স্বপ্নের বৃষ্টিমহল – ৫

সামি বাড়ি ফিরল একশ’ চার ডিগ্রি জ্বর নিয়ে। চোখে রক্তের লাল। মুখের চামড়া সাদা। দেখামাত্র বোঝা যাচ্ছে একটা বিশাল ঝড় বয়ে গেছে ওর ওপর দিয়ে। হৃদির অবস্থাও শোচনীয়। কাঁদতে কাঁদতে চোখের কোল ফুলে বেলুনের মতো হয়েছে। গতিবিধি অসংলগ্ন। রোমেলা হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন ছেলের দুর্দশা দেখে। সামি সকাল থেকে অভুক্ত। শরীর এখন শক্তির উৎস খুঁজে চলেছে। কিন্তু শত প্রচেষ্টায়ও তাকে কিছু খাওয়ানো গেলো না। অল্প একটু ভাত মুখে তুলতেই গলগল করে বমি করে দিল। বাড়িতে ডাক্তার এল। রক্তপরীক্ষা করা হলো। জানা গেল শরীরে পটাশিয়ামের ঘাটতি আছে। সাপ্লিমেন্ট আবশ্যক। স্বাভাবিক নিয়মে খাদ্য গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না বিধায় বাড়িতেই স্যালাইনের নল লাগানোর ব্যবস্থা করা হলো। এদিকে হৃদিরও দিনটা একরকম অনশনেই কেটে গেছে। পেটে দানাপানি কিছুই পড়েনি। দুর্বলতার দরুন হাত পা কাঁপছে। মাথা ভোঁভোঁ করছে। চোখের সামনে ভাসছে সর্ষে ফুল। রুচির অভাববোধ করলেও সে জোর করে ভাত খেয়ে নিচ্ছিল মুরগির মাংস দিয়ে। রোমেলা ঠিক তখনই কটূক্তিটা ছুড়ে দিলেন তীরের মতো, ‘খাও খাও… তোমরাই খেয়ে পরে বেঁচে থাকো। আমার ছেলেটাকে তো শেষ করে দিলে সবাই মিলে। এখন যত পারো খেয়ে নাও, আমোদ ফুর্তি করো।’ হৃদির মুখের সামনে ভাতের গ্রাস থেমে গেলো। জীবনে এই প্রথম কেউ তাকে খাবার নিয়ে খোঁটা দিল। লাঞ্ছনার প্রবল জখমে যেন দুই টুকরা হয়ে গেলো ভেতরটা। যন্ত্রণার সুস্পষ্ট চিহ্ন ফুটে উঠল মুখে। কিন্তু হৃদির চোখে এই মুহূর্তে জল এল না। জ্বলে উঠল অগ্নি শিখা। গর্জে উঠে বলল, ‘আপনার ছেলের সর্বনাশ আমরা করিনি। আপনি নিজে করেছেন।’

রোমেলা হিংস্র চোখে তাকালেন হৃদির দিকে। নিতান্তই মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ এক মেয়ের স্পর্ধা দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললেন, ‘কী বলতে চাইছ তুমি? আমি আমার নিজের ছেলের সর্বনাশ করেছি? এত বড় কথা বলার সাহস হয় কী করে তোমার?’

হৃদি খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘সামিকে এসব জানানোর কী দরকার ছিল? চিঠিটা কেন দেখালেন আপনি? ওকে এসব বিষয় না জানালে আপনার পেটের ভাত হজম হচ্ছিল না?’

রোমেলার কোঁকড়ানো চুলগুলো আলুথালু হয়ে আছে। ফর্সা মুখে মরিচের ঝাঁজ। ক্রোধের দাপাদাপিতে যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে চোখ।

‘এর মানে তুমি বলতে চাইছ আমার উচিত ছিল পুরো ঘটনা চেপে গিয়ে এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া? যেভাবে তোমরা দিয়েছ?’

‘আমি বলতে চাইছি আপনার উচিত ছিল সঠিক সময়ের অপেক্ষা করা। আপনার উচিত ছিল ছেলেকে না জানিয়ে আগে নিজের হাসবেন্ডের সাথে বোঝাপড়া করা। অমৃতা বলেছিল সরে দাঁড়াবে। সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু আপনি তাকে সেই সুযোগটা দেননি। তাকে, আমাকে, আমাদের পুরো ফ্রেন্ড সার্কেলকে, এমনকি নিজের স্বামীকে অপমান করাই আপনার এক এবং অভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। আপনি এসব নাটকের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পান। আপনি ভেবেছিলেন এসব করে জিতে যাবেন। কিন্তু এই যুদ্ধে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে আপনার, আমার এবং এই ফ্যামিলির। সত্যি আপনার মতো বোকা মহিলা আমি আমার জীবনে আর দেখিনি। আমি এতকাল নিজেকে সবচেয়ে বোকা ভাবতাম। কিন্তু এখন দেখছি আপনি আমার চাইতেও বোকা।’

বিভীষণ রাগের দাপটে রোমেলার শ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। রক্তে বিষের ছোবল টের পাচ্ছেন তিনি। তার ইচ্ছে করছে মেয়েটার গালে ঠাশ করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। চুলের মুঠি ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারছেন না। নড়তে পারছেন না। মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারছেন না। অসম্ভব দুর্বলবোধ করছেন। মনে হচ্ছে আরেকটু হলেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। ডাইনিং টেবিল সংলগ্ন চেয়ারের পিঠ শক্ত করে চেপে ধরে তিনি শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করলেন। ক্রোধ প্রকাশ করতে গিয়েও কেন যেন একটু নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। ভাঙা গলায় বললেন, ‘সত্য সামনে আসতেই হতো। একদিন-না-একদিন সামি জেনে যেত সবকিছু। অনেক বছরের পুরনো স্বামী যখন প্রতারণা করে, তখন কোনো স্ত্রীরই মাথা ঠিক থাকে না। আমার যা ভালো মনে হয়েছে তাইই করেছি। তুমি নিজে যদি কখনো এমন সমস্যার সম্মুখীন হও, তবেই বুঝবে আমার ওপর দিয়ে কী গেছে।’

হৃদি চেয়ারের ওপর হতাশভাবে বসে পড়ে বলল, ‘কাজটা করার আগে একবার আমার সাথে আলাপ করে নিলে পারতেন। হয়ত সামিকে জানানোর এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় বের করতে পারতাম। এমন একটা উপায় যাতে ও কষ্ট কম পায়। আপনি বুঝতেই পারছেন না যে, অমৃতা আমার বন্ধু একথা ঠিক, কিন্তু আপনি আমার ফ্যামিলি। আমার নিজের মায়ের সাথে এমনটা হলে আমি যেমন মেনে নিতে পারতাম না ঠিক তেমনি এখনো মেনে নিতে পারছি না।’

রোমেলা কাঠ কাঠ গলায় বললেন, ‘তোমার চাওয়া-না-চাওয়ায় কিছু এসে যায় না। নিজেকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবছ কেন?’

‘এটাই তো আপনার মূল সমস্যা। অন্যের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আপনি কখনই মাথা ঘামান না। অথচ বাবাকে দেখেছি সব সময় অন্যকে নিয়ে ভাবতে। নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে হলেও তিনি অন্যের উপকার করেন।’

‘বেশ তো! তাহলে বরং এক কাজ করো। তোমার পরোপকারী শ্বশুরকে তোমার মহৎ রূপসী বান্ধবীর সাথে বিয়ে দিয়ে দাও। তারপর শান্তিতে সংসার করো সবাই মিলে। আমাকে বিষ-টিষ কিছু একটা দিয়ে মেরে ফেলো। আমি মরে গেলেই তোমাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’

হৃদি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে স্খলিত পায়ে এগিয়ে গেলো শাশুড়ির দিকে। কাঁধে একটা হাত রেখে নরম স্বরে বলল, ‘মা! আপনি আমাকে ভুল বুঝে আসছেন সেই প্রথম থেকে। আমি কিন্তু আপনার শত্রুপক্ষ নই। আমি শুধু চেয়েছিলাম সামি যেন কিছু জানতে না পারে। আমি আপনার কষ্টটা বুঝি। বাবা অনেক বড় ভুল করেছেন। এই ভুলের কোনো ক্ষমা হয় না। তবুও আমি বলব আপনি সামির দিকে চেয়ে, এই পরিবারের দিকে চেয়ে একটু ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিন। আমার বিশ্বাস বাবা খুব শীঘ্রই আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন।

রোমেলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তার ঠোঁট কাঁপছে থরথর করে। বুকে উথালপাতাল ঢেউ ভাঙছে কান্না। হৃদি কি এই প্রথমবারের মতো তাকে মা বলে সম্বোধন করল? আগে কখনো এভাবে ডেকেছে বলে তো মনে পড়ে না! সারাদিন নিঃসঙ্গ বন্দি বাড়িতে একা একা দগ্ধ হয়েছে তার হৃদয়। আত্মীয়-স্বজনদের কানে এই খবর গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ঘটনা চেপে যেতে হবে। কিন্তু একা একা এত বড় বিপদ সয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। দিন শেষে মেয়েটি যখন পাশে এসে দাঁড়ালো, মা বলে ডাকল, তখন মনে হলো যেন নিঃসঙ্গতার ভার অনেক খানি ঘুচে গেছে। তিনি অশ্রুরুদ্ধ স্বরে বললেন,

‘সে ফিরে আসলেই যে তাকে আমি গ্রহণ করব, এমনটা কেন ভাবছ? আমার নিজেরও তো আলাদা সিদ্ধান্ত থাকতে পারে। পারে না?’

হৃদি একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে বলল, ‘আপনার যেকোনো সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান করব। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রাখবেন, সামি আপনাদের দুজনকে পাশাপাশি দেখতে চায়। নিজেদের সুখের জন্য ওর মনটা ভেঙে দিয়েন না প্লিজ!’

একজন গৃহকর্মী এসে রোমেলাকে বলল, ‘ম্যাডাম ছোট স্যারে আপনারে খুঁজতেছে।’

রোমেলা কথাটা শোনামাত্র তড়িঘড়ি করে দোতলায় ছুটে গেলেন। হৃদিও অনুসরণ করল শাশুড়িকে। সামির লম্বা চওড়া শরীরটা নেতিয়ে আছে বিছানার ওপর। ডান হাতের কব্জির শিরায় স্যালাইনের সূচ লাগানো। চোখ দুটো আধবোজা। রোমেলা এগিয়ে এসে ছেলের পাশে বসলেন। সামি মায়ের একটা হাত ধরে মৃদু স্বরে বলল, ‘কেমন আছ মা?’

রোমেলা উত্তর দিতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন, ‘আমি ভালো আছি বাবা। আমাকে নিয়ে তোমাকে একদম ভাবতে হবে না। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠ।’

হৃদি বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর দিকে চোখ পড়ামাত্র সামির মুখটা রাগের চোটে বিকৃত হয়ে উঠল। মায়ের দিকে চেয়ে বজ্রগম্ভীর গলায়

বলল, ‘মা, ওকে বলো আমার সামনে থেকে চলে যেতে। আজকের পর থেকে ওর সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই।’

হৃদি কথাটা শুনতে পেয়েছে স্পষ্টভাবে। শোনার পর তার মুখ চোখের ভঙ্গি বদলে গেছে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো তার একটুও কষ্ট হচ্ছে না, কান্না পাচ্ছে না, বরং সারা গায়ে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে লক্ষ্মীছাড়া ক্রোধ। সে পাগলের মতো চেঁচিয়ে বলল, ‘যা বলার আমাকে বল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল। উনাকে বলছিস কেন?’

রোমেলা একটু বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘আহ চিৎকার করো না। ছেলেটা অসুস্থ।’

সামি হৃদির দিকে তাকাল না। চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিল তারপর শীতল… খুব শীতল গলায় বলল, ‘যা বলার একবারই বলেছি। আজ থেকে আমার স্ত্রী নেই, বন্ধু নেই, এমনকি বাবাও নেই!’ একটু থেমে সে নিরুত্তাপভাবে পূর্বের কথাগুলোর সাথে যোগ করল আরো একটি বাক্য, ‘মা, ওকে বলো এই বাড়ি থেকে এখুনি চলে যেতে। রাইট নাও। আই নেভার ওয়ান্ট টু সি হার ফেস এগেইন।’

হৃদি আর এক মুহূর্ত ব্যয় না করে ঝড়ের বেগে ঘুরে দাঁড়ালো। ক্লজেট থেকে একগাদা কাপড় বের করে নিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে পুরে নিতে লাগল ব্যাগে। রোমেলা উঠে দাঁড়ালেন, ‘কী করছ?’

হৃদি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আর এক সেকেন্ডও এখানে থাকব না আমি!’

রোমেলা কী বলবেন খুঁজে পেলেন না। বেচারী মেয়েটির জন্য করুণা হচ্ছে একথা ঠিক, তবে তার তামাশাপ্রিয় মন এই ঘটনায় কোথায় যেন একটু টনটনে বিনোদনও খুঁজে পাচ্ছেন। খুব তো বড় গলায় বলেছিল, সামি কোনোদিন আমাকে ওর জীবন থেকে তাড়িয়ে দেবে না। এখন কী হলো? রোমেলার মুখের কথাই তো সত্য হলো, নাকি? যাক, সারাদিনে অন্তত একটি মনের মতো ঘটনা ঘটল! তিনি ভেতরকার গোপন আনন্দ আড়াল করার চেষ্টা করে মেকী গলায় বললেন, ‘এত রাতে কোথাও যাবার প্রয়োজন নেই। কাল সকালে যেও।’

হৃদি দৃঢ় চিত্তে ঘোষণা দিল, ‘যেতে হলে আজ এই মুহূর্তেই যাব!’

হৃদির প্রস্থানের পর ক্ষণকাল ক্ষেপণের আগেই রাশেদ বাড়ি ফিরলেন। মুখের চামড়ায় অসন্তোষের সুস্পষ্ট কুঞ্চন। চোখে নেমে এসেছে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের আকাশের মতো ঘন ঘোর অন্ধকার। রোমেলা লিভিং রুমের সোফায় বসেছিলেন। চোখে চোখ পড়ল দুজনের। কয়েকটা শীতল, শ্লথ সেকেন্ড কেটে যাবার পর রাশেদ নিঃশব্দে এগিয়ে এসে বসলেন সোফার ওপর। পা থেকে জুতো খুলে নিলেন। গৃহকর্মী শরবতের গ্লাস নিয়ে দৌড়ে এল। রাশেদ ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘পানি দাও। ঠান্ডা পানি।’

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই গৃহকর্মী ফিরে এল আবার। রাশেদ এক চুমুকে প্রায় এক গ্লাস পানি পান করে ফেললেন। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে স্ত্রীর দিকে চেয়ে গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘সামি কেমন আছে?’

‘শরীর ভালো না। টেম্পারেচার অনেক হাই ছিল। বাড়িতে ডাক্তার ডাকতে হয়েছে। এখন স্যালাইন চলছে।

রাশেদের মুখে দুশ্চিন্তার প্রলেপ পড়ল। একটু সময় চুপ করে কী যেন ভাবলেন তিনি। তারপর উঠে দাঁড়ালেন ব্যস্তভাবে। রোমেলা বললেন, ‘ছেলের সাথে কথা বলতে যাবার চেষ্টা করো না। তার মানসিক অবস্থা ভালো না। তোমাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে যাবে। শরীর আরো বেশি খারাপ করবে।’

‘বউমা কোথায়?’

প্রশ্নটা শোনামাত্র রোমেলার চোখে চাপা একটা রসিক আভা ঝিলিক দিল, ‘তোমার বউমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে তোমার ছেলে!’

‘তাড়িয়ে দিয়েছে?’

‘হ্যাঁ তাড়িয়েই দিয়েছে।’

‘কেন?’

রোমেলা ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘সেই প্রশ্নের উত্তর তো আমার কাছে নেই। আমি শুধু ছেলেকে বলতে শুনলাম আজকের পর থেকে তার কোনো স্ত্রী নেই, বন্ধু নেই, এমনকি বাবাও নেই!’

রাশেদ বিস্ময়বিদ্ধ ব্যথিত চোখে সম্মুখে দাঁড়ানো মাঝবয়সী রমণীটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হৃৎপিণ্ডে চাবুকের ঘা পড়তে লাগল অনবরত। হৃদয়বিদারক কথাগুলো কত অনায়াসেই না বলে ফেললেন রোমেলা। বলার আগে বুক কাঁপল না একবার? রাশেদ অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘এই কথা বলেছে সামি?’

‘হ্যাঁ বলেছে।’

রাশেদ নিঃস্ব মানুষের মতো বিমর্ষ ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। দেখে মনে হচ্ছিল এইমাত্র তার কাছ থেকে জীবনের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নেয়া হয়েছে। তিনি আর একটা কথাও না বলে প্রস্থানের জন্য পা বাড়ালেন। রোমেলার কণ্ঠস্বর ভেসে এল পেছন থেকে,

‘তোমার গার্লফ্রেন্ডের কী খবর? বেঁচে আছে?’

রাশেদ থমকে দাঁড়ালেন। ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে উঠল নিমেষে। চোখে ঝিলিক দিল তেজের অশনি। ঘুরে দাঁড়িয়ে রোমেলার দিকে ক্রূর চোখে তাকালেন তিনি। বরফ শীতল কণ্ঠে বললেন, ‘কাজটা তুমি ঠিক করোনি।’

‘আমার তো সব কাজই ভুল। তা এখন তুমি কোন কাজটির কথা বলছ?’

‘সামিকে বিষয়টা জানাতে নিষেধ করেছিলাম!’

রোমেলা বিদ্রূপের হাসি হেসে উঠলেন, ‘না জানালে যে তোমার খুব সুবিধা হতো তা কি আর আমি বুঝি না? আমার চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করতে চেয়েছিলে। সেই পরিকল্পনা সার্থক হলো না বলেই এখন মাথা খারাপ হয়ে গেছে তাই না? ছি! ভাবতেও লজ্জা করে আমার।’

‘সমস্যাটা অন্যভাবেও সমাধান করা যেত।’

রোমেলা হঠাৎ তীব্র চিৎকারে ফেটে পড়লেন, ‘এই সমস্যার কোনো সমাধান নেই! আমার ছেলেকে আমার জীবন সম্পর্কে জানানোর শতভাগ অধিকার আমার আছে। যে বাবাকে সে অন্ধের মতো ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, সেই বাবার আসল কদর্য রূপ একদিন-না-একদিন তার সামনে আসতেই হতো। সত্য কখনো চাপা থাকে না।’ রাশেদ তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থেকে কথাগুলো শুনলেন। বড় একটা শ্বাস ফেলে ধীরস্থির অথচ দৃঢ় গলায় বললেন, ‘ঠিক আছে। মেনে নিলাম আমি খারাপ, কদর্য এবং কলুষিত। তুমি ছেলের সামনে আমার কদর্যতা তুলে ধরে মহৎ কাজ করেছ। তুমি মহান! এবার তবে তোমার ছেলেকে তুমি সামলাও। আমি তো আদর্শ পিতা হতে পারিনি। আমি ব্যর্থ। তুমি তোমার মহৎ মাতৃত্ব দিয়ে ছেলেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনো। উইশ ইউ অল দ্যা বেস্ট!’

পরের সপ্তাহটা কেটে গেল ঝড়ের বেগে। অমৃতা মোটামুটি ধাতস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। আকাশ পুরনো চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে দেশের নামকরা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেতনের অঙ্ক বেশ ভালো। হৃদি সেদিনের পর থেকে আর একটিবারের জন্যও শ্বশুরবাড়ি যায়নি। শ্বশুরবাড়ির কেউ তার খোঁজখবর নেয়নি। একদিন শুধু শ্বশুরমশাই ফোন করে অনেকটা সময় আলাপ করেছিলেন। সামির সাথে বন্ধুরা কেউ এর মাঝে যোগাযোগ করতে পারেনি। রুদ্র আর আকাশ একাধিকবার তার বাড়িতে গিয়ে হানা দিয়েছে। সামি দেখা করেনি। বিভার শাশুড়ির হার্টে রিং পরানো হয়েছে। আপাতত বিভা কলকাতায়ই অবস্থান করছে শ্বশুরবাড়িতে। অভিজিৎ ফিরে গেছে জলপাইগুড়ি। তার ছুটি ফুরিয়ে এসেছিল। এদিকে রুদ্রর বিদেশ যাবার দিনক্ষণ এগিয়ে আসছে। মাঝে বেশ কিছুদিন সে সামির বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে ছিল। কিন্তু এখন সামি পুরো বন্ধুমহলকে অগ্রাহ্য করছে। হৃদিও শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করেছে। অতএব রুদ্রকে বাধ্য হয়ে ওই বাসস্থান ছাড়তে হলো। ঠিক করেছে অমৃতা সুস্থ হলেই চট্টগ্রাম ফিরে যাবে। বিদেশ যাবার আগের কয়টা দিন পরিবারের সদস্যদের সাথে কাটাতে চায় সে। আপাতত আকাশের বাসায় আছে। সমস্যা হলো আকাশের বাসাটা অতিরিক্ত ছোট। দুটো মাত্র বেডরুম। মাস্টার বেডরুম বাবা আর ঝুমকির দখলে। ড্রয়িংরুমে ঘুমোয় তারা। আকাশের শোবার ঘরে একটা মাত্র সিঙ্গেল খাট। ওই একটা খাট আর মাঝারি আকারের পড়ার টেবিলেই পুরো ঘর ভরে গেছে। খাটের পাশের একরত্তি মেঝেতে পাটি বিছিয়ে ঘুমায় রুদ্র

হৃদিকে নিয়ে সকালের দিকে বঙ্গবাজার গিয়েছিল রুদ্র গরম কাপড় কেনার উদ্দেশ্যে। অন্য কিছু না হলেও আমেরিকা যাবার সময় অন্তত কয়েক সেট প্যান্ট, শার্ট আর জ্যাকেট, সোয়েটার সাথে করে নিয়ে যেতে হবে। যে কাপড় এখানে পাঁচশ টাকায় পাওয়া যাবে সেটাই আমেরিকায় হয়ত জেসিপেনি থেকে কিনতে হবে পঞ্চাশ ডলারে। কাপড়ের গায়ে স্পষ্টভাবে লেখা থাকবে মেড ইন বাংলাদেশ। নিজের দেশের পণ্য বিদেশ থেকে অতিরিক্ত দাম দিয়ে কেনার কোনো মানে হয় না।

বাজারে ঢোকার আগেই হৃদি খুব গুরুত্বপূর্ণ গলায় বলেছে, ‘কিছু পছন্দ হইলে তুই শুধু বলবি। দাম ঠিক করার দায়িত্ব আমার।

‘বুঝলাম। কিন্তু দাম দেওয়ার দায়িত্বটা কার?’

‘ঐটা তোর দায়িত্ব। অতটুকুও করতে পারবি না? শালা মদন কোথাকার! দামাদামি করাটাই হচ্ছে আসল কাজ। আসল কাজটাই তো আমি করে দিচ্ছি। তুই শুধু টাকা দিবি। ইজি হিসাব। আর দাম করার সময় একটা কথাও বলবি না। টু শব্দ করলে ঘুষি খাবি।’

অতএব দরদাম-যজ্ঞ পালন করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা বুকে নিয়ে হৃদি বাজারে পদার্পণ করল। চারিদিকে হৈ-হট্টগোল। শীতকাল আসতে এখনো দু তিন মাস দেরি আছে, তবুও শীতের কাপড়ের এই হোলসেল মার্কেটে উপচে পড়া ভিড়। গরমটা একেবারে ভ্যাপসা। মনে হয় যেন উনুনের আঁচে দগ্ধ হচ্ছে পৃথিবী। দরদর করে ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে। গায়ের চামড়া তৈলাক্ত এবং আঠা-আঠা। প্রথমে রুদ্রর একটা কালো রঙের লেদারের জ্যাকেট পছন্দ হলো। ভর গ্রীষ্মের দুপুরে ঘাম জবজবে শরীরে বহুত কষ্ট করেই জ্যাকেটটা গায়ে চড়াল সে। একরত্তি দোকানটার কাপড়ের স্তূপের সামনে ছোট একটা টুলে বসে ছিল হৃদি। তার পরনে ঘিয়া রঙের পাকিস্তানি লোন কাপড়ের সালওয়ার কামিজ। শিফনের ওড়না। পিঠের ওপর হৃষ্টপুষ্ট একখানা বিনুনি। চোখের কোলে কাজলের গাঢ় রেখা। কয়েকটা চুল ঘামে লেপটে আছে কপালের সাথে। রুদ্র জ্যাকেট পরে হৃদির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘কেমন?’

‘সত্যি বলব নাকি মিথ্যা?’

‘আজিব! মিথ্যা বলবি ক্যান?’

‘কার্টুনের মতো লাগতেছে।’

অল্পবয়সী দোকানদার ফোঁড়ন কেটে বলল, ‘কী কন আপা। ভাইরে তো খুব মানাইছে জ্যাকেটটা।’

এই দোকানে কোনো আয়না নেই। রুদ্র বুঝতে পারছিল না নিজেকে আসলে কেমন দেখাচ্ছে। অতি করুণ স্বরে একরাশ বিভ্রান্তি নিয়ে সে হৃদিকে বলল, ‘ঠিক করে বল, সত্যিই কার্টুন লাগতেছে?’

‘কার্টুনকে তো কার্টুনের মতোই লাগবে, মানুষের মতো লাগার কি কোনো চান্স আছে? যাই হোক তোর পছন্দ হইছে নাকি বল।’

রুদ্র মিনমিন করে বলল, ‘আমার তো ভালোই লাগতেছে।’

হৃদি ঝানু উকিলের মতো ওপর নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা… দেখতেছি ব্যাপারটা!’

কথাটা বলেই সে মহাউদ্যমে উঠে দাঁড়ালো। জ্যাকেটের কাপড়টা আঙুল দিয়ে ধরে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করল কয়েক সেকেন্ড। ভারিক্কি স্বরে বলল, ‘কোথাকার প্রোডাক্ট এটা?’

‘প্রোডাক্ট তো আপা মেড ইন বাংলাদেশ।’ দোকানদার ছোকরাটা উত্তর দিল।

‘হুম… দাম কত?’ হেডমিস্ট্রেসের মতো ধমক দেয়ার সুরে প্রশ্ন করে হৃদি। রুদ্র ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। মুখে একটা গোবেচারা ভাব। চুলে ঝুঁটি। পরনে হাফস্লিভ পাতলা টিশার্ট আর হাফ প্যান্ট।

দোকানদার ছেলেটা পেশাদারী গলায় বলল, ‘দাম চাইলে চাওয়াই যায় ইচ্ছা মতন। কিন্তু আমি যেমন তেমন দাম বলব না আপনারে। আপনাদের মতো মানুষের সাথে দামাদামি চলে না। একদাম আড়াই হাজার টাকা।’ মুখের কথা পুরোপুরি বলে শেষ করার আগেই জ্যাকেটটা অন্য এক কর্মচারীর দিকে ছুড়ে মেরে ছেলেটা আদেশসূচক গলায় বলল, ‘এইটা প্যাকেট কইরা দে আপারে।’ হৃদি হুঙ্কার ছাড়ল। এমনভাবে হুঙ্কার ছাড়ল যেন কেউ ভিড়ের মধ্যে তার ব্যাগ ছিনতাই করে পালিয়ে যাচ্ছে।

‘আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান! আড়াই হাজার মানে? আড়াই হাজার দিয়ে জ্যাকেট কিনতে হইলে তো আমি আর্টিসানেই যাইতে পারতাম। এত কষ্ট করে গরমের মধ্যে বঙ্গবাজার আসছি কেন?

হৃদির হুংকারে আশেপাশের লোকজন চমকে উঠল। একজন যুবক বয়সী চশমাপরা বোকা চেহারার ক্রেতা রুদ্রর পাশে দাঁড়িয়ে কাপড় বেছে নিচ্ছিল। হৃদির আকস্মিক চিৎকারে তার হাত থেকে স্মার্ট ফোন পড়ে গেল। রুদ্র বিনয়ের সাথে ফোনটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে ছেলেটার কাছে ফিরিয়ে দিল। পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনার গলায় অনেকটা ফিসফিস করে বলল, ‘ভয় পাইছেন ভাই? ভয় পায়েন না। এই মহিলা এমনেই চিল্লায় সারাদিন। মাথায় ডিস্টিং আছে।’ ছেলেটা রুদ্রর কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারল না। হাঁ করে চেয়ে রইল। দোকানদার ছোকরা ধমক শুনে অল্পবিস্তর থতোমতো খেয়ে গেছে। তবে তার চেহারার চোয়াড়ে ভাবটা বলছে এসব ধমকে সে অভ্যস্ত। কালচে গালের কালচে দাড়িতে হাত বুলিয়ে মেকী হাসতে হাসতে সে তেলবাজি গলায় বলল, ‘আপনার কাছে বেশি দাম চাই নাই আপা। একদম ঠিকটাই চাইছি।’

হৃদি দাঁতমুখ খিঁচে বলল, ‘এই জ্যাকেটের দাম আড়াই হাজার টাকা? বোকা পাইছেন আমাকে? চুলে ঝুঁটিঅলা, হাফপ্যান্ট পরা পাংকু ফ্রেন্ড সঙ্গে নিয়া আসছি দেখে মনে করছেন বাজারের হালচাল কিছু বুঝি না?’

রুদ্র মুখ বেজার করে নিজের পরনের হাফপ্যান্টের দিকে একবার চাইল। চুলের ঝুঁটিতে হাত রাখল। নিজেকে আর যাই হোক পাংকু ভাবতে তার ভালো লাগে না। সে একজন গাতক। এভাবে তুচ্ছতার সাথে ‘পাংকু’ সম্বোধন না করে হৃদি তাকে গায়ক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেও পারত! ভ্রু-কুঁচকে বান্ধবীর দিকে তাকালো সে। এর মাথাটা কি পুরোপুরিই গেছে? এমনভাবে দরদাম করছে যেন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটা। কোমরে হাত। মুখ কঠোর। চোখ জুলজুল করছে হিংস্র চাপা উত্তেজনায়। রুদ্র ওর কানের কাছে মুখ নামিয়ে আস্তে করে বলল, ‘থাক দোস্ত। বাদ দে। অন্য দোকানে চল।’

হৃদির ভ্রু উঁচুতে উঠে গেল।

‘বাদ দিব মানে? এই জ্যাকেট আমি কিনবই আজকে। তুই চুপ করে বসে থাক। একটা কথাও বলবি না।’

রুদ্র ধমক খেয়ে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে রইল স্ট্যাচু হয়ে। হৃদি কোমর বেঁধে দরদাম করতে লাগল। দোকানদার বলল, ‘আচ্ছা দুই হাজার দ্যান।’

হৃদি পাথুরে মুখে ঘোষণা দিল, ‘পাঁচশ দিব।’

রুদ্র ভয়ে ভয়ে দোকানদারের দিকে চাইল। এই বুঝি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। দুই হাজারের প্রোডাক্ট কোন আক্কেলে পাঁচশ টাকায় কিনতে চায় হৃদি? ওর কি লজ্জা-শরম বলতে কিছু নাই? কিন্তু রুদ্রকে অবাক করে দিয়ে দোকানি ছেলেটা রাগ করার বদলে তেলমাখা হাসি হেসে গদগদ গলায় বলল, ‘শেষ কথা। এক হাজার দিয়েন আপা। বসেন বসেন। আর কী লাগবে?

‘এক হাজার হবে না ভাই। পাঁচশ দিলে দ্যান, নইলে যাচ্ছি।’

‘আরে আপা এত তাড়া কীসের? বসেন বসেন। বসে কথা বলেন।’

ছোকরাকে দেখে মনে হলো হৃদিকে বসাতে না পারলে আজকে তার চাকরিই থাকবে না। হৃদি টুলের ওপর বসে পায়ের ওপর পা তুলে দিল I ভারিক্কি গলায় বলল, ‘পাঁচশ হবে?’

‘এক হাজার।

‘পাঁচশ।’

‘আচ্ছা নয়শ দিয়েন।

‘পাঁচশর এক টাকাও বেশি হবে না।’

‘সাড়ে আটশ।’

‘পাঁচশ।’

‘এত নিষ্ঠুর হইলে হয় আপা? আর কী লাগবে দ্যাখেন। আমি দাম বেশি রাখব না। ঠকাব না আপনারে।’

হৃদি রুদ্রর দিকে চেয়ে বলল, ‘তুই ভ্যাবদার মতো দাঁড়ায় আছিস কেন? কী কী পছন্দ হয় দ্যাখ। আমি তো দাম ঠিক করে দিচ্ছি।’

রুদ্র ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মন নিয়ে কাপড় দেখতে লাগল। কিছুই আর পছন্দ হচ্ছে না তার। বিরক্ত লাগছে। সেকেন্ড এগিয়ে যাচ্ছে, মিনিট এগিয়ে যাচ্ছে, হৃদির বার্গেনিং শেষ হচ্ছে না। একটা সময় রুদ্র অধৈর্য হয়ে বলল,

‘আমি বাইরে যাই। তুই থাক।’

হৃদি কথাটা শুনল কি না কে জানে! রুদ্র বাইরে বেরিয়ে এল। সিগারেট ধরালো। ঠান্ডা কোক কিনল। গিলল ঢকঢক করে। দশ মিনিট পর ফিরে এসে দেখল কাজ কিছু এগোয়নি। দরদাম প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। রুদ্র থম ধরে দাঁড়িয়ে রইল আরো পাঁচ মিনিট। একটা সময় সাড়ে ছয়শ টাকায় জ্যাকেটটা কিনে হৃদি বিশ্বজয়ের হাসি হাসল। রুদ্রর হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে প্রফুল্ল চিত্তে বলল, ‘নে ধর। এটা তোর গিফট। আমেরিকায় প্রথম স্নোফলের দিন তুই এইটা পরবি। পরে আমার কথা মনে করবি। ভিডিও কল দিয়ে দেখাবি। কেমন?’

রুদ্র ভেতরকার বিরক্তি এবং রাগ হজম করার চেষ্টা করে বলল, ‘এতক্ষণ লাগল একটা জিনিস কিনতে। ড্যাম! মানে তুই একটা চিজ রে ভাই!’

হৃদি দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগল, ‘জিতছি মামা! জিতে গেছি একদম! অনেক দিন পর আঁশ মিটায়ে দামাদামি করলাম। আহ! কী যে ভালো লাগতেছে। মাজা অ্যা গ্যায়া ইয়ার!’

রুদ্রর ভ্রু-কুঁচকে গেল, ‘কী সমস্যা তোর? কয়টা মাত্র টাকার জন্য এতক্ষণ ফকিরের মতো ঝগড়া করলি এখন আবার খ্যাতের মতো হিন্দি বলতেছিস। সব ঠিক আছে তো?’

‘ঠিক মানে? একদম একশ একশ ঠিক। এখন আমারে খাওয়া।’

ফুচকার দোকান দেখিয়ে রুদ্র বলল, ‘চল ফুচকা খাই।’

‘ফুচকা মানে? সকাল থেকে কিছু খাই নাই। খালি পেটে ফুচকা খাইলে গ্যাস্ট্রিক হবে।’

‘তাহলে কী খাবি?’

হৃদি চোখ পিটপিট করে ভেবে বলল, ‘স্টেক খাব।’

ইশ! শখ কত! ছয়শ টাকার গিফট দিয়ে হাজার টাকার স্টেক খাইতে চায়। ঐসব হবে না। তেহারি খাওয়াইতে পারি।’

‘কেন বিদেশি বন্ধুদের সাথে তো ঠিকই গিয়ে স্টেক খাবা। মদ খাবা। পার্টি করবা। আমরা বাঙালি দেখে কি শখ আহ্লাদ নাই? আম্রিকা গিয়া যদি স্টেক খাইতে দেখছি কখনো, থুতু মারব তোর খাবারে দেখিস।’

‘থুতু মাইরা লাভ নাই। তোর থুতু অত দূর পর্যন্ত যাবে না।’

‘আলবৎ যাবে। না গেলে ফেডেক্স কইরা পাঠায় দিমু।’

রুদ্র আড়চোখে তাকাল হৃদির দিকে। তার বন্ধুরা পাগল একথা ঠিক আছে কিন্তু আজকে হৃদির আচরণ অন্যদিনের তুলনায় বেশি অসংলগ্ন। চোখের দৃষ্টি পাগলাটে। পদক্ষেপ এলোমেলো। রাস্তা পার হবার সময় কোনোদিকে না তাকিয়েই সে ব্যস্ত সড়কে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল। রুদ্র তড়িঘড়ি করে হাত টেনে ধরে সামলে নিল। নইলে গাড়ির চাকার নিচে পিষ্ট হতে হতো।

তেহারিঘরে একটা ছোট টেবিলে মুখোমুখি বসল ওরা। খাবার আসতে না আসতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল দুজনে। হৃদি হাপুস-হুপুস করে খাচ্ছিল। এক লোকমা তেহারি মুখে দিচ্ছে আর কাঁচামরিচে কামড় বসাচ্ছে। রুদ্র বলল, ‘আস্তে খা। এত তাড়াহুড়ার কী আছে? খাওয়া কোথাও চইলা যাইতাছে না।

হৃদি কাঁচামরিচে কামড় দিয়ে ঝালে হু হা করতে করতে বলল, ‘কোক দিতে বল। ঠান্ডা কোক।

রুদ্র ওয়েটারকে ডেকে কোক অর্ডার করল। হৃদিকে বলল, ‘তুই এরকম পাগলের মতো করতেছিস ক্যান দোস্ত? প্রব্লেম কী?’

হৃদির চোখ লাল। মরিচের ঝাঁজে জিব ভারী। কোনো রকমে বলল, ‘কী করলাম?’

রুদ্র মুখে গরুর মাংস চিবোতে চিবোতে বলল, ‘তুই আসলে সামিরে মিস করতেছিস। তাই না?’

হৃদির চোখে ক্রোধের বিদ্যুৎ খেলে গেলো।

‘ঐ হারামজাদার নাম নিবি না আমার সামনে। অ্যাসহোল একটা। ওর চ্যাপ্টার ক্লোজ। ওইটা একটা আস্ত কুত্তা।’

চোখভর্তি জল আর ঠোঁটভর্তি ঝাঁজ নিয়ে গগনবিদারী চিৎকারে ফেটে পড়ে কথাগুলো বলল হৃদি। রুদ্র একটু অপ্রস্তুত হলো, ‘আস্তে!’

ওয়েটার কোক নিয়ে এসেছে। হৃদি স্ট্র ঠোঁটে চেপে অনেকটা কোক একসাথে টেনে নিল গলায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘ওই কুত্তা এই এক সপ্তাহে আমারে একটা ফোন পর্যন্ত করে নাই। ওরে আমি মিস করব কোন দুঃখে? আই ডোন্ট গিভ অ্যা ফাক। সে তার মারে কোলে নিয়া বইসা থাকুক। তার মতো ইররেস্পন্সিবল জামাই আমার লাগবে না।’

রুদ্রর মনটা ক্রমেই খারাপ হয়ে যাচ্ছিল হৃদির কথাবার্তা এবং আচার আচরণে। সে ব্যথিত স্বরে বলল,

‘ওর সিচুয়েশনটা একটু বোঝার চেষ্টা কর। বেচারা এতবড় একটা শক খাইছে…’

‘ওর সিচুয়েশনের আমি গুল্লি মারি। ও তো যা করার কইরাই ফেলছে। অমৃতার মাথা ফাটায় দিছে। অমৃতা মইরা গেলে কী হইত? মেয়েটা একটা সপ্তাহ হাসপাতালে ছিল। ওর ফ্যামিলি যে সামির নামে কেস করে নাই এইটাই তো ভাগ্য। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই সমস্ত কিছুর পেছনে আমার তো কোনো হাত নাই। আমি তো অমৃতারে বলি নাই যা আমার শ্বশুরের সাথে গিয়া প্রেম কর। ওদের মনে চাইছে, ওরা প্রেম করছে। আমাকে কেন এর জন্য শাস্তি পাইতে হচ্ছে?’ হৃদির গলা কাঁপতে লাগল। চোখের কোলে ঝাঁপ দিয়ে নামল অশ্রুর ঢল। ঠোঁটে কামড় দিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বলল, ‘তুই জানিস না আমার শাশুড়ির সামনে ও আমারে কীভাবে অপমান করছে সেদিন। বাড়ির কাজের লোকরা পর্যন্ত আমার অবস্থা দেখে উপহাস করছে।’

রুদ্র একটা প্রগাঢ় শ্বাস ফেলে বলল, ‘দোস্ত আমি জানি তুই খুব রাফ একটা সময় পার করতেছিস। একটু ধৈর্য ধর। সামিরেও একটু টাইম দে। আমার মন বলতেছে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

হৃদি ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে ধরা গলায় বলল, ‘কিছুই ঠিক হবে নারে। সামির কাছে ওর মা ছাড়া অন্য কোনো কিছুর মূল্য নাই। এমনকি সে তার বাবাকেও কোনোদিন বুঝতে চায় নাই। দ্যাখ আমি বলতেছি না আমার শ্বশুর কাজটা ঠিক করছে। উনি অবশ্যই অনেক বড় অপরাধ করছে। কিন্তু আমার শাশুড়ির তুলনায় শ্বশুর অনেক বড় মনের মানুষ। দুইজনে কিছুতেই খাপ খায় না। এটা উনাদের প্রথম জীবনেই বোঝা উচিত ছিল। আমি দোস্ত ফার রিচিং চিন্তা-ভাবনা করতেছি ইদানীং। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতেছি। দ্যাখ দুইটা মানুষের মেন্টালিটিতে মিল না থাকলে শুধু শুধু সোসাইটির ভয়ে মিথ্যা সংসার করার কোনো মানে হয় না। এইযে দ্যাখ আমি একটা সপ্তাহ বাপের বাড়ি আছি, আব্বা আম্মা থেকে শুরু কইরা খালা চাচারাও প্রতিদিন আস্ক করতেছে, জামাই ফোন দিছিল? জামাই কী বলে? তোমারে নিতে আসবে কবে? এমন সিচুয়েশনে হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় রাগ অভিমান ভুলে আজকেই চলে যাই শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু এভাবে গেলে আমার সেলফ রেস্পেক্ট এর কী হবে? আমি তো নিজের কাছেই নিজে ছোট হয়ে যাব! দোস্ত আমি ঠিক করছি, সামি নিজের ভুল না বুঝলে কোনোদিন ঐ বাড়িতে ফিরে যাব না। ওর এভাবে আমাকে অপমান করা উচিত হয় নাই। ওর মা তো মনে মনে খুশি হইছে। আমি ঐ মহিলারে চিনি!’

‘আমার মনে হয় তোর সামিকে একটু বোঝা উচিত। অন্য কোনো মেয়ে হইলে একটা কথা ছিল। নিজের ফ্রেন্ডের সাথে নিজের বাবা! চিন্তা করতেই তো কেমন লাগে! আমি হইলে তো স্ট্রোক করতাম।’

‘এতদিন অনেক বুঝছিরে ভাই। আমি অমৃতার সাথেও অনেক মিস বিহেভ করছি এইসব নিয়া। সামিকে জানাইতেই চাই নাই ব্যাপারটা কারণ, আমি জানতাম সে কষ্ট পাবে। অমৃতা প্রমিজ করছিল ও এই সম্পর্কে আর আগাবে না। ওরা কিন্তু দেখা সাক্ষাৎ করে নাই মাঝখানে অনেকদিন। অমৃতা বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করতেছিল। সামির মা এই পাকনামিটা না করলে কোনো ঝামেলাই হইত না। তোর বাবা মায়ের সব গোপন কথা কি তুই জানিস বল? সবকিছু সবাইকে জানতে হয় না। এটা জীবনের নিয়ম। এই নিয়ম ভাঙতে গেলেই গোলমালটা হয়। ‘একটু থেমে লম্বা দম নিল হৃদি। জরুরি গলায় বলল, ‘আচ্ছা শোন, আমি যে শ্বশুরবাড়ি থেকে চইলা আসছি এটা অমৃতারে বলার দরকার নাই। আমি চাই না ওর স্ট্রেস বাড়ুক।’

ভার্সিটি থেকে সেলুনে গিয়েছিল আকাশ। চুল দাড়ি কাটা হয় না বিগত কয়েক সপ্তাহ যাবত। চেহারা হয়েছে উল্লুকের মতো। আজকে চুল টুল কেটে পরিপাটি হবার পর নিজেকে একটু মানুষ মনে হচ্ছিল। বিকেল চারটার দিকে সেলুন থেকে অমৃতার বাসায় পৌঁছুল সে। দরজা খুলেছিল দীপা। প্রশ্ন করল, ‘খেয়ে এসেছেন নাকি এখন খাবেন?’

আকাশ জুতো খুলতে খুলতে সোজাসাপ্টা উত্তর দিল, ‘লাঞ্চ করিনি। খাবার রেডি থাকলে দিতে পার। রেডি না থাকলে কষ্ট করার প্রয়োজন নেই। এক কাপ চা হলেই চলবে।’

দীপা প্রত্যুত্তর না করে সরে দাঁড়ালো জায়গাটা থেকে। অমৃতার বেডরুমে এসে দেখা গেল সামি ব্যতীত অন্য বন্ধুরা সবাই উপস্থিত আছে। বিভার মুখটা ভেসে আছে রুদ্রর আইপ্যাডে। হৃদি আর অমৃতা বিছানায় পা তুলে বসেছে। রুদ্র বেতের চেয়ারে। অমৃতার কপালে তিনটা ঢাউস আকারের সেলাইয়ের দাগ প্রকটভাবে দৃশ্যমান। ফুলে থাকা লালচে চামড়ার খাঁজে খাঁজে কালো রক্ত জমাট বেঁধে আছে। এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে নকশী কাঁথার মতো ঠেসে আছে পাংশুটে রঙের সুতা। মাথার সামনের দিকের কিছু চুল কামিয়ে ফেলতে হয়েছে। ওখানেও সেলাই পড়েছে। মুখ শীর্ণ। চোখের কোলভর্তি কালিমার দাগ। হঠাৎ দেখলে মনে হয় পাড়ার গলিতে ঘুরতে থাকা, তাড়া খাওয়া কোনো কদম ছাটের পাগলিনী। চেহারা নিয়ে অবশ্য অমৃতার তেমন মাথা ব্যথা নেই। হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় বাড়ির লোকেরা বলেছিল হ্যাট কিংবা স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢেকে নিতে। অমৃতা রাজি হয়নি। যতই বীভৎস লাগুক না কেন নিজের খুঁত আড়াল করার জন্য পর্দার আশ্রয় নেবে না সে। কখনো পর্দা করলে হয়ত ধর্মীয় চেতনাবোধ থেকেই করবে। চেহারার কদর্যতা লুকোনোর জন্য করবে না।

আকাশ ঘরে ঢুকতেই হৃদি উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল, ‘আরে দোস্ত! তোরে তো সুন্দর লাগতেছে। ফর্সা হইলি ক্যামনে? রহস্য কী? ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী মাখিস নাকি?

বিভা শুধরে দিল, ‘ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম মাখে। আমি একটা গিফট করছিলাম তো ওরে।’

আকাশ ভ্রু-কুঁচকে বলল, ‘মিথ্যা কথা বলিস ক্যান? তুই কবে আমাকে ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম গিফট করছস?’

বিভা প্রতিবাদী কণ্ঠে বলে উঠল, ‘মিথ্যা বলতেছি না। ওই সময় তুই রেগুলার ক্রিকেট খেলতি। রোদে পুইড়া গায়ের রং হইছিল কয়লার মতো কুচকুইচ্চা। একদিন আমাদের বাসায় আসছিস তুই আর সামি। বসছিস ড্রয়িংরুমে। ভস করে কারেন্ট চলে গেছে। আমি ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি সামি একা বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কীরে আকাশ কই? হঠাৎ দেখি অন্ধকারে বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়া উঠছে এক পাটি সাদা দাঁত। ভূতের মতো হেসে হেসে দাঁতের পাটি বলতেছে, ‘এইতো আমি!’ এমন ভয় পাইছিলাম। মাইরি! মানে ও এত কালো ছিল যে অন্ধকারে মিশে গেছিল একদম। গায়ে ছিল ডার্ক কালারের শার্ট। তারপরের দিনই ওরে ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম গিফট করছিলাম। এখন নিমকহারামের বাচ্চা সব ভুইলা গেছে।’ অনেকগুলো কথা বলে দম নিল বিভা। আকাশ মুখ বাঁকিয়ে হাসল একটু। তারপর কণ্ঠস্বরে পশ্চিমা টান যুক্ত করে তারিয়ে তারিয়ে বলল, ‘মাইরি! কী ভীষণ রেসিস্ট তুমি দিদি! তোমাদের ঘটির দেশে কি কালো লোক নেই? এত ঘেন্না কেন শুনি?’

বিভা গোমড়া মুখে বলল, ‘লাথি খাবি হারামজাদা!’

রুদ্র বলল, ‘বাদ দেতো এইসব। শোন আকাশ আমরা কৌন বানেগা দুইশ’ টাকা পতি খেলতেছি। প্রশ্ন হইল একটা মুরগির ডিম হাত থেকে ছেড়ে দেয়া হলো কিন্তু ভাঙল না। কীভাবে সম্ভব? পারলেই দুইশ টাকা!’

আকাশ একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘এসব দুইশ টাকার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় নাই আমার। কোটি টাকার প্রশ্ন হইলে খেলতে রাজি আছি।’ কথাটা বলতে বলতে সে বিছানায় উঠে বসল, অমৃতার পাশে। ছোট করে প্রশ্ন করল, ‘আজকে কেমন আছিস দোস্ত?’

অমৃতা ফ্যাকাশে হাসল, ‘ভালো আছি। তোর কী খবর? নতুন চাকরি কেমন যায়?’

‘চলতেছে মোটামুটি। ফ্যাকাল্টিতে আমার ক্যাম্পাসের পরিচিত দুইজন বড় ভাই আছে। তাই অতটা লোনলি ফিল করতেছি না।’

ওদিকে হৃদি আর বিভা তখন রুদ্রর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। রুদ্রর মুখে চালবাজ হাসি। রাজকীয় ভঙ্গিতে পা নাচাচ্ছে সে। বিভা ভেবে চিন্তে বলল, ‘ডিমটা আগে থেকেই ভাঙা ছিল।’

অমৃতা ফোড়ন কাটল, ‘স্টুপিড ধাঁধাগুলার উত্তর সবসময় স্টুপিডই হয়।’

‘হুম, নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা!’ রুদ্রর ত্যাড়া মন্তব্য। হৃদি চোখ বড় করে বিজ্ঞ গলায় বলল, ‘ডিমটা আসলে মুরগীর ডিম না, ঘোড়ার ডিম। আর ঘোড়ার ডিম তো কখনো ভাঙতে পারে না।’

বন্ধুরা সবাই হোহো করে হেসে উঠল। রুদ্র চোখ সরু করে বলল, ‘ঘোড়ার ডিম ভাঙবে না কেন? লজিকটা কী?’

‘লজিকের কী আছে এখানে? ঘোড়ার ডিম বলে তো কিছু নেই। ঘোড়ার ডিম অদৃশ্য। অদৃশ্য ডিম কখনো ভাঙে না।’

রুদ্র ক্ষেপল একটু, ‘তোদের মাথায় আসলে বুদ্ধি বলতে কিছুই নাই।’

‘আমাদের মাথায় তো বুদ্ধি নাই। বুদ্ধি তো সব তোমার মাথায়। এইজন্যই তো এখন পর্যন্ত একটা গার্লফ্রেন্ডও যোগাড় করতে পারো নাই।’ হৃদির উপহাস।

‘কীসের মধ্যে কী, পান্তা ভাতে ঘি! খোঁটা দিলি ক্যান?’ কথাটা শেষ করে রুদ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইয়ো ম্যান! তুমি কিছু বলবা না? গার্লফ্রেন্ড তো তোমারও নাই শালা! কতবার বললাম কিছু একটা কর। এখন ঠ্যালা সামলা, নিজের আপন ফ্রেন্ডরা খোঁটা দিতেছে!’

দীপাকে দেখা গেলো দরজার ওপাশে। মাথা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আকাশ ভাই, মা ডাকছে। খেতে আসেন।

আকাশ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘জব্বর ক্ষুধা লাগছে মামা! খাওয়াদাওয়া সেরে নেই আগে। তারপর ব্যাপারটা দেখতেছি।’

রুদ্র শক্ত মুখে বলল, ‘আজকে একটা গার্লফ্রেন্ড নাই দেইখা ফ্রেন্ডরাও বেল দেয় না! কী দুনিয়া!’ একটু বিরক্তি নিয়ে সে আবার বলল, ‘দাঁড়া এক সপ্তাহের মধ্যে গার্লফ্রেন্ড বানাইতেছি। বিদেশে যাওয়ার আগেই একটা প্রেম করব বুঝছিস? তারপর সেকেন্ড প্রেমটা করব বিদেশে গিয়া।’

‘থার্ডটা কোথায় করবি? প্ল্যানটা শুনি।’ পানসে মুখে বলল বিভা।

উত্তরটা ঠোঁটের আগায় প্রস্তুত ছিল রুদ্রর, ‘মঙ্গলগ্রহে।’

‘এলিয়েনের সাথে?’

‘এলিয়েন একটা পাইলে মামা আর ছাড়াছাড়ি নাই। শুধু প্রেম না, বিয়ে করে পৃথিবীতে নিয়ে আসব।’

‘ছেলে এলিয়েন নাকি মেয়ে এলিয়েন?’ অমৃতার গম্ভীর প্রশ্ন।

‘অবশ্যই মেয়ে। আমি কি গে নাকি?’

‘দোস্ত আর যাই করিস না কেন, বিয়ে করার চেষ্টা করিস না। ঐসব তোরে দিয়ে হবে না। শুধু শুধু একটা এলিয়েনরে বিপদে ফেলাবি।

হৃদি হাত উঁচিয়ে সিদ্ধান্ত দিল, ‘থাক ঠিক আছে… বিপদে পড়লে এলিয়েনই পড়ুক। মানুষরে বিপদে না ফেললেই হইল।’

‘ক্যান বিপদের কী আছে?’ ক্ষেপে যায় রুদ্র।

‘তোর তো আজকে এরে ভালো লাগে, কালকে তারে। আজকে আমিনা কালকে সামিনা। তুই কখনো একজনের ব্যাপারে সিরিয়াস হইতে পারবি না।’

রুদ্র করুণ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ‘আমার সম্পর্কে তোর এই ধারণা?’

‘ধারণা না। এটাই সত্য। কমিটমেন্ট হবে না তোকে দিয়ে।’

‘হবে হবে। সব হবে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে, এক সপ্তাহের মধ্যে গার্লফ্রেন্ড জুটাইতে পারলে আরেকটা জ্যাকেট কিনে দিব বঙ্গবাজার থেকে।’ হৃদি বলল বেশ প্রসন্ন গলায়।

রুদ্র জিব কাটল, ‘মাফ চাই, দোয়াও চাই। জীবনে আর কোনোদিন তোর লগে মার্কেটে গেছি তো আমার নাম রুদ্র না।’ ওর বলার ধরনে বন্ধুরা হেসে ফেলল হোহো করে। অমৃতা বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে। শারীরিক যন্ত্রণা এখনো তাকে পুরোপুরি নিষ্কৃতি দেয়নি। সারাক্ষণ মাথা ভার হয়ে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ চিলিক মেরে ওঠে তীব্র ব্যথা। খাওয়াদাওয়ায় রুচি নেই। জিবে তিতকুটে ভাব লেগে আছে। তাছাড়া শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিক অসুস্থতাও কম পীড়া দিচ্ছে না। গত কয়েকটা দিন ভয়ঙ্কর বিষাদে আকণ্ঠ ডুবে ছিল মন। যেন তুমুল ঝড় ওঠা মাঝসমুদ্রে একলা ফেলে দেয়া হয়েছে তাকে। কূল নেই, কিনারা নেই, চারিদিকে শুধু থৈথৈ পানি! প্রথম কয়টা দিন কেবলই মনে হচ্ছিল সব কিছু শেষ হয়ে গেছে! নিজের বাবা মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না। বন্ধুদেরকেও মনে হচ্ছিল দূরের মানুষ। মনে হচ্ছিল এবার বুঝি সত্যিকার অর্থে একা হয়ে গেছে সে। পুরো পৃথিবীই তাকে ঘৃণা করছে। এই সুজলা- সুফলা শস্য-শ্যামলা অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবীতে সে একমাত্র মানুষরূপী ঘৃণিত কীট, যার আদতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই! কিন্তু প্রিয়জনেরা এই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে এখন অবধি কেউ তার দিকে নিন্দুকের দৃষ্টিতে তাকায়নি। অমৃতা ওদের চোখে ভর্ৎসনা এবং তিরস্কারের বদলে দেখেছে সীমাহীন প্রশ্রয়, মায়া এবং ভালোবাসা! মৃত্যুর শীতল ঘর থেকে ঘুরে আসার পর নিজের প্রতিটি নিঃশ্বাসের উষ্ণতাকে সে নতুনভাবে অনুভব করছে… উপভোগ করছে… তারিয়ে তারিয়ে আস্বাদন করছে। প্রিয়জনের মুখের এক টুকরো হাসিকে জীবনের অমূল্য সম্পদ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওদের মুখের এই হাসিটুকুর জন্য হলেও তাকে বাঁচতে হবে। সে ঠিক করেছে আর কখনো নিজের কথা ভাববে না। পরিবার, বন্ধু এবং দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য জীবনের বাকি দিনগুলোকে উৎসর্গ করবে। ঐ অপ্রত্যাশিত, আকস্মিক দুর্ঘটনা তার বুকের মধ্যে জ্ঞানচক্ষুর উন্মোচন ঘটিয়েছে। সে এখন জানে, শুধু সুস্থভাবে নিঃশ্বাস নেয়াটাই জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। সে আরো জানে যে, ভোগে নয় বরং ত্যাগেই মনুষ্যত্বের বিকাশ। ত্যাগের মহিমাই জীবনকে সুন্দর করে, নিকষিত করে। তাই নিজের জন্য আর কখনো কিছু ভাববে না। ভাববে শুধু অন্যের জন্য।

বন্ধুদের সহজ স্বাভাবিক উচ্ছ্বসিত ব্যবহার তাকে স্বস্তি দিচ্ছিল। ভালো লাগছিল ভীষণ। কিন্তু সামি যে এই দল থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে শুধুমাত্র তার কারণে, এই সত্য উপলব্ধিটুকু নিঃশ্বাসে হুলের মতো বিঁধে যাচ্ছিল অনুক্ষণ। ওর প্রসঙ্গ টেনে আনতেও ভয় হচ্ছিল। জ্ঞান ফেরার পর থেকে একটিবারের জন্য সামির নাম উচ্চারণ করেনি সে। যেন ওই নাম তার জন্য নিষিদ্ধ। আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো বন্ধুরাও কেউ ঐ দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে টু-শব্দটি করছে না। বাবা, মা, দীপা… কেউ না! যেন সেই অপ্রীতিকর, কলঙ্কিত ঘটনাটি সবার মনন এবং মস্তিষ্ক থেকে চিরতরে বিস্মৃত হয়ে গেছে। যদি কেউ সেদিনের ঘটনাটি নিয়ে কথা তুলত, তবে হয়ত এক ফাঁকে সামির কুশল জেনে নেয়া যেত। কিন্তু কেউ তাকে সেই সুযোগ দিচ্ছে না। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ওর কথা জানতে চাইতে অমৃতার ভয় হচ্ছে। এই অযৌক্তিক ভয়ের কারণ সে জানে না। জানতে চায়ও না। শুধু চায় আশেপাশের মানুষগুলো ভালো থাকুক। এই যে বন্ধুরা হাসছে, কথা বলছে, হৈ-চৈ করছে, এই আনন্দযজ্ঞে যেন কোনো ছন্দপতন না ঘটে। বন্ধুরা এভাবেই হাসতে থাকুক জীবন ভর। ওদের হাসির মধ্যে বেঁচে থাকুক অমৃতার স্বপ্নে দেখা বৃষ্টিমহল। কিন্তু সামিকে ছাড়া বৃষ্টিমহল পরিপূর্ণ হবে কী করে? এসব কথা ভাবতে গেলে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা কলিজা কামড়ে ধরে। হাঁসফাঁস লাগে। সামি কেমন আছে? কেমন আছে ওর পরিবারের মানুষজন সেই বিষয়ে একটাবার জানতে বড় ইচ্ছে করে। কিন্তু অদ্ভুত এক সংকোচ এসে ইচ্ছে শক্তিতে লাগাম টেনে ধরে। একটা সময় নিজের ইচ্ছেকেই সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে সে। আর আজকে, এই দ্বিতীয় জীবন প্রাপ্তির পর ‘ইচ্ছে’নামক ঘাতক অনুভূতিটিকে জীবন থেকে চিরতরে বিসর্জন দেয়ার সংকল্প করেছে।

‘তোর কী হইছে? কথা কস না ক্যান?’ অমৃতাকে ছুড়ে দেয়া হৃদির প্রশ্ন।

‘কিছু হয় নাই। ঠিকই আছি।’ কপট হাসি মুখে ঝুলিয়ে উত্তর দিল অমৃতা। তারপর আবার বলল, ‘রুদ্রর ধাঁধাটা নিয়ে ভাবতেছিলাম।

হৃদি ভেংচি কেটে বলল, ‘ঐসব গাধা মার্কা ধাঁধা নিয়া ভাবার কিছু নাই।’

‘ভাবার মতো ব্রেইন থাকলে তো ভাববি। ব্রেইন-ভর্তি তো গোবর।’ রুদ্র বলল ক্যাটক্যাট করে।

ওদিকে বিভার উচ্ছ্বাসে ঠাসা কণ্ঠস্বর হঠাৎ ঝুমঝুম করে বেজে উঠল হাওয়ায়, ‘অ্যাই… আমার বর ফোন দিচ্ছে। এখন রাখি। পরে কথা বলব আবার।’ ভস করে অদৃশ্য হয়ে গেলো বিভার মুখটা আইপ্যাডের স্ক্রিন থেকে। আকাশ ভাতের প্লেট নিয়ে ঢুকল ঘরের ভেতর। মাংসের টুকরা মুখে নিয়ে অস্পষ্টভাবে বলল, ‘তোরা খাইছিস?’

হৃদি বলল, ‘আমি তো তেহারি খাইছি। রুদ্র খাওয়াইছে।’

‘মানে কী? রুদ্র তোমারে তেহারি খাওয়াইছে। আমরা কী দোষ করলাম? আমাদেরটা কই?’ কথা বলতে বলতে বিছানার এক পাশে বসল আকাশ।

‘আর বলিস না দোস্ত! ছয়শ টাকায় একটা জ্যাকেট কিনে দিয়ে গপগপ করে আটশ টাকার তেহারি খেয়ে ফেলছে।’ আক্ষেপ করল রুদ্র। হৃদি তেজি এবং গর্বিত কণ্ঠে বলল,

‘আড়াই হাজার টাকার জ্যাকেট ছয়শ টাকায় কিনছি। কী জিতাটা জিতছি চিন্তা করতে পারিস? এইযে দামাদামির শ্বাসরুদ্ধকর যুদ্ধ, সেই যুদ্ধে জয়ী হলাম আমরা, এগুলোর কোনো দাম নাই তোর কাছে?’

অমৃতা মুখ খুলল এতক্ষণে, ‘আড়াই হাজারের জ্যাকেট আমি হইলে চারশ টাকায় কিনতে পারতাম।’

রুদ্র নাকমুখ কুঁচকে বলল, ‘উফ! কী বিরক্তিকর! ফকির কতগুলার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করছি। শুনো শপিং করতে গিয়ে বার্গেনিং করার রিচুয়াল দুনিয়া থেকে উঠে যাচ্ছে। যেসব জায়গায় ঠকার সম্ভাবনা আছে সেসব জায়গা এভয়েড করবা। একটা জিনিস কেনার জন্য ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা ব্যয় করার মতো অ্যাবসারডিটির কোনো মানে হয় না। এত টাইম কোথায় মানুষের?’

‘বাংলাদেশে এসবই করতে হয়। তুমি তো আমেরিকায় যাওয়ার আগেই আম্রিকান হয়ে গেছ মনে হচ্ছে। খ্যাত বান্ধবীদের সহ্য হচ্ছে না!’ মুখ ঝামড়ে উঠে বলল হৃদি। পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়ায় তার মুখের রং পাল্টে গেল। চোখে ঝিলিক দিল চাপা খুশি। আমুদে গলায় বলল, ‘আচ্ছা শোন, এসব কথা থাক। এখন বল আমার জন্য কী গিফট পাঠাবি?’

‘গিফট পাঠামু ক্যান হুদাই?’ রুদ্রর পানসে মুখের পানসে প্রশ্ন।

হৃদি যেন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলছে এমন ভঙ্গিতে বলল,

‘পাঠাবি তো মাস্ট! আমার জন্য কসমেটিক্স দিলেই হবে। আমি লিস্ট করে দিব। নো ওরিজ। ম্যাকের লিপ্সটিক আমার ফেভারিট। এসটেলডারের একটা আই ক্রিম আছে বুঝছিস দোস্ত? চোখের কালির জন্য। আমার ইদানীং চোখের নিচে কালি পড়তেছে। ভূতের মতো চোখ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ঐ ক্রিমটা আমার খুব দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুই জিনিসটা আমাকে দিবি।

‘আচ্ছা? আর কী কী করা লাগবে তোর জন্য?’ সরু চোখে জানতে চাইল রুদ্র।

‘আমার তো আপাতত এই দুইটা জিনিস হলেই চলবে। আকাশ তোর কী লাগবে?’

আকাশ বিশেষ চিন্তা-ভাবনা না করেই এক বাক্যে বলে দিল, ‘আইফোন লাগবে, লেটেস্টটা!’

‘আর কিছু? তোদের পুরা লিস্ট শুইনা নেই। তারপর প্ল্যান করতেছি কোন ব্যাংকটা ডাকাতি করব।’

‘অমৃতা! তোর কী কী লাগবে ঝটপট লিস্ট করে ফ্যাল!’ আদেশ করল হৃদি।

অমৃতার মুখে এতক্ষণ মিটিমিটি হাসির একটা স্টিকার লেগে ছিল। হৃদির কথাটা শোনামাত্র কী কারণে যেন তার ঠোঁট থেকে সেই হাসি ম্যাজিকের মতো মিলিয়ে গেল। রক্তহীন শীর্ণ মুখের সবকটা আলো ঢেকে গেল বিষণ্নতার একরাশ কালো মেঘে। এভাবেই একজন মানুষ তাকে উপহারের তালিকা তৈরি করতে বলেছিল সেদিন। সেই তালিকার পুরোটা জুড়ে শুধু সেই মানুষটারই নাম লিখেছিল সে। কী বোকা ছিল! কতটা নির্বোধ হলে… আহাম্মক হলে… কাউকে এমন পাগলের মতো ভালোবাসা যায়? বুকটা হঠাৎ মুচড়ে উঠল যন্ত্রণায়। চোখের তারায় হামলা করল অশ্রুজল। কোথায় আছে সেই লোকটা? কেমন আছে? আর কোনোদিন তাকে এক পলকের জন্য হলেও দেখতে পাবে কি? ওর যন্ত্রণাবিদ্ধ মুখটা চমকে দিল বন্ধুদের।

‘কী হইছে তোর?’ সমস্বরে প্রশ্ন করল সকলে।

অমৃতা চোখ বুজে বালিশে হেলান দিয়ে বলল, ‘কিছু না। মাথাটা একটু ধরছে।

হৃদি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, ‘শোন, তুই বরং রেস্ট নে। আমরা এখন ফুটি। থাকলেই বকবক করব।’

অমৃতা কিছু বলল না। তার বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। বন্ধুদের সান্নিধ্য ভালো লাগছিল। বন্ধু মানেই প্রাণের প্রাচুর্য এবং উচ্ছ্বাস! কিন্তু এই মুহূর্তে, বন্ধুদের সরব উপস্থিতি সত্ত্বেও ভেতরটা অদ্ভুত এক একাকিত্বে গমগম করে উঠছে। প্রকৃতি যে নিঃসঙ্গতার শাস্তি তাকে দিয়েছে সেই শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাবার কোনো উপায় নেই। এভাবেই ভিড়ের মধ্যে একলা হয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে বন্ধুদের বলল, ‘ঠিক আছে। এখন ভাগ।’

বাইরে বেরিয়ে এসে হৃদি কেঁদে ফেলল হাউমাউ করে। বাকি দুই বন্ধু বিস্মিত।

‘কাঁদছিস কেন?’

হৃদি চোখভর্তি জল নিয়ে বলল, ‘অমৃতার জন্য অনেক খারাপ লাগতেছে। ওকে কখনো এভাবে দেখি নাই। কী হবে? সব কিছু ভুলে গিয়ে কবে আবার স্বাভাবিক হবে মেয়েটা?’

সন্ধ্যা নেমে গেছে তখন। অমৃতাদের অ্যাপার্টমেন্টের গলিতে যানবাহনের একটা ছোটখাটো ভিড় লেগে গেছে। অযথাই হর্ন বাজাচ্ছে কিছু গাড়ি। নিত্যদিনের নাগরিক কোলাহলের ভেতর সন্ধ্যার আবছায়া আলোয় দুই বন্ধু কান্নারত হৃদির দিকে কিছুক্ষণ আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটার নিজের সংসারে ভাঙনের জোয়ার লেগেছে। টানা অনেকগুলো দিন শ্বশুরবাড়ির সাথে যোগাযোগ নেই। অনিশ্চয়তায় দোদুল্যমান তার ভবিষ্যৎ। জীবনের এমন ঘোর সংকটময় পরিস্থিতিতে সে চোখের জল ফেলছে সেই বন্ধুর জন্য, যে বন্ধুর অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের কারণেই আজ তার এই দুর্দশা।

আকাশ ওর কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, ‘কাঁদিস না দোস্ত। ঠিক হয়ে যাবে সব। ইন-শা-আল্লাহ।’

‘চল সামির বাসায় যাই।’ রুদ্র প্রস্তাব দিল।

আকাশ হৃদির দিকে চেয়ে সাবধানে বলল, ‘তুই যাবি হৃদি?’

‘মাথা খারাপ! এত বড় অপমানের পর আমি ওই বাড়িতে আর কোনোদিন যাব না।’ আকাশ একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘এভাবে বলতে হয় না। ঐটা তো তোরই বাড়ি। তুই নিজের বাড়িতে যাবি না? এটা কোনো কথা হইল?’

হৃদি কাঁপা গলায় বলল, ‘ওটা আমার বাড়ি না মোটেও। আমার কোনো বাড়ি নাই। ‘কথাটা বলে একটু চুপ করে রইল সে। তারপর হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা শোন। একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলি। রুদ্র, তুই অমৃতাকে বিয়ে করে আমেরিকা নিয়ে যা। খুব ভালো হবে। দেশ থেকে দূরে চলে গেলে ও খুব সহজে সবকিছু ভুইলা যাবে।’

রুদ্র বিরক্ত হল, ‘তোর মাথাটা গেছে। চল বাসায় দিয়ে আসি তোকে। এসব বালছাল চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে একটু চিন্তা কর। চাকরি বাকরি খোঁজ।’

হৃদি প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। কেমন যেন বিমর্ষ ভঙ্গিতে চুপ করে গেল। ওড়না দিয়ে মুছতে লাগল চোখের জল। একটা সিএনজি ভাড়া করে হৃদিকে প্রথমে ওর বাসায় নামিয়ে দিল ওরা। তারপর রওয়ানা দিল সামির বাসার দিকে। সিএনজির খাঁচার ভিতর বসে ইঞ্জিনের উৎকট আওয়াজের ভেতর আকাশ হঠাৎ বলল, ‘হৃদি কথাটা খারাপ বলে নাই। তুই অমৃতাকে একবার অফার দিয়ে দেখবি?’

‘পাগল হইছিস? অমৃতারে তুই চিনিস না? হৃদির মাথা ভর্তি গোবর। নইলে এমন কথা বলতে পারত না।’

‘হৃদি আসলে প্র্যাকটিক্যাল চিন্তা করতেছে। দেশের বাইরে চলে যাইতে পারলে অমৃতার জন্য ভালোই হইত।’

‘আমার জানা মতে অমৃতা নিজেই কয়েক জায়গায় অ্যাপ্লাই করছে। কোথাও-না-কোথাও অ্যাডমিশন হয়ে যাবে।’

‘সেটা হয়ত হবে। কিন্তু একজন পার্টনার থাকলে ভালো না? ওর জন্য এখন একা থাকাটা রিস্ক।’

‘দোস্ত অমৃতার ওপর আমার ভরসা আছে। ও কাজকর্ম শুরু করলেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আর বিয়ের কথা বলতেছিস… এসব আসলে এভাবে হয় না। অমৃতার প্রতি ফিলিংস ছিল কিন্তু অনেকদিনের ফ্রেন্ডশিপ তো… এখন আর অন্যরকম কিছু লাগে না বুঝছস? ভাই-বোন টাইপ একটা ব্যাপার এসে গেছে। অ্যাট্র্যাকশন নাই।’

‘অ্যাট্রাকশন ফিরে আসতে কতক্ষণ?’

‘মনে হয় না… তুই বল… তুই কি এখন আর আগের মতো ফিল করিস?’

‘এসব নিয়ে ভাবি না।’

‘ভেবে বল।’

আকাশ একটু সময় চুপ থেকে গম্ভীরভাবে বলল, ‘তোর কথাই ঠিক। অ্যাট্রাকশন কেটে গেছে। ছোটবেলায় একটা মুগ্ধতা ছিল। ওর মতো অসাধারণ একটা মেয়ের সাথে প্রেম করতে কে না চাইবে বল? কিন্তু এখন আর সেরকম কিছু ফিল হয় না।’

রুদ্র ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আধো আলো অন্ধকারে বসে থাকা আকাশের দিকে। চোখে চোখ পড়া মাত্র দুজনেই একটু হাসল। আকাশ বলল, ‘হৃদি একটা কথা তো ঠিকই বলছে তাই না? তুই কখনো কারো ব্যাপারে সিরিয়াস হইতে পারিস নাই।

রুদ্র তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, ‘এসব আমাকে দিয়ে হবে না আসলে। তুই নিজেও তো পারলি না।’

‘কী আর করা যাবে। সবাই তো সামির মতো স্মার্ট না!’

হেসে ফেলল রুদ্র। পরমুহূর্তেই সামির বর্তমান পরিস্থিতি মনে পড়ে গেল দুজনের। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল হালকা। সিএনজি মহাখালির জ্যামে আটকে আছে এখন। একটুও এগোচ্ছে না। গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত রুদ্র সিগারেট ধরালো। একটা লম্বা টান দিয়ে সিএনজির গ্রিলের বাইরে আঙুল নেড়ে ছাই উড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘প্রেম ট্রেম আর হবে না বুঝছিস? মনীষাকে আগে সেই লাগত। এখন আর কিছু লাগে না।’

মনীষার প্রসঙ্গ উঠতেই আকাশ কেন যেন একটু নিভল। চোখে ভাসল হালকা দ্বিধা। জড়তা নিয়ে বলল, ‘তোকে একটা কথা বলা হয় নাই। মনীষার হাসবেন্ড এখন জেলে।’

‘তাই?’

‘হুম ড্রাগের মামলায় ফেঁসে গেছে ব্যাটা। সে নিজেও নেশা করত।’

‘তুই কখন জানলি?’

‘কদিন আগে। লোকটাকে নিয়ে অবশ্য মনীষার কোনো দুঃখ নাই। সে ছেলের জন্য চিন্তিত। ছেলেকে কী বলবে, কী জবাব দিবে এসব নিয়েই কান্নাকাটি করতেছিল।’

রুদ্র কিছু বলল না। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল নিঃশব্দে। সিএনজি চলতে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে উড়ে আসছে গ্রীষ্মের রুক্ষ বাতাস। শুষে নিচ্ছে শরীরের ঘাম। ওরা দুজন যান্ত্রিক রাজপথে নিষ্প্রভ চোখ মেলে চুপচাপ বসে আছে। ওদের দেখে এই মুহূর্তে নিছক চঞ্চল, চপলমতি, ফুর্তিবাজ তরুণ মনে হচ্ছে না বরং জীবনযুদ্ধে লিপ্ত, পোড় খাওয়া প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মনে হচ্ছে।

উত্তরায় সামিদের প্রাসাদতুল্য বাড়ির সামনে সিএনজি এসে থামল রাত আটটায়। বেশ কিছু গাড়ি নিয়মকানুন না মেনেই গেটের সামনের রাস্তায় পার্ক করা হয়েছে। বিশৃঙ্খল অবস্থা। দুই বন্ধু সদর দরজায় এসে দেখল প্রায় তিরিশ পঁয়ত্রিশ জোড়া জুতো রাখা। ভেতরে নিশ্চয়ই দলীয় মিটিং চলছে। লিভিং রুমে দুজন চোয়াড়ে চেহারার লোক বসে আছে। বয়স চল্লিশের মধ্যে। হাতে চায়ের কাপ। বন্ধুদের দেখে একজন উৎসুক গলায় প্রশ্ন করল, ‘আপনারা কি সংবাদপত্রের লোক?

রুদ্র মাথা নাড়ল। লিভিং পেরিয়ে ডাইনিং-এ আসতেই দেখা গেল টেবিলে রোমেলা, সামির খালা এবং খালাতো বোন বসে আছে। টেবিলের ওপর চায়ের কেটলি, কাপ-সহ নানা পদের নাশতা সাজানো। গৃহকর্মীরা ট্রেতে করে চা নিয়ে যাচ্ছে স্টাডিরুমে। যেখানে সভা বসেছে। বাড়িটা আগের মতোই আছে। পা রাখামাত্র বোঝা যায় এখানে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাস করে।

রোমেলার পরনে একটা হালকা হলুদ রঙের সিল্ক শাড়ি। কাঁচা হলুদ টকটকে ফর্সা রঙের সাথে হলুদ শাড়িটা মানিয়েছে খুব। গলায় কানে শোভা পাচ্ছে মূল্যবান জুয়েলারি। হাতে হীরের পাথরখচিত ব্রেসলেট। মধ্য বয়সেও তার সর্বাঙ্গে চোখ ধাঁধানো রূপের জেল্লা আছে। এমন জেল্লা শুধু দৌলতদার, পয়সাওয়ালা ব্যক্তিদের মাঝেই পরিলক্ষিত হয়। বন্ধুদ্বয়কে দেখামাত্র রোমেলার মুখ কুঁকড়ে গেল। যেন ডাস্টবিন থেকে দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা তুলে আনা হয়েছে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘সামি তো বাসায় নেই।’

‘কোথায় গেছে?’ আকাশের প্রশ্ন।

‘আমাকে বলে যায়নি।’

রুদ্র আর আকাশ পরস্পরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল একবার। চোখে চোখে কথা হলো। রুদ্র বলল, ‘একটা ফোন করে দেখবেন আন্টি?’

রোমেলা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘ফোন করে লাভ নেই। ও তোমাদের সাথে দেখা করবে না। শুধু শুধু বিরক্ত করো না আমার বাচ্চাটাকে।’

বন্ধুরা এই কথার পিঠে কিছু বলার সাহস পেলো না। বিষণ্ণ বদনে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর আর সময় ব্যয় না করে প্রস্থানদ্যত হলো। রাশেদ স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে করিডোর ধরে এগিয়ে আসছিলেন সেই সময়। পুত্রের বন্ধুদের দেখে একটু থমকে দাঁড়ালেন তিনি। দাঁড়ালো বন্ধুরাও। চোখে চোখ পড়ল। কাটল কতিপয় অস্বস্তির মুহূর্ত। আকাশ রুদ্রর দিকে চেয়ে দায়সারা গলায় বলল, ‘চল যাই। দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।’

ওরা চলে যাবার পর রাশেদ স্ত্রীর কাছে ছুড়ে দিলেন প্রশ্নটা, ‘সামি কোথায়?’

‘জানি না।’

‘ফোন করছ না কেন?’

‘ফোন করেছি। কোথায় আছে, কী করছে, কিছুই বলেনি। শুধু বলেছে ফিরতে রাত হবে।’

রাশেদ চিন্তিত মুখে সরে পড়লেন জায়গাটা থেকে। ছেলের গতিবিধি অনুসরণ করা তার জন্য জটিল কোনো ব্যাপার নয়। চাইলেই এই মুহূর্তে তিনি ছেলের পেছনে গোয়েন্দা নিয়োগ করতে পারেন। তিনি সামিকে সমস্ত প্রতিকুলতা থেকে আগলে রাখতে চেয়েছেন সব সময়। যেকোনো মূল্যে নিজ পুত্রের ভবিষ্যৎ নিরাপদ এবং নিষ্কণ্টক করতে চেয়েছেন। সামি মানুষের মতো মানুষ হবে, পড়াশোনা এবং কর্মক্ষেত্রে কৃতিত্বের পরিচয় দেবে, এই একটিমাত্র স্বপ্ন পূরণের অবাধ্য স্পৃহা থেকেই তিনি ছেলের পেছনে জোঁকের মতো লেগে ছিলেন সারা জীবন। ধনী পরিবারের ছেলে-মেয়েদের সামনে পথভ্রষ্ট হবার হাজারটা দরজা খোলা থাকে। সামি একমাত্র সন্তান। বাবা মায়ের অগাধ ভালোবাসা এবং অপ্রমিত অর্থকড়ির প্রাচুর্য একজন কোমলমতি শিশুর মাথা বিগড়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। মমতাময়ী মা হিসেবে রোমেলার তুলনা হয় না কিন্তু সুবিবেচক এবং বিচক্ষণ মায়ের ভূমিকা তিনি কখনই পালন করতে পারেননি। সামি মায়ের ভালোবাসাকে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড হিসেবে নিয়েছে। সে বখে যায়নি একথা সত্য। কিন্তু দায়িত্ববান সন্তান হিসেবে বাবা-মায়ের মন রক্ষার কোনো শক্তিশালী তাগিদ তার কাজেকর্মে কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। সে নিজের ইচ্ছে মতো বন্ধু বেছে নিয়েছে। বাবা-মায়ের আপত্তি অগ্রাহ্য করেছে। উচ্ছন্ন বন্ধুমহল ত্যাগ করেনি। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও বাবার আদেশ মান্য করেনি। পড়েছে নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে। অন্য ধর্মের এক মেয়ের প্রেমে পড়ে বাবার সঙ্গ ত্যাগ করেছে। ক্যারিয়ার নিয়ে মনোযোগী হয়নি। শেষমেশ বিয়েটাও করল নিজের পছন্দের মেয়েকেই। রাশেদ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছেলেকে সহযোগীতা করেছেন জীবনের প্রতিটি ধাপে। তবুও আজ পিতা হিসেবে তিনি ব্যর্থ। এই ব্যর্থতা বুকে নিয়েই বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। পুত্রের চোখে চোখে আর কখনো তিনি আগের মতো সহজভাবে তাকাতে পারবেন না। সংসারে যে ভাঙনের সুর লেগেছে সেই সুরের প্রভাব আর কোনোদিন কাটবে বলে মনে হয় না। সামি এখন প্রাপ্তবয়স্ক যুবাপুরুষ। এবার বাবা মায়ের ছত্রছায়া থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজের জীবনের হাল ধরতে হবে। মধ্যরাতের ঢাকা শহরে পিতার নিয়োজিত প্রহরী তাকে আর পাহারা দেবে না। গতিবিধিতে আর থাকবে না কারো নিয়ন্ত্রণ। সে এখন থেকে মুক্ত, স্বাধীন, পরিপূর্ণ একজন মানুষ। রাশেদ ছেলেকে নিয়ে আর ভাবতে চান না। এবার একটু অবসর চাই। পরিপূর্ণ অবসর!

মনের সাথে এতসব বোঝাপড়ার পরেও পুত্র-ভাবনা তাকে মুক্তি দিল না। তিনি ক্ষণিক বাদে বাদে সময় দেখতে লাগলেন। জানালার বাইরে চোখ ফেলতে লাগলেন ঘনঘন। সারাদিন নানারকম ব্যস্ততায় কেটে গেলেও রাত্রিগুলো যেন কাটতেই চায় না। অকর্মণ্য ক্লান্ত মস্তিষ্কে একাকিত্ব হানা দেয়। যদিও নিঃসঙ্গতার এই উৎপীড়ন তার মতো কর্ম-সাধন-তৎপর মানুষকে মানায় না। তিনি কবি নন। বৈষয়িক, বাস্তবিক মনের অধিকারী সাধারণ এক জীবন-সৈনিক। কাজ তার জীবনের একমাত্র ভালোবাসা! কিন্তু এখন আর আগের মতো দিন নেই। দিন পাল্টে গেছে। আজকাল মন ভীষণ অন্যমনস্ক! খণ্ড খণ্ড চিন্তার মেঘ মনের আকাশে বিচরণ করে বেড়ায় অবিরাম। স্ত্রীর কথা, পুত্রের কথা, নিজের বাবা মায়ের কথা, শৈশব, তারুণ্য… কত স্মৃতি… কত টুকরো টুকরো ঘটন-অঘটন… কত আক্ষেপ… কত প্রাপ্তি… কত অভিজ্ঞতা…! মাঝে মাঝে অমৃতার মুখটা মনে পড়ে। মনে পড়লেই তিনি দ্রুত কোনো-না-কোনো কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাজের তো শেষ নেই। দিনে দিনে দায়িত্ব বেড়ে চলেছে। সামি শক্ত হাতে ব্যবসার হাল ধরলে রাজনৈতিক কার্যকলাপে তিনি যথার্থ মনোনিবেশ করতে পারতেন। কিন্তু গত দেড় সপ্তাহ ধরে সামি অফিসে অনুপস্থিত। আপাতত কাজে তার মন ফিরবে না। কখনো ফেরে কি না তা নিয়েও সন্দেহ আছে। ছেলের কথা ভাবতে গেলে দিশাহারাবোধ করেন রাশেদ। পুত্রবধূটিও বিশেষ চালাক চতুর নয়। সহজ-সরল আবেগী মেয়ে। সামির পাশে শক্তভাবে দাঁড়ানোর মতো সাহস বা উদ্যম তার নেই। এসব দুশ্চিন্তা আজকাল রাশেদের হৃদয় কণ্টকিত করে তোলে। মাথা টনটন করে। হাঁসফাঁস লাগে। মানসিক অবস্থা খুব বেশি বিপন্ন হয়ে পড়লে তিনি হাঁটতে বেরিয়ে পড়েন। কিছু দূর হেঁটে, দৌড়ে, শরীরটাকে বশে এনে তারপরেই ঘরে ফিরে আসেন। আজ বেরোনোর আগে নিজের বেডরুমে উঁকি দিলেন একবার। আজকাল এই ঘরে রাত্রিযাপন করা হয় না। স্টাডিরুমেই স্থায়ী আস্তানা গেড়েছেন রাশেদ। বেডরুমে শ্যালিকা উপস্থিত আছে। দুই বোনের মধ্যে ফুসুরফাসুর গল্প চলছিল। রাশেদ ঘরে উপস্থিত হতেই সামির খালা উঠে দাঁড়াল। প্রস্থান করল দ্রুত। রোমেলা বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। নিঃস্পৃহভাবে তাকালেন স্বামীর দিকে।

‘কিছু বলবে?’

‘রাত বারোটা বাজে। ছেলে কোথায়?’

‘আজ ফিরবে না। কলিগের বাসায় স্টে করবে।’

‘কোন কলিগ? নাম জানো তুমি?’

‘স্কুলে একসাথে পড়াত। নাম জানি না। স্পাইগিরি করা তোমার স্বভাব, আমার না।’

রাশেদ শীতল গলায় বললেন, ‘শোন, ছেলে ফিরে এলে ওকে বলবে আমাদের লাইফ নিয়ে যেন আর চিন্তা না করে। নিজের ক্যারিয়ার এবং সংসার নিয়ে ভাবতে হবে ওকে। বউটাকে গিয়ে নিয়ে আসতে বলবে। আর বলবে তার বাবা মায়ের মধ্যে সবকিছু ঠিক আছে। আগের মতোই আছে।’

রোমেলা একটু নড়েচড়ে বসলেন, ‘মিথ্যে বলব ছেলেকে?’

রাশেদের কপালে চিন্তার সূক্ষ্ম কুঞ্চন পড়ল। রোমেলা সেই কুঞ্চনটা লক্ষ্য করলেন না। তার মনে হলো রাশেদকে দেখতে আগের মতোই ফিটফাট কেতাদুরস্ত লাগছে। একটা সাদা পোলো শার্ট আর ছাই রঙের ট্রাউজার পরনে। গালের দাড়ি কামানো। চুল পরিপাটি করে ছাঁটা। সংসারের এই ঘন ঘোর দুঃসময়েও মানুষটার সৌম্যদর্শন চেহারায় কোনো ম্লান ভাব নেই। কাজে-কর্মে বিরতি নেই। নিরলস, নিরবসর, নিয়মমাফিক জীবন তার। চোখের চাউনি আগের মতোই বুদ্ধিবিবেচনাদীপ্ত। বচনে-বাচনে আত্মবিশ্বাসের ফুলঝুরি! কোনো কিছুই কি একে প্রভাবিত করে না? স্ত্রীর আক্ষেপ, পুত্রের অভিমান কিংবা প্রেমিকার প্রস্থান… এসব খুঁটিনাটি জাগতিক ঘটনা কি মানুষটাকে এক বিন্দুও নাড়া দেয় না? কী করে এতটা নির্বিকার থাকে? রোমেলা তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ছিলেন সুদর্শন, শক্তপোক্ত, ব্যক্তিত্ববান স্বামীর দিকে। এই লোকের অজস্র গুণ থাকা সত্ত্বেও রোমেলা আজ অবধি একে মনের মতো করে ভালোবাসতে পারলেন না। অনেক চেষ্টা করেও সর্বস্ব দিতে পারলেন না একে। আনিস ছিল চালচুলোহীন বেকার যুবক। চেহারাও সাধারণ। রূপ, গুণের বিচারে সামির আব্বার ধারে কাছে আসার মতো যোগ্যতা ছিল না তার। তবুও কী এক আশ্চর্য উপায়ে সেই সাধারণ যুবকটি সুপ্রতিষ্ঠিত, স্বীয় কীর্তিতে চরিতার্থ এক মহৎ ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে দিল! কিন্তু রোমেলার বৈষয়িক জ্ঞান সদা জাগ্ৰত। আবেগকে তিনি আরাম আয়েশের চাইতে বেশি প্রাধান্য দেননি কখনো। ভালোবাসায় থাকা আর ভালো থাকায় বিস্তর ফারাক আছে। প্রথম যৌবনে তিনি ধনাঢ্যতা, অর্থের প্রাচুর্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। শারীরিক উন্মাদনা বা আকর্ষণ আর কদিন থাকে? পরবর্তীতে টিকে থাকে মনের টান নইলে বোঝাপড়া। লোকটাকে তিনি মন দিতে না পারলেও অসম্মান তো কখনো করেননি! সম্মান করেছেন। স্ত্রী হিসেবে সমস্ত দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। কিন্তু নিজ পুত্রের বান্ধবীর সাথে প্রণয়ঘটিত কেলেঙ্কারির পর সেই সম্মান টুকু উবে গেছে। সত্যি বলতে এর চোখে চোখ রাখতেও ঘেন্না হয় আজকাল। মন চায় সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যান। কিন্তু ছেলের মুখের দিকে চেয়ে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তাছাড়া তার বিষয়াসক্ত বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন চিন্তাধারা কোনো হঠকারী সিদ্ধান্তকে প্রশ্রয় দেবে না। তিনি প্রায়শই ভাবছেন প্রস্থানের কথা। আবার পরমুহূর্তেই সাবধানী হয়ে উঠছে মন। এই প্রাসাদতুল্য অতি মূল্যবান বাড়িটির একচ্ছত্র কর্তৃত্বে আছেন তিনি। এখানে তার সুপ্রতিষ্ঠিত অধিকার আছে। বাড়িটির জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি তারই তত্ত্বাবধানে আছে। ঢাকা শহর এবং দেশের বাড়ি মিলিয়ে সামির আব্বার মোট সাতটা বাড়ি আছে। এর মধ্যে লালমাটিয়ার বাড়িটি শুধু রোমালার নামে কেনা হয়েছে। বাদবাকি সব সম্পত্তি সামির আব্বার নিজের নামে। অন্যান্য সম্পদের ওপর রোমেলার লোভ নেই, কিন্তু এই বাড়ির প্রতিটি দেয়াল তিনি নিজের হাতে সাজিয়েছেন। এই বাড়ির প্রতি টান অন্যরকম। এ অধিকার খুব সহজে বেহাত করা যাবে না।

রাশেদ একসময় চিন্তার অবসান ঘটিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন এক ঝলক। স্মিত হেসে বললেন, ‘সত্য মিথ্যা জানি না। তবে একমাত্র সন্তানের জন্য এতটুকু আমাদের করতেই হবে।’

রোমেলা বিদ্রূপের হাসি হাসলেন নিঃশব্দে। কিছু বললেন না।

আকাশ আজকাল রাত জাগে না। বিছানায় যাওয়ামাত্র গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। তাড়াতাড়ি না ঘুমিয়েও উপায় নেই। প্রায় সকালেই ক্লাস থাকে। এদিকে চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর থেকে রুদ্র ইনসমনিয়ায় ভুগছে। অনেক রাত অবধি ঘুম আসে না তার। কানে এয়ারপড লাগিয়ে নেটফ্লিক্স বা হুলুতে সিরিয়াল দেখে। ইন্টারনেট ব্রাউজ করে। মাঝে মাঝে পড়াশোনা করে। যে প্রফেসরের আন্ডারে পিএইচডি করবে সেই প্রফেসর চাইনিজ এবং বেশ সপ্রতিভ। সুযোগ পেলেই রুদ্রর সাথে নানা বিষয়ে আলাপ করে। প্রায়ই জুম মিটিং-এ জয়েন করতে হয়। অতএব নিদ্রাবিহীন রাত্রিগুলো রুদ্রর অতটা খারাপ কাটে না। তরতর করে সময় কেটে যায়। কিন্তু সমস্যা হলো ইদানীং মাঝরাতে তার সিগারেটের তেষ্টা পায়। আকাশের ধূমপানের বদঅভ্যাস নেই। ঘরের ভেতর সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না সে। এই বাসায় বারান্দায় যেতে হয় ড্রয়িংরুম পেরিয়ে। ড্রয়িংরুমে তারা ঘুমায়। মেয়েটির রাত জাগার অভ্যাস আছে। গভীর রাত পর্যন্ত বাতি জ্বালিয়ে গল্পের বই পড়ে। রুদ্র প্রথমে ভেবেছিল অ্যাপার্টমেন্টের নিচে নেমে স্মোক করবে। কিন্তু সদর দরজাটাও তো ড্রয়িংরুমের সাথে লাগোয়া। তারাকে ডিঙিয়েই বাইরে বেরোতে হবে। মাঝরাতে একটা মেয়েকে এভাবে বিরক্ত করতে সংকোচ হয়েছিল। প্রথমদিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল ড্রয়িং কাম ডাইনিং-এর পর্দার ওপাশে। কী করবে বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ তারা নিজ থেকেই কথা বলে উঠল, ‘রুদ্র ভাইয়া, কিছু বলবেন?’

‘তুমি জেগে আছ এখনো?’

‘নিশ্চয়ই জেগে আছি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি মানুষ কথা বলতে পারে?’

‘আসব?’

‘আসুন।’

রুদ্র পর্দা ঠেলে ড্রয়িংরুমে ঢুকল। তারা বিছানায় বসে বই পড়ছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মাথায় জবজবে তেল। দেখেই কেমন হাসি পেয়ে গেল রুদ্রর। তারা চশমাটা নাকের ডগা থেকে আঙুল দিয়ে ওপরের দিকে ঠেলে দিল। গমগমে গলায় বলল, ‘হাসছেন কেন?’

রুদ্র হাসিটা চাপানোর চেষ্টা করল, ‘তুমি কি খুব বই পড়তে ভালোবাসো?’

‘বাসি।’

রুদ্র হাসতে লাগল, ‘তুমি একটু নার্ভ আছ, তাই না?’

‘এটা বলতে এসেছেন?’

‘আমি একটু নিচে যাচ্ছি।’

‘এত রাতে?’

‘হ্যাঁ, এত রাতে।’

‘যেতে পারবেন না।’

‘কেন?’

‘তাকিয়ে দেখুন। দরজায় তালা ঝুলছে।

রুদ্র তাকাল। সত্যিই একটা ইয়া বড় লোহার তালা লাগানো দরজায়। ‘খালু সাহেব তালা মেরে ঘুমাতে যান রাতে। চাবি উনার কাছেই থাকে। আকাশ ভাইয়ার কাছেও খুব সম্ভবত ডুপ্লিকেট আছে। আপনি কাল চেয়ে নিয়েন।’

রুদ্র থ বনে যাওয়া গলায় বলল, ‘কিন্তু আমার তো একটু যাওয়া দরকার।’

‘দরকারটা কি আমাকে বলা যায়?’

‘বিড়ি টানব।’

‘বারান্দায় যেতে পারেন।’

রুদ্র হাসল। একশ ভোল্টের ফকফকা হাসি।

‘থ্যাংক ইউ। আমি ভয়ে ভয়ে প্রস্তাবটা দিতে পারছিলাম না।’

‘আপনি আমাকে ভয় পান?’

‘তোমাকে তো যে কেউ ভয় পাবে! বাপরে! তোমার চশমার সাইজ দেখছ? দেখলেই মনে হয় হেডমিস্ট্রেস।’ তারার মুখটা হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে উঠল। আর একটি শব্দও উচ্চারণ না করে বইয়ের পাতায় চোখ নামালো সে। রুদ্র পরদিন আকাশের কাছ থেকে চাবি চেয়ে রাখল। রাত দুটোর সময় শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল ড্রয়িংরুমের বাতি জ্বলছে এখনো। তারা দিব্যি জেগে আছে। চোখে চশমা। চুল দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব তেল ঠেসে দেয়া হয়েছে ওই মাথায়। রুদ্র মৃদু গলায় বলল,

‘আসব?’

‘জি আসুন।’

রুদ্র পর্দা সরিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকেই সদর দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তারা বলল, ‘নিচে যাবার কী দরকার? আপনি বারান্দা ইউজ করতে পারেন।

রুদ্র হাসে, ‘সত্যি?’

তারা কোনো উত্তর না দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করল ওকে। চুলে ঝুঁটি, পরনে ছাই রঙের টিশার্ট আর কালো হাফ প্যান্ট। দাড়িভর্তি গালে ফকফকা হাসি। এত খুশি হওয়ার মতো কোনো খবর কি এটা? ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হাসছে কেন? সর্বক্ষণ খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তামাশা করতে একটা মানুষের কী করে ভালো লাগে? রুদ্র বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘তারপর? কেমন চলছে সব?’

তারা অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল, ‘রুদ্র ভাইয়া! আমার ঘুম পাচ্ছে। এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।’

রুদ্র চিন্তিত হয়ে উঠল,

‘আমি খেয়াল করে দেখেছি বেশিরভাগ সময়ই তোমার কথা বলতে ইচ্ছা করে না। এর কারণ কী? তোমাকে কথা বলার ক্লাসে ভর্তি হতে হবে।’

তারা অবাক, ‘কথা বলার ক্লাস বলে কিছু আছে নাকি?’

‘আমার কাছেই আছে। আমি তোমাকে কথা বলা শেখাব। ক্লাস কবে থেকে শুরু করবা বল?’

‘ক্লাস করব না।’

‘কেন?’

‘ক্লাস করতে আমার ভালো লাগে না।’

‘কী করতে ভালো লাগে?’

‘জানি না।

‘নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি?’

‘রুদ্র ভাইয়া… প্লিজ এখন যান এখান থেকে।’

‘আচ্ছা যাব। কিন্তু তুমি আমাকে ভাইয়া ডাকো কেন? কী কারণে?’

‘আজব! ভাইয়াকে ভাইয়া ডাকব না তো কী ডাকব?’

‘আমি তোমার ভাইয়া হলাম কবে?’

তারা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, ‘আপনি যাবেন? নাকি আমিই যাব?’

‘আরে বসো বসো। কোথায় যাবা এত রাতে? তোমার কি কোনো কারণে মন খারাপ?’

তারা চুপ করে রইল। তার মনটা বছরের অধিকাংশ দিনই খারাপ থাকে। এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। মন খারাপ নিয়েই বেঁচে থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে। রুদ্র বলল,

‘তোমাকে বরং একটা গান শুনাই। গান শুনলে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।’

‘গান শুনব না।’

‘কী আশ্চর্য! কেন?’

‘আপনি যেসব গান করেন সেগুলো আমার পছন্দ না।’ রুদ্র ভ্রু-কুঁচকে বলল, ‘তোমার কী ধরনের গান পছন্দ?’

‘রবীন্দ্রসংগীত।’

তাচ্ছিল্যে ঠোঁট বাঁকাল রুদ্র, ‘আমি তো ছোটবেলায় রবীন্দ্রসঙ্গীতই শিখেছি। কোনটা শুনতে চাও বলো। এখুনি গেয়ে দিচ্ছি।’

তারা বলল, ‘এত রাতে গান করলে বাড়ির লোক জেগে যাবে।’

রুদ্র ফিচেল হেসে বলল, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে কারো ঘুম ভাঙবে না। বরং আরো বেশি ঘুম পাবে।’

তারা একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, ‘আজকে নয়। অন্য একদিন শুনব।’

‘তোমার প্রিয় গান কোনটি? সেটা তো বলো!’

‘সেটা জেনে আপনি কী করবেন?’

রুদ্র হাসে, ‘কী করব আবার? তোমার মন খারাপের সময় গানটা গেয়ে

মন ভালো করে দেব!’

তারা চোখ নামিয়ে নিল নিচে। এত সহজ… এত সুন্দর… এত মায়া করে কেউ তার সাথে কখনো কথা বলেছে কি না মনে পড়ে না। সে অধোবদনে মৃদু স্বরে বলল,

‘কেন? আপনি কি মানুষের মন ভালো করার চাকরি নিয়েছেন?’

রুদ্র একটু অবাক হলো- ‘দারুণ বললে তো! এরকম চাকরির প্রচলন থাকলে খুব ভালো হতো। কিন্তু আনফরচুনেটলি কেউ এসব কাজের বেল দেয় না। আমি ফ্রিতেই মানুষের মন ভালো করে দেই। অন্ধকার মুখের মানুষ আমার ভালো লাগে না। আমি চাই পৃথিবীর সব মানুষের মুখ আলোয় আলোয় ভরে যাক।’ এটুকু বলে রুদ্র নিজের মনে হাসে। রসিয়ে রসিয়ে বলে, ‘ঠিক আমাদের মতো! আমাকে আর আমার বন্ধুদের দ্যাখো। সারা মুখে আলো নিয়ে ঘুরে বেড়াই।

‘আপনি বলতে চাইছেন আমি অন্ধকার মুখের মানুষ?’

‘ঠিক তাই! যাই হোক, এখন চটপট বলে ফ্যালো তোমার প্রিয় গানের লাইন।’

‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে? বসন্তের বাতাস টুকুর মতো!’

‘আরে বাহ! বেশ রোমান্টিক তো। প্রেম ট্রেম করো নাকি?’

তারার মুখে লজ্জার আলতা রং ছড়িয়ে পড়ল। ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘রুদ্র ভাইয়া, প্লিজ আপনি যান এখন।

‘গান শুনবা না?’

তারা কোনো উত্তর না দিয়ে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজল। বারান্দার দরজা খুলতে খুলতে রুদ্রর হঠাৎ মনে হলো, এত সহজ-সরল মেয়ে সে এর আগে কখনো দেখেনি। ওই সহজ মুখে কী যেন একটা আছে। দেখলে ঠান্ডা ঝিরিঝিরি অনুভূতিতে মন ছেয়ে যায়। কিন্তু মেয়েটা সবসময় দুঃখী-দুঃখী ভাব নিয়ে বসে থাকে কেন? এর কারণ কী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *