এ-কূল ও-কূল – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
নিৰ্মল আমাকে এই গল্পটি বলেছিলেন।
নির্মল জ্যোতিষী।—সেইরকম জ্যোতিষী, যার গণনার বেশিরভাগ কথাই মেলে না। দৈবাৎ যদি—বা দু’একটা মিলে যায়—তা সে তার গণনার গুণে নয়, এম্নিই।
সেই নির্মল হঠাৎ দেখি একটা ঘর ভাড়া করে বসলো। রাস্তার ধারেই ঘর। রাস্তাটা বড়ও নয়, ছোটও নয়। তবে কলকাতা শহরের রাস্তা। লোকজনের চলাচল খুব।
দোরের মাথায় প্রকাণ্ড সাইনবোর্ড টাঙানো হলো। চারটে চার রকমের চেয়ার এলো। ভাঙা একটা তক্তাপোশের ওপর রঙিন একটা চাদর বিছিয়ে দেওয়া হলো।
জ্যোতির্বিজ্ঞান মন্দিরের অধ্যক্ষ নির্মলকুমারের আস্তানা। দিনের বেলা ভাগ্যগণনা চলে, রাত্রে শয়ন এবং নিদ্রা। আহারের ব্যবস্থাটা শুধু বাইরের হোটেলে। ভেবেছিল স্বপাক আহারের ব্যবস্থাটা এইখানেই করে নেবে। কিন্তু করতে গিয়ে দেখে তার হাঙ্গামা অনেক। ঘরটার এদিকে ওদিকে কোথাও এতটুকু আড়াল নেই যেখানে বসে এই অতি প্রয়োজনীয় কর্মটি গোপনে সমাধা করে নিতে পারে। কাজেই অপরের ভাগ্যগণনা যার পেশা, সে তার নিজের দুর্ভাগ্যটা অপরের কাছে জাহির করতে চাইলে না।
ভেবেছিলাম নির্মলকে তার কারবার গুটিয়ে ফেলতে হবে। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, চলবে তো?
নির্মল বললে, হোমিওপ্যাথি-ডাক্তারি আর জ্যোতিষ—এই দুটো এইখানেই চলে ভাল। মানুষের পয়সা না থাকলে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করায়, আর সময় খারাপ হলে জ্যোতিষীর কাছে ছোটে।
কাজেই আমাদের দেশটাকে এই দুটো কারবারের পীঠস্থান বলা চলে।
হলোও তাই।
মাস চার-পাঁচ পরে, একদিন গিয়ে দেখি নির্মল পরমানন্দে বসে বসে পান চিবোচ্ছে। চেহারাটা প্রায় জ্যোতিষী-জ্যোতিষী করে এনেছে। মাথায় বাবরি চুল রেখেছে, সোনা দিয়ে রুদ্রাক্ষের মালা তৈরি করিয়ে গলায় পরেছে। মাইনে দিয়ে একটা চাকর রেখেছে ফাইফরমাশ খাটবার জন্যে।
যেতেই একগাল হেসে মহা সমাদর করে নিয়ে গিয়ে বসালে।
চাকরটাকে ডাকলে, চৈতন্য!
তেরো-চোদ্দ বছরের একটি ছেলে এসে দাঁড়ালো।
নির্মল বললে, চা নিয়ে আয়! পান নিয়ে আয়!
চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম, চলছে কেমন?
নির্মল বললে, ভাল।
বললাম, অবস্থা যাদের খারাপ, তারাই তো আসে।
নির্মল বললে, না। কত রকমের কত মজার মজার লোক আসে এখানে। সেদিন একজন। এসেছিল। অবস্থা তার মোটেই খারাপ নয়। শোন্ তবে—
এই বলে সে বলতে আরম্ভ করলে ;
লোকটির নাম সতীশ।
সকাল বেলা। চা-টা খেয়ে সবে বসেছি। লোকটি হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে পড়লো আমার চেম্বারে। এইখানটায় বসলো। বসেই পেছন ফিরে ফিরে তাকায় আর থু-থু করে থুতু ফেলে। সক্কাল বেলা। এ কার পাল্লায় পড়লাম রে বাবা! বললাম, এ কি করছেন মশাই? থুতুতে যে ঘর ভরিয়ে দিলেন!
লোকটি বললে, দেবো না? না দিলে যাবে কেন? ভূত যে!
ভূত!—বললাম, ভূত কোথায় পেলেন?
বললে, পাব আবার কোথায় মশাই! সেই যে গঙ্গার ঘাটে পিছু নিলে, আজ পাঁচটি বছর পিছু ছাড়ছে না। আপনি গা বাঁধতে জানেন? যদি জানেন তো দিন বেঁধে!
বললাম, নিশ্চয় জানি। কিন্তু গা বাঁধার খরচ দেবে কে?
বললে, কত খরচ? আমি দেবো।
ভাবলাম কত বলি। দিতে তো পারবেই না জানি। ঝট্ করে বলে ফেললাম, দশ টাকা।
আমার দিকে তাকিয়ে লোকটি তার মুখখানা এমনি করলে—যেন দশ টাকা তার কাছে কিছুই নয়।
বললে, টাকা কি আগেই দিতে হবে?
নিশ্চয়।
রঙিন একটা ডোরাকাটা হাফশার্ট ছিল গায়ে। তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে খান-পাঁচ-ছয় দশ টাকার নোট বের করলে। তাই থেকে দশ টাকার একখানি নোট আমার হাতে দিয়ে বললে, দিন তাড়াতাড়ি গাটা আমার বেঁধে দিন, নইলে আবার আসবে।
লোকটি যে এমন করে টাকা বের করে দেবে ভাবিনি।
নিতে কেমন যেন সঙ্কোচবোধ করছিলাম। কিন্তু সে মুহুর্তের জন্য। টাকাটা নিলাম। নিয়ে, দিলাম তার গা বেঁধে।
বিড়বিড় করে কত রকমের কত মন্ত্র বললাম। একবার শোয়ালাম, একবার বসালাম, মাথা থেকে পা পর্যন্ত আলতোভাবে হাত চালিয়ে কম করেও অন্তত বিশ-ত্রিশবার গায়ে মাথায় ফুঁ দিয়ে দিলাম।
যেমন তার ভূত, তেমনি আমার মন্ত্র!
বললাম, এবার কই আসুক দেখি! আর আসতে পারবে না।
—যদি আসে?
বললাম, তাহলে বত্রিশ বন্ধনে বেঁধে দিতে হবে। কিন্তু তার আগে আপনাকে বলতে হবে যিনি আসছেন তিনি কে আর কেনই বা আসছেন।
লোকটি বললে, তাহলে আগাগোড়া আপনাকে সব কথা শুনতে হয়।
বললাম, বলুন, শুনছি।
সতীশ বলেছিল
বলেছিল, তার বীরভূম জেলায় বাড়ি। নাম সতীশ সরকার।
মস্ত বড়লোক বাপ, তার একমাত্র ছেলে সতীশ। দেশের ইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে পড়তে এলো কলকাতায়। বাবার এক মস্ত বড়লোক বন্ধু থাকে শ্যামবাজারে। সতীশ তারই বাড়িতে থাকবে, খাবে আর কলেজে পড়বে—বাপ নিজে সঙ্গে এসে সেই ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলেন। দোতলায় আলাদা একখানা ঘর দেওয়া হলো সতীশকে। আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো ঘর। পাশেই বাথরুম। ব্যবস্থা চমৎকার। কিন্তু নিতান্ত অপরিচিত লোকজন, সঙ্গী নেই, সাথী নেই, বাড়িতে একগাদা মেয়ে, ছেলে যারা আছে, তারা নিতান্ত ছোট ; সতীশের মন খুঁতখুঁত করতে লাগলো। এর চেয়ে কলেজ হোস্টেলে থাকলে সে ভাল থাকতো। টাকা এখানেও লাগবে, সেখানেও লাগতো। কথাটা কিন্তু সে তার বাবাকে মুখ ফুটে বলতে কিছুতেই পারলে না। অতি শৈশবে তার মা মারা গেছে। বাপকে সে ভয় করে বাঘের মত। ভাবলে, মুখে যা বলতে পারলে না, চিঠিতে লিখে তাই জানিয়ে দেবে তার বাবাকে।
দেখতে দেখতে দুটি বছর পার হয়ে গেল। আই-এ পাস করে সতীশ বি-এ পড়তে লাগলো। তখনও কিন্তু কথাটা তার বাবাকে জানানো হলো না। বাড়ির সবার সঙ্গেই পরিচয় তখন তার হয়ে গেছে। পরিচয় হয়েছে, কিন্তু অনাত্মীয়ের সঙ্কোচ তখনও ঘোচেনি।
সব কথা খুলে তার বাবাকে একখানা চিঠি সে লিখবে লিখবে করছে, এমন দিনে একটা বড় মজার ঘটনা ঘটে গেল।
সেদিন শনিবার। সতীশ সকাল-সকাল কলেজ থেকে ফিরেছে। ইংরেজি একটা কি ভাল সিনেমার ছবি চলছে, সেদিন তাই দেখতে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে সে। এক পায়ে জুতো পরেছে,আর এক পায়ে তখনও পরেনি এমন সময় তার ঘরে ঢুকলো আঠারো-উনিশ বছরের পরমা সুন্দরী এক তন্বী তরুণী। কখনও এ-বাড়িতে তাকে দেখেছে বলে তার মনে হয় না। মেয়েটি এসেই প্রথমে হাত দুটি জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললে, নমস্কার। আমাকে চিনবেন না আপনি। নতুন এসেছি। এই বাড়িতে থেকে আমি কলেজে পড়বো। ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছি বেথুনে। শুনলুম আপনার থার্ড ইয়ার। ফার্স্ট ইয়ারের বইগুলো আপনার আছে নিশ্চয়ই। একটিবার যদি দেখতে দেন তো দেখি যদি এক-আধটা আমার কাজে লাগে। এক টানে এতগুলো কথা বলে গিয়ে হঠাৎ সে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো; এ কি, আপনি কোথাও যাবার জন্যে তৈরি হয়েছেন নাকি?
সতীশ বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, সিনেমায় যাব।
মেয়েটি বললে, তাহলে যান, আমি তো এই বাড়িতেই আছি। ফিরে আসুন, এলেই দেখবো।
সতীশের হঠাৎ একবার মনে হলো—নাইবা গেল সিনেমা দেখতে। তার পরেই কি ভেবে বললে, সেই ভাল। ফিরেই আসি।
এই বলে সতীশ জুতোটা আবার পরে ফেললে।
দু’জনেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
মেয়েটি বললে, একটু দাঁড়াবেন? এক মিনিট।
বেশ তো। সতীশ দাঁড়িয়ে রইলো।
বাড়ির ভেতর থেকে ফিরে আসতে খুব বেশি দেরি হলো না মেয়েটির। ফিরে যখন এলো, দেখলে পায়ে একজোড়া স্যাণ্ডেল পরে এসেছে। বললে, চলুন আমিও যাই আপনার সঙ্গে সিনেমা দেখতে। আপনার আপত্তি নেই তো?
কোথাও এতটুকু সঙ্কোচ বা জড়তা নেই মেয়েটির ব্যবহারে।
দু’জনের অনেক কথা হলো সেদিন।
এই বাড়ির যিনি মালিক, তাঁর বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যে গ্রামে, সেই গ্রাম থেকে এসেছে মেয়েটি। নাম মিনতি। কায়স্থের মেয়ে। বাপ-মা, ভাই—বোন—কেউ কোথাও নেই তার। বাবা মারা যাবার পর লাইফ ইন্সিওরের তিন হাজার টাকা সে পেয়েছিল। তাই থেকে দু’হাজার টাকা খরচ করে সে পড়েছে। এখনও এক হাজার টাকা তার হাতে আছে।
গ্রামের মুরুব্বি-মাতব্বরেরা চেষ্টা করেছিলেন, তার একটি বিয়ে দিয়ে দেবার। কিন্তু বিয়ে সে করতে চায় নি। সে চেয়েছিল পড়তে। তাইতেই তাঁরা চটে যান। আর তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম—
মিনতি ম্লান একটু হেসে বললে, বুঝতেই পারছেন। আমি একা মেয়েছেলে কি করতে পারি বলুন।
সতীশ জিজ্ঞাসা করলে, কি করলেন?
মিনতি বললে, সে সব অনেক কথা। শুনতে হলে আজ আর আমাদের সিনেমা দেখা হবে না। আজ থাক, বলবো আর একদিন।
সতীশ বললে, আজই বলুন। সিনেমা দেখবো না।
সেদিন কিন্তু সে বললে না কিছুতেই। শুধু বললে, আপনি আমাকে আপনি বলবেন না, তুমি বলুন।
সিনেমা দেখে ফেরবার পথে সতীশ বললেন, এই যে তুমি আমার সঙ্গে একা একা চলে এলে সিনেমা দেখতে, এই যে তোমাকে আমি তুমি বলছি, এর জন্যে লোকে যদি আমাদের নামে অপবাদ দেয়?
মিনতি বললে, সেটা যদি মিথ্যা হয়, তাকে ভয় পাবো কেন? আর যদি সত্য হয়, তখন তো আর সেটা অপবাদ থাকবে না! দেখুন, আমার মাত্র উনিশ বছর বয়স। এই উনিশ বছরে যে অভিজ্ঞতা আমি সঞ্চয় করেছি, অনেক মেয়ে সারা জীবনেও তা পারে না। কাজেই কোনও মিথ্যাই আমাকে আজ আর বিচলিত করতে পারে না।
সতীশ বললে, যদি সত্যি হয়?
মিনতি একবার হাসলে। হাসলে তার সেই প্রাণমাতানো হাসি। হেসে বললে, আমার এই রূপই আমার সর্বনাশ করেছে। মানুষকে একবার ভাবতে পর্যন্ত সময় দেয় না—সে কি করতে যাচ্ছে। ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় তার লোভ আর লালসা নিয়ে। কিন্তু আমি পোড়খাওয়া মেয়ে সতীশবাবু, আমি অত সহজে ভুলবো না।
সতীশের মুখ সেদিন মিনতিই বন্ধ করে দিলে নিজের হাতে।
সে মুখ আবার খুলেছিল মিনতি নিজেই।
একই বাড়িতে থাকে। দু’জনেই কলেজে পড়ে। একসঙ্গে খায়, একসঙ্গে কলেজে যায়, একসঙ্গে বেড়াতে বেরোয়, একসঙ্গে বাড়ি ফিরে আসে।
বাড়িটা আবার এমনি যে, কে কার খবর রাখে!
দু’জনের ঘনিষ্ঠতা দিন দিন বাড়তে থাকে। ঘনিষ্ঠতা শেষে এমন হয় যে, কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারে না। মান-অভিমানের পালা চলে।
সতীশ চিঠি লিখে মিনতির মান ভাঙায়। এক লাইন দু’লাইন চিঠি শেষে এক পাতা দু’পাতাতেও শেষ হয় না। মুখে যা বলতে পারে না, চিঠিতে তাই লিখে জানায়।
একখানা চিঠি হাতে নিয়ে মিনতি সেদিন সতীশের ঘরে এসে ঢুকলো। বললে, প্রেমপত্র লিখতে আরম্ভ করলে? বলেই চিঠিখানা তার গায়ের ওপর ছুঁড়ে দিলে।
সতীশ বললে, প্রেমপত্র কেন হবে?
মিনতি বললে, যা আমি দেখতে পারি না তাই! এই চিঠি যদি কেউ দেখে কি বলবে বলতে পারো? এবাড়ি থেকে ঝাঁটা মেরে বিদেয় করে দেবে যে!
সতীশ বললে, বিদেয় করে দেয় তো তখন আমার বাড়ি আছে।
মিনতি বললে, ওরে বাবা! তোমার বাড়ি? তোমার বাবা থাকতে? মরুক্গে যাক আর ভাবতে পারি না বাবা, দাও আমার চিঠি দাও। এই বলে সতীশের লেখা চিঠিখানি নিয়ে মিনতি চলে গেল।
সতীশ বললে, ও-চিঠি তুমি আবার নিয়ে যাচ্ছো কেন?
মিনতি চৌকাঠের বাইরে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। ভাঁজ করা চিঠিখানি জামার নিচে বুকের তলায় রাখতে রাখতে বললে, আমার চিঠি আমি নেব না তো কে নেবে?
বি-এ পাস করলে সতীশ। আই-এ পাস করলে মিনতি।
হঠাৎ সতীশের নামে এক টেলিগ্রাম এলো দেশ থেকে। তার বাবা টেলিগ্রাম করেছে—তাড়াতাড়ি যাবার জন্যে।
বাবার শরীর অসুস্থ। ব্লাড প্রেসারের রুগী। অসুখ বাড়লো কিনা কে জানে।
সতীশ ভাবতে লাগলো। সন্ধ্যায় ট্রেন। মিনতি বললে, চল তোমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসি। ছেলে বি-এ পাস করেছে। গিয়ে দেখবে হয়ত বাবা একটি বউ আনবার ব্যবস্থা করেছেন।
সতীশ বললে, তাহলে চল না আমার সঙ্গে। বউ নিয়েই যাই।
—সে সাহস কি তোমার আছে?
—নেই?
মিনতি বললে, দেখে তো মনে হয় না।
সতীশ বললে, বেশ তাহলে তৈরি হয়ে থাকো।
মিনতি ম্লান একটু হাসলে। বললে, অদৃষ্ট আমার খুব মন্দ। শেষ পর্যন্ত কি হবে জানি না।
সতীশকে ট্রেনে চড়িয়ে দিয়ে মিনতি একাই ফিরে এলো শ্যামবাজারে।
সতীশ বাড়ি গিয়ে দেখে, মিনতি যা বলেছিল ঠিক তাই।
বাবার ব্লাড প্রেসারের অসুখটা ঘন ঘন জানাচ্ছে। ভয় হচ্ছে আর বেশিদিন তিনি বাঁচবেন না। তাই আগামী পঁচিশে ফায়ূন সতীশের বিয়ের সব কিছু তিনি ঠিক করে ফেলেছেন।
সর্বনাশ! সতীশের বুকের ভিতরটা কেমন যেন করতে লাগলো। মিনতি যা বলেছিল ঠিক তাই।
কিন্তু বাবার মুখের ওপর জীবনে সে কোনোদিন কোনও কথা বলেনি। কথা বলবার মত সাহসও তার নেই। অথচ এ সময় কথা যদি সে না বলে, মিনতির এবং তার—দু’জনের দুটো জীবনই চিরদিনের মত ব্যর্থ হয়ে যাবে।
সাহসে বুক বেঁধে এর প্রতিবাদ করবার জন্য সতীশ গেল তার বাবার কাছে।
সতীশকে দেখেই তার বাবা বললেন, আর আমি বেশিদিন বাঁচবো না বাবা। এখন তোমায় বিয়ে দিয়ে তোমাকে সংসারী করে দিয়ে যেতে চাই। তোমাকে কিছু না জানিয়েই এইখানে আমি বিয়ের সব ঠিক করে ফেলেছি। জানি আমি যা করবো তার ওপর তুমি একটি কথাও বলবে না। তুমি আমার সেরকম ছেলে নও।
এই কথা বলেই বাবা একটু থামলেন। সতীশের বুকের ভিতরটা আরও বেশি ধক্ ধক্ করছে।
বাবা বললেন, কলকাতায় একখানি বাড়ি করবার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের। কিন্তু সেটা এতদিন হয়ে ওঠনি। যার জন্য বন্ধুর বাড়িতে রেখে তোমাকে পড়াতে হলো। তুমি জানো না—পনেরো হাজার টাকায় কলকাতার একখানি ছোট বাড়ি আমি বন্ধক রেখেছিলাম। যাঁর বাড়ি তিনি মারা গেছেন। তাঁর দুই ছেলে এলো আমার কাছে। এসে বললে বাড়িটা ছাড়াবার ক্ষমতা আমাদের নেই, বোনের বিয়ে দিতে হবে। কাজেই আপনি যদি হাজার পাঁচেক টাকা আমাদের দেন তো বাড়িটা আপনাকেই বেচে দিই। এই পাঁচ হাজার টাকা আমি তাদের দিলাম না। যে-মেয়ের বিয়ের জন্যে বাড়িখানা বিক্রি করতে চায়, সেই মেয়েটিকে দেখে এলাম। বেশ মেয়ে। এই মেয়ের সঙ্গেই তোমার বিয়ে ঠিক করে ফেললাম। বাড়িখানি তারা তোমার নামে লিখে রেজেষ্ট্রি করে দিয়েছে। এই বাড়িতেই বিয়ে হবে। বিয়ের পরেও তোমরা এই বাড়িতেই থাকবে। পড়তে ইচ্ছে হয় পড়বে আর নয় তো তোমার যা খুশি—
চাকর এলো তেলের বাটি হাতে নিয়ে বাবাকে তেল মাখিয়ে স্নান করাবে।
বাবা বললেন, যাও।
সতীশের বলা কিছুই হলো না। চার দিন পরে পঁচিশে ফাল্গুন। সেদিন বর সেজে সে কলকাতায় যাবে বিয়ে করতে। মিনতি থাকবে কলকাতায়। কিছুই সে জানবে না। কিছুই সে শুনবে না।
তারপর?
কোন মুখে সতীশ গিয়ে দাঁড়াবে তার কাছে?
সতীশ মনে-মনে সঙ্কল্প করলে—বিবাহের পর কোনও সম্বন্ধই সে রাখবে না তার স্ত্রীর সঙ্গে।
দুর্বল এবং অক্ষমের একমাত্র সান্ত্বনা।
শুভদিনে এবং শুভ লগ্নে বিবাহ হয়ে গেল সতীশের।
বি-এ পাসকরা যুবক সতীশ বিয়ে করে এলো শ্রীমতী সতীরাণীকে। মেয়েটির রং ফর্সা, দুর্বল এবং রুগণা। তবু সবাই বলতে লাগলো, চমৎকার মানিয়েছে।
সতীশের বাবা কিন্তু সত্যই আনন্দিত হলেন।
বললেন, সতী আর সতীশ। নামের মিল কি রকম হয়েছে দেখো।
ডাক্তার-কোবরেজ সবাই বলেছেন, তাঁর অসুখের চিকিৎসার প্রয়োজন। কলকাতার বাড়িখানি মেরামত করালেন মনের মত করে। তারপর ভাল একটি দিন দেখে ছেলে বউ নিয়ে যাত্রা করলেন কলকাতায়।
নতুন বাড়িতে নতুন সংসার পাতলেন তিনি।
কিন্তু পঞ্জিকা দেখার ভুলেই হোক কিংবা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, যাত্রাটা বোধ হয় শুভ হয়নি। নইলে বুড়ো বয়সে যে-সুখের আশায় তিনি এত কাণ্ড করলেন, সে-সুখ তিনি পাচ্ছেন না কেন? ছেলেবউয়ের মুখে হাসি নেই, তাঁরও অসুখ তাড়াতাড়ি সারছে না ; তার ওপর একদিন সকাল বেলা, বউমা প্রত্যহ যেমন আনে সেদিনও তেমনি তাঁর জন্য চা আনছিল, হঠাৎ তাঁর চোখের সুমুখেই মাথা ঘুরে পড়ে গেল। বড় বড় ডাক্তার এলো, নার্স এলো, বউমা উঠে বসলো, আবার তেমনি উঠে হেঁটে বেড়াতে লাগলো, কিন্তু ডাক্তার বললে, সাবধানে থাকতে হবে, হার্টের গোলমাল।
রুগী ছিল একজন, হলো দু’জন।
সতীশের বাবা কিছুতেই ভেবে উঠতে পারলেন না কেন এমন হলো! কখনও ভাবেন, বাড়িটা অপয়া। কখনও ভাবেন, বউটা অপয়া।
অথচ তখন আর শোধরাবার কোনও পথই অবশিষ্ট নেই।
একমাত্র যে-পথটি তাঁর জানা ছিল না, সে-পথের সন্ধান যে তিনি এত শীঘ্র পাবেন তা তিনি কোনদিন কল্পনাও করতে পারেননি। তিন মাস তখনও পার হয়নি, অকস্মাৎ একদিন সন্ধ্যায় তিনি বাথরুমে ঢুকলেন। ঢুকে আর সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন না। দেরি হচ্ছে দেখে চাকরটা দরজা খুলেই চিৎকার করে উঠলো। চিৎকার শুনে সতীশ এলো, সতী এলো। দেখলে, তিনি তাঁর সকল রকমের ভাবনাচিন্তা থেকে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছেন। তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
সতীশ কেঁদে আকুল হলো। সতীই তাকে সান্ত্বনা দিলে। মাথাটি তার নিজের কোলের ওপর তুলে নিয়ে বললে, এ সময় বিচলিত হয়ো না। তোমাকেই সব করতে হবে।
মন্দ লাগছিল না। তবু সতীশ উঠে বসলো।
সতী বললে, আমাকে তোমার ভাল লাগে না—আমি জানি। কিন্তু কি করব বল, কোথায় ফেলবে? দাদাদের বোঝা হয়ে ছিলাম এতদিন, সেই বোঝার ভার তোমাদের মাথায় চড়িয়ে দিয়ে তারা সরে পড়লো। কোথায় যে গেল একটা ঠিকানা পর্যন্ত দিলে না। অথচ আমি তাদের সহোদর বোন।
সতীশ উঠে যাচ্ছিল, সতী তাকে টেনে বসালো। বললে, আমার এই হার্টের ব্যারাম আজকের নয়—অনেক দিনের। আগে খুব ঘন ঘন হলে। বড়দা বলেছিল বিয়ে আমার দেবে না। ছোট বউদি বেঁকে বসলো। বললে, আমার স্বামীর রোজগার নেই, আমি ঠাকুরঝিকে রাখতে পারবো না।
বড় বউদি কিন্তু খুব ভালো। বললে, ছি ছোট-বউ, ও-কথা বলতে আছে? ও যদি তোর মেয়ে হতো? তারপর বড় বউদিই সবাইকে ডেকে বললেন, মেয়েটা কানা নয়, খোঁড়া নয়, অথর্ব নয়, অকর্মণ্য নয়, ওর-ও সাধ আছে সাধ্য আছে, যেমন করে পারো ওর বিয়ে দিয়ে দাও, যাদের বউ হবে তারাই ওর অসুখ সারিয়ে নেবে। শেষ পর্যন্ত এই এজমালি বাড়ি বিক্রি করে আমার বিয়ে হলো। এক ঘাটের জঞ্জাল আর-এক ঘাটে এসে লাগলো।
সতীশের মনের অবস্থা খুব খারাপ। আজ শুধু মিনতির কথাই তার মনে হচ্ছে। পিতৃশ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ করতে যেতে হবে সেই বাড়িতে। চিঠিখানা ডাকে পাঠিয়ে দিলেই হতো, কিন্তু মন তার কেন জানি না ছট্ফট্ করতে লাগলো মিনতির জন্যে। শুধুই মনে হতে লাগলো এতদিন সে পরাধীন ছিল, বাপের মৃত্যুর পর এখন সে স্বাধীন হয়ে গেছে।
সেদিন রবিবার। মিনতির নিশ্চয়ই কলেজের ছুটি। সতীশ ভাবলে দুপুরবেলা যাবে শ্যামবাজারে। কিন্তু নাঃ, অত্যন্ত স্পষ্ট পরিষ্কার দিনের আলো, এ সময় গিয়ে মিনতির কাছে সে দাঁড়াতে পারবে না। অপরাধীর পক্ষে রাত্রিটাই ভালো। মিনতি যদি তাকে ক্ষমা নাও করে, আলোয়-আঁধারে মেশা রহস্যময়ী মিনতিকে সে প্রাণভরে দেখে আসবে।
কাচা গলায় দিয়ে সতীশ সেদিন সন্ধ্যায় গিয়ে দাঁড়ালো তার সেই বহুদিনের পরিচিত বাড়ির অন্দরমহলে। দেখা হলো সকলের সঙ্গেই। সবার মুখেই সেই এক কথা!—বিয়ে তো সবাই করে, কিন্তু এমন কি সুন্দরী বউ হলো যে তাকে পেয়ে সারা পৃথিবীটাকে ভুলে গেলে!
মুখচোরা সতীশ মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু যার মুখ থেকে এই কথাটা শোনবার জন্যেই সে এসেছে, সে কোথায়?
শেষ পর্যন্ত মুখ ফুটে বলতেই হলো সতীশকে।—মিনতিকে দেখছি না যে!
কর্তার বড় মেয়ে—মিনতিকে যে এনেছিল এই বাড়িতে, সেই জবাব দিলে—সে হতভাগীর কথা আর বলিসনে ভাই। তাকে তাড়িয়ে দিয়েছি এখান থেকে।
—কেন?
—একদিন তার বালিশের তলায় দেখি না এই এতগুলি প্রেমপত্র। পড়তে পড়তে রাত্রে বোধ হয় বালিশের তলায় রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর মনের ভুলে সেইখানে ফেলে রেখেই কলেজে চলে গেছে। বালিশের ওয়াড়গুলো ময়লা হয়েছিল, একহাত সাবান দিয়ে দিই ভেবে যেই বালিশটা উল্টেছি, বাস্, পড়বি তো পড়্ আমার হাতেই! বললাম, নাম-ঠিকানা বল, এর সঙ্গে তোর বিয়ে দিয়ে দিই। তা সেই যে এক গোঁ ধরে বসে রইলো, নাম-ঠিকানা কিছুতেই বললে না।
সতীশ জিজ্ঞাসা করলে, কারও নাম লেখা ছিল না চিঠিতে?
সে বললে, না। প্রত্যেকটি চিঠির শেষে লেখা ছিল—ইতি, তোমারই শ্রী।
সর্বনাশ! সতীশের মাথাটা কেমন যেন ঘুরে গেল। চোখের সামনের আলোগুলো মনে হলো যেন দপদপ করে নিবে যাচ্ছে!
এ যে তারই লেখা চিঠি!
সতীশ আর সেখানে দাঁড়ালো না। দাঁড়াতে পারলে না। তরতর করে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। পেছনে কে যে কি বললে তা তার কানেও গেল না।
পিতৃশ্রাদ্ধ চুকে গেল নির্বিঘ্নে।
তার পরেই সতীশ একদিন গিয়ে দাঁড়ালো বেথুনের দরজায়। যেদিন গেল, সেইদিনই দেখা হলো মিনতির সঙ্গে।
কত ভাবনা ভেবেছিল সতীশ, কত ভয় হয়েছিল তার মনে। ভেবেছিল দেখা হলে মিনতি হয়ত কথাই বলবে না তার সঙ্গে, ভেবেছিল, মান-অভিমানের পালা চলবে কিছুদিন কিংবা হয়ত এই শেষ। বলবে, তুমি আর আমার কাছে এসো না, তোমার মুখ আমি আর দেখতে চাই না।
কিন্তু তার কিছুই হলো না। কলেজের ছুটির পর অন্য মেয়েদের পাশ কাটিয়ে একাই সে বেরিয়ে এলো বাগানের পথ ধরে। বহু দূর থেকে সতীশ তাকে চিনতে পেরেছিল। সেই তার মিনতি! সেই রহস্যময়ী তরুণী! সে যেন আরও সুন্দরী হয়েছে আগের চেয়ে। আরও উজ্জ্বল হয়েছে তার মুখশ্রী।
মিনতি মুখ তুলতেই সুমুখে দেখলে সতীশ দাঁড়িয়ে! ঠোঁটের ফাঁকে একটুখানি হেসে বললে, এসেছো?
কিছুই যেন হয়নি তাদের মধ্যে!
চলতে চলতে বললে, জানি তুমি আসবে।
সতীশ চলছে মাথা হেঁট করে তার পাশে পাশে।
মিনতি বোধ করি তার ন্যাড়া মাথার দিকে তাকিয়েই বললে, বাবা কোথায় মারা গেলেন? দেশের বাড়িতে না কলকাতায়?
কলকাতায়।
বউ কি করছে?
শুয়ে আছে।
শুয়ে কেন?
উঠে হেঁটে বেড়াতে পারছে না।
অসুখ? কখন থেকে?
বিয়ের আগে থেকে।
তাহলে ঠকেছ বল।
সতীশ জবাব দিলে না। মিনতি ডানদিকে রাস্তা ভাঙলে।
সতীশ বললে, এ দিকে?
মিনতি বললে, আমি শ্যামবাজারে থাকি না।
কিছুই যেন জানে না এমনিভাবে সতীশ জিজ্ঞাসা করলে, ওখান থেকে চলে এসেছে? কেন?
এমনিই! —মিনতি বললে, এক জায়গায় বেশিদিন ভগবান আমাকে রাখেন না।
কোথায় থাকো?
সেইখানেই তো যাচ্ছি। দেখবে চল না!
পরে দেখবো। হেদোয় একটু বসি। এমন করে চলতে চলতে কথা বলা যায় না।
চল।
দু’জনে বসলো গিয়ে হেদোর একটা গাছের ছায়ায়। সবুজ ঘাসের ওপর পা দুটি মুড়ে বাঁধানো একটি খাতা আর বইয়ের ওপর একটি হাত রেখে মিনতি বসলো সতীশের দিকে মুখ ফিরিয়ে। আর সতীশ বসলো নিতান্ত জড়সড়ো হয়ে মাথা হেঁট করে।
মিনতি বললে, ও কি? অমন করে বসলে কেন?
সতীশ তার মুখের পানে তাকালে না। বললে, তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পারো না মিনতি?
মিনতি হাসলে। হাসলে সেই রকম হাসি, যে-হাসি কান্নার চেয়েও করুণ। বললে, তুমি নিতান্ত ছেলেমানুষ! অপরাধ কি করেছে যে, ক্ষমা করবো?
সতীশ এইবার মুখ তুলে তাকালে। বললে, অপরাধ করিনি?
মিনতি বললে, না, ওটা তোমার স্বভাব। তুমি কি ইচ্ছে করলেই তোমার স্বভাব বদলাতে পারো? তুমি বাড়ি যাবার সময়েই তো আমি বলেছিলাম।
সতীশ বললে, হ্যাঁ, যা বলেছিলে ঠিক তাই হলো।
মিনতি সে প্রসঙ্গটা যেন এড়িয়ে যেতে চাইলে। বললে, পড়াটা ছাড়লে কেন?
—তুমি কি আমার সব খবরই রাখো?
মিনতি বললে, সে সময় আমার নেই। এক ভদ্রলোকের দুটি নাতনীকে পড়াতে হয়, তার ওপর নিজের পড়া, পরের খবর রাখবার সময় আমার কোথায়? —পড়া ছেড়েছো, সারাটা দিন কাটাও কেমন করে?
সতীশ জবাব দিতে ইতস্তত করছিল। মিনতি বললে, ভাবছো কি বলবে? স্ত্রীর কথাটা বাদ দিয়েই বল। সে-কথা বলতে তোমার লজ্জা হচ্ছে আমি বুঝতে পেরেছি।
সতীশ বললে, না লজ্জা নয়—তবে তার কথা কি আর বলবো। সে তো রুগী ; ডাক্তার আসছে, ওষুধ খাচ্ছে, আর আমি দিনরাত ইংরেজি নভেল পড়ছি, ইংরেজি সিনেমার ছবি দেখছি। আর—আর—আর কি যে করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
মিনতি বললে, আমি কিন্তু বুঝতে পারছি—আর কিছুক্ষণ যদি বসি এখানে, তাহলে আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে। কাজেই আজ আমাকে ছুটি দাও। আজ উঠি।
মিনতি উঠে দাঁড়ালো। সতীশও উঠলো।
হেদো থেকে বেরিয়ে একটা গলির ভেতর ঢুকে একটুখানি এগিয়ে গিয়ে পুরনো ধরনের প্রকাণ্ড একটা বাড়ির ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে মিনতি বললে, এই বাড়ি।
সতীশ বললে, আজ দেখে গেলাম। আবার আসবো। কেউ কোনও আপত্তি করবে না তো?
না। বলে মিনতি ফটক পেরিয়ে গেল।
ফটক পেরিয়েই আবার ফিরে দাঁড়ালো। ফিরে দাঁড়িয়ে একটুখানি হেসে বললে, আপত্তি করলেই-বা তোমাকে ঠেকাবো কি দিয়ে?
মিনতি দাঁড়ালো না। পিছনে ফিরে একবার তাকিয়েও দেখলে না।
সতীশের একদিকে সতী, একদিকে মিনতি।
সতীকেও ফেলতে পারে না, মিনতিকেও ছাড়তে পারে না। এ কি দুর্বহ জীবন হলো সতীশের! কিই-বা এর পরিণাম, কোথায় এর শেষ?
রোজই তার দেখা হয় মিনতির সঙ্গে। কথাও হয় রোজ। শুধু সতীর কথাটা সতীশ যথাসম্ভব এড়িয়ে যেতে চায়। বলতে গিয়েও বলতে পারে না। কোথায় যেন আটকে যায়।
অথচ ওইটিই তার আসল কথা।
মিনতিই বা কেমনধারা মেয়ে, সেই যে বলেছিল, লজ্জা যদি পাও, সতীর কথাটা বাদ দিয়ে বোলো ; সেইদিন থেকে ভুলেও সে একবার জিজ্ঞাসাও করে না—সতী কেমন আছে।
সতীকে বুঝতে পারে সতীশ, কিন্তু মিনতিকে বুঝতে পারে না। রহস্যময়ী মিনতি এখনও তার কাছে তেমনি রহস্যময়ীই রয়ে গেল।
সতীশ সেদিন আর থাকতে পারেনি। বলে ফেলেছিল মিনতিকে শুনিয়ে শুনিয়ে।—বউটা মরেও না তো!
মিনতি বলেছিল, ছি! মানুষের মৃত্যুকামনা করতে নেই। বলেছিল, নিজের হাতে যে-গাছ পুঁতেছো, তার ফলভোগ তো তোমাকেই করতে হবে।
সতীশ বলেছিল, অসহ্য হয়ে উঠেছে। আর আমি পারছি না মিনতি!
কান্নায় ভরে উঠেছিল তার কণ্ঠ।
এ যেন মিনতির কাছে তার মিনতিকাতর প্রার্থনা! —তুমি আমাকে রক্ষা কর! তুমি আমাকে বাঁচাও!
কথাটা শুনে মিনতি এমন হাসি হেসেছিল যে, সতীশ আর একটি কথাও বলতে পারেনি।
একসঙ্গে বসে সিনেমার ছবি তারা অনেকদিন দেখেনি।
সতীশ বললে, শুনছি একখানা ভাল ছবি চলছে। কাল রবিবার। কাল যাবে?
মিনতি বললে, এসো। দেখবো চেষ্টা করে।
অনেক আশা নিয়ে সতীশ গেল মিনতির কাছে। কিন্তু গিয়েই শুনলে, মিনতি বেরিয়ে গেছে। একা নয়, বেরিয়ে গেছে সবাই মিলে। বাড়ির কত্তা, কত্তার দুই নাতনী আর মিনতি।
কোথায় গেছে কেউ কিছু বলতে পারলে না।
সতীশ একাই গেল সিনেমার ছবি দেখতে।
ছবির নাম—‘প্লেস ইন দ্য সান’। চমৎকার ছবি! তার জীবনের সঙ্গে অনেকখানি মিলে যায়। থিয়োডোর ড্রেসলারের ‘অ্যান আমেরিকান ট্র্যাজিডি’ বই থেকে নেওয়া গল্পাংশ। ছবি দেখে বাড়ি ফিরতে ফিরতে শুধু এই আফসোস তার হতে লাগলো—ইংরেজি বই সে এত পড়েছে, অথচ এই বইখানি এতদিন পড়েনি কেন?
আমেরিকার এক তরুণের দুর্ভাগ্যের কাহিনী। তারই মত একজন যুবক তার স্ত্রীর জ্বালায় জ্বলে-পুড়ে মরছে। এমন দিনে সে তার এক বন্ধুর বাড়ি গেল বেড়াতে। সেখানে এক তরুণীর সঙ্গে দেখা। মনে হলো এই মেয়েটিকে যদি সে তার জীবনসঙ্গিনী করতে পারতো, তাহলে তার জীবন হয়ে উঠতো মধুময়। তার যে স্ত্রী আছে, সে-কথা সে গোপন করে মেয়েটিকে বিয়ে করবার সব ব্যবস্থাই যখন ঠিক করে ফেলেছে, এমন দিনে সেই শহরের এক হোটেল থেকে এলো এক টেলিফোন! তার স্ত্রী এসে হাজির হয়েছে সেখানে।
সর্বনাশ!
তৎক্ষণাৎ মাথায় তার এক দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল।
মস্ত বড় একটি লেক আছে সেই শহরের প্রান্তে। সেখানে নৌকো ভাড়া পাওয়া যায়। তরুণ-তরুণীরা সেখানে আসে নৌকো-বিহার করতে। সেও তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গেল সেই লেকের ধারে, নৌকো ভাড়া করলে, তারপর নির্জনে কথা বলবার জন্যে সেই নিস্তরঙ্গ লেকের জলে দিলে নৌকো ভাসিয়ে। আকাশে চাঁদের আলো। বাতাসে বসন্তের আমেজ। স্বামী শুরু করলে তার স্ত্রীর সঙ্গে প্রেমালাপের অভিনয়।
তারপর হঠাৎ এক সময় নৌকোটা দুলে উঠলো। দুলে উঠেই গেল উলটে্। স্ত্রী সাঁতার জানতো না।নৌকোর তলায় চাপা পড়ে কোথায় তলিয়ে গেল—দেখবার কোনও প্রয়োজন ছিল না তার স্বামীর। সাঁতার কেটে সে তীরে উঠলো। তারপর কাজ হাসিল করে ফেলেছে ভেবে মনের আনন্দে মিললো গিয়ে তার প্রণয়িনীর সঙ্গে।
লোকটা নিতান্ত নির্বোধ। একবারও ভাবলেও না—যে-লোকটা তাকে নৌকো ভাড়া দিয়েছিল, সে তার নৌকোর খোঁজ করবে।
তাই শেষ পর্যন্ত সে ধরা পরে গেল।
কিন্তু সতীশ এত নির্বোধ নয়।
নতুন একজন ডাক্তার এলেন সতীকে দেখতে।
সতীশ বললে, এতদিন ধরে এত চিকিৎসা হচ্ছে, এত ওষুধ খাচ্ছ, তবু তোমার রোগ সারছে না। ও ডাক্তারগুলো বোধ হয় টাকা পাবার লোভে পুষে রাখছে রোগটাকে। তাই আমি আজ অরুণবাবুকে ডেকে আনলাম। হার্ট স্পেশালিস্ট। বিলেত থেকে পাস করে এসেছেন।
সতী বললে, কেন মিছিমিছি খরচ করছে টাকাগুলো। আমার এ রোগ সারবে না।
নিশ্চয় সারবে।
নতুন ডাক্তারবাবুও সেই কথা বললেন। বললেন, খুব বেশি ওষুধ খাইয়েছেন কি?
সতীশ বললে, যেখানে যত ওষুধ আছে—সব।
ডাক্তারবাবু বললেন, আজকালকার নিয়ম হচ্ছে খুব কম ওষুধ খাওয়ানো। সাত দিনের জন্যে অন্তত সব ওষুধ বন্ধ করে দিন। সাত দিন পরে আমি আবার আসবো, এসে ওষুধ দেবো একটা।
সতীশ জিজ্ঞাসা করলে, একেবারে সবকিছু বন্ধ থাকবে?
হ্যাঁ সব।—ডাক্তারবাবু বললেন, শুধু একবার করে গঙ্গার হাওয়া খাওয়ান। রোজ সন্ধেবেলা একটা নৌকোয় করে গঙ্গার ওপর অন্তত ঘণ্টাখানেক ঘুরে আসবেন।
ডাক্তারবাবু চলে গেলেন।
কথাটা সতীরও মনে ধরলো। খোলা হাওয়ায় সে বেশ ভালই থাকে।
পরের দিন নৌকোয় চড়ে গঙ্গায় বেড়াবে। যাবার জন্যে সতী তৈরি হলো সন্ধের আগেই। রান্নার জিনিসপত্র বের করে দিলে ঠাকুরকে। ফিরতে যদি দেরি হয়। চাকরটাকে বললে, বাড়ি ছেড়ে যেন পালিয়ো না কোথাও আড্ডা মারতে! ঝিকে বললে, আমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত থেকো তুমি।
তারপর ভাল একটি জামা গায়ে দিয়ে, ভাল শাড়ি পরে সতীশের কাছে এসে বললে, চা খাওয়া হয়েছে তোমার? চল।
সতীশ ফিরে তাকালে। বা রে! সাজলে তো সতীকে মন্দ দেখায় না! বললে, তুমি একেবারে সেজেগুজে তৈরি হয়ে গেছ?
সতী বললে, হ্যাঁ, গঙ্গা পর্যন্ত হেঁটে হেঁটেই যাব তোমার সঙ্গে।
সতীশ তার দিকে তাকিয়ে ছিল একদৃষ্টে। সতী বললে, কি দেখছো অমন করে?
সতীশের ভাবনার সূত্রটা যেন ছিড়ে গেল। বললে, নাঃ, কিচ্ছু না।
সতী আর একটু এগিয়ে এলো তার কাছে।
সতীশ বললে, সাজলে তোমাকে মন্দ দেখায় না।
ম্লান একটি হাসির রেখা ফুটে উঠলো সতীর ঠোঁটের ওপর। বললে, তাও ভালো যে ফিরে তাকালে এইদিকে!
সতীশ তার জামাটা গায়ে দিলে। জানলার কাছে থমকে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবলে। তারপর বললে, নাঃ, আজ আর যাওয়া হলো না। কাল যাব। আজ আমার একটা খুব জরুরি কাজ আছে, সেরে আসি।
সতীশ আর দাঁড়ালো না, সতীর দিকে একবার ফিরেও তাকালো না, সোজা চলে গেল তার জরুরি কাজের জায়গায়।
জায়গাটা আর কোথাও নয়। বেথুনের কাছে হেদো, হেদোর কাছে একটা গলি, গলির ভেতর রায়বাহাদুর নিকুঞ্জ ঘোষালের বাড়ির তেতলায় নির্জন একখানি ঘর। মিনতির আস্তানা।
মিনতিকে কথাটা বলবার জন্যে সতীশ যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল।
বললে, সেদিন যদি যেতে আমার সঙ্গে সিনেমায়—ভারি মজা হতো।
মজাটা কি হতো, ইনিয়ে-বিনিয়ে তাকে বললে সতীশ। বললে তাকে ছবির গল্পটা।
তারপর তার এক বন্ধুকে ডাক্তার সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া।
তারপর ডাক্তারের অভিনয়!
এই বুঝি ধরা পড়ে! বলতে বলতে সতীশের সে কি হাসি!
হাসতে হাসতে মিনতির মুখের পানে যেই সে মুখ তুলে তাকিয়েছে ; মুখের হাসি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।
মিনতি গম্ভীর মুখে অন্যদিকে চেয়ে আছে। কি যেন ভাবছে।
সতীশ জিজ্ঞাসা করলে, কি ভাবছো?
মিনতি বললে, পারবে তুমি একাজ করতে?
সতীশ বললে, বুঝতে পেরেছে তাহলে?
মিনতি বললে, “হুঁ।
সতীশ বললে, আচ্ছা দেখোই না আমি কি করি! ভগবান সেদিন আমাকে যেন এই ছবিটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে!
মিনতি বললে, ভগবান তোমাকে খুব ভালবাসে দেখছি!
সতীশ বললে, কথাটা তোমার ভাল লাগছে না, আমি বুঝতে পারছি। মেয়েমানুষ তো! স্বভাবতই দুর্বল।
মিনতি বললে, তোমার চেয়েও?
সতীশ চুপ করে গেল।
মিনতি বললে, না না, তুমি একাজ কোরো না। দেখো না—কি হয়!
হবে আর ছাই! আমি আজ উঠলাম।
এই বলে সতীশ সেদিন তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেল।
মিনতি তার পিছু পিছু সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত এলো। সতীশ যেন উন্মাদ হয়ে গেছে।
মিনতিকে পাবার জন্য উন্মাদ!
পরের দিন সন্ধ্যায়। সতীকে সঙ্গে নিয়ে সতীশ গঙ্গার তীরে গিয়ে দাঁড়ালো। নৌকো ছিল একটিই। মাঝি এক বৃদ্ধ মুসলমান। এক ঘণ্টা ঘুরিয়ে আনবে। ভাড়া চেয়েছিল দু’ টাকা। সতীশ দু’ টাকা দিতেই রাজি। সতী বললে, না, দেড় টাকা।
মাঝি তাইতেই রাজি হলো।
নৌকো চললো। ধীরে-ধীরে। অত্যন্ত ধীরে-ধীরে।
সতীশ বললে, নৌকোটা জোরে জোরে চলে না বুঝি?
মাঝি বললে, ঠিক যাচ্ছে বাবুজী।
ফাঁকা নৌকো। ছই নেই।
সতীশ আর সতী—একজন বসেছিল এইদিকে, একজন ওইদিকে—দু’জন মুখোমুখি। সতীশ ঘন ঘন এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
নৌকো মাঝ-দরিয়ায় এসে গেছে। সতীশ পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে মুখে দিলে। দেশলাই জ্বালতে গিয়ে দেখলে, ক্রমাগত নিবে যাচ্ছে।
সতী বললে, যা হাওয়া!
সতীশ কিন্তু জানে, হাওয়া নয়, তার হাতদুটো কাঁপছে।
সতীশ এদিকে সরে এলো। সতীর পাশে এসে বসলো। বাঃ, চমৎকার! সতীকে-আড়াল করে দেশলাই জ্বালবে। একটা কাঠি জ্বাললে। নিবে গেল। আর-একটা। এবারও তাই। আবার একটা। এবার জ্বলেছে।
সতীশ চোঁ-চোঁ করে খুব জোরে জোরে সিগারেট টানছে। ভুলেই গেছে যে, সিগারেটের ধোঁয়া সতী সহ্য করতে পারে না।
একবার চেষ্টা করলে। পারলে না।
সতী খুক্ খুক্ করে কেসে উঠলো।
ও।—সতীশ সরে গেল নিজের জায়গায়।
মাঝি বললে, এবার ফেরাই বাবু।
সতীশ কি যেন বলতে যাচ্ছিল, সতী তার আগেই বললে, হ্যাঁ, ফেরাও। সেদিন কিছু হলো না। ফিরে এলো।
তাহলে কি মিনতি যা বলেছিল তাই সত্যি? পারবে না সে এ-কাজ করতে?
নিশ্চয়ই পারবে।
মিনতিকে দেখিয়ে দেবে সে দুর্বল নয়।
পরের দিন আবার।
আবার সেই গঙ্গা, সেই মাঝি, সেই নৌকো!
সতী আর সতীশ চলেছে মাঝ-দরিয়ায়।
আজও সিগারেট বের করলে সতীশ। আজও জ্বলছে না একটা কাঠিও। কিন্তু—
সতী বললে, আজ তো সেরকম হাওয়া নেই। তবু জ্বলছে না?
না। বলে সতীশ উঠে এলো সতীর পাশে।
দেশলাই জ্বলছে। সিগারেট ধরেছে। ধোঁয়ার জন্য এবার তার নিজের জায়গায় চলে যাবার কথা। তবু যাচ্ছে না।
সতী কি ভেবে চট্ করে ফিরে তাকালে।
কি দেখল সে?
নিজের অপকৌশল চাপা দেবার জন্যে যে-হাত দিয়ে সতীকে সে ঠেলে ফেলে দিতে গিয়েছিল, তার প্রসারিত সেই দুই হাত দিয়ে সতীর হাতদুটো চেপে ধরে বললে, হাওয়া পাচ্ছো?
সতীশের গলা কাঁপছে। হাতদুটো কাঁপছে। সে যেন ধরা-পড়া চোর। সতী একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো সতীশের দিকে।
সতীশ আর কোনও কথা বলতে পারছে না।
সিগারেটটা চোঁ-চোঁ করে টেনেই চলেছে। ধোঁয়ায় সতীর মুখ ভরে গেল।
সতীর দু’চোখ জলে ভরে এলো। বললে, বুঝতে পেরেছি। এ-কথা আমাকে তুমি আগে বলনি কেন?
এই বলে সতী তাকে একটি প্রণাম করলে।
সতীশ কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তাকে আর মুহুর্তের অবসর না দিয়ে নিজেই সে সশব্দে মাঝ-গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়লো।
সতীশ চিৎকার করে উঠলো, সতী! সতী!
বুড়ো মাঝি হাতের বৈঠা ছেড়ে দিয়ে ঝাঁপ দিলে জলে।
মাঝিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে ওদিক থেকে একটা নৌকো যেন তরতর করে ছুটে আসছে।
সতীশ দু’হাত দিয়ে প্রাণপণে নৌকোর একটা পাটাতন চেপে ধরে থরথর করে কাঁপছে।
মুহূর্তের মধ্যে কি যে হয়ে গেল, কেমন করে সে তীরে এসে পৌঁছলো, কেমন করে আরও কয়েকটা নৌকো তাদের কাছে এসে গেছে—কিছুই তার স্মরণ নেই।
বুড়ো মাঝি একা নয়, আরও অনেকে চেষ্টা করেছে সতীকে উদ্ধার করবার, কিন্তু কেউ কিছু করতে পারেনি। স্রোতের টানে সতীকে কোথায় টেনে নিয়ে গেছে কে জানে! মৃতদেহ কোথায় গিয়ে ভেসে উঠবে, তাই-বা কে বলতে পারে!
সতীশ থানায় গেল। মাঝিদের সঙ্গে নিয়ে গেল।
যা করবার সবই করলে।
অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরে এলো একা।
ঠাকুর, চাকর, ঝি—সবাই জিজ্ঞাসা করলে, মা কোথায়?
সতীশ শুধু বললে, মা নেই।
সতীর ঘরে যে বিছানা তার পাতাই থাকতো, সতীশ তার ওপর গিয়ে বসলো। বালিশটা তুলতেই তার তলায় দেখলে কয়েকটা কাগজের টুকরো, একখানা বাংলা নভেল।
কাগজে কি যেন লেখা রয়েছে। সতীর হাতের লেখা।
অনেক কিছু সে লিখেছে আর কেটেছে। সম্ভবত তাকেই সে লিখে জানাতে চেয়েছে—এক জায়গায় লিখেছে, তোমাকে বলতে পারছি না, তাই লিখে জানাচ্ছি। তুমি একটি বিয়ে কর।
সে-রাত্রে সতীশ আর মিনতির কাছে যেতে পারলে না। গেল তার পরের দিন সকালেই গেল।
যাবা-মাত্র বুড়ো রায়বাহাদুর তাকে বললেন, শোনো তো ভাই। এই ঘরে এসো।
সতীশ তাঁর ঘরে যেতেই তিনি দু’খানি খামের চিঠি দেখিয়ে বললেন, মিনতি পালিয়েছে। এই নাও তোমার চিঠি। কি লিখেছে পড়ে দেখো। খাম বন্ধ করে দিয়েছে। আমাকে লিখেছে, আমি যেমন এসেছিলাম, তেমনি চলে গেলাম। আমার খোঁজ করবেন না।
সতীশ ততক্ষণে তার নিজের চিঠিখানি খুলেছে।
মিনতি লিখেছে : তুমি যে দুর্বল নও, সেই কথাটা প্রমাণ করবার চমৎকার সুযোগ তুমি পেয়েছে। তুমি নিজেই বলেছে—মেয়েরা স্বভাবতই দুর্বল। তাই আজ আমি তোমার চেয়ে দুর্বল হয়েই রইলাম। চলে গেলাম চিরদিনের মত। আমার খোঁজ করবার বৃথা চেষ্টা কোরো না। আমাকে তুমি পাবে না।
সতীশ চিঠিখানি নিয়ে চলে এলো।
সেই থেকে সতীশ মিনতিকে খুঁজছে।
এদিকে ক্রমাগত মনে হচ্ছে, পেছনে সতীর কণ্ঠস্বর : এ-কথা আমাকে তুমি আগে বলনি কেন? সুমুখে মিনতি, পেছনে সতী!
মানুষ সামলায় কেমন করে বলতে পারেন?
১৩৬২ (১৯৫৫)