স্বপ্নের বৃষ্টিমহল – ৫৫

৫৫

বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই হাড় কাঁপানো ভেজা বাতাস ওদের আকণ্ঠ ডুবিয়ে দিয়ে গেলো। কিন্তু দুজনের কেউই সেই বাতাসের ঠান্ডা স্পর্শ টের পেল না। রুদ্রর চোখে মুখে একটা বিমূঢ় স্তব্ধতা নেমে এসেছে। হৃৎপিণ্ডে চাক চাক হয়ে থমকে আছে ভয়ঙ্কর বিস্ময়বোধ। তার আজন্মকালের চিরচেনা শরীরটায় যেন ভর করেছে সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ। এই দেহ-মন আর নিজের বশে নেই। বাসার সামনের মুদির দোকানে টিমটিমে হলুদ আলো জ্বলছে। সেই অস্ফুট আলোয় রাস্তায় জমে থাকা কাদা জলের দিকে নিষ্কম্প দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রুদ্র বশীভূতর মতো হেঁটে যাচ্ছিল। ওর এক হাত পেছনে শাড়ির কুচি সামলে কাদার ওপর সাবধানে পা ফেলছে তারা। অনিশ্চয়তায় দুলছে বুক। নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে। মস্তিষ্ক জমে গেছে জড়বুদ্ধি মানুষের মতো। কোনো ভাবনা খেলছে না মাথায়। শুধু বুক থেকে ঊর্ধ্বধাবিত হয়ে ছুটে আসছে তীব্র হাহাকার মিশ্রিত প্রশ্ন, ‘কী করলাম?… এ আমি কেন করলাম?…এখন কী হবে?

গলির মাথা পর্যন্ত গটগটিয়ে হেঁটে এল রুদ্র। পেছন ফিরে দেখল না একবারও। তারার গায়ে এক প্যাঁচ দিয়ে পরা শাড়ি, কানে গলায় ফুলের গয়না। মাথায় ঘোমটা। দেখলে মনে হয় নতুন বউ। রাস্তার লোকজন বধূ- বেশের মেয়েটির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। অস্বস্তিতে কুঁকড়ে যাচ্ছিল তারা। এমনিতেই বৃষ্টির দিন। কাদাজলে শাড়ির কুচি ভিজে যাচ্ছে। আঁচল উড়ছে ফরফর করে। অস্বস্তির সীমা নেই। আর রুদ্রর ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে এখন তারাকে চেনেই না। এক লাফে ফুটপাতে উঠে গেছে। দিশাহারা তারা কেনা গোলামের মতো ওকে অনুসরণ করছে। দুকূল ছাপানো কান্নায় ভেসে যেতে চাইছে বুক। এত বড় ভুল সে কী করে করল? কেন ছেলেটার কথামতো বাসা থেকে বেরিয়ে এলো? এই ছেলে তো আস্ত পাগল!

হঠাৎ হাত তুলে একটা খালি রিকশা দাঁড় করালো রুদ্র। রিকশাটা ফুটপাতের ধার-ঘেঁষে থামতেই উঠে পড়ল চট করে। একপাশে সরে এসে তারার জন্য জায়গা করে দিল। শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন তারা কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ উঠে বসল রিকশায়। মুখটা দুশ্চিন্তায় কুঁকড়ে আছে। চশমার ভেতরের আলগা পাপড়ি লাগানো মেকআপ করা চোখে ছমছম করছে ভয়। হুড খোলা রিকশায় সে রুদ্রর গা বাঁচিয়ে বসল। শীর্ণ ছিপছিপে তনুখানি গুটিশুটি হয়ে চেপে রইল একদিকে। মধ্যবয়সী রিকশাঅলা প্যাডেলে চাপ দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘কই যাইবেন মামা?’

রুদ্র অপ্রস্তুত হলো প্রশ্নটা শুনে। তারার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘আপনি চালান। একটু পরে বলছি কোথায় যেতে হবে।’

রিকশাঅলা এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করল না। নীরবে প্যাডেল ঘোরাতে লাগল। বৃষ্টির রাত বলে রাস্তা ফাঁকা। বেশ জোরে জোরেই চলছিল রিকশাটা। বৃষ্টি-বৃষ্টি গন্ধভরা মদিরা-মত্ত বাতাসে মিশে যাচ্ছিল বুকের সব শুষ্কতা। রুদ্রর চুল, জামা-কাপড় সব এখনো ভেজা। একটু শীত শীত ভাব হচ্ছিল। জ্বর আসবে কি না কে জানে! কিছু একটা বলা উচিত। বলার আছে অনেক কিছু! কিন্তু কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। একটা তারছেঁড়া উত্তেজনা বুকের ভেতরটায় চরম অরাজকতা সৃষ্টি করেছে। শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে গেল। দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে সরিয়ে নিল চোখ। সেই মুহূর্তে রুদ্রর নিজের ওপরেই খুব রাগ ধরে গেল। কী করছে সে পাগলের মতো? মেয়েটাকে কেন ডেকে নিয়ে এল বাসা থেকে? আর আনলই যেহেতু এখন তবে মুখ ফুটে কোনো কথা বের হচ্ছে না কেন?

সেই সময় সেলফোনটা বেজে উঠল। সামির নম্বর ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে। রুদ্র রিসিভ করল।

‘হ্যালো।’

‘ওই শালা! কই তুই?’

‘আমি তো… রিকশায়…!’ ইনোসেন্ট উত্তর দিল রুদ্র।

‘রিকশায় কী করস? মেয়েটা কই?’

রুদ্র কুণ্ঠা নিয়ে একবার তাকালো তারার দিকে। তারা ওর দিকেই চেয়ে আছে। ফোনের স্পিকারের ভলিউম বেশি হওয়ায় সামির বলা সব কথাই শুনতে পাচ্ছে সে।

‘আমার সাথেই আছে।’

‘সাথে আছে তো বুঝলাম কিন্তু যাচ্ছিস কোথায়?’

রুদ্র অপ্রতিভ গলায় বলল, ‘কোথায় যাওয়া যায় ভাবছি।’

সামি একটু সময় চুপ করে থেকে ভারি উত্তেজিত গলায় বলল, ‘তোরা কি আজকেই বিয়ে করবি?’

প্রশ্ন শুনে একটা প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে গেলো রুদ্র। মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে অস্বস্তিকর এবং লজ্জাজনক প্রশ্ন এটা। সংকোচের ধাক্কায় মুখখানা কুঁকড়ে গেল। তারা অতর্কিতে চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। রুদ্র আমতা আমতা করে বলল, ‘না…আব্বা আম্মার সাথে কথা বলতে হবে…।’

অপরিসীম কুণ্ঠাবোধ তারার নাক কান সব জমিয়ে দিচ্ছিল একদম রুদ্রর কথাগুলো যেন শুনতে পেয়েও শুনছিল না ঠিকমতো। এত লজ্জা লাগছে! মনে হচ্ছে লজ্জার ঠ্যালায় একদম মরেই যাবে! সামি বলল, ‘তাহলে কী করবি?’

‘আকাশ কী বলে?’

‘তোরে পিটানোর জন্য রেডি হইতাছে। আয় একবার। খেলা হব্বে এইবার মামা!’

সামির বলার ধরনে একটু হাসল রুদ্র। লঘু গলায় বলল, ‘তোরা আছিস কী করতে? ম্যানেজ কর।’

হঠাৎ সামির ফোনটা জায়গা বদল করল। ভেসে এল হৃদির কণ্ঠস্বর I ‘অ্যাই পাগলা, করিস কী?’

‘কিছু না।’

‘কেন? প্রেম করতেছিস না?’

আবারও অস্বস্তিতে জাড় হয়ে যায় রুদ্র। তারা বিপন্নভাবে আরো একটু দূরে সরে যায়। অপ্রস্তুতভাবে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে শাড়ির আঁচলের একটা প্রান্ত। রুদ্র কণ্ঠস্বরে জোরপূর্বক স্থিরতা ধরে রাখার চেষ্টা করে বলে, ‘এখন রাখি।’ হৃদি ঠাট্টার সুর তুলল গলায়,

‘ফোন রাখার জন্য এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? কী করতেছিস আসলে দোস্ত? চুমু খাচ্ছিস নাকি?’

কথাটা শুনে তারা পারলে লাফ দিয়ে নেমে যায় রিকশা থেকে। রুদ্রর বিচলিত মুখে রক্তের লাল ঝাপটা এসে লাগে। অপ্রস্তুত হয়ে ফোনের লাইন কেটে দেয় সে। তারপর দুজনে দুদিকে দৃষ্টি দিয়ে বসে থাকে। যেন কেউ কাউকে চেনে না!

ফোনটা আবার আসে। এবার বিভার নম্বর থেকে।

‘হ্যালো।’

‘হ্যালো রোমিও!’

‘ফাইজলামি না করে কেন ফোন করছিস সেটা বল।’ কঠোর শোনায় রুদ্রর কণ্ঠস্বর

‘তুই এক কাজ কর। বাসায় ফিরে আয়।’

‘ইম্পসিবল।’ বুলেটের মতো তীক্ষ্ণ বেগে শব্দটা বেরিয়ে আসে মুখ থেকে।

‘কেন? ফিরে এসে আকাশের সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বল।’

এবার তারা ঘুরে তাকিয়েছে রুদ্রর দিকে। চোখে উৎকণ্ঠা। গালের ভাঁজে ভাঁজে ভয় মিশ্রিত দুশ্চিন্তার আকুলি-বিকুলি।

রুদ্র ওর চোখে চোখ রেখেই হৃদিকে বলল, ‘আকাশকে বল কালকের বিয়েটা আগে ক্যানসেল করতে। তারপর আমরা আসব।’

‘বিয়ে ক্যানসেল করা এত সহজ না।’

রুদ্র অধৈর্য গলায় বলল, ‘আমারে ওই লোকের ফোন নাম্বার দে। আমি ফোন করে কথা বলতেছি।’

‘তুই কী বলবি?’

‘যা বলার বলব আমি। তুই নাম্বার দে।’

সামি ফোনটা কেড়ে নিল বিভার হাত থেকে।

‘শোন… তুই প্যারা নিস না। আমরা দেখতেছি কী করা যায়। কিন্তু কথা হইল তুই এখন মেয়েটারে নিয়ে যাবি কই এত রাতে?’

রুদ্র চুপ করে রইল। সামি একটু ভেবে নিয়ে বলল,

এক কাজ কর। আমাদের বাসায় চল।’

‘আরে না… কেমন দেখায়… আংকেল আন্টি কী ভাববে?’

‘তাহলে… গাজীপুরে আমাদের একটা গেস্টহাউজ আছে। ওখানে যেতে পারিস। আমি কেয়ারটেকারকে ফোন করে বলে দিচ্ছি।’

সেই সময় ফোনটা অমৃতা কেড়ে নিল, ‘রুদ্র… অনেক হইছে। বাসায় ফিরে আয়।’

‘আগে বিয়ে ক্যানসেল কর। তারপর আসব।’

সামি অমৃতার হাত থেকে পুনরায় ছিনিয়ে নিল ফোন, ‘যাবি গাজীপুর?’

‘একটু দূরে হয়ে যায়… দেখি… তুই ঠিকানা দে।’ একটু থেমে রুদ্র আবার বলল, ‘আর শোন, আকাশকে দেখিস। ওই শালা যেন বেশি চাপ না নেয়।’

‘চিন্তা করিস না। ওরে আমরা ম্যানেজ করতেছি।’ তারা চুপচাপ শুনছিল কথাগুলো। আকাশ আর ঝুমকির কথা মনে পড়তেই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। অপরাধবোধ আর গ্লানিতে থম ধরে আছে ভেতরটা। রিকশাটা সাত মসজিদ রোডের ওপর দিয়ে বেশ দ্রুত গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছিল। মেঘ ডাকছিল ঘনঘন। আবারও বৃষ্টি নামবে হয়ত। ভেজা বাতাসটা বড় সুন্দর! গায়ে লাগলেই মন কেমন করে! তারা একবার চোরা চোখে রুদ্রকে দেখল। এলোমেলো বাবরি চুল উড়ছে হাওয়ায়। কটা চোখের মণিজোড়ায় চিকচিক করছে রাস্তার ফ্লুরোসেন্ট আলোর সাদাটে প্রতিবিম্ব। লম্বাটে শীর্ণ চোয়ালে এখন জঙ্গলের মতো দাড়ি নেই। একশ’ ভোল্টের ফকফকা হাসিটাও নেই। গম্ভীরতার গাঢ় ছায়াঘেরা মুখখানা ভারি অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। যেন কবিতার পঙ্ক্তি থেকে নেমে আসা উদাসী আউলবাউল স্বাপ্নিক পুরুষ! সেইদিকে চেয়ে থেকে তারার বুকটা ভীষণ কাঁপতে থাকে। বিশ্বাস হয় না… পছন্দের মানুষটা আজ এত কাছাকাছি বসে আছে!

সামির কাছ থেকে গেস্টহাউজের ঠিকানা পাওয়া মাত্রই রুদ্র রিকশা থামাতে বলল। ভাড়ার জন্য দরদাম না করে একশ’ টাকার একটা নোট গুঁজে দিল রিকশা চালকের হাতে। ভাঙাচোরা চেহারার মধ্যবয়স্ক রিকশাঅলা একগাল হেসে বলল, ‘আপনাদের কি আজকেই বিয়া হইছে?’

লজ্জায় কান ঝাঁঝাঁ করে উঠল তারার। চট করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল সে। রুদ্র ব্রিতভাবে শব্দটা উচ্চারণ করল, ‘না…।’ একটু থেমে তারাকে চোখ ঘুরিয়ে দেখল একবার। তারপর হালকা হেসে বলল, ‘এখনো হয়নি… তবে হয়ে যাবে। দোয়া করবেন মামা।’

তারা মুখ তুলে কোনোদিকে তাকাতে পারল না। সংকোচের একটা পাহাড় যেন ধসে পড়ছে গায়ের ওপর। মিশিয়ে দিচ্ছে মাটির সাথে। ওরা যেখানে দাঁড়িয়েছে তার পাশেই সুপার মার্কেট। রিকশা, সিএনজি, গাড়ি ভিড় জমিয়ে তুলেছে ফুটপাতের পাশে। ভারি বিশৃংখল অবস্থা। রুদ্র এই প্রথম কথা বলল তারার সাথে, ‘তোমার কিছু লাগবে?’

তারা মুখ নিচু করে বলল, ‘বুঝলাম না।’

‘না মানে… জামা-কাপড়? এখানে মার্কেট আছে। চাইলে কিনে নিতে পার।’

‘আমার কিছু লাগবে না। আপনার শার্ট-প্যান্ট ভিজে গেছে একদম। চেঞ্জ না করলে জ্বর আসবে।’

কথা যৌক্তিক। রুদ্র ঠিক করল প্রথমে বিভার বাসায় গিয়ে নিজের ব্যাগটা নিয়ে নেবে। তারপর যাবে সামির গেস্টহাউজে। উবার কল করার পর তিন-চার মিনিট অপেক্ষা করতে হলো। এই তিন-চার মিনিট ওরা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে রইল। কেন যেন আড়ষ্ট ভাবটা যাচ্ছেই না। হুট করে এমন অদ্ভুত পরিস্থিতির শিকার হতে হবে তা কে জানত! কেউ যেন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জীবনের চাকাটা একদম উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই দিক পরিবর্তনের ধাক্কা সামলে উঠতে কিছুটা সময় তো লাগবেই। রুদ্র পেছনের সিটে তারার পাশে বসতে গিয়েও বসল না কেন যেন। ড্রাইভারের পাশে বসল। এতে একরকম হাঁফ ছেড়ে বাঁচল তারা। অন্তত কিছুটা সময় তো স্বস্তিতে থাকা যাবে।

গাড়িতেও ওদের তেমন কোনো কথা হলো না। দুশ্চিন্তা, ভয় এবং সংকোচে রুদ্র ভীষণ চুপসে আছে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাবার আগে বুকটা যেমন থমকে থাকে দুশ্চিন্তামিশ্রিত ভয়ে, ঠিক সেরকম একটা ভয় ওর চেতনার পরতে পরতে ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছিল। হালকা ভলিউমে নজরুল সঙ্গীত বেজে যাচ্ছে। এয়ারকন্ডিশনের হিম হিম স্পর্শে ভরে আছে ভেতরটা। জানালার কাচের ভেতর দিয়ে তারা দেখছিল বৃষ্টিভেজা আলো ঝলমলে রাতজাগা নগরী। বহুবার দেখেছে আগে, তবে আজ যেন সম্পূর্ণ নতুন চোখে দেখল। মন খারাপের পৃথিবীটার রাজপথে কোনো মায়া ছিল না। ছিল কেবলই বীভৎস যান্ত্রিকতা। কিন্তু এই পৃথিবীতে, যে পৃথিবীতে মায়ের শরীরের ঘ্রাণ শ্বাস টানলেই পাওয়া যায়, যে পৃথিবীতে সঙ্গে থাকে জাদুকর… সেই পৃথিবীর সবকিছুই অনেক বেশি বেশি সুন্দর! তারার মনে হলো, আজকের দিনটা তার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিনগুলোর একটি। এত সুখ তার জন্য জমা ছিল তা কে জানত!

রাত সাড়ে দশটার সময় ওরা গাজীপুর এসে পৌঁছল। কাঁচা রাস্তা পার হয়ে হাতের ডান পাশে ছোট্ট পুকুর ফেলে গাড়িটা এগিয়ে গেলো গোলাপি রঙের লতানো বাগানবিলাস ছাওয়া গেটের কাছে। হর্ন দিতেই গেট খুলে দিল দারোয়ান। গাছগাছালির ছায়ায় ঘেরা শান্ত সুনিবিড় বাড়িটি দেখামাত্র ভীষণ ভালো লেগে গেলো তারার। টালির ছাদ দেয়া দোতলা বাড়ি। সামনে গাড়ি বারান্দা। দু’পাশে শোভা পাচ্ছে নানা জাতের ফুলগাছ। সামি কেয়ারটেকারকে আগেই জানিয়ে রেখেছিল। ওরা গাড়ি থেকে নেমে দেখল লুঙ্গি-গেঞ্জিপরা প্রৌঢ় কেয়ারটেকার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। ভীতু ভীতু পা ফেলে রুদ্রর পেছন পেছন এগিয়ে এল তারা। দুই ধাপের সিঁড়ি ভেঙে পোর্চে উঠে দেখল দরজার পাশে একটা আকাশি রঙের সিরামিকের জুতো। জুতোর মাথায় সবুজ রঙের ছোট্ট সিরামিকের ব্যাঙ। দরজার মাথায় লাগানো নেমপ্লেটে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘সামিউল হক’। কদিন আগেও এখানে রাশেদুল হকের নাম লেখা ছিল। সম্প্রতি রাশেদ এই গেস্টহাউজটা ছেলের নামে হিবা করেছেন। তাই নেমপ্লেট পাল্টে ফেলা হয়েছে। তারা চোখ বড় করে দেখছিল চারপাশটা। সে নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। আভিজাত্য কী বস্তু তা নিজ চোখে কখনো দেখেনি। আজকে তার চোখে মুখে মুগ্ধতা এবং বিস্ময় একযোগে ডিগবাজি খাচ্ছে।

ভেতরে ঢুকতেই মাঝারি আকারের ড্রয়িং রুম চোখে পড়ল। দুই সেট লাল গদির কাউচ। একটা সাদা ফুটন। সেন্টার টেবিলে সাজানো ফুলদানি থেকে মাথা তুলে উঁকি দিচ্ছে কয়েক জোড়া লাল গোলাপ। পাশে একটা মার্বেল পাথরের মোমদানি। জানা গেল কেয়ারটেকারের নাম আকবর। সে ব্যাগ বহন করে করিডোরের সাথে লাগোয়া একটি ঘরে পৌঁছে দিল ওদের। রুদ্র লক্ষ্য করল অন্যান্য ঘরগুলোতে তালা দেয়া। আকবরকে সামি ওদের বিষয়ে কী বলেছে আল্লাহ জানে। অন্যঘর খুলে দিতে বলতে সংকোচ হচ্ছে। লোকটা জানালো সে এখানে থাকে না। বাড়ি খুব কাছেই। পুকুর ধারে। রাতে কিছু প্রয়োজন হলে ফোন করে জানালেই হবে। কেয়ারটেকার ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর তারাও আর দাঁড়ালো না। ছুটে পালালো ঘর থেকে। ওকে এভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে রুদ্রর মনে একটা অপমানের কাঁটা খচখচ করে উঠল। এত দূরে এমন নির্জন একটা বাড়িতে হুট করে চলে আসা বোধহয় উচিত কাজ হয়নি। মেয়েটা অন্যরকম কিছু ভাবছে কি না কে জানে! এই খবর বাবা মায়ের কানে গেলে সর্বনাশ! বাড়ি থেকে দূরে, প্রায় অনেকগুলো বছর একটানা ঢাকায় থেকেছে সে। যতই বাউন্ডুলে ছন্নছাড়া বা এলোমেলো হোক না কেন, বাড়ির লোকের কানে কখনো কোনো অপবাদ যায়নি। নারীঘটিত কেলেঙ্কারি বা নেশা ভাং করার বদনাম তার বন্ধুদের মধ্যে কারুরই নেই। কিন্তু আজকের এই ঘটনার কথা মা বাবার কানে গেলে কী রকম সর্বনাশ হবে তা চিন্তা করেই গা শিউরে উঠল ওর। দুশ্চিন্তার একটা ঝড় উঠল বুকের ভেতর। বৃষ্টিভেজা জামা-কাপড় এতক্ষণে মোটামুটি শুকিয়ে গেছে। তবে একটা ভ্যাপসা সোঁদা সোঁদা গন্ধ বেরোচ্ছে। কাপড় পাল্টে নিয়ে সে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে নিল ভালো করে। মাথাটা ভার হয়ে আছে। জ্বর না এলেই বাঁচোয়া। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল আকবর আর তারা ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। তারার মুখে কোনো দুশ্চিন্তার ছাপ নেই। বরং চোখেমুখে একটা চাপা আনন্দ ডগমগ করছে। মাথার ঘোমটা নেমে গেছে ঘাড়ে। চুলে এল খোঁপা। খোঁপার চারিধারে বেলিফুলের গজরা জড়ানো। কপালে একটা বড় লাল টিপ। কী সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে! যেন রবীন্দ্রনাথের গল্পের নায়িকা!

রুদ্রকে দেখে আকবর এক গাল হেসে বলল, ‘ভাবী খুবই ভালো মানুষ। আমি এতবার বললাম আমার কোনো সাহায্য লাগবে না। উনি শুনলেনই না। নিজের হাতে সব খাবার গরম করলেন।

তারার চোখে লজ্জার রেশটা ফিরে এলো। রুদ্র একটু হাসল শুধু। কিছু বলল না। লক্ষ্য করল লোকটার কথায় কোনো আঞ্চলিকতার টান নেই। ঝকঝকে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে। চেহারা দেখেও মনে হয় যেন মার্জিত রুচিসম্পন্ন পরিবারের কেউ। আকবর সযত্নে চেয়ার এগিয়ে দিল ওর দিকে। বলল, ‘মাত্র তিন ঘণ্টা আগে সামি ভাই ফোন করে বললেন তার বেস্ট ফ্রেন্ড আসবেন। বলেছেন আদর যত্নের যেন কোনো কমতি না হয়। এত অল্প সময়ের মধ্যে কিছুই করতে পারিনি। আমার গিন্নী তাড়াহুড়া করে যা পেরেছে করেছে।’

রুদ্র দেখল টেবিল ভর্তি হয়ে আছে খাবারে। খিচুড়ি, গরুর মাংস, কাবাব, সবজি ইত্যাদি। সে কৃতজ্ঞ গলায় বলল, ‘অনেক কিছু করেছেন আকবর ভাই। এত আয়োজনের প্রয়োজন ছিল না।’

তারা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসেছে। রুদ্রর মুখোমুখি। আকবর সহজ গলায় প্রশ্ন করল, ‘আপনাদের বিয়ে হয়েছে কতদিন হলো স্যার?’

তারা জগ থেকে পানি ঢালছিল গ্লাসে। প্রশ্ন শুনে হাত কেঁপে গেল। পানি চলকে উঠে গড়িয়ে পড়ল টেবিলে। আকবর ঘটনাটা লক্ষ্য করল। সে বেশ বুদ্ধিমান। তারার বিচলিত অবস্থা দেখে মনে সন্দেহের উদ্রেক হওয়া অসম্ভব ব্যাপার নয়। রুদ্র পরিস্থিতি সামলে নেয়ার জন্য ত্বরিত গলায় বলল, ‘খুব বেশিদিন হয়নি।’

তারা এমনভাবে খাবার খাচ্ছে যে দেখে মনে হচ্ছে প্লেটের মধ্যে পুরো শরীরটা মিশিয়ে দিতে পারলে বেঁচে যেত। আকবর সহজে ওদেরকে ছাড়ল না। কোথায় বাড়ি, সামির সাথে কতদিনের বন্ধুত্ব এসব নানা তথ্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিতে লাগল। রুদ্র এমনিতে ভোজন রসিক মানুষ। ভালো খাবার কব্জি ডুবিয়ে না খেলে শান্তি হয় না ওর। কিন্তু আজকে অল্প একটু খেয়েই উঠে পড়ল। হাত ধুয়ে অশান্তভাবে বেরিয়ে এল পোর্চে। আবারও বৃষ্টি নামবে। মেঘ গর্জে উঠছে থেকে থেকে। কাছেই কোথাও কাঁঠালচাঁপার গাছ আছে। বাতাসে উড়ে আসছে ভারি সুন্দর গন্ধ। রুদ্র একটা সিগারেট ধরালো। বুকে চাপচাপ হয়ে জমে আছে দুশ্চিন্তা। রাব্বি নামের লোকটা এখন খুব বেশি ঝামেলা না করলেই হয়। রুদ্র চায় না আকাশ কোনো বিপাকে পড়ুক। অবশ্য অন্য বন্ধুরা সাথে আছে। এটাই ভরসা। আকাশকে এই সমস্যা একলা মোকাবেলা করতে হবে না। বন্ধুরা ওকে আগলে রাখবে। রুদ্র সামির নম্বরে কল করল। কয়েকবার রিং পড়তেই রিসিভ করল সামি

‘হ্যালো দোস্ত, কী অবস্থা?’

‘এইতো… তোদের কী খবর?’

‘আমরা মাত্র বাসায় আসলাম।’

‘বিয়ে ক্যানসেল করছে?’

‘হ্যাঁ আকাশ তো ওই লোককে ফোন করেছে।’

‘কী বলছে ফোন করে?’

‘বলছে বউ পালাইছে।’

‘তাই?’

‘হ।’

‘তারপর?’

‘ওই লোক তো ক্ষেপে গেছে। বলে পুলিশে রিপোর্ট করবে। যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবে, ছাড়বে না কিছুতেই… এইসব বালছাল।’

‘আকাশ ঠিক আছে তো?’

‘ঠিক আছে বলতে… একটু আপসেট… তোরা আসলে বিষয়টা আগে খুলে বললেই পারতি।’

রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আগে বলব কী করে? আমি নিজেই তো কিছু জানতাম না!’

আকবর বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। সালাম দিয়ে বলল, ‘স্যার এখন আমি আসি। কোনো দরকার হইলে বলবেন। ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে আসছি ভাবীকে।’

রুদ্র সৌজন্যতার হাসি হেসে বলল, ‘ঠিক আছে আকবর ভাই। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’

আকবর একটু দূরে সরে যেতেই রুদ্র সামিকে বলল, ‘তোর এই আকবরকে আমাদের ব্যাপারে কী বলছিস?’

‘তেমন কিছুই না। জানতে চাইছিল তুই কি একা যাবি নাকি। আমি বলছি একা না, ওয়াইফ থাকবে সাথে। গার্লফ্রেন্ড বা বান্ধবী সাথে থাকবে এটা তো বলা যাবে না এদেরকে, বুঝিস না? ওই ব্যাটা বাবার কী রকম যেন আত্মীয় হয়।’

ফোনটা হঠাৎ ছিনিয়ে নিল হৃদি। কানে ঠেকিয়ে খুব আহ্লাদী কণ্ঠে বলল, ‘দোস্ত! কী করতেছিস?’

রুদ্র বিরক্ত হলো, ‘নাচি।’

‘একটু ভিডিও পাঠাইস আমাদেরকে।’

‘উফ… এত লেইম কেন তোরা?’

‘তুমি গার্লফ্রেন্ডের সাথে নাচতেছ এমন একটা দৃশ্য দেখার জন্য কতদিন ধরে কত অপেক্ষা। এখন তুমি লুকায় লুকায় নাচবা? আমাদের একটু বিনোদন দিবা না?’

‘হুম… আরো কিছু…।’

হৃদি জমানো গলায় বলল, ‘আজকে রাতে কী হবে দোস্ত? নেটফ্লিক্স অ্যান্ড চিল? তোর এতদিনের এত পবিত্র ভার্জিনিটি লস হয়ে যাবে? ভাবতেই আমার কেমন…’

‘আজাইরা প্যাঁচাল করিস না তো হৃদি। ফোন রাখি। পরে কথা বলব।’

‘হ্যাঁ এখন তো ফোন রাখবাই… গার্লফ্রেন্ড পাইছ এখন তো আর ফ্রেন্ডদেরকে সহ্য হবে না।’

ঘরে ফিরে দেখা গেলো তারা ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে। সদর দরজাটা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকল রুদ্র। আর তখনই যেন নতুন করে মনে পড়ল পুরো বাড়িতে শুধু সে আর এই মেয়েটি ছাড়া অন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি নেই এখন। মনে পড়তেই এক অদ্ভুত নাম না জানা আতঙ্ক মিশ্রিত অস্থিরতায় ওর মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত শিউরে উঠল। দুলতে থাকা হৃৎপিণ্ড নিয়ে তারার সামনে হাজির হলো সে। একটু ইতস্তত করে বসল মুখোমুখি সোফায়। দুজনে তাকালো একে অপরের দিকে। চারিদিকে কোনো শব্দ নেই, কোলাহল নেই, শুধু মাথার ওপর একটা ফ্যান ঘুরছে ভনভন করে। বাইরে বৃষ্টির আভাস। দুটি মানুষ একজন আরেকজনের চোখে চোখ রেখে বসে আছে চুপচাপ।

‘বিয়েটা ক্যান্সেল করা হয়েছে।’ রুদ্র বলল, একসময় নীরবতা ভেঙে।

‘তাই?’

‘হ্যাঁ।’

‘কোনো ঝামেলা হয়েছে কি?’

‘লোকটা নাকি বলেছে পুলিশে কেস করবে। তবে কেস করে কোনো লাভ নেই। তুমি তো মাইনর নও। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যেখানে ইচ্ছা যেতে পারে। আইনের কিছু করার নেই এখানে।

‘আকাশ ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছে?’

‘না।’

রুদ্ধশ্বাস ভালোলাগায় তারার গা শিরশির করছিল। সব কিছু কেমন স্বপ্নের মতো সুন্দর! আচ্ছা সে কোনো দীর্ঘ সুখ-স্বপ্ন দেখছে নাতো? এখুনি খালার কর্কশ কণ্ঠস্বরে সুন্দর মধুর স্বপ্নটা ভেঙে যাবে নাতো? হয়ত ঘুম থেকে উঠে দেখবে রাব্বির সাথে আর কয়েক ঘণ্টা বাদেই তার কাবিন। রুদ্র কোথাও নেই। রুদ্রর কোথাও থাকার কথাও ছিল না। কী আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটে গেল! তারা কখনো ভাবেনি কেউ ওর জন্য এতটা করবে!

হঠাৎ কোনো ভূমিকা ছাড়াই প্রশ্নটা করে বসল সে, ‘কেন করলেন এসব?’

রুদ্র একটু তটস্থভাবে বলল, ‘কী সব?’

তারা মুখ নিচু করে বলল, ‘এইযে হঠাৎ উপস্থিত হলেন… তারপর…’

এইযে এসব… যা ঘটল এতক্ষণ।’ দম আটকে দেয়া বিব্রতকর প্রশ্নটার সহজ উত্তর দেবার চেষ্টা করল রুদ্র। ভদ্রতার ছদ্ম হাসি হেসে বলল, ‘আমার মনে হয়েছিল তুমি বিয়েটা নিজের ইচ্ছায় করছ না। তাই ভাবলাম একটা রিস্ক নিয়েই দেখি। একটা মেয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করে জীবন নষ্ট করুক… এটা আমি চাইছিলাম না।’

সহজ, সুন্দর পরিচ্ছন্ন উত্তরটা শুনে তারার মনের কোণে একটা কাঁটা খচ করে উঠল। ব্যস এটুকুই? তারাকে রাব্বির হাত থেকে বাঁচানোই ছিল এই অ্যাডভেঞ্চারের এক এবং অভিন্ন উদ্দেশ্য? অন্য কোনো কারণ নেই? নেই কোনো গোপন, সুন্দর, দুর্গম অভিসন্ধি? হঠাৎ করেই আশেপাশের সমস্ত রং কেমন ধূসর হয়ে এল তারার চোখে। মনের মধ্যে একটা ত্রাস উঠল এই ভেবে যে সে হয়ত এতক্ষণ ভুল বুঝে এসেছে। হয়ত রুদ্র নিছক মানবতার খাতিরে কাজটা করেছে। কিন্তু কী দরকার ছিল এসব করার? রাব্বিকেই নাহয় বিয়ে করত সে। তারা মরুক বাঁচুক তাতে রুদ্রর কী এসে যায়?

‘আপনি কী করে বুঝলেন যে আমি বিয়েটা করতে চাইছিলাম না? আমি তো কাউকে মুখ ফুটে কিছু বলিনি কখনো!’

একটু হেসে রুদ্র বলল, ‘সবকিছু কি বলতে হয় তারা? অনেক সময় মুখ ফুটে কিছু না বললেও এক মনের কথা অন্য মনে চলে যায়।’

কথাটা শোনামাত্র একটা উৎকট ভয়ের স্রোত তারার শিরদাঁড়া বেয়ে বিদ্যুতের মতো চিলিক কেটে গেল। মনে হলো রুদ্র বুঝি ওর মনের অবস্থা ধরে ফেলেছে। সে যে দিনরাত চব্বিশঘণ্টা শয়নে স্বপনে শুধু একজনেরই ধ্যান করে গেছে বিগত বেশ কিছুদিন যাবত সেই অবগুণ্ঠিত লজ্জাজনক ঘটনা সামনে বসা মানুষটির অজানা নয়। তারার মুখটা অপমানে কালো হয়ে উঠল মুহূর্তের মাঝে। রাগ হলো নিজের ওপর। যে মেয়ের ভাগ্যে অবহেলা, অযত্ন, অনাদর আর করুণা ছাড়া কিছুই জোটেনি এতদিন, সে কোন আক্কেলে আজ হঠাৎ স্বপ্ন পূরণের এহেন স্পর্ধিত স্বপ্ন দেখার সাহস করল? ওর মতো পোড়া-কপালির ভাগ্যে হবে এত সুখ? নিজেকে নিজে গঞ্জনা দেয়ায় এতই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল তারা যে লক্ষ্যই করেনি সামনে বসা মানুষটা ওর দিকে বিভোর চোখে চেয়ে আছে। লক্ষ্য না করেই হঠাৎ খুব খাপছাড়াভাবে বসা থেকে উঠে পড়ে বলল, ‘রাত হয়ে গেছে।’

রুদ্র অবাক হলো। আঘাতও পেল। আমতা আমতা করে বলল, ‘হ্যাঁ… তুমি কি শুয়ে পড়বে এখুনি?’

তারা মুখ নিচু করে ম্লান গলায় বলল, ‘জি। খুব টায়ার্ড লাগছে।’

রুদ্র বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, ‘ঠিক আছে। তুমি তাহলে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। আমি এখানে আছি।’ বলল ঠিকই কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিষণ্ণ বোধ করল সে। কাল সকালে তারাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ফিরে যেতে হবে চট্টগ্রাম। আগামী মাসের এক তারিখ ঢাকা ফিরবে অমৃতাকে সি অফ করার উদ্দেশ্যে। তিন তারিখে তার নিজের ফ্লাইট। এরপর কবে দেশে ফিরতে পারবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। তারাকে কে বোঝাবে যে আজকের পর সামনাসামনি বসে কথা বলার সুযোগ খুব সহজে পাওয়া যাবে না। হঠাৎ দুর্দান্ত বাতাসে কয়েকবার ধাক্কা খেলো জানালার কপাট। বৃষ্টি নামল মুষলধারে। তারপর ঝুপ করে চলে গেলো বিদ্যুৎ। সারা বাড়ি ডুবে গেল গাঢ় অন্ধকারে। রুদ্র মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে আবছায়ায় দেখল তারার মুখটা ভয়ে একটুখানি হয়ে গেছে। সেন্টার টেবিলের ওপর একটা ক্যান্ডেল স্ট্যান্ড রাখা আছে। রুদ্র লাইটার দিয়ে মোমবাতি জ্বালালো। চারপাশ ঝুপসি অন্ধকার। মোমবাতির কমলা রঙের আবছা আলো দেয়ালজুড়ে রহস্যময় ছায়া বিস্তার করেছে। টালির ছাদে ঝরঝর করে ঝরছে বৃষ্টি। বাতাসে কাঁঠালচাপার ঘ্রাণ। ঘরের প্রতিটি পর্দা উড়ছে ছন্নছাড়া হাওয়ায়। জানালার কার্নিশে রাজকীয় চালে বসে আছে একটা সবুজ ব্যাঙ। ডেকে যাচ্ছে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। আগুনের শিখা দামাল বাতাসের ধাক্কায় নেচে বেড়াচ্ছে তিড়িংবিড়িং করে।

তারা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। বাতাসে শাড়ির আঁচল উড়ছে। মোমের আগুনে ওর নত হয়ে থাকা মুখটা অপার্থিব সুন্দর দেখাচ্ছে। যেন মায়া দিয়ে আঁকা। ওই মুখের দিকে চেয়ে রুদ্র বুঝতে পারল তার হৃৎপিণ্ডের শোরগোলটা আবার ফিরে এসেছে। সে দুর্বল গলায় বলল, ‘আমার ইউএসএ যেতে ইচ্ছে করছে না তারা!’

‘কেন?’

রুদ্র টেবিলের অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তারাকে মোমবাতির অলৌকিক আলোতে পিপাসার্ত চোখে দেখতে থাকে। ভরাট শ্বাস ফেলে স্পন্দিত কণ্ঠে বলে, ‘তোমাকে ছাড়া থাকব কীভাবে?’

তারার বুকে একটা অদ্ভুত তরঙ্গ উঠল। মধুর… তীব্র… ভয়ঙ্কর সুন্দর এই মন কেমনের তরঙ্গ মুহূর্তের মাঝে রক্তের শিরায় শিরায় ধাবিত হলো কুলকুল করে। আচ্ছা এই ছেলেটা কি পাগল? প্রেম নিবেদনের সঠিক নিয়মটাও কি জানে না? কোন কথাটা আগে বলতে হয়, কোনটা পরে… এতটুকু সাধারণ জ্ঞানও নেই তার ঘটে…।

‘যাচ্ছেন কেন? না গেলেই পারেন!’ ভয়ে ভয়ে… আড়চোখে… আড়গলায় কথাটা বলে সোফার ওপর বসল তারা। কোলের ওপর রাখল ভারি সুন্দর একটা গোল মখমলি কুশন।

‘কীভাবে ক্যানসেল করা যায় বলো তো? কোনো আইডিয়া আছে তোমার?’ বাচ্চা ছেলের মতো করুণ গলায় বলল রুদ্র। তারা চাপা হাসি নিয়ে চোখ তুলে দেখল ওকে। ঘাড়ের ওপর অবহেলায় পড়ে আছে একঝাঁক চুল। চুলের মাঝখানের আবছা মুখটা গম্ভীর… কঠিন… সৌম্য আর পাগলাটে! এমন পাগলও মানুষ হয়? বিদেশের একটা স্কলারশীপের জন্য লোকের কত আহাজারি, কত খাটুনি, কত প্রতীক্ষা! আর এই ছেলে সেই মহা মূল্যবান জিনিস পায়ে ঠেলে দেয়ার পাঁয়তারা করছে।

‘আপনার কি মাথা খারাপ? এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে?’

‘আমি তো দেশ ছাড়তে কখনই চাইনি। এটা আমার বাবা মায়ের ইচ্ছা।’

‘তাহলে আপনার উচিত বাবা মায়ের ইচ্ছা পূরণ করা।’

রুদ্র হুঁশ করে শ্বাস ফেলে একটা, ‘আর আমার ইচ্ছার কী হবে?’

তারা ঠোঁট উল্টে বলল, ‘আপনারও আবার কোনো ইচ্ছে আছে নাকি?’

‘থাকতে নেই?’

তারা চুপ করে চেয়ে থাকে। চেয়ে থাকে রুদ্রও। একটা নেশারু মাদকতা ছড়িয়ে পড়ে বাদলা বাতাসে আর কাঁঠালচাপার সুন্দর গন্ধে। ভালো লাগায় দম বন্ধ হয়ে আসে।

‘আপনার ইচ্ছেটা কী শুনি?’

রুদ্র দুর্বল হাসি হেসে বলল ‘আমার তো সারাক্ষণ… সারাদিন… সারারাত… শুধু তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে!’

তারা চকিতে চোখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। বাঁধছেড়া উত্তেজনা খামচে ধরল হৃৎপিণ্ড। রুদ্র বলল, ‘আমি সবসময় অনেক দুষ্টুমি করতাম। মেয়ে দেখলেই নানারকম ফাইজলামি করা আমার অভ্যাস ছিল। আমরা বন্ধুরা অনেক দুষ্টু ছিলাম তো… কলেজ ভার্সিটি লাইফে এমন কোনো দুষ্টুমি নেই আমরা করিনি। অমৃতা…আমার ফ্রেন্ড… ওর ওপর আমার হালকা-পাতলা ক্রাশ ছিল ছোটবেলায়। আর মনীষা…’

তারা চমকে তাকালো। চোখে সন্দেহ। রুদ্র বলল, ‘মনীষাকে ভালো লাগত।’

কথাটা যেন মনের মধ্যে বিষদাঁত দিয়ে কামড় দিল একদম। ভীষণ চুপসে গেলো তারা। রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কিন্তু তখনো আমি জানতাম না ভালোলাগা আর ভালোবাসার মধ্যে তফাৎটা কী!

তারা মুখ নিচু করে চুপ করে রইল। সে জানত রুদ্র খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে। প্রথম দেখার দিনই বুঝেছিল এই ছিটিয়াল, পাগলাটে, বাউন্ডুলে ছেলেটা দস্যিপনায় সেরা। এই ছেলেকে শুরু থেকেই ভদ্র কিংবা মার্জিত বলে মনে হয়নি। কিন্তু সে জানে রুদ্র কখনো মেয়েবাজ ছিল না, লম্পট ছিল না। মেয়েদের সাথে দুষ্টুমিতে একটা সীমারেখা মেনে চলে সে। তবুও আকাশের বন্ধুদের মধ্যে রুদ্রকেই সবচেয়ে উচ্ছৃঙ্খল গোঁয়ার বলে মনে হতো ওর। কিন্তু প্রকৃতির কী নির্মম উপহাস! সেই উচ্ছৃঙ্খল ছেলেটার জন্যই তারার বুকের মধ্যে অপরাজেয় আকর্ষণ টলমল করে। এর রহস্যঘেরা ছত্রভঙ্গ এলোমেলো ব্যক্তিত্ব চুম্বকের মতো টানে তাকে। ভারি আশ্চর্য এবং অবাধ্য সেই টান!

‘তারা!’

‘হুম…?’

‘এমন কেন হলো? আগেই তো ভালো ছিলাম… স্বস্তিতে ছিলাম… কেউ আমার নিজস্ব ভাবনার জগতে দখল দিতে পারেনি কখনো… কিন্তু তুমি কেন সারাক্ষণ আমার মনের মধ্যে ঘোরাফেরা কর বলো তো? তোমার কি আর কোনো কাজ নাই?’

শেষের কথাটা শুনে তারার হাসি পেল কিন্তু হাসতে পারল না। বাইরের বৃষ্টিটা এখন তার বুকের মধ্যে কষ্ট কষ্ট সুখ হয়ে ঝরে যাচ্ছে ঝরঝর করে। রুদ্র একটা গভীর শ্বাস ফেলল। কেমন ম্লান গলায় বলল, ‘অনেকদিন ধরে আমি ভালো নাই জানো? তুমি আমাকে ভীষণ বিরক্ত করছ!’

‘আমি বিরক্ত করছি?’

‘হ্যাঁ করছ… উঠতে… বসতে… ঘুমে… জাগরণে… সারাক্ষণ আমার মাথায় শুধু তুমি আর তুমি। প্রব্লেম কী তোমার?’

তারার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘মা মারা যাবার পর থেকে আমার পৃথিবীটা বদলে গেছে। আমার বাবা কিন্তু থেকেও নেই। প্ৰায় অনেক বছর ধরে তিনি আমার কোনো খোঁজ-খবর রাখেন না। নানার বাড়ির তিনটা বছর আমার খুব খারাপ কেটেছে। আমার মামারা ভালো মানুষ না। আমার এক মামাতো ভাই আমাকে প্রায়ই অ্যাবিউজ করত। কয়েকবার সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছিলাম। একবার খুব জ্বর হলো। মামা বাড়ির কেউ আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। হেঁটে গিয়ে নিজের খাবার বেড়ে নেয়ার মতো শক্তি ছিল না। না খেতে পেয়ে মরেই যাচ্ছিলাম। আল্লাহর ইচ্ছায় খালা সেইসময় কী একটা দরকারে যেন মামার বাড়ি গিয়েছিল। উনার সাথেও মামাদের সম্পর্ক ভালো না। খালা তখন শুধু আমার জন্যই মামা বাড়ি যাওয়া আসা করতে লাগলেন। সেবা যত্ন করে সুস্থ করে তুললেন। তারপর নিয়ে এলেন নিজের কাছে। আকাশ ভাইয়া খুবই ভালো মানুষ। উনি আমাকে নিজের বোন হিসেবে মেনে নিয়েছেন। খালা আর ভাইয়া ছাড়া আমার জীবনে এখন আপন বলতে কেউই নেই। তাই রাব্বির সাথে যখন ওরা আমার বিয়ে ঠিক করল, আমি ওদের মুখের ওপর না করতে পারলাম না।’ তারার কণ্ঠস্বর অসম্ভব কাঁপছিল। ঘনঘন কয়েকবার নাক টানল সে। চশমা খুলে চোখের পানি মুছল। তারপর বলল, ‘রুদ্র, আমি খুবই সাধারণ একজন মেয়ে। আমার বাবা মা নেই। মানুষের বাসায় আশ্রিত হয়ে আছি অনেকদিন ধরে। লেখাপড়ায় মাঝারি। আপনার মতো ভালো স্টুডেন্ট নই। চেহারাটাও খুব একটা ভালো না। আমার মতো একটা মেয়েকে নিয়ে আপনি এতটা কেন ভাবছেন?’

তারার মুখ নিঃসৃত কথাগুলো রুদ্রকে দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। শেষ প্রশ্নটায় ধাক্কা খাওয়া ফুটবলের মতো লাফিয়ে উঠল হৃদয়। শিউরে উঠল গা। কেন ভাবছে? সত্যিই তো… কেন? রুদ্র তারার চশমাবিহীন কান্না ভেজা ফোলা চোখের দিকে প্রখর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল খানিকক্ষণ। কাঁপা কাঁপা শ্বাস উঠল ওর বুকে। ঠোঁটের দূরবর্তী আবছা কোণে প্রচ্ছন্ন একটা হাসি ফুটিয়ে বিবশ গলায় বলল, ‘ভাবতে চাই না। কিন্তু ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। আমি জানি না তুমি আমাকে নিয়ে কখনো কিছু ভেবেছ কি না। কিন্তু কেন যেন অনেকদিন ধরেই আমার একটা অদ্ভুত উপলব্ধি হচ্ছে!’

তারা ভয়ে ভয়ে, সাবধানে, বাধো বাধো গলায় প্রশ্ন করে, ‘কী উপলব্ধি?’

‘আমার মনে হয়…’

‘কী মনে হয়?’

‘মনে হয়… তুমি আমার… তোমার জন্মই হয়েছে শুধু আমার জন্য।’

‘হ্যাঁ?’

রুদ্র তারার চোখের ওপর মাদক মাদক দুটি চোখ রেখে মাদক গলায় আরেকবার উচ্চারণ করল শব্দটা, ‘তুমি আমার!’

সেই সময় ভস করে আলো জ্বলে উঠল চারপাশে। তারার মুখটা ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়ল মুহূর্তের মাঝে। লজ্জার আলপিন ফুটতে লাগল সারা গায়ে। রুদ্র তখনো চেয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে। তারা অনেক চেষ্টা করেও বিপন্ন, লজ্জিত ভাবটা লুকাতে না পেরে হাতের কুশন দিয়ে মুখটা আড়াল করে ফেলল। আদুরে গলায় বলল, ‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’

রুদ্র এই ছেলেমানুষী কথা শুনে হেসে ফেলল। একশ’ ভোল্টের ফকফকা হাসিটা। উঠে এসে মোমবাতিগুলো নিভিয়ে দিল হাত দিয়ে। বৃষ্টি থেমে গেছে। ভেজা হাওয়াটা এখন বড় মসৃণ। রুদ্র তারার পাশে বসল। বেলীফুলের সুন্দর ঘ্রাণ এসে লাগল নাকে। মৃদু স্বরে বলল,

‘তারা, আমি কি তোমার হাতটা একটু ধরতে পারি?’

মুখের ওপর থেকে কুশনটা সরিয়ে নিল তারা। জীবনে এই প্রথমবারের মতো কোনো পুরুষ তাকে স্পর্শ করার আগে অনুমতি চাইল। এতকালের মরচে পড়া মনটা হঠাৎ এক পবিত্র সুখের উত্তাপে প্লাবিত হয়ে উঠল। কাঁপা কাঁপা একটা হাত সে রুদ্রর বাদামি রঙের রোমশ হাতের ওপর রাখল। একবার তাকালো চোখ তুলে। রুদ্র ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, ‘এত সাজছ কেন?’

তারা হেসে ফেলল, ‘আজকে আমার গায়েহলুদ।’

রুদ্র ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘এত শখ গায়েহলুদের! মাঞ্জা মাইরা তো ফাটায় ফেলছ! বিয়াটা তো হচ্ছে না… এখন কী হবে?’

‘আমি কি সাজতে চেয়েছিলাম নাকি? বিভা আপুই তো জোরজার করে সাজিয়ে দিল।’

‘আর বইল না… বিভার জীবনের একটাই কাজ। সাজগোজ করা। আমার মনে হয় ওই গাধী ঘুমের মধ্যেও সাজগোজ করে।’

তারা ডান হাতটা রুদ্রর মুখের সামনে ধরে বলল, ‘বিভা আপু খুব সুন্দর মেহেদি দিতে পারে। দেখুন কত নিখুঁতভাবে আমার বরের নামের প্রথম অক্ষরটা লিখে দিয়েছে।

রুদ্র দেখল ফুল লতাপাতার নকশার মধ্যে বড় করে লেখা ‘র’। তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সেদিকে। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘ওই শালার নাম কী?’

‘কার কথা বলছেন?’

‘যার সাথে তোমার বিয়ে হওয়ার কথা।’

‘রাব্বি।’

রুদ্রর মুখে মেঘের ছায়া পড়ল। চোখে চিড়িক দিল হালকা তেজ।

‘তুমি ওর নাম লিখছ কেন হাতে?’ চোখাভাবে প্রশ্ন করে রুদ্র।

তারা ঠোঁট টিপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে বলল, ‘কই… ওর নাম তো লিখিনি!’

‘ওর নামের প্রথম অক্ষর কেন লিখেছ?’

তারা যেন দূর আকাশের তারার মতোই স্নিগ্ধভাবে মিটমিট করে জ্বলে উঠল, ‘আমি তো আমার বরের নামের প্রথম অক্ষর লিখেছি। বিভা আপু জানতে চাইল… উত্তর না দিয়ে কি থাকতে পারি? বেয়াদবি হবে না?’

রুদ্র কিছুক্ষণ বিমূঢ়ভাবে চেয়ে রইল। ধীরেধীরে বিমূঢ়তার কুয়াশা ভেদ করে ভেসে উঠল হালকা একটু আনন্দ… একটু সংকোচ… একটু উত্তেজনা। মুখের সামনের দেয়ালের দিকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে একটা বড় শ্বাস টেনে সে বলল, ‘আমার নিজের ভাগ্য দেখে অবাক হচ্ছি। আমি আসলে অনেক লাকি!’

‘হঠাৎ নিজেকে লাকি মনে হচ্ছে কেন?’

‘এইযে তোমাকে নিয়ে হুট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। যদি তুমি আমার সাথে না আসতে, যদি প্রত্যাখ্যান করতে… তাহলে কী হতো তারা? এই অপমান বুকে নিয়ে আমি বেঁচে থাকতাম কী করে?’

‘আমিও অনেক লাকি জানেন? যদি আপনি সাহস করে আমার সামনে গিয়ে না দাঁড়াতেন, আমাকে বাসা থেকে বের করে না আনতেন, তবে এতক্ষণে মনে হয় আমি মরে যেতাম!’

সেলফোনটা বেজে উঠল ঝনঝন করে। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল রুদ্র। হৃদির নাম্বার।

‘হ্যালো!’

‘হ্যালো দোস্ত… কী করিস?’

‘এইতো…’

‘এইতো মানে? কী করিস? নেটফ্লিক্স অ্যান্ড চিল?’

‘তোরা ঘুমাস না ক্যান? রাত কয়টা বাজে?’

‘আমার তো দোস্ত উত্তেজনায় ঘুম আসতেছে না!’

‘এত উত্তেজনা কেন?’

‘তোর জন্য।’

‘আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না। ঘুমা শালী!’

‘আমি ভাবতেছি দোস্ত তোর বাসা থেকে কি রাজি হবে? মানে তারার তো বাবা মা কেউ নাই। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড একদম যা তা। দেখতেও মোটামুটি… ‘

তারার ডান বাহুটা রুদ্রর বাম বাহুর সাথে ঠেকে আছে। রুদ্রর কাঁধ বরাবর ওর মাথা। হৃদির সব কথা অনায়াসে প্রবেশ করেছিল কানে। মুখের ভঙ্গি পাল্টে যাচ্ছিল। রুদ্রর হাতের ভেতর বন্দি হাতখানা শিথিল হয়ে আসছিল ধীরেধীরে। রুদ্র বিবর্ণ গলায় বলল, ‘তুই এসব কী বলতেছিস দোস্ত? মাথা ঠিক আছে?’

‘মাথা ঠিকই আছে… দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।’

তারা রুদ্রর হাতটা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে জানালার দিকে। পুরনো অবসাদটা ফিরে এসেছে তার বুকে। রুদ্র কঠিন গলায় বলল, ‘এত দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আর শোন, জীবনে কখনো আমার বউয়ের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে কোনো কথা বলবি না… আর আমার বউ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে! এটা জেনে রাখ।’

কথাটা স্বপ্নের আবেশের মতো স্নিগ্ধ হয়ে তারার কানে গিয়ে লাগল। ছুঁয়ে দিল মন। পবিত্রতায় মাখামাখি হয়ে গেলো সমস্ত সত্তা। এই স্বীকৃতি যেন রুদ্রকেই আরো বেশি করে মহিমান্বিত করে তুলল, অপরূপ করে তুলল, ওকে আরো বেশি করে ভালোবাসতে ইচ্ছে হলো… কিন্তু এতে তো তারার জীবনের সত্য পাল্টে যাবে না। নিরাশ্রয়, গৃহহারা এক মেয়েকে কোনো শিক্ষিত, ভদ্র পরিবার কেন পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেবে? তাছাড়া একথাও তো সত্য তারার চেহারাটা তেমন আহামরি কিছু নয়। এমন মেয়ে রাস্তাঘাটে হরহামেশা দেখা যায়! জানালার কাছে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তারা। বুকের পাঁজরায় পেরেক ঠুকছে অপমান মিশ্রিত যন্ত্রণা। হৃদি তখন ভিড়মি খাওয়া গলায় বলছে, ‘ওরে বাবা! এত প্রেম!’

‘সামি কোথায়?’

‘ভস ভস করে ঘুমাচ্ছে।’

‘তুইও ঘুমা।’

‘আমি তো তোর চিন্তায় ঘুমাইতে পারতেছি না।’

হুট করে বিভাও যুক্ত হলো গ্রুপ কলে। ফোন ধরেই ঘুমভাঙা ভারী কণ্ঠে বলল, ‘দোস্ত! কিস করছিস?’

রুদ্র বিরক্ত হলো, ‘তুই কি ঘুমায় ঘুমায় কথা বলতেছিস বিভা?’

‘ঘুমায় গেছিলাম। হঠাৎ তোর কথা মনে হইল। ভাবলাম ফোন দিয়ে খোঁজ নেই।’ ঘুম জড়ানো গলায় বলল বিভা।

‘শোন, তোরা ঘুমা। আমি রাখি।’

‘বল না… কিস করছিস নাকি?’

রুদ্র আড়চোখে দেখল একবার তারাকে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ির আঁচল লুটাচ্ছে মাটিতে। ঘাড় ছুঁয়ে আছে বেলিফুলের গজরা। রুদ্র বলল, ‘নাহ…’

‘এখনো কিস করিস নাই?’ বিভার গলায় রাজ্যের হতাশা। রুদ্র লাজুক কণ্ঠে বলল, ‘করি নাই তো।’

দূরে সরে যাওয়ায় তারা এখন আর বন্ধুদের কথোপকথন শুনতে পারছে না। নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জানালার সামনে। বিভা বলল, ‘প্রপোজ করছিস?’

‘হুম।’

‘ওয়াও! ক্যামনে করলি দোস্ত? একটু বল না।’ হৃদি বলল গদ্গদ স্বরে। বিভাও যোগ করল,

‘আই লাভ ইউ বলছিস?’

রুদ্র হুঁশ করে একটা বিরক্তির শ্বাস ছেড়ে বলল, ‘মামা এইসব কথা পরে শুনলে হয় না? এখনই শোনা লাগবে?’

হৃদি একগুঁয়ে গলায় বলল, ‘এখুনি বল… নাইলে ঘুম হবে না!’

‘ফোন রাখ… পরে কথা বলব।’

লাইনটা কেটে দিল রুদ্র। তারার পেছনে এসে দাঁড়ালো নিঃশব্দে। তারা টের পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো। চোখে একটু জলের আভাস। ঠোঁট কাঁপছে হালকা। স্তিমিত গলায় বলল, ‘হৃদি আপু ঠিকই বলেছেন।’

রুদ্রর চোখে প্রশ্ন চিহ্ন, ‘কীসের কথা বলছ?’

তারা মুখ নিচু করল, ‘আমার বাবা মা নেই। আশ্রয় নেই। চেহারা সুরত ভালো না। আপনার বাসা থেকে মেনে নেবে না।

রুদ্র তারার হাত ধরল, ‘হৃদি একটা গাধী। আবোলতাবোল কথা বলে সব সময়। কিন্তু ওর মনটা ভীষণ ভালো। তুমি ওর কথায় মাইন্ড করো না প্লিজ।’

‘উনি ভুল কিছু বলেননি। আমার মনে হয় বিষয়টা নিয়ে আপনার আবারও ভাবা উচিত।’

রুদ্র আরেক পা এগিয়ে আসতেই তারার পিঠ ঠেকে গেলো জানালার গ্রিলের সাথে। তারা চোখ তুলে তাকাতে পারল না। অনুভব করল রুদ্রর বুকের ভেতরের হৃৎপিণ্ড ধুকপুক করে প্রাণের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। রুদ্র একটু চাপা স্বরে বলল, ‘আমিও কোনো রাজপুত্র না। অনেক এলোমেলো… পাগল ছাগল মানুষ। তোমারও উচিত ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখা।’

তারা রুদ্রর টি-শার্টের বুকে একটা হাত রেখে চোখ তুলে তাকালো, ‘আপনার এলোমেলো দিকটাই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে!’

রুদ্র তারার কাজলমাখা জল ভাসা চোখে একদৃষ্টে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। ভাঙা ভাঙা শ্বাস ফেলে বলল, ‘আর আমার ভালো লাগে তোমার সিম্পলিসিটি… এত বেশি ভালো লাগে যে আমি সহ্য করতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যিই পাগল হয়ে যাব!’

তারার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এলো। গলায় সুড়সুড়ি দিল কান্না। চোখ নিচে নামিয়ে নিল সে। রুদ্রর দুটি হাত জানালার গ্রিলের ওপর রাখা। ওই বাহুবেষ্টনীর মধ্যে বন্দি হয়ে আছে সে। বুক কাঁপছে প্রবলভাবে। দেহের প্রতিটি অণুতে অণুতে আশ্চর্য সুখের উন্মাদনা। রুদ্র একটু কুণ্ঠা নিয়ে বলল, ‘আমার বন্ধুরা জানতে চাইছিল আমি তোমাকে কিস করেছি কি না।’ তারা ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলো। খাঁচা বন্দি পাখির মতো ছটফট করে উঠে বলল, ‘অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে পড়ুন। আপনার সকালে চিটাগাং যেতে হবে।’

‘সকালে না। দুপুরে।

‘ওইতো… একই কথা।’

‘তোমার ঘুম পাচ্ছে?’ তারা চোখ না তুলেই বলল, ‘হ্যাঁ… খুব ঘুম পাচ্ছে।’

রুদ্র সরে দাঁড়ালো। মুক্তি পেয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল তারা। রুদ্র জানালার গ্রিলে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করল দু’হাত দিয়ে। ঠোঁটের কোণে একটু হাসি, গালে রক্তের আভাস, বিড়াল চোখে নেশার মতো চিক চিক করছে একরাশ মুগ্ধতা। তারা মৃদু স্বরে বলল, ‘গুডনাইট।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রুদ্র, ‘গুডনাইট!’

তারা চলে যাবার পর রুদ্র আরো অনেকক্ষণ জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। একটা বোকা বোকা ফাঁকা ভাব উই পোকার মতো পুরো মস্তিষ্কটা যেন কুরে কুরে খেয়ে ফেলছে। মূক-অভিমানে ছেয়ে আছে অন্তর। ওই মেয়েটাকে ছাড়া সে কিছুই ভাবতে পারছে না। চুম্বকের মতো টানটান আকর্ষণের অঙ্গারে ঝলসে যাচ্ছে দেহ-মন। বড় একটা শ্বাস নিয়ে ভেতরের উত্তেজনা আর স্নায়বিক দৌর্বল্য সামলে নেয়ার চেষ্টা করল সে। বাইরের বারান্দায় পায়চারি করল। সিগারেট টানল। অস্থির চিত্তে ঘরে ফিরে এসে দেখল তারা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে। চোখাচোখি হলো।

‘কী ব্যাপার?’ রুদ্রর প্রশ্ন। তারা অসহায়ভাবে বলল, ‘ঘুম আসছে না!’

‘তাহলে?’

‘তাহলে কী?’

‘ঘুম না আসলে কী করা যায়?’

‘আসুন গল্প করি।’

রুদ্র উল্টো পাশের সোফায় বসল। তারার মুখে অস্বস্তি। চোখে ভয়ের আঁকিবুকি। রুদ্র ওর চোখের ওপর চোখ রেখে দৃঢ় গলায় বলল, ‘তুমি ভয় পেও না তারা। আমি বিনা অনুমতিতে তোমাকে ছোঁব না।’

‘আমি জানি।’

‘তাহলে ভয় পাচ্ছ কেন?’

‘ভয়টা আপনাকে নিয়ে নয়। বরং নিজেকে নিয়ে।’

রুদ্র হাসল, ‘গল্প কর।’

‘কীসের গল্প?’

যেকোনো কিছু। ভালো কিছু।’

‘আমার মায়ের কথা শুনবেন?’

‘নিশ্চয়ই!’

দেয়াল ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে বয়ে যাচ্ছিল। বাইরের মেঘাচ্ছন্ন কালো রাত ধীরেধীরে ধরা দিচ্ছিল ভোরের সুষমার কাছে। বাতাসে এখনো বৃষ্টির ভেজা স্পর্শ লেগে আছে। কাঁঠালচাঁপার উত্তাল ঘ্রাণে মাতোয়ারা চারপাশ। তারা গল্প বলছে। মায়ের গল্প। ছোটবেলার গল্প। রুদ্র চেয়ে আছে ওর দিকে গভীর তৃষিত চোখে!

৫৬

আকাশের বাসায় সকাল দশটার দিকে বন্ধুরা সব হাজির হয়েছে। রাব্বি অ্যাপার্টমেন্টের নিচে এসে চিৎকার চেঁচামেচি করে তুলকালাম কাণ্ড করেছিল। সামি হৃদির বডিগার্ড এবং দারোয়ান মিলে সামাল দিয়েছে সেই হাঙ্গামা। রুদ্র আর তারা এল বেলা বারোটার দিকে। বন্ধুরা ড্রয়িংরুমে বসে ছিল। ওরা দুজন মাথা নিচু করে অপরাধীর ভঙ্গিতে প্রবেশ করল বাসায়। মুখ শুকিয়ে এতটুকু। চোখে রাতজাগার গাঢ় ক্লান্তি। তারাকে দেখামাত্র ঝুমকি এগিয়ে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল ওর গালে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘বেহায়া মেয়ে কোথাকার! সারারাত পরপুরুষের সাথে রাত কাটিয়ে কোন মুখে তুই ঘরে ফিরলি? মরলি না কেন?’

তারা গালে হাত রেখে কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকল ঝুমকির দিকে। তারপর এক ছুটে দৌড়ে গেল ঘরের ভেতর। রুদ্র ভীষণ অবাক হয়েছে। থাপ্পড়টা যেন তারার গালে পড়েনি। পড়েছে রুদ্রর বুকে। সে খুব গম্ভীর মুখে ঝুমকির দিকে তাকিয়ে ছিল। ঝুমকি চড়া গলায় বলল, ‘আর তুমি… তোমাকে তো আমি ভদ্রলোকের ছেলে বলে জানতাম। নিজের ছেলের মতো দেখেছি। তুমি আমার বোনের মেয়েটার এত বড় সর্বনাশ করলে কেন?’

আকাশ এগিয়ে এসে ঝুমকিকে নিরস্ত করল, ‘আপনি ভিতরে যান। আমি দেখছি ব্যাপারটা।’

ঝুমকি যাবার পর আকাশ দাঁড়ালো রুদ্রর মুখোমুখি। দুই বন্ধু কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল একে অপরের দিকে। আকাশের চোখভর্তি ক্রোধ। রুদ্রর চোখে অপরাধবোধ। একটা সময় রুদ্র চোখ নামিয়ে নিল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘সরি দোস্ত!’

আকাশ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করে বলল, ‘কয়দিন পর চলে যাবি। তাই কিছু বললাম না। নাইলে হাড্ডি মাংস একটাও আস্ত থাকতো না বুঝছিস?’

রুদ্র ঘাড় কাৎ করল, ‘বুঝছি।’

‘বিয়েটা কবে করবি?’

এই প্রসঙ্গ খুব পছন্দ হলো বাকি বন্ধুদের। হৈহৈ করে উড়ে এসে জুড়ে বসল সকলে। বিভা বলল, ‘রুদ্রর বিয়েতে কী মজা হবে! আমরা সবাই মিলে চিটাগাং থেকে বরযাত্রী আসব।’

সামি বলল, ‘তুই তো থাকিস ইন্ডিয়া। চিটাগাং থেকে ক্যামনে আসবি?’

‘আরে ওর গায়েহলুদের আগে যাব তো চিটাগাং।’

হৃদির কণ্ঠ স্বপ্নালু হয়ে উঠল, ‘সত্যি… ভাবতেই আমার আনন্দে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তারার গায়েহলুদ শেষ করে পরদিন সবাই মিলে চিটাগাং চলে যাব। রুদ্রর গায়েহলুদে ধেই-ধেই করে নাচব। পরদিন আবার সবাই মিলে বরযাত্রী সেজে ঢাকা চলে আসব।’ এটুকু বলে হৃদির গলায় অন্যরকম সুর লাগল। ভারি কাব্যিক আনন্দে ভেসে যেতে যেতে সে বলল, ‘তারপর বউ নিয়ে আবার চিটাগাং। পরদিন বউভাত! ওয়াও!’

‘এমন একটা ভাব করতেছিস যেন জীবনে কোনোদিন বিয়া খাস নাই। ফকিরের বাচ্চা ফকির।’ রুদ্র বলল।

‘বিয়া খাইছি কিন্তু রুদ্রর বিয়া তো খাই নাই আগে, তাই না? তাছাড়া তোদের চিটাগাং-এর বিয়া নাকি অনেক ধুমধাম হয়। কথা সত্যি নাকি?’ অমৃতা বলল।

আকাশ ফোড়ন কাটল এবার, ‘শোন, আজাইরা প্যাচাল বাদ দে। রুদ্র. তুই বল আসলে প্ল্যান কী?’

রুদ্র শুকনো ঠোঁটজোড়া জিভ দিয়ে একটু ভিজিয়ে নিয়ে বলল, ‘প্ল্যান বলতে… দোস্ত আব্বা আম্মার সাথে কথা বলতে হবে। ওরা সারাদিন বলতে থাকে বিদেইশশা মাইয়া বিয়ে করাবে না। সো বাবা মাকে রাজি করাতে একটু টাইম লাগবে। আর যদি রাজি না হয় তাহলে আমি নিজে নিজেই বিয়ে করে ফেলব।’

এ কথা শুনে সামি ওর কাঁধে চাপড় মারল একখানা, ‘একদম… এই না হলে হিরো?’

আকাশ বলল, ‘যাই হোক, এখন এসব নিয়ে অত চিন্তার কিছু নাই। তুই আমেরিকা যা। গিয়ে একটু গুছায় নে। ছয় সাতমাস পর পারলে একবার আসিস।’

রুদ্র খুব মন খারাপের গলায় বলল, ‘না গেলে কেমন হয়? থেকে যাই। কী বলিস?’

বন্ধুরা সব হৈহৈ করে উঠল। বিভা বলল, ‘আরে…গার্লফ্রেন্ড ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না বেচারার…!’

রুদ্র মিনমিন করল, ‘শুধু গার্লফ্রেন্ড কেন? তোদেরকে ফেলেও তো যেতে ইচ্ছা করছে না।’

হৃদি কাতর স্বরে বলল, ‘আমারে নিয়া যা দোস্ত। স্যুটকেসের মধ্যে ভরে। নেয়া যাবে না?’

বিভা বলল, ‘আমাকে ল্যাপটপের ব্যাগে নিতে পারবি।

‘আমি প্লেনের চাকার সাথে ঝুলে ঝুলে চলে যাইতে পারব।’ আকাশ সিদ্ধান্ত দিল।

সামি বলল, ‘তোরা বরং এক কাজ কর। কে কোন ব্যাগের মধ্যে ঢুকবি আর কে চাকায় করে যাবি, কে পাখায় ঝুলে যাবি এসব বিষয়ে একটা লিস্ট করে ফ্যাল। আমি এখন ফুটি। কাজ আছে।’

রুদ্র বলল, ‘আমিও যাব। বাস ছাড়বে একটায়।’

‘আরেকটু বয় না দোস্ত। কালকে রাতে কী কী হইল ইন ডিটেইলস বলে যা। নইলে ঘুম আসবে না।’

বিভা বলল নাছোড় গলায়। অমৃতা একটা গাট্টা মারল বিভার মাথায়, ‘এসব ফাইজলামি আকাশের সামনে একদম করিস না। ওর ছোটবোন!’

আকাশ পাশ কাটানো গলায় বলল, ‘তোরা দুপুরে খেয়ে যা।’

রুদ্র আপত্তি করল, ‘না দোস্ত। আমার বের হইতে হবে এখুনি।’

‘আচ্ছা চা খেয়ে যা।’ চায়ের কথা বলতে বলতেই তারা চায়ের টে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। হৃদি ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, ‘ভাবী আমাদের জন্য চা নিয়ে এসেছে। আল্লাহ, ভাবী কী ভালো!’

সবাই হেসে উঠল ওর কথা শুনে। এভাবেই চায়ের কাপে আর হাসি ঠাট্টায় আরো আধা ঘণ্টা কেটে গেলো। যাবার সময় রুদ্র ঝুমকির সাথে একবার দেখা করল। বিনীতভাবে বলল, ‘আন্টি, প্লিজ আমাকে মাফ করে দেবেন। এরকম একটা ঘটনা ঘটবে আমি নিজেও কখনো ভাবিনি। তবে এতটুকু বলতে পারি তারাকে আমি অনেক ভালো রাখব। আপনি এতটুকু বিশ্বাস আমার ওপরে রাখবেন।’

রুদ্র চলে যাবার সময় বন্ধুদের মন খুব ভার হয়ে উঠল। ও সারা বছর চিটাগাং যাওয়া-আসা করে। তবুও কখনো মনে হয়নি দূরে থাকে। বন্ধুরা ডাকা মাত্রই হাজির হয়েছে সবসময়। কিন্তু এবার যে সত্যিই দূরে যাবে। অনেক দূরে। চাইলেই সকালের বাসে চড়ে বিকেলের মধ্যে ঢাকা চলে আসতে পারবে না। দেখা হবে হিসেব করে… মেপে মেপে… হয়ত অনেক বছরের ব্যবধানে।

তারা ডাইনিং-এর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। চশমার আড়ালের চোখদুটো ভেজা। ঠোঁটে কম্পন। রুদ্র একবার ওর দিকে চেয়ে আকাশকে বলল, ‘আমার বউটাকে রেখে গেলাম। দেখে রাখিস দোস্ত।’

বন্ধুরা আরো একবার হুল্লোড় করে উঠল। তারা লজ্জা পেয়ে ছুটে গেলো ভেতরে। আকাশ এগিয়ে এসে একটা হাত রাখল রুদ্রর কাঁধে, —তুই চিন্তা করিস না।’

রুদ্র কয়েক সিঁড়ি নিচে নেমে থমকে দাঁড়ালো। কী মনে করে যেন উঠে এল আবার। আকাশকে বলল, ‘তারা কোথায়? একটু কথা ছিল ওর সাথে।’

‘ভেতরে আছে। যেতে পারিস।’

রুদ্র পর্দা সরিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল। অন্য বন্ধুরা আর দাঁড়ালো না। বেরিয়ে এল সবাই। আকাশের ঘরের বিছানা করছিল তারা। বুক খাঁ-খাঁ করছে। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে গাল। ছেলেটা ঢাকা থেকে চিটাগাং যাচ্ছে তাতেই অদম্য কষ্টে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে আসার উপক্রম। আমেরিকা চলে গেলে তারা বাঁচবে কী করে? হঠাৎ পেছনে একটা শব্দ হলো। মুখ ফিরিয়ে দেখল রুদ্র দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কাঁধে ব্যাকপ্যাক। পরনে সাদা টি-শার্ট আর ছাই রঙের ট্রাউজার। জানালা দিয়ে আসা ডিমের কুসুমের মতো কমলা রোদে ডুবে আছে ওর মুখ। রাতজাগা চোখদুটো টকটকে লাল। তারা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের কোল বেয়ে নেমে আসছে জলের ধারা। রক্তে হুহু করে বয়ে যাচ্ছে তুফান। কয়েক মুহূর্ত চারটা চোখ একে অপরের সাথে লেগে রইল চুম্বকের মতো। রুদ্র দরজা ঠেলে দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এল সামনে। তারার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্যাকুলভাবে বলল, ‘আমি কি তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি তারা? প্লিজ?’

তারা হাতে ধরা চাদরটা বিছানার ওপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রুদ্রর বুকের ওপর। রুদ্র ওকে নরম বেড়ালছানার মতো জাপটে ধরে মিশিয়ে ফেলল পাঁজরের সাথে। তুলতুলে ঠোঁটে চুমু খেলো… চুমু খেতে লাগল এমনভাবে যেন এই তৃষ্ণা কোনোদিনও মিটবে না!

৫৭

এক বিকেলে মায়ের সাথে বসুন্ধরা সিটির থার্ড ফ্লোরে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটি পরিচিত মুখ দেখে থমকে গেলো অমৃতা। যুবকটি পাশের দোকানে ঢুকতে যাচ্ছিল। অমৃতাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। চোখে চাপা কৌতুক। অমৃতা একবার ভাবল, না দেখার ভান করে এড়িয়ে যায়। কিন্তু ঠিকমতো কিছু ভেবে ওঠার আগেই সুন্দর ডাক্তার ওর মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।

‘টিংকু রানী সর্দার! আছেন কেমন?’

অমৃতা হাসল, ‘ভালো। আপনি?’

‘আমি ভালো আছি। আপনার কপালে কী হয়েছে?’

‘তেমন কিছু না। একটা ছোটখাটো অ্যাক্সিডেন্ট।’

‘আপনাকে কিন্তু খুব অসুস্থ দেখাচ্ছে।’

মা এগিয়ে এসে অমৃতার পাশে দাঁড়িয়েছেন। চোখে কৌতূহল। অমৃতা বাধ্য হয়ে পরিচয় পর্বে এগিয়ে গেলো। সুন্দর ডাক্তার একগাল হেসে বলল, ‘আপনার মেয়ের সাথে আমার একাধিকবার দেখা হয়েছে। আমার মনে হয় উনার সাথে আমার কোনো কানেকশন আছে। নইলে এত বড় শহরে এত লোক থাকতে উনার সাথেই কেন দেখা হবে বারংবার?’

মা একটু ভড়কে যাওয়া গলায় বললেন, ‘কিন্তু তোমাদের পরিচয় কীভাবে হয়েছিল?’

সুন্দর ডাক্তার অমায়িক হাসি হেসে বলল, ‘সেই গল্পটা তো ভীষণ মজার! শুনতে চাইলে বলতে পারি আন্টি। চলুন, আমরা ফুডকোর্টে গিয়ে বসি।’

অমৃতা আপত্তি করল, ‘এখন একদম সময় নেই। সরি!’

‘আপনার তো কখনই সময় থাকে না মিস টিংকু রানী! এবার তো ফোন নম্বরটা দিয়ে যান দয়া করে।’

মায়ের মুখটা হাঁ হয়ে গেল, ‘টিংকু রানীটা কে?

অমৃতা মায়ের হাত টেনে ধরে বলল, ‘চলো তো!’ কয়েক পা এগিয়ে পেছন ফিরে ডাক্তারের দিকে তাকাল একবার। হাত নেড়ে বলল, ‘গুডবাই ফর নাও। ভাগ্যে থাকলে আবারও দেখা হবে!’

মা বিস্ময়ে ফেটে পড়ে বললেন, ‘ছেলেটা কে-রে?’

‘একজন ডাক্তার।’ অমৃতার দায়সারা উত্তর।

‘তোকে কী করে চেনে?’

‘সে বিশাল কাহিনি মা। পরে কোনো একসময়ে বলব।’

মা খুশি খুশি গলায় বললেন, ‘ছেলেটা দেখতে তো খুবই সুন্দর। তোর প্রতি আগ্রহ আছে মনে হলো। তুই ফোন নম্বর দিলি না কেন?’

অমৃতা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, ‘এটা কোন সুন্দর হলো? আমি যাকে ভালোবাসি সে আরও অনেক বেশি সুন্দর মা! তাকে দেখার পর থেকে অন্য কাউকেই চোখে ধরে না।’

মায়ের মুখটা রাগে থমথম করে উঠল

‘লজ্জা শরম বলতে কি কিছুই নাই তোর?’

‘তুমিই তো কথাটা তুললে। নিজেই ভেবে দেখো, উনার পাশে এই ছেলেকে দাঁড় করালে পুরাই দেবতার পাশে বাঁদর বলে মনে হবে।

মা একটু কড়া গলায় বললেন, ‘চুপ কর। তোর বাবা কিন্তু গত রাতেও ঐ প্রস্তাবটার কথা বলছিলেন। এখনো সময় আছে।’

‘সময় আছে বলতে?’

‘ছেলেটার সাথে কথা বলে দেখতে পারিস। একবার কথা বলবি? হয়ত ভালো লেগেও যেতে পারে।’

অমৃতা চোখ সরিয়ে নিল অন্যত্র। ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আমার আর কোনোদিনই অন্য কাউকে ভালো লাগবে না। শুধু শুধু একটা মানুষের জীবন নষ্ট হবে। এসব নিয়ে আর কখনো ফোর্স করো না মা। প্লিজ!’

৫৮

বাড়িতে চব্বিশঘণ্টার জন্য প্রহরী নিযুক্ত করা হয়েছে। বাইরে বেরোলে প্রত্যেকেই এখন যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে। পাশে থাকে সশস্ত্র দেহরক্ষী। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে করা মামলাটার কোনো সুরাহা হয়নি এখনো। এক বিকেলে বাবার সাথে উকিলের চেম্বারে যেতে হলো সামির। ছুটির দিন বলে তেমন ভিড় নেই। বাবা ছেলে অপেক্ষা করছিল লিফটের সামনে। উকিল সাহেবের চেম্বার তিনতলায়। সুস্থ অবস্থায় তিন চারতলা বেয়ে ওঠা রাশেদের জন্য শক্ত কোনো ব্যাপার নয়। প্রায়ই তিনি সুযোগ পেলে লিফটের ব্যবহার এড়িয়ে যান। তরতর করে সিঁড়ি ভাঙেন। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। আরো কিছুদিন চলাফেরায় কড়া সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, মেনে চলতে হবে ডাক্তারের নির্দেশনা। লিফট সমতলে এসে গেছে। খুলে গেছে দরজা। হঠাৎ পিতা পুত্রের মাঝে তৃতীয় এক ব্যক্তির আগমন ঘটল। ঢোলা শার্ট, মাথায় ছোট ছাটের চুল, কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ। রাশেদ লিফটের ভেতরে ঢুকে গেছেন। সামি তখনো বাইরে। অমৃতা দৌড়ে আসতে আসতে হাঁপধরা গলায় বলল, ‘দাঁড়া এক মিনিট। আমিও উপরে যাব।’

সামির মুখে অপ্রস্তুত ভাব ফুটে উঠল। একটু চমক… একটু অস্বস্তি… আর অল্পবিস্তর বিরক্তি নিয়ে সে বান্ধবীকে প্রশ্ন করল, ‘তুই এখানে?’

অমৃতা জরুরি এবং ব্যস্ত গলায় বলল, ‘আমার কিছু ইম্পর্ট্যান্ট ডকুমেন্ট রয়ে গেছে চেম্বারে। ওগুলো নিতে আসছি। তুই কী করিস?’ লিফটের ভেতরে পা রাখতে যাবার ঠিক আগমুহূর্তে চোখ পড়ল। লম্বা মানুষটা একদম কোণার দিকে দাঁড়িয়ে আছেন। ছাই রঙের টি-শার্ট, কালো ট্রাউজার। প্রবল একটা ধাক্কা এসে লাগল অমৃতার বুকে। অনেকদিন অতল অন্ধকার গুহাবাসের পর হঠাৎ সূর্যের প্রখর আলোয় বেরিয়ে এলে যেমন চোখ ধাঁধিয়ে যায়, ভস্ম হয়ে যায়, ঠিক তেমনিভাবেই যেন ছ্যাঁত করে পুড়ে গেলো অমৃতার চোখ। ঐ মুখের দিকে সরাসরি তাকাতে পারল না। সরিয়ে নিল চকিত দৃষ্টি। পিছিয়ে নিল পা। ত্রস্ত গলায় বলল, ‘থাক… আমি সিঁড়ি দিয়ে যাব।’

এলেভেটরের ডোর হোল্ড বাটনে আঙুল চেপে রেখে ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল সামি অমৃতার দিকে। জলদগম্ভীর গলায় বলল, ‘ভিতরে যা।’

অমৃতা বাধ্য মেয়ের মতো আদেশ পালন করল। রাশেদের সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল লিফটের প্রান্ত-ঘেঁষে। সামি দাঁড়াল মাঝামাঝি। আটকে গেল দরজা। অমৃতার মাথা হেঁট। চোখের দৃষ্টি বিচলিত, ভীত এবং অস্থির। বুকে বড্ড কাঁপাকাঁপি! অনেকদিন ধরে সে আয়নায় নিজেকে দেখে না। আজকে কেমন জোকারের মতো দেখাচ্ছে আল্লাহ জানে! ইশ… দেখা হবে জানলে একটু ফিটফাট হয়ে আসত। মাত্র এক সপ্তাহ পরেই তার ফ্লাইট। জীবনে আর কোনোদিন হয়ত দেখা হবে না। হয়ত এই শেষ! কিন্তু এ কেমন সাক্ষাৎ? চোখ তুলে তাকাবার মতো সাহস নেই বুকে। শেষবার তিনজন একত্রিত হওয়ার দিনটির কথা মনে পড়ল অমৃতার। মনে পড়ল সামির রুদ্রমূর্তি, খুনীর মতো ভয়ঙ্কর চোখ… তারপর সেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। সামির মুখ কঠোর, প্রেতের মতো নিঃস্পৃহ চোখের দৃষ্টি। একপাশে তার পিতা, অন্যপাশে সমবয়সী বান্ধবী। দুজনের মধ্যে জন্মজন্মান্তরের বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। দাঁড়িয়ে থাকবে আজীবন!

একটা বরফশীতল স্তব্ধতা বিমূঢ় করে তুলেছিল রাশেদকে। অমৃতা সামনে এসে দাঁড়াতেই সর্বপ্রথমে চোখ পড়েছিল কপালের কাটা দাগটার ওপর। কী প্রকাশ্য আর প্রকট ক্ষতচিহ্নটা! এই দাগটা কি আজীবন ওর সঙ্গে থেকে যাবে? কখনো মুছে যাবে না? রাশেদ কুঞ্চিত কপাল নিয়ে লিফটের দরজার দিকে চেয়ে ছিলেন। এক হাত দূরে সামি, আরো এক হাত দূরে অমৃতা। কারো মুখে কথা নেই। বাতাসে বুকচাপা অস্বস্তি। চার দেয়াল বন্দি খুপরি লিফট ছেড়ে এই মুহূর্তে অন্য কোনোদিকে যাবার উপায় নেই। কিছু সময় পরেই লিফটের দরজা খুলে যাবে। মাত্র কয়েকটা মিনিট। এর মধ্যেই বহুবর্ণময়, ব্যাখ্যাতীত সব চিন্তা রাশেদের মস্তিষ্কে খড়কুটোর মতো ভেসে বেড়াতে লাগল। জীবনে কিছু ছোট ছোট অভিজ্ঞতা মানুষকে অনেক বড় বড় শিক্ষা বা উপলব্ধির হদিস দিয়ে যায়। আজকে এই মুহূর্তের মুখোমুখি না হলে তিনি জানতেন না যে, এতদিন মনে মনে একটি ভুল ধারণা পুষে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন ছাব্বিশ বছর বয়সী টগবগে যুবক পুত্রকে তিনি ভয় পান। কিন্তু অমৃতা সামনে এসে দাঁড়ানো মাত্র জীবন লিপির একটা পৃষ্ঠা যেন খসখস করে পালটে গেল দমকা হাওয়ায়। এই পৃষ্ঠায় কোনো ভয় নেই, সংকোচ নেই, শাসন নেই… আছে শুধু হৃদয়ের মুক্ত, বিহঙ্গ, সত্য উপলব্ধি। অমৃতা তার জীবনের তেমনই এক সত্য উপলব্ধির নাম, যে উপলব্ধিকে নিজের কাছে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কোনো উপায় তার জানা নেই। তবুও সত্যটা গ্রহণ করে নেয়া যায় না। একটা কিন্তু থেকে যায়। ‘কিন্তুটা ভয়ভীতি নয়, বরং দায়িত্ববোধ, নৈতিকতা ও কর্তব্যপরায়ণতা। এই দায়িত্ববোধ থেকেই ছেলেকে তিনি কখনো নিজের মনের সত্য উপলব্ধির সন্ধান দেবেন না। মিথ্যা বলে যাবেন বারংবার। একটা মিথ্যা যদি সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করে, বাঁচিয়ে দেয় অনেকগুলো সম্পর্ক… তবে সেই মিথ্যা শিরোধার্য করে রাখাই উত্তম। লিফটের দরজা খুলে যেতেই অমৃতা হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেলো। সামি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল বাবাকে। রাশেদ চোখ ফিরিয়ে নিলেন না। অকুতোভয়, নির্ভীক চোখে চেয়ে রইলেন পুত্রের দিকে। ছেলেকে তিনি ভয় পান না। এই একটিমাত্র আবিষ্কার তার ভেতরে নতুন করে যেন প্রাণের স্পন্দন ফিরিয়ে এনেছে। রক্ত চনমন করছে। শরীর থেকে ধুয়ে মুছে গেছে রোগ শোকের গন্ধ।

বেশ দীর্ঘসময় আলাপ হলো উকিল সাহেবের সঙ্গে। একটা জরুরি ফাইল খুঁজে দেবার জন্য অমৃতার ডাক পড়ল। শেলফের ওপর থরে থরে সাজিয়ে রাখা ফাইলের বস্তা ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে অমৃতার কাণ্ডজ্ঞানহীন অবাধ্য চোখজোড়া বারেবারে উড়ে গিয়ে বসছিল সেই মানুষটার চোখের ওপর। সামি দেখছিল অমৃতার হাতে পায়ে এক অবশীভূত অস্থিরতা উদ্দাম নৃত্য নেচে বেড়াচ্ছে। রক্ত রং ভিড় করেছে মুখে। চোখে চপল খুশির ছায়া। এত বেহায়া মানুষ হয়? সামির সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছিল রাগে। চোখের নিচে ঝাপটা দিচ্ছিল ক্রোধের লেলিহান শিখা। হঠাৎ দৃষ্টি পড়ল পাশে বসে থাকা মানুষটার ওপর। শিউরে উঠল সামি! বাবার মুখে এমন বিশুদ্ধ বিহ্বল ভাব সে জীবনে কোনোদিন দেখেনি! প্রসন্নতার নির্মল আলো ঠিকরে পড়ছে ঐ চোখে। আশ্চর্য এক ভয়ের স্রোত সামির হাত পা জমিয়ে দিয়ে গেলো। তার নিজের সান্নিধ্যও বাবার চেহারায় এমন চিত্তপ্রসাদের সঞ্চার ঘটায় না, যে চিত্তপ্রসাদের সঞ্চার ঘটিয়েছে অমৃতার এক ঝলকের উপস্থিতি! যে বাবাকে সে জন্মের পর থেকে দেখে এসেছে… ভালোবেসেছে… নিজের বলে জেনে এসেছে… সেই বাবাকেই আজ বড্ড অচেনা লাগতে লাগল। ভয়ঙ্কর মন খারাপে ভারী হয়ে উঠল মন। সেই মন খারাপের ঘোর সহজে কাটল না। বাড়ি ফিরে কারো সাথে ঠিকঠাক কথা বলল না সামি। খেলো না কিছু। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একের-পর-এক সিগারেট পুড়িয়ে ছাই করল। হৃদি কতবার কতকিছু প্রশ্ন করল, সামি উত্তর দিল না। এক গুমোট নিরবচ্ছিন্ন নিস্তব্ধতার খোলসের ভেতর আত্মগোপন করে রইল। মাঝরাতে তাড়া খাওয়া পাগলের মতো দিশাহারা অবস্থায় উপস্থিত হলো স্টাডিরুমে। ডেকে উঠল ব্যাকুলভাবে।

‘বাবা!’

রাশেদ একটা বই পড়ছিলেন লম্বাটে টেবিলের পার্শ্ববর্তী ইজি চেয়ারে বসে। সামির মাথার চুল উষ্কখুষ্ক, চোখের নিচে রাত্রি জাগরণের কালি। মনে হয় যেন সহস্র রাত ধরে নিদ্রাহীনতার কঠোর অসুখে ভুগে যাচ্ছে। ছেলের মুখের দিকে চেয়ে মুচড়ে উঠল রাশেদের বুক। ধড়ফড় করে উঠে বসলেন তিনি।

‘বাবা, তুমি কেমন আছ?’

রাশেদ থমকে গেলেন প্রশ্নটা শুনে। বিস্ময় ফাটা চোখে চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থেমে এল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। একটা সময় তিনি ধীরস্থিরভাবে উঠে দাঁড়ালেন। হাতের বইটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে ছেলের মাথায় হাত রেখে পরম মমতা নিয়ে বললেন, ‘আমি ভালো আছি। তুমি ভালো থাকলেই আমার ভালো থাকা হয়। এটা কি তুমি বুঝতে পার না?’

সামি দুর্বোধ্য হাসে, ‘তুমিও তো বোঝ না…’

রাশেদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলেন পুত্রের মুখের ওপর। সবল, শক্তপোক্ত, লম্বা চওড়া যুবক। তবুও মুখ থেকে মুছে যায়নি কৈশোরের লাবণ্য। মুখের কোথায় যেন এখনো লেগে আছে ছেলেবেলার সেই আহ্লাদী, আদুরে আবেগের চিহ্ন। সেদিনের সেই ছোট্ট সামিকে সত্যিই আজ আর আগের মতো করে বোঝা যায় না। প্রাপ্তবয়স্কতার দুর্বোধ্য এক বলয় আজ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে রাখে সারাক্ষণ। রাশেদ একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, ‘আমিও তো মানুষ… সবটা বোঝার সাধ্য আমার নেই। স্বীকার করি। কিন্তু তুমি একবার বোঝানোর চেষ্টা করে দেখতে পার। হয়ত বুঝেও যেতে পারি!’ সামি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, ‘তুমি বোঝ না কেন বাবা? আমি ভালো থাকব তখনই… যখন তুমি আর মা… তোমরা দুজনে ভালো থাকবে।’

‘আমরা ভালো আছি… খুব ভালো আছি!’

সামি দুজ্ঞেয় দৃষ্টিতে বাবার দিকে চেয়ে থাকে। ঠোঁটে খেলতে থাকে এক চিলতে ভুতুড়ে হাসি। রাশেদ ছেলের চোখে চোখ রাখতে পারলেন না। দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। ছেলেটা যেন হঠাৎ করেই অনেক বড় হয়ে গেছে। হয়ে উঠেছে অন্তর্যামী! গ্লানি আর অপরাধবোধের প্রবল অত্যাচারে পিষ্ঠ হতে হতে রাশেদ টের পেলেন… একমাত্র সন্তানের কাছে তিনি ধরা পড়ে গেছেন… পালাবার আর কোনো পথ নেই! সামি ধীরেধীরে সরে আসছিল জায়গাটা থেকে। রাশেদ মুখ তুলে ডাকলেন হঠাৎ, ‘একটা কথা শুনে যাও। ‘ সামি থামল। বিষণ্ণ একজোড়া চোখ স্থাপন করল বাবার মুখের ওপর।

রাশেদ ভারী কণ্ঠস্বর নিয়ে মন্থরভাবে বললেন ‘বুকে যখন গুলি এসে লাগল… আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না সেটা কী রকম যন্ত্রণা, সেরকম যন্ত্রণা যেন সৃষ্টিকর্তা কাউকে কখনো না দেন। কিন্তু শারীরিক কষ্টের চাইতেও মানসিক পীড়া আমাকে বেশি দুর্বল করে দিয়েছিল। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসার সময় ভেতর থেকে শুধু একটামাত্র নাম বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। সেই নামটা তোমার। চোখ বন্ধ করার আগে আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, আর একটাবার যেন তিনি আমাকে আমার ছেলের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ করে দেন। আল্লাহ তায়ালা আমার দোয়া কবুল করেছেন। আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তোমাকে দেখছি। সুস্থভাবে কথা বলতে পারছি। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার চাওয়ার নেই।’

৫৯

আজকাল সামিকে নস্টালজিয়ায় পায়। কেবলই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। কত স্মৃতি, কত সুখ, কত আনন্দ, কত টুকরো টুকরো অনুভূতি! বন্ধুদের সাথে কাটানো প্রতিটি দিন যেন স্বর্গ থেকে ভেসে আসা! অমন নিষ্কলুষ আনন্দ শুধু বন্ধুদের সান্নিধ্য ছাড়া পাওয়া যায় না। অমৃতার বলা সেই কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছিল না সামি।

‘আমি কখনো চাই নাই রুদ্রর ভাগ্যটা আমার মতো হোক।’

বাক্যটা অষ্টপ্রহর নরকের কীট হয়ে বিবেককে দংশন করে যাচ্ছিল। কাজের ফাঁকে, ঘুমের ঘোরে… এমনকি স্বপ্নের অবচেতনেও কথাটা কানের কাছে বেজে যাচ্ছিল ভাঙা টেপ রেকর্ডারের মতো। চোখ বন্ধ করলেই সে দেখতে পাচ্ছিল অমৃতার শীর্ণ হয়ে আসা মুখ, চোখের নিচের কালি, কপালের ক্ষত… আর চেহারার খাঁজে খাঁজে স্থায়ীভাবে বসে যাওয়া চির দুঃখী ভাব। এমন ছিল না অমৃতা। ফর্সা, সুন্দর, আদুরে দেখতে ছিল। দারুণ আত্মবিশ্বাসী। চোখের কোল ঝকঝক করত বুদ্ধিতে। ঠোঁটে থাকত তীক্ষ্ণ হাসি। সেই অমৃতা কোথায় হারিয়ে গেল! ভাবতে গেলে বুকটা খালি খালি লাগে। অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা আকণ্ঠ ডুবিয়ে দিয়ে যায়। দিশাহারা বোধ হয়! কোনোদিকে যাবার পথ খুঁজে পায় না সামি। যেন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এখন শুধু মাথা ঠুকে ঠুকে মরা ছাড়া আর কোনো গতি নেই।

প্রায় প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে এসে হৃদিকে বাড়িতে পাওয়া যায় না। দুপুরের পরেই সে বিভাকে নিয়ে অমৃতার বাসায় চলে যায়। আকাশও চলে যায় ওখানটায়। সবাই একসাথে ডিনার করে। মাঝে মাঝে রাত জেগে আড্ডা দেয়। হৃদির সাথে গাড়ি থাকে। তাই রাত হলেও সমস্যা হয় না। এর মাঝে একদিন হৃদি বলল, ‘তোকে খুব মিস করি। রুদ্রটাও নাই। কতদিন আর রাগ করে থাকবি। চল কালকে একবার যাই অমৃতার বাসায়। সামি কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। নিজের চারধারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা অদৃশ্য দেয়ালটা টের পায়। সেই দেয়াল ডিঙিয়ে কোথাও যাবার সাধ্য নেই তার।

পরদিন সকালে অমৃতার নম্বরে ডায়াল করে সে। ওর ফোন পেয়ে ভারী অবাক হয় অমৃতা।

‘কীরে সামি? হঠাৎ কী মনে করে?’

‘দেখা করতে পারবি?’

‘কখন?’

‘বিকাল চারটায় ফ্রি আছিস?’

‘হুম আছি মনে হয়।’

‘আমি পিক করব তোকে বাসা থেকে। রেডি থাকিস।’

বিকেল চারটায় সামির গাড়ি এসে থামল অমৃতাদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে। ফোন দিতেই অমৃতা নিচে নেমে এলো। আকাশী রঙের টি-শার্ট আর ব্ল্যাক জিন্স পরেছে। চোখে রোদ চশমা। ড্রাইভার নেই। সামিই ড্রাইভ করছে গাড়ি। অমৃতা ড্রাইভিং সিটের পাশে উঠে বসল। আড়চোখে দেখল একবার সামিকে। গায়ে অফিসের ফুলস্লিভ ফর্মাল শার্ট, গলায় টাই। মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ধবধবে ফর্সা গালে অল্প অল্প অবহেলার দাড়ি। মুখে একটা দুর্বোধ্য কঠোর ভাব। ঐ কঠিন মুখের দিকে চোরা চোখে চেয়ে থেকে অমৃতা টের পেল সামিকে সে এখনো ভয় পায়। সকালবেলা ফোনটা পাবার পর থেকে ভেতরকার উত্তেজনায় অস্থির লাগছিল। এক মুহূর্তের জন্য স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারেনি। দুশ্চিন্তা ছিঁড়ে খেয়েছে মাথা। কী কারণে সামি আজ এতদিন পর হঠাৎ তলব করল? রাগের মাথায় আবার কোন অঘটন ঘটিয়ে বসবে নাতো? নাকি অমৃতাকে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধু তালিকা থেকে বাদ দেবে? কে জানে কী হবে! কী যে অস্বস্তি! একঝাঁক অস্বস্তি ঠেসে আছে শ্বাসনালীতে!

বড় রাস্তায় গাড়ি উঠিয়ে সামি কিছুটা নিষ্প্রভ গলায় বলল, ‘কিছু খাবি?’

‘নাহ…’

‘কফি?’

‘নাহ…’

‘আইস্ক্রিম?’

‘নাহ…’

‘ঘুষি?’

অমৃতা হেসে ফেলল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সামির দিকে। মুখটা এখনো কঠিন করে রেখেছে কিন্তু কথাবার্তায় স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে বিধায় একটু আরাম লাগল অমৃতার।

‘বিড়ি খাওয়াইতে পারিস।’ অমৃতা বলল।

‘ক্যান? তোর কাছে নাই?’

‘আজকাল কমায় দিছি।’

‘তাই নাকি? কী কারণে?

অমৃতা চুপ করে রইল। গত কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। আজ সকালেও এক পশলা ঝরে গেছে মুষলধারে। এখনো আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কিছু রাস্তায় পানি জমে আছে। ফুটপাত থকথক করছে কাদায়। উঁচু বিল্ডিংগুলোর ইট-পাথরের গায়ে শ্যাওলাপড়া ভেজা গন্ধ। দেশ ছেড়ে যাবার পর এই সমস্ত কিছুই ভীষণ মিস করবে। এমন বর্ষা বোধহয় পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। একটু আনমনা হতে-না-হতেই সামির কথা ঘোর ভাঙিয়ে দিল।

‘তোর ফ্লাইট কি পরশু দিন?’

‘হ্যাঁ।’

‘কখন?’

‘রাত নয়টা।’

‘কতদিনের জন্য যাচ্ছিস?’

‘দু’বছরের কোর্স।’

‘দেশে ফিরবি তো? নাকি ফেরার ইচ্ছা নাই?’

অমৃতা চুপ করে থাকে। উত্তরটা তার নিজেরই জানা নেই। একটা কফিহাউজের সামনে গাড়ি থামায় সামি। পার্ক করে নেমে পড়ে। লিফট দিয়ে উঠে আসে টপফ্লোরে। খোলা ছাদের ওপর চেয়ার টেবিল পাতা। ধূমপানের অনুমতি আছে। ছাদের মাঝামাঝি জায়গায় একটা ছোট টেবিলে মুখোমুখি বসল ওরা। অমৃতা অর্ডার করল ক্যারামেল ফ্র্যাপাচিনো। সামি ব্ল্যাক কফি। দশ তলার ছাদের ওপর এখন হাওয়ার গতি বড়ই দুর্গম। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। ওরা দুজন বাদে আশেপাশে কোনো খদ্দের নেই। সুনসান নীরব। চারিদিকে শুধু হাওয়ার শব্দ, বজ্রপাতের শব্দ, ছাদের ওপর সাজিয়ে রাখা পাতাবাহারের গায়ে বাতাসের বিলি কাটার শব্দ, আর নিচের পৃথিবী থেকে ছুটে আসা গাড়ির হর্নের ক্ষীণ শব্দ।

বেনসনের বাক্স থেকে একটা সিগারেট বের করে এগিয়ে দিল সামি অমৃতার দিকে। দেখল ওর শীর্ণ মুখ, ক্ষত-বিক্ষত কপাল। পাঁচ আঙুল দিয়ে মুখ ঢেকে লাইটার আড়াল করে সিগারেটে আগুন ধরালো অমৃতা। সামির প্রখর এবং সতর্ক চাউনিটা লক্ষ্য করল সে। আগে কখনো এভাবে তাকায়নি সামি ওর দিকে। মনের ভেতর অস্বস্তিটা ফিরে এল আবার। বুকে শিকারীর তাড়া খাওয়া পাখির মতো ভয়। পাপবোধটা এখনো পিছু ছাড়েনি। সামির সামনে এলেই নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়। অপরাধের ভারে নুইয়ে পড়ে ভেতরটা।

সামি পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে বসেছে ওর মুখোমুখি। ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগারেটে টান দিচ্ছে, অ্যাশট্রেতে আঙুল নাড়িয়ে ছাই ফেলছে। ধূসর বিকেলটা নিকোটিনের ধোঁয়ায় আরো বেশি রকম ধূসর হয়ে উঠছে। সেই ধোঁয়াটে ধূসরতার ভেতর দিয়ে সামি ওর তীব্র ভেদক দুটি চোখ অমৃতার মুখের ওপর লেজার বীমের মতো নিক্ষেপ করে রেখেছে।

‘কী দেখিস?’

‘তোকে।’

‘আমাকে অত দেখার কী আছে?’

সামি এই প্রশ্নের তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর দেয় না। ঠোঁটে দুর্গম দুর্বোধ্য হাসি খেলা করে। আকাশের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবে আনমনে। তারপর পরিহাসের গলায় বলে, ‘আমার বাবার পছন্দটা ঠিক কীরকম সেটা বোঝার চেষ্টা করতেছি।’

গা শিউরে ওঠা এক চমক চিলিক দিয়ে গেল অমৃতার হৃৎপিণ্ডে। সামির কাছ থেকে এই ধরনের রসিকতা কখনো আশা করেনি সে। অনেকক্ষণ মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না। বড় বড় ডাগর চোখ মেলে তাকিয়ে রইল শুধু। আঙুলের ফাঁকের সিগারেট পুড়তে লাগল নিঃশব্দে।

সামি ব্যঙ্গের হাসি হাসতে হাসতে বলল, ‘মানে আগে তোকে দেখছি আমার ফ্রেন্ড হিসেবে, এখন দেখতেছি বাবার গার্লফ্রেন্ড হিসেবে। দুইটা দুই রকম না?’

অমৃতা তাৎক্ষণিকভাবে হাতে ধরা সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

‘দ্যাখ সামি। এসব বিষয় নিয়ে তামাশা করার মুড নাই আমার।’ কথাটার সাথে অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখা একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল ফোঁস করে।

‘আরে কোথায় যাচ্ছিস? দাঁড়া… কথা আছে।’

ওয়েটার কফি আর ফ্র্যাপাচিনো রেখে গেল টেবিলে। একটু দূরে সরে যেতেই অমৃতা চাপা গলায় বলল, ‘আমি জানি তুই আমাকে এখন আর দেখতে পারিস না। হয়ত বন্ধুও ভাবিস না আর। আমি সবকিছু জানি। নতুন করে এসব মনে করায় দিতে হবে না।’

সামি কিছু বলে না। অদ্ভুত রহস্যময় হাসিটা নিঃশব্দে হাসতে থাকে শুধু। ঐ হাসি দেখে গায়ে কাঁটা দেয় অমৃতার। মনে হয় হাসির আড়ালে খুব সাঙ্ঘাতিক এক মানুষ লুকিয়ে আছে। যে ঠান্ডা মাথায় খুন পর্যন্ত করতে পারে! সামি এমন ছিল না আগে। ওর এই চারিত্রিক মানসিক অধঃপতনের জন্য দায়ী একমাত্র সে নিজে। এ-কারণেই নিজেকে তার ধিক্কার দিতে মন চায়। ঘেন্না হয়। প্রচণ্ড ঘেন্না! ঐ গা ছমছমে ভয়ঙ্কর হাসিটার দিকে চেয়ে অমৃতা ব্যাকুল গলায় বলল, ‘আমি তো বলছি সবকিছু আগের মতো হয়ে গেছে। উনার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নাই। তারপরেও তুই এসব কথা কেন বলতেছিস?’

‘সব আগের মতো হয়ে গেছে?’

অমৃতা চেয়ারে বসে পড়ে বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে তোর চেহারার এই অবস্থা ক্যান? ঘুমাস না কতদিন?’

থমকে গেল অমৃতা। কয়েকটা স্থবির সেকেন্ড কাটল নিঃশব্দে। কেন কে জানে সামির এই প্রশ্নটা বুকের মধ্যে আবছা এক সুখের তাপ ছড়িয়ে দিয়ে গেল। উষ্ণ, নরম একটা অনুভূতির অনুরণন তাকে জানিয়ে দিয়ে গেল আলতোভাবে, যে তার ভালো থাকা-না-থাকা হয়ত এখনো সামিকে ভাবায়… অল্পবিস্তর হলেও ভাবায়! অমৃতা প্রশ্নটার কোনো উত্তর দিতে পারল না। চোখ নামিয়ে নিল নিচে। ফ্র্যাপাচিনোর মগটা টেনে নিল কাছে।

‘হৃদি বলল আংকেল আন্টি নাকি তোকে বিয়ে দিতে চায়। তুই রাজি হচ্ছিস না।’

ভয়ের শিরশিরে ঢেউটা আবারও বয়ে গেল বুকের ওপর দিয়ে। অমৃতা একটু তাকালো সামির দিকে। একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘তোরা তো অনেক আগে থেকেই জানতি বিয়েশাদি, ঘর-সংসার এসব আমার দ্বারা হবে না।’

সামি একথা শুনে দুর্গম, গা ছমছমে হাসিটা আরো একবার হাসল, ‘আগের কথা এখন বলে লাভ নাই। তুই তো আর আগের অমৃতা নাই। আগে তুই আমার ফ্রেন্ড ছিলি… এখন তো…’ কথাটা বলতে বলতে সামি হঠাৎ থমকে গেল। একটা অদ্ভুত অপ্রত্যাশিত সৃষ্টিছাড়া ভাবনা তার মাথায় বিদ্যুতের মতো চিলিক কেটে গেল। অমৃতা নিশ্চয়ই এখন কোনো একভাবে তার মা হয়… কিংবা মায়ের মতো! কথাটা মনে হতেই একটা বিদ্রূপাত্মক, পাগলাটে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সে। চারপাশটা সেই হাসির দমকে থরথর করে কাঁপতে লাগল। যেন ওর সাথে গলা মিলিয়ে বিদ্রূপের হাসি হাসছে এই সুবিশাল পৃথিবী, ফেনীল সমুদ্র এবং নিঃসীম অন্তরীক্ষ। সামির মনে হলো এই একটা জায়গায় এসে তার গোটা জীবনটা সমস্ত গভীরতা বিসর্জন দিয়ে নিমেষে হয়ে উঠেছে অদ্বিতীয়, অসামান্য এক কৌতুক! অপ্রকৃতস্থ অট্টহাসিতে চৌচির হতে হতে সামি বলল, ‘তোকে কি এখন আমার মাম্মি ডাকা উচিত বাই দ্যা ওয়ে?’

অমৃতা রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে দেখল ঐ চূড়ান্ত অবমাননাকর নির্দয় হাসি। অপমানের ধোঁয়া ছুটল বুকে। রক্তে ঝংকার দিল ক্রোধ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘চুপ কর!’

সামি চুপ করল না। উন্মাদের মতো হাসতে লাগল। ধৈর্যের বাধ ভাঙল অমৃতার। টেবিলে একটা প্রবল থাবা বসিয়ে চিৎকারে ফেটে পড়ে বলল, ‘চুপ কর সামি!’ হাতের আঘাতে টেবিলে রাখা মগ থেকে চলকে উঠল তরল কফি। কালো রঙের ছিটা এসে পড়ল সামির সাদা ধবধবে ইস্ত্রী করা শার্টে। ওর হাসিটা এক লহমায় থামল না বরং পুরনো নষ্ট ইঞ্জিনের গাড়ির মতো থেমে থেমে… হোঁচট খেয়ে খেয়ে… গন্তব্যে এসে থামল যেন। অমৃতা আগুনগরম শ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আমি তোর বন্ধু ছিলাম। বন্ধুই আছি। যদি তোর আমাকে বন্ধু ভাবতে আর ইচ্ছা না করে সেটা অন্য ব্যাপার… কিন্তু আমাদের ফ্রেন্ডশিপ নিয়ে কোনো তামাশা আমি সহ্য করব না।’

সামি নিজের শার্টে এসে পড়া কফির দাগটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে তেরছা গলায় বলে, ‘আমি যে তোর ফ্রেন্ড, এই কথাটা আমার বাবার সাথে প্রেম করার সময় মনে ছিল না?’

‘ছিল। মনে ছিল… কিন্তু কিছু করার ছিল না…’

সামি প্রেতের মতো শীতল চোখে তাকায় অমৃতার দিকে, ‘কিছু করার ছিল না?’

অমৃতা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ায়। চোখে ঝাপটা মারে সমুদ্রের ঢেউ। ঝাপসা চোখে সামির দিকে চেয়ে করুণ গলায় বলে, ‘সরি বলছি তো তোকে… আর কতবার বলতে হবে?’

সামি অমৃতার কপালের ক্ষতটার দিকে তাকায়। কী যেন চিন্তা করে গভীরভাবে। কফির কাপে চুমুক দেয়। স্তিমিত গলায় বলে, ‘আমার বাবা তো তোকে পছন্দ করত না প্রথমে। আমাকে অনেকবার বলছে তোর সঙ্গ যেন আমি ত্যাগ করি। তুইও সবসময় তার এগেইন্সটেই কথা বলতি। হঠাৎ প্রেম হয়ে গেলো কীভাবে?’

অমৃতা চোখ সরিয়ে নিয়ে বাধো বাধো গলায় বলল ‘আমারই দোষ। আমার উনাকে ভালো লাগছিল। তুই তো জানিস আমি কোনো কিছু লুকাই না। সো উনাকে সব খুলে বলছিলাম। উনি রিজেক্ট করে দিছিল সাথে সাথে।’

‘ব্যস এটুকুই?’

‘এটুকুই।’

‘তো বিদেশে গিয়ে কি নতুন বয়ফ্রেন্ড হবে? নাকি আমার বাবাকে ভুলতে পারবি না কখনো?’

অমৃতার মুখে অস্বস্তির কাদা থকথক করে ওঠে। অধৈর্য গলায় বলে, ‘তোর কথা শেষ হইছে? এখন কি আমি উঠতে পারি?’

টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ছাদের ওপর খুব বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। সামি হাতের ইশারায় ওয়েটারকে ডাকল। বিল পে করল। তারপর বিরস মুখে অমৃতাকে বলল, ‘চল!’

‘আমাকে বাসায় নামায় দে। কাজ আছে অনেক।’ গাড়িতে উঠে ব্যস্ত গলায় বলল অমৃতা।

বৃষ্টির তোড় বেড়েছে। চোখের সামনেটা সাদা। উইন্ডশিল্ড নড়ছে ক্রমাগত। বড্ড ভিড়! পার্কিং লট থেকে রাস্তায় গাড়ি তুলতেই সাত আট মিনিট সময় লেগে গেল। পিঁপড়ার মতো ধীরে ধীরে অন্যান্য যানবাহনের গা ঘেঁষে-ঘেঁষে সন্তর্পণে এগোচ্ছিল গাড়িটা। ওরা চুপ করে ছিল। অমৃতা বুঝতে পারছিল এতদিনের চোরা চোরা, গোপন সংকোচটা কেটে গেছে। যে কলঙ্ক-যুক্ত সত্য নিয়ে কখনো কথা বলবে না ভেবেছিল, যা নিয়ে কথা বলা রীতিমতো নিষিদ্ধ ছিল, সেই বিধিবিরুদ্ধ, অলঙ্ঘনীয় গুরুপাক ঘটনাটি যেন আজ হঠাৎ করেই অনেকখানি লঘু এবং সহজপাচ্য হয়ে উঠল। কতক্ষণ কেটেছিল কে জানে! অমৃতা হঠাৎ বলল, ‘তুই আমাকে খুব হেট করিস, তাই না রে সামি?’

সামি চোখের পাশ দিয়ে অমৃতাকে একবার দেখল। আবেগে নাকি রাগে কে জানে, ওর নাকের পাটা একটু ফুলে উঠল ক্ষণিকের জন্য। নিঃশ্বাস ভারী হলো। অমৃতা উইন্ড শিল্ডে আছড়ে পড়া ঝাপসা, মিহি গুঁড়ো বৃষ্টির দিকে চেয়ে কেমন সিক্ত কণ্ঠে বলল, ‘দোস্ত আমি কখনো চাই নাই তোকে কষ্ট দিতে। এই কারণেই কথাটা নিজ থেকে বলি নাই। আমি ঠিক করছিলাম দেশ ছেড়ে চলে যাব। সব কিছু ভুলে যাব। তোর সাথে যোগাযোগ থাকবে কিন্তু তোর ফ্যামিলির সাথে কোনো কন্ট্যাক্ট রাখব না। ভাবছিলাম আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোকে না জানায়েই সমস্যাটার সমাধান করে ফেলব।’

মুষলধারে বৃষ্টি নামতেই রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেছে। অমৃতা এতক্ষণে খেয়াল করল গাড়ি মহাখালি ফ্লাইওভারের কাছাকাছি এসে গেছে। বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করল, ‘কীরে? আমাকে বাসায় নামায় দিলি না? কোথায় যাচ্ছিস?’

সামি উত্তর দিল না। চুপচাপ ড্রাইভ করতে লাগল। স্পিকারে ছেড়ে দিল গান। আরো আধাঘণ্টা পরে গাড়িটা ওদের উত্তরা বাড়ির গেটের সামনে এসে থামল।

‘এখানে কেন আসছিস?’ প্রায় গর্জে উঠল অমৃতা। বাড়ির সামনে পুলিশ টহল দিচ্ছে। গেট খুলতে খুব বেশি সময় লাগল না। সামি লন সংলগ্ন ড্রাইভওয়েতে গাড়ি থামিয়েই আদেশ করল অমৃতাকে, ‘নাম!’

‘মানে কী?’

‘নামতে বললাম!’

অমৃতা রক্তে আবারও ভয়ের ছোবল টের পাচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে উৎকণ্ঠায়। সে একটুও নড়ল না। শক্ত হয়ে বসে থেকে একরোখাভাবে বলল, ‘সামি আমি কিছু বুঝতেছি না। এই বাসায় কেন আসছি আমরা?’

সামির মুখে পাগলামির চিহ্ন। অমৃতার দিকের দরজাটা দুম করে খুলে বাঘের মতো গর্জে উঠে বলল,

‘নেমে আয়! চলে যাবি। বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করবি না?’

অমৃতার মুখটা কুঁকড়ে গেলো তীব্র যন্ত্রণায়।

‘প্লিজ সামি! স্টপ বিইং রিডিকিউলাস। ইউ আর ড্রাইভিং মি ম্যাড!’

সামি ওর বাহু খামচে ধরে টেনেহিঁচড়ে বের করল গাড়ি থেকে। কাছেই দু’জন গার্ড দাঁড়িয়ে ছিল। কড়া চোখে একবার তাকালো সামি ওদের দিকে। তাকানোর ভঙ্গিতেই গার্ডদ্বয় বুঝে নিল কী করতে হবে। চট করে সরে গেলো জায়গাটা থেকে। বৃষ্টি তখন ধরে এসেছে। গাছের পাতায় জমে থাকা টলটলে জলবিন্দু বাতাসের ধাক্কা খেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক-সেদিক। ড্রাইভওয়ে পিচ্ছিল, কর্দমাক্ত। মেঘলা আকাশ থেকে নেমে এসেছে সন্ধ্যার ছায়া। প্যাটিওতে জ্বলতে থাকা বাল্বের হলদে অস্পষ্ট আলোয় মাখামাখি হয়ে আছে ওদের দুজনের মুখ। সামি অমৃতাকে জোরপূর্বক দাঁড় করালো নিজের সামনে। ছিটগ্রস্ত, চিড়-খাওয়া চোখে কিয়ৎক্ষণ অপলক চেয়ে থেকে কাটা কাটা গলায় বলল, ‘অমৃতা! লাইফে এই প্রশ্নটা শুধু একবার করব। প্রথম এবং শেষবারের মতো। ভেবে-চিন্তে উত্তর দিবি।’

সামির পাগল পাগল মুখটার দিকে চেয়ে অদ্ভুত এক ত্রাসে দম আটকে আসতে চাইল অমৃতার। কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘কী প্রশ্ন?’

‘তুই কি আমার বাবাকে বিয়ে করবি?’

অমৃতা বরফ জমা হিমহিম কণ্ঠে বলল, ‘এটা কোন ধরনের ফাইজলামি হচ্ছে সামি?’

‘উত্তর দে!’

মস্ত এক পুলকের ঢেউ এসে ঝপ করে ভিজিয়ে দেয় অমৃতাকে। আশায় দুলে ওঠে বুক। মনে হয়… এবার বুঝি সত্যিই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ধুঁকে ধুঁকে জীবন্ত-লাশ হয়ে আর বেঁচে থাকতে হবে না। ভালোবাসার মানুষটাকে পাশে নিয়ে বাঁচার মতো করে বাঁচবে সে। ধূসর পৃথিবীর দেয়ালে আচমকা রঙের ছোপ এসে পড়ে। বসন্তের ফুরফুরে হাওয়া ছুঁয়ে দেয় মন, দূরে কোথাও কোকিল ডেকে ওঠে কুহুতানে। আনন্দে ঝুমঝুম করে চারপাশটা!

সামি আরো এক পা এগিয়ে আসে ওর দিকে। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে,

‘লিসেন, তোর সামনে দুটো অপশন আছে। হয় তুই বাবাকে বিয়ে কর, নইলে প্রমিজ কর তার সাথে কোনো কন্ট্যাক্ট রাখবি না। কোনোদিন দেখা করবি না।’

অমৃতা একটু থমকায়। সামির হলুদাভ আলো-মাখা অস্থিরচিত্ত মুখের দিকে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থেকে সম্মোহিতের মতো বলে, ‘উনাকে বিয়ে করলে… তোর মা…’

‘আমার মায়ের কথা তোর ভাবতে হবে না। আমি আমার মা আর বউকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব।’

‘কোথায় যাবি?’

‘যাব কোথাও। পৃথিবীটা অনেক বড়।’

অমৃতা পাগলের প্রলাপ বকার মতো এলোমেলো স্বরে বলে, ‘কিন্তু তোর বাবা… বাবাকে ছেড়ে চলে যাবি?’

‘যেতে হবে।’

‘আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?’

সামি বড় একটা শ্বাস টেনে নেয়। কাঁপতে থাকে কণ্ঠস্বর, ‘যেতে হবে!’ অমৃতার চোখের কার্নিশ উপচে জল নেমে আসে। ধরা গলায় বলে, ‘কেন দোস্ত? সবাই একসাথে থাকা যায় না?’ সামি অধৈর্য হয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দৃঢ় হয়ে আসে কণ্ঠস্বর, ‘না যায় না। আমার বাবা আর আমার মাঝে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে তোর। হয় তুই উনার স্ত্রী হয়ে থাকবি, নয় আমার বন্ধু!’

অমৃতার বুকটা সুতীব্র আর্তনাদে হুহু করে উঠল। একটু আগের আনন্দে ঝুমঝুম করা পৃথিবীটা চোখের সামনে খান-খান হয়ে ভেঙে যেতে দেখল সে। দিশাহারা অসহায় এক বোধ ক্রমেই তাকে বাক্যহারা করে তুলল। যেন এমন একটা দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছে যার দু’পাশেই উত্তপ্ত অগ্নিলাভা। যেদিকেই যাক, পুড়তে তাকে হবেই! সামি মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে অন্যদিকে। অমৃতা এগিয়ে এসে ওর একটা হাত ধরল। স্খলিত কণ্ঠে বলল, ‘আমি কখনই এমন কিছু করব না যার কারণে আমাদের ফ্রেন্ডশিপ নষ্ট হবে। আমার কাছে তুই সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট।’ একটু থেমে অমৃতা বড় একটা শ্বাস টেনে নেয়। ধীর গলায় বলে, ‘আই ওয়ান্ট আস ব্যাক দোস্ত! আই ওয়ান্ট মাই বেস্ট ফ্রেন্ড ব্যাক! প্লিজ! আমাকে একটাবার ক্ষমা করে দে। আমি কোনোদিন তোর ফ্যামিলির ধারে কাছে আসব না। আই প্রমিজ!’

সামি ঘুরে তাকালো অমৃতার দিকে। কপালের দাগটা চোখে পড়ল। একটু ঝুঁকে এসে একটা হাত রাখল সে ওই খসখসে, উঁচু, অমসৃণ চামড়ার ওপর। অদ্ভুত শীতল গলায় বলল, ‘সেদিন যদি তোকে আমি মেরে ফেলতাম। তাহলে কী হতো অমৃতা?’

অমৃতা চোখ বুজে মন্ত্রপাঠের মতো বিড়বিড় করে বলল, ‘মরে গেলেই বেঁচে যেতাম!’

সামি পাঁচ আঙুল দিয়ে ওর কপালটা ঠেলে দিল দূরে। শক্ত গলায় বলল, ‘যা!’

‘কোথায় যাব?’ সামির ধাক্কা খেয়ে দু পা পিছিয়ে পড়ে অমৃতা।

‘মা হৃদিকে নিয়ে ক্লাবের পার্টিতে গেছে। ফিরতে রাত হবে। বাবা খুব সম্ভবত স্টাডিরুমে আছে। তুই গিয়ে দেখা কর।’

অমৃতা মাথা নাড়তে লাগল অনবরত, ‘না… দেখা করার দরকার নাই।’

সামি ধমকে উঠল এবার।

‘কথা শুনিস না কেন?’

অমৃতা ধরা গলায় বলল, ‘দরকার নাই…আমার লাগবে না… আমি তো বলছি… সব ভুলে যাব।’

সামি এবার একটু শান্তভাবে অমৃতার একটা হাত টেনে নিল নিজের হাতের মুঠোয়। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে তুই দেশ ছাড়ার আগে একবার দেখা করলে বাবা খুশি হবে।’ কথাটা বলেই অমৃতার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির সদর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল সামি। অমৃতা কিছু বলার সুযোগ পেলো না। চোখের সামনের দৃশ্যগুলো অশ্রুজলের দাপটে ফেটে যাচ্ছে ভাঙাচোরা কাচের মতো। মনে হচ্ছিল যেন পায়ের তলায় মাটি নেই। মাথার ওপর আকাশ নেই। একটা অদম্য, লাগামছাড়া ঝড় তাকে খড়কুটোর মতো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে!

রাশেদ অনলাইন মিটিং-এ আছেন। ঘরটা এলইডি টিউব লাইটের সাদা আলোয় ঝকঝক করছে। আজকে গরম নেই বলে এয়ারকুলার চালানো হয়নি। জানালার পাল্লা খোলা। বৃষ্টিভেজা ঠান্ডা বাতাসে দোল খাচ্ছে ঘরের পর্দা। লম্বা সেগুন কাঠের টেবিলটার একপ্রান্তে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছেন রাশেদ। কানে হেডফোন। লাইট ব্লু কালারের সুতির পাঞ্জাবি তার পরনে। টেবিল ভর্তি হয়ে আছে ফাইলপত্র আর বইয়ের স্তূপে। অদূরেই নার্স ছেলেটা হাতে মোবাইল নিয়ে বসে আছে। সারাদিন রোগীর কাছাকাছি থাকার কড়া নির্দেশ আছে তার ওপর। দরজার বাইরে থেকে হঠাৎ পদশব্দ ছুটে এলো। টোকা পড়ল পরপর তিনবার। নার্স উঠে এলো। সামি ওকে দেখা মাত্র বলল, ‘আপনি প্লিজ একটু বাইরে যান। বাবার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।’

ছেলেটা ভ্রু উঁচিয়ে জড়োসড়ো, বিব্রত অমৃতাকে দেখল একবার। তারপর একটাও কথা না বলে ওদেরকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সামি ভেতরে ঢুকল। লম্বা টেবিলের শেষপ্রান্তে বসে থাকা বাবাকে দেখল একবার। রাশেদ কথা বলতে বলতে ছেলের মুখের দিকে চেয়ে হাসলেন। অমৃতা তখনো কাঠপুতুলের মতো দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। সামি ঘরের ভেতর টেনে আনল ওকে। দরজা বন্ধ করল। রাশেদের কথা তখন থমকে গেছে। হঠাৎ যেন একটা জোর ধাক্কা এসে লেগেছে তার অসুস্থ, দুর্বল হৃৎপিণ্ডে। খেই হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছেন ঘরের মধ্যবর্তী স্থানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুই যুবক-যুবতীর দিকে। অপলক চোখের দৃষ্টিতে নেমে এসেছে চূড়ান্ত স্থবিরতা। অমৃতা নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। চিবুকটা প্রায় লেগে গেছে কণ্ঠার সাথে। সামি বাবার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল। রাশেদ পুত্রর হাসির উত্তরে হাসি ফিরিয়ে দিতে পারলেন না। বিচলিতভাবে মিটিং লিভ করলেন। কান থেকে হেডফোন খুলে নিয়ে উত্তেজিতভাবে বললেন, ‘কী ব্যাপার?’

প্রশ্নটা শুনে অমৃতা আরও বেশি আড়ষ্ট হয়ে গেল। পারলে যেন মাটির সাথে মিশে যায়। সামি আশ্চর্য চোখে অমৃতার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এই মেয়েকে সে জীবনে কোনোদিন লজ্জা পেতে দেখেনি। অমৃতা সবসময় সপ্রতিভ, ড্যাম-কেয়ার, স্মার্ট! সে মাথা নিচু করে জড়োসড়ো মেয়েলি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, এই দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে সামি কখনো বিশ্বাস করত না।

‘ও লন্ডন যাচ্ছে। যাবার আগে তোমার সাথে দেখা করতে এলো।’ সামি বলল।

অমৃতা মুখ না তুলেই গলায় সামান্য অভিযোগের সুর তুলে বলল, ‘আমি আসতে চাইনি। ও নিয়ে এসেছে আমাকে।’

রাশেদ এতটা অপ্রস্তুত এবং বিব্রত বোধহয় কখনো হননি, যতটা আজকে হলেন। সংকোচের দুর্ভেদ্য আস্তরণ পড়ল বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়ায়। কুঞ্চিত কপালে বিভ্রমের অবাধ বিচরণ। কী বলা যায় কিংবা কী করা যায় তা ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারলেন না। ঠোঁট টিপে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন শুধু। সামি বাবার চোখের দিকে এখনো সরাসরি তাকায়নি। তাকাতে পারছিল না। সংকোচের উৎপীড়ন তাকেও নিস্তার দিচ্ছিল না সহজে। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আড়ষ্টভাবে বলল,

‘আমি আসছি। তোমরা কথা বলো।’ রাশেদ ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন, ‘দাঁড়াও… কোথায় যাচ্ছ? বসো। তোমার কোথাও যেতে হবে না।’

সামি নিরস্ত হলো। তাকাল একবার অমৃতার দিকে। অমৃতার তখনো মাথা নিচু। দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি জড়োসড়ো। যেন পড়া না পারার কারণে শাস্তি পাওয়া এক স্কুল ছাত্রী। সামি বলল, ‘আমার একটু কাজ আছে। আসছি কিছুক্ষণ পর।’

রাশেদ এবার কড়া আপত্তির সুরে বললেন, ‘আমি বলেছি তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। চুপ করে বসো এখানে।

সামি বাবার আদেশ অমান্য করল না। এগিয়ে এসে বসল চেয়ারে। অমৃতা দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। রাশেদ এতক্ষণে অমৃতার দিকে আড় দৃষ্টি স্থাপন করলেন। কপালে এখনো কুঞ্চন রেখা স্থির হয়ে আছে। সামি একটা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। হেঁটে এগিয়ে এল অমৃতার কাছে। কাঁধে হাত রেখে খুব ফিসফিস করে বলল, ‘কাহিনি কী? তুই এরকম এইটিজ-এর নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পাচ্ছিস কেন?’ যেন কারেন্ট শক করল অমৃতাকে। সামির পেটে জোরালো খোঁচা দিয়ে বলল, ‘ফাইজলামি করবি না। ফাজিল কোথাকার!’ সামি একটু হাসল। অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তার ভেতরে আর বিশ্রী লাগার অদ্ভুত কাঁপুনিটা নেই। এই দুজন মানুষকে একই ঘরে একই সাথে সহ্য করতে এখনো কষ্ট হচ্ছে এ কথা সত্য। কিন্তু বিশ্রী লাগছে নাতো আগের মতো!

অমৃতা গা ঝাড়া দেবার মতো করে সংকোচটা ঝেড়ে ফেলতে চাইল মন থেকে। চোখ নিচের দিকে রেখেই বলল, ‘আমি চলে যাচ্ছি… লন্ডনে … তো সামি বলল আপনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেতে। দ্যাটস ইট!’

রাশেদ অমৃতার দেশ ছাড়ার ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। বিস্মিত হলেন… হয়ত ব্যথিতও হলেন… কিন্তু পুত্রের সামনে কিছুতেই সামান্যতম দুর্বলতা প্রকাশ করলেন না। জলদ-গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘বেশ… বেশ। খুব ভালো। বেস্ট উইশেস অন ইওর নিউ অ্যাডভেঞ্চার!’

দায়সারাভাবে বাক্যটা উচ্চারণ করেই তিনি থেমে পড়লেন। ব্যস্ত ভাবে হাতঘড়িটা দেখলেন। যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটে যাচ্ছে তুচ্ছ কাজে। যেন অমৃতার বিদেশ যাওয়া-না-যাওয়ায় তার কিছুই এসে যায় না। এই অবজ্ঞাসূচক আচরণের বিষাক্ত তীর অমৃতার হৃৎপিণ্ডে গিয়ে বিঁধল একদম। লোকটা তাকে মানুষ বলেই গণ্য করছে না… আশ্চর্য! কয়েক সেকেন্ড ব্যাক্কলের মতো দাঁড়িয়ে থেকে অপদস্থ গলায় বলল,

‘আসি আমি।’ কথাটা বলেই ঘূর্ণিঝড়ের মতো তীব্র বেগে ঘুরে দাঁড়াল। হনহন করে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সামি হতভম্ব চোখে দৃশ্যটা দেখল। রাশেদ পুত্রের দিকে চেয়ে সাবলীল গলায় বললেন, ‘আর কিছু বলবে? একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে আমার।’ সামি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

অমৃতার হাত পা জ্বলে যাচ্ছিল অসহ্য অপমান আর রাগে। একটা বিষয় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, মানুষটার মনের মধ্যে তার জন্য ইঞ্চি পরিমাণ জায়গাও নেই। ভুলে গেছে সবকিছু! আসলে ভালোই বাসেনি কখনো! ভালোবাসলে কি এত সহজে ভুলতে পারত? সত্যি… ভালোবাসার কথা কখনো বলেওনি মানুষটা মুখ ফুটে। যেটুকু দুর্বলতা ছিল… সেটাকে খুব বেশি হলে মোহ বলা যায়, ভালোবাসা নয়! কান্নার একটা স্রোত কলকল করে গলা পর্যন্ত উঠে এসে শ্বাস আটকে দিল। নিজেকে ভীষণ নিকৃষ্ট, তুচ্ছ এবং অবাঞ্ছিত মনে হতে লাগল। লনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো অমৃতা। সামিও এল মিনিট দুয়েকের মধ্যেই। অমৃতা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিল। কেন যেন সামির সামনেও এই মুখ দেখাতে লজ্জা করছিল তার। সামি লঘু গলায় বলল,

‘কীরে… তোর বয়ফ্রেন্ড তো তোরে পাত্তাই দিল না!’

অমৃতা হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসতে পারল না। তার মুখখানা যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ঢেউ তুলল কণ্ঠে, ‘তোরে তো আমি আগেই বলছিলাম ব্যাপারটা একতরফা। এখন বিশ্বাস হইল?’

সামি তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলল না। ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবতে লাগল গভীরভাবে। বাবার আচরণ তার কাছে কেমন লেগেছে তা বুঝতে পারছে না, তবে অমৃতার ঐ শীর্ণ ম্লান মুখ দেখতে কেন যেন একটুও ভালো লাগছে না!

ওরা চলে যাবার পর রাশেদ বেশ কিছুক্ষণ ঝুম হয়ে বসে রইলেন। মিটিং জয়েন করলেন না। বিচলিত ভাবটা এখনো তার পিছু ছাড়েনি। অমৃতাকে সঙ্গে নিয়ে পুত্রের এই আকস্মিক আগমনের পেছনে কোনো যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা তিনি মনে মনে দাঁড় করাতে পারছেন না। এই কাজের দ্বারা সামি কী প্রমাণ করতে চেয়েছে? সে কি বাবা এবং বন্ধুর অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছে? আজকের ছোট্ট এই ঘটনাটুকু কি সেই ক্ষমার নিদর্শন? পুরো ব্যাপারটাই কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে। যেন একটা ধোঁয়াটে কুয়াশার জালের মধ্যে আটকা পড়ে গেছেন তিনি। আশেপাশে কিছুই স্পষ্টভাবে দেখা যায় না, বোঝা যায় না। এই আদিগন্ত অস্পষ্টতার ভেতরেই তার মনে পড়ল অমৃতা চলে যাচ্ছে। কতদিনের জন্য যাচ্ছে… কী কারণে যাচ্ছে… কিছুই জানা হলো না। পুত্রের সামনে সংকোচের দরুন তিনি মেয়েটির সাথে একটি কথাও বলতে পারেননি। মানুষের জীবনে এহেন অসহায় মুহূর্তও আসে? বিগত কয়েকটা দিন ছেলের সান্নিধ্য পেয়ে মনের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছিল। আজ আবারও গহন বিষণ্নতার কালো কুচকুচে অন্ধকার তাকে মাকড়সার জালের মতো জাপটে ধরল চারপাশ থেকে। অথচ এই বিমৰ্ষতা ভিত্তিহীন। অমৃতার সাথে যোগাযোগ নেই অনেক দিন যাবত। মেয়েটা দেশে থাকুক বা না থাকুক, এতে তার দৈনন্দিন জীবনে কোনো প্রভাব পড়ার কথা না। তবুও এক যুক্তিবিরুদ্ধ, শূন্যগর্ভ মর্মপীড়া বুকের পাঁজরে যেন হাতুড়ি দিয়ে আঘাত হানছে। তিনি বুঝতে পারছেন মেয়েটি একই শহরে কাছাকাছি বাস করছে এই সত্যটুকু তার অবচেতন মনে গোপন প্রবোধের সঞ্চারণ করে এসেছে এতকাল। চেতনার কোনো এক অস্পষ্ট প্রান্তে একটি ক্ষীণ, দুর্বল আশা গোধূলির শেষ আলোটির মতো আলগোছে লেগে ছিল সবসময়। মনে হতো চলার পথে কোনো এক সময় দেখা হয়ে যাবে। সেদিন লেকের পাড়ে মর্নিং ওয়াকের সময় একটি ছিপছিপে ঢোলা শার্টপরা ছেলেকে দূর থেকে অমৃতার মতো লাগছিল। কাছাকাছি যেতেই ভুল ভাঙল। অমৃতা দেশ ছেড়ে চলে গেলে দৈবক্রমে দেখা পাবার এমন সব ক্ষীণ সম্ভাবনা পুরোদমেই বিলীন হয়ে যাবে।

রাশেদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। নার্স এগিয়ে এসে সসম্ভ্রমে বলল, ‘স্যার কিছু লাগবে?’

‘কিছু লাগবে না।’ কথাটা বলে তিনি দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। নার্সকে পিছু পিছু আসতে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘তোমার আসতে হবে না। আমি একটু একা থাকতে চাই।’

লনের সামনে গাড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে দুই বন্ধু তখনো দাঁড়িয়ে ছিল। রাশেদ পোর্চে এসে দাঁড়াতেই সামির সাথে চোখাচোখি হলো। তিনি একটু ভদ্রতার হাসি হাসলেন ছেলের দিকে তাকিয়ে। তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলেন ঘাসযুক্ত বৃষ্টিভেজা কদমাক্ত মাটিতে। তারপর কোনো দিকে না তাকিয়ে গোল বারান্দা সংলগ্ন লাইব্রেরি রুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন নিঃশব্দে। অথচ অমৃতাকে শেষবারের মতো একটু দেখতে বড়ই ইচ্ছে করছিল। ছেলের উপস্থিতির কারণে তাকানো গেলো না।

তিনি যখন গোল বারান্দার সিঁড়ির প্রথম ধাপে গিয়ে পৌঁছুলেন ঠিক সেই সময় গাড়ির হেডলাইটের আলো এসে পড়ল অমৃতা আর সামির গায়ে। দুজনে অবাক চোখে দেখল সাদা রঙের বিএমডব্লিউ গাড়িটা হর্ন দিতে দিতে এগিয়ে এসে থামল বাড়ির সামনে। মিনিট গড়ানোর আগেই রোমেলা নেমে পড়লেন গাড়ি থেকে। নামল হৃদিও। সামির পাশে অমৃতাকে দেখে রোমেলার চোখ পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে উঠল ক্ষণিকের জন্য। মুখের চামড়ায় ভেসে উঠল ক্রোধবহ্নির তীব্র আস্ফালন। অমৃতা এক ঝলক দেখল রোমেলাকে। চোখ ফিরিয়ে নিল। বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। সে নিজ থেকে আসেনি এ বাড়িতে। সামি জোরজবরদস্তি নিয়ে এসেছে। তার ভয় কীসের?

ভয় পেয়েছে হৃদি। শাশুড়ির হাত চেপে ধরে ত্রস্ত গলায় সে বলল, ‘মা ভেতরে চলেন।’

সামি এগিয়ে গেল মায়ের দিকে। কাঁধ জড়িয়ে ধরে শান্তভাবে বলল, ‘মা, চলো ভেতরে যাই।’

রোমেলা নড়লেন না। অগ্নিশর্মা চোখে চেয়ে রইলেন অমৃতার দিকে। সামি একরকম জোর করেই মাকে নিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ক্রোধান্বিত রোমেলাকে ধরে বেঁধে কষ্টেসৃষ্টে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসিয়ে দিল ওরা। তারপর দুজনে বসল মায়ের পায়ের কাছে। রোমেলা ফুঁসে যাচ্ছেন ক্রমাগত। ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে রাগে। সামি ব্যাকুল স্বরে বলল, ‘মা… লক্ষ্মী মা আমার। একটা কথা শোন… মন দিয়ে শোন… অমৃতা চলে যাবে বিদেশে… আর কোনোদিন আমাদের বাড়িতে আসবে না। আমার ফ্যামিলির সাথে আজকের পর থেকে ওর আর কোনোরকম যোগাযোগ থাকবে না। ও আমাকে প্রমিজ করেছে।’

রোমেলা দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ‘ও কেন যাবে? আমিই বরং চলে যাচ্ছি। তোমরা সুখে শান্তিতে থাকো সবাই মিলে।’

হৃদি আঁতকে ওঠা গলায় বলল, ‘এ কেমন কথা? এই সংসার আপনার। আপনি আমাদের মা। আপনাকে ছাড়া আমাদের চলবে, এটা ভাবলেন কী করে?’

সামি মায়ের একটা হাত শক্ত করে ধরল, ‘অন্য কেউ তোমার সাথে থাকুক বা না থাকুক। এটা সব সময় জেনে রেখো, আমরা তোমার সাথে আছি। আমার চোখে আমার মা পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা মানুষ!’

হৃদি বলল, ‘মানুষের জীবনে সবকিছু পার্ফেক্ট হয় না মা। লাইফে আপস অ্যান্ড ডাউনস থাকবেই। মাঝখানে একটা খারাপ সময় গেছে। কিন্তু আমার মন বলছে খুব শীঘ্রই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’

রোমেলা ছেলে-মেয়েদের কথায় কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। প্রস্তরীভূত হয়ে বসে রইলেন। চোখে চিকচিক করতে লাগল জল। এই প্রথমবারের মতো তিনি উপলব্ধি করলেন অর্থবিত্ত, সামাজিক মর্যাদা এবং বিলাসব্যসনের বাইরেও মানুষের জীবনে আরো কিছু আছে। আজকে পুত্র এবং পুত্রবধূর সান্নিধ্য তার মনে যে সাহস বা নিরাপত্তাবোধের সঞ্চার করল, তা সামাজিক মর্যাদা বা অর্থ দিয়ে কেনা যাবে না কখনো। স্বামীর প্রতি জীবনভর একটা প্রচ্ছন্ন অযত্ন বা অবহেলা বুকের মধ্যে পুষে এসেছেন তিনি। প্রাপ্তিটুকুকে সুনিশ্চিত বলে ধরে নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন তার মতো অভিজাত পরিবারের সুন্দরী মেয়ের জন্য ধনাঢ্য পরিপাটি একটি জীবন অবধারিত। এই ভাবনায় ভুল ছিল। মানুষকে সবকিছুই অর্জন করতে হয়। আর অর্জন করার পর সেই অর্জনটুকু টিকিয়ে রাখার প্রয়াস অক্ষত রাখতে হয়। নইলে কোনোকিছুই টেকে না। ক্ষয়ে যায়। প্রকৃতি অবহেলা সহ্য করে না। মানুষ ভুলে যায়… কিন্তু প্রকৃতি ভুলে না কিছুই। ঠিক ঠিক শোধ নেয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *