জীবনের নিয়ামক
আদিকাল থেকে মানুষ দৈবশক্তির অস্তিত্বে আস্থা রেখেছে এবং নিজের ভাগ্যকে সে- শক্তির সঙ্গে করেছে যুক্ত। যে যত বেশি দুর্বল, অসহায় ও অসমর্থ; তার জীবনে দৈব-শক্তির প্রভাবও তত অধিক। জীবনে রয়েছে নানা প্রয়োজন, নানা অভাব এবং তা বাঞ্ছ বা আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপে মনের কোণে জেগে থাকে। যা চাওয়া হয় তা পাওয়া যায় না। চাওয়া-পাওয়ার মধ্যেকার ব্যবধান ঘোচানো যখন সাধ্যাতীত বলে নিশ্চিত ধারণা জন্মায় অথচ প্রাপ্তির বা কোনোমতেই মন থেকে মুছে ফেলা যায় না, তখন বাঞ্ছর তীব্রতা মনের মধ্যে জাগায় একপ্রকার স্বপ্ন কিংবা কল্পনা –যা যুক্তি, বুদ্ধি অথবা দৃষ্টিগ্রাহ্য উপায়বোধের অতীত। কোনো অলৌকিক উপায়ে কোনো অদৃশ্য শক্তির সাহায্যে যদি আমার বাঞ্ছ সিদ্ধি হত –এমনি মানস অবস্থা থেকে দৈবশক্তির উদ্ভব। যেখানে সাধ্য-সামর্থ্যের শেষ, সেখান থেকেই কামনার উদ্ভব, আর এই কামনার আশ্রয়েই দৈবশক্তির উদ্ভব ও বিকাশ। অতএব সাধ্যাতীত লিপ্সর প্রশ্রয়ে কামনার জন্ম, এবং কামনা-পূর্তির সহায় হিসেবে অলৌকিক অদৃশ্য সত্তার আবির্ভাব ও স্থিতি। জীবনের মৌল বাঞ্ছ দুটো–আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রসার, জীবনের নিরাপত্তা ও জীবিকার সংস্থান। দুটোর কোনোটাই নির্বিঘ্ন নয়। তাই অদৃশ্য শক্তির সহায়তা আবশ্যক। আদিম মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি ও কল্পনা ছিল কম; তাই সর্বপ্রাণবাদ, জাদুবিশ্বাস প্রভৃতি দিয়ে তার জীবনযাত্রার শুরু।
ক্রমে ক্রমে তার জ্ঞান, বুদ্ধি ও কল্পনাশক্তির বিকাশ হয়েছে এবং জীবন ও জীবিকার নিয়ন্ত্ৰীশক্তির ধারণাও সে-অনুপাতে প্রসার লাভ করেছে। সে দৈবশক্তির শ্রেণীভাগ করেছে–অরি ও মিত্র শক্তিরূপে। ঐ শক্তিতে সে আরোপ করেছে ব্যক্তিত্ব। আবার শক্তির তারতম্য ও কর্তব্য নিরূপণ করে সে অসংখ্য দেবতা, উপদেবতা ও অপদেবতার কল্পনা করেছে। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে প্রসারিত জগৎ সম্বন্ধে তার ধারণা দৃঢ়মূল হয়েছে, কল্পনার যৌক্তিকতা এবং সৌন্দর্যও ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছে–মনুষ্য সমাজের বিকাশ ও সম্ভাবনার আদলে সৃষ্টি হয়েছে তার সেই শক্তির ও সম্ভাবনার, সৌন্দর্যের ও ঐশ্বর্যের, আনন্দের ও যৌবনের দেবনোক। সে জগৎ অমরত্বের, চিরবসন্তের, চিরযৌবনের ও চির-আনন্দের। আদি মানবের অবোধ বাসনায় যার জন্ম, ক্রমে তার বিস্ময়কর বিকাশবিস্তার হয়েছে। মানুষের দেহ-মন-আত্মাকে আচ্ছন্ন করে বট-অশ্বথের মতোই বিপুল হয়েছে সে জড়ে ও কলেবরে। অক্টোপাস ও অশ্বথের ধর্ম অভিন্ন। যাকে জড়িয়ে ধরে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে; তাদের প্রীতির বন্ধন-মমতার আলিঙ্গন মৃত্যুর আগে আর শিথিল হয় না। তাই আজ দৈবশক্তির সম্পর্ক, প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণবিহীন জীবন কল্পনা করাও মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য।
মনুষ্য-চেতনার শৈশবে এ অদৃশ্য সত্তার জন্ম। তারপর তার চেতনার বাল্যের, কৈশোরের, যৌবনের ও প্রবীণ বয়সের জ্ঞান, বুদ্ধি ও কল্পনার অনুপাতে এই বোধের বিকাশ ও প্রকাশ ঘটেছে। এতে তার বোধ ও কল্পনার আমূল রূপান্তর হয়েছে কখনো কখনো। ফলে জগতের বিভিন্ন অঞ্চলে এ বোধের জন্ম আর মৃত্যুও কম হয়নি। এ বোধের ও তৎসংক্রান্ত যাবতীয় ভাব-চিন্তা, আচার আচরণ ও বিধি-নিষেধের নাম ধর্ম। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি, যুক্তি, কল্পনা প্রভৃতির প্রয়োগে ধর্মতত্ত্ব, তথ্য, যুক্তি, মনন ও আবেগের আধার হয়েও উঠেছে। এভাবে সর্বপ্রাণবাদ, দেববাদ, সর্বেশ্বরবাদ ও একেশ্বরবাদে উত্তরণ ঘটেছে মনুষ্যচিন্তার ও বোধের। এমনকি নাস্তিক্যও এ বোধের ও চিন্তার প্রসূন–বিদ্রোহী সন্তান। জ্ঞানবাদে, ভক্তিবাদে, কর্মবাদে, ভাববাদে ও লীলাবাদে এর বিচিত্র বিকাশও লক্ষণীয়। এটি আর কেবল বাঞ্ছ-সিদ্ধির সহায় থাকেনি। সমাজ-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকল্পে ন্যায়-নীতিবোধ, প্রীতি-করুণা-মৈত্রী, দয়া-মা-সহিষ্ণুতা প্রভৃতি মানবিক গুণ জাগানো লক্ষ্যে ধর্মবোধ হয়েছে নিয়োজিত। বাঞ্ছা-সিদ্ধিকামী অসহায় মানুষের কামনার প্রসূন যে এমনি করে জন্ম-মৃত্যুর পরিসরে সীমিত মানব-জীবনের ভাব-চিন্তা-কর্ম, রোগ-শোক-যন্ত্রণা, আরাম-আনন্দ আকাক্ষার অবলম্বন ও নিয়ন্তা হবে তা কে জানত!
ধর্ম মানব-প্রতিভার এক আশ্চর্য উদ্ভাবন। ধর্ম মানুষের প্রাণের উচ্ছলতা, কামনার উদ্দামতা, অভিলাষের অদম্যতা, আচরণের অবাধতা, চিন্তার স্বাধীনতা সম্ভাবনার বিচিত্রতা প্রভৃতি এক নিয়মিত খাতে পরিচালিত করে যান্ত্রিক পরিমিতিতে সীমিত রাখে। ধর্ম দুরাত্মাকে করে নিয়ন্ত্রিত, সু-আত্মাকে রাখে আড়ষ্ট, আনন্দকে করে দুর্লভ, অতৃপ্তিকে করে চিরন্তন, আকাঙ্ক্ষাকে করে বোবা, বেদনাকে করে অন্ধ, অনুভূতি হয় নিরবয়ব আর গতি হয় সীমিত। সবল ও দুর্বল, জ্ঞানী ও মূর্খ, সাধু ও দুষ্ট সমভাবেই থাকে কাবু। ধর্মবোধ মানুষের অন্তরে এমন এক জীর্ণতা এনে দেয়, প্রাণশক্তির উৎসমুখে এমন এক বাঁধ নির্মাণ করে, এমন এক প্রত্যয় ও নিশ্চিত ভাব জাগায় যার কবলমুক্ত হওয়া সম্ভব হয় না কারো পক্ষে। এর প্রভাবের বুঝি সীমা শেষ নেই। তাত্ত্বিকের ভাষায় একে মায়া কিংবা বিষয়ীর ভাষায় একে আফিম বলা চলে বটে, কিন্তু সবটা বলা হয় না। কারণ বোধাতীত এ নেশার স্বরূপ ধরা ভার। মানুষের মর্মমূলে এর বাস। জীবনের সঙ্গে নিঃশেষে জড়িয়ে যায় এ বিশ্বাস।
অনেক মনীষীর মতে এই যুক্তি ও বিজ্ঞানের যুগে বিশ্বাসের অঙ্গীকারে ও কল্পনার প্রশ্রয়ে রচিত পুরোনো ধর্মের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। যে পরিবেশে ও প্রয়োজনে ধর্মগুলো প্রবর্তিত হয়েছিল, সে-পরিবেশ আজ আর নেই বলেই তার উপযোগও শেষ হয়েছে। বর্বর মানুষের মনুষ্যত্ব জাগানো লক্ষ্যে সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকল্পে ধর্মের উদ্ভব। ধর্ম তার ঐতিহাসিক ভূমিকা কৃতিত্বের সঙ্গে সুষ্ঠুভাবেই পালন করেছে। তাই সমাজ ও সভ্যতার বিবর্তন ধারায় ধর্মের ভূমিকা ও তার গুরুত্ব আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব। তার ঐতিহাসিক মর্যাদা স্বীকার করব অকুণ্ঠ চিত্তে।
আজ বহু মানুষের আশ্চর্য আত্মিক উন্নতি হয়েছে। তাদের সামাজিক ও মানস সঙ্গ পেয়ে অন্যরা হয়ে উঠেছে মনুষ্যত্ব-সচেতন। মানবিক তথা সামাজিক দায়িত্ব কর্তব্য প্রকাশ্যত অস্বীকার করে না তারা। কাজেই অলৌকিক চেতনা-লব্ধ পুরোনো ধর্মের প্রয়োজন নেই আর।
ধর্মও মানুষের সমাজ-সভ্যতার শৈশব-বাল্যের ধাত্রী। স্বীকার না করে উপায় নেই যে মনুষ্য সভ্যতা আজ কৈশোরও উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। লোকে বলে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের প্রতিভা এখন বিকাশের ও প্রকাশের মধ্যগগনে স্থিত এবং এখন মানব-সভ্যতার মধ্যাহ্ন। তাই যদি হয় তাহলে শৈশবের ধাত্রী ধর্মের পরিচর্যার আর প্রয়োজন নেই।
শৈশব-স্বভাব যতদিন থাকবে ততদিন তো সাবালেগ হওয়া যাবে না। বয়স্ক মানুষের শিশু স্বভাব নিন্দনীয়, আত্মীয়ের পক্ষে বেদনাদায়ক। তাহলে আজকের পরিবর্তিত পরিবেশে সমাজ সভ্যতার প্রায় পূর্ণাবয়ব প্রাপ্তির পরও শৈশবের সে-ধর্ম ধরে থাকা কল্যাণকর নয়।
ধর্মের মূল লক্ষ্য সমাজ-প্রেক্ষিতে দায়িত্ব-চেতনা ও কর্তব্যবুদ্ধি জাগানো। দায়িত্ব-চেতনা ও কর্তববুদ্ধি জোর করে জাগানো যায় না। তার সাথে ব্যক্তি-মনের সায় থাকা চাই। মনের এই সম্মতি আসে সুরুচি ও আত্মসম্মানবোধ থেকে। অতএব আত্মমর্যাদাবোধই দায়িত্বজ্ঞানের ও কর্তব্য চেতনার উৎস। মর্যাদা সচেতন মানুষই কেবল দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যত্ন করে। আত্মসম্মানজ্ঞান আবার পরিবেশ ও শিক্ষার দান। শিক্ষার গুরুত্ব যে অধিক তার প্রমাণ দুষ্ট শিক্ষিত লোকের অপকর্মের সাধারণত মাত্রা ও সীমা আছে, দুষ্ট অশিক্ষিত লোকের নেই। তাছাড়া মর্যাদাকামী লোক জীবনে ও সমাজে অধিকার ভেদ মেনে চলে।
বিশেষ করে দেখা গেছে অধার্মিক আস্তিক মানুষও করে না হেন অপকর্ম নেই। কেবল ধর্মীয় বিশ্বাস কাউকে সৎ ও উন্নত করে না, যদি না সে দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবুদ্ধি ও মর্যাদাজ্ঞানসম্পন্ন হয়।
জানামি ধর্ম ন-চ প্রবৃত্তি। জানামি অধর্ম ন-চ নিবৃত্তি।–এই পুরোনো আপ্তবাক্য অপকর্মাসক্ত, লিলু আস্তিক মানুষেরই খেদোক্তি।
গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সভ্য ও আস্তিক যিশুর প্রেমবাদী খ্রীস্টান জার্মানেরা প্রায় এক লাখ ইহুদি হত্যা করেছে, আমেরিকানরা মেরেছে অসংখ্য জাপানি। অতগুলো পিঁপড়ে হত্যা করতেও বিবেকবান নাস্তিক মানুষের প্রাণে লাগে। খ্রীস্টান ও মুসলমান নাইজেরিয়া আজ ইবো গোত্রীয় আশি লক্ষ মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার বর্বর উল্লাসে মত্ত। দুনিয়ার ইতিহাসে বড় ছোট এমনি হাজার হাজার অমানুষিক দানবীয় নিষ্ঠুরতার ও অপকর্মের সাক্ষ্য রয়েছে। আজো এমনি বর্বরতার অবধি নেই। সবটাই প্রায় আস্তিক ও উন্নত ধর্মাবলম্বী মানুষের একক ও যৌথ স্বার্থে কৃত। গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও জাতি-চেতনা ছাড়াও ধর্মচেতনাও বহু বর্বরতার জন্যে দায়ী। অবশ্য রাজনৈতিক মতও এমনি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়-চেতনা জাগায় আর বর্বরতায় উৎসাহিত করে। ধর্মমতবাদ কিংবা রাজনৈতিক মতবাদ যে-কোনো মতবাদ পরিণামে অসহিষ্ণুতা জাগায় মতবাদীর মনে। হাঙ্গেরী (১৯৫৬) ও চেকোশ্লোভাকিয়ায় (১৯৬৮) রুশ বর্বরতা, চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অমানুষিকতা, ভিয়েৎনামে আমেরিকার দানবিক দৌরাত্ম্য প্রভৃতি এ সূত্রে উল্লেখ্য।
অতএব ধর্মমত অথবা তার দার্শনিক ও রাজনৈতিক মতবাদ কোনোটাই মানুষের কল্যাণ আনেনি। কোনোটাই সংহত ও সংযত করতে পারেনি প্রবলের দৌরাত্ম্য, পারেনি দুর্বলকে প্রবলের পীড়ন থেকে রক্ষা করতে। ব্যষ্টির হৃদয়ে বিবেকের প্রতিষ্ঠা না হলে নীতিকথা, ধর্মকথা কিংবা তত্ত্বকথা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
কাজেই সমাজে-সংসারে পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যে-শান্তি ও স্বস্তি, যে-সুযোগ ও সুবিধা মেলে, তার জন্যে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রিক বিধিবিধানই যথেষ্ট।
অতএব আজকের দিনে মানুষের ধর্মগ্রন্থ হবে শাসনতন্ত্রের পুস্তক, হাদিস হবে দেশের আইন-কানুন আর লক্ষ্য হবে দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকার-বুদ্ধিসম্পন্ন সুনাগরিকতা। এতেই মানুষের পার্থিব জীবনের মনুষ্য-রচিত সমস্যা মিটবে। অপার্থিব সুখলিলুরা বৈরাগ্যে-সন্ন্যাসে অভীষ্ট খুঁজুক- দীন-দুনিয়া জড়িয়ে ব্যবহারিক জীবনে ঝামেলা বাড়ানোর দুর্বুদ্ধি না-রাখাই শ্রেয়।
মনীষীরা যাই বলুন ধর্ম কিন্তু থাকবে। কেননা মানুষের অসহায়তায় ও দুর্বলতায় তার জন্ম ও স্থিতি। এবং ধর্মবিশ্বাস দুর্বল মানুষের দুর্যোগ-দুর্দিনে বল-ভরসার আকর– অভয় ও নিশ্চিত আশ্রয়। তাই ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় সংস্কার অধিকাংশ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে নিয়ামকরূপে পাবে চিরায়ু এবং হবে চিরঞ্জীব। যদিও সামাজিক শক্তি হিসেবে ধর্ম রাজতন্ত্রের মতোই বিলীয়মান।