বাউল মত ও সাহিত্য

বাউল মত ও সাহিত্য

ক.

বাউলমতের উদ্ভব সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছি অন্যত্র। কিন্তু সেসব বাহ্য পরিচয়ই বহন করে। অন্তরঙ্গ পরিচয়ের জন্যে তত্ত্বকথার জাল বুনতে হবে এবং তাতে ইতিহাসের পাথুরে প্রমাণ প্রয়াগ করা সম্ভব হবে না। প্রমাণ যা থাকবে তা পরোক্ষ, তাই পঞ্জী হবে বিরল।

চলমান জীবন প্রতিমুহূর্তে বিচিত্ররূপে নিজেকে প্রকাশ করে। অভিব্যক্তির এ প্রবাহকে কোনো ছকে ফেলে যাচাই করা চলে না। এ-কথা কেবল ব্যক্তি সম্পর্কেই নয় জাতীয় জীবন সম্বন্ধেও সত্য। তবু জানবার-বুঝবার সুবিধের জন্য একটা মাপকাঠি স্বীকার না করলেই নয়। তাই সমাজ-নীতি ধৰ্ম-বিধি রাষ্ট্রসংস্থা ইতিহাস দর্শন বিজ্ঞান শিল্প স্থাপত্য ভাস্কর্য সাহিত্য সঙ্গীত পোশাক আচার আচরণ প্রভৃতি সাধারণভাবে সমাজের বা জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিচায়ক ও পরিমাপক বলে স্বীকৃত হয়। যদিও এমন কোনো সাধারণ গুণনীয়ক কিংবা সমীকরণ পদ্ধতি নেই যা দিয়ে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের বিচিত্র আচরণকে একটি সামগ্রিক ধারণার অনুগত করে বিচার করা সম্ভব। কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে একটা জাতির পূর্ণ পরিচয় নিবন্ধ নেই বলে সামগ্রিক স্বরূপে কোনো জাতিকে চিহ্নিত করাও অসম্ভব। তবু মানুষের বোধের ও ব্যবহারের পরিসরে জাতিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের যে রেওয়াজ চালু রয়েছে, আপাতত আমাদের তাই অনুসরণ করতে হবে।

জাতির পরিচয় ক্ষেত্রে ধর্ম ও সাহিত্যকে প্রধান উপকরণ বলে গণ্য করা হয়। কেননা জীবন একান্তই স্থান-কাল ভিত্তিক। কাজেই মানুষের দেহমন গড়ে তোলে প্রতিবেশ। আর মানুষের অন্তরের অপকট অনুভূতি ও উপলব্ধির সুন্দরতম ও নিবিড়তম প্রকাশ ঘটে সাহিত্যে। এবং জীবনের তথা মনের ও আচরণের অলক্ষ্য নিয়ন্তা হচ্ছে ধর্মীয় সংস্কার। ধর্মের অন্তলীন প্রভাবের স্বরূপ যাই হোক, সাহিত্য যে মানুষের বোধ-বুদ্ধির অবিকৃত প্রতিরূপ তা মানতেই হবে। কারণ সাহিত্য জীবনালেখ্য নয়, জীবনবোধের অভিব্যক্ত সাক্ষ্য। এজন্যেই সাহিত্য জাতীয় জীবনের মুকুর বলে স্বীকৃত। সাহিত্যে মানুষের মর্মমূলের স্বরূপ বিধৃত থাকে বলে মানুষের অন্তসত্তার পরিচায়করূপে একে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। আর মানুষের মননে ও আচরণে স্থানিক কালিক প্রভাব অনপনেয় বলে কোনো কোনো ঐতিহ্য মানুষের প্রেরণার মাতৃকা, কর্মের দিশারী ও মর্মের পরিচায়ক। কাজেই সাহিত্য ও ঐতিহ্যের উজান পথে সন্ধান নিতে হবে তত্ত্বের।

.

খ.

মানুষের মনে জগৎ ও জীবন সৃষ্টির রহস্য এবং জগৎ ও জীবনের মহিমা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে যে চিরন্তন ও সর্বজনীন জিজ্ঞাসা রয়েছে তারই জবাব খোঁজা হয়েছে ধর্ম ও আধ্যাত্মজীবন সম্পর্কিত রচনায়। বাস্তবধর্মী শক্তিমানের যে জিজ্ঞাসা মানুষকে বিজ্ঞানী করেছে, ভাববাদী দুর্বলকে তা-ই করেছে তাত্ত্বিক ও দার্শনিক। একই জিজ্ঞাসা আপাত বিরোধী দু-কোটির চিন্তা ও কর্মের প্রেরণা ও জন্ম দিয়েছে। এই একই জিজ্ঞাসা কাউকে করেছে বহির্মুখী, কাউকে দিয়েছে অন্তদৃষ্টি। বহির্মুখিতা মানুষকে করেছে বিষয়ী ও বিজ্ঞানী, অন্তর্দৃষ্টি মানুষকে করেছে রহস্যবাদী, গড়ে তুলেছে অধ্যাত্মবাদ। বিজ্ঞান এনেছে ভোগবাদ বা ঐহিক জীবনবাদ তথা বস্তুতান্ত্রিকতা। অধ্যাত্মবাদ দিয়েছে। বৈরাগ্য বা ইহবিমুখিতা জাগিয়েছে, জীবনের জীবনের আকাঙ্ক্ষা। বৈরাগ্য প্রাচ্যের মানস- সম্পদ আর বিজ্ঞান প্রতীচ্যের ঐশ্বর্য। দুটোরই মূল প্রেরণা জিগীষা–একটার লক্ষ্য আত্মজয়, অপরটার কাম্য দুনিয়া-জয়। একটার সম্বল হৃদয় ও মনোবল, অপরটার হাতিয়ার বুদ্ধি ও বাহুবল। একটি হৃদয়বৃত্তির লীলা, অপরটি প্রাণধর্মের অভিব্যক্তি।

তত্ত্বচিন্তা মানুষকে তিনটে মার্গের সন্ধান দিয়েছে–জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির পথ। জ্ঞানবাদ আস্তিক, নাস্তিক্য ও সংশয়প্রবণ দর্শনের জন্ম দিয়েছে। কর্মবাদ সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রবিধি গড়ে তুলেছে আর ভক্তিবাদ হয়েছে নিষ্ঠা ও বৈরাগ্যের উৎস। এবং ভক্তিবাদের উপজাত কিংবা পরিণাম হচ্ছে প্রেমবাদ। বাঙলা ভাষায়ও এই তত্ত্বজিজ্ঞাসা তিন ধারার সাহিত্য সৃষ্টির উৎস হয়েছে– ধর্মসাহিত্য, তত্ত্বসাহিত্য ও সাধনসাহিত্য। বাউল গান হচ্ছে তত্ত্বাশ্রয়ী মরমীয়া সাহিত্য।

.

গ.

বাউলগান আমাদের তত্ত্ব-সাহিত্যের অন্যতম শাখা। মুসলিম প্রভাবে তথা সূফীবাদের প্রত্যক্ষ সংযোগে এক প্রাচীন মতের রূপান্তরে বাউল মতের উদ্ভব হয়েছে। সে মতের জড় রয়েছে প্রাচীন ভারতে। আদিকাল থেকেই মানুষ সাধারণভাবে দৈহিক শুচিতাকে মানস-শুচিতার সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করেছে। এজন্যে যে-কোনো ধর্মমতে উপাসনাকালে দৈহিক পবিত্রতা আবশ্যিক। মনে হয় এ বোধেরই পরিণতি ঘটেছে দেহাত্মবাদে ও দেহতত্ত্বে। যোগে, সাংখ্যে বৌদ্ধ ও হিন্দুতন্ত্রে এবং সূফীসাধন তত্ত্বে দেহকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দেহের আধারে যে-চৈতন্য সেই তো আত্মা। এ নিরূপ নিরাকার আত্মার স্বরূপ-জিজ্ঞাসা শারীরতত্ত্বে মানুষকে করেছে কৌতূহলী। এ থেকে মানুষ বুঝতে চেয়েছে–দেহযন্ত্র নিরপেক্ষ আত্মার অনুভূতি যখন সম্ভব নয় তখন আত্মার রহস্য ও স্বরূপ জানতে হবে দেহযন্ত্র বিশ্লেষণ করেই। এভাবে সাধনতত্ত্বে যৌগিক প্রক্রিয়ার গুরুত্ব দেয়া হয়েছে অসামান্য। তাই এদেশে অধ্যাত্ম সাধনায় যোগাভ্যাস একটি আবশ্যিক আচার। যোগসাধন পাক ভারতের একটি আদিম অনার্য শাস্ত্র। বৌদ্ধযুগে এর বহুল চর্চা ছিল। বাঙলায় পাল আমলের তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের একটি শাখাই মধ্যযুগে সূফী প্রভাবে বৈষ্ণব সহজিয়া ও বাউল মত রূপে প্রসার লাভ করে। এভাবে চর্চাগীতির পরিণতি ঘটে সহজিয়া পদে ও বাউল গানে। তত্ত্ব-সাহিত্যে তথা মরমীয়া সাধনায় সাধারণভাবে যোগ আর সূফী সাধন তত্ত্বের ও পদ্ধতির মিশ্রণ ঘটেছে। সমাজ ও ধর্মের আচারিক প্রভেদ সত্ত্বেও শাসক-শাসিত সম্পর্কের অন্তরালে ভিন্নাদর্শমুখী দুটো জাতির মধ্য কী নিবিড় প্রাণের যোগ সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে বাউল গানে ও এ ধরনের অন্যান্য রচনায়। জীবনের যে চিরন্তন প্রশ্নে আত্মার আকুলতা-উদার পটভূমিকায় ও বিস্তৃত পরিসরে তার সমাধান খুঁজতে চাইলে জাত, ধর্ম ও সমাজ চেতনার উর্ধ্বে উঠতেই হয়। মানস সংস্কৃতির এরূপ লেনদেন, এমনি আত্মিক যোগাযোগ চিরকালই মানুষের চিত্তপ্রসারের ও আত্মবিকাশের সহায়ক হয়েছে।

মুসলিম বিজয়ের পরে হিন্দু-মুসলমানের বিপরীতমুখী ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘর্ষে প্রথমে দক্ষিণ ভারতে, পরে উত্তরভারতে এবং সর্বশেষে বাঙলা দেশে হিন্দুসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ আলোড়নের বাহ্যরূপ ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় প্রয়াস। হিন্দুর মায়াবাদ ও তজ্জাত ভক্তিবাদ এবং ইসলামের সূফীতত্ত্বই এ আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছে। দক্ষিণ ভারতের ভক্তিধর্ম; উত্তর ভারতের সন্তধর্ম এবং বাঙলার বৈষ্ণব ও বাউল মত সূফীবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল। সেদিন ইসলামের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও ব্যক্তিস্বাধীনতার মহিমা যে আবেগ ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছিল তারই ফলে মন্দির ছেড়ে মসজিদে না গিয়ে উদার আকাশের নিচে স্রষ্টার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক পাতাবার এ নতুনতরো প্রয়াসমাত্র। তারা বুঝেছে যদিও হিন্দু ধাবই দেহরা, মুসলমান মসীত সেখানে তো আল্লাহ নেই। কবীরের ভাষায় তাদেরকে আল্লাহ বলেছেন :

মো কো কঁ টুড়ো বন্দে মৈ তো তেরে পাসর্মে
না মৈ দেবল না মৈ মসজিদ, না কাবে কৈলাসর্মে।

জীবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মার স্থিতি। কাজেই আপন আত্মার পরিশুদ্ধিই খোদা প্রাপ্তির উপায়-তাই আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির সাধনাই এদের প্রাথমিক ব্রত। এদের আদর্শ হচ্ছে Knoweth thyself; আত্মানাং বিদ্ধি–নিজেকে চেনো, হাদীসের কথায় মান আরফা নাফসাহু ফাঁকাদ আরাফা রাব্বাহু–যে নিজেকে চিনেছে সে আল্লাহকে চিনেছে। জীবনের পরম ও চরম সাধনা সে-খোদাকে চেনা।

.

ঘ.

ইরানি সূফী সাধনাও যৌগিক প্রক্রিয়া নির্ভর। পাক-ভারতের যোগ-সাধনার সঙ্গে পরিচয়ের পর। সূফীদের দেহচর্চায় যোগশাস্ত্রে প্রচুর প্রভাব পড়ে। সূফীদের দেহতত্ত্বের সঙ্গে যোগশাস্ত্রের সার্থক মিশ্রণ ঘটিয়ে উভয় প্রক্রিয়ার সমন্বয় সাধন করে যিনি পাক-ভারতের মুসলিম সমাজে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন তাঁর নাম শেখ শরফুদ্দিন বু আলি কলন্দর শাহ (মৃত্যু ১৩২৪ খ্রী.)। তার প্রবর্তিত সাধনপদ্ধতির বাঙলা নাম যোগ কলন্দর। পানিপথে তার সমাধি আছে। উত্তরভারতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আর তাঁর খ্যাতি আজো ম্লান হয়নি। এক সময়ে বাঙলায় কলন্দর-পন্থী বৈরাগীর এমনি প্রাদুর্ভাব ছিল যে কলন্দর বলতে মুসলিম বৈরাগীই বোঝাত। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে কলন্দর হৈয়া কেহ ফিরে দিবারাতি। ঋণ করি নাহি দাও, নহ কলন্দর। আর সূফীতত্ত্বের সঙ্গে এদেশের লোকের সাহিত্যিক পরিচয় ঘটে প্রথমে রুমীর মসনবী এবং পরে হাফিজ প্রভৃতির সৃষ্টির মারফৎ। ব্যবহারিক পরিচয় তো আগে থেকেই ঘটেছে, কেননা ভারতে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে প্রধানত সূফী দরবেশের ও তাদের অনুচরের মাধ্যমে।

আত্মা পরমাত্মার অংশ। কাজেই আত্মাকে জানলেই পরমাত্মাকে জানা হয়। তাই দেহধারাস্থিত আত্মাকে জানাই বাউলের ব্রত।

 খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।

 এ দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ ডাকলে কথা কয়।

 বাউলেরা তাদের ভাষায় অচিন পাখি, অলখ সাঁই (অলক্ষ্য স্বামী) মনের মানুষ বা মানুষ রতন-রূপ আত্মা তথা পরমাত্মাকে জানবার সাধনা করে। বৈষ্ণব বা সূফীর মতো এরা প্রেমিক নয় যোগীর মতো তাত্ত্বিক। বাউল গান একাধারে ধর্মশাস্ত্র ও দর্শন-সাধ, সঙ্গীত ও ভজন গান ও গীতিকবিতা। তথাপি ভাষায়, আঙ্গিকে ও ভঙ্গিতে এগুলো আমাদের লোকসাহিত্যেরই অন্তর্গত। মোটামুটিভাবে সতেরো শতকের দ্বিতীয় পাদ থেকেই বাউলমতের উন্মেষ। মুসলমান মাধববিবি ও আউলচাঁদই এ মতের প্রবর্তক বলে বাউল সম্প্রদায়ের বিশ্বাস। মাধববিবির শিষ্য নিত্যানন্দ-পুত্র বীরভদ্রই বাউল-মত জনপ্রিয় করেন। আর উনিশ শতকে লালন ফকিরের সাধনা ও সৃষ্টির মাধ্যমেই এর পূর্ণ বিকাশ।

ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই বাউলেরা সাধনা করে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধক ও দার্শনিকের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তারা সাম্য ও মানবতার বাণী প্রচার করে। এঁরা রুমী-হাফিজের সগোত্র সাধক। বাউল গুরুরা একাধারে কবি, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা ও মরমী। তাদের গান লোকসাহিত্য মাত্র নয় বরং বাঙালির প্রাণের কথা, মনীষার ফসল ও সংস্কৃতির স্বাক্ষর।

বাউলের রূপক অভিব্যক্তিতে পরমাত্মা হচ্ছেন : মনের মানুষ, সহজ মানুষ, অধর মানুষ, অটল মানুষ, রসের মানুষ, সোনার মানুষ, মানুষ রতন, মনমরা, অলখ সই প্রভৃতি। চর্যাপদ, দোহা প্রভৃতি সব মরমীয়া রচনার মতো বাউলগানও সাধারণত রূপকের আবরণে আচ্ছাদিত। সে-রূপক দেহধার, বাহ্যবস্তু ও ব্যবহারিক জীবনের নানা কর্ম ও কর্মপ্রচেষ্টা থেকে গৃহীত। কারণ All creation-wonders excite the cry of Love. (foto)

বলেছি, ব্রাহ্মণ্য শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্ৰমত–যার নাম নাথপন্থ। বামাচার নয়, কায়াসাধন তথা দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। হঠযোগের মাধ্যমেই এ সাধনা চলে। একসময়ে এই নামপন্থ এবং সহজিয়া মতের প্রাদুর্ভাব ছিল বাঙলায়। এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময়ে ইসলামে ও বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হয়। কিন্তু পুরোনো বিশ্বাস সংস্কার বর্জন সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেই এরা নিজেদের পুরোনো প্রথায় ধর্মসাধনা করে চলে। তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানদের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। বাউলেরা অশিক্ষিত। এজন্যেই তাদের কোনো লিখিত শাস্ত্র নেই। এবং তাদের মতবাদের কালিক কিংবা দার্শনিক পরিচয় তারা দিতে পারে না। সমাজের অজ্ঞ ও গরিব লোকের মধ্যেই এ সাধনা আবদ্ধ বলে বাউলমত শিক্ষিত লোকের শ্রদ্ধা পায়নি, সেজন্যে পণ্ডিতের আলোচনার বিষয়ও হয়নি। রবীন্দ্রনাথই প্রথম এদের প্রতি শিক্ষিত সাধারণের ঔৎসুক্য জাগান।

গুণী ও মরমী হয়েও বাউলেরা সমাজে উপেক্ষিত। বাউল সম্প্রদায়ে জাতি ও শ্ৰেণী-বৈষম্য নেই। হিন্দু-মুসলিম ভেদ নেই। হিন্দু গুরুর মুসলিম-শিষ্য, মুসলিম গুরুর হিন্দু-সাগরেদ গ্রহণে কোনো দ্বিধা-বাধা নেই। তাই বাউল মনাই শেখের শিষ্য কালাচাঁদ মিস্ত্রি, তাঁহার শিষ্য হারাই নমশূদ্র, তাহার শিষ্য দীনু জাতিতে নট, তাঁহার শিষ্য ঈশান যুগী, তাঁহার শিষ্য মদন। নিত্য নাথের শিষ্য বলা কৈবর্ত, তাহার শিষ্য বিশা ভূঁইমালী, তাঁহার শিষ্য জগা কৈবর্ত, তাঁহার শিষ্য মাধা পটিয়াল বা কাঁপালী, তাহার শিষ্য গঙ্গারাম। গঙ্গারাম ও মদন দুই বন্ধু ছিলেন। গঙ্গারামের ব্রাহ্মণ শিষ্যও ছিলেন।

অনার্য-অধ্যুষিত বাঙলা দেশে জনগণ চিরকাল অত্যধিক ভাবপ্রবণ। এই ভাবপ্রবণতা বা হৃদয়োচ্ছাস থেকেই বাঙালির গীতিকবিতার উদ্ভব। বাঙলা কেবল ধানের দেশ নয়, গানের দেশও। এখানকার মাটির ফসল ধান, মনের ফসল গান। শুধু বন্যাতেই দেশ প্লাবিত হয় না, গানেও হৃদয় প্লাবিত থাকে। লাল কাঁকরের পশ্চিমবঙ্গ শুষ্ক উত্তরবঙ্গ ও নদীবহুল পূর্ববঙ্গ-বাসীর দৃষ্টি চিরকাল আকাশের দিকে। শ্যামল সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যেমন আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা বিস্ময় ও কৃতজ্ঞতা জানায়, তেমনি প্রকৃতির নিদারুণ রুক্ষতায় কিংবা বিরূপতায় ঊর্ধ্বে দুচোখ তুলে ফরিয়াদও জানায়। মমতায় আঁকড়ে ধরা নয়, চরম ঔদাস্যে মোহ–মুষ্ঠি শিথিল করাই এদের জীবনাদর্শ। তাই চর্যাপদের দেশেই বৈষ্ণব-বাউলের উদ্ভব। মূলত সবগুলিই এক। প্রকাশভঙ্গিই ভিন্ন। সিদ্ধ-সূফী-যোগী-বৈষ্ণবেরা যেমন গুরুবাদী, বাউলেরাও তাই। বাঙালির স্বভাবেই রয়েছে মরমীয়াবাদ।

এই ভাবপ্রবণ বাঙালি-হৃদয়ে স্রষ্টা, সৃষ্টি ও রহস্যময় মানবজীবন সম্বন্ধে যে জিজ্ঞাসা জেগেছে সেই জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজতে বাঙালি কেবল কালে কালে ঘরছাড়া হয়নি আত্মহারাও হয়েছে। সেইজন্যে এদেশে যুগে যুগে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্ম লৌকিক দেবতার কাছে হার মেনেছে।

তাই স্মার্ত রঘুনন্দনের ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ও শরিয়তী ইসলামের নিষেধের বেড়া ভেঙে, জগৎ ও জীবনের রহস্যসন্ধানী বাঙালি নিজের মনের মতো পথ তৈরি করে নিয়েছে।

এজন্যেই এক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান একগুরুর দীক্ষা নিয়ে মনে মনে এক হতে পেরেছে। স্রষ্টার একটা সর্বজনীন রূপ দেওয়ার জন্যেই বাউলেরা অনামক অলখসইর সন্ধানী। এজন্যেই তারা সহজে বলতে পারে :

কালী কৃষ্ণ গড খোদা
কোনো নামে নাহি বাধা।
মন, কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।

.

ঙ.

পথের পার্থক্য মতের অনৈক্য এবং সাধন পদ্ধতির বিভিন্নতা সত্ত্বেও বাউল, বৈষ্ণব ও সূফীর মধ্যে উদ্দেশ্য লক্ষ্য ও পরিণামগত মিল বর্তমান। তাই একের বাণীতে অপরের মনের কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। এক চরম ক্ষণে দেহাধারস্থিত আত্মায় পরমাত্মার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। তখন পরমকে উপলব্ধির আনন্দে সবাই একই সুরে বলে আনল হক কিংবা সোহম। এই অদ্বৈতসিদ্ধি আমরা বাউলে বৈষ্ণবে সূফীতে প্রত্যক্ষ করি। রাগাত্মিকা ভক্তিতে শুনি মুই সেই সূফীরাও বলেন আনল হক বাউলও বলেন দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ ডাকলে কথা কয়। বাউল যেমন বলেন

এই মানুষে আছেরে মন
যারে বলে মানুষ রতন।

অথবা

ক্ষেপা তুই না-জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়।
আপন ঘর না-বুঝে বাইরে খুঁজে পড়বি ধাঁধায়
আমি যেরূপ, দেখুনা সেরূপ দীন দয়াল।

কিংবা

ডুবে দেখ দেখি মন–তারে–কিরূপ লীলাময়
 যারে আকাশ পাতাল খোঁজ এই দেহে তিনি রয়।
লামে আলিফ লুকায় যেমন মানুষে সাঁই আছে তেমন।
তা না হলে কি সব নূরের তন
আদম তনকে সেজদা জানায়।

অথবা,

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।

বা

কারে বলব কেবা করে বা প্রত্যয় —
আছে এ মানুষে সত্য নিত্য চিদানন্দময়।
আত্মা আর পরমাত্মা ভিন্ন ভেদ জেনো না।
এই মানুষে রঙ্গে রসে বিরাজ করেন সাঁই আমার ( পাঞ্জু)

কেননা রুমীও বলেন :

I gaged into my own heart, there I saw Him. He was nowhere else.

কিংবা,

I, All in All becoming
 Now clear see God in All
Ends up from union yearning
take flight the cry of Love.

 রবীন্দ্রনাথও বলেন :

আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
(আমি) তাই হেরি তায় সকল খানে।
–ও তোরা আয়রে ধেয়ে দেখরে চেয়ে আমার বুকে
ওরে দেখরে আমার দু নয়নে।

 কিংবা

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিল দেখতে আমি পাইনি
বাহির পানে চোখ মেলেছি হৃদয় পানে চাইনি।

অথবা,

আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না
এই জানারই সাথে সাথে তোমায় চেনা।

এমনি বোধেরই গাঢ়তায় জীবাত্মা-পরমাত্মার ব্যবধান ঘুচে যায়। ইরানের সূফীমত ও ভারতের বেদান্ততত্ত্ব বাঙলার মাটিতে বাউল বাণীতে প্রত্যক্ষ বিরাজ করে। সূফী বৈষ্ণবদের মতো গানের মাধ্যমেই বাউলদের সাধন ভজন চলে :

বীণার নামাজ তারে তারে, আমার নামাজ কণ্ঠে গাই।

.

চ.

বাউলেরা রাগপন্থী। কামাচার বা মিথুনাত্মক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। ইন্দ্রিয় নিরোধ, বিষয় ত্যাগ কিংবা বৈরাগ্য এদের লক্ষ্য নয়। তবু প্রাচীন ভারতিক ঐতিহ্য প্রভাবে মুনি, আজীবক, ভিক্ষু, সাধু, সন্ন্যাসী, বৈষ্ণব, বৈরাগী প্রভৃতির মতো বাউলেও ভিক্ষাজীবী বৈরাগী আছে। সে হিসেবে বাউল দুই প্রকার: গৃহী ও বৈরাগী। বর্তমানে এরা বহু উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত। হযরতী, গোবরাই, পাগল নাথী, খুশী বিশ্বাসী, সাহেব ধনী, জিকির, ফকির, বাউল, আউল, কৰ্তর্ভজা, সাঁই, ন্যাড়া, বলরামী, শম্বুচাদী, রামবল্লভী প্রভৃতি নাম থেকে তাদের সম্প্রদায়ের প্রবর্তকের নাম ও সাধনপন্থার আভাস পাওয়া যায়। এদের সম্প্রদায়ের গুরুপরম্পরার ও ধর্ম-দর্শনের কোনো নির্ধারিত ইতিহাস বা শাস্ত্রগ্রন্থ নেই। তাই এসব মতের উন্মেষ, বিকাশ ও পরিণতির খবর পাওয়া দুষ্কর। বিশেষ করে বাউলেরা প্রায় অশিক্ষিত, তাদের শ্রুতি-স্মৃতির উপর তেমন নির্ভর করা চলে না। বাউল সাধনার মর্মকথা বাউল কবির ভাষায় এরূপ :

সখি গো জন্মমৃত্য যাহার নাই।
তাহার সঙ্গে প্রেম গো চাই।

এবং —

উপাসনা নাইগো তার
 দেহের সাধন সর্বসার
তীর্থব্রত যার জন্য–
এ দেহে তার সব মিলে।

বাউল কবিদের মধ্যে : লালন শাহ, শেখ মদন, গঙ্গারাম, পাগলা কানাই, পাঞ্জু শাহ পদ্মলোচন ( পোদো) জাদু, দুদু, পাঁচু, চণ্ডী গোঁসাই, রশীদ, হাউড়ে গোঁসাই গোলাম গোঁসাই, চণ্ডীদাস গোঁসাই,ফুলবাসুদ্দিন, ঈশান, বাখেরা শাহ, এরফান শাহ, সৈয়দ শাহ নূর, মিয়া ধন, শীতলাঙ শাহ, আতর চাঁদ, তিনু, শ্রীনাথ, শেখ কিনু প্রভৃতি জনপ্রিয়।

বাউল গানের অনুরাগী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর রচনায় বাউল প্রভাবও কম নয়। তাঁর। ভাষাতেই আলোচনা শেষ করছি : বাউল গান) থেকে স্বদেশের চিত্তের একটা ঐতিহাসিক পরিচয় পাওয়া যায়। এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই। একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এ মিলনে গান জেগেছে। এ গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলছে। কোরানে পুরাণে ঝগড়া বাধেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *