সাহিত্যের দ্বিতত্ত্ব

সাহিত্যের দ্বিতত্ত্ব

মানুষ তার পরিবেষ্টনীর আনন্দ ও যন্ত্রণা, সম্পদ ও সমস্যার মধ্যেই বাঁচে। এজন্যেই দেশ-কাল নিরপেক্ষ জীবনানুভূতি নেই। তাই বলে প্রতিবেশ আহৃত সব অনুভূতি সবহৃদয়ে সমান গুরুত্ব পায় না। বিদ্যা-বুদ্ধি-বোধি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা, রুচি-সংস্কৃতি ও মানস-প্রবণতার আনুপাতিক প্রভাবও অনুভবকে লঘু-গুরু করে। ফলে একের কাছে যা অসহ্য গুরুতর বা চাঞ্চল্যকর, অপরের কাছে তা নিতান্ত তুচ্ছ।

এ না হয়ে পারে না। কেননা জীবন ঋজু নয়, ঘটনা-বিরলও নয়। নিতান্ত ঘটনা-বিরল প্রাত্যহিকতার মধ্যেও কি ঘটনা কম! স্ত্রীর মেজাজ, ছেলের অবাধ্যতা, চাকরের ফাঁকি, প্রতিবেশী গৃহে ঝগড়া, রোয়াকে ইয়ারদের মধ্যে বিতর্কের ঝড়, বাজারে বেপারীর সঙ্গে চটাচটি, সংবাদপত্রের নানা খবর, চড়া বাজারদর, ভাগ্নের অসুখ–এমনি শতেক দিকে মন ও নজর আকৃষ্ট হচ্ছে। জীবনে এসব ঘটনার কোনোটাই ফেলনা নয়।

শত্রুকল্প প্রতিবেশীর ঘরের ঝগড়া কেমন শ্রোত্ররসায়ন ও মুখরোচক। আবার বাজারে পণ্যের অগ্নিমূল্য কীরকম ক্ষোভ জাগায়! বিরোধীদল জাতীয় পরিষদে সরকার পক্ষকে জব্দ করছে–এ সংবাদও তৃপ্তিকর। এমনি কত বিপরীত রসের অনুভবে চিত্তলোক তোলপাড় করছে। কিন্তু সবটা সমান আকর্ষণীয় নয় কোনো একজনের কাছে। ঘর-সংসারের দায়-দায়িত্ব যার নেই তেমন রাজনীতি-প্রিয় লোক যে-সংবাদে আনন্দিত কিংবা বিচলিত, ছাপোষা স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে তা পড়ার মতোও নয়। ক্রীড়াপ্রিয় কিংবা সিনেমাপ্রিয় কিশোর-তরুণ যে-কারণে সংবাদপত্র উলটাতে উৎসুক, সে-কারণ আমাতে একবারেই অনুপস্থিত।

অতএব আমার মনের উপর আজকের যে-ঘটনা প্রভাব ফেলেছে, আমার অনুভব ও চিন্তা উদ্ৰিক্ত করেছে অথবা আমার মেজাজে প্রসন্নতা কিংবা বিকৃতি এনেছে, সে ঘটনাই আমার আত্মীয় বন্ধুর সঙ্গে আলাপে কিংবা আমার লিখিত চিঠিপত্রে আভাসিত হবে। অন্য সব ঘটনা ও অনুভূতি চিরকালের জন্যে বিস্মৃতির আকাশে হাওয়া হয়ে যাবে। তা ছাড়া যার উদ্দেশে বলা, তার রুচি, প্রবণতা ও আগ্রহ নেই তেমন ঘটনা কিংবা অনুভুতি তার কাছে প্রকাশ করা অনুচিত–এমন চেতনাও ক্রিয়াশীল থাকে। কাজেই প্রসঙ্গ এবং পাত্র চেতনাও আমাদের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করে।

তাই গানে-গাথায়-কাব্যে-গল্পে উপন্যাসে প্রবন্ধে-ভ্রমণবৃত্তান্তে-বক্তৃতায় কোথাও আমরা সমকালীন-জীবনের-সমাজের-দেশের সামগ্রিক পরিচয় পাইনে। কোথাও বাজার দর মেলে, কোথাও হাট-বাটের বর্ণনা পাই, কোথাও বা ফলমূলের ফিরিস্তি থাকে, কোথাও থাকে ঘর-বাড়ি আসবাব-তৈজসের বর্ণনা, আবার কেউ বলেন আচার-আচরণ-পাল-পার্বণের কথা, কেউ বয়ান করেন অঙ্গের আবরণ-আভরণের বৈচিত্র্য, কারো কাছে মানুষের ধনদৌলত ও রাজনীতিই বর্ণিতব্য বিষয়– কিন্তু কোনো একজনের কাছে সবকিছুর খবর মিলে না।

সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এ সমভাবে সত্য। তাছাড়া সব মানুষের জীবন-দৃষ্টি ও জীবন-সমস্যা একরূপ নয়। দেশ কাল ব্যক্তি ভেদে তা ভিন্ন ও বিচিত্র। স্বাধীন দেশে মুক্তিসংগ্রামের গান রচিত হয় না, কিংবা আজকের চীন-রাশিয়ায় গণসংগ্রামের বাণী, নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদ কাব্যে ধ্বনিত হওয়ার কারণ অপগত।

ফোর্ড-রকফেলার ডালমিয়া-বিরলা, দাউদ-ভাওয়ানী-ইস্পাহানী-আগা খাঁর মনে জীবন সম্পর্কে যে জিজ্ঞাসা জাগে তা অন্ন-বস্ত্রের নয়, তাঁদের চেতনায় প্রেম-প্রকৃতি-পরকাল বিমূর্ত সত্য ও অম্লান আনন্দের তত্ত্ব ও তথ্যই মুখ্য। এমন মানুষের রচনায় বঞ্চিত-লাঞ্ছিত-শোষিত মানুষের কান্না ধ্বনিত হওয়ার কথা নয়। এবং ধ্বনিত হয় না বলে ক্ষুব্ধ হওয়াও কারো পক্ষে অনুচিত। কেননা নিরপেক্ষ ও অনাসক্ত দৃষ্টি ও মন মানুষে সুলভ নয়। যে যেই গাঁ, দেশ, জাত, ধর্ম, পরিবার এবং আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার অন্তর্গত, সে-সবের প্রতি মমতা ও আনুগত্য তার স্বভাবগত। এ কারণে শ্রেয়ো-বোধ কখনো সর্বজনীন হয় না। জীবনের দায়িত্ব-কর্তব্য, আদর্শ-উদ্দেশ্য তাই সবার অভিন্ন নয়। যে-মুহূর্তে যার মনে যে-যন্ত্রণা বা আনন্দ, যে-সমস্যা বা সম্পদ গুরুত্ব পায় তা-ই তার কথায় কাজে কিংবা লেখায় অভিব্যক্তি লাভ করে।

মানুষের বৈষয়িক জীবনে যেমন শ্ৰেণী আছে, শ্ৰেণীস্বার্থ আছে, দেশ-জাত-ধর্ম আছে, অন্তর্জগতেও তেমনি রয়েছে শ্রেণীগত মনন। কোনো আনন্দ বা যন্ত্রণা, কোনো সমস্যা বা বিপর্যয়, কোনো সৌভাগ্য বা গৌরব, দেশের সব মানুষকে স্পর্শ করে না, অন্তত সমভাবে করে না। এসব ক্ষেত্রে কেউ হারে, কেউ জেতে, কারো হয় সর্বনাশ, কারো আসে পৌষমাস। কাজেই দেশ-কাল অভিন্ন বলেই ভাব-চিন্তা-কর্ম অভিন্ন হয় না। এমনকি স্বার্থবুদ্ধির প্রভাবমুক্ত মনও অন্যের হয়ে ভাবতে পারে না। সহানুভূতিও তাই কখনো সমানুভূতির পর্যায়ে ওঠে না। তেমন অবস্থায় মানবিক বোধ ও আদর্শ-চেতনাই যোগায় অনুপ্রেরণা।

অতএব সাহিত্যে-সঙ্গীতে, চিত্রে-ভাস্কর্যে দুইরূপ-দুইতত্ত্ব থাকবেই। যারা বেদনামুক্ত যারা আনন্দিত, যাদের জীবন সমস্যা-সঙ্কুল নয় তারা নান্দনিক কলাচর্চায় পাবে আত্মার খোরাক। আর যারা বঞ্চিত, শোষিত ও যন্ত্রণাগ্রস্ত তাদের কলায় থাকবে জমাট আর্তনাদ কিংবা মুক্তি-অন্বেষা। এভাবে সাহিত্যাদি কলায় সুন্দরের অনুধ্যান ও আনন্দের অভিব্যক্তি যেমন থাকবে; হাভাতের হাহাকার, আর্তের চিৎকার, বঞ্চিতের অভিশাপ, নির্যাতিতের ক্ষোভ, শোষিতের সংগ্রামী কণ্ঠও তেমনি ধ্বনিময় হয়ে উঠবে।

কাজেই বুর্জোয়ার আনন্দের সাহিত্যের পাশাপাশি পরাধীন নির্যাতিত শোষিত মানুষের বেদনা, বিক্ষোভ ও সগ্রামের সাহিত্যও থাকবে।

অবশ্য এমন দিনের স্বপ্নও আমরা দেখতে থাকব যখন সংগ্রামী গণসাহিত্যের প্রয়োজন ফুরাবে। তখন সাহিত্যাদি কলা আবার পুরোনো নান্দনিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন আবার প্রেম-পাখী-প্রকৃতি সত্য ও সত্তার রহস্য, সুন্দর ও আনন্দের অনুধ্যান আমাদের আঁকার ও লেখার, গানের ও বাজনার, নাচের ও নির্মাণের অবলম্বন হবে। কেননা যন্ত্রণাবিহীন জীবনই তো সবার কাম্য। আনন্দলোক সৃষ্টি করাই তো সবার লক্ষ্য। সে পথে যে-বাধা রয়েছে সে-বাধা অপসারণের চেষ্টার নামই গণ-সগ্রাম। সে লক্ষ্যে উত্তরণের জন্যেই সগ্রাম। সেদিন আর শোষিত-নির্যাতিত শ্ৰেণীর জন্যেই নয়–মানুষ নির্বিশেষের জন্যে প্রীতির অনুশীলনই হবে লিখিয়েদের লক্ষ্য। বঞ্চিত শোষিত-নির্যাতিত মানবতার সেবার ব্রত তাদের মুক্তির জন্যে সংগ্রামী প্রেরণা যোগানোর সাধনা, তাদের বেদনা-বিক্ষোভের অভিব্যক্তি দানের দায়িত্ব-মানবতাবাদীদের গ্রহণ করতেই হবে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকেই আসবে এ সংগ্রামের সৈনাপৈত্য, এ ক্ষোভ-মিছিলে নেতৃত্ব, এ প্রতিরোধ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা। কাজেই আজকের আফ্রো-এশিয়ায় দরদী ও দায়িত্বশীল লিখিয়েরা সংগ্রামী সাহিত্যই সৃষ্টি করবেন, যেমন প্রতীচ্যের সুখী মানুষেরা করেছেন ভঙ্গিসরস, মনন-প্রধান, লীলা-সখ্য সাহিত্য।

বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন–লোক-শিক্ষা, লোকোপকার কিংবা সৌন্দর্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে লেখনী ধারণ পাপ। হৃদয়বান মানববাদীরাও বলেন যেখানে মানুষ আজো অনিকেত, আজো অভুক্ত, আজো দাসত্বে পশুপায়, আজো অশিক্ষায় পঙ্গু, আজো অজ্ঞানে অন্ধ, আজো অবিদ্যায় অবোধ, আজো পীড়নে পৃষ্ঠ, আজো শোষণে অস্থিসার, আজো অকালমৃত্যুর শিকার, আজো রুদ্ধকণ্ঠ, আজো বদ্ধহস্ত; সেখানে সৌন্দর্য সৃষ্টি পাপ– অমানুষিক অনাচার দানবিক নির্মমতা।

কিন্তু এ নিন্দা ও বিক্ষোভ অবিবেচনাপ্রসূত। কেননা জীবনে যাঁরা অবাধসুখ ও অপরিমেয় সুযোগসুবিধা পাচ্ছেন তাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চা হবে আনন্দের জন্যেই অর্থাৎ আনন্দলোক নির্মাণ লক্ষ্যে তাঁরা সৌন্দর্য সৃষ্টি করবেন। বাধা পেলে বরং লেখনী ত্যাগ করবেন, কিন্তু অন্তরে প্রেরণা নেই বলেই গণসাহিত্য সৃষ্টি করতে কখনো পারবেন না। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। এ শ্রেণীর কোনো কোনো মানববাদী গণ-সগ্রামের সৈনিকরূপে মসীযুদ্ধে অবতীর্ণ হন।

ব্যক্তিগত জীবনে যেমন পীড়ন পেলে প্রতিকার-প্ৰয়াস জাগে তেমনি সামাজিক ঔপনিবেশিক, আর্থিক ও কায়িক পীড়ন মুক্তির জন্যে সগ্রাম না করে অন্য পক্ষের উপায় নেই। তাছাড়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লিখিয়ে-আঁকিয়েরাও তো ঘা-খাওয়া মানুষ, তারাও তো আর্থিক-সামাজিক-মানসিক অনেক ন্যায্য অধিকার থেকেই বঞ্চিত। কাজেই তাদের নিজেদের জন্যেও মুক্তিসংগ্রাম প্রয়োজন। মনোবল থেকেই আসে বাহুবল, কাজেই লেখনী মাধ্যমে গণমনে মনোবল জাগানো, চোখ খুলে দেয়া, চেতনা সঞ্চার করা তাঁদেরও গরজ। কারণ এক্ষেত্রে সাফল্যের একমাত্র উপায় হচ্ছে জনমত গঠন তথা গণশক্তি প্রয়োগ। এ হচ্ছে সামাজিক তথা যৌথ কর্ম। একক মানুষের দায়িত্ব কেবল সভ ঘক্তির অনুগত্যে সাড়া দেওয়া। অবশ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লেখকও বুর্জোয়া প্রলোভনে লক্ষচ্যুত হয়ে স্বস্বার্থে সুখ-সুবিধা লাভের লোভে দায়িত্ব এড়িয়ে কর্তব্য-ভ্রষ্ট হয়ে অথবা নিছক মানস-প্রবণতা বশে জুটে যান নিরাপদ নান্দনিক কলার চর্চায়। এদের কেউ কেউ সরকারি শিরোপারও উমেদার। এঁরা স্বশ্রেণীদ্রোহী চরিত্রহীন। এবং প্রয়োজন ও প্রতিবেশ চেতনাহীন। মধ্যবিত্তশ্রেণীর কোনো কোনো লিখিয়ে কৃপার ও ক্ষমার পাত্র। কেননা তারা জানেন না তারা কী লিখছেন আর কেন লিখছেন। এভাবে মধ্যবিত্ত সমাজের লিখিয়েদের তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা চলে। একদল যথার্থ সংবেদনশীল, দায়িত্ব-সচেতন, কর্তব্যপরায়ণ ও নিষ্ঠ সগ্রামব্রতী; এঁরাই জনগণের আশা-আশ্বাসের অবলম্বন। এঁরা সরকার-শত্রু। আর একদল আছেন সরকার-ঘেঁষা–এরা সুবিধাবাদী-স্বার্থবাজ। এরা গণ-শত্রু। তাই ঘৃণ্য। শেষ দল সরকার-ভীরু। এরা গা বাঁচিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রত্যাশী। এরা কৃপার পাত্র।

কাজেই যতদিন পর্যন্ত কলাকৈবল্যরস উপভোগ করার অবস্থা ও সামর্থ্য সর্বমানবে সম্ভব না হচ্ছে ততদিন এই কেজো–এই বৈষয়িক–এই বাস্তব জীবনের চাহিদা-সর্বস্ব গণ-সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়োজন থাকবে।

অতএব সাহিত্যের দুইরূপ– দুইতত্ত্ব-দুইধারা এবং দুটোই রসময়; একটি কেবল উপভোগের জন্যে আর একটি নিছক উপলব্ধির জন্যে। একটির রস হয়তো যথার্থই মধুর, অপরটি ভিন্ন নামে কষ– যা কলিজা-নিঃসৃত এবং প্রথমে লাল ও পরে কালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *