দায় – সমরেশ মজুমদার
দশ দিন হয়ে গেল মাকে দেখেনি জয়দেব। ঠিক হিসেব করলে অবশ্য ন দিন। হাউলির হাসপাতাল থেকে যখন ওরা বেলেঘাটায় পাঠিয়ে দিয়েছিল তখন জয়দেব সঙ্গে সঙ্গে ছিল। তাই। হাউলির হাসপাতালেই লোকে বলেছিল মা বাঁচবে না। তবু বেঁচে ছিল। ওখান থেকে যখন কলকাতায় পাঠিয়ে দিল তখন ডাক্তাররাই বলেছিল বাঁচা মুশকিল, বাঁচল না।
মৃত্যুর খবরটা শুনে চিৎকার করে কাঁদতে পারেনি জয়দেব। চৈত্রের মাটির মত বুকটা তখন ফেটে-ফুটে চৌচির। দশ দিন ধরে মানুষগুলোর পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে চোখের জল ফেলেছে যে তার চোখে মায়ের জন্য আলাদা করে জল থাকবে কি করে! শেষ পর্যন্ত পুলিসের বড়সাহেব চিঠি দিলেন, হ্যাঁ, মৃতদেহ গোলাপবালার ছেলের হাতে দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। হাসপাতালের বাবুও বললেন খবর এসেছে দিয়ে দেবার, ব্যবস্থা হচ্ছে।
তাই বসে আছে জয়দেব। ন দিন হল মা শুয়ে আছে লাশকাটা ঘরে। আর চরকির মত ঘুরে বেড়িয়েছে জয়দেব। দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। জমাদারকে বললে হয়তো দেখতেও দিত। কিন্তু শুধু দেখে কি হবে? কলকাতায় এনেও তো মাকে বাঁচানো গেল না। এমনকি একমাত্র পুত্র হয়েও দশ দিনেও মায়ের কাজ করতে পারল না।
হাউলি গ্রামের গোলাপবালার কোন শখ ছিল না। স্বামী মারা যাওয়ার পর অবশ্য ইচ্ছে ছিল ছেলেকে মানুষ করার, লেখাপড়া শেখানোর। হয়নি। ওসবে মাথা নেই ছেলের। দিনভর মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়ায় আর গুলি খেলে। মারধর করেও যখন শুধরে গেল না ছেলে তখন হাল ছেড়ে দিয়েছিল সে। তবে শখ না থাকলেও ইচ্ছে ছিল। গঙ্গানদীর গায়ে শরীর রাখা। তা সে ইচ্ছে মিটবে না তা জানাই ছিল। হাউলি থেকে একমাত্র শ্রীধর ঘোষের বাবাই কালীঘাটের শ্মশানে যাওয়ার ভাগ্য করেছিলেন। প্রচুর পয়সা ছিল তাঁর। গোলাপবালার পাঁচ বাড়িতে বাসনমাজার আয় মাস ঘুরতেই ফুরিয়ে যায় তার আবার ইচ্ছে মিটবে! ছেলের বয়স যখন সতেরো হল তখন দিনরাত সে গালমন্দ শুরু করল। যা হোক একটা কাজ জুটিয়ে নেওয়ার জন্যে। কোন বদগুণ নেই, আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মতই তবু কেন যে কাজ করতে ইচ্ছে করে না ওর! আর এসব ভাবতে ভাবতে গোলাপবালা একদিন ভোরে কাজে যাবার সময় চৌমাথায় লরি চাপা পড়ল।
ঘুমুচ্ছিল জয়দেব। খবর পেয়ে দৌড়ে চৌমাথায় গিয়ে সে জমে গেল। মেলা বসে গেছে সেখানে। বৈকুণ্ঠ ডাক্তারের দাওয়ায় গোলাপবালা শুয়ে আছে। রক্তের বান ডেকেছে পা থেকে। খুব জোরে ছুটছিল লরিটা। টাল সামলাতে না পেরে পাশের মাঠে নেমে পড়ার মুখে গোলাপবালাকে ঠেলে দেয়। দেওয়ার সময় পা দুটোয় চাকার ঘষ্টানি লাগে। হাউমাউ করে কেঁদেছিল জয়দেব। এ সংসারে মা ছাড়া কেউ নেই তার। ইদানীং যতই গালমন্দ করুক, রাত্তিরে মায়ের শরীর ছুঁয়ে না শুলে জয়দেবের ঘুম আসে না। গোলাপবালার শুকনো দেহটা থেকে অদ্ভুত একটা গন্ধ বের হয়।
বৈকুণ্ঠ ডাক্তার রক্ত বন্ধ করতে পারেনি। রিকশায় চাপিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেল সবাই। হাউলির হাসপাতালে সবাই টাটকা ওষুধ নিতে যায়। রাত কাটালে অসুখ সারে না বলে একটা বদনাম আছে। কিন্তু রাত কাটল গোলাপবালারও তবে ডাক্তারবাবু বললেন অবিলম্বে কলকাতার বেলেঘাটায় নিয়ে যাও। ধনুষ্টঙ্কার হয়ে গেছে গোলাপবালার। হাত-পা বেঁকতে শুরু করেছে এর মধ্যেই।
লরিটা কিন্তু হাওয়া হয়ে গিয়েছিল গোলাপবালাকে শুইয়ে দিয়ে। যারা দেখেছিল তারা বলল চৌধুরীবাবুদের লরি। চৌধুরীবাবু বললেন, ‘অত্যন্ত অন্যায়, অবশ্যই অন্যায় হয়েছে। খবর পেয়েই আমি ড্রাইভারকে ছাড়িয়ে দিয়েছি। তা শোন খোকা, তোমার এখন প্রধান কর্তব্য মাকে বাঁচিয়ে আনা। চিকিৎসার যেন কোন ত্রুটি না হয়। যা লাগে আমি দেব। পাঁচজনে কুপরামর্শ দেবে সেসব কানে নিও না। কি বললে? শরীর বেঁকছে? বেলেঘাটায় নিয়ে যেতে হবে। সে তো অনেক দূর। তা হোক, বাঁচাতে হবে নিশ্চয়ই। নীলকণ্ঠকে বলে দিচ্ছি, সে টেম্পো করে পৌঁছে দেবে। পকেটে বিশ টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন চৌধুরীবাবু কাজ চালানোর জন্যে। অতটা পথ মাকে কিভাবে তারা নিয়ে এসেছিল ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। পা-কাটা শরীরটাকে সোজা রাখাই মুশকিল ছিল।
কলকাতা শহর প্রথম দেখল জয়দেব। একদম সিনেমার মত। কিন্তু চোখ দুটো তখন এমন ঘোলাটে যে কিছুই নজর হল না। রাত কাটল না গোলাপবালার। নীলকণ্ঠদার সঙ্গে সঙ্গীরা ফিরে গিয়েছিল পৌঁছে দিয়েই। হাসপাতালের সামনে রাত জেগে ভোরে খবর পেল জয়দেব, গোলাপবালা নেই। ধক্ করে উঠেছিল বুক। মুচড়ে মুচড়ে উঠেছিল। কিন্তু হাউমাউ করে কান্নাটা গলা অবধি এসে থমকে যাচ্ছিল। মা নেই! এ সংসারে সে এখন একা, একদম একা। মাথার ভেতরটা তখন ফাঁকা, সাদা দেখছে চারধার। ঠিক তখনই হাসপাতালের বাবু ডেকে পাঠাল।
ভরতির সময় বলা হয়েছিল অ্যাক্সিডেন্ট কেস। কিন্তু হাউলি থানা জানাচ্ছে সেখানে কোন অ্যাক্সিডেন্টই হয়নি গত সাত দিনে। তাহলে?
কথাটা মাথায় ঢুকল না প্রথমে। চৌমাথার সবাই দেখেছে চৌধুরীবাবুদের লরি মাকে শুইয়ে দিল আর থানা থেকে খবর দিল কিছু জানে না। জয়দেবের বিড়বিড়ানিকে পাত্তা দিল না হাসপাতালের বাবু। বলল, ‘এখন বডি ছাড়া যাবে না। অ্যাকসিডেন্ট কেস অথচ অ্যাকসিডেন্টই হয়নি। মার্ডার-ফার্ডারও তো হতে পারে। লোকাল থানা থেকে বড়ি আটকাতে বলেছে। তোকে খুঁজতে এখনই সেপাই আসবে।’ অসাড় হয়ে গেল জয়দেব। মার্ডার কথাটার মানে সে জানে। লোকটা বলে কি? নিজের মাকে সে খুন করবে? হাসপাতালের বাবু বোঝাল, এমনও হতে পারে পুলিস ভুল করেছে। মানুষ মাত্রই ভুল করে। কিন্তু সেটা যে ভুল তা প্রমাণ করা দরকার। না হলে দোষ না করেও অনেকে সারা জীবন জেলে পচে মরে। এখন পুলিস যদি প্রমাণ করতে পারে অন্য কোন লোভে সে নিজের মাকে খুন করেছে তাহলে জজসাহেব ছেড়ে কথা বলবে? তারচে’ জয়দেব এখন চুপচাপ হাউলিতে ফিরে যাক। গিয়ে সেখানকার থানা থেকে ধরে কয়ে যদি সত্যি কথাটা লিখিয়ে আনতে পারে তবেই ঝামেলা মিটবে, না হলে নির্ঘাত হাজতবাস। অ্যাকসিডেন্টাল ডেথ্ হলেই করোনারের কাছে যাবে, সে অনেক হ্যাপা। হাউলি থেকে ঘুরে না আসা পর্যন্ত লাশকাটা ঘরে থাক গোলাপবালা, কোন চিন্তা নেই।
চোরের মত হাউলিতে পালিয়ে এল জয়দেব। চৌমাথায় নেমে দেখল কোন পরিবর্তন নেই। লরিটা যে মাকে মেরে ফেলল তা যেন কেউই মনে রাখেনি। জীবন স্বাভাবিক সর্বত্র। বৈকুণ্ঠ ডাক্তার চুক চুক শব্দ করল, ‘বউ গেলে বউ পাবি রে, গর্ভধারিণী কি আর ফিরে আসে! তা বাছা, কাছা নিস নি এখনো?’
জয়দেবের কান্না পেল, চোখে জল এল না। সমস্যার কথা বলল। শুনে বৈকুণ্ঠ ডাক্তার বলল, ‘থানায় যা বড়বাবুকে ধর। না, ধরে লাভ নেই। কেউ তো ডায়েরি করেনি। পুলিস এলে সাক্ষি দেবে না কেউ। তবু যা, যেতে হয়।’
বড়বাবু কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন, ‘কি বললি, লরি চাপা পড়েছে? নাম কি? অ। কবে? দু দিন হল! কেউ বলেনি তো! ও হ্যাঁ, আমি তো তাই রিপোর্ট পাঠালাম, অ্যাকসিডেন্ট হয়নি। অ্যাঁ, টেঁসে গেছে। যা বাব্বা। ঝামেলা বাড়ল। ও বিধু, এদিকে এসো হে, এ ছোঁড়াকে নিয়ে একবার স্পটটা ঘুরে এসো তো।’
বিধুবাবু, ছোট দারোগা, সব শুনছিল। সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে চলতে বলল, ‘এ সব করে কি লাভ? চৌধুরীদের সঙ্গে কেস লড়তে পারবি? লড়লে তোর মায়ের প্রাণ ফিরে পাবি! সাক্ষি দেবে কেউ? নান্। বরং চৌধুরীবাবু যদি বলে তুই করেছিস কাজটা তো সবাই বলবে তাই ঠিক। তার চাইতে মাথা ঠাণ্ডা কর। যে যায় সে আর ফিরে আসে না। যারা থাকে তাদের সঙ্গে ঝামেলা করে কি লাভ? এক কাজ কর, সোজা চৌধুরীবাবুর কাছে চল, একটা বিহিত হবে।’ লোকটা বেশ ভালমানুষের গলায় কথা বলল। একটা কিছু বিহিত করা দরকার বুঝতে পারছিল জয়দেব। মাকে মেরেছে চৌধুরীবাবুর লরি, কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারে নিশ্চয়ই। ছোট দারোগাবাবু বলল, ‘অনেকে অনেক কুমতলব দেবে, একদম শুনবি না। ক্ষতিপূরণ, মামলা করা এসব বলবে। আরে যারা বলবে তারাই দেখবি প্রয়োজনের সময় হাওয়া হয়ে গেছে।’
চৌধুরীবাবু বললেন, ‘চলে গেল মেয়েছেলেটা! আহা, কে যেন বলছিল ভারি ভাল বাসন মাজতো। কি করবি ছোঁড়া, মা তো আর কারো চিরকাল থাকে না।’ চুক চুক শব্দ করলেন তিনি বৈকুণ্ঠ ডাক্তারের মত।
ছোট দারোগাবাবু বলল, ‘ও একটা বিপদে পড়েছে স্যার।’
চৌধুরীবাবু বললেন, ‘বিপদই বটে, মাতৃদায় বলে কথা।’
ছোট দারোগাবাবু বলল, ‘সে তো ঠিকই। কিন্তু তারা তো কোন খবর পাইনি, মানে ডায়েরি করেনি কেউ। তাই হাসপাতালকে বলেছি অ্যাকসিডেন্ট হয়নি। তাই শুনে ইনজুরি কেস বলে হাসপাতাল বলছে বডি ছাড়বে না। এ বেচারাকে টানা-হ্যাঁচড়া করবে, এই আর কি!’
চৌধুরীবাবু চোখ কপালে তুললেন, ‘সে কি কথা, বডি ছাড়বে না? আমাদের হাউলির মেয়েছেলেকে আটকে রাখবে!’
ছোট দারোগাবাবু বলল, ‘মানে দাহ করতে দেবে না।’
চৌধুরীবাবু বললেন, ‘ভারি অন্যায়। তা তোমরা আমায় একটু জিজ্ঞেস করলে পারতে কি রিপোর্ট দেবে। বলতে পারতে গাছ-ফাচ থেকে পড়ে গেছে, চুকে যেত।’
ছোটবাবু বলল, ‘না স্যার, ওই পা দেখলেই বোঝা যায় রান-ওভার কেস, পড়লে ওরকম হয় না।’
চৌধুরীবাবু বললেন, ‘তা রান-ওভারই লিখতে। হাজারটা গাড়ি ছুটছে রাস্তা দিয়ে। যে-কেউ মেরে পালিয়ে যেতে পারত, তোমরা সব কেস ধরতে পারো? তাই লিখে দাও।’
ছোট দারোগাবাবু বলল, ‘তা হয় না আর। মানে একবার লিখলে আর পাল্টানোটা আইনসম্মত, মানে অসম্মানের ব্যাপার।’
চৌধুরীবাবু বললেন, ‘বাজে কথা রাখো তো। ভুল সংশোধন মানে রেক্টিফিকেশন কথাটা ডিকশনারিতে আছে কেন? সময় নিয়ে লেখ, আজই লিখতে হবে তার কোন মানে নেই।’
পরদিন ফিরে এল জয়দেব কলকাতায়। ছোট দারোগাবাবু বলেছেন কোন চিন্তা নেই। ভুল স্বীকার করে তিনি রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন। হাসপাতালে এসে খবরটা দেবার আগেই সিপাই তার হাত ধরল। জয়দেব যত বোঝায় কে শোনে কার কথা। ক’দিন লকআপে থেকে শেষে ছাড়া পেয়েছে আজ। হাউলি থেকে রিপোর্ট এসেছে গোলাপবালা গাড়িচাপা পড়েছিল। চালক গাড়ি নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে, ধরা যায়নি।
চৌধুরীবাবু সেবার দিয়েছিলেন বিশ এবার একশ। বলেছিলেন, ‘মায়ের কাজ করে ফিরে আয় হাউলিতে, আমি তো আছি, কোন চিন্তা নেই তোর।’
সেই টাকাটা এখনও আস্ত আছে। থানার সেপাই দুটো টাকা নিয়েছিল মাত্র। কিন্তু এখনও তার পকেটে একশ দু’-তিন টাকা রয়ে গেছে। হাসপাতালের বাবু বলেছে দশ টাকা দিতে হবে। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট নিয়ে যাতে কোন ঝামেলা না হয় সেই জন্যে।
একটা ঝিমুনি এসেছিল। শরীর আর সোজা থাকতে পারছে না। জয়দেব চোখ মেলে দেখল বেলা গড়িয়ে আসছে। হাসপাতালের বাবু বলেছিল সময় হলেই ডাকবে, ডাকছে না কেন? জয়দেব উঠল।
বাবুর সামনে বেজায় ভিড়। লোকগুলো খুব চেঁচাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে ওদের খুব তাড়াতাড়ি আছে। বাবুও যেন ওদের খুশি করার জন্যে খুব চেষ্টা করছেন। ওই ভিড় ঠেলে নিজের কথা বলার সাহস পেল না জয়দেব। চুপচাপ এককোণে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল ওদের কাণ্ড। এই কয়দিনে লকআপে বসে সে অনেক দেখেছে। দশ দিন আগের প্রথম কলকাতায় আসার সঙ্গে এখনকার দেখার কোন মিল নেই। সে বুঝতে পারছিল এই লোকগুলো খুব বড়লোক। তাদের কেউ আজ সকালে মারা গেছে। ডেডবডি পাওয়ার ব্যাপারে কোন দেরি ওরা সহ্য করতে পারছে না। এই নিয়ে কত রকমের চোখরাঙানি চলতে চলতে হঠাৎ সব শান্ত হয়ে গেল। কেউ মারা গেছে অথচ ওদের ভাবভঙ্গীতে সেটা একদম বোঝা যাচ্ছে না। কাজ হাসিল করে ওরা চলে গেলে বাবু রুমাল দিয়ে মুখ মুছল। কিন্তু তাকে একটুও বিরক্ত দেখাচ্ছিল না।
জয়দেবকে দেখতে পেয়ে বাবু চিনতে পারল, ‘আয়। এবার তোর কাজটা করে দিই। উঃ, বড়লোকের ছেলে মরলে হাজার ঝামেলা।’ জয়দেব দেখল কাগজের আড়ালে বাবু কিছু লুকোল। তারপর খসখস করে কিছু লিখে বলল, ‘দে। জয়দেব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। বাবু হাসল, ‘কথাটা মনে নেই? মনে ছিল। দশটা টাকা দিতেই একটা কাগজ তৈরি হয়ে গেল। বাবু বলল, ‘ব্যাস। আর কোন ঝামেলা নেই। যা, এখন মনের সুখে তোর মাকে দাহ কর। আমি এখনই অর্ডার পাঠিয়ে দিচ্ছি। মর্গে চলে যা।’
বেলেঘাটায় লাশকাটা ঘর নেই। শেয়ালদার কাছে সেটা। ক’দিন ঘুরে ঘুরে পথ চেনা হয়ে গেছে। কিন্তু চেনা হলেও পথ হাঁটতে ভারি ভয় করে জয়দেবের। প্রতি মুহূর্তে মনে হয় গাড়িগুলো গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বলে। খিদে পেয়েছে খুব। হাসপাতালের সামনে ফুটে-বসা দোকান থেকে আলুরদম রুটি খেয়ে নিল সে। কলকাতায় খুব সস্তায় নানান রকম খাবার পাওয়া যায়।
লাশকাটা ঘরের অফিস থেকে অনুমতি পাওয়া গেল। জয়দেব মাকে নেবার জন্যে এগিয়ে যেতেই দেখল খুব ধুমধাম করে গাড়ি সাজিয়ে সেই বাবুগুলো হরিধ্বনি দিতে দিতে একটা মড়া নিয়ে যাচ্ছে। তাহলে ওদের বাড়ির ছেলেরও ধনুষ্টঙ্কার হয়েছিল। কিন্তু কেউ কাঁদছে না কেন? কেন অমন চিৎকার করে হরিধ্বনি দিচ্ছে!
মৃতদেহ চলে গেলে ওদের দেখতে পেল জয়দেব। গোল হয়ে টাকা গুনছে। এদের চেহারা হাউলির হাসপাতালের লোকগুলোর মতনই। নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করার পর জয়দেবকে দেখতে পেল ওরা। চেহারায় মালুম হল নেহাতই সে ফালতু পার্টি। গা করল না ওরা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে জয়দেব বুড়ো মতন একজনকে ধরল।
লোকটি জিজ্ঞাসা করল, ‘কদ্দিনের মড়া?’
‘মা দশ দিন হল মারা গেছে।’
‘দশ দিনের মড়া? ওরে বাব্বা, গলে পচে ফুটবল হয়ে গেছে। দাঁড়াও, অর্ডারটা নিয়ে আসি।’ অফিসঘরের দিকে লোকটা চলে যেতে জয়দেব হতভম্ব হয়ে গেল। মা পচে গেছে? সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল মড়া বাসি হলে শরীরে পচন আসে। একবার হাউলির নদীতে একটা পচা মড়া ভেসে এসেছিল। কি দুর্গন্ধ! মা কি সেরকম হয়ে গেছে? বিশ্বাস করতে কষ্ট হল জয়দেবের। মায়ের যে ছবিটা মনের মধ্যে খোদাই হয়ে আছে সেটাকে আঁকড়ে ধরে থাকল।
লোকটা ফিরে এসে বলল, ‘বাসচাপা কেস। পা দুটো নেই? বাইশ নম্বর। দশটা টাকা বের করো।’
‘দশ টাকা? কিসের জন্যে?’
‘খুব কম করে বললাম তোমার চেহারা দেখে। আমরা পেয়ে থাকি।’
‘কেন?’
‘আঃ, এ তো খুব ফ্যাচাং করে। ঘর থেকে ওটাকে টেনে বের করতে হবে না? যা গন্ধ তাতে দশ টাকা তো বহুৎ কম বলেছি। এই একটু আগে যারা মড়া নিয়ে গেল তারা পঞ্চাশ টাকা দিয়ে গেল। হেঁ হেঁ। বউনি হয়ে গেছে বলে তোমায় কম বলছি।’ লোকটা ফোকলা দাঁতে হাসল।
মায়ের শরীরটাকে বাইরে বের করে দেবে বলে লোকটা টাকা চাইছে? এই কাজটার জন্যে নিশ্চয়ই ও মাইনে পায়! মাথা গরম হয়ে গেল ওর। কলকাতায় আসার পর ক্রমশ ওর মনে হচ্ছিল চারধারে শুধু শকুনের মেলা। সুযোগ পেলেই এরা ঠোকর মারে। সে মাথা নাড়ল, ‘না, আমার টাকা অত সস্তা না। গরিব মানুষ দেখেও তোমাদের মায়া হয় না?’
‘হয়। সেই জন্যেই দশটা টাকা চাইলাম। ঠিক আছে, বলছ যখন, পাঁচটাই দাও।’
মাথা নাড়ল জয়দেব। না, এ কাজে সে টাকা দেবে না। তার পকেটে এখন মাত্র বিরানব্বুই আছে। সামনে কত খরচ। মাকে শ্মশানে নিয়ে যেতে হবে, দাহ করতে হবে। কলকাতার রীতিনীতি সে কিছুই জানে না।
লোকটা হ্যা হ্যা করে হাসল, ‘তাহলে যাও, নিজের মাকে নিজেই বের করে আনো। কত ধানে কত চাল টের পাবে বাছাধন।’
জেদ চেপে গেল জয়দেবের। তাই করবে সে। মায়ের শরীরটা তো পাখির মত হালকা। সে নিজেই কোলে করে বের করে নিয়ে আসবে। ছেলে হয়ে সে এটুকু করতে পারবে না! লোকটা মিটিমিটি হাসছে এখন। বলল, ‘ওই ঘর, দেখবে পায়ে লকেট ঝোলানো আছে তাতে নম্বর লেখা। ও হ্যাঁ, তোমার মায়ের তো আবার পা নেই, হাতে লাগানো হয়েছে। বাইশ নম্বর। দেখো আবার অন্য মড়া বার করে এনো না।’ লোকটার হাসি যেন থামছিল না।
জেদে মানুষ অন্ধ হয়। পঙ্গু পাহাড় ডিঙোয়। জয়দেব সোজা বারান্দায় উঠে গেল। ও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল লোকটা আরো দু’তিন জনকে ডেকে তাকে দেখিয়ে হাসছে। রাগে মাথা ঝিমঝিম করছিল।
দরজা ঠেলতেই ভক্ করে একটা চিমসে অথচ তীব্র গন্ধ নাকে এল। যেন কেউ তাকে আচমকা ধাক্কা দিয়ে ছিটকে সরিয়ে দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে ঘরে ঢুকে পড়তেই গন্ধটা তীব্র হয়ে ঢেউয়ের মত তাকে জড়িয়ে ধরল। প্রাণপণে নিজেকে ঠিক রাখতে চেষ্টা করে চোখ চাইল জয়দেব। সামনে সার সার শরীর পড়ে আছে। ফুলে ফেঁপে বেটপ শরীর। মুখ দেখে কিছুই চেনা যায় না। সবাইকে এক দেখায়। চকিতে পায়ের কথা মনে পড়তেই গোলাপবালার শরীরটাকে সে দেখতে পেল। ও কি তার মা? সেই শীর্ণ গোলাপবালা? এক পা এগোতে গিয়েই মাথা ঘুরে গেল জয়দেবের। পেটের ভেতরটা গোলাচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সামনের একটি মৃতদেহের বীভৎস মুখের দিকে তাকাতেই তার মনে হল সে পড়ে যাবে, চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে আসছে। হঠাৎ পেছন থেকে একটা আকর্ষণ অনুভব করল সে। কেউ যেন তাকে টেনে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। চারধারে আলো, নির্মল বাতাস, জয়দেব ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে লাগল। রুটি আলুরদমগুলো সবেগে বেরিয়ে এল পেট থেকে। সমস্ত শরীরে ঘাম, ঝিমঝিমে অবস্থা। সেই মুহূর্তেও কানে এল কারা খ্যা খ্যা করে হাসছে। চোখ তুলল সে কোন রকমে।
ওর মাথার ওপর নীল আকাশ। ফুরফুরে হাওয়ায় ঘাম শুকোচ্ছে। চেতনা ফিরে এলেও বোধ কেমন অস্বচ্ছ হয়ে রইল খানিকক্ষণ। বুড়োটা জিজ্ঞেস করল, ‘মাতৃদর্শন হল?’
‘একদম বিশ্বরূপ দর্শন।’ আর একজন টিপ্পনী কাটল।
‘যাকে যা মানায় তাকে তাই করতে দেওয়া উচিত। এ হল বাবা বিধাতার নিয়ম। চল্লিশ বছর শুধু শুধু এখানকার বাতাস শুঁকলাম! আমি না ঢুকলে তো তুমি মায়ের পাশে শুয়ে থাকতে এতক্ষণ! আবার তেজ কত! নাকি আমার মা আনব। আজব! আরে প্রাণ গেলে সব মানুষই মড়া হয়ে যায়। দাও পাঁচটা টাকা।
একটুও প্রতিবাদ করল না জয়দেব। পকেট থেকে টাকাটা বের করে মাটিতে রাখল। উবু হয়ে বসেছিল সে, শরীর এখনও অবসন্ন। লোকটা টাকাটা নিতেই আর একজন বলল, বডি তো বের করে দিচ্ছ, শ্মশানে নিয়ে যাবে কে? এ ছোঁড়ার সঙ্গে তো আর লোকজন দেখি না।
বুড়ো জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার সঙ্গে আর কেউ নেই?’
ঘাড় নাড়ল জয়দেব, না।
‘তাহলে পোড়াতে নিয়ে যাবে কি করে! যা বাবাঃ। ডেডবডি বের করে রাখলে তো এখানে কেউ টিকতে পারবে না। কি করা যায় বল তো?’ সঙ্গীদের দিকে তাকাল লোকটা। এই মুহূর্তে তাকে খুব নরম দেখাচ্ছিল।
জয়দেবকে ঘিরে ওরা কিছুক্ষণ আলোচনা করল। তারপর একজন এসে শুধোল, ‘পকেটে টাকা-পয়সা আছে?’
জয়দেব তাকাল। লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কত?’
‘পঞ্চাশ।’
‘কেন?’
‘তাহলে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা হতে পারে।’
বুড়ো লোকটা এবার বুঝিয়ে বলল। কাছাকাছি শ্মশান বলতে নিমতলা ঘাট। তা সেখানে তো আর জয়দেব একা নিয়ে যেতে পারবে না মাকে। ও রকম পচা ধনুষ্টঙ্কারের মৃতদেহকে কাঁধে করে নিয়ে যেতে দেবেও না পাবলিক। একটাই উপায় আছে গাড়ি ভাড়া করা। ওদের জানাশোনা একটা টেম্পো আছে, তার ড্রাইভারকে ধরে কয়ে রাজি করানো যেতে পারে। তা যত কমই হোক টেম্পোওয়ালা পঞ্চাশ টাকার নিচে রাজি হবে না, ওই রেট।
জয়দেব তখন কিছুই ভাবতে পারছিল না। খুব দ্রুত হাঁটতো মা। তরতর করে। পাখির মত হালকা শরীর নিয়ে খাটতে পারত খুব। তার কি চেহারা হয়েছে এখন! জয়দেবের মনে হল আর বেশিক্ষণ মায়ের শরীরটা পৃথিবীতে রাখলে তার পাপ বেড়ে যাবে। পকেটে যে টাকা আছে তার বিনিময়ে—। সে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। বুড়ো লোকটা সঙ্গীকে টেম্পোর সন্ধানে পাঠিয়ে দিয়ে কোমর থেকে গামছা খুলে মুখে জড়িয়ে নিল। তারপর সদর্পে লাশকাটা ঘরে ঢুকে গেল। উবু হয়ে বসে তাকিয়েছিল জয়দেব। খানিক বাদেই দেখতে পেল বুড়ো দড়ি বেঁধে গোলাপবালাকে টেনে বের করে আনছে বাইরে। দরজা বন্ধ করে দড়িটা খুলে নিয়ে বুড়ো এগিয়ে এসে বলল, ‘শরীরে আর কিছু নেই।’
উঠে দাঁড়িয়েছিল জয়দেব। আচমকা একটা কটু গন্ধ নাকে লাগল। এত কটু যে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। খোলা আকাশের নিচে বলে কোন রকমে সে সামলে নিল। তারপর এক-পা এক-পা করে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ফুলে ঢোল হয়ে গেছে গোলাপবালা। নগ্ন শরীরে কোন রকমে একটা কাপড় জড়ানো। মুখ চেনা যাচ্ছে না, কিন্তু পা-দুটো মুড়িয়ে কাটা। সেই কাটা জায়গাটা বীভৎস দেখাচ্ছে। চুলগুলো জট পাকিয়ে গেছে, চামড়া ফুলে যাওয়ার জন্যেই টানটান হয়ে গিয়ে কেমন সাদাটে ভাব এসে গেছে। মুখ হাঁ হয়ে থাকায় ভাল করে তাকানো যাচ্ছে না। এ কি গোলাপবালা? তার মা! নরম ছোট্ট শরীরে যার মায়াময় গন্ধ বের হত। জয়দেবের সমস্ত শরীর পাক দিচ্ছিল। সে অবিশ্বাস নিয়ে আর একবার তাকাতেই বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা দেখতে পেল। গোলাপবালার ওই আঙুলটা কাটা ছিল, এরও আছে।
জয়দেব কখন নিজের অজান্তে গোলাপবালার কাছ থেকে সরে এসেছে সে নিজেই জানে না। দশ দিন ধরে যে টানাপোড়েন চলছিল বুকের মধ্যে তা যেন হঠাৎই থমকে গেল। এই চেহারা দেখার পর সে যেন কিছুতেই জীবন্ত গোলাপবালাকে স্মরণ করতে পারছে না। বুড়ো বলল, ‘মানুষের শরীর মাটির চাইতেও কমজোরী। ক’দিনেই দ্যাখো গলে হেজে গেল। অথচ ওই শরীরে তুমি দশ মাস শুয়েছিলে। যেই প্রাণ ফুড়ুত হয়ে গেল অমনি ভালবাসা মরে গেল। তা যাক, এখন কথা হল একে তুমি নিয়ে যাবে কি করে, যা গন্ধ ছড়াচ্ছে!’
এই সময় ঘটাং ঘটাং করে একটা টেম্পো এসে হাজির হল। টেম্পোওয়ালা চিমড়ে ধরনের, মাথায় একগাছিও চুল নেই। গাড়ি থেকে নেমেই চিৎকার করে উঠল, ‘ওরে বাপ, কি দুর্গন্ধ। না না আমি পারব না নিয়ে যেতে, ওরে ব্বাস, অন্নপ্রাশনের ভাত বেরিয়ে আসছে, ওয়াক্।’
বুড়ো ছুটলো। টেম্পোওয়ালার কাছে গিয়ে হাত-পা নেড়ে জয়দেবকে দেখিয়ে কিসব বলতে লাগল। টেম্পোওয়ালা তখনও মাথা নেড়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত লোকটা চিৎকার করে উঠল, ‘সত্তর টাকার নিচে আমি নিতে পারব না। ও মড়া নিয়ে গেলে গাড়ি ধুতে হবে।’
বুড়ো ছুটে এল জয়দেবের কাছে, ‘শুনলে তো কথা। আমি বলি কি ওতেই রাজি হয়ে যাও। মাতৃদায় বলে কথা।’
জয়দেবের মনে হল বুড়ো নিশ্চয়ই এককালে তার আত্মীয় ছিল। এত ঝামেলা লোকটা যে তার জন্যে সামলাচ্ছে তাই সে কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল। তার পকেটে এখন সাতাশি টাকা রয়েছে। সত্তর যদি চলে যায় তাহলে দাহ খরচ কিসে হবে? বুড়ো বলল, ‘শ্মশান হল যাওয়ার রাস্তা। একবার সেখানে পৌঁছে গেলে কেউ কি পড়ে থাকে? কিন্তু এই গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে গেলে পাবলিক তোমাদের ঢিল মারবে। দাঁড়াও, ব্যবস্থা করছি। পাঁচটা টাকা ছাড়ো।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেঁড়া কাপড়ে প্রায় মুড়ে দিল বুড়োটা। তারপর একটা বোতল থেকে খানিকটা তরল পদার্থ ঢেলে দিল শরীরে। দিয়ে বলল, ‘গন্ধ লাগছে আর?’ জয়দেব বুঝল আর একটা চড়া গন্ধ নাকে আসছে। ওষুধ ওষুধ। বুড়ো যখন শরীরটাকে টেম্পোয় তুলে দিল তখন ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, ‘রস গড়াচ্ছে নাকি? তাহলে কাগজ পেতে শোওয়াও।’
বুড়ো বলল, ‘রাখো, বললে তো গাড়ি ধুয়ে ফেলবে।’
ড্রাইভার জয়দেবকে বলল, ‘অ্যাই, তুমি বডির পাশে গিয়ে বস। পাবলিক প্যাঁদালে তুমি বুঝবে। তাছাড়া মড়া ছুঁয়ে থাকতে হয়।’
গাড়ি ছাড়ার আগে ড্রাইভার বুড়োর সঙ্গে কিছু কথা আলাদা বলে এলে বুড়ো বলল, ‘যাও বাছা, মায়ের কাজ করো। বল হরি, হরিবোল।’
কলকাতা শহরের ওপর দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। মায়ের শরীর ছুঁয়ে বসেছিল জয়দেব। এখন দুটো গন্ধ পাশাপাশি নাকে ঠেকছে। সে মায়ের শরীরটাকে দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু চুলগুলো বাইরে বেরিয়ে আছে। আঙুলে চুল স্পর্শ করতেই অদ্ভুত অনুভূতি হল। ছেলেবেলায় মা ঘুমুলে এই চুলে মুখ ডুবিয়ে থাকত, ঘুম ভেঙে গেলে মা চেঁচাত। নারকেল তেলের গন্ধটা অদ্ভুত মিষ্টি লাগত তখন। এখন চুলগুলো লালচে, খসখসে।
ঘাড় ঘুরিয়ে জয়দেব ট্রাম-বাস দেখল। এবং তখনই চোখে পড়ল দু’পাশের মানুষজন নাক চাপা দিচ্ছে। ড্রাইভার খুব তাড়াতাড়ি চালাবার চেষ্টা করলেও লোকজনের মুখে বিরক্তিটা চোখ এড়াল না। যেন কলকাতা শহরকে অপবিত্র করছে গোলাপবালা। পাশে দাঁড়ানো একটা বাসের যাত্রীরা চিৎকার করে গালাগালি শুরু করল নাক টিপে। ভয়ে সিঁটিয়ে গেল জয়দেব। লোকগুলো যদি তাকে মারে! ছেলে হয়ে সে মায়ের শরীরটাকে কেন পচতে দিল। গোলাপবালার ওপর তার ক্রমশ রাগ হতে লাগল। কি পাপ করেছে সে যে মরে গিয়েও মা তাকে এমন যন্ত্রণা দিচ্ছে! প্রাণ বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই তো মা আর এই শরীরটায় নেই। আকাশ থেকে নিশ্চয়ই মজা দেখছে এখন। টেম্পোটা লাফিয়ে উঠতেই গোলাপবালার শরীরটা নড়ে উঠল। চমকে উঠল জয়দেব। তারপর আঁকড়ে ধরল দেহটাকে। তারপর চোখ বন্ধ করে বসে থাকল। মায়ের বড় শখ ছিল কলকাতা দেখার, কালীঘাট দেখার। মা, আমরা গাড়ি করে কলকাতার ওপর দিয়ে যাচ্ছি। চোখ বন্ধ থাকায় জয়দেব টের পেল না যে সে চিৎপুর পেরিয়ে যাচ্ছে।
শ্মশান তো নয়, মেলা বসে গেছে চারধারে। টেম্পোওয়ালা পুরো টাকা গুনে নিয়ে চলে যাওয়ার পর ওদের ঘিরে ভিড় জমে গিয়েছিল। সবাই নাকে হাত চেপে কি দেখতে চায়। একজন বলল, ‘কদ্দিন? ওরে বাবা, দশ দিনের মড়া পোড়াতে গেলে তো কাঠে কুলোবে না, টায়ার লাগবে। কাগজপত্র সব ঠিকঠাক আছে? তো যাও অফিসে লিখিয়ে এস।’
হাসপাতালের কাগজে কাজ হল। নাম লেখানোর সময় পকেট খালি হয়ে গেল জয়দেবের। সে ফিরে এসে দেখল ভিড়টা বেড়েছে। সবাই যেন একটা আজব জিনিস দেখছে নাক চাপা দিয়ে। কি করে হল, কোথায় হল, প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে জয়দেব নাজেহাল। তার মনে হচ্ছিল যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারে ততই মঙ্গল।
প্রায় দেড়শ টাকা লাগবে। অঙ্কটা শুনে জয়দেবের কোনই বিকার হল না। সে যখন জানাল তার পকেটে পয়সা নেই তখন ভিড় ফাঁকা হয়ে গেল আচমকা। ঘন ঘন মৃতদেহ আসছে হরিধ্বনি দিতে দিতে, তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল ওরা। মায়ের পাশে উবু হয়ে বসে থাকল জয়দেব। ওষুধের গন্ধটা কেটে গেছে এতক্ষণে। পচা গন্ধটা তীব্র হচ্ছে। কিন্তু কি আশ্চর্য, এখন সেটা নাকে একটুও ঠেকছে না, কখন যেন অভ্যাস হয়ে গেছে গন্ধটা। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে এখন, মাথা তুলতে কষ্ট হচ্ছিল।
‘অ্যাই শালা, এমন মড়া নিয়ে এসেছিস বাপের নাম ভুলিয়ে দিচ্ছিস। শালা গন্ধে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে; মালের নেশাও ঝুল হয়ে গেল। অ্যাই, পোড়াচ্ছিস না কেন?’
ধমক শুনে চোখ মেলল জয়দেব। মুখগুলোকে চিনতে পারল সে। এদের সে বেলেঘাটায় দেখেছে, লাশকাটা ঘরে দেখেছে। কি বলবে সে বুঝতে পারল না। জড়ানো গলায় সামনে দাঁড়ানো একজন বলল, ‘দশ মিনিটের মধ্যে পুড়িয়ে ফেল, কে হয় তোর?’
‘মার্ডার কেস? বয়স কত ছিল?’
কথাটা শুনেই কান ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল জয়দেবের। কিন্তু লোকগুলোর জামাকাপড় দেখে সে চোখ সরিয়ে নিল। এরা এত বড়লোক, এদের সঙ্গে কি কথা বলতে পারে সে! আবার মুখ নামিয়ে নিল সে।
জড়ানো গলায় বলল, ‘মুখে বাক্য নেই যে! পচা মড়া নিয়ে শোক করলে চলবে? না, না, এখানে মড়া রেখে গন্ধ ছড়ালে চলবে না। দশ মিনিট টাইম দিলাম। শালা গন্ধে আমাদেরটা না উঠে বসে!’
লোকজন আর কাছে ঘেঁষছে না। সন্ধে ঘনিয়ে এল। জয়দেব বুঝে উঠছিল না সে কি করবে। মা তুমি এমনি করে প্রতিশোধ নিচ্ছ তখন কথা শুনতাম না বলে! ঝিমুনিটা বেড়ে যাচ্ছিল, শুতে ইচ্ছে করছিল খুব।
‘সত্যি সত্যি টাকা নেই?’
গলাটা শুনে তাকাল জয়দেব। মুখে পাকা দাড়ি, চোখ লাল একজন দাঁত খুঁটতে খুঁটতে ওকে জিজ্ঞাসা করছে। জয়দেব ঘাড় নাড়ল, ‘নেই।’
‘তাহলে কি করে পোড়াবি?’
‘জানি না, যা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে।’
‘আমি যদি পুড়িয়ে দিই কি দিবি?’
জয়দেব ভেবে পেল না কি দিতে পারে! কেউ যদি দয়া করে তাহলে হাউলিতে গিয়ে সে টাকা যোগাড় করে আনতে পারে। কিন্তু এখন?
‘একটু চালাকি করতে হবে। এতদিনের মড়াকে ইলেক্ট্রিকে শোওয়ানো নিষেধ আছে। কিন্তু সে আমি বুঝব। এখন বল কি দিবি?’
গলা শুকিয়ে গেছে জয়দেবের, কোন রকমে বলল, ‘কিছুই নেই আমার।’
‘আছে। আছে।’ খপ করে তার কনুই-এর ওপরটা ধরল লোকটা। দুটো আঙুল দিয়ে রুপোর তাবিজটা নেড়ে চেড়ে দেখে বলল, ‘এটা খোল।’
হাঁ হয়ে গেল জয়দেব। সমস্ত শরীর অসাড়। তাবিজটা চাইছে লোকটা? বাবার থানে মানত করে জমানো টাকা দিয়ে তাবিজটা বানিয়ে দিয়েছিল গোলাপবালা। খুব বড় ফাঁড়া আছে ছেলের, বার বার করে বলে দিয়েছিল এটা যেন কখনও হাত থেকে না খোলে। কত দাম এর? গোলাপবালা বলত, ‘জামার তলায় ঢেকে রাখবি, রুপোর এখন খুব দাম।’
“কিরে দিবি? কবচ হাতে বেঁধে কি হবে যদি মায়ের শরীর পচে! ছেলের কাজ কর। তোকে দেখে মায়া হল বলে এলাম।’
টাইট হয়ে গিয়েছিল চেনটা। অনেক কষ্টে খুলল জয়দেব। লোকটা একবার আকাশে ছুঁড়ে লুফে নিল ফের। তারপর বলল, ‘আমি ঢুকিয়ে দিয়ে চিৎকার করে তোকে গালাগাল করব। দুটো একটা চড়ও মারব। তুই চুপ করে মার খাবি। বুঝলি? নে, নিয়ে আয় ওটাকে। জলদি।’
বিদ্যুৎ বয়ে গেল শরীরে। তড়াক করে উঠে দাঁড়াল জয়দেব। দু হাতে গোলাপবালাকে তুলে নিতে গিয়ে শরীর টলল। মাগো, কি ভারী হয়ে গেছ তুমি! হাতের মুঠোয় কি রকম অনুভূতি লাগছে। কোন রকমে সামলে নিয়ে সে লোকটির পেছন পেছন চলতে লাগল। আশেপাশে যাঁরা ছিল তারা অবাক হয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। একটা মেশিনের মত জিনিসের সামনে গিয়ে লোকটা সুইচ টিপতেই জয়দেব দেখতে পেল লম্বা মতন শোওয়ার জায়গা বেরিয়ে এসেছে। চাপা গলায় লোকটা বলল, ‘শুইয়ে দে এখানে চটপট।’
গোলাপবালাকে সেই জায়গায় নামিয়ে দিতেই সটাং করে ভেতরে চলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে লোকটা চিৎকার শুরু করে দিল, কেন মিথ্যে কথা বললি? কেন বললি অমুক বাবুর নাম। হায় হায় কাকে ঢাকাতে কাকে ঢোকালাম।’ চড় লাথি চালাতে লাগল লোকটা, ‘তোর জন্যে আমার চাকরি যাবে, হায় ভগবান।’ মাটিতে শুয়ে পড়েছিল জয়দেব মারের চোটে। ভিড় জমে গেছে চারধারে। নানান লোক নানান কথা বলছে। একজন গালাগালি দিচ্ছে লোকটাকে, সে কি করে এমন ভুল করল! হই-হট্টগোল চরমে। ওকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে সুপারিশ করছে অনেকে। শ্মশানের বাবু এই মারে কি সেই মারে। যার হাতে মেশিনের দায়িত্ব সেই লোকটা ওকে অবশ্য আড়াল করে দাঁড়িয়ে ওকেই গালাগালি দিচ্ছে। এই সময় একটা গলা শোনা গেল, ‘কি আরম্ভ হয়েছে। শ্মশানের মত শান্তির জায়গাতে এসব করতে ভাল লাগে! কত খরচ লাগছে বল দিয়ে দিচ্ছি।’
শ্মশানের বাবু বলল, ‘আপনি মহৎ লোক কিন্তু কাজটা ও অন্যায় করেছে। আপনার মাতৃশোক তাই এ কথা বলছেন।’
আধঘণ্টাটাক পরে লোকটা তাকে ডাকল। শরীর থেকে রক্ত বেরিয়েছে, প্রচণ্ড ব্যথা, জয়দেব উঠে বসল। লোকটা বলল, ‘এদিকে আয়। বেঁচে গেলি। মায়ের দায় বলে কথা।’
জয়দেব দেখল এখন ভিড় নেই। দু-একজন ওর দিকে অলস চোখে তাকিয়ে আছে। সে কোন রকমে টলতে টলতে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটা মেশিনের তলা থেকে ছাই মেশানো কিছু একটা ভাঁড়ে তুলে বলল, ‘নে তোর মায়ের পঞ্চাত্মা। পাশেই মা গঙ্গা, দিয়ে ঋণমুক্ত হ।’ জয়দেব ভাঁড়টাকে দেখল। মায়ের শরীরটা এখন ওইটুকু। লোকটা হাসল, ‘কেমন হল বল এখন আর পচা গন্ধ পাচ্ছিস ওই থেকে?’
নিজের অজান্তে ভাঁড়টাকে নাকের কাছে এনে মাথা নেড়ে না বলতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল জয়দেব। হঠাৎ যেন কটু গন্ধটাকে টের পেল সে। তবে এবার গন্ধটা আসছে তার নিজের শরীরের ভেতর থেকে, সারা জীবন যে গন্ধটাকে বয়ে বেড়াতে হবে তাকে। ভাঁড়টাকে গঙ্গায় ছুঁড়ে দিলেও যে দায় ঘুচবে না।
১৩৮৮(১৯৮১)