বলাকাকাব্যে মৃত্যু-মহিমা

বলাকাকাব্যে মৃত্যু-মহিমা

রবীন্দ্রনাথ যে বিদ্রোহী-বিপ্লবী সগ্রামী কবি নজরুল ইসলামের পূর্বসূরী ও বিপ্লব-মন্ত্রে দীক্ষাগুরু, সে কথা আমরা প্রায়ই ভুলে থাকি। বলাকাকাব্য থেকে এখানে বিপ্লবী-সংগ্রামী রবীন্দ্রনাথের পরিচয় তুলে ধরছি।

ইন্দ্রনাথ চরম তাচ্ছিল্যে শ্রীকান্তকে বলেছিল, মৃত্যুকে ভয় কি, মরতে তো একদিন হবেই। নৌকাডুবি হয়ে, গাড়িচাপা পড়ে, ঝড়-বন্যা-মহামারীর কবলে পড়ে রোজ কত কত অপঘাত অপমৃত্যু হচ্ছে। মরণকে এড়ানো-আটকানো যায় না। মরতেই যদি হবে, তাহলে অন্য দশ প্রাণীর মতো অসহায় নিষ্ফল মৃত্যুর জন্যে সভয়ে অপেক্ষা করার চেয়ে স্বেচ্ছায় মহৎ মৃত্যুবরণ করাই তো মানুষের কাজ। সক্রেটিস, যিশু, ব্রোনো এমনি মহৎ মৃত্যুই হাসিমুখে বরণ করেছিলেন। এ মৃত্যু বাঁচবার ও বাঁচাবার জন্যেই। এক প্রাণ দিয়ে লক্ষ কোটি প্রাণের নিরাপত্তা দানই এমন মৃত্যুর লক্ষ্য। প্রয়োজনমতো যে মরতে প্রস্তুত, বাঁচবার অধিকার তারই। সময়মতো যে মরতে জানে সেই বাঁচিয়ে রাখে জগৎ-সংসারের মানুষকে ও মনুষ্যত্বকে। লক্ষ-কোটি মানুষের মধ্যেই সে সগৌরবে সার্থক হয়ে বাঁচে। নিঃশেষে প্রাণ যে করিব দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।

যিশু ক্রুসে বিদ্ধ হয় রক্ত দিয়েছিলেন, দিয়েছিলেন প্রাণ। তার রক্ত ধুইয়ে-মুছে দিয়েছে কোটি কোটি পাপী-তাপী খ্রীস্টানের পাপ-তাপ এবং তার এক প্রাণের বিনিময়ে কোটি কোটি প্রাণ পেয়েছে ত্রাণ। তাই যিশু হলেন মানুষের ত্রাণকর্তা Saviour এবং যে-সে যিশু বিদ্ধ হয়েছিলেন তা হল মানুষের প্রাণরক্ষক বর্ম। এমনি করে মৃত্যুর বিনিময়ে জাগে প্রাণ, বিকাশ পায় জীবন। দুনিয়াব্যাপী মানুষের অগ্রগতির মূলে রয়েছে বীর মুযাহিদের আত্মদান।

স্বার্থপর লোভী নিজেও শেষ অবধি বাঁচতে পারে না, অন্যকেও বাঁচতে দিতে জানে না। তার লোভ ও আত্মরতি তাকে পরস্বে ও পীড়নে প্ররোচিত করে। লোকহিতার্থে তাকে ঠেকানোর জন্যেই ত্যাগবীরের প্রয়োজন। যে-দেশে যে-সমাজে তেমন লোকের অভাব, সে-দেশের ও সে-জাতির জীবন-যন্ত্রণা কেবলই বাড়ে। ভীরুরা আত্মসংকোচন করে ও পালিয়ে বাঁচতে চায়। আত্মসংকোচন ও পলায়ন নামান্তরে আত্মবিলোপ বই কিছুই নয়। কেননা ওতে লোভীর লোভ ও দুবৃর্ত্তের পীড়ন-স্পৃহা বৃদ্ধি পায়। মানুষের জীবনে ও জীবিকার যেখানে যতটুকু নিরাপত্তা রয়েছে তা তো ঐ নির্ভীক ত্যাগবীরের প্রাণের বিনিময়েই লব্ধ। এবং প্রয়োজনমতো প্রাণদানে সমর্থ কিছুসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিই তো লোভী হিংস্রকে সংযত রেখেছে। দুবৃর্তের সম্বল বুদ্ধি ও বাহুবল। এগুলোর সীমা আছে। লোক-রক্ষক সংগ্রামীর শক্তির উৎস হচ্ছে সদিচ্ছা ও মনোবল। এ শক্তি তাই অসীম, অপরিমেয় ও অফুরন্ত। ত্রাসের ঝড় বিভীষিকাময় কিন্তু ক্ষণজীবী, ত্রাণের বায়ু মৃদু-প্রবাহী কিন্তু স্থায়ী ফলপ্রসূ। দুবৃত্ত নামে ঝড়ের বেগে এবং গতিও তার ঝড়ো। জনে জনে হয় জনতা। তার বেগ বন্যার। এবং বন্যা বাঁধ মানে না। জনতার সৃষ্টি রক্তবীজে। কেটে-মেরে তাকে নিঃশেষ করা যায় না। কেবলই বাড়ে, অসংখ্য ও অজয় হয়ে বাড়ে। বাহুবলে বলীয়ান দুবৃত্ত সিংহচর্মের আবরণে শৃগাল।

তাই আত্মপ্রত্যয়ী জনতা যখন রুখে দাঁড়ায়, তখন সেই দুবৃত্তপীড়ক–

পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাষ্য মিশে।

কেননা,

কেহ নাহি সহায় তাহার
মুখে করে আস্ফালন, জানে সে হীনতা
আপনার মনে মনে।

মনোবল আসে ন্যায়নিষ্ঠা ও আত্মপ্রত্যয় থেকে। সদিচ্ছা ও কর্তব্যবুদ্ধিই মানুষকে করে নির্ভীক ও আত্মদানে অনুপ্রাণিত। তেমন মানুষই পা বাড়ায় বিপদের মুখে। এগিয়ে যায় নিশ্চিত মৃত্যুর পথে। কেননা সে জানে, পরিণামে জয়ী হয় শহীদেরাই। ভয়-সংশয় দলিত করে জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে যে প্রথম এগিয়ে যায়, সেই-দেশ-জাত মানুষের ত্রাণকর্তা। পৌরুষ ও কাপুরুষতার মধ্যে ব্যবধান ঐ এক কদমেরই। ঐ বাড়তি কদমেরই নাম বীরত্ব, আত্মত্যাগ, নেতৃত্ব, মনুষ্যত্ব এবং লোকাণ। জগতে ও জীবনে শক্তির ও সংগ্রামী প্রেরণার উৎস ঐ আগে-বাড়ানো কদমটিই। এই বাড়তি কদমের মূলে রয়েছে যে জাগ্রত চিত্ত, সে-চিত্ত আগেই জীবনের প্রসাদরূপে গ্রহণ করে :

কালবৈশাখীর আশীর্বাদ
শ্রাবণ রাত্রির বজ্রনাদ
পথে পথে কণ্টকের অভ্যর্থনা
পথে পথে গুপ্তসৰ্প গূঢ়ফণা।

সে-চিত্ত জানে-পীড়ন হবে যত প্রবল, মুক্তি আসবে তত দ্রুত। শিকল পরেই বিকল করতে হয় শিকল, একপ্রাণের বীজ সৃজন করতে হয় কোটি প্রাণ, বুকের রক্তই হয় রক্তবীজ যা সৃষ্টি করে অসংখ্য-অজেয়-অমর আত্মা। এমন মানুষের নেতৃত্বেই তো দেশ-জাত ও ধর্ম রক্ষার জন্যে মানুষ চিরকাল অকাতরে প্রাণ দিয়েছে–মরণোৎসবে উল্লসিত হয়েছে, রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে তুলেছে বিদ্রোহের ধ্বজা। যারা প্রাণের মমতায় প্রাণীমাত্র, তারা প্রাণটা জিইয়ে রাখার জন্যে সদসতর্ক থেকেও অকালে- অসময়ে-অকারণে-অঘোরে প্রাণ হারায়; আর যারা প্রাণের মূল্য বোঝে, তারা দেশ-জাত-মানুষের ত্রাণের জন্যে প্রয়োজনের মুহূর্তে প্রাণটি দিয়ে প্রাণের মূল্য প্রমাণ করে। এবং ধন্য হয় নিজে, ধন্য করে জগৎ সংসারকে।

আমরা চলি সমুখ পানে, কে আমাদের বাঁধবে?
 দিনে দিনে যখন বঞ্চনা বাড়িয়া উঠে, ফুরায় সত্যের যত পুঁজি
তখন বন্ধন পীড়ন-দুঃখ অসম্মান ক্ষুব্ধ মৃত্যুঞ্জয় তরুণেরা –
ভীরুর ভীরুতাঞ্জ প্রবলের উদ্ধত অন্যায়
লোভীর নিষ্ঠুর লোভ বঞ্চিতের নিত্য চিত্তক্ষোভ
জাতি-অভিমান।

দূর করবার জন্যে নেমে পড়ে বন্ধুর পথে। ঝড়ো হাওয়ার মতো, ঝাবিক্ষুব্ধ-সমুদ্রের মতো তারা প্রতিবাদের রোল-কল্লোল জাগায়। তখন বিশ্বজগৎ অবাক হয়ে দেখে আর শোনে ঝড়ের মাতন, বিজয় কেতন নেড়ে, অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেড়ে এগিয়ে চলছে তরুণরা। এবং

ঝটিকার কণ্ঠে কণ্ঠে শূন্যে শূন্যে প্রচণ্ড আহ্বান
মরণের গান।
উঠেছে ধ্বনিয়া পথে নবজীবনের অভিসারে
ঘোর অন্ধকারে।

প্রপীড়িত আত্মার বন্ধন জর্জরতা ঘুচাবার সংকল্পে দৃপ্ত নির্ভীক তরুণের কণ্ঠে জেগে উঠে মরণজয়ী-গান :

লাঞ্ছিতেরে কে রে থামায়?
ঝাঁপ দিয়েছি অতল পানে
মরণ-টানে।

মরণপণ সংগ্রাম তাদের। তারা জানেই :

বাধা দিলে বাধবে লড়াই, মরতে হবে।

রবীন্দ্রনাথ কোনো সুখের-সম্পদের ও কোনো খ্যাতি-ঐশ্বর্যের লোভ দেখিয়ে তরুণদের আহ্বান করেননি। গ্যারিবল্ডীর মতোই তিনি সংগ্রামী সৈতিকদের ডাক দিয়েছেন-দুঃখ যন্ত্রণার ও মৃত্যুর পথে। তাঁর মতে যে প্রয়োজনমতো মরতে ও মারতে জানে, বাঁচবার ও বাঁচাবার যোগ্যতা রয়েছে তারই। দেশ-জাতমানুষের হিতার্থে আত্মাহুতি দিতে পারে, সমাজে তেমন তরুণের আবির্ভাব তিনি চিরকালই কামনা করেছেন। তার বিশ্বাস জীবন-মৃত্যুকে যে পায়ের ভূত্য করেনি, তেমন মানুষ দিয়ে দেশ-জাত-মানুষের কোনো কল্যাণ আসতে পারে না, কেননা সারা দুনিয়াব্যাপী পাশব-শক্তিরই দানবীয় লীলা চলছে। তার মোকাবেলার জন্যে দিতে হবে রক্ত ও প্রাণ, দিতে হবে শোণিত ও জীবন। এভাবেই দূর করা সম্ভব —

যত দুঃখ পৃথিবীর, যত পাপ, যত অমঙ্গল
যত অশ্রুজল
যত হিংসাহলাহল

 মানুষের প্রাণে মানুষ যত বিষ মিশিয়েছে, সে বিষ ধুইয়ে-মুছে ফেলবার জন্যে চাই মহৎপ্রাণ ব্যক্তির রক্ত। কাজেই রবীন্দ্রনাথ ত্যাগবীর তরুণের রক্ত ও প্রাণ দান কামনা করেছেন নব-দানবের দেয়া দারিদ্র-পীড়ন-যন্ত্রণা থেকে মানুষের মুক্তির জন্যে। এই দানবের সাথে লড়াইয়ের জন্যে ঘরে ঘরে যে লড়িয়ে-তরুণ প্রস্তুত হচ্ছে, তাও তিনি দেখতে পেয়ে আশ্বস্ত হয়েছিলেন। এবং এ-ও জানতেন :

কোনো ভাবী ভীষণ সংগ্রাম
রণ শৃঙেখ আহ্বান করিছে তার নাম।

আমরা যারা বাঁচবার মতো বাঁচতে জানলাম না, পারলাম না মরার মতো মরতে, এই মৃত্যুঞ্জয়ী বীরদের আত্মাহুতির সহজ প্রবণতা দেখে আমরাও জীবনে হঠাৎ করে খুঁজে পাই শক্তি, গর্ব ও প্রত্যয়। ভাবীসগ্রামে শহীদেরাই হয়ে থাকে প্রেরণার উৎস ও পথের দিশারী।

রবীন্দ্রনাথের মতে, দুঃখ-বেদনা ও মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ঘটে নবযুগের ও নতুন জীবনের অরুণোদয়। যে-পোষ মানে, সে মরে, যে অতীতকে আশ্রয় করে, সে হয় জীর্ণতায় অবসিত। কাজেই বিপদ সামনে নয়, পশ্চাতে। পশ্চাতই–পুরাতনই মানুষকে গ্রাস করে :

ওরা জীবন আঁকড়ে ধরে
মরণ-সাধন সাধবে
কাঁদবে ওরা কাঁদবে।..
রইল যারা পিছুর টানে।
কাঁদবে তারা কাঁদবে।

সম্মুখের বাধার আহ্বানে যে সাড়া দেয়, জীবনযাত্রায় সেই হয় জয়ী। জীবন তার কাছেই ধরা দেয়। সে জানে সামনে নতুন দিন। প্রভাত হতে দেরি নেই :

নতুন ঊষার স্বর্ণদ্বার।
খুলিতে বিলম্ব নাই আর।

 রবীন্দ্রনাথের চিরকালই এ-বিশ্বাস ছিল যে-কোনো মহৎ মৃত্যুই বৃথা যায় না এবং রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে ছাড়া কোনো মহৎ কল্যাণ, কোনো বৃহৎ মুক্তি আসতে পারে না। কেননা পাপ ও পীড়ন, অন্যায় ও শোষণ দানবীয় শক্তিরই দান। সেই রাক্ষুসে রাহু- গ্রাসই ম্লান করে দিয়েছে– কালো করে দিয়েছে পৃথিবীর আলো। তাই আস্তিক্যবুদ্ধি নিয়ে কবি প্রশ্ন করেছেন :

মৃত্যুর অন্তরে পশি অমৃত না পাই যদি খুঁজে
সত্য যদি নাহি মেলে দুঃখ সাথে যুঝে,
পাপ যদি নাহি মরে যায়
আপনার প্রকাশ লজ্জায়,
অহংকার ভেঙ্গে নাহি পড়ে আপনার অসহ্য সজ্জায়,
তবে ঘর ছাড়া সবে
অন্তরের কি আশ্বাস রবে
মরিতে ছুটিছে শত শত
 প্রভাত আলোর পানে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের মতো?
 বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য সে কি ধরার ধূলায় হবে হারা?
রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন?
নিদারুণ-দুঃখরাতে
মৃত্যুঘাতে।
মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্তসীমা
 তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?

রবীন্দ্রনাথ গান্ধীপন্থী ছিলেন না, তিনি শক্তি দিয়ে শক্তির মোকাবেলায় আস্থা রাখতেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *