জিজ্ঞাসা

জিজ্ঞাসা

০১.

জিজ্ঞাসা জৈবিক বৃত্তি কিনা জানিনে, কিন্তু মানবিক যে তাতে সন্দেহ নেই। বলতে গেলে বিশেষ অর্থে ওটাই মানুষের RATIONALITY-র ভিত্তি, প্রাণিজগতে মানুষের Differentia. কেননা জিজ্ঞাসা থেকেই জ্ঞানের উদয়, চিন্তার উদ্ভব, অনুশীলন তথা বিকাশ। জিজ্ঞাসাই মানুষের সংস্কৃতি সভ্যতা বিকাশের মূল প্রেরণা। জিজ্ঞাসার অশেষ আকুতিই চিন্তা ও কর্মে প্রবর্তনা দেয়। এই জিজ্ঞাসাই কল্পনাজগতের উপর মানুষের আধিপত্যের কারণ এবং বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্য-শিল্পাদি কলার জন্মদাতা। এক কথায় মানুষের যা-কিছু স্বকীয় তা জিজ্ঞাসার দান।

কার্যকারণ জানবার ইচ্ছাই জিজ্ঞাসা। কার্যের কারণ আবিষ্কারের কৌতূহল মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি। বলা চলে যে-কোনো ঘটনার পশ্চাতে অন্তত যেমন-তেমন একটা কারণ অনুমান করতে না পারলে বা না করে সে স্বস্তিবোধ করে না। যেমন পৃথিবী কখনো কখনো কেঁপে ওঠে নড়ে ওঠে। কিন্তু কেন? ভেবে ভেবে সে বের করল পৃথিবীটা সহস্রমুণ্ড নাগের মাথায় কিংবা গরুর শৃঙ্গে স্থাপিত। ভার যখন অসহ্য হয়ে ওঠে তখন নাগ বদলায় মাথা, গরু বদলায় শিঙ। এই স্থানান্তরের সময় কেঁপে ওঠে পৃথিবী, নড়ে ওঠে বিশ্বসংসার। এদের অসাবধানতার কিংবা বিরক্তির ফলে প্রলয়কাণ্ড ঘটে যায় কখনো কখনো। আরো পরে বিজ্ঞ মানুষ বুঝল ওরা ধর্মের অনুগত ও ধর্মের দাস। পাপাসক্ত মানুষের পাপের ভারই ওদের বিরক্তির কারণ।

আকাশে চাঁদ-সূর্য কেবল ঘোরে না, রাহু-কেতুর গ্রাসেও পড়ে। হয় তারা কোনো প্রবল দুরাত্মার কবলে পড়ে দুঃখ পায়, অথবা স্বকৃত অন্যায়ের শাস্তি ভোগ করে। স্বর্গলোক নিশ্চয়ই পায়ের তলায় থাকার কথা নয়; কাজেই আকাশে তার স্থিতি। অবশ্য স্বর্গ মানেও আকাশ। রাত্রে নির্জন প্রান্তরে আগুনের শিখা থাকবে কেন; নিশ্চয়ই এ ভূতের চেরাগ–আলেয়া। শূন্যতা তো ব্যর্থতারই লক্ষণ। পূর্ণতা যেমন সাফল্যের প্রতীক। অতএব শূন্য ঘট কিংবা কলসি দেখার পরে অভিষ্ট সিদ্ধ না-হওয়ারই কথা। তেমনি হাঁচি, কাশি, টিকটিকি, ডিম, ঝাটা, হোঁচট ও পিছুডাকা দুর্লক্ষণ বলে পরিচিত। কেননা কারো কারো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও এই কাকতালীয় ন্যায়ের যাথার্থ্য প্রমাণের নিশ্চয়ই সহায়কও ছিল। প্রয়োজনের তাগিদ ও বাঞ্ছর তীব্রতা মানুষকে গুরুত্ব চেতনা দেয়, তখন অভীষ্টে অসিদ্ধি, প্রয়াসে ব্যর্থতা ও কর্মে অসাফল্য, দৈবিক কারণ সন্ধানে প্রবর্তনা দেয় মানুষকে। তখন প্রকৃতি ও পরিবেষ্টনী, বস্তু ও প্রাণী তার সাফল্য-ব্যর্থতার দৈব প্রতীক হয়ে ওঠে। উদ্দেশ্যবিহীন যাত্রায় কিংবা গুরুত্বহীন কর্মে অর্থাৎ লাভক্ষতির ভয়-ভরসা যেখানে নেই, সেখানে মানুষ শুভাশুভ সম্বন্ধে কিংবা দৈবানুকূল্য বা বিরূপতা সম্বন্ধে সচেতন থাকে না। যেমন গ্লাস থেকে যদি পানি পড়ে যায় তখন মানুষ তাতে অশুভ কিছু দেখে না। কিন্তু বহুতে আনা পড়া-পানি পড়ে যাওয়া নিশ্চয়ই দুর্ভাগ্যজ্ঞাপক। কিংবা পয়সার জিনিস একবাটি দুধ পড়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে দুর্লক্ষণ। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সব সন্ধিস্থলেই অসংখ্য রেখা রয়েছে কিন্তু কোনো রেখারই কোনো তাৎপর্য নেই–কোনো রেখাই নিয়তি প্রতীক নয়–কেবল হাতের তালুর রেখারই আছে গুরুত্ব।

এমনি করে মানুষ তার জীবনের ও ভুবনের সবকিছুর কার্যকারণ সম্বন্ধ আবিষ্কার করে হয়েছে আশ্বস্ত ও নিশ্চিত।

.

০২.

জিজ্ঞাসাবৃত্তি মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি হলেও, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন মানুষ পরমুখাপেক্ষী, পরশ্রমনির্ভর ও পরান্নজীবী, এক্ষেত্রেও তেমনি সাধারণত তারা অবহেলাপরায়ণ। কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যে তারা অপরের বুদ্ধি, চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। পরের মুখে শুনেই তারা সন্তুষ্ট। নিজেরা ভেবেচিন্তে বিচার-বিশ্লেষণ করে কিছু যে বের করবে সে-ধৈর্য ও অধ্যবসায় তাদের নেই। এ ব্যাপারে তারা আশুতোষ। প্রয়াসবিহীন প্রাপ্তিতেই তাদের আনন্দ ও সন্তোষ। এই আলস্য ও অবহেলা মানুষের পক্ষে শুভ হয়নি। মানুষের মন্থর অগ্রগতির এ-ই মূল কারণ। বস্তুত পূর্বোক্ত স্তরেই রয়ে গেছে পৃথিবীর পনেরো আনা মানুষ। তারা চিরকালের জন্যে নিশ্চিত হয়েছে তাদের জিজ্ঞসার আপাত যৌক্তিক জবাব পেয়ে ও আপাত রম্য সমাধান নিয়ে। এজন্যে আদিম আরণ্য জীবন যেমন সুলভ, তেমনি যান্ত্রিক জীবন-চিন্তাও সভ্য-শহুরে মানুষে দুর্লভ নয়। ফলে অধিকাংশ মানুষ রয়ে গেছে মানবিকতার শৈশবে-বাল্যে। এবং তাদের মনে নতুন করে জিজ্ঞাসা না জাগলে আর সে-জিজ্ঞাসার জবাব নিজেরা মন-বুদ্ধি-জ্ঞান দিয়ে সন্ধান না করলে তাদের–মানুষের বাল্যাবস্থা কখনো ঘুচবে না। যে-দেশে বা যে-গোত্রে জিজ্ঞাসু মানুষের সংখ্যা বেশি সে-দেশে ও সে-গোত্রের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মননের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে।

অতৃপ্তি ও কৌতূহল এবং শোনা-কথায় সন্দেহ ও অনাস্থাই জিজ্ঞাসার জনক। এজন্যে উদ্যমশীলতার প্রয়োজন। আবার সে-উদ্যম আসে নতুন আকাঙ্ক্ষা আর বিরুদ্ধ শক্তির প্রতিরোধ প্রয়োজন, সুখবাঞ্ছ ও জীবনস্বপ্ন থেকে। যে বাহীন, স্বপ্নহীন তার পক্ষে জিজ্ঞাসা জিইয়ে রাখা ও জবাব খোঁজার প্রয়াসী হওয়া অসম্ভব। তাই সে প্রশ্নহীন, গতানুগতিকতায় সে অভ্যস্ত ও নিশ্চিন্ত এবং বিশ্বাসে আশ্বস্ত। এরা বদ্ধজীব, এদের মন-আত্মা বন্ধক রয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আজন্ম লালিত বিশ্বাস-সংস্কারে। এরা পুরোনো ধর্মে, জীর্ণসমাজে, হৃতউপযোগ আদর্শে ও বাড় বৈচিত্র্যহীন জীবনযাত্রায় স্বস্তি খোঁজে পরমনির্ভরতায়। এগুলোকে বিপদে-সম্পদে জীবনের নিরাপদ আশ্রয় বলেই তারা জানে। দুর্বল ও জিজ্ঞাসাহীন মনের প্রশ্রয়ে বিশ্বাস-সংস্কার বুনোলতা কিংবা অশ্বথ-শিকড়ের মতো মানুষের মন-বুদ্ধি-আত্মাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে জীনতা আনে জীবনে, এমন মানুষ কেবলই প্রাণী–নিয়তিবাদী পোষমানা প্রাণী, তার না আছে জিজ্ঞাসা, না আছে বিদ্রোহ করবার মতো মন। সব মানুষে জিজ্ঞাসার তীব্রতা নেই বটে, কিন্তু সব মানুষই ভোগলি ও আরামপ্রিয়। উদ্যমহীন মানুষ সুখের ও ভোগের স্বপ্ন দেখে এবং তারা যে-কোনো স্বপ্নের বাস্তবায়ন চায় কৃত্রিম ও অলৌকিক উপায়ে। তাই সে দৈব-নির্ভর, কল্পনাপ্রিয় এবং নিষ্ক্রিয়। সে আধিদৈবিক কিংবা আধ্যাত্মিক শক্তিবলে সাধের ও স্বপ্নের ভোগ্যবস্তু হাতের মুঠোয় পেতে অভিলাষী। এক্ষেত্রেও সে পরনির্ভরশীল এবং পরসম্পদজীবী।

কেননা সে দৈবশক্তি অর্জনে কিংবা অধ্যাত্মবিদ্যায় ও সাধনায় সিদ্ধিলাভে প্রয়াসী নয়। সে পীর-ফকির, সাধু-সন্ন্যাসীর অনুগ্রহ, তুকতাক, দারুটোনা, তাবিজ-কবচ অথবা ঝাড়-ফুঁকের বদৌলতে ও কেরামতিপ্রভাবে বাঞ্ছসিদ্ধি কামনা করে। এই নিষ্ক্রিয় দলের জীবন-স্বপ্ন মানুষকে করেছে কল্পনাবিলাসী-ভূত-প্রেত-দেও-দানব-গন্ধর্ব-পরী অঙ্গরা তাদেরই কল্পনোক সহচর। মন্ত্রবলে আকাশে উড়তে কিংবা পাতালে প্রবেশ করতে, নদ-নদী উল্লম্বনে অথবা মরু-কান্তার উত্তরণে বাধা নেই কোথাও সেই কল্পনা ও বাসনার জগতে। রূপকথা, উপকথা, ধর্মকথা, পুরাণকথা প্রভৃতি এদেরই সৃষ্টি।

যারা উদ্যমশীল তারা জ্ঞান, বুদ্ধি ও আত্মপ্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসে বাস্তবক্ষেত্রে বাঞ্ছসিদ্ধির উপায় উদ্ভাবনে। তারা আকাশে উড়বার যন্ত্র, পাতালের খবর জানার কৌশল, সাগরতলা দেখবার দৃষ্টি, রোগ নিরাময়ের নিদান, কর্মে সাফল্যের কল এবং অন্যান্য বাঞ্ছসিদ্ধির সামর্থ্য অর্জনে হয় ব্রতী। এই মানুষের দ্বারাই বৈষয়িক জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দান সম্ভব হয়েছে। এরাই করেছে প্রয়োজনীয় সব বস্তু আবিষ্কার ও নির্মাণ। শস্য-উৎপাদন অথবা মৃতে প্রাণসঞ্চার থেকে আণবিক শক্তি সন্ধান কিংবা গ্রহলোকে গমন অবধি সবকিছুই উদ্যমশীল আত্মপ্রত্যয়ী মানুষের দান। এরাই মিটিয়েছে অলস মানুষের সুখ-স্বপ্ন ও সাধ।

আজ উদ্যমশীলতা ও আত্মপ্রত্যয় প্রতীচ্যের সম্পদ আর উদ্যমহীনতা ও দৈব নির্ভরতায় প্রাচ্য মানবের পরিচয়। প্রাচ্যে যা কল্পনা, পাশ্চাত্যে তা-ই বাস্তব; প্রাচ্যে যা আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য, প্রতীচ্যে তা-ই যান্ত্রিক সম্পদ। এ পার্থক্যের মূলে রয়েছে প্রতীচ্য মানুষের শোনা-কথায় সন্দেহ ও অনাস্থা এবং কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, আত্মবিশ্বাস, উদ্যম ও অবিরাম প্রয়াস; আর প্রাচ্য-মানবের প্রয়াসহীন প্রাপ্তি-লিপ্সা, আজন্ম লালিত বিশ্বাস- সংস্কারে নিষ্ঠা, প্রশ্নহীন প্রত্যয় এবং আত্মসামর্থ্যে অনাস্থা। জিজ্ঞাসার ও আকাক্ষার, আত্মপ্রত্যয়ের ও উদ্যমের মেলবন্ধন না হলে জীবনে ও জীবিকায়, মনে ও মানসে যে- জীর্ণতা আসে তা থেকে হাজার হাজার বছরেও যে ব্যক্তির বা সমাজের মুক্তি ঘটে না, তার সাক্ষ্য আফ্রো-এশিয়ায় অনুন্নত ও আরণ্য সমাজ।

অতৃপ্তি, কৌতূহল, অনবরত নতুন নতুন জিজ্ঞাসা ও উত্তর সন্ধানের অক্লান্ত উদ্যমই মানুষকে প্রগতি দান করে। সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রসারের মূলে রয়েছে এ জিজ্ঞাসা ও উদ্যম। অতএব পুরানো-প্রীতি পরিহার করে নতুনের স্বপ্নে ও আকাঙ্ক্ষায় মন ও মননকে জাগিয়ে তুলতে না পারলে সন্ধানী ও সৃজনশীল হওয়া, সংস্কৃতি ও সভ্যতা সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না কারো পক্ষে।

গোড়াতেই বলেছি, জিজ্ঞাসা একটি মানবিক বৃত্তি। এর জাগর আছে, সুপ্তি আছে, মৃত্যু নেই। আমাদের জিজ্ঞাসাবৃত্তি অনেক অনেক কাল ধরে সুপ্ত। তাই আমরা আজ অনুকারক ও প্রতীচ্য-নির্ভর। আমাদের জিজ্ঞাসা-বৃত্তি উদ্দীপিত না করলে আমরা কখনো সুস্থ ও সুস্থ হয়ে স্বকীয়তার ঔজ্জ্বল্যে ও মহিমায় আত্মনির্ভর ও আত্মসম্মানসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে পারব না।

এ অসাধ্য-দুঃসাধ্য কোনো সাধনা নয়। অভিপ্রায় সাংকল্পিক দৃঢ়তা পেলেই আমরা সফল হব। কেননা মানুষের সামর্থ্য হচ্ছে কচুগাছের মতোই, সে সুপ্তিতে অদৃশ্য হয় বটে কিন্তু জাগরে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। প্রাণশক্তির অজস্রতায় সে দেহে পায় পুষ্টি ও লাবণ্য।

জাতির জীবনে এমনি নধর-কান্তি নিয়ে আসে জিজ্ঞাসা ও উদ্যম। তৃপ্তমন্য ও কাক্ষাহীন, নিরুদ্যম ও প্রশ্নহীন জাতিও মরে না, জীর্ণ জীবনের দুর্ভোগই তার নিয়তি হয়ে ঘাড়ে চাপে মাত্র। কার্য-কারণ সচেতন হলেই জাতির দুর্ভোগ ঘোচে। নতুন চেতনার প্রসাদ পেয়ে সে আবার প্রাণের পূর্ণতা অনুভব করে, ধন্য হয় নিজে, ধন্য করে তার প্রতিবেশকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *