সাহিত্যে স্বাতন্ত্র

সাহিত্যে স্বাতন্ত্র

স্বাতন্ত্র্য আজকাল একটি মুখরোচক ও শ্রোত্ররসায়ন চালু কথা। মানুষ ভাবে কম এবং পরের মুখে ঝাল খাওয়ায় অভ্যস্ত, আর কানকথা শুনতে উৎসুক, এমনকি কানকথায় কান ভার করতেও তার দ্বিধা নেই। তাই চলতি বুলির জনপ্রিয়তা প্রায় অপ্রতিরোধ্য। চলতি কথার প্রভাবও গভীর এবং ব্যাপক। এর প্রভাব ভালো-মন্দ, আবেগ-উদ্বেগ, আনন্দ-বেদনা, আশা-হতাশা, সাহস-ভীরুতা, উৎসাহ-নৈরাশ্য, উত্তেজনা-ঔদাসীন্য প্রভৃতি যে-কোনো ভাব মানবমনে জিইয়ে রাখতে সমর্থ। ফলে এর থেকে লাভের লোভ ও ক্ষতির ঝুঁকি এড়ানো যায় না।

স্বাতন্ত্র্য কথাটিও এখন একটি জনপ্রিয় চলতি বুলি! রাষ্ট্রিক স্বাতন্ত্র, জাতীয় স্বাতন্ত্র, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র, সামাজিক স্বাতন্ত্র, ব্যক্তিক স্বাতন্ত্র, সাহিত্যে স্বাতন্ত্র প্রভৃতি জীবনের প্রতিক্ষেত্রে প্রায় শতেক স্বাতন্ত্রের বেড়ায় আমরা নিজেদের বদ্ধ করছি। দেখে-শুনে মনে হয় জগতে স্বাতন্ত্র গৌরবের মতো গৌরব নেই। স্বাতন্ত্রের অনুশীলন কর, তাহলেই ঘুচবে সব দুঃখ, মিটবে সব অভাব। ইরি ধানের মতো স্বাতন্ত্রের চাষে যে ফলন তার যেন তুলনা নেই।

ঘরে যারা এভাবে বিভেদের বীজ বুনে চলেছে, তারাই আবার UNO-এর প্রেক্ষা- মঞ্চে বিশ্বমানবের বিশ্বরাষ্ট্রের সংহতি ও ঐক্যের বাণী কপচায়। নিবর্ণ ও নির্বিশেষ মনুষ্যসমাজের প্রচারক যাঁরা, তাঁরা বৈষম্যের ব্যবধান জিইয়ে রাখার উপায় উদ্ভাবনেও উৎসাহী। সত্যিই মানুষ বড় বিচিত্র ও অদ্ভুত প্রাণী। মুখে তার প্রীতি ও মৈত্রীর বাণী, হাতে তার মারণাস্ত্র। সে এক হাতে কাড়ে, আর এক হাতে বাহবা ললাটে।

আবাল্য ম্যাকিয়াভেলীকে একজন সুন্দর শয়তান বলে জেনেছি। কিন্তু আজকাল যেন তার প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে উঠছি। মাঝে মাঝে মনে হয় মানব-প্রকৃতির এতবড় ব্যাখ্যাতা বুঝি আর দ্বিতীয়টি নেই। তার উচ্চারিত তত্ত্ব যে চিরন্তন ও চর্চার বিষয় হয়ে থাকবে তা হয়তো তিনিও জানতেন না। তিনি বলেছেন– A Prince must know how to play at once man and beast, lion and fox. He neither should nor can keep his word, when to do so, will turn against him…I venture to maintain that it is very disadvantageous always to be honest, useful, on the other hand to appear pious and faithful, humane and devout. Nothing is more useful than the appearance of virtue.

আজকের দিনের রাষ্ট্রপতি-রাষ্ট্রনায়কেরা এই নীতি অবিচল নিষ্ঠায় মেনে চলেছেন। প্রজার আনুগত্য লাভের সহায়ক হিসেবে ধর্মের বুলি কপচানো এবং প্রবল পক্ষের ধর্মমতকে সমর্থন করাও সরকারের পক্ষে আবশ্যিক বলে জানতেন ম্যাকিয়াভেলী। বিশ্বের অনুন্নত দেশের কোনো কোনো সরকার তাও আক্ষরিকভাবে মানে এবং নির্বিঘ্ন নিশ্চিন্ত শাসন-শোষণের সুযোগ পায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্ণের, গোত্রের ও ধর্মের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার বুলি। দুনিয়ার সর্বত্র বিশেষ করে আমেরিকায়, আফ্রিকায় ও অস্ট্রেলিয়ায় আজ এটিও শাসন-শোষণের একটি ফলপ্রসূ কৌশল ও মোক্ষম উপায়রূপে বিবেচিত, প্রযুক্ত ও প্রমাণিত। ফলে দুনিয়ার সর্বত্র সরকারের পরোক্ষ প্ররোচনায় আজ স্বাতন্ত্র-সাধনা দ্রুত প্রসার লাভ করছে। রোমকদের সেই Divide and Rule নীতি আজো উপযোগ হারায়নি, বরং তার গুরুত্ব বেড়েছে।

জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যের ক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্য-চেতনা এবং স্বাতন্ত্র-সাধনা প্রবল। হয়ে উঠেছে। সুন্দরের ও আনন্দের আয়োজনে ও উপভোগে স্বাতন্ত্র্য-চেতনা নিরপেক্ষ কানে অদ্ভুত শোনায় বটে, কিন্তু আজ এও সত্য ও স্বাভাবিক হতে চলেছে। এতকাল আমরা জানতাম শিল্প, সংগীত ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে রসিকের রুচি ও বোধের মাত্রাভেদ আছে। কিন্তু স্বাতন্ত্র যে আছে, তা ইদানীং জানছি।

কিন্তু এ স্বাতন্ত্র কোন্ তাৎপর্যে প্রযুক্ত তা আমরা জানিনে। যে-কোনো কলা-স্রষ্টার ব্যক্তিগত বোধ-বুদ্ধি, রুচি-সংস্কৃতি, মন-মনন ও চেতনার কথা জীবন-দৃষ্টির প্রসূন। সে কারণে প্রত্যেক শিল্পীর সৃষ্টি স্বতন্ত্র অর্থাৎ অনন্য ও মৌলিক। এ অর্থে সাহিত্যে জাতিগত কিংবা দেশগত স্বাতন্ত্র্য থাকতে পারে না, পারে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য।

আবার আদর্শ, উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনগত ঐক্য থাকলে, রূপগত অর্থাৎ আঙ্গিকগত অনৈক্য স্বাতন্ত্র্য দান করে না। যেমন জুতা কিংবা পাজামা প্রত্যেকেই তার পায়ের ও গায়ের মাপে তৈরি করায়, তাতে কিন্তু জুতো বা পাজামা স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে না। সাহিত্য-সংগীত-চিত্র-নৃত্য-ভাস্কর্য প্রভৃতির আবেদন সর্বজনীন। কেননা এগুলো মনের এক নিরূপ চাহিদা পূরণ করে, চেতনার এক মানবিক পিপাসা মিটায়। এগুলো কলা-চেতনার সৌন্দর্যময় ও আনন্দময় অভিব্যক্তি। এজন্যে প্রাত্যহিক জীবনের স্থূল প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে এগুলোর স্থিতি। চিত্তে বিশেষ এক চেতনা বা চিত্তবৃত্তি না জাগলে অথবা না থাকলে এগুলোর কোনো আবেদন অনুভব কিংবা এগুলোর অভাববোধ করা সম্ভব হয় না। কাজেই অনুভবের এই বিশেষক্ষেত্রে দেশ-কাল-জাতি-ধর্ম না-থাকারই কথা।

যেহেতু এসব কলার আধার-নিরপেক্ষ অবয়ব নেই, সেজন্যে এগুলোর আধার ভেদ নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আধার ভেদে আধেয় রূপ বদলায়, গুণ বদলায় না। কাজেই দেশ-কাল ও নামভেদ থাকলেও সাহিত্যে আর কোনোরূপ স্বাতন্ত্র সম্ভব নয়। এবার দৃষ্টান্ত নিয়ে বুঝবার চেষ্টা করা যাক।

প্রথমত, ধরা যাক জাতীয় সঙ্গীত ও স্বদেশ-স্বজাতি-প্রীতিমূলক গান ও কবিতা। এগুলো সবদেশের সবজাতের লোকই রচনা করে। তাতে আদর্শ, উদ্দেশ্য ও বক্তব্য থাকে অভিন্ন। কেবল দেশের নামভেদ থাকে মাত্র। ওটি বদল করে দিলে সর্বজনীন ও সর্বকালিক অনুভূতির বাহন হয় সেই গান বা কবিতা। নাটক-উপন্যাস-গল্পের ক্ষেত্রেও আদর্শ, উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন যেহেতু অভিন্ন, পরিবেশ ও পাত্র-পাত্রীর নাম পালটে দিলে তা যে-কোনো দেশের মানুষের জীবনে চেতনার চিত্র হয়ে উঠতে পারে। তেমনি নৈতিক-সামাজিক জীবনের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্বন্ধীয় রচনায়ও ব্যক্তিভেদে মতাদর্শের পার্থক্য হতে পারে। কিন্তু দেশভেদে প্রয়োজন ও ফল ভেদ হতে পারে না।

প্রেম কিংবা পীড়ন, লোভ কিংবা অসূয়া, ক্রোধ কিংবা সহিষ্ণুতা, ক্ষমা কিংবা প্রতিহিংসা, আনুগত্য কিংবা কৃতঘ্নতা প্রভৃতি জৈব বৃত্তি-প্রবৃত্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেশভেদে আলাদা হয় না, ব্যক্তিভেদে মাত্রার তারতম্য ঘটে কেবল।

অতএব যথার্থ সাহিত্য-রস দেশ-কালের ঊর্ধ্বে সর্বমানবিক। কেবল প্রচার সাহিত্যেরই দেশ কাল ও জাত-ধর্ম আছে। বলাবাহুল্য সংস্কৃতিবান কোনো মানুষ তা রচনাও করে না, পড়েও না এবং সাহিত্য বলে স্বীকারও করে না। সৎ-সাহিত্য মানুষকে ভাবায়, পরিশ্রুত করে চিত্তবৃত্তি এবং অনুভবের জগৎ করে প্রসারিত। এক-একটি মহৎ সৃষ্টি পাঠকের চেতনায় নতুন ভুবন রচনা করে। এক-একটি মহৎ কথার অনুভবে পাঠক তিলে তিলে নতুন হয়ে ওঠে। তেমন কথায় ঘটে জীবনবোধের উন্নয়ন ও আত্মার স্বাধীন জগতে উত্তরণ। তেমন গ্রন্থ বিদেশীর-বিজাতির কিংবা বিধর্মীর রচনা বলে পরিহার করলে জীবনের আশীর্বাদ ও প্রসাদ থেকেই কেবল নিজেকে বঞ্চিত রাখা হয়, রোধ করা হয় নিজের অগ্রগতি। মানুষের চেতনার শ্রেষ্ঠ প্রসূন ভাব-চিন্তা-জ্ঞান-অনুভূতি বর্জনের দুর্বুদ্ধি যার মনে বাসা বাঁধে, সেও কি শিক্ষিত!

সাহিত্য-শিল্পাদি কলার ক্ষেত্রে অন্তত স্বাতন্ত্র-চিন্তা বর্জন করাই বাঞ্ছনীয়। এখানে স্বাতন্ত্র্য নয়, সহযোগিতা ও সহ-অবস্থানই কাম্য। তা ছাড়া এগুলো যখন বৈষয়িক নয়, মানসিক এবং সাধারণের নয়, কেবল বিশেষেরই চর্চার বিষয় তখন সহিষ্ণুতাই শোভন। এক্ষেত্রে সাড়ে পাঁচশ বছর আগেকার এক মনীষীর বাণী আমাদের হয়তো দিশা দিতে পারে :

Love the truth. Let others have their truth and the truth shall prevail. (Jan Huss of Bohemia)

এ সূত্রে গ্যটের বাণী স্মরণ করেও আমরা হয়তো চক্ষুষ্মান হতে পারি :

National literature is now rather and unmeaning term; the epoch of world literature is at hand and each one must try to hasten its approach.

তা ছাড়া বৈষয়িক জীবনেই যখন স্বস্বার্থে আমরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দৃঢ় ও গাঢ় করবার প্রয়াসী, তখন মানসিক-জীবনেই বা স্বাতন্ত্র্য কামনা করে দীনতাকে দীর্ঘস্থায়ী করব কেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *