স্বপ্নের বৃষ্টিমহল – ৫০

৫০

বেশি কিছু নয়, অল্প একটু আশা ছিল তারার মনে। সে দুঃখী মেয়ে। মানুষের লাথি ঝাঁটা খেয়ে অভ্যাস। মা চলে যাবার পর ঝুমকি আর আকাশ বাদে অন্য কেউ তাকে মানুষ হিসেবে গণ্য করেনি। যে লোকটার সাথে দুদিন পর বিয়ে হতে যাচ্ছে, সেই লোকটাও কদিন আগে বিনা অনুমতিতে গায়ে হাত দিয়ে দিল। আপত্তি করে উঠতেই বিশ্রীভাবে বলল, এত দেমাগ কীসের? বিয়ে তো আমাকেই করবি। নাকি অন্য কোনো নাগর আছে? হ্যাঁ? কথাটা এত স্পষ্ট উঁচু গলায় বলল যে গাড়ির ড্রাইভার শুনতে পেয়ে একবার পেছন ফিরে তাকাল। লজ্জা আর অপমানে জমে গেল তারা। লোকটা নীল শিরা ওঠা ময়লা নখঅলা হাত দিয়ে ওর কোমর জাপটে ধরল। মুখ রাখল বুকে। ভয়ঙ্কর বিশ্রী অনুভূতিতে গুলিয়ে উঠল গা। মনে চাইল শরীরটা কেটে ভাসিয়ে দেয় বুড়িগঙ্গার জলে। এই ঘটনার পর কেন যেন রুদ্রর ওপর খুব রাগ হলো। অথচ রুদ্রর তো এখানে কোনো দোষ নেই। তারা খুব ভালো মতোই জানে যে তার মতো সাধারণ, গুণহীন, নিতান্তই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একটা মেয়েকে রুদ্রর কখনো মনে ধরবে না। সমাজের উঁচু তলার মানুষজনের সাথে সে হরহামেশা ওঠা-বসা করে। কত বন্ধু…. কত শুভাকাঙ্ক্ষী…কত সুন্দরীদের ভিড় লেগে থাকে চারপাশে! এত জাঁকজমকের ভেতর তারার মতো অন্ধকারমুখো এক মেয়েকে সে কেন মনে রাখবে? তবুও আশার একটা লিকলিকে শিখা তিরতির করে জ্বলে যাচ্ছিল তারার বুকে। ভেবেছিল আর একবার অন্তত দেখা হবে। অন্তত সেই রিস্টব্যান্ড ফিরিয়ে দেবার অজুহাতে আর একবার তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু সেই যে ভিডিও কলে কথা হলো শাড়ির দোকানে… এরপর কেটে গেল দশটি দিন! এই দশদিন অর্থাৎ দুইশ’ চল্লিশ ঘণ্টা তারার কেমন করে কাটল সেই খবর কেউ রাখেনি। মিথ্যে আশা বুকে নিয়ে ভিখিরির মতো কারো জন্য প্রতিনিয়ত অপেক্ষা করা বোধহয় মৃত্যুর চাইতেও বেশি কষ্টের। এই দশদিনে কতবার যে মনে মনে সে নিজের মরণ কামনা করল! কিন্তু মরণেরও মায়া হলো না। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে সেই চিরচেনা দুর্বিষহ অপেক্ষার শহরেই নিজেকে আবিষ্কার করে গেল ক্রমাগত। সে এল না!

আজ ঘুম থেকে উঠেই দেখল ঝুমকি ভীষণ ব্যস্ত। তারা তখনো বিছানায় বসে আড়মোড়া ভাঙছে। ঝুমকি হাতে শলার ঝাড়ু নিয়ে সোফার গদিতে ঝাড়ন দিতে দিতে বলল, ‘ও মেয়ে! একটু জলদি জলদি উঠে আমার সাথে হাত লাগাও। গেস্ট আসবে।’

‘কে আসবে?’ তারার ঘুম ঘুম প্রশ্ন।

‘কে আবার? আমার ছেলের বন্ধুরা আসবে। তোমার বরকেও বলব।’ তারার ঘুম ছুটে যায়। উৎসুক হয়ে বলে, ‘সব বন্ধুরা আসবে? মানে ছয়জনই?’

‘সবাইকেই তো বলেছি। দেখা যাক আসে কি না। রুদ্র চলে যাবে। ভাবলাম ওর জন্য একটু রান্না করি। ছেলেটা খেতে ভালোবাসে।’

শোনামাত্র রক্তের কণায় কণায় রিমঝিম সুর খেলে যায়। স্প্রিং-এর মতো লাফ দিয়ে ওঠে হৃদপিঞ্জরের ছোট্ট যন্ত্রটা। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়ে। হাতমুখ ধুয়ে এসে ঝটপট ঘরের কাজে হাত লাগায়। ঠোঁটে উপচে পড়ে ডগমগে হাসি। কলকলিয়ে কথা বলতে থাকে। এই মুখচোরা মেয়েকে একসাথে এত কথা বলতে ঝুমকি কোনোদিন দেখেনি। ঝুমকি আরো বেশি অবাক হলো যখন মেয়েটা মহা উদ্যমে বলল, ‘খালা আজকে আমাকে একটা শাড়ি পরিয়ে দেবে?’

ঝুমকি ঝুমঝুম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর তৃপ্ত গলায় বলল, ‘বাহ! আজকে সূর্য কোনদিক উঠল? তারারানী শাড়ি পরতে চাইছে?’

তারা লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করল। ঝুমকি বলল, ‘নিশ্চয়ই পরিয়ে দেব। জামাই আসছে। খুশি হবে দেখে। কোন শাড়িটা পরবি বল।’

সামি আর হৃদি এল ঠিক বারোটায়। তার একটু বাদে অমৃতা। আজ সামি মুখ ফিরিয়ে নিল না, অগ্রাহ্য করল না বরং দেখামাত্র একটি সৌজন্যের হাসি হাসল। যে হাসিটা আরো বেশি করে অমৃতাকে বুঝিয়ে দিল যে ওর প্রতি সামির মনোভাব এখনো আগের মতোই শীতল। কেন না, বন্ধু কখনো বন্ধুকে দেখে ভদ্রতার নকল হাসি হাসে না। অমৃতা বন্ধুদের হাসি দেখামাত্র বলে দিতে পারবে, কোনটা আসল, কোনটা নকল। তাছাড়া সামিকে দেখলে আজও একটা পাপবোধ বুকের জমিন ফুঁড়ে ভস করে মাথা গজিয়ে ওঠে। ওর দিকে সরাসরি তাকাতে ভয় হয়। চোর চোর ভাব মনটাকে সংকুচিত করে দেয়। অথচ চুরি তো অমৃতা করেনি। তবুও আজীবন এই চুরির দায় মাথায় নিয়ে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর মতো নতমস্তকে ঘুরতে হবে সামির সামনে।

রুদ্র, বিভা, অভিজিৎ এল দেড়টার দিকে। রুদ্র কিন্তু খালি হাতে আসেনি। ঝুমকির জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছে জামদানি শাড়ি আর পারফিউম। অভিজিৎ জামাই মানুষ। সে নিয়ে এসেছে একগাদা মিষ্টি বসেছে ড্রয়িংরুমে। তার সুবাদে বন্ধুরাও ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ছোট্ট ড্রয়িংরুমটাতে অত লোকের জায়গা হয় না। বেশ গাদাগাদি করে বসতে হলো। রাব্বিও উপস্থিত হলো যথাসময়ে। তারা ট্রে হাতে মিষ্টি এবং চা নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসেছে। সে কোনোদিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা মেয়েকণ্ঠ বলে উঠেছে, ‘ওমা তারাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! একদম নতুন বউ!’ ঝুমকি হেসে বলেছে, ‘নতুন বউ তো বটেই। দুদিন পর বিয়ে মেয়েটার। তোমরা সবাই দোয়া করো।’

তারা লজ্জায় কেঁচোর মতো কুঁকড়ে গিয়ে ছুটে গেছে রান্নাঘরে। উনুনের পাশে মস্ত গরমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলটা দাঁত দিয়ে চিবিয়ে গেছে অনবরত। বুকটা ভীষণ কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল, যে কেউ দেখামাত্র টের পেয়ে যাবে ভেতরকার এলোমেলো অবস্থা। কোথাও লুকিয়ে যেতে পারলে বেশ হতো।

মনীষা আসার পর সকলে ওর গান শোনার বায়না ধরল। গান গাওয়ায় মনীষার আলস্য নেই। অনুরোধ পাওয়া মাত্র সে গান শুরু করে দেয়। গান শুনে আকাশের বাবা বেডরুম থেকে বেরিয়ে আসেন একবার। বসার ঘরে উঁকি দেন। চারদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করেন। তারপর নিপাট ভদ্রলোকের মতো নিজের ঘরে ফিরে যান। টেবিলে খাবার সাজানো হয়ে গেলে তারা ড্রয়িংরুমের পর্দার একপাশে এসে দাঁড়ায়। টের পায় বারান্দার দরজা-ঘেঁষা চেয়ারে বসে আছে জাদুকর। তার গা থেকে উড়ে আসছে পুরনো পৃথিবীর ঘ্রাণ! যে পৃথিবীতে মা ছিল… শরতের আকাশে পেঁজাতুলো মেঘ ছিল! কম্পমান চোখের পাতা মেলে একবার তাকায় তারা। চোখে চোখ পড়ে। বটলগ্রিন টিশার্ট, চুলে ঝুঁটি, গালে এবড়োখেবড়ো কৃষ্ণভ্রমর দাড়ি। কী এলোমেলো… দুরন্ত… আর সবল চেহারা… তবুও কী উথাল-পাথাল আকর্ষণ ওই মুখে! তারার বুক ভীষণ কাঁপতে থাকে। নিঃশ্বাস গাঢ় হয়। জাদুকরের মুখের ওপর থেকে চোখ সরাতে পারে না সে।

বারান্দার দরজার সামনে বসে আছে রুদ্র, উল্টো পাশে পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে তারা। ওর গায়ে ফিরোজা রঙের শাড়ি। পাতলা চশমার আড়ালের চোখে গাঢ় কাজলরেখা টানা। পিঠে ছড়ানো দীর্ঘ কেশভার আর কানের কাছে বারান্দার টব থেকে সদ্য ছিঁড়ে নেয়া একথোকা সাদা নয়নতারা ফুল। রুদ্রর ঠোঁটে হাসি নেই। বিস্ময়বিমূঢ় অনিমেষ দৃষ্টিতে সে উল্টো পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে চেয়ে আছে। চেয়ে আছে সেই মেয়েটিও। কেউ লক্ষ্য করছে না ওদের এই চেয়ে থাকা। সবাই গান শোনার নেশায় মত্ত। গান শেষ হলে হাততালির ঝড় উঠল। আকাশ তড়িঘড়ি করে ভেতরের ঘর থেকে গিটার নিয়ে এসে তুলে দিল রুদ্রর হাতে। এদিকে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ঝুমকি বারবার খাবারের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কেউ তার কথা খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। রুদ্র আবিষ্ট মনে গিটারে সুর তুলছিল। বন্ধুরা এতক্ষণে লক্ষ্য করল দলের সবচেয়ে ফুর্তিবাজ ছেলেটিকে আজ বড্ড নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে। রুদ্রর গান মানে উল্লাস, আনন্দ। রুদ্রর গান মানে চারপাশের মানুষকে মাতিয়ে তোলা। মুখে ঝকঝকে হাসি… গানের তালে নাচবে পা… দুলবে মাথার বাবরি … চারিদিকে হইহই রব পড়ে যাবে। আজকে ওর সেই চিরাচরিত আমুদে ভাবটি নেই। চোখেমুখে খেলছে নিবিড় একাগ্রতা। তারা পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল তখনো। নিমগ্নচিত্ত গিটারবাদককে দেখছিল নিষ্পলক চোখে। রাব্বি বসা থেকে উঠে পড়েছে। দাঁড়িয়েছে তারার পাশে, গা-ঘেঁষে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলছে, ‘আজকে তোমার সাজটা একদম পার্ফেক্ট আমার পছন্দ হয়েছে। এভাবেই সাজবে সবসময়। নতুন বউ একটু সেজেগুজে না থাকলে ভালো লাগে না।’ রুদ্র সেই সময় মুখ তুলে দেখল তারাকে। এবার ওর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করল সকলে। ঝপ করে কয়েকজোড়া চোখ নিজের দিকে তীরের মতো ছুটে এসেছে, এটা বুঝতে পেরেই তারা সংকুচিত হয়ে গেল। রক্তের ঝাপটা এসে লাগল চোখে। রুদ্রর ঠোঁটে তখন এক টুকরো অপার্থিব হাসি। সে তারার ভীত ভীত কুণ্ঠিত মুখপানে চেয়ে গেয়ে উঠল,

“তোমার জন্য আকাশভরা তারা,
আমায় না হয় খোঁপার ফুলটি দিও,
বাউল মনের আকুল করা সুরে,
এই পাগলের ভালোবাসা টুকু নিও…”

লজ্জার অরুণ-বরণ রং চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়তেই ভারী সুন্দর দেখালো তারাকে। পর্দাটা এত জোরে খামচে ধরল যে আরেকটু হলেই স্ট্যান্ড থেকে ঝুলে পড়বে। এক পলক রুদ্রর দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে নিল। আবার তাকালো। মুখের উপচে পড়া অবাধ্য হাসি ঠোঁট চেপে আটকানোর চেষ্টা করল। নাকের পাটা ফুলে উঠল অনভিপ্রেত অহংকারে। ঘরের সব্বাই এখন ওদের দুজনকেই দেখছে। আর ঐ পাগলটা নির্ভয়ে গেয়ে যাচ্ছে, বাউল মনের আকুল করা সুরে/ এই পাগলের ভালোবাসাটুকু নিও…!

এই লজ্জা মাথায় নিয়ে আর দাঁড়ানো গেল না। এক ছুটে ঘরের ভেতর পালিয়ে গেল তারা। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। জ্বরের মতো উতরোল বিকারে লুপ্ত হচ্ছে চেতনা। রান্নাঘরের দরজার পেছনে নিজেকে কোনো রকমে আড়াল করল সে। ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে। গালে রক্তের আভাস। ঝুমকি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তখন। সন্দেহের মেঘ থমথম করছে তার মুখে। তারা শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল, ‘খালা, খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। উনারা আসছেন না কেন?’ কথাটা গলা থেকে উৎরে দিয়ে সে জায়গাটা থেকে চট করে সরে দাঁড়ালো।

বাসার মধ্যে একটা আকস্মিক শীতলতা নেমে এসেছে। আকাশ রাব্বির সামনে অপ্রস্তুতবোধ করছে। অভিজিৎ, মনীষা এবং বাকি বন্ধুরা বিভ্রমে ভুগছে। এদিকে রাব্বির মুখখানা গোলমরিচতুল্য। সে কুপিত দৃষ্টিতে রুদ্রকে দেখছে বারবার। খাওয়াদাওয়ার পাট চুকে গেল নির্বিঘ্নে। বন্ধুরা স্বাভাবিক মোডে ফিরে গেলো খুব দ্রুত। শুধু রাব্বির মুখ থেকে গোলমরিচের ঝাঁজটা যাচ্ছিল না কিছুতেই। তারা পারতপক্ষে অতিথিদের সামনে এল না আর। রান্নাঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গরমে সিদ্ধ হলো। এই বাসাটা এত ছোট। লুকিয়ে থাকার মতো পর্যাপ্ত ফাঁকফোকর নেই!

লাঞ্চের পর সুযোগ বুঝে বন্ধুরা রুদ্রকে পাকড়াও করল। বিভা ওর হাত ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এল ভেতরের ঘরে। দরজা আটকে দিয়ে বিভা নাচতে নাচতে বলল, ‘আমাদের রুদ্র প্রেমে পড়ে গেছে লা লা লা!’ হৃদি সতর্ক করল ওকে, ‘অ্যাই তুই নাচিস না। তোর পেটে বাছুয়া।’

সামির ভ্রু কুঁচকে গেলো, ‘বাছুয়া জিনিসটা কী?

হৃদি বলল, ‘বিভার বাচ্চার নাম রাখছি বাছুয়া।’

‘ছি! কী উইয়ার্ড নাম!’ অমৃতার মন্তব্য।

হৃদি চোখে মুখে অদ্ভুত ভঙ্গি করে বলল ‘উইয়ার্ড হবে কেন? কনসিভ করার পর থেকেই বিভা সারাদিন বলতে থাকে, কেমন জানি লাগতেছে রে। বাছা হলে এমন লাগে জানতাম নাতো! খালি খাই খাই লাগে। মনে হয় যা দেখি তাই খাই। তোরেও কোন সময় খাইয়া ফেলাই ঠিক নাই।’ বন্ধুরা সব হাসতে লাগল হৃদির কথা শুনে। হৃদি কিন্তু হাসল না। গম্ভীরভাবে বলতে লাগল, ‘উঠতে বসতে খালি ঘ্যানর ঘ্যানর… বাছা হবে… বাছা হবে…। এইজন্যে ওর বাছার নাম রেখে দিছি বাছুয়া।

বিভা হড়বড় করে বলল ‘হৃদি আমার বাছার নাম রাখছে বাছুয়া। আমি ওর বাছার নাম রাখছি কাছুয়া।’ সামি হেডবোর্ডে মাথা হেলিয়ে দিয়েছিল। বিভার আগডুমবাগডুম কথা শুনে চমকে গেলো সে। সোজা হয়ে বসল। সরু চোখে তাকালো বিভার দিকে, ‘কী বললি তুই? হৃদির বাচ্চা মানে?’

হৃদি অভয় দিয়ে বলল, ‘আরে ফিউচারের কথা বলতেছে।’

সামি শ্বাস ফেলল একটা, ‘ওহ… আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম!’

হৃদি ওর পাশে বসে আহ্লাদি গলায় বলল, ‘ভয় কী? আমার একটা কাছুয়া লাগবে বুঝছিস? কবে দিবি?’

সামি নাক মুখ কুঁচকে বলল, ‘ইশ কী খ্যাত!’

‘বল কবে দিবি কাছুয়া?’

সামি মাছি তাড়াবার মতো হাত নেড়ে বলল, ‘বিরক্ত করিস নাতো!’

হৃদি খপ করে সামির কলার খামচে ধরল ‘একশ’বার বিরক্ত করব। বল কবে দিবি? এখুনি দে!’

কথাটা বলেই সে হঠাৎ খুব বিমর্ষ হয়ে গেলো। কলার থেকে হাত আলগা করে ঠোঁট উল্টে বলল, ‘কিন্তু আমরা তো প্রোটেকশন ছাড়াই করতেছি… আমার কি তাহলে বাছা হবে না?’

অমৃতা ফুঁসে উঠল, ‘সিরিয়াসলি? তোমরা উইদ অর উইদাউট প্রটেকশন করতেছ, নাকি ক্যামনে কী করতেছ, এইগুলা শুনতে হবে এখন?’ হৃদি লুতুপুতু স্বরে বলল, ‘কেন শুনতে সমস্যা কী? তুমি আবার এত ভদ্র হইলা কবে থেকে?’

অমৃতা কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘প্রব্লেম হইল আমি যা শুনি তা আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকে… তোমরা দুইজন… মানে… ইয়াক…!’

সামি মৃদু ধমকের সাথে হৃদিকে বলল, ‘তুই হঠাৎ বাচ্চার জন্য মরে যাচ্ছিস কেন? এত তাড়াতাড়ি আমি বাপ হব না।’

‘কেন হবি না?’ রুখে ওঠে হৃদি।

‘বাচ্চা কাচ্চা… ঝামেলা… লাইফ এনজয় করে নেই। তারপর দেখা যাবে।’

হৃদির মুখে হালকা একটু দুশ্চিন্তার প্রলেপ পড়ে। হঠাৎ করেই চুপ হয়ে যায় সে। রুদ্র পড়ার টেবিলের ওপর উঠে বসেছে। পা দুটো ঝুলছে বাইরে। হাতে ধরা সেলফোনে চোখ নিবদ্ধ। বন্ধুদের কথাবার্তার বিন্দুমাত্র রেশ তার কান পর্যন্ত যাচ্ছে না। অমৃতা ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘অ্যাই পোলা, কাহিনি কী? ‘

‘আরে ফোন নিয়ে গেলি ক্যান। সমস্যা কী? দে এইদিকে।

অমৃতা ফোনটা আরো দূরে সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আগে কাহিনি বল। তারপর ফোন পাবি।’

বিভা হুট করে এগিয়ে এসে রুদ্রর দুই গাল ইচ্ছে মতো দলাইমলাই করে টেনে দিয়ে বলল, ‘কী সুন্দর করে প্রপোজ করলিরে দোস্ত… প্রেমে একদম হাবুডুবু খাচ্ছিস!’ রুদ্র লাল টাল হয়ে বিভার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, ‘কী যে শুরু করলি না তোরা!’

সামি বলল, ‘তুমি তো মামা খেল দেখায় দিলা… তলে তলে এতদূর। আমরা কিছুই জানি না!’

রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আমি নিজেও কি কিছু জানি নাকি ছাই!’ অমৃতা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, ‘মানে কী? তুমি কিছু না জানলে এইটা কী ছিল? সবার সামনে মেয়েটারে তুমি কী বললা?’

রুদ্র নতমস্তকে বসে থাকে। তাকিয়ে থাকে নিজের হাতের আঙুলের দিকে। চোখে মুখে বিভ্রমের ছায়া খেলে। ভারী অসহায় দেখায় তাকে সেই মুহূর্তে। হৃদি ওষ্ঠ চাপা তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে, ‘রুদ্র একটা গাধার বাচ্চা। এই মেয়েটা তেমন আহামরি সুন্দর না। এত ক্রেজি হওয়ার মতো কিছু নাই।’

রুদ্রর ম্লান মুখে হঠাৎ যেন ঝলসে ওঠে প্রবল উৎকণ্ঠা। এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে বলে, ‘মেয়েটা সুন্দর না?’

প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে রুদ্র বন্ধুদের দিকে ব্যগ্রভাবে চেয়ে থাকে। উত্তরের অপেক্ষা করে। বন্ধুদের চুপ করে থাকতে দেখে নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দেয়, ‘আমার তো মনে হয় আমি ওর মতো সহজ-সরল সুন্দর মেয়ে এর আগে কখনো দেখি নাই। দেয়ার ইজ সামথিং ডিভাইন ইন হার!… আই থিঙ্ক শী ইজ সিম্পলি ডিভাইন!’ নিজের বক্তব্য নিজের কানেই কেমন অদ্ভুত লাগে রুদ্রর। বন্ধুরা অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে থাকে। বিভা একসময় মিনমিন করে বলে, ‘এটা ঠিক মেয়েটা আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়ে গেছে এখন। আজকে তো দেইখা চমকায় গেছি। বাট অনেস্টলি স্পিকিং দোস্ত… তোর জন্য আমাদের এক্সপেক্টেশন অন্য রকম ছিল। নো অফেন্স!’

আচমকা দড়াম করে ঘরের দরজাটা খুলে যায়। বুনো মোষের মতো তেড়ে আসে আকাশ। রুদ্রর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, ‘এসব ফাইজলামির মানে কী?’

রুদ্র তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলতে পারে না। বিচলিত একটা ভাব ফুটে ওঠে ওর চেহারায়। অমৃতা আকাশের কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘কুল ডাউন। এত চেতিস না। দেখতেছি ব্যাপারটা।’

আকাশ ফেটে পড়ে আক্রোশে, ‘দেখার কী আছে? যা হবার তা তো হয়েই গেছে তাই না? একটা মেয়ের বিয়ে হবে কাল বাদে পরশু। সেই মেয়ের উড বি হাজবেন্ডের সামনে এই হারামজাদা কোন আক্কেলে এমন একটা কাজ করল? ও কি মনে করছে কেউ কিছু বুঝে না? সবাই ওর মতো ব্যাক্কল?’

হৃদি গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে মতামত জানাল, ‘আসলেই কাজটা ঠিক করিস নাই রুদ্র।’

সামি স্বগতোক্তি করল, ‘তারার হবু বরটাকে আমার খুব একটা পছন্দ হয় নাই। ম্যান… হি লুকস ওল্ড!’

অমৃতা হাত উঁচিয়ে বলল, ‘থাম তো তোরা। রুদ্রকে কথা বলতে দে।’ এরপর রুদ্রর দিকে ঘুরে তাকিয়ে আদেশ করল, ‘তুই বল।

‘কী বলব? ওরে তো মানাই করছিলাম বিয়েটা দিতে।’ জড়তা কাটিয়ে উঠে নালিশ করার সুরে বলল রুদ্র।

এ কথায় বন্ধুদের মধ্যে বিস্ময়ের রোল পড়ে গেল। আকাশ ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ রুদ্রর দিকে। তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘হোয়াট দ্যা ফাক আর ইউ ট্রাইং টু ডু রুদ্র? ডু ইউ থিংক দিস ইজ অ্যা গেম?’

রুদ্র একটা হতাশ শ্বাস ফেলে অসহায় ভঙ্গিতে বলল, ‘বুঝলাম না কী এমন দোষ করলাম ভাই। আমার মনে হইছে মেয়েটা বিয়া করতে চায় না, তাই প্রথম থেকেই বলছি বিয়া দিস না। দ্যাটস ইট।’

অমৃতা বলল, ‘তাহলে আজকে এটা কী ছিল রুদ্র? তুই সবার সামনে ওর দিকে তাকায়ে গান গাইলি ক্যান?’

রুদ্র মলিন হাসে, ‘গান গাওয়াটা অপরাধ? গান গাইতে মনে চাইছে, তাই গাইছি।’

আকাশ তেড়ে উঠে বলল, ‘তোকে কে বলছে তারা বিয়ে করতে চায় না?’ বাক্যটা শেষ করেই সে গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়ল, ‘তারা! অ্যাই তারা!’

‘থাক আকাশ। এখন আবার তারাকে ডাকতেছিস ক্যান?’ আপত্তি করে উঠল বিভা। আকাশ হুঙ্কার ছেড়ে বলল, ‘আজকে একটা ফয়সালা হয়ে যাক। ও সবসময় আমারে ব্লেম করে আমি নাকি জোর কইরা বিয়া দিতেছি। দেখি তারা কী বলে।’

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই তারা দরজার কাছে এসে হাজির হলো। মুখ খানা রক্তিম। ঘনঘন শ্বাস পড়ছে। চোখে ভয়ের দাপাদাপি। বন্ধুদের আক্রমণে রুদ্র এমনিতেই ভেতরে ভেতরে নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। তারাকে আকস্মিকভাবে তলব করে সালিস বসানোর নাটকটা তাকে মানসিকভাবে আঘাত করল। অপমানের কালো ছায়ায় থমথম করে উঠল মুখ।

তারা ঘরের মাঝে এসে গুটিশুটি হয়ে দাঁড়াতেই আকাশ ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করল, ‘একটা প্রশ্ন করব সরাসরি উত্তর দিবা।’

তারা অধোবদনে দাঁড়িয়ে রইল। একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। ‘তোমার কি এই বিয়েতে মত নাই? তোমাকে কি আমি ফোর্স করে বিয়ে দিচ্ছি?’

তারা এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে তাকাল আকাশের দিকে। হঠাৎ এত মানুষের সামনে ডেকে এনে এই অদ্ভুত প্রশ্ন করার অর্থ তার কাছে বোধগম্য হলো না। ভীষণ বিচলিত দেখালো ওকে। নার্ভাসভাবে বলল, ‘ফোর্স করবেন কেন ভাইয়া? এটা কেমন কথা?’

আকাশ বলল, ‘এভাবে নয়। তুমি স্পষ্টভাবে বল তারা, এই বিয়েতে কি তোমার মত আছে?’

তারা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীর মতো মলিন মুখে বলল, ‘আমি তো বিয়েতে আপত্তি করিনি।’

‘এর মানে বিয়েটা তুমি নিজের ইচ্ছায় করছ?’

তারা একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করল, ‘জি।’

আকাশ রুদ্রর মুখের ওপর অর্থপূর্ণ দৃষ্টি রাখল। মুখে বিজয়ীর হাসি। বোঝাই যাচ্ছে রুদ্রকে ভুল প্রমাণিত করতে পেরে সে বিশেষ সন্তুষ্ট। রুদ্র ব্যথিত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল আকাশের দিকে। তারপর লাফ দিয়ে টেবিলের ওপর থেকে নেমে পড়ল। অপদস্থ গলায় বলল, ‘সরি। আমারই ভুল ছিল।’ কথাটা ছুড়ে দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে এল সে ঘর থেকে। ড্রয়িংরুমে অভিজিৎ, ঝুমকি আর মনীষা বসে আছে। রুদ্র ওদের সামনে দিয়েই ঝড়ের বেগে সদর দরজা পার হলো। কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ করল না। সারা শরীরে লাঞ্ছনার সুচ ফুটছে। রক্তে টগবগ করছে অপরাধবোধের গ্লানি। সিঁড়ির চতুর্থ ধাপে পৌঁছে গেছে তখন। হঠাৎ পেছন থেকে উদ্বেগ মিশ্রিত কণ্ঠটা ভেসে এলো, ‘রুদ্র ভাইয়া!’

রুদ্র থমকে দাঁড়ালো। দম নিতে ভুলে গেলো সেকেন্ডের জন্য। ভুল শুনল না তো? ডাকটা কি বাস্তব? নাকি তার অবসন্ন মস্তিষ্কের ভ্রান্তিময় বিভ্রম?

‘রুদ্র!’

পেছন ফিরে তাকায় রুদ্র। সিঁড়িঘরের খুপরি জানালা দিয়ে আসা বিকেল শেষের সাদা আলোয় এক ঝলক দেখতে পায় তারাকে। তারা কয়েক পা এগিয়ে এসে দুই ধাপ সিঁড়ি ভেঙে মুখোমুখি দাঁড়ায়। রুদ্র নিজের হৃৎপিণ্ডে একটা আশ্চর্য কোলাহল টের পায়। মেরুদণ্ড শিরশির করে। ঠান্ডা স্নিগ্ধ ঝিরঝিরি অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আসে চেতনা। তারা ডান হাত বাড়িয়ে ব্রেসলেটটা এগিয়ে দেয়। কটা চোখের মণিজোড়ার ওপর গভীর একাগ্র দৃষ্টি রাখে। বুক কাঁপে রুদ্রর। নিজেকে ভীষণ বোকা আর ভীতু বলে মনে হয়। পড়া ভুলে যাওয়া নিরেট জড়বুদ্ধি ছাত্রের মতো অবোধ মুখে হাত বাড়িয়ে জিনিসটা তুলে নেয়। তারা ক্ষীণ স্বরে বলে, ‘শেভ করেন না কেন রুদ্র?

রুদ্র হালকা চমকে উঠে নিজের গালে হাত রাখে। সত্যি… অনেকদিন দাড়ি কামানো হয় না। মনেই থাকে না! মনীষা এসে দাঁড়ায় পেছনে। ফ্ল্যাটের সদর দরজার সামনে। রুদ্র রিস্টব্যান্ডটা হাতে নিয়ে তরতর করে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। হৃৎপিণ্ডের শোরগোল তখনো থামেনি। অবাধ্য হৃৎপিণ্ড কোনো রকমে সামলে সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে ওর মনে পড়ে… তারা একটু আগে ভাইয়া ডাকেনি… শুধু নাম ধরে ডেকেছে!

৫১

রুদ্রর প্রস্থানের ক্ষণকাল পরে অমৃতা বলল, ‘কাজটা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না আকাশ। রুদ্রকে আমি এরকম কখনো দেখি নাই।’

আকাশ তাচ্ছিল্যের সাথে বলে, ‘ধুর ধুর… ওই শালার কোনো ঠিক নাই। বিদেশে গিয়ে এসব বেমালুম ভুলে বসে থাকবে।’ কথাটা শেষ করে সে তীব্র চোখে অমৃতার দিকে তাকালো একবার। তীব্র গলায় বলল, ‘সবাইকে নিজের মতো ভাবিস না অমৃতা! রুদ্র খুবই আনরিলাঅ্যাবল একটা ছেলে। আজকে এরে ভালো লাগে তো কালকে তারে। ওর ওপর ভরসা করে আমি তারার বিয়ে বাতিল করতে পারব না। আর রুদ্র তো সিরিয়াসলি কিছু বলতেছে না। বিয়ে দিতে মানা করে। জিগাইছি যে বিয়া দিমু না ক্যান, তুই কি ওরে বিয়া করবি?’

‘তখন কী উত্তর দিল?’ অমৃতার উৎসুক প্রশ্ন।

‘বলে আমি ক্যান বিয়া করব। আজিব!’

আকাশের বলা ‘সবাইকে নিজের মতো ভাবিস না অমৃতা।’ কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থ বন্ধুরা সকলেই বুঝেছিল। বুঝেছিল সামিও। এক ঝলক দেখেছিল সে অমৃতাকে সেই মুহূর্তে। চেহারাটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। কপালে দাগ। কোটরাগত চোখ। একটা চিরস্থায়ী দুঃখী ভাব যেন আসন গেঁড়ে বসে গেছে ঐ মুখে।

আকাশের সেলফোনটা ঠিক সেই সময় বেজে উঠল। দ্রুত রিসিভ করল সে। কথা বলল মিনিট দুয়েক, তারপর লাইন কেটে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বন্ধুদের বলল, ‘রাব্বি সাহেব ফোন দিছিলেন। উনি চাইতেছে কালকেই আকদ হয়ে যাক।

‘এত ক্যাড়া উঠছে ক্যান ব্যাটার? দুইদিন পর তো বিয়ে হচ্ছেই!’ বিভা বলল।

আকাশকে একটু বিভ্রান্ত দেখালো, ‘হুম… কী জানি… তাড়াহুড়া কেন করতেছে জানি না। যাই হোক, পরশুদিন আকদ হওয়া আর কালকে হওয়ার মধ্যে কোনো তফাত নাই। তাই না?’

শেষের প্রশ্নটা যেন নিজেকেই নিজে করল আকাশ। কিছুক্ষণ সবাই নিজস্ব চিন্তায় মগ্ন হয়ে রইল। কেউ কোনো কথা বলল না। একটা সময় সামি বলল, ‘রাব্বি খুব সম্ভবত রুদ্রকে নিয়ে ইনসিকিউরড ফিল করছেন। এ-কারণেই তাড়াহুড়া। কিন্তু অনুষ্ঠান তো সাতাশ তারিখেই হবে। তাই না?’

‘হ্যাঁ।’ উত্তর দিল আকাশ।

বিভা ফোড়ন কাটল, ‘ব্যাটা ভালোই ভয় পাইছে।’ কথাটা বলতে বলতে নিজের মনে হাসতে লাগল বিভা।

‘হাসিস ক্যান?’ বন্ধুদের প্রশ্ন।

বিভা হাসিতে ফেটে পড়ে বলল, ‘রুদ্রকে হিংসা করতেছে ঐ পেটমোটা পটলের মতো দেখতে লোকটা… এটা ভেবেই কেন যেন আমার খুব হাসি পাচ্ছে।’

হাসি ছোঁয়াচে। বিভার হাসি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল বাকিদের মধ্যে। শুধু আকাশ গোমড়া মুখে বলল, ‘মানুষের চেহারা কখনো পটলের মতো হয় নাকি? তোদের সমস্যা কি জানিস? তোরা মানুষকে খুব আন্ডারেস্টিমেট করিস। এটা ঠিক না।’

বিভার হাসির তোড় আরো বাড়তে লাগল। দরজায় অভিজিৎ এসে কখন দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি ওরা। এবার চোখ পড়তেই বিভা হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, ‘বাছুয়ার বাবা এদিকে এসো, শুনে যাও একটা কথা।

অভিজিৎ জানে তার বউটা মস্ত পাগল। কনসিভ করার পর থেকে পাগলামো আরও একধাপ বেড়ে গেছে। সে মুখে আলগা হাসি ধরে রেখে ভদ্র গলায় বলল, ‘শুনছি….. বলো।’

বিভা চোখমুখ খিঁচে হাসতে হাসতে বলল, ‘আমাদের রুদ্র আর ওই পটলের মতো দেখতে পেটমোটা লোকটা, এই দুজন হচ্ছে রাইভ্যাল… একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। বিষয়টা চিন্তা করেই কেমন হাসি পাচ্ছে না?’

.

আগামীকাল আকদ, এই খবরটা শোনার পর থেকেই তারার শুধু কান্না পাচ্ছে। ঝুমকি অবাক, ‘এত কাঁদছিস কেন? বিয়ে তো সেই কবে থেকেই ঠিক হয়ে আছে!’ তারা কোনো কথা বলতে পারছে না। মন চাইছে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মরে যায়। কিংবা বিষ খায়। সে তো আর আসবে না! একটা মানুষ চলে যাবার সময় অন্য এক মানুষকে ভেতরে ভেতরে চূর্ণ- বিচূর্ণ করে দিয়ে গেলো, অথচ সেই মানুষটা কিছু জানল না পর্যন্ত! প্রকৃতির এ কেমন বিধান? এই বিয়েতে মত নেই, এমন কথা বলার স্পর্ধা তারার আছে নাকি? আকাশ তাকে করুণা করে থাকতে দিয়েছে… তিনবেলা খেতে দিয়েছে… নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে। এমন দেবতার মতো মানুষের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কি আওয়াজ তোলা যায়? এই বিয়ে না করার অপরাধে যদি ঝুমকি তাকে আবার নানার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়? ঐ বাড়ির পিশাচগুলোর হাতে এবার নির্ঘাত খুন হয়ে যাবে। নিজের বাবাকে এই নিয়ে তিনবার ইমেইল করেছে। ফোন করেছে একাধিকবার। সেই লোক লাপাত্তা। আকাশ আর ঝুমকির মন ভেঙে দিয়ে তারা এই পৃথিবীতে টিকতে পারবে না। কেউ যদি কথাটা বুঝত! জাদুকরও তো ভুল বুঝে চলে গেলো। আরেকটু সাহসী কি সে হতে পারত না? ভাবতে ভাবতে তারা নিজেকে নিজে কটূক্তি করে, গাল দেয়। তোর মতো মেয়ের জন্য সাহস দেখাবে? তুই কি ওর যোগ্য? তবুও বুকের কোণে একটা ক্ষীণ আকাঙ্ক্ষা দুর্বল অগ্নিশিখার মতো জ্বলতে থাকে। যদি সত্যিই ওর মনে কিছু না থাকে তবে এমন করে চেয়ে থাকা কেন? কেন সবার সামনে ওভাবে গান গেয়ে অপ্রস্তুত করা? কেন ও জীবনে আসার পর থেকেই সবকিছু এমন সুন্দর হয়ে উঠল? কেন তারার জীর্ণ শরীরে এল রূপের প্লাবন? এতকাল কোথায় ছিল এসব সৌন্দর্য? জাদুকরের জন্যই জীবনটা রূপে আর মাধুর্যে ভর-ভরন্ত হয়ে উঠেছিল। সে চলে গেলে ছিবড়ে খাওয়া আমের আঁটির মতো ক্ষয়িত আর নিঃশেষিত হয়ে যাবে তারার সবকিছু। এই সর্বনাশের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া এখন আর কোনো গতি নেই। কাল সকালে আকদ! তারার মনে হচ্ছে আকদ নয়, বরং মৃত্যুদণ্ডের আদেশ জারি হয়েছে।

মনীষা বলল, ‘কাল যদি সকালে বিয়ে হয়, তবে এসো আজকেই আমরা হাতে মেহেদি দেই। গায়ে হলুদ করি।’

এই কথায় মেয়েদের মধ্যে একটা খুশির ধুম পড়ে গেল। গায়েহলুদের অনুষ্ঠানের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। মেয়েদের এই ঝটিকা উদ্যোগ ঝুমকিকে অত্যন্ত আনন্দিত করে তুলল। তারার ভাগ্যটা নেহাত খুব ভালো, নইলে যে মেয়ের বাপ মা নেই, পরিবার নেই, আশ্রিতের মতো পড়ে আছে অন্যের বাড়িতে, সেই মেয়ের বিয়েতে কখনো এত আড়ম্বর হয় নাকি?

বিভা আর হৃদি সাজগোজের অযুহাত পেয়ে গেল। চট করে যার যার বাসায় গিয়ে নিয়ে এল শাড়ি আর ম্যাচিং অর্নামেন্টস। কিনে আনল হিনা মেহেদি টিউব। বরপক্ষ মেয়ের গায়েহলুদের জন্য কোনো তত্ত্ব পাঠায়নি। বিভা তাড়াহুড়া করে তারার জন্য একটা মেহেদি রঙের তাঁতের শাড়ি কিনল। ফুলের গয়না কিনল। মনীষা ছেলেদেরকে পাঠিয়েছে কাঁচা ফুলের বাজারে। ফুল আসতেই ঐ একরত্তি ড্রয়িং রুমের সিঙ্গেল বিছানাটাকেই ফুল-টুল দিয়ে সাজিয়ে মঞ্চ বানিয়ে ফেলল মনীষা। এর মাঝে একাধিকবার রুদ্রকে ফোন দেয়া হয়েছে। সে ফোন ধরছে না। কয়েকবার মুখের ওপর লাইন কেটে দিয়েছে। এমন অকাট আনন্দের মাঝে তার এই একগুঁয়ে আচরণ বন্ধুদেরকে বিচলিত করে তুলছিল ক্ষণে ক্ষণে। বিরক্তও যে হচ্ছিল না তা নয়। হৃদি তো বিরক্তিতে কাদা কাদা হয়ে বলেই ফেলল, ‘রুদ্রর বাচ্চা ঢং করার আর জায়গা পায় না। আজকে একটা আনন্দের দিন। একসাথে সবাই এনজয় করব তা না। সে উধাও হয়ে বসে আছে।’

বিভা বলল, ‘রুদ্রকে ছাড়া তো গানও হবে না। শয়তানটাকে ফোন দিয়ে তাড়াতাড়ি আসতে বল তো। গান-টান না হইলে গায়ে হলুদ জমে নাকি?’

অমৃতা দুই বান্ধবীর দিকে কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘তোরা খুব অদ্ভুত, জানিস? রুদ্রর মেন্টাল অবস্থা কী রকম সেটা নিয়ে কেউ চিন্তা করতেছিস না। নিজেদেরকে নিয়ে মত্ত হয়ে আছিস। কেমন ফ্রেন্ড তোরা?

হৃদি অমৃতার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, ‘চিল থাকো দোস্ত। রুদ্র হচ্ছে রুদ্র। দুইদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘ঠিক না হইলে কী করবি?’

হৃদি বলল, ‘ঠিক না হইলে মাথার চুল কাইটা ফেলব আমি। কথা দিলাম।’

অমৃতা হেসে ফেলল, ‘মনে থাকে যেন।’

‘আইচ্ছা মনে থাকবে। দেখবি ইউএসএ যাবার পর রুদ্রর একটা ড্যাশিং গার্লফ্রেন্ড হবে।’

অমৃতার মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। হৃদি আর বিভার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম অহংবোধ দেখতে পায় সে। দুজনেই নিজ নিজ সংসারে সুখী। পাশে আছে মনের মতো জীবনসঙ্গী। অভাব অনটন নেই। সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। বিভার কোলজুড়ে দুদিন পর রাজপুত্র বা রাজকন্যা আসবে। শুরু হবে জীবনের নতুন অধ্যায়। হৃদির ব্যাংকের চাকরিটা হয়ে গেছে। না হলেও কোনো সমস্যা নেই। সামি ওর কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখবে না। চাকরিটা নেহাত শখের বশেই করবে সে। ফি বছর ভ্যাকেশনে দেশের বাইরে ঘুরতে যাবে। দামি দামি জিনিস কিনবে। ওদের সংসারেও আসবে নতুন অতিথি। সেই অতিথিকে কেন্দ্র করে ঘুরবে জীবন চাকা। ছেলে-মেয়েকে নামী-দামি স্কুলে পড়াবে। কোথাও কোনো ছন্দপতন হবে না। বিলাসব্যসন হয়ত মানুষের মনকে শক্ত করে তোলে। ধনীদের মধ্যে আবেগের তেমন উচ্ছ্বাস থাকে না, যতটা মধ্যবিত্তদের মধ্যে থাকে। তারা মেয়েটা আশ্রয়হীন, দরিদ্র এবং সাধারণ বলেই আজকে ওদের চোখে বন্ধুর জন্য মানানসই মনে হচ্ছে না। এমন হীন-মনোভাব বুকে পুষে রাখা যে কত বড় পাপ… কত বড় অপরাধ… ওরা কি তা জানে?

৫২

স্কুল বালিকার কোঁকড়ানো চুলের মতো কৃষ্ণ মেঘের দলে ছেয়ে গিয়েছিল ঢাকার ধোঁয়াটে আকাশ। ঝড়ো বাতাসে উড়ছিল এলোমেলো ধুলো। ঘন বরিষণের আসন্ন আভাসে উবে গেছে বিকেলের সাদা আলো। নগরীর উঁচু উঁচু বিল্ডিং-এর গায়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বাদামী সন্ধ্যার ম্লান উপস্থিতি। বৃষ্টির ভয়ে লোকজন প্রায় হুড়োহুড়ি করে বাড়ির পথে ছুটছে। হকাররা গুটিয়ে নিচ্ছে পণ্যসামগ্রী। কেউ কেউ রাবারক্লথ দিয়ে মুড়ে দিচ্ছে বিক্রির জিনিস। চারিদিকে সোঁদা সোঁদা গন্ধ। যানবাহনের ভিড় লেগে গেছে রাস্তায়। দুর্যোগের বিকেলে কে কার আগে বাড়ি ফিরবে সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছে লোকে। বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হবে। অনেক রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। কারো কারো বাসার সামনে হয়ত উঠে যাবে হাঁটুজল। এসব দুর্ভোগের কথা নগরীর মানুষ জানে বলেই বাড়ি ফেরার এত তাড়া। এই ব্যস্ত, চলন্ত, কোলাহলপূর্ণ মেঘলা শহরের ঘিঞ্জি ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিল ছিপছিপে লম্বা এক অন্যমনস্ক যুবক। ঘাড়ে লুটিয়ে থাকা এলোমেলো বাবরি চুল উড়ছে হাওয়ায়। পায়ে দুই ফিতার স্যান্ডেল। চোখের দৃষ্টি উদাস। এত উদাস যে দেখলে কেমন চমকে উঠতে হয়। মনে হয় পার্থিব ব্যস্ততার সাথে এই দুই চোখের মালিকের কোনো যোগসাজশ নেই। জীবনে কিছু কিছু সময় মানুষ খুব ভালো মতো টের পায় যে একা থাকাটাই তার অমোঘ নিয়তি। খুব আমুদে, খুব বন্ধু বৎসল মানুষটাও হঠাৎ হঠাৎ ঝুপ করে একা হয়ে যায়। এক সমুদ্র মানুষের মাঝে তখন নিজের আপন বলতে কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সবাই পর হয়ে যায়। বিস্তৃত শব্দময় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মাঝে নিজেকে বড়ই অবাঞ্ছিত এবং ঠুনকো বলে মনে হয়। পৃথিবীর ওপর অভিমান হয়। ইচ্ছে করে পৃথিবী ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু মানুষ যে আজন্ম পৃথিবী নামক খাঁচায় বন্দি! সেই একই আকাশের নিচেই তাকে ঘুরে ঘুরে ফিরে আসতে হয়।

শহরের কোথাও একটু নির্জনতা নেই, লুকোনোর জায়গা নেই। জনসমুদ্রের মধ্যে দিয়ে অনেকটা সময় বুক ভর্তি রাগ আর অভিমান নিয়ে চুপচাপ হেঁটে বেড়াল রুদ্র। এমন অসহ্য অভিমানী রাগ আগে কখনো হৃদয় জুড়ে আসন পেতে বসেনি। রাগটা কার ওপর তা সঠিক জানে না সে। একবার বন্ধুদের ওপর রাগ হচ্ছে, আবার মনে হচ্ছে পুরো দোষটা আসলে তার নিজেরই। তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে সে বাড়াবাড়ি করছে। তারার ওপরেও রাগ হচ্ছে। মেয়েটা কেন বিয়ে করার জন্য অমন মুখিয়ে আছে? নিজের মতামত দৃঢ়ভাবে জানাবার মতো সাহস নেই। ভীষণ ভীরু মেয়েটা। আত্মসম্মান বলতেও কিছু নেই। থাকলে আকাশের কথায় অমন পুতুল নাচ নাচত না। এমন একটা যেন-তেন মেয়েকে নিয়ে রুদ্রই একটু বেশি ভেবে ফেলছে। হয়ত আকাশের কথাই ঠিক। মেয়েটি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই বিয়েটা করছে। রুদ্রর এসব নিয়ে কথা বলাই উচিত হয়নি। ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোটা চরম অনধিকার চর্চা হয়েছে! রুদ্র ঠিক করল আজ রাতেই চট্টগ্রাম চলে যাবে। মনটাকে স্বাভাবিক রাস্তায় ফিরিয়ে আনতে হবে। ভাবল বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে টিকেট কাটবে। তখনো ঝড়ের তাণ্ডব কমেনি। উতলা বাতাসে শহর লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। চোখে ধুলো এসে কিচকিচ করছে। হাওয়ার দাপটে ঠিকমতো চোখ খুলে রাখা দায়। অন্ধের মতো হাঁটছিল রুদ্র। হঠাৎ কার সাথে যেন ধাক্কা লেগে গেল। নাকে এসে লাগল মেয়েলি পারফিউমের ঘ্রাণ। রুদ্র বালি কিচকিচ করা আধবোজা চোখে দেখল একটি ভারী সুন্দর দেখতে তরুণী মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে গনগনে তেজের আগুন।

‘ধাক্কা দিলেন কেন?’

রুদ্র সচকিতভাবে বলল, ‘সরি, আমি দেখিনি আপনাকে। ভুল হয়ে গেছে।’

রুদ্রর চোখ তখন আটকে গেছে রাস্তার ধারের একটা নাপিতের দোকানে। মনে পড়ল তারা আজ শেভ করার কথা বলেছিল। মেয়েটিকে পাশ কাটিয়ে সে পাশের দোকানে ঢুকে গেল। শেভ করল। পুরোপুরি নয়। সবুজ ঘাসের মতো একটা ক্ষীণ আস্তর লেগে রইল গালে। সেলুন থেকে বেরিয়ে আবারও নিরুদ্দেশ যাত্রা। শহরের অলি-গলি ভবঘুরের মতো চষে বেড়াল। এক সময় শ্রান্ত শরীর নিয়ে রমনা পার্কে এসে বসল। পায়ের কাছে ঘুরতে লাগল নেড়ি কুকুরের দল। আশেপাশে ভিক্ষার থালা হাতে ঘুরছে ভিখিরি। পার্কের গাছগাছালি দুলছে মাতাল তুফানে। কয়েকটা অল্পবয়সী টোকাই ছেলে অর্থহীন উল্লাস করে আসন্ন বৃষ্টিকে স্বাগত জানাচ্ছে। রুদ্র একটি সোনালু গাছের নিচের বেঞ্চিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে। বাতাসে দিগ্‌ বিদিগশূন্য হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে ফুলের পাপড়ি। নাকে ধাক্কা খাচ্ছে সোঁদা মাটির ঘ্রাণ। ছাই রঙের আকাশে কালো ধোঁয়ার মতো কুণ্ডুলি পাকিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে মেঘ। বুকের ঠিক কোথায় যন্ত্রণাটা হচ্ছে তা ঠিক মতো ঠাওর করা যাচ্ছে না। কিন্তু সর্ব সত্তা দিয়ে অনুভব করা যাচ্ছে। একটা গভীর মন খারাপের অসুখ ভেতরটাকে খুঁটে খুঁটে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। মনের এমন ভয়াবহ বিপর্যয় কী করে মোকাবেলা করতে হয় কে জানে! মনই তো মানুষের সব! মনই মানুষকে বাঁচায়, হাসায়, কাঁদায়। সেই মনেরই যদি জটিল, দুর্গম রোগ হয়… তবে মানুষ বাঁচে কী করে? রুদ্র তমসাচ্ছন্ন মেঘমেদুর আকাশের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল। মেঘে মেঘে ঘষা লেগে চমকে উঠছে চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ। বজ্রপাতের শব্দে ফেটে পড়ছে পৃথিবী। দস্যি বাতাস গাছের পাতা উড়াচ্ছে শূন্যে, মটমট করে ভাঙছে গাছের ডাল। ধুলো এসে লাগছে চোখে মুখে। হঠাৎ মেঘের পর্দা ঠেলে উঁকি দিল সেই মুখটা। পাতলা কাচের চশমার পেছনের ডগডগে সরল দুটি চোখে পৃথিবীর সমস্ত রূপ উপচে পড়ছে। সেই রূপের ঝাঁজ রুদ্রকে কেমন ছেয়ে ফেলল মুহূর্তের মধ্যে। রক্তকণিকা শিউরে উঠল অবোধ, অস্পষ্ট কষ্ট কষ্ট ভালো লাগায়! ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির ঝরঝর শব্দে ঢাকা পড়ে গেল ব্যস্ত নগরীর যাবতীয় কোলাহল। আকাশটা ভেঙে ভেঙে পড়তে লাগল রুদ্রর বুকের ওপর। বৃষ্টির শীতল জল ছুঁয়ে দিয়ে গেলো হৃদয়ের প্রতিটি রন্ধ্র। কী মনে করে যেন পকেট থেকে সেলফোনটা একবার বের করল রুদ্র। অমৃতার টেক্সট ভেসে আছে ফোনের পর্দায়।

দোস্ত তারার আকদ কাল সকালে হচ্ছে। এখন গায়ে হলুদ। তুই কই? আসবি না?

৫৩

বৃষ্টিতে চারপাশ সাদা। অমৃতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। গায়ে এসে পড়ছে একরোখা বৃষ্টির জল। সামনের বিল্ডিং-এর ছাদে দুটি কিশোরী মেয়ে গান গেয়ে গেয়ে বৃষ্টি বিলাস করছে। ছুটছে ছাদের এক মাথা থেকে আরেক মাথায়। মাঝে মাঝে কোমর দুলিয়ে নেচেও ফেলছে আনন্দে। বিল্ডিং-এর পাশের মেস বাড়ির টিনের চালে জল গড়ানোর শব্দ হচ্ছে। হাওয়া বড় উতলা! বুকে জমে থাকা সমস্ত খরা শুষে নিচ্ছে এক নিমেষে। বাবার দেয়া সাদা খোল নীল পাড়ের শাড়িটার কথা মনে পড়ছিল অমৃতার। মনে পড়ছিল তার কথা। এই বৃষ্টিভেজা মন কেমনের মেঘলা দিনে কী করছে মানুষটা? সোঁদা মাটির ঘ্রাণের সাথে স্মৃতির কুঠুরির কোনো গোপন সংস্রব আছে বোধহয়। নইলে ঐ ঘ্রাণ নাকে এসে লাগলেই বুক কেন দুরুদুরু করে? ফেলে আসা দিনগুলোর সুখ সুখ অনুভূতি কেন দূর থেকে হাতছানি দেয়? সেই দিনটাও বৃষ্টি-বৃষ্টি গন্ধে ভরা ছিল। কী গভীর হতাশায় ডুবে গিয়ে, এক পৃথিবী আঁধার নিয়ে উত্তরা বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকেছিল অমৃতা! মেঘলা দিনের আকাশ মাথায় নিয়ে সেই সুন্দর মানুষটা বসে ছিলেন গোল বারান্দায়। ভাবতে ভাবতে অমৃতার চোখে সুখের একটা আবছা ছায়া পড়ে। কুচিকুচি বৃষ্টির জল ভিজিয়ে দেয় শরীর। অমৃতা টের পায় তার ঠোঁটে এখনো বেঁচে আছে প্রথম চুম্বনের আমেজ। এই আমেজটুকু কখনই হারিয়ে যাবার নয়। ওই একটুখানি সুখ স্মৃতিই নাহয় উদ্বৃত্ত হয়ে থেকে যাক আজীবন।

ভেতরে খুব হৈচৈ হচ্ছে। তারাকে মনের আশ মিটিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে বিভা। বিভার হাতের গুণেই কি না কে জানে, সাজের পর তারাকে অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা এত বেশি কান্নাকাটি করছে, যেকোনো মুহূর্তে পুরো সাজ নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। বিভা ফুলেল মঞ্চের ওপর বসে তারার হাতে মেহেদি লাগিয়ে দিচ্ছে। হৃদি আর মনীষা কার্পেটের ওপর বরের তত্ত্ব সাজাচ্ছে। বেডরুমে আড্ডা দিচ্ছে আকাশ, সামি আর অভিজিৎ। ডালা সাজানোর পালা শেষ হলে হৃদি আর বিভা শাড়ি পরে তৈরি হবে। ফটোসেশন হবে। হবে গান বাজনা এবং খাওয়াদাওয়া। এমন ঝুমঝুম আনন্দের মাঝে তারার ফিচ ফিচ কান্নাটা বাগড়া দিচ্ছে থেকে থেকে। ঝুমকি বারবার সান্ত্বনা দিচ্ছে, ‘সব মেয়েদেরকেই এক সময় শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়। সব ঠিক হয়ে যাবে। এত কান্নাকাটির কিছু নেই। আমরা কাছাকাছিই আছি। যেকোনো সময় চলে আসবি দেখা করতে।’

তারাকে দেখে বিভার নিজের বিয়ের দিনটির কথা মনে পড়ছিল। তার মনটাও এত ভয়ংকর খারাপ ছিল যে চোখের জলে সাজসজ্জার রফাদফা হয়ে গিয়েছিল। তারার হাতে মেহেদী দিতে দিতে বিভা নরম গলায় বলল, ‘জানো, আমার বিয়ের দিনও মন প্রচণ্ড খারাপ ছিল। কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ হবার দশা। তোমার তো কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। আমার বয়ফ্রেন্ড ছিল। বাবা মা সব জেনেশুনেও বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল জোরজার করে। প্রথম কিছুদিন খুব কষ্ট হয়েছিল একথা সত্য। কিন্তু দ্যাখো, এখন আমি কত্ত সুখী! অভিজিৎ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। ভাগ্যিস বাবা মায়ের কথা মেনে নিয়েছিলাম সেই সময়! তুমি দেখো… তোমার ক্ষেত্রেও ঠিক এমনই হবে। প্রথম কয়টা দিন খারাপ লাগবে, কান্না পাবে। তারপর সব ঠিকঠাক।’

তারা ঝাপসা চোখে চেয়ে ছিল বিভার দিকে। মাথাটাও বড্ড ঝাপসা। কোনো চিন্তা স্থির হয়ে থাকছে না। ভাবনাগুলো পদ্মপাতায় জমে থাকা শিশিরের মতো তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে গড়িয়ে পড়ছে নিঃশব্দে। হারিয়ে যাচ্ছে শূন্যে। ফাঁকা মাথায় শুধু বরফের মতো চাকচাক হয়ে জমে আছে অসহ্য যন্ত্রণা। বিভা তারার হাতে মেহেদি দিতে দিতে মিটমিটে হাসি হেসে বলে, ‘বরের নামটা যেন কী? লিখে দেব নাকি?’

তারা মৃদু স্বরে বলে ‘শুধু একটা অক্ষর লিখে দিলেই হবে আপু।’

‘হ্যাঁ… তাই করি। খুব বেশি জায়গাও নেই। কী যেন তোমার বরের নামের প্রথম অক্ষরটা?’

তারা লাজুক গলায় মিষ্টি করে উচ্চারণ করে শব্দটা- ‘র।’

বিভা মনোযোগ দিয়ে লিখে দেয়। বাইরে তখনও বৃষ্টির একটানা ঝরঝর। সদর দরজাটা খোলা। হঠাৎ সেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে আপাদমস্তক ভেজা এক ছিপছিপে লম্বা মানুষ। তারার হৃৎপিণ্ড চলতে চলতে হঠাৎ প্রবলভাবে ব্রেক কষে ফেলে। রুদ্রর চুল থেকে টপটপ করে বেয়ে পড়ে জল। টি-শার্ট লেপটে লেগে থাকে গায়ের সাথে। হৃদি আর মনীষা বিয়ের তত্ত্ব সাজাতে সাজাতে সুর করে গান গায়। ভেতর থেকে আকাশ আর সামির কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। ভেসে আসে হাসির শব্দ। চৌকাঠের সামনে দাঁড়িয়ে অনিমেষ চেয়ে থাকে কন্দ্র শাড়িপরা, গায়ে হলুদের সাজে সজ্জিতা তারার দিকে। চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ জ্বালা করে। শ্বাস ঘন হয়। চার চোখেতে মিলে থাকে আঠাকাঠির মতো। নেশার মতো সুতীব্র ভালোলাগা ছোবল মারে রক্তে। দুজনের মধ্যিখানে একটা অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়। কেউ ওদের লক্ষ্য করে না। সেকেন্ডের কাঁটা এগিয়ে যায় টিকটিক করে। রুদ্র এক সময় ভেজা শরীর নিয়ে কার্পেটের ওপর উঠে আসে সন্তর্পণে। হৃদি আর মনীষাকে ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে যায় মঞ্চের দিকে। বিভার মাথাটা তারার হাতের ওপর ঝুঁকে ছিল। রুদ্রর আগমন টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সে। দেখল রুদ্রর ভেজা চুল, ভেজা শার্ট, কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির জল… দেখল একজোড়া রক্তলাল চোখ… দেখল জ্বরের মতো উৎকণ্ঠা সেই মুখের আনাচেকানাচে! এবার তারা বেশ ভয় পেয়ে গেছে। মুখ রক্তশূণ্য। ঠোঁট শুকনো। হৃদি চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘পুরা কার্পেটটা ভিজিয়ে দিলি তুই। কী অসভ্য!’ রুদ্র হৃদির কথার কোনো প্রত্যুত্তর করে না। অজানা অচেনা দুর্দান্ত অনুভূতির অদ্ভুত প্রলয়ে ভাসতে ভাসতে তারার দিকে চেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর গলায় সে একটা মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে, ‘চলো!’

ঘরে নেমে এল অস্বাভাবিক গা শিউরে ওঠা পিন-পতন নীরবতা। তারা একবার ঝাপসা চোখে চারপাশের মানুষগুলোকে দেখল। সবকিছু অহেতুক, ভিত্তিহীন আর তুচ্ছ বলে মনে হলো তার কাছে। শুধু সামনে দাঁড়ানো মানুষটাই নির্ভুল সত্য। কয়েকটা সেকেন্ড কাটল মাত্র। তারার চোখ থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল কয়েকফোঁটা জল। চট করে বিভার কাছ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল সে। উঠে দাঁড়াল নিঃশব্দে। রুদ্রর দিকে চেয়ে চাপা স্বরে একবার বলল, ‘চলেন!’

ঘরে উপস্থিত মানুষগুলো কোনো কথা বলতে পারছিল না। নির্বাক বোবা চোখে চেয়ে ছিল শুধু।

৫৪

ঝুমকির মুখটা দুশ্চিন্তায় এতটুকু হয়ে গেছে। ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারছে না। তারার মতো শান্ত-শিষ্ট মুখচোরা মেয়ে যে এত বড় অঘটন ঘটাবে তা ভুলেও কখনো চিন্তা করেনি। আর রুদ্রকে সে নিজের সন্তানের মতো মায়া মমতা করেছে। সেই ছেলে দিন শেষে সাপ হয়ে ছোবল কাটবে তা কে জানত! এতক্ষণের আনন্দ উৎসবের জোয়ারে আচমকাই ভাটা নেমে এসেছে। সবার মুখ অন্ধকার। রুদ্র ফোন রিসিভ করছে না। তারা তো মোবাইল ফেলেই বেরিয়ে গেছে। আকাশের মুখটা তেজের আগুনে গনগন করছে। রাক্ষুসে রাগ ঝড় তুলছে তার মাথায়। অস্থির চিত্তে ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পায়চারি করছে। সামি বলল, ‘মাথা ঠান্ডা কর দোস্ত। মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা কর কী করা যায়।

‘চিন্তা করার তো কিছু নাই। রাব্বিকে ফোন করে বলতে হবে কালকের বিয়েটা হচ্ছে না। ব্যস ঝামেলা শেষ।’ অমৃতা সিদ্ধান্ত দিল। আকাশ ফুঁসে উঠে বলল, ‘কোন মুখে লোকটাকে আমি এসব কথা বলব? রুদ্র এইটা কী করল?’

‘রুদ্র তো তোকে বলেছিল বিয়েটা দিস না।’ ঠান্ডাভাবে বলল অমৃতা।

‘এসব ঢং না করে সরাসরি বললেই তো পারত সে তারাকে বিয়ে করতে চায়।’ আকাশের কণ্ঠে বারুদ ঝলসে ওঠে। সামি বলল, ‘ও নিজেও বুঝতে পারে নাই। তুই আসলে বিয়ে নিয়ে তাড়াহুড়া না করলে পারতি।’

আকাশ ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘তোমরা একটা বিষয় বুঝতেছ না বিয়ের সিদ্ধান্ত ছিল ওর খালার। রুদ্র যদি সিরিয়াসলি বলত যে, সে মেয়েটাকে পছন্দ করে তাহলে তো এসব ঝামেলা হইত না। সে বলল না কেন? এখন আমাকে এতবড় একটা ঝামেলায় ফেলায় দিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। কোন দেশি ফাইজলামি এইগুলা?’

আকাশ সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছিল। হৃদি আর বিভা কচুপানা মুখে বসে আছে বিছানার ওপর জবুথবু হয়ে। অমৃতার মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা। সেই হাসি দেখে হৃদি ব্যথিত স্বরে বলল, ‘তুই হাসতেছিস ক্যান? কোন জিনিসটা দেইখা তোর হাসি পাইতেছে?’

অমৃতা বলল, ‘রুদ্রর সাহস আমাকে মুগ্ধ করেছে।’ একটু থেমে সে হৃদির চোখে সরাসরি তাকিয়ে অবিচল গলায় বলল, ‘কেন হৃদি? তোর কি কিছু মনে পড়ে না? তুইও তো সামির বিয়ের ঠিক আগের দিন হাওয়া হয়ে গেছিলি। তোদের তো এটলিস্ট রুদ্রকে বোঝা উচিত!’

হৃদির মুখটা ঝুপ করে কালো হয়ে গেল। থমথমে গলায় বলল, ‘রুদ্রকে বুঝতেছি না এটা কে বলল? কথা হচ্ছে রুদ্র একটা পাগল। পাগল বলেই ওর ওপর ভরসা হয় না।’

অমৃতা ব্যঙ্গের হাসি হাসল ‘আমরা সবাইই কম-বেশি পাগল আছি। তোরা যে তানিশাকে ধোঁকা দিয়ে বিয়ের আগের দিন পালায় গেছিলি, সেটা কি পাগলামো নয়? বিভা যে বিয়ের পরেও দিনের পর দিন প্রেম করত অভিজিতের চোখে ধুলো দিয়ে, সেটা কি পাগলামো নয়? অপরাধ নয়?’

ভাগ্যিস অভিজিৎ আশেপাশে নেই। বিভা চাপা গলায় বলল, ‘আহ… থাক না অমৃতা! পেছনের কথা বলে কী লাভ?’

অমৃতা আগের মতোই পরিষ্কার কণ্ঠে বলল, ‘ফেলে আসা দিনের অভিজ্ঞতাই আমাদের বর্তমানকে সহজ করে তোলে। তোরা নিজেরা যখন পালায় বিয়ে করিস, লোক ঠকাস, তখন কিছু হয় না। অন্যেরা করলে সেটা মস্ত দোষ। আজিব!… যাই হোক, আই অ্যাম হ্যাপি ফর রুদ্র। আমি কখনই চাই নাই ওর ভাগ্যটাও আমার মতো হোক।’

শেষের কথাটা ভুলবশত বলে ফেলায় একটু অপ্রস্তুত হলো অমৃতা। চকিতে একবার তাকাল সামির দিকে। সামি তীক্ষ্ণ চোখে ওকেই দেখছিল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *