমনকি মন জুড়েও ছড়িয়ে পড়ে আচ্ছন্নতা। স্যুটকেস হাতে বেরিয়ে গেল তন্ময়, তার পিছনে মাধুরী। বেশ কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতায় দূর থেকে ক্রমশ কাছে এগিয়ে এলো দ্রুত ধাবমান ট্রেনের শব্দ। ছন্দোবদ্ধ এবং একটানা, সেখানে একঘেয়েমি নেই কোনো।

অস্বস্তি থেকে মুখ তুলে অপরেশকেই দেখল নীপা। খানিক আগে দু’পাশে হাত নামিয়ে যে-ভঙ্গিতে বসেছিল তন্ময়, প্রায় সেই ভঙ্গিতে, দৃষ্টি জানলার দিকে, অন্ধকার ছাড়া যেখানে আর কিছুই দেখবার নেই। তবে, অপরেশ তন্ময় নয়।

‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

‘কী?’

‘সেই কবে, ছোটবেলা থেকে আপনার গান শুনছি—আমি আপনার ভীষণ ফ্যান—’, মেয়েলি দ্বিধা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আনার প্রাণপণ চেষ্টা করল নীপা, ‘সেজন্যে নয়। আসলে জানতে চাইছি গান আপনাকে কী দিয়েছে—?’

অপরেশ হাসল। কৌতূহলের দৃষ্টিতে খানিক নীপার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বড় কঠিন প্রশ্ন করলে হে! কেন গাই তা’ই তো আজও বুঝে উঠতে পারিনি।’

‘ভালো নিশ্চয়ই লাগে?’

‘সেটা তো সহজ উত্তর, শুরুর কথা। তুমিও তাই বলেছিলে না!’

নীপা চুপ করে থাকল।

ভাববার সময় নিয়ে অপরেশ বলল, ‘কী চেয়েছি তা ঠিকঠিক বুঝে উঠতে না পারলে কী পেয়েছি তা বলব কী করে!’

‘আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন—’

‘না। তা নয়। হয়তো তুমিও বুঝতে পারবে প্রশ্নটাই বাঁচিয়ে রাখে—উত্তর হয়তো কোনোদিনই পাওয়া হয় না। একটু আগে অমলেন্দুবাবুও হঠাৎ বললেন, সময় ফুরিয়ে আসছে, যা চেয়েছিলাম এখনো তার কিছুই লিখতে পারলাম না—’

‘উনি খুব বড় লেখক।’

‘সেটা তুমি আমি বলছি, যা লিখেছেন তাই পড়ে। আমরা তো জানি না উনি কী লিখতে চেয়েছেন, ওঁর চাওয়াটা কোন ধরনের! তবে—’, অল্প থেমে অপরেশ বলল, ‘কিছু একটা তো পাওয়া যায়—’

অপরেশ বোধ হয় আরও কিছু বলত, তার আগেই স্লাইডিং দরজা সরিয়ে তন্ময় ঢুকল। হাতে ভাঁজ-করা চাদর। সীটের একদিকে সেটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘কিছু মনে কোরো না, নীপা। মাধুরী যেন কী জন্যে ডাকছিল তোমাকে।’

‘কেন!’

‘জানি না।’ তন্ময় বলল, ‘একবার ঘুরেই এসো না!’

নীপা খুশি হলো না। সম্ভবত ওরা এখন হুইস্কি নিয়ে বসবে; এটাও বুঝতে পারল না তন্ময় তাকে সরাতে চাইছে কি না। মাধুরী মেয়েটিকে তার পছন্দ নয়। একটু আগেই ভেবেছে ঘুম ছেঁকে না ধরলে যাবে না ক্যুপেতে; আর, তন্ময় যদি বউয়ের সঙ্গেই রাত কাটাতে চায়, তাহলে সে এইখানেই থেকে যেতে পারে।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠল। তন্ময়ের দিকে না তাকিয়ে অপরেশকে বলল, ‘কথা শেষ হলো না। আমি আসছি এখুনি—’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। মুড থাকলে একটা গানও শোনাতে পারো।’

দরজা ধরে দাঁড়িয়ে নীপা বলল, ‘এই ট্রেনে!’

‘নয় কেন! তোমাকে বলতে ভুলে গেছি, অমলেন্দুবাবু তোমার গানের সুখ্যাতি করছিলেন। ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ—, কোথায় যেন গেয়েছিলে, উনি ছিলেন সেখানে—’

‘হ্যাঁ, মহাজাতি সদনে। গত বুধবার।’

‘তবে! এমন গুণী লোকের প্রশংসা—!’

একরকম ঢেউ এসে গেল শারীরিক মুদ্রায়। নীপা বলল, ‘আসছি।’

ক্যুপের সংখ্যা ‘ডি’, আগেই দেখে রেখেছিল। করিডোর দিয়ে যেতে যেতে লক্ষ করল অন্যগুলির দরজা বন্ধ; শেষ প্রান্তে কন্ডাক্টর গার্ডের সীটে বসে সিগারেট টানছে একটি ক্ষয়া চেহারার লোক। যাত্রীও হতে পারে। দরজা বন্ধ পেয়ে টোকা দিল নীপা।

খুলল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। ইতিমধ্যেই শাড়ি ছেড়ে ফ্রিল-বসানো হাল্কা নীল রঙের নাইটি পরেছে মাধুরী, স্পষ্ট হয়ে আছে বুকের ঢল। হাতের তালুতে ক্রীম নিয়ে ঘষছিল মুখে। নীপাকে দেখেও সক্রিয় থাকল হাত।

বাইরে থেকেই নীপা বলল, ‘ডাকছিলে কেন!’

‘ভেতরে এসো না! বলছি।’

মেঝের ওপর সুটকেসটা খোলা। পাশ কাটিয়ে ভিতরে গিয়ে বসল নীপা।

মাধুরী বলল, ‘তুমি আসবে তো এখানে?’

‘দেখি।’

গালে হাত ঘষা বন্ধ করে মাধুরী বলল, ‘আমি একেবারে রাত জাগতে পারি না। এদিকে ও গেল মদ গিলতে। এখন কতক্ষণ চলবে কে জানে! আচ্ছা, কী দরকার ছিল ভদ্রলোকের সঙ্গে মদ আনার?’

‘ওটা ওঁর নিজের ব্যাপার।’

‘কিন্তু, ওকেও তো টানছে!’

‘টানলেই যেতে হবে তার কী মানে আছে!’ প্রায় ক্ষুব্ধ গলায় নীপা বলল, ‘তন্ময়দা খায় না এমন তো নয়! আমি এর মধ্যে দোষের কিছু দেখছি না। আর তুমি যদি চাও, তন্ময়দাকে এখানে ডেকে নিতে পারো। আমি তো আগেই বলেছি—’

মাধুরী নিজেকে গুটিয়ে নিল।

‘দ্যাখো, অপরেশবাবুকে ছোট করার জন্যে আমি কিছু বলিনি। ও আমাকে ধমকালো, বলল কোথায় কী বলতে হয় জানি না। তুমি শুনেছ—, প্লীজ, কথাগুলো কাউকে বোলো না!’

মাধুরীর গলায় ভান নেই। নীপা বলল, ‘ওসব নিয়ে ভাববার কিছু নেই। আর কেউ জানবে কেন! আমি কাউকে কিছু লাগাই না।’

‘তুমি খুব ভালো। তোমাকে দেখে তাই মনে হয়—’

‘থ্যাঙ্ক ইউ। এবার শুয়ে পড়ো।’

নীপাকে উঠতে দেখে মাধুরী বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই খাও না! দেখো, ও যেন বেশি না খায়। কাল তোমাদের সবাইকেই গাইতে হবে—’

জবাব না দিলেও দাঁড়িয়ে থাকল নীপা। বস্তুত সে থেমে আছে প্রথম বাক্যটিতে, মাধুরীর কথায় কি ইঙ্গিত ছিল কোনো? এমনকি হতে পারে যে এখানে নয়, কিন্তু পরে, অন্য কোথাও, অন্য কোনো উপলক্ষে তার সম্পর্কেও মন্তব্য করবে মাধুরী?

প্রশ্নটা প্রশ্নই থাকল। অনিশ্চিতির মধ্যে কিছু না বলেই বেরিয়ে এলো নীপা।

অনুমান মিথ্যে নয়। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের গ্লাস নিয়ে এরই মধ্যে বসে পড়েছে দু’জনে। চেনা দৃষ্টি নিয়ে অপরেশ হাসলেও তন্ময়কে কঠিন লাগছে এখনো। ও কিছু বলার আগেই নীপা বলল, ‘এমন স্বামী-ভক্ত বউ আর দেখিনি। তন্ময়দা, আপনাকে বেশি রাত জাগতে মানা করল।’

‘ঠাট্টা কোরো না!’

‘ঠাট্টা করব কেন! আমি বলেছি ঠেলে পাঠিয়ে দেবো। না হলে তো ওরও ঘুম হবে না।’

অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তন্ময়। নীপা জানে এই মুহূর্তে সে তার আগ্রহ নয়; আগে ছিল না, পরেও থাকবে না। অনেকদিনের আল্‌গা পরিচয় থাকলেও আজই হয়তো চেনা হলো ওকে। অপরেশ সম্পর্কে বলা ওর কথাগুলোয় এক ধরনের কমপ্লেক্স কাজ করে থাকতে পারে, কিন্তু, আজ, এই যাত্রায় মনে হচ্ছে তাকে নিয়েও ক্ষোভ জমিয়েছে তন্ময়, কেন তা বোঝা মুশকিল। অপরেশ তার প্রশংসা করল ব’লে। নাকি ভাবছে নীপা একটা খুঁটি পেয়ে গেল!

একান্তের ভার এরই মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে মাঝখানে। দেবাশিস কী বলেছিল মনে পড়ল। দেবাশিসও তাকে কেরিয়ারিস্ট ছাড়া আর কিছু ভাবে না। তাহলে বাঁচা, আশ্রয়, অবলম্বন এসব কথাগুলোর মানে কী!

ট্রেনের জানলায় মাথা নামিয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই সামনে বসা দু’টি পুরুষের অস্পষ্ট আলাপ কানে এলো নীপার। পরিচয় থাকা কিংবা হওয়ার অর্থই চেনা নয়; হয়তো একসঙ্গে যাওয়া এবং ফিরে আসার পর যা থাকবে তার নাম অপরিচয়, কিংবা শূন্যতা। কার কী হলো না হলে কে জানছে!

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অল্প ঠাণ্ডা মিশেছে হাওয়ায়। তার জোরালো স্পর্শে আরাম ছড়িয়ে পড়ল মাথায়। একরকম আবেগে নিজেকে আরও একটু এগিয়ে জানলায় গাল চেপে ধরল নীপা: অবাধ হতে দিল ট্রেনের একটানা শব্দে মেশা হাওয়া। চোখদুটো বন্ধ করল এবং ভাবল, কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে অদৃশ্যে, সে যার কিছুই জানে না, কিন্তু যার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। এই মুহূর্তে দুটি অনাগ্রহী মানুষের সঙ্গ আরও অবিন্যস্ত করে দিল তাকে। সম্ভবত এখানে থেকে সে ভুল করেছে।

নিঃসঙ্গতার বোধ তীব্র হতে ক্রমশ অপমানে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল নীপা। ইতিমধ্যে বর্ধমান জংশন এলো এবং চলে গেল। বাইরের গোলমাল ও মিশ্র শব্দ এখানে তারতম্য আনল না কোনো। প্রায় ঘুমে জড়ানো চোখে অপরেশকে দেখল সে। কিছু বা আবজানো মুখ, মনে হয় অহঙ্কারী। এবং দূরত্বময়। ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ—, লোকটি কি বলেছিল তার গান শুনবে, এই ট্রেনেই? নাকি এসব বলার মধ্যেও ছিল অন্য কোনো উদ্দেশ্য, যা গান নয়, যা কিছু একটা তো পাওয়া যায়-এর স্বীকারোক্তি থেকে অনেক দূরে। নীপা জানে না। এই মুহূর্তের অসহায়তা তাকে টেনে নিল পূর্বাপর হারানো এক গাঢ় নিরুদ্দেশে।

এরপর কী হয়েছে নীপা জানে না। আচ্ছন্নতার মধ্যে হঠাৎই একটা চেতনা ছুঁয়ে গেল তাকে। অননুভূত এক ধরনের অনুভূতি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল মাথায়। ভিতরের আলো এখন মৃদু নীল। নিজেকে প্রত্যক্ষের মধ্যে ফিরিয়ে এনে দেখল, উল্টোদিকের বার্থের জানলা ঘেঁষে যেমন ছিল তেমনি বসে আছে অপরেশ; তন্ময় নেই; গতির চাপে বন্ধ-করা স্লাইডিং দরজাটা দুলছে আগল-ছাড়া হবার প্রক্রিয়ায়।

ট্রেনের শব্দ ছাপিয়ে ক্রমশ অন্য এক ধ্বনি স্পষ্ট হয়ে আসছিল নীপার কানে; এই ধ্বনিই, মনে হলো, ঘুমের মধ্যে স্পর্শ করেছিল তাকে। বুঝতে পারেনি। সচেতন হয়ে লক্ষ করল ঠোঁট নড়ছে অপরেশের, আলোড়িত হচ্ছে কণ্ঠনালী, একান্ত, নির্জন, গলায় নিঃসৃত হচ্ছে গান। আঁধার রাতে একলা পাগল যায় কেঁদে—। কথাগুলো চেনা, কিন্তু একেবারেই অপরিচিত হয়ে এখন ফিরে আসছে নতুন তাৎপর্য নিয়ে। সেই কণ্ঠ, সেই কথা, সেই সুরের বিভঙ্গ ট্রেনের যান্ত্রিক শব্দ কেটে চলে যাচ্ছে দূরে, ছড়িয়ে পড়ছে অন্ধকার অনন্তে—বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে।

চেপে রাখা নিঃশ্বাসের ভার সংবরণ করার চেষ্টায় অস্পষ্ট থেকে স্পষ্ট এক অনুভূতিতে জড়িয়ে পড়ল নীপা। শিরায় শিরায় ব্যাপ্ত হচ্ছে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা। ক্রমশ তা স্পর্শ করল তার চোখ, তার ওষ্ঠ, তার স্তনাগ্র; আরও গভীর আশ্রয় জানিয়ে জড়িয়ে গেল নাভিদেশে। ইতিমধ্যেই জলে ভরে উঠেছিল চোখদুটো। দূরগামী এক বেদনার্ত কণ্ঠের আকর্ষণ তাকে টানতে লাগল সেই দুর্বোধ্যের দিকে, অশরীরী হওয়া সত্ত্বেও যার উপস্থিতির অনুভবে আপ্লুত হচ্ছে সে।

অপরেশ অবাক হয়েছিল। গান থামিয়ে উঠে এলো কাছে, ওর পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হলো! নীপা!’

নীপা মাথা নাড়ল, যার অর্থ কিছু না, কিছু নয়।

১৩৯৩ (১৯৮৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *