প্রবন্ধ-সাহিত্য

প্রবন্ধ-সাহিত্য

সাহিত্যে আমরা জীবনের গানই শুনতে পাই। কেননা সাহিত্যের উৎসই হচ্ছে জীবন। জীবনের ভাব-চিন্তা-প্রয়াসই অভিব্যক্তি পায় সাহিত্যে। জীবনের গান অবশ্যই-সুর-তাল লয়ে ও বক্তব্যে বিচিত্র। কারণ জীবনে রয়েছে আনন্দ ও যন্ত্রণা, ভয় ও ভরসা এবং আশা ও নৈরাশ্য। যেখানে বিকার সেখানেই বিচলন। এ বিচলন থেকেই আসে গানে-গাথায়, গল্পে-উপন্যাসে, কাব্যে-নাটকে, রম্য রচনায় ও প্রবন্ধে বিচিত্র সুরে জীবনের শ্ৰেয় ও প্রেয়, উল্লাস ও বেদনা, প্রয়োজন ও সমস্যা প্রকাশ পায়।

সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো প্রবন্ধ-সাহিত্যের আবেদন পরোক্ষ নয়। উচ্ছ্বাস কল্পনা এবং অলৌকিকতার ভার প্রবন্ধ-সাহিত্য সয় না বলেই বাস্তব জীবন-প্রতিবেশে উদ্ভূত ভাব ও চিন্তা, তত্ত্ব ও তথ্য, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা-সম্পদ ও আপদ, প্রয়োজন ও সমস্যা, কল্যাণ ও দুর্ভোগ প্রভৃতিই প্রবন্ধ সাহিত্যের বিষয়। অতএব দুনিয়ার যাবতীয় ভাব ও বস্তুই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় হতে পারে যা গল্প-উপন্যাস কিংবা নাটক-কবিতার আঙ্গিকে সম্ভব নয়।

আমাদের ভাষায়ও প্রবন্ধ বিভিন্ন বিষয় উপজীবী। বিজ্ঞান-দর্শন-ইতিহাস, রাষ্ট্র-সমাজ-ধর্ম, সাহিত্য-শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি-ভাষা, রীতিনীতি-আদর্শ প্রভৃতি চিরন্তন ও সাময়িক সব বিষয়েই অল্প-বিস্তর রচনা চোখে পড়ে। যদিও গুণগত কিংবা সংখ্যাগত দৈন্য আজো ঘোচেনি।

যেহেতু সমকালীন দৈশিক ও জাতিক জীবনের আনন্দ ও উদ্বেগ, প্রয়োজন ও সমস্যা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ইতিহাস ও দর্শন, শিক্ষা ও সম্পদ, ধর্ম ও রাষ্ট্র প্রভৃতি সম্বন্ধেই প্রবন্ধগুলো লেখা হয়; সেহেতু প্রবন্ধ-সাহিত্য নাগরিক চেতনারই প্রসূন। এবং তাই প্রবন্ধ-সাহিত্যে দেশের শিক্ষিত মননশীল কল্যাণকামী মানুষের বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা, মন-মনন, রুচি-সংস্কৃতি, আদর্শ-উদ্দেশ্য, ভাব-চিন্তা প্রভৃতি প্রতিবিম্বিত হয়।

এ কারণেই প্রবন্ধ-সাহিত্যে দেশগত ও কালগত জীবনের ভাব-চিন্তা-কর্মের প্রতিচ্ছবি যতটা পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে, এমনটি গানে-নাটকে-কবিতায় কিংবা কথা-সাহিত্যে কখনো সম্ভব হয় না। প্রবন্ধ-সাহিত্যেই বিশেষ দেশের ও কালের মানুষের জীবন-দৃষ্টির একটি সামগ্রিক পরিচয় মেলে। এজন্যে সাহিত্যের জাতীয় রূপ প্রবন্ধ-সাহিত্যেই থাকে সুপ্রকট। স্থানিক ও কালিক প্রতিবেশ, শৈক্ষিক যোগ্যতা, নৈতিক চেতনা, আর্থিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক মান, সামাজিক পরিবেশ, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, ধার্মিক প্রত্যয়, আদর্শিক প্রেরণা প্রভৃতির সামষ্টিক প্রভাবে ও প্রতিক্রিয়ায় গড়ে উঠে যে মন ও রুচি এবং যে-প্রবণতা ও অভিপ্রায়, তা-ই অভিব্যক্তি পায় প্রাবন্ধিকের রচনায়। প্রজ্ঞা, চিন্তা, যুক্তি, তথ্য, তত্ত্ব ও সামগ্রিক জীবন-দৃষ্টি প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রাণ বলেই লেখকের ব্যক্তিত্ব ঐ প্রবন্ধের প্রাণবায়ু। সুলিখিত প্রবন্ধ বুদ্ধিকে জাগ্রত ও তৃপ্ত করে এবং জ্ঞান ও বিচারকে দেয় প্রাধান্য।

সব প্রবন্ধ সাহিত্য হয় না। পাকা লিখিয়ের হাতেই প্রবন্ধ সাহিত্য-শিল্প হয়ে ওঠে জ্ঞান-যুক্তি প্রয়োগ-পরিবেশনের দুর্লভ নৈপুণ্যে। বাঙলায় বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-রামেন্দ্রসুন্দর-প্রমথ চৌধুরীর হাতে প্রবন্ধ সাহিত্য হয়ে উঠেছে।

আমাদের গবেষণামূলক প্রবন্ধ আজো পেশাগত প্রয়াসে সীমিত। কারণ তা উপাধি পরীক্ষার স্তর অতিক্রম করেনি। তাছাড়া গবেষণাবৃত্তগত বলেই গবেষণালব্ধ তথ্য পরিবেশিত হয় ইংরেজিতে। তবু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধ্যাপকেরা ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও দর্শন প্রভৃতি সম্পর্কে বাঙলায় কিছু কিছু লিখেছেন এবং সেগুলো নবলব্ধ জাতীয় চেতনাজাত নতুন দৃষ্টির প্রভাবে কিছু নতুন তাৎপর্য লাভ করেছে।

ভাষা সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি ধর্ম দর্শন ইতিহাস রাষ্ট্র সমাজ ঐতিহ্য প্রভৃতি সম্বন্ধে রচিত সাধারণ প্রবন্ধের মত, পথ ও দৃষ্টির পার্থক্য ও বৈপরীত্য বিচিত্রভাবে প্রকটিত হয়েছে বিভিন্ন মন ও মননের স্পর্শে বিচিত্র ও বর্ণালি হয়ে উঠলেও তাতে দেশ-কাল-জাত-চেতনা দুর্লক্ষ্য নয়।

জাতীয় জীবনের সম্পদ ও সমস্যা, প্রয়োজন ও অভিপ্রায়-সচেতনতা সর্বত্র সুলভ। কেননা লক্ষ্য তাদের বিভিন্ন আত্মিক ও বৈষয়িক ক্ষেত্রে জাতীয় জীবনের সর্বাত্মক উন্নয়ন। এই উদ্দেশ্য সাধন কল্পে কারো দৃষ্টি দেশগত জীবনে নিবদ্ধ, কারো লক্ষ্য ধর্মগত আদর্শে সীমিত, কারো চিন্তা কালিক সমস্যার অনুগত, আবার কারো উদ্যম সর্বমানবিক কল্যাণ চিন্তায় নিয়োজিত। অর্থাৎ কেউ স্বাজাতিক পটভূমিকায়, কেউ স্বাধর্মিক প্রতিবেশে, কেউবা আন্তর্জাতিক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে জগৎ ও জীবনকে প্রত্যক্ষ করতে প্রয়াসী এবং সেভাবেই জাতীয় জীবনে উন্নয়নকামী। তবে আমাদের প্রাবন্ধিকদের মধ্য ধর্মবাদী ও রাষ্ট্রবাদীর চেয়ে মানববাদীর সংখ্যাই বেশি। ধর্মপন্থীরা গোড়া রাষ্ট্রপন্থীরা উগ্র এবং মানবপন্থীরা উদার বলে পরিচিত। লিখিয়ে মাত্রেই–কবি কিংবা কথাশিল্পী যেই হোন–প্রবন্ধ লেখেন। তাই জনপ্রিয় বিষয়ে প্রবন্ধের সংখ্যা অজস্র। কিন্তু নতুন বক্তব্য না থাকলে যে লিখতে নেই, তা তাঁরা বোঝেন না। জ্ঞান-প্রজ্ঞা, চিন্তা-রুচি, উদ্দেশ্য ও জীবন-দৃষ্টির সমন্বয়ে গড়ে উঠে নতুন বক্তব্য। বক্তব্য ব্যক্তিত্বেরই অভিব্যক্ত রূপ। বক্তার স্বাতন্ত্রই বক্তব্যকে বিশিষ্ট করে। নিজস্ব বক্তব্যহীন বাঁচালতায় কেবল আবর্জনারই সৃষ্টি হয়। প্রবন্ধে নতুন ব্যঞ্জনা, নতুন তাৎপর্য নতুন ব্যক্তিত্বের ছাপ আবশ্যিক। বলা বাহুল্য আমাদের প্রবন্ধ-সাহিত্যে অবাঞ্ছিত আবর্জনাই বেশি।

তবু বিভিন্ন মতাদর্শের অনেক প্রাবন্ধিকই পাঠকমনে প্রভাব বিস্তার করেছেন। জাগ্রত জীবনের আহ্বান যাদের চিত্তলোকে সাড়া জাগায় তাদের কিছু-না-কিছু বক্তব্য থাকেই এবং জাগ্রত জীবন থেকেই সাহিত্যের সৃষ্টি ও পুষ্টি। অতএব এ-যুগে প্রবন্ধ-সাহিত্যের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এবং তা হবে জাতির মনীষার মুকুর।

প্রবন্ধ দুই প্রকার : সৃষ্টিমূলক ও নির্মিতিমূলক। ভাব ও তত্ত্ব বিষয়ক বিমূর্ত রচনাই সাহিত্য গুণান্বিত হয় বেশি। আর তথ্য ও সমস্যামূলক Objective রচনা শিল্পায়িত করা অসামান্য শক্তির পরিচায়ক। রামেন্দ্রসুন্দর, রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীর মধ্যে ছিল এই অনন্য প্রতিভা। নির্মিত প্রবন্ধে বৈষয়িক প্রয়োজন পূরণ হয়, আর সৃষ্ট প্রবন্ধ ভাবাত্মক বলেই রসাত্মক এবং সে কারণেই কাব্যগুণান্বিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *