একটি অলস-চিন্তা
০১.
সুস্থ ও রুগ্ণলোকের মন-মেজাজের পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। এমনকি ভরপেট ও ক্ষুধার্ত লোকের মেজাজেও মাত্রাভেদ লক্ষণীয়। তাহলে মন-মেজাজ ও স্বভাবের সঙ্গে শরীর-স্বাস্থ্যের যোগ ঘনিষ্ঠ ও অবিচ্ছেদ্য। একারণেই মনে হয় বাল্যে-কৈশোরে-যৌবনে-প্রৌঢ়ত্বে ও বার্ধক্যে মানুষের মন-মেজাজের লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে।
আবার মানুষের স্বভাবের অভিব্যক্তি পরিবেশ-পরিবেষ্টনী নিরপেক্ষ নয়। অকালে আম খাবার আকাক্ষা যেমন জাগে না, তেমনি সাধ্যাতীত বস্তুতেও মানুষ লুব্ধ হয় না। কাজেই প্রাপ্তি-প্রয়াসে মানুষ যা-কিছু করে তাতে সাফল্যের ক্ষীণ সম্ভাবনা অন্তত থাকে, একেবারে অসম্ভব অস্বাভাবিকতার পিছু ধাওয়া করে না। অতএব মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়াসের পশ্চাতে আত্মপ্রত্যয় ও সাফল্য-বাঞ্ছর ভিত তৈরি থাকে। বিভিন্ন বয়স ও বিভিন্ন শারীরিক অবস্থা এ কাক্ষা ও প্রয়াস নিয়ন্ত্রণ করে। এক বয়সে যা তুচ্ছ, অন্য বয়সে তাই মুখ্য। কেবল তা-ই নয়, এক মুহূর্তে যা প্রাণের প্রেরণা অন্য মুহূর্তে তা ত্রাসের উৎস। যে-সুন্দরীকে কাছে পেয়ে চিত্তে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হল, পরমুহূর্তে তার অঙ্গে কুষ্ঠ কিংবা অন্য ভয়াবহ রোগের লক্ষণ প্রত্যক্ষ করে ত্রস্ত মন ঘৃণায় ও ভয়ে শিউরে উঠল। যে নব অনুরাগী প্রেম-স্বপ্নের মাধুরী উপভোগে রত, বাস্তু-বিকিয়ে যাওয়ার আকস্মিক সংবাদে হতাশার তুলে সে মুহূর্তে বিপর্যস্ত। যাকে না হলে জীবন অচল, সে-প্রেয়সীর মৃত্যুর পরেই নতুন নীড়ের স্বপ্ন ওঠে জেগে।
কাজেই কেবল কাল নয়, পরিবেশও মানুষের মন-মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে। দৈহিক পরিবর্তনও ঘটায় মন-মেজাজের বদল। ষাঁড় বলদ হয়ে কেবল দেহে নয়, স্বভাবেও পায় গাভীর রূপ। পাঠা খাশি হয়ে অবয়বে ও স্বভাবে হয়ে ওঠে ছাগী। খোঁজারাও হয়তো হারাত পুরুষসুলভ মেজাজের অনেকখানি, যদিও মানুষ হিসেবে কৃত্রিম মানস ও সামাজিক অনুশীলনে পুরুষালি বজায় রাখার চেষ্টা ছিল তাদের।
অতএব, স্বভাবের পূর্ণ ও অকৃত্রিম অভিব্যক্তির জন্যে আঙ্গিক সম্পূর্ণতা ও স্বাস্থ্যের পূর্ণতা প্রয়োজন। ভর-যৌবনেই কেবল তা সুস্থ মানুষে লভ্য। কিন্তু মানুষের পূর্ণতার আরো এক গুরুতর বাধা রয়েছে। বিশ্বাস-সংস্কার ও আর্থিক-সামাজিক প্রভাবও কিছু বিকৃতি ঘটায়। তাই মানুষ জীবনে হয়তো কখনো সচেতনভাবে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে না। কর্মে, চিন্তায় ও অনুভবে মানুষের অভিব্যক্ত আচরণ তাই কখনো স্বচ্ছন্দ ও স্বাভাবিক নয়–কৃত্রিম ও আড়ষ্ট। তাই ক্ষোভ, শোক, ক্রোধ, ঘৃণা, প্রতিহিংসা প্রেম-প্রীতি, স্নেহ, শ্রদ্ধা, আনন্দ, উল্লাস, দুঃখ, বেদনা, রিরংসা প্রভৃতি বৃত্তি প্রবৃত্তির প্রকাশ স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে বিভিন্ন। তবু ক্ষণে ক্ষণে অবচেতন মুহূর্তে চিত্তের সাবল্য বা দৌর্বল্যবশে মানুষ স্বরূপে ধরা দেয় বিদ্যুতের মতোই তা ক্ষণস্থায়ী বটে, কিন্তু তা-ই তার স্বরূপ। মানুষকে তা-ই ক্ষণ-প্রভায় বিচার করলেই তাকে যথার্থভাবে চেনা-বোঝা যায়। তার প্রাত্যহিক রূপ একটা সামাজিক সাংস্কারিক মুখোশ মাত্র।
.
০২.
শৈশবে-বাল্যে-কৈশোরে পরনির্ভরতায়, যৌবনে স্বনির্ভরতায়, প্রৌঢ়ত্বে সতর্কতায়, বার্ধক্যে পরমুখাপেক্ষীর অসহায়তায় জীবন হয় অবসিত। অতএব, জীবনে যৌবনই হচ্ছে চরম ও পরম লগ্ন। কিন্তু তার আবির্ভাব সম্বন্ধে সচেতন হতেই মানুষ উত্তর-তিরিশে পা রাখে, আর তার তিরোভাবের অনুশোচনা জাগে চল্লিশে। তাই সচেতনভাবে যৌবনের মর্ম উপলব্ধি ও স্বাদ উপভোগ করতে প্রয়োজন হয় প্রৌঢ়ত্বের কল্পনা ও স্মৃতির রোমন্থন। তখন হৃতযৌবনের কান্নায় ভরে ওঠে বুক। সম্পদ প্রাপ্তির আনন্দকে ম্লান করে দেয় অতীতকে হারানোর বেদনা। ঠিক সময়ে ঠিক কথাটি কখনো মনে জাগে না, যথাসময়ে তাই যথাকৰ্তব্য করাও হয় না; তাই এ বেদনা, সে কারণেই এ ক্রন্দন। তাই We donot know what we are missing today–চিরসত্য ও চিরন্তন Tragedy-র উৎস হয়ে রয়েছে।
যদি চেতনা দিয়ে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ-উপলব্ধি করা যেত, যদি ভ্রান্তির ও অবহেলা-ঔদাসীন্যের অনুশোচনার দংশনমুক্ত হত জীবন, যদি ব্যর্থতার ও হতবার বেদনাবিহীন হত চিত্তলোক, তা হলেই কি জীবন সুখের হত? মনে হয় না। দুঃখ-বেদনা-ব্যর্থতার ছেদ-দাহ-ঘা না থাকলে চেতনার অপমৃত্যু ঘটত; তার বড় প্রমাণ আমরা যখন দিনের পর দিন মাসের পর মাস শারীরিক সুস্থতা ভোগ করি, তখন মুহূর্তের জন্যেও মনে হয় না যে আমি সুস্থ, আঙ্গিক বেদনামুক্ত এবং সেজন্যে সুখী, সে কারণেই আনন্দিত।
দুঃখ-সুখের তরঙ্গায়িত চেতনাই জীবন। তাই দুঃখবিহীন চেতনা দুর্লভ আর সুখবিহীন জীবন অকল্পনীয়। অভাবিক সৌভাগ্য, অযাচিত প্রাপ্তি, অকারণ ব্যর্থতা, অসঙ্গত যন্ত্রণা, অযৌক্তিক বঞ্চনার অসমঞ্জস সমষ্টিই জীবন। একে উপেক্ষা করা যায় না বলেই স্বীকার করে নিতে হয়।
তাই কোনো দুটো জীবনের বোধে, উপভোগে, দুর্ভোগে কিংবা যন্ত্রণায় মিল নেই। অভিন্ন পরিবেশেও সবলে-দুর্বলে, সুস্থে-রুগুণে, যুবকে-প্রৌঢ়ে, বীরে-ভীরুতে, পণ্ডিতে-মূর্থে, ধনীতে-দরিদ্রে, নির্বোধে-বুদ্ধিমানে সুখ-দুঃখের বোধ–স্থান, কাল ও মাত্রা ভেদে বিভিন্ন।
.
০৩.
জীবনে হতাশা, ব্যর্থতা ও বেদনা আছে বলেই মানুষ সুখের কাঙাল ও সহানুভূতির প্রত্যাশী। এইজন্যে মানুষ অন্য মানুষকে বিশ্বাস করে, ভালোবেসে তার উপর ভরসা রেখে বাঁচতে চায়। নিশ্চিন্ত হতে চায় এইটুকু জেনে যে তার জন্যে ভাববার, তাকে বিপদে সাহায্য করবার, তার দুঃখে বিচলিত হবার লোক আছে। এরূপে বিশ্বাসে, ভালো বাসায় ও ভরসায় আশ্বস্ত হয়েই মানুষ বাঁচে। সে ভালোবাসে, ভালোবাসা পায়, তাই জীবনের প্রতি সে আসক্ত, জগতের মমতায় মুগ্ধ। তাই পৃথিবী সুন্দর ও আনন্দময়, জীবন মধুময় ও লোকপ্রিয়। কাজেই বেদনা ও ব্যর্থতার অভিঘাত ও আশঙ্কাই মানুষে মানুষে মিলনসূত্র। গোড়াতে জীবনের অবলম্বন মাতাপিতা, ভাইবোন; তারপর স্বামী বা স্ত্রী ও সন্তান; তারও পরে আত্মীয়-বন্ধু। সুখে-শোকে, আনন্দে-বেদনায়, সম্পদে-বিপদে এদের সাহচর্য, সান্নিধ্য, সহায়তা, সহানুভূতি ও সহযোগিতা না হলে কারো চলে না। রুগণমানুষ প্রিয়-পরিজন-পরিচিতের মুখের একটি কথার জন্যে, হাতের একটু স্পর্শের জন্যে, সান্নিধ্যের এতটুকু উষ্ণতার জন্যে, একটু মমতার দৃষ্টির জন্যে কত যে লালায়িত, উৎকণ্ঠ, উনুখ ও আকুল থাকে, তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।
অতএব, মানুষ বিশ্বাস-ভরসা ও ভালোবাসাকে পাথেয় করেই বাঁচে। তাই বিশ্বাস- ভরসা ভালোবাসার পাত্র-পাত্রী থেকে আঘাত পেলে মানুষের জীবন বিষিয়ে ওঠে, বাঁচা অর্থহীন হয়ে পড়ে। পৃথিবী হয়ে ওঠে বাসের অযোগ্য। ম্লান হয়ে ওঠে সমাজ-সংসার। এই বিশ্বাস-ভরসা ও ভালোবাসার বন্ধনেই অনাত্মীয়-অপরিচিত হয় পরমাত্মীয়। তাই স্ত্রী বা স্বামীর মতো আপন আর
আবার গোড়ার কথায় ফিরে আসতে হয়। কেননা এমনি অবস্থায় কেবল দেহে-মনে সুস্থ লোকই বেপরওয়া হয়ে বাঁচতে পারে। এবং বেপরওয়া জীবনেই প্রাণধর্ম পায় তার স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। অতএব, যার জীবনে বিশ্বাস-সংস্কার ও সমাজের প্রভাব যত কম, সে তত বেশি মুক্ত মানুষ। অকৃত্রিম জীবন-চেতনা, অবিমিশ্র জীবন-সত্য লাভ কেবল সর্বপ্রকারের বন্ধনমুক্ত মানুষের পক্ষেই সম্ভব। তার জন্যে চাই দেহ-মনের যৌবন। কেননা সুস্থ যুবক-যুবতীই কেবল বাঁচতে জানে বিরুদ্ধ পরিবেশে আর কেউ নয়।
আর সব হৃত-যৌবনের কান্নায় কাতর। এমনি এক হৃত-যৌবনের কান্না শুনি মোহিতলালের এক কবিতায় :
আমার সকল কামনা ফোটেনি এখনো
ফোটেনি গানের শাখে।
চৈত্র নিশীথে বসন্ত কাঁদে দ্বারে হেরি বৈশাখে ইত্যাদি।
আর সবার কাছে জীবনতত্ত্ব নানা বাহ্যরঙে রঙিন, খণ্ড-চেতনায় খণ্ডিত। তাই আজো তথ্যরূপী তত্ত্ব এত বিচিত্র ও বহুধা। জীবন-সত্যকে এভাবে কোনোদিন সমগ্র সত্তায় পাওয়া যাবে না। তাই মানুষের জীবন সম্পর্কে ধারণ থাকবে বিচিত্র, তার রহস্য থাকবে চিরআবৃত।