স্বপ্নের বৃষ্টিমহল – ২৫

২৫

‘হ্যালো মা! কী খবর?’ সেলফোন কানে ঠেকিয়ে বলল অমৃতা।

‘তুই কোথায়?’

‘রুদ্রদের বাসায়।’

‘ফিরছিস কবে?’

‘এখনো শিওর না।’

‘শোন এই শুক্রবারে ছেলেটা তোর সাথে দেখা করতে চেয়েছে। ওর বাবা মাও আসবে। আমরা ঠিক করেছি দুই পক্ষ মিলে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে বসব।’

‘কোন ছেলে? কেন দেখা করতে চেয়েছে?’

‘তোর একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে বলেছিলাম না?’

অমৃতা বিরক্তিতে কাদা কাদা হয়ে বলল, ‘মা প্লিজ! বন্ধ কর তো এসব! আমি বিয়ে করব না। একথা তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি!’

মায়ের কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে উঠল, ‘বিয়ে করতেই হবে তোকে। বিদেশে যাওয়ার আগেই করতে হবে। অবিবাহিত মেয়ে আমরা একলা এত দূরে ছাড়ব না।’

‘সিরিয়াসলি?’

‘হ্যাঁ সিরিয়াসলি।’

‘হাস্যকর কথাবার্তা বলো নাতো মা! এসব বিয়েশাদী ঘর সংসার আমাকে দিয়ে হবে না। তোমরা বরং দিপাকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা কর।’ কথাটা বলে ফোনের লাইন কেটে দিল অমৃতা। দোতলার পশ্চিমের বারান্দায় গ্রিলের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছিল সে। অন্ধকার আকাশে গোল চাঁদ ঝুলে আছে। চাঁদের চারিদিকে ঢেউখেলানো ধোঁয়াটে মেঘের বিস্তার। নীলচে জোছনায় সেই মেঘের ঢেউগুলোকে বড় রহস্যময় দেখায়। ঝিরঝিরে একটা প্রাণ জুড়ানো বাতাস দেবপাহাড়ের নিবিড় গাছগাছালির পাতায় পাতায় দোল দিয়ে যাচ্ছিল। ধারে-কাছে কোনো বাড়ির ছাদে ছেলে-মেয়েরা গলা ছেড়ে গান গাইছে।

‘কী করিস?’ বিভার কণ্ঠস্বর কানে এসে লাগল।

অমৃতা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল বিভাকে। নীরস গলায় বলল, ‘বিড়ি টানি।’

‘একলা কেন? বাকিরা সব কোথায়?’

‘কে জানে!’

‘এত আপসেট দেখাচ্ছে কেন তোকে? কী হইছে?’ বিভার প্রশ্ন। অমৃতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার কথা বাদ দে। আমাদের জামাই বাবু কেমন আছে?’

বিভা সলজ্জ হেসে বলল, ‘মিস করছে আমাকে।’

‘আহারে… উনাকে সঙ্গে নিয়ে এলেই পারতি।’

‘ছুটি নেই তো! কদিন আগে মায়ের অসুস্থতার জন্য ছুটি নিতে হলো। এখন আবার কী করে নেয় বল?’

‘হুম…!’

‘তোর খবর বল। একা একা দেশ ছেড়ে এত দূরে যাবার ফিলিংস কেমন?’

অমৃতা ঠোঁট উল্টে বলল, ‘কোনো ফিলিংস টের পাচ্ছি না। আজকাল আমার অনুভূতিগুলো কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে। এদিকে আমার সিনিয়ার চাইতেছে না আমি বিদেশ যাই। উনি বললেন প্র্যাক্টিশনার হইতে চাইলে মাস্টার্স না করে বার অ্যাট ল’ করা উচিত। মাস্টার্সের জন্য দেশ ছাড়তেছি এটা উনি সাপোর্ট করতেছেন না, বুঝছিস? উনি চায় আমি প্র্যাক্টিসেই থাকি।’

‘ঠিকই তো। মাস্টার্স তো তুই করছিস একবার। আবার কী দরকার। তাছাড়া তোর মতো ট্যালেন্টেড জুনিয়ার হারাইতে চাইবে ক্যান বল? তুই বরং ব্যারিস্টারি কর।’

‘পয়সা দিবে কে? এল এম এমের জন্য তো ফান্ড পেয়ে গেলাম।’

‘আঙ্কেল দিবে।’

‘আমার বাপের অত টাকা নাই।’

সেলফোন বেজে উঠল আবার। আকাশ কল করছে অমৃতার নাম্বারে। ধরতেই ওপাশ থেকে বলল, ‘তোরা কই? ছাদে আয়।’

‘তোরা সব কি ছাদে নাকি?’

‘হ আমরা সবাই ছাদে। বিভা কি তোর সাথে আছে?’

‘হুম আমার সাথেই আছে।’

‘চলে আয় তাড়াতাড়ি।’

ফোন রেখে আধ খাওয়া জ্বলন্ত সিগারেটটা দূরে ছুড়ে ফেলল অমৃতা। রেলিং এর বাইরে পিচ করে আলসে থুতু ফেলল একবার। তারপর বিভাকে বলল, চল ছাদে যাই।’

২৬

নীল জোছনায় চেয়ার পেতে গোল হয়ে বসেছিল ওরা তিনজন। রুদ্র, আকাশ আর সামি। রুদ্রর কোলে গিটার। আকাশ সেলফোনে মগ্ন। সামি চেয়ারে হেলান দিয়ে উদাস ভঙ্গিতে ধোঁয়াটে মেঘে ঘেরা রহস্যময় চাঁদটা দেখছিল। ক্ষণিক আগে মা ফোন দিয়েছিল। সামি বলেছে বিপ্লবের গ্রামের বাড়ি এসেছে। মিথ্যে বলতে ইচ্ছে হয়নি কিন্তু মাকে সে আর কষ্ট দিতে চায় না। সামি জানে প্রতারক বন্ধুদের সঙ্গ এখনো সে ছাড়তে পারেনি এই তথ্য মাকে সীমাহীন কষ্ট দেবে। হৃদি কিছুটা দূরে রেলিং-এর ধার-ঘেঁষে ধীর পায়ে পায়চারি করছে আর ফোনে কথা বলছে নিচু স্বরে। মৃদু বাতাসে ওর শাড়ির আঁচল উড়ছে। উড়ছে খোলা চুল। সামি আড়চোখে লক্ষ্য করছিল ওকে। কার সাথে কথা বলছে এতটা সময় ধরে? সামি নিজের ভেতর বেশ কিছুদিন যাবত এক ধরনের বৈরাগ্য টের পাচ্ছে। সব কিছুতেই একটা গা সওয়া নির্বিকার ভাব। যাবতীয় পার্থিব টানাপোড়েন তুচ্ছ মনে হয়। সুখ, দুঃখ, ঘৃণা অথবা ভালোবাসার মতো সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতিগুলোকে আর আগের মতো টের পায় না সে। টের পায় শুধু বিরক্তি। যেমন এই মুহূর্তে হৃদিকে তার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে। মন চাইছে ওর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় বাইরে। তারপর কানটা মলে দিয়ে বলে, ‘এত রাতে কার সাথে কথা বলিস তুই?’

পাশের ছাদে ছোটখাটো একটা দল অনেকক্ষণ যাবত গান গেয়ে যাচ্ছে খালি গলায়। রাস্তা থেকে ছুটে আসা পিঙ্গল আবছায়ায় কারো মুখ ঠিকমতো বোঝা যায় না। রেলিং-এর গায়ে ঠেস দেয়া মূর্তিগুলোকে অলীক বলে মনে হয়। পাশের বাড়ির সাথে রুদ্রদের বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি নয়। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় ওই ছাদের রেলিং। সম্মুখে গাছগাছালির জঙ্গলে ভরা পাহাড় ঢালু হয়ে নিচে নেমে মিশে গেছে বড় রাস্তার সাথে। দৃষ্টি প্রসারিত করলেই দেখা যায় পাহাড়ের নিচের আলোকজ্জ্বল রাতজাগা বন্দরনগরীর অবিরাম ঝিকিমিকি।

একটি মেয়ে হেঁড়ে গলায় গাইছিল,

‘ওরে নীল দরিয়া
আমায় দে রে দে ছাড়িয়া…’

আকাশ রুদ্রকে বলল, ‘আজকে মনে হয় তুই চান্স পাবি না। শিল্পীর মেলা বসে গেছে। তোর বেল নাই।’

রুদ্র একটু সময় চুপ করে থেকে ফন্দি আঁটার গলায় বলল, ‘চল জ্বালাই ওদেরকে!’

আকাশকে দেখে মনে হল এই কথাটা বেশ পছন্দ হয়েছে। নড়েচড়ে বসে বেশ উদ্যমী হয়ে বলল, ‘কীভাবে জ্বালাবি?’

‘দাঁড়া অমৃতা বিভা আসুক। সবাই মিলে এমন চিল্লায়ে গান ধরব যে ওরা ছাদ ছাইড়া পালাইতে বাধ্য হবে।’

সামি বিরস গলায় বলল, ‘দেখা যাবে ফলাফল হয়ে গেছে উল্টা। ওরা পালাচ্ছে না। আমরাই পালাচ্ছি।’

‘জি না! পলাইব ওরা। পারলে ছাদ থেকে লাফ দিয়া নামবে। বেট ধরলাম।’

‘কত টাকা?’

‘কী খালি ট্যাকা ট্যাকা করস শালা। ট্যাকা ছাড়া জীবনে আর কিছু নাই?’

‘বাজি ধরুম কীসে তাহলে? তোর তো ব্যাটা গার্লফ্রেন্ডও নাই। গার্লফ্রেন্ড থাকলে কইতাম এক দিনের জন্য তোর গার্লফ্রেন্ড আমার।’ সামি বলল উত্তেজিতভাবে। আকাশ চাপা গলায় বলে উঠল, ‘আস্তে… তোর বউ কিন্তু কাছাকাছিই আছে। বুঝে শুনে কথা বল ড্যুড!’

‘ধুর… বউরে আমি ডরাই নাকি?’ তেজি গলায় বলে সামি। হৃদি তখন পায়ে পায়ে হেঁটে এসেছে ওদের কাছে। উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করছে, ‘কী হইছে?’

সামি অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিল। উত্তর দিল রুদ্র, ‘সামি বলতেছে ও নাকি তোরে ডরায় না।’

‘কী?’ হুঙ্কারের সুরে প্রশ্ন করে হৃদি।

আকাশ কাঁচুমাচু হয়ে বলে, ‘আমরা তো ওর কথা বিশ্বাসই করি নাই দোস্ত! বউরে ভয় পায় না। তাও আবার তোর মতো বউ! এত বড় সাহস!’ সামি এবারেও কোনো কথা বলল না। উদাস ভঙ্গিতে চেয়ে থাকল জোছনা ধোয়া আসমানের দিকে। হৃদি বলল, ‘আমাকে ভয় পায় নাকি পায় না এইসব কথা কেন আসল হঠাৎ?’

রুদ্র হড়বড় করে বলল, ‘দুঃখের কথা কী আর বলব দোস্ত? আমার গার্লফ্রেন্ডকে ধার চায় তোর বর। একদিনের জন্য।’

এ কথা শুনে হৃদির নাক দিয়ে ড্রাগনের মতো ফোঁসফোঁস অগ্নি-শ্বাস পড়তে লাগল। কোমরে হাত রেখে বিভীষণ চোখে চেয়ে রইল সে সামির দিকে কিছুক্ষণ। সামি নির্বিকার। মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে জোছনার নীল ধোঁয়াশার দিকে। মুখে একটা পরিচিত গানের সুর তুলছে শিস দিয়ে। ঐ নির্বিকারত্ব দেখে হৃদির রাগের মাত্রা আর কয়েক ডিগ্রী বেড়ে গেল। গর্জে উঠে বলল, ‘ফালতু মানুষরা তো এসবই করবে। নিজের বউকে তো ভালো লাগবে না আর। অন্যের গার্লফ্রেন্ডের দিকে নজর দিবে।’ একটু থেমে সে রুদ্রর দিকে চেয়ে ত্যাড়া গলায় বলল, ‘তোর গার্লফ্রেন্ড আবার কে? আমি তো কিছু জানি না!’

‘ফিউচার গার্লফ্রেন্ড। আমেরিকায় যাইয়া সবার প্রথম আমার যে ব্লন্ড গার্লফ্রেন্ডটা হবে তাকেই চায় তোর জালিম স্বামী।’ রুদ্র বলল কাতর গলায়।

আকাশ তিরস্কারের গলায় বলল, ‘ছি সামি, তুমি পৃথিবীর নিকৃষ্টতম স্বামী!’

সামি নির্লিপ্ত ভাবে বলল, ‘রুদ্র শোন, রাশান মেয়েরা অনেক সুন্দর হয় বুঝছিস। তুই বরং একটা রাশান গার্লফ্রেন্ড বানা। ভালো হবে।’

সেই মুহূর্তে হঠাৎ আসমান থেকে যেন কী একটা পড়ল টুপ করে। সামির কোলের ওপর। একটু চমকে উঠে কাগজের পুটলিটা তুলে নিল সামি। খুলে দেখল লেখা আছে, ‘এখনো গেলি না? পাছায় কিক মেরে ছাদের ওপর থেকে ফেলে দিব তোকে হারামজাদা। এখুনি বের হয়ে যা!’

পড়ামাত্র রাগে গজগজ করে উঠে হৃদির মুখের সামনে কাগজটা মেলে ধরল সামি, ‘এসব ফাইজলামির মানে কী? ‘

অনেকদিন বাদে হৃদির সাথে সরাসরি কোনো কথা বলল সে। হৃদি এই আকস্মিকতায় কিঞ্চিৎ থতোমতো খেয়ে গিয়েছিল। সামির হাতে ধরা কাগজটায় পলক ফেলে নিষ্পাপ মুখে বলল,

‘কী এটা?’

‘এটা কী তুমি জানো না?’ দাঁত কিড়মিড় করে সামি। ‘আজিব! আমি কীভাবে জানব?’

আকাশ সামির হাত থেকে কাগজটা তুলে নিয়ে দেখল। অট্টহাসি হেসে বলল, ‘দ্য গ্রেট হালুলুকা হ্যাজ ল্যান্ডেড অন দ্য ছাদ!’

হৃদি চোখ পিটপিট করে কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন হয়ে থেকে ভারী ইনোসেন্ট গলায় বলল, ‘তুই বলতে চাচ্ছিস এটা হালুর হাতের লেখা?’

রুদ্র সুর করে বলল, ‘হালু… রিকশাঅলা তোর খালু! হালুকে জিজ্ঞাসা করিস তো ওর কোন খালু ঢাকা শহরে রিকশা চালায় কি না?’

হৃদি একটা গাট্টা মারল রুদ্রর মাথায় ‘চুপ থাক!’

সামি তীব্র বিরক্তি এবং তাচ্ছিল্যের সাথে কাগজটা দুমরে মুচড়ে ছুড়ে মারল দূরে। মুখে বলল, ‘এইসব লেইম জোকের কোনো মানে হয় না।’

হৃদি বাকি দুই বন্ধুর দিকে চেয়ে রসিয়ে রসিয়ে বলল, ‘আমি তো কিছুই জানি না! হোয়াটস গোয়িং অন বিচ?’

‘আই ডোন্ট নো, বিচ!’ হৃদির গলার সুর নকল করেই বলল আকাশ। সামি দূরের বন্দরনগরীর অবিরাম ঝিকিমিকির দিকে চোখ রেখে তীব্র গলায় প্রত্যুত্তর করল, ‘এসব বালছাল ফাইজলামির বয়স নাই আর। এখন এসবে মজা লাগে না। মেজাজ খারাপ হয়।

হৃদি তখনো বিষয়টা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি। আলুথালু চোখে চেয়ে আছে বন্ধুদের দিকে। সেই সময় অমৃতা আর বিভার আগমন ঘটল। পাশের ছাদের মেয়েটা তখনো গলা ছেড়ে গেয়ে যাচ্ছিল গান। সবাই সমবেত হবার পর সামি খবরটা দিল, ‘শোন, পরশু দিন সকাল দশটায় আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে। অনলাইনে করা সম্ভব না। সো কক্সবাজার যাওয়ার প্ল্যানটা এইবার বাদ দে। আমরা কালকে সারাদিন ঘুরাফিরা করে সন্ধ্যার পর ব্যাক করব ঢাকা।’

রুদ্র আপত্তি জানাল, ‘কীরে মামা। এইটা লাস্ট টাইম ফানিমুন হবে। আবার কবে আমরা একসাথে হব ঠিক নাই। প্লিজ ম্যানেজ কর সামহাও।’

সামি ঘাড় নাড়ে, ‘পসিবল না দোস্ত। বোঝার চেষ্টা কর।

রুদ্রর মনটা খারাপ হলো। কিন্তু কথা আর বাড়াল না সে। বিভাকে বলল, ‘বিভাবরী শোন, এখন আমি গান ধরব আর তুমি তাধিন তাধিন নাচবা। এমন নাচ নাচবা যেন পাশের ছাদের ছাগলগুলা বিরক্ত হয়ে ম্যাম্যা বন্ধ করে বাড়ি ফিরে যায়। গট ইট?’

বিভা নিরুপায় গলায় বলল, ‘কিন্তু আমার সাথে তো ঘুঙুর নাই। ঘুঙুর ছাড়া ক্যামনে নাচব?’

‘আরে ধুত্তোর ঘুঙুর। নাচার জন্য এসব লাগে নাকি? আকাশরে বললে এখনই ধেইধেই শুরু করবে।’ রুদ্র বলল গিটারে টুংটাং করতে করতে। অমৃতা বলল, ‘কেন পাশের বাসার মেয়েটা তো বেশ সুন্দর গাচ্ছে। ভালো লাগতেছে শুনতে।’

রুদ্রর আত্মসম্মানে ঘা লাগল, ‘আমার মতো এত বড় শিল্পী সামনে বসে আছে। আর তুই দুই টাকার শিল্পীর গান শুনতে চাস? যা শালা… আজকে কোনো গান হবে না।’

বিভা হাতজোড় করে কপট বিনয়ের সুরে বলল, ‘একথা বলিবেন না গুরু! আপনার সঙ্গীত না হইলে আজিকার এই সুরের মুর্ছনা ছারখার হইয়া যাইবে। আমি কলিকাতা থেকে ছুটিয়া আসিয়াছি শুধুমাত্র আপনার মহৎ সঙ্গীতের টানে!’

ওর বলার ধরনে বাকিরা হেসে ফেলল। পর্যাপ্ত চেয়ার ছিল না বলে বিভা আর অমৃতা ছাদের মেঝেতে আসন গেঁড়ে বসল। অনেকদিন বাদে ছয় বন্ধুর আসর জমে উঠতে যাচ্ছে। ওদের সবার চোখে ফুর্তির রেশ। মনটা আনন্দে উথাল-পাতাল। শুধু অমৃতা একটু অপ্রতিভ, অন্যমনস্ক এবং বিচলিত।

সামি ওর মুখোমুখি চেয়ারে বসেছে। কিন্তু কেউ কারো দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। একটা দম আটকানো অস্বস্তি দুজনের মধ্যকার শূন্য বাতাসকে ক্রমেই বিষাক্ত করে তুলছে।

পাশের ছাদের গানের দল এখন নতুন গান শুরু করেছে। রুদ্র উচ্চস্বরে গাওয়া শুরু করল,

‘তুই বন্ধু হয়ে আমার হাতটা ছুঁলে
আমি এ বিশ্ব সংসার যাবো ভুলে
ভুলবো সব ভুল অংকের ভুল উত্তর
শত দুঃখ বেদনা আর কষ্টের প্রহর
তুই বন্ধু হয়ে থাকলে আমার পাশে
আমি কষ্ট গিলে খাই এক নিঃশ্বাসে
তুই কাছে আয়, দূরে চলে যাই চল
তোর জন্য গড়েছি স্বপ্নের বৃষ্টি মহল!’

ওর সাথে বাকি বন্ধুরাও গলা মিলিয়ে দিল। বিভা, হৃদি আর আকাশ শুরু করল নাচ। পাশের বাড়ির দলটা বিস্তর থতোমতো খেয়ে গেছে। গান থামিয়ে নিঝুম হয়ে বসে আছে অন্ধকারে। বন্ধুদের গলার স্বর এবং উদ্যম ওদের চাইতে দ্বিগুণ বেশি এটা বুঝতে পেরেই হয়ত হার মেনে নিয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক বিস্ময়ের ধাক্কাটা খুব সহজেই সামলে নিল ওরা। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই গলা ছেড়ে দিল আবার। এবার আগের চাইতে তিনগুণ উঁচু ভলিউমে। এতে রুদ্রর কণ্ঠের তেজ আরো বেড়ে গেল। সামি ভীষণ বিরক্ত, ‘কী মুশকিলে পড়লাম। চারিদিকে ভ্যাভ্যা করতেছে এক দল ভ্যাড়া। এর মধ্যে থাকা যায়?’

কে শোনে কার কথা? হৃদি, বিভা আর আকাশ ধেই ধেই করে নেচে যাচ্ছে। আবোলতাবোল সুরে গান গাইছে। কোনোদিকে হুঁশ নেই। রুদ্রর সুরেলা কণ্ঠস্বর হোঁচট খাচ্ছে ওদের বেসুরো গলার সাথে মিশতে গিয়ে। অমৃতা চুপচাপ বসে আছে। চুপচাপ বসে আছে সামি। একগুচ্ছ প্রাণোচ্ছল তারুণ্যের মাঝে দুটি বিষণ্ণ মানুষ ঝিম ধরে আছে। হঠাৎ বিভা থেমে পড়ে হাঁপধরা গলায় বলল, ‘পারতেছি না। এনার্জি নাই।

‘কী হলো?’ সামির প্রশ্ন।

বিভা ওর পাশের চেয়ারে বসে বলল, ‘জানি না দোস্ত, মাথাটা হঠাৎ ঘুরায় উঠল। মুখে বিশ্রী একটা স্বাদ।’

আকাশের ফোন ডেকে উঠল আচমকা। নাচতে নাচতে ফোনটা কানে ঠেকিয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘হ্যালো।’ গানের আওয়াজ এতই প্রকট যে ওর গগনবিদারী চিৎকারটাও ফিকে মনে হলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার চেঁচিয়ে উঠল সে, ‘হ্যাঁ তারা! বলো কী খবর?’

গাইতে গাইতে হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেলল রুদ্র। গানের কথা ভুলে গেলো। স্মরণে এল আজ সকালে মেয়েটা তাকে অগ্রাহ্য করেছিল। ঐ অবজ্ঞাটুকু যে অনিচ্ছাকৃত ছিল না রুদ্র তা জানে। কিন্তু কেন? কেন হঠাৎ এই অদ্ভুত আচরণ? আকাশ ফোন হাতে নিয়ে একটু দূরে সরে যায়। ওর পেছন পেছন দূরে সরে যায় রুদ্রর অভিনিবেশ। ফুর্তিবাজ বুকের খাঁজে সম্পূর্ণ অন্য রকম একটা মন এসে ভর করে হঠাৎ। কটা চোখের মণিতে টলটল করে বিষণ্ণতা। মনে হয় ছোট্ট ওই বদ্ধ ঘরে একলা বসে বোকা মেয়েটা কী করছে এই মুহূর্তে? ওর কথা ভাবতে গিয়ে রুদ্ররও কেন এই ভরা মজলিশে হঠাৎ নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছে? একাকিত্বর রোগটা কি ছোঁয়াচে? তারার কাছ থেকে উড়ে এসে সেই রোগ রুদ্রর শরীরেও বাসা বাঁধল নাকি অবশেষে?

‘থামলি কেন?’ হৃদির আগুন গরম প্রশ্ন। একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল রুদ্র। কিছু বলতে পারল না। পাশের বাড়ির ছাদের ছেলে-মেয়েরা এই আকস্মিক নিস্তব্ধতাকে হেরে যাওয়া ভেবে উল্লাসে মেতে উঠেছে। বিভা খুব রেগে গেল, ‘রুদ্রর বাচ্চা! তুই চুপ করে গেলি কেন? ওরা তো জিতে গেল!’

অমৃতা আকাশকে ডেকে বলল, ‘অ্যাই আকাশ! তারার সাথে আমাকে একটু কথা বলিয়ে দিস তো!’ আকাশ হেঁটে এসে ফোনটা অমৃতার দিকে এগিয়ে দিল। অমৃতা ফোন কানে নিয়ে বলল, ‘হ্যালো তারা! কেমন আছ আপু?’

‘এইতো ভালোই। আজ সন্ধ্যায় আকাশ ভাইয়ার কাছে একজন এসেছিল প্রিন্টার নিয়ে। উনি নাকি ভাইয়ার প্রিন্টার ধার নিয়েছিল কদিনের জন্য। তো এই খবরটা জানানোর জন্যই ফোন দিলাম।’

অমৃতার কানে কথাগুলো কৈফিয়তের মতো শোনালো। অথচ সে তো মেয়েটির কাছে কোনো কৈফিয়ত চায়নি। চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। সে তার ভাইকে যেকোনো সময় ফোন করবে, এতে অমৃতার কী এসে যায়? একটু সময় নীরবতা পালন করে অমৃতা বলল, ‘তোমার খালা কেমন আছেন তারা? ডমেস্টিক ভায়োলেন্স হচ্ছে নাতো আর?’

‘না আপু। বিগত কিছুদিন ধরে খালুর মাথা মোটামুটি ঠান্ডা।’

‘হুম… দ্যাটস অ্যা গুড নিউজ! মানবাধিকার সংস্থা থেকে তোমার খালুকে এর মাঝেই দুইবার সামন দেয়া হয়েছে। উনি একবারও দেখা করেননি। এরপরের সামন অমান্য করলে কেস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তোমার কি মনে হয় উনি শুধরে গেছেন? আমি কি মানবাধিকার সংস্থার কমপ্লেইনটা তুলে নেব?’

তারা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার মনে হয় কমপ্লেইনটা তুলে নিলেই ভালো হয় আপু। খালাও চাইছেন না পারিবারিক বিষয় নিয়ে কোর্ট-কাচারি হোক।’

‘তোমার খালু যদি আবারও খালার গায়ে হাত তোলেন, মারধর করেন, তাহলে কিন্তু কেস হবে। আমি চাই কেসটা হোক।’

তারা চিন্তিত গলায় বলল, ‘আমি তাহলে খালাকে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখি।’

‘হুম… সেটাই ভালো হবে। জানিও আমাকে, কেমন?’

‘জি আপু।’

‘একটু দ্রুত জানাতে হবে।

‘জি আপু।’

‘ভালো থেকো।’

‘আপু আপনি কেমন আছেন?’ অমৃতার মনে হলো তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে কথোপকথন প্রলম্বিত করছে।

‘আমি ভালোই আছি।’

তারা একটু ইতস্তত করে বলে, ‘বাকিরা সবাই কেমন আছে?’

এই প্রশ্ন শুনে অমৃতার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন চোখের দৃষ্টি কী কারণে যেন রুদ্রর ওপরে গিয়ে পড়ল। ওদিকে বাকি চার বন্ধু নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল ছিল। রুদ্রর মন ছিল না সেই গল্পে… মন ছিল না গিটারের তারে… মন কোথায় ছিল সে জানে না আদতে…তবে চোখদুটি কোনো এক বিচিত্র কারণে আশ্রয় নিয়েছিল অমৃতার মুখের ভাঁজে। চোখে চোখ পড়ে যেতেই সে অপ্রস্তুত হলো সামান্য। মুখ ঝুঁকিয়ে নিল গিটারের ওপর। অমৃতা হেসে তারাকে বলল, ‘বাকিরা সবাই ভালো আছে।’

তারার কণ্ঠস্বর একটু ম্লান শোনালো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। রাখি তাহলে আপু।’

‘রুদ্র গান গাইছে। তুমি কি রুদ্রর গান শুনবে তারা?’ সাবধানে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল অমৃতা।

ওপাশে নীরবতা। কোনো কথা নেই। অমৃতা জানে না… কেউ জানে না… ঐ নাম শোনামাত্র তারার বুকটা কী অসম্ভব এক কম্পনে কম্পিত হয়ে উঠেছিল! রুদ্র মুখ তুলে দেখল একবার অমৃতাকে। তারপর ধীর গলায় বলল, ‘একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত ধরি, কেমন?

‘কীরে তোর কথা শেষ হয় নাই? আমার ফোন দে।’ অধৈর্য হয়ে উঠল আকাশ।

‘এত পাগল হইছিস ক্যান? তোর ফোন খেয়ে ফেলব না আমি। চিল!’ আপত্তি জানালো অমৃতা।

রুদ্র তখন গান ধরেছে খালি গলায়,

‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাস টুকুর মতো!’

ঝিরঝিরে বাতাসে ওর আউল-বাউল বাবরি চুল উড়ছিল এলোমেলো। নীল জোছনা ছুঁয়ে আছে মুখ। পাশের বাড়ির ছেলে-মেয়েগুলো হৈচৈ করে রুদ্রকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল না এবার। বরং চুপ করে শুনতে লাগল ঐ ভরাট কণ্ঠের মন কেমন করা গানটা। বন্ধুরাও চুপ। অমৃতার হাতে ধরা ফোনের অপর প্রান্তের মেয়েটি বারান্দার রেলিঙের ধারে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বুকের জমিনে প্রবল ভূমিকম্প! একটা ভীষণ অলীক আনন্দ এই মুহূর্তে তার রক্ত কণিকায় ঝড়ের মতো বয়ে চলেছে। সে বুঝতে পারছে রুদ্র গানটা গাইছে একজন অন্ধকার মুখের মেয়ের মাঝে আলো ছড়াবার জন্য। রোজ রাতে সেই মেয়েটি অন্ধকার মুখে, এক আকাশ মন খারাপ নিয়ে, চুপটি করে বদ্ধ ঘরের কোণে গুটিসুটি হয়ে পড়ে থাকে। এই ঘটনা অন্য কেউ না জানলেও রুদ্র অন্তত জানে! তারা যে রুদ্রর জন্য বিশেষ কেউ, এমনটা তো নয়! রুদ্র মানুষের মুখে হাসির আলো বিকিরণ করে। এটা তার পছন্দের কাজগুলোর একটি। এই সত্যতা সম্যক রূপে জানার পরেও তারার মনে হলো আজকের গানের মধ্যে অন্যরকম একটা রেশ আছে। সেই অন্যরকমটা যে আসলে কী রকম তা আর বোঝা যায় না। ধরা ছোঁয়ার বাইরের অনুভূতিটা সমস্ত চেতনার ওপর নেশার মতো লেগে থাকে আলগোছে। অকারণে গা শিরশির করে। গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাততালির রোল পড়ে গেল ফোনের ওপাশে। তারা ফোনের লাইন কেটে দিল চট করে।

আকাশ অমৃতার হাত থেকে নিজের ফোনটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে ত্যাড়া গলায় বলল, ‘মানে কী এসবের?’

অমৃতার কণ্ঠে কপট বিস্ময়, ‘কীসের মানে কী?’

‘ফোন চাইতেছি সেই কখন থেকে, দিস না ক্যান?’

‘দিলাম তো। এইবার খা চিবায় চিবায়।

‘খাব ক্যান? শোন, তুই মানবিধাকার সংস্থার কমপ্লেইনটা তুলে নিতে বলিস।’

‘কেন?’

‘কেন আবার? বুড়া বয়সে লোকটাকে অফিস আদালতে ডেকে অপমান করার কোনো মানে হয় না।’

অমৃতা একটু কঠিন স্বরে বলল, ‘লোকটা তোর বাবা বলেই কি তার অপরাধের বিচার হবে না আকাশ?’

আকাশকে কিঞ্চিৎ বিচলিত দেখাল, ‘আমার বাবা সেটা মেইন বিষয় না। মেইন বিষয় হইল সে গত দুই মাস ধইরা কোন ডমেস্টিক ভায়োলেন্স করে নাই।’

‘গত দুইমাস করে নাই মানে যে ভবিষ্যতে কখনো করবে না, এমন তো না।’

আকাশ কিয়ৎক্ষণ চুপ করে থাকে। ক্ষীণ গলায় বলে, ‘কমপ্লেইনটা বাতিল করিস অমৃতা। যা বলার একবারই বলছি।’

পাশের বাড়ির ছাদ থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

‘ভাইয়া… এইযে গাতক ভাইয়া… একটু কথা বলতে পারি আপনার সাথে?’

বন্ধুরা থমকালো একটু। রুদ্রর বাহুতে একটা চিমটি কেটে হৃদি বলল, ‘গাতক ভাইয়া, তোমাকে ডাকছে!’

রুদ্র একটা বিরক্তিসূচক চুকচুক শব্দ করে উঠে বলল, ‘এত জোরে চিমটি কাটার মানে কী?’

পাশের বাড়ির ছেলেটা রেলিঙের ওপর দিয়ে গলা বাড়িয়ে দিয়েছে। হৃদি ফিসফিস করে রুদ্রকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি যা। মনে হচ্ছে তুই এখুনি না গেলে ছেলেটা রেলিঙ্গের ওপর দিয়ে লাফ দিবে। লাফ দিয়ে এই ছাদে পৌঁছুতে পারবে না। বেচারা পড়ে গিয়ে মরে যাবে।’

রুদ্র বিরক্তি নিয়ে হাতের গিটারটা চেয়ারের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখল। তারপর এগিয়ে গেল রেলিঙ্গের দিকে। আকাশও গেল ওর পেছন পেছন। ছেলেটা একটু মেয়েলি ঢঙে হাত নেড়ে সুরে সুরে বলল, ‘হ্যালো গাইজ!’

‘হাই!’ বলল আকাশ। রাস্তার ঝাপসা আলোয় ছেলেটার মুখ হালকা ভাবে দেখা যাচ্ছিল। বয়স একুশ থেকে পঁচিশের মধ্যে হবে। লম্বা চওড়া সুঠাম দেহ। মুখের ডৌলটি একটু চারকোণা ধাঁচের। ছেলেটির দলের বাকি ছেলে-মেয়েরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিল।

‘ভাইয়া আমি আরিয়ান। এটা আমার মামার বাসা। বেড়াতে এসেছি ঢাকা থেকে।’ বলল ছেলেটা মেয়েলি ভঙ্গিতে হাত নেড়ে, কিছুটা নেচে নেচে।

রুদ্র আর আকাশ কী বলবে ভেবে পেল না। চুপ করে ভ্যাবলার মতো চেয়ে রইল। পেছনে তখন বাকি বন্ধুরা এসে দাঁড়িয়েছে। আরিয়ান অনভিপ্রেত একটা হাততালি দিয়ে বলে উঠল, ‘আল্লাহ ভাইয়া আপনি কী সুন্দর গান করেন। আমি পুরা ফিদা হয়ে গেছি। আপনার কন্ট্যাক্ট নাম্বারটা একটু দেয়া যাবে? প্লিজ?’

রুদ্র ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলল, ‘কন্ট্যাক্ট নাম্বার?’

‘জি ভাইয়া। প্লিজ নাম্বারটা দিন না!’

রুদ্র লক্ষ্য করল তার বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে আর খুকখুক করে চাপা হাসি হাসছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে বিব্রত গলায় প্রশ্ন করল, ‘হাসিস ক্যান?’

আকাশ রুদ্রকে বলল, ‘আরে ওদের মন চাইছে হাসতেছে। তুই এই ভাইরে ফোন নাম্বারটা দিয়া দে। এত রিকোয়েস্ট করতেছে।’

আরিয়ান আকাশের দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘ভাইয়া আপনার নাম কী?’

আকাশ প্রশ্ন করার ধরনের মাধুর্যে সামান্য অপ্রতিভ হলো। একটা ছেলে এত মধুরভাবে আরেকটি ছেলের নাম জানতে চাইতে পারে আকাশের তা জানা ছিল না। সে মিনমিন করে বলল, ‘আমার নাম আকাশ।’

‘ওয়াও! ভীষণ সুন্দর আপনার নামটা। ভাইয়া আপনার ফোন নাম্বারটাও একটু দিয়েন প্লিজ!’

‘আমার নাম্বার দিয়ে কী করবেন? আমি তো গাতক না।’

আরিয়ান হাত নেড়ে নেচে নেচে বলল, ‘এত সুন্দর চেহারা আপনার। গান গাইতে হবে না। এমনিই আপনার সাথে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগবে!’

পেছনে তখন চাপা হাসির রোল পড়ে গেছে। আকাশ নার্ভাসভাবে বলল, ‘আমার নাম্বার… এই রুদ্র আমার নাম্বারটাও দিয়ে দিস।’

কথাটা বলেই জায়গাটা থেকে কেটে পড়ল আকাশ। রুদ্র আকাশের ফোন নম্বরের একটা ডিজিট পরিবর্তন করে দিল। নিজেরটাও বলল ভুলভাল। আরিয়ান নম্বর পেয়ে বেজায় খুশি। নাচতে নাচতে বলল,

‘থ্যাংক ইউ সো মাচ! ইউ আর সো কিউট! গাতক ভাইয়া আপনার নামটা কী?’

রুদ্র কাঁচুমাচু মুখে বলল ‘কুদ্দুস আলি।’

‘জি ভাইয়া?’

‘আমার নাম কুদ্দুস আলি।’

আরিয়ান একটু অসন্তুষ্ট হলো, ‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ সত্যি। সুন্দর না নামটা?’

‘সুন্দর… বাট আপনার সাথে ঠিক ম্যাচ করে না।’

‘তাহলে বরং তুমিই একটা নাম রেখে দাও আমার। তোমার পছন্দের নাম।’

আরিয়ান খুশিতে আটখানা হয়ে বলল, ‘সত্যিই?’

‘হ্যাঁ সত্যি!’

‘ঠিক আছে আমি আপনার নাম দিলাম…উম্মম্ম… এখন ঠিক মাথায় আসছে না। তবে আমি আজকে রাতের মধ্যেই আপনাকে টেক্সট করে জানাচ্ছি।’

‘ওকে…. সাউন্ডস গ্রেট।’ বলল রুদ্র।

আরিয়ান এবার একটা ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিল, ‘ওকে হ্যান্ডসাম! গুডনাইট।’

ফ্লাইং কিস খেয়ে রুদ্রর মাথা ঘুরে যাবার অবস্থা হল। পড়িমড়ি করে রেলিং-এর কাছ থেকে সরে এল সে। বাকি বন্ধুদের তখন হাসতে হাসতে বেহুঁশ হবার উপক্রম। রুদ্রকে দেখা মাত্র অমৃতা বলে উঠল, ‘কেমন লাগল? প্রেমটা এবার হবে তো?’

ক্ষেপে গেল রুদ্র, ‘ধুর শালী… চুপ থাক!’

‘ফ্লাইং কিসটা কেমন ছিল? রুদ্র রহমান?’ এবার বিভার আক্রমণ।

সামি বলল, ‘জীবনে কখনো ভাবছিলি কোনো মাইয়ার চুমা খাওয়ার আগে পোলার চুমা খাওয়া লাগব? তোর লাইফের ফার্স্ট কিস মামা! তোর তো সেলিব্রেট করা উচিত।’

আকাশকে বোকা বোকা মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অমৃতা বলল, ‘আকাশ! তোর ফোনটা কোথায়? হাতে রাখ। ফোন করে তোকে না পেলে কষ্ট পাবে বেচারা।

হৃদি বলল, ‘হ্যাঁরে… তোর চেহারা দেখে ছেলেরা ক্রাশ খাচ্ছে। তুই একটু রেইনবো টাইপ ছবি তুলে ইন্সটাতে আপলোড দিস। গেগুলা সব পাগল হয়ে যাবে।

বিভা বলল, ‘দ্যাখ আমাদের রুদ্র আর আকাশের গার্লফ্রেন্ড তো কখনো হয় নাই, তবে এইবার বয়ফ্রেন্ড হওয়ার চান্স আছে। এই উপলক্ষ্যে ট্রিট চাই।’

এসব অনর্থক হাসিঠাট্টায় আরো অনেকখানি সময় কেটে গেল। অমৃতার বাধো বাধো ভাবটা এখন আর নেই। সামির মুখ থেকেও মেঘ সরে গেছে। তবে ওরা কেউ সরাসরি কথা বলছিল না। চোখে চোখ পড়ে গেলে দ্রুত সরিয়ে নিচ্ছিল চোখ। মাছের ছোট কাঁটার মতো একটুখানি অস্বস্তি বুকের কাছে লেগে ছিল অনুক্ষণ।

ওরা ঠিক করেছিল সারারাত জেগে থাকবে। কিন্তু ক্লান্ত শরীর অতটা ধকল সইতে পারল না। রাত একটার দিকেই যার যার রুমে চলে গেলো। হৃদি বান্ধবীদের ঘরেই ঘুমোতে চেয়েছিল। কিন্তু অমৃতা আর বিভা কিছুতেই রাজি হলো না। বিভা বলল, ‘এই সময় সামির পাশে তোর থাকা উচিত হৃদি। কেন খামোখা রাগ দেখাচ্ছিস?’

২৭

হৃদি প্রতিবাদী সুরে বলে উঠল, ‘রাগ দেখাচ্ছি না বিভা, আমি রেগেই আছি। ও শুধু ওর মাকে নিয়েই থাক। ওর বউ লাগবে না, বাপ লাগবে না, বন্ধুদেরকেও লাগবে না।’

‘এভাবে বলিস না দোস্ত। ওই সময় বেচারার মাথা ঠিক ছিল না। রাগের মাথায় মানুষ কত কিছুই তো করে।’

‘বেশ তো, তখন মাথা ঠিক ছিল না মেনে নিলাম। যখন মাথা ঠিক হবে তখন আমার হাতে পায়ে ধরে মাফ চেয়ে ঐ বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে হবে। নইলে আমি যাব না।’

অমৃতা নিস্তেজভাবে বিভাকে বলল, ‘থাক, ওরে আর জোর করিস না। বিষয়টা ওকে নিজের মতো করে হ্যান্ডেল করতে দে। যেকোনো রিলেশনে মিউচুয়াল রেস্পেক্ট একটা বিগ ইস্যু। সামিকে রেস্পেক্ট করা শিখতে হবে। নিজের বউকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার কাজটা সে ঠিক করে নাই। তাছাড়া হৃদি সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিল।’

বিভা বলল, ‘ঠিক আছে। মেনে নিলাম সবটাই। হৃদিতা শোন, তুই কথা বলিস না সামির সাথে, তবুও আজকের রাতটা ঐ ঘরেই থাক। নইলে রুদ্রর ফ্যামিলি কী ভাববে বল?’

‘কী ভাববে আবার? আমি বেড়াতে এসে বান্ধবীদের সাথে থাকতে পারি না? সব সময় বরের সাথে চিবকায় থাকতে হবে?’ বাক্যটা বলে শেষ করে একটু থামল হৃদি। অভিমানের সুরে বলল, ‘ঠিক আছে। তোরা এত করে বলতেছিস যখন… যাচ্ছি আমি। গুডনাইট।’

সামি দরজা লক করে দিয়েছিল। তিন চারবার টোকা দেয়ার পর খুলল। দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে হৃদিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে কাষ্ঠ গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী চাই?’

মেজাজ খিঁচড়ে গেল হৃদির, ‘মাথা আর মুণ্ডু চাই।’ দাঁত কিড়মিড় করে বলল সে।

‘কোনোটাই নাই আমার কাছে।’ সোজাসাপটা উত্তর সামির ‘ভেতরে ঢুকতে দে।’

‘কেন?’

‘ঘুমাব।’

সামি বঙ্কিম ভ্রুজোড়া কপালে তুলে বলল, ‘আমার সাথে?’

হৃদি গর্জে উঠতে যাচ্ছিল। পাছে বাড়ির লোকে শুনে ফেলে, সেই ভয়ে গলার স্বর এক ধাপ নিচে নামিয়ে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘তোর সাথে ঘুমানোর কোনো শখ নাই আমার। এই ঘরে থাকব। কারণ, আমি চাই না রুদ্রর ফ্যামিলির মানুষ কিছু জানুক।’

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে হৃদিকে পরখ করে সামি। সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলে, ‘তাই?’

‘হ্যাঁ তাই।’

সামি দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। ভেতরে ঢুকল হৃদি। থমথমে মুখে ব্যাগ থেকে সুতির জামা বের করল। শাড়ি পাল্টে নিল বাথরুমে গিয়ে 1 বেরিয়ে এসে দেখল সামি বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। হৃদি বাথরুমে জ্বলতে থাকা বাল্বের আলোয় সেলফোনে চার্জার লাগাল। পানি খেল এক গ্লাস। তারপর বাথরুমের লাইট অফ করে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ল বিছানায়। মাথার ওপর ফ্যান চলছে। খোলা জানালা গেলে মেঝেতে এসে পড়েছে নীল জোছনার শতরঞ্জি। সেই সাথে একটু একটু উষ্ণ বাতাস। খোলা বাতাসেও গরম কমে না আজকাল। হাঁসফাঁস লাগে। সামির এয়ারকন্ডিশন ছাড়া ঘুম হয় না। সে এপাশ-ওপাশ করে যাচ্ছিল ক্রমাগত। হৃদি বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, ‘এত নড়িস না। ঘুমাইতে দে।’

সামি চুপ করে রইল। আচ্ছা হৃদি কি বদলে গেছে? ভালোবাসা কি বিয়ের কয়েক মাসের মাথায়ই লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেছে অন্য কোন গ্রহে? এত কাছে থেকেও হৃদির কি একটাবার ইচ্ছে হচ্ছে না সামিকে জড়িয়ে ধরতে? ভালোবাসতে? ঠিক একই কথা ভাবছিল হৃদিও। তার মনে হচ্ছিল সামি আর আগের মতো নেই। এতদিন পরে, এত কাছাকাছি এসেও এমন দুর্মর শীতলতা কী করে আসে ওর মধ্যে? ও কি আর ভালোবাসে না হৃদিকে? চোখের কার্নিশ উপচে এক ফোঁটা অশ্রুজল ছিটকে পড়ল বালিশের ওপর। নিঃশ্বাস ভারী হলো। হৃদি উঠে বসল শোয়া থেকে। বসেই রইল অনেকক্ষণ। সামি চোখ চেয়ে দেখল শুধু। কিছু বলল না। এই নিরুত্তাপ, দ্বেষহীন, ঈর্ষাবিহীন আচরণ হৃদির কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিল।

জানালার ওপারে জোনাকির সবুজ ডানা তারার মতো মিটমিট করে জ্বলছে। রাত বয়ে চলেছে দিনের ঠিকানায়, রোজকার আমোঘ নিয়মে। ওরা দুজন চুপচাপ বসে থেকে নিজেদের মধ্যকার বিষণ্ণ বিচ্ছিন্নতাকে অনুভব করছে।

হৃদি উঠে পড়ল আচমকা। পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বান্ধবীদের ঘরের দরজা ধাক্কাতে লাগল পাগলের মতো। বিভা আর অমৃতা চমকে উঠেছিল। দরজা খুলতেই শিকারীর তাড়া খাওয়া ভীত হরিণীর মতো ছটফটিয়ে ভেতরে ঢুকল হৃদি। আর্তনাদ করে বলল, ‘ও আমাকে আর ভালোবাসে না রে!’

অমৃতা আর বিভা অন্ধকারে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে হৃদির দিকে। ওদের মুখে কোনো কথা নেই। একটা সময় অমৃতা বলে ওঠে, ‘তুই ভুল বলতেছিস হৃদি। সামি তোকে ভীষণ ভালোবাসে।’

‘তুই কী করে বুঝলি?’ হৃদির প্রশ্ন।

অমৃতা জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়ায়। অলীক জোছনায় ওর মুখখানি হঠাৎ খুব রহস্যময় দেখায়। রহস্যময় হেসে বলে, ‘মানুষের চোখ দেখে আমি কিছু জিনিস বুঝতে পারি। তুই যদি ওর দিকে ঠিকমতো তাকিয়ে দেখতি একবার। তাহলে হয়ত তুইও বুঝতে পারতি।’ বিভা হৃদির কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভগবান সব ঠিক করে দেবেন।’

অমৃতা তখনো জানালার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখে দূরগত দৃষ্টি। মুখের ভাঁজে বিষণ্ণতার ঘেরাটোপ। কেমন দুঃখী মানুষের মতো দেখায় ওকে। বিমর্ষ, ভগ্নহৃদয় এই অমৃতাকে সহ্য হয় না বিভার। কষ্টে বুক মুচড়ে ওঠে। পাশে দাঁড়িয়ে ভারি নরম গলায় প্রশ্ন করে, ‘কী ভাবতেছিস দোস্ত?’

অমৃতা হাসার চেষ্টা করে, ‘তেমন কিছু না।’

‘উনাকে অনেক মিস করিস, তাই না?’

ভীষণ চমকে গেল অমৃতা। বিদ্যুৎ চিলিক দিয়ে গেল শিরদাঁড়ায়। রুদ্ধশ্বাসে বড় বড় চোখ মেলে তাকাল বিভার দিকে। দুর্ঘটনার পর এই প্রথমবারের মতো কেউ সেই মানুষটার নাম নিল তার সামনে। যেন প্রথমবারের মতো কেউ স্বীকার করে নিল যে অমৃতাও আর দশটা রক্ত মাংসের মানুষের মতোই, জীয়ন্ত হৃদয় সম্পন্ন একজন মানুষ। তারও কষ্ট হয়, দুঃখ হয়, তার মনটাও সর্ব সাধারণের মতো বিরহব্যথায় কাতর হয়। তারও আছে ভালোবাসার অধিকার। ভালোবাসার মানুষকে কাছে চাইবার অধিকার। বিভার প্রশ্নটা যেন অমৃতার মনুষ্য সত্তাকে নতুন করে স্বীকৃতি দিল। ফিরিয়ে দিল অনেক খানি আত্মসম্মান। নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতায়, ভালোবাসায় আর মায়ায় তার বুকটা টলমল করে উঠল। কয়েক নিমেষ করুণ চোখে চেয়ে থেকে সে বিভাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। কেন জানে না, এই মুহূর্তে বিভাকে জড়িয়ে ধরতে তার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল! বিভা ওর মাথায় একটা হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল, ‘আমি বুঝি দোস্ত… আমি বুঝি!

একটা বক্ষচেরা কাঁপা কাঁপা শ্বাস পড়ে অমৃতার। বুকের ভেতর চেপে থাকা যন্ত্রণা যেন হঠাৎ মুক্তির পথ খুঁজে পায়। বিভাকে তার মায়ের মতো পবিত্র মনে হয়!

‘কথা বলবি?’ এবারের প্রশ্নটা অমৃতাকে কাঁপিয়ে দিল।

‘যা!’

হৃদি এগিয়ে এসে বলল, ‘ওর মাথাটা শুধু শুধু খারাপ করিস নাতো বিভা। ভালো আছে ভালো থাকতে দে।’

বিভা চোখা দৃষ্টিতে তাকায় হৃদির দিকে, চোখা গলায় বলে, ‘এটাকে তুই ভালো থাকা বলিস?’

হৃদির তাকানোর ভঙ্গিটা স্বাভাবিক নয়। অন্ধকারেও ওর মুখের উগ্র ভাবটা টের পাওয়া যায়। কেটে কেটে বলল, ‘বেঁচে আছে এটাই অনেক বেশি। তুই তো দেখিস নাই সামি ওকে মেরে লাশ বানায় দিছিল।’

‘তোমার বর তোমার বন্ধুকে মেরে লাশ বানায় দিছিল এটা খুব একটা গর্বের বিষয় না হৃদিতা!’

‘আমি তো বলি নাই গর্বের বিষয়। জাস্ট বলতেছি অমৃতা যেমন আছে, তেমনই থাকতে দে। ঝামেলা বাড়াইস না।’

বিভা হৃদির কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বিছানার ওপর রাখা সেলফোনটা তুলে নিল। অমৃতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘নে। ফোন কর।’

শিউরে উঠল অমৃতা। কয়েক পা সরে এসে বিছানার ওপর অসহায়

ভাবে ধপ করে বসে পড়ে বলল, ‘না। থাক!’

বিভা ওর পাশে এসে বসল। ফোনটা জোর করে পাঁচ আঙুলের ভেতর গুঁজে দিতে দিতে বলল, ‘ফোন কর। কথা বলতে না চাইলে বলিস না। ভয়েস শুনলেও ভালো লাগবে তোর।’

‘এখন অনেক রাত। উনি নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছেন।’ অমৃতা বলল ভীষণ দুর্বল গলায়।

‘আচ্ছা তুই ট্রাই করে দ্যাখ। ঘুমিয়ে পড়লে তো ফোন রিসিভ করবে না। প্যারা নাই।’

অমৃতা স্খলিত হাতে ফোন ধরল। উত্তেজনায় কাঁপছে ভেতরটা। দাঁতে দাঁত লেগে খিল ধরার উপক্রম। ওর আঙুল এত বেশি দোদুল্যমান যে ঠিকঠাক ডায়াল নম্বর প্রেস করা যাচ্ছে না। ভুল হয়ে যাচ্ছে বারবার। বিভা ফোনটা ছিনিয়ে নিল নিজের কাছে।

‘নাম্বার বল।’ হুকুম দিল।

অমৃতা এক নিঃশ্বাসে ফোন নম্বরটা বলল। বিভা ডায়াল করে ফোনটা ফিরিয়ে দিল অমৃতার কাছে। সরে এল জায়গাটা থেকে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হৃদির পাশে গিয়ে ছায়ার মতো স্থির হল। ফোনের রিং পড়ছিল স্পষ্টভাবে। গভীর রাতের পিনপতন নৈঃশব্দতায় ফোনের শব্দটাকে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বলে মনে হচ্ছে। রিং পড়ছে… পড়ছে… পড়েই যাচ্ছে। অস্থির অমৃতা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ফোন কানে নিয়ে উন্মাদের মতো পায়চারি করতে লাগল ঘরের ভেতর। হঠাৎ খুট করে শব্দ হলো ফোনের অপর প্রান্তে। একটা ধাক্কা এসে লাগল অমৃতার বুকে। স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।

‘হ্যালো!’

অমৃতা শ্বাস নিতে ভুলে গেল। একটা আশ্চর্য শিহরনে কাঁটা দিয়ে উঠল শরীর। অসাধারণ ভরাট এবং সুন্দর কণ্ঠে আরেকবার বেজে উঠল শব্দটা, ‘হ্যালো…!’

টপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল অমৃতার চোখ থেকে। অনেকক্ষণ যাবত আটকে রাখা দমটা নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এল শ্বাসনালী দিয়ে। লাইন কেটে দিল অমৃতা।

২৮

মন্ত্রীর কন্যার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হচ্ছে কুয়াকাটার এক ডাক বাংলোতে। ভারী বর্ণোজ্জ্বল, জাঁকালো আয়োজন। বাংলোতে অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। সামনের খোলা চত্বরে সাজানো হয়েছে কনের মঞ্চ। দেশের নামকরা গায়ক গায়িকারা সংগীত পরিবেশন করছেন। ভারত থেকে এসেছেন কয়েকজন প্রসিদ্ধ নৃত্যশিল্পী। মন্ত্রীর নিমন্ত্রণে রাশেদ সস্ত্রীক এসেছেন কুয়াকাটা। রোমেলা দেশের রাঘববোয়ালদের আড়ম্বরপূর্ণ, জাঁকজমক আচার-অনুষ্ঠান সচরাচর মিস করেন না। সঙ্গে বোন এবং বোনের মেয়েকেও নিয়ে এসেছেন তিনি। এমন হাই প্রোফাইল প্রোগ্রামগুলোতে সুযোগ পেলেই নিজের আত্মীয়স্বজনদেরকে জুড়ে দেয়ায় আলাদা তৃপ্তি আছে। তার সুবাদে আত্মীয়দের দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয়। এইসব সুযোগসন্ধানী আত্মীয়রা রোমেলাকে তোষামোদ এবং সমীহ করে চলে। এই তোষামদ মন প্রাণ ভরে উপভোগ করেন তিনি। আজকে বোনের মেয়ে এসেছে ভারত থেকে আগত বিখ্যাত নৃত্যশিল্পীর সাথে সাক্ষাৎ করার বাসনা নিয়ে। বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রিয় বিদেশি সেলিব্রিটিকে দেখতে পাবে, তাও এত কাছ থেকে, এই ঘটনা তার কাছে স্বপ্নের মতো। মন্ত্রী সাহেবের এই মেয়েটি বাংলাদেশের মডেলিং জগতে বেশ প্রসিদ্ধ। তার বন্ধু বান্ধবীরা সব নামকরা মানুষজন। ভিড়ের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ ঝিলিক মেরে উঠছে নাট্যজগতের তারকাদের সুন্দর মুখশ্রী।

নাচ গানের আসর সারা রাত ধরে চলবে। অতিথিরা চত্বরের শামিয়ানার নিচে বসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করছে। ডাক বাংলোর দোতলার বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেছেন স্বয়ং মন্ত্রী সাহেব, মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ দেশের উঁচুতলার বেশ কজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। মাঝখানে একটি সেগুন কাঠের তেপায়া টেবিলের ওপর স্কচের বোতল রাখা। সাথে কিছু মুখরোচক স্ন্যাক্স। একজন সহকারী কর্মী অতিথিদের গ্লাসে পানীয় ঢেলে দিচ্ছে। মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে অনেক বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছেন উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ। মনে হয় যেন সকলের বুকেই দেশপ্রেম উথলে উঠছে। রাশেদ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন। কথা বলছিলেন কম। এদের অনেকের কৃতকর্ম সম্পর্কেই তিনি সম্যক রূপে জ্ঞাত। পত্রিকাতেও বিস্তারিত এসেছে তাদের দুর্নীতি উপাখ্যান। দেশের রাজনীতি চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। পেশাগত রাজনীতিবিদ, যারা সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক আদর্শ বুকে নিয়ে চলে, তেমন নেতাকর্মীর দেখা পাওয়া ইদানীং দুষ্কর। কিছু পেশাদার রাজনীতিবিদ এখনো আছেন যারা অর্থবিত্তের লোভে ব্যবসায়ী বা ব্যবসায়ীদের সহযোগীতে পরিণত হয়েছেন। রাশেদের মতো সুশীল, শিক্ষিত, আদর্শবান ধনী ব্যক্তি বর্তমানে দেশে খুব কমই আছে। তাই জলে নামলেও স্রোতে ভেসে যেতে তিনি সক্ষম হননি এখনো। অনেকেই রাশেদকে মনে মনে প্রতিপক্ষ হিসেবে ধরে নিয়েছে। তিনি কাউকে তোষামোদ করে চলেন না, যত্রতত্র রাজনৈতিক করাপশনের বিরুদ্ধে কথা বলেন, সামর্থ্যবিহীন জনপ্রিয় প্রতিভাবান তরুণ নেতাকর্মীদের সহযোগীতা করেন, নিজস্ব নীতির বাইরে গিয়ে কাজ করেন না, প্রভাবশালী ধনী হবার পরেও ঋণখেলাপির খাতায় এখন অবধি তার নাম ওঠেনি… এসব নানা কারণ, সহযোদ্ধাদের মনে ঈর্ষার বীজ বপন করে তুলছে। দিনে দিনে শত্রুসংখ্যা বাড়ছে। এই সভায় উপস্থিত আছেন এমন একজন সংসদ সদস্যর সাথে সম্প্রতি একটি বিষয় নিয়ে রাশেদের মতবিরোধ এবং নীরব সংঘর্ষ দেখা দিয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত হয় রাশেদের এক দূর-সম্পর্কের আত্মীয়র অভিযোগের মাধ্যমে। উল্লিখিত আত্মীয় সংসদ সদস্য ‘ক’ সাহেবের এলাকার বাসিন্দা। কদিন আগে তার বাড়িতে গভীর রাতে ডাকাতি হয়। সে পুলিশের কাছে দাবি করে সন্ত্রাসীরা এলাকার পরিচিত মুখ। পুলিশ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে অস্বীকার করে। জানা যায় স্থানীয় নেতাকর্মী এবং সংসদ সদস্যের আদেশক্রমেই পুলিশ মামলা নেয়নি। সেই আত্মীয় রাশেদকে ব্যাপারটা জানানোর পর তিনি নিজ উদ্যোগে ক সাহেবের সাথে যোগাযোগ করেছেন। ক সাহেব রাশেদকে বলেছেন, ‘আপনি রাজনীতির লোক। বোঝেনই তো মিটিং মিছিল করার জন্য আমাদের কত গুণ্ডাপাণ্ডা পালতে হয়। ছেলেগুলোকে জেলে ঢুকালে আমার কাজের ক্ষতি হবে। আমি বরং আপনার আত্মীয়র বিষয়টা দেখছি। যেকোনোভাবে তাদেরকে কম্পেন্সেট করে দেব। রাশেদ সরাসরি বলেছিলেন, আমার আত্মীয়র বিষয় না হয় আপনি দেখলেন কিন্তু যেসব সাধারণ এলাকাবাসী আমার আত্মীয় নন তাদের কী হবে? আপনার এসব গুণ্ডারা নানাভাবে এলাকাবাসীদের উত্যক্ত করে আসছে। দেখুন, মিছিল মিটিং-এর জন্য ছাত্রদের কনভিন্স করুন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করুন। প্রয়োজনে ওদের পড়াশোনার খরচ দিন। ফ্যামিলির বাজার করে দিন। কিন্তু এসব ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটিসে সহায়তা করবেন না। এদের হাতেই দেশের ভবিষ্যৎ। আপনি এসব সন্ত্রাস বন্ধ করুন। নইলে আমি আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।’

সেদিনের পর থেকেই উড়ো টেলিফোন আসে। অচেনা কণ্ঠস্বর জান নিয়ে ফেলার হুমকি দেয়। আত্মীয়র কাছ থেকে খবর পাওয়া গেছে স্থানীয় থানা এখনো সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা নেয়নি। রাশেদ খুব দ্রুত আইনের শরণাপন্ন হবেন বলে মনস্থির করেছেন। সামিকে নিয়েই যত দুশ্চিন্তা। আগে ছেলের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতেন তিনি। কখন কোথায় যাচ্ছে সমস্ত খুঁটিনাটি ছিল নখদর্পণে। সেই দুর্ঘটনার পর থেকে পুত্রের পেছনে কোনো গুপ্তচর নিয়োগ করেননি। ধারণা হয়েছিল পুত্র এখন সাবলম্বী I পিতার পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই টিকে থাকতে পারবে। কিন্তু দিনকাল আরো বেশি খারাপ হচ্ছে ধীরেধীরে। তার নিজের কাজের ক্ষেত্রটা নিরাপদ নয়। শুধুমাত্র নিরাপত্তার জন্য তিনি নিজস্ব আদর্শ বিসর্জন দেবেন না। থানায় জিডি করা হয়েছে। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য একজন বডিগার্ড নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবছেন তিনি। এখন সামি বিষয়টা বুঝতে পারলেই হয়।

ফোনটা এল সেই সময়, যে সময় নানামুখী কণ্টকাকীর্ণ দুশ্চিন্তা তাকে ভরা মজলিশেও নিঃশব্দে সূচের মতো বিদ্ধ করে যাচ্ছিল। নম্বরটা তার চেনা। Sami’s friend Bibha নামে সেভ করা আছে ফোনলিস্টে। রাশেদ কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে কিছুক্ষণ নম্বরটার দিকে চেয়ে রইলেন। মেয়েটা তাকে ফোন দিচ্ছে কেন? এত রাতে? সামি ঠিক আছে তো? রোমেলার কাছে শুনেছিলেন ছেলে আজ কলিগের গ্রামের বাড়িতে রাত্রি যাপন করবে। সেখানে কোন দুর্ঘটনা ঘটল কি না কে জানে! দুশ্চিন্তায় মনটা কাঁটা দিয়ে উঠল। তিনি উঠে পড়লেন চেয়ার ছেড়ে। বাংলোর ভেতরটা এখন ফাঁকা। লোকজন সব বাইরের খোলা চত্বরে জড়ো হয়েছে। কয়েকটা ঘর ঘুমন্ত শিশুদের দখলে। রাশেদ দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলেন পেছন দিকের উঠোনে। এখান থেকে সাগর সৈকত কাছে। চারপাশ নীরব থাকলে সমুদ্রের গর্জন স্পষ্টভাবে কানে লাগার কথা। এই মুহূর্তে গান-বাজনার উচ্চশব্দ সাগরের ডাক মুছে দিয়েছে। তিনি গানের আওয়াজ থেকে বাঁচার জন্য উঠোন পেরিয়ে ঘন গাছগাছালি সন্নিবিষ্ট জঙ্গলের মাঝে এসে দাঁড়ালেন। আকাশে গোল চাঁদ জেগে আছে। নারকেল গাছের চিরল বিরল পাতায় নেচে বেড়াচ্ছে জোছনা। গানের শব্দ ঝাপসা হয়ে আসার পর তিনি ফোনটা রিসিভ করলেন।

‘হ্যালো!’

ওপাশে কোনো শব্দ নেই। গহন নৈঃশব্দ্য! তিনি আরেকবার স্পষ্ট গলায় ‘হ্যালো’ বললেন। একটা শ্বাস পড়ল ফোনের অপরপ্রান্তে। রাশেদ থমকে গেলেন। তার মনে হলো ঐ শ্বাসযন্ত্রের অধিকারিণী তার জনম জনমের চেনা! পরমুহূর্তেই ফোনের লাইনটা কেটে গেল। রাশেদ স্থিরচিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন নারকেল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে। মধ্যরাতের সাগর থেকে লোনাজল ছোঁয়া আঁশটে বাতাসের ঝাপটা ভেসে আসছে। গাছের পাতায় শব্দ হচ্ছে শনশন। রূপালি জোছনায় ভেসে যাচ্ছে জল-স্থল- অন্তরীক্ষ। প্রকৃতির রহস্যময় অতীন্দ্রিয় মায়াজালের মধ্যে আকণ্ঠমগ্ন হয়ে রাশেদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কী করে যেন ফোনের অপরপ্রান্তের মেয়েটিকে ঠিক ঠিক চিনে ফেলল। ছোট্ট ঘটনাটা তার ক্রিয়াশীল, কর্মব্যস্ত, বিষয়ী মস্তিষ্কে ক্ষণিকের জন্য একটা শূন্যতার বলয় তৈরি করল। কয়েক সেকেন্ড তিনি কিছু ভাবতে পারলেন না। বুদ্ধিভ্রষ্ট বোকা মানুষের মতো থমকে রইলেন। ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠল শ্বাস-প্রশ্বাসের অস্বাভাবিকতা। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল কপালে। চোখ জ্বালা করতে লাগল। মন কিছুতেই যুক্তিশীল আচরণ করতে চাইছে না। এমন চন্দ্ৰাহত মায়াবী জোছনাই কি মানুষকে সীমালঙ্ঘনকারী বানায়? অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়? নীতিবোধের চৌকাঠ ডিঙোতে বাধ্য করে? কে জানে!

রাশেদ নম্বরটাতে ডায়াল করলেন। রিং পড়তে লাগল।

রিংটোন বেজে উঠতেই তিন বান্ধবীকে চকিত বিস্ময় ধাক্কা দিয়ে গেল। হৃদি ভীত শঙ্কিত কণ্ঠে বলল, ‘আল্লাহ! ফোন দিতেছে বাবা! কেটে দে। লাইন কেটে দে!’

অমৃতার হাত কাঁপছে। বিস্ফারিত নয়নে চেয়ে আছে সে ফোনের স্ক্রিনের দিকে। বিভা ওর পিঠের ওপর একটা হাত রাখল। হাত রেখেই বুঝল মেয়েটার হৃৎপিণ্ডে ঘোড় দৌড় চলছে। সে স্তিমিত স্বরে বলল, ‘তুই বরং ফোনটা রিসিভ কর। একটু কথা বললে কিছু হবে না। বরং মনটা ভালো লাগবে।’

হৃদি বিভার হাত খামচে ধরল। চাপা হিসহিসে গলায় বলল, ‘তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’

‘চুপ থাক!’ ধমকে উঠল বিভা

অমৃতা ফোন হাতে নিয়ে জানালার কাছে সরে এলো। কাঁপা কাঁপা আঙুলে প্রেস করল অ্যানসার বাটন।

‘হ্যালো!’ শব্দটা ভেসে এল ওপাশ থেকে।

অমৃতা জং ধরা কণ্ঠ সচল করল অনেক কষ্টে, ‘হ্যালো!’

আকাশ থেকে অদ্ভুত এক সুগন্ধি নীরবতা নেমে এল ক্ষণকালের জন্য। মিথ্যে হয়ে গেল পৃথিবীর যাবতীয় কলোরব। কোথাও নেই নেই। আছে শুধু দুই হৃদয়ের অবিরত স্পন্দন!

‘কেমন আছ অমৃতা?’

কান্নার ডেলা বিঁধছিল গলায়। অমৃতা ঢোঁক গিলে কান্নাটাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করল। স্খলিত কণ্ঠে বলল,

‘ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন রাশেদ?’

‘ভালো আছি।’

অমৃতা চুপ করে গেল। তার মাথাটা ভীষণ ফাঁকা! ভয়, উত্তেজনা এবং আবেগের প্রাবল্যে চেতনা প্রায় বিলুপ্ত।

‘অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘুমোওনি এখনো?’

‘ঘুম… না ঘুমাইনি। আমরা রুদ্রর বাসায় এসেছি।’

‘সামি কি তোমাদের সাথে?’

‘জি।’

আবারও নীরবতা। এলোমেলো শ্বাস-প্রশ্বাস। হৃৎপিণ্ডের উচ্ছৃঙ্খল, অবাধ্য স্পন্দন!

‘অমৃতা!’

ডাকটা বুকের গভীরে নাড়া দিয়ে যায়। মনে হয় এত সুন্দর করে কেউ কোনোদিন এর আগে ওর নাম ধরে ডাকেনি। বুক মুচড়ে ওঠে এক আশ্চর্য কষ্ট কষ্ট সুখে!

‘জি বলুন।’

‘সামির সাথে তোমার প্যাচ-আপ হয়েছে?’

‘হয়নি এখনো।’

‘হবার সম্ভাবনা আছে?’

‘ফিফটি ফিফটি চান্স।’

‘ওর সাথে কথা হলে বলবে সবকিছু আগের মতোই আছে। তোমার আমার মধ্যে কখনই কিছু ছিল না। ও যেন কথাটা বিশ্বাস করে। কেমন?’

অমৃতা কান্নার জন্য কথা বলতে পারল না। ছোট করে উচ্চারণ করল একটা শব্দ, ‘হুম।’

‘তুমি ওকে ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারবে তো?’

‘হ্যাঁ পারব। দুশ্চিন্তা করবেন না।’

‘গুড!’

‘আপনি ভালো থাকবেন। এত রাতে ফোন করে ডিস্টার্ব করার জন্য সরি।’

লাইনটা কেটে গেল। হুহু করা ফাঁকা অন্তর নিয়ে আরো অনেকক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে রইলেন রাশেদ রূপালি জোছনার অলীক মায়ার বিস্তারে। বুকে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। একটাই জীবন মানুষের! এই একমাত্র আরাধ্য জীবন নিজের ইচ্ছেমতো কাটানো যায় না কেন?

২৯

সকালবেলা চোখ মেলেই মাথার ওপর মোচড়ানো কাগজটা আবিষ্কার করল সামি। লেখা আছে, ‘আমার গার্লফ্রেন্ডকে ছেড়ে দে। নইলে ঘাড় মটকে দেব।’

রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল। কাগজটা হাতে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। আলুথালু মাথার চুল। চোখে আগুন। এলোমেলো কুঁচকানো টিশার্টের নিচে ট্রাউজারের দড়ি ঝুলছে ঢ্যালঢ্যাল করে। দেখলে মনে হয় বদ্ধ উন্মাদ। ড্রয়িংরুমে হৃদি, রুদ্র আর আকাশ বসেছিল। বাকি দুজন তখনো ঘুমোচ্ছে। সামি পাগলা ষাঁড়ের মতো দৌড়ে এসে হৃদির সামনে কাগজটা ধরে খ্যাকখ্যাক করে বলল, ‘সকাল সকাল ফাইজলামি শুরু করছিস? সমস্যা কী তোর?

হৃদি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, ‘আমি আবার কী করলাম?’

‘এসব কী?’ হাতের কাগজটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সিংহের মতো গর্জে উঠল সামি। রুদ্র আর আকাশ দৌড়ে এসে সামিকে নিরস্ত করার চেষ্টা করল। রুদ্র কাগজটা হাতে নিয়ে বলল, ‘হালু কাকা তো ভালোই বিরক্ত করা শুরু করছে! একটা ব্যবস্থা করতে হবে দাঁড়া।’

সামি বলল, ‘আমাকে বোকা পাইছিস তোরা? এটা তোদেরই কারসাজি।’

আকাশ জিব কেটে বলল, ‘না দোস্ত, বিশ্বাস কর আমরা কেউ কিছু জানি না!’

সামি চোখের আগুনে হৃদিকে ভস্ম করতে করতে বলল, ‘শোন হৃদিতা, আমার সাথে থাকতে ইচ্ছে করলে থাকবি, ইচ্ছা না করলে থাকবি না। তোরে কেউ বেঁধে রাখে নাই। এসব ঢং আমার খুবই বিরক্ত লাগতেছে!’

এত কঠিনভাবে কথাটা না বললেও পারত সামি। হৃদির চোখজোড়া মুহূর্তের মধ্যে রক্তাভ হয়ে উঠল। আয়নার মতো স্বচ্ছ এক বিন্দু জল তিরতির করে কাঁপতে লাগল ডান চোখের কার্নিশ বরাবর। চট করে সরে পড়ল জায়গাটা থেকে। আকাশ সামির দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল, ‘এইভাবে কথা বললি ক্যান ওর সাথে?’

সামির রাগ কমে না। ক্রোধের অশনি ঝিলিক দেয় চোখে। চিৎকার করে বলে, ‘আমার বউয়ের সাথে কীভাবে কথা বলব সেটা তোর কাছ থেকে শিখতে হবে?’

আকাশ আর রুদ্র একটু থমকানো চোখে চেয়ে থাকে ওর দিকে। বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পায় না। সামি কাগজটা দুমড়েমুচড়ে জানালার বাইরে ফেলে দিয়ে গটগটিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *