হবীবুল্লাহ বাহার স্মরণে

হবীবুল্লাহ বাহার স্মরণে

০১.

প্রথমে চট্টগ্রামে, মধ্যে কোলকাতায় এবং পরে ঢাকায় বাহার ছিল একটি প্রিয় নাম। প্রিয়জনের উচ্চারিত নাম চিত্তে একপ্রকার প্রসন্নতা আনে। বাহারও ছিল তেমন একটি মধুর ধ্বনি।

সুদীর্ঘ সুঠাম শ্যামল সুপুরুষ বাহার সাহেবের আঙ্গিক লাবণ্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল তার অন্তরের সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য। আবাল্য তিনি ছিলেন দেহে-মনে সুস্থ, সুন্দর ও প্রাণবান। তিনি অন্যের অন্তরের স্পর্শ পেতে যেমন চাইতেন, তেমনি নিজের অন্তরও মেলে ধরতেন অন্যের কাছে। তাঁর সঙ্গ-প্রিয়তা তাঁকে করেছিল বাকপটু, বন্ধুবৎসল, অকপট ও পরার্থপর। তার এই মানস-প্রবণতা বা চারিত্রিক গুণই তাঁকে করেছিল মজলিশি লোক ও আড্ডাবাজ। তাঁর জীবনে বৈচিত্র্য এবং ব্যপ্তিও আসে হয়তো এই সঙ্গ-সুখ প্রবণতা থেকেই। খেলার মাঠে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, সাহিত্যের আসরে ও রাজনীতিক মঞ্চে তাঁর ছিল সমান আকর্ষণ, পাওয়া যেত তাকে সর্বত্র। তার নির্দিষ্ট কোনো পেশা বা বৃত্তি ছিল না বলে তিনি সমান উৎসাহে যোগ দিতে পেরেছেন সামাজিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মে ও খেলাধুলায়। ক্রীড়া ও কর্ম দু-ই তাঁর কাছে সমান ছিল। তাঁর প্রাণময়তা ও আনন্দিত জীবনের উল্লাস প্রকাশ পেয়েছে তার সব ভাব-চিন্তা ও কর্মে। বাহার সাহেবের জীবন খেলা দিয়ে শুরু এবং সেবা দিয়ে শেষ। প্রথম জীবনে ক্রীড়ানৈপুণ্য এবং পরবর্তী জীবনে বাকপটুতাই তাকে জনপ্রিয় করে। তুচ্ছ কথাকেও রসিয়ে রসিয়ে বলে বা লিখে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার আশ্চর্য জাদু ছিল তার আয়ত্তে। কারো নিন্দায় বা প্রশংসায় তিনি সমান মুখর থাকতেন। কিন্তু তাঁর হৃদয় ছিল আসূয়ামুক্ত ও স্বার্থবুদ্ধিবিহীন, তাই এ সব নিন্দা-প্রশংসায় তাঁর বিদ্বেষ বা অনুগ্রহ লোভ ছিল না। ফলে তা হত অনাবিল উপভোগ্য আড্ডা-রস।

.

০২.

বাহার সাহেবের মাতৃ ও পিতৃভূমি ছিল ফেনী মহকুমার পরশুরাম থানার অন্তর্গত উত্তরগুথুমা গাঁ। তার প্রপিতামহ তমিজুদ্দীন চৌধুরী ওর্ষে তমিজুদ্দিন মুন্সী ছিলেন নোয়াখালী আদালতের ফারসিনবিশ উকিল। প্রমাতামহ আমজাদ আলি ছিলেন ইংরেজি জানা সরকারি চাকুরে–চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনারের প্রথমে পেশকার ও পরে Personal assistant. তমিজুদ্দীন মুন্সীর বজলুর রহিম, ফজলুল করিম, আব্দুল ওদুদ, শামসুদ্দীন প্রভৃতি পাঁচটি পুত্ৰই উচ্চ ইংরেজি শিক্ষালাভ করে চট্টগ্রাম বিভাগের মুসলিম সমাজে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন এবং এ পরিবার প্রখ্যাত ও শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠে। আমজাদ আলির জ্যেষ্ঠ পুত্র আবদুল আজিজই নোয়াখালী জেলার প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট। এই দুই পরিবারের অনেকেই পদস্থ সরকারি কর্মচারী, ব্যবহারজীবী ও জননেতা হিসেবে সরকারি খেতাব এবং সামাজিক মর্যাদা অর্জন করেন। আবদুল আজিজ বিয়ে করেন তমিজুদ্দিন মুন্সীর মেয়ে এবং আমজাদ আলির কন্যার সঙ্গে বিয়ে হয় বজলুর রহিমের। তমিজুদ্দিন মুন্সীর প্রথম পুত্র ফজলুল করিমের পুত্র নুরুল্লাহ চৌধুরী। নুরুল্লাহ চৌধুরী বিয়ে করেন আমজাদ আলির পুত্র খান বাহাদুর আবদুল আজিজের জ্যেষ্ঠা কন্যাকে। বাহার সাহেব ও বেগম শামসুন। নাহার মাহমুদ এঁদেরই সন্তান। বাহার সাহেবের মাতৃ ও পিতৃকুলে উচ্চশিক্ষা ও ঐশ্বর্য দু-ই ছিল। বাহার-নাহার এই পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্যুতি ও ঐশ্বর্যের প্রসাদের মধ্যে লালিত।

তা ছাড়া বাহার ও নাহার আরো একটি বিশেষ পরিবেশ পেয়েছিলেন। তা দুর্ভাগ্য দিয়ে শুরু বটে কিন্তু সৌভাগ্যের সম্ভাবনাও সূচিত হয় সে-পথেই। খান বাহাদুর আবদুল আজিজ অপুত্রক ছিলেন। তাঁর ছিল পাঁচটি কন্যা। আশ্চর্য, অতি অল্প সময়েই তিন কন্যার হয় মৃত্যু এবং দুই কন্যা হন বিধবা। বাহার সাহেবের মা ছিলেন জ্যেষ্ঠা কন্যা। তিনি যখন বিধবা হন তখন তার বয়স বিশের বেশি নয়। এবং বাহার তিন বছরের আর নাহারের বয়স তখন দেড় বছর। এসময় তাদের মা-খালারা এবং নানা-নানী সব জীবিত এবং সম্ভবত খালারাও অবিবাহিতা। আবদুল আজিজ সাহেব চট্টগ্রাম বিভাগের মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের সহকারী পরিদর্শক ছিলেন এবং চট্টগ্রাম শহরেই স্থায়ীভাবে বাস করতেন। এখানেই পিতৃহীন বাহার-নাহার নানা-নানী, মা-খালাদের চোখের মণিরূপে পরম আদরযত্নে লালিত হন। খান বাহাদুর আব্দুল আজিজ জনহিতৈষী শিক্ষাবিস্তারকামী উদার-হৃদয় ও সাহিত্য-প্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি কাব্যচর্চাও করেছিলেন। সমকালীন বিরুদ্ধ সামাজিক পরিবেশেও তিনি কন্যাদের লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। তারই ঘরে তারই তত্ত্বাবধানে বাহার-নাহার লালন ও শিক্ষা পান। ১৯০৭ খ্রীস্টাব্দে বাহার এবং ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে নাহারের জন্ম।

.

০৩.

শিশু স্বাস্থ্যবান হলেই চঞ্চল হয়, আর শৈশবের চাঞ্চল্যের অপর নাম দুরন্তপনা। এবং দুরন্ত ছেলেই বাল্যে-কৈশোরে-যৌবনে ক্রীড়াপ্রিয় হয়। আবার ক্রীড়াপ্রিয় মানুষ বন্ধু ও সঙ্গ-সুখকামী হয়। বাহার সাহেবের আবাল্য এসব বৈশিষ্ট্য ছিল। আজীবন আড্ডাবাজ থাকার মূলে রয়েছে এই মানসচেতনা। খেলোয়াড়েরা সাধারণত পড়ুয়া ছাত্র হয় না। বাহার সাহেব ছিলেন মাঝারি ছাত্র। বাড়ির পাশের চট্টগ্রাম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। আই-এসসি পাস করে চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়তে শুরু করেন–কিন্তু এ কর্ম আড্ডাবাজ ছেলের জন্য নয়, তাই চট্টগ্রাম কলেজে আরবিতে অনার্স নিয়ে বি এ পড়তে থাকেন। পরীক্ষার সময় কিন্তু অনার্স পরীক্ষা দেননি। বিএ পাস করার পর তাঁর শিক্ষাপর্ব সমাপ্ত হয়।

.

০৪.

চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবাদী তরুণদের কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। অনন্ত সিং তাঁদের অন্যতম। কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লবে তাঁর সমর্থন ছিল না–তিনি নিয়মতান্ত্রিক-আন্দোলন সাফল্যে আস্থাবান ছিলেন।

তাঁর জীবনে বন্ধু-বান্ধবের প্রভাব কখনো গম্ভীর হতে পায়নি। তাঁর পারিবারিক প্রভাবই তার চরিত্র নির্মাণ ও জীবন নিয়ন্ত্রণ করেছে। নানা-নানী ও মা-খালাদের থেকে তিনি দুটো সম্পদ লাভ করেছিলেন–একটি সাহিত্য-প্রীতি এবং অপরটি নৈতিক-চেতনা। তাঁর জীবনে নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ জাগে পারিবারিক পরিবেশ থেকেই। ধর্মবুদ্ধি, আদর্শবাদ ও উদারতার সমন্বয় ঘটেছিল এ পরিবারের পরিজনদের চরিত্রে। বাহার সাহেবের মধ্যে আমরা এসব দুর্লভ গুণের উত্তরাধিকার প্রত্যক্ষ করি। খেলোয়াড় ও আড্ডাবাজ বাহারের আদর্শবাদ ছিল অনাবিল ও অটল, নৈতিক চেতনা ছিল প্রবল। তাই এই প্রাণবন্ত প্রবল পুরুষের জীবনের কোনো নৈতিক উজ্জ্বলতা ছিল না, ছিল না কোনো কাপট্য বা মিথ্যাচার। আদর্শ চরিত্র ও মহৎ জীবনের অনুধ্যানেই তাঁর জীবন কেটেছে। তাঁর রচনাবলীর অধিকাংশই তাই চারিত্র্যপূজার ও কীর্তিমান পুরুষের কর্মের অনুধ্যানের নিদর্শন।

ধর্মভাব ও আদর্শবাদ তাঁকে অতীত ও বর্তমানের মুসলিম জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র- চিন্তায় উৎসাহী করেছে। তাঁর স্বধর্ম ও স্বধর্মীপ্রীতি বিধর্মী-বিদ্বেষ জাগায়নি। তাই তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও নিন্দা চিরকালই অসূয়ার হুল-মুক্ত ছিল। তার হিং ও হালিম তাই বিদ্বিষ্টমনের বিষ ছড়ায়নি, রসিকজনের চিত্তে কেবল রসই সিঞ্চিত করেছিল। গাল যে খেলো আর গাল যে দিল–উভয়েই রইল পাঠকের উচ্চহাস্যের আধার হয়ে। হিং ও হালিমে কলমের জোর যেমন প্রত্যক্ষ, তেমনি কলমের পশ্চাতে যেমন ক্রিয়াশীল ছিল, তার প্রসারও হত আভাসিত। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আর নিন্দা গালিও যে অশ্লীলতা-মুক্ত হতে পারে, তা বাহার সাহেব নতুন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

যৌবনে তিনি তাসে আসক্ত ছিলেন। তাসে নাশ এই আপ্তবাক্যের প্রভাবে তাঁর মা তাঁকে তাস খেলতে নিষেধ করেন। এই নিষেধের পরে তিনি জীবনে আর তাস স্পর্শও করেননি। এ-কথা আমি তাঁরই মুখে একদিন কথাপ্রসঙ্গে শুনেছিলাম।

সাহিত্যিক হিসেবে মহৎ জীবনের চরিত্র ও কৃতির আলোচনা মাধ্যমে নৈতিকচেতনা, আদর্শানুগত্য ও মহম্ভব জাগানোর সচেতন প্রয়াস ছিল তার। সৈয়দ আমীর আলী, স্যার সৈয়দ আহমদ প্রভৃতি তার প্রমাণ। তাঁর ভাষায় ও ভঙ্গিতে এক দুর্লভ লাবণ্য ও আকর্ষণ-শক্তি ছিল। বক্তা হিসেবে তিনি যেমন শ্রোতাকে অভিভূত রাখতে পারতেন, আলাপচারী হিসেবে যেমন উপস্থিত ব্যক্তিকে একটানা পাঁচ-সাত ঘণ্টা ধরে রাখতে পারতেন, লেখক হিসেবেও তিনি পাঠককে সহজেই মুগ্ধ করতে জানতেন। অনর্গল অনবরত রসিয়ে রসিয়ে অক্লান্তভাবে কথা বলার সে কী আশ্চর্য সামর্থ্য ছিল তাঁর। এজন্যেই তাঁর সঙ্গ-সুখ ত্যাগ করা দুঃসাধ্য ছিল তাঁর বন্ধু-বান্ধবের পক্ষে। তাঁর সম্পাদিত বুলবুল পত্রিকা এবং রচিত পাকিস্তান গ্রন্থ তাঁর সাহিত্যপ্ৰাণতার ও রাজনীতি প্রীতির নিদর্শন। তাঁর দেখবার দৃষ্টিও ছিল তীক্ষ্ণ। অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি তাঁর প্রতিবেশের সবকিছু খুঁটিয়ে দেখবার অদ্ভুত শক্তি রাখতেন। এ সূত্রে কলম্বোর চিঠি ও জেনেভার চিঠি স্মতব্য। রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বমুহূর্ত অবধি তিনি একটি তাজা তরুণ প্রাণ বয়ে বেড়াতেন। রসিকের দৃষ্টি নিয়ে তিনি জীবন ও জগৎকে, প্রতিবেশ ও প্রতিবেশীকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর চারদিককার ভবন থেকে তিনি জীবনরস গ্রহণ করেছেন অবাধে এবং দিয়েছেন অকাতরে সবাইকে যারা তাঁকে বেষ্টন করে থাকতেন। তিনি এভাবে অন্তরে-বাইরে এক আনন্দলোক সৃষ্টি করে জীবনকে উপভোগ করতে ও করাতে চেয়েছেন। জীবনে তিনি চাকরি করেননি। তাই তার সময় ছিল অঢেল, প্রয়োজন ছিল সামান্য, লোভ ছিল অজ্ঞাত, ঔদাসীন্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল ঔদার্য, সবটা মিলে এক নির্ভাবনার জীবন। তিনি ভালোবাসতে জানতেন। জীবনভরে ভালোবাসা দিয়েছেন এবং ভালোবাসা কুড়িয়েছেন। তাঁর জীবনে প্রীতির লেনদেনই ছিল মুখ্য। রাজনীতিক জীবনে তার প্রতিপত্তি ও সাফল্য আসে এই স্বতঃস্ফূর্তপ্রীতির পথেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *