স্বপ্নের বৃষ্টিমহল – ১০

১০

আজ রুদ্র আর আকাশ বাড়ি ফিরল বেশ রাত করে। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁইছুঁই। ড্রয়িংরুমে পিতৃদেব বসে আছেন পেটে ফুটবল আকৃতির ভুঁড়ি ভাসিয়ে। এই বাসায় রুদ্রর উপস্থিতি তিনি বিশেষ পছন্দ করেন না। রুদ্রকে দেখলেই নাক মুখ কুঁচকে ফেলেন। আজকেও ব্যতিক্রম কিছু হলো না। আকাশের পেছন পেছন রুদ্রকে ঢুকতে দেখে পিতৃদেব গলা খাঁকারি দিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, ‘বাড়ি তো নয় যেন লঙ্গরখানা!’

রুদ্র পারতপক্ষে আকাশের বাবার চোখে চোখে তাকায় না। এই মদ্যপ, রোষপরবশ, আনকালচারড লোকটিকে সে মনে মনে একটু ভয়ই পায়। আকাশের জন্য কষ্ট হয়। ওর মতো ভদ্র একটা ছেলের জন্মদাতা পিতা যে এমন গোঁয়ার, বর্বর হতে পারে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। বাবার কথা শুনে আকাশের চোখ মুখ কঠোর হয়ে উঠল। উত্তেজিতভাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে, রুদ্র ওর কুনুই খামচে ধরে নিরস্ত করল, ‘থাক দোস্ত। কিছু বলিস না। ভিতরে চল।’

পাশেই ডাইনিং রুম। তারা রান্নাঘরে থালাবাসন ধুচ্ছিল। আকাশদের দেখে এগিয়ে এল। মৃদু গলায় বলল, ‘খাবার রাখা আছে টেবিলে। খেয়ে নিন।’

আকাশ তারার কথা শুনতে পেয়ে দায়সারা উত্তর দিল, ‘খিদে নেই। খাবো না কিছু।’

রুদ্র আকাশের পিছু পিছু এগিয়ে যাচ্ছিল। তারার দিকে চেয়ে একটু সৌজন্যতার হাসি হাসল সে। দুই বন্ধু বেডরুমে ঢুকেই দড়াম শব্দে দরজাটা আটকে দিল। ডাইনিং-এ দাঁড়িয়ে তারা স্পষ্ট শুনতে পেল রুদ্র আর্তস্বরে বলছে, ‘তুই তো খাইছিস অমৃতার বাসায়। আমি তো খাই নাই। খাবার দিতে না করলি কেন?’

‘ওহো। সরি দোস্ত। ভুইলাই গেছি। খাওয়া রেডি। তুই যা। খেয়ে নে।’

‘থাক ভাই… তোমার টাইগার বাপ পাহারা দিতাছে। আমারে দেইখা হালুম কইরা ঝাঁপায় পড়তে পারে। শেষে খাওয়ার লোভ করতে গিয়া নিজেই খাদ্য হয়ে যাব।’

কথাগুলো শুনে তারার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। রুদ্র খেতে ভালোবাসে। আজকে খালামণি ঝাল ঝাল হাঁসের মাংস রান্না করেছিল। খেতে খেতে তারার বারংবার রুদ্রর কথা মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল ছেলেটা এই মাংস খেয়ে কতই না খুশি হবে! ওর আনন্দোচ্ছল মুখটা কল্পনা করে তারারও একরকম গোপন আনন্দ হচ্ছিল মনে মনে। অথচ রুদ্রর হাপুসহুপুস খাওয়ার ধরনটা দেখলে বরাবরই গা ঘিনঘিন করে। একেবারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে খেতে থাকে। আকাশ ভাইয়া, সামি ভাইয়ার পাশে ইনাকে বন্ধু হিসেবে মানায়ই না। তারা লক্ষ্য করে দেখেছে চেহারা খানা খারাপ নয়। বরং কটা রঙের চোখদুটো অনেক বেশিই প্রাঞ্জল। কিন্তু আউল বাউল চুল আর ডাকাতের মতো বিজবিজে দাড়ির আড়ালে মায়া-মায়া মুখটা ঢাকা পড়ে গেছে। ওই মুখের দিকে তাকালেই হনুমানের কথা মনে পড়ে। মনে হয় গাছের ডাল বেয়ে বেয়ে এইমাত্র একটা গোঁয়ার হনুমান নেমে এসেছে ভদ্র সমাজে। কিন্তু হনুমানেরও তো ক্ষুধা তৃষ্ণাবোধ আছে। বেচারা হনুমান সারাটা রাত অভুক্ত অবস্থায় কাটাবে। ভাবতেই খুব খারাপ লাগছে! ঝুমকি শোবার ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে ছিল। সন্ধ্যের পর থেকে তার এই একটি মাত্র কাজ- শুয়ে থাকা। তারা কত বলে টিভি দেখো, নইলে লুডু খেলো… কিছু-না-কিছু তো কর! কিন্তু নাহ… ঝুমকির যেন বাতি নিভিয়ে শুয়ে থাকার মধ্যেই সর্বসুখ নিহিত আছে। তারা অন্ধকার ঘরে এসে ঝুমকির বিছানার পাশে বসল। নিচু স্বরে ডাকল, ‘খালামণি!’

‘হুম!’

তারা একটু দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, ‘ইয়ে… আকাশ ভাইয়া খেয়ে এসেছে বাইরে থেকে। বলল বাসায় খাবে না।’

‘ঠিক আছে। খাবারগুলো তুলে রাখ ফ্রিজে।’ ঝুমকির যান্ত্রিক গলার আদেশ শুনে চুপসে গেলো তারা। রুদ্রর কথা একবার জিজ্ঞাসাও করল না। আজব! তারাকে নড়তে না দেখে ঝুমকি সন্দিহান হয়ে বলল,

‘বসে আছিস কেন?’

তারা অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘রুদ্র ভাইয়া খায়নি। কিন্তু খালুসাহেবের ভয়ে ঘর থেকে বের হতে পারছে না।’

‘তাই নাকি? তুই কী করে জানলি।’

তারা অপরাধীর গলায় বলল, ‘আকাশ ভাইয়াকে বলছিল উনি। আমি ডাইনিং এ দাঁড়িয়ে শুনেছি।’

ঝুমকি বিছানা থেকে নেমে এল। আলুথালু শাড়ির আঁচলটা ঠিকভাবে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আকাশের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। দুমদুম ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘আকাশ! অ্যাই আকাশ!’

ভেতর থেকে রুদ্রর গলা ভেসে এল, ‘আন্টি আকাশ বাথরুমে। শাওয়ার নিচ্ছে।’

‘তুমি দরজাটা খুলো।’

মিনিট না গড়াতেই রুদ্র দরজা খুলল। ঝুমকি ভারী নরম গলায় বলল, ‘তারার কাছে শুনলাম তুমি নাকি রাতে খাও নাই বাবা?’

কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তারার কানে কথাটা যাওয়া মাত্র অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেল সে। খালামণিটাও না আস্ত একটা গাধা! তারার নাম নেয়ার কী দরকার ছিল? যত্তসব! মানুষের উপকার করতে যাওয়াটাই আসলে বোকামি!

‘না আন্টি… মানে… আমি ঠিক আছি। না খেলেও চলবে।’

‘খাবার তো রেডি। এসো এসো, সময় নষ্ট না করে খেয়ে নাও।’ তারার অস্বস্তিটা হঠাৎ কেন যেন বেড়ে গেল। মন চাইল কোথাও পালিয়ে যায়। কিন্তু এই ছোট্ট এক টুকরো খুপরি বাসায় পালাবার মতো বিস্তর জায়গা নেই। খালামণি তার নাম মেনশন না করলেই এই ঝামেলাটা হতো না। বিরক্তিতে খিঁচড়ে গেল মন। ঝুমকি হাঁক ছাড়ল, ‘অ্যাই তারা! কই গেলি?’

তারা মিউমিউ স্বরে বলল, ‘এইতো।’

‘খাবারের ঢাকনাগুলো তুলে দে। রুদ্র খেয়ে নিক। গরম করা লাগবে কিনা দ্যাখ।’

কথাটা বলে ঝুমকি আবার নিজের ঘরের দিকে যাত্রা শুরু করল। আকাশের বাবা টিভি বন্ধ করে উঠে এসেছেন। চার হাত লম্বা স্বল্প পরিসরের করিডোরটার দুই মাথায় দুটি রুম। রুদ্র যখন বেডরুমের দরজায়, বাবা ঠিক তখনই করিডোরে পা রাখলেন। চোখে চোখ পড়ল। কোটরে ঢোকা গোল গোল জ্বলন্ত দুটি চোখ দেখে ভয় খেল রুদ্র। পিছিয়ে গেল এক পা। লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ল নিজের ঘরের সামনে। কটমটে চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। লুঙ্গি কিছুটা নেমে গিয়েছিল ভুঁড়ির নিচে। দুহাত দিয়ে শক্ত করে লুঙ্গিতে গিঁট দিলেন তিনি। রুদ্র অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘স্লামালিকুম আংকেল।’

সালামের উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলেন না তিনি। আরো কিছুক্ষণ চোখের আগুনে রুদ্রকে পুড়িয়ে দিয়ে ঘরের ভেতর পা বাড়ালেন।

কিছুদিন আগে আকাশ একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেন কিনেছে। বেশ আরাম হয়েছে এটা কেনার পর। খাবারদাবার বারবার চুলায় গরম করা মস্ত ঝামেলা। তারা ওভেনে হাঁসের মাংস গরম করছিল। দেখল রুদ্র ডাইনিং-এ এসে বুকে ফুঁ দিচ্ছে। এলোমেলো চুলগুলো ছড়িয়ে আছে ঘাড়ময়। শ্যামলা মুখে কালচে দাড়ির হিজিবিজি। প্রাঞ্জল চোখ জোড়ায় চাপা কৌতুকের ঝিলিক। একটা মানুষ যে সারাক্ষণ হাসি তামাশায় মেতে থাকতে পারে রুদ্রকে না দেখলে তারা এ কথা কোনোদিন বিশ্বাস করত না। অবশ্য মানুষ তো না সে। আস্ত একটা হনুমান। হনুমানরা বোধহয় অনেক কিছু পারে, যা মানুষ পারে না!

‘যেই ভয়টা পাইছিলাম! বাপরে!’ রুদ্র বলল চেয়ার টেনে নিয়ে বসে।

‘ভয় কেন?’ গরম ভাত ভর্তি হটবক্সের ঢাকনা তুলতে তুলতে তারা প্রশ্ন করল, নতমুখে।

‘আংকেল আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল, মনে হচ্ছিল যেন আস্ত চিবিয়ে খাবে!’

‘হুম।’ ছোট করে শব্দটা উচ্চারণ করল তারা। অন্যকিছু খুঁজে পেল না বলার মতো। খালু সাহেব যে অদ্ভুত একজন মানুষ সেই খবর তো সবাই জানে। নতুন করে এ নিয়ে আর কী কথা বলবে?

‘তুমি খেয়েছ?’ রুদ্রর প্রশ্ন।

তারা একটু ঠেস দেয়া গলায় বলল, ‘রাত বারোটা বাজে… না খেয়ে বসে থাকব কার জন্য?’

রুদ্র ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো এক ঝলক। ফিচেল হেসে সকৌতুকে বলল, ‘কার জন্য আবার? আমার জন্য!’

তারা দাঁত মুখ খিঁচে গমগমে গলায় বলল, ‘কাজ নাই আর!’

রুদ্রর ঠোঁট থেকে ফিচেল হাসিটা সরল না সহজে। রসিয়ে রসিয়ে বলল, ‘তুমি মেয়েটা অনেক কেয়ারিং। আমাকে অনেক কেয়ার কর। এই জিনিসটা আমার ভালোই লাগে।’

তারা গ্লাভসপরা হাতে ওভেন থেকে গরম ধোঁয়া ওঠা মাংসর বাটি নামাতে নামাতে কড়াভাবে বলল, ‘আপনি বাসার অতিথি, তাই যথাসাধ্য আপ্যায়ন করার চেষ্টা করি। কেয়ার টেয়ার করি না।’

কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে তারা প্রস্থানদ্যত হয়েছিল। রুদ্র পেছন থেকে বলে উঠল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’

‘ড্রয়িং রুমে।’

রুদ্র প্লেটে ভাত বেড়ে নিতে নিতে বলল, ‘ঠিক আছে। যাও।’

‘আর কিছু লাগবে?’

রুদ্র পলক তুলে চাইল, ‘আমার একা একা খেতে ভালো লাগে না। তুমি কি একটু বসবে?’

তারা চোখ নামাল নিচে। অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। রুদ্র বলল, ‘সমস্যা থাকলে যাও। বসতে হবে না।’ তারা জানে রুদ্র এখন হাভাতের মতো গপগপ করে খাবে। আঙুল চেটেপুটে খাবে। পারলে ভাতের প্লেটটা শুদ্ধ খেয়ে ফেলবে। তারার এই দৃশ্য দেখতে মোটেও ভালো লাগে না। কিন্তু আজব ব্যাপারে হছে এই মুহূর্তে এখান থেকে অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। মনটা খুব রহস্যময় আচরণ করছে। সে কিছু না বলে পা টিপে টিপে এগিয়ে এল। বসল রুদ্রর মুখোমুখি চেয়ারে। রুদ্র চোখ তুলে দেখল একবার। চোখে চোখ পড়তেই গালভর্তি হাসি হাসল। তারার হঠাৎ মনে হলো এই হাসিটা বেশ সুন্দর ছিল। হনুমানদেরকেও মাঝে মাঝে সুন্দর লাগে নাকি? রুদ্র তারাকে দেখছিল। চোখে মোটা চশমা। ঘাড়ের ওপর এক মস্ত খোঁপা। টিয়া রঙের সুতির সালওয়ার কামিজ পরনে। নিত্যদিনের মতোই সাধারণ বেশভূষা।

‘তুমি মুখটাকে সারাক্ষণ প্যাঁচার মতো করে রাখো কেন?’ রুদ্র প্রশ্ন করল নির্বিকার গলায়।

তারা নিম্নমুখী চোখ নিয়ে বলল, ‘মানুষের মুখ কখনো প্যাঁচার মতো হয় না।’

‘হয় না কে বলল? এই মুহূর্তে একজন প্যাঁচামুখী মেয়ে আমার সামনে বসে আছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

মেজাজ খিঁচড়ে গেল তারার। সে প্যাঁচার মতো হলে রুদ্র নিজে কী? নিজে তো আস্ত একটা হনুমান। বয়সে বড় বলে মুখের ওপর কথা শোনানো যাচ্ছে না। নইলে তারার খুব বলতে ইচ্ছে করছে, আপনাকে দেখলেই আমার হনুমানের কথা মনে পড়ে। কোন জঙ্গল থেকে উঠে এসেছেন আপনি? কতদিন গোসল করেন না?

‘আরে! মাংসটা তো সেই টেস্ট হয়েছে! তুমি রান্না করেছ?’ হাপুশহুপুশ করে খেতে খেতে রুদ্র বলল।

‘জি না।’

‘তুমি রান্না করতে পারো?’

‘জি না’

‘তুমি কী করতে পার তারা?’

‘কিছুই পারি না।’

‘এটা খুব ভুল একটা কথা। প্রতিটা মানুষের কিছু-না-কিছু স্কিল থাকে। প্রতিভা থাকে। যেটা নিজেকেই খুঁজে বের করতে হয়।’

‘বুঝলাম।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল তারা।

‘তুমি আমার কথা শুনে সব সময় এত বিরক্ত হও কেন?’

তারা নাকের ডগায় আটকে থাকা চশমাটা আঙুল দিয়ে সামান্য উপরে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘আমার বেশি কথা বলতে ভালো লাগে না।’

‘তুমি কিন্তু খুব বোরিং আছ!’

তারা চুপ করে রইল। সে বোরিং এই বিষয় সম্পর্কে অনেক আগেই নিশ্চিত হয়েছে। স্কুল কলেজে তার বিশেষ কোনো বন্ধু বান্ধবী ছিল না। বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল তিশা। তারার মতই কথা কম বলত। এসএসসি-তে ফেল করেছিল বলে ওর পরিবার ধরে-বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের পর তিশা আর যোগাযোগ রাখেনি। এখন ভার্সিটির দুজন বান্ধবী আছে। নোট আদান প্রদান হয়। মাঝে মাঝে ক্যান্টিনে বসে চা খাওয়া হয়। ব্যস এটুকুই। বেশি কথা বললেই ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উঠে আসে। তারার নিজের সম্পর্কে কথা বলতে ভালো লাগে না। বলার মতো কিছুই নেই। নিজেকে আড়াল করে রাখতেই ভালো লাগে তার। মেয়েদের সাথে যাও একটু কথা বলতে পারে, ছেলেদের সাথে তো একেবারেই পারে না। তার কোনো ছেলে বন্ধু নেই।

‘তারা!’ রুদ্র ডাকল।

‘জি বলুন।’

‘এত বোরিং কেন তুমি?’

কেমন অন্য গলায় প্রশ্ন করে রুদ্র। কানে সুন্দর হয়ে এসে লাগে কথাটা। কিন্তু তারার মন খারাপ হয় একটু। মন খারাপের গলায় বলে, ‘জানি না।’

‘প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়ায়ে নিজের সাথে নিজে কথা বলবা।

এভাবে কথা বলার অভ্যাস হবে।’

‘কী হবে এত কথা বলে?’

‘কথা না বললে বেঁচে থাকবা কীভাবে? বয়ফ্রেন্ড হবে নাতো!

তারার চিবুকটা গলার সাথে লেগে যায়। রুদ্র খাবার চিবোতে চিবোতে রসিক গলায় বলে, ‘প্রেম করছ কখনো?’

তারা বিরক্ত হয়, ‘জি না!’

রুদ্র হাসে, ‘আমিও করি নাই!’

তারা প্রমাদ গুণল মনে মনে। হনুমানের সাথে কে প্রেম করবে? ‘তুমি চাইলে আমার সাথে প্রেম করতে পারো।’

তারা চমকে উঠল, ‘কী যা তা বলছেন?’

রুদ্র নির্বিকার, ‘হুম… আইডিয়াটা কিন্তু খারাপ না। তুমি যদিও প্রেমিকা হিসেবে একেবারেই ম্যান্দামারা হবা। বোম ফাটাইলেও কথা বলবা না। বাট আই ক্যান টিচ ইউ! আমিও যেহেতু আগে কখনো প্রেম করি নাই। দুইজনেরই একটা অভিজ্ঞতা হইল। কী বলো?’

তারা স্তব্ধ হয়ে গেল। ছেলেটা ফাজিল সে আগে থেকেই জানত কিন্তু এমন বাড়াবাড়ি রকমের বেহায়া এটা তো জানত না। ওর লম্বাটে শ্যামলা মুখের ভাঁজে ভাঁজে অপমানের মেঘ এসে ভিড়ল। গমগম করে বলল,

‘আপনি সব সময় এমন ফাজিল কথা বলে বেড়ান কেন?’

রুদ্র হাসে, ‘ভালো লাগে! আমার জীবনের সবচেয়ে ফেভারিট কাজ হলো, ফাজিল কথা বলা।’

হঠাৎ আকাশের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, ‘কী হচ্ছে?’

তারার মুখটা খুব থমথমে। সে কিছু বলল না। গুম হয়ে বসে রইল। রুদ্র হাস্যোজ্জ্বল গলায় বলল, ‘দোস্ত হাঁসের মাংসটা জটিল হইছে। না খাইলে মিস করবি। আন্টির হাতটা হীরা দিয়া বাঁধায় দেয়া উচিত এই রান্নার জন্য। আমার সামর্থ্য থাকলে কাজটা করতাম।’

আকাশ চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘খাওয়া শেষ কর তাড়াতাড়ি। সামির খোঁজ পাওয়া গেছে। রাতেই যাব ওর কাছে। দিনের বেলা নানা কাজের ঝামেলা।’

কথা শুনে রুদ্রর মুখের চর্বণ প্রক্রিয়া থেমে গেল। অবাক গলায় বলল, ‘কই আছে শালায়?’

‘কলিগের বাসায়।’

‘এত রাতে যাবি?’

‘হুম। রাতেই যামু। ওই শালা আবার দিনের বেলা বের হয়ে যাইতে পারে। এখনই ধরতে হইব। ওর বাসায় গিয়া তো লাভ হয় না, বুঝস না? আন্টি ঝামেলা করে।’

রুদ্র দ্রুত খাওয়া শেষ করল। জামা কাপড় পাল্টালো না আর। হাফ প্যান্ট আর টি শার্ট পরেই বেরিয়ে এল আকাশের সাথে। আকাশের পরনে থ্রি কোয়ার্টার গ্যাবার্ডিং প্যান্ট, হাফহাতা পাতলা গেঞ্জি। উবার কল করে দুই বন্ধু বাসার গলির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। মধ্যরাত বিধায় রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার উপস্থিতি কম। ল্যাম্পপোস্টের ফ্লুরোসেন্ট আলো ছড়িয়ে আছে চারপাশে। কয়েকটা বাস সাঁইসাঁই করে ছুটে যাচ্ছে বড় রাস্তার ওপর দিয়ে। আকাশ হঠাৎ বলল, ‘তুই কী বলতেছিলি তারাকে?’

রুদ্র সরু চোখে তাকাল বন্ধুর দিকে, ‘কেন তুই শুনিস নাই?’

‘ফ্লার্ট করতেছিলি ওর সাথে?’

রুদ্র ফিচেল হাসে, ‘একটু মজা নিচ্ছিলাম।’

আকাশ গম্ভীর গলায় বলল, ‘দ্যাখ রুদ্র, তারা আমার ফ্যামিলি। আমি ওকে ছোটবোন হিসেবে মেনে নিছি। তুই ওর সাথে কোনো টাইপ ফাইজলামি করবি না।’

রুদ্র ত্যাড়াভাবে বলল, ‘এত সিরিয়াস হচ্ছিস কেন?’

‘যা বললাম মাথায় রাখবি। ও ছোট মানুষ। ওর সাথে এসব তামাশা করার কোনো মানে হয় না।

‘কিন্তু দোস্ত… কাহিনি হচ্ছে ওর সাথে তামাশা করতে আমার ভালো লাগতেছে আজকাল।’

‘তোর এসব ভালো লাগার কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই রুদ্র। তারা সহজ সরল সিরিয়াস টাইপ একটা মেয়ে। তোর সস্তা ফাইজলামি ওর সাথে যায় না।’

উবার চলে আসায় ওদের কনভার্সেশন থেমে গেল ক্ষণিকের জন্য। রুদ্র গাড়িতে উঠে বলল, ‘আমি ভাবতেছিলাম তারার সাথে প্রেম করব।’

আকাশ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল ‘এখন পর্যন্ত জীবনে কয়টা মেয়েরে দেইখা তোর প্রেম করতে মন চাইছে, শুনি?’ রুদ্র রসিক গলায় বলল,

‘হাজারের কম হবে না!’

‘প্রেম হইছে কয়জনের সাথে?’

‘একজনের সাথেও না।’

‘এবারও হবে না। অতএব তারার সাথে এসব ফাইজলামি মার্কা কথাবার্তা আর কখনো বলবি না তুই।’

‘এত শিওর হইলি কীভাবে এবারও হবে না?’

‘হবে না কারণ তুই কখনো সিরিয়াসলি কাউকে পছন্দ করতে পারিস না রুদ্র। তোর মধ্যে জিনিসটা নাই। তারা বেচারী ছোট মানুষ, ও ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিয়ে নিলে পরে কষ্ট পাবে। বোঝার চেষ্টা কর।

‘হুম…!’ শব্দটা উচ্চারণ করে আকাশের কথায় সায় দিল রুদ্র।

১১

বিপ্লব সাহা রাজধানীর একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অঙ্কের টিচার। সামির কলিগ ছিল এক কালে। ব্যাচেলার মানুষ। থাকে দুই কামরার একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে। সামি আপাতত এখানেই আছে। স্বস্তির খবর হলো স্কুলের চাকরিটা আবারও যোগাড় করতে পেরেছে সে। বিপ্লবের বাসা থেকে স্কুল খুব কাছে। হেঁটেই যাওয়া যায়। আপাতত ওর বাসায় থেকেই চাকরি শুরু করবে বলে ঠিক করেছে সামি। মাস শেষে ভাড়া শেয়ার করবে। দুদিন ধরেই সামির পরিবর্তনটা লক্ষ্য করছিল বিপ্লব। ছেলেটা যেন কদিনের ব্যবধানেই পুরো অন্য মানুষ হয়ে গেছে। চটপটে হুল্লোড়বাজ স্বভাব, আমুদে কণ্ঠস্বর এবং প্রাণবন্ত আচার-আচরণের জন্য সামি খুব অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিপ্লবের প্রিয় মানুষদের একজন হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া দেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তির সন্তান হয়েও সামির মধ্যে বিন্দু পরিমাণ অহংবোধের উপস্থিতি নেই। দম্ভহীন, উদারচিত্তের ছেলেটির প্রতি তাই এক ধরনের শ্রদ্ধা কাজ করে বিপ্লবের। এর বন্ধুদেরকেও দেখেছে কয়েকবার। ভীষণ জিয়ন্ত এবং ফুর্তিবাজ প্রতিটা ছেলে-মেয়ে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। আনন্দচ্ছল, সরস একটি যুবকের এমন মুষড়ে পড়া রূপ দেখে অবাক না হয়ে পারেনি বিপ্লব। সে নানারকম প্রশ্ন করে আসছে। সামি কোনো প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিচ্ছে না। এড়িয়ে যাচ্ছে। বাসায় থাকাকালীন সময়গুলোতে সে টিভির সামনে বসে একদৃষ্টে খেলা দেখে। ফর্সা মুখে ছেয়ে থাকে মেঘের মালিন্য। চোখে বিষণ্ণতা। কথা নেই, বার্তা নেই, যেন কাঠের পুতুল। খাওয়ার কথাও মনে থাকে না তার। বিপ্লব প্লেটে খাবার বেড়ে এনে মুখের সামনে ধরে। সামি নিস্পৃহভাবে হাতে তুলে নেয় প্লেট। অনিচ্ছা নিয়ে খাবার চিবোয়। যেন খাদ্য ভক্ষণ পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজগুলোর একটি। উপর্যুপরি প্রশ্ন করে এখন ক্লান্ত হয়ে গেছে বিপ্লব। এই ছেলের পেট থেকে কথা বেরুবে না। ওর বন্ধু আকাশ বিপ্লবের ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে আছে। সে গোপনে আকাশের সাথে যোগাযোগ করেছে।

পৃথিবীটা আজকাল বড় অচেনা লাগে সামির। যেন সবটাই কেমন ধোঁয়াশায় ঢাকা। শৈশব থেকে যা দেখে এসেছে, জেনে এসেছে, শুনে এসেছে তার কোনোটাই বুঝি পুরোপুরি সত্য নয়। মিথ্যে এক অলীক সময়ের জালে বাঁধা পড়ে আছে সবকিছু। এই ধরাধামের নিয়মকানুন এবং ছলচাতুরী সম্পর্কে সে পরিপূর্ণ রূপে অজ্ঞাত ছিল। সে জানত না, এখানকার সমস্ত কিছুর বাহ্যিক স্বরূপ যতটা সুন্দর, আভ্যন্তরীণ স্বরূপ ততটাই কদৰ্য। কী আগাপাশতলা বেকুব ছিল সে! ভাবতে গেলে আশ্চর্য হতে হয়… কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতে হয়… অদ্ভুত এক মর্মভেদী যন্ত্রণায় আকণ্ঠ ডুবে যেতে হয়! মস্তিষ্কের আনাচকানাচ ফাঁকা হয়ে যায় পুরোপুরি! অবিশ্বাস্য লাগে সবকিছু! মনে হয় যেন কোনো ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের অতল অন্ধকারে তলিয়ে গেছে সে। এখুনি ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখবে সবকিছু আগের মতোই আছে।

নিজেকে সুখী মনে হতো তার। পারফেক্ট মা, ক্ষমতাবান সুপারহিরো বাবা, মনের মতো বন্ধু, স্ত্রীর ভালোবাসা… এইতো জীবন! সুখে থাকার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না মানুষের। নিজের জীবনটা সামির ফেভারিট ছিল। সত্যিই ভালোবেসেছিল সে বেঁচে থাকার এই অনিবার্য, অপরিহরণীয় পরিক্রমাকে। সবকিছু পুতুলের সংসারের মতো সাজানো গোছানো এবং পরিপাটি ছিল। কী ছিল না ওর? অর্থের প্রাচুর্য, লাক্সারি, পরিবার, প্রেম, বন্ধুদের সঙ্গ! বাবা-মা এবং বন্ধুরা, এই দুটি পক্ষ তার জীবনের অন্যতম ঐশ্বর্য ছিল। যেন উত্তাল সমুদ্রের দুটি সুন্দরতম স্নিগ্ধ দ্বীপ! নির্ভরতার নিশ্চিন্ত আশ্রয়! হতাশ, দুর্বল, ভগ্নহৃদয় সামি আজ আর চোখ মেলে সেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল দেখতে পায় না। বীভৎস ঝড়ের আগ্রাসন ডুবিয়ে দিয়ে গেছে ওদের। বন্যাদুর্গত অসহায় মানুষের মতো এক টুকরো নড়বড়ে ভেলায় দিনরাত ভেসে বেড়াচ্ছে সে। কোথাও কেউ নেই। চারিদিকে কেবলই থইথই জল!

বাবা-মায়ের পারস্পরিক সম্পর্কটাকে অনবদ্য বলে মনে হতো তার। মাকে কখনো অসুখী দেখেনি। বাবাকেও দেখেনি কখনো মাকে অসম্মান করতে। নিজের পরিবার নিয়ে মনের মাঝে সুপ্ত অহংবোধ ছিল তার। লোকে প্রশংসা করত… মান্য করত… ঈর্ষা করত! তবে কি এতকাল ধরে সে ভুল জেনে এসেছে? যে লোকটা ছিল তার জীবনের প্রথম শিক্ষক, পথপ্ৰদৰ্শক, অন্যতম আদর্শ… যে লোক কাজ এবং পড়াশোনা ছাড়া অন্যসবকিছুকে গুরুত্বহীন মনে করত, যে ন্যায়নিষ্ঠ মানুষটা রাজনীতির মতো কলুষিত মাঠেও সততার চাষ করে যাচ্ছে অবিচলভাবে, সেই কঠোর নীতিবান ব্যক্তি কিনা নিজ স্ত্রীকে ঠকিয়ে সন্তানের বয়সী এক মেয়ের সাথে অবৈধ প্রেমে লিপ্ত হয়ে পড়ল? কী করে সম্ভব? সামির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মাথাটা পাগল পাগল লাগে। বুকে রক্তক্ষরণ হয়! বাবা কি তাহলে মাকে ভালোবাসেনি কখনো? সামি জন্মের পর থেকে টানা ছাব্বিশটা বছর ধরে ভুল জেনে এসেছে? কী আশ্চর্য! কী অবিশ্বাস্য! কী জঘন্য! আর অমৃতা? অমৃতা কী করে বন্ধুর বাবার সাথে… ছি! ভাবতে ঘেন্না হয় সামির। গা গুলিয়ে ওঠে। অরুচিতে কুঁকড়ে যায় মন। অথচ অমৃতাকে ও অন্যরকম সম্মান করত মনে মনে। বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে ব্রাইট ছিল সে। সাহসী, বিচক্ষণ, ন্যায়পরায়ণ। কখনো কেস লড়তে গিয়েও মিথ্যে কথা বলেনি। সেই অমৃতা এমন জঘন্য কাজ কী করে করল? একবারও বুক কাঁপল না? অন্য বন্ধুরাও সামিকে ঠকিয়েছে। সবাই সবকিছু জেনে শুনে চেপে গেছে সত্যটা। নিজের স্ত্রী একই ছাদের নিচে অষ্টপ্রহর পাশাপাশি অবস্থান করে ঠান্ডা মাথায় অংশ নিয়েছে এই ষড়যন্ত্রে। সামির কথা কেউ ভাবেনি। সামির অসহায় মায়ের কথা কেউ ভাবেনি। সব বিশ্বাসঘাতক, বেইমানের দল! এদের কাউকে ক্ষমা করবে না সামি। কোনোদিন না! সোফার ওপরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ অপ্রত্যাশিত পদশব্দ কানে এসে ভিড়ল। চোখ মেলে দেখল দুই মূর্তি দণ্ডায়মান। ঘুম ডোবা মস্তিষ্ক সক্রিয় হতে সময় লাগল একটু। হাত দিয়ে চোখ কচলে ঘুমের রেশ তাড়াবার চেষ্টা করল সে। আকাশ আর রুদ্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। একটা সাদা টিউব লাইট জ্বলছে ঘরের ভেতর। সেই সাদা আলোয় সামির ফ্যাকাশে মুখখানা তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করছিল দুই বন্ধু। এই কদিনে সামির চেহারা পাল্টে গেছে। শীর্ণ, ক্লান্ত এবং বিষণ্ন দেখাচ্ছে তাকে। হঠাৎ ঘরের মধ্যে যেন প্রকট শব্দে বজ্রপাত হলো।

‘বিপ্লব! অ্যাই বিপ্লব!’ চিৎকার করে উঠল সামি।

বিপ্লব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল পাশের ঘর থেকে। সামি উঠে দাঁড়িয়েছে। ক্রোধের দাপটে হাত পা কাঁপছে তার। ফর্সা কপালের নীল শিরা দপদপ করছে। নাকের পাটা ফুলে ঢোল। বিপ্লবকে দেখে সে দাঁত মুখ খিঁচে বলল, ‘আমার ঠিকানা কে দিল এদেরকে?’

বিপ্লব একটু থতোমতো খেয়ে গেছে। সামিকে সে অনেকদিন ধরে চেনে। কোটিপতি বাবার সন্তান হলেও সামি কখনো কলিগদেরকে তুচ্ছ- তাচ্ছিল্য করেনি, উঁচু গলায় কথা বলেনি। আজকের এই উদ্ধত ব্যবহারের জন্য বিপ্লব মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে থম ধরা চোখে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে পারল না। আকাশ এক পা এগিয়ে এসে সামির কাঁধে হাত রাখল, ‘শান্ত হ। কুল ডাউন ড্যুড।’

সামি ক্ষিপ্র গতিতে আকাশের হাতটা নিজের কাঁধ থেকে ছাড়িয়ে নিল। খাঁচাবন্দি ক্ষুধার্ত হিংস্র সিংহের মতো গর্জে উঠল, ‘তোদের সাহস তো কম না তোরা আমার সামনে আইসা দাঁড়াস? এখনই দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে। নইলে সবকটার লাশ ফালায় দিমু।’

বিপ্লবের সামনে অপ্রস্তুতবোধ করল দুই বন্ধু। দুজনের চেহারায় ভর করেছে অমাবস্যার অন্ধকার। এই পাগল বন্ধুকে বশে আনার কোনো মন্ত্ৰ তাদের জানা নেই। মনে মনে তারা বড়ই অসহায়বোধ করছে। রুদ্র একটু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘সামি… দোস্ত… তুই মাথাটা একটু ঠান্ডা কর। একটু ঠান্ডা মাথায় আমাদের কথা শোন প্লিজ! তোর পায়ে পড়ি!’ বিপ্লব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা না দেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ছেলেটার ভদ্রতা-জ্ঞান প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু সামির বোধ-শক্তি এখন বিলুপ্তির পথে। চোখ রক্ত লাল। নিঃশ্বাসে আগুনের হলকা। খুনীর দৃষ্টিতে দুই বন্ধুর দিকে চেয়ে আছে সে। আকাশ চোখ মেঝেতে নিবদ্ধ করে বলল, ‘দোস্ত তুই আমাদের ওপর শুধু শুধুই রাগ করতেছিস। এখানে আমাদের কোনো দোষ নাই। আমরা কখনই তোর খারাপ চাই না। আমরা তোর ফ্রেন্ড।

সামি এমনভাবে চিৎকার করে উঠল যে মনে হলো যেন আরেকটু হলেই কণ্ঠনালী ছিঁড়ে যাবে।

‘তোদের মতো ফ্রেন্ড আমার লাগবে না। তোদের ফ্রেন্ডশিপ আমি চুদি না। ভাগ এখান থেকে বেইমানের দল!’

রুদ্র সামির কাঁধে হাত রাখার চেষ্টা করতেই সামি খপ করে ওর কলার চেপে ধরল। অপর হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে তুলে আনল রুদ্রর মুখের খুব কাছে। রাগে ওর হাত কাঁপছে, ঠোঁট কাঁপছে, কাঁপছে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ। আকাশ দৌড়ে এসে ওর মারমুখী উদ্ধত হাত নিরস্ত করল। রুদ্রর কলারে চেপে বসা পাঁচটা আঙুল ছাড়িয়ে নিল জোরপূর্বক। তারপর সামির বুকে সজোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে দিল সোফায়। হাত উঁচিয়ে শাসানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘আর একটা কথাও বলবি না তুই! ঢং চোদাও তুমি শালা? আমরা এখানে ঢং করতে আসছি তোমার সাথে? জরুরি কথা আছে। বলা শেষ হইলেই চইলা যাব। যাওয়ার কথা বারবার বলতে হবে না তোমার!’

সামি বড় বড় শ্বাস ফেলছিল। ফর্সা গালে রক্তের ছোপ ছোপ আলপনা। চোখ উদ্ভ্রান্ত। আকাশ আর রুদ্র বসল না। দাঁড়িয়েই রইল।

‘তোর কি ধারণা যা ঘটছে তার পেছনে আমাদের কোনো স্বার্থ আছে?’ রুদ্র বলল।

সামি উত্তর দিল না। চুপচাপ বসে থেকে ফুঁসতে লাগল রাগে। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। গলা তেষ্টায় চৌচির। আকাশ বলল,

‘আমরা জানার সাথে সাথেই অমৃতারে নিষেধ করছিলাম। রুদ্র তো অমৃতার সাথে কথা বলাও বন্ধ করে দিছিল। ট্রাস্ট মি দোস্ত অমৃতার এই অদ্ভুত কাজে আমাদের ফ্রেন্ডদের কারো সাপোর্ট ছিল না। কিন্তু অমৃতাকে তুই চিনিস না? ও কি কারো কথা শোনে?’

সামি স্থিরচিত্র। চুল আলুথালু। পরনের ঘিয়া রঙের ঢোলা ফতুয়া কুঁচকে আছে বুকের দিকে। রুদ্র বলল, ‘তুই হৃদির উপর রাগ করতেছিস। একটা বার ভেবে দেখছিস ওই মেয়েটার ওপর দিয়ে কী গেছে? সে না পারছে তোকে কিছু বলতে, না পারছে ঘটনাটা হজম করতে। আমরা সবাই একটা অদ্ভুত সিচুয়েশনে পড়ে গেছিলাম দোস্ত। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড! অমৃতা আমাদের ফ্রেন্ড, তুইও আমাদের ফ্রেন্ড… আর এইদিকে তোর বাপ… কী কমপ্লিকেটেড একটা ব্যাপার… আমরা কী করব? কোনদিকে যাব?’

সামি রক্তচক্ষু মেলে তাকাল, ‘তোরা কেউ আমাকে কিছু বলিস নাই কেন? কেন আমার মায়ের কাছ থেকে ঘটনাটা জানতে হইল?’

আকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘বলি নাই কারণ… কারণ দোস্ত এই কথা ক্যামনে বলা যায় আমরা জানতাম না। আর অমৃতা আমাদেরকে প্রমিজ করছিল ও সরে আসবে। আমরা খুব করে চাইছিলাম বিষয়টা যেন তোর কান পর্যন্ত যাওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। এমনকি তোর মা জানুক এটাও চাই নাই।’

রুদ্র সামির পাশে বসে আর্ত গলায় বলল, ‘তোর কাছ থেকে বিষয়টা লুকাবার কারণ একটাই ছিল দোস্ত। কারণটা হইল তোকে আমরা কেয়ার করি।’

‘তুই কষ্ট পাবি এই জন্যেই বলি নাই।’ আকাশ এগিয়ে এসে বসল সামির অন্যপাশে। দুই বন্ধুর নৈকট্য সামির ভেতরকার ক্রোধের স্ফুরণে একটু ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিয়েছিল বোধহয়। তাই ওর রক্তাভ চোখে এখন আগুনের পরিবর্তে অশ্রুজলের আভাস। এই বিশ্রী অঘটনটা তার অস্তিত্বের ভিত নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে একদম! মনের অবস্থা কারো সাথে ভাগ করে নিতে না পারার যন্ত্রণায় সে ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সে এখন জানে নিঃসঙ্গতা মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ! বন্ধুরা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এ কথা ঠিক, কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে বন্ধুদের মুখ নিঃসৃত একটি বাক্যও এই মুহূর্তে তার কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে না। বরং ওদের বলা কথাগুলোকে অকাট্য সত্য হিসেবেই গ্রহণ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আকাশ আর রুদ্রর চোখেও জলের আভাস চিকচিক করছিল। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছিল ভনভন করে। বাইরে মধ্যরাত। গার্ডের হুইসেলের শব্দ ভেসে আসছে। রাস্তার মাথায় একটা নেড়ি কুকুর ঘেউঘেউ করে ডেকে যাচ্ছে ক্রমাগত। ওরা তিনজন সোফার ওপর ঝাপসা চোখে বসে আছে। হতাশা আর বিভ্রান্তি খেলছে মুখে। সামির গলায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে কান্না। অনেক চেষ্টা করেও কান্নাটা গিলতে পারল না সে। চোখ ফেটে নেমে এল অশ্রুর ধারা। আকাশ ওর কাঁধে হাত রেখে কী যেন একটা বলতে গিয়েও বলতে পারল না। গলা খুব কাঁপছে। বুক ভার হয়ে আছে অদ্ভুত এক কষ্টে। এই কষ্টটার নাম কি আবেগ? ভালোবাসা? নাকি বন্ধুত্ব? জানে না আকাশ। শুধু জানে সামিকে এভাবে দেখতে তার ভালো লাগছে না একেবারেই। হঠাৎ সামি কম্পনরত গলায় বলল, ‘অমৃতা এমন একটা কাজ কেন করল? ও একবারও কেন ভাবল না যে লোকটা আমার বাবা?’

আকাশ আর রুদ্র চুপ করে রইল। ওদের কাছে কোনো উত্তর নেই। কতক্ষণ কেটেছিল কে জানে! একটা সময় রুদ্র খুব নরম গলায় বলল, ‘দোস্ত মানুষ মাত্রই ভুল…! ক্ষমা করা যায় না?’

১২

অমৃতার শূন্যতা সর্বস্ব নির্বাক চোখের চাউনি সহ্য হয় না হৃদির। একতরফা আলাপ চালানো যায় কতক্ষণ? আজ কথা বলতে বলতে হঠাৎ একটু রেগে গেল সে।

‘হা করে তাকিয়ে আছিস ক্যান ব্যাক্কলের মতো? কিছু বল!’

অমৃতার যেন সম্বিৎ ফিরল। বিকেল শেষের বারান্দায় বেতের চেয়ার পেতে বসেছিল দুই বান্ধবী। সারাদিন বড্ড গরম ছিল। এখন আকাশজুড়ে মেঘ করেছে। বারান্দার নয়নতারা ফুলে দোল খাচ্ছে হাওয়া। বৃষ্টি বৃষ্টি ঘ্রাণ ছুটছে এদিক-সেদিক। অমৃতা একটু নড়ে চড়ে বসে বলল, ‘কী বলব? তোর কথা শুনতেই তো ভালো লাগছে।’

‘তুই আবার কবে থেকে এত ভালো শ্রোতা হইলি?’

অমৃতা এই প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। আজকাল তার মস্তিষ্কটা বড্ড ফাঁকা হয়ে থাকে। হৃদি মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘ম্যান্দামারা বোবা টাইপ ফ্রেন্ড আমার একদমই পছন্দ না। একা একাই যদি কথা বলতে হয় তাহলে দেয়ালের দিকে তাকায়ে কথা বললেই হয়। মানুষের দরকার নাই।’

অমৃতা একটু হাসল হৃদির কথা শুনে। তার কপালে সেলাই নেই এখন কিন্তু কাটা দাগের অস্তিত্ব রয়ে গেছে। মুখখানা রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে। চোখের নিচে কালির আভাস। তবুও হেসে ওঠার পর তার বেড়ালের মতো আদুরে মুখটা ভারী সুন্দর দেখাল। হৃদি ওই হাসিটার দিকে মন ভরে, প্রাণ ভরে চেয়ে থাকল খানিক ক্ষণ। কতদিন অমৃতাকে হাসতে দেখে না!

‘শোন, একটা সুখবর আছে।’ বলল হৃদি।

‘কী সুখবর?’ অমৃতার চোখে উৎকণ্ঠা ঝিলিক দেয়।

‘আমার ব্যাংকের চাকরিটা হয়ে গেছে।’

‘সত্যি? কনগ্রেচুলেশনস দোস্ত!’ আনন্দে ঝুমঝুমিয়ে উঠল অমৃতা। সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে পরমুহূর্তেই আবার বলল, ‘তোর বরের কোনো অবজেকশন নাই তো চাকরি নিয়ে?’

হৃদির মুখে ঝপ করে অন্ধকার নেমে এলো। দুর্ঘটনার পর থেকে অমৃতা একটাবারের জন্যও সামির নাম মুখে নেয়নি। আজকে সামির ব্যাপারে জানতে চাইল নিজের বন্ধু হিসেবে নয়, হৃদির বর হিসেবে।

‘কী হলো? থাম্বু খাইলি ক্যান?’ অমৃতার প্রশ্ন।

‘ওর কথা বাদ দে।’ হৃদি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। অমৃতার বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল অনির্ণেয় ত্রাসে। সামির খারাপ কিছু হয়নি তো? ভালো আছে তো সে? এতদিন মনে মনে কত লক্ষ্যবার ওর কথা ভেবেছে। ভাবতে ভাবতে দুশ্চিন্তার উৎকট প্রাবল্যে গিট্টু লেগে গেছে মাথার মধ্যে। কিন্তু চক্ষুলজ্জার জ্বালায় আর কী এক নাম না জানা অদ্ভুত ভয়ের তাড়নায় নিজের বন্ধুটার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারেনি কারো সামনে। কিন্তু এভাবে কতদিন থাকা যায়? অমৃতার হঠাৎ মনে হলো এই মুহূর্তে সামির খবর না পেলে সে দম আটকে মরে যাবে।

‘ও কেমন আছে? তুই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিস কেন? উত্তর দে।’

‘ভালো আছে।’ হৃদির শুষ্ক উত্তর। অমৃতার মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ উঁকি দিল। সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল,

‘তোদের মধ্যে কি ঝগড়া চলছে নাকি?’

হৃদি নিষ্পলক চোখে বিকেলের মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে চেয়ে রইল। উত্তর দিল না।

‘দোস্ত! আমি একটা প্রশ্ন করছি। প্লিজ কিছু বল!’ অমৃতার করুণ মিনতি

হৃদি দৃঢ় চোখে তাকালো অমৃতার দিকে। স্পষ্ট গলায় বলল, ‘ওর ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছা করতেছে না।’

একটা ভয়ের বিদ্যুৎ খেলে গেল অমৃতার শিরদাঁড়া বেয়ে, ‘কেন? সব ঠিক আছে তো?’

হৃদি তাৎক্ষণিক কোনো প্রত্যুত্তর করল না। প্রখর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। অমৃতার মনে হলো হৃদি যেন আর আগের সেই ছিঁচকাঁদুনে, ভীতু, লুতুপুতু স্বভাবের আবেগী মেয়েটি নেই। অনেক খানি পাল্টে গেছে। এই মুহূর্তে তাকে বেশ পরিণত, বিচক্ষণ এবং আত্মবিশ্বাসী বলে মনে হচ্ছে। একটা দীর্ঘ শ্বাস গোপন করে সে বলল, ‘সব ঠিক আছে। তুই চিন্তা করিস না।’

‘মিথ্যা কথা বলতেছিস কেন? হৃদি আমি তোর ফ্রেন্ড! আমার কাছ থেকে হাইড করতেছিস কিছু?’

‘আমিও তো তোর ফ্রেন্ড, তাই না? তুই কি আমাকে সবকিছু বলিস? এইযে সারাক্ষণ বোবা হয়ে ধ্যান করিস এক মনে। কী এত ভাবিস দিন রাত, হ্যাঁ? ফ্রেন্ড হিসেবে আমার বুঝি জানার অধিকার নাই?’ হৃদির কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে উঠে যাচ্ছিল। অমৃতা থম ধরা চোখে চেয়ে রইল শুধু। হৃদির আচার-আচরণ তার কাছে দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। সেই সময় চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে অমৃতার মা প্রবেশ করলেন বারান্দায়। হৃদি উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। অমৃতার মা চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন ওর দিকে। হাসিমুখে বললেন, ‘আমার একটু জরুরি কথা আছে তোমাদের সাথে।’

হৃদি চায়ের কাপ হাতে নিল, ‘জি আন্টি। বসেন আপনি। বসে কথা বলেন।’

চায়ের ট্রে মেঝের এক কোণে নামিয়ে রাখলেন মা। তারপর একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসলেন। হৃদির মুখের দিকে চেয়ে শান্ত স্বরে বললেন, ‘হৃদি শোন, তোমার উপস্থিতিতেই কথাটা তুলছি। যেন তোমার ফ্রেন্ডকে একটু বোঝাতে পার। অমৃতার জন্য তোমার আঙ্কেলের কাছে খুব ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। উনার এক্স কলিগের ছেলে। ব্যারিস্টারি পাস করে এসেছে গত বছর। এখন সুপ্রিমকোর্টে প্র্যাকটিস করছে। আমরা চাইছি খুব দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিতে। তোমার ফ্রেন্ডকে বল সে যেন দয়া করে আমাদেরকে হেল্প করে। আর যেন না জ্বালায়। তোমার বিয়ে হয়েছে। বিভার বিয়ে হয়েছে। তোমরা দুজনেই মাশাআল্লাহ কত সুন্দর করে সংসার করছ। তোমরা ওকে বোঝাও। ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনো। এটা তোমাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ।’

অমৃতা মায়ের কথা শুনে মিটমিট করে হাসছিল। হৃদি গম্ভীর গলায় বলল, ‘চিন্তা কইরেন না আন্টি। সব ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ে-শাদি তো করতেই হবে। আজ নয় কাল।’

অমৃতা আড়মোড়া ভেঙে আলসে গলায় বলল, ‘শোন তোমরা, লন্ডনের একটা ইউনিভার্সিটিতে আমার অ্যাডমিশন হয়ে গেছে। ভিসা হয়ে গেলে আমি ফুড়ুৎ করে উড়ে যাব বিদেশে। বিয়ে-টিয়ে করার সময় নাই।’

অমৃতার মায়ের মুখটা রাগে থমথম করে উঠল, ‘তুই বিদেশে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিছিস আমাদেরকে কিছু না বলেই?’

‘ওমা! আমি অ্যাপ্লাই করছিলাম বেশ কিছুদিন ধরে। তোমরা তো জানতেই!’

‘অ্যাডমিশন হয়েছে এটা তো বলিসনি!’

অমৃতা একটু চুপসে যাওয়া গলায় বলল, ‘বলব বলব করেও বলা হয়নি। ভুলেই গিয়েছিলাম আসলে!’

১৩

শেষ রাতের দিকে অদ্ভুত একটা কাণ্ড হলো। সবেমাত্র চোখ বুজে এসেছে ঘুমে এমন সময় শিয়রের কাছের জানালার একটা পাল্লা নড়ে উঠল। রাশেদ ইদানীং স্টাডিরুমের মেঝেতে চাদর বিছিয়ে ঘুমান। ঘরটা বেশ বড়। একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার ভালো লাগে না বিধায় কর্নারে টিমটিম করে ল্যাম্পশেড জ্বলছে। চোখজুড়ে তখন ঘুমের দাপাদাপি। জানালায় শব্দ হতেই তিনি ভ্রু উঁচিয়ে একবার চাইলেন। এই ঘরটা বহুদিন যাবত সংস্কার বিহীন পড়ে আছে। জানালা, দরজার কপাট পুরনো হয়েছে। দমকা বাতাসে জানালার পাল্লা একটু আকটু ফাঁক হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। ঘরের ভেতর এয়ারকন্ডিশন চলছে। জানালায় ফাঁকা থাকলে ঘর সহজে ঠান্ডা হবে না। তিনি ঘটনাটা তেমন গ্রাহ্য করলেন না। চোখ বুজে রইলেন। আধো ঘুম এবং জাগরণের মধ্যে হঠাৎ স্পষ্ট টের পেলেন জানালাটা এবার ভস করে খুলে গেল। রাশেদ বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চোর-টোর নয়ত? জানালার ওপাশে জারুল গাছ। গাছের নিচে একটা নারীমূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারেও মায়ের মুখখানা স্পষ্ট চেনা গেল। মায়ের দু-চোখভর্তি জল। ঠোঁটে কান্নার কম্পন। মা চলে গেছেন বহু বছর আগে। অথচ এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে রক্ত মাংসের জলজ্যান্ত মানুষ। কী আশ্চর্য!

রাশেদ জানালার ধারঘেঁষে দাঁড়ালেন। এদিকটায় কোনো আলো নেই। রাস্তার আলো এত দূর অবধি আসে না। আজব ব্যাপার হলো এই নিকষ কালো অন্ধকারেও রাশেদ মায়ের মুখের প্রতিটি ভাঁজ স্পষ্টরূপে দেখতে পাচ্ছেন। বহুদিন পর কোনো নিকটজনের সান্নিধ্য পেলেন তিনি। আপাদমস্তক গাম্ভীর্যে মোড়া কঠোর চরিত্রের মানুষটি যেন হঠাৎ আবেগী বালকে রূপান্তরিত হয়ে গেলেন। আকুল স্বরে ডেকে উঠলেন,

‘মা!’

‘তোর কী হয়েছে বাবা?’

মায়ের কণ্ঠস্বর অবিকল আগের মতোই আছে। রাশেদ কি স্বপ্ন দেখছেন? কিন্তু স্বপ্ন এত পরিষ্কার হয় কী করে? তার লজিক কখনো গোলমাল করে না। ভূত-প্রেত বা আত্মায় বিশ্বাস নেই। মড়া নিয়ে শ্মশান ঘাটে রাত কাটিয়েছেন এমন অভিজ্ঞতাও আছে। আজকের এই অবাস্তব ঘটনার পেছনের ব্যাখ্যা কী? মা কি সত্যিই এসেছেন? মৃত মানুষদের কি পার্থিব জগতে ভ্রমণে আসার অনুমতি আছে? তিনি জানালার গ্রিলের ভেতরে দিয়ে হাত বাড়িয়ে মায়ের বাহু স্পর্শ করলেন,

‘তুমি কাঁদছ কেন মা? কীসের কষ্ট তোমার?’

‘আমার কষ্ট তো তোকে নিয়ে। তুই কেন এত বড় ভুল করলি?’

‘ভুল তো মানুষই করে! আমি শুধরে নেব… তুমি দেখে নিও!

‘তুই রাজনীতি করিস কেন? রাজনীতি কি ভালো মানুষের কাজ?’

‘ভালো মানুষরা দেশের দায়িত্ব না নিলে দেশটা যে পুরোপুরি খারাপদের দখলে চলে যাবে!’

‘ছাত্র জীবনেও তোকে মিছিল টিছিলে যোগ দিতে মানা করতাম। কেন এসব করতে গেলি?’

‘একথা সত্য যে দুর্নীতিবাজদের ছাড়া রাজনীতির চাকা সচল থাকে না। কিন্তু আমি আজ পর্যন্ত কোনো মানুষের ক্ষতি করিনি মা। এতটুকু বুকে হাত রেখে বলতে পারি। কখনো ঘুষ খাই না, কারো অন্যায় আবদার মেনে নেই না। এমনকি সরকারও জোরপূর্বক আমাকে দিয়ে কোনো অন্যায় কাজ করাতে পারবে না। সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আমি পার্লামেন্টের সদস্যপদ ছেড়ে দেব।’

মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আপনমনে বিড়বিড় করলেন, ‘কোনটা অন্যায় আর কোনটা সঠিক তা নির্ণয় বড় কঠিন কাজ। সেই সময় তোর বিয়েটা জোর করে দেয়া উচিত হয়নি। তুই কড়াভাবে আপত্তি জানাসনি কেন?’

‘কড়া আপত্তি জানাবার কোনো কারণ ছিল না। তাছাড়া আমি তোমাকে খুশি করতে চেয়েছিলাম। তুমি খুশি হয়েছিলে এটাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল।

‘তুই আজীবন অন্যকে খুশি করতে চাইলি। নিজের জন্য কী করলি?’

‘নিজের জন্য করেছি… ব্যবসা, রাজনীতি, কর্মজগতের সমস্ত অর্জন এবং স্বীকৃতি, এগুলো নিজের সন্তুষ্টির জন্যই করেছি মা! তুমি অযথা কষ্ট পেও না।’

‘এসব অর্জন দিয়ে কী ছাইপাশ হবে? যদি মনের সুখ না থাকে?

রাশেদ শ্লেষ যুক্ত হাসি হাসলেন, ‘জীবন কেটে গেছে… এখন এই শেষ সময়ে এসে আর মনের সুখের তালাশ করি না।’

মা একটা হাত রাশেদের মাথার ওপর রাখলেন, ‘নিজেকে কষ্ট দিস না বাবা। সুখের তালাশ না করলেও স্বস্তির তালাশ কর। সুখের চেয়ে স্বস্তির দাম বেশি।’

মায়ের কণ্ঠস্বরটা একটু একটু করে দূরের ঘণ্টা ধ্বনির মতো মিলিয়ে যাচ্ছিল বাতাসে। রাশেদের তন্দ্রাচ্ছন্নতা কাটল না। সমগ্র চেতনা স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মাঝ বরাবর থমকে রইল। এই মুহূর্তে ভীষণ ভালো লাগছে। মন চাইছে আধো জাগরণের এই আশ্চর্য বিভ্রম যেন কোনোদিন না কাটে। অলীক অনুভূতিতে ছেয়ে আছে আত্মা। মায়ের অস্তিত্বের অতীন্দ্রিয় স্পর্শ এখনো বুকে লেগে আছে। টের পাচ্ছেন দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুজল। জল মুছে নেবার কোনো তাগিদ নেই। এই নীরব অশ্রু বিসর্জনেও যেন অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে মা কোথাও যাননি। এই বাড়িতেই আছেন। এইতো স্পঞ্জের স্যান্ডেলের খসখস শব্দ শোনা যাচ্ছে। কোমরে গোঁজা চাবির রিং টুংটুং করছে। কার সাথে যেন কথা বলছেন উচ্চস্বরে। ধোপা এসেছে খুব সম্ভবত। মায়ের পছন্দের বিছানার চাদর মিসিং। এই ভুলের জন্য বেচারা ধোপাকে বিস্তর বকাঝকা সহ্য করতে হচ্ছে। একতলার বারান্দায় বাবা বসে আছেন হাতে হিসাবের খাতা নিয়ে। বাবার সামনে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুলেমান। রাশেদের ঘোর সর্বস্ব বেহেড মস্তিষ্ক একটাবারের জন্যও টের পাচ্ছে না যে এই মানুষগুলো সবাই মৃত। এদের পার্থিব উপস্থিতি প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ। কিন্তু মৃত মানুষেরা কি আসলেই চিরতরে হারিয়ে যায়? নাকি চোখের আড়ালের অদৃশ্য জগতে এরা সদা বিচরণ করে নিভৃতে? যেভাবে রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে, সেভাবে হয়ত প্রয়াত সব মানুষেরাও টিকে থাকে মানবচক্ষুর অগোচরে!

স্বপ্নের মধ্যে বাড়িটা আগের মতোই আছে। লাল রঙের মেঝে, সাদা চুনসুড়কির মোটা দেয়াল, উঁচু সিলিং-এ চৌকস ঘুলঘুলি। বিশাল বড় রসুই ঘরের পেছনে শান বাঁধানো কলপার। কলপারে বাবার পোষা কবুতর উড়ে বেড়াচ্ছে ফরফর করে। খুব সম্ভবত এখন রোজার মাস। একটু পরেই ইফতার। বাড়িভর্তি লোকজন গিজগিজ করছে। কাছারি ঘরে মৌলভি

সাহেব মধুর সুরে কোরআন তেলাওয়াত করছেন। রাশেদ কলপারে এসেছেন অজু করতে। কিন্তু অজুর প্রক্রিয়া শেষ হতে না হতেই আবারও প্রথম থেকে শুরু হচ্ছে। তিনি কিছুতেই কাজটা সমাপ্ত করতে পারছেন না। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বারংবার। হঠাৎ মায়ের কণ্ঠস্বর কানে এসে লাগল। আহ্লাদি গলায় বলছেন, ‘তোর বিয়ে দেব ঠিক করেছি। আমি বেশিদিন বাঁচব না। নাতি-নাতনির মুখ দেখে মরতে চাই।’ চোখের সামনে একটা মেয়ের ছবি মেলে ধরলেন। কাঁচা হলুদ গায়ের রং। সদ্য প্রস্ফুটিত কুসুমের ন্যায় মুখ। ঘন পল্লব ঘেরা দুটি চোখ দেখলে মনে হয় যেন পুতুল। রাশেদ একনজর ছবিটার দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলেন। নারী আসক্তি তার ছিল না! রাজনীতি, খেলাধূলা, এবং পড়াশোনা ছিল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু ছবির মেয়েটি যেন জাদু জানে! ছবিটা দেখামাত্র বুকের মধ্যে একটা অনির্বচনীয় শিহরন বয়ে গেল। এমন অদ্ভুত উপলব্ধি এর আগে কখনো হয়নি! মেয়েটি যেন কোন রক্তমাংসের মানবী নয়, বরং একঝাঁক ভালোলাগার সমাহার। ছবিটা দেখার পর থেকেই এত বেশি ভালো লাগছে যে, সেই ভালোলাগাটুকু শব্দ দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে প্রকাশ করার সামর্থ তার নেই। মায়ের কণ্ঠস্বর আবারও কানে এসে বাজল, ‘মেয়ে পছন্দ হয়েছে?’

রাশেদ লজ্জায় মাকে বলতে পারলেন না যে মেয়েটিকে তার খুবই পছন্দ হয়েছে। শুধু পছন্দ হয়েছে এটাই নয়, বরং ছবিটা দেখামাত্র মনে হয়েছে এতকাল ধরে বুঝি এর জন্যই অপেক্ষা করে ছিলেন মনে মনে। কে এই মেয়ে? নাম কী তার? কোথায় দেখেছে একে! যেন জনম জনমের চেনা! হৃদয়ের তন্ত্রীতে একটা সুন্দর সুর টুংটুং করে বেজে চলেছে। বাতাস জান্নাতি ফুলের সুগন্ধে ছাওয়া। স্নিগ্ধ একটা অমর্ত্য সুন্দর অনুভূতি পছন্দের কবিতার পঙ্ক্তির মতো শিরশির করে বয়ে চলেছে রক্তের ধারায়।

ফজরের আজানের সময় ঘুমটা ছুটে গেল। রাশেদ চোখ খুলে হৃদপিঞ্জরে আবদ্ধ বিশ বছরের তরুণ মনটাকে আবিষ্কার করলেন ঊনপঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ় দেহে। কিন্তু নিজেকে মোটেও অথর্ব বৃদ্ধ বলে মনে হচ্ছে না। বরং স্বপ্নে পাওয়া ভালোলাগার রেশটুকু মনের মধ্যে যৌবনচিত এক চাঞ্চল্যের বিকাশ ঘটিয়েছে। জীবনে প্রথমবারের মতো মস্তিষ্কে এক বিস্ময়কর বোধ উন্মোচিত হয়েছে। মনে হচ্ছে বয়স বা সময় বলে আদতে কিছু নেই পৃথিবীতে। সময় জিনিসটা একটা ধোঁয়াশা! আর বয়স একটি সংখ্যা। মায়ের উপস্থিতি এতটাই জীবন্ত ছিল যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে মা এসেছিলেন স্বপ্নে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো স্বপ্নে মায়ের দর্শন লাভের পর বুক থেকে যেন একটা পাষাণ ভার নেমে গেছে। যেন সমস্ত সাংসারিক জটিলতা তাকে মুক্তি দিয়ে গেছে চিরতরে। তিনি শোয়া থেকে উঠে পড়লেন। অজু করে ফজরের নামাজ আদায় করেই বেরিয়ে পড়লেন প্রাতঃ ভ্রমণে। ভোরের আকাশ আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে সবে। ছিমছাম রাস্তাঘাট ঝাঁট দিচ্ছে মিউনিসিপ্যালিটির লোক। কয়েকটা খালি রিকশা বসে আছে রাস্তার ধারে, যাত্রীর অপেক্ষায়। বাতাসে এখন আর্দ্রতা কম। অতটা গরম লাগছে না। রাশেদের পরনে একটা সাদা টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার। চুল পরিপাটি। গালের দাড়ি কামানো। ব্যক্তিত্বে ঠাঁসা গম্ভীর মুখে চাপা একটা সুখের দ্যুতি ঝিলিক দিচ্ছে। ছবির মেয়েটিকে তিনি চিনতে পেরেছেন। আজ থেকে বহু বছর আগে মা যখন সর্ব প্রথম বিয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন, তখন এই মেয়েটির জন্মও হয়নি! অথচ স্বপ্নে মনে হচ্ছিল যেন মেয়েটি তারই সমবয়সী। কী ভীষণ গোলমেলে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগতটা! কিন্তু অনুভূতি কি কখনো গোলমেলে হয়? মেয়েটিকে দেখার পর যে নিষ্কলুষ অনুভূতি হৃদয়কে আচ্ছন্ন করেছে সেই অনুভূতির মধ্যে কোনো জটিলতা নেই। কিন্তু এই অনুভূতির নাম কী? একেই কি প্রেম বলে? তিনি কি মেয়েটির প্রেমে পড়েছেন? মেয়েটি তার চেয়ে বয়সে তেইশ বছরের ছোট। এত বয়সের ব্যবধানে কি প্রেমে পড়ার নিয়ম আছে? নিয়ম নিশ্চয়ই নেই। কিন্তু নিয়ম ভঙ্গ করাই হয়ত প্রেমের চিরাচরিত স্বভাব। মানুষ জীবনে অনেক সময় সত্যকে গ্রহণ করতে ভয় পায়। ভুল স্বীকার করে নেবার বদলে নানা রকম অজুহাত বা যুক্তি দিয়ে সেই ভুলকে সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করে। মানবিক মূল্যবোধ এবং বাসনাকে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু তেলে আর জলে মিশ খায় না কখনো। শেষ অবধি দুটোকেই হারাতে হয়! পশ্চিমা জগতের আধুনিক সমাজ মূল্যবোধের কোনো মানদণ্ড তৈরি করে দেয়নি। সব মানুষ একই রকম ভাববে, একই ভাবে জীবনযাপন করবে এই ধারণা থেকে তারা ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছে। ওদের সমাজে বিবাহ প্রথা বিলুপ্ত হচ্ছে। ওরা সমাজকে নয়, পরিবারকে নয় বরং নিজেকেই প্রাধান্য দিতে শিখছে। পারিবারিক দায়িত্ব কর্তব্য থেকে নিষ্কৃতি চাইছে। কিছু মানুষ স্বাধীন সংসার বর্জিত জীবনেই সন্তুষ্ট থাকে, আবার কেউ কেউ দায়িত্বের বোঝা নিয়ে দিনাতিপাত করার মাঝেই বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পায়। রাশেদ দ্বিতীয় দলের মানুষ। তার অন্তরদেশ বিষয়-আশয়, হিসেব-নিকেশ এবং নিয়মনীতিতে ঠাঁসা। নিয়ম বহির্ভূত কাজ তিনি ঘৃণা করেন। অবৈধ সম্পর্ক বা লাম্পট্যকে তার রুচিশীল মন কখনই সমর্থন করেনি। অথচ আজ এক নিয়ম বহির্ভূত, বিশৃঙ্খল অনুভূতির কাছে নিজেকে সঁপে দেয়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই। সমাজ-সংসার কিংবা দেশকে নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য তার আছে কিন্তু মন নামের অবাধ্য সত্তাটিকে নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য নেই। আশ্চর্য এই যে এসব কট্টর সত্য সম্পর্কে ভাবতে আজ একটুও কষ্ট হচ্ছে না। বরং বুকের মধ্যে সুখের সুরটা এখনো বেজে যাচ্ছে অনবরত। এই সুখের কারণ সম্পর্কে তিনি অবগত। মানুষ আজীবন কত শত আর্টিকেল পড়ে। গল্প, উপন্যাস এবং জ্ঞানগর্ভ আলোচনা পড়ে কিন্তু অধিকাংশ লোকেই নিজেকে পড়তে পারে না। এটাই মানব জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। রাশেদ নিজেকে পড়তে পেরেছেন। আজ তিনি জানেন অমৃতার প্রতি এই আকর্ষণ মোহ বা সম্মোহন নয়, কামুক আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং এই আকর্ষণের নাম ভালোবাসা! ভালোবেসে কেউ কখনো ব্যভিচারী হতে পারে না। ভালোবাসা তো আলো ছড়ায় জীবনের অন্ধকার অলিতে গলিতে! অমৃতার কারণেই আজকের এই সাধারণ ভোরবেলা অলৌকিক সুন্দর হয়ে ধরা দিয়েছে চোখে। কিন্তু অমৃতা এখন কেমন আছে? কোথায় আছে? বহুদিন হয়ে গেল ওর খোঁজ নেয়া হয় না। বিষয়টা মাথায় টোকা দিতেই তিনি একটু বিচলিতবোধ করলেন। অস্বস্তি ভর করল চোখে। একটা হাহাকার ঝংকার দিয়ে উঠল মনের মাঝে। স্বপ্নে পাওয়া সুখটা নিষ্ক্রান্ত হতে খুব বেশি সময় লাগল না। ক্রমেই বাস্তব জীবনের খুঁটিনাটি বৃত্তান্ত এসে ভিড় করল মনে। কদিন আগে লোক মারফত খবর পেয়েছেন অমৃতা এখন মোটামুটি সুস্থ। এই খবর তাকে নিশ্চিন্ত করেছে। মেয়েটা সুস্থ হোক, ধীরেধীরে নিজের জীবন গুছিয়ে নিক। সামনে ওর অনেকটা পথ যেতে হবে। রাশেদ ওর চলার পথে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি করবেন না। জীবনে অনেক সময় মূল্যবোধ এবং চিত্তবৃত্তির মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হয়। রাশেদ মূল্যবোধকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন সব সময়। এটা তার ব্যক্তিগত পছন্দ।

বাড়ি ফিরলেন বুকভর্তি অস্থিরতা নিয়ে। চটপট শাওয়ার নিয়ে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নিলেন। রোজ একই রুটিন! তিনি চাকরি করেন না। স্বাধীন ব্যবসা। তার অধীনে হাজার হাজার বেতনভুক কর্মচারী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা দেশে। একটা দিন ছুটি নিয়ে রুটিনের হেরফের করলে এমন কোনো ক্ষতি সাধন হবে না। তবুও ছুটি নিতে তার ইচ্ছে করে না। এমনকি ছুটির দিনেও নানা রকম কাজ খুঁজে বের করার তাগিদ অনুভব করেন। আজকাল এই কাজ কাজ খেলাটা আর আগের মতো ভালো লাগছে না। খেলা! হঠাৎ খেলা শব্দটা মাথায় এল কেন? ভ্রুকুটিবক্র মুখে কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ ঝুলিয়ে ডাইনিং রুমে এসে বসলেন তিনি। খেলা নয়ত কী? বেঁচে থাকাটাই তো খেলার মতো একটা বুজরুকি ব্যাপার। গোল হোক বা না হোক জীবনের মাঠে খেলোয়াড়দের দৌড়ে যেতে হয় অবিরাম। হঠাৎ একটা ডাক ছুটে এলো।

‘মা!… মা!’

পুত্রর কণ্ঠস্বর শুনে পুলকিত বোধ করলেন তিনি। পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সামি এগিয়ে আসছে এদিকটায়। রাশেদ একটু নার্ভাস ফিল করছেন। হৃৎপিণ্ডের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক। এই স্নায়ুবিক দুর্বলতার কারণ কী? তিনি কি নিজের সন্তানকে ভয় পাচ্ছেন? নাকি অপরাধবোধের কারণে এমনটা হচ্ছে?

সামি ডাইনিং-এর চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে। কফির মগে চুমুক দিতে গিয়ে রাশেদ চোখ উঁচিয়ে একবার দেখলেন ছেলেকে। দেখামাত্র একটা প্রাণ জুড়ানো ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে গেল তাকে। টের পেলেন মাঝখানের দুটি সপ্তাহ পুত্র তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল। ছাব্বিশ বছরের রূপবান পুত্রের দিকে পিপাসার্ত চোখে চেয়ে রইলেন তিনি। মন থেকে দুশ্চিন্তার ময়লা দাগ মুছে গেল। বুক ভরে অনেক ক্ষণ বাদে একটা স্বস্তির শ্বাস টেনে নিলেন। হঠাৎ মনে পড়ল, স্বপ্নে মা বলেছিলেন সুখ নয়, স্বস্তিকে বেছে নিতে। জীবনের এক এবং অভিন্ন স্বস্তি এই মুহূর্তে তার চোখের সম্মুখেই দাঁড়িয়ে আছে। সুখ কিংবা কামনা বাসনার কাছে এই স্বস্তিটুকুকে কিছুতেই বিক্রি করা চলবে না!

সামি বাবার দিকে ভ্রুক্ষেপ করল না। সিঁড়ির গোঁড়ায় রোমেলা এসে দাঁড়িয়েছেন। সামি শক্ত গলায় বলল, ‘রেডি?’

রোমেলা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। ড্রাইভার রোমেলার স্যুটকেস বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল গাড়িতে। সামি তাড়া দিয়ে উঠে বলল, ‘চলো।’

রাশেদ হালকা স্বরে স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন, ‘কোথায় যাচ্ছ?’

রোমেলা উত্তর দেয়ার বদলে ছেলের মুখের ওপর দৃকপাত করলেন। যেন উত্তরটা তার কাছে গচ্ছিত নেই, আছে ছেলের মালিকানায়। সামি বুক চিতিয়ে এগিয়ে এল কয়েক পা। পরনে সাদা কালো চেকের একটা সাধারণ ফতুয়া। ফর্সা গালে কয়েকদিনের দাড়ি। তার ব্যক্তিত্ব আগের চাইতে প্রখর। কথা বার্তার ধরন পিতার মতোই ধারালো। রাশেদ যুবক পুত্রের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থেকে যেন নিজের যৌবনের ঝাঁজালো সেই রূপখানি দেখতে পাচ্ছেন। বিচক্ষণ, তেজী এবং সাহসী!

‘মাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি।’ বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিল সামি।

‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’

‘আমার কাছে।’

রাশেদ গম্ভীর চোখে মা, ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন স্বল্প ক্ষণ। ঠোঁট টিপে ভাবলেন কিছু একটা। শীতল গলায় বললেন, ‘এই বাড়িটা তোমার মায়ের নামে লিখে দিচ্ছি খুব শীঘ্রই। তার কোথাও যাবার প্রশ্ন-ই আসে না। প্রয়োজনে আমিই চলে যাব।’

‘তোমার প্রপার্টি আমরা চাই না। মা এখানে আর কখনও আসবে না। এই লাইফ সে ডিজার্ভ করে না। শী ডিজার্ভস টু বি লাভড।’

রাশেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

‘তুমি শিওর তোমার মা এই প্রপার্টি চান না?’

রোমেলাকে বিচলিত দেখালো। দ্বিধা খেলছে চোখে। স্বামীর এই পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত ছিলেন না। মনে হয়েছিল এতকালের সংসার পুরো দমেই হাতছাড়া হয়ে গেছে। কিন্তু লোকটা এখন বলছে গোটা বাড়িটাই তার নামে লিখে দেবে। এখানে রোমেলা দীর্ঘদিন সংসার করেছেন। সন্তান লালন-পালন করেছেন। বড় করেছেন। এই বাড়ি তার নিজের। সামি একেবারেই বৈষয়িক নয়। মাথাভর্তি আগুন নিয়ে চলাফেরা করে। সবকিছু আবেগ ইমোশন দিয়ে বিচার করে, যুক্তি দিয়ে কিছু ভাবতে পারে না।

‘আমাদের বিষয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। তুমি বরং বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটাও। পলিটিক্স কর, সভা সমিতি করো, নাইট ক্লাবে যাও। মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি কর।’

রাশেদ মর্মাহত চোখে একমাত্র পুত্রের দিকে চেয়ে আছেন। বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। মাথাটা ফাঁকা লাগছে। সামি বাবার মর্মাহত চোখের মর্মভেদী দৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল, ‘আরেকটা কাজ করতে পার। তুমি বরং তোমার গার্লফ্রেন্ডকে একটা অফার দিয়ে দ্যাখো। সে এখানে এসে থাকলেও থাকতে পারে। এই বাড়িটা তার নামেই লিখে পড়ে দাও।

রোমেলা চমকে উঠলেন, ‘কী বলছ তুমি?’

সামি মায়ের হাত চেপে ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, ‘চলো এখান থেকে!’

রাশেদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। বলার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না। রোমেলার সাথে গত পরশুদিন এই ব্যাপারে কথা হয়েছিল। ছেলেকে কী বলতে হবে সে বিষয়ে পইপই করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তবুও রোমেলা ছেলের বিচারবুদ্ধিহীন হঠকারী সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছে কেন? সে কি তাহলে চায় না সংসারটা টিকে থাকুক? রাশেদ উচ্চস্বরে হুঙ্কার ছাড়লেন আচমকা, ‘থামো!’

মা, ছেলে থামল। রাশেদ মেঘাচ্ছন্ন থমথমে মুখে এগিয়ে এলেন কয়েক পা। পুত্রের চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘আমার স্ত্রীর সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। প্রাইভেসি চাই।’

সামি মায়ের দিকে অসন্তোষের দৃষ্টিতে তাকালো। রোমেলা একটু ভীতু ভীতু গলায় বললেন, ‘তুমি যাও। আমি আসছি।’

‘এসবের মানে কী?’ প্রশ্ন করলেন রাশেদ।

‘ছেলেকে তো দেখলেই কতটা অ্যাগ্রেসিভ হয়ে উঠেছে। সে কিছুতেই আমাকে এখানে থাকতে দেবে না।’

‘তুমি কি বলোনি ওকে আমাদের মধ্যে সবকিছু ঠিক আছে?’

রোমেলা পলক তুলে চাইলেন, ‘এতবড় মিথ্যে কথা বলতে তোমার বুক কাঁপছে না?’

রাশেদ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘না বুক কাঁপছে না। কারণ, আমি শতভাগ নিশ্চিত যে কথাটা এক বিন্দুও মিথ্যে নয়। এই বাড়িটা, এই সংসারটা তোমার আর আমার ছিল… থাকবে আজীবন।’

রোমেলা কাটা কাটা গলায় বললেন, ‘এর মানে তুমি সংসার করবে আমার সাথে, আর মনে মনে অন্য একজনের ধ্যান করবে, অন্য একজনকে ভালোবাসবে। চমৎকার!’

রাশেদ কয়েক সেকেন্ড ব্যথিত চোখে চেয়ে থেকে দুর্বল গলায় বললেন, ‘এই একই কাজ কি তুমিও করনি রোমেলা সারা জীবনভর? অস্বীকার করতে পারবে?’

রোমেলা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন। বিস্ফারিত চোখে তাকালেন রাশেদের দিকে। অপমানের কালো ছায়া তার ফর্সা মুখের সমস্তটাকেই গ্রাস করে নিয়েছে। তিনি ফাটা বাঁশির মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, ‘এত বড় অপবাদ দিচ্ছ তুমি আমাকে?’

রাশেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তুমি প্লিজ এই সংসার ছেড়ে যেও না। আমার ছেলেটাকে আমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। প্লিজ!’

১৪

আয়নার ভেতরের মেয়েটার দিকে এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকে অমৃতা। এতবড় কপাল ছিল না আগে। সামনের দিকের কিছু চুল ছেটে ফেলায় কপালটা অনেক বড় দেখাচ্ছে। চুলবিহীন অংশে একটা কাটা দাগ। সেই দাগ ডালপালা গজিয়ে নেমে এসেছে কপালে। চোখের নিচে গভীর কালো দাগ। শীর্ণ চোয়াল। কণ্ঠার হাড়ের ওপর চামড়াটা যেন কোনো রকমে লেপ্টে আছে। কী বীভৎসই না লাগছে দেখতে! এই কিম্ভুত চেহারার জন্য ভিসা নাকচ হয়ে যাবে নাতো আবার? কে জানে! অমৃতা ঠিক করল আয়নার সামনেই আর দাঁড়াবে না। নিজেকে দেখলেই আত্মবিশ্বাস লোপ পাচ্ছে।

একটা ফুলস্লিভ সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরল সে। কাগজ-পত্র গুছিয়ে নিল ফাইলে। বেশ কটা দিন শুধু হাসপাতাল আসা যাওয়া করেই কেটে গেল। আজকে বাসা থেকে বেরিয়ে ডাক্তারখানায় যেতে হবে না এটা ভেবেই অন্যরকম শান্তি লাগছে। শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে দেখা গেল হৃদি আর রুদ্র বডিগার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য আগেভাগেই হাজির হয়ে গেছে। অমৃতার বাবা দুই বন্ধুর ঘাড়ে এই বিশেষ দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। মেয়েকে তিনি আপাতত একা ছাড়তে চান না। চেম্বারে একগাদা কাজ পড়ে থাকলেও অমৃতা সেখানে যাবার অনুমতি পায়নি বাবার কাছ থেকে। বাড়িতে বসে শুধু ড্রাফটিং-এর কাজ করেছে। ড্রয়িং রুমে দুই মূর্তিকে দেখামাত্র অমৃতার ভ্রুজোড়া তুঙ্গে উঠে গেল, ‘কী সমস্যা? তোরা কী করিস এইখানে? কাজ কাম নাই কিছু?’

হৃদি পানসে মুখে বলল, ‘কাজেই তো আইলাম।’

‘কী কাজ?’

উত্তর দিল রুদ্র, ‘তোকে নিয়ে যাব ব্রিটিশ হাই কমিশনে। এটাই কাজ।’

‘আমাকে নিয়ে যাবি মানে? আমি কি যাইতে পারি না? আমার কি পা নাই?’

রুদ্র নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘হাত পা ঠিকই আছে। কিন্তু চেহারা সুরত দেইখা মনে হয় রাস্তার পাগলী। মানুষ আবার কোন সময় ইটা মারা শুরু করে, সেই ভয়েই মনে হয় আংকেল বলছে তোরে গার্ড দিয়া রাখতে।’

‘ফাইজলামির একটা সীমা থাকে। আমি একাই যাব!’ হুঙ্কার ছাড়ল অমৃতা।

হৃদি খুব গম্ভীর গলায় বলল, ‘একা যাওয়াটা ঠিক হবে না।’

‘ঠিক হবে না কেন? আমি কি এত বছর একা যাওয়া আসা করি নাই? হঠাৎ করে তোরা আমার সাথে এমন করতেছিস কেন?’

রুদ্র বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অমৃতার কাঁধে একটা হাত রাখল, ‘চেতিস না। আমাদের কিছু বলার নাই এখানে। আমরা জাস্ট আংকেলের আদেশ পালন করতেছি।’

‘লাখি খাবি হারামজাদা। অ্যাসহোলের বাচ্চা! সর এখান থেকে।’ রুদ্রর হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিল অমৃতা। হৃদি আগের মতোই গম্ভীর গলায় বলল, ‘আগামী কয়েকদিন একা চলাফেরা করা তোর জন্য মঙ্গলজনক হবে না।’ অমৃতা ভেঙচি কাটল, ‘আসছে আমার পীর সাহেবা। আর কী কী হবে এবং কী কী হবে না সেটাও বলে দেন পীর ম্যাডাম! ভিসাটা হবে তো?’

হৃদি চোখ বন্ধ করে ধ্যানমগ্ন স্বরে বলল, ‘ভিসা হয়ে যাবে।’

‘বাহ্! এই সুখবরের জন্য আপনাকে আমি কী দিতে পারি ম্যাডাম? গরু জবাই দিব? নাকি খাসি?’

রুদ্র রাশভারী কণ্ঠে গুরুত্বপূর্ণ মতামত পেশ করল, ‘সিংহ জবাই দিতে হবে! পীর সাহেবার গরু ছাগলে হয় না। সিংহ লাগে!’

হৃদি ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেই গমগমে গলায় মন্ত্রপাঠ করার সুরে বলল, ‘দুইটি উট এবং তিনটি হরিণ। আগামী কাল বিকেলের মধ্যে যোগাড় করতে হবে। হালুলুকা খাবে!’

অমৃতা নাক-মুখ কুঁচকে সবিস্ময়ে বলে উঠল, ‘হোয়াট দ্যা ফাক হ্যাপেন্ড টু দিস গাধী? কী আবোলতাবোল বলতেছে?’

রুদ্র এগিয়ে এসে হৃদির মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল, ‘ওঠ! অনেক ধ্যান হইছে। আর লাগব না।’

হৃদি গাট্টা খেয়ে রেগে গেল। আগুন চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে, ‘ডিস্টার্ব করতেছিস ক্যান?’

রুদ্র ওর হাত টেনে ধরল, ‘চল! দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

হৃদি অধৈর্য হয়ে বলল, ‘ইশ তোরা এত জ্বালাস কেন? হালুলুকার সাথে মিটিং করতেছিলাম।’

‘হালুলুকাটা কে?’ অমৃতার প্রশ্ন।

‘আমার জ্বীন বন্ধু।’ হৃদির সোজাসাপ্টা উত্তর।

অমৃতা আর রুদ্র একে অপরের দিকে তাকাল। অমৃতার চোখভর্তি বিস্ময় আর রুদ্রর ঠোঁটভর্তি দামাল হাসি। হাসতে হাসতে সকৌতুকে সে বলল, ‘হায় আল্লাহ! এই বেটির মাথার তার সবগুলা ছিঁড়ে গেছে। মেন্টাল হাসপাতালে পাঠাতে হবে।’

অমৃতা তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করল হৃদিকে। রেশমি চুলের গোছা পিঠময় ছড়িয়ে আছে। আড়ং থেকে কেনা সাদার ওপর নীল সুতোর কারুকার্যঅলা চমৎকার একটা সালওয়ার কামিজ পরনে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। সাজপোশাকে অমনোযোগের ছাপ নেই। কিন্তু চোখের দৃষ্টিটা কেমন যেন অসংলগ্ন। সত্যিই কি ওর মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দিয়েছে? জ্বীন বন্ধু আবার কোত্থেকে এলো? আগে তো এমন অদ্ভুত বিকারগ্রস্ত কথাবার্তা কখনো বলেনি। অমৃতা চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করল, ‘তোর শরীর ঠিক আছে হৃদি? তুই বরং বাসায় গিয়ে রেস্ট নে। আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না।’

হৃদি কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘মরে গেলেও বাসায় যাব না। আমার বাপ মা আমারে শ্বশুর বাড়ি পাঠানোর জন্য উঠে পড়ে লাগছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমারে দুই বেলা ভাত খাওয়ানোর ও পয়সা নাই তাদের। শুধু বাপ মা না, খালা, খালু, চাচা, চাচি চৌদ্দগুষ্টির এখন একটা মাত্র চিন্তায় ঘুম আসে না। চিন্তাটা হইল হৃদিতা কবে শ্বশুর বাড়ি যাবে?’

‘আমিও তো সেই চিন্তাই করছি। তুই শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিস না কেন?’ অমৃতার প্রশ্ন।

হৃদি ঠোঁট বাঁকিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে, মুখখানা কিম্ভুত বানিয়ে, তাচ্ছিল্যে ঠাঁসা কণ্ঠে বলল, ‘ধুর… বাদ দে। বালের একটা শ্বশুরবাড়ি! জীবনেও যামু না আর!’

অমৃতা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিল হৃদির আচার-আচরণ এবং এলোমেলো বক্তব্যে। শীর্ণ-জীর্ণ রোগা মুখখানা দুশ্চিন্তার প্রকোপে আরো বেশি চুপসে যাচ্ছিল যেন। রুদ্র বিষয়টা বুঝতে পেরে আলোচনার সমাপ্তি টানতে চাইল। তাড়া দিয়ে বলে উঠল, ‘চল আমরা বের হই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। উবার ডাকছি। ড্রাইভার ওয়েইট করতেছে।

ভিসা ইন্টারভিউ বেলা বারোটায়। এখন বাজে সকাল সাড়ে নয়টা। ঢাকার রাস্তার যানজট সর্বদাই অনিশ্চিত। তাই হাতে ঘণ্টা খানেক সময় নিয়েই বেরিয়েছে ওরা। রুদ্র ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে। অমৃতা আর হৃদি বসেছে পেছনে। গাড়িতে উঠে বসতে না বসতেই হৃদি ভারিক্কি কণ্ঠে বলল, ‘হালুলুকার ব্যাপারটা তোরা বিশ্বাস করলি না?’

অমৃতা চোখ কটমট করল, ‘ফালতু প্যাঁচাল বন্ধ কর হৃদি। একটা ইম্পরট্যান্ট কাজে যাচ্ছি।’

‘তোর মনে হচ্ছে আমি ফালতু কথা বলছি? হালুলুকাকে তোর আনইম্পরট্যান্ট মনে হচ্ছে?’

রুদ্র সামনের সিট থেকে ফুর্তিবাজ গলায় বলল, ‘হালুলুকাকে আনইম্পরট্যান্ট মনে হবে? মাথা খারাপ? প্রশ্নই আসে না!’

‘রুদ্র ফাইজলামি বন্ধ কর। এটা কোনো ফাইজলামি করার বিষয় না।’ ধমকে উঠল হৃদি।

ধমক খেয়ে রুদ্রর দুষ্টুমির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। গাল ভর্তি ফিচেল হাসি নিয়ে সুরে সুরে বলতে লাগল,–‘হা—লু—লু—লু—লু—লু—লু—লু—কা আআআআআ! জটিল তো নামটা! কোন দেশি নাম? শালা দেখতে কেমন? আলিফ ল্যালার ভূতের মতো?’

হৃদি অপমানে জ্বলে উঠল, ‘মোটেও আলিফ ল্যালার ভূতের মতো না। দেখতে সে খুবই সুন্দর। বিশ্রী কথা বলবি না রুদ্রর বাচ্চা! পাছায় লাথি মেরে রাস্তায় ফেলে দিব!’

গাড়ির ড্রাইভার অল্পবয়সী। যাত্রীদের কথোপকথন তাকে বেশ বিনোদন দিচ্ছে। মুচকি মুচকি হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে আছে মুখ।

অমৃতা হৃদির দিকে চেয়ে ভ্রু নাচাল, ‘কাহিনি কী? কে এই হালুয়া কাকা?’

হৃদি ভুল শুধরে দিল। খুবই যত্নের সাথে বলল, ‘হালুয়া কাকা না, হালুলুকা।’

‘আচ্ছা হবে কিছু একটা চুকা বুকা ফুকা… এখন বল কোত্থেকে আমদানি করলি ব্যাটারে?’

এই প্রশ্নটা হৃদির খুব পছন্দ হলো। নড়েচড়ে আয়েশ করে বসল সে। তারপর কণ্ঠস্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ শলা-পরামর্শ করার ঢঙে বলল, ‘দুদিন আগের ঘটনা। সন্ধ্যার পর হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল। আমি জায়নামাজে দাঁড়িয়ে আছি। জেনারেটর চালু হয়নি তখনও। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। হঠাৎ মনে হলো কে যেন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি টের পেয়েও নামাজ ভাঙলাম না। দুরুদুরু বুক নিয়ে নামাজ শেষ করলাম। সালাম ফিরিয়ে দেখি পড়ার টেবিলের চেয়ারে খুবই সুন্দর একজন সুদর্শন যুবক বসে আছে। তার পরনে একটা ইয়া লম্বা সাদা আলখাল্লা। গালে চাপদাড়ি, চোখে সুরমা…’

রুদ্র যোগ করল, ‘ঠোঁটে লিপ্সটিক, কপালে টিপ…’

খ্যাঁক দিয়ে উঠল হৃদি, ‘হালুলুকা টিপ পরবে কেন? সে তো ছেলে জ্বীন!’

অমৃতার পেট ফেটে যাচ্ছিল হাসিতে। কিন্তু পাছে হৃদি রেগে যায়, সেই ভয়ে হাসতে পারছে না। ঠোঁট টিপে মুখে জোরপূর্বক একটা গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে রেখেছে। কোনো রকমে বলল, ‘আচ্ছা গল্পটা শেষ কর।’

হৃদি নিবিড় মনোযোগের সাথে গল্প বলা শুরু করল, ‘অচেনা যুবক দেখে আমি তো অবাক। প্রশ্ন করলাম, তুমি কে? ছেলেটা বলল, আমি একজন জ্বীন। আমার নাম হালুলুকা। তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। তুমি কি আমার বন্ধু হবে? আমি তো ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে শেষ। বললাম, জ্বীনদের সাথে আমি তো কখনো বন্ধুত্ব করিনি আগে। আমি জানতাম জ্বীন- রা অনেক ভয়ঙ্কর হয়। কিন্তু তোমাকে দেখে তো আমার একটুও ভয় লাগছে না! হালু তখন হেসে বলল, আমি কখনই তোমাকে ভয় দেখাব না। বরং বন্ধু হয়ে পাশে থাকব।’

রুদ্র বলল, ‘খুব ভালো। আমি চলে যাচ্ছি ইউ এস, অমৃতাও যাইব গা লন্ডন। বিভা ইন্ডিয়া। আকাশ ভার্সিটির প্রফেসর হয়ে যাবে, শালার ভাব সাব বেড়ে গেলে তোরে আর বেল দিবে না। তুই একদম একা হয়ে যাবি। হালুলুকা তোর একাকিত্ব ঘুচিয়ে দেবে। আমাদেরকে আর মিস করবি না তুই। হালুলুকা মহৎ এক জ্বীন। তার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।’

‘ঠিকই বলছিস, হালুও এই কথাই বলছিল।’

‘কী বলছিল?’ অমৃতার প্রশ্ন। এর মাঝে রুদ্র আবার সুরে সুরে যুক্ত করল একটা লাইন, ‘হালু… রিকশাওয়ালা তোর খালু!’ হৃদি ওর দিকে একবার কড়া চোখে তাকিয়ে অমৃতার প্রশ্নের উত্তর দিল,

‘বলছিল যে, তোমার ফ্রেন্ডরা তো সবাই চলে যাচ্ছে, হাজবেন্ডের সাথেও ছাড়াছাড়ি। সো এখন থেকে আমিই তোমার বন্ধু।’

অমৃতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘হৃদি, আমার মনে হয় তুই সামিকে অনেক মিস করতেছিস। আবার আমি আর রুদ্র চলে যাব এটাও মেনে নিতে পারছিস না। এ কারণে তোর হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।’

হৃদি হঠাৎ খুব রেগে গেল, ‘আজাইরা কথা বলিস ক্যান? হ্যালুসিনেশন কীসের? তোরা জ্বীন বিশ্বাস করিস না? কোরআন শরীফে জ্বীনের কথা বলা হইছে।’

হৃদিকে হঠাৎ আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠতে দেখে অমৃতা একটু থতোমতো খেয়ে গেল। মিনমিন করে বলল, ‘বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা আসছে না। তবে আমার মনে হচ্ছে তুই সামিকে মিস করছিস…!’

‘ঐ ফালতু ছেলেকে আমি মিস করব কেন? প্রশ্নই আসে না!’

অমৃতা চুপ করে গেল। হৃদির সাথে অহেতুক গলাবাজি করতে ইচ্ছে করছে না। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে হঠাৎ করেই। নিজের ওপর ঘেন্না হচ্ছে। তার একটি গর্হিত কাজের কারণে আজ কতগুলো মানুষের জীবনে সর্বনাশ নেমে এলো। সামির বাবা মায়ের সংসারে তো ফাটল ধরলই, এমনকি সামির নিজের সংসারটাও আর রক্ষা হলো না। নিজেকে

অমৃতা ক্ষমা করবে না কখনো! হয়ত প্রকৃতিও তাকে ক্ষমা করবে না। এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে, এতজনের মন ভেঙে কি ক্ষমার আশা করা যায়? এসব ভীতিজনক ভাবনা ভাবতে গেলে শ্বাসকষ্ট হয়। মনে হয় বেঁচে ফিরে আসার চাইতে মরে গেলেই ভালো হতো। কিন্তু মরে গেলে হয়ত সামিকে খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হতো। সেদিক দিয়ে ভাবতে গেলে অমৃতা বেঁচে গিয়ে অনেকগুলো মানুষকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আশা করা যায় সময়ের প্রভাবে সমস্ত ক্ষত একটু একটু করে সেরে উঠবে। এখন আল্লাহ আল্লাহ করে ভিসাটা হয়ে গেলেই হয়। অমৃতা দেশান্তরী হলেই সবার জীবনে মঙ্গল নেমে আসবে। গাড়িটা বিজয় সরণীর জ্যামে আটকে আছে। গন্তব্যে পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগে কে জানে! ঢাকার রাস্তার এই অনিয়ন্ত্রিত যানজট নগরবাসীদের জীবনটা নরক বানিয়ে ছেড়েছে। মানুষের সময়ের শ্রাদ্ধ হচ্ছে, সেই সাথে বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপ, বক্ষব্যাধিসহ নানারকম স্বাস্থ্য সমস্যা। দেশ ছেড়ে যাবার ইচ্ছে ছিল না অমৃতার। বিদ্যার্জনের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেলেও পড়া শেষে দেশে ফিরে আসবে এমনটাই বরাবর ভেবে এসেছে। দেশের মানুষগুলোর জন্য কিছু করার বাসনা ছিল মনে। আর কিছু না পারুক অন্তত একটা মানবাধিকার সংস্থার উদ্যোক্তা হতে চেয়ছিল সে। যে সংস্থা গরীবদের লিগ্যাল এইড দেবে, হিজড়া এবং ট্র্যান্সজেন্ডারদের নিয়ে কাজ করবে। পার্লামেন্ট পাস হওয়া অনেক আইনের খবর সাধারণ মানুষ রাখে না। জানে না বলেই নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয় তারা। সেইসব আইনকানুন মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়াটাও বড় দায়িত্ব। দেশের সর্বস্তরের আদালতে গরীব, দুঃখী, অশিক্ষিত লোকজন দিনের-পর-দিন ভুলভুলাইয়া পথে ঘুরতে থাকে, সঠিক গাইডেন্সের অভাবে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়, ধরনা দিতে হয় ঘুষখোরদের দ্বারে দ্বারে। এমনকি সরকারি হাসপাতালগুলোতেও সাধারণ জনগণ নিগৃহীত

জনগণ নিগৃহীত অবহেলিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কেবিনগুলো নোংরা, টয়লেট নোংরা, এমন অপরিচ্ছন্ন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগী সুস্থ হবে কী করে? দেশের জন্য এসব নানামুখী দুশ্চিন্তা বুকের মধ্যে উথলে উঠলেই একটা মানুষকে বড় বেশি মনে পড়ে। সেই একজন মানুষের কাছে দেশের প্রসাশনের বিরুদ্ধে অভিযোগের বন্যা বইয়ে দেয়ার মধ্যে যেন মুক্তির আনন্দ পেত অমৃতা। ক্ষোভ আর আক্ষেপগুলো নিষ্কৃতি পাবার পথ পেয়ে যেত। তার মতো আর কে আছে? যার সামনে মন খুলে নিজের দেশপ্রেমিক সত্ত্বাকে উজাড় করে দেয়া যায়? অমৃতার বুকে ক্রমশই দুঃসহ কষ্ট ঘনিয়ে আসছিল। ঝাঁজ ওঠা সেই কষ্টের গ্যাঁজাল ফ্যানার মধ্যে চোখের সামনে একটা অবয়ব ভেসে উঠল। মনের চোখে দেখল অমৃতা… সেই বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, ধারালো চোয়াল… মানুষটা কোথায় আছে? কেমন আছে? অমৃতাকে কি কখনো ভুল করেও মনে পড়ে? দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা আকণ্ঠ ব্যস্ততায় ডুবে থাকা মানুষটা কি হঠাৎ হঠাৎ টের পায় যে একটা হৃদয় তার জন্য সর্বদা ব্যাকুল হয়ে থাকে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *