শাহ্ আবদুল লতিফ ভিটাই

শাহ্ আবদুল লতিফ ভিটাই

করাচী থেকে ট্রেনে করে হায়দরাবাদ রওয়ানা হলাম ভিটশাহ উদ্দেশে। মরু সিন্ধুর বুক চিরে ছুটে চলেছে ট্রেন। দুদিকে বসতি বিরল ও বসতিহীন প্রান্তর; এখানে ওখানে বাবলা গাছ, কাঁটা ঝোঁপ আর পাথুরে টিলা। প্রকৃতির এ রুক্ষতা ভাবিয়ে তোলে, বিস্মিতও করে। যেখানে সংগ্রাম সেখানেই বুঝি স্বাস্থ্য। নইলে প্রাচুর্যের দেশ বাঙলায় কেন জন ও জীব দুইই ক্ষুদ্রকায়। আর অনুর্বর অঞ্চলে মানুষে পশুতে কী পায় আর কী খায় যে সেখানে এরা আকারে বড় আর স্বাস্থ্যে সুষ্ঠু। ট্রেন চলেছে। একঘেয়ে দৃশ্য। তাই মন চলে গেছে সুদূর অতীতে। ইতিহাসের পাতা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। এ মরুভূমিতে দেখা দিয়েছিল একদিন প্রাণ-বন্যা, উঠেছিল বিচিত্র জীবনের কলরোল। ময়েনজোদাড়োর বিস্ময়কর সংস্কৃতি-সভ্যতা সেই মুখর জীবনের প্রতীক। সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা প্রাচীন মানুষের অক্ষয় কীর্তি। দেখতে পাচ্ছি দাহিরের পরাজয় ও লাঞ্ছনাম্লান মুখ, মুহম্মদ বিন কাসিমের বিজয়দীপ্ত চেহারা, দৃপ্ত পদক্ষেপ। মুসলিমের বিজয় কেতন। পরে আরো কত পরাক্রান্ত দাম্ভিক বিদেশীর উদ্ধত পদধ্বনি। তারপর এই বিগত শতকে তালপুর বংশীয়রা সিন্ধু শাসন করেছেন। ১৮৩১ সনে বৃটিশের নজর পড়ল সিন্ধুর ওপর। তালপুরেরা সে শ্যেনদৃষ্টির সামনে টিকতে পারল না। ১৮৪৩ সনে সিন্ধু পড়ল বৃটিশ খপ্পরে।

কতক্ষণ অতীতের ইতিহাসলোকে ছিলাম জানিনে, আবার যখন নিজের মধ্যে ফিরে এলাম, তখন দেখছি ট্রেন কোটরি স্টেশনে থেমেছে। কোটরি একটি ক্ষুদ্র শহর–সিন্ধুর আঞ্চলিক শাসন ও বাণিজ্য কেন্দ্র।

এক ঘণ্টার মধ্যে হায়দরাবাদ পৌঁছলাম। হায়দরাবাদ প্রাক্তন সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী, তখন আঞ্চলিক শাসনকেন্দ্র। বড় শহর। লোকসংখ্যা শুনলাম প্রায় তিন লক্ষের মতো। রাজধানীসুলভ সব প্রতিষ্ঠানই আছে। দু-তিনটে সিন্ধি ও উর্দু দৈনিক বের হয় এখান থেকে। আমরা সরকারি অতিথি। আমাদের দেখাশুনার ভার পড়েছে হায়দরাবাদের ইনফরমেশন বিভাগের উপর। ইনফরমেশন অফিসার ও তার দুই সহকর্মী জনাব হাজী আবদুর রহমান আর জনাব আলাড়ী দায়-সারানো সরকারি কাজ হিসেবে আমাদের ভার নেননি, বরং শ্রদ্ধেয় পারিবারিক অতিথি হিসেবেই বরণ করেছিলেন। তাঁদের সৌজন্য, আন্তরিকতা, যত্ন-আপ্যায়ন আমাদের অভিভূত করেছে। দু-দিন আমরা সেখানে ছিলাম। আমাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য তারা ছায়ার মতো আমাদের সঙ্গে থাকতেন। হালিম সাব সুদ্ধ এ চারজন সিন্ধি ভদ্রলোকের আচরণ সুপ্রাচীন আরবি ঐতিহ্যের কথা মনে পড়িয়ে দিল।

প্রাণের স্পর্শে প্রাণ জাগবেই। তা প্রেমে হোক, প্রীতিতে হোক কিংবা সৌজন্যে হোক। তাঁদের আন্তরিক আতিথেয়তায় আমরাও তাই তাঁদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠলাম। ভুলে গেলাম যে তারা সরকারি কর্মচারী, কর্তব্য করছেন মাত্র, তাই বিদায়কালে আত্মীয় বিচ্ছেদের বেদনা অনুভব করেছি।

হায়দরাবাদ থেকে বাসে ভিটশাহ্ যাত্রা করলাম। পাকা ঋজু রাস্তা চলে গেছে লাহোর পেশোয়ারে। দু-ধারে সবুজের সমারোহ। মনে হচ্ছে, বাঙলা দেশেরই কোথাও শরতে ক্ষেতের পাশ দিয়ে চলেছি। মনে হয় পানির স্পর্শে পাষাণ-প্রাণ অহল্যা জেগে উঠেছে। মরুতে সোনা ফলেছে। গম আর তূলা ক্ষেত। বাড়ন্ত ফলন্ত অবস্থা। দেখলে চোখ জুড়ায়।

সিন্ধু জেগেছে। তার মাটি জেগেছে, তার মানুষ জেগেছে। প্রাণের পরশ মাটির ফসল সে উল্লাস ব্যক্ত করছে নৃত্যের তালে তালে। আর মানুষের আশাপ্রদীপ্ত প্রাণে দেখা দিয়েছে কর্মচাঞ্চল্য। মরু বালুকার বুকে যেমন জেগেছে জীবন-স্বপ্ন, তেমনি সিন্ধিরাও করেছে বৃহৎকে তাদের ধ্যানের বস্তু। দুটোই সম্ভব হয়েছে শুকুর ও গোলাম মোহাম্মদ বাঁধ প্রভৃতির মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার ফলে। প্রকৃতি-নিগৃহীত সিন্ধিরা এভাবে প্রকৃতিকে এনেছে বশে, আর তাদের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিচ্ছে বাস্তবায়নের পথে। এসবের আভাস পেয়েছি সাধক কবি শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই-এর উরসের মেলায়। বসতি-বিরল সিন্ধুর জনসংখ্যা হচ্ছে মাত্র চল্লিশ লক্ষ।

দূরদূরান্তর থেকে দুইদিনব্যাপী মেলায় এসেছে প্রায় দু-লক্ষের মতো লোক। চল্লিশ লক্ষের মধ্যে দু-লক্ষের উপস্থিতিতেই সাক্ষ্য দেয় যে, শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই সিন্ধিদের হৃদয়-রাজ্যের রাজা ও জাতীয় মানসের প্রতীক। তাই আজ ভিটাই-বার্ষিকী দূরদেশের উরস মাত্র নয়, বরং জাতীয় মহোৎসব। এ উৎসবের মাধ্যমে সিন্ধু নিজেকে প্রকাশ করছে। স্থির করেছে নিজেদের আদর্শ ও লক্ষ্য। শাহ আবদুল লতিফের সাধনা ও বাণীর মাধ্যমে জাগছে তাদের জীবন-জিজ্ঞাসা। আর জীবনের দিশাও তারা খুঁজছে সেই আলোকে। আবদুল লতিফ ভিটাই ইতর-ভদ্র ও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবারই প্রিয়। অশিক্ষিতরা তাঁর কাছে যায় অভীষ্ট সিদ্ধির বাচ্ছা নিয়ে; আর শিক্ষিতেরা তার মধ্যে খোঁজে জাতীয় মানসের স্বরূপ। অশিক্ষিতের কাছে লতিফ ঐহিক জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা-সহায় আর অধ্যাত্ম জীবনের পীর এবং শিক্ষিতের চোখে তিনি জাতীয় মনন ও সংস্কৃতির প্রভিভূ। অশিক্ষিতেরা করে উস আর শিক্ষিতেরা করে স্মৃতিবার্ষিকী। এভাবেই শাহ লতিফ হয়েছে সিন্ধিদের আশা-ভরসা ও লক্ষ্যের অবলম্বন। এক কথায় লতিফ National hero, সবাই তাঁর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়। দেখেশুনে মনে হয়, লতিফের সাধনা ও বাণী আদর্শ করেই সিন্ধু জেগেছে, সিন্ধু জাগছে।

এবার শাহ লতিফের পরিচয় দেব। মহৎ জীবনের উপর অলৌকিকতা আরোপ করা একটি মানবিক দুর্বলতা। শাহ লতিফ-চরিত্রও এই অলৌকিকতার প্রলেপ থেকে মুক্ত নয়। তাঁর শৈশব, বাল্য, কৈশোর সম্বন্ধে কয়েকটি অদ্ভুত কাহিনী চালু আছে। ভক্তজনের কল্পনাপ্রসূত এসব কাহিনী থেকে তথ্য ও সত্য উদ্ধার করা সহজ নয়। তাই আগে শাহ আবদুল লতিফের জীবনী লিখিত হয়নি। তবে যারা দশের উপরে বড় হন, তাঁদের জীবনে হয়তো কিছু অসামান্যতা থাকে। সে অসামান্যতাই ভক্তজনের চিত্তমুকুরে অলৌকিকতার রূপ ধরে প্রচার লাভ করে।

১৬৮৯ সনে হায়দরাবাদের হালাহাবেলী গ্রামের এক প্রখ্যাত সৈয়দ বংশে শাহ লতিফের জন্ম। তাঁর পিতার নাম শাহ্ হাবীব। প্রপিতামহ শাহ আবদুল করিম কবি ছিলেন। পীরালিই পারিবারিক পেশা। মেধাবী লতিফ অল্প বয়সেই আরবি, ফারসি ও ইসলামে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।

হালাহাবেলী অঞ্চলে এক তায়মুরী পরিবার ছিল চেঙ্গিস-তৈমুরের বংশধর এবং দিল্লীর বাদশাহর জ্ঞাতি বলে সমাজে তাদের বিশেষ মর্যাদা ও আভিজাত্য ছিল। শাহ লতিফেরা ছিলেন তাদের পীর-পরিবার। একবার তায়মুরী পরিবারের প্রধান মীর‍্যা মুঘল বেগের কুমারী কন্যা অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিরাময়ের জন্যে আল্লাহর নাম কালাম পড়ে দোয়া করবার জন্যে ডাক পড়ল পীর শাহ হাবীরের। তিনি কোনো কারণবশত যেতে পারলেন না, পাঠালেন কিশোর ছেলে লতিফকে। পীরের কাছে পর্দা নেই। কাজেই লতিফকে অন্দরে রোগীর শয্যাপাশে নেয়া হল। বয়োধর্মের গুণে লতিফ প্রথম দৃষ্টিতেই মেয়েটির রূপে মুগ্ধ হলেন। এবং তার হাত ধরে আত্যন্তিক আবেগে তাকে প্রেম নিবেদন করলেন। বললেন, সৈয়দের হাতের ছোঁয়া লেগেছে যার আঙুলে, সাগর তরঙ্গের সাধ্য নেই তাকে ছিনিয়ে নেয়। দেশজ প্রথায় এটা যথার্থই পাণিগ্রহণ। পীর-পুত্রের এই ঔদ্ধত্য সহ্য করা মীর‍্যা মুঘল বেগের পক্ষে কঠিন হল। কলঙ্কের ভয়ে তিনি এ কথা প্রকাশ করলেন না বটে, কিন্তু পীর-পরিবারের উপর নানাভাবে নিপীড়ন শুরু করলেন। ফলে শাহ্ হাবীব গাঁ ছেড়ে আত্মরক্ষা করলেন। এদিকে কিশোর লতিফ প্রণয়ে ব্যর্থতার আঘাতে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘর ছাড়লেন এবং বিবাগী হয়ে, যোগী হয়ে সন্ন্যাসীদলে ভিড়ে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ালেন। এ সময়ে তিনি যোগশাস্ত্র ও সুফীমতের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হন। কাবুল, কান্দাহার, হিংলাজ, যশশ্মীর, কচ্ছ, কাথিওয়ার, লাসবেলা, মাকরান প্রভৃতি অঞ্চল ভ্রমণ করলে তিনি নানা ধর্মমত ও বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সংস্পর্শে আসেন। এ অভিজ্ঞতার প্রভাবে তিনি নতুন মানুষ হয়ে উঠলেন, নারী-প্রেম ভূমা-প্রেমে উন্নীত হল। ঐহিক কামনা পরমের সাধানায় রূপ পেল। তিনি হলেন যোগী সূফী এবং সাধক কবি। বিবাগী জীবনে তিনি স্বরচিত দোহরা গেয়ে বেড়াতেন। আমাদের পদাবলীর সঙ্গে দোহরার একদিকে মিল আছে; কেননা এগুলো মানবিক ও অধ্যাত্ম- এই উভয় প্রেমের গান হিসেবে উপভোগ করা চলে।

বহুকাল পরে তিনি ঘরে ফিরলেন। এদিকে মীর‍্যা মুঘল বেগের পরিবারে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। পীর-পরিবারের উপর পীড়ন করার ফলেই দুর্ভাগ্যের দুর্দিন দেখা দিয়েছে মনে করে অনুতপ্ত মীর‍্যা মুঘল বেগ লতিফের হাতে কন্যা সম্প্রদান করলেন। এ কাহিনী ছোট ভিটাই (ভিটাইয়ের দুলামিয়া) নামে আজো চালু আছে।

এবার গৃহী সাধক লতিফ ইরানি সূফী কবিদের মতো পুরোনো লৌকিক প্রণয় গাথাগুলোকে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মানুষ ও আল্লাহর প্রেমের রূপকে রূপান্তরিত করেন। এগুলোও রুচিমতো মানবিক প্রণয় কিংবা অধ্যাত্মপ্রেমের রূপক হিসেবে আস্বাদন করা যায়। এতে স্বদেশপ্রেম, সাহস প্রভৃতি ব্যবহারিক গুণের আলেখ্য আছে। এভাবে পুরোনো প্রণয় গাথাগুলোক তাঁর হাতে নতুন মহিমায় উজ্জ্বল ও জনপ্রিয় হয়ে উঠল। মুহনী মহিয়াল, শশীপুন্ন, হির ঝনঝা, মোমেল-রানু, লীলা-চানেসার, সোবথ দিয়া-বিজল, মা আরভি-মারুঙ্গ-উমর প্রভৃতি তাঁর অমর কীর্তি। কেউ কেউ বলেন, শাহ লতিফ ৩৬টি নাট্য-গাথার রচয়িতা।

১৮৬৬ সনে জার্মান পণ্ডিত Tremp-ই প্রথম শাহ লতিফের কাব্য-সগ্রহ বের করেন। পরের বছর বোম্বাই সরকারের শিক্ষা দফতর থেকেও একটি সংশোধিত ও বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৪০ সনে Dr.Surely তাঁর Shah Abdul Latif of Bhit Shah নামের গবেষণামূলক গ্রন্থে লতিফের জীবনকাহিনী ও তাঁর রচনার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। হায়দরাবাদের সিন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় শাহ লতিফের রচনার নির্ভরযোগ্য সিন্ধি সংস্করণ ও তার উর্দু তরজমা প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছেন। এ ছাড়াও, পাকিস্তানের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় ও বোম্বাই প্রদেশে শাহ লতিফ সম্বন্ধে নানাভাবে আলোচনা হচ্ছে এবং সে সূত্রে তাঁর রচনার কিছু কিছু অনুবাদও হচ্ছে।

শাহ লতিফ সাধনা ও কবিত্বের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার জন্মসূত্রেই পেয়েছিলেন। পীরালি সূত্রে লোকসাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ঐতিহ্যও ছিল সুপ্রাচীন। তাই তিনি সহজেই জনগণকে আপন করে নিতে পেরেছিলেন, আর নিজেও হয়ে উঠেছিলেন তাদের আপন মানুষ। ধর্মমত প্রচারের বাহনরূপেই কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষা হিসাবেই চিরকাল মুখের বুলি সাহিত্যের শালীন ভাষায় উন্নীত হয়েছে। সিন্ধি-ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। ঐতিহাসিক যুগে দেখতে পাচ্ছি, ধর্মের, দরবারের ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ভাষা ছিল সংস্কৃত, তারপরে মুসলমান আমলে দরবার ও সংস্কৃতির ভাষা হল ফারসি, ইংরেজ আমলে হল ইংরেজি। তাই দেশের আঞ্চলিক বুলিগুলো স্বাধীন ও স্বাভাবিকভাবে বিকাশ লাভ করে শালীন সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হতে পায়নি। তবু এর মধ্যে গৌতমবুদ্ধ ও বর্ধমান মহাবীরের ধর্মপ্রচারের বাহন হয়ে পালি ও প্রাকৃত, রাজপুত রাজাদের প্রশাসনের মাধ্যমরূপে অবহট্ট, এবং মধ্যযুগের কলন্দর, রামানন্দ, কবীর, দাদু, রামদাস, রজব, নানক, চৈতন্য প্রমুখের মতপ্রচারের বাহন হয়ে আধুনিক সাহিত্যিক ভাষাগুলো গড়ে ওঠে। ধর্ম প্রচার ও রাষ্ট্র পরিচালনার সহায়ক ভাষারূপে তুর্কী আমলে একবার এবং ইংরেজ শাসনের গোড়ার দিকে আর একবার বাঙলা ভাষার বহুল চর্চা হওয়ার ফলেই বাঙলা অন্যান্য পাক-ভারতীয় আধুনিক ভাষাকে (রূপে ও সামর্থ্যে) অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু সিন্ধি ভাষা এ সৌভাগ্য থেকে অনেক কাল বঞ্চিত ছিলো। প্রধান কারণ, সিন্ধু ভারতের সীমান্ত-মুখের দেশ হওয়ায় চিরকাল বিদেশী আক্রমণের কবলে পড়েছে, স্বাধীন বিকাশের সুযোগ পায়নি। দারা, আলেকজান্ডার, মুহম্মদ বিন কাসিম, মুহম্মদ গজনভী, মুঘল, নাদির শাহ, আহমদ শাহ প্রভৃতির আক্রমণের কবলে যে সিন্ধু প্রাণে মরেনি, তাই তা যথেষ্ট। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর (১৭০৭ খ্রী.) পর কুলহুড় বংশীয় নূরমুহম্মদ-আধা স্বাধীনভাবে সিন্ধু শাসন করবার অধিকার পান। কুলহুড়রা ছিলেন সিন্ধিভাষী। দরবারি ভাষা ফারসি থাকা সত্ত্বেও এদের সময়েই সিন্ধি ভাষার বহুল চর্চা শুরু হয় এবং সাহিত্য সৃষ্টি হতে থাকে। অবশ্য পনেরো শতক থেকেই সিন্ধিরচনার কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। কুলহুড় বংশের পতনের পর তালপুর বংশীয়রা ১৮৪৩ সন পর্যন্ত সিন্ধুর শাসক ছিলেন। এরপর ইংরেজ শাসনে সিন্ধির কদর হ্রাস পায়।

আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সময় শাহ লতিফের বয়স ছিল আঠারো। কাজেই শাহ লতিফের বাকি জীবন কুলহুড় শাসনাধীনেই কেটেছে। শাহ লতিফের সূফীমত তার সিন্ধি ভাষায় রচিত গানগাথার মাধ্যমেই প্রচার লাভ করে। তখনো এ ভাষা ও সাহিত্যে লোকবুলিও লোকসাহিত্যের স্তরে উত্তীর্ণ হয়নি। বিশেষ করে শাহ লতিফের উদ্দিষ্ট শ্ৰেতাও ছিল অশিক্ষিত জনগণ। শাহ লতিফ মুখে মুখেই তার গান ও গাথা রচনা করেন। (জনশুতি এই যে, লতিফ লিখে লিখেই তাঁর গান ও গাথা রচনা করেন। কিন্তু অহংকার বিলুপ্তির জন্যে তিনি নিজের হাতেই তার পুথিগুলো কিরার হ্রদের পানিতে ফেলে দেন।) গাইয়ে শিষ্যরা তা শ্রুতিস্মৃতিতে জিইয়ে রেখেছে এবং পুরুষপরম্পরায় তা মুখে মুখে চালু রয়েছে। অবশ্য শিক্ষিত লোকের পড়বার জন্যে আঠারো শতকের একেবারে শেষের দিকে তার রচনাবলী লিপিবদ্ধ হয়। কাজেই ধরে নেয়া যেতে পারে যে, তাঁর রচনা অবিকৃতভাবে আমাদের হাতে পৌঁছায়নি। তবু ভাবে, ভাষায়, ছন্দে, সুরে, শব্দের চয়ন ও বিন্যাস-সৌন্দর্যে শাহ লতিফের রচনা সিন্ধিভাষায় অতুলনীয়। তাই আজো তিনি শ্রেষ্ঠ সিন্ধি কবি। তিনি একাধারে লোককবি, সাধক কবি এবং শালীন সাহিত্যের কবি-শিল্পী। এজন্যেই রসিক ও ভক্ত, পণ্ডিত ও মূর্খ, যোগী ও সূফী এবং হিন্দু ও মুসলমান সকলেরই তিনি প্রিয় কবি। আঙ্গিকের দিক দিয়ে সিন্ধি ভাষায় তাঁর বিশেষ দান ওয়াই-শ্রেণীর কবিতা। সোরথ, মা আরভি, আ-আরবি, দোথী, মা আয়ুরী হোসাইনী, সোহিনী, কোহিয়ারী (পাহাড়ী) প্রভৃতি সুরে শাহ লতিফের গান ও গাথা গীত হয়।

পাঞ্জাবের বুলেহশাহ ও আমাদের লালন প্রভৃতি বাউল কবির সমগোত্রীয় ছিলেন লতিফ। সাধারণভাবে হয়তো বলা যায়–রুমী, জামী, হাফিজ প্রমুখ সূফী কবি এবং রামানন্দ, কবীর, দাদু। কলন্দর, রজব প্রভৃতির উত্তরসাধক ছিলেন শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই। ভিট শব্দের অর্থ টিলা, আর টিলাবাসী বলে ভিটাই এবং শাহর টিলাই হল ভিটশাহ।

সূফী বৈষ্ণবদের মতো পরমের বিরহবাধই শাহ লতিফের অধ্যাত্ম-প্রেরণার উৎস এবং পরমের সাথে মিলনই কবির সাধনার লক্ষ্য।

বৈষ্ণব কবি বলেন :

জনম অবধি হাম রূপ নেহারলু
নয়ন না তিরপিত ভেল,
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু
তব হিয়া জুড়ন ন গেল।

 লতিফও বলেন:

প্রিয়তমা মোরে ছাড়িয়া গিয়াছে।
হৃদয় আমার বিরহে বিধুর,
প্রেম থেকে আমি বঞ্চিত তাই
পরাণে বাজিছে বেদনার সুর।

এবং প্রেমিকের গানে না-পাওয়ার সুর চিরকাল তাই ধ্বনিত হয়।

কিংবা –

আমার হৃদয় একটি বহ্নিশিখা
অবিরাম জ্বলছে। সেই জ্বালিয়েছে
শিখাটি যাকে আমি ব্যাকুল হয়ে
খুঁজে চলেছি।

রবীন্দ্রনাথও বলেন :

আজিও কাঁদিছে রাধা হৃদয়-কুটিরে।

সূফীরা প্রেমের রাহে ফানা হয়ে যেতে উপদেশ দেন। শাহ লতিফেও তাই পাই–হে পতঙ্গ, প্রেমের অনল তোমায় ইশারায় ডাকছে। ভয় পেও না তুমি, ঝাঁপ দাও নিঃসঙ্কোচে। সে-অনলে পুড়ে পুড়ে খাঁটি হবে তোমার চিত্ত।

লতিফ আরো বলেন :

আশেক মাশুকে কোনো ভেদ নেই। সাগর আর ঢেউ যেমন মূলত এক হয়েও দুইরূপে দেখা দেয়, কিংবা ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি যেমন দুই সুরে বেজে উঠে, আত্মা ও পরমাত্মাও তেমনি ভিন্ন বলে প্রতীয়মান হয় মাত্র।

লতিফ তাই বলেন :

তুমি বৃথাই দূরের পথে যাত্রা করছ; চেয়ে দেখ, বন্ধু তোমার কাছে রয়েছে রয়েছে তোমার মেঝের উপর। যাকে পাওয়ার জন্যে এত দুঃখ পাচ্ছ, সে তো তোমার ভিতরেই বাস করে। তাকে নিজের হৃদয়ের মধ্যে খোজো। তোমার পায়ের পর্যটন থামাও। এবার হৃদয়পথে মন চালাও। কেননা, পায়ে হেঁটে কচ্ছদেশে পৌঁছার সে সাধ্য নেই।

আমাদের বাউল কবিও তাই বলেন :

লামে আলিফ লুকায় যেমন
মানুষে সাঁই আছে তেমন।
তা না হলে কি সব নূরের তন
আদম তনকে সেজদা জানায়।

 অথবা—

এ মানুষে আছে রে মন
যারে বলে মানুষ রতন
যারে আকাশ পাতাল খোঁজো
এই দেহে তিনি রয়।

কিংবা–

দেহের মাঝে আছে সোনার মানুষ
ডাকলে কথা কয়।

অথবা —

আছে তোরই ভিতর অতল সাগর
তার পাইলি না মরম।
 তার নাই ফুলকিনারা শাস্ত্রধারা নিয়ম কী রকম।

রবীন্দ্রনাথও বলেন

আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
আমি তাই হেরি তায় সকল খানে।

অথবা —

ও তোরা আয়রে ধেয়ে দেখরে চেয়ে আমার বুকে
ওরে দেখরে আমার দুনয়নে।

 কিংবা —

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি,
বাহির পানে চোখ মেলেছি হৃদয় পানে চাইনি।

রুমীও বলেন

আমি দেখলাম, তিনি আমার অন্তরেই আছেন, আর কোথাও নাই।

 লালনের —

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।

সিন্ধি মরমী কবি সাচালও বলেন–

প্রিয়তম আমার হৃদয়েই আছেন, তিনি আমার দেহ-বাগের
কোকিল, আমি প্রিয়তমকে আমার হৃদয়ের মধ্যেই দেখেছি,
দিল-আলোকরা তিনি এসেছিলেন আমার চেতনার সীমার
ভেতরে।

আল্লাহ বলেন

মো কো কহ ঢুড়ো বন্দে, র্মৈ তো তেরে পাসর্মে।
সৈঁ দেবল, না মৈ মসজিদ, না কাবে কৈলাস মে। (কবীর)

কলন্দর বলেন–

নহো মোল্লা, নহে ব্ৰহমন দুই কো ছোড় কর পূজা
হুকুম হৈ শাহ কলংরকা আনলক কহা তাজা।

মদন বলেন–

তোমার পথ ঢাইক্যাছে মন্দিরে মসজিদে।

লতিফও বলেন —

আল্লাহ হচ্ছেন প্রেমের বশ। তাই তিনি বলেন,
তোমার হৃদয় কর আলিফের লীলাস্থল
 তাহলেই বুঝবে তুমি কেতাবী গানের অসারতা।
জীবনকে দেখতে শেখো, তাহলে বুঝবে
আল্লাহর নামই যথেষ্ট। প্রিয়ের মিলন আকাঙ্ক্ষা
যার জেগেছে, সে কেবল প্রিয়তমের পাঠই পড়ে।

 কিংবা–

প্রিয়তমের পথ অতি সরল ও প্রশস্ত।
কেবল কামনা-বাসনার কাটাই তাকে আকীর্ণ করেছে।

অথবা–

নামাজ রোজা ভালো বটে
কিন্তু প্রিয় মেলে অন্য বাটে।

 হাফিজও বলেন —

ঢালো সুরা সখি সাজাও পেয়ালা শরম আছে কি তায়
প্রেমের মরম তারা কি জানে লো ধরম যাহারা চায়।

 কবি সাচাল বলেন

পাপ-পুণ্যের পথে আল্লাহকে কেউ জানতে পায় না।

বেদিল বলেন —

পুথি পড়ে কী হবে; কেবল ফানার তত্ত্ব শেখো।

শাহ লতিফ বলেন

আমার চোখদুটো দেখে কেবল দেখে।
 তারা দেখেছে প্রেমে এবং চিনেছে প্রেম
আর তাই ফিরে এসেছে আমার কাছে।

কিংবা

প্রিয়তম তুমি যখন আমার তখন পৃথিবী আনন্দে গেয়ে ওঠে
পথে পথে তৃণ-লতা-ফুল তোমাকে চুম্বন করে ধন্য হয়।
তোমাকে দেখে আমার সকল আশা মুহূর্তে মিটে যায়।

রবীন্দ্রনাথও বলেন–

তোমার আমার মিলন হবে বলে
এমন ফুল্ল শ্যামল ধরা…

তাদের কথায় ধাঁধা লাগে।
তোমার কথা আমি বুঝি,
আমার আকাশ তোমার বাতাস।
এই তো সবি সোজাসুজি।…

আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না
এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।

উপরে আমরা দেখতে চেয়েছি, দুনিয়াব্যাপী সব মরমী সাধকের এক বোল এবং সাধনার লক্ষ্যও অভিন্ন; কেবল ভঙ্গিটি দেশ, কাল ও ব্যক্তিভেদে বিচিত্র। আমাদের বাউল গানে যতটা ব্যবহারিক জীবন ও সমাজ-চেতনা রয়েছে, সিন্ধি মরমী সাহিত্যে ততটা নেই। আবার বাউল গানে ছন্দোমাধুর্যের বিশেষ অভাব আছে, সুরের লালিত্য এবং বৈচিত্র্যও কম। কিন্তু শাহ লতিফের গান ও গাথা রবীন্দ্রনাথের গানের মতোই ছন্দোবদ্ধ কবিতা। শাহ লতিফ সচেতন সুরকার ও ছন্দকুশল শিল্পী। তার অধিকাংশ দোহরা, কাফী ও গাথার সুর তাঁর সৃষ্টি। সিন্ধিরা আজো তার দেয়া সুরে তাঁর সৃষ্ট রাগ-রাগিণীতে যে কেবল তাঁর রচিত গানই গায় তা নয়: অন্যন্য গান এবং গাথায়ও তার সাধা সুর প্রয়োগ করে। তাঁর অনেক গান ক্ল্যাসিক্যাল ঢঙে গীত হয়। মরুভূ সিন্ধুর লু হাওয়া যখন সিন্ধিদের দেহমন তপ্ত ও অশান্ত করে তোলে, তখন শাহ লতিফের দোহরার গীতমূৰ্ছনা তাদের। দেহেমনে স্বস্তি-শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দেয়। কিংবা যখন জীবন-জীবিকার নানা যন্ত্রণায় তারা মুষড়ে পড়ে, তখনো শাহ লতিফের গানের অনবদ্য প্রাণ-জুড়ানো সুরে ও ভাব-রসে বিভোর হয়ে তারা স্নিগ্ধ প্রশান্তি লাভ করে। এক কথায়, শাহ লতিফের রচনা সিন্ধিদের জীবনমরূর মরূদ্যান। তাই সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বেদনায়, উৎসবে-পার্বণে, সাফল্যে-ব্যর্থতায় তারা শাহ লতিফের শরণ নেয়। সে শরণ তার রুহের দোয়ার, তাঁর গানের-তার বাণীর। দু-শ বছর আগের শাহ লতিফ আজো সিন্ধিভাষীর হৃদয়-মনের একচ্ছত্র রাজা। তিনি তাদের প্রাণ জুড়ে বিরাজ করছেন, তাদের মন মননের দিশা দিচ্ছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *