গবেষণা-সাহিত্য ও প্রবন্ধ-সাহিত্য

গবেষণা-সাহিত্য ও প্রবন্ধ-সাহিত্য

০১.

সাহিত্য ও শিল্প কিংবা ইতিহাস ও দর্শন সম্পর্ক এ-যুগে বিদ্বানদের ধারণা বদলে গেছে। আগেকার যুগে যে- কিছু সুন্দর করে আঁকলে-শিখলেই শিল্প বা সাহিত্যরূপে গৃহীত হত। তেমনি তথ্যের সমাবেশে হত ইতিহাস এবং তত্ত্বের উপস্থাপনায় হত দর্শন।

এখনকার যুগে ঘনিষ্ঠ জীবন-প্রতিবেশের নিরিখেই এগুলোর গুণাগুণ ও উপযোগ নির্ধারিত হয়। যেহেতু মানুষ তার সমকালীন স্বদেশে আনন্দ ও যন্ত্রণা এবং সম্পদ ও সমস্যা নিয়েই বাঁচে সেজন্যে তার সাহিত্যে ও শিল্পে কিংবা ইতিহাসে ও দর্শনে দেশ-কাল-সমাজ-প্রতিবেশপ্রসূত চেতনার স্বরূপ বিধৃত হবে–পাঠক-দর্শক এই প্রত্যাশাই রাখে। যদি সে প্রত্যাশা পূরণ না হয়, তাহলে রচিত শিল্প-সাহিত্য-ইতিহাস-দর্শন উপযোগ হারায়। কেননা উপযোগই সব সাধনার ও গুরুত্ব নিরূপণের মাপকাঠি।

গবেষণাও আজ আর তথ্যের উদঘাটনে ও সমাবেশে সমাপ্ত নয়। দেশগত কালিক জীবন প্রতিবেশের উন্মোচন ও বিশ্লেষণই গবেষকের লক্ষ্য। তাই ইতিহাসের ক্ষেত্রে কেবল বাহ্য ঘটনা কিংবা আচরণ ও তার ফলাফলই শুধু জ্ঞাতব্য নয়। স্থানিক ও কালিক পরিবেশ, নৈতিক চেতনা, আর্থিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক মান, ধার্মিক প্রত্যয় ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রভৃতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সামষ্টিক প্রভাব জন- চৈতন্যে কীভাবে প্রতিফলিত এবং ভাব-চিন্তা-কর্মে কিরূপে অভিব্যক্ত তা দেখা-জানা-বোঝার জন্যেই ইতিহাস চর্চায় আজকের মানুষ আগ্রহী। দর্শনও আজ জীবন-নিরপেক্ষ তত্ত্বসর্বস্ব চিন্তার প্রসূন নয়–জগৎ প্রতিবেশে জীবন-চেতনার গভীরতর স্বরূপ যাচাইয়ের উপায় মাত্র।

.

০২.

গবেষণার ক্ষেত্রে যারা বিচরণ করেন, সঙ্গত কারণেই তারা হয় অধ্যাপক নয়তো হবু অধ্যাপক। তাই গবেষণা আজো বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রী। এবং অপ্রিয় হলেও এ-কথা সত্য যে গবেষণা আমাদের দেশে আজো বিশ্ববিদ্যালয়ী উচ্চতম উপাধি পরীক্ষার স্তর অতিক্রম করেনি। অর্থাৎ জ্ঞানের ক্ষেত্র প্রসারের জন্যে গবেষণার অঙ্গনে আজো কেউ তেমন বিচরণ করেন না। পেশার ক্ষেত্রে পদোন্নতি লক্ষ্যেই গবেষণার জগতে তাদের পদচারণা সীমিত। অতএব ব্যক্তিগত প্রেরণার সংকীর্ণ পরিসরেই আমাদের জ্ঞান-চর্চা পরিমিতি মানে, জ্ঞান-লোভীর অভিযাত্রার উদ্যম তাতে অনুপস্থিত। পেশাগত প্রয়াস নেশাগত না হলে আমাদের গবেষণার ক্ষেত্র অভীষ্ট ফসল-প্রসূ হবে না। তাছাড়া বিভিন্ন বিদ্যা আজো ইংরেজির মাধ্যমে অর্জন সাপেক্ষ বলেই গবেষণালব্ধ জ্ঞান, তথ্য ও তত্ত্ব পরিবেশিত হয়। ইংরেজি গ্রন্থেই এবং কিছু অসুবিধে ও কতকাংশে আমাদের হীনমন্যতার দরুন গবেষণা-স্থানও য়ুরোপ-আমেরিকা। তাই বাঙলাভাষা আজো গবেষণা-সাহিত্যে সমৃদ্ধ নয়। তবু ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাস সম্পর্কিত কিছু কিছু গবেষণা গ্রন্থ গত বিশ বছরের মধ্যে বাঙলা ভাষায় রচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অধ্যাপকরাই প্রধানত এ কৃতিত্বের দাবীদার। এসব গবেষণামূলক রচনা তথ্যে ও তত্ত্বে ঋদ্ধ বটে,কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বহু প্রত্যাশিত স্থানিক ও কালিক জীবন-প্রতিবেশ নিরপেক্ষ। ফলে এসব গবেষণার উপযোগগত গুরুত্ব সামান্য। দেশগত ও কালগত জীবনের পটে উপস্থাপিত না হলে কোনো জ্ঞানই পূর্ণ জ্ঞানের মর্যাদা লাভ করে না।

.

০৩.

আমাদের প্রবন্ধ-সাহিত্যের দৈন্য ঘুচতে মনে হয় আরো দেরি আছে। অবশ্য পত্র-পত্রিকার প্রয়োজনে প্রবন্ধও প্রায় গল্প-কবিতার মতোই অজস্র লিখিত হয়। বিশেষ বিশেষ সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক উৎসব পার্বণ উপলক্ষে স্কুলের ছাত্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অবধি সবাই প্রবন্ধ লেখেন। কিন্তু এদের প্রবন্ধ কৃচিৎ রচনার স্তর অতিক্রম করে। তার কারণ প্রবন্ধ যে প্রতিবেশ সচেতন লেখকের জ্ঞান, মন,প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বের সমন্বিত অভিব্যক্তির ধারক তা তারা বোঝেন না। তাই বক্তব্যহীন বাঁচালতা কেবলই আবর্তিত হয়; চিন্তা রুচি কিংবা দৃষ্টিতে কোনো পরিবর্তন ঘোষণা করে না। সাময়িক আনন্দ কিংবা যন্ত্রণাজাত নতুন চিন্তা, রুচি ও অনুভব প্রসুত কোনো নতুন বক্তব্য না থাকলে প্রবন্ধ লিখবার অধিকার জন্মায় না। পুরোনো কথার রোমন্থনে আবশ্যক কী। যেমন ধরা যাক রবীন্দ্র-নজরুল পাকিস্তান-ইসলাম সম্বন্ধীয় একগাদা রচনা প্রতি বছরেই পার্বণিক প্রয়োজনে লিখিত হয়। কারো কোনো নতুন বক্তব্য নেই, অথচ ম্যাগাজিন ও পত্রিকার প্রয়োজনে কিংবা রেডিয়ো-টেলিভিশনের তাগিদে তারা লেখেন। ফলে সব লেখাই হয় নিবর্ণ ও নির্বিশেষ। প্রবন্ধে যদি লেখকের ব্যক্তিত্বের ছাপ না রইল অর্থাৎ কে বলছে ও কী বলছে–এ দুটোর সমন্বয় না হল তাহলে পাঠক মনে সে লেখার কোনো প্রভাবই পড়ে না। যে-কথা কেজো নয়, সে কথা পাগলে ছাড়া কেউ বলে না। বক্তব্য মাত্রেরই উদ্দিষ্ট থাকে শ্রোতা, যে-বক্তব্য বিভিন্ন মুখে বহুশ্রুত তা তাৎপর্যহীন ও আটপৌরে। বহু মনের স্পর্শ তা মলিন ও তুচ্ছ।

প্রবন্ধ যে সবসময় সাহিত্য হবে তা নয়, কিন্তু শোনার মতো বক্তব্য হবে তার প্রাণ। স্বদেশের ও স্বকালের জীবন-প্রতিবেশের আনন্দ ও যন্ত্রণার, সম্পদ ও সমস্যার অভিঘাত যদি মন-বুদ্ধিকে বিচলিত করে, প্রাগ্রসর চেতনায় উল্লাস কিংবা যন্ত্রণা এনে দেয় অথবা কোনো পুরোনো ভাব-চিন্তা কর্ম বা তত্ত্ব, তথ্য ও বস্তু নতুন তাৎপর্যে চমকপ্রদ হয়ে ওঠে অথবা চেতনায় নতুন দৃষ্টি দান করে তখনই কেবল বলবার মতো বক্তব্য প্রকাশের আবেগ সৃষ্টি হয়। এবং তেমন প্রবন্ধই কেবল পাঠকের প্রত্যাশা পূরণ করে।

গত বিশ বছর ধরে কয়েককুড়ি লেখক যে-কয়েক শ প্রবন্ধ লিখেছেন, তার মধ্যে থেকে শতখানিক ভালো প্রবন্ধ হয়তো পাওয়া যেতে পারে। মানবশক্তির এ-ও একপ্রকার অপচয়।

স্বদেশের স্বকালীন মানুষের জীবন ও জীবিকার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির, মত ও পথের, ধর্ম ও সমাজের কিংবা রাষ্ট্রের সমস্যা ও সংকট যাদের চেতনায় জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে যন্ত্রণা জাগিয়েছে অথবা গভীর উল্লাস ও আবেগ সৃষ্টি করেছে, তারাই কেবল সার্থক প্রবন্ধ রচনা করতে পেরেছেন। তেমন প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রবন্ধকারেরা দেশে চিন্তা- নায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেন, অতুল জ্ঞান-প্রজ্ঞা তত্ত্বের-ভাব-চিন্তা–কর্মের ও মত-পথের দিশা দিয়ে তারা জাতিকে যুগোপযোগী ও কল্যাণাভিসারী করে তোলেন।

প্রবন্ধ-সাহিত্যে আমাদের দৈন্যের মধ্যেও আশ্বস্ত হই যখন দেখি আমাদের সমাজ-সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমস্যা ও সঙ্কট-সচেতন অন্তত কয়েকজন প্রবন্ধকার আমরা পেয়েছি, যারা শোষিত পীড়িত নির্যাতিত ও মূঢ় দেশবাসীর জন্যে বেদনা-ক্লিষ্ট হৃদয়ে উদ্বিগ্ন চিত্তে প্রতিকার-পন্থা সন্ধানে সদানিরত।

তারা অজ্ঞের অজ্ঞতা, অন্ধের অন্ধতা, মূঢ়ের মোহ, পথভ্রষ্টের যন্ত্রণা ঘুচানোর কাজে তাদের মন-মনন নিয়োজিত করেছেন। অবশ্য পিছুটান দেবার লোকেরও অভাব নেই। তাদের সর্বপ্রযত্নও যে প্রায়ই অসাফল্যে বিড়ম্বিতোর মূলে রয়েছে তাদের প্রতিক্রিয়াশীলতা ও পশ্চাৎমুখিতা।

প্রবন্ধ সুচিন্তিত, সুযৌক্তিক ও সুলিখিত হবে বটে, কিন্তু সাহিত্য হওয়া জরুরি নয়। কেননা প্রবন্ধ হচ্ছে চিন্তার ও যুক্তির প্রসূন-গরজের সৃষ্টি। তাই সমকালীন সমাজজীবনের ও জীবিকার যে- কোনো বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচিত হতে পারে এবং হয়ও। জ্ঞানগর্ভ ও নৈতিক-তাত্ত্বিক প্রবন্ধই কেবল দীর্ঘায়ুর দাবীদার। অবশ্য জ্ঞান পূর্ণসাপেক্ষ আর নীতিচেতনা এবং তত্ত্ববোধও আপেক্ষিক এবং সে কারণে পরিবর্তনশীল। যেমন চুরি করা অপরাধ; তার শাস্তি হস্ত কর্তন। কিন্তু আজকের মানববাদীর চোখে বুভুক্ষুর ভাতচুরি নিঃস্বর পয়সা চুরি–অপরাধ হতে পারে না। অভাবজাত চুরি অপরাধ নয়, স্বভাবজাত চৌর্যই অপরাধ। কাজেই হস্ত কর্তন করতে হবে ঘুসখোর পদস্থকর্মচারীর, গরিব চোরের নয়। অর্থাৎ যে-অভাবের ও যে-বেকারত্বের কারণে মানুষ চৌর্যবৃত্তি গ্রহণ করে, সমাজ-পরিবেশে সেই আর্থিক অসাচ্ছল্যের অনুপস্থিতির পরও যদি কেউ চোর হয়, তাহলেই হস্ত কর্তন ন্যায়সিদ্ধ। অন্যথায় তা হবে অমানুষিক অযৌক্তিক বর্বরতা। আবার ভূগর্ভ সমুদ্র আকাশ নক্ষত্র চন্দ্র জল বায়ু নীতি রাষ্ট্র প্রভৃতি সম্পর্কিত পূর্বজ্ঞানের তথ্যগত অপূর্ণতাই এ সম্বন্ধীয় পূর্ববর্তী রচনাকে পরিত্যাজ্য করে। অতএব কোনো বিষয়ক প্রবন্ধই স্থায়ী সাহিত্যের মর্যাদা পাবে না। অবশ্য কালান্তরে মানুষের ভাষা, ভঙ্গি ও চেতনা বদলায় বলে সৃজনশীল সাহিত্যও অবিনশ্বর হয় না। যদি সাহিত্যগুণও থাকে তাহলেও বক্তব্যের সাময়িকতা তাকে স্বল্পায়ু করবে। শিল্পগুণের ও বক্তব্যের চিরন্তনত্বের সহ-স্থিতি সুদুর্লভ মহামুহূর্তের দান। তেমন প্রবন্ধ অবশ্যই স্থায়ী সাহিত্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *